আমরা, বাংলাদেশের পুরুষশাসিত সমাজের অধিবাসীরা মায়ের আবেগ সংরক্ষণে,
মেয়ের অধিকার লালনে নিজেকে উজার করে দিতে পারি। বোনের বেলায় শৈশব, কৈশোর ও
যৌবনে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক লালনে ও পালনে আবেগে মথিত হই, স্ত্রীর অধিকারে
একটু রেখে ঢেকে নিজেকে উন্মুখ করি কিছুটা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে আর
বেশির ভাগটা ধর্মীয় প্রথার সমর্থনে। আর মা, বোন, মেয়ে ও স্ত্রীর ছাড়া বাকী
সব নারী সমাজ সভ্যতার আদি অবস্থানে থাকলেও উঃ আঃ করে নিজেকে আধুনিক হিসেবে
প্রতিভাত ছাড়া কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ হাতেগোণা কয়েকজন বাঙালী
পুরুষই নিয়েছেন। এ কয়েকজনের মধ্যে কি আরজ আলী মাতব্বর সাহেব পড়েন ? এরই
অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁর লেখায় ইতিবাচিক সাড়াই পেয়ে আসছিলাম। কিন্তু!
হ্যাঁ, আজ ‘কিন্তু’ দিয়ে শুরু করতে হচ্ছে।
একজন পুরুষ বিজ্ঞান মনস্ক,নাস্তিক, অলৌকিক শক্তিতে সন্দিহান,নারী
অধিকারে বিশ্বাসী আর নারী মুক্তির জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ
সমার্থক নয়।
আরজ আলী মাতুব্বর নারী মুক্তির জন্য কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি
বলেই বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়। স্মরণিকা’ গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায় ‘আরজ
মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরী’ অংশে তিনি লামচারি গ্রামের শিক্ষিত লোকের একটি
পরিসংখ্যান দিয়েছেন যেখানে সাক্ষর বা স্বাক্ষর কিংবা শিক্ষিত নারীর কোন
তথ্য নেই। ছেলে আর পুরুষদের তথ্য দিয়েই উপসংহার টেনেছেন যে “যদিও এ গ্রামের
জনসংখ্যার অনুপাতে আলোচ্য সংখ্যাগুলো অতি নগণ্য, তথাপি আশাব্যঞ্জক এ জন্য
যে, এ গ্রামের অন্তত স্থবিরতা দূর হচ্ছে।’’ এ গ্রামের নিরক্ষর — অশিক্ষিত
নারী সমাজ যে জড় পদার্থের মত স্থবির হয়ে আছে তা কি তাঁর চিন্তা চেতনায় ঘা
দেয়নি? এ নিয়ে তাঁর কোন আফসোস পর্যন্ত নেই! কোন প্রতিক্রিয়া নেই! বিষয়টি
বিশ্লেষণের দাবি রাখে বৈ কি।
১৯৮১ সালের ২৬ জানুয়ারি লামচারি গ্রামে লাইব্রেরী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে
বরিশালের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মহোদয় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রশাসনের লোক, সাংবাদিক, অধ্যক্ষ, অধ্যাপক মিলিয়ে আরও
সাতজনের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন যেখানে কোন নারীর নাম ছিল না। কোন নারীকে
যে রাখতে পারেননি, বা পাননি বা নিমন্ত্রণ পেয়ে আসেনি এমন কোন তথ্য এখানে
নেই। এর অর্থ তো কি এই দাঁড়ায় যে এমন একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানে নারীর
অনুপস্থিতি নিয়ে তাঁর মনে কোন রেখাপাত করেনি !
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের তিনি নিজ ভাষণে বলেছেন “ আজ আমার জীবন ধন্য হলো, তা
দুটি কারণে। প্রথমটি হলো, জেলা প্রশাসক সাহেবের হাতে আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত
ক্ষুদ্র লাইব্রেরীটির দ্বারোদঘটন দেখতে পেরে; দ্বিতীয়টি হলো আমার চিরপ্রিয়
পাঠশালার প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সুকোমল হস্তে সর্বপ্রথমবার
বৃত্তিপ্রদান করতে পেরে।’’ এখানে একটূ খটকা আছে। যদিও বৃত্তিপ্রদান নিয়ে
ছাত্রদের সাথে ছাত্রীদের কথাও উল্লেখ করেছেন, কিন্তু আগে পিছের তথ্য
পর্যালোচনায় এমন ধারণা করা কি অমূলক হবে যে ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদানে তাঁর
কোন উদ্যোগ বা পদক্ষেপ ছিল না? অহেতুক বা অসচেতনভাবে ছাত্রী শব্দটি যোগ
হয়েছে! অথবা এটা কি জেলা প্রশাসনের নিজস্ব কোন পরিকল্পনার ফলাফল?যদিও এমন
কোন তথ্য নেই।
আরজ আলী মাতুব্বর ঐ অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছেন, “করা হচ্ছে ২টি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে বার্ষিক বৃত্তিদানের ব্যবস্থা” — এ বৃত্তিতে ছাত্রীদের কোন কোটা
বা এ বিষয়ক কোন কথাই বলেননি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সচেতন ছিলেন যে দেশের অন্য
সব ছাত্রদের সাথে ছাত্রীরাও আছে। যেমনঃ “দারিদ্র নিবন্ধন কোনো স্কুল-কলেছে
গিয়ে পয়সা দিয়ে বিদ্যা কিনতে পারিনি আমি দেশের অন্যসব ছাত্র-ছাত্রীদের
মতো।” অর্থাৎ অন্য এলাকার বিষয়টি এসেছে বাইরের স্বতঃস্ফূর্ত প্রভাবে। কারণ
তাঁর কচিমন শিশু ছাত্রদের সাহচর্য প্রার্থী — ছাত্রী নয়। নিজেই তাঁর ভাষণে
বলেছেন, “মনের সরলতায় আমি যে আজো একজন শিশু তা কেউ বুঝবে না,বোঝবার কথাও
নয়। তাই আমি স্থির করেছি যে, ছাত্ররা আমাকে ভালোবাসুক আর না-ই বাসুক, আমি
তাদের ভালোবাসবো। শৈশবকাল থেকেই আমার মনেবাসা বেঁধেছে পাঠশালাপ্রীতি ও
ছাত্রপ্রীতি। ………… আর আমার সেই পাঠশালা ও ছাত্রপ্রীতির নিদর্শন হলো
’ছাত্রদের বৃত্তিদান” অর্থাৎ আরজ ফান্ড থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
ছাত্র-ছাত্রীদের অনন্তকাল স্থায়ী প্রতিযোগিতামূলক বার্ষিক বৃত্তি প্রদান।”
কিন্তু স্থায়ী ‘প্রতিযোগিতামূলক বার্ষিক বৃত্তি’ প্রদানে পিছিয়ে পড়া ছাত্রী
সমাজের জন্য ন্যয্যতা (equity)ভিত্তিক বৃত্তি বিভাজন নিয়ে তার তেমন কোন
উচ্চ বাচ্য নেই। অর্থাৎ মেয়ে শিশুর প্রতি কোন ইতিবাচক পক্ষপাতিত্ব নেই।
আরজ আলী মাতুব্বরের ভাষ্য অনুযায়ী লাইব্রেরী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে,“
অনুষ্ঠানের শেষপর্বে মাননীয় জেলা প্রশাসক সাহেব আমার পরিকল্পনা মোতাবেক
উত্তর লামচরি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ লামচরি সরকারী প্রাথমিক
বিদ্যালইয়ের ১৯৭৯ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী
ছাত্র-ছাত্রীদের “আরজ ফান্ড’ থেকে মং ২০০.০০ টাকা বৃত্তিপ্রদান করেন। এ
সময়ে উক্ত বিদ্যালয়ের ১৯৮০ সালের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেও তার ফলাফল
