Tuesday, May 23, 2017

আল্লাহর সাক্ষাৎকার। পর্ব – ১

 

১.
গতকাল রাতে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে টয়লেটে গিয়ে টয়লেট করে বেসিনের কলটা ছাড়তেই দেখলাম, একজন ধবধবে সাদা পোষাক পড়া দাড়িওয়ালা বুড়ো ভদ্রলোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী ব্যাপার, আপনি আমার ফ্ল্যাটে কীভাবে ঢুকলেন? চাবি পেলেন কই? চুরি করতে এসেছেন নাকি?
এই কথা বলেই আর কিছু না ভেবে আমি তাকে চড় থাপ্পর মারা শুরু করলাম। এত রাতে আরেকজনার বাসায় বিনা অনুমতিতে ঢোকা এদেশের আইনে মস্তবড় অপরাধ। সত্যি বলতে কী, এমন হুট করে একজনকে আমার বাসায় দেখে আমি একটু ভড়কেই গিয়েছিলাম। আমার কিলঘুষি খেয়ে সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, আরে করেন কী করেন কী। থামেন থামেন। আমি জিব্রাইল। পেশায় আমি একজন ফেরেশতা। থামেন ভাই, আর মাইরেন না। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
আমি আরেকবার ভিমড়ি খেলাম। এ কী জিব্রাইল বললো, না আজরাইল বললো? অবাক হয়ে বললাম, মানে কী? কোথায় নিয়ে যেতে এসেছেন? মিয়া এত রাতে মজা করেন?
সে বললো, শুনেছি আপনি একজন ভয়াবহ উগ্র নাস্তিক। খালি আল্লাহ আর ইসলামের সমালোচনা করেন। পুরাই ইসলাম বিরোধী। তাই আল্লাহ পাক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আপনার সাথে সাক্ষাত করে নিজেই আপনাকে উনার দিদার লাভের সুযোগ দেবেন। যেন আপনার মত নাস্তিকের মনে আর কোন সংশয় না থাকে। ঐ যে নিচে তাকিয়ে দেখুন, বোরাক ঘোড়া সাথে নিয়ে এসেছি।
আমি জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলাম, আরে! আসলেই তো। এক পাখনাওয়ালা ঘোড়া আমার বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে আরেকটি ঘোড়া। ঐটা মনে হয় এই বেটা জিব্রাইল না আজরাইলের।
আমি বললাম, আচ্ছা, আপনি কোন কিডনাপার কিংবা আজরাইল না তো?
সে বললো, না না, কী যে বলেন। আমি আজরাইল না। জিব্রাইল। অনেকদিন পরে দুনিয়াতে আসলাম। শেষবার এসেছিলাম সেই মুহাম্মদের আমলে, আরব দেশে।
আমি আরো অবাক হয়ে বললাম, আমাকে নিতে কেন এসেছেন? আমি কী নবী রাসুল হয়ে গেলাম নাকি?
সে বললো, আরে না! আল্লাহ পাক অনেকদিন ধরেই আপনার দিকে নজর রাখছেন। আপনার ব্লগ উনি নিয়মিতই পড়েন। ফেইসবুকের স্ট্যাটাসও পড়েন। তা দেখেই আপনাকে উনি প্রমাণ দেখাতে চান যে, উনি আসলেই আছেন।
আমি বললাম, তা এত নাস্তিক থাকতে আমাকেই কেন নিতে হবে? তাছাড়া আমার এখন ঘুমাবার সময়। অন্য এক সময়ে আসা যায় না? কাল আবার অফিস আছে।
তিনি বললেন, আসলে, আপনাকে প্রমাণ করে দিতে পারলে এই যুগের অনেক বড় বড় নাস্তিকরাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে। আপনি সবচাইতে উগ্র নাস্তিক কিনা, তাই। আর আল্লাহ পাক এখুনি আপনাকে তলব করেছেন। এখুনি যাওয়া জরুরি। আমি মনে মনে ভাবলাম, আচ্ছা, কী আর করা। যাই না হয়। অনেকদিন ঘুরতে টুরতে যাই না। এই চান্সে মহাকাশ দেখে আসা যাবে। শুনেছি স্টিফেন হকিং নাকি মহাশূন্যে যাচ্ছেন, যদি মহাকাশে তার সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে তো ভালই হয়। নতুন বইটা সম্পর্কে কিছু আইডিয়া পাওয়া যাবে। কিছু বিষয় একদমই বুঝি নাই।
এই ভেবে জামাটা চেঞ্জ করে নিলাম। নিচে নামতেই দেখি, ঘোড়াটা উড়ার জন্য প্রস্তুত। আমি জিব্রাইলকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ঘোড়া মহাকাশ পাড়ি দেবে? ধুর, মিয়া মজা লন! একটা স্পেসশিপ আনলে হতো না? মহাকাশে অক্সিজেন পাবো কোথায়? অক্সিজেন মাস্ক কই? আর এই ঘোড়া না হয় দুনিয়ায় পা দিয়ে দৌঁঁড়ালো, পাখনা দিয়ে বায়ুমন্ডল অতিক্রম করলো, কিন্তু বায়ুমণ্ডলের ওপরে পাখনা দিয়ে কী হবে? পাখনা দিয়ে মহাকাশ পাড়ি দেবে, ডানা ঝাঁপটে? ফাইজলামি করেন মিয়া? আর এত দূরের পথ, এনার্জি সোর্স কী এই ঘোড়ার? কী ধরণের ফুয়েল ব্যবহার করা হবে?
জিব্রাইল কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে খাস ঢাকাইয়া ভাষায় বললো, এই নাস্তিকদের নিয়ে মহা মুসিবত। আপনেরে ঘোড়ায় চড়তে কইছি চড়েন মিয়া। এত ক্যাচাল করেন ক্যা? বালের চাকরি করি, কোন বেতন বুতন নাই, সরকারি ছুটি নাই, খালি সারাদিন উপাসনা আর উপাসনা। মরার জিন্দেগীতে কিছুই করবার পারলাম না হালায়। এত কথা জিগাইয়েন না। আমি এতকিছু জানি না। আল্লাহর হুকুমে ঘোড়া উড়ে, আমি ক্যামনে জানমু এইসব ক্যামনে কী হয়। আমি কী স্কুলে গিয়া বিজ্ঞান পড়ছি নাকি?
আমি কাচুমাচু করে বললাম, আচ্ছা বস, স্যরি। জানতাম না আপনের চাকরিতে এতো ক্যারফা। লন যাই, আর কিছু জিগামু না।
এরপরে ঘোড়ায় চড়ে বসতেই ঘোড়া উড়াল দিলো। প্রথমে ঘোড়া গেল এক আসমানে। এরপরে প্রতিটা আসমানে এক একজন বর্ডার কন্ট্রোল অফিসার। জিজ্ঞেস করলো, ভিসা আছে? জিব্রাইল তখন আমার ভিসাটা দেখালেন। বর্ডার কন্ট্রোল অফিসার বিরক্ত মুখে বললেন, ও, আপনেই তাইলে সেই উগ্র নাস্তিক? যান, আপনের আজকে খবরই আছে। বলে একটা সিল মেরে ছেড়ে দিলেন। আমি এইসব কথা শুনে আরো একটু ভড়কে গেলাম আর কী। এরপরে এক এক করে এসে পৌঁছালাম সাত আসমানে। প্রত্যেকেরই দেখলাম বর্ডার কন্ট্রোল অফিসারের বিরক্ত চেহারা। এখানে চাকরিবাকরিতে সম্ভবত ঠিকমত পে করা হয় না। ছুটিছাটাও নাই। বেতনই মনে হয় না দেয়া হয়। এদের বানানোই হয়েছে গোলামি করার জন্য। ভাবলাম, দাসপ্রথা এখনো চালু আছে, এ এক বিস্ময়! এই আধুনিক যুগেও? খুব অন্যায়। এই নিয়ে আল্লাহর কাছে বলতেই হবে। এভাবে ফেরেশতাদের খাটানো উচিত না। অন্তত বছরে বিশটা ছুটি, এবং উৎসবের দিনগুলোতে ছুটি দেয়া উচিত। নইলে একই কাজ করতে করতে এরা তো বোর হয়ে যায়। এই কারণেই মিকাইল ফেরেশতা ঠিকমত কাজকাম করে না। যেইখানে বৃষ্টি দরকার সেইখানে না দিয়ে যেখানে দরকার নাই সেইখানেই দেয়। সবই চাকরিবাকরিতে আনন্দ নাই বলেই তো! এসব ভাবতে ভাবতে সাত আসমানে পৌঁছে গেলাম। ঘোড়া থেকে নামলাম।
২.
ও আচ্ছা, এই তাহলে আল্লাহর আরশ! বাপরে, খুবই রাজকীয় অবস্থা দেখা যায়। আল্লাহর আরশের কাছে আসতেই দেখলাম, চারিদিক উজ্জ্বল হয়ে গেছে। আল্লাহর নুর বলে কথা! একদমই নুরানী কুদরত চারিদিকে। উজ্জ্বল আলোর ছ্বটা, চারিদিকে সোনা মনি মুক্তো ছড়ানো। কী অদ্ভুত অবস্থা।
ধুম করে এক শব্দ হলো। প্রথমে বুঝলাম না কী। পরে বুঝলাম, এটাই আল্লাহর কণ্ঠস্বর। সে বললো, আসসালামু ওয়ালাইকুম হে আসিফ মহিউদ্দীন। হে নালায়েক উগ্র নাস্তিক! কেমন আছিস? এখন বিশ্বাস হলো তো আমাকে? নাকি এখনো কোন সন্দেহ?
আমি আসলে একটু ভয়ই পেলাম। গলাটা একদমই শুকিয়ে গেছে। কিন্তু সেটা তো আর বুঝতে দেয়া যায় না। নাস্তিকের মান সম্মান বলে কথা। একটু মোটা গলা করে বললাম, ওয়ালাইকুম আস সালাম হে আল্লাহ পাক। আমি ভালই আছি। আপনার শরীর কেমন?
সে হুঙ্কার দিয়ে বললো, আরে বেটা, আমার কী শরীর আছে রে? আমি হচ্ছি আল্লাহ! মহান আল্লাহ পাক। অসীম দয়ালু। যাকে তুই সারাজীবন গালমন্দ করেছিস!
আমি বললাম, শরীর না থাকলে এই যে আপনার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, এর জন্য তো একটি ফুসফুস দরকার। জিহবা এবং ঠোঁঁট দরকার। না হলে আপনি উচ্চারণ করছেন কীভাবে? আমরা জানি যে, শব্দ উচ্চারণের জন্য এসব দরকার হয়। তা যদি না হয়, কোন যন্ত্র অবশ্যই দরকার। যেমন রেডিও টিভি আর কি। সেই যন্ত্রে ইলেক্ট্রিসিটিও দরকার। রেডিও টিভিতে কীভাবে সাউন্ড তৈরি হয় তা আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। তাছাড়া, কোরানে আপনি নিজেই বলেছেন,
আল্লাহ তোমাদিগকে আপন  নফসের ভীতি প্রদর্শন করছেন । আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। [আল ইমরান ৩০] নফস শব্দের অর্থ হচ্ছে দেহ। বা শরীর। আপনি নিজেই বলেছেন আপনার দেহ আছে। তাহলে এখন আবার উলটা কথা বলার মানে কী?
আল্লাহ পাক অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এরপরে বললেন, বেয়াদব কোথাকার! আমাকে সচোক্ষে দেখবার পরেও তর্ক করছিস? সাহস তো কম না? এখনো বিশ্বাস আনলি না?
আমি বললাম, বিশ্বাস আনা না আনা পরের বিষয়। আমি তো তোমার নবী রাসুলদের মত না, যে যাচাই না করেই বদহজম জনিত দুঃস্বপ্নকে সত্যি ভেবে নেবো। এমনও তো হতে পারে, এটা আমার স্বপ্ন। রাতের বেলা ছাই পাশ খেয়ে এখন বাজে স্বপ্ন দেখছি। বা আমাকে নিয়ে কোন রসিকতা করা হচ্ছে। নিশ্চয়ই চিপায় চাপায় কোন ভিডিও ক্যামেরা সেট করা। একটু পরেই লোকজন বের হয়ে বলবে, এতক্ষণ ইউটিউবে আপলোডের জন্য এই মজাটা করা হচ্ছিল। প্র‍্যাঙ্ক ভিডিও দেখেন নি? কত লোক বানাচ্ছে আজকাল।
আল্লাহ আরো জোরে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, তবে রে বদমাইশ! সাত আসমান নিয়ে আসার পরেও অবিশ্বাস! শালার নাস্তিকদের কলবে আমি সিল মেরে দিছি কী সাধেই! বল, কী হলে তুই বিশ্বাস আনবি?
আমি বললাম, কলবে সিল মেরেছেন আপনি, বুদ্ধি দিয়েছেন আপনি। সেগুলো ব্যবহার করেই তো যা বলার বলছি। তাই বেয়াদবি কিছু হলে তার দায় আপনারই। আপনাকে কে বলেছিল কলবে সিল মেরে আমাকে পাঠাতে? আমি আপনের পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিলাম নাকি, আমার কলবে সিল ছাপ্পর মেরে দিতে?
– বেয়াদব কোথাকার। কোন মান্যগণ্য করা শিখিস নি?
– মান্যগণ্য অবশ্যই করি। আপনি বৃদ্ধ মানুষ, এত বছর ধরে বেঁচে থাকা কম কষ্টের কাজ না।  যাইহোক, তাহলে এক কাজ করা যেতে পারে। আসুন আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিই। সেটা আমার ব্লগে পোস্ট করবো। সাক্ষাৎকারের মধ্যেই আমার যত সন্দেহ বা সংশয় নিয়ে আলাপ করা যাবে। অন্যরাও এই লেখাটি পড়ে আপনার সম্পর্কে জানতে পারবে, এবং বিশ্বাস আনতে পারবে। কী বলেন?
আল্লাহ বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। জিজ্ঞেস কর কী জিজ্ঞেস করবি।
-তার আগে আপনার সাথে একটা সেলফি নিই আল্লাহ পাক?
-খবরদার বেয়াদব, জানিস না আমি ছবি তোলা হারাম করেছি?
-আচ্ছা ঠিক আছে, স্যরি। ছবি লাগবে না। প্রথমেই আপনাকে যা বলা দরকার, সেটা হচ্ছে তুই তুকারি করবেন না। আপনি আল্লাহ বলে এমন কোন চ্যাটের বাল হয়ে যান নাই যে, অভদ্রের মত তুই তুকারি করবেন। ভদ্রভাবে উত্তর দেবেন। গালাগালি করবেন না
আল্লাহ আমতা আমতা করে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি করে বললে চলবে? শত হলেও আমি তো বয়সে বড়, নাকি? তোকে আপনি তো আর বলা যায় না।
আমি বললাম, আচ্ছা, তুমিতে আপাতত কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আপনি যে শুরুতে আমাকে সালাম দিলেন, সালামের অর্থ হচ্ছে আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। তা আপনি কার কাছে এই কামনা করলেন?
– আরে ওটা তো কথার কথা। এমনিতেই বলি আর কি।
– ও আচ্ছা। তাহলে ঠিক আছে। যাই হোক, শুরু থেকেই শুরু করি। প্রথম প্রশ্ন। আপনার নাম কী?
– আমার নাম? আমার নাম আল্লাহ। আমার নাম স্রষ্টা। রহমানুর রাহিম। আরো ৯৯ টা প্রশংসাসূচক নাম আছে আমার।
– এই নামগুলো কে রেখেছে? আপনার বাবা মা?
– আরে বেয়াদব! আমার নাম আবার কে রাখবে? আমি নিজেই রেখেছি।
– মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনার এইসব প্রশংসা সংবলিত নাম আপনি নিজেই নিজেকে দিয়েছেন, তাই তো? নিজেই নিজের নাম রেখেছেন দয়ালু, করুনাময়, ন্যায়বিচারক, ইত্যাদি? বেশ বেশ! এই সার্টিফিকেটগুলো নিজেই নিজেকে দিলেন? আপনি কী নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিসওর্ডার নামক মানসিক সমস্যাটির নাম শুনেছেন? এই মানসিক সমস্যাটি হলে কী হয় জানেন?
– বেয়াদব কোথাকার! আমার নাম আমি দিলে তোমার সমস্যা কোথায়?
– না সমস্যা নাই তেমন কিছু। বলছিলাম কী, ইয়ে মানে এটা একটা মানসিক সমস্যা। এইসব সার্টিফিকেট নিজেকেই নিজে দেয়া যায় না। এই ধরণের কথা পৃথিবীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামক দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই বলে থাকে। নিজেই নিজেকে অমুক তমুক দাবী করা আর কী! সে যাই হোক। এবারে দ্বিতীয় প্রশ্ন। আপনার সৃষ্টি কীভাবে হলো? কে আপনার স্রষ্টা?
– তবে রে নালায়েক, আমার আবার স্রষ্টা কিসের? আমাকে কেউ সৃষ্টি করে নি। আমি প্রাকৃতিক। আমি কোন সৃষ্টি না।
– তারমানে বলতে চাচ্ছেন, আপনি নিজে একজন নাস্তিক? মানে আপনি আপনার স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন না?
– না। আমার কোন স্রষ্টা নাই।
– আপনি কী এই বিষয়ে নিশ্চিত? যেমন ধরুন, ধর্মান্ধ মুসলমানরা সেই মধ্যযুগে এক ধরণের যুক্তি দিতো। যে মায়ের পেটে জমজ বাচ্চা একে অন্যের সাথে আলাপ করছে। একজন বলছে, এই পেটের বাইরে আর কিছু নেই। আরেকজন বলছে, এই পেটের বাইরে আরেক পৃথিবী আছে। এই যুক্তি দিয়ে তারা বোঝাতে চাইতো, মরার পরেও জীবন আছে। সেই একই যুক্তিতে, আপনার এই আরশের বাইরে আরেক মহা-মহা-বিশ্ব আছে কিনা, সেখানে আপনার পাপ পূণ্যের বিচার হবে কিনা, আপনি কী নিশ্চিত? কেউ আপনার দিকে খেয়াল রাখছে কিনা, আপনার দোষগুণ হিসেব করছে কিনা, আপনি কি নিশ্চিত?
আল্লাহ(একটু কনফিউজড ভঙ্গিতে) – এরকম কোন প্রমাণ আমি পাই নি।
– কিন্তু প্রমাণের প্রশ্ন আসছে কীভাবে? আপনি কী প্রমাণ করতে পারবেন, আপনার কোন স্রষ্টা নাই?
– না, তা পারবো না।
– তাহলে মেনে নিতে আপত্তি কিসের?
– বেটা, তুই আসলেই একটা বজ্জাত।
– আপনি কোন প্রশ্নেরই ঠিকমত জবাব দিচ্ছেন না। এটা ঠিক না। আচ্ছা যাইহোক, তাহলে বোঝা গেল, আপনি একজন নাস্তিক। যে স্রষ্টায় বিশ্বাসী না। তাহলে পরের প্রশ্নে যাচ্ছি। আপনি কী দিয়ে তৈরি? নুরের?
– হ্যা, আমি নুরের তৈরি।
– নুর মানে আমরা জানি আলো। আমরা এখন জানি, আলোর কিছু ধর্ম রয়েছে। তার কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। তাহলে আপনি যেহেতু নুরের তৈরি, সূত্র মতে আপনিও সেই সব নিয়মের মধ্যেই থাকবেন। অর্থাত আপনি নিজেই সেই সূত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাই না?
– না, আমি কোন কিছু দ্বারা নিয়ন্ত্রত নই। আমি যা ইচ্ছা করতে পারি।
– মানে আপনি বলছেন, আপনার যা ইচ্ছা তাই আপনি করতে পারেন? কিন্তু আমরা তো জানি, আপনি শুধু ভাল কাজটিই করেন। খারাপ কিছু আপনি করতেই পারেন না। তাহলে আপনি কী নিজেই ভাল কিছু করতে দায়বদ্ধ নন? মানে আপনি ভাল কিছু করার নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন?
– তুই একটা আস্তা বেয়াদব!
– আবারো তুই তুকারি শুরু করলেন। যাই হোক, এবারে বলুন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে আপনি কী করছিলেন?
– কিছুই করছিলাম না। তখন আমি ফেরেশতা বানিয়েছিলাম, জ্বীন বানিয়েছিলাম।
– সেই সবকিছু বানাবার আগে?
– কিছুই করছিলাম না।
– ঠিক কতটা সময় আপনি এরকম বেহুদা বসে ছিলেন?
– অনন্তকাল।
– তা এই অনন্তকাল বেহুদা বসে কী করছিলেন? ভাবছিলেন? নাকি অন্য কোন কাজ?
– ধরো, হুদাই বসে ছিলাম। তো?
– মানে বুঝতে চাচ্ছিলাম, সেই সময়ে কী আপনি জানতেন, যে একদিন আপনি মহাবিশ্ব বানাবেন? আপনি তো শুনেছি ভবিষ্যত জানেন। তাহলে বেহুদা বসে না থেকে আরো আগেই বানালেন না কেন?
– আগে বানাই পরে বানাই তাতে তো কী? আমার ইচ্ছা যখন তখনি বানামু।
– মানে আমার জিজ্ঞাসা ছিল, ধরুন আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, আমি একটা বাড়ি বানাবো। তাহলে অনন্তকাল বেহুদা বসে থেকে, কোন কাজ কাম না করে অনন্তকাল অপেক্ষার পরে মহাবিশ্ব এবং যাবতীয় কিছু বানাবার কারণ কী? অনর্থক বেহুদা এতদিন বসে ছিলেন কেন? তাছাড়া বিগ ব্যাং তত্ত্ব থেকে যা এখন অনেক কিছুই জানি আর কি। সময় এবং স্থান তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাং এর পরে। তার আগে সময় বা স্থানের অস্তিত্ব ছিল না। তাহলে আপনি কোন সময়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, যে মহাবিশ্ব বানাবেন? সেই সময়ে আপনার আরশটা কই ছিল? কোন স্থানে? আপনিই বা কই বসে ছিলেন?
– এইসব জিজ্ঞেস করতে তোরে এতো দূরে এনেছি নালায়েক?
– আপনি আবারো মুসলমানদের মত গালাগাল শুরু করলেন। আমি তো ভদ্রভাবে প্রশ্ন করছি। আচ্ছা যাইহোক। এরপরে আপনি ফেরেশতা বানালেন আপনার দাসত্ব করার জন্য। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে দাস প্রথা তো উঠে গেছে। এই ফেরেশতাদের এখনো আপনি খাটিয়ে মারছেন, এ তো অন্যায়।
– এদের বানানোই হয়েছে আমার গোলামি করার জন্য।
– যেকারনেই বানানও হয়ে থাকুক। যেমন ধরুন, সৌদি আরবে বাঙালি শ্রমিক নিচ্ছে কাজ করাবার জন্য। কিন্তু তাই বলে শুধু খাটিয়ে মারবে তা তো হয় না। তাদেরও জীবন আছে। তারা আনন্দ ফুর্তি করবে, ঘুমাবে, বিবি বাচ্চার সাথে একটু সময় কাটাবে, তা হলেই তো তারা কাজে আনন্দ পাবে। একসময়ে সাদা চামড়ার মানুষও ভাবতো, কালো চামড়ার মানুষদের সৃষ্টিই করা হয়েছে সাদাদের গোলামী করার জন্য। কিন্তু সেই পুরনো অসভ্য বর্বর ধারণাকে আমরা ত্যাগ করেছি। আপনারও উচিত সেইসব মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণা থেকে বের হয়ে আসা।
– দেখ আসিফ, এইসব আস্তে বল। ফেরেশতারা শুনতে পেলে তারা না আবার বিদ্রোহ করে বসে।
– তা তো করাই উচিত। অনন্তকাল এদের সেবা আপনি নিয়েছেন, এবারে এদের একটু নিজের ইচ্ছামত স্বাধীন জীবন যাপন করতে দিন না!
– পরের প্রশ্ন করো। চুপ থাক।
– আচ্ছা, ঠিক আছে। এরপরে জিজ্ঞেসা হচ্ছে, আপনি শুনেছি জ্বীন জাতিকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, নাকি?
– হ্যা, ঠিকই শুনেছো।
– কিন্তু আগুন তো কোন পদার্থ না, যে তা দিয়ে কিছু সৃষ্টি করা যায়। আগুন হচ্ছে জাস্ট একটা ক্যামিকেল রিয়্যাকশন। সেটা তো আলাদা কোন পদার্থ বিশেষ না।
– তোর কাছে আমার বিজ্ঞান শিখতে হবে?
– আপনি রাজনৈতিক নেতাদের মতই প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন। আচ্ছা, তাহলে পরের প্রশ্ন। শয়তান আপনাকে এত লক্ষ কোটি বছর উপাসনা করলো, তার বিনিময়ে আপনি তাকে এতোবড় শাস্তি কেন দিলেন?
– শয়তান আমার হুকুম পালন করে নি।
-কিন্তু ছোট্ট একটা হুকুম পালন করে নি, সেটা হচ্ছে আদমকে সিজদা না করা। এখন আপনিই বলেন, আমার চাইতে বয়সে ছোট কাউকে এনে যদি আমাকে বলেন, ওকে সিজদা করো, আমি তো কখনই তা করবো না। শয়তানকে তো আমার মনে হয়েছে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন উন্নত চরিত্রের ভদ্রলোক। কাল আপনি বালছাল কাকে না কাকে ধরে আনবেন আর আমার তাঁকে সিজদা করতে হবে নাকি? এটা কী সম্ভব?
-আমি যা হুকুম দেবো সেটাই পালন করতে হবে! এখানে কোন বিচার বিবেচনার সাথেন নেই।
-বাহ, এটা কেমন কথা হলো। বিচার বিবেচনাই যদি না করি, তাহলে আমরা রোবটের চাইতে উন্নত কীভাবে? মগজ খাটানো আপনার এত অপছন্দ কেন?
– পরের প্রশ্ন কর।
– আপনি কোন প্রশ্নেরই ঠিকঠাক জবাব দিচ্ছেন না। আচ্ছা যাই হোক, এবারে বলুন, আদমকে আপনি কী দিয়ে বানালেন?
– সেটা তো কোরানেই লিখে দিয়েছি। মাটি দিয়ে।
– আল্লাহ, আমাকে কী আপনি গর্দভ পেয়েছেন? মাটির ক্যামিকেল এলিমেন্ট আর মানব দেহের ক্যামিকেল এলিমেন্ট এক হলো? কীসের সাথে কী? মানে মামদোবাজির তো একটা সীমা আছে নাকি?
– বেয়াদব, তুই তো এগুলো বিশ্বাস করবিই না।
– আচ্ছা, তাও মানলাম। আপনি আদম হাওয়াকে বানালেন। আদম হাওয়ার ছেলেপেলে হলো। কিন্তু তাদের বংশ বিস্তার কীভাবে হলো? ভাই বোন ছেলে মা এদের যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে?
– তখনকার দিনে এইসব জায়েজ ছিল।
– মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি সময়ে সময়ে আপনার বেঁধে দেয়া নিয়ম পাল্টান? মানে প্রাচীন কালের জন্য এক নিয়ম, আধুনিক সময়ের জন্য আরেক নিয়ম?
এই প্রশ্নটা করতেই, অবাক কাণ্ড, দেখলাম ইসলাম ধর্মের মহানবী হযরত মুহাম্মদ এবং খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যীশু খ্রিস্ট গলাগলি করে আল্লাহর আরশে প্রবেশ করলেন। তাদের একসাথে গলাগলি করে ঢুকতে দেখেই আমি মূর্ছা গেলাম।

