Saturday, October 27, 2018

যৌনতা কেনা-বেচা’র নৈতিকতা এবং কিছু বৈশ্বিক বিতর্ক।


বানিজ্যিক যৌনতার কেনা-বেচায় সুইডেন প্রথম দেশ হিসাবে, ক্রেতাকে অপরাধী হিসাবে ঘোষণা করে, বিক্রেতাকে নয়।
১.
ইংরাজি ‘সেক্স ট্রেড’ এর বাংলা কি হতে পারে? যৌনতার বানিজ্য? হয়তো এমন কিছু একটা। ভারতীয় উপমহাদেশে আমরা এর নাম দিয়েছি ‘পতিতাবৃত্তি’। এই নামকরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে অর্থের বিনিময়ে যৌনকর্মের শুধু একজন অংশীদারকেই যুক্ত করা হচ্ছে, বাকিজন যিনি খরিদ্দার তাকে এক রকমের সোস্যাল ইনডেমনিটি বা সামাজিক সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে। এটাই পিতৃতন্ত্র। পিতৃতন্ত্র অর্থের বিনিময়ে নারীকে যৌনতা বিক্রি করতে বাধ্য করে এবং দিনের শেষে সেই কর্মটির জন্যে তাকেই “পতিতা” হিসাবে চিহ্নিত করে। অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির পেশাটিতে শুধু সেই “পতিতা”রই দায় থাকে; তাই পেশাটির নাম “পতিতাবৃত্তি”। এই ‘পতিতাবৃত্তি’ নামকরনের ব্যাখ্যা অনেক নারীবাদী লেখক দিয়েছেন। আমি নীতিগতভাবে ‘পতিতাবৃত্তি’ লিখিনা, বলিনা। তাই আমি একে বলছি ‘যৌনতার বানিজ্য’। এই বানিজ্যে ক্রেতা এবং বিক্রেতা সমানভাবে উপস্থিত।
এখন শিরোনামে যে বিতর্কের কথা লিখেছি তা খুব সাধারণ, সাদামাটা। এটা একটা ঔচিত্যবোধের প্রশ্ন। প্রশ্নটা করেই ফেলি আগে, তারপরে এই প্রশ্নকে ঘিরে বিতর্কগুলো ব্যাখ্যা করা যাবেঃ
“পেশা হিসাবে বানিজ্যিক ভাবে যৌনতার কেনাবেচা কি থাকা উচিৎ”? আর এই কেনাবেচার বাজার বলে আমরা যা জানি অর্থাৎ ব্রোথেল বা পতিতালয় কি থাকা উচিৎ?
দুটি প্রশ্নে শেষে “উচিৎ” শব্দটি দিয়ে বোঝাই যাচ্ছে, এই প্রশ্নের হাজারটা উত্তর হতে পারে। এটা নির্ভর করবে ব্যক্তি মানুষ হিসাবে, সমাজ হিসাবে আমার বা আমাদের “ঔচিত্যবোধ” এর উপরে। মুশকিল হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ঔচিত্যবোধ ভিন্ন ভিন্ন। এটা কেবলই একটি পার্থক্য বা ভিন্নমত। ধরুন, এই প্রশ্নটি যদি ইউরোপের সভ্য দুটি দেশ নেদারল্যান্ডস ও জার্মানিতে করা হয়, তাহলে হয়তো প্রশ্নকারীর দিকেই বিস্ময়কর চোখ দিয়ে তাকাবেন অন্যান্য মানুষেরা। কেননা, নেদারল্যান্ডস বা জার্মানিতে যৌনতার বানিজ্য শুধু বৈধই নয়, এটা একটা স্বীকৃত পেশা, যারা আরো দশটা পেশার মতোই রাষ্ট্রকে আয়কর দিয়ে নিজের পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ জার্মানি কিংবা নেদারল্যান্ডসে মৌলিক অর্থে একজন ডাক্তার, অধ্যাপক, ট্রাকচালক কিংবা একজন যৌনকর্মীর মাঝে পেশাগত সংজ্ঞার দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই । হয়তো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে এখনো, কিন্তু এঁরা সবাই রাষ্ট্রের আইন দ্বারা স্বীকৃত পেশায় নিয়োজিত এবং সবাই আয়কর দেয়া মানুষ, তাই আয়করের সুবিধা হিসাবে সকল সামাজিক কল্যাণের সমান অধিকার ভোগ করে থাকেন।
