Monday, April 27, 2020

করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা যেভাবে করা হয়

নতুন করোনা ভাইরাস কভিড-১৯ এর ভয়াল থাবায় ২০ মার্চ পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আড়াই লাখেরও বেশি। মৃতের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। এই রোগের লক্ষণ হচ্ছে গলা ব্যথা, কাশি, নাকে সর্দি, জ্বর ইত্যাদি। কিন্তু এসব লক্ষণ তো নিউমোনিয়া বা ফুসফুসের অন্যান্য রোগেও দেখা যায়। তাহলে এর সাথে কভিড-১৯ এর পার্থক্য কী? সুতরাং শুধু লক্ষণ দেখে এই রোগ শনাক্ত করা সম্ভব নয়।
কভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা জানা যায় একটি নির্দিষ্ট শনাক্তকরণ পরীক্ষার মাধ্যমে। সেই পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ আসলেই জানা যায়, তিনি ওই রোগে আক্রান্ত। কী সেই বিশেষ পরীক্ষা?
পরীক্ষাগারে রোগীর নমুনা থেকে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়; Image Source: Shannon Stapleton/Reuters
পরীক্ষাটি হচ্ছে পলিমারেজ চেইন রিএকশন বা পিসিআর পদ্ধতি। পিসিআর পদ্ধতিটি হচ্ছে ডিএনএ সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র সংখ্যক ডিএনএ থেকে বিপুল পরিমাণ ডিএনএ সৃষ্টি করা হয়, যা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় করা যায়। আশির দশকে ক্যারি মুলিস পিসিআর পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন। এর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার জেতেন।
পিসিআর পদ্ধতিতে ডিএনএকে চক্রাকারে উত্তপ্তকরণ ও শীতলীকরণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরিমাণ ডিএনএ থেকে লক্ষ লক্ষ ডিএনএ তৈরি করা হয়। এরপর ফ্লুরোসেন্ট নামক একপ্রকার রঞ্জক পদার্থের মাধ্যমে বোঝা যায়, মিশ্রণে কী পরিমাণ ডিএনএ আছে। এর মাধ্যমে শরীরে জীবাণুর উপস্থিতি জানা যায় সঠিকভাবে।
তবে এর আগে করোনা ভাইরাসের জীবাণু শনাক্ত করতে হলে এর জিনোম সংগ্রহ করতে হয়। জিনোম হচ্ছে সিংগেল স্ট্র্যান্ডেড আরএনএ। একে একধরনের এনজাইমের মাধ্যমে ডাবল স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ-তে রূপান্তর করা হয়। এই এনজাইমের নাম রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ বা আরটি। এই প্রক্রিয়া ও পিসিআরকে একত্রে বলা হয় আরটি-পিসিআর (RT-PCR)।
বর্তমানে আরটি-পিসিআরের মাধ্যমেই জানা যায়, কোনো রোগীর শরীরে কভিড-১৯ ভাইরাস আছে কি না। এটিই একমাত্র আদর্শ ও দ্রুত পদ্ধতি, যার মাধ্যমে করোনার সাথে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো অন্যান্য জীবাণুর পার্থক্য করা যায়। তাহলে রোগীর শরীর থেকে কীভাবে শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
চীনে এক রোগীর নাক থেকে নমুনা সংগ্রহ করছেন চিকিৎসক; Image Source: AP: Chinatopix
প্রথম ধাপ হচ্ছে রোগীর নমুনা সংগ্রহকরণ। শ্বসনতন্ত্রের উপরিভাগের অংশ এবং নিম্নভাগের অংশ বা ফুসফুস থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। উপরিভাগের নমুনা সংগ্রহ করা হয় একটি বিশুদ্ধ প্লাস্টিকের নরম কাঠির সাহায্যে। একে বলা হয়ে ‘সোয়াব স্টিক’। এর মাধ্যমে জিহ্বা স্পর্শ না করে গলার পেছনের দিকে টনসিলের অংশ থেকে সোয়াব নিয়ে আসা হয়। এরপর নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে যে পর্যন্ত বাধা না আসে, সে পর্যন্ত সোয়াব স্টিক ঢুকানো হয়। তারপর ১০-১৫ সেকেন্ড কাঠিটি ঘুরিয়ে বের করে আনা হয়। দুই নাকের ছিদ্র থেকেই নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
নমুনা সংগ্রহের পর সোয়াব স্টিকটি একটি জীবাণুমুক্ত টেস্ট টিউবে নিয়ে সিল মেরে দেয়া হয়। এরপর একে ঠাণ্ডা বক্সে করে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। নমুনাগুলো রাখতে হয় ৩৫-৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায়। পরীক্ষা করতে হয় চারদিনের মধ্যে।
সার্স এবং মার্স করোনা ভাইরাস শ্বসনতন্ত্রের নিম্নভাগের নমুনা থেকে সংগ্রহ করা হতো। তাই সম্ভব হলে এই অংশ থেকেও নমুনা সংগ্রহের কথা বলা হয়। এক্ষেত্রে প্লুরাল ফ্লুইড, কফ এগুলো নমুনা হিসেবে একটি জীবাণুমুক্ত কৌটায় নেয়া হয়।
নার্স, চিকিৎসক কিংবা যে কর্মী নমুনা সংগ্রহ করেন, তাদের কিছু প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হয়। তাদেরকে গাউন, দস্তানা, আই শিল্ড ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। এগুলোকে বলা হয় পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট বা পিপিই।
রোগীর নমুনা সংগ্রহকারীদের পিপিই ব্যবহার করা উচিত; Image Source:
Robin Lubbock/WBUR
পরীক্ষাগারে নমুনা আনার পর প্রথমে আরএনএ সংগ্রহ করা হয়। মানব কোষ, প্রোটিন, এনজাইম এগুলো থেকে আরএনএ-কে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এই ধাপকে বলা হয় আরএনএ নিষ্কাশন। এই প্রক্রিয়া যদি হাতে করতে হয়, তাহলে নমুনার মধ্যে বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ যোগ করতে হয়। তারপর একে সেন্ট্রিফিউজ করলে অন্যান্য অংশ থেকে আরএনএ বিচ্ছিন্ন হয়। বর্তমানে বেশ কিছু কোম্পানি এক ধরনের কিট তৈরি করে, যাতে আরএনএ নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় সব উপকরণই পাওয়া যায়। স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমেও এই নিষ্কাশন করা যায়।
PCR পদ্ধতির ধাপসমূহ; Image Source: laboratoryinfo.com
আরএনএ নিষ্কাশন করার পরের ধাপে এর সাথে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ এনজাইম যোগ করা হয়। এই এনজাইম আরএনএকে ডিএনএ-তে রূপান্তরিত করে। এরপর এই ডিএনএকে একটি টেস্টটিউবে রাখা হয়। টেস্টটিউবে নিউক্লিওটাইড, ডিএনএ নির্মাণকারী এনজাইম এবং একধরনের ক্ষুদ্র ডিএনএ'র অংশ মেশানো হয়। নিউক্লিওটাইড ডিএনএ এর একটি গাঠনিক অংশ। এর মধ্যে থাকে ডিএনএ'র চারটি বেসের যেকোনো একটি (অ্যাডিনিন, গুয়ানিন, থাইমিন, সাইটোসিন), এক অণু শর্করা ও এক অণু ফসফরিক এসিড। নিউক্লিওটাইড ও এনজাইমের সাথে ক্ষুদ্র আরএনএ মেশানো হয় একে বলা হয় ‘প্রাইমার’।
প্রাইমারগুলোকে এমনভাবে নকশা করা হয়, যেন এগুলো ভাইরাসের জিনোমের নির্দিষ্ট সিকুয়েন্স খুঁজে বের করে মিলিত হতে পারে। তারা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ভাইরাসের জিনোমের সাথেই মিলিত হয়। অন্য কোনো অংশ যেমন মানবকোষ বা ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ'র সাথে যুক্ত হয় না।
এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় একটি পিসিআর মেশিনে। এই মেশিনের মাধ্যমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাপমাত্রা বাড়ানো হলে ডিএনএ'র ডাবল হ্যালিক্স ভেঙ্গে যায় এবং দুটি স্ট্র্যান্ড উন্মুক্ত হয়। যখন তাপমাত্রা কমানো হয়, তখন প্রাইমারগুলো উন্মুক্ত হওয়া ডিএনএ স্ট্র্যান্ডের কাঙ্ক্ষিত স্থানে গিয়ে যুক্ত হয়। এভাবে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একটি থেকে দু'টি ডিএনএ তৈরি হয়ে যায়।
এই চক্র ৩০-৪০বার সম্পন্ন করা হলে এক কপি ডিএনএ থেকে কোটি কোটি কপি ডিএনএ প্রস্তুত হয়। তখন এই ডিএনএ থেকে বিজ্ঞানীরা জীবাণুর ডিএনএ আছে কি না, তা সহজেই শনাক্ত করতে পারেন।
পিসিআর মেশিন; Image Source: istock
ডিএনএ শনাক্ত করার জন্য টেস্ট টিউবে ফ্লুরোসেন্ট রঞ্জক পদার্থ মিশ্রিত করা হয়। এর আভা দেখা যায় শুধুমাত্র ডিএনএ'র উপস্থিতি থাকলে। ডিএনএ'র সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে নির্গত আলোর সংখ্যাও বেড়ে যায়। পিসিআর মেশিনে বিশেষ ধরনের আলো পরিমাপের যন্ত্র থাকে। এটি ফ্লুরোসেন্স প্যাটার্ন থেকে শনাক্ত করতে পারে কোন নমুনায় ভাইরাস আছে, কোন নমুনায় নেই। আপনার শরীরে যদি করোনা ভাইরাসের জীবাণু থাকে, তাহলে এর আরএনএ রূপান্তরিত হবে ডিএনএ-তে। তারপর এই ডিএনএগুলো ফ্লুরোসেন্স আলোর মাধ্যমে নিশ্চিত করবে আপনার শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি।
রোগীর কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠাতে হয়। পরীক্ষাগার থেকে ফলাফল স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে আসে, তারপর রোগীর কাছে যায়। অস্ট্রেলিয়াতে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ৪৮-৭২ ঘণ্টা বা গড়ে পাঁচদিন সময় লাগে। অন্যান্য দেশেও এরকম সময়ই লাগে। সুতরাং, আমরা আজ যে তথ্য জানতে পারছি, তা আরো পাঁচদিন আগের। পাঁচদিন পর নতুন ফলাফল আসলে দেখা যায় আক্রান্ত রোগী আরো বেড়ে গেছে।
বর্তমানে অন্তত ২০টি কোম্পানি কাজ করছে ভাইরাস শনাক্তকরণ প্রক্রিয়াকে আরো দ্রুত ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় নিয়ে আসার। এতে পাঁচদিনের জায়গায় আধঘণ্টায় ফলাফল জানা যাবে। ক্রিস্পর (CRISPR) ভিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রেগনেন্সি টেস্টের মতো খুব দ্রুত ভাইরাসের ফলাফল জানার কথা বলা হচ্ছে। তবে এগুলো এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে।
এছাড়া আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে, রক্তে ভাইরাসের অ্যান্টিবডি নির্ণয় করার পদ্ধতি। একে বলা হয় সেরোলজিক্যাল পদ্ধতি। এতে অ্যান্টিবডি নির্ণয়ের মাধ্যমে জানা যাবে কোনো ব্যক্তি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, কিন্তু এখন সুস্থ আছেন। এটি পিসিআরের চেয়ে সস্তা এবং এতে রোগীও শনাক্ত করা যায়। কিন্তু এটি পিসিআরের মতো উপযুক্ত নয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ভাইরাসের আক্রান্তের চেয়ে বড় সঙ্কট ভাইরাস শনাক্তকরণের কিটের অভাব। কারণ এর ফলে জানা যাচ্ছে না, কেউ আদৌ ভাইরাসে আক্রান্ত কি না। আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে চীন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া কিট দিয়ে পরীক্ষা করলেই হয়তো বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সংখ্যাটা কেমন, তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে।