Sunday, May 21, 2017

ইয়েজিদিদের উৎস সন্ধানে ১, ২

লিখেছেন

লেখক: সায়ন দেবনাথ
২০১৪ সাল থেকে পশ্চিম এশিয়ার ইরাকে ইয়েজিদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এর পরিকল্পনামাফিক গণহত্যা, এই রহস্যাবৃত ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বিশ্বের নজরে এনে দেয়।ইরাকে ইসলামের বিজয়রথ প্রবেশের পর থেকেই সুপ্রাচীন এই মূর্তিপূজক গোষ্ঠী অসংখ্য গণহত্যার শিকার হয়েছে। আসলে পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য পৌত্তলিক ধর্মগুলিকে ইসলাম সমূলে উৎপাটিত করতে সক্ষম হলেও, ইয়েজিদিরা সম্পূর্ণভাবে কোনদিন তাদের বশ্যতা স্বীকার করেনি আর এটাই ইসলামিক ইরাকের কাছে অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়।তাই বারবার ইয়েজিদিদের ওপর আঘাত নেমে এসেছে;কখনও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আবার কখনও ধর্মগুরুদের মাধ্যমে।
অটোমান সাম্রাজ্যের কাল থেকে হালফিলের সাদ্দাম হুসেনের আমল কখনই ইয়েজিদি নির্যাতনে ছেদ পড়েনি। সাদ্দাম হুসেনের সময়কালে ইয়েজিদিরা বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। সাদ্দামের সময় কুর্দ জনজাতি স্বাধীন ‘কুর্দিস্তান’এর দাবীতে আন্দোলন শুরু করেছিল এবং বহু সংখ্যক ইয়েজিদির বাস ছিল এই কুর্দিস্তানে। তাই স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে প্রতিহত করার যুক্তিতে সাদ্দামের সরকার বিপুল সংখ্যক ইয়েজিদিদের উৎখাত করেছিল ও পরবর্তীতে তাদের সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘খাতানিয়া’ নামক হাউসিং কমপ্লেক্সে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। ফলে এই সম্প্রদায় সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য হয়। সবচেয়ে বিস্ময়কর দিকটি হল যে ইয়েজিদিরা কখনই নিজেদের কুর্দ রূপে পরিচয় দেয় না এবং প্রতিবেশী ইসলাম ধর্মালম্বী কুর্দদের থেকে তারা যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখে। সর্বোপরি এই বিচ্ছিন্নতাকামী আন্দোলনে ইয়েজিদিরা ছিল নিরপেক্ষ। আসলে ইয়েজিদিদের জীবন-যাপন সরকারী নিয়ন্ত্রনে আনার মাধ্যমে তাদেরকে ইসলামে দীক্ষিত করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল,যা একদমই ফলপ্রসূ হয়নি।
ইয়েজিদি ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে তার মোট বাহাত্তরটি গণহত্যার শিকার হয়েছে। তবে তীব্র ইসলামিক আগ্রাসন সত্ত্বেও ইয়েজিদিরা উত্তর ইরাক,সিরিয়া ও আর্মেনিয়ার কিছু অংশ এবং উত্তর পশ্চিম ইরানে নিজেদের স্বকীয়তা যুগ যুগ ধরে বজায় রেখেছে। সাম্প্রতিক কালে ইয়েজিদিদের প্রতি ইসলামিক স্টেটের নৃশংসতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।নীল চোখের ইয়েজিদি মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে আই এস মহলে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সম্প্রতি মসুলে প্রকাশ্য রাস্তায় উনিশ জন ইয়েজিদি কিশোরীকে লোহার খাঁচায় বন্দী অবস্থায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হল। তাদের অপরাধ ছিল যে তারা জঙ্গিদের সাথে যৌনসংগমে সম্মত হয়নি। বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপিংসে প্রকাশিত ইয়েজিদি কিশোরী-মহিলাদের আর্ত চিৎকার বুঝিয়ে দেয় সুপ্রাচীন এই ধর্মীয় গোষ্ঠী এক ভয়ঙ্কর অস্তিত্বের সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।তাও ইয়েজিদিরা দলে দলে স্বভূমি পরিত্যাগ করে ইউরোপে পাড়ি জমায় নি।বরং নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করেই ঐতিহ্যমণ্ডিত উপাসনাস্থল গুলিকে রক্ষা করা চলেছে।আর তাদের এই দৃঢ় মনোভাবই আই এস কে আরও নৃশংস করে তুলেছে। বন্দুকের নলের সামনে বসিয়ে আই এস তাদেরকে ইসলাম কবুল করাতে পারেনি, তাই সহস্রাধিক ইয়েজিদিকে গনকবরের গহীন অন্ধকারে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়তে হয়েছে।
ইরাকের উত্তরাঞ্চলের লালিশ শহরে ইয়েজিদিদের একমাত্র এবং প্রধান প্রার্থনা কেন্দ্র। ছবি: রয়টার্স
ইরাকের উত্তরাঞ্চলের লালিশ শহরে ইয়েজিদিদের একমাত্র এবং প্রধান প্রার্থনা কেন্দ্র। ছবি: রয়টার্স
ইয়েজিদিদের ইতিহাস আজও রহস্যাবৃত। তবে এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে,তারা এক সুপ্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। জার্মান গবেষক Philip Kreyenbroek এর মত অনেকেই মনে করেন যে, ইয়েজিদিদের ধর্মীয় বিশ্বাস অত্যন্ত প্রাচীন।তবে বহুকাল যাবত এই সম্প্রদায় সম্পর্কে একটি ভুল ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে,তা হল ইয়েজিদিরা হচ্ছে ‘শয়তানের পূজারী’। ইসলামে শয়তানের ধারনা রয়েছে,যা ইবলিশ হিসেবে খ্যাত। ইসলামীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইবলিশ হল পতিত স্বর্গীয় পুরুষ,কারন সে আল্লাহের আদেশ অগ্রাহ্য করেছিল। একই ভাবে ইয়েজিদিদের ধর্মীয় বিশ্বাসে এক সর্ব শক্তিমানের কল্পনা করা হয়েছেএবং সমগ্র বিশ্বব্যাপী তাঁর অবস্থান।ইয়েজিদিদের শ্রুতি ঐতিহ্যে বিশ্ব সৃষ্টির যে বর্ণনা রয়েছে তা আবার বাইবেলের সাথেও সাযুজ্যপূর্ণ। তাঁরা বিশ্বাস করে যে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বিশ্ব সৃষ্টির পর তাঁর দূত রূপে ‘তাওসি মেলেক’কে প্রেরন করেন এবং পরবর্তীতে তাঁকে সহায়তা করার আরও ছয় জন দুতকে প্রেরন করা হয়। অধুনা উত্তর ইরাকের অন্তর্গত নিনেভ প্রদেশের সিঞ্জার পর্বতে ‘তাওসি মেলেক’ এক অপূর্ব সুন্দর ময়ূর রূপে অবতরণ করেন ও নিজের সাতটি রঙের রুপান্তর ঘটিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের সৃষ্টি করেন।তবে এরপর তাওসি মেলেক ঈশ্বরের আদেশ অগ্রাহ্য করলে, ঈশ্বর তাঁকে নরকে নিক্ষেপ করে আগুনের কারাগারে বন্দী রাখেন। পরে তাওসি মেলেক গভীর অনুতপ্ত হন ও শেষ পর্যন্ত তাঁর অশ্রুবিসর্জনে আগুন নিভে যায়।পরবর্তীতে ঈশ্বর পুনরায় তাঁকে পৃথিবীতে বাকি ছয় দেবদূতের প্রধান রূপে প্রেরন করেন। ইয়েজিদিরা বিশ্বাস করে যে একজন মানুষের মধ্যে তাওসি মেলেকের মত শুভ-অশুভ এই দুই সত্ত্বারই অস্তিত্ব থাকে।আসলে মানুষকে প্রকৃত শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই সে দুই প্রকার রূপ ধারন করেছিল। তবে বিধর্মী মুসলিমরা সর্বশক্তিমানের আদেশ অমান্য করায় তাওসি মেলেক’কে শয়তান বলেই গণ্য করে আর এই কারনেই ইয়েজিদিরা শয়তানের পূজারী।
ইয়েজিদিদের শ্রুতি ঐতিহ্যের সাথে বাইবেলের বেশ কিছু সামঞ্জস্য রয়েছে।যেমন ইয়েজিদি লোকগাঁথায় এডেন উদ্যানের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া আদম ও ইভের প্রসঙ্গ দুই ধর্মেই রয়েছে।সর্বোপরি পতিত দেবদূতের কথাও উভয় দর্শনে রয়েছে। একসময় খৃষ্টান মিশনারিরাও ইয়েজিদিদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেই প্রয়াসও খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। এরপরই মিশনারিরা ইয়েজিদিদের মতাদর্শকে কার্যত নস্যাৎ করে দিয়ে খ্রিস্টীয় মতের অংশ রূপে অভিহিত করেন। পাশাপাশি মুসলিমদের ন্যায় তাঁরাও ইয়েজিদিদের শয়তানের পূজারী রূপে অভিহিত করতে শুরু করে এবং খৃস্ট ধর্মের পতিত দেবদূত লুসিফারের সাথে তাওসি মেলেকের তুলনা করা হয়। এই সংকীর্ণ মানসিকতাই পরবর্তীকালে পশ্চিমী ঐতিহাসিকদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। কারন তাঁরা ইয়েজিদি ইতিহাস রচনার প্রেক্ষিতে খ্রিস্টীয় চেতনায় অনুপ্রানিত হয়ে প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করে ফেলছেন। এদের মধ্যে অনেকেই আবার নিজেদের মন মত করে দুই খণ্ডে বিভক্ত ইয়েজিদি ধর্মগ্রন্থ সংকলন করে ফেলেন, যেখানে পদে পদে এই স্বকীয় বিশ্বাসকে হেয় করে বাইবেলের শ্রেষ্ঠত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে জার্মান ঐতিহাসিকরা প্রায় নিরপেক্ষভাবেই এই প্রাচীন মূর্তিপূজারী গোষ্ঠীর ইতিহাস তুলে ধরেছেন,তা স্বীকার করতেই হবে।
দীর্ঘকাল ব্যাপী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও ইয়েজিদিরা নিজদের অতীত ঐতিহ্যকে তেমনভবে ক্ষুণ্ণ হতে দেয়নি।ইয়েজিদি শ্রুতি অনুযায়ী তাঁরাই সর্বপ্রথম এডেন উদ্যানে আবির্ভূত হয়েছিল। উত্তর ইরাকের লালিশ নামক এক সুন্দর পাহাড়ঘেরা গ্রামে ইয়েজিদিদের প্রধান মন্দির অবস্থিত। তাঁরা বিশ্বাস করে যে লালিশ ও তাঁর সন্নিবিষ্ট অঞ্চলেই একসময় এডেন উদ্যানের অস্তিত্ব ছিল। লালিশের মন্দির নিয়েও প্রচুর ধোঁয়াশা রয়েছে। দ্বাদশ শতকের প্রাক্কালে শেখ আদি বিন মুসাফির নামক একজন সুফি সন্ত ইয়েজিদি দর্শনকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। অনেকের মতে,তিনি আবার ছিলেন উম্মায়েদ খলিফা মারওয়ান ইবন আল হাকামের বংশধর। মুসাফির ইয়েজিদিদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তিনি ইয়েজিদিদের ধর্মীয় পরিকাঠামোর বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেছিলেন।তাই তাঁকে তাওসি মেলেকের অবতার হিসেবে গণ্য করা হয় এবং লালিশের মন্দিরে মুসাফিরের সমাধি রয়েছে। এবার সমস্যা শুরু হল এখান থেকে,কারন ইসলামীয় ধর্মগুরুরা লালিশের মন্দিরের প্রাচীনত্ব নস্যাৎ করে দেন এবং এই মতাদর্শকে ইসলামের বিপথগামী শাখা রূপে উল্লেখ করতে থাকেন।অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইয়েজিদি মতাদর্শে সুফি মতের কিছুটা প্রভাব রয়েছে। তবে কখনই ইয়েজিদিদের ইসলামের শাখা হিসেবে গণ্য করা যায় না এবং ইসলামের চেয়েও এই মতাদর্শ অনেক প্রাচীন। নিছক সাদৃশ্যের প্রেক্ষিতে যারা ইসলাম ও ইয়েজিদি দর্শনকে সমজাতীয় রূপে গণ্য করেন,তাদের আদতে পশ্চিম এশিয়ার প্রাচীন ধর্মমত গুলি সম্পর্কে তেমন ধারনা নেই। কারন খ্রিস্টীয় মতাদর্শের ন্যায় ইসলামও তাঁর প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কালে, আরব অঞ্চলের প্রাচীন বহু দেব-দেবী কেন্দ্রিক ধর্মগুলিকে যেমন বলপূর্বক উৎখাত করেছিল তেমনই সেগুলি থেকে বেশ কিছু উপাদান সংগ্রহ করেছিল। বর্তমানে ইসলামে রোজা পালনের যে রীতি রয়েছে, ঠিক প্রায় একই প্রকার উপবাস পদ্ধতি ইসলামের আবির্ভাবের বহুকাল আগে থেকেই মূর্তিপূজারী প্রাচীন আরবীয়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল।তাই ইয়েজিদি মতের বেশ কিছু যে ইসলাম অনুকরণ করেছে এমনও হতে পারে। কারন ইয়েজিদিরা দিনে মোট পাঁচবার প্রার্থনা করে।এর মধ্যে চারবার সূর্যের প্রতি ও মধ্যাহ্নকালীন প্রার্থনা লালিশের দিকে মুখ করে সম্পন্ন হয়।সর্বোপরি তাঁরা যেখানেই থাকুন না কেন,জীবনে অন্তত একবার লালিশে তীর্থ করতে আসতেই হয়। এখানেই ইসলাম বর্ণিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ,মক্কার প্রতি মুখ করে প্রার্থনা ও জীবনে একবার হজে যাওয়ার বিষয়টির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তবে পশ্চিম এশিয়ায় ইসলাম বিজয়ের পর নতুন কোন মূর্তি পূজক গোষ্ঠীর উদ্ভব হবে, একথা কল্পনাতেও আনতে বেশ কষ্ট হয়। সুতরাং ইসলামের চেয়ে ইয়েজিদিদের প্রাচীনত্বের বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই।
