Sunday, April 23, 2017

জঙ্গিরা ডাকছে, জেগে উঠুন

উঠোনে জঙ্গিবৃক্ষ। ফল দিয়েছে, খান।
বিষয়টা এমন নয় যে, আওয়ামীলীগকে ক্ষমতা থেকে সরানোর লক্ষ‍্যে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে এসব জঙ্গি তৎপরতা শুরু হয়েছে। বরং স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসা মৌলবাদ তোষণের ফল হচ্ছে চলমান বর্তমান। এমনটিই হওয়া কথ। এটা অনিবার্য ছিলো। যেহেতু সংখ‍্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ, সেহেতু জঙ্গিবাদের বীজ আগেই বপন করা হয়েছে। আপনারা সেই বীজে সার দিয়েছেন, জল দিয়েছেন। পাতা ফোটার পর বেড়া দিয়ে রক্ষা করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন সব রাজনৈতিক দল। কেউ প্রকাশ‍্যে, কেউ অপ্রকাশ‍্যে বসে বসে জঙ্গিবৃক্ষের পাতায় হাত বুলিয়েছেন, যত্ন নিয়েছেন, বড় করেছেন। এখন ফল দিচ্ছে, সে ফল খাবেন। খেতে হবে। অযথা অস্বীকার করছেন, এড়িয়ে যাওয়ার ভান করছেন। এটা ঠিক না।
জঙ্গিরা সোয়াট ডাকে, পাঠান।
পথে ঘাটে পুলিশের উপর হামলা হয়। ফাঁড়িতে, চেকপোস্টে, পুলিশবক্সে, আসামী বহনকারী প্রিজনভ‍্যানে অসংখ‍্যবার হামলা হয়েছে। হলি আর্টিজানের অভিযানে পুলিশ মরেছে। তবুও আপনারা জাগেননি। উল্টো বই মেলায় গিয়ে সেন্সরবোর্ড বসিয়েছেন। এর আগে ব্লগারদের শাসিয়েছেন, তাড়িয়েছেন। আরো অনেক কিছু করেছেন। আপনাদেরকে জঙ্গিরা মারে, পেটায়, দৌড়ানি দেয়। অথচ স্কচটেপ নিয়ে এগিয়ে যান প্রগতিশীল মানুষদের মুখে লাগাতে। কেন, কেন আপনারা এমন? কীসের জন‍্য এসব করেন?
পুলিশের ঘুম ভাঙাতে না পেরে জঙ্গিরা গেলো র‍্যাবের কাছে। একেবারে ক‍্যাম্পে ঢুকে কানের ভেতর খড় ঘুরিয়ে ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে একজন জঙ্গি জীবনও দিলো। তবু ঘুম ভাঙে না। তারা ব‍্যস্ত ক্রসফায়ার বিজনেসে। কোটি কোটি টাকার ব‍্যবসার কাছে জঙ্গি হামলা তাদের কাছে সুড়সুড়ির মত। সুড়সুড়ি খেয়ে অন‍্যমনস্ক হয়ে একটু নড়ে, হাসে। তারপর আবার ব‍াণিজ‍্যে ঢুকে যায়।
পুলিশ গেলো, র‍্যাব গেলো। এবার জঙ্গিরা বলে তাদের জন‍্য সোয়াট পাঠাতে। এমনভাবে ডাকছে, যেন বাপে মরার সময় অসিয়ত করে গেছে “আমি মরার পর ১০ জন সোয়াট ডেকে ভালোমন্দ খাওয়াস।” হেভি তাড়া ছিলো, “সময় কম, সোয়াট পাঠান।” মানে, জানপ্রাণ দিয়ে সরকারের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে জঙ্গিরা। নাস্তিক, মুক্তমনা, প্রগতিশীলরাতো ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে কেউ দেশ ছেড়েছে, কেউ ডুব দিয়েছে, কেউ মানিয়ে নিচ্ছে… খুব বিচ্ছিরি অবস্থা। তাই সরকারের ঘুম ভাঙানোর দায়িত্ব জঙ্গিরাই নিয়েছে। কিন্তু “প্রিয়ারও এমনও কঠিনো গভীরো ঘুমও কী ভাঙে…!”
আর্মির টর্চ নাই। আসলে অভিজ্ঞতা নাই। হবে।
সিলেটে জঙ্গিরা সোয়াট ডেকে আর্মি পেলো। খুশি হলো। সেই খুশিতে ঢাকার বিমানবন্দরে এক জঙ্গি নিজেকে ফাটিয়ে দিলো। পুলিশের বড়কর্তা বললেন খুশিতে নয়, “অতিসতর্কতায় ফেটে গেছে।” যাইহোক আর্মি গেলো অভিযানে। কিন্তু সাথে টর্চ নিয়ে যায়নি। আবহাওয়া খারাপ, আকাশে মেঘ। পরিস্থিতি খারাপ, বিদ‍্যুত সংযোগ বন্ধ। সময় খারাপ, চারদিকে অন্ধকার। কিন্তু আর্মির মনে আশা ছিলো, ভালোবাসা ছিলো, আলো ছিলো। আর্মি ভেবেছে, যেহেতু জঙ্গিরা ভালোবেসে সোয়াট ডেকেছে, সেহেতু তারা ৫ তলা বাড়ির প্রতিটি সিঁড়িতে, রুমে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখবে। “তোমরা বাতি জ্বালাওগো, আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে!” কিন্তু কেউ বাতি জ্বালিয়ে রাখেনি। প্রতারণা করেছে। তাই পাশের বাড়িগুলোতে টর্চ খুঁজতে হয়েছে। বিষয়টা প্রতীকী। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আর্মি নিজেই অন্ধকারে আছে। তাই জনতার কাছে গিয়েছে আলোর সন্ধানে। অবশ‍্য কন্সট্রাকশন বিজনেস সামলাতেই সময় চলে যায়, টর্চ নেয়ার কথা মনে থাকে কি করে! শুধু অপারেশনের নামের সাথে লাইট লাগাতে ভুল হয় না। অপারেশন টুইলাইট!
ব‍্যাপার না। সবেতো শুরু। সামনে যে কঠিন ভবিষ‍্যত অপেক্ষা করছে, এসব অভিজ্ঞতার ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে। একটু সময় লাগবে আরকি।
যারা বলে এসব নাটক, তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রীর লোক
গত কয়েকবছর আমরা একইসাথে দু’টো বিবৃতি পড়তে/শুনতে/দেখতে অভ‍্যস্ত হয়ে গেছি। প্রথমে আইএস বা আলকায়দা অথবা আনসারুল্লাহ বিবৃতি দিয়ে খুনের দায়, হামলার তায় স্বীকার করবে। তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রী বলবে এসব ভুয়া কথা, দেশে কোন আয়েস পায়েস নাই।
এটা বার বার ঘটেছে। এখনো ঘটেই যাচ্ছে। সিলেটে জঙ্গি অভিযানের মাঝে ঢাকায় এক জঙ্গি আত্মঘাতী হামলা করলো, পুলিশ বলে এটা হামলা নয়। অতিসতর্কতা! অস্বীকার, জঘন‍্য অস্বীকার। কেন? কারণ স্বীকার করলেই জঙ্গি দমনে সর্বাত্মকভাবে মাঠে নামতে হবে। শফি, চরমোনাই, আলেমালীগ, কালেমালীগ, ঝামেলালীগ, সবগুলারে সাইজ করতে হবে। নিজেদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে গড়ে তোলা এত বড় বড় দৈত‍্য দানব সাইজ করার মত সাহস ও নৈতিক বল সরকারের নেই। কারণ তারা ডুবে আছে দুর্নীতি আর দুঃশাসনে। একেবারে মাখামাখি অবস্থা। অশ্লীল!
তো এখন কী করতে হবে? বলতে হবে জঙ্গি নাই, আইএস নাই। মানুষ মরুক, পুলিশ মরুক। তবুও বলতে হবে আইএস নাই। নাই মানে নাই। তো, নাই বললেও বুঝায় জঙ্গি নাই, আবার জঙ্গি ধরার অভিযানকে নাটক বললেও বুঝায় জঙ্গি নাই। দুই পার্টিই এক। প্রথম পার্টি কয়, “দেশে কোন জঙ্গি নাই, তাই দমননীতি নাই।” সেকেন্ড পার্টি কয়, “দেশে কোন জঙ্গি নাই। সরকার অভিযানের নামে নাটক করে।” তারমানে দুই পক্ষই বলতেছে দেশে কোন জঙ্গি নাই। যেটা বলা প্রধানমন্ত্রীর পলিসি। সুতরাং যারা বলে জঙ্গি নাই, তারা প্রধানমন্ত্রীর লোক।
শরমের কিছু নেই, উঠে পড়ুন
আমরা যারা মরনপণ চিৎকার করেছি, মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গলা ফাটিয়েছি, হেফাজতের সাথে সখ‍্যতায় ছি ছি করেছি, এখন তাদের কথা শুনতে বিষের মত লাগে? মুখ লুকাতে ইচ্ছা করে? আমরা যখন মাথামোটা প্রধানমন্ত্রী, বেয়াদব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পা চাটা পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব‍্য নিয়ে স‍্যাটায়ার করি, তখন রাগে গা জ্বলে? কিচ্ছু করার নেই। এই খানাখন্দের পথ আপনারা যত্ন করে নির্মাণ করেছেন। এখন যদি মনে করেন এই পথ মেরামত করতে হবে, তাহলে শরম পেয়ে লাভ নেই। গায়ে জ্বলুনি ধরিয়েও লাভ নেই। মিডিয়াতে কওয়ার দরকার নেই, জাস্ট মনে মনে “দেশে জঙ্গি আছে, রুখতে হবে” বলে মাঠে নেমে যান। সাপের গর্তে ঢুকেছেন, বুদ্ধি খাটান, লড়াই করেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মরার কোন মানে হয় না।
জঙ্গিরা ডাকছে, জেগে উঠুন। প্লীজ।

Friday, April 21, 2017

হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ -

০১. মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।

০২. পুঁজিবাদের আল্লার নাম টাকা, মসজিদের নাম ব্যাংক।

০৩. হিন্দুরা মূর্তিপূজারী, মুসলমানেরা ভাবমূর্তিপূজারী। মূর্তিপূজা নির্বুদ্ধিতা, আর ভাবমূর্তিপূজা ভয়াবহ।

০৪. আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে, এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

০৫. পরমাত্মীয়ের মৃত্যুর শোকের মধ্যেও মানুষ কিছুটা সুখ বোধ করে যে সে নিজে বেঁচে আছে।

০৬. একটি স্থাপত্যকর্ম সম্পর্কেই আমার কোনো আপত্তি নেই, তার কোনো সংস্কারও আমি অনুমোদন করি না। স্থাপত্যকর্মটি হচ্ছে নারীদেহ।

০৭. প্রতিটি দগ্ধ গ্রন্থ সভ্যতাকে নতুন আলো দেয়।

০৮. অধিকাংশ রূপসীর হাসির শোভা মাংসপেশির কৃতিত্ব, হৃদয়ের কৃতিত্ব নয়।

০৯. বাঙলায় তরুণ বাবরালিরা খেলারাম, বুড়ো বাবরালিরা ভণ্ডরাম।

১০. পুরস্কার অনেকটা প্রেমের মতো : দু-একবার পাওয়া খুবই দরকার, এর বেশি পাওয়া লাম্পট্য।

১১. আমাদের অঞ্চলে সৌন্দর্য অশ্লীল, অসৌন্দর্য শ্লীল। রূপসীর একটু নগ্ন বাহু দেখে ওরা হৈচৈ করে, কিন্তু পথে পথে ভিখিরিনির উলঙ্গ দেহ দেখে ওরা বিচলিত হয় না।

১২. এক-বইয়ের-পাঠক সম্পর্কে সাবধান।

১৩. বুদ্ধিজীবীরা এখন বিভক্ত তিন গোত্রে : ভণ্ড, ভণ্ডতর, ভণ্ডতম।

১৪. যে বুদ্ধিজীবী নিজের সময় ও সমাজ নিয়ে সন্তুষ্ট, সে গৃহপালিত পশু।

১৫. পা, বাঙলাদেশে, মাথার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পদোন্নতির জন্য এখানে সবাই ব্যগ্র, কিন্তু মাথার যে অবনতি ঘটছে, তাতে কারো কোনো উদ্বেগ নেই।

১৬. জন্মান্তরবাদ ভারতীয় উপমহাদেশের অবধারিত দর্শন। এ অঞ্চলে একজন্মে পরীক্ষা দিতে হয়, আরেক জন্মে ফল বেরোয়, দু-জন্ম বেকার থাকতে হয়, এবং ভাগ্য প্রসন্ন হ'লে কোনো এক জন্মে চাকুরি মিলতেও পারে।

১৭. মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে, কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে।

১৮. বাঙালি আন্দোলন করে, সাধারণত ব্যর্থ হয়, কখনো কখনো সফল হয়, এবং সফল হওয়ার পর বাঙালির মনে থাকে না কেনো তারা আন্দোলন করেছিল।

১৯. এদেশের মুসলমান এক সময় মুসলমান বাঙালি, তারপর বাঙালি মুসলমান, তারপর বাঙালি হয়েছিল। এখন আবার তারা বাঙালি থেকে বাঙালি মুসলমান, বাঙালি মুসলমান থেকে মুসলমান বাঙালি, এবং মুসলমান বাঙালি থেকে মুসলমান হচ্ছে। পৌত্রের ঔরষে জন্ম নিচ্ছে পিতামহ।

২০. একটি নির্বোধ তরুণীর সাথেও আধ ঘণ্টা কাটালে যে জ্ঞান হয়, আরিস্ততলের সাথে দু-হাজার বছর কাটালেও তা হয় না।

২১. প্রতিটি সার্থক প্রেমের কবিতা বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে পায় নি, প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমের কবিতা বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে বিয়ে করেছে।

২২. প্রতিটি বিজ্ঞাপনে পণ্যটির থেকে পণ্যাটি অনেক লোভনীয়; তাই ব্যর্থ হচ্ছে বিজ্ঞাপনগুলো। দর্শকেরা পণ্যাটিকেই কিনতে ও ব্যবহার করতে অধিক আগ্রহ বোধ করে।

২৩. কোনো দেশের লাঙলের রূপ দেখেই বোঝা যায় ওই দেশের মেয়েরা কেমন নাচে, কবিরা কেমন কবিতা লেখেন, বিজ্ঞানীরা কী আবিষ্কার করেন আর রাজনীতিকেরা কতোটা চুরি করেন।

২৪. যারা ধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়, তারা ধার্মিকও নয়, বিজ্ঞানীও নয়। শুরুতেই স্বর্গ থেকে যাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল, তারা তার বংশধর।

২৫. শিল্পকলা হচ্ছে নিরর্থক জীবনকে অর্থপূর্ণ করার ব্যর্থ প্রয়াস।

২৬. মূর্তি ভাঙতে লাগে মেরুদণ্ড, মূর্তিপূজা করতে লাগে মেরুদণ্ডহীনতা।

২৭. বাঞ্ছিতদের সাথে সময় কাটাতে চাইলে বই খুলুন, অবাঞ্ছিতদের সাথে সময় কাটাতে চাইলে টেলিভিশন খুলুন।

২৮. এমন এক সময় আসে সকলেরই জীবনে যখন ব্যর্থতাগুলোকেই মনে হয় সফলতা, আর সফলতাগুলোকেই মনে হয় ব্যর্থতা।

২৯. বিশ্বের নারী নেতারা নারীদের প্রতিনিধি নয়, তারা সবাই রুগ্ন পিতৃতন্ত্রের প্রিয় সেবাদাসী।

৩০. অধিকাংশ সুদর্শন পুরুষ আসলে সুদর্শন গর্দভ, তাদের সাথে সহবাসে একটি দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর সাথে সহবাসের অভিজ্ঞতা হয়।

৩১. ক্ষুধা ও সৌন্দর্যবোধের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে সব দেশে অধিকাংশ মানুষ অনাহারী, সেখানে মাংসল হওয়া রূপসীর লক্ষণ; যে সব দেশে প্রচুর খাদ্য আছে, সেখানে মেদহীন হওয়া রূপসীর লক্ষণ। এজন্যেই হিন্দি আর বাঙলা ফিল্মের নায়িকাদের দেহ থেকে মাংস ও চর্বি উপচে পড়ে। ক্ষুধার্ত দর্শকেরা সিনেমা দেখে না, মাংস ও চর্বি খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করে।

৩২. যতোদিন মানুষ অসৎ থাকে, ততোদিন তার কোনো শত্রু থাকে না; কিন্তু যেই সে সৎ হয়ে উঠে, তার শত্রুর কোনো অভাব থাকে না।

৩৩. ভক্ত শব্দের অর্থ খাদ্য। প্রতিটি ভক্ত তার গুরুর খাদ্য। তাই ভক্তরা দিনদিন জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয়ে আবর্জনায় পরিণত হয়।

৩৪. এদেশে সবাই শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক। দারোগার শোকসংবাদেও লেখা হয় : 'তিনি শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক ছিলেন!'

৩৫. কারো প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রাখার উপায় হচ্ছে তার সাথে কখনো সাক্ষাৎ না করা।

৩৬. পুরুষ তার পুরুষ বিধাতার হাতে লিখিয়ে নিয়েছে নিজের রচনা; বিধাতা হয়ে উঠেছে পুরুষের প্রস্তুত বিধানের শ্রুতিলিপিকর।

৩৭. বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিণত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে।

৩৮. নজরুলসাহিত্যের আলোচকেরা সমালোচক নন, তাঁরা নজরুলের মাজারের খাদেম।

৩৯. বাঙালির জাতিগত আলস্য ধরা পড়ে ভাষায়।বাঙালি 'দেরি করে', 'চুরি করে', 'আশা করে' এমনকি 'বিশ্রাম করে'। বিশ্রামও বাঙালির কাছে কাজ।

৪০.বাঙালি অভদ্র, তার পরিচয় রয়েছে বাঙালির ভাষায়। কেউ এলে বাঙালি জিজ্ঞেস করে, 'কী চাই?' বাঙালির কাছে আগন্তুকমাত্রই ভিক্ষুক। অপেক্ষা করার অনুরোধ জানিয়ে বাঙালি বলে, 'দাঁড়ান'। বসতে বলার সৌজন্যটুকুও বাঙালির নেই।

৪১. এখানে সাংবাদিকতা হচ্ছে নিউজপ্রিন্ট-বলপয়েন্ট-মিথ্যার পাচঁন।

৪২. বিনয়ীরা সুবিধাবাদী,আর সুবিধাবাদীরা বিনয়ী।

৪৩. শ্রেষ্ঠ মানুষের অনুসারীরাও কতোটা নিকৃষ্ট হ'তে পারে চারদিকে তাকালেই তা বোঝা যায়।

৪৪. কবিতা এখন দু-রকম : দালালি, ও গালাগালি।

৪৫. দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম প্রেম ব'লে কিছু নেই। মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম।

৪৬. কোন কালে এক কদর্য কাছিম দৌড়ে হারিয়েছিলো এক খরগোশকে, সে-গল্পে কয়েক হাজার বছর ধ'রে মানুষ মুখর। তারপর খরগোশ কতো সহস্রবার হারিয়েছে কাছিমকে, সে-কথা কেউ বলে না।

৪৭. পুঁজিবাদী পর্বের সবচেয়ে বড়ো ও জনপ্রিয় কুসংস্কারের নাম প্রেম।

৪৮. শাশ্বত প্রেম হচ্ছে একজনের শরীরে ঢুকে আরেকজনকে স্বপ্ন দেখা।

৪৯. প্রেম হচ্ছে নিরন্তর অনিশ্চয়তা। বিয়ে ও সংসার হচ্ছে চূড়ান্ত নিশ্চিন্তির মধ্যে আহার. নিদ্রা, সঙ্গম, সন্তান ও শয়তানি।

৫০. শাড়ি প'রে শুধু শুয়ে থাকা যায়, এজন্যে বাঙালি নারীদের হাঁটা হচ্ছে চলমান শোয়া।

৫১. পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক দুরবস্থার সম্ভবত গভীর ফ্রয়েডীয় কারণ রয়েছে। সমাজতন্ত্রের মার্ক্সীয়, লেনিনীয়, স্তালিনীয় আবেদন ছিলো, কিন্তু যৌনাবেদন ছিলো না।

৫২.বিপ্লবীদের বেশি দিন বাঁচা ঠিক নয়। বেশি বাঁচলেই তারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।

৫৩. ইতিহাস হচ্ছে বিজয়ীর হাতে লেখা বিজিতের নামে একরাশ কুৎসা।

৫৪. পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শহীদের নাম মা।

৫৫. গত দু-শো বছর গবাদিপশুর অবস্থার যতোটা উন্নতি ঘটেছে নারীর অবস্থার ততোটা উন্নতি ঘটে নি।