স্কুল থেকেই ঝরে পড়া যে নারীর চোখে প্রথম ধরা পড়ে করোনাভাইরাস

বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে আজ কান পাতলে শুধু একটিই আতঙ্কের নাম শোনা যায়- ‘করোনাভাইরাস’। ২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহান শহরে সর্বপ্রথম আবির্ভূত হয় নভেল করোনাভাইরাস বা সার্স কোভ-২। অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নাম দিয়েছে ‘কোভিড-১৯’। সেই দিন থেকে প্রায় সাড়ে চার মাসের ব্যবধানে করোনাভাইরাস গোত্রের সপ্তম প্রজাতির ভাইরাসটি ইতিমধ্যে প্রায় পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করে ফেলেছে। মৃত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
নভেল করোনাভাইরাসের ত্রিমাত্রিক মডেল; Image source: Wikimedia commons
অনেকটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, যে করোনাভাইরাস আজ সকল জীবাণুবিদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, তার আবিষ্কারক ছিলেন এমন এক নারী, যার বিদ্যার দৌড় স্কুলের গণ্ডিও পার করতে পারেনি! কে সেই নারী? কীভাবে তিনি অতি ক্ষুদ্র করোনাভাইরাসকে সর্বপ্রথম শনাক্ত করেছিলেন? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই কীভাবে তিনি দৃশ্যপটে আসতে সক্ষম হন? সেসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আজকের এই লেখা।

পরিচয় এবং শিক্ষা জীবন

অদম্য ও প্রতিভাবান সেই নারীর নাম জুন ডালজিয়েল আলমেইডা। তিনি ১৯০৫ সালের ৩০ অক্টোবর তৎকালীন স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয় জুন হার্ট। তার বাবা ছিলেন একজন বাস ড্রাইভার। গ্লাসগো শহরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অ্যালেক্সান্দ্রা পার্কের নিকটে ভাড়া করা এক অ্যাপার্টমেন্টে কাটে তার শৈশব।
জুন ডালজিয়েল আলমেইডা; Image source: oxibuzz.com
ছাত্রী হিসেবে তিনি বেশ মেধাবীই ছিলেন। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া ছিল তার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন। কিন্তু দারিদ্র্যের কাছে তার স্বপ্ন হেরে যায়। তার বাবার পক্ষে মেয়ের উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেয়া সম্ভব ছিল না। তাই মাত্র ১৬ বছর বয়সে যৎসামান্য লেখাপড়া করেই বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ফেলেন জুন

কর্মজীবনের সূত্রপাত

জীবিকার তাগিদে জুন ১৯৪৭ সালে গ্লাসগো রয়্যাল হাসপাতালে ল্যাব টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগ দেন। তিনি সেখানে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন টিস্যুর নমুনা বিশ্লেষণের কাজ করতেন। 

বিয়ে ও গবেষণায় হাতেখড়ি

কর্মক্ষেত্রে আরও সাফল্যের আশায় তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান এবং সেন্ট বারথেলোমেউ হাসপাতালে টেকনিশিয়ানের কাজে যোগ দেন। সেখানে এনরিক্স আলমেইডা নামক ভেনিজুয়েলার এক চিত্রশিল্পীর সাথে তার দেখা হয়। দুজন একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেন এবং ১৯৫৪ সালে বিয়েটাও সেরে নেন। এরপর ১৯৫৪ সালের শেষভাগে জুন তার স্বামী এবং সদ্য ভূমিষ্ট কন্যাকে নিয়ে কানাডার টরোন্টোতে চলে যান। সেখানে তিনি অন্টারিও ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের কৌশলী হিসেবে যোগদান করেন।
সেখানে তিনি মাইক্রোস্কোপ বিষয়ক যাবতীয় বিষয় নিয়ে কাজ করেন। এমনকি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পূর্বে অদেখা বিভিন্ন ভাইরাসের গঠন পর্যবেক্ষণের নতুন নতুন উপায় তিনি আবিষ্কার করেন। সেসব পর্যবেক্ষণ তিনি গবেষণাপত্র আকারে প্রকাশও করেন।
১৯৬৩ সালে অন্টারিও ক্যান্সার ইনস্টিটিটিউটে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে কর্মরত জুন আলমেইডা; Image source: Getty images

আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন

আলমেইডার আবিষ্কারটি ছিল বেশ সরল। তবে জীবাণুবিদ্যার জগতে তার উদ্ভাবন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।
আণুবীক্ষণিক কণা নিয়ে কাজ করার মূল সমস্যা হলো কোন জিনিসটা খুঁজতে হবে তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ একটি নমুনার দিকে ইলেকট্রন বিম বা দ্রুতগতির ইলেকট্রন কণার স্রোত নিক্ষেপ করে। এরপর সেই নমুনার তলের সাথে ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়াকে রেকর্ড করে রাখে। ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য(১.২৩ ন্যানোমিটার) দৃশ্যমান আলোর (৪০০-৭০০ ন্যানোমিটার) চেয়ে অনেক ছোট হওয়ার কারণে বিজ্ঞানীরা এই মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে নমুনা তলের আরও সূক্ষ্ম ও নিখুঁত ছবি পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হন। কিন্তু এরপরেও সমস্যা থেকেই যায়। মাইক্রোস্কোপ থেকে পাওয়া ছবিতে ছোট ছোট বিন্দুর মতো অংশ নিয়ে গবেষকরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকেন। সেগুলো কি কোষ নাকি ভাইরাস না অন্য কিছু সেটা নিয়ে তারা একমত হতে পারছিলেন না।
এই সমস্যার সমাধানে কাজ শুরু করেন জুন আলমেইডা। তিনি অনুধাবন করেন, কোনো ভাইরাসকে সঠিকভাবে শনাক্ত করার জন্য সেই ভাইরাসে পূর্বে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির দেহের অ্যান্টিবডি ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ তিনি জানতেন, কোনো ভাইরাসের অ্যান্টিবডি তার প্রতিযোগী অ্যান্টিজেনকে ধ্বংসের জন্য তার দিকে ধাবিত হয়। তাই অ্যান্টিবডি আক্রমণের সময় শুধুমাত্র ভাইরাসের অ্যান্টিজেনের চারপাশেই সমবেত হয় এবং তার উপস্থিতি সহজেই মাইক্রোস্কোপে ধরা পড়ে। মোদ্দা কথায়, জুন অ্যান্টিবডির সাহায্য নিয়ে ভাইরাস শনাক্তের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো কাজ। এই পদ্ধতি আবিষ্কারের মাধ্যমে চিকিৎসকরা রোগীর দেহের ভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষার জন্য ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের প্রচলন শুরু করে।
এই আবিষ্কারের মাধ্যমে আলমেইডারের সামনে সাফল্যের রাস্তা খুলে যায়। তিনি তার পদ্ধতি ব্যবহার করে বিভিন্ন ভাইরাস এবং এর পোষকদেহ খুঁজে পান। এর মধ্যে রুবেল্লা (Rubella) ভাইরাস উল্লেখযোগ্য। এই ভাইরাসের সংক্রমণে নারীদের গর্ভকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। বিজ্ঞানীদের কাছে এটি 'তিন দিনের হাম' বা ‘Three Day Measles’ নামে সুপরিচিত। জীবাণুবিদেরা কয়েক দশক ধরে এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। কিন্তু সেটি মাইক্রোস্কোপের নীচে প্রথমবারের মতো দেখেন জুন।