ইয়েজিদি ধর্মীয় দর্শন যূথবদ্ধ হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলামের কোন প্রভাবই ছিল না বরং প্রাচীন মেসোপটেমীয় ও ইরানীয় ধর্মের অনেকখানি প্রভাব ছিল।কারন মেসোপটেমিয়ার এরেডু নগরীর মুখ্য দেবতা ‘এনকি’র সাথেও ময়ূরের সংযোগ লক্ষ্য করা যায়।এছাড়া প্রাচীন মেসোপটেমীয় ধর্মের বেশ কিছু রীতি আজও ইয়েজিদিদের মধ্যে প্রচলিত আছে প্রায় অপরিবর্তিত রূপে। অনেকেই মনে করেন যে ইরানীয় ‘ইয়াজাতা’(স্বর্গীয় সত্ত্বা) শব্দ থেকে ‘ইয়েজিদি’ শব্দের উতপত্তি হয়েছে।তাঁরা বিশ্বাস করে যে পূর্বে সমস্ত কুর্দরা ইয়েজিদি ছিল। তবে কুরমাঞ্জি উপভাষা ব্যবহারকারী ইয়েজিদিরা কত প্রাচীন- এই প্রশ্নের সমাধান আজও হয়নি।তবে এই বিষয়ে বেশ কিছু যৌক্তিক অনুমান করা যেতে পারে।বেশিরভাগ গবেষকই ইয়েজিদিদের সাথে খৃষ্টান ও মুসলিমদের সাদৃশ্য সন্ধান করতে গিয়ে একটি বিশেষ দিক তাঁরা এড়িয়ে গেছেন।সেটা হল,ইয়েজিদিরা তাওসি মেলেকের প্রতিরুপ হিসেবে যে ময়ূরের উপাসনা করে তা আদৌ প্রাকৃতিক ভাবে ইরাকে কেন, পশ্চিম এশিয়াতেই পাওয়া যায় না। এমন এক পক্ষী যা ওই অঞ্চলে পাওয়াই যায় না,তা কি ভাবে সেখানকার এক ধর্মীয়গোষ্ঠীর প্রধান উপাস্যে পরিণত হল, এর সমাধান কেউ করেননি। এবার যদি প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার ওপর নজর দেওয়া যায়, তাহলে বোধহয় এই ময়ূর সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। হরপ্পার সাথে যে ইরাক তথা প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সংযোগ ছিল, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। মেসোপটেমিয়ার অক্কাদীয় রাজা সারগনের সময় মেলুহের সাথে বানিজ্য চলত এবং বিভিন্ন মূল্যবান দ্রব্যাদির পাশাপাশি ময়ূর আমদানি করা হত। এই মেলুহ হল নিম্ন সিন্ধ উপত্যকা ও সিন্ধ বদ্বীপ অঞ্চল।আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় ময়ূরের যে বিপুল কদর ছিল,তাঁর প্রমান পরবর্তীতেও পাওয়া যায়।ভারতে আগমনের পর গ্রিক রাজা আলেকজান্ডার ময়ূরের সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলেন এবং তিনি ভারতীয় ময়ূর ম্যাসিডোনিয়ায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।গ্রিক দেবী হেরার সাথে ময়ূরের যে সম্পৃক্তকরন লক্ষ্য করা যায়,তা আসলে ভারত থেকে গ্রিসে ময়ূর আমদানীর প্রমান বহন করে। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট অধ্যায় থেকেও ভারতীয় ময়ূরের চাহিদার কথা জানা যায় এবং রাজা সলোমন ভারতীয় ময়ূরের বিশেষ ভক্ত ছিলেন- এই তথ্যও পাওয়া যায়। সুতরাং প্রাচীন ভারতের সাথে ইয়েজিদি সম্প্রদায়ের যোগাযোগের বিষয়টি বেশ স্পষ্ট। হরপ্পার বেশ কিছু মৃৎপাত্রে ময়ূরের চিত্র পাওয়া গেছে।এর মধ্যে একটিতে দেখা যায় যে,একটি ময়ূর এক ক্ষুদ্র মনুষ্য দেহকে সাথে নিয়ে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে উড়ে যাচ্ছে।আপাত সাধারণ এই ছবিটির ধর্মীয় প্রেক্ষিতে ব্যাপক ব্যঞ্জনা আছে। ময়ূরকে এখানে স্বর্গে উত্তরণের মাধ্যম হিসেবে দেখানো হয়েছে বলাই যেতে পারে। যদি ‘আলোকময় জগৎ’কে স্বর্গ রূপে অভিহিত করার বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত থাকে,তাহলে একে জ্ঞানের প্রতীক রূপে অভিহিত করাই যেতে পারে। অন্যদিকে ইয়েজিদিরা তো বিশ্বাস করে যে ময়ূররুপী তাওসি মেলেক মানুষের মন থেকে অজ্ঞানতা দূরীভূত করে তাকে জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত করে।পুনরায় ভারত-ইয়েজিদি সম্পর্কের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হচ্ছে বলেই মনে হয়।
প্রাচীন ভারতের সাথে পশ্চিম এশীয় এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর সংযোগকে উস্কে দেয় তাদের শ্রুতি ঐতিহ্য। এরা বিশ্বাস করে যে,তাদের আধ্যাত্মিক অবক্ষয়ের কারনে বিশ্বে কয়েকটি ভয়ঙ্কর প্লাবন সংগঠিত হয় এবং শেষ প্লাবনটি হয়েছিল আজ থেকে ছয় হাজার বছর পূর্বে ও তার ফলে তাঁরা ইরাক পরিত্যাগ করে অধুনা আফগানিস্তান,ভারত ও উত্তর আফ্রিকায় এসে বসতি স্থাপন করে। এরপর প্রায় দু হাজার বছর পূর্বে তারা পুনরায় নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে মেসোপটেমীয় সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।অর্থাৎ এখান থেকে ভারতের সাথে তাদের যোগাযোগের বিষয়টি আবার সামনে চলে আসছে।ইয়েজিদি ক্যালেন্ডারের হিসবে বর্তমানে পৃথিবীতে ৬৭৬৫ সাল চলছে।ইয়েজিদি শ্রুতির সাথে যদি এই ক্যালেন্ডারের সামঞ্জস্য বিধান করি,তাহলে দেখা যায় ভারত থেকে তাঁরা ৪০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ চলে গিয়েছিল অর্থাৎ তখনও হরপ্পা সভ্যতা প্রাথমিক স্তরে রয়েছে।তাহলে হয়ত হরপ্পা সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ের বিকাশে এই গোষ্ঠীর কোন অবদান থাকতে পারে।কারন হরপ্পা ও মেসোপটেমিয়ার বস্তুগত প্রেক্ষিতে বেশ সাযুজ্য রয়েছে। মনে রাখতে হবে যে মেহেড়গর সভ্যতার দ্বিতীয় পর্বে প্রায় ৫০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে কুমোরের চাকায় নির্মিত যে মৃৎপাত্রের অবশেষ পাওয়া গেছে,সেই প্রযুক্তি নিশ্চিত ভাবে পশ্চিম এশিয়া থেকেই এসেছিল।সুতরাং প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার বিকাশে পশ্চিম এশিয়ার অবদান বেশ স্পষ্ট।
ভারতীয় ইতিহাসের অঙ্গনে ‘অশ্ব’ কে কেন্দ্র করে যে পরিমাণ বিতর্ক হয়েছে,আর অন্য কোন প্রাণীকে নিয়ে এত কাঁটাছেঁড়া হয়নি।হরপ্পাবাসীরা আর্য না দ্রাবিড়ীয় তা নিয়ে বিতর্ক করতে গিয়ে,হরপ্পায় অশ্বের অবশেষ পাওয়া গেছে কিনা বা তা কত প্রাচীন এই নিয়েই আমরা ব্যস্ত থেকেছি। যদিও ময়ূর যে প্রাচীন ভারতীয় ধর্মীয় কাঠামোয় সর্বদা সম্পৃক্ত ছিল এবং কেন ময়ূরের এই সার্বজনীন জনপ্রিয়তা তা নিয়ে বিশেষ আলোকপাত হয়নি। অন্যদিকে হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল,সেখানকার অধিবাসী,ধর্ম সমস্ত কিছু নিয়েই বিতর্ক আছে এবং এই সব বিষয়ে কোন দৃঢ় সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় নি।সুদূর দক্ষিন ভারতের তামিল ভাষার উপভাষা ব্রাহুই কি ভাবে অধুনা পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে প্রচলিত রয়েছে ,সে সম্পর্কে প্রবল ধোঁয়াশা রয়েছে।এই কারনেই অনেকে আবার হরপ্পার অধিবাসীদের তামিলদের পূর্বপুরুষ রূপে মনে করেন।এখানে আবার একটা গোলমেলে বিষয় আছে, তা হল তামিলদের প্রধান দেবতা মুরুগান-এর উৎপত্তি কাল আজও অজানা।তবে মুরুগানের উপাসনা যে বহু প্রাচীন তা মেনে নিতেই হয়। মুরুগানের বাহন হল ময়ূর এবং মুরুগান কেন্দ্রিক প্রত্নকথায় ময়ূরের বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাহলে ইয়েজিদিদের তাওসি মেলেকের প্রভাব কি ভারতীয় মুরুগানের ওপর পড়েছিল না মুরগান ইয়েজিদি ধর্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করেছিল-এই বিষয়টিও তেমন স্পষ্ট নয়।বিষয়টি আরও জটিল হয়ে যাবে যদি পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের চিত্রল জেলার পার্বত্য উপত্যকায় ‘কলশ’ উপজাতির প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করা হয়।কলশ-রা বহুদিন দিন ধরে দাবী করত যে তাঁরা আলেকজান্ডারের সময় ভারতে আগত গ্রিক সেনাদের বংশধর।যদিও সাম্প্রতিক জিনগত গবেষণা বিষয়টিকে নস্যাৎ করে দিয়েছে।সর্বোপরি সুন্নি প্রধান পাকিস্তানে হাজার চারেক জনসমষ্টির এই উপজাতি যে ধর্মীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে,তা বৈদিক ক্রিয়াকলাপের সাথে সমজাতীয়।দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে এই উপজাতির যে কাষ্ঠ নির্মিত মন্দির রয়েছে,সেখানে মন্দির গাত্রের সম্মুখে ময়ূরের প্রতিকৃতি খোদাই করা রয়েছে।কলশদের প্রাচীনত্ব নির্ণয় এখনও সম্ভব হয়নি।তবে তাঁরা যে রীতি-নীতি অনুসরণ করে তা যে বহু পুরনো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।সর্বোপরি কলশদের গাত্রবর্ণের সাথে ইয়েজিদিদের বেশ মিল রয়েছে।তামিলদের মধ্যে মুরুগানের বিপুল জনপ্রিয়তা ও তাঁর সাথে ময়ূরের সংযোগ এবং ইয়েজিদিদের সাথে ভারতের সম্পর্ক ও তাঁদের ধর্মীয় দর্শনে ময়ূরের উচ্চ অবস্থান এই দুই জাতির মধ্যে এক আপাত সামঞ্জস্যের ইঙ্গিত বহন করে।তবে এদেশীয় তামিলদের পূর্ব পুরুষরাই প্রাচীন ইরাকে বসতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইয়েজিদি বিশ্বাসের সৃষ্টি করেছিল কিনা,তা নিয়ে এখনই কোন নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না।
ইয়েজিদিদের উৎস সংক্রান্ত বিতর্ক আরও জটিল হয়ে যায় যখন আর্যদের ধর্মীয় কাঠামোয় ময়ূরের গুরুত্বের প্রতিফলন পাওয়া যায়।হিত্তি ও মিত্তানিদের মধ্যে সম্পাদিত যে চুক্তির উল্লেখ আনাতোলিয়া বা তুরস্ক থেকে প্রাপ্ত ভোগসকাই লেখতে পাওয়া যায় সেখানে বৈদিক দেবতা ইন্দ্র,ব্রুন,মিত্র ও নাসাত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই নাসাত্য হল ঋগ্বেদীয় দুই যমজ ভাই অশ্বিন, যাদের উদ্দেশ্যে অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় ময়ূর উৎসর্গ করা হত।এছাড়া দেবরাজ ইন্দ্রের সবচেয়ে প্রিয় পাখি ছিল ময়ূর। হিত্তি ও মিত্তিদের যাদেরকে ভারতে আগত বৈদিক আর্যদের পূর্বপুরুষ রূপে গণ্য করা হয় তাঁদের মধ্যেও আবার ময়ূরের মোটিফ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।আবার হিত্তিরা মেসোপটেমিয়া থেকে লিখন পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল।১৯৯৪ সাল নাগাদ তুরস্কের গোবেকেলি টেপে অঞ্চলে জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক ক্লস স্মিথের নেতৃত্বে প্রায় আট হাজার বছরের প্রাচীন এক মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে।এই মন্দিরটি আবার তুরস্কের সানলিউরফা অঞ্চলের নিকটেই অবস্থিত এবং এই অঞ্চলে একদা ইয়েজিদিদের সংখ্যাধিক্য ছিল।প্রাচীন এই মন্দিরে সাপের প্রতিকৃতি পাওয়া গেছে।একই ভাবে লালিশে স্থিত ইয়েজিদি মন্দিরের প্রধান প্রবেশপথে সাপের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ রয়েছে।আবার বৈদিক দর্শন অনুসারে ময়ূর ও সাপের সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে ‘কালচক্র’ বোঝানো হয়।বর্তমান তুরস্ক বা প্রাচীন আনাতোলিয়ার সংস্কৃতি অনেকাংশেই ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃতির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ছিল। তাই অনেকেই বৈদিক আর্যদের প্রাচীন বসতিস্থল রূপে তুরস্ককে অভিহিত করেন।সামগ্রিকভাবে দেখা যায় যে,ইয়েজিদিদের সাথে প্রাচীন তুরস্কের সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।সুতরাং বৈদিক আর্যদের সাথে ইয়েজিদিদের সংযোগের ক্ষেত্রেও কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়।
ইয়েজিদিদের ধর্মীয় আচার পদ্ধতির সাথে বর্তমান হিন্দু সংস্কৃতির বেশ সামঞ্জস্য রয়েছে।উভয়েই পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসী এবং পবিত্র আগুনে আহূতি প্রদান করে।ইয়েজিদি মন্দির ও হিন্দু মন্দিরের গঠনগত কোন তফাতই প্রায় নেই। তাঁরা ময়ূর প্রতিকৃতি সম্বলিত যে প্রদীপ প্রজ্বলন করে তাঁর সাথেও হিন্দু বিশেষত তামিলদের মিল রয়েছে।ইয়েজিদি মন্দিরের দেওয়ালে এই ধরনের প্রদীপ প্রজ্বলন রত নারীর চিত্র অঙ্কিত রয়েছে,যিনি শাড়ী পরিহিতা।তবে এই চিত্র অনেক পরবর্তীকালীন বলেই মনে হয়।ইয়েজিদিদের ধর্মবিশ্বাস কার্যত বৈদিক ধর্ম ও আব্রাহামিক ধর্মগুলির মধ্যে এক সেতুবন্ধের ভূমিকা পালন করছে।ভারতীয় প্রেক্ষিতে বৈদিক আর্য ও দ্রাবিড়ীয় ধর্মমতের সাথে ইয়েজিদি দর্শনের উপাদানগত সাযুজ্য অত্যন্ত বিস্ময়কর।এছাড়া বৈদিক দেবতা কার্তিকেয় ও দ্রাবিড়ীয় দেবতা মুরুগানের সাথে ময়ূরের সম্পৃক্তকরণের বিষয়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।যদিও কার্তিকেয় ও মুরুগান দুজনেই সমজাতীয়,শুধুমাত্র অভিব্যক্তিজনিত পার্থক্য লক্ষণীয়।দর্শনগত প্রেক্ষিতে ইয়েজিদি ও প্রাচীন ভারতের সামঞ্জস্য নিয়ে কোন সন্দেহর অবকাশ নেই।অন্যদিকে কিছু কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগত মিলও উভয়ের রয়েছে।যদিও এই বিষয়ে এখনও বিশদ গবেষণার প্রয়োজন আছে। তবে একথা জোর দিয়েই বলা যায়, পশ্চিম এশীয় এই প্রাচীন মূর্তিপূজক গোষ্ঠীর উৎস সন্ধান করতে গেলে প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ একান্ত প্রয়োজনীয় এবং প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতির মধ্যে এদের উপস্থিতি নিশ্চয়ই আছে।সর্বোপরি ইয়েজিদিদের উৎস সংক্রান্ত প্রশ্নের সমাধান হলে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের যে সমাধান হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না;বিশেষত দীর্ঘকাল অব্যাহত আর্য-অনার্য বিতর্কের প্রেক্ষিতে যুক্তিগ্রাহ্য দিশা পাওয়াও সম্ভব হবে।
সায়ন দেবনাথ,এম ফিল,প্রথম বর্ষ,
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
যোগাযোগ-৭৮৯০৮৫৮২৪০
ই মেল- sayandebnathhistory@gmail.com
.
.
.
তথ্যসূত্রঃ
1. The Peacock Cult in Asia(Article)- P.Thankappan Nair
2. Devil worship; the sacred books and traditions of the Yezidiz-Isya Josep
3. Heirs to Forgotten Kingdoms: Journeys Into the Disappearing Religions of the Middle East- Gerard Russell
4.Land of seven rivers: History of India’s Geography- Sanjeev Sanyal
5.Peacock-Christine E. Jackson
6. Peacock in Indian Art Thought & Literature- Krishna Lal