৫৬. মৌলবাদ হচ্ছে আল্লার নামে শয়তানবাদ।

৫৭. মানুষ মরলে লাশ হয়, সংস্কৃতি মরলে প্রথা হয়।

৫৮. পৃথিবীর প্রধান বিশ্বাসগুলো অপবিশ্বাস মাত্র। বিশ্বাসীরা অপবিশ্বাসী।

৫৯. আমি ঈর্ষা করি শুধু তাদের যারা আজো জন্মে নি।

৬০. মুসলমানের মুক্তি ঘটে নি, কারণ তারা অতীত ও তাদের মহাপুরুষদের সম্পর্কে কোনো সত্যনিষ্ঠ আলোচনা করতে দেয় না।

৬১. সতীচ্ছদ আরব পুরুষদের জাতীয় পতাকা।

৬২. ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের আধুনিক উৎস মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

৬৩. মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা, মন্দিরও ভাঙে ধার্মিকেরা। তারপরেও তারা দাবি করে তারা ধার্মিক, আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই তারা অধার্মিক বা নাস্তিক।

 ৬৩ নিন্দুকেরা পুরোপুরি অসৎ হ’তে পারেন না, কিছুটা সততা তাঁদের পেশার জন্যে অপরিহার্য; কিন্তু প্রশংসাকারীদের পেশার জন্যে মিথ্যাচারই যথেষ্ট।

৬৪ বাস্তব কাজ অনেক সহজ অবাস্তব কাজের থেকে ; আট ঘন্টা একটানা শ্রম গাধাও করতে পারে, কিন্তু একটানা এক ঘন্টা স্বপ্ন দেখা রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও অসম্ভব।

৬৫ একটি নির্বোধ তরুণীর সাথেও আধ ঘণ্টা কাটালে যে-জ্ঞান হয়, আরিস্ততলের সাথে দু-হাজার বছর কাটালেও তা হয় না।

 ৬৬ প্রতিটি সার্থক প্রেমের কবিতা বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে পায় নি, প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমের কবিতা বোঝায় যে কবি প্রেমিকাকে বিয়ে করেছে।

 ৬৭ বিলেতের কবিগুরু বলেছিলেন যারা সঙ্গীত ভালোবাসে না, তারা খুন করতে পারে; কিন্তু আজকাল হাইফাই শোনার সাথেসাথে এক ছুরিকায় কয়েকটি-গীতিকার, সুরকার, গায়ক/গায়িকাকে খুন করতে ইচ্ছে হয়।

 ৬৮ এখন পিতামাতারা গৌরব বোধ করেন যে তাঁদের পুত্রটি গুণ্ডা। বাসায় একটি নিজস্ব গুণ্ডা থাকায় প্রতিবেশীরা তাঁদের সালাম দেয়, মুদিদোকানদার খুশি হয়ে বাকি দেয়, বাসার মেয়েরা নির্ভয়ে একলা পথে বেরোতে পারে, এবং বাসায় একটি মন্ত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৬৯ তৃতীয় বিশ্বের নেতা হওয়ার জন্যে দুটি জিনিশ দরকার : বন্দুক ও কবর।

৭০ প্রতিটি বিজ্ঞাপনে পণ্যটির থেকে পণ্যাটি অনেক লোভনীয়; তাই ব্যর্থ হচ্ছে বিজ্ঞাপনগুলো। দর্শকেরা পণ্যের থেকে পণ্যাটিকেই কিনতে ও ব্যবহার করতে অধিক আগ্রহ বোধ করে।

৭১ কোন দেশের লাঙলের রূপ দেখেই বোঝা যায় ওই দেশের মেয়েরা কেমন নাচে, কবিরা কেমন কবিতা লেখেন, বিজ্ঞানীরা কী আবিষ্কার করেন, আর রাজনীতিকেরা কতোটা চুরি করে।

৭২ যারা ধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়, তারা ধার্মিকও নয়, বিজ্ঞানীও নয়। শুরুতেই স্বর্গ থেকে যাকে বিতারিত করা হয়েছিলো, তারা তার বংশধর।

৭৩ যতোদিন মানুষ অসৎ থাকে, ততোদিন তার কোনো শত্রু থাকে না; কিন্তু যেই সে সৎ হয়ে উঠে, তার শত্রুর অভাব থাকে না।

৭৪ নারী সম্পর্কে আমি একটি বই লিখছি; কয়েকজন মহিলা আমাকে বললেন, অধ্যাপক হয়ে আমার এ-বিষয়ে বই লেখা ঠিক হচ্ছে না। আমি জানতে চাইলাম, কেনো ? তাঁরা বললেন, বিষয়টি অশ্লীল !

৭৫ এদেশে সবাই শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক : দারোগার শোকসংবাদেও লেখা হয়, ‘তিনি শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক ছিলেন!’

৭৬ শিল্পকলা হচ্ছে নিরর্থক জীবনকে অর্থপূর্ণ করার ব্যর্থ প্রয়াস।

৭৭ কিছু বিশেষণ ও বিশেষ্য পরস্পরসম্পর্কিত; বিশেষ্যটি এলে বিশেষণটি আসে, বিশেষণটি এলে বিশেষ্যটি আসে। তারপর একসময় একটি ব্যবহার করলেই অন্যটি বোঝায়, দুটি একসাথে ব্যবহার করতে হয় না। যেমন : ভণ্ড বললেই পীর আসে, আবার পীর বলতেই ভন্ড আসে। এখন আর ‘ভণ্ড পীর’ বলতে হয় না; ‘পীর’ বললেই ‘ভণ্ড পীর’ বোঝায়।
৭৮ ভক্ত শব্দের অর্থ খাদ্য। প্রতিটি ভক্ত তার গুরুর খাদ্য। তাই ভক্তরা দিনদিন জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয়ে আবর্জনায় পরিণত হয়।

৭৯ মূর্তি ভাঙতে লাগে মেরুদণ্ড, মূর্তিপূজা করতে লাগে মেরুদণ্ডহীনতা।

৮০ আমাদের সমাজ যাকে কোনো মূল্য দেয় না, প্রকাশ্যে তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করে, আর যাকে মূল্য দেয় প্রকাশ্যে তার নিন্দা করে। শিক্ষকের কোনো মূল্য নেই, তাই তার প্রশংসায় সমাজ পঞ্চমুখ; চোর, দারোগা, কালোবাজারি সমাজে অত্যন্ত মুল্যবান, তাই প্রকাশ্যে সবাই তাদের নিন্দা করে।

 ৮১ সৌন্দর্য রাজনীতির থেকে সব সময়ই উৎকৃষ্ট।

৮২ ক্ষুধা ও সৌন্দর্যবোধের মধ্যে গভীরসম্পর্ক রয়েছে। যে-সব দেশে অধিকাংশ মানুষঅনাহারী, সেখানে মাংসল হওয়া রূপসীর লক্ষণ; যে-সব দেশে প্রচুর খাদ্য আছে,সেখানে মেদহীন হওয়া রূপসীর লক্ষণ। এজন্যেই হিন্দি আর বাঙলা ফিল্মের নায়িকাদের দেহ থেকে মাংস চর্বি উপচে পড়ে। ক্ষুধার্ত দর্শকেরা সিনামা দেখে না, মাংস ও চর্বি খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করে।

 ৮৩ বাঞ্ছিতদের সাথে সময় কাটাতে চাইলে বই খুলুন, অবাঞ্ছিতদের সাথে সময় কাটাতে চাইলে টেলিভিশন খুলুন।

৮৪ স্তবস্তুতি মানুষকে নষ্ট করে। একটি শিশুকে বেশি স্তুতি করুন, সে কয়েকদিনে পাক্কা শয়তান হয়ে উঠবে। একটি নেতাকে স্তুতি করুন, কয়েকদিনের মধ্যে দেশকে সে একটি একনায়ক উপহার দেবে।

৮৫ ধনীরা যে মানুষ হয় না, তার কারণ ওরা কখনো নিজের অন্তরে যায় না। দুঃখ পেলে ওরা ব্যাংকক যায়, আনন্দেওরা আমেরিকা যায়। কখনো ওরা নিজের অন্তরে যেতে পারে না, কেননা অন্তরে কোনো বিমান যায় না।

 ৮৬ বাঙলাদেশের রাজনীতিকেরা স্থূল মানুষ, তারা সৌন্দর্য বোঝে না ব’লে গণতন্ত্রও বোঝে না; শুধু লাইসেন্স-পারমিট-মন্ত্রীগিরি বোঝে।

 ৮৭ এমন এক সময় আসে সকলেরই জীবনে যখন ব্যর্থতাগুলোকেই মনে হয় সফলতা, আর সফলতাগুলোকে মনে হয় ব্যর্থতা। ৮৮ রাজনীতি ও সংস্কৃতি সম্পুর্ণ বিপরীত বস্তু ; একটি ব্যাধি অপরটি স্বাস্থ্য।

৮৯ মহিলাদের ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রবল। আমার এক বন্ধুপত্নী স্বামীর সাথে টেলিফোনে আলাপের সময়ও তার স্বামীর মুখে হুইস্কির ঘ্রাণ পান।

 ৯০ আগে প্রতিভাবানেরা বিদেশ যেতো; এখন প্রতিভাহীনেরা নিয়মিত বিদেশ যায়।

 ৯১ অধিকাংশ সুদর্শন পুরুষই আসলে সুদর্শন গর্দভ; তাদের সাথে সহবাসে একটি দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর সাথে সহবাসের অভিজ্ঞতা হয়।

 ৯২ বিশ্বের নারী নেতারা নারীদের প্রতিনিধি নয় ; তারা সবাই রুগ্ন পিতৃতন্ত্রের প্রিয় সেবাদাসী।

৯৩ কোন বাঙালি আজ পর্যন্ত আত্মজীবনী লেখে নি, কেননা আত্মজীবনী লেখার জন্যে দরকার সততা। বাঙালির আত্মজীবনী হচ্ছে শয়তানের লেখা ফেরেশতার আত্মজীবনী।

৯৪ মানুষের তুলনায় আর সবই ক্ষুদ্র : আকাশ তার পায়ের নিচে,চাঁদ তার এক পদক্ষেপের দূরত্বে, মহাজগত তার নিজের বাড়ি।

৯৫ কারো প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রাখার উপায় হচ্ছে তার সাথে কখনো সাক্ষাৎ না করা।

৯৬ চারাগাছেও মাঝেমাঝে ফোটে ভয়ংকর ফুল।

৯৭ পুরুষ তার পুরুষ বিধাতার হাতে লিখিয়ে নিয়েছে নিজেররচনা; বিধাতা হয়ে উঠেছে পুরুষের প্রস্তুত বিধানের শ্রুতিলিপিকর।

 ৯৮ হিন্দুবিধানে পুরুষ দ্বারা দূষিত না হওয়া পর্যন্ত নারী পরিশুদ্ধ হয় না!

৯৯ উচ্চপদে না বসলে এদেশে কেউ মূল্য পায় না। সক্রেটিস এদেশে জন্ম নিলে তাঁকে কোনো একাডেমির মহাপরিচালক পদের জন্যে তদ্বির চালাতে হতো।

১০০ সব ধরনের অভিনয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে রাজনীতি; রাজনীতিকেরা অভিনয় করে সবচেয়ে বড় মঞ্চে ও পর্দায়।

১০১ সক্রেটিস বলেছেন তিনি দশ সহস্র গর্দভ দ্বারা পরিবৃত। এখন থাকলে তিনি ওই সংখ্যার ডানে কটি শূন্য যোগ করতেন?

 ১০২ বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিনত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে।

 ১০৩ নজরুলসাহিত্যের আলোচকেরা সমালোচক নন, তাঁরা নজরুলের মাজারের খাদেম।

 ১০৪ ভ্রষ্ট বাঙালিকে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ উপায় তার গালে শক্ত ক’রে একটি চড় কষিয়ে দেয়া।

১০৫ ভিখিরির জীবন মহৎ উপন্যাসের বিষয় হ’তে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানদের জীবন সুখপাঠ্য গুজবনামারও অযোগ্য।

১০৬ বাঙালির জাতিগত আলস্য ধরা পড়ে ভাষায়। বাঙালি ‘দেরি করে’, ‘চুরি করে’, ‘আশা করে’, এমনকি ‘বিশ্রাম করে’। বিশ্রামও বাঙালির কাছে কাজ।

১০৭ বাঙালি অভদ্র, তার পরিচয় রয়েছে বাঙালির ভাষায়। কেউ এলে বাঙালি জিজ্ঞেস করে, ‘কী চাই?’ বাঙালির কাছে আগন্তুকমাত্রই ভিক্ষুক। অপেক্ষা করার অনুরোধ জানিয়ে বাঙালি বলে, ‘দাঁড়ান’। বসতে বলার সৌজন্যটুকুও বাঙালির নেই।

১০৮ এখানে সাংবাদিকতা হচ্ছে নিউজপ্রিন্ট-বলপয়েন্ট-মিথ্যার পাচঁন।

১০৯ মানুষ মরণশীল, বাঙালি অপমরণশীল।

 ১১০ এ-সরকার মাঝে মাঝে গোপন চক্রান্ত ফাঁস ক’রে ফেলে। সরকার মাটি আর মানুষের সমন্বয় ঘটানোরসংকল্প ঘোষণা করেছে। আমি ভয় পাচ্ছি, কেননা মাটি ও মানুষের সমন্বয় ঘটে শুধু কবরে।

১১১ আজকালকার আধিকাংশ পি এইচ ডি অভিসন্দর্ভই মনে আশার আলো জ্বালায়; মনে হয় এখানেই নিহিত আমাদের শিক্ষাসমস্যা সমাধানের বীজ। প্রথম বর্ষ অনার্স শ্রেণীতেই এখন পি এইচ ডি কোর্স চালু করা সম্ভব, এতে ছাত্ররা আড়াই বছরে একটি ডক্টরেট ডিগ্রি পেতে পারে। এখানকার অধিকাংশ ডক্টরেটই স্নাতকপূর্ব ডক্টরেট; অদূর ভবিষ্যতে উচ্চ-মাধ্যমিক ডক্টরেটও পাওয়া যাবে।

১১২ সত্য একবার বলতে হয়; সত্য বারবার বললে মিথ্যার মতো শোনায়। মিথ্যা বারবার বলতে হয়; মিথ্যা বারবার বললে সত্য ব’লে মনে হয়।

১১৩ ফুলের জীবন বড়োই করুণ। অধিকাংশ ফুল অগোচরেই ঝ’রে যায়, আর বাকিগুলো ঝোলে শয়তানের গলায়।

১১৪ ঢাকা শহরে, ক্রমবর্ধমান এ-পাগলাগারদে, সাতাশ বছর আছি। ঢাকা এখন বিশ্বের বৃহত্তম পাগলাগারদ; রাজধানি নয়, এটা পাগলাধানি; কিন্তু বদ্ধপাগলেরা তা বুঝতে পারে না।

 ১১৫ বদমাশ হওয়ার থেকে পাগল হওয়া অনেক মানবিক।

১১৬ টেলিভিশনে জাহাজমার্কা আলকাতরার বিজ্ঞাপনটি আকর্ষণীয়, তাৎপর্যপূর্ণ; তবে অসম্পুর্ণ । বিজ্ঞাপনটিতে জালে,জাহাজে, টিনের চালে আলকাতরা লাগানোর উপকারিতার কথা বলা হয়; কিন্তু বলা উচিত ছিলো যে জাহাজমার্কা আলকাতরা লাগানোর উৎকৃষ্টতম স্থান হচ্ছে টেলিভিশনের পর্দা, বিশেষ ক’রে যখন বাঙলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখা যায়।

১১৭ রবীন্দ্রনাথ এখন বাঙলাদেশের মাটিথেকে নির্বাসিত, তবে আকাশটা তাঁর। বাঙলার আকাশের নাম রবীন্দ্রনাথ।

১১৮ গণশৌচাগার দেখলেই কেনোযেনো আমার বাঙালির আত্মাটির কথা বারবার মনে পড়ে।

১১৯ আমাদের অধিকাংশের চরিত্রএতো নির্মল যে তার নিরপেক্ষ বর্ণনা দিলেও মনে হয় অশ্লীলগালাগাল করা হচ্ছে।

১২০ এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি,তুমি কথা বলো।

ইহকাল ও পরকালের এত সাদৃশ্য কেন???

পরকালের অন্তর্গত কবর,হাশর,দোজখ ইত্যাদির যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায় তার প্রায় প্রত্যেকটি পৃথিবীর বিষয়বস্তুর অনুকরণ বা আনুসরন।যথা:

কবরে:

1>সাওয়াল বা প্রশ্ন

2>গুর্জ বা গদা।

3>সুরঙ্গ

4>স্নিগ্ধ সমীকরণ

5>উত্তপ্ত বায়ু

6>সাপ,বিচ্ছু

7>আগুন ইত্যাদি।



হাশর ময়দানে:

1>তামার পাত

2>সুর্যের তাপ

3>সাক্ষ-জবানবন্দী

4>দাঁড়ি-পাল্লা

5>বিচার

6>ছায়া

7>সুপারিশ

8>সাঁকো বা পুলসেরাত

9>বিশেষ সরবত

10>নেকি ভিক্ষার চেষ্টা ইত্যাদি।



বেহেস্ত:

1>সুস্বাদু ফল

2>সুপেয় জল

3>দুধ

4>মধু

5>সুন্দরী রমনী

6>সুন্দর ঘর

7>সুন্দর ফুল

8>অনেক জমি ইত্যাদি।



দোজাখ:

1>অগ্নি

2>পুঁজ

3>রক্ত

4>গরম জল

5>পোল

6>সাঁড়াশী

7>চামড়া পোড়ানো

8>অঙ্গ কাঁটা

9>উত্তপ্ত পাদুকা ইত্যাদি।



এতে কি প্রমানিত হয় না এসব দুনিয়ার কারো মনগড়া কল্পনা যা কিছুটা পরিবর্ধিত এবং পরিবর্তিত???