করোনাভাইরাস আবিষ্কার

জুনের বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে যুক্তরাজ্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে তিনি ১৯৬৪ সালে লন্ডনের বিখ্যাত সেন্ট থমাস হসপিটাল মেডিকেল স্কুলে কাজ শুরু করেন। নামটা অনেকেই শুনে থাকতে পারেন। কারণ ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছিলেন।
লন্ডনে ফেরার পর তিনি উইল্টসশায়ারের সাধারণ সর্দি-কাশি বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডক্টর ডেভিড টাইরেলের সাথে যুগ্মভাবে গবেষণায় লেগে যান। টাইরেল মূলত জ্বর কিংবা সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের নাকের ভেতরের তরল পদার্থ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন। তার গবেষক দল সেই তরল পদার্থের নমুনা থেকে সাধারণ সর্দি-কাশি সৃষ্টিকারী বেশ কিছু ভাইরাস ল্যাবে তৈরি করতে সমর্থ হয়। কিন্তু কিছু ভাইরাস ছিল তাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নমুনার নাম ‘B814’। ১৯৬০ সালে সারে প্রদেশের একটি বোর্ডিং স্কুলের এক ছাত্রের নাসারন্ধ্র থেকে তিনি এই তরল নমুনাটি সংগ্রহ করেন।
ডেভিড টাইরেল; Image Source: royalsocietypublishing.org
বিজ্ঞানীরা অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের দেহে নমুনাটি প্রয়োগ করে সর্দি-কাশির উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারলেন। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ল্যাবে কোনো কোষের মাঝে ভাইরাসটির বিস্তার ঘটাতে ব্যর্থ হন। অথচ পরীক্ষাগারে তৈরিকৃত কৃত্রিম অঙ্গের মাঝে ভাইরাসটি দিব্যি বিস্তার ঘটিয়ে চলছে। বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তোলে টাইরেলকে। তখন তিনি ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে ভাইরাসটি দেখার শেষ একটা চেষ্টা করার চিন্তা করলেন। তিনি সেই নমুনাটি জুনের কাছে পাঠান। তবে এই পর্যবেক্ষণের বিষয়ে তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন না। টাইরেল ২০০২ সালে প্রকাশিত তার নিজের লেখা ‘Cold Wars: The Fight Against the Common Cold’- বইটিতে এই নমুনাটির পরীক্ষার বিষয়ে লেখেন, “আমরা খুব বেশি আশাবাদী ছিলাম না। তবে এই চেষ্টাটুকু অন্তত যৌক্তিক ছিল।
আলমেইডার কাছে পরীক্ষণের জন্য খুব সীমিত উপকরণ ছিল। কিন্তু নিরলস পরিশ্রম এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে তিনি যে ফলাফল বের করলেন তা টাইরেলের প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যায়। তিনি  ভাইরাসটি শনাক্ত এবং তার পরিষ্কার ছবি তোলার পাশাপাশি পূর্বে তার আবিষ্কৃত দুটি ভাইরাসের সাথে এর সাদৃশ্য খুঁজে পান। এর মাঝে একটি ছিল মুরগির বাচ্চার ব্রঙ্কাইটিস রোগের ভাইরাস। অপরটি হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্ত ইঁদুরের যকৃতে প্রদাহ সৃষ্টিকারী ভাইরাস। জুন এই দুটি বিষয়কে ভিত্তি করে একটি রিসার্চ পেপার লিখে ফেলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার সেই গবেষণাপত্রটি গৃহীত হলো না।
পেপার রিভিউ কমিটির লোকেরা সাফ জানিয়ে দিল, এটা নতুন কোনো ভাইরাস নয়। সম্ভবত ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসেরই নিম্ন রেজল্যুশনের ছবি। কিন্তু টাইরেলের নমুনাটি যে নতুন প্রজাতির ভাইরাসের সেই বিষয়ে আলমেইডা শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন।  তিনি তাই দমে না গিয়ে পুনরায় গবেষণা চালাতে লাগলেন। ‘B814’ নমুনাটি নিয়ে তার লেখা গবেষণাপত্রটি ১৯৬৫ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়। এর দুই বছর পরে জার্নাল অব জেনারেল ভাইরোলজিতে নমুনায় উল্লেখিত ভাইরাসটির প্রথম ছবি ছাপা হয়।
১৯৬৭ সালে জার্নাল অব জেনারেল ভাইরোলজিতে প্রকাশিত হিউম্যান করোনাভাইরাসের প্রথম আণুবীক্ষণিক ছবি
একদিন আলমেইডা, ড. টাইরেল এবং আলমেইডারের সুপারভাইজার ও সেন্ট থমাসের পরিচালক প্রফেসর টনি ওয়াটারসন তাদের গবেষণার ফলাফল নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। হঠাৎ তারা খেয়াল করলেন, তাদের আবিষ্কৃত ভাইরাসটির এখনও কোনো নাম দেয়া হয়নি। যে-ই ভাবা সেই কাজ। তারা তিনজন এর নাম প্রদানের কাজে লেগে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত ভাইরাসের ছবি পর্যবেক্ষণ করে এর দেহের চারদিকের বলয় বা মুকুটসদৃশ অংশের জন্য এর নাম রাখা হয় ‘করোনা’। কারণ ল্যাটিন ভাষায় ‘করোনা’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘মুকুট’। এর মাধ্যমে  করোনাভাইরাসের আবিষ্কারক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান জুন আলমেইডা।
শুধু তা-ই নয়, জীবাণুবিদ্যায় অনবদ্য অবদানের জন্য ১৯৬৪ সালে লন্ডনের পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল স্কুল তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট অব সায়েন্স ডিগ্রী প্রদান করে।

করোনা পরবর্তী জীবন

কর্মজীবনের গোধূলিলগ্নে আলমেইডা ওয়েলকাম ইনস্টিটিউটে যোগ দেন। সেখানে কতিপয় ভাইরাস আবিষ্কারের জন্য তিনি পেটেন্টও পেয়েছিলেন। ওয়েলকাম ছাড়ার পর তিনি কিছুদিন ইয়োগা প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু আবিষ্কারের নেশা যার মাঝে রয়েছে তিনি কি আর গবেষণা থেকে দূরে থাকতে পারেন? তাই তিনি আবার কাজে যোগ দিলেন। তবে এবার আর গবেষক নয়, সেন্ট থমাসের ভাইরোলজি বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে। আশির দশকের শেষভাগে জীবাণুবিদেরা তার সহায়তায় এইডস রোগের জন্য দায়ী এইচআইভি ভাইরাসের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ছবি প্রকাশে সক্ষম হয়।
বিরল প্রতিভার অধিকারী স্বশিক্ষিত এই নারী ২০০৭ সালের ১ ডিসেম্বর ৭৭ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের বেক্সহিলে মৃত্যুবরণ করেন। আলমেইডার বর্ণিল কর্মজীবনের প্রশংসা করে তার শিক্ষানবিশ ইউনিভার্সিটি অব এবারডিনের ব্যাক্টেরিওলোজি বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক হিউ পেনিংটন বলেন, “নিঃসন্দেহে তিনি তার সময়ের অন্যতম সেরা একজন স্কটিশ বিজ্ঞানী ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি আজ বিস্মৃতপ্রায়।” দ্য হেরাল্ড পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি আরও বলেন, “ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলেও কোভিড-১৯ এর মহামারী তাণ্ডবের ফলশ্রুতিতে তার কাজের গুরুত্ব পুনরায় প্রতীয়মান হয়েছে।
তার কথাটা নিতান্তই অমূলক নয়। ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল  বিবিসি স্কটল্যান্ড নিউজে জুন আলমেইডাকে নিয়ে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। সেখানে তাকে করোনাভাইরাসের আবিষ্কারক হিসেবে পূর্ণ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর ১৩ বছর পরে হলেও তিনি তার প্রাপ্য সম্মানটা পেয়েছেন। গবেষক হতে হলে ভারি ডিগ্রী নয়, প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন- এরই এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ ছিলেন জুন আলমেইডা। তিনি নিজে কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি। কিন্তু তার আবিষ্কৃত পন্থা অবলম্বন করে আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা গবেষণার মাধ্যমে তাদের স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করছে। ভাইরোলজিস্টরা এখনও কোনো ভাইরাসকে দ্রুততার সাথে সঠিকভাবে শনাক্তের জন্য তার দেখানো পদ্ধতি ব্যবহার করেন। একজন স্বশিক্ষিত গবেষকের জন্য এটিও একটি দুর্লভ অর্জন।