ইয়েজিদিদের উৎস সন্ধানে,পর্ব-২

লিখেছেন
উত্তর ইরাকের নিনেভে বসবাসকারী ইয়েজিদিরা সম্ভবত এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ধর্মীয়গোষ্ঠী।রহস্যময় এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি নির্ণয় খুব একটা সহজসাধ্য নয়।তবে এটা নিশ্চিত যে,এরা আদৌ ইসলামের কোন উপগোষ্ঠী বা শাখা নয়।শেখ আদি বিন মুসাফির নামক একজন সুফি সন্ত যিনি দ্বাদশ শতকে ইয়েজিদি ধর্মমতের সংস্কার করেছিলেন,তাঁকে কেন্দ্র করে ইয়েজিদিদের অতীত ঐতিহ্যকে বারবার বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে।ইসলামী চিন্তাবিদরা ইয়েজিদিদের প্রাচীনত্বকে নস্যাৎ করে দিলেও,তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।ইয়েজিদিদের ধর্মবিশ্বাস কেবল ইসলাম নয় খ্রিস্টীয় এমনকি পার্সি ধর্মমতের তুলনায় অনেক প্রাচীন।আসলে পশ্চিম এশিয়ার এই প্রাচীন ধর্মমতটি যুগ যুগ ধরে অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিশ্বাসকে নিজের মধ্যে আত্তীকরণ করে নিয়েছে।ফলে এদের উৎস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এত জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।একদা ইসলামীয় আক্রমণের হাত থেকে লালিশের মন্দিরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বাধ্য হয়েই ইয়েজিদিরা মন্দিরের দেওয়ালে কোরানের কিছু বক্তব্য খোদাই করে দেয়।যদিও তাতে রেহাই মেলেনি বরং বারবার আক্রমন নেমে এসেছে।বর্তমানে লালিশে ইয়েজিদিদের যে মন্দিরটি রয়েছে তা আনুমানিক একশো বছর আগে নির্মিত।ইয়েজিদিরা বিশ্বাস করে যে,বহুকাল পূর্বে তাওসি মেলেকের সম্মানে লালিশের মন্দির নির্মিত হয়েছিল।লালিশের মন্দিরের প্রাচীনত্ব নির্ণয়ের জন্য জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিকরা ইরাক সরকারের কাছে বারবার আবেদন করলেও,তাতে সরকার কোন কর্ণপাত করেনি।অন্যদিকে ইয়েজিদিদের বেশ কিছু ধর্মীয় নেতা,যারা পশ্চিমী ডলারে পরিপুষ্ট তারাও বরাবর এর বিরোধিতায় সরব,কারন এর ফলে নাকি লালিশের পবিত্রতা বিনষ্ট হবে।
yazidi
প্রাচীনত্ব নির্ণয়ের সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত রীতি হল রেডিও কার্বন পদ্ধতি কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লালিশের মন্দিরের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগের সুযোগ হয়নি।তাই মূলত সাহিত্যসূত্রের ওপর নির্ভর করেই যুক্তিসম্মতভাবে ইয়েজিদিদের উৎস সন্ধান করতে হবে।এই প্রেক্ষিতে সবচেয়ে কার্যকরী হল জেন্দ আবেস্তা।জেন্দ আবেস্তায় আসলে জরাথুস্ত্রের মতাদর্শ বিবৃত রয়েছে।ইরানের প্রাচীন নাম ছিল পারস্য।তাই এই পারস্যের নামানুসারে জরাথুস্ত্র প্রবর্তিত ধর্মমত পার্সি নামে পরিচিতি লাভ করে।উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে,জরাথুস্ত্রের পূর্বেও ইরানে এক প্রাচীন ধর্মমতের অস্তিত্ব ছিল,যার প্রমান জেন্দ আবেস্তায় পাওয়া যায়।কারন জেন্দ আবেস্তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে,জরাথুস্ত্রের আবির্ভাবের পূর্বে ইরানে প্রচলিত ধর্মমত ছিল অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত।যীশুর জন্মের আনুমানিক আটশো বছর পূর্বে জরাথুস্ত্রের আগমন ঘটেছিল।যদিও আধুনিক গবেষকরা ৬২৮-৫৫১ খৃস্টপূর্বের মধ্যবর্তীকালে জরাথুস্ত্রের জীবনীকাল নির্ধারণ করেছেন।তিনি মূলত পারস্যের সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেটের সমসায়িক ছিলেন। জরাথুস্ত্রের পিতার নাম ছিল পৌরুশসপ ও মাতার নাম ছিল দুঘধোবা দেবী।যদিও আজ পর্যন্ত জরাথুস্ত্রের জন্ম ইরানের কোথায় হয়েছিল তা নির্ণয় করা যায় নি।তিরিশ বৎসর বয়সে তিনি পিতার গৃহ ত্যাগ করে জ্ঞানান্বষণে দেশপর্যটন এবং তারপর তপস্যায় মনোনিবেশ করেন।অতঃপর কঠোর সাধনার ফলে সাবাতন নামক পর্বতে তিনি আহুর মজদার কৃপা ও দিব্যজ্ঞান লাভ করেন।
জেন্দ আবেস্তায় জরাথুস্ত্র ঈশ্বরকে ‘আহুর মজদা’ রূপে উল্লেখ করেছেন।আদতে এই আহুর মজদা হলেন বৈদিক দেবতা বরুন।কিন্তু বরুনের সাথে ইন্দ্রের ঘনিষ্ঠতা থাকায় আবেস্তা থেকে বরুন নামটি বাদ দেয়া হয়।কারন আবেস্তা ইন্দ্রের তীব্র বিরোধী।আসলে জেন্দ আবেস্তা বরাবরই বেদের উল্টো সুর গাইতে অভ্যস্ত।তাই বেদে যেখানে ‘দেব’ শব্দটি শুভসত্ত্বার বাহক সেখানে আবেস্তায় ‘দেব’ নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের পরিচয়বাহী।আহুর ও অসুর এই দুটি শব্দ প্রায় সমজাতীয়।অসুর বৈদিক সাহিত্যে নিন্দিত হলেও আবেস্তায় তাঁর স্থান সর্বোচ্চে।আসলে বেদ ও আবেস্তার রচিয়তার একই গোষ্ঠীভুক্ত ছিল,তাই এই প্রকার সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।যদিও পরবর্তীতে কোন এক বিষয়ে মতভেদ হওয়ায় এই গোষ্ঠী ভেঙে যায় এবং ধর্মবিশ্বাসেও পার্থক্য দেখা দেয়।বর্তমানে যে জেন্দ আবেস্তা প্রচলিত রয়েছে তা অপেক্ষাকৃত নবীন, যা সাসানীয় সাম্রাজ্যের সময়কালে(২২৪-৬৫১)সংকলিত।যদিও জেন্দ আবেস্তায় এমন বেশ কিছু বিষয়বস্তু আছে যা প্রাচীন ইরানীয় ধর্মের সময়কালীন অর্থাৎ জরাথুস্ত্রেরও পূর্বকালীন।আবেস্তায় বেদের নানা বিষয় থাকলেও ইয়েজিদিদের বিষয়ে প্রতক্ষ্যভাবে কিচ্ছু বলা নেই কিন্তু পরোক্ষভাবে কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়।জেন্দ আবেস্তায় বিবৃত হয়েছে যে,আহুর মজদা শুভ শক্তি বা ‘স্পেন্তা মন্যু’ সৃষ্টি করেছিলেন।অন্যদিকে এর বিপরীত শক্তি ছিল অাহ্রিমন এবং এই দুই শক্তির সংঘর্ষের মাধ্যমে সভ্যতা এগিয়ে চলবে।সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হল আবেস্তায় বলা হয়েছে যে, এই অাহ্রিমন ময়ূর সৃষ্টি করেছিলেন এবং এই ময়ূর হল অত্যন্ত অলস ও কুৎসিত।সর্বোপরি এই ময়ূর কোন কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না।এবার একটু ইয়েজিদিদের সৃষ্টিতত্ত্ব দেখা যাক।এই তত্ত্ব অনুসারে তাওসি মেলেক সিঞ্জার পর্বতে অপূর্ব সুন্দর ময়ূর রূপে অবতীর্ণ হন এবং এই ময়ূর নিজের রঙের রূপান্তর ঘটিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের উদ্ভব ঘটান।এর থেকে সহজেই বোঝা যায় যে,পার্সিরা কার্যত ইয়েজিদিদের সৃষ্টিতত্ত্বকেই নস্যাৎ করে দিচ্ছে।আসলে বিরোধী মতাদর্শকে তখনই গুরুত্ব প্রদান করা হবে,যদি জনমানসে তাঁর জনপ্রিয়তা থাকে।ইয়েজিদি ক্যালেন্ডার যীশুর উদ্ভবকালের চেয়ে প্রায় চার হাজার বছরের প্রাচীন।এর থেকে একটা অনুমান করেই নেওয়া যায় যে,পশ্চিম এশিয়ার ধর্মীয় পরিমণ্ডলে ইয়েজিদিরাই প্রাচীনতম এবং এদের ধর্মমত একসময় অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল বলেই জেন্দ আবেস্তা তাঁদের সৃষ্টিতত্ত্বকে নস্যাৎ করে দিয়েছে।কেবলমাত্র ক্যালেন্ডার ই নয়,সাম্প্রতিক সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কারও পরোক্ষভাবে ইয়েজিদিদের প্রাচীনত্বের স্বপক্ষে কথা বলে।জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক ক্লস স্মিথ তুরস্কের গোবেকেলি টেপে থেকে প্রায় আট হাজার খৃস্টপূর্বাব্দের সমকালীন মন্দির আবিস্কার করেছেন।এই মন্দিরটি আবার তুরস্কের সানলিউরফা অঞ্চলের নিকটেই অবস্থিত এবং এই অঞ্চলে একদা ইয়েজিদিদের সংখ্যাধিক্য ছিল।এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম মন্দিরের নিদর্শন।এই মন্দিরের দেওয়ালে এক পক্ষী মানবের চিত্র খোদিত আছে,যার সাথে ময়ূরের পেখমের ব্যাপক মিল আছে।সর্বোপরি এই মন্দিরে সাপেরও প্রতিকৃতি পাওয়া গেছে এবং লালিশস্থিত ইয়েজিদি মন্দিরের প্রবেশদ্বারেও সাপের চিত্র উৎকীর্ণ রয়েছে।বিস্ময়কর দিকটি হল এই যে,সাপ পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার আর অন্য কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়।
এবার দক্ষিন ভারতীয় দেবতা মুরুগানের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করা যাক।তামিলনাড়ুতে বোধহয় এমন কোন গ্রাম নেই,যেখানে মুরুগানের মন্দির নেই।তামিল সংস্কৃতির সাথে মুরুগান ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।এখন মুরুগান কতটা প্রাচীন তা আজও রহস্যাবৃত।একদা ফাদার হেরাস হরপ্পার একটি সীলে’মুরুগান আদু’ নামে শব্দদ্বয়ের উল্লেখ রয়েছে বলে দাবী করেছিলেন।দুর্ভাগ্যের বিষয় যে আজ পর্যন্ত হরপ্পীয় ভাষার কোন সর্বজনগ্রাহ্য উদ্ধার সম্ভব হয়নি।ফলে হেরাসের এই বক্তব্য অনেকেই মানেননি।সর্বোপরি হরপ্পার নিকটস্থ বেলুচিস্তানে তামিলের উপভাষা ব্রাহুই কি ভাবে প্রচলিত হল তার উত্তরও অজানা।যদিও এর ভিত্তিতে হরপ্পার অনার্য প্রেক্ষিতের বিষয়টি বেশ জোরদার হয়ে ওঠে।মুরুগান যে বৈদিক সাহিত্যে বর্ণিত স্কন্দ কার্তিকের সমজাতীয় তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।মুশকিল হল যে কার্তিক না মুরুগান কে প্রাচীন?ঋগ্বেদে কোথাও কার্তিকের উল্লেখ পাওয়া যায় না।কেবলমাত্র ঋগ্বেদের একটি সুক্তে ‘মেজমেষ’ নামক একজনের তথ্য পাওয়া যায়,যিনি শিশুদের ক্ষতিসাধন করতেন।অন্যদিকে বৈদিক দেবতা কার্তিক আবার শিশুদের ক্ষতিসাধনকারী মাতৃকাদের সাথে সম্পৃক্ত।এর ভিত্তিতে অনেকেই মেজমেষ ও কার্তিককে সমজাতীয় রূপে অভিহিত করেছেন।আসলে বৈদিক সাহিত্যের বরাবরেরই প্রবণতা রয়েছে যে,অনার্য সংস্কৃতিকে হেয় করে তার আত্তীকরণ ঘটানো।এই ধারাপাত বহু পরবর্তীকালে রচিত পুরাণগুলিতেও দেখা যায়।যেমন বাংলা অঞ্চলে রচিত পুরাণগুলিতে একদিকে গৌতম বুদ্ধকে নেতিবাচক সত্ত্বার সাথে যুক্ত করা হয়েছে,আবার তাঁকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবেও গন্য করা হয়েছে।সুতরাং বৈদিক কার্তিক যে আসলে অনার্য দেবতা তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই।তাই কার্তিকের চরিত্রের প্রতি কালিমালেপনেও বৈদিক সাহিত্য কুণ্ঠাবোধ করেনি।কার্তিক সম্পর্কে দাবী করা হয়েছে যে,নারী সম্ভোগে ব্যাপক আসক্তি থাকায় মাতা পার্বতীর সাথে তাঁর মনোমালিন্য হয় এবং পরবর্তীকালে তিনি মহাযোগীতে রূপান্তরিত হন।
সর্বপ্রথম অথর্ববেদের ‘স্কন্দযাগ’ নামক অধ্যায়ে কার্তিক সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যায়।যদিও অথর্ব বেদকে আবার চতুর্বেদের অংশ হিসেবে গণ্য করতে বেশ অসুবিধাই হয়।কারণ এই বেদের বিষয়বস্তুর চরিত্র অন্য তিন বেদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।ইন্দ্রজাল,জাদুবিদ্যা ইত্যাদি হল অথর্ব বেদের মুখ্য বিষয়।পরবর্তীকালে রচিত ব্রাহ্মণ গুলিতে ব্রাহ্মণ্যসম্প্রদায়ের সাথে ঋগ্বেদ,সামবেদ ও যজুর্বেদকে সম্পর্কিত বলা হলেও কোথাও অথর্ববেদের উল্লেখ নেই।তাই অনেকেই অথর্ববেদকে অনার্য সংস্কৃতির ধারক হিসেবে মনে করেন।অথর্ববেদের রচনা বেশ পরবর্তীকালেরই এবং তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বৈদিক কার্তিকের ধারনা আসলে অনার্য মুরুগানের থেকেই এসেছিল।যদি ঋগ্বেদর মেজমেষই আবার কার্তিক হন তাহলে সেক্ষেত্রে বেশ সমস্যা রয়েছে।কারন যে সকল তামিল সাহিত্যে মুরুগানের উল্লেখ পাওয়া যায়,তা ঋগ্বেদের তুলনায় নবীন।মূলত তিনশো খৃস্টপূর্বাব্দে বিরচিত তামিল সঙ্গম সাহিত্যে মুরুগানের কথা পাওয়া যায়।কিন্তু এখানেও এক রহস্য আছে।সঙ্গম সাহিত্যে এক দেবতার কথা পাওয়া যায়,যার গাত্রবর্ণ ছিল রক্তাভ এবং তিনি নীল ময়ূরের ওপরে উপবিষ্ট থাকতেন।এই দেবতা মুরুগানের থেকেও প্রাচীন এবং এরই বিবর্তিত রূপ হল মুরুগান।অন্যদিকে মুরুগানের অনেকগুলি নামের মধ্যে অন্যতম একটি নাম হল-‘গুহন’,যা থেকে বোঝা যায় যে তিনি গুহাবাসীদের দেবতা ছিলেন।অতএব সঙ্গম সাহিত্যে বর্ণিত মুরুগানের উৎপত্তি যে আরও প্রাচীনকালে হয়েছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে যে,সমগ্র দক্ষিন ভারতীয় অঞ্চলে একদা তামিল ভাষার আদি রুপের প্রচলন ছিল এবং এর আনুমানিক সময়কাল ছিল প্রায় তিন হাজার খৃস্টপূর্বাব্দ।
অনার্য মুরুগান ও ইয়েজিদি তাওসি মেলেকের মধ্যে বাহ্যিক প্রেক্ষিতে ব্যাপক মিল আছে।আবার উভয়েরই প্রত্নকথায় ময়ূরের গভীর তাৎপর্য রয়েছে।শুধু তাই নয় সঙ্গম সাহিত্যে ‘মইল ইয়ঝ'(Mayil Yazh)নামক এক বাদ্যযন্ত্রের বিবরণ পাওয়া যায়,যার আকৃতি ময়ূরের মত।সর্বোপরি তামিল ভাষায় ময়ূরের আরেক নাম হল মইল।তাহলে কি এই’মইল’ থেকে ‘মেলেক’ শব্দটি এসেছে?এই বিষয়ে এখনই কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়।আরেকটি দিক হল যে,ইয়েজিদিরা কুর্দ জাতিভুক্ত এবং কুর্দ শব্দের অর্থ হল রক্তাভ বা লাল।আসলে কুর্দদের মুখমণ্ডলের রঙ অনেকটাই রক্তাভ।সঙ্গম সাহিত্যে আবার বিস্ময়কর ভাবে লাল বর্ণের দেবতার কথা পাওয়া যায়।আবার প্রাচীন তামিল শব্দভাণ্ডারে ‘কুরুধি’নামক একটি শব্দ পাওয়া যায়,যার অর্থ লাল।একই ভাবে কুরুধি থেকে কুর্দ শব্দটি আসতে পারে।তাহলে কি তামিলরা ইয়েজিদিদের থেকে প্রাচীন?একথার স্বপক্ষে প্রত্যক্ষ কোন প্রমান নেই,তবে পরোক্ষভাবে বেশ কিছু সূত্র পাওয়া যায়।একটা সময় পর্যন্ত মনে করা হত যে,দক্ষিন ভারতীয় সভ্যতা অপেক্ষাকৃত অনেক পরবর্তীকালীন।সব হিসেব নিকেশ গুলিয়ে দিল যখন তামিলনাড়ু থেকে হরপ্পার ন্যায় একটি সীল পাওয়া গেল।তাহলে কি সুদূর দক্ষিন ভারতেও সমসাময়িক কালে হরপ্পার ন্যায় কোন সভ্যতা ছিল?এই দাবির স্বপক্ষে এখনও কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমান না পাওয়া গেলেও বহু প্রাচীন তামিল প্রত্নকথা থেকে জানা যায় যে অধুনা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিপুল অংশজুড়ে এক সুপ্রাচীন উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল,যা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।এই সভ্যতকে’কুমারী কন্দম’নামে অভিহিত করা হয়েছে।বেশকিছু ভাষাতাত্ত্বিক মনে করেন যে,কুমারী শব্দটি আদতে তামিল ভাষা ও সংস্কৃতির বিশুদ্ধতাকে দ্যোতিত করে,যা পরে ইন্দো-আর্য ও সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে কলুষিত হয়েছিল।হরপ্পায় সোনা ব্যবহারের প্রমান পাওয়া গেছে এবং সোনার সম্ভাব্য উৎসক্ষেত্র হিসেবে দক্ষিনের রাজ্য কর্ণাটকের কোলার স্বর্ণখনিকে অভিহিত করা হয়েছে।এখন যদি সত্যি কোলার স্বর্ণখনি থেকেই হরপ্পায় সোনা যেত,তাহলে নিশ্চিত সেই সময় দক্ষিন ভারতেও কোন এক সভ্যতা ছিল,যা বহিরাঞ্চলের সাথে বানিজ্যে অভ্যস্ত ছিল।না হলে এমন তো কখনই সম্ভব নয় যে,দক্ষিন ভারতে তখন গহন বনাঞ্চল বিরাজমান অথবা দক্ষিন ভারতের মানুষগুলো উলঙ্গ হয়ে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় আর হরপ্পার লোকেরা এসে সোনা তুলে নিজেদের দেশে নিয়ে যায়।
ইয়েজিদিদের উৎস কোথায় নিহিত আছে- প্রাচীন ভারতে না পশ্চিম এশিয়ায়?এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কখনই খুব একটা সহজ নয়।বৈদিক সাহিত্যে ময়ূর হল ইন্দ্রের সবচেয়ে প্রিয়তম পক্ষী।আর এই ইন্দ্র আবার জেন্দ আবেস্তায় নিন্দিত হয়েছেন।পাশাপাশি আবেস্তাতে ময়ূরকে অশুভ শক্তি অাহ্রিমনের থেকে সৃষ্টি বলে দাবী করা হয়েছে।এখানে বেশ এক সমজাতীয়তা লক্ষ্য করা যায়।বৈদিক সাহিত্য ও ইয়েজিদি শ্রুতিকথা দুটি ক্ষেত্রেই ময়ূর ইতিবাচক আর আবেস্তা যেমন একদিকে বেদ বিরোধী তেমনই অন্যদিকে সেখানে ময়ূরের নিন্দা করেছে তাঁর আলস্য ও সৃষ্টিবিমুখতার কারনে।তাহলে কি এই ইয়েজিদিরা আদতে আর্যদের পূর্বপুরুষ?বিশেষত ঋগ্বেদের যে বিষয়বস্তু তাতে সর্বপ্রানবাদ বা অ্যানিমিজমের যেমন ধারনা পাওয়া যায় তেমনই মনুষ্যদেহ সম্বলিত ঈশ্বর বা অ্যানথ্রোপোমরফিজমের ধারনাও পাওয়া যায়।তবে বিস্ময়কর ভাবে ‘টোটেম’ ধারনার প্রতিফলন তেমন ভাবে এই বেদে নেই।টোটেম হল কোন প্রাণী বা কোন পক্ষী অথবা কোন ফল যাকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করে ঈশ্বর রূপে তাঁর আরাধনা করা।ইয়েজিদি তাওসি মেলেক যে আদতে এক টোটেম তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই,কারণ ইয়েজিদিরা ময়ূররূপী টোটেমকে পবিত্র রূপে গণ্য করে তার উপাসনা করে।তাহলে কি এমন এক পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল যেখানে ইয়েজিদিদের ধর্মীয় আদর্শ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে জেন্দ আবেস্তা পরোক্ষভাবে তাঁদের সৃষ্টিতত্ত্ব নস্যাৎ করে দিল এবং বেদে ময়ূরকে যুক্ত করে দেওয়া হল ইন্দ্রের সাথে,যিনি আবার আবেস্তাতে অত্যন্ত সমালোচিত চরিত্র।সর্বোপরি বেদও ইয়েজিদিদের সন্তর্পণে এড়িয়ে গেল কিন্তু ময়ূরকে যুক্ত করে দিল ইন্দ্রের সাথে অর্থাৎ সেই আত্তীকরণের নমুনা যা পাওয়া যায় কার্তিকের ক্ষেত্রে এবং বহু পরবর্তীকলে পৌরাণিক সাহিত্যে গৌতম বুদ্ধের ক্ষেত্রে।আসলে বেদ যে ময়ূরকে নিয়ে খুব একটা খুশি ছিল না তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।প্রাথমিক পর্বে ময়ূরকে কেন্দ্র করে বেদে কোন নেতিবাচক মানসিকতার প্রতিফলন পাওয়া না গেলেও প্রায় হাজার বছরের ব্যবধানে রচিত রামায়নে ময়ূরের প্রতি নিন্দাসূচক বক্তব্য পাওয়া যায়।রামায়নের কাহিনী অনুসারে ইন্দ্রের সাথে সাক্ষাতের পূর্বে ময়ূরকে দেখতে অত্যন্ত কুৎসিত ছিল এবং তার গলার স্বর ছিল অত্যন্ত কর্কশ।তাই ময়ূরের কোন গ্রহনযোগ্যতা ছিল না।একদা রাবন স্বর্গলোক আক্রমন করলে ইন্দ্র পলায়ন করেন এবং এইসময় তিনি ময়ূরের পেখমের পশ্চাতে লুকিয়ে রাবনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন।এরপর ময়ূর ইন্দ্রের নিকট বর প্রার্থনা করলে,ইন্দ্র ময়ূরকে এক অনিন্দ্য সুন্দর পক্ষীতে রূপান্তরিত করেন ও তাকে স্বর্গালোকে নিয়ে যান।অতএব বোঝাই যাচ্ছে যে,বিরোধিতার সুরটা আগে থেকেই লুকিয়ে ছিল যা পরে বৈদিক সভ্যতার পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতিতে প্রকাশিত হয়।একটা বিষয় স্পষ্ট যে,বেদ ময়ূরের বিরোধিতায় বেশ ভয় পেয়েছিল।কারন পার্সি ধর্মের প্রবক্তা জরাথুস্ত্র শেষ পর্যন্ত ময়ূরের জন্মদাতা অাহ্রিমনের অনুগামীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন।সুতরাং ময়ূর পূজারীদের বাহুবলী কার্যকলাপের আরও প্রাচীন নিদর্শন নিশ্চয়ই ছিল,যেগুলি সম্পর্কে বেদের রচয়িতারা জ্ঞাত ছিলেন।পরিশেষে এটুকুই বলব যে,ইয়েজিদিদের প্রাচীনত্ব নিয়ে কোন সন্দেহই নেই কিন্তু তাঁদের উৎস কোন অঞ্চলে হয়েছিল তা নির্ণয় এখনই সম্ভব নয় ,যতদিন না ইয়েজিদিদের বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে সরাসরি কোন সূত্র পাওয়া যাচ্ছে।
সায়ন দেবনাথ, এম ফিল, প্রথম বর্ষ
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