চাপাতির কোপ থেকে বাঁচার কয়েকটি উপায়

চাপাতির কোপ থেকে বাঁচার কয়েকটি উপায়
================================
১) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুন।
২) দাড়ি রাখুন, মাথায় টুপি, টাকনুর উপর প্যাণ্ট, বোরখা পরুন।
৩) ঢিলেঢালা বোরখা পরুন যাতে স্তন, নিতম্ব এবং পেট-পিঠের কোন চর্বির ভাজ না বোঝা যায়। হাতে-পায়ে মোজা পরুন, ও চক্ষু ঢেকে রাখুন।
৪) বোরখার রঙ অবশ্যই কালো হতে হবে। রঙিন কাপড় বর্জন করুন।
৫) ফ্যাশন এড়িয়ে চলুন। লিপিস্টিক, নেইলপালিশ বর্জন করুন।
৬) ব্রাশ-টুথপেস্ট বর্জন করুন। মেসওয়াক ব্যবহার করুন।
৭) ঢিলাকুলুখ ব্যবহার করুন।
৮) স্বামীর অনুমতি ব্যতীত বাইরে বের হবেন না।
৯) যাদের স্বামী নাই বা স্বামীর অনুমতি নাই, তার ঘরের মধ্যে থাকুন।
১০) মাদ্রাসায় পড়ুন এবং পড়ান। ইহুদি-নাসারাদের শিক্ষাব্যবস্থা স্কুল-কলেজ, বই-পুস্তক পরিহার করুন।
১১) আসল পুরুষ হলে চারটে করে বিয়ে করুন।
১২) পিচ্চি বোন-মেয়ে থাকলে বুড়ো দেখে বিয়ে দিয়ে দিন।
১৩) শিল্প-সাহিত্য বর্জন করুন।
১৪) ইহুদি-নাসারাদের চিকিৎসা পদ্ধতি বর্জন করুন। দোয়া-দরুদে আস্থা রাখুন।
১৫) কালোজিরার চাষ করুন।
১৬) হিন্দুয়ানী বাংলা ভাষা বর্জন করুন। উর্দু-আরবিতে কথা বলা অভ্যাস করুন।
১৭) বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জেহাদ করুন। মন্দির-মূর্তি ভেঙে ফেলুন। গণিমতের মাল ভাগ করে নিন (নবী-আল্লাহর ভাগটা দিতে ভুলবেন না যেন।)
১৮) গাছ কাটুন। খেঁজুর গাছ লাগান। মরুভূমি বাঁচান।
১৯) খেলাধূলা বাদ দিন। শুধু বিবিদের সাথে খেলা চলবে।
২০) বিনোদন বাদ দিন। শুধু বেলিড্যান্স চলবে।
২১) সানি লিয়নকে ডিলিট দিন। ওয়াজ শুনুন (প্রকাশ্যে)। হাত মারুন (গোপনে)।
২২) অফিস-আদালত বন্ধ করুন। কাজি অফিস আর শরিয়া আইন খোলা রাখুন।
২৩) প্রতি বাক্যের আগে-পরে আলহামদুলিল্লাহ, সুবাহানাল্লাহ, মাসাল্লাহ বলুন।
২৪) ইসলামের আগে যথাযথ ভাবে চাপাতির ধর্ম পালন করুন।
২৫) সহিহ মুসলমান হোন, ফেসবুক বর্জন করুন।

বিঃদ্রঃ কোনো বিষয় বাদ গেলে জঙ্গীদের কাছ থেকে জেনে এসে এখানে কমেণ্ট করে অন্যদেরকেও জানার সুযোগ করে দিন।

পুরীষ পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিকতা

সব আস্তিক খারাপ না…
সব নাস্তিক খারাপ না…
সব মুসলমান খারাপ না…
সব হিন্দু খারাপ না…
সব পুরুষ খারাপ না…
সব নারী… আর কইয়েন না, নারী নরকের দ্বার…শয়তান আসে নারীর বেশ ধরে…
২) – রবীন্দ্রনাথ নাকি বৌদির…
— দেখুন, লেখককে বিচার করতে হবে তার লেখা দিয়ে, ব্যক্তিজীবন দিয়ে নয়…
– নজরুল নাকি…
— দেখুন, লেখককে বিচার করতে হবে তার লেখা দিয়ে, ব্যক্তিজীবন দিয়ে নয়…
– আজাদ নাকি…
— — দেখুন, লেখককে বিচার করতে হবে তার লেখা দিয়ে, ব্যক্তিজীবন দিয়ে নয়…
– রুদ্র নাকি…
— দেখুন, লেখককে বিচার করতে হবে তার লেখা দিয়ে, ব্যক্তিজীবন দিয়ে নয়…
– তসলিমা নাকি…
— আর কইয়েন না, শালী একটা পুরাই বেশ্যা, খাঙ্কি, পতিতা, মাগী… এত্তগুলা বিয়া করছে… একটার সাথেও ঘর করতে পারে নাই… তারপর কত পুরুষের সাথে শুইছে, হ্যাতে নিজেও গুইনা শেষ করতে পারবে না…
৩) আস্তিকাবালীয় যুক্তি : আপনি সমপ্রেমীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন, আপনি কি সমপ্রেমী?
নাস্তিকাবালীয় যুক্তি : আপনি ন্যুডিস্টদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন, কিন্তু আপনি নিজেই তো ন্যাংটা হন না। আগে নিজের কিছু ন্যাংটা ছবি দেন পারলে…
৪) গত বছর অভিযোগ উঠেছিল–তসলিমা নাসরিন ব্লগারদের টাকা মেরে খেয়েছেন। বিষয়টা নিয়ে কোনো আইডিয়া ছিল না। তাই যারা অভিযোগ তুলেছিল, তাদেরকে বিনীত অনুরোধ করেছিলাম–প্রমাণ দেন। আর এতেই খুব সম্ভবত সর্বপ্রথম তনান্ধ, তনার মুরিদ, তনার চ্যালা, ইত্যাদি ট্যাগ খেয়েছিলাম। এবং তখন থেকেই খেয়াল করলাম, কেমন যেন একটা বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, অনেকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন। বেশিরভাগই নাস্তিক-মুক্তমনা।
যখন কেউ দাবী করে–আল্যা আছে/আল্যা নাই, তখনও বলি প্রমাণ দেন। কই, তখন ত কেউ এসে আল্যান্ধ, আল্যার মুরিদ, আল্যার চ্যালা ইত্যাদি ট্যাগ দেয় না। যে কোন অভিযোগ, যে কোনো দাবীর স্বপক্ষে যদি প্রমাণ না দেখাতে পারেন, তাহলে সেগুলো হুদাই কেন দাবী করবেন?
বিষয়টা শুধু তনার ব্যাপারে নয়, আরো যে কারো ব্যাপারে অভিযোগ উঠলেও প্রমাণ চাইব। ব্লগ-ফেসবুকে অনেকরেই ডিফেণ্ড করেছি, এমনকি পিয়ালের চটি লেখার অভিযোগের সূত্র ধরে ফারামি-ফাত্তা-মালদের সাথেও বিশাল তর্ক হয়েছিল। তারা পর্যন্ত ট্যাগাইতে সাহস করে নাই। কিন্তু এখন অহরহ ট্যাগানো হয়ে শুধু তনাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ তুললে তার প্রমাণ চাইলে।
কিন্তু খেয়াল করেন, প্রোপিক-কাভারপিকে আমরা পছন্দের মানুষদের ছবি দেই, তাদের বাণী সম্মিলিত ব্যানার টানাই, তাদের পক্ষে যুক্তি দেই, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে ডিফেণ্ড করি–তখন কিন্তু তাদের নাম ধরে কেউ ট্যাগায় না। শুধু তনার বেলাতেই এটা হয় কেন?
৫) কেউ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচনার কোনো সীমারেখাও নির্ধারণ করে দেয়া যায় না। যদিও ইদানিং অনেকেই এই কাজটি করেন–কে কী কিভাবে কার কেমন সমালোচনা করবে, কেমন করবে না, কী উচিত, কী উচিত না–এইসব জ্ঞান দিয়ে স্ট্যাটাস প্রসব করতেছেন। যে কেউ যে কোনো ভাষায় সীমাহীন সমালোচনা করতে পারে। তবে সমালোচনা আর গালির মধ্যে পার্থক্যটা ভুলে গেলে কেমনে কী!
আরেকটা ব্যাপার–কী উচিত আর কী উচিত না–এর কোনো নির্ধারিত কেতাব আমাদের নেই। কেউ কিছু বললে বা করলে আমি বড়জোর প্রশ্ন তুলতে পারি–এটা করা উচিত হয়েছে কি-না… উচিত হলে তার পেছনে যুক্তি কী…
৬) তনার পোস্ট পইড়া আমি ভালো করেই বুঝছি এইটার সাথে রুদ্রর সম্পর্ক আছে। একজনরে কইলাম যে, আমার রুদ্রানুভূতিতে আঘাত লাগছে। কইল–প্রমাণ করেন যে এইটা রুদ্ররে নিয়া লেখা। আমার মাথা গরম হয়ে গেছে। মাথার চুল ছিঁড়ছি। হাত পা কামড়াইছি। কিন্তু কেমনে প্রমাণ করব সেইটা বুঝতেছি না। ওদিকে পোস্টটা যতবার মনে আসে, ততবার সারাদেহে চুলকানি…মনে হয় কেউ শরীরে আগুন ধরাই দিছে। কিন্তু তর্ক কেমনে করব বুঝতেছিলাম না। পুরাই বাচ্চাদের মত আচরণ। শেষে কইলাম, খেলুম না, আমি অহন ‘মাটিতে সেহরি খাইয়া’ ঘুমাইতে যামু…
৭) তর্কের সময় আবেগী হয়ে যাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। কোনো কিছুর দাবী যখন করবেন, চাই আপনার সেই দাবী প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু সেখানে যুক্তি-প্রমাণের বদলে আবেগী হয়ে গেলে মারা খাবেন নিশ্চিত। তখন বাচ্চাদের মত কাঁদবেন, হাত-পা ছুঁড়বেন, মাথার চুল ছিঁড়বেন, আর নানান রকম ট্যাগিং করে বিপক্ষের হিন্দি চুল ফেলাবেন…
৮) যুক্তিতর্কের সময় নো ছাড়। সেটা যে কেউ হন না কেন। আপনার যুক্তিতর্কের গ্রাউণ্ডে যদি ফাঁক-ফোকর থাকে তো সেখানে অনেক কিছু ঢুকে যেতে পারে… কিন্তু কোনো কিছুই ব্যক্তিগত নয়। এখানে কোনো বিতর্ক প্রতিযোগিতা হচ্ছে না যে জিতে গেলে প্রাইজ পাব। এসব শুধুই নিজেদের ঝালিয়ে নেয়ার জন্য…
৯) ধর্মটাকে সামান্য একটা ডাল মনে করি, আর পুরা বটগাছ হলো পুরুষতান্ত্রিকতা। ধর্ম পুরুষতান্ত্রিকতার সামান্য একটা হাতিয়ার মাত্র। সামান্য কমনসেন্স দিয়ে ধর্মের শিকড় উপড়ে ফেলতে পারলেও পুরুষতান্ত্রিকতার শিকড় অনেক গভীরে…আমাদের অস্থি-মজ্জা-রক্ত-শিরা-উপশিরায় পুরুষতান্ত্রিকতার শিকড় গ্রোথিত। তাই অনেক বড় বড় নাস্তিক-মুক্তমনাকেও দেখা যায় নারী নিয়ে কথা প্রসঙ্গে নারীর দেহ, যৌনতা, স্থূল কৌতুক তুনে আনেন। পুরুষতান্ত্রিকতা এমন ভাবেই মিশে আছে যে অনেক নারীকেও দেখা যায় বুঝে-না-বুঝে পুরুষতান্ত্রিকতা জয়গান গাইতে।
১০) পুরুষতান্ত্রিকতার ধারক-বাহকদের জন্য নতুন দুইটা শব্দ পাইছিলাম–“পুরীষের বাচ্চা”। কিন্তু Annopurna Debi কইলেন, “পুরুষকে পুরীষ বললেও ওতো গায়ে লাগে না যতোটা লাগে পুরুষ বললে, কারণ তারা জানে কোন কোন স্থানে পুরীষ থেকে জঘন্য।” শালার পুরীষের বাচ্চাদের জন্য কোনো বিশেষণই দেখি যথোপযুক্ত না। আমার এত সাথের শব্দ দুইটাও দেখি বিফলে গেল!

Thursday, April 6, 2017

নক্ষত্রের বর্জ্যেই প্রাণের পত্তন

লিখেছেনঃ মডার্ণ এইপ

বিষয়: জ্যোতির্বিজ্ঞান

হাজার বছর ধরে মানুষ রাতের ঝলমলে আকাশ দেখে বিস্মিত হয়েছে আর মুগ্ধ নয়নে ভেবেছে বহুদুরের ঝুলন্ত আলোক বিন্দু নিয়ে। আকাশের বুকে জ্বলজ্বলে এই ঝুলন্ত বিন্দুই হলো তারা বা নক্ষত্র। তখনকার দিনে নক্ষত্র মানুষের মনে ঐশ্বরিক চিন্তার যোগান দিত, এমনকি নক্ষত্রদের মাধ্যমে নাবিকরা সমুদ্রে দিক ঠিক করতো। যদিও নক্ষত্র কি, কিভাবে এদের উৎপত্তি – এসব সম্পর্কে তাদের কোন ধারনা ছিলনা। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আজ নক্ষত্রদের সম্পর্কে জানার তেমন কিছু বাকি নাই। মজার বিষয় হলো, নক্ষত্ররা নিষ্প্রাণ হলেও অনেকটা জীবিত; এদের জন্ম হয় এবং জীবন শেষে মৃত্যুবরন করে।মহাবিশ্বে প্রাচুর্যতার দিক দিয়ে নক্ষত্ররাই সবথেকে এগিয়ে। নক্ষত্র হলো সৌরজগতের শক্তি এবং আলোর মুল উৎস। নক্ষত্রগুলো অনেকটা আজকের দিনের পারমানবিক চুল্লির মত, এদের কেন্দ্রেই উৎপন্ন হয় জীবন গঠনের যত প্রয়োজনীয় মৌল। মহাবিশ্ব যদি নক্ষত্রশুন্য হতো তাহলে কোন প্রানের উৎপত্তি হতোনা। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত সুর্য কিন্তু আদতে একটা নক্ষত্র।

নক্ষত্রের জন্মকথা
মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বহুপ্রকার গ্যাস এবং ধূলিকণা। স্থান বিশেষ এই গ্যাস এবং ধূলিকণার অনুপাত বা পরিমান কমবেশি হয়ে থাকে। বিশেষ কিছু জায়গায় ধূলিকণার পরিমাণ অত্যন্ত বেশি থাকে, এরকম জায়গাকে নেবুলা বলে। যখন কোন ভারী বস্তু নেবুলার পাশ দিয়ে যায় অথবা কাছাকাছি কোন সুপারনোভা বিষ্ফোড়ন ঘটে তখন তার মহাকর্ষ বলের প্রভাবে নেবুলা সঙ্কুচিত হতে থাকে। এই সঙ্কোচনের ফলে নেবুলার অভ্যন্তরে অবস্থিত গ্যাস এবং ধূলিকণা কেন্দ্রে জড়ো হতে থাকে এবং শিশু নক্ষত্র গঠন করে, যাকিনা অনেকটা নক্ষত্রের মত কিন্তু অতবেশি ঘনত্বের নয়। মহাকর্ষের প্রভাবে শিশু নক্ষত্রটি আরো সঙ্কুচিত হয় এবং অধিক পরিমাণ ধূলিকণা এর সাথে যোগ হতে থাকে ফলে এর ভর ও ঘনত্ব দুটোই বেড়ে যায়। ভর ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রে তাপ উৎপন্ন হতে থাকে। এভাবে যখন ভর এবং তাপমাত্রা একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখন নক্ষত্রটির কেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয় এবং নক্ষত্রটি পরিনত হয়। এটা নক্ষত্রের প্রথম পর্যায় এবং একে মেইন সিকুয়েন্স ফেজ বা মেইন সিকুয়েন্স নক্ষত্র বলে। নক্ষত্রদের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটে এই ধাপে। উল্লেখ্য যে আমাদের সুর্য এখনো এ পর্যায়ে আছে।
নক্ষত্রের বিবর্তন
নক্ষত্রগুলো প্রকৃতপক্ষে বিশালাকৃতির পারমানবিক চুল্লী যেখানে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন পরমানু হিলিয়াম পরমানুতে রুপান্তরিত হয়। ফিউশন প্রক্রিয়াই নক্ষত্রদের শক্তির উৎস। ফিউশন বিক্রিয়ায় মুলত দুটি পরমানু মিলে একটি বৃহৎ পরমানু তৈরি করে। হাইড্রোজেন পরমানুর নিউক্লিয়াসে থাকে একটি প্রোটন। হাইড্রোজেন পরমানুর দুটি ভিন্ন প্রকরন বা আইসোটপ আছে -ডিউটেরিয়াম এবং ট্রিটিয়াম। এদের প্রত্যেকেরই প্রোটন সংখ্যা একটি কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা যথাক্রমে ১ এবং ২। অর্থাৎ ডিউটেরিয়ামে থাকে ১টি প্রোটন ও ১টি নিউট্রন ; এবং ট্রিটিয়ামে থাকে ১টি প্রোটন ও ২টি নিউট্রন। নক্ষত্রদের কেন্দ্রে ১টি ডিউটেরিয়াম এবং ১টি ট্রিটিয়াম মিলে ১টি হিলিয়াম পরমানু তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত একটি নিউট্রন নির্গত হয় এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়।
হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম রূপান্তর
এভাবে যখন নক্ষত্রের সমস্ত হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রুপান্তরিত হয়, তখন হটাৎ করে এটি ফুলে যায়। নক্ষত্রের এই অবস্থাকে বলে রেড জায়ান্ট। যেসব নক্ষত্র আকারে খুব বড় তারা রেড সুপারজায়ান্টে পরিণত হয়; এবং হিলিয়ামকে অক্সিজেন ও কার্বনে রূপান্তর করে। আকার যদি সেইরকম বড় হয় তাহলে এই রূপান্তরকরণ চলতে থাকে কার্বন, অক্সিজেন থেকে নিয়ন, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার এবং সিলিকন পর্যন্ত। সেগুলো আবার পুনরায় রুপান্তর হয় ক্যালসিয়াম, নিকেল, ক্রোমিয়াম, কপার, এভাবে চলতে থাকে লৌহ পর্যন্ত। যখন নক্ষত্রের কেন্দ্র পুরোপুরি লৌহে পরিণত হয় তখন নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া হটাৎ করে থেমে যায়, কারন লৌহকে ফিউজ করার জন্য অত্যন্ত বেশি তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়।এখন নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া থেমে যাওয়ার কারনে এর উপরে মহাকর্ষ বল পুরোদমে কাজ করবে ফলে তারাটি নিজের উপরেই চুপশে যাবে। কারন নক্ষত্রে ঘটা নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন চাপ বাইরের দিকে কাজ করে এবং মহাকর্ষ বল নক্ষত্রের কেন্দ্রের দিকে চাপ প্রদান করে – এভাবে দুটো বল পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে নক্ষত্রকে সাম্যাবস্থায় রাখে। যাহোক ক্রমাগত এভাবে চুপশে যাওয়াই নক্ষত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারন করে; এটা অবশ্য ভরের উপরেও নির্ভর করে। গড়পড়তা ভরের নক্ষত্রগুলো তাদের বহির্বারন বা খোলস ছড়িয়ে দেয় এবং প্লানেটারি নেবুলা গঠন করে। প্লানেটারি নেবুলার কেন্দ্রে থাকে উক্ত নক্ষত্রের চুপশে যাওয়া কেন্দ্র যেটা সাদা বামন হিসাবে জ্বলতে জ্বলতে একসময় শীতল হয়ে পরে এবং নিভে যায়। তখন এটাকে কালো বামন বলে।
নক্ষত্রের বিবর্তন ও জীবনচক্র
এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল কিন্তু উক্ত তারার ভর যদি অস্বাভাবিক রকম বেশি হয় তাহলে তারাটি খুব দ্রুত গতিতে চুপশে যাবে ফলে ভয়ংকর রকমের বিষ্ফোড়ন ঘটবে। একে সুপারনোভা বিষ্ফোড়ন বলে। তারাটির ভর যদি আমাদের সুর্যের ভরের ১.৪ গুন বেশি হয়, তাহলে এটি বিষ্ফোড়নের পরেও সঙ্কুচিত হতে থাকবে এবং নিউট্রন তারায় রুপান্তরিত হবে। কিন্তু যদি তারাটির ভর আমাদের সুর্যের ৩ গুন বা তার বেশি হয়, তাহলে এর সঙ্কোচনের হার এতোবেশি হবে যে তারাটির মধ্যকার সমস্ত পদার্থ একটি বিন্দুতে জড়ো হবে এবং বলতে গেলে এটা মহাশূন্যে মিলিয়ে যাবে। সবশেষে থাকবে অসীম মহাকর্ষ বলের একটা গর্ত যেখান থেকে কোন কিছুই বের হতে পারেনা, এমনকি আলোও নয়। এটাকে তখন ব্লাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর বলে।
যাহোক, সাধারণত নক্ষত্রগুলো প্লানেটারি নেবুলা হিসাবে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রসারিত হতে থাকে এবং নিকটবর্তী কোন ভারী বস্তুর মহাকর্ষের প্রভাবে পুনরায় সঙ্কুচিত হতে শুরু করে। এভাবে অসীম সংখ্যকবার চলতে থাকে নক্ষত্র সৃষ্টির মহাজাগতিক পুনর্জন্ম এবং বিবর্তন। আমাদের সৌর জগত মুলত সৃষ্টি হয়েছে এধরনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় জেনারেশনের নেবুলা থেকে। একারনে আমাদের পৃথিবী তথা সৌরজগতে বিভিন্ন হালকা ও ভারী মৌলের এতো প্রাচুর্যতা যেটা প্রানের উৎপত্তি সম্ভব করেছে। আমাদের শরীর গঠনের যাবতীয় পরামানু এসেছে নক্ষত্রের কেন্দ্রে ঘটা নিউক্লিয়ার ফিশন থেকে অথবা সুপারনোভা বিষ্ফোড়ন থেকে। এমনকি এমনো হতে পারে যে, আমার দুটি হাতের মৌল হয়তো এসেছে দুটি ভিন্ন নেবুলা থেকে। সত্যি বলতে আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান। নক্ষত্রের বর্জ্যেই আমাদের পত্তন।