প্রকাশিত না হওয়ায় উক্ত বৃত্তিদান স্থগিত থাকে।” আমাদের কাছেও ছাত্রী
বিষয়ে, ব্যাখ্যা করে বললে নারী শিক্ষা বিষয়ে তাঁর মতামত ও তখনকার লমচরি
গ্রামে নারী শিক্ষার অবস্থা ও নারীদের অবস্থান জানাও স্থগিত হয়ে যায়।
পরবর্তীতে ১৯৮০ সালের বৃত্তিপ্রদান অনুষ্ঠানে কে কে উপস্থিত ছিলেন,
দুটির পরিবর্তে একটি বিদ্যালয় বাড়িয়ে তিনটি বিদ্যালয়ের নামসহ এ বৃত্তির কথা
উল্লেখ করলেও কে কে বৃত্তি পেল বা এতে ছাত্রী কয়জন ছিল তা অজানাই থেকে
যায়। শুধু উল্লেখ আছে,“মাননীয় সভাপতি সাহেব স্বহস্থে ছাত্র-ছাত্রীদের
বৃত্তিপ্রদান করেন।” বিষয়টি ব্যাকরণের বিভিন্ন কারক ও বিভক্তির উদাহরণ হয়েই
থাকলো।
আরজ আলী মাতুব্বরের সমাজ চিন্তা, বিভিন্ন দিকে তাঁর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের
গভীরতা নিয়ে তিনি একজন শ্রদ্ধার্ঘ ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাঁর মননে নারী
উন্নয়ন তেমন নাড়া দেয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। তাঁর পাঠাভ্যাসে নারী বিষয়টি
স্থান পায়নি বলেই হয়তো এ ফাঁক। আর পাঠাভ্যাসে নারী বিষয়টির শুন্যতার কারণ
তাঁর পরিচিত বলয়, যেমন যাদের নামে বই আনতেন লাইব্রেরী থেকে তারা। তিনি সে
বলয়কে অতিক্রম করতে পারেননি বা করার তাগিদও অনুভব করেননি।অর্থাৎ তাগিদ
অনুভব করার মতো পরিমন্ডলে তাঁর অবস্থান ছিল না।
চেতনায় নারী (১)
শিরোনাম পড়ে অনেকে নিশ্চয়ই ভাবছেন, আরজ আলীর রচনায় নারীর অবস্থান খোঁজা
কেন? তিনি তো বিজ্ঞান, বিশ্বাস,আধ্যাত্মিকতা,লৌকিক জীবন ইত্যাদি নিয়ে
ভেবেছেন,লিখেছেন। তাঁর লেখায় আস্তিক্যবাদ আর নাস্তিক্যবাদ নিয়ে আলোচনা না
করে নারী বিষয় কেন? কিন্তু এসব বিষয়ের সাথে তো মানব জীবনকে টেনেছেন আর
মানবের একটা অংশ তো নারী। নারী অবস্থান তার চেতনার কোথায় নাড়া দিয়েছিল সে
কৌতূহল মেটাতেই আরজ আলী মাতুব্বর পুনঃপাঠ। আর পুনঃপাঠের প্রকাশই এ লেখা।
প্রথমে নারীপ্রেম থেকেই আরজ আলী মাতুব্বরের গতানুগতিক পথের বাইরে বিকল্প
পথের সন্ধান। সে নারী তার মা। তার মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের ছবি তোলার অপরাধে
(?) মৃতদেহ দাফন সহ জানাযায় নিজ বাড়ির লোকজন ছাড়া অন্য কেউ আসতে রাজি
হয়নি।
জন্মদাত্রী মা নামক নারীর মুখচ্ছবি ধরে রাখতে গিয়ে সামাজিকভাবে তাকে
বিপর্যয়ের সন্মুখীন হতে হলেও মানসিকভাবে তার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠা শুরু। শুরু
আলোর পথে যাত্রা। তার চেতনায় লাগে নতুন মাত্রা।
কথায় আছে জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। এ তিনটি বিষয় বিধাতা নির্ভর
বলে বিধাতা একই ধর্মের নারী পুরুষে বিয়ে হওয়া ভালবাসেন। এমন বিধানও
দিয়েছেন। আরজ আলী মা্তুব্বর নির্দ্বিধায় স্বামী স্ত্রীর ভিন্ন ধর্মের
বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। তিনি ‘সত্যের সন্ধান” নামক বইয়ে বলেছেন,“ এই
কল্পিত ধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিল উহাতে মতভেদ। ফলে
পিতা-পুত্রে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, এমনকি স্বামী-স্ত্রীতেও এই কল্পিত ধর্ম নিয়া
মতভেদের কথা শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত যে কত রক্তপাত হইয়া গিয়াছে, ইতিহাসই
তাহার সাক্ষী।”(মূল কথা/ প্রশ্নের কারণ)
তিনি ইঙ্গিতে ঘোষণা করেছেন যে, স্বামী ও স্ত্রী মাত্র একই ধর্মের হয় না, বা
হওয়া লাগবেই এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এজন্য রক্তপাতের মত ঘটনাও ঐতিহাসিক
সত্য। স্বামী স্ত্রীর যে ধর্ম নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে তা ধর্মপ্রাণ
মানুষমাত্রই অস্বীকার করবেন। স্বামীর ধর্মই স্ত্রীর ধর্ম। ইসলাম
ধর্মমতে,কোন মুসলিম নারীর স্বামী হতে হলে কোন পুরুষকে স্বামী হওয়ার আগে
ইসলামধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর মুসলিম পুরুষ আহলে কিতাব ( অর্থাৎ যাহারা
বাইবেল, তোউরাত, এবং যবুর গ্রন্থে বিঃশ্বাসী) অনুসারী মহিলাকে বিয়ে করতে
পারে। কিন্তু এতে ধর্মপ্রাণ সমাজে বসবাস কঠিন হয়ে যায়। তা ছাড়া সন্তানদের
ধর্ম নিয়ে তখন টানা হেঁচড়া করা লাগে বলে বিধর্মী প্রেমিক প্রমিকারা
ধর্মান্তরিত হয়ে তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে
স্বামী স্ত্রীরও যে আলাদা ধর্ম হতে পারে তা বলার মত সততা ও সাহস আরজ আলী
মাতুব্বরের ছিল।
স্বামী ও স্ত্রীর যে আলাদা ধর্ম থাকতে পারে এ তথ্যটি বলাও অনেক মৌলবাদীর
কাছে গর্হিত অপরাধ। আরজ আলী মাতুব্বর এ সত্য প্রকাশে দ্বিধান্বিত নন।
নারীর ধর্মীয় স্বাধীনতা চর্চা করতে গিয়ে রক্তপাতের ঘটনাও যে স্বাভাবিক তা
তিনি অবলীলায় বলতে পারেন। এখানেই তার নারী প্রতি আধুনিকতম দৃষ্টিভঙ্গির
প্রকাশ।
১৯২৯ সালের বাল্য বিবাহ আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে কোন মেয়ের বিয়েকে বলে
বাল্য বিবাহ। আর ইদানিংকালে আধুনিক চেতনার উন্নয়নবিদরা, উন্নয়নকর্মীরা বলে
শিশু বিয়ে। বাল্য বিয়ে আর শিশু বিয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে কি? আছে। বাল্য
বিয়ে ইংরেজি early marriage আর শিশু বিয়ে ইংরেজি child marriage. সমাজের
চেতনাকে নাড়া দিতে শিশু বিয়ে শব্দটি বেশি লাগসই। বাল্য বিয়ে আইনগত ভিত্তি
আর শিশু বিয়ে সামাজিক প্রেক্ষাপট ও মানবিক আবেদন।
তাছাড়া, আইনে ১৮ বছরের নিচে কোন মেয়ের বিয়েকে বাল্য বিয়ে বললেও আধুনিক
চেতনায় বিশ্বাসী অনেকেই লেখাপড়া শেষ না করে বা প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বিয়ে
করাকে বলে বাল্য বিয়ে। আর সমাজের আবেগকে নাড়া দিতে ১৮ বছরের নীচের বয়সী
মেয়ের বিয়েকে বলে শিশু বিয়ে। এ নিয়ে ইউনিসেফ এর সাথে বাংলাদেশ সরকারের একটি
প্রকল্পও রয়েছে। যে প্রকল্প 3C নিয়ে কাজ করছে। C তিনটি হল child marriage,
child labour ও corporal punishment.