এমন কি সংরক্ষণবাদী পাঠকদের হয়তো ভালো লাগবেনা পড়তে, তবুও বলি, নেদারল্যান্ডস বা জার্মানিতে এই পেশাটির সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা হয়তো যৎকিঞ্চিত পার্থক্য আছে, তবে তা আরো দশটি পেশার চাইতে খুব খারাপ কিছু নয়। নেদারল্যান্ডস এ বানিজ্যিক যৌনকর্মীরা স্কুলে বা কলেজে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাতে পারেন- কেনো একজন যৌনকর্মী হওয়াটা আরো দশটা পেশার মতোই একটি সাধারণ পেশা। বরং স্বাধীনতার দিক থেকে কেনো এই পেশাটি একটি কাংখিত পেশা হতে পারে।
এই তথ্যগুলো উপস্থাপনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা বলা যে, বানিজ্যিকভাবে যৌনতা বেচা-কেনার পেশা থাকা উচিৎ কিনা- এই বিষয়টি দারুণভাবে নির্ভর করে একটি সমাজের গড় মূল্যবোধের উপরে, আর সেই মূল্যবোধের উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আইনের উপরে। এবং সভ্যতার নিরিখে অনেক সমাজ আছে যাদেরকে আমরা সভ্য ও মানবিক সমাজ বলে মনে করি, তারা মনে করেন বানিজ্যিকভাবে যৌনতা বেচাকেনার মাঝে কোনো নীতিগত সমস্যা নেই। যেমন ধরা যাক, জার্মানি বা নেদারল্যান্ডস এ জনমত হচ্ছে, নারী বা পুরুষের যৌনতার বানিজ্যিক কেনা-বেচার মাঝে কোনো সমস্যা নেই। গণতন্ত্র ও সারা বিশ্বের মানবতার প্রধান ঠিকাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যের মাঝে মাত্র একটিতে যৌনতার বানিজ্যিক কেনা-বেচা বৈধ, আর বাকি উনপঞ্চাশটি রাজ্যে যৌনতার বানিজ্যিক কেনা-বেচা নিষিদ্ধ। যদিও বাস্তব পরিসংখ্যান ও তথ্য বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল রাজ্যেই যৌনতার বানিজ্যিক কেনা-বেচার অবাধ বানিজ্য বিদ্যমান।
যৌনতার বানিজ্যিক কেনা-বেচার প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে নারী হচ্ছেন বিক্রেতা আর পুরুষ ক্রেতা। দুই একটি দেশ বাদ দিয়ে, প্রায় সত্তুর – আশি শতাংশ নারী এই পেশায় আসেন হয় “মানব পাচার” বা হিউম্যান ট্র্যাফিকিং এর শিকার হয়ে, নয়তো চরম দারিদ্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে। যেহেতু মানব পাচার এবং তার পরবর্তী বাধ্যতামূলক যৌনদাসত্ব এভাবেই চক্রটি শুরু হয় ও চলতে থাকে, তাই এখানেই একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন কেউ কেউ, – এই পেশাটি কেনো নারীর বিরুদ্ধে একটি পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন নয়? সারা বিশ্বে আসলে ঠিক কতজন নারী সত্যিকার অর্থেই নিজের ইচ্ছায় আরো দশটি পেশার মতো করেই “বানিজ্যিক যৌনতা বিক্রির” পেশা বেছে নেন? কোনো সন্দেহ নেই, এই প্রশ্নগুলো জটিল।
আজ থেকে প্রায় আঠারো বছর আগে, ১৯৯৯ সালে সুইডেন প্রথম ঘুম ভাঙ্গালো সারা বিশ্বের। সুইডেন ঘোষণা করলো, যৌনতা বিক্রি কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু যৌনতা খরিদ করাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অর্থাৎ, টাকা বা ভিন্ন কিছুর বিনিময়ে যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হলো দেশটিতে। সারা বিশ্বে সম্ভবত যৌনতা বিষয়ে সবচাইতে খোলামেলা দৃষ্টিভঙ্গির দেশ হচ্ছে সুইডেন। এখানে ছেলে মেয়েরা খুব ছোট বয়স থেকেই যৌনতা ও মানুষের যৌন সম্পর্ক বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, স্কুলের পাঠ্যসূচীতে প্রাতিষ্ঠানিক যৌনশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হয় খুব ছোটবেলা