আইনস্টাইনের ডেস্ক ও রহস্যময় জড় পদার্থ

লিখেছেনঃ হিমাংশু কর| 

বিষয়: জ্যোতির্বিজ্ঞান

বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর, বিশ্বের সব পত্রিকায়ই একটি অগোছালো ডেস্কের ছবি ছাপা হয়। ডেস্কটি স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইনের। ডেস্কের ছবির সাথে পত্রিকার শিরোনাম করা হয়, “The unfinished manuscript of the greatest work, of the greatest scientist of our time”। পুরো বিশ্বই তখন এই কিংবদন্তী বিজ্ঞানীর আলোচনায় মুখর। কিন্তু বিজ্ঞানে আগ্রহী যেকোনো লোকেরই কৌতূহল জাগবে, কি সেই অসমাপ্ত কাজ ? আর কেনই বা তার মত একজন কিংবদন্তী বিজ্ঞানী তা শেষ করে যেতে পারলেন না ? আইনস্টাইন তার জীবনের শেষ ৩৫ বছর এই অসমাপ্ত কাজ শেষ করার চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু কোনভাবেই কুল-কিনারা করতে পারেন নি। সাধারণ মানুষের কাছে তাই সবচেয়ে বড় ধাঁধা ছিল, কি এমন কাজ যা আইনস্টাইনের মত একজন বিজ্ঞানী তার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত চেষ্টা করেও সফল হতে পারলেন না !
আইনস্টাইন বেচে থাকতেই তার নামে অনেক মিথ প্রচলিত ছিল। বেশিরভাগ মানুষেরই ধারনা ছিল, তিনি মহাবিশ্ব সম্পর্কে এমন কিছু বুঝতে সক্ষম যা সাধারণ মানুষ কখনই বুঝতে পারবে না। তার আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়েও অনেক কল্পকাহিনী প্রচলিত ছিল। তবে এটিও সত্য যে, সে সময়ে তার “আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব” বোঝার মত লোক খুব কমই ছিল।বিজ্ঞানী এডিংটন ছিলেন তার আপেক্ষিক তত্ত্বের একজন জোরালো সমর্থক। জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও আপেক্ষিক তত্ত্বের বক্তৃতা দিয়ে ততদিনে তার বেশ সুনামও হয়ে গেছে। একদিন এডিংটনকে বলা হল, “ আপনি সহ মোট তিনজন ব্যক্তি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব বুঝতে পারে ”। একথা বলার পর এডিংটন কিছুক্ষণ কোন কথা বললেন না। তখন সবার মনে হয়েছিল, এডিংটন বুঝি বিনয় দেখিয়ে চুপচাপ আছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে এডিংটন বলল, “ আসলে আমি ভেবে পাচ্ছিনা, তৃতীয় ব্যক্তিটি কে ? ” ।
image001
চিত্র: আলবার্ট আইনস্টাইনের ডেস্ক।
এডিংটনের পরবর্তী সময়ের কারো মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কেমন সেই তত্ত্ব, আইনস্টাইনের মত লোকও যার সমাধান করতে চেয়ে কোন সুবিধা করতে পারেন নি ! তিনি যে তত্ত্বের জন্য তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন তার নাম , ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি(Unified Field Theory) বা “সমন্বিত ক্ষেত্র তত্ত্ব” । তিনি এমন একটি তত্ত্ব গঠন করতে চেয়েছিলেন, যা প্রকৃতির জানা সকল বল ও ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারে; এমন একটি সমীকরণ, যা দিয়ে প্রকৃতির সবকিছু বর্ণনা করা যায়। আইনস্টাইনের বিশ্বাস ছিল, এমন একটি তত্ত্ব অবশ্যই আছে, যা দিয়েই প্রকৃতির সবকিছু বর্ণনা করা যাবে। কিন্তু সে সময়ের বিজ্ঞানীরা তার এই চিন্তাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। তারা মনে করেছিল, এমন কোন তত্ত্বের সন্ধান করা সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই না।
আসলে আইনস্টাইন ছিলেন তার সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রগামী ।তার সময়ের বিজ্ঞানীরা সে সময় এমন একটি তত্ত্বের গুরুত্বই বুঝতে পারে নি। কিন্তু আইনস্টাইন মারা যাবার দশক দুয়েক পরেই বেশ কিছু বড়সড় পরিবর্তন আসে। ষাটের দশকের শেষের দিকে বিজ্ঞানীরা এমন একটি তত্ত্বের প্রয়োজন অনুভব করেন। তখন নতুন নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে পরমাণুর জগত ও মহাকাশের অনেক অজানা রহস্য উন্মোচিত হতে থাকে। এসময় তাদের প্রধান লক্ষ হয়ে দ্বারায় এমন একটি তত্ত্ব নির্মাণ করা, যা প্রকৃতির সবগুলো বলকে একীভূত করতে পারে। মূলধারার গবেষকরা বুঝতে পারেন, প্রকৃতিতে যে চারটি মৌলিক বল আছে তাদের একীভূত না করতে পারলে নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না। আর প্রকৃতিকেও বোঝা সম্ভব না। আইনস্টাইনের স্বপ্নের “ ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি ” তখন বিজ্ঞানীদের বাস্তব প্রয়োজন হয়ে দ্বারায়।
রহস্যময় গুপ্ত পদার্থ ও রহস্যময় শক্তি
কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমাদের মহাবিশ্বের সবকিছু কি দিয়ে গঠিত? তাহলে সবাই বলবে, কেন পরমাণু দিয়ে গঠিত! যারা বিজ্ঞান সম্পর্কে অল্পকিছু জানে তারা বলবে- ইলেকট্রন , প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে সকল পরমাণু গঠিত, তাই সবকিছুই এই ইলেকট্রন-প্রোটন-নিউট্রন দিয়েই গঠিত। এতসব কথা আমরা জেনেছি সেটি কিন্তু খুব বেশি দিন আগে নয়। দার্শনিক এরিস্টটল(৩৮৪-৩২২ খ্রিঃপূঃ) মনে করতেন, আমাদের মহাবিশ্বে যা কিছু আছে তা সবই “মাটি”, “পানি”, “আগুন” আর “বাতাস” এই চারটি মৌলিক জিনিস দিয়ে গঠিত। তিনি এমনই প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন যে, তার মৃত্যুর পরও প্রায় দুই হাজার বছর মানুষ এই কথাই মেনে নিয়েছিল। তবে ভিন্ন মত যে একেবারেই ছিলনা তা নয়।ডেমোক্রিটাস নামে এক গ্রিক মনে করতেন ব্যাপারটি এমন নয়। তিনি ভাবতেন, কোন পদার্থকে ভাঙ্গলে দেখা যাবে এরা খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত । তিনি আরও প্রস্তাব করেন যে, এসব কণাকে আর ভাঙ্গা যাবে না।তিনি এসব অবিভাজ্য কণার নাম দেন এটম বা পরমাণু। কিন্তু এরিস্টটল বা ডেমোক্রিটাস কারও কথার পক্ষেই কোন প্রমাণ ছিল না।
১৯১১ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড নামে একজন পদার্থবিজ্ঞানী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি পরমাণু মডেল প্রস্তাব করেন ।পরবর্তীতে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই মডেলের উন্নতি করা হয়। আর একথাও প্রতিষ্ঠিত হয় যে, সকল পদার্থই পরমাণু দিয়ে গঠিত; তবে এসব পরমাণুও অবিভাজ্য নয়। পরমাণুগুলো ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন নামে মৌলিক কণিকা দিয়ে গঠিত।
প্রকৃতিকে প্রথমে যতটা সহজ সরল বলে ভাবা হয়েছিল, দেখা গেল ব্যাপারটা মোটেই সেরকম না। বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন, কোন সহজ উপায়েই পরমাণুর ভেতরে থাকা অতি-পারমানবিক কণাদের আচরণ ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। গবেষণা চলতেই থাকল। পরবর্তী গবেষণায় বেরিয়ে এলো আরও আশ্চর্য তথ্য। প্রোটন, নিউট্রনকে আমরা যেমন অবিভাজ্য ও মৌলিক কণা বলে ভেবে এসেছি, সেগুলো আসলে অবিভাজ্য না। প্রোটন ও নিউট্রনগুলো “কোয়ার্ক” নামে এক ধরনের কণা দিয়ে গঠিত। তিনটি কোয়ার্ক মিলে তৈরি হয় একটি প্রোটন বা নিউট্রন। পার্টিক্যাল এক্সিলারেটরের ভিতর পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে আরও অনেক অস্থায়ী অতি-পারমানবিক কণিকার অস্তিত্ব পাওয়া গেল। তবে এরা সবাই কিন্তু পদার্থের কণিকা। এটুকু আমরা জানতে পারলাম, সকল প্রকার পদার্থ পরমাণু দিয়েই গঠিত আর এসব পরমাণু বিভিন্ন অতি-পারমানবিক কণা দিয়ে দিয়ে তৈরি।
ব্যাপারটি কিন্তু এমন না যে, শুধু আমাদের পৃথিবী বা অন্য গ্রহগুলো এই মৌলিক কণিকা দিয়ে গঠিত। বিজ্ঞানীরা দেখলেন আমাদের সৌরজগৎ, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এমনকি মহাবিশ্বে যত নীহারিকা,ধূমকেতু বা মহাজাগতিক ধূলিকণা আছে তার সবকিছুই আমাদের চেনাজানা পদার্থ দিয়েই গঠিত। দূর মহাকাশের কোন নক্ষত্র থেকে আসা আলোর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলে দিতে পারেন সেই নক্ষত্রটিতে কি কি উপাদান আছে।তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের মহাবিশ্বে যা কিছু আছে তা মূলত এই পরমাণু বা তার অতি-পারমাণবিক কণিকার সমন্বয়েই গঠিত।
সবকিছু ঠিকই ছিল। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে, ভেরা রুবিন নামে একজন বিজ্ঞানী আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ঘূর্ণন নিয়ে গবেষণা করার সময়, একটি আশ্চর্য জিনিস দেখতে পেলেন। রুবিন দেখলেন, আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দূরবর্তী নক্ষত্রগুলোর গতি যেমন হবার কথা, সেগুলোর গতি মোটেই সে রকম না। মূলত নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে যত দূরে যাবার কথা, নক্ষত্রগুলোর গতিও তত কমে যাওয়া উচিত। কারণ কোন বস্তু থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, মহাকর্ষ বলের পরিমাণ ততই কমতে থাকে। তাই একটি নক্ষত্র গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে যত দূরে হবে, তার গতিবেগও তত কম হবে। আমাদের সৌরজগতের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটাই ঘটে। আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে আছে সূর্য। আর যে গ্রহ সূর্য থেকে যত বেশি দূরে, তার গতিবেগও তত কম। তাই আমাদের গ্যালাক্সির ক্ষেত্রেও এমনই হবার কথা।কিন্তু রুবিনের পর্যবেক্ষণ থেকে দূরবর্তী নক্ষত্রগুলোর গতিবেগ তো কম পাওয়া গেলই না, বরং দেখা গেল একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের পর সব নক্ষত্রের বেগই প্রায় একই রকম। প্রথমে মনে করা হয়েছিল রুবিনের গণনায় হয়ত কোন ভুল আছে। কিন্তু পরে দেখা গেল শুধু আমাদের মিল্কিওয়েই না, আমাদের পাশে এন্ড্রোমিডা নামে যে সর্পিল গ্যালাক্সিটি আছে তার অবস্থাও একই রকম। এই রহস্যময় গতি লক্ষ্য করার পর বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টি নিয়ে আরও অনেক অনুসন্ধান করতে থাকলেন। পরবর্তীতে গ্যালাক্সির ঘূর্ণন, এদের ছড়িয়ে পরার বেগ, গ্যালাক্সি ক্লাস্টার, মহাকর্ষীয় লেন্সিং , মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করে বোঝা গেল, গ্যালাক্সির ভিতরে আমাদের চেনাজানা পদার্থের বাইরেও বিপুল পরিমাণ রহস্যময় কোন পদার্থ আছে। এদের নাম দেওয়া হল “ডার্ক ম্যাটার” বা গুপ্ত পদার্থ।
ডার্ক ম্যাটার শুধু নামেই ডার্ক না, এরা আসলেই পুরোপুরি অদৃশ্য। কোন ভাবেই এদের পর্যবেক্ষণ করার কোন উপায় নেই।তাদের উপস্থিতি জানার একমাত্র উপায় হল তাদের মহাকর্ষ বল। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার আছে তাদের মহাকর্ষ বল এতো বেশি যে, আমাদের গ্যালাক্সির সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র মিলিয়ে তার দশ ভাগের এক ভাগও না(৯৫% ডার্ক ম্যাটার, ৫% পদার্থ)। তাহলে বোঝা যাচ্ছে কি বিশাল পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার লুকিয়ে আছে আমাদের মহাবিশ্বে। বিজ্ঞানীদের বর্তমান গবেষণা বলছে আমাদের মহাবিশ্বের মোট শক্তি ও পদার্থের ২৩% ই হল এই ধরনের ডার্ক ম্যাটার। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে গ্যালাক্সির মধ্যে কোথায় কোথায় এই ডার্ক ম্যাটার আছে তার একটি ত্রিমাত্রিক মানচিত্রও তৈরি করে ফেলেছেন।
image002
চিত্র: ডার্ক ম্যাটারের ত্রিমাত্রিক মানচিত্র ।
যদিও বিজ্ঞানীদের গণনা অনুসারে বর্তমান মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় ২৩% এই রহস্যময় গুপ্ত পদার্থ, কিন্তু তারা এটাও ধারনা করছেন- মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুর সময়গুলোতে এই ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণই ছিল বেশি, প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুর দিকের সবকিছু ভাল মত বোঝার জন্য এই রহস্যময় জড় পদার্থগুলোর আচরণ বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
এত গেল রহস্যময় গুপ্ত পদার্থের কথা। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আরও এক ধরনের রহস্যময় বিষয় আবিষ্কার করেছেন। আইনস্টাইনের দেওয়া সূত্র অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা জানেন যে, মহাকর্ষ বল ক্রিয়াশীল থাকলে আমাদের মহাবিশ্বের প্রসারণের তীব্রতা এক সময় কমে আসবে। এই প্রসারণ কতটা দ্রুত বাড়ছে বা কমছে তার উপরই নির্ভর করছে আমাদের মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ। ১৯৯৮ সালে বিজ্ঞানীদের দুটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ, সুপার নোভা বিস্ফোরণ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাদের গবেষণায় এক আশ্চর্য বিষয় বেরিয়ে আসল। তারা লক্ষ্য করলেন আমাদের মহাবিশ্বের প্রসারণের হার তো কমছেই না বরং দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে ! মহাকর্ষ বল সবসময়ই আকর্ষনধর্মী। আর সে কারণেই মহাকাশের ছড়িয়ে থাকা হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম তাদের নিজেদের মধ্যে আকর্ষণের কারণে নিজেদের উপরই চুপসে পড়ে। এভাবে চুপসে যাবার ফলে তাদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, ফলে তাপমাত্রাও বাড়তে থাকে। এই তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে যখন নিউক্লীয় বিক্রিয়া হবার মত উপযোগী তাপমাত্রায় পৌছায়, তখনই জন্ম নেয় নক্ষত্র। আমাদের সূর্যও ঠিক এভাবেই মহাকাশের জমে থাকা হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের ধূলিকণা থেকে জন্ম নিয়ে এখন একটি সাম্যাবস্থায় আছে।এর হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মহাকর্ষ শক্তির প্রভাবে নিজের ভিতরে চুপসে যাচ্ছে, আর ভিতরের ঘটতে থাকা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া, সব কিছুকে বাইরের দিকে ঠেলে একে সাম্যাবস্থায় রেখেছে। নিউক্লীয় বিক্রিয়ার ভর ক্ষয় হতে হতে যখন মহাকর্ষের টান কমে যাবে, তখন ভিতরের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হওয়া শক্তির পরিমাণ যাবে অনেক বেড়ে। তাই সে তখন আর সাম্যাবস্থায় থাকবে না। সুপার নোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে তার জ্বলজ্বলে জীবন শেষ করে ফেলবে।
আবার কোন বস্তুকে পৃথিবী থেকে উপরে ছুড়ে দিলে দেখা যায়, ধীরে ধীরে তার বেগ কমে আসছে। বস্তুটির উপর মহাকর্ষ বল কাজ করে বলেই তার বেগ কমতে থাকে। আমাদের মহাবিশ্বের সব বস্তুগুলোও একটি বিস্ফোরণের ফলে চারদিকে ছুটে যেতে শুরু করেছিল। আর এই মহাকর্ষের কারণেই মহাবিশ্বের প্রসারণে হারও ধীরে ধীরে কমে আসা উচিত। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখলেন ব্যাপারটি আসলে তেমন ঘটছে না। কোন এক রহস্যময় শক্তির প্রভাবে মহাকর্ষের আকর্ষণ কাটিয়ে, মহাবিশ্ব তার প্রসারণের হার বাড়িয়েই চলেছে। পরবর্তীতে আরও পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এই রহস্যময় শক্তির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। এই রহস্যময় শক্তির নাম দেওয়া হয়েছে “ডার্ক এনার্জি” । সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল, কোন ভাবেই এই “ডার্ক এনার্জি” বা গুপ্ত শক্তির প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। আরও অবাক করা তথ্য হল, আমাদের মহাবিশ্বের ৭৩% ই গঠিত এই ডার্ক এনার্জি দিয়ে !
image003
চিত্র: ডার্ক এনার্জির কারণে মহাবিশ্বের প্রসারণের হার দিন দিন বাড়ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি মহাবিশ্বের ২৩% “ডার্ক ম্যাটার” আর ৭৩% “ডার্ক এনার্জি” হয় তাহলে পদার্থের পরিমাণ কতটুকু ?
বিজ্ঞানীদের বর্তমান পর্যবেক্ষণ ও গণনা অনুযায়ী মহাবিশ্বের মোট পদার্থ ও শক্তির ৭৩% ই হল “ডার্ক এনার্জি”, ২৩% “ডার্ক ম্যাটার”, ৩.৬% মুক্ত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম(মহাজাগতিক ধূলিকণা) ও ০.৪% পদার্থ(যা দিয়ে উপগ্রহ,গ্রহ, নক্ষত্র,ধূমকেতু ইত্যাদি গঠিত )।
image004
চিত্র: মহাবিশ্বের কেবল শতকরা ৪% ভাগ আমাদের চেনাজানা পদার্থ দিয়ে গঠিত। আর বাদবাকি সবই, “ডার্ক ম্যাটার” ও “ডার্ক এনার্জি” ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমরা যাকে পদার্থ বলি তা মহাবিশ্বের মাত্র ৪ শতাংশ। আর বাদবাকি ৯৬% শতাংশই রহস্যময় গুপ্ত পদার্থ আর গুপ্ত শক্তি দিয়ে ভর্তি। আসলে আমরা মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে যেসব জায়গাকে শূন্য বলে ভাবছি সেগুলো আসলে আক্ষরিক অর্থেই শূন্য না। আমাদের চেনা জানা পদার্থ দিয়ে তৈরি গ্রহ-নক্ষত্রগুলোই বরং এই অজানা বস্তুগুলোর মধ্যে ছোট্ট দ্বিপের মত নগণ্য কিছু !
কারো কৌতূহলী মনে যদি প্রশ্ন জাগে ডার্ক ম্যাটার আসলে কেমন ? কেমন এই রহস্যময় শক্তি ? তাহলে উত্তর দেওয়াটি কিন্তু একটু কঠিন হবে। কারণ গতানুগতিক পদার্থবিদ্যার সাহায্যে এর উত্তর দেওয়া মুশকিল।পদার্থবিজ্ঞান এতদিন শুধু আমাদের চেনাজানা পদার্থ নিয়েই কাজ করে এসেছে। তাই আমাদের এমন একটি তত্ত্ব প্রয়োজন, যা আইনস্টাইনের “ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরির” মত এই মহাবিশ্বের সকল পদার্থ ও শক্তির ব্যাখ্যা করতে পারে। । পদার্থবিজ্ঞান যে এসব গুপ্ত পদার্থ ও শক্তির ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করছে না এমন নয়, কিন্তু গতানুগতিক তত্ত্ব দিয়ে এসব পদার্থের ব্যাখ্যাগুলো মোটেই আশানুরূপ নয়।
আইনস্টাইন তার আপেক্ষিক তত্ত্বের সফলতা নিয়ে খুশি ছিলেন না। তার ইচ্ছা ছিল প্রকৃতিকে আরও গভীর ভাবে বুঝতে পারা। প্রায় সময়ই বলতেন, তিনি ঈশ্বরের মন বুঝতে চান। তার সময়ে জানা দুটি মৌলিক বলকে ব্যাখ্যা করার জন্য দুটি তত্ত্ব ছিল। তড়িৎ-চুম্বক বলকে ব্যাখ্যা করার জন্য ছিল ম্যাক্সওয়েল তড়িৎ-চুম্বক তত্ত্বের সমীকরণ। এই সমীকরণগুলো স্থানের যেকোনো বিন্দুতে এই বলের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে পারত। আর মহাকর্ষ বল ও স্থান-কালের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য ছিল আইনস্টাইনের নিজের “আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব”। কিন্তু এই দুটি তত্ত্বকে কোনভাবেই একটির সাথে অন্যটিকে সমন্বিত করা যাচ্ছিল না। দুটি তত্ত্বই পৃথকভাবে খুবই সফল, কিন্তু দুটিকে এক করার কোন উপায় তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আইনস্টাইনের বিশ্বাস ছিল এই দুটি তত্ত্বকে এক করতে পারলে আমরা আরও মৌলিক কোন তত্ত্ব পাব।যার সাহায্যে প্রকৃতির আরও গভীরের প্রবেশ করা যাবে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, সেই তথাকথিত “ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি” গঠন করা সম্ভব হলে তিনি ঈশ্বরের মন বুঝতে পারবেন। আমরা পরে জানব তার সময়ে এটি কোনভাবেই সম্ভব ছিল না।
এখন প্রশ্ন হল, আমাদের হাতে কি এমন কোন একক তত্ত্ব নেই যা ডার্ক ম্যাটারের মত অজানা বস্তু সহ সকল প্রকার পদার্থ ও শক্তির ব্যাখ্যা দিতে পারে? উত্তর হল হ্যাঁ। আমাদের কাছে এমন একটি তত্ত্ব আছে; আর সেটিই হল- স্ট্রিং থিওরি(String Theory) বা তার তত্ত্ব। স্ট্রিং থিওরিই একমাত্র তত্ত্ব যা প্রকৃতির সকল বস্তুকণার আচরণ ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি প্রকৃতিতে বিদ্যমান চারটি মৌলিক বলকেও একীভূত করতে পারে।
এই তত্ত্ব শুধু সকল প্রকার পদার্থ ও শক্তিকে বর্ণনাই করে না, পাশাপাশি এই মহাবিশ্ব কেন আছে তারও উত্তর দেয়। আরেকভাবে বললে বলা যায়, স্ট্রিং থিওরি আমাদের “বিগ ব্যাঙ” বা মহাবিশ্ব সৃষ্টিরও আগে নিয়ে যায়। এই তত্ত্ব সেইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়, হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ যার খোজ করে যাচ্ছে। কেন এই মহাবিশ্ব ? কেন কোনকিছু না থাকার বদলে কিছু আছে? এখানে আমি দেখানোর চেষ্টা করব স্ট্রিং থিওরির এমন সব বৈশিষ্ট্য আছে যাতে এটি নিজেকে সবকিছুর তত্ত্ব বা “Theory of Everything” বলে দাবি করতে পারে। আর এটিও বলতে পারে কেন এই মহাবিশ্ব ?
স্ট্রিং থিওরি
প্রথমে স্ট্রিং তত্ত্বের মূল বিষয়টি একটু আলোচনা করা যাক। আমরা যদি কোন বস্তু যেমন: একটি আপেলকে ভেঙ্গে টুকরো করতে থাকি তাহলে একসময় এসে পরমানুতে পৌছব। এবার এই পরমাণুকেও যদি আবার ভাঙ্গা হয় তাহলে ইলেকট্রন ও কোয়ার্কের মত মৌলিক কণিকা পাওয়া যাবে; যাদের আর ভাঙ্গা সম্ভব নয়।পদার্থবিদ্যার প্রচলিত ধারনা অনুসারে এসব মৌলিক কণিকাদের আমরা মাত্রা-বিহীন বিন্দুর মত ভাবি। আর স্ট্রিং তত্ত্বের পার্থক্যটা ঠিক এখানেই।স্ট্রিং তত্ত্ব বলছে আমরা যাদের গোল বিন্দু বলে ভাবছি তারা আসলে বিন্দু নয়, আমাদের দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার কারণে এদেরকে আমরা বিন্দু হিসেবে দেখি।যদি এদেরকে কোন সুপার মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে বহুগুণে বিবর্ধিত করা সম্ভব হয় (প্রায় বিলিয়ন বিলিয়ন গুন বেশি) তাহলে আমরা এদেরকে একমাত্রিক লম্বা তার আকারে দেখব। স্ট্রিং তত্ত্ব অনুসারে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সকল মৌলিক কণিকাই আসলে এরকম তার। এসব তার আবার বিভিন্ন কম্পাঙ্কে কাঁপছে। এসব তারের কম্পাংকের ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন রকম বৈশিষ্ট্যের মৌলিক কণিকা সৃষ্টি হয়। তারের কম্পনের পার্থক্যই এসব কণিকার আধান, ভর নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। আর এসব তারের বলবিদ্যা স্টাডি করে অন্য বৈশিষ্ট্যগুলোও বের করা যাবে। সহজভাবে বললে গিটারের তারের কম্পাঙ্কের পার্থক্যের কারণে যেমন চিকন মোটা সুর বের হয় (ভিন্ন ভিন্ন নোট বাজে) তেমনি এসব স্ট্রিং এর কম্পনের পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কণিকার দেখা মিলছে।