আরজ আলী মাতুব্বর কিন্তু বহু বছর আগে বাল্য নয়, শিশু বিয়ে শব্দটিই
ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ‘সত্যের সন্ধান” নামক বইয়ে ‘মূলকথা’ পরিচ্ছেদে
বলেছেন, “আমাদের দেশে জন্মহার অত্যধিক। জনসংখ্যা অস্বাভাবিকরূপে বৃদ্ধি
পাইতেছে —-শিশু, বিধবা ও বহুবিবাহে।” ”(মূলকথা/প্রশ্নের কারণ)
অনায়াসে বাল্য বিবাহ শব্দটি ব্যবহার করতে পারতেন। সচেতনভাবেই অনুপ্রাস
সৃষ্টির সুযোগ এড়িয়ে গেছেন। কারণ শিশু বিবাহের সাথে নারী অধিকার সম্পর্কিত,
শিশু অধিকার তো বটেই। তিনি অনেক আগেই শিশু বিয়ে ও বহু বিয়ের কুফল নিয়ে
লিখেছেন যা নিয়ে বাংলাদেশের নারীবাদীরা এখনও আন্দোলন করছে ।
যদিও তিনি সবশেষে বলেছেন, “ সুখের বিষয় এই যে, সরকারী নির্দেশে
শিশু-বিবাহ বর্তমানে কমিয়াছে।’ ”(মূলকথা/প্রশ্নের কারণ)তবে কমে যাওয়ার গতি
খুবই ধীর। নারীর যাপিত জীবনের জাগতিক যন্ত্রণায় শিশু বিয়ে ও বহু বিয়ের মত
দুটো প্রথারই নেতিবাচক প্রভাব যে অসহণীয় তা তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি
করেছিলেন।
যুক্তি দেখাতে বাস্তব জীবন থেকে উদাহরণ লাগে। চাক্ষুষ ঘটনার উপস্থাপন
যুক্তিকে শাণিত করে। বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের দ্বন্দ্বে নির্ভরশীলতা, আস্থা ও
জীবনরক্ষাকারী পথ হিসেবে মানুষ বিজ্ঞানকেই বেছে নেয়। তবে বিশ্বাসের বলি তো
সমাজে যুগ যুগ ধরে নারীরাই হয়ে আসছে। আর আরজ আলী মাতুব্বর তা জানেন ও মানেন
বলেই উদাহরণ এনেছেন গর্ভবতী নারীর সন্তান জন্মদানের মত ঘটনাকে। “গর্ভিনীর
সন্তান প্রসব যখন অস্বাভাবিক হইয়া পড়ে, তখন পানি পড়ার চেয়ে লোকে বেবী
ক্লিনিকের (baby clinic) উপর ভরসা রাখে বেশী।”(মূলকথা/প্রশ্নের কারণ। এ তার
চারপাশের নারীর জীবন চক্র পর্যবেক্ষণের ফল।
নারী পুরুষ বিভাজন নিয়ে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে আপত্তিকর, বিভ্রান্তিকর,
বৈষম্যমূলক, বিসদৃশ্য এবং জেন্ডার অসংবেদনশীল বক্তব্য আছে। তাই ধর্মীয়
প্রভাবে প্রভাবিত সমাজে ও পরিবারে নারীমুক্তি বিষয়টি গুরুত্ব পায় না।ধর্মের
মূলসুর ইহজগতকে গৌণ করে পরকালের জীবনকে মূখ্য করে তোলা; নারী পুরুষের
লিঙ্গজ, জৈবিক, প্রাকৃতিকভাবে দৈহিক পার্থক্যকে বড় করে দেখিয়ে নারীকে
সামাজিকভাবে অধঃস্তন করে রাখায় ধর্মের ভূমিকা ও অবদান প্রত্যক্ষভাবেই দায়ী।
বিষয়টি নিয়ে নারীবাদীরা সংগ্রাম করছেন। নারীর দৈহিক কাঠমোকে ভিত্তি করে
সমাজ ও রাষ্ট্র তার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে। আর নারীর এ অধঃস্তন অবস্থা
থেকে মুক্তির জন্যই নারী আন্দোলন। আর নারী পুরুষের মধ্যে প্রাকৃতিক ও
সামাজিক পার্থক্য নিয়ে উন্নয়ন জগতে gender নামে বহুল আলোচিত একটি ক্ষেত্র
রয়েছে।
পরকালে নারীর অবস্থান অধঃস্তন ও কোথাও কোথাও অস্পষ্ট বলে ইহজাগতিক জীবনে
নারী বৈষম্যের শিকার হয়। কিন্তু পরকালে নারী পুরুষের লিঙ্গভিত্তিক
অস্তিত্ব নিয়েই আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্ন যা নারী পুরুষের বৈষম্যের
ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দেয়। তিনি প্রাণের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করে একটি মৌলিক
প্রশ্ন উপস্থাপন করেছেন,“কেঁচো ও শামুকাদি ভিন্ন যাবতীয় উন্নত জীবেরই
নারী-পুরুষ ভেদ আছে, কৃচিৎ নপুংসকও দেখা যায়। কিন্তু জীবজগতে নারী ও পুরুষ,
এই দুই জাতিই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। প্রতিটি জীব বা মানুষ জন্মিবার
পূর্বেই যদি তাহার স্বতন্ত্র সত্ত্বাবিশিষ্ট প্রাণ সৃষ্টি হইয়া থাকে, তাহা
সেই প্রাণেও লিঙ্গভেদ আছে কি? যদি থাকেই, তাহা হইলে অশরীরী নিরাকার প্রাণের
নারী, পুরুষ এবং ক্লীবের চিহ্ন কি? আর যদি প্রাণের কোন লিঙ্গভেদ না থাকে,
তাহা হইলে এক জাতীয় প্রাণ হইতে ত্রিজাতীয় প্রাণী জন্মে কিরূপে? লিঙ্গভেদ কি
শুধু জীবের দৈহিক রূপায়ণ মাত্র? তাহাই যদি হয়, তবে পরলোকে মাতা-পিতা,
ভাই-ভগিনী ইত্যাদি নারী-পুরুষভেদ থাকিবে কিরূপে?পরলাকেও কি লিঙ্গজ দেহ
থাকিবে?”(প্রথম প্রস্তাব/ আত্মা বিষয়ক)।
কাজেই ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে ভিত্তি করে নারীর প্রতি যে বৈষম্য তা এ
প্রশ্নের কাছে খড়কুটোর মতই উড়ে যায়। আর এখানেই তিনি নারী মুক্তি আন্দোলনের
একজন সহযোগী হিসেবে স্বীকৃত হন।
চেতনায় নারী (২)
নারীর যৌন জীবন ও যৌন অধিকার নিয়ে নারীবাদীরা সোচ্চার।‘শরীর আমার
সিদ্ধান্ত আমার’ স্লোগান নারীর শরীরের ওপর নিজের অধিকারের দাবি। নারীর যৌন
জীবন ও অধিকার কোন ধর্মেই স্বীকৃত তো নয়ই, বরং জগণ্য শব্দ ব্যবহারে
ধিকৃত।নারী সংসারে পুতুলের মত। পরিবার তথা সমাজ আরোপিত কর্মই তার কর্তব্য।
সে একই শরীরে বিভিন্ন সময়ে অনেক সময় একই ব্যক্তির কাছে বিভিন্নরূপে যথাযথ
ভূমিকা পালনের জন্য বাধ্য। কখনও কন্যা, কখনও মাতা আর শয্যায় ভার্যা। ভার্যা
হিসেবে তার কোন চাহিদা নেই। সে পুতুল। স্বামীর মনোরঞ্জনই ভার্যার একমাত্র
চাওয়া, ধর্ম, কর্ম। যদিও marital rape বিষয়টি আলোচিত। অনেক দেশে এটি অপরাধ
এবং এ নিয়ে আদালতে যাওয়া যায়। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসনে পরিচালিত সমাজে এ
নিয়ে কথা বলাই অপরাধ।
আরজ আলী মাতুব্বর নারীর যৌন জীবন ও যৌন অধিকারের বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক
ধারণা পোষন করতেন। ‘হেজরল আসোয়াদ” নামে একটি কালো পাথর কাবাগৃহের দেওয়ালে