থেকেই। মানুষের যৌনতা সম্পর্কে, তা সে নর-নারী, নর-নর কিংবা নারী-নারীতে হোক না কেনো, মানুষের পরস্পরের সম্মতির ভিত্তিতে যৌন সম্পর্ক বা সাধারণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই দেশটির মতো উদার দেশ শুধু ইউরোপে নয়, সারা বিশ্বেই খুব কম আছে। সেই রকমের একটি সমাজে হঠাৎ করে “যৌনতার বানিজ্য” বন্ধ করে দেয়াটা ছিলো এক ধরনের বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত। শুধু সুইডেনের নয় সারা বিশ্বের পিতৃতন্ত্র হামলে পড়েছিলো এই সিদ্ধান্তের উপরে।
সুইডেনের এই নতুন আইনটির পেছনে রাজনীতি, নারীবাদী দর্শন ও সুইডেনের সামাজিক মূল্যবোধ কাজ করেছে। কিন্তু সহজভাবে, অর্থনীতির ভাষায় এটাকে বলে চাহিদার জায়গাটিকে নিরুৎসাহিত করা। আমাদের সমাজে এরকমের বহু উদাহরণ আছে। যেমন, সিগারেট উৎপাদনকে নিষিদ্ধ না করে, বরং সিগারেটের উপরে অতি উচ্চ করারোপ এবং ধুমপানের বয়স আইন করে নির্ধারণ করে দেয়া। কিংবা এলকোহল উৎপাদনকে নিষিদ্ধ না করে বরং মদ্যপানের ন্যূনতম বয়স আইন করে নির্ধারণ করে দেয়া। ঠিক তেমনি, বানিজ্যিকভাবে যৌনতা কেনার খরিদ্দার ৯০% ক্ষেত্র পুরুষ এবং এই বানিজ্যের ফলে নারীর উপরে নিপীড়নের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তাই সুইডেনে এই আইনের মধ্যে দিয়ে মূলত পুরুষের এবং পুরুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রতিই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে। এটা ছিলো পশ্চিমা বিশ্বের পিতৃতন্ত্রের গালে একটা বিরাট চপোটাঘাত।
কিন্তু ঠিক কি কি নীতিগত বিতর্ক তৈরী করেছিলো সুইডেনের এই সিদ্ধান্তটি? ফেসবুকে যে নারীবাদী লেখক একাই ভিন্ন স্রোতের একটি মন্তব্য করে সবার বিরাগভাজন হয়েছিলেন, মূলত তাঁর মতো করেই প্রশ্নটিই করেছেন এবং এখনও করছেন অনেক গবেষক, নারীবাদী, মানবতাবাদী, রাজনীতিবিদসহ আরো অনেকেই। ইউরোপে সেই একই প্রশ্ন নিয়ে অনেকেই একাডেমিক গবেষণা করছেন, কেউ তাঁদের গালিগালাজ করে কোণঠাসা করছেন না। সেই প্রশ্নগুলো সেই বিতর্কগুলো তুলে ধরাই এই লেখার উদ্দেশ্য।
২.
যৌনতা বিক্রি অপরাধ নয়, ক্রয় করাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই দারুণ বিতর্কিত আইনটি প্রথম প্রনয়ণ করে সুইডেন এবং পরবর্তীতে নরওয়ে ও আইসল্যান্ড এবং সাম্প্রতিক সময়ে ক্যানাডা এবং ফ্রান্সও একই রকমের আইন প্রনয়ণ করে। একটি নরডিক দেশ সুইডেন এই আইনের প্রথম প্রবক্তা বলে এই মডেলটির নাম হয়ে যায় “নরডিক মডেল”। নরডিক মডেল সারা সুইডেন ও ইউরোপেতো বটেই সারা বিশ্বেই আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয়। নারীবাদী, সাধারণ জনগণ, রাজনীতিবিদ, একাডেমিক সমাজতাত্ত্বিকবৃন্দসহ প্রায় সকল শ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েন এই ইস্যুতে। খোদ সুইডেনেই, আইনটির বিপক্ষে মত দিয়েছিলো প্রায় ৭০ শতাংশ নাগরিক (জনমতে অংশগ্রহণকারীর ৭০ শতাংশ), সুইডিশ জাতীয় সংসদ বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো, এমনকি দ্বিমত পোষণ করেছিলো আইন পেশার বিশেষজ্ঞরা, আদলত ও বিচারকেরা, পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্তাব্যক্তিরাও।
৩.