জেগে উঠছে বরফের নিচে থাকা ঘুমন্ত জীবাণু

মানব ইতিহাসের সেই আদিকাল থেকেই মানুষ ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের সাথে পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। বুবনিক প্লেগ থেকে শুরু করে গুটিবসন্ত প্রতিরোধে আমরা সক্ষম হয়েছি, পক্ষান্তরে পালটা ব্যবস্থা হিসেবে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াও নিত্যনতুন উপায় বের করে ফেলেছে আমাদেরকে নতুন উপায়ে সংক্রমণ করার জন্য।

আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর থেকে প্রায় শতবর্ষ হতে চলল আমাদের এন্টিবায়োটিক ওষুধ আছে। জবাবে ব্যাকটেরিয়া বিবর্তিত হয়েছে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধে। এই যুদ্ধের কোন শেষ নাই কারণ, আমরা রোগজীবাণুর গবেষণায় এত সময় ব্যয় করেছি যে মাঝে মাঝে সৃষ্টি করে ফেলি প্রাকৃতিক অচলাবস্থা।
কী হবে যদি আমরা হঠাৎ করেই হাজার হাজার বছরের পুরনো মরণঘাতী ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে চলে আসি অথবা এমন জীবাণুর সংক্রমণ হল যার সাথে আগে কোনদিন পরিচিত ছিলাম না? সম্ভবত আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত জীবাণু খুঁজে পেয়ে গেছি। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে হাজার বছরের হিমশীতল পার্মাফ্রস্ট ( বরফের স্তরে থাকা চির জমাট মাটি ) গলে যাচ্ছে এবং পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার ফলে বরফ মাটির নিচে এতদিনের সুপ্ত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস মুক্ত হয়ে সজীব হয়ে উঠছে।
Reindeer (Rangifer tarandus) migrating (Credit: Eric Baccega/naturepl.com)
মেরু অঞ্চলে সাইবেরিয়ার বরফাচ্ছন্ন ইয়ামাল পেনিনসুলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ২০১৬ সালের আগস্টে ১২ বছরের একটা ছেলে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং কমপক্ষে আরও ২০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ধারণা করা হয়, ৭৫ বছর আগে এখানে একটা বলগাহরিণ অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল এবং হরিণের মৃতদেহটি পার্মাফ্রস্টের স্তরে জমে অ্যানথ্রাক্সের ফাঁদে পরিণত হয়। ২০১৬ সালের গ্রীষ্মের গরমে পার্মাফ্রস্ট গলতে শুরু করার আগ পর্যন্ত হরিণের মৃতদেহটি সেখানেই ছিল। বরফ গলে যাওয়ার ফলে সেখান থেকে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের পানি, মাটি এমনকি দৈনন্দিন খাদ্য শৃঙ্খলে। ঐ এলাকায় ঘাস খেতে আসা ২০০০ হরিণ অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হয় এবং অল্পমাত্রায় মানুষের মাঝেও সংক্রমিত হয়েছিল। ভয় হয়, এরকম সংক্রমণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
Permafrost in Svalbard (Credit: Wild Wonders of Europe/de la L/naturepl.com)
পৃথিবী যত উষ্ণ হবে পার্মাফ্রস্টের বরফ তত দ্রুত গলতে শুরু করবে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রতি বছর গ্রীষ্মে প্রায় ৫০ সেমি বরফের উপরের স্তর গলে যায়। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে লাগামহীন গতিতে, ফলে বরফের অনেক পুরনো স্তর উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে। পার্মাফ্রস্টের অনাদিকালের জমাট বরফে কটেরিয়ার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে, এমনকি লক্ষ লক্ষ বছর পরেও তাদেরকে পাওয়া যায় অবিকৃত অবস্থায়। সার্বিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে বরফ গলে যাওয়া মানে হল সম্ভাব্য রোগজীবাণুর প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাওয়া। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রায় তিনগুণ দ্রুত হারে বাড়ছে। যেহেতু বরফের স্তূপ, হিমায়িত মাটি দ্রুত গলে যাচ্ছে সুতরাং এখানে আটকে থাকা সংক্রামক জীবাণু মুক্ত হয়ে যেতে পারে।
ফ্রান্সের আইএক্স মার্সেই ইউনিভার্সিটির বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী জ্য মিশেল ক্লাভেরি বলেন, “পার্মাফ্রস্ট আণুবীক্ষণিক অণুজীব এবং ভাইরাসের অভয়ারণ্য। এখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, এখানে নেই কোন অক্সিজেন এবং এখানে রাজত্ব করে চির অন্ধকার। মানুষ বা যেকোনো প্রাণীকে সংক্রমণ করতে পারে এমন ভয়াবহ সংক্রামক রোগের জীবাণু সম্ভবত পার্মাফ্রস্টের স্তরে স্তরে জমে আছে এবং তারা অতীতে বৈশ্বিক মহামারীর জন্ম দিয়েছিল।
শুধু সাইবেরিয়াতেই ২০ শতকের শুরুর দিকে দশ লক্ষাধিক বলগাহরিণ মারা যায় অ্যান্থ্রাক্স আক্রান্ত হয়ে। এত মৃতদেহকে অনেক গভীর মাটির নিচে কবর দেয়া সম্ভব ছিল না। বাধ্য হয়েই তাদেরকে কবর দিতে হয়েছিল মাটির উপরিভাগে। রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলে মৃত হরিণের এরকম ৭০০০ গণকবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অজানা আশঙ্কার ব্যাপার হল, বরফ মাটির আস্তরণ ভেদ করে হরিণের মৃতদেহ থেকে এখন অ্যান্থ্রাক্স বাইরে আসার জন্য ওঁত পেতে আছে।
Anthrax spores can survive for decades (Credit: Cultura RM/Alamy)
মৃত মানুষ এবং প্রাণীদের শত শত বছর ধরে পার্মাফ্রস্টে কবর দিয়েছে। সুতরাং এটা সহজেই অনুমেয় যে, সংক্রামক জীবাণু বেরিয়ে আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আলাস্কার বরফাচ্ছন্ন গণকবর থেকে ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু আক্রান্ত হয়ে মরে যাওয়া শরীর থেকে স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসের আরএনএ আবিষ্কার করছেন। গুটিবসন্ত এবং বুবনিক প্লেগে মৃতদেরও কবর দেয়া হয়েছিল সাইবেরিয়াতে। ২০১১ সালের এক গবেষণায় বরিস রেভিচ এবং মারিনা পোডোলনায়া লিখেছেন, “পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার কারণে ১৮ এবং ১৯ শতকের সংক্রমণে মৃতদের লাশ থেকে সংক্রামক রোগ ফিরে আসতে পারে, বিশেষ করে যেখানে তাদের কবর দেয়া হয়েছিল।”
২০০৫ সালে নাসার এক গবেষণায় একদল বিজ্ঞানী আলাস্কার একটা জমে যাওয়া পুকুর থেকে ৩২,০০০ বছরের পুরনো ব্যাকটেরিয়া পুনর্জীবিত করেছেন। ১৮৯০ সালের দিকে সাইবেরিয়াতে গুটিবসন্ত মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। একটা শহরের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ গুটিবসন্তে মারা যায়। এত মৃতদেহকে কলিমা নদীর তীরে বরফ মাটির সামান্য নিচের স্তরে গণকবর দেয়া হয়। ১২০ বছর পরে বন্যার পানিতে কলিমা নদীর তীর ভাঙতে শুরু করে এবং পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার কারণে নদী ভাঙনের গতি আরও তীব্রতা পায়। আলাস্কায় প্রাপ্ত ‘কারনোব্যাকটেরিয়াম প্লাইস্টোসেনিয়াম’ অণুজীবটি পার্মাফ্রস্টে জমেছিল সেই প্লাইস্টোসিন যুগ থেকে যখন পৃথিবীতে দুর্দান্ত প্রতাপে ঘুরে বেড়াতো পশমে আবৃত বিশালাকার হাতি। এরপর বরফ গলা শুরু হতেই অণুজীব মুক্ত হয়ে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং তারা এখনো পূর্বের মতই অবিকৃত আছে। অণুজীব মুক্ত হয়েই দ্রুত সংক্রামক হয়ে যায়।