image005
চিত্র: পদার্থের গঠনের মৌলিক একক স্ট্রিং।
এই তারগুলোর দৈর্ঘ্য অস্বাভাবিক রকম ক্ষুদ্র, ১০^-৩৩ সে.মি.। এই ক্ষুদ্র তারগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এদের কম্পনের ধরন। ইলেকট্রনের তারগুলো হয়ত একভাবে কাঁপছে, আবার কোয়ার্কের তারগুলো হয়ত ভিন্নভাবে কাঁপছে। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভাল, প্রত্যেকটি মৌলিক কণিকাদের জন্য কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন তার বরাদ্দ নেই।মানে ইলেকট্রনের তারগুলো একরকম, নিউট্রিনোর তারগুলো আরেক রকম, এমন কিছু নয়। বরং একই তার ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কেপে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কণিকা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
সব মৌলিক কণিকাই যদি স্ট্রিং হয় তাহলে আমাদের চেনাজানা বাস্তবতার চিত্রটাই কিন্তু পাল্টে যাবে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসিদ্ধান্ত হল, মৌলিক কণিকা বলে আসলে কিছু নেই। কারণ কোয়ার্ক বা নিউট্রিনোর মত সব মৌলিক কণিকাই আসলে অভিন্ন স্ট্রিং দিয়েই তৈরি। তাই একমাত্র মৌলিক স্বত্বা হল স্ট্রিং, যা থেকেই মহাবিশ্বের সকল বস্তু ও শক্তির সৃষ্টি।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে বস্তুজগতে আমরা যা কিছু দেখছি তার সবকিছুই মূলত খুব ক্ষুদ্র একধরনের তারের সমষ্টি। স্ট্রিং তাত্ত্বিক ড. মিচিও কাকুর মতে, আমাদের মহাবিশ্বের গঠন সঙ্গীতের সাথে অনেক সঙ্গতিপূর্ণ।তার ভাষায় , “আমাদের দেখা প্রতিটি অতি-পারমানবিক কণিকাই এক একটি মিউজিক্যাল নোট, আমরা হাজার বছর ধরে পদার্থবিজ্ঞানের যে সূত্রগুলো আবিষ্কার করেছি এগুলো যেন তারের কম্পনের ফলে বাজানো হারমোনি, রসায়নের সূত্রগুলো অনেকটা: তার দিয়ে বাজানো সুন্দর কোন মেলোডি, আর পুরো মহাবিশ্বটা যেন একটি সিম্ফোনি। ”
2015-01-18 17_45_20-1 Einstein desk - Microsoft Word
স্ট্রিং তত্ত্বে এই তার ছাড়াও “ব্রেন” নামে আরেক ধরনের মৌলিক স্বত্বার কথা বলা হয়েছে। ব্রেন শব্দটির পূর্ণরূপ মেমব্রেন বা ঝিল্লী। একটি ঝিল্লীর ভেতর যেমন কোন কিছু আটকে থাকতে পারে, তেমনি কোন স্ট্রিংগুলোও এই ব্রেনের ভিতর আটকে থাকতে পারে।স্ট্রিংগুলো একমাত্রিক হলেও ব্রেনগুলো কিন্তু একমাত্রিক না। একটি ব্রেনের মাত্রার সংখ্যা ২ থেকে ১০ এর মধ্যে যেকোনোটি হতে পারে। একটি দ্বিমাত্রিক ব্রেনকে ২-ব্রেন বলা হয়। দ্বিমাত্রিক ব্রেনের মত ৩-ব্রেন বা ৫-ব্রেনও সম্ভব । যদিও আমাদের মত ত্রিমাত্রিক জগতের কারও পক্ষে একটি পাচমাত্রিক বস্তু কল্পনা করা অসম্ভব, তবে স্ট্রিং তাত্ত্বিকরা গাণিতিকভাবে একটি পাচমাত্রিক ব্রেনকে খুব ভালমতোই সংজ্ঞায়িত করতে পারেন ।
স্ট্রিং থিওরিতে মাত্রার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কণাবাদী পদার্থবিদ্যার মতে মৌলিক কণিকারা হোল মাত্রাহীন বিন্দুর মত। ঠিক যেমনটি জ্যামিতিতে শেখানো হয়েছিল , “যার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও উচ্চতা নেই তাকেই বিন্দু বলে”। যে কণার দৈর্ঘ্য,প্রস্থ ও উচ্চতা নেই , আসলে তার কোন মাত্রাও নেই(এই দৈর্ঘ্য,প্রস্থ ও উচ্চতাই হোল স্থানের তিনটি মাত্রা )। তো, কণাবাদী পদার্থবিদ্যার মতে মৌলিক কণিকারা হোল মাত্রাহীন । স্ট্রিং থিওরির তারগুলো মাত্রা-বিহীন না, বরং এক মাত্রিক । একটি তারের যেমন শুধু দৈর্ঘ্য আছে ঠিক তেমনি।এই একমাত্রিক তারগুলো দুই থেকে দশ যেকোনো মাত্রার ব্রেনের সাথে যুক্ত থাকতে পারে।
স্ট্রিং তত্ত্ব শুধু কণিকাদের আচরণই ব্যাখ্যা করে না, বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্থান-কালের গঠনকেও ব্যাখ্যা করতে পারে। বিজ্ঞানীরা যখন প্রথমবারের মত স্ট্রিংগুলোর আচরণ নিয়ে গবেষণা করছিলেন তখন দেখতে পেলেন , স্থান-কালের মধ্যে স্ট্রিংগুলো ইচ্ছা মত চলাফেরা করতে পারে না। বরং সুনির্দিষ্ট কিছু গাণিতিক নিয়ম মেনে এরা স্থান-কালের মধ্যে কিছুর জটিল গতির সৃষ্টি করে। স্ট্রিংগুলোর এসব গতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তো বিজ্ঞানীদের চোখ একেবারে কপালে। আর তা হবেই বা না কেন ? স্ট্রিংগুলোর আচরণ থেকেই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সমীকরণ এমনিতেই বেরিয়ে আসছে ! আমরা জানি শুধুমাত্র আপেক্ষিক তত্ত্বই স্থান-কালের আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারে। অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে স্থান-কালের আচরণ ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু কোনভাবেই তা সম্ভব হচ্ছিল না । যখনই কোন কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে স্থান-কালের আচরণ ব্যাখ্যা করা হয় তখন গাণিতিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ ও অসীম ফলাফল পাওয়া যায়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখলেন স্ট্রিংগুলোর আচরণ থেকেই স্থান-কালের আচরণ ব্যাখ্যাকারী আপেক্ষিকতার সমীকরণগুলো বেরিয়ে আসছে। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, আইনস্টাইন যদি কখনো আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কার না’ও করতেন তবুও স্ট্রিং তত্ত্ব থেকে আমরা তা জানতে পারতাম। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আপেক্ষিক তত্ত্বও আসলে মৌলিক কোন তত্ত্ব নয়। আইনস্টাইন সম্ভবত নিজেও এটি বুঝতে পেরেছিলেন।
শুধুমাত্র আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যেই যেকোনো ভৌত ঘটনার ব্যাখ্যা করা যায়। গ্রহ-নক্ষত্র,গ্যালাক্সির ঘূর্ণন,ব্ল্যাক হোল,হোয়াইট হোল,ওয়ার্মহোল বা বিগ ব্যাঙ, এমনকি স্থান-কালের নিজের প্রকৃতি সহ বৃহৎ যেকোনো কিছুই সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের সাহায্যে বর্ণনা করা সম্ভব। অন্যদিকে পরমাণু, অতি-পারমানবিক কণিকা ও এদের আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানীরা “স্ট্যান্ডার্ড মডেল”(Standard Model of Particle Physics) নামে একটি তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে থাকেন। স্ট্যান্ডার্ড মডেল অতি-পারমাণবিক কণিকাদের আচরণ ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে খুবই সফল। এখন মজার বিষয় হল, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের মত স্ট্যান্ডার্ড মডেলকেও শুধুমাত্র স্ট্রিং তত্ত্বের নীতিগুলো থেকেই প্রতিপাদন করা যায়।
আমরা আগেই জেনেছি স্ট্রিংগুলো স্থান-কালের মধ্যে ইচ্ছেমত চলাফেরা করতে পারে না।বিজ্ঞানীরা যখন স্ট্রিংগুলোর আচরণ গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখছিলেন, তখন তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, স্ট্রিংগুলো স্থানের দশটি মাত্রার মধ্যে চলাফেরা করে। এই তথ্যটির তাৎপর্য কিন্তু অনেক গভীর। স্ট্রিংগুলো স্থানের দশ-মাত্রার মধ্যে চলাচল করার অর্থ হল, আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বও দশ মাত্রিক ! কিন্তু আমরা সবাই দেখে আসছি আমাদের পরিচিত জগতটি খুব নিখুঁতভাবে ত্রিমাত্রিক।
সাধারণভাবে ভাবলে স্ট্রিং থিওরির ধারনাগুলো আমাদের পরিচিত জগতের সাথে খাপ খাবে না।পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো মৌলিক কণিকার সাহায্যেই পদার্থের সকল আচরণ ব্যাখ্যা করে থাকে।কিন্তু আমরা প্রথমেই জেনেছি এই তত্ত্ব মতে মৌলিক কণিকা বলে আসলে কিছু নেই। সবকিছুই অভিন্ন স্ট্রিং দিয়ে তৈরি।আবার এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের পরিচিত ত্রিমাত্রিক জগতটি আসলে দশ-মাত্রিক। এখন অনেকেই প্রশ্ন করবে,যদি আমাদের জগতটি দশ-মাত্রিক হয়েই থাকে, তাহলে বাকি মাত্রাগুলো কোথায় ? আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না কেন?স্ট্রিং তাত্ত্বিকরা বলছেন, বাকি মাত্রাগুলোকে আমরা দেখতে পাচ্ছিনা, কারণ তারা খুব ক্ষুদ্র আকারে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। একটি লোহার দণ্ডের কথা ভাবা যাক। এই দণ্ডটিকে যদি চিকন করতে করতে একটি সুতার মত করে ফেলি, তাহলে এটিকে একমাত্রিক তার বলেই মনে হবে।
2015-01-18 17_46_04-1 Einstein desk - Microsoft Word
যেহেতু দণ্ডটির দৈর্ঘ্য কমানো হয় নি, শুধু ব্যাস কমানো হয়েছে, তাই এর ব্যাসটি খুব ক্ষুদ্র আকারে পেঁচিয়ে আছে। খুব ক্ষুদ্র হলেও দণ্ডটির কিন্তু ব্যাস ঠিকই আছে। তাই আমরা একথা বলতে পারি, যদিও দণ্ডটিকে একমাত্রিক তার বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু খুব সূক্ষ্মভাবে দেখলে এটি ব্যাস-যুক্ত একটি ত্রিমাত্রিক বস্তু। স্ট্রিং তত্ত্বের মতে আমাদের জগতের তিনটি দৃশ্যমান মাত্রার পাশাপাশি বাকি মাত্রাগুলোও এরকম খুব ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে।
এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো কিন্তু ইচ্ছামত জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকতে পারে না। “ক্যালাবি ইয়ো ম্যানিফোল্ড(Calabi Yau manifold)” নামে একটি বিশেষ গাণিতিক উপায়ে এরা বিভিন্ন ভাবে পেঁচিয়ে থাকতে থাকে। স্ট্রিং তত্ত্বের ভাষায় মাত্রাগুলোর পেঁচিয়ে থাকাকে কম্প্যাক্টিফিকেশন(Compactification) বলা হয়।
এই মাত্রাগুলো কতটা ক্ষুদ্র তা বোধহয় অনেকে কল্পনাও করতে পারবে না। এক সেন্টিমিটারের বিলিয়ন বিলিয়ন গুণেরও বেশি ছোট(১০^-৩৩ সে.মি.) জায়গার মধ্যে এগুলো পেঁচিয়ে আছে।আমরা যদি কোনভাবে এরকম ক্ষুদ্র আকার ধারণ করতে পারি তাহলে কিন্তু আমরা ঠিকই দশটি মাত্রাই দেখতে পাব। স্ট্রিংগুলো যেহেতু এতটাই ক্ষুদ্র, তাই এরা দশ মাত্রার মধ্যে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই চলাফেরা করে।
অনেকের মনে হতে পারে এসব মাত্রার জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকার কি দরকার ছিল ? এভাবে না থাকলে তো আমাদের মহাবিশ্বটাই দশ মাত্রার হয়ে যেত। ত্রিমাত্রিক জগতের চেয়ে দশ-মাত্রিক জগতটি নিশ্চই আরও সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় হবে ! তবে কেন আর কিভাবে এই মাত্রাগুলো এত ছোট্ট জায়গার মধ্যে পেঁচিয়ে আছে এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু খুব সোজা না। এর উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মহাবিশ্বের জন্ম ও পদার্থবিদ্যার নিয়মগুলোর রহস্য।
স্ট্রিং তত্ত্ব ও মহাবিশ্ব
এতক্ষণ আমরা জানলাম স্ট্রিং তত্ত্ব কিভাবে পদার্থ ও স্থান-কালকে বর্ণনা করে। এখন জেনে নেওয়া যাক এ তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের ধারনাটি কেমন। পদার্থবিদ্যার আধুনিক ধারনা অনুসারে একটি মহাজাগতিক স্ফীতির মধ্য দিয়ে আমাদের মহাবিশ্বের শুরু।স্ফীতির ঠিক পরেই একটি বড়সড় বিস্ফোরণের(বিগ ব্যাং) মাধ্যমে মহাজাগতিক বস্তুগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পরতে থাকে। আর আমরা সেই বিস্ফোরণের অনেক পরের একটি সময়ে অবস্থান করছি।মহাবিশ্ব সম্পর্কে এই ধারনা চিত্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করুন।এই চিত্র অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্ব একটিই ।আর পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো মহাবিশ্বের সর্বত্র একই রকম, বা অন্যভাবে বলা যায়, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো শুধুমাত্র একই রকম হতে পারে।
কিন্তু স্ট্রিং থিওরি বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এই তত্ত্ব মতে একদম শূন্য থেকে অসংখ্য মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। তাই আমাদের মহাবিশ্বই যে একমাত্র মহাবিশ্ব এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আর বিষয়টি এমন নয় যে, কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই মহাবিশ্বগুলো সৃষ্টি হয়েছিল। এভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারে সময়ের কোন নির্দিষ্ট পরিমাপ নেই। কেননা আমাদের দুনিয়ার সময়ের সাথে সেই সময়ের কোন যোগাযোগ নেই। সৃষ্টির এই প্রক্রিয়ায়, আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি হবার আগেও যেমন অসংখ্য মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে তেমনি আমাদের এই স্থান-কালের বাইরে শূন্য থেকেই আরও বিশ্ব সৃষ্টি হয়েই চলেছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আর এই প্রতিটি মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলি যে আমাদের মত সেটিও না। আমাদের মত নিয়ম সমৃদ্ধ মহাবিশ্বও যেমন আছে, তেমনি সম্পূর্ণ আলাদা নিয়মের মহাবিশ্বও আছে অসংখ্য।
প্রতিটি আলাদা নিয়মের মহাবিশ্বগুলো কেমন হবে, তা নির্ভর করে স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রাগুলো কিভাবে পেঁচিয়ে আছে তার উপর।আমরা আগেই জেনেছি স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রাগুলো চাইলেই ইচ্ছেমত জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকতে পারে না। অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলোর প্যাঁচ নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। এই অন্তর্বর্তী জগতের প্যাঁচের আকার-আকৃতিই বিভিন্ন ভৌত ধ্রুবক যেমন, ইলেকট্রনের চার্জ, মৌলিক কণিকাগুলোর পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়া ইত্যাদির মান নিয়ন্ত্রণ করে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়, এই প্যাঁচের আকৃতিই প্রকৃতির দৃশ্যমান নিয়ম গুলো নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে দৃশ্যমান নিয়ম বলতে, মৌলিক চারটি বল ও তাদের পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ধরন, মৌলিক কণিকা যেমন, কোয়ার্ক বা নিউট্রিনোর ভর, আধান ইত্যাদির কথা বোঝানো হচ্ছে। আর এসব দৃশ্যমান নিয়মগুলো আবার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে স্ট্রিং তত্ত্বের নিজস্ব নিয়মগুলো থেকে।অর্থাৎ স্ট্রিং তত্ত্বের নিয়মগুলোই হল প্রকৃতির সবচেয়ে মৌলিক নিয়ম, যেগুলোর উপর ভিত্তি করে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়মগুলোর উদ্ভব ঘটে।
এভাবে স্ট্রিং তত্ত্বের নিজস্ব নিয়মগুলো থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মত প্রাকৃতিক নিয়মযুক্ত, বিভিন্ন ধরনের মহাবিশ্ব উদ্ভব হতে পারে। শুধুমাত্র প্রতিটি মহাবিশ্বের অন্তর্বর্তী জগত ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে পেঁচিয়ে থাকবে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, স্ট্রিং তত্ত্বের অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলো প্রায় ১০^৫০০ উপায়ে পেঁচিয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ এই তত্ত্ব মতে ১০^৫০০ সংখ্যক আলাদা আলাদা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম সমৃদ্ধ মহাবিশ্ব সম্ভব । এই সংখ্যাটি কতটা বড় সেটি বুঝতে চাইলে এমন একজন বিজ্ঞানীর কথা ভাবুন যিনি স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধান থেকে কোন শক্তিশালী কম্পিউটারের সাহায্যে প্রতি সেকেন্ডে ১০০০ টি নিয়ম বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে। এত ক্ষমতা সম্পন্ন যন্ত্র থাকার পরও তিনি যদি তিনি বিগ ব্যাঙের পর থেকে আজ পর্যন্ত হিসেব করতে থাকেন, তাও মাত্র ১০^২০ টি মহাবিশ্বের নিয়ম গণনা করতে পারবেন। আর এমন প্রতিটি নিয়মের মহাবিশ্ব সংখ্যাও অগণিত।
প্যারালাল ইউনিভার্স(Parallel Universe) বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব
স্ট্রিং তত্ত্বের এরকম সমাধানের পর মহাবিশ্বের ধারনা বদলে মাল্টিভার্স(Multiverse) বা বহুবিশ্বে রূপ নিয়েছে। এরকম অসংখ্য মহাবিশ্বের ভিতর এমন অনেক মহাবিশ্ব আছে যেগুলোর পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো হয়ত হুবহু আমাদের মত। আর এদের ভিতর অনেকেই আবার আকার আয়তন সবদিক থেকেই দেখতে আমাদের মহাবিশ্বের মত। এদেরকে বলা হয় প্যারালাল ইউনিভার্স(Parallel Universe) বা সমান্তরাল মহাবিশ্ব। এরকম সমান্তরাল মহাবিশ্বের সংখ্যা যেহেতু অগণিত, তাই এমন কিছু মহাবিশ্ব পাওয়া যাবে যেগুলোর সবকিছুই হুবহু আমাদের মহাবিশ্বের মত।যেন ঠিক যমজ ভাই-বোন। ঠিক আপনার মতই আরেকজন আপনি হয়ত আরেকটি সমান্তরাল মহাবিশ্বে বসে ঠিক এই বইটিই পড়ছে।
image012
চিত্র: উপরের প্রতিটি গোলকই এক একটি আলাদা মহাবিশ্ব,এদের মধ্যে কিছু আবার আছে হুবহু আমাদের মহাবিশ্বের মতই দেখতে।
সমান্তরাল মহাবিশ্বের কথা শুনতে হয়ত অনেকের কাছে আজগুবি মনে হতে পারে। কিন্তু স্ট্রিং তত্ত্ব ছাড়াও মহাবিশ্বের জন্ম রহস্য বর্ণনাকারী- ইনফ্লেশন তত্ত্বও একই রকম কথা বলে। কেওটিক ইনফ্লেশন তত্ত্ব অনুসারে বিজ্ঞানী আঁদ্রে লিণ্ডে কম্পিউটার সিমুলেশন করে দেখেছেন, এই ধরনের স্ফীতি তত্ত্বও স্ট্রিং তত্ত্বের মত আলাদা ধরনের পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম কার্যকর অসংখ্য মহাবিশ্বের কথা বলছে। এমআইটির( MIT) কসমোলজিস্ট ম্যাক্স টেগমার্ক আমাদের পরিচিত গণিতের সম্ভাবনার সাহায্যে হিসেব কষে দেখিয়েছেন, আমাদের এই মহাবিশ্ব থেকে প্রায় ১০^১০^২৮ মিটার দুরেই হয়ত হুবহু আপনার মত দেখতে একজন সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়েই ভাবছে।কিন্তু সমস্যা হল আপনি বা আপনার টুইন কেউই কারও সম্পর্কে জানতে পারবেন না।
টেগমার্ক বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব থেকে পাওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে চার রকম প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলেছেন । লেভেল ওয়ান প্যারালাল ইউনিভার্স হল সবচেয়ে মজার। বলা যেতে পারে আপনি যদি আপনার বর্তমান অবস্থান থেকে যথেষ্ট দূরে ভ্রমণ করতে পারেন তাহলে আপনি আবার আপনার বাসাতেই ফিরে যাবেন। সেখানে দেখা যাবে হুবহু আমাদের পৃথিবীর মত গ্রহে আপনার মতই একজন বসে স্ট্রিং তত্ত্বের কোন বই পড়ছে। শুনতে অবাক লাগবে, বহুবিশ্বের কথা বিবেচনা না করলেও, এরকম প্যারালাল জগত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ ইনফ্লেশন তত্ত্বের বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানি মহাবিশ্বকে আগে যতটুকু বড় মনে করা হত এটি তার থেকে ঢের বেশি বড়। আক্ষরিক অর্থেই অসীম বলা যেতে পারে।বিজ্ঞানীরা গাণিতিক সম্ভাবনার সাহায্যে হিসেব কষে দেখেছেন, এই অসীম মহাবিশ্বে আমাদের সৌরজগতের একটি টুইন খুঁজে পাবার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।একই রকম এসব মহাবিশ্বকে লেভেল-1 প্যারালাল ইউনিভার্স বলা হয়।
স্ট্রিং তত্ত্বের সমীকরণ বিশ্লেষণ করে একদল বিজ্ঞানী বলছেন আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল দুটি ব্রেনের সংঘর্ষের কারণে। দুটি ব্রেনের এরকম সংঘর্ষের ফলেই ইনফ্লেশনের সৃষ্টি হয়। এরকম সংঘর্ষ কিন্তু কোন নির্দিষ্ট একটি স্থানে হয় না, বরং আমাদের মহাবিশ্বের বাইরের শুন্যতায় এরকম সংঘর্ষ হয়েই চলেছে, ফলে সৃষ্টি হয়ে চলেছে অসংখ্য মহাবিশ্ব। এই অসংখ্য মহাবিশ্বের ভিতর আমাদের মহাবিশ্বের মত কোন একটি থাকা খুবই সম্ভব। ব্রেনের সংঘর্ষের কারণে এভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির এই তত্ত্বকে ইকপাইরোটিক থিওরি(Ekpyrotic Theory) বলা হয়। এই তত্ত্ব ঠিক হলে আমাদের মহাবিশ্বের মত দেখতে আরও কোন মহাবিশ্ব থাকাটা বাধ্যতামূলক। এরকম মহাবিশ্বগুলোকে লেভেল-2 প্যারালাল ইউনিভার্স বলে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সম্ভাব্যতা ও এর বর্ণনাকারী ওয়েব ফাংশনকে ব্যাখ্যা করার জন্য আরেক ধরনের প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলা হয়।এ ধরনের মহাবিশ্বের কথা বুঝতে চাইলে “হিলবার্ট স্পেস” নামে এক ধরনের তাত্ত্বিক ও বিমূর্ত স্থানের কথা ভাবতে হবে। এই তাত্ত্বিক স্পেস অসীম-মাত্রিক এবং একটি কোয়ান্টাম জগত এই হিলবার্ট স্পেসের সাপেক্ষে বিভিন্নভাবে ঘুরতে পারে। এই তত্ত্ব মতে যে ধরনের মহাবিশ্বের কথা বলা হয়, সেগুলো প্রত্যেকটি একই জায়গায় এবং একই সময়ে সহ-অবস্থান করছে, কিন্তু প্রত্যেকে আলাদা ডাইমেনশনে অবস্থিত বলে কেউ কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। যোগাযোগ করতে না পারলে কি হবে,প্রতিটি মুহূর্তে নেয়া আপনার সিদ্ধান্তগুলো হয়ত আপনার মত অসংখ্য আপনার হুবহু প্রতিরূপের সাথে মিলিত ভাবেই নেওয়া হচ্ছে। আপনার নাকের ডগায়ই হয়ত একটি সমান্তরাল মহাবিশ্ব রয়েছে, শুধু আলাদা মাত্রায় অবস্থিত বলে তাকে ধরা ছোঁয়া যাচ্ছে না। এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতারা মনে করেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভুত নিয়মগুলোর উৎপত্তি আসলে এরকম অসীমসংখ্যক প্যারালাল ইউনিভার্সের যোগাযোগের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এ ধরনের সমান্তরাল মহাবিশ্বগুলোকে লেভেল থ্রি প্যারালাল ইউনিভার্স বলা হয়।
image013
চিত্র: শিল্পীর কল্পনায় হিলবার্ট স্পেস
স্ট্রিং তত্ত্বে অন্তর্বর্তী জগতের মাত্রাগুলো বিভিন্ন ভাবে পেঁচিয়ে থাকার কারণে বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক নিয়মাবলী সমৃদ্ধ মহাবিশ্বের উদ্ভব হতে পারে। এ রকম আলাদা আলাদা নিয়মের মহাবিশ্বগুলোর সবকিছুই আলাদা। এমন সব মহাবিশ্বের বেশিরভাগই প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য অনুপযোগী। যদিও আমরা এমন মহাবিশ্বের প্রমাণ পাইনি, কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে এরকম মহাবিশ্বের সংখ্যা প্রায় অসীম, ১০^৫০০।আর এর ভিতর আমাদের মহাবিশ্বের মত নিয়ম যুক্ত মহাবিশ্বের সংখ্যাও অগণিত। বর্তমান প্রযুক্তির ধরা ছোঁয়ার বাইরে হলেও, ভবিষ্যতে কোন দিন হয়ত আমরা এমন মহাবিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হব। এমন বিভিন্ন নিয়ম যুক্ত মহাবিশ্বকে বলা হয় লেভেল-4 প্যারালাল ইউনিভার্স।