প্রখ্যাত আমূল নারীবাদী (র‍্যাডিক্যাল ফেমিনিস্ট) গবেষক ও লেখক, অধ্যাপক ক্যাথরিন ম্যাককিনন তাঁর এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন –
“আর্থসামাজিক অসমতা দূর করতে হবে এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই, মানব পাচার বা হিউম্যান ট্র্যাফিকিং বন্ধ করা দরকার, এটা নিয়েও কেউ কখনও দ্বিমত করেছেন বলে শুনিনি। কিন্তু “যৌনতার বানিজ্য” বা প্রস্টিটিউশন বন্ধ করা দরকার, এই ইস্যুতে সচেতন মানুষদের অনেকেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই মনে করেন, বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সঠিক বা “পলিটিক্যালি কারেক্ট”, সুতরাং কি দরকার এই ইস্যুতে নিরর্থক খোঁচাখুচি করার”।
অধ্যাপক ম্যাককিনন এর পর্যবেক্ষণের বাস্তবতা আছে, পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে নানান রকমের আন্দোলন, সংগ্রাম গড়ে উঠেছে গত একশো বছরে, সেখানে আজও নারীকে তাঁর নিজের শরীর বিক্রি করে জীবন ধারণের জন্যে অর্থ উপার্জন করতে হয় এবং এই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে খুব বেশী একটা আলোচনা নেই। আরো উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সারা বিশ্বে, মানব পাচার, বানিজ্যিক যৌনতা ও পর্ণগ্রাফী ব্যবসার মোট বাজার এর তথ্য বিস্ময়করভাবে প্রমাণ করে, এটা আজকের আধুনিক পুঁজিবাদের পরম স্নেহে লালিত-পালিত একটা বানিজ্যিক ধারা। চরম অমানবিক কিন্তু দারুণ লাভজনক। কে না জানে, টাকার কোনো ধর্ম নেই, উচিৎ-অনুচিৎ বোধও নেই। তাইতো পুঁজিবাদী সমাজের নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ এই পেশাটিকে টিকিয়ে রাখার স্বপক্ষে অনেক যৌক্তিক অবস্থান তৈরী করেছে।
এই প্রশ্নটি নিয়ে নারীবাদীদের মাঝেও রয়েছে মতামতের সুস্পষ্ট বিভক্তি। বানিজ্যিকভাবে নারীর যৌনতা বিক্রিকে নারীবাদীরা কিভাবে দেখে থাকেন? এর উত্তরে বলা যায়, প্রস্টিটিউশন বা যৌনতার বানিজ্যিক কেনা-বেচা প্রসঙ্গে, আধুনিক সময়ে, পশ্চিমা নারীবাদীরা অন্তত তিনটি প্রধান দলে বিভক্ত। এদের কে সহজ বাঙলায় বলা যেতে পারে-
১ – কঠোর বা নির্মূলপন্থী (Strict or Abolitionist feminist)
২ – উদারনীতিবাদী (Liberal Feminist)
৩ – প্রজ্ঞাবান (Pragmatic feminist)
কঠোর বা নির্মূলপন্থীরা মনে করেন, যৌনতার বানিজ্য হচ্ছে নারীর প্রতি পিতৃতন্ত্রের আরেকটি শোষণমূলক ব্যবস্থা।- এটা আংশিক নয় বরং সম্পূর্ণ বিলোপ হওয়া উচিৎ। উদারনীতিবাদীরা মনে করেন, নারী যদি চায় তাহলে তিনি তাঁর শরীর অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করতে পারেন, এবং এইজন্যে তাকে নির্যাতিত বা ভিক্টিম হিসাবে চিহ্নিত করাটা অনুচিৎ। কেননা একজন নারীর শরীর সম্পূর্ণভাবে তাঁর নিজের, সুতরাং তাঁর নিজের শরীর নিয়ে তিনি কি করবেন তা নিয়ে কারো কিছু বলার নেই, এমন কি রাষ্ট্রেরও কিছু বলার নেই। আর প্রজ্ঞাবান বা প্র্যাগমাটিস্ট ফেমিনিস্টরা মনে করেন, নৈতিকভাবে এই বিষয়টি যেমনই হোক না কেনো, যৌনতা বিক্রি বা কেনা, কোনটাই প্রচলিত অর্থে অপরাধ হওয়া উচিৎ নয়। এই তিন দলের