১৯৯০ সালে রাশিয়ার নোভোসিবির্স্ক শহরের স্টেট রিসার্স সেন্টার ফর ভাইরোলজি এবং ব্যাকটেরিওলজি’র গবেষকরা সাইবেরিয়ার গোর্নি আলতাই অঞ্চলে প্রাপ্ত পাথর যুগের মানুষের ফসিল পরীক্ষা শুরু করেন। পাশাপাশি তারা রাশিয়ার পার্মাফ্রস্টে কবর দেয়া ১৯ শতকে গুটিবসন্ত মহামারীতে মৃতদের লাশের নমুনা পরীক্ষা শুরু করেন। গবেষকরা বলছেন, মৃতদেহে তারা গুটিবসন্তের ফলে ক্ষতের দাগ দেখতে পেয়েছেন। যদিও তারা গুটিবসন্তের ভাইরাস খুঁজে পাননি, কিন্তু তারা গুটিবসন্তের ডিএনএ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। বরফের স্তরে হিমায়িত ব্যাকটেরিয়ার জীবন ফিরে পাওয়া নিশ্চিতভাবে বলা যায় এটাই প্রথমবার নয়।
Bacteria have been found dormant in Antarctic ice (Credit: Colin Harris/Era Images/Alamy)
দুই বছর বাদে বিজ্ঞানীরা এন্টার্কটিকার বিকন এবং মুলিন পাহাড়ি উপত্যকার একটা হিমবাহর নিচে বরফের স্তর থেকে ৮ মিলিয়ন বছরের পুরনো ব্যাকটেরিয়া পুনর্জীবিত করেন। একই অনুসন্ধানে বরফ থেকে ১ লাখ বছরের পুরনো ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পাওয়া যায়। তবে আশার কথা হচ্ছে সব ব্যাকটেরিয়া কিন্তু পার্মাফ্রস্টে জমে থাকার পরে ফিরে আসতে পারে না। কিন্তু অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়া ফিরে আসতে পারে, কারণ অ্যানথ্রাক্স নিজের সুরক্ষার জন্য একধরণের খোলস তৈরি করে, যা খুব শক্ত এবং জমাট অবস্থায় শত শত বছর বেঁচে থাকতে পারে। কিছু ব্যাকটেরিয়া নিজের শক্ত আবরণ তৈরি করতে পারে এবং বরফের মধ্যে দীর্ঘদিন নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে পারে যেমন টিটেনাস, ক্লোস্ট্রিডিয়াম বোটুলিনাম। বোটুলিনামের কারণে বোটুলিজম নামে বিরল এক ধরণের রোগ হয় যার ফলে মানুষ পঙ্গু হতে পারে এমনকি মৃত্যুও অস্বাভাবিক নয়। কিছু ছত্রাকও দীর্ঘদিন পার্মাফ্রস্টে জীবিত থাকতে পারে। কিছু ভাইরাস তো প্রায় অমরত্ব প্রাপ্ত।
Mimivirus, an example of a giant virus (Credit: Science Photo Library/Alamy)
২০১৪ সালে মিশেল ক্লাভেরির নেতৃত্বে একদল গবেষক সাইবেরিয়ার পার্মাফ্রস্টে জমাট ৩০,০০০ বছর আগের ‘পিথোভাইরাস সাইবেরিকাম’ এবং ‘মলিভাইরাস সাইবেরিকাম’ নামে দুইটা ভাইরাস চিহ্নিত করেন। এই দুইটি ভাইরাসই অন্য ভাইরাসের তুলনায় বড় যা প্রচলিত মাইক্রোস্কোপ দিয়েই দেখা সম্ভব। তুন্দ্রাঞ্চলের অববাহিকার ১০০ ফুট গভীরে ভাইরাস দুটিকে পাওয়া যায়। ভাইরাস পুনর্জীবিত হওয়ার সাথে সাথেই সংক্রামক হয়ে ওঠে। আমাদের জন্য আশার কথা হলো, এই ভাইরাসগুলো শুধু এককোষী অ্যামিবাকে সংক্রামিত করে। তবে গবেষণা বলছে, অন্যান্য ভাইরাস যেগুলো মানুষকে সংক্রামিত করতে পারে সেগুলো ঠিক একই প্রক্রিয়ায় জেগে উঠবে। বড় আকারের ভাইরাসগুলো অধিক ভয়ানক এবং তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করা প্রায় অসম্ভব।
বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়া একমাত্র হুমকি নয়। আর্কটিক সাগরের জমাট বরফ গলছে অনেক বছর ধরে, ফলে সাইবেরিয়ার উত্তর সমুদ্রতটের সাথে সাগরের সংযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। তদুপরি এই এলাকায় নতুন করে শুরু হয়েছে শিল্প বিপ্লব, কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি মিশে যাচ্ছে সমুদ্রে, ক্রমশ লাভজনক হয়ে উঠছে সোনা এবং অন্যান্য খনিজ আকরিক সংগ্রহ, তেল ও গ্যাস কূপ খনন। মিশেল ক্লাভেরি বলেন, এই মুহূর্তে এই অঞ্চলের প্রতিবেশ বিপন্ন হচ্ছে এবং পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার ফলে আশংকায় হচ্ছে সমূহ দুর্যোগ অতি সন্নিকটে। যাইহোক, খনিজ উত্তোলন এবং তেলের কূপ খনন করলে প্রাচীন বরফের স্তর আরও দ্রুত গলে যেতে পারে। যদি কোন সংক্রামক ভাইরাস সেখানে থেকে থাকে তাহলে তারা উন্মুক্ত হয়ে যাবে এবং ডেকে আনবে ভয়ানক বিপর্যয়। অপেক্ষাকৃত বড় ভাইরাসগুলোই সংক্রমণ মহামারির জন্য প্রধানত দায়ী।
Neanderthals once lived in Siberia (Credit: The Natural History Museum/Alamy
ক্লাভেরি বলেন, আর্কটিক অঞ্চলে মানুষের মাঝে সংক্রামিত প্রাচীন ভাইরাস আবার ফিরে আসতে পারে। বহু পূর্বে নিয়ান্ডারথাল বা ডেনিসোভানের মত মানুষের অন্য প্রজাতি সাইবেরিয়াতে ভাইরাস এবং অন্যান্য জরা ব্যাধিতে ভুগেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বেঁচে থাকা অবশিষ্ট নিয়ান্ডারথাল মানুষদের দেখা মেলে ৩০ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে রাশিয়াতে। সেই প্রজাতির মানুষ রাশিয়াতে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে বসবাস করছিল, সেখানেই তারা অসুস্থ হয় এবং হাজার বছর ধরে মরতে মরতে নিঃশেষ হয়ে যায়। এদিকে নাসার বিজ্ঞানীরা মেক্সিকোর একটা খনির স্ফটিক থেকে ৫০ হাজার বছর আগের অণুজীবের সন্ধান পেয়েছেন। মেক্সিকোর উত্তরে নাইকা খনির একটা গুহার মধ্যে কিছু ধবধবে সাদা স্ফটিকের মধ্যে এই অণুজীব মিলেছে যেগুলো সৃষ্টি হয়েছিল লক্ষ লক্ষ বছর আগে। হাজার হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়ান্ডারথাল মানুষের সংক্রামিত ভাইরাস আমাদেরকেও আক্রমণ করতে পারে। এথেকে আভাস পাওয়া যায় ভাইরাস পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এমন ধারণা করা ভুল এবং ছদ্ম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যাওয়া আরেকটা ভুল। ক্লাভেরি বলেন, সুতরাং এই কারণেই সব সময় ভ্যাকসিনের মজুদ ধরে রাখতে হবে, বলাতো যায় না কখন কাজে লাগে। যে কোনভাবেই হোক না কেন, ব্যাকটেরিয়া বর্তমানে প্রায় ১৮ ধরণের এন্টিবায়োটিক-রোধী হয়ে গেছে। অথচ এই ওষুধগুলো সংক্রমণ থেকে মুক্তির শেষ আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০১২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে গবেষকরা বলছেন, তারা Paenibacillus sp. LC231 ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছেন যারা ৭০ শতাংশ এন্টিবায়োটিক বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম এবং কিছু ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক কোন কাজেই লাগবে না।
মানুষের মাঝে সংক্রমণ ঘটাতে পারে এমন ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার জেনেটিক বৈশিষ্ট্য খুঁজতে ২০১৪ সাল থেকে ক্লাভেরি পার্মাফ্রস্টের স্তরে জমে থাকা জৈব-কণার ডিএনএ বিশ্লেষণ করছেন। তিনি মানুষের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর কয়েকটি ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছেন। ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ’তে নকশা করা আছে তার ক্ষতিকর দিক। ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের মত রোগজীবাণু থেকে উৎপাদিত জৈব-কণা পোষকের শরীরে রোগজীবাণু সংক্রমণ করে, ফলে পোষক রোগে সংক্রামিত হয়।
ক্লাভেরির গবেষক দল কয়েকটি ভাইরাসের ডিএনএ পরম্পরা (সিকুয়েন্স) খুঁজে পেয়েছেন; এর মধ্যে কিছু মানুষের শরীরে চর্মরোগের জন্য দায়ী। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলে গুটিবসন্তের ভাইরাসের সন্ধান পাননি। সঙ্গত কারণেই গবেষকরা রোগজীবাণু পুনর্জীবিত করতে পদক্ষেপ নেননি। তবে গবেষকরা বলছেন, মানুষের সাথে আপাতত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন রোগজীবাণু বরফ বা পার্মাফ্রস্ট ছাড়াও যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে।
The crystals in the Naica cave (Credit: SOTK2011/Alamy)