Sunday, May 14, 2017

আরজ আলী মাতুব্বরের চেতনায় নারী-১,২,৩,৪,৫


লিখেছেন গীতা দাস
আমরা, বাংলাদেশের পুরুষশাসিত সমাজের অধিবাসীরা মায়ের আবেগ সংরক্ষণে, মেয়ের অধিকার লালনে নিজেকে উজার করে দিতে পারি। বোনের বেলায় শৈশব, কৈশোর ও যৌবনে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক লালনে ও পালনে আবেগে মথিত হই, স্ত্রীর অধিকারে একটু রেখে ঢেকে নিজেকে উন্মুখ করি কিছুটা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে আর বেশির ভাগটা ধর্মীয় প্রথার সমর্থনে। আর মা, বোন, মেয়ে ও স্ত্রীর ছাড়া বাকী সব নারী সমাজ সভ্যতার আদি অবস্থানে থাকলেও উঃ আঃ করে নিজেকে আধুনিক হিসেবে প্রতিভাত ছাড়া কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ হাতেগোণা কয়েকজন বাঙালী পুরুষই নিয়েছেন। এ কয়েকজনের মধ্যে কি আরজ আলী মাতব্বর সাহেব পড়েন ? এরই অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁর লেখায় ইতিবাচিক সাড়াই পেয়ে আসছিলাম। কিন্তু! হ্যাঁ, আজ ‘কিন্তু’ দিয়ে শুরু করতে হচ্ছে।
একজন পুরুষ বিজ্ঞান মনস্ক,নাস্তিক, অলৌকিক শক্তিতে সন্দিহান,নারী অধিকারে বিশ্বাসী আর নারী মুক্তির জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ সমার্থক নয়।
আরজ আলী মাতুব্বর নারী মুক্তির জন্য কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি বলেই বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়। স্মরণিকা’ গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায় ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরী’ অংশে তিনি লামচারি গ্রামের শিক্ষিত লোকের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছেন যেখানে সাক্ষর বা স্বাক্ষর কিংবা শিক্ষিত নারীর কোন তথ্য নেই। ছেলে আর পুরুষদের তথ্য দিয়েই উপসংহার টেনেছেন যে “যদিও এ গ্রামের জনসংখ্যার অনুপাতে আলোচ্য সংখ্যাগুলো অতি নগণ্য, তথাপি আশাব্যঞ্জক এ জন্য যে, এ গ্রামের অন্তত স্থবিরতা দূর হচ্ছে।’’ এ গ্রামের নিরক্ষর — অশিক্ষিত নারী সমাজ যে জড় পদার্থের মত স্থবির হয়ে আছে তা কি তাঁর চিন্তা চেতনায় ঘা দেয়নি? এ নিয়ে তাঁর কোন আফসোস পর্যন্ত নেই! কোন প্রতিক্রিয়া নেই! বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবি রাখে বৈ কি।
১৯৮১ সালের ২৬ জানুয়ারি লামচারি গ্রামে লাইব্রেরী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বরিশালের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মহোদয় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রশাসনের লোক, সাংবাদিক, অধ্যক্ষ, অধ্যাপক মিলিয়ে আরও সাতজনের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন যেখানে কোন নারীর নাম ছিল না। কোন নারীকে যে রাখতে পারেননি, বা পাননি বা নিমন্ত্রণ পেয়ে আসেনি এমন কোন তথ্য এখানে নেই। এর অর্থ তো কি এই দাঁড়ায় যে এমন একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানে নারীর অনুপস্থিতি নিয়ে তাঁর মনে কোন রেখাপাত করেনি !
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের তিনি নিজ ভাষণে বলেছেন “ আজ আমার জীবন ধন্য হলো, তা দুটি কারণে। প্রথমটি হলো, জেলা প্রশাসক সাহেবের হাতে আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত ক্ষুদ্র লাইব্রেরীটির দ্বারোদঘটন দেখতে পেরে; দ্বিতীয়টি হলো আমার চিরপ্রিয় পাঠশালার প্রাণপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সুকোমল হস্তে সর্বপ্রথমবার বৃত্তিপ্রদান করতে পেরে।’’ এখানে একটূ খটকা আছে। যদিও বৃত্তিপ্রদান নিয়ে ছাত্রদের সাথে ছাত্রীদের কথাও উল্লেখ করেছেন, কিন্তু আগে পিছের তথ্য পর্যালোচনায় এমন ধারণা করা কি অমূলক হবে যে ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদানে তাঁর কোন উদ্যোগ বা পদক্ষেপ ছিল না? অহেতুক বা অসচেতনভাবে ছাত্রী শব্দটি যোগ হয়েছে! অথবা এটা কি জেলা প্রশাসনের নিজস্ব কোন পরিকল্পনার ফলাফল?যদিও এমন কোন তথ্য নেই।
আরজ আলী মাতুব্বর ঐ অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছেন, “করা হচ্ছে ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক বৃত্তিদানের ব্যবস্থা” — এ বৃত্তিতে ছাত্রীদের কোন কোটা বা এ বিষয়ক কোন কথাই বলেননি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় সচেতন ছিলেন যে দেশের অন্য সব ছাত্রদের সাথে ছাত্রীরাও আছে। যেমনঃ “দারিদ্র নিবন্ধন কোনো স্কুল-কলেছে গিয়ে পয়সা দিয়ে বিদ্যা কিনতে পারিনি আমি দেশের অন্যসব ছাত্র-ছাত্রীদের মতো।” অর্থাৎ অন্য এলাকার বিষয়টি এসেছে বাইরের স্বতঃস্ফূর্ত প্রভাবে। কারণ তাঁর কচিমন শিশু ছাত্রদের সাহচর্য প্রার্থী — ছাত্রী নয়। নিজেই তাঁর ভাষণে বলেছেন, “মনের সরলতায় আমি যে আজো একজন শিশু তা কেউ বুঝবে না,বোঝবার কথাও নয়। তাই আমি স্থির করেছি যে, ছাত্ররা আমাকে ভালোবাসুক আর না-ই বাসুক, আমি তাদের ভালোবাসবো। শৈশবকাল থেকেই আমার মনেবাসা বেঁধেছে পাঠশালাপ্রীতি ও ছাত্রপ্রীতি। ………… আর আমার সেই পাঠশালা ও ছাত্রপ্রীতির নিদর্শন হলো ’ছাত্রদের বৃত্তিদান” অর্থাৎ আরজ ফান্ড থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অনন্তকাল স্থায়ী প্রতিযোগিতামূলক বার্ষিক বৃত্তি প্রদান।” কিন্তু স্থায়ী ‘প্রতিযোগিতামূলক বার্ষিক বৃত্তি’ প্রদানে পিছিয়ে পড়া ছাত্রী সমাজের জন্য ন্যয্যতা (equity)ভিত্তিক বৃত্তি বিভাজন নিয়ে তার তেমন কোন উচ্চ বাচ্য নেই। অর্থাৎ মেয়ে শিশুর প্রতি কোন ইতিবাচক পক্ষপাতিত্ব নেই।
আরজ আলী মাতুব্বরের ভাষ্য অনুযায়ী লাইব্রেরী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে,“ অনুষ্ঠানের শেষপর্বে মাননীয় জেলা প্রশাসক সাহেব আমার পরিকল্পনা মোতাবেক উত্তর লামচরি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ লামচরি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালইয়ের ১৯৭৯ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী ছাত্র-ছাত্রীদের “আরজ ফান্ড’ থেকে মং ২০০.০০ টাকা বৃত্তিপ্রদান করেন। এ সময়ে উক্ত বিদ্যালয়ের ১৯৮০ সালের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেও তার ফলাফল প্রকাশিত না হওয়ায় উক্ত বৃত্তিদান স্থগিত থাকে।” আমাদের কাছেও ছাত্রী বিষয়ে, ব্যাখ্যা করে বললে নারী শিক্ষা বিষয়ে তাঁর মতামত ও তখনকার লমচরি গ্রামে নারী শিক্ষার অবস্থা ও নারীদের অবস্থান জানাও স্থগিত হয়ে যায়।
পরবর্তীতে ১৯৮০ সালের বৃত্তিপ্রদান অনুষ্ঠানে কে কে উপস্থিত ছিলেন, দুটির পরিবর্তে একটি বিদ্যালয় বাড়িয়ে তিনটি বিদ্যালয়ের নামসহ এ বৃত্তির কথা উল্লেখ করলেও কে কে বৃত্তি পেল বা এতে ছাত্রী কয়জন ছিল তা অজানাই থেকে যায়। শুধু উল্লেখ আছে,“মাননীয় সভাপতি সাহেব স্বহস্থে ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তিপ্রদান করেন।” বিষয়টি ব্যাকরণের বিভিন্ন কারক ও বিভক্তির উদাহরণ হয়েই থাকলো।
আরজ আলী মাতুব্বরের সমাজ চিন্তা, বিভিন্ন দিকে তাঁর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে তিনি একজন শ্রদ্ধার্ঘ ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাঁর মননে নারী উন্নয়ন তেমন নাড়া দেয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। তাঁর পাঠাভ্যাসে নারী বিষয়টি স্থান পায়নি বলেই হয়তো এ ফাঁক। আর পাঠাভ্যাসে নারী বিষয়টির শুন্যতার কারণ তাঁর পরিচিত বলয়, যেমন যাদের নামে বই আনতেন লাইব্রেরী থেকে তারা। তিনি সে বলয়কে অতিক্রম করতে পারেননি বা করার তাগিদও অনুভব করেননি।অর্থাৎ তাগিদ অনুভব করার মতো পরিমন্ডলে তাঁর অবস্থান ছিল না।