গাঁথা আছে। হজ্বের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে হাজীগণকে অন্য অনেক নিয়মের মত ঐ
পাথরে চুমা দিতে হয়। উনি তার প্রশ্ন করেছেন,‘হাজীগণকে ঐ পাথরখানায় সম্মানের
সাথে চুম্বন করিতে হয়। পিতা-মাতা স্নেহবশে শিশুদের মুখ চুম্বন করে এবং
প্রেমাসক্তিবশে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মুখ চুম্বন করিয়ে থাকে। যাহাকে
চুম্বন করা হয়, তাহার মমতাবোধ বা সুখানুভূতি থাকা আবশ্যক। যাহার মমতাবোধ বা
সুখানুভূতি নাই, তাহাকে চুম্বন করার কোন মূল্য থাকিতে পারে না।‘হেজরল
আসোয়াদ”চেতনাবিহীন একখন্ড নিরেট পাথর মাত্র। উহাকে চুম্বন করিবার উপকারিতা
কি?” (চতুর্থ প্রস্তাব/ধর্ম বিষয়ক)।
এখানে উনি স্বামী-স্ত্রীর চুম্বন করার কথা উদাহরণ হিসেবে টানতে গিয়ে
পরস্পর বিষয়টির ওপরে গুরুত্ব দিয়ে নারীর যৌন অধিকারের বিষয়টিকেই সমর্থন
করেছেন। আর হেজরল আসোয়াদ নামে চেতনাবিহীন একখন্ড নিরেট পাথর প্রসঙ্গে
স্বামী স্ত্রীর প্রসঙ্গ টেনে নারীকে যে সমাজ ও ধর্ম চেতনাবিহীন পাথর মনে
করে এরও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
নারীকে সতী আর অসতী হিসেবে আখ্যায়িত করা মানবতা বিরোধী ও নারী বিদ্বেষী
মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। এতে নারীকে অসম্মান করা হয়। অপমান করা হয়। সতী আর
অসতী নারীর ধারণা যে খেলো ব্যাপার তা আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর লেখায় ব্যক্ত
করেছেন। পৌরাণিক কাহিনীর নারী চরিত্র সীতা সতী বলে আগুনে পুড়েনি এমন কাহিনী
রয়েছে। শুধু মানবীই না, বা মানব দেহ মাত্রই না, দাহ্য বস্তু মাত্রই আগুনে
পুড়বে।তা সতী, সৎ, অসতী বা অসৎ, জীব, জড় যা ই হোক না কেন। কাজেই নারীকে
অসতী বলে আগুন দিয়ে পরীক্ষা করার ছল চাতুরির দিন শেষ। আগুনের কাছে যেমন সতী
অসতী ভেদাভেদ নেই তেমন সমাজেরও এ নিয়ে বিভাজন করা বা সংজ্ঞায়িত যে
উপহাসেরই কাজ তা আরজ আলী মাতুব্বরের ভাবনায় প্রস্ফুটিত। তিনি
লিখেছেন,“সেকালে হিন্দুদের ধারণা ছিল যে, সতী নারী অগ্নিদগ্ধ হয় ন। তাই
রাম-জায়া সীতা দেবীকে অগ্নিপরীক্ষা করা হইয়াছিল। সীতা দীর্ঘকাল রাবণের হাতে
একাকিনী বন্দিনী থাকায় তাঁহার সতীত্বে সন্দেহবশত তাঁহাকে অগ্নিকুন্ডে
নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু উহাতে নাকি তাঁহার কেশাগ্রও দগ্ধ হয় নাই। আর আজকাল
দেখা যায় যে সতী বা অসতী, সকল রমণীই দগ্ধ হয়। ইহাতে মনে হয় যে, অগ্নিদেব
দাহ্য পদার্থমাত্রেই দহন করে, সতী বা অসতী কাহাকেও খাতির করে না, নতুবা
বর্তমানকালে সতী নারী একটিও নাই।” (পঞ্চম প্রস্তাব/‘প্রকৃতি বিষয়ক’)
সত্যের সন্ধান বইয়ে ষষ্ঠ প্রস্তাব পরিচ্ছেদের ‘বিবিধ’ নামক প্রবন্ধে আরজ
আলী মাতুব্বর প্রশ্ন রেখেছেন যীশুখ্রীষ্টের পিতা কে এবং এর উত্তরও
খুঁজেছেন। নিঃসন্তান সখরিয়ার ছিল অতি বৃদ্ধা স্ত্রী ইলীশাবেত যে ফেরেস্তার
বর পেয়ে পুত্রের মা হন এবং পরে সখরিয়ার পালিতা ১৬ বছর বয়সী কুমারী মরিয়মও
গর্ভবতী হন। আরজ আলী নির্মোহভাবে বিভিন্ন ঘটনা, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে
দেখিয়েছেন যে সখরিয়াই যীশুখ্রীষ্টের জন্মদাতা। কিন্তু কোথাও একটি শব্দও
মরিয়মের চরিত্রের প্রতি নেতিবাচকভাবে খরচ করেননি। তিনি শুধু অলৌকিক ঘটনার
গিট্টু খুলেছেন। তিনি ব্যভিচারের অপরাধে সখরিয়ার প্রাণদন্ডের উল্লেখ
করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে মহাভারতের মহর্ষি পরাশরের ঔরসে অবিবাহিতা মৎসগন্ধার
গর্ভে ব্যাসদেবের জন্মের লৌকিক ঘটনার উদাহরণ দিয়েছেন।
আরজ আলী মাতুব্বরের নারী চরিত্রের প্রাসঙ্গিকতায় যে নির্মোহ ভাব তা
নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। সাধারণত পুরুষতান্ত্রিক
সমাজব্যস্থায় পরিপক্ক হওয়া মানসিকতা নারীর চরিত্র হননের সুযোগ হাতছাড়া করে
না। কুমারী মাতার মত তথাকথিত রসঘন বিষয় পেয়েও তিনি কুমারী মাতার পুত্রের
পিতার অনুসন্ধান করেছেন যা আমাদের এখনকার সমাজ ব্যবস্থায় অতীব
প্রয়োজন।কুমারীর মায়ের দায়ের চেয়ে, তার চরিত্র বিশ্লেষণের চেয়ে অঘটনপটিয়সীর
সন্ধান জরুরী।নারী আন্দোলন ঘটনার শিকার নারীর চেয়ে অঘটনগপটিয়সী পুরুষটির
পরিচয় জনসন্মুখে প্রকাশের দাবি করে। আর যীশুখ্রীষ্টের জন্ম ইতিহাসের
আলোচনায় আরজ আলী মাতব্বর এ কাজটিই করেছেন।
হজরত আদমের বাম পাজর থেকে বিবি হাওয়া সৃষ্টি বলে স্ত্রীকে স্বামীর অঙ্গজ
বলা হয়। স্ত্রী স্বামীর অঙ্গজ হিসেবে অঙ্গিনী একটি বহুল বির্তকিত
বিষয়।সচেতন নারী মাত্রই এ নিয়ে প্রতিবাদমুখর। আরজ আলী মাতুব্বরও এ নিয়ে
রসিকতা করেছেন।“মানুষের হস্তপদাদি কোন অঙ্গ রুগ্ন হইলে উহার প্রতিকারের
জন্য চিকিৎসা করান হয়।রোগ দুরারোগ্য হইলে ঐ রুগ্নাঙ্গ লইয়াই জীবন কাটাইতে
হয়।রুগ্নাঙ্গ লইয়া জীবন কাটাইতে প্রাণহানির আশংকা না থাকিলে কেহ রুগ্নাঙ্গ
ত্যাগ করে না। স্ত্রী যদি স্বামীর অঙ্গই হয়, তবে দূষিতা বলিয়া তাহাকে ত্যাগ
করা হয় কেন? কোনরকম কায়ক্লেশে জীবনযাপন করা যায় না কি”?(ষষ্ঠ
প্রস্তাব/বিবিধ)। তালাক আর বহু বিয়ের অজুহাতকে তিনি বেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবেই
উপস্থাপন করেছেন।
নারীর প্রতি এক জগণ্য অপরাধ হিল্লা প্রথা।এ প্রথা নারীর মন ও মর্যাদার
ওপর আঘাত। তালাকের পর স্ত্রীকে অন্য কারও সাথে বিয়ে দিয়ে পরে ঐখান থেকে