উপরে চার ধরনের প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলা হয়েছে।স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধানগুলো শুধু লেভেল-3 ছাড়া বাকি সবগুলোর অস্তিত্ব দাবি করে। স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধানগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় অবশ্যই কোথাও আমাদের মহাবিশ্বের মত অন্য মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে। এই তত্ত্ব আমাদের সামনে সৃষ্টির যে চিত্র তুলে ধরে তাতে বহুবিশ্ব ও সমান্তরাল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব খুবই বাস্তব।
ওয়ার্মহোল (Wormhole)
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে স্পেস বা স্থানকে আমরা যেরকম সমতল বলে ভাবি, স্পেস আসলে তেমন না, বরং এটি বাঁকানো। আলো যখন মহাশূন্যের(স্পেস) ভিতর দিয়ে ভ্রমণ করে, তখন এই বাঁকানো স্পেসের ভেতর দিয়ে একটি বাঁকানো পথে চলতে বাধ্য হয়।কিন্তু এই বাঁকা পথের পাশাপাশি একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তাও আছে। এই সংক্ষিপ্ত পথকেই ওয়ার্মহোল বলা হয়। ওয়ার্মহোলকে অনেক সময় আইনস্টাইন-রজেন ব্রিজ নামেও ডাকা হয়ে থাকে।দুটি স্থানে যাবার এই বিভিন্ন রাস্তা থাকার কারণে গণিতবিদরা একে বহুভাবে সংযুক্ত স্থান(Multiply connected spaces) বলেন। কিন্তু পদার্থবিদরা একে ওয়ার্মহোল বলেন কারণ, একটি পোকা যেমন মাটি খুড়ে পৃথিবীর এই প্রান্তের সাথে অন্য প্রান্তের একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তা তৈরি করতে পারে, তেমনি একটি ওয়ার্মহোলও মহাবিশ্বের দুটি স্থানের ভিতর একটি বিকল্প সংক্ষিপ্ত রাস্তা তৈরি করে।
আমাদের সূর্যের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রপুঞ্জ হল আলফা সেন্টরাই। সৌরজগৎ থেকে আলোর বেগে ভ্রমণ করলেও পার্শ্ববর্তী এই নক্ষত্রপুঞ্জে যেতে আমাদের কমপক্ষে ৪.৩ বছর সময় লাগবে(বাস্তবে যা অসম্ভব,কেননা কোন কিছুর পক্ষেই আলোর বেগে ভ্রমণ সম্ভব নয়)।কিন্তু যদি কেউ একটি ওয়ার্মহোল দিয়ে যেতে পারে তবে ডিনার করতে করতেই আলফা সেন্টরাই থেকে ঘুরে আসা সম্ভব।
image014
চিত্র: সৌরজগৎ ও আলফা সেন্টরাই এর মাঝে ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে সৃষ্ট সংক্ষিপ্ত রাস্তা।
আইনস্টাইনের তত্ত্ব আমাদের মহাবিশ্বের দুটি ভিন্ন স্থানের মধ্যে ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে ভ্রমনের কথা বললেও, স্ট্রিং তত্ত্বের সমাধান অনুযায়ী আমরা যদি একটি ওয়ার্মহোল তৈরি করতে পারি তা আমাদের মহাবিশ্বের যেকোনো গ্যালাক্সির পাশাপাশি অন্য মহাবিশ্বে ভ্রমনের সম্ভাব্যতার কথাও বলে।এমনকি একটি ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে শুধু দুটি ভিন্ন মহাবিশ্বেই নয়, এমনকি অতীত ও ভবিষ্যতেও ভ্রমণ করা সম্ভব। স্ট্রিং তত্ত্ব যে অতিরিক্ত মাত্রার কথা বলে, আমরা যদি সেই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো দিয়ে একটি আন্তঃমাত্রিক ভ্রমনের পথ তৈরি করতে পারি, তাহলে খুব কম সময়েই অন্য মহাবিশ্বের অন্য সময়ে গিয়ে উপস্থিত হতে পারব। অনেক পদার্থবিজ্ঞানী মনে করেন, আমাদের মহাবিশ্ব যখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পরবে, তখন আন্তঃমাত্রিক ভ্রমনের মাধ্যমে আমরা অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দিয়ে আমাদের সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে পারব।
স্ট্রিং ফিল্ড থিওরির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. মিচিও কাকু একটি হাইপোথিটিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করেছেন। এতে আমরা স্থান-কালের দেয়াল ভেদ করে ওয়ার্মহোল দিয়ে অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দিতে পারব।পদ্ধতিটি খুব বেশি জটিল না। প্রথমে আমাদের যেকোনো একটি নক্ষত্রকে বেছে নিতে হবে।তারপর একটি শক্তিশালী গামা-রে গান দিয়ে সেই নক্ষত্রের চারিদিকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে গামা-রে গুলোকে আবার নিজেদের উপরে ফেলতে হবে। এরকম শক্তিশালী রশ্নি নিজের উপর চক্রাকারে উপরিপাতন হবার ফলে শক্তির পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।একসময় প্রচুর শক্তি সৃষ্টি হলে, স্থান-কালের দেয়ালে একটি ওয়ার্মহোল তৈরি হবে। এখন এই ওয়ার্মহোলকে নিয়ন্ত্রণ করে অন্য মহাবিশ্বে পাড়ি দেয়া যাবে!
image015
চিত্র: স্ট্রিং ফিল্ড থিওরির কো-ফাউন্ডার ড. মিচিও কাকু
সুপারসিমেট্রি(Supersymmetry)
স্ট্রিং থিওরির একটি অন্যতম ভিত্তি হল এই সুপারসিমেট্রি। বাংলায় একে মহাপ্রতিসাম্যতা বলা যেতে পারে। এই প্রতিসাম্যতা প্রকৃতির ভিন্ন ধরনের মৌলিক কণিকাদের মধ্যে এক ধরনের আন্তঃসম্পর্কের কথা বলে। প্রকৃতিতে যত রকম মৌলিক কণিকা পাওয়া যায় তাদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের কণিকাদের বলা হয় বোসন আর অন্যদের বলা হয় ফার্মিওন। এমনিতে এই দুই ধরনের কণিকার বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু সুপার সিমেট্রি অনুসারে- প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সব বোসনের জন্য একটি করে ফার্মিওন কণা রয়েছে,আবার সব ফার্মিওনের জন্যই একটি করে বোসন কণা রয়েছে । এসব কণিকাদের বলা হয় সুপারপার্টনার। এই ধারনা গ্রহণ করার ফলে আমাদের মৌলিক কণিকার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে ! স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের মতে, একটি একীভূত তত্ত্ব গঠন করার জন্য সুপারসিমেট্রির কোন বিকল্প নেই। সুপারসিমেট্রির ধারনা গ্রহণ করার পর স্ট্রিং তত্ত্বের নাম হয়ে গেছে- “সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব”।
হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল(Holographic principle)
বিজ্ঞান আমাদের অনেক রকম বাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে আমরা জেনেছি এমনকি সময়ও ধীর হয়ে যায়। কিন্তু স্ট্রিং থিওরির এমন কিছু অনুসিদ্ধান্ত আছে যা সকল প্রকার কল্পকাহিনীকেও হার মানায়।এমন একটি অনুসিদ্ধান্তের নাম হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল। এই তত্ত্ব মতে আমি, আপনি, আপনার এই বই সহ পুরো মহাবিশ্বটিই একটি বিশাল হলোগ্রাফিক চিত্র ছাড়া আর কিছু না। অর্থাৎ, আমরা যাকে চিরন্তন বাস্তব বলে ভেবে আসছি তা তেমন কোন পরম বাস্তবতা নয়। এই প্রিন্সিপল আমাদের বলে যে- আমাদের মহাবিশ্বের ত্রিমাত্রিক স্থানে যা কিছু ঘটছে, তার সব তথ্যই একটি মহাজাগতিক দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠে জমা করা আছে। আর সেই পৃষ্ঠ থেকে এক ধরনের হলোগ্রাফিক প্রতিফলনের প্রকাশই হল- আমি, আপনি ও আমাদের এই মহাবিশ্ব ।
এখন প্রশ্ন জাগছে, তাহলে আমরা এই যে দিব্যি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছি, কত রকম অনুভূতি হচ্ছে এসব কি করে মিথ্যা হয় ? এই তত্ত্ব মতে, আমারা যা কিছু দেখছি এগুলো আসলে এক ধরনের উচ্চ মাত্রার বাস্তবতার(High order of reality) প্রতিফলন। সেই দ্বিমাত্রিক পৃষ্ঠকে কোন তত্ত্ব দ্বারা বর্ণনা করা হলে, সেই তত্ত্ব আর আমাদের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের তত্ত্ব, সমতুল্য হবে। তাই আমাদের বাস্তবতাকে বেশি বাস্তব বলাটা কোন ভাবেই ঠিক হবে না। বরং আমরা যে বাস্তবতায় বাস করি তার সাহায্যে ব্ল্যাক হোলের কিছু বিষয় সহ অনেক কিছুই বর্ণনা করা যায় না। হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল সত্য হবার পেছনে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই বেশ কিছু তাত্ত্বিক প্রমাণ পেয়েছেন। এই তত্ত্ব বিজ্ঞানী মহল সহ, সমগ্র পৃথিবীর বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের মাঝে বাস্তবতা নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। ১৭ জানুয়ারি, ২০০৯ নিউ সায়েন্টিস্টের কাভার ফটোতে লিখা হয় “Are you a hologram… projected form the edge of universe”
image016
চিত্র: ১৭ জানুয়ারি, ২০০৯ নিউ সায়েন্টিস্ট কাভার ফটোতে হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল ।
Ads/CFT correspondence
এই তত্ত্বের নামটি খটোমটো দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। দেখতে একটু কাঠখোট্টা হলেও মূল বিষয়টি খুব সহজ। এখানে বলা হয় , দুটি তত্ত্ব দেখতে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হলেও কিছু নির্দিষ্ট শর্তের ভিতর তারা একই রকম আচরণ করতে পারে। ভিন্ন ধরনের তত্ত্ব দুটির একটি হল কোয়ান্টাম থিওরি, আর অন্যটি হল স্ট্রিং থিওরি। এই তত্ত্ব দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। যতগুলো কোয়ান্টাম তত্ত্ব আছে তার সবগুলোতেই স্থান-কালের ধারনা স্ট্রিং তত্ত্বের থেকে একদম আলাদা। তাই আপাত দৃষ্টিতে এদের কোনভাবেই মেলান সম্ভব নয়। কিন্তু Ads/CFT correspondence মতে, কিছু বিশেষ শর্তের ভিতর এই দুটি তত্ত্বই একই রকম ফলাফল দেখাবে।
এরকম যোগাযোগ(correspondence) , প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন এই correspondence স্ট্রিং থিওরির একটি মৌলিক নীতি। উপরে যে হলোগ্রাফিক প্রিন্সিপল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, তার একটি প্রমাণ হল এই তত্ত্ব। এছারাও কোয়ান্টাম জগতের অনেক রহস্যময় ঘটনার ভেতরের কারণ বোঝার জন্য এই তত্ত্বটি অনেক সাহায্য করবে বলে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা ।
পদার্থ থেকে সুপারস্ট্রিং
ধরা যাক আমাদের রান্না ঘরে প্রেসার কুকারের মধ্যে এক টুকরো বরফ রাখা আছে। স্টোভটি জ্বেলে দিলে কি হবে আমরা সবাই আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু ভাবুন তো, একে যদি ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রা পর্যন্ত গরম করতে থাকি, তাহলে কি ঘটবে ?
যদি বরফ টুকরোটি গরম করতে শুরু করা হয় প্রথমে এটি গলে পানিতে পরিণত হবে। এর মানে বরফ টুকরোটি তার দশা পরিবর্তন করে কঠিন থেকে তরলে পরিণত হল। এখন পানিটুকু ফুটতে শুরু করার আগ পর্যন্ত যদি তাপ দেওয়া হয়, তাহলে এটি আবারও একটি দশা পরিবর্তনের মাধ্যমে তরল থেকে বাষ্পে পরিণত হবে। এখন যদি আমরা তাপমাত্রা বাড়াতেই থাকি তাহলে একসময় পানির অণুগুলো ভেঙ্গে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের আলাদা পরমাণুতে পরিণত হবে। পানির অণুগুলো যে শক্তি দ্বারা নিজেদের মধ্যে যুক্ত ছিল, তার থেকে বেশি শক্তি প্রয়োগ করায় এটি তখন আর পানি থাকবে না। বরং এটি অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের একটি মিশ্র ও উত্তপ্ত গ্যাসে পরিণত হবে।
এখন যদি তাপমাত্রা ৩০০০ K পর্যন্ত বাড়ানো হয়, তাহলে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণুগুলোও ভাঙতে শুরু করবে। ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। এটি তখন এক ধরনের উচ্চ তাপমাত্রার আয়নিত গ্যাসে পরিণত হবে।পদার্থের এই অবস্থাটি প্লাজমা নামে পরিচিত।কঠিন, তরল, বায়বীয় এই তিনটি দশার পাশাপাশি পদার্থের এই প্লাজমাকে অনেকে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলে থাকে। যদিও দৈনন্দিন জীবনে আমরা পদার্থের এই প্লাজমা অবস্থার সাথে পরিচিত না, তবে আমাদের সূর্যের দিকে তাকালেই আমরা প্লাজমা দেখতে পাব। মূলত সূর্যের মত সব নক্ষত্রগুলোতে পদার্থ এই প্লাজমা আকারেই থাকে।আর আমাদের মহাবিশ্বের বেশিরভাগ পদার্থই প্লাজমা আকারে আছে।
এখন আমাদের স্টোভের তাপমাত্রা আর একটু বাড়িয়ে ১ বিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন করে ফেলব। এই তাপমাত্রায় অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসগুলো ভেঙ্গে গিয়ে নিউট্রন ও প্রোটনের গ্যাসে পরিণত হবে। পদার্থের এই অবস্থাও কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বে অচেনা না। নিউট্রন স্টার বা পালসারের ভিতর পদার্থগুলো এই অবস্থায়ই থাকে।
এই নিউট্রন ও প্রোটনের গ্যাসকে যদি ১০ ট্রিলিয়ন কেলভিন তাপমাত্রায় নেওয়া যায়, তাহলে এই অতি-পারমানবিক কণিকারা ভেঙ্গে গিয়ে কোয়ার্কে পরিণত হবে। এখন আমাদের হাতে যা আছে তা হল, কোয়ার্ক আর লেপটনের(ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো) মিশ্র গ্যাস। এই তাপমাত্রায় আমরা কোয়ার্ক, ইলেকট্রন আর নিউট্রিনোগুলো স্বতন্ত্র কণা হিসেবে পাব।
আমরা তাপমাত্রা বাড়াতেই থাকব। এবার কোয়ার্ক-লেপ্টনের গ্যাসের তাপমাত্রা যখন ১ কোয়াড্রিলিয়ন পর্যন্ত উঠবে, তড়িৎ-চুম্বক বল ও নিউক্লিয়ার দুর্বল বল এক হয়ে যাবে। এদেরকে আর আলাদা বল হিসেবে সনাক্ত করা যাবে না। এই তাপমাত্রায় SU(2) X SU(1) সিমেট্রি তৈরি হবে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, তখন নতুন একটি প্রতিসামতা প্রকাশ পাবে, ফলে এই দুটি বলের প্রকৃতি হবে একই রকম। এই দুই বলের একীভূত রূপকে বলা হয় তাড়িৎ-দুর্বল বল।
এবার যখন তাপমাত্রা বাড়িয়ে ১০ ^ ২৮ ডিগ্রি কেলভিন করা হবে, তখন সবল নিউক্লিয়ার বল ও তাড়িৎ-দুর্বল বল একীভূত হয়ে GUT সিমেট্রি দেখা দেবে [ SU(5) , O(10) অথবা E(6)] । এই প্রতিসাম্যতা তৈরির পর নিউক্লিয় বল বলে আলাদা কিছু থাকবে না।
সবশেষে যখন ১০^৩২ ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় মহাকর্ষ বল, GUT বলের সাথে একীভূত হবে তখন দশ-মাত্রার সুপারস্ট্রিং জগতে তৈরি হবে, দেখা দেবে সব প্রতিসাম্যতা । এখন আমাদের স্টোভের ভিতর যা আছে তা হল সুপারস্ট্রিং-এর গ্যাস।(এই তাপমাত্রায় প্রকৃতির সকল প্রতিসাম্যতা দেখা দেবে ফলে স্ট্রিংগুলো তাদের সুপার পার্টনারের সাথে মিলিত হয়ে সুপারস্ট্রিং গঠন করবে )। এই বিশাল তাপমাত্রায় স্থান-কালের মাত্রা পরিবর্তন হয়ে যাবে। পরিচিত চতুর্মাত্রিক জগত আর কোঁকড়ানো ছয় মাত্রার জগত মিলে দশ-মাত্রার সুপারস্ট্রিং এর জগত তৈরি হবে। সুপারস্ট্রিং গ্যাসের মধ্যে, ইন্টার-ডাইমেনশনার ট্রাভেল করা যাবে, হয়ত চোখের সামনেই দেখা যাবে একটি সুন্দর ওয়ার্মহোল। তবে এই পরিস্থিতিতে ঐ রান্নাঘর থেকে যত তাড়াতাড়ি বের হওয়া যায় ততই মঙ্গল !
কেন স্ট্রিং থিওরি ?
পুরো বিশ্বজগতকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের হাতে এখন দুটি তত্ত্ব আছে। একটিকে বলা যায় বড়দের তত্ত্ব; আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব। অন্যটিকে বলা যায় ছোটদের তত্ত্ব; কোয়ান্টাম মেকানিক্স। আপেক্ষিক তত্ত্বের সাহায্যে বৃহৎ জগতের সবকিছুই নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। গ্রহ-নক্ষত্র, সৌরজগৎ, ছায়াপথ, নীহারিকা, ব্ল্যাক হোল, হোয়াইট হোল,মহাবিশ্বের প্রসারণ এমনকি বিগ ব্যাং । আর পরমাণু, অতি-পারমানবিক কণিকা- ইলেকট্রন, কোয়ার্ক, নিউট্রিনো, মেসন সহ আরও অনেক অতিক্ষুদ্র কণিকাদের জগতকে ব্যাখ্যা করে কোয়ান্টাম মেকানিক্স।
দুটি তত্ত্বই আলাদা ভাবে মহাবিশ্বের সকল ভৌত ঘটনার ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু দুটি একসাথে কখনোই নয়। মূলত এই দুটি তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারনার উপর গড়ে উঠেছে। দেখলে মনে হবে যেন, একটি সঠিক হলে অন্যটি সঠিক হতে পারে না। কিন্তু দুটো তত্ত্বই সকল প্রকার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ইতিমধ্যেই নির্ভুল প্রমাণিত । বিজ্ঞানীরা যখন অতিক্ষুদ্র কোন কিছুর আচরণ ব্যাখ্যা করেন তখন তারা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্য নেন। আবার বড় থেকে শুরু করে অতি-বৃহৎ কিছুর আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য আপেক্ষিক তত্ত্বকে কাজে লাগান।
সমস্যা হল, এভাবে কিন্তু সব কিছুর ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। যেমন, ব্ল্যাক হোলের কথাই ধরা যাক। ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে কি ঘটছে তা জানার জন্য আমাদের আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স দুটোই ব্যাবহার করতে হবে। কারণ ব্ল্যাক হোলের প্রচণ্ড ভর, স্থান-কালকে এমনভাবে বাকিয়ে দেয় যে, সেখানে আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণ ভেঙ্গে পরে। আর ব্ল্যাক হোলের ভেতরটায় পদার্থ কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না; ভেঙ্গে চুরে এমন অবস্থায় থাকে যে, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ছাড়া সেই অবস্থা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। তবে এত বিশাল ভরের বস্তুকে ব্যাখ্যা করার জন্য’তো আপেক্ষিক তত্ত্বেরও দরকার। ফলে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের একই সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আপেক্ষিক তত্ত্ব দুটোরই প্রয়োজন হয়।
আবার সৃষ্টির একদম শুরুতেও আপেক্ষিকতার তত্ত্ব কাজ করে না। শুরুটা ছিল একই সাথে একটি কোয়ান্টাম ঘটনা ও স্থান-কালের বক্রতার সৃষ্ট । সেই সময়টা ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের দুটি তত্ত্বকে একইসাথে প্রয়োগ করতে হবে।
আর দুটি তত্ত্ব এমনই যে এদের একসাথে কোথাও প্রয়োগ করা যায় না। এই তত্ত্ব দুটি শুধু ভিন্ন বিষয়ই ব্যাখ্যা করে না,এদের মূল ধারনাগুলোও একদম বিপরীত। আপেক্ষিক তত্ত্বে বলকে ব্যাখ্যা করা হয় স্থান-কালের জ্যামিতির সাহায্যে। সেখানে কোয়ান্টাম মেকানিক্স মতে বলগুলো কার্যকর হয় কিছু ক্ষুদ্র কণিকার বিনিময়ের দ্বারা। আপেক্ষিক তত্ত্বের সাহায্যে যেকোনো গ্রহ নক্ষত্রের গতি ও অবস্থান একদম নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎবাণী করা যায়। আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি মূল নিয়ম হল অনিশ্চয়তা নীতি। ফলে বোঝাই যাচ্ছে এদের সবকিছুই একদম বিপরীত। কোয়ান্টাম জগতে সাধারণ পদার্থবিজ্ঞানের কোন নিয়মই প্রযোজ্য নয়, আবার বস্তু জগত ও মহাবিশ্বের বৃহৎ মাত্রিক গঠন ব্যাখ্যা করতে গেলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধারণাগুলোর কোন দামই নেই। তাই প্রকৃতিতে আসলে কি ঘটে চলছে আমরা সত্যিই জানি না।
ব্ল্যাক হোল বা সৃষ্টির মুহূর্ত সম্পর্কে ভালমতো জানতে হলে, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আপেক্ষিক তত্ত্বকে সমন্বিত করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু কাজটি কিন্তু মোটেও সহজ নয়। বিজ্ঞানীরা অনেক চেষ্টা করেও তা করতে পারছেন না। তবে একমাত্র স্ট্রিং থিওরিই পারে কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আপেক্ষিক তত্ত্বকে সমন্বিত করতে।
এই দুটি আপাত বিরোধী তত্ত্বকে কেন সমন্বিত করা যাচ্ছে না তা বুঝতে হলে , প্রকৃতির চারটি মৌলিক বল, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও আপেক্ষিক তত্ত্ব সম্পর্কে ভালমতো জানতে হবে। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে তিনটি বলের জন্য কোয়ান্টাম তত্ত্ব গঠন করে, এদের সমন্বিত করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এই তিনটি বলের সাথে মহাকর্ষ বলকে কোনভাবেই একীভূত করা যাচ্ছে না। ফলে পদার্থবিজ্ঞানের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে, মহাকর্ষের জন্য একটি কোয়ান্টাম তত্ত্ব গঠন করে প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলকে একীভূত করা।
মূলত মহাকর্ষের জন্য একটি কোয়ান্টাম তত্ত্ব গঠন করাটাই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন প্রকৃতির বলগুলোকে একীভূত করে একটি চূড়ান্ত তত্ত্ব গঠন করতে পারলে আমরা মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য জানতে পারব। শুধুমাত্র এই একটি তত্ত্ব দিয়েই মহাবিশ্বের সকল ভৌত ঘটনার ব্যাখ্যা করা যাবে। এজন্য এই তত্ত্বকে বলা হয় সবকিছুর তত্ত্ব(Theory of Everything)।
স্ট্রিং থিওরিকে বোঝা মানে আমরা যে বাস্তবতায় বাস করি তার মুল সুরটাকে বুঝতে পারা। আমরা যে মহাবিশ্বে বাস করি এর পাশাপাশি কি প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে? প্রকৃতিতে কি শুধুমাত্র এক সেট নিয়ম কার্যকর নাকি অসীম সংখ্যক ? আমাদের মহাবিশ্বে কেন এই নিয়মগুলোই খাটে, কেন অন্য কোন নিয়ম নয় ? ভবিষ্যৎ বা অতীতে ভ্রমণ কি সম্ভব ? আমাদের মহাবিশ্বে কতগুলো মাত্রার অস্তিত্ব আছে? পদার্থবিদরা মূলত এইসব প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে যাচ্ছে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আমরা দেখব, কিভাবে মহাকর্ষকে অন্য বলগুলোর সাথে সমন্বিত করে একটি সবকিছুর তত্ত্ব গঠন করা হয়েছে। আর এই তত্ত্ব সত্যিই সবকিছুর তত্ত্বের দাবীদার কিনা ! তবে তার আগে আমাদের প্রকৃতির চারটিও মৌলিক বল, আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্পর্কেও ভালমতো জেনে নিতে হবে ।
বিঃদ্রঃ লিখাটি মূলত স্ট্রিং থিওরি নিয়ে একটি বইয়ের জন্য লিখা। তাই আকারে একটু বড় হয়ে গেল। সময়ের অভাবে ব্লগ পোস্ট উপযোগী করে দিতে না পারার জন্য দুঃখিত। পরবর্তী পোস্টে নিউটনের তত্ত্ব ও আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা থাকবে।

মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তে পৌঁছে…

লিখেছেনঃ দীপেন ভট্টাচার্য

বিষয়: জ্যোতির্বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, বিশ্বতত্ত্ব
 
গত সপ্তাহের সংবাদ অনুযায়ী জ্যোতির্বিদরা পর্যবেক্ষিত বা অবলোকিত গ্যালাক্সীদের মধ্যে সবচেয়ে দূরতম গ্যালাক্সীটি খুঁজে পেয়েছেন। এই গ্যালাক্সীটি আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টির আদি মূহুর্ত বিগ ব্যাংএর মাত্র ৬০০ মিলিয়ন (৬০ কোটি) বছরের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল। বিগ ব্যাংএ সৃষ্ট হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস থেকে ক্রমঃশীতল মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্ররা হয়তো এই গ্যালাক্সীর অধিবাসী। এই গ্যালাক্সী থেকে যে আলো আমরা এই বছর অবলোকন করছি তা প্রায় ১৩.১২ বিলিয়ন (বা এক হাজার তিন শো বারো কোটি) বছর আগে রওনা দিয়েছিল। [খেয়াল করবেন আমি এই আলোর উৎসদের ১৩ বিলিয়ন বা ১৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত বলছি না, কারণ স্থানের (বা দেশের) প্রসারণের জন্য মহাকাশবিদ্যায় দূরবর্তী গ্যালাক্সীদের দূরত্ব নির্ধারণ করা তুলমামূলকভাবে জটিল।] গ্যালাক্সীটি যদি “আজও” বেঁচে থাকে, তবে তার বয়স মহাবিশ্বের কাছাকাছিই হবে, কিন্তু তাকে আমরা যে অবস্থায় দেখছি সেটা তার শিশু অবস্থায়, সে বোধহয় সবে জন্মগ্রহণ করেছে। মহাবিশ্বের বয়স যদি এখন হয় ১০০, তখন মহাবিশ্বের বয়স সবে ৪.৪ (বা বর্তমান বয়সের ৪.৪%)। তখন এই গ্যালাক্সী থেকে যে আলো বিকিরিত হয়েছিল আজ আমরা তা দেখতে পারছি। সেই সময় পৃথিবীর জন্মগ্রহণ হয় নি।

শক্তিশালী দূরবিন দিয়ে বিজ্ঞানীরা দেশ-কালের চরম প্রান্তে প্রথম নক্ষত্র বা প্রথম গ্যালাক্সীর খোঁজ করছেন। তাহলে আমরা কি মহাবিশ্বের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেছি? আমরা কি তাহলে ঐ গ্যালাক্সীর থেকে দূরবর্তী কোন বস্তু এর আগে অবলোকন করি নি? এর উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ! করেছি। প্রায় ৪৫ বছর আগে প্রথমবারের মত আমরা মহাবিশ্বের প্রায় শেষ প্রান্ত থেকে আগত আলো কিছুটা কাকতালীয় ভাবে হলেও প্রথম বারের মত পর্যবেক্ষণ করেছি, এখনও করে যাচ্ছি। সেই আলো গ্যালাক্সীর মত কোন একক বস্তু থেকে আসছে না, সে আলো আসছে আমাদের চারপাশ ঘিরে মহাবিশ্বের যে সীমানা সেইখান থেকে। সেই আলো অবশ্য চোখে দেখা যায় না, তার তরঙ্গ দৈর্ঘ মাইক্রো-ওয়েভ এলাকায়। এই পর্যবেক্ষণের পর জ্যোতির্বিজ্ঞান পুরোপুরি বদলে গেছে।

১৯৬৫ সালে নিউ জার্সীতে বেল ল্যাবরেটরীর দুজন বিজ্ঞানী প্রায় হঠাৎ করেই একটা বড় রেডিও এন্টেনার মাধ্যমে এই মাইক্রো-ওয়েভ তরঙ্গের সন্ধান পেয়েছিলেন, যে তরঙ্গ মনে হল আকাশের সব দিক থেকেই আসছে, দিনে ও রাতে। তাকে বলা হল কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা সিএমবি (CMB)। উইকিপিডিয়ার বাঙ্গালীরা দেখলাম এটার নাম দিয়েছেন মহাবিশ্ব অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ। যাইহোক, সিএমবি দেখা গেল বহু কোটি বছর আগে ঘটিত বিগ ব্যাংএর বিস্ফোরণে সৃষ্ট শক্তির অবশেষ। সিএমবি আবিষ্কারকদের নোবেল পুরস্কার দেয়া হল, যদিও এই বিকিরণের ভাবীকথন অনেক তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা আগেই করেছিলেন। সেই আবিষ্কারের পর বহু দশক কেটে গেছে। ইতিমধ্যে সিএমবিকে কৃত্রিম উপগ্রহ ও বেলুনে বসানো যন্ত্র দিয়ে আরো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবলোকন করা হয়েছে। ১৯৯০এর দশকে COBE উপগ্রহ সিএমবির মধ্যে ঔজ্জ্বল্যের ওঠানামার ওপর ভিত্তি করে মহাজাগতিক বস্তুর আদি ঘনত্বের বিতরণকে কিছুটা নির্ধারণ করতে পারলো। তার জন্যেও আর একটি নোবেল পুরস্কার দেয়া হল। তার দশ বছর পর WMAP নামে আর একটি উপগ্রহ-যন্ত্র আরো যথার্থতা সহকারে সিএমবি মেপে দেখালো যে আমাদের মহাবিশ্বের স্থান (বা দেশের) মেট্রিক সমতল (বক্র নয়), অর্থাৎ একটি আলোর রেখা মহাবিশ্বে প্রায় সরলরেখায় ভ্রমণ করবে।