চেতনায় নারী (১)

শিরোনাম পড়ে অনেকে নিশ্চয়ই ভাবছেন, আরজ আলীর রচনায় নারীর অবস্থান খোঁজা কেন? তিনি তো বিজ্ঞান, বিশ্বাস,আধ্যাত্মিকতা,লৌকিক জীবন ইত্যাদি নিয়ে ভেবেছেন,লিখেছেন। তাঁর লেখায় আস্তিক্যবাদ আর নাস্তিক্যবাদ নিয়ে আলোচনা না করে নারী বিষয় কেন? কিন্তু এসব বিষয়ের সাথে তো মানব জীবনকে টেনেছেন আর মানবের একটা অংশ তো নারী। নারী অবস্থান তার চেতনার কোথায় নাড়া দিয়েছিল সে কৌতূহল মেটাতেই আরজ আলী মাতুব্বর পুনঃপাঠ। আর পুনঃপাঠের প্রকাশই এ লেখা।
প্রথমে নারীপ্রেম থেকেই আরজ আলী মাতুব্বরের গতানুগতিক পথের বাইরে বিকল্প পথের সন্ধান। সে নারী তার মা। তার মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের ছবি তোলার অপরাধে (?) মৃতদেহ দাফন সহ জানাযায় নিজ বাড়ির লোকজন ছাড়া অন্য কেউ আসতে রাজি হয়নি।
জন্মদাত্রী মা নামক নারীর মুখচ্ছবি ধরে রাখতে গিয়ে সামাজিকভাবে তাকে বিপর্যয়ের সন্মুখীন হতে হলেও মানসিকভাবে তার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠা শুরু। শুরু আলোর পথে যাত্রা। তার চেতনায় লাগে নতুন মাত্রা।
কথায় আছে জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। এ তিনটি বিষয় বিধাতা নির্ভর বলে বিধাতা একই ধর্মের নারী পুরুষে বিয়ে হওয়া ভালবাসেন। এমন বিধানও দিয়েছেন। আরজ আলী মা্তুব্বর নির্দ্বিধায় স্বামী স্ত্রীর ভিন্ন ধর্মের বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। তিনি ‘সত্যের সন্ধান” নামক বইয়ে বলেছেন,“ এই কল্পিত ধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিল উহাতে মতভেদ। ফলে পিতা-পুত্রে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, এমনকি স্বামী-স্ত্রীতেও এই কল্পিত ধর্ম নিয়া মতভেদের কথা শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত যে কত রক্তপাত হইয়া গিয়াছে, ইতিহাসই তাহার সাক্ষী।”(মূল কথা/ প্রশ্নের কারণ)
তিনি ইঙ্গিতে ঘোষণা করেছেন যে, স্বামী ও স্ত্রী মাত্র একই ধর্মের হয় না, বা হওয়া লাগবেই এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এজন্য রক্তপাতের মত ঘটনাও ঐতিহাসিক সত্য। স্বামী স্ত্রীর যে ধর্ম নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে তা ধর্মপ্রাণ মানুষমাত্রই অস্বীকার করবেন। স্বামীর ধর্মই স্ত্রীর ধর্ম। ইসলাম ধর্মমতে,কোন মুসলিম নারীর স্বামী হতে হলে কোন পুরুষকে স্বামী হওয়ার আগে ইসলামধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর মুসলিম পুরুষ আহলে কিতাব ( অর্থাৎ যাহারা বাইবেল, তোউরাত, এবং যবুর গ্রন্থে বিঃশ্বাসী) অনুসারী মহিলাকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু এতে ধর্মপ্রাণ সমাজে বসবাস কঠিন হয়ে যায়। তা ছাড়া সন্তানদের ধর্ম নিয়ে তখন টানা হেঁচড়া করা লাগে বলে বিধর্মী প্রেমিক প্রমিকারা ধর্মান্তরিত হয়ে তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীরও যে আলাদা ধর্ম হতে পারে তা বলার মত সততা ও সাহস আরজ আলী মাতুব্বরের ছিল।
স্বামী ও স্ত্রীর যে আলাদা ধর্ম থাকতে পারে এ তথ্যটি বলাও অনেক মৌলবাদীর কাছে গর্হিত অপরাধ। আরজ আলী মাতুব্বর এ সত্য প্রকাশে দ্বিধান্বিত নন। নারীর ধর্মীয় স্বাধীনতা চর্চা করতে গিয়ে রক্তপাতের ঘটনাও যে স্বাভাবিক তা তিনি অবলীলায় বলতে পারেন। এখানেই তার নারী প্রতি আধুনিকতম দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ।
১৯২৯ সালের বাল্য বিবাহ আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে কোন মেয়ের বিয়েকে বলে বাল্য বিবাহ। আর ইদানিংকালে আধুনিক চেতনার উন্নয়নবিদরা, উন্নয়নকর্মীরা বলে শিশু বিয়ে। বাল্য বিয়ে আর শিশু বিয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে কি? আছে। বাল্য বিয়ে ইংরেজি early marriage আর শিশু বিয়ে ইংরেজি child marriage. সমাজের চেতনাকে নাড়া দিতে শিশু বিয়ে শব্দটি বেশি লাগসই। বাল্য বিয়ে আইনগত ভিত্তি আর শিশু বিয়ে সামাজিক প্রেক্ষাপট ও মানবিক আবেদন।
তাছাড়া, আইনে ১৮ বছরের নিচে কোন মেয়ের বিয়েকে বাল্য বিয়ে বললেও আধুনিক চেতনায় বিশ্বাসী অনেকেই লেখাপড়া শেষ না করে বা প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বিয়ে করাকে বলে বাল্য বিয়ে। আর সমাজের আবেগকে নাড়া দিতে ১৮ বছরের নীচের বয়সী মেয়ের বিয়েকে বলে শিশু বিয়ে। এ নিয়ে ইউনিসেফ এর সাথে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রকল্পও রয়েছে। যে প্রকল্প 3C নিয়ে কাজ করছে। C তিনটি হল child marriage, child labour ও corporal punishment.
আরজ আলী মাতুব্বর কিন্তু বহু বছর আগে বাল্য নয়, শিশু বিয়ে শব্দটিই ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ‘সত্যের সন্ধান” নামক বইয়ে ‘মূলকথা’ পরিচ্ছেদে বলেছেন, “আমাদের দেশে জন্মহার অত্যধিক। জনসংখ্যা অস্বাভাবিকরূপে বৃদ্ধি পাইতেছে —-শিশু, বিধবা ও বহুবিবাহে।” ”(মূলকথা/প্রশ্নের কারণ)
অনায়াসে বাল্য বিবাহ শব্দটি ব্যবহার করতে পারতেন। সচেতনভাবেই অনুপ্রাস সৃষ্টির সুযোগ এড়িয়ে গেছেন। কারণ শিশু বিবাহের সাথে নারী অধিকার সম্পর্কিত, শিশু অধিকার তো বটেই। তিনি অনেক আগেই শিশু বিয়ে ও বহু বিয়ের কুফল নিয়ে লিখেছেন যা নিয়ে বাংলাদেশের নারীবাদীরা এখনও আন্দোলন করছে ।
যদিও তিনি সবশেষে বলেছেন, “ সুখের বিষয় এই যে, সরকারী নির্দেশে শিশু-বিবাহ বর্তমানে কমিয়াছে।’ ”(মূলকথা/প্রশ্নের কারণ)তবে কমে যাওয়ার গতি খুবই ধীর। নারীর যাপিত জীবনের জাগতিক যন্ত্রণায় শিশু বিয়ে ও বহু বিয়ের মত দুটো প্রথারই নেতিবাচক প্রভাব যে অসহণীয় তা তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন।
যুক্তি দেখাতে বাস্তব জীবন থেকে উদাহরণ লাগে। চাক্ষুষ ঘটনার উপস্থাপন যুক্তিকে শাণিত করে। বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের দ্বন্দ্বে নির্ভরশীলতা, আস্থা ও জীবনরক্ষাকারী পথ হিসেবে মানুষ বিজ্ঞানকেই বেছে নেয়। তবে বিশ্বাসের বলি তো সমাজে যুগ যুগ ধরে নারীরাই হয়ে আসছে। আর আরজ আলী মাতুব্বর তা জানেন ও মানেন বলেই উদাহরণ এনেছেন গর্ভবতী নারীর সন্তান জন্মদানের মত ঘটনাকে। “গর্ভিনীর সন্তান প্রসব যখন অস্বাভাবিক হইয়া পড়ে, তখন পানি পড়ার চেয়ে লোকে বেবী ক্লিনিকের (baby clinic) উপর ভরসা রাখে বেশী।”(মূলকথা/প্রশ্নের কারণ। এ তার চারপাশের নারীর জীবন চক্র পর্যবেক্ষণের ফল।
নারী পুরুষ বিভাজন নিয়ে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে আপত্তিকর, বিভ্রান্তিকর, বৈষম্যমূলক, বিসদৃশ্য এবং জেন্ডার অসংবেদনশীল বক্তব্য আছে। তাই ধর্মীয় প্রভাবে প্রভাবিত সমাজে ও পরিবারে নারীমুক্তি বিষয়টি গুরুত্ব পায় না।ধর্মের মূলসুর ইহজগতকে গৌণ করে পরকালের জীবনকে মূখ্য করে তোলা; নারী পুরুষের লিঙ্গজ, জৈবিক, প্রাকৃতিকভাবে দৈহিক পার্থক্যকে বড় করে দেখিয়ে নারীকে সামাজিকভাবে অধঃস্তন করে রাখায় ধর্মের ভূমিকা ও অবদান প্রত্যক্ষভাবেই দায়ী। বিষয়টি নিয়ে নারীবাদীরা সংগ্রাম করছেন। নারীর দৈহিক কাঠমোকে ভিত্তি করে সমাজ ও রাষ্ট্র তার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে। আর নারীর এ অধঃস্তন অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যই নারী আন্দোলন। আর নারী পুরুষের মধ্যে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পার্থক্য নিয়ে উন্নয়ন জগতে gender নামে বহুল আলোচিত একটি ক্ষেত্র রয়েছে।
পরকালে নারীর অবস্থান অধঃস্তন ও কোথাও কোথাও অস্পষ্ট বলে ইহজাগতিক জীবনে নারী বৈষম্যের শিকার হয়। কিন্তু পরকালে নারী পুরুষের লিঙ্গভিত্তিক অস্তিত্ব নিয়েই আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্ন যা নারী পুরুষের বৈষম্যের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দেয়। তিনি প্রাণের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করে একটি মৌলিক প্রশ্ন উপস্থাপন করেছেন,“কেঁচো ও শামুকাদি ভিন্ন যাবতীয় উন্নত জীবেরই নারী-পুরুষ ভেদ আছে, কৃচিৎ নপুংসকও দেখা যায়। কিন্তু জীবজগতে নারী ও পুরুষ, এই দুই জাতিই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। প্রতিটি জীব বা মানুষ জন্মিবার পূর্বেই যদি তাহার স্বতন্ত্র সত্ত্বাবিশিষ্ট প্রাণ সৃষ্টি হইয়া থাকে, তাহা সেই প্রাণেও লিঙ্গভেদ আছে কি? যদি থাকেই, তাহা হইলে অশরীরী নিরাকার প্রাণের নারী, পুরুষ এবং ক্লীবের চিহ্ন কি? আর যদি প্রাণের কোন লিঙ্গভেদ না থাকে, তাহা হইলে এক জাতীয় প্রাণ হইতে ত্রিজাতীয় প্রাণী জন্মে কিরূপে? লিঙ্গভেদ কি শুধু জীবের দৈহিক রূপায়ণ মাত্র? তাহাই যদি হয়, তবে পরলোকে মাতা-পিতা, ভাই-ভগিনী ইত্যাদি নারী-পুরুষভেদ থাকিবে কিরূপে?পরলাকেও কি লিঙ্গজ দেহ থাকিবে?”(প্রথম প্রস্তাব/ আত্মা বিষয়ক)।
কাজেই ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে ভিত্তি করে নারীর প্রতি যে বৈষম্য তা এ প্রশ্নের কাছে খড়কুটোর মতই উড়ে যায়। আর এখানেই তিনি নারী মুক্তি আন্দোলনের একজন সহযোগী হিসেবে স্বীকৃত হন।

চেতনায় নারী (২)