নারীবাদীরা যৌনতার কেনা-বেচার প্রসঙ্গে তাত্ত্বিক বিতর্কে বেশ সরব। এছাড়াও আরো দুই গোত্রের নীরব নারীবাদীরা আছেন যারা মনে করেন, এই পেশাটি চলতে পারে, তবে এই পেশার ফলে নারীর উপরে যত নিপীড়নমূলক আচরণ আছে তা নির্মূল করতে হবে। এই শেষ গোত্রের নারীবাদীরা মনে করেন, কোনটা স্বেচ্ছায় বেছে নেয়া আর কোনটা বাধ্যতামূলক যৌনদাসত্ব- সেই বিষয়টি খুব পরিস্কার করে সংজ্ঞায়িত করা দরকার এবং স্বেচ্ছা নির্ধারিত পেশা হিসাবে একে সুরক্ষা দেয়া ও বাধ্যমূলক যৌনদাসত্বকে নির্মূল করা উচিৎ।
৩.
একটি আধুনিক পুঁজিবাদী দেশ হয়েও কেনো প্রায় সকল দেশ ও সমাজ থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন হয়ে সুইডেন এই রকমের একটি সিদ্ধান্ত নিতে গেলো? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে আমাদেরকে সুইডেনের এই আইনের ইতিহাসটি সংক্ষেপে জানা দরকার।
যৌনতার কেনা-বেচা প্রসঙ্গে কঠোর বা নির্মূলপন্থীদের প্রথম দিকের উদাহরণ হচ্ছে সুইডিশ আমূল নারীবাদী বা র‍্যাডিক্যাল ফেমিনিস্টরা। সুইডেনের সরকারী উদ্যোগে দুই দফায় বিশেষ অনুসন্ধান ও গবেষণার উদ্যোগ নেয়া হয়, প্রথমবার ১৯৮২ সালে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯৩ সালে। সরকারী উদ্যোগে নেয়া এই গবেষণাধর্মী অনুসন্ধানে সমান সংখ্যক নারী ও পুরুষ অংশ নেন এবং গবেষণা দলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন একজন নারী।
এ প্রসঙ্গে এই আইন প্রনয়ণের গবেষণা কাজের একজন প্রধান গবেষক Cecilie Høigård বলেছিলেন –
সুইডেনের এই আইন তৈরীর করার আগে আমরা যথেষ্ট পরিমাণে সামাজিক গবেষণা ও জরিপ করেছি। আমরা বানিজ্যিক যৌন কর্মীদের সাথে বছরের পর বছর মিশেছি, কথা বলেছি, তাঁদেরকে জানার চেষ্টা করেছি। আমাদেরকে অনেক বানিজ্যিক যৌনকর্মী বলেছেন যৌনকর্ম বিষয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও বোধের কথা। বানিজ্যিক যৌনকর্মীদের কেউ কেউ বলেছেন –
“বানিজ্যিকভাবে যৌনকর্মের এই পেশাটিতে কাজ করার সময় আমার নিজের যোনীকে অনেকটা রেন্টাল এপার্টমেন্ট এর মতো মনে হয়। প্রতিদিন কিংবা কিছুদিন অন্তর অন্তর একজন অচেনা মানুষ এসে এপার্টমেন্টটি ব্যবহার করে যান টাকার বিনিময়ে। যৌনকর্মের মতো কাজটিতে মনোদৈহিক অংশগ্রহণ দরকার হয়, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে নিজের শরীর থেকে মনকে আলাদা করতে হয়। কেননা মন এই অজানা মানুষটিকে গ্রহণ করতে পারেনা, কিন্তু শরীরকে এদের গ্রহণ করতে হয় টাকার জন্যে”।
প্রশ্নটি নিয়ে আধুনিক কালের নারীবাদীরা বিভক্ত হয়ে গেছেন। বিশেষ করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ফেমিনিস্ট মতামত এই আইনের বিপক্ষে গেছে। তাঁরা যুক্তি দিয়েছেন, এটা ব্যক্তি স্বাধীনতার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। “আমার শরীর, আমার সিদ্ধান্ত” এই মতামতে বিশ্বাসীদের অনেকেই এই আইনের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এটা নারীর শরীর নিয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত নেবার মৌলিক অধিকারকে খর্ব করবে। অনেকেই