কিন্তু সিএমবি শুধুমাত্র বিগ ব্যাংএর অবশেষ নয়। আমাদের দ্বারা নিরূপিত প্রতিটি সিএমবি ফোটন মহাবিশ্বের একদম শেষ প্রান্ত থেকে আসছে। বিগ ব্যাংএর পরে বস্তুর ঘনত্ব ধীরে ধীরে হাল্কা হয়ে আসছিল। কিন্তু তার মধ্যেও আলোর কণিকা বা ফোটন ইলেকট্রনের মেঘের মধ্যে আটকে পড়েছিল। বিগ ব্যাংএ সৃষ্ট ফোটন কণাসমূহ ইলেকট্রনের সাথে ক্রমাগত আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে আবদ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা ঠাণ্ডা হয়ে আসলে ইলেকট্রন প্রোটনের কক্ষপথে আবদ্ধ হয়ে সৃষ্টি করল হাইড্রোজেন পরমাণুর, ফোটনের সাথে তার বিক্রিয়ার পরিমাণও সেই সাথে কমে গেল। বিগ ব্যাংএর প্রায় ৩৫০,০০০ বছর পরে ফোটন মুক্ত হল, সেই ফোটনই প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর পরে আজ আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এর মধ্যে মহাবিশ্বের ক্রমাগত সম্প্রসারণের ফলে এই সিএমবি ফোটনের তাপমাত্রা তাদের আদি ৩০০০ কেলভিন (বা প্রায় ৩০০০ সেলসিয়াস) থেকে ২.৭ কেলভিনে নেমে এসেছে। বলা যায় সিএমবি’র প্রতিটি ফোটন মহাশূন্যের শেষ প্রান্ত থেকে এসেছে। কিন্তু তারা মুক্তি পেয়েছে বিগ ব্যাংএর ৩৫০,০০০ বছর পরে, তার মানে আমরা যাই করি না কেন আমরা সেই সাড়ে তিন লক্ষ বছরের দেয়াল পার হতে পারবো না, অর্থাৎ বিগ ব্যাংএর ৩৫০,০০০ বছরের মধ্যে কি হয়েছিল তার কোন সম্যক ছবি আমরা পাবো না (যদিও নিউট্রিনো পটভূমি বলে একটা জিনিস আছে যার সূত্রপাত হয়েছে বিগ ব্যাংএর প্রথম ১০ সেকেন্ডের মধ্যে, সেই আদি নিউট্রিনোর সন্ধান এখনও পাওয়া যায় নি)।

এই “দেয়াল”টা কি সত্যি একটা কিছু? এর উত্তরটা মহাজাগতিক অনেক কিছুর মতই একটু জটিল। এটা সবই নির্ভর করে সময়ের সাথে আমাদের অবস্থানের ওপর। আমরা সবাই জানি সারা মহাবিশ্বের জন্য কোন “এখনই” মূহুর্ত নেই। কিন্তু সারা বিশ্বের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়কে আমরা কেমন করে নির্ধারণ করবো? একটা খুব সহজ উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। আমাদের সূর্য। সূর্যের যে ছবিটা আমরা পাই তার সৃষ্টি হয়েছে সূর্য পৃষ্ঠে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড আগে। কাজেই আমাদের ও সূর্যের জন্য “এখনই” বলে একটা সময় আমরা সৃষ্টি করতে পারি যদি আমরা এই মূহুর্তে (সময় = ০) একটা পৃথিবী পৃষ্ঠেরর ছবি তুলি, তারপর ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড (সময় = ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড) অপেক্ষা করি এবং সূর্যের একটা ছবি তুলি। এই দুটো ছবি পাশাপাশি রেখে আমরা দাবী করতে পারি আমরা আমাদের সংলগ্ন পৃথিবী পৃষ্ঠের ও সূর্যের “এখনই” বলে একটা বাস্তবতার সৃষ্টি করেছি। এই যুক্তি অনুযায়ী, আমরা ৪.৩৬ বছর অপেক্ষা করে নিকট তারা আলফা সেন্টাউরির (সময় = ৪.৩৬ বছর) ছবি তুলে তাকে আমাদের তথাকথিত “এখনই” মূহুর্তের অন্তর্ভূক্ত করতে পারি। আমাদের ২.৫ মিলিয়ন (২৫ লক্ষ) বছর অপেক্ষা করতে হবে নিকটবর্তী বড় গ্যালাক্সী অ্যান্ড্রোমিডাকে “এখনই” মূহুর্তের অ্যালবামে ভর্তি করতে।
ওপরের এই নকশা অনুযায়ী আমাদের ১৪ বিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে হবে আমাদের তথাকথিত সিএমবি দেয়ালকে “এখনই” মুহূর্তের সঙ্গী করতে। কিরকম হবে তখন সেই “এখনই” দেয়াল? ১৪ বিলিয়ন বছর পরে, আমরা (বা অন্য কোন বুদ্ধিমান প্রাণী) হয়তো দেখব সেই “দেয়ালের” অবস্থানে অবস্থিত আমাদের মতই এক মহাবিশ্ব, আমাদের চারপাশের সাধারণ যেরকম গ্যালাক্সী সেরকম গ্যালাক্সীতে ভরপূর। আর সেখানে যদি আমাদের মত “বুদ্ধিমান” প্রাণী থেকে থাকে, তারাও হ্য়তো দূরবিন লাগিয়ে আমাদের দেখছে, কিন্তু আমাদের গ্যালাক্সীর বদলে তারা দেখছে সেই সিএমবি “দেয়াল”। যতদিনে তারা জানবে “ছায়াপথ” গ্যালাক্সীর কথা, ততদিনে আরো ১৪ বিলিয়ন বছর চলে গেছে। এই নকশা অনুযায়ী, মহাবিশ্বে কোন বিশেষ অবস্থান নেই, প্রতিটি দর্শক তার নিজস্ব মহাবিশ্বের “কেন্দ্রে” দাঁড়িয়ে আছে। আর “সিএমবি” দেয়াল? সে কোথায় থাকবে তখন? এই গ্যালাক্সীতে তখন কোন বুদ্ধিমান প্রাণী বেঁচে থাকলে তার দেখবে এমন একটি “দেয়াল” যার ফোটনেরা প্রায় ২৮ (১৪ + ১৪) বিলিয়ন বছর আগে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল।

দৃশ্যমান মহাবিশ্ব হচ্ছে আমাদের পর্যবেক্ষণের আওতাধীন মহাবিশ্ব, শুধুমাত্র গত ১৩ বা ১৪ বিলিয়ন বছরের মধ্যে যে আলো আমাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে, সেই আলো অবলোকনের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের সীমানা রচিত হয়। আমাদের পর্যবেক্ষণ একটা “দেয়াল” দ্বারা আবদ্ধ। আমরা যাই করি না কেন, যতই শক্তিশালী দূরবিন ব্যবহার করি না কেন, আমরা সেই “দেয়াল” ভেদ করতে পারব না। এই দৃশ্যমান মহাবিশ্ব সমগ্র মহাবিশ্বের একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ হতে পারে। সমগ্র মহাবিশ্ব কত বড় সেই সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই নেই।

ফিরে আসি আপাততঃ দূরতম গ্যালাক্সীর পর্যবেক্ষণে। জ্যোতির্বিদরা চিলির ইউরোপিয়ান সাদার্ন অবজারভেটরীর VLT (ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ) দিয়ে ১৩.১২ বিলিয়ন বছর আগের এই গ্যালাক্সীটি দেখেছেন। তাদের এই নিরীক্ষণ ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে সৃষ্ট দূরতম একক মহাজাগতিক বস্তুর রেকর্ড ভেঙ্গে দিল। ঐ মাসে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করেছিলেন একটি গামা-রে বার্স্ট যা কিনা বিস্ফোরিত হয়েছিল ১৩.০৯ বিলিয়ন বছর আগে। এর আগের রেকর্ড ছিল একটি গ্যালাক্সী, যেখান থেকে আলো ১২.৯৩ বিলিয়ন বছর আগে রওনা দিয়েছিল। একটার পর একটা রেকর্ড ভাঙ্গছে, আমরা ধীরে ধীরে প্রথম সৃষ্ট গ্যালাক্সীটির সন্ধান করছি। দেখা যাচ্ছে বিগ ব্যাংএর কয়েকশো মিলিয়ন বছরের মধ্যেই প্রথম নক্ষত্র ও প্রথম গ্যালাক্সীগুলো তৈরি হয়েছিল। তাদের আলো চারপাশের হাইড্রোজেন গ্যাসকে আয়নিত করেছিল, এই নিউট্রাল হাইড্রোজেন দৃশ্যমান আলোকে আটকে রাখতো। বলা হয়ে থাকে বিগ ব্যাংএর পরে যে অন্ধকার যুগ শুরু হয়েছিল এই আয়নায়নের মাধ্যমে সে যুগের অবসান হল।

কিন্তু আমরা যখন সেই প্রথম গ্যালাক্সিটি আবিষ্কার করবো, তখন কি হবে? (এমনও হতে পারে আমরা প্রথম সৃষ্ট তারাটি আবিষ্কার করতে পারি যদি সেটি গামা-রে বার্স্ট হিসেবে বিস্ফোরিত হয়।) দূরতম গ্যালাক্সিটি যখন আবিষ্কার হবে, জ্যোতির্বিদরা তখন কি করবেন? তারা কি ডাকটিকিট সংগ্রহের মত দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্যালাক্সীকে নথিবদ্ধ করবেন? অথবা খোঁজ করবেন আর একটি সৌর জগতের (এর মধ্যে এমনতর ৫০০টি সৌর মণ্ডলের সন্ধান পাওয়া গেছে)? অথবা আর একটি সুন্দর মহাকর্ষ লেন্স মাধ্যমে একটি গ্যালাক্সীর বহু প্রতিচ্ছায়া মাধ্যমে খোঁজ করবেন ডার্ক ম্যাটারের। আমরা এখন জানি মহাবিশ্বের বেশীর ভাগ বস্তুই আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয় (ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি)। কিন্তু যে সমস্ত জিনিস আমরা চোখে দেখি, যাদের অত্যাশ্চার্য ছবি আমাদের জ্যোতির্বিদ্যায় আকৃষ্ট করেছিল, তাদের ভাগ্য বোধহয় শুধুমাত্র বড় বড় ক্যাটালগে নথিভুক্ত হওয়া।

জ্যোতির্বিদ্যা নিশ্চয় প্রাচীনতম বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে একটি। যদি আগুনের আবিষ্কার ও রন্ধনবিদ্যাকে রসায়ন শাস্ত্রের অন্তর্গত ধরা হয়, তবে রসায়ন একটি প্রাচীন বিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যাও নিশ্চয়ই সেই ধরণের প্রাচীনত্ব দাবী করতে পারে। প্রাচীন মানুষ, আফ্রিকার সাভানা থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার সময় তাদের ক্যাম্পের আগুণের স্ফুলিঙ্গকে অনুসরণ করে নিশ্চয়ই নিচ্ছিদ্র কালো আকাশের স্ফটিকসম বিন্দুদের চরিত্র নিয়ে ভেবেছিল। তারা তখনকার পাঁচটি দৃশ্যমান গ্রহের পদচারণাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে নিরীক্ষণ করেছিল, তাদের বলেছিল ভ্রমণকারী। তারা পৃথিবীর কিংবদন্তী কালো আকাশে স্থাপন করেছিল। তার হাজার হাজার বছর পরে, আজ আমরা বলছি মহাকাশকে আমরা যতটুকু দেখার তা প্রায় দেখে ফেলেছি। তবু আমাদের সংশয়বাদী বন্ধুরা বলবেন, আমরা এখানে এর আগেও ছিলাম। ঊণবিংশ শতাব্দীর শেষে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন প্রকৃতির সব রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে, এখন শুধু পৃথিবীর বা মহাবিশ্বের শ্রেণীবিন্যাস বাকি যা কিনা বোটানী বা ডাক-টিকিট সংগ্রাহকের অনুশীলনের মতই। এর কিছু পরেই আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব জগত সম্বন্ধে আমাদের বোধের আমূল পরিবর্তন করল। জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে আমরা কি আবার সেই জায়গায় ফিরে আসে নি? ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জী কি নতুন বিজ্ঞানের দিশা দিচ্ছে না? অবশ্যই। কিন্তু পর্যবেক্ষণ জ্যোতির্বিদ্যা (astronomy) ও জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার (astrophysics) মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। পৃথিবীতে নতুন একটা দ্বীপ আবিষ্কার করা (যা কিনা এখন কার্যতঃ প্রায় অসম্ভব) এবং দ্বীপ গঠনের প্রক্রিয়াকে অধ্যয়ন করার মধ্যে যে পার্থক্য এই পার্থক্যটা মূলতঃ তাই। কসমিক স্ট্রিং বা ওয়ার্ম হোলের মত কুহেলিকাময় Holy Grailএর সন্ধানের আশা জ্যোতির্বিদ্যা হয়তো রাখতে পারে, কিন্তু মহাবিশ্বের স্বরূপ উদঘাটন একমাত্র জ্যোতির্পদার্থবিদ্যাই করতে পারে। মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তে পৌঁছে পর্যবেক্ষণ জ্যোতির্বিদ্যার দিন হয়তো শেষ হয়ে আসছে।

অসীম আদি মহাবিশ্ব?

লিখেছেন দীপেন ভট্টাচার্য।

বিষয়: জ্যোতির্বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, বিশ্বতত্ত্ব
 
বেশ কয়েক মাস আগে মুক্তমনায় একটা লেখা লিখেছিলাম – “মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তে পৌঁছে।” লেখাটা সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সী আবিষ্কারের ওপর ছিল, গ্যালাক্সীটি বিগ ব্যাংগের মাত্র ৬০০ মিলিয়ন বছরের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল। ঐ লেখাটার সূত্র ধরে ও কিছু প্রশ্নের আলোকে কিছু বক্তব্যকে পুনরায় উপস্থাপনা করছি।
সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সীগুলো পার হলে আমরা পাই নিউট্রাল হাইড্রোজেনের একটা স্তর, তার পরে একটা অস্বচ্ছ দেয়াল যার পেছনে বিগ ব্যংএ সৃষ্ট ফোটন আলোক কণাসমূহ ইলেকট্রনের মেঘের মাঝে আটকা পড়ে আছে। সেই দেয়াল হচ্ছে আমাদের পর্যবেক্ষণের শেষ সীমা, যে দেয়ালের বিকিরণ আমরা পৃথিবী থেকে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রউন্ড হিসেবে দেখছি। সেই দেয়ালের পেছনে হচ্ছে বিগ ব্যাং। আমার বক্তব্য ছিল আমরা যদি “এই মূহুর্তে” সেই অস্বচ্ছ দেয়ালের কাছে পৌঁছতে পারতাম তাহলে সেখানে কোন দেয়াল থাকত না, বরং আমরা দেখতাম আমাদের মতই একটা মহাবিশ্ব – গ্যালাক্সিতে ভরা। কিন্তু সেই জায়গা থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে পৃথিবী দেখা যেত নয়া, দেখা যেত একটি অস্বচ্ছ দেয়াল। এর মানে হচ্ছে বিগ ব্যাংএর পরবর্তী মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের তরঙ্গ পৃথিবী যেখানে আজ অবস্থিত সেখান থেকে সবে মাত্র ঐ জায়গায় পৌঁছাচ্ছে।

অর্থাৎ মহাবিশ্বের যে কোন বিন্দুতেই যাওয়া যাক না কেন সেখান থেকে একটা গোলকের কল্পনা করা যেতে পারে যার সীমা রচিত হবে সেই অস্বচ্ছ দেয়াল দিয়ে। যত দিন যাবে সেই দেয়ালের দূরত্ব আমাদের থেকে বাড়বে কারণ দেয়ালের পেছন থেকে আলো আমাদের কাছে পৌঁছানোর সময় পাবে। বিগ ব্যাং যদি প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে সংঘটিত হয়, তবে সেখান থেকে আলো এসে পৌঁছাতে ১৪ বিলিয়ন বছর লেগেছে। এর মানে এই নয় সেই দেয়ালের দূরত্ব ১৪ বিলিয়ন আলোকবছর। ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জীর মডেলের গণনা অনুযায়ী সেই দেয়াল “এই মূহুর্তে” আমাদের কাছ থেকে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে, অর্থাৎ মহাবিশ্বের ব্যাস প্রায় ৯০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ধরে নেয়া যায়। কি ভাবে ১৪ বিলিয়ন বছরের মধ্যে মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ ৪৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ হল সেটা নিয়ে আর এক দিন আলোচনা করা যাবে, এখানে শুধু বলে রাখি যখন কোন দূরবর্তী বিন্দু থেকে আমাদের কাছে আলো আসে তখন আলোকে একটা প্রসারণশীল দেশ বা স্থানের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ আলো যে উৎস থেকে রওনা হয়েছিল তা পেছন দিকে আরো দূরে সরে যেতে থাকে এবং সামনে যেখানে আলোর পৌঁছনোর কথা সেই উদ্দেশ্য বিন্দুও দূরে সরে যেতে থাকে।

আমি এখানে গোলক, ব্যাস, ব্যাসার্ধ ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করছি কারণ ইদানীং কালের পর্যবেক্ষণ থেকে মনে হচ্ছে মহাবিশ্বের সামগ্রিক জ্যামিতি ইউক্লিডিও, অর্থাৎ দেশ-কালের “মেট্রিক” সমতল। তার মানে এই মহাবিশ্বে একটি বিশাল ত্রিভূজ আঁকলে তার তিনটি কোণের সমষ্টি হবে ১৮০ ডিগ্রী। কিন্তু ইউক্লিডিও মহাবিশ্ব মানে একটি অসীম মহাবিশ্বও বটে!
কিন্তু মহাবিশ্ব যদি “এই মূহুর্তে” অসীম হয়, তবে সে অতীতেও অসীম ছিল। কোন একটি “সীমিত” বিন্দু থেকে অসীম মহাবিশ্বের সূত্রপাত হতে পারে না। শুধুমাত্র একটি অসীম মহাবিশ্ব থেকেই আর একটি অসীম মহাবিশ্বের সৃষ্টি হতে পারে।
তাহলে আমাদের বিগ ব্যাংএর মডেলটি কি রকম হওয়া উচিত?
ধরে নিন আজ থেকে ১৪ বিলিয়ন বছর আগে সেই অসীম মহাবিশ্বের ঘনত্ব সাংঘাতিক রকম বেশী ছিল। চিন্তা করুন একটা বিশাল কাদামাটির (বা রাবারের) দলা যা কিনা প্রতিটি মাত্রায় অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কোন একটা বিশেষ মূহুর্তে, যাকে আমরা বিগ ব্যাং বলছি, দলাটি বিস্তৃত হতে শুরু করল। এই মডেলটি আপনি একটা রাবারের দলাকে হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতে পারেন। দেখবেন যে এই প্রসারণের ফলে রাবার বা কাদামাটির ঘনত্ব কমে যাচ্ছে এবং আপনি যদি নিজেকে একটি রাবারের কণা হিসেবে কল্পনা করেন দেখবেন যে অন্য সব কণাই আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

এখন মনে করুন যে মুহূর্তে প্রসারণ শুরু হল সেই মুহূর্তে অনেক আলোরও (ফোটনের) সৃষ্টি হল (বিগ ব্যাং জনিত আলো, বস্তু-প্রতি বস্তু ধ্বংসের আলো, ইত্যাদি)। ধীরে ধীরে ঘনত্ব কমে গেলে সেই আলো মুক্তি পেয়ে মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দিকে রওনা দিল। আমাদের পৃথিবী যেখানে সৃষ্টি হবার কথা সেই জায়গার আলো অনেক আগেই চলে গেছে (১৪ বিলিয়ন বছর আগে), সেই আলোই এখন ৪৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত গ্যালাক্সীরা কসমিক মাইক্রোওয়েভ হিসেবে দেখছে।

আমাদের যদি “ঈশ্বরের দৃষ্টি” থাকত তবে আমরা দেখতাম আমাদের মহাবিশ্বের গ্যালাক্সীপুঞ্জের মত গঠনই একটা অসীম স্থানে ছড়িয়ে আছে, কিন্তু আলোর সীমিত গতির জন্য দূরবর্তী স্থানের সংবাদ শুধুমাত্র এখনই আমাদের কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে।
১৪ বিলিয়ন বছর আগে কিছু একটা হয়েছিল। কিন্তু সেটা একটি বিন্দু থেকে বিস্ফোরণের মত নয়। [এমনও সম্ভব দুটি অসীম ত্রি-মাত্রিক মহাবিশ্ব চতুর্থ মাত্রায় ভাসতে ভাসতে ধাক্কা খেয়েছিল যা কিনা স্থান-কালের প্রসারণের সৃষ্টি করেছিল। সেটাও এক ধরণের বিগ ব্যাং।] সাধারণতঃ পাঠ্যবইএ বা জনপ্রিয় বিজ্ঞান প্রবন্ধে এই ছবিটা ঠিকমত দেয়া হয় না, তার একটা কারণ অবশ্য এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিজেরাই একটু দ্বিধান্বিত আছেন, অসীম স্থানে বিস্তৃত আদি মহাবিশ্বের ধারণাটা বোধগম্য নয়।