নারীর যৌন জীবন ও যৌন অধিকার নিয়ে নারীবাদীরা সোচ্চার।‘শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার’ স্লোগান নারীর শরীরের ওপর নিজের অধিকারের দাবি। নারীর যৌন জীবন ও অধিকার কোন ধর্মেই স্বীকৃত তো নয়ই, বরং জগণ্য শব্দ ব্যবহারে ধিকৃত।নারী সংসারে পুতুলের মত। পরিবার তথা সমাজ আরোপিত কর্মই তার কর্তব্য। সে একই শরীরে বিভিন্ন সময়ে অনেক সময় একই ব্যক্তির কাছে বিভিন্নরূপে যথাযথ ভূমিকা পালনের জন্য বাধ্য। কখনও কন্যা, কখনও মাতা আর শয্যায় ভার্যা। ভার্যা হিসেবে তার কোন চাহিদা নেই। সে পুতুল। স্বামীর মনোরঞ্জনই ভার্যার একমাত্র চাওয়া, ধর্ম, কর্ম। যদিও marital rape বিষয়টি আলোচিত। অনেক দেশে এটি অপরাধ এবং এ নিয়ে আদালতে যাওয়া যায়। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসনে পরিচালিত সমাজে এ নিয়ে কথা বলাই অপরাধ।
আরজ আলী মাতুব্বর নারীর যৌন জীবন ও যৌন অধিকারের বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক ধারণা পোষন করতেন। ‘হেজরল আসোয়াদ” নামে একটি কালো পাথর কাবাগৃহের দেওয়ালে গাঁথা আছে। হজ্বের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে হাজীগণকে অন্য অনেক নিয়মের মত ঐ পাথরে চুমা দিতে হয়। উনি তার প্রশ্ন করেছেন,‘হাজীগণকে ঐ পাথরখানায় সম্মানের সাথে চুম্বন করিতে হয়। পিতা-মাতা স্নেহবশে শিশুদের মুখ চুম্বন করে এবং প্রেমাসক্তিবশে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মুখ চুম্বন করিয়ে থাকে। যাহাকে চুম্বন করা হয়, তাহার মমতাবোধ বা সুখানুভূতি থাকা আবশ্যক। যাহার মমতাবোধ বা সুখানুভূতি নাই, তাহাকে চুম্বন করার কোন মূল্য থাকিতে পারে না।‘হেজরল আসোয়াদ”চেতনাবিহীন একখন্ড নিরেট পাথর মাত্র। উহাকে চুম্বন করিবার উপকারিতা কি?” (চতুর্থ প্রস্তাব/ধর্ম বিষয়ক)।
এখানে উনি স্বামী-স্ত্রীর চুম্বন করার কথা উদাহরণ হিসেবে টানতে গিয়ে পরস্পর বিষয়টির ওপরে গুরুত্ব দিয়ে নারীর যৌন অধিকারের বিষয়টিকেই সমর্থন করেছেন। আর হেজরল আসোয়াদ নামে চেতনাবিহীন একখন্ড নিরেট পাথর প্রসঙ্গে স্বামী স্ত্রীর প্রসঙ্গ টেনে নারীকে যে সমাজ ও ধর্ম চেতনাবিহীন পাথর মনে করে এরও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
নারীকে সতী আর অসতী হিসেবে আখ্যায়িত করা মানবতা বিরোধী ও নারী বিদ্বেষী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। এতে নারীকে অসম্মান করা হয়। অপমান করা হয়। সতী আর অসতী নারীর ধারণা যে খেলো ব্যাপার তা আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর লেখায় ব্যক্ত করেছেন। পৌরাণিক কাহিনীর নারী চরিত্র সীতা সতী বলে আগুনে পুড়েনি এমন কাহিনী রয়েছে। শুধু মানবীই না, বা মানব দেহ মাত্রই না, দাহ্য বস্তু মাত্রই আগুনে পুড়বে।তা সতী, সৎ, অসতী বা অসৎ, জীব, জড় যা ই হোক না কেন। কাজেই নারীকে অসতী বলে আগুন দিয়ে পরীক্ষা করার ছল চাতুরির দিন শেষ। আগুনের কাছে যেমন সতী অসতী ভেদাভেদ নেই তেমন সমাজেরও এ নিয়ে বিভাজন করা বা সংজ্ঞায়িত যে উপহাসেরই কাজ তা আরজ আলী মাতুব্বরের ভাবনায় প্রস্ফুটিত। তিনি লিখেছেন,“সেকালে হিন্দুদের ধারণা ছিল যে, সতী নারী অগ্নিদগ্ধ হয় ন। তাই রাম-জায়া সীতা দেবীকে অগ্নিপরীক্ষা করা হইয়াছিল। সীতা দীর্ঘকাল রাবণের হাতে একাকিনী বন্দিনী থাকায় তাঁহার সতীত্বে সন্দেহবশত তাঁহাকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু উহাতে নাকি তাঁহার কেশাগ্রও দগ্ধ হয় নাই। আর আজকাল দেখা যায় যে সতী বা অসতী, সকল রমণীই দগ্ধ হয়। ইহাতে মনে হয় যে, অগ্নিদেব দাহ্য পদার্থমাত্রেই দহন করে, সতী বা অসতী কাহাকেও খাতির করে না, নতুবা বর্তমানকালে সতী নারী একটিও নাই।” (পঞ্চম প্রস্তাব/‘প্রকৃতি বিষয়ক’)
সত্যের সন্ধান বইয়ে ষষ্ঠ প্রস্তাব পরিচ্ছেদের ‘বিবিধ’ নামক প্রবন্ধে আরজ আলী মাতুব্বর প্রশ্ন রেখেছেন যীশুখ্রীষ্টের পিতা কে এবং এর উত্তরও খুঁজেছেন। নিঃসন্তান সখরিয়ার ছিল অতি বৃদ্ধা স্ত্রী ইলীশাবেত যে ফেরেস্তার বর পেয়ে পুত্রের মা হন এবং পরে সখরিয়ার পালিতা ১৬ বছর বয়সী কুমারী মরিয়মও গর্ভবতী হন। আরজ আলী নির্মোহভাবে বিভিন্ন ঘটনা, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে সখরিয়াই যীশুখ্রীষ্টের জন্মদাতা। কিন্তু কোথাও একটি শব্দও মরিয়মের চরিত্রের প্রতি নেতিবাচকভাবে খরচ করেননি। তিনি শুধু অলৌকিক ঘটনার গিট্টু খুলেছেন। তিনি ব্যভিচারের অপরাধে সখরিয়ার প্রাণদন্ডের উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে মহাভারতের মহর্ষি পরাশরের ঔরসে অবিবাহিতা মৎসগন্ধার গর্ভে ব্যাসদেবের জন্মের লৌকিক ঘটনার উদাহরণ দিয়েছেন।
আরজ আলী মাতুব্বরের নারী চরিত্রের প্রাসঙ্গিকতায় যে নির্মোহ ভাব তা নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। সাধারণত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যস্থায় পরিপক্ক হওয়া মানসিকতা নারীর চরিত্র হননের সুযোগ হাতছাড়া করে না। কুমারী মাতার মত তথাকথিত রসঘন বিষয় পেয়েও তিনি কুমারী মাতার পুত্রের পিতার অনুসন্ধান করেছেন যা আমাদের এখনকার সমাজ ব্যবস্থায় অতীব প্রয়োজন।কুমারীর মায়ের দায়ের চেয়ে, তার চরিত্র বিশ্লেষণের চেয়ে অঘটনপটিয়সীর সন্ধান জরুরী।নারী আন্দোলন ঘটনার শিকার নারীর চেয়ে অঘটনগপটিয়সী পুরুষটির পরিচয় জনসন্মুখে প্রকাশের দাবি করে। আর যীশুখ্রীষ্টের জন্ম ইতিহাসের আলোচনায় আরজ আলী মাতব্বর এ কাজটিই করেছেন।
হজরত আদমের বাম পাজর থেকে বিবি হাওয়া সৃষ্টি বলে স্ত্রীকে স্বামীর অঙ্গজ বলা হয়। স্ত্রী স্বামীর অঙ্গজ হিসেবে অঙ্গিনী একটি বহুল বির্তকিত বিষয়।সচেতন নারী মাত্রই এ নিয়ে প্রতিবাদমুখর। আরজ আলী মাতুব্বরও এ নিয়ে রসিকতা করেছেন।“মানুষের হস্তপদাদি কোন অঙ্গ রুগ্ন হইলে উহার প্রতিকারের জন্য চিকিৎসা করান হয়।রোগ দুরারোগ্য হইলে ঐ রুগ্নাঙ্গ লইয়াই জীবন কাটাইতে হয়।রুগ্নাঙ্গ লইয়া জীবন কাটাইতে প্রাণহানির আশংকা না থাকিলে কেহ রুগ্নাঙ্গ ত্যাগ করে না। স্ত্রী যদি স্বামীর অঙ্গই হয়, তবে দূষিতা বলিয়া তাহাকে ত্যাগ করা হয় কেন? কোনরকম কায়ক্লেশে জীবনযাপন করা যায় না কি”?(ষষ্ঠ প্রস্তাব/বিবিধ)। তালাক আর বহু বিয়ের অজুহাতকে তিনি বেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবেই উপস্থাপন করেছেন।
নারীর প্রতি এক জগণ্য অপরাধ হিল্লা প্রথা।এ প্রথা নারীর মন ও মর্যাদার ওপর আঘাত। তালাকের পর স্ত্রীকে অন্য কারও সাথে বিয়ে দিয়ে পরে ঐখান থেকে তালাক নিয়ে পুনঃবিবাহ করা হল হিল্লা প্রথার মূল বিষয়। ইসলামী এ প্রথা আইয়ূব খানের আমলে পরিবর্তন হলেও গ্রামে গঞ্জে এ বিষয়ক ফতোয়া এখনও চলমান। এ নিয়ে প্রায়শঃই পত্রিকার পাতায় খবর প্রকাশিত হয়। নারী আন্দোলন হিল্লা প্রথা নির্মূল ও প্রতিরোধে বদ্ধ পরিকর। আরজ আলী মাতুব্বরও এ ঘৃণিত প্রথাটির শিকার নারীর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে বলেছেন, “অথচ পুনঃগ্রণযোগ্যা নির্দোষ স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণে ‘হিল্লা’ প্রথার নিয়মে স্বামীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয় সেই নির্দোষ স্ত্রীকেই।অপরাধী স্বামীর অর্থদন্ড, বেত্রাঘাত ইত্যাদি না-ই হউক, অন্তত তুওবা (পুনরায় পাপকর্ম না করিবার শপথ) পড়ারও বিধান নাই, আছে নিস্পাপিনী স্ত্রীর ইজ্জতহানির ব্যবস্থা। একের পাপে অন্যকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয় কেন?”?(ষষ্ঠ প্রস্তাব/বিবিধ)।
তিনি এমন স্বামীকে বাগে পেলে যে নিদেন পক্ষে তওবা পড়িয়ে ছাড়তেন তা উপরের লাইনে প্রকাশিত।
নারীবাদী কে? আধুনিক মানুষ মাত্রই নারীবাদী। এ আমার নারীবাদ সম্পর্কিত সরল মন্তব্য। আধুনিক মানুষ মাত্রই নারীর প্রতি ইতিবচক মনোভাব পোষণ করে, নারী মুক্তি চায়,নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, নারীর সম ও ন্যায্য অধিকারে সহযোগী ভূমিকা পালন করে। আরজ আলী মা্তুব্বর একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন এবং নারীবাদী চেতনা লালনকারী ছিলেন।

চেতনায় নারী (৩)

‘সত্যের সন্ধান” বইয়ের নাম যুক্তিবাদ দিয়েও আরজ আলো মাতুব্বর তাঁর হাজতবাস ঠেকাতে পারেননি। তাই দ্বিতীয় বইয়ের নাম দিয়েছিলেন “অনুমান”, গ্রন্থটি সম্পর্কে নিজেই বলেছিলেন, “ তাই এবারে ‘সত্যের সন্ধান” না করে মিথ্যার সন্ধান করতে চেষ্টা করছি এবং “যুক্তিবাদ” এর আশ্রয় না নিয়ে আমি আশ্রয় নিচ্ছি “অনুমান”-এর। তাই এ পুস্তিকাখানার নামকরণ করা হলো– মিথ্যার সন্ধানে “অনুমান।”এতে যুক্তিবাদের কঠিন দেয়াল নেই, আছে স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ।” তিনি স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ দিয়ে প্রতিকী চরিত্র সৃষ্টি করে নারীর অধঃস্তন অসহায় অবস্থানকে উপস্থাপন করেছেন।
“অনুমান” গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধটির নাম ‘রাবণের প্রতিভা।’ রাবণ আর সীতার কাহিনীর মোড়কে রামকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বসবাসকারী গতানুগতিক একজন পুরুষ ও সীতাকে পুরুতান্ত্রিক সমাজের শিকার একজন অসহায় নারী হিসেবে এঁকেছেন।
কোন দম্পতির সন্তান না হলে সমাজ স্ত্রীকেই প্রথমে দায়ী করে।বাঁজা নামের অপবাদ নারীর প্রতিই সাধারণত ছোঁড়া হয়। আমাদের সমাজে নারীকে বন্ধ্যা বানিয়ে বহু বিবাহ প্রথা বহাল তবিয়তে বিরাজমান। কিন্তু রাম আর সীতার দাম্পত্য জীবনে বায়ান্ন বছর (পৌরাণিক কাহিনীর বছর)নিঃসন্তান থাকার জন্য আরজ আলী সীতাকে নয়, রামকে দায়ী করেছেন। তিনি লিখেছেন, “সীতাদেবী বন্ধ্যা ছিলেন না এবং উক্ত তেপান্ন বছরের মধ্যে বনবাসের দশ মাস(অশোককাননে রাবণের হাতে সীতা বন্দিনি ছিলেন ১০ মাস)ছাড়া বায়ান্ন বছর দু’মাস সীতা ছিলেন রামচন্দ্রের অঙ্কশায়িনী। তথাপি এ দীর্ঘকাল রতিবিরতি রামচন্দ্রের বীর্যহীনতারই পরিচয়,নয় কি?”
এটাকে আমরা তাঁর গ্রামের বা পরিচিত বলয়ের কোন প্রত্যক্ষ ঘটনার প্রতিবাদের জন্য লেখা বলে গণ্য করতেই পারি। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন যে স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ দিয়ে তাঁর “অনুমান” বইটি লিখেছেন।
আর দাম্পত্য জীবনের বায়ান্ন বছর অর্থাৎ দীর্ঘ বছর কাটিয়ে দেয়ার পর রাম সীতার সন্তান হওয়াকে নিঃসন্তান স্বামীদের বহু বিবাহ না করে ধৈর্য ধরার ইঙ্গিত করেছেন যা নারীকে সতীনের ঘর করা থেকে রক্ষা করবে। কারণ প্রবাদ রয়েছে যে নারী স্বামীকে যমকে দিতে রাজি থাকলেও পরকে অর্থাৎ সতীনকে দিতে রাজি হয় না।
নারীর এ রাজি হওয়া আর না হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্যে রয়েছে নারীর মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ। নারীর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া ও শ্রদ্ধা করা তো নারী আন্দোলনের দাবি। আরজ আলী মাতুব্বরের এ দাবির প্রতি সমর্থন ছিল বলেই সীতা ও রামের প্রতিকী কাহিনী বলে নারীকে সতীনের সাথে বসবাসের অসহায়তাকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন।
নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়ার জন্য সময় লাগে না। যখন তখন, যেভাবে মন চায় ইচ্ছে মত গুজব রটিয়ে দিলেই হয়। রাম হাস্যকরভাবে প্রজা মনোরঞ্জন বা প্রজা বিদ্রোহের অজুহাতে বনবাস থেকে ফেরার ২৭ বছর পর সীতাকে ত্যাগ করে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন। আরজ আলী মাতুব্বর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “ … স্বতই মনে প্রশ্নের উদয় হয় যে, মরার দু’যুগের পরে কান্না কেন? বনবাসান্তে রামচন্দ্র স্ববাসে প্রত্যাবর্তন করলে তাঁর বনবাসের বিবরণ তথা লঙ্কাকান্ড দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিলো। তাঁর দেশে ফেরার সংগে সংগেই এবং সীতা কলঙ্কের কানাকানিও চলছিলো দেশময় তখন থেকেই। আর গুজবের ভিত্তিতে সীতাদেবীকে নির্বাসিত করতে হলে তা করা তখনই দরকার ছিলো সঙ্গত। দীর্ঘ ২৭ বছর পর কেন?”
তাঁর প্রশ্ন থেকে আমাদের মনে উত্তর উদয় হয় যে নারীকে অপবাদ দিতে সাক্ষী লাগে না, প্রমাণ লাগে না, সময় লাগে না। স্বামী তথা পুরুষ নিজের ইচ্ছে ও সুবিধামত নারীকে যখন ত্যাগ করতে চাইবে তখনই উপযুক্ত সময়। চরিত্রহীন আখ্যা দিয়ে তা করার জন্য জনমত, সমাজ, রাষ্ট্র ও আইন পুরুষের পক্ষেই কাজ করে। তথাকথিত চরিত্রহীন নারী পরিত্যাজ্য ও পরিত্যক্ত।
আর আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্ন করে অচলায়তন সমাজকে নিংরে দেখানোর কৌশল প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মন্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন “……..আরজ আলী মাতুব্বর প্রথম ও নির্মম যে অন্ধকার সুচিরকাল ধরে স্থায়ী হয়ে আছে এই বাংলাদেশে, তার কথাই বলেছেন তাঁর বইতে। বর্ণনা করে নয় প্রশ্ন করে।’’
পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্রের আড়ালে আরজ আলী মাতুব্বর নারীর অসহায় অবস্থার জন্য দায়ী সমাজে বিরাজমান চরিত্র চিত্রণ করেছেন। প্রজা মনোরঞ্জন জন্য, নিজের সিংহাসন নিষ্কলুষ রাখার জন্য নিষ্কলঙ্ক পাঁচ মাসের অন্তঃসত্বা স্ত্রী সীতাকে রাম বনবাসে পাঠিয়েছিলেন। আরজ আলী মাতুব্বরের ভাষায়, “রামচন্দ্র সীতাদেবীকে গৃহত্যাগী করেছিলেন শুধু জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য,স্বয়ং তাঁকে নাকি “নিষ্কলঙ্কা” বলেই জানতেন।এইরূপ পরের কথায় নিষ্ককলঙ্কা স্ত্রী ত্যাগ করার নজির জগতে আছে কি?”
ছিল। আছে। আর না থাকার জন্য নারী আন্দোলন। সমাজে এমন পুরুষ চরিত্রের ছড়াছড়ি যারা পরের কথায় ঘরের বউকে ত্যাগ করে, তালাক দেয়, শ্বশুর বাড়ির নামে বনবাসে পাঠায়। তথাকথিত লোক লজ্জার অপমানের আশংকায় নিজের স্ত্রীকে অপমান করে। নারী তার অধঃস্তন অবস্থা ও অবস্থানের জন্য তা মেনে নিতে বাধ্য হয়। সীতার প্রতীকে তিনি বাংলাদেশের নারীর জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন।
তিনি প্রসঙ্গক্রমে গ্রেট বৃটেনের অষ্টম এডোয়ার্ড এর প্রেমের মহান উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে, “পার্লামেন্ট এডোয়ার্ডকে জানালো যে হয় মিসেস সিম্পসনকে ত্যাগ করতে হবে, নচেৎ তাঁকে ত্যাগ করতে হবে সিংহাসন।এতে এডোয়ার্ড সিংহাসন ত্যাগ করলান, কিন্তু প্রেয়সীকে ত্যাগ করলেন না। শুধু তা-ই নয়, তাঁর মেঝ ভাই ডিউক- অব-ইয়র্ককে সিংহাসন দিয়ে তিনি সস্ত্রীক রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেন বিদেশে। রামচন্দ্রেরও তো মেঝ ভাই ছিলো।”
আরজ আলী মাতুব্বর নিজে নারী প্রেমের মর্যাদায় বিশ্বাস করতেন এবং নারীর প্রতি প্রখর মর্যাদাবোধ ধারণ করতেন বলেই রামকে সীতার জন্য রাজ্য ত্যাগের পরামর্শ দিতে কুন্ঠিত নন। অর্থাৎ স্ত্রীর জন্য স্বামীকে ত্যাগী হবার মন্ত্র ছড়িয়েছেন।
সমাজ সব সময়ই নারীর তথাকথিত সতীত্ব নিয়ে বাড়াবাড়ি করে। নারী সতী না হলে হয় পতিতা। কিন্তু পুরুষ পতিত হয় না কোন কালেই। এ গতানুগতিক বিষয়টি বহুল আলোচিত। ‘রাবণের প্রতিভা’ প্রবন্ধে আরজ আলী মাতুব্বর সীতার সতীত্বের বিষয়টি উহ্য রেখে, তার দেবত্বের মহিমা দূরে রেখে তাকে সমাজের বিভিন্ন চরিত্রে বিভিন্নরুপে বসিয়েছেন। রামায়ণের রাম সীতা আর রাবণের কাহিনীর আভরণে তাঁর আশেপাশের নারীর জীবন কথা তুলে এনেছেন। ‘সত্যের সন্ধান” বইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে যে এটা তাঁর কৌশলী অবস্থান তা তিনি বইয়ের ভূমিকায় নিজেই প্রকাশ করেছিলেন।
আরজ আলী মাতুব্বর প্রথমে রামায়ণের কাহিনী ঠিক রেখে পরে “— ঘটনাগুলো হয়তো এরূপও ঘটে থাকতে পারে। যথা—’’ বলে তিনি প্রতিকী সীতাকে রাবণের সাথে স্বেচ্ছায় শুইয়েছেন, অন্তঃসত্ত্বা বানিয়েছেন, আবার সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণও করিয়েছেন।
হিন্দু সমাজে সাধারণত মেয়েদের নাম সীতা রাখা হয় না। প্রচলিত ধারণা সীতা নাম রাখলে মেয়েটির জীবন সীতার মতই দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে থাকবে। কদাচিৎ কারও নাম সীতা রাখা হলে দেখা যায় ওই মেয়েটির নবজাতক অবস্থায় তার মা মারা গেছে বা বাবা মারা গেছে, অথবা কোন পারিবারিক বিপর্যয় ঘটেছে। হয়ত এ ধারণাটিকে কাজে লাগিয়ে আরজ আলী মাতব্বর পৌরাণিক কাহিনী থেকে সীতা নামটিই বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশের নারীর দুঃখ গাঁথা তুলে ধরার জন্য।বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নারী নির্যাতনের যে চিত্র তা সীতা নামের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন।
দুঃখিনী সীতাদের সংসারে কিল চড় খাওয়া নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। তিনি লিখেছেন,‘সীতাদেবীকে নিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় পৌঁছলে লঙ্কাকান্ড প্রকাশ হওয়ায় সেখানে তখন সীতাকলঙ্কের ঝড় বইছিলো নিশ্চয়ই। হয়তো সীতার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য প্রথমত জেরা-জবানবন্দি, কটূক্তি, ধমকানি-শাসানি ও পরে মারপিট ইত্যাদি শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো তাঁর প্রতি। কিন্তু তিনি নীরবে সহ্য করেছিলেন সেসব নির্যাতন, ফাঁস করেননি কভূ আসল কথা। আর সেটাই হচ্ছে সীতার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া”।
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সর্বংসহা নারী তো এভাবেই বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না অবস্থায় মারপিট খেয়েও অবস্থান করছে। আর জেরা-জবানবন্দি, কটূক্তি, ধমকানি-শাসানি ও মারপিটসহ শারীরিক নির্যাতন পৃথিবীব্যপীই নারীর জীবনের অপরিহার্য লিখন। এজন্যই তো ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। । আর এ অভিজ্ঞতা থেকেই তো নারী আন্দোলনের স্লোগান—‘কিসের ঘর কিসের বর/ঘর যদি হয় মারধোর।’’
আরজ আলী মাতুব্বর বাস্তবতার নিরীখে দেবী সীতাকে মাটিতে এনে তথাকথিত অবতার রামকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যোগ্য উত্তরসূরী করে রাম ও সীতার সম্পর্ককে ও সংসারকে কিসের বর ও মারধোরের ঘর হিসেবে চিত্রিত করেছেন।
রাম আর সীতার পুরো কাহিনিটিই রামায়ণ থেকে ভিন্নভাবে আরজ আলী মাতুব্বর উপস্থাপন করেছেন, যা বাংলাদেশের নারীর দুঃখে ভরা জীবন যাপনের সাথে একাত্ম। বাংলাদেশে সীতাদের স্বামীরা সন্তানদের রেখে স্ত্রীদের তালাক দিয়ে তাড়িয়ে দেবার ঘটনা অসংখ্য। আর তালাক প্রাপ্ত নিরুপায় নারী আত্মহত্যা ছাড়া বিকল্প উপায় খুঁজে পায় না। আরজ আলী মাতুব্বরের কাহিনীতে এরই প্রতিধ্বনি, “কুশ-লবকে গ্রহণ করলেও সীতাকে গ্রহণ করেননি রামচন্দ্র সেদিনও। সীতাদেবী হয়ত আশা করেছিলেন যে, বহু বছরান্তে পুত্ররত্ন-সহ রাজপুরীতে এসে এবার সমাদর পাবেন।কিন্তু তা তিনি পান নি,বিকল্পে পেয়েছিলেন যতো অনাদর-অবজ্ঞা। তাই তিনি ক্ষোভে দুঃখে হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। নারী হত্যার অপবাদ লুকানোর উদ্দেশ্যে এবং ঘটনাটি বাইরে প্রকাশ পাবার ভয়ে শ্মশান দাহ করা হয়নি সীতার শবদেহটি, হয়তো লুকিয়ে প্রোথিত করা হয়েছিল মাটির গর্তে,পুরীর মধ্যেই। আর তা-ই প্রচারিত হয়েছে ‘স্বেচ্ছায় সীতাদেবীর ভূগর্ভে প্রবেশ’ বলে।”
নারী হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে অহরহ। পত্রিকার পাতাই এর সাক্ষী। আরজ আলী মাতুব্বরের চেতনায় তা ঘা দিয়েছিল বলেই প্রতিকারের আশায় রাম সীতার কাহিনীর অবতারণা। এ অবতারণা আরজ আলী মাতুব্বরের চেতনায় নারী মুক্তি আন্দোলনের সাক্ষ্য বহন করে।