তালাক নিয়ে পুনঃবিবাহ করা হল হিল্লা প্রথার মূল বিষয়। ইসলামী এ প্রথা আইয়ূব
খানের আমলে পরিবর্তন হলেও গ্রামে গঞ্জে এ বিষয়ক ফতোয়া এখনও চলমান। এ নিয়ে
প্রায়শঃই পত্রিকার পাতায় খবর প্রকাশিত হয়। নারী আন্দোলন হিল্লা প্রথা
নির্মূল ও প্রতিরোধে বদ্ধ পরিকর। আরজ আলী মাতুব্বরও এ ঘৃণিত প্রথাটির শিকার
নারীর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে বলেছেন, “অথচ পুনঃগ্রণযোগ্যা নির্দোষ
স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণে ‘হিল্লা’ প্রথার নিয়মে স্বামীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত
করিতে হয় সেই নির্দোষ স্ত্রীকেই।অপরাধী স্বামীর অর্থদন্ড, বেত্রাঘাত
ইত্যাদি না-ই হউক, অন্তত তুওবা (পুনরায় পাপকর্ম না করিবার শপথ) পড়ারও বিধান
নাই, আছে নিস্পাপিনী স্ত্রীর ইজ্জতহানির ব্যবস্থা। একের পাপে অন্যকে
প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয় কেন?”?(ষষ্ঠ প্রস্তাব/বিবিধ)।
তিনি এমন স্বামীকে বাগে পেলে যে নিদেন পক্ষে তওবা পড়িয়ে ছাড়তেন তা উপরের লাইনে প্রকাশিত।
নারীবাদী কে? আধুনিক মানুষ মাত্রই নারীবাদী। এ আমার নারীবাদ সম্পর্কিত
সরল মন্তব্য। আধুনিক মানুষ মাত্রই নারীর প্রতি ইতিবচক মনোভাব পোষণ করে,
নারী মুক্তি চায়,নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, নারীর সম ও ন্যায্য অধিকারে
সহযোগী ভূমিকা পালন করে। আরজ আলী মা্তুব্বর একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন এবং
নারীবাদী চেতনা লালনকারী ছিলেন।
চেতনায় নারী (৩)
‘সত্যের সন্ধান” বইয়ের নাম যুক্তিবাদ দিয়েও আরজ আলো মাতুব্বর তাঁর
হাজতবাস ঠেকাতে পারেননি। তাই দ্বিতীয় বইয়ের নাম দিয়েছিলেন “অনুমান”,
গ্রন্থটি সম্পর্কে নিজেই বলেছিলেন, “ তাই এবারে ‘সত্যের সন্ধান” না করে
মিথ্যার সন্ধান করতে চেষ্টা করছি এবং “যুক্তিবাদ” এর আশ্রয় না নিয়ে আমি
আশ্রয় নিচ্ছি “অনুমান”-এর। তাই এ পুস্তিকাখানার নামকরণ করা হলো– মিথ্যার
সন্ধানে “অনুমান।”এতে যুক্তিবাদের কঠিন দেয়াল নেই, আছে স্বচ্ছ কাঁচের
আবরণ।” তিনি স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ দিয়ে প্রতিকী চরিত্র সৃষ্টি করে নারীর
অধঃস্তন অসহায় অবস্থানকে উপস্থাপন করেছেন।
“অনুমান” গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধটির নাম ‘রাবণের প্রতিভা।’ রাবণ আর
সীতার কাহিনীর মোড়কে রামকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বসবাসকারী গতানুগতিক একজন
পুরুষ ও সীতাকে পুরুতান্ত্রিক সমাজের শিকার একজন অসহায় নারী হিসেবে
এঁকেছেন।
কোন দম্পতির সন্তান না হলে সমাজ স্ত্রীকেই প্রথমে দায়ী করে।বাঁজা নামের
অপবাদ নারীর প্রতিই সাধারণত ছোঁড়া হয়। আমাদের সমাজে নারীকে বন্ধ্যা বানিয়ে
বহু বিবাহ প্রথা বহাল তবিয়তে বিরাজমান। কিন্তু রাম আর সীতার দাম্পত্য
জীবনে বায়ান্ন বছর (পৌরাণিক কাহিনীর বছর)নিঃসন্তান থাকার জন্য আরজ আলী
সীতাকে নয়, রামকে দায়ী করেছেন। তিনি লিখেছেন, “সীতাদেবী বন্ধ্যা ছিলেন না
এবং উক্ত তেপান্ন বছরের মধ্যে বনবাসের দশ মাস(অশোককাননে রাবণের হাতে সীতা
বন্দিনি ছিলেন ১০ মাস)ছাড়া বায়ান্ন বছর দু’মাস সীতা ছিলেন রামচন্দ্রের
অঙ্কশায়িনী। তথাপি এ দীর্ঘকাল রতিবিরতি রামচন্দ্রের বীর্যহীনতারই পরিচয়,নয়
কি?”
এটাকে আমরা তাঁর গ্রামের বা পরিচিত বলয়ের কোন প্রত্যক্ষ ঘটনার
প্রতিবাদের জন্য লেখা বলে গণ্য করতেই পারি। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন যে
স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ দিয়ে তাঁর “অনুমান” বইটি লিখেছেন।
আর দাম্পত্য জীবনের বায়ান্ন বছর অর্থাৎ দীর্ঘ বছর কাটিয়ে দেয়ার পর রাম
সীতার সন্তান হওয়াকে নিঃসন্তান স্বামীদের বহু বিবাহ না করে ধৈর্য ধরার
ইঙ্গিত করেছেন যা নারীকে সতীনের ঘর করা থেকে রক্ষা করবে। কারণ প্রবাদ রয়েছে
যে নারী স্বামীকে যমকে দিতে রাজি থাকলেও পরকে অর্থাৎ সতীনকে দিতে রাজি হয়
না।
নারীর এ রাজি হওয়া আর না হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে রয়েছে নারীর
মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ। নারীর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া ও শ্রদ্ধা করা তো
নারী আন্দোলনের দাবি। আরজ আলী মাতুব্বরের এ দাবির প্রতি সমর্থন ছিল বলেই
সীতা ও রামের প্রতিকী কাহিনী বলে নারীকে সতীনের সাথে বসবাসের অসহায়তাকে
উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন।
নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়ার জন্য সময় লাগে না। যখন তখন, যেভাবে মন চায়
ইচ্ছে মত গুজব রটিয়ে দিলেই হয়। রাম হাস্যকরভাবে প্রজা মনোরঞ্জন বা প্রজা
বিদ্রোহের অজুহাতে বনবাস থেকে ফেরার ২৭ বছর পর সীতাকে ত্যাগ করে বনবাসে
পাঠিয়েছিলেন। আরজ আলী মাতুব্বর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “ … স্বতই মনে প্রশ্নের
উদয় হয় যে, মরার দু’যুগের পরে কান্না কেন? বনবাসান্তে রামচন্দ্র স্ববাসে
প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর বনবাসের বিবরণ তথা লঙ্কাকান্ড দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিলো।
তাঁর দেশে ফেরার সংগে সংগেই এবং সীতা কলঙ্কের কানাকানিও চলছিলো দেশময় তখন
থেকেই। আর গুজবের ভিত্তিতে সীতাদেবীকে নির্বাসিত করতে হলে তা করা তখনই
দরকার ছিলো সঙ্গত। দীর্ঘ ২৭ বছর পর কেন?”