স্ফটিকের মধ্যে একধরণের তরল থলিতে ব্যাকটেরিয়ার জীবাণু আটকে থাকে কিন্তু যদি কোনভাবে তারা বাইরে আসতে পারে তবে তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং নিজেই নিজের বংশবৃদ্ধি শুরু করে। প্রতিটি রোগজীবাণুই বংশগতির ক্রমধারায় স্বতন্ত্র এবং বিবর্তন প্রক্রিয়ায় নতুন শ্রেণির জন্ম দেয়। গবেষকরা আরও পুরনো ব্যাকটেরিয়ার খোঁজ পেয়েছেন নিউ মেক্সিকোর লেচুগুইলা গুহার ভিতরে ১০০০ ফুট মাটির নিচে। পৃথিবীতে এই অণুজীবের দেখা মিলেছিল সর্বশেষ ৪ মিলিয়ন বছর আগে। তবে গবেষকরা তাদের গবেষণাপত্র এখনো প্রকাশ করেন নি।
Selenite formations in Lechuguilla Cave (Credit: Paul D. Stewart/naturepl.com)
গুহার মধ্যে কখনো সূর্যালোক প্রবেশ করেনি। এতটাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন যে ভূপৃষ্ঠ হতে গুহার মধ্যে পানি পৌছাতে সময় লেগেছিল ১০ হাজার বছর। ব্যাকটেরিয়া মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে থেকেই নিজেদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছিল। ব্যাকটেরিয়া সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় গুহার অন্ধকারে প্রায় ৪ মিলিয়ন বছর আটকে ছিল, তাদের সাথে মানুষের কোন সংস্পর্শ হয়নি কিন্তু যেহেতু মানুষের সংক্রমণ চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয় সেহেতু নতুন ব্যাকটেরিয়া একসময়ে এন্টিবায়োটিকরোধী হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, যে ব্যাকটেরিয়া মানুষের ক্ষতি করে না সেগুলোও প্রাকৃতিকভাবে এন্টিবায়োটিকরোধী হয়। একারণেই অনুমান করা হচ্ছে কিছু ব্যাকটেরিয়া মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে থেকেই এন্টিবায়োটিকরোধী।
Permafrost on the Tibetan plateau (Credit: Gertrud & Helmut Denzau/naturepl.com)
এরকম প্রাচীন এন্টিবায়োটিকরোধী ব্যাকটেরিয়া ক্লিনিক থেকে বিবর্তিত হয় না। ঠিক একই কারণে বিভিন্ন প্রকার ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া অন্যান্য অণুজীবের সাথে টিকে থাকার যুদ্ধে অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য নিজেরাই প্রাকৃতিক উপায়ে নিজেদের এন্টিবডি সৃষ্টি করে। একই প্রক্রিয়ায় অ্যালেক্সান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। গবেষণা পাত্রে ব্যাকটেরিয়া মারা যাওয়ার পর অন্য একটা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হয়।
অন্ধ বন্ধ গুহার মধ্যে যেখানে আলো বাতাস নাই, খাদ্য নাই সেখানে অণুজীবদের টিকে থাকতে হলে অবশ্যই যুদ্ধ করতে হয়। পেনিব্যাসিলাসের মত ব্যাকটেরিয়াকে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী অণুজীবের সাথে যুদ্ধ করে মৃত্যু এড়াতে চাইলে তাকে অবশ্যই এন্টিবায়োটিকরোধী হয়ে যেতে হয়। ফলে আমরা বুঝতে পারি কেন কিছু ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিকভাবেই অন্য ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক ব্যাবহার করে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
এইসব ব্যাকটেরিয়া থেকেই আমাদের ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক ওষুধের প্রায় ৯৯.৯৯ শতাংশ তৈরি হয়। ব্যাকটেরিয়া কখনো মানুষের বানানো এন্টিবায়োটিক অতিক্রম করতে পারে না যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও স্টেটের আক্রোন ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক হ্যাজেল বার্টনের নেতৃত্বে অণুজীব নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। হ্যাজেল বার্টন বলেন, “আমাদের এবং অন্যান্য গবেষকদের গবেষণা থেকে বোঝা যায় ব্যাকটেরিয়ার ক্রমশ এন্টিবায়োটিকরোধী হয়ে যাওয়া মোটেও ভাল লক্ষণ নয়। আমাদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত অণুজীব ভূপৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্ন গুহার মধ্যে নির্বাসিত ছিল ৪ থেকে ৭ মিলিয়ন বছর। তাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভূপৃষ্ঠে প্রাপ্ত অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় জেনেটিক্যালি আলাদা করা সম্ভব। এই গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়, ব্যাকটেরিয়ার এই জিন ৪ থেকে ৭ মিলিয়ন বছরের পুরনো এবং মানুষের এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে তাদের এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম হয় নি”। যদিও পেনিব্যাসিলাস নিজেরা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, কিন্তু এরা নিজেদের প্রতিরক্ষা কৌশল অন্য রোগজীবাণুদের মাঝে সঞ্চারিত করতে পারে। তবে যেহেতু তারা মিলিয়ন বছর পাথরের মধ্যে ছিল সুতরাং তারা অন্যদের মাঝে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা সঞ্চার করে দেবে সেটাও অসম্ভব মনে হয়।
তদুপরি, প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যাকটেরিয়ার জন্য এত প্রয়োজনীয় যে পার্মাফ্রস্ট গলে যাওয়ার ফলে যে ব্যাকটেরিয়া বেরিয়েছে তাঁদের শরীরে হয়ত আগে থেকেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। এছাড়াও, ২০১১ সালে বিজ্ঞানীরা রাশিয়া এবং কানাডার মধ্যের চির তুষারাচ্ছন্ন বেরিনজিয়ান এলাকা থেকে প্রাপ্ত ৩০ হাজার বছরের পুরনো পার্মাফ্রস্টের ব্যাকটেরিয়া থেকে ডিএনএ আলাদা করেছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, এই ব্যাকটেরিয়ার জিনে বেটা-ল্যাকটাম, টেট্রাসাইক্লিন, গ্লাইকোপেপ্টাইডের মত এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে।
Permafrost tundra in Siberia (Credit: Staffan Widstrand/naturepl.com)
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এইসব রোগজীবাণু নিয়ে আমাদের কতটা সচেতন থাকতে হবে? এই বিষয়ে বিস্তর যুক্তিতর্ক, মতভেদ আছে। একপক্ষ যুক্তি দিচ্ছেন, পার্মাফ্রস্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়া জীবাণু কী ধরণের ঝুঁকি বয়ে আনবে তা এখনি নিশ্চিত করে বলা যায় না, তাই তাদের বিষয়ে সচেতনতা সম্পর্কেও কিছু বলা যাচ্ছে না। বরং আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিৎ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব হুমকি সেগুলো মোকাবেলায় সচেষ্ট হওয়া। যেমন, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে দক্ষিণ গোলার্ধের ম্যালেরিয়া, কলেরা, ডেঙ্গুর মত ব্যাধি মহামারী উত্তর গোলার্ধেও ছড়িয়ে পড়বে, সেজন্য আশু সম্ভাব্য বিপদের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
অন্যপক্ষ বলছেন, আমরা যেহেতু আসন্ন জীবাণুদের সম্পর্কে কিছুই জানি না তাই ঝুঁকি অবহেলা করা যাবে না। ক্লাভেরি বলেন, “আমাদের তো বটেই অন্য যে কারো গবেষণাতেই দেখা যাচ্ছে জীবাণুর ফিরে আসার সম্ভাবনা, তার পুনর্জীবিত হতে পারে, আমাদেরকে সংক্রামিত করতে পারে”। কীভাবে তারা আসবে জানা নেই কিন্তু তাদের আসার সম্ভাবনা আছে। হতে পারে অনাগত ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ এন্টিবায়োটিক ওষুধেই নিরাময় হয়ে যাচ্ছে, অথবা অন্য কোন ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে হয়ত এন্টিবায়োটিক কাজ করে না। ফিরে আসতে পারে ভাইরাস। কী অদ্ভুত ব্যাপার, রোগজীবাণু দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকলে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকে না। মানে শত্রু নাই তো যুদ্ধের প্রস্তুতি নাই। কিন্তু রোগজীবাণু যদি হঠাৎ করে চলে আসে (যেমন করোনা আসছে) তখন কিন্তু মানুষের শরীর অতর্কিত আক্রমণ সহ্য করতে পারবে না (যেমন এখন করোনার সংক্রমণ সহ্য করতে পারছে না)।