চেতনায় নারী (৪)

ভগ মানে স্ত্রী যোনি। গুরুপত্নী অহল্যার সতীত্ব নষ্ট করায় ইন্দ্রকে গুরুর অভিশপে সর্বাঙ্গে এক হাজার ভগ বা স্ত্রী যোনি ধারণ করতে হয় বলে তার নাম হয় ভগবান। এখানে স্ত্রী যোনিকে আরজ আলী মাতুব্বর অশ্লীল বা লজ্জাস্কর অথবা কদর্‍্যভাবে বর্ণনা না করে ইন্দ্রের শাস্তিটাকেই মুখ্য করে তুলেছেন। এখানে অহল্যা চরিত্রটিকে ধর্ষন করার পৌরাণিক কাহিনী সেঁচে তিনি যে উদাহরণ তুলে ধরেছেন তা যেন ইন্দ্রকে আজকালকার ধর্ষণকারীদের রূপে দেখতে পাই। নারীবাদীরা ধর্ষণের শিকার নারীর চেয়ে ধর্ষনকারীদের পরিচয় ও চরিত্র বিশ্লেষণে সচেষ্ট। অপরাধকে নির্মূল করতে এর শিকড়ের সন্ধান করতে হয়। অপরাধ ও অপরাধীর তথ্য বেশি প্রয়োজনীয়। তাই আরজ আলী মাতুব্বর নারী বিদ্বেষীদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে ইন্দ্রের ছদ্মবেশেদারী চরিত্রহীন এক পুরুষের আদ্যপ্রান্ত তুলে ধরেছেন “অনুমান” গ্রন্থের ‘ভগবানের মৃত্যু’ নামক নিবন্ধে। ভগবানের মৃত্যু নামক লেখাটিই হেঁয়ালি দিয়ে শুরু বলে এ যে পৌরাণিক ইন্দ্রের ছদ্মবেশে আমাদেরই চারপাশে বসবাসকারী ধর্ষনকারী তা সহজেই অনুমেয়। আর তার “অনুমান” গ্রন্থটির বিভিন্ন লেখা যে স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখার কৌশল তা বইটির ভূমিকায় বলেই রেখেছিলেন।
ইন্দ্রের দুঃষ্কর্মের বর্ণনায় তিনি তার মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তানসহ কুন্তীর সাথে অবৈধ যৌনাচার, কিষ্কিন্ধ্যার অধিপতি রক্ষরাজের পত্নীর গর্ভে বালী রাজের জন্মদান, গুরুপত্নীকে ধর্ষনসহ সবই তুলে ধরে যেন আমাদের সমাজেরই কোন পরিচিত পুরুষ চরিত্র চিত্রণ করেছেন। আমাদের সামাজিক বলয়ে দুঃশ্চরিত্র ব্যক্তি যৌন ব্যভিচারে লিপ্ত বলে তাঁর জ্ঞান, গরিমা, বুদ্ধি,যশ, প্রতিপত্তি সবই অর্থহীন । পুরুষের যৌন ব্যভিচারের শিকার যে নারী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরজ আলী মাতুব্বর পুরুষ বা ইন্দ্র তথা ধর্ষনকারীর পরিচয়ে বলেছেন, “‘ভগবান’ হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্রের একটি কুখ্যাত উপাধি মাত্র।ইন্দ্র ছিলেন শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান- বিজ্ঞানে অতি উন্নত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। তাই তার একনাম ‘দেবরাজ’ । , কিন্তু দেবরাজ হলে কি হব্‌ তাঁর যৌন চরিত্র ছিলো নেহায়েত মন্দ।’’ এ মন্দ তো নারীকে শিকার করে বলেই। মন্দের এ সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে তিনি নারীর অবস্থানকেই তুলে ধরেছেন।
নারীরা পদবী তার বাবার থেকে নেয়। অনেকে বিয়ের পর স্বামীরটা নেয়। অনেকে আবার নামের পাশে স্ত্রী লিংগবাচক বেগম সুলতানা নিয়ে থাকেন। আমাদের দেশে মায়ের নাম নিজের সাথে লাগানোর রেওয়াজ খুবই কম। তবে স্বামীর তার স্ত্রীর পদবী নেওয়ার চর্চা নেই।পদবী তো দূরের কথা, স্ত্রীর কথার গুরুত্ব দিলেই স্বামীকে স্ত্রৈণ হিসেবে সম্বোধন করে ঠাট্টা করা হয়। আরজ আলী মাতুব্বর কিন্তু গুরুত্বের সাথে স্ত্রীর নামে স্বামীর পরিচিতি পাবার বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
আরজ আলী মাতুব্বরের ভাষায়, “সহস্র ভগ অঙ্গে থাকায় ইন্দ্রদেব ‘ভগবান’ আখ্যা পেয়েছিলেন। কিন্তু মহাদেব শিবকেও ‘ভগবান’ বলা হয়, অথচ তার দেহে ‘ভগ’ ছিল না একটিও। তত্রাচ তিনি ‘ভগবান’ আখ্যা প্রাপ্তির কারণ হয়তো এই যে তিনি ছিলেন ভগবতীর স্বামী। স্বয়ং ‘ভগযুক্তা’ বলেই দূর্গাদেবী হচ্ছেন ভগবতী এবং‘ভগবতী’- এর পুংরূপে হয়তো শিব বনেছেন ভগবান। যদি তা-ই হয় অর্থাৎ ভগযুক্তা বলে দূর্গাদেবী ভগবতী হন এবং ভগবতীর স্বামী বলে শিব ভগবান হয়ে থাকেন, তাহলে জগতের তাবৎ নারীরাই ভগবতী এবং তাদের স্বামীরা সব ভগবান।”
“হয়তো’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি নারীর তথা ভগবতীর পুংলিঙ্গ সৃষ্টি করেছেন, যেখানে সমাজ পুংলিঙ্গের স্ত্রীবাচক শব্দ সৃষ্টিতে তৎপর, ধর্ম যেখানে স্ত্রীকে পুরুষের অঙ্গ হতে সৃষ্ট বলে ব্যাখ্যায় ব্যপৃত, আরজ আলী মাতুব্বরের বর্ণনায় সেখানে ভগবান নয়, স্ত্রীর পরিচয়ে পরচিতি লাভ যেন ভাগ্যবানের ভাগ্য। এমন কথা পড়ে নারীবাদীদের হাত স্বতঃস্ফূর্তভাবে তালির শব্দ তুলে। ভগযুক্ত স্ত্রীর স্বামী হিসেবে ভগবান শব্দের ব্যাখ্যায় নারীর অধঃস্তন অবস্থানকে উপরের দিকে সজোড়ে ধাক্কা দেবার মন্ত্র বৈ কি!
বর্তমান বাংলাদেশের সমাজে যেখানে বাবা বা স্বামীর নাম বহনই নারীদের কপালে সমাজের লিখন সেখানে স্ত্রীর নামে শিব ভগবান হয় বলে তার যে ব্যাখ্যা তা নারীবাদের উলুধ্বনিই শোনা যায়।
অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান বলেছেন, “…আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনের জিজ্ঞাসার যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা পাঠকের মনে চিন্তার খোরাক যোগাতে সক্ষম।” এ চিন্তার খোরাক যোগানোতে আরজ আলী মাতব্বর পাঠ প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্তমান প্রজন্মের কোন নারীবাদী পুরুষ স্ত্রীর পদবী গ্রহণ করলে নারীবাদের জয়ধ্বনির অংশীদার ও দাবিদার আরজ আলী মাতুব্বরকেই যে করতে হবে।

চেতনায় নারী (৫)

(অর্ফিউসকে কথা দিয়েছিরাম যে আরজ আলী মাতুব্বরের চেতনায় নারী সিরিজটি শেষ করব। কিস্তু সাময়িক বন্ধের অনেক কারণ এবং কারণগুলো অনেকের কাছে অনর্থক অজুহাতের পর্যায়ে পড়বে বলে তা আর উল্লেখ করছি না। যাহোক, অর্ফিউসকে কথা দেয়ার যাতনায় আবার শুরু করলাম। @অর্ফিউস )
আরজ আলী মাতুব্বর “অনুমান’ গ্রন্থের শেষ নিবন্ধটির নাম সমাপ্তি। সমাপ্তি নিবন্ধের মূল কথাটি দিয়েই আমি আমার লেখার প্রথম পর্বটি শুরু করেছিলাম। স্বামীহারা, বিত্তহারা, গৃহহারা এক বিধবার চার বছর বয়সের ছেলে মৃত মায়ের ফটো তুলাতে মায়ের মৃত্যু পরবর্তী ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান না করতে পেরে একদিন নাখোদাদের নামকরা নায়ক হয়েছেন। মাতৃ শোকের আবেগকে তেজে, শক্তিতে ও আশীর্বাদে পরিণত করেছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর।
বরিশাল প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন সাধারণ কৃষক থেকে আরজ আলী মাতুব্বর হয়ে উঠার মূলে, প্রেরণায়, উদ্ধুদ্ধকারী হিসেবে রয়েছেন এক নারী। তিনি নিজেই বলেছেন, “অগত্যা কতিপয় অমুছল্লি নিয়ে জানাজা ছাড়াই আমার মাকে সৃষ্টিকর্তার হাতে সোপর্দ করতে হয় কবরে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে ছবি তোলা দুষণীয় হলে সে দোষে দোষী স্বয়ং আমিই, আমার মা নন। তথাপি যে আমার মায়ের অবমাননা করা হলো, তা ভেবে না পেয়ে আমি বিমূঢ় হয়ে মার শিয়রে দাঁড়িয়ে তাঁর বিদেহী আত্মাকে উদ্দেশ্য করে এই বলে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘মা! আজীবন ছিলে তুমি ধর্মের একনিষ্ঠ সাধিকা। আর আজ সেই ধর্মের নামেই হলে তুমি শিয়াল-কুকুরের ভক্ষ্য। সমাজে বিরাজ করছে এখন ধর্মের নামে অসংখ্য অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার। তুমি আমায় আশীর্বাদ করো –আমার জীবনের ব্রত হয় যেনো কুসস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণ অভিযান। আর সে অভিযান সার্থক করে আমি যেনো তোমার কাছে আসতে পারি’’।
আবেগে আপ্লুত, দুঃখে মুহ্যমান, প্রতিজ্ঞায় শাণিত মন এ প্রসঙ্গে একটী কবিতার লাইনও যোগ করেছিলেন,
“তুমি আশীর্বাদ করো মোরে মা,
আমি যেনো বাজাতে পারি
সে অভিযানের দামামা”
এ দামামা ধর্মীয় রীতিনীতি, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দুরীকরণে বাজাতে গিয়ে নারীর প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধেও বাজিয়েছেন।
“স্মরণিকা’ গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়টি হল ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরী’।এর প্রথম পাঠ লামচরি গ্রামের অবস্থান ও পরিবেশ। যেখানে একমাত্র লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার চেয়ে একাধিক মসজিদ প্রতিষ্ঠা অগ্রাধিকার পায়। যার বর্ণনায় আরজ আলী মাতুব্বর কবি নজরূল ইসলামের লেখা থেকে উদ্ধৃতি টেনেছেন,” বিশ্ব যাখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখন বসে, বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকাহ-হাদিস চষে।’’ অর্থাৎ তিনিও নজরুলের মত বিংশ শতাব্দীতে এসে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চাকে শিকেয় তুলে, সভ্যতার কথা ভুলে, নারীর মর্যাদা ও নারী অধিকারের প্রতি সম্মান না জানিয়ে, নারীর জীবিনবোধকে গুরুত্ব না দিয়ে নারীকে অবদমিত করতে, নারীর ভোগান্তি বাড়াতে এখনও যে ফেকাহ-হাদিস খুঁজে নারীর বিরুদ্ধে ফতোয়া চলছে — তা উপলদ্ধি করে মর্মাহত।
তিনি যেন দূরবীণ দিয়ে পরবর্তী কয়েক দশকে নারীর অবস্থানকে দেখেই নজরুলের উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে ২০১৩ সালে হেফাজত ইসলাম এর নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনাটিও মনে করিয়ে দেয়।
আরজ আলী মাতুব্বরের লামচরি গ্রামে কয়েক দশক আগে যেমন অবস্থা ছিল আজও বাংলাদেশের যে কোন গ্রাম তা ই রয়ে গেছে। একমাত্র লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার চেয়ে একাধিক মসজিদ প্রতিষ্ঠা অগ্রাধিকার পায়। সেখানে আরও বেড়ে যাচ্ছে অর্ধিশিক্ষিত অপশিক্ষিত মোল্লাদের দৌরাত্ম্য। আর এ দৌরাত্ম্যে নারীকে পেছনের দিকে ঠেলে পাঠানোর অপতৎপরতা বিরাজমান যা আরজ আলী মাতুব্বর তাঁর অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখে ও অন্যকে দেখানোর ব্যবস্থা করে গেছেন তাঁর লেখায়।