তাঁর প্রশ্ন থেকে আমাদের মনে উত্তর উদয় হয় যে নারীকে অপবাদ দিতে সাক্ষী
লাগে না, প্রমাণ লাগে না, সময় লাগে না। স্বামী তথা পুরুষ নিজের ইচ্ছে ও
সুবিধামত নারীকে যখন ত্যাগ করতে চাইবে তখনই উপযুক্ত সময়। চরিত্রহীন আখ্যা
দিয়ে তা করার জন্য জনমত, সমাজ, রাষ্ট্র ও আইন পুরুষের পক্ষেই কাজ করে।
তথাকথিত চরিত্রহীন নারী পরিত্যাজ্য ও পরিত্যক্ত।
আর আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্ন করে অচলায়তন সমাজকে নিংরে দেখানোর কৌশল
প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন “……..আরজ
আলী মাতুব্বর প্রথম ও নির্মম যে অন্ধকার সুচিরকাল ধরে স্থায়ী হয়ে আছে এই
বাংলাদেশে, তার কথাই বলেছেন তাঁর বইতে। বর্ণনা করে নয় প্রশ্ন করে।’’
পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্রের আড়ালে আরজ আলী মাতুব্বর নারীর অসহায় অবস্থার জন্য
দায়ী সমাজে বিরাজমান চরিত্র চিত্রণ করেছেন। প্রজা মনোরঞ্জন জন্য, নিজের
সিংহাসন নিষ্কলুষ রাখার জন্য নিষ্কলঙ্ক পাঁচ মাসের অন্তঃসত্বা স্ত্রী
সীতাকে রাম বনবাসে পাঠিয়েছিলেন। আরজ আলী মাতুব্বরের ভাষায়, “রামচন্দ্র
সীতাদেবীকে গৃহত্যাগী করেছিলেন শুধু জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য,স্বয়ং তাঁকে
নাকি “নিষ্কলঙ্কা” বলেই জানতেন।এইরূপ পরের কথায় নিষ্ককলঙ্কা স্ত্রী ত্যাগ
করার নজির জগতে আছে কি?”
ছিল। আছে। আর না থাকার জন্য নারী আন্দোলন। সমাজে এমন পুরুষ চরিত্রের
ছড়াছড়ি যারা পরের কথায় ঘরের বউকে ত্যাগ করে, তালাক দেয়, শ্বশুর বাড়ির নামে
বনবাসে পাঠায়। তথাকথিত লোক লজ্জার অপমানের আশংকায় নিজের স্ত্রীকে অপমান
করে। নারী তার অধঃস্তন অবস্থা ও অবস্থানের জন্য তা মেনে নিতে বাধ্য হয়।
সীতার প্রতীকে তিনি বাংলাদেশের নারীর জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন।
তিনি প্রসঙ্গক্রমে গ্রেট বৃটেনের অষ্টম এডোয়ার্ড এর প্রেমের মহান উদাহরণ
দিয়ে বলেছেন যে, “পার্লামেন্ট এডোয়ার্ডকে জানালো যে হয় মিসেস সিম্পসনকে
ত্যাগ করতে হবে, নচেৎ তাঁকে ত্যাগ করতে হবে সিংহাসন।এতে এডোয়ার্ড সিংহাসন
ত্যাগ করলান, কিন্তু প্রেয়সীকে ত্যাগ করলেন না। শুধু তা-ই নয়, তাঁর মেঝ ভাই
ডিউক- অব-ইয়র্ককে সিংহাসন দিয়ে তিনি সস্ত্রীক রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেন
বিদেশে। রামচন্দ্রেরও তো মেঝ ভাই ছিলো।”
আরজ আলী মাতুব্বর নিজে নারী প্রেমের মর্যাদায় বিশ্বাস করতেন এবং নারীর
প্রতি প্রখর মর্যাদাবোধ ধারণ করতেন বলেই রামকে সীতার জন্য রাজ্য ত্যাগের
পরামর্শ দিতে কুন্ঠিত নন। অর্থাৎ স্ত্রীর জন্য স্বামীকে ত্যাগী হবার মন্ত্র
ছড়িয়েছেন।
সমাজ সব সময়ই নারীর তথাকথিত সতীত্ব নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। নারী সতী না হলে
হয় পতিতা। কিন্তু পুরুষ পতিত হয় না কোন কালেই। এ গতানুগতিক বিষয়টি বহুল
আলোচিত। ‘রাবণের প্রতিভা’ প্রবন্ধে আরজ আলী মাতুব্বর সীতার সতীত্বের বিষয়টি
উহ্য রেখে, তার দেবত্বের মহিমা দূরে রেখে তাকে সমাজের বিভিন্ন চরিত্রে
বিভিন্নরুপে বসিয়েছেন। রামায়ণের রাম সীতা আর রাবণের কাহিনীর আভরণে তাঁর
আশেপাশের নারীর জীবন কথা তুলে এনেছেন। ‘সত্যের সন্ধান” বইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে
যে এটা তাঁর কৌশলী অবস্থান তা তিনি বইয়ের ভূমিকায় নিজেই প্রকাশ করেছিলেন।
আরজ আলী মাতুব্বর প্রথমে রামায়ণের কাহিনী ঠিক রেখে পরে “— ঘটনাগুলো হয়তো
এরূপও ঘটে থাকতে পারে। যথা—’’ বলে তিনি প্রতিকী সীতাকে রাবণের সাথে
স্বেচ্ছায় শুইয়েছেন, অন্তঃসত্ত্বা বানিয়েছেন, আবার সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষায়
উত্তীর্ণও করিয়েছেন।
হিন্দু সমাজে সাধারণত মেয়েদের নাম সীতা রাখা হয় না। প্রচলিত ধারণা সীতা নাম
রাখলে মেয়েটির জীবন সীতার মতই দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে থাকবে। কদাচিৎ কারও নাম
সীতা রাখা হলে দেখা যায় ওই মেয়েটির নবজাতক অবস্থায় তার মা মারা গেছে বা
বাবা মারা গেছে, অথবা কোন পারিবারিক বিপর্যয় ঘটেছে। হয়ত এ ধারণাটিকে কাজে
লাগিয়ে আরজ আলী মাতব্বর পৌরাণিক কাহিনী থেকে সীতা নামটিই বেছে নিয়েছেন
বাংলাদেশের নারীর দুঃখ গাঁথা তুলে ধরার জন্য।বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নারী
নির্যাতনের যে চিত্র তা সীতা নামের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন।
দুঃখিনী সীতাদের সংসারে কিল চড় খাওয়া নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। তিনি
লিখেছেন,‘সীতাদেবীকে নিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় পৌঁছলে লঙ্কাকান্ড প্রকাশ
হওয়ায় সেখানে তখন সীতাকলঙ্কের ঝড় বইছিলো নিশ্চয়ই। হয়তো সীতার স্বীকারোক্তি
আদায়ের জন্য প্রথমত জেরা-জবানবন্দি, কটূক্তি, ধমকানি-শাসানি ও পরে মারপিট
ইত্যাদি শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো তাঁর প্রতি। কিন্তু তিনি নীরবে
সহ্য করেছিলেন সেসব নির্যাতন, ফাঁস করেননি কভূ আসল কথা। আর সেটাই হচ্ছে
সীতার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া”।
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সর্বংসহা নারী তো এভাবেই বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না
অবস্থায় মারপিট খেয়েও অবস্থান করছে। আর জেরা-জবানবন্দি, কটূক্তি,
ধমকানি-শাসানি ও মারপিটসহ শারীরিক নির্যাতন পৃথিবীব্যপীই নারীর জীবনের
অপরিহার্য লিখন। এজন্যই তো ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ
দিবস পালিত হয়। । আর এ অভিজ্ঞতা থেকেই তো নারী আন্দোলনের স্লোগান—‘কিসের ঘর
কিসের বর/ঘর যদি হয় মারধোর।’’
আরজ আলী মাতুব্বর বাস্তবতার নিরীখে দেবী সীতাকে মাটিতে এনে তথাকথিত
অবতার রামকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যোগ্য উত্তরসূরী করে রাম ও সীতার