পৃথিবীও পুষিয়ে নিতে জানে

লিখেছেন: ঘুণপোকা

এক অভূতপূর্ব সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। লাখ লাখ মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, প্রাণ যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। শুধু মহামারী আর মৃত্যুই নয়, প্রকৃতির কাছে এমন সর্বব্যাপী চপেটাঘাতের ঘটনাও মানুষের ইতিহাসে বিরল। অর্থনীতির ইতিহাসেও সবচেয়ে বড় মন্দার মুখে পড়েছে মানুষ। সেই মন্দায় কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা কল্পনা করা কঠিন, তবে সেটা যে পৃথিবীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেবে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
মানুষের এই পরিণতি কি অবধারিত ছিল? গত কয়েক শতকে মানুষ পৃথিবীর উপর কতৃত্ব ফলাতে গিয়ে মাটি-পানি-বাতাসকে বিপন্ন করেছে। পরিবেশের কথা না ভেবে উন্মাদের মত অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে, জিডিপির দিকে ছুটেছে। একটা গবেষণা বলছে, প্রতি ১০ লাখ ডলারের জিডিপির জন্য মানুষ বাতাসে ছাড়ে ৫০০ টন সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরোকার্বন) গ্যাস। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপির জন্য মানুষ পৃথিবীর বাতাসে ছেড়েছে প্রায় ৪০ বিলিয়ন টন সিএফসি গ্যাস। কোটি কোটি বছর ধরে গড়ে উঠা ওজোন স্তর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়েছে মাত্র কয়েক শতকে। মানুষের বিলাসী খাবার, চিকিৎসা আর বিনোদনের লালসার বলি হয়েছে লাখ লাখ পাখি আর বন্যপ্রাণী। বহু বন্যপ্রাণী চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে। বিপন্ন হয়েছে খাদ্যশৃঙ্খল, নষ্ট হয়েছে বাস্তুসংস্থান।
কিন্তু করোনা নামে এক ভাইরাসের টিকে থাকার লড়াইয়ের রেশ ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। পৃথিবীর উপর, প্রকৃতির উপর মানুষের দখল তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ছে। তথাকথিত ‘উন্নত’ প্রযুক্তি এবং ‘উন্নত’ সভ্যতার মেকি ক্ষমতার মুখোশ খুলে পড়ছে। করোনা কান ধরে বন্ধ করিয়েছে কলকারখানা, গাড়ির চাকা, জাহাজের ইঞ্জিন, থমকে দিয়েছে পার ক্যাপিটা-জিডিপি আর সর্বস্ব দখলের অর্থনীতি। জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো কমিয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে ‘গর্তে’ ঢুকছে পৃথিবীর ‘শ্রেষ্ঠ’ জীব।
নাসার সম্প্রতি বেশ কিছু স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে কীভাবে সারা বিশ্বের শহরগুলিতে দ্রুত দূষণের পরিমাণ কমছে। সবচেয়ে বেশি কার্বন উৎপাদনকারী ও করোনার উৎপত্তিস্থল চীনের শহরগুলোতে ব্যাপকভাবে বায়ু দূষণ হ্রাস পেয়েছে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি কোপার্নিকাস সেন্টিনেল স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছে করোনার প্রভাবে ইতালি ও চীনের আকাশে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমেছে ৪০-৬০
শতাংশ।
ফিনল্যান্ডের সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এন্ড ক্লিন এয়ার (CREA) বলছে, ১ মার্চ পর্যন্ত চীনে কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমন এক চতুর্থাংশ বা ২০ কোটি টন কমে গেছে, যা ব্রিটেনে এক বছরে নির্গমন হওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইডের অর্ধেক। তারা আরও জানিয়েছে, ২২ মার্চ টানা ১৪ ঘণ্টার কারফিউর ফলে ভারতের বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ বসন্তকালে ইতিহাসের সর্বনিম্ম পর্যায়ে নেমে গেছে। রেকর্ড না ভাঙলেও অন্যান্য বিষাক্ত কণার পরিমাণও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
কার্বন-সালফার মুক্ত পৃথিবী যেন বহু শতাব্দী পর একটু নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়েছে। কমছে পানি-মাটি-বায়ু-শব্দ দূষণ। ‘সভ্য’ মানুষের কাছ থেকে পৃথিবীর দখল কেড়ে নিয়ে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে পাখি, সমুদ্রের প্রাণী, বনের প্রাণী ও গাছেদের দখল। অতিষ্ঠ খাল-নদী, বনানী, আকাশ কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছে। একটু একটু করে ধরণী তার অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।
বহুদিন পরে মানুষশূন্য কক্সবাজার সৈকতে ফিরেছে ডলফিনরা। ব্যস্ত মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভের দখল নিয়েছে পায়রারা। ইতালির ভেনিসের বিখ্যাত খালগুলিতে স্বচ্ছ জলের দেখা মিলেছে। সেখানে ফিরে এসেছে ডলফিন ও নানা প্রজাতির মাছেরা। ইউরোপজুড়ে ফিরে আসছে হাজার হাজার পাখি। পরিবেশবিদরা বলছেন মানুষের এই অভূতপূর্ব ‘বন্দিদশায়’ পৃথিবীর উষ্ণায়নে কিছুটা হলেও বাধা পড়বে। অন্তত ছয় মাস এভাবে চলতে থাকলে উত্তর-দক্ষিণ মেরুর গলে যাওয়া বরফ আবার জমতে শুরু করবে। পৃথিবী আবার শান্ত হয়ে আসবে। আপাতঃস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে স্থলচর-জলচর প্রাণীরা। হ্যাঁ, এটা অসম লড়াই নিশ্চয়ই। শীঘ্রই টিকা বা রোগ প্রতিরোধ শক্তিতে করোনাকে ‘জয়’ করবে মানুষ। এই লড়াইয়েরও শেষ হবে। মানুষের জীবন ‘স্বাভাবিক’ হবে। আবার জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়বে, কল-কারখানার বর্জ্য-ধোঁয়ায় পানি-বাতাস বিষাক্ত হবে, কার্বনে ছেয়ে যাবে আকাশ। তবে
মানুষ কি এই ধাক্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীর প্রতি কিছুটা হলেও সংযমী হবে? নাকি ‘ক্ষতি’ পুষিয়ে নিতে দ্বিগুণ উদ্যমে নতুন ধংসে মাতবে?
সুত্রঃ
১। https://www.newsweek.com/coronavirus-major-impact-environment-co2-air-quality-anim
als-1493812
২। India’s Coronavirus Curfew Resulted in the Lowest One-Day Traffic Pollution Levels
on Record.
৩। Airborne Nitrogen Dioxide Plummets Over China.
৪। কক্সবাজার সৈকতে ডলফিন খেলা করছে।
৫। জনতা কারফিউতে রাজপথে নিজেদের অধিকার ফলাল পক্ষিবাহিনী।

তাবিজ-মাদুলী গোমূত্র-গোবর নয়- আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানই করোনাকে চুড়ান্তভাবে পরাস্ত করবে ।