সম্পর্ককে ও সংসারকে কিসের বর ও মারধোরের ঘর হিসেবে চিত্রিত করেছেন।
রাম আর সীতার পুরো কাহিনিটিই রামায়ণ থেকে ভিন্নভাবে আরজ আলী মাতুব্বর
উপস্থাপন করেছেন, যা বাংলাদেশের নারীর দুঃখে ভরা জীবন যাপনের সাথে একাত্ম।
বাংলাদেশে সীতাদের স্বামীরা সন্তানদের রেখে স্ত্রীদের তালাক দিয়ে তাড়িয়ে
দেবার ঘটনা অসংখ্য। আর তালাক প্রাপ্ত নিরুপায় নারী আত্মহত্যা ছাড়া বিকল্প
উপায় খুঁজে পায় না। আরজ আলী মাতুব্বরের কাহিনীতে এরই প্রতিধ্বনি, “কুশ-লবকে
গ্রহণ করলেও সীতাকে গ্রহণ করেননি রামচন্দ্র সেদিনও। সীতাদেবী হয়ত আশা
করেছিলেন যে, বহু বছরান্তে পুত্ররত্ন-সহ রাজপুরীতে এসে এবার সমাদর
পাবেন।কিন্তু তা তিনি পান নি,বিকল্পে পেয়েছিলেন যতো অনাদর-অবজ্ঞা। তাই তিনি
ক্ষোভে দুঃখে হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। নারী হত্যার অপবাদ লুকানোর
উদ্দেশ্যে এবং ঘটনাটি বাইরে প্রকাশ পাবার ভয়ে শ্মশান দাহ করা হয়নি সীতার
শবদেহটি, হয়তো লুকিয়ে প্রোথিত করা হয়েছিল মাটির গর্তে,পুরীর মধ্যেই। আর
তা-ই প্রচারিত হয়েছে ‘স্বেচ্ছায় সীতাদেবীর ভূগর্ভে প্রবেশ’ বলে।”
নারী হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে
অহরহ। পত্রিকার পাতাই এর সাক্ষী। আরজ আলী মাতুব্বরের চেতনায় তা ঘা দিয়েছিল
বলেই প্রতিকারের আশায় রাম সীতার কাহিনীর অবতারণা। এ অবতারণা আরজ আলী
মাতুব্বরের চেতনায় নারী মুক্তি আন্দোলনের সাক্ষ্য বহন করে।
চেতনায় নারী (৪)
ভগ মানে স্ত্রী যোনি। গুরুপত্নী অহল্যার সতীত্ব নষ্ট করায় ইন্দ্রকে
গুরুর অভিশপে সর্বাঙ্গে এক হাজার ভগ বা স্ত্রী যোনি ধারণ করতে হয় বলে তার
নাম হয় ভগবান। এখানে স্ত্রী যোনিকে আরজ আলী মাতুব্বর অশ্লীল বা লজ্জাস্কর
অথবা কদর্্যভাবে বর্ণনা না করে ইন্দ্রের শাস্তিটাকেই মুখ্য করে তুলেছেন।
এখানে অহল্যা চরিত্রটিকে ধর্ষন করার পৌরাণিক কাহিনী সেঁচে তিনি যে উদাহরণ
তুলে ধরেছেন তা যেন ইন্দ্রকে আজকালকার ধর্ষণকারীদের রূপে দেখতে পাই।
নারীবাদীরা ধর্ষণের শিকার নারীর চেয়ে ধর্ষনকারীদের পরিচয় ও চরিত্র
বিশ্লেষণে সচেষ্ট। অপরাধকে নির্মূল করতে এর শিকড়ের সন্ধান করতে হয়। অপরাধ ও
অপরাধীর তথ্য বেশি প্রয়োজনীয়। তাই আরজ আলী মাতুব্বর নারী বিদ্বেষীদের চোখে
আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে ইন্দ্রের ছদ্মবেশেদারী চরিত্রহীন এক পুরুষের
আদ্যপ্রান্ত তুলে ধরেছেন “অনুমান” গ্রন্থের ‘ভগবানের মৃত্যু’ নামক নিবন্ধে।
ভগবানের মৃত্যু নামক লেখাটিই হেঁয়ালি দিয়ে শুরু বলে এ যে পৌরাণিক ইন্দ্রের
ছদ্মবেশে আমাদেরই চারপাশে বসবাসকারী ধর্ষনকারী তা সহজেই অনুমেয়। আর তার
“অনুমান” গ্রন্থটির বিভিন্ন লেখা যে স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখার
কৌশল তা বইটির ভূমিকায় বলেই রেখেছিলেন।
ইন্দ্রের দুঃষ্কর্মের বর্ণনায় তিনি তার মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তানসহ
কুন্তীর সাথে অবৈধ যৌনাচার, কিষ্কিন্ধ্যার অধিপতি রক্ষরাজের পত্নীর গর্ভে
বালী রাজের জন্মদান, গুরুপত্নীকে ধর্ষনসহ সবই তুলে ধরে যেন আমাদের সমাজেরই
কোন পরিচিত পুরুষ চরিত্র চিত্রণ করেছেন। আমাদের সামাজিক বলয়ে দুঃশ্চরিত্র
ব্যক্তি যৌন ব্যভিচারে লিপ্ত বলে তাঁর জ্ঞান, গরিমা, বুদ্ধি,যশ, প্রতিপত্তি
সবই অর্থহীন । পুরুষের যৌন ব্যভিচারের শিকার যে নারী তা আর বলার অপেক্ষা
রাখে না।
আরজ আলী মাতুব্বর পুরুষ বা ইন্দ্র তথা ধর্ষনকারীর পরিচয়ে বলেছেন,
“‘ভগবান’ হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্রের একটি কুখ্যাত উপাধি মাত্র।ইন্দ্র ছিলেন
শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান- বিজ্ঞানে অতি উন্নত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। তাই তার
একনাম ‘দেবরাজ’ । , কিন্তু দেবরাজ হলে কি হব্ তাঁর যৌন চরিত্র ছিলো
নেহায়েত মন্দ।’’ এ মন্দ তো নারীকে শিকার করে বলেই। মন্দের এ সংজ্ঞা
নির্ধারণ করতে গিয়ে তিনি নারীর অবস্থানকেই তুলে ধরেছেন।
নারীরা পদবী তার বাবার থেকে নেয়। অনেকে বিয়ের পর স্বামীরটা নেয়। অনেকে আবার
নামের পাশে স্ত্রী লিংগবাচক বেগম সুলতানা নিয়ে থাকেন। আমাদের দেশে মায়ের
নাম নিজের সাথে লাগানোর রেওয়াজ খুবই কম। তবে স্বামীর তার স্ত্রীর পদবী
নেওয়ার চর্চা নেই।পদবী তো দূরের কথা, স্ত্রীর কথার গুরুত্ব দিলেই স্বামীকে
স্ত্রৈণ হিসেবে সম্বোধন করে ঠাট্টা করা হয়। আরজ আলী মাতুব্বর কিন্তু
গুরুত্বের সাথে স্ত্রীর নামে স্বামীর পরিচিতি পাবার বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
আরজ আলী মাতুব্বরের ভাষায়, “সহস্র ভগ অঙ্গে থাকায় ইন্দ্রদেব ‘ভগবান’
আখ্যা পেয়েছিলেন। কিন্তু মহাদেব শিবকেও ‘ভগবান’ বলা হয়, অথচ তার দেহে ‘ভগ’
ছিল না একটিও। তত্রাচ তিনি ‘ভগবান’ আখ্যা প্রাপ্তির কারণ হয়তো এই যে তিনি
ছিলেন ভগবতীর স্বামী। স্বয়ং ‘ভগযুক্তা’ বলেই দূর্গাদেবী হচ্ছেন ভগবতী
এবং‘ভগবতী’- এর পুংরূপে হয়তো শিব বনেছেন ভগবান। যদি তা-ই হয় অর্থাৎ
ভগযুক্তা বলে দূর্গাদেবী ভগবতী হন এবং ভগবতীর স্বামী বলে শিব ভগবান হয়ে
থাকেন, তাহলে জগতের তাবৎ নারীরাই ভগবতী এবং তাদের স্বামীরা সব ভগবান।”
“হয়তো’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি নারীর তথা ভগবতীর পুংলিঙ্গ সৃষ্টি করেছেন,
যেখানে সমাজ পুংলিঙ্গের স্ত্রীবাচক শব্দ সৃষ্টিতে তৎপর, ধর্ম যেখানে
স্ত্রীকে পুরুষের অঙ্গ হতে সৃষ্ট বলে ব্যাখ্যায় ব্যপৃত, আরজ আলী মাতুব্বরের
বর্ণনায় সেখানে ভগবান নয়, স্ত্রীর পরিচয়ে পরচিতি লাভ যেন ভাগ্যবানের
ভাগ্য। এমন কথা পড়ে নারীবাদীদের হাত স্বতঃস্ফূর্তভাবে তালির শব্দ তুলে।
ভগযুক্ত স্ত্রীর স্বামী হিসেবে ভগবান শব্দের ব্যাখ্যায় নারীর অধঃস্তন
অবস্থানকে উপরের দিকে সজোড়ে ধাক্কা দেবার মন্ত্র বৈ কি!