ষোড়শ শতকেও প্রায় সকল মানুষ বিশ্বাস করত-মানুষের রোগ-শোকের কারণ কোন পাপের ফল বা অশুভ শক্তি। ঈশ্বর বা দেবতা মানুষের কোন পাপে রুষ্ট হয়ে মানুষকে রোগ-মহামারির মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করে।
ফলশ্রুতিতে রোগাক্রান্ত্র মানুষ কেবল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা এবং ধর্মীয় মোল্লা-পুরোহিত-তান্ত্রিকদের নিকট ধর্ণা দিয়ে দোয়া-তাবিজ-মাদুলীর মাধ্যম রোগমুক্তির কামনা করত।
ষোড়শ শতকে সুইজারল্যাণ্ডের বেসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও ভেষজ বিদ্যার অধ্যাপক ডাক্তার ফিলিপ্রাস অ্যাওরেওলাস প্যারাসেলসেস ঘোষণা করলেন-মানুষের অসুস্থতার কারণ কোন পাপের ফল বা অশুভ শক্তি নয়-রোগের কারণ জীবাণু। পরজীবী এ জীবাণুকে শেষ করতে পারলেই মানুষ আরোগ্য লাভ করবে।
প্যারাসেলসেস এর ঘোষণা শুনেই প্রত্যেক ধর্মের মানুষ রে রে করে তেড়ে আসল। তাদের এতদিনের লালিত ধর্ম বিশ্বাসের বিপরীত এ কথা তারা মানতেই চাইল না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মবেত্তারা যা বলে এসেছেন বা তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্তে যা লেখা আছে-তা কখনো ভুল হতে পারে না।
ধর্মবিরোধী এমন উক্তি করার জন্য প্যারাসেলসেসকে বিচারের মুখোমুখী হতে হল এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হল। সুইজারল্যান্ড থেকে পালিয়ে তিনি জীবন রক্ষা করেন।
আজ কেবল সুইজাল্যাণ্ডবাসী নহে, সারা বিশ্বের মানুষ জানে-যে কোন রোগের মূল কারণ বিশেষ ধরণের জীবাণু বা ভাইরাস। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মানুষ বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক আবিস্কার করে মানুষের জীবনকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে।
মানবজাতি শতাব্দী কাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানিক বা বৈশ্বিক মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে নিতান্ত অসহায়ের মত জীবন দিয়েছে। সে সব ঘটনা ইতিহাস থেকে আমরা জানি।
কিভাবে প্লাগ নামক মহামারী, স্পেনীস ফ্লু, বিশ্ব ব্যাপী কোটি কোটি মানুষের প্রাণ সংহার করছে। আমাদের বাল্যকালে কলেরা, গুটি বসন্ত ইত্যাদি রোগে আমাদের দেশে অগুণিত মানুষকে আমরা মরতে দেখেছি। সে মৃত্যুর মিছিলে আমাদের অনেকের অনেক স্বজনও শরীক হয়েছে।
মহামারী কলেরা প্রতিরোধ করতে-আমার এখনো মনে পড়ে-আমরা দল বেধে একজন হুজুরকে সাথে নিয়ে-বাঁশের কঞ্চিতে আরবীতে দোয়া-লেখা কিছু পতাকা নিয়ে-সমস্বরে বিভিন্ন দোয়া পড়তে পড়তে- হুজুরে ফুঁক দেওয়া মাসকলাই ছিটাতে ছিটাতে সারা গ্রাম প্রদক্ষিণ করতাম-আমাদের সাথে একটি কাল রঙের ছাগলও থাকত এবং কিছুদূর পর পর হুজুর আজান দিতেন, আমরা সেখানে পতাকা লাগানো একটি বাঁশের কঞ্চি পুতে দিতাম। সারা গ্রাম চক্রাকারে প্রদক্ষিণ শেষ করে আমাদের সাথে থাকা ছাগলটি জবাই করে সোল্লাসে খেয়ে ফেলতাম-আর এক প্রকার স্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরতাম-যাক বাবা, পাড়া বন্ধ করে এসেছি-আর এ মহামারি আমাদের গ্রামে প্রবেশ করতে পারবে না।
এভাবে পাড়া বন্ধ করার পর আমরা তরুণেরা মুরুব্বিদের নির্দেশে পাড়ার বিভিন্ন প্রবেশ মুখে পাহারা দিতাম-যাতে বোরকা পড়া কোন মহিলা অন্যগ্রাম থেকে পাড়ায় প্রবেশ করতে না পারে। কারণ মহিলাদের বোরকার অন্তরালে নাকি ঐ রোগ(উলা বিবি) আবার গ্রামে চলে আসতে পারবে।
এতকিছু করেও আমরা বস্তুত: আমাদের গ্রামকে ঐ মহামারি থেকে রক্ষা করতে পারতাম না। শয়ে শয়ে মানুষ-এমনকি কোন পরিবারের একাধিক সদস্য অসহায়ের মত মারা যেত। কবরে কবরে ভরে ওঠত গ্রামের সকল কবরস্থানগুলো। একই রকম আরো একটি রোগ-গুটি বসন্ত-ফি বছর গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ত। অনেক লোক তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে মারা যেত। গুটি বসন্ত হয়ে যারা মারা যেত, তাদের দেখতে ভয়ে আত্মীয় স্বজনেরা কাছে যেতনা। ঝাড়-ফূঁক-দোয়া-তাবিজ-মাদুলী কিংবা শিখড়-পড়া এসব রোগকে ঠেকাতে পারত না।
সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতির ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও নানা আবিস্কার-ঐ সমস্ত রোগের প্রতিষেধক টিকা-ঔষধের বদৌলতে সে সমস্ত রোগ দেশ থেকে নির্মূল হয়েছে-বহু বছর পূর্বেই।
মানুষের সমাজ গতিশীল-সদা পরিবর্তনময়। এ পরিবর্তনের নানা ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রভাব পড়ে প্রকৃতিতে-প্রাকৃতিক পরিবেশে। মানুষের জৈবিক আচরণ, প্রকৃতিকে জয় করার দুদর্মনীয় প্রয়াস ও আকাক্সক্ষা নিয়ে বিকাশমান বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ঔরষে জন্ম নেওয়া প্রযুক্তির ব্যবহার-মানুষের কল্যাণে ও অকল্যাণে-রাজনৈতিক স্বার্থে তার অপব্যবহার-ইত্যাদি হাজারো কারণে সৃষ্ট নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিভিন্ন সময়ে মানুষের প্রচণ্ড দুর্ভোগের কারণ হয়ে ওঠে।
যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়াও, সম্পূর্ণ জৈবিক কারণে সৃষ্ট নতুন নতুন জীবাণু বা ভাইরাস কখনো কখনো প্রাণঘাতি হয়ে সারা দুনিয়ার মানুষকে বিপদগ্রস্থ করে তুলেছে।
এটা একটি প্রাকৃতিক জৈবিক প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি-কারো ইচ্ছা অনিচ্ছার ফল নয়। তবে মানুষের কর্মফলত বটেই। যেমন-আমাদের প্রশাসনিক চরম অদক্ষতার ফলশ্রুতিতে, আমাদের ঘনবসিতপূর্ণ নগরগুলোকে আমরা যখন আমাদের পরিত্যক্ত বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত করেছি-যা ডেঙ্গু মশার উর্ব্বর জন্মক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে-তারই অপরিহার্য ফলশ্রুতিতে জন্ম নেওয়া এডিস মশার কারণে গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু নামক রোগের মর্মান্তিক শিকার হয়ে আমাদের কত লোক জীবন দিল-এর জন্য কাকে দোষ দেব-সৃষ্টি কর্তা ঈশ্বরকে-নাকি আমাদের অদক্ষ-দুর্নীতিপরায়ণ মেয়র সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নটের গুরুদের?
আজ যে জীবনজ্ঞাতি যে ভাইরাস-করোনা-সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলেছে-বিপন্ন করে তুলেছে বিশ্ব মানবতাকে-তার জন্মেরও হাজারো একটি কারণ আছে-যা ভবিষ্যতে গবেষণার বিষয়-কিন্তু এ মুহুর্তে তাকে রুখতে না পারলে বিশ্ব যে মনুষ্যশূণ্য হয়ে যাবে।
এখানেই প্রশ্ন-রুখব কিভাবে? আল্লাহ, ঈশ্বর ভগবানের নিকট প্রার্থনা করে-নাকি এ ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিস্কার করে ?
যারা মনে করেন এবং এখনো প্রচার করেন-করোনা ভাইরাস মহান সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে একটি গজব-তাদের কাছেতো প্রার্থনার কোন বিকল্প নেই। সেখানেওতো বিপদ-এ ভাইরাস এত নির্মম সন্ত্রাসী যে-উপাসনালয়ে গেলেও সংক্রমণ করতে ছাড়ে না। ইতোমধ্যে তার ভূরি ভূরি প্রমান মিলেছে বলে দুনিয়ার তাবৎ দেশে উপসনালয়-মসজিদ-মন্দির-প্যাগোড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহের ঘর নামে আখ্যাত পবিত্র হেরেম শরীফের দরজায়ও তালা পড়েছে।
যারা নানা বয়ানে-মিলাদে করোনাকে আল্লাহের গজব বলে বেড়াচ্ছে-তারা একথা বুঝতে অক্ষম যে, মানুষের সৃষ্ট দুর্ভোগের দায় তারা অবলীলায় নির্দোষ সৃষ্টিকর্তার উপর দিয়ে তাকে বরং খাটো করছে। বলা হয় মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাহলে সৃষ্টিকর্তা তার সেরা সৃষ্টির প্রতি এত নির্মম কেন হবেন?
সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাইরাস-করোনা-আজ চীনের কোন একটি প্রদেশে কোন জৈব রাসায়নিক কারণে জন্ম নিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। এ ভাইরাসটি সম্পূর্ণ নতুন-অত্যন্ত দ্রুত সংক্রামক এবং প্রাণঘাতী। করোনার দুধর্ষ আক্রমনে ইতিমধ্যেই পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ধনী ও ক্ষমতাধর দেশগুলোও নাস্তানাবুদ অবস্থায় পড়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশ ও অঞ্চলে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও তার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি। বরং শণৈ: শণৈ: আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এক অজানা অদৃশ্যপূর্ব শত্রুর আচমকা আক্রমণে বস্তুত: চিকিৎসা বিজ্ঞান এ মুহুর্তে হতবিহ্বল-তবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় নয়। চিকিৎসক সমাজ যেমন এ অজানা অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে-নিরন্তর-তেমনি বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কারভ্যাকসিন-ঔষধ তৈরীর গবেষণাও শুরু হয়েছে। কিছু কিছু আশার বাণীও শুনা যাচ্ছে ইতোমধ্যেই। অতীতের সকল অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি-এ লড়াইয়েও বিজ্ঞান অবশ্যই জয়ী হবে-তবে ততদিনে হয়ত অনেক জীবন কেড়ে নিবে এ ভাইরাস। তবে ভবিষ্যতের জন্য তাকে রুখে দেওয়া যাবে চিরতরে।
এ মহা বিপর্যয়ের মুখে আমরা বাংলাদেশের মানুষ অন্যদেশের চেয়ে বেশী আতঙ্কের মধ্যে আছি। কারণ আমাদের দেশে বিদ্যমান যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা-চিকিৎসা সামগ্রী-সবকিছু মিলিয়ে আমাদের দেশে যদি এ রোগের বিস্তার পশ্চিমা দেশগুলোর মত ভয়াবহ রূপ লাভ করে-তাহলে আমাদের অবস্থা যে কী মর্মান্তিক হতে পারে-তা ধারণা করতেই শিউরে ওঠতে হয়।
তাই বর্তমান অবস্থায় আমাদের প্রথম করণীয় হচ্ছে-তার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা। যার জন্য প্রয়োজন কঠিন-কঠোর ভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত বিজ্ঞান ভিত্তিক স্বাস্থ্য বিধিসমূহ মেনে চলার জন্য আমজনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
কিন্তু দু:খজনক হল-আমাদের দেশের আমজনগণ যে সকল ব্যক্তিদের কথা বেশী শুনে-মানে-বিশ্বাস করে-তারা হল আমাদের দেশের আলেম সমাজ ও ধর্মীয়গুরু। তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নানা ভাবে তাদের মিলাদে-সমাবেশে সধারণ মানুষকে মারাত্মকভাবে বিভ্রান্ত করছে এটা বলে যে-করোনা ভাইরাস আল্লাহের গজব-অমুসলমান-কাফের কিংবা মুনাফেক মুসলমানদের জন্য আল্লাহ এটা প্রেরণ করেছে। া হুজুর শফির ভাষায়-এটা নাকি আল্লাহের সৈনেক-খাঁটি মুসলমানদের এটা কিছু করবে না। তাদের এজাতীয় বয়ান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেদারসে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা মানুষকে স্বাস্থবিধি মানতে নিরুৎসাহিত করছে। সরকার বা প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।
তাদের বক্তব্য শুনলে বুঝা যায়-তারা এখনো ষোড়শ শতকের পিছনে বসবাস করছে। তাদের এ মুর্খতা ক্ষমার অযোগ্য। তারা মানুষকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে চায়-মানব সভ্যতাকে পেছনে ফিরাতে চায়। তাদের বুঝানো যাবে না-কারণ এক মধ্যযুগীয় বিশ্বাসের ভাইরাসে তাদের মস্তিস্ক আক্রান্ত। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সাথে এসব গণ্ডমুর্খ মোল্লা পুরুহিত ও গুরু বাবাদের বিরুদ্ধে একটি মনস্তাত্ত্বিক লড়াই অত্যাবশ্যক। যা করার দায়িত্ব অবশ্যাম্ভাবীভাবে আজকের প্রজন্মের বিজ্ঞানমনস্ক তরুণদের। তা না হলে সামনে যে মহাবিপদ।