বর্তমান বাংলাদেশের সমাজে যেখানে বাবা বা স্বামীর নাম বহনই নারীদের
কপালে সমাজের লিখন সেখানে স্ত্রীর নামে শিব ভগবান হয় বলে তার যে ব্যাখ্যা
তা নারীবাদের উলুধ্বনিই শোনা যায়।
অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান বলেছেন, “…আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনের জিজ্ঞাসার যে
চিত্র তুলে ধরেছেন, তা পাঠকের মনে চিন্তার খোরাক যোগাতে সক্ষম।” এ চিন্তার
খোরাক যোগানোতে আরজ আলী মাতব্বর পাঠ প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্তমান প্রজন্মের
কোন নারীবাদী পুরুষ স্ত্রীর পদবী গ্রহণ করলে নারীবাদের জয়ধ্বনির অংশীদার ও
দাবিদার আরজ আলী মাতুব্বরকেই যে করতে হবে।
চেতনায় নারী (৫)
(অর্ফিউসকে কথা দিয়েছিরাম যে আরজ আলী মাতুব্বরের চেতনায় নারী সিরিজটি
শেষ করব। কিস্তু সাময়িক বন্ধের অনেক কারণ এবং কারণগুলো অনেকের কাছে অনর্থক
অজুহাতের পর্যায়ে পড়বে বলে তা আর উল্লেখ করছি না। যাহোক, অর্ফিউসকে কথা
দেয়ার যাতনায় আবার শুরু করলাম। @অর্ফিউস )
আরজ আলী মাতুব্বর “অনুমান’ গ্রন্থের শেষ নিবন্ধটির নাম সমাপ্তি। সমাপ্তি
নিবন্ধের মূল কথাটি দিয়েই আমি আমার লেখার প্রথম পর্বটি শুরু করেছিলাম।
স্বামীহারা, বিত্তহারা, গৃহহারা এক বিধবার চার বছর বয়সের ছেলে মৃত মায়ের
ফটো তুলাতে মায়ের মৃত্যু পরবর্তী ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান না করতে পেরে একদিন
নাখোদাদের নামকরা নায়ক হয়েছেন। মাতৃ শোকের আবেগকে তেজে, শক্তিতে ও
আশীর্বাদে পরিণত করেছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর।
বরিশাল প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন সাধারণ কৃষক থেকে আরজ আলী মাতুব্বর হয়ে
উঠার মূলে, প্রেরণায়, উদ্ধুদ্ধকারী হিসেবে রয়েছেন এক নারী। তিনি নিজেই
বলেছেন, “অগত্যা কতিপয় অমুছল্লি নিয়ে জানাজা ছাড়াই আমার মাকে সৃষ্টিকর্তার
হাতে সোপর্দ করতে হয় কবরে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে ছবি তোলা দুষণীয় হলে সে দোষে
দোষী স্বয়ং আমিই, আমার মা নন। তথাপি যে আমার মায়ের অবমাননা করা হলো, তা
ভেবে না পেয়ে আমি বিমূঢ় হয়ে মার শিয়রে দাঁড়িয়ে তাঁর বিদেহী আত্মাকে
উদ্দেশ্য করে এই বলে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘মা! আজীবন ছিলে তুমি
ধর্মের একনিষ্ঠ সাধিকা। আর আজ সেই ধর্মের নামেই হলে তুমি শিয়াল-কুকুরের
ভক্ষ্য। সমাজে বিরাজ করছে এখন ধর্মের নামে অসংখ্য অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার।
তুমি আমায় আশীর্বাদ করো –আমার জীবনের ব্রত হয় যেনো কুসস্কার ও অন্ধবিশ্বাস
দূরীকরণ অভিযান। আর সে অভিযান সার্থক করে আমি যেনো তোমার কাছে আসতে
পারি’’।
আবেগে আপ্লুত, দুঃখে মুহ্যমান, প্রতিজ্ঞায় শাণিত মন এ প্রসঙ্গে একটী কবিতার লাইনও যোগ করেছিলেন,
“তুমি আশীর্বাদ করো মোরে মা,
আমি যেনো বাজাতে পারি
সে অভিযানের দামামা”
এ দামামা ধর্মীয় রীতিনীতি, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দুরীকরণে বাজাতে গিয়ে নারীর প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধেও বাজিয়েছেন।
“স্মরণিকা’ গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়টি হল ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরী’।এর
প্রথম পাঠ লামচরি গ্রামের অবস্থান ও পরিবেশ। যেখানে একমাত্র লাইব্রেরী
প্রতিষ্ঠার চেয়ে একাধিক মসজিদ প্রতিষ্ঠা অগ্রাধিকার পায়। যার বর্ণনায় আরজ
আলী মাতুব্বর কবি নজরূল ইসলামের লেখা থেকে উদ্ধৃতি টেনেছেন,” বিশ্ব যাখন
এগিয়ে চলেছে আমরা তখন বসে, বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকাহ-হাদিস চষে।’’
অর্থাৎ তিনিও নজরুলের মত বিংশ শতাব্দীতে এসে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চাকে শিকেয়
তুলে, সভ্যতার কথা ভুলে, নারীর মর্যাদা ও নারী অধিকারের প্রতি সম্মান না
জানিয়ে, নারীর জীবিনবোধকে গুরুত্ব না দিয়ে নারীকে অবদমিত করতে, নারীর
ভোগান্তি বাড়াতে এখনও যে ফেকাহ-হাদিস খুঁজে নারীর বিরুদ্ধে ফতোয়া চলছে — তা
উপলদ্ধি করে মর্মাহত।
তিনি যেন দূরবীণ দিয়ে পরবর্তী কয়েক দশকে নারীর অবস্থানকে দেখেই নজরুলের
উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে ২০১৩ সালে হেফাজত ইসলাম এর নারীকে
তেঁতুলের সাথে তুলনাটিও মনে করিয়ে দেয়।
আরজ আলী মাতুব্বরের লামচরি গ্রামে কয়েক দশক আগে যেমন অবস্থা ছিল আজও
বাংলাদেশের যে কোন গ্রাম তা ই রয়ে গেছে। একমাত্র লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার চেয়ে
একাধিক মসজিদ প্রতিষ্ঠা অগ্রাধিকার পায়। সেখানে আরও বেড়ে যাচ্ছে
অর্ধিশিক্ষিত অপশিক্ষিত মোল্লাদের দৌরাত্ম্য। আর এ দৌরাত্ম্যে নারীকে
পেছনের দিকে ঠেলে পাঠানোর অপতৎপরতা বিরাজমান যা আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর
অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখে ও অন্যকে দেখানোর ব্যবস্থা করে গেছেন তাঁর লেখায়।