বলেছেন, বানিজ্যিক যৌনকর্ম একটি পেশা বা কাজ, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টিয়ে এই পেশাকে সম্মানজনক পেশার মর্যাদা দেয়া দরকার। পাশাপাশি এই আইনটির স্বপক্ষের মানুষেরা বিতর্ক তুলেছেন, বানিজ্যিক যৌনকর্ম কোনো পেশা নয়। তাঁরা দাবী করেছেন, সকল পেশাই একটি নির্দিষ্ট দক্ষতার দাবী করে এবং সকল পেশাই মানুষকে ক্ষমতাবান বা এম্পাওয়ারড করে তোলে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে। কিন্তু বানিজ্যিক যৌনকর্মীদের বেলায় দেখা যায়- শুধুমাত্র এই পেশায় থাকার কারণে তাঁরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সমাজ-বিচ্ছিন্ন পড়েন। ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার বদলে তাঁরা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। শুধু তাই নয়, এই নারী কর্মীদের উপরে নেমে আসে অর্থের বিনিময়ে “বৈধ” নিপীড়নের সন্ত্রাস। শেষোক্ত যুক্তিতে বানিজ্যিক যৌনকর্মকে সুইডেনে কোনো “পেশা” বা “বৃত্তি” হিসাবে স্বীকার তো করা হয়ইনি, বরং মনে করা হয়েছে- এটা নারীর বিরুদ্ধে যৌনতা নির্ভর আর্থ-সামাজিক অসমতাকে টিকিয়ে রাখে এবং যা এক ধরনের শোষণই বটে। বলা হয়ে থাকে, সারা বিশ্বের বিরুদ্ধ স্রোতে গিয়ে এই রকমের একটি ব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক অবস্থান নেয়ার মূল কারণ ছিলো, সুইডেনের সেই সময়কার ক্ষমতাসীন সরকারে বামপন্থী, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট আর আমূল নারীবাদীদের সুস্পষ্ট প্রাধান্য।
কিন্তু এই আইন একই সাথে বেশ কিছু জটিলতা ও স্ববিরোধীতা তৈরী করেছিলো। কিছু জটিলতা একেবারে নিরেট রাষ্ট্রীয় আর কিছু জটিলতা নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা আর মানবাধিকার প্রশ্নে।

বানিজ্যিক যৌনতা বিক্রির বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের বিধি নিষেধ আরোপের প্রচেষ্টাকে যৌনকর্মীদের অধিকার খর্ব করার শামিল বলে মনে করেন একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অধিরকার কর্মী ও নারীবাদী মানুষ।

৪.
প্রথম স্ববিরোধীতাঃ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকার যৌনতা বিক্রি করা অপরাধ নয়, কিন্তু খরিদ করা দন্ডনীয় অপরাধ, এই আইনটি প্রথম যে স্ববিরোধীতাটি তৈরী করেছিলো তা হচ্ছে, নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা, স্বাধীন পছন্দ বা “ফ্রি চয়েস”, এবং মানবাধিকার বিষয়ক প্রশ্নের মাঝে বিরোধ। এই বিষয়গুলোতে সারা বিশ্বব্যাপী একই মানদন্ড বজায় রাখার জন্যে কখনও আন্তর্জাতিক ঘোষণাসমূহ (যেমন জাতিসংঘের) ঘোষণা আবার কখনোবা স্থানীয় আইন বা উভয়ই ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন, তিনটি আন্তর্জাতিক ঘোষণায় মানুষের যে সমস্ত অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত হয়েছে, তা সুইডিশ এই বিশেষ আইনটির ক্ষেত্রে এসে স্ববিরোধী অবস্থানে মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। এই তিনটি ঘোষণা হলোঃ
1. International Covenant on Social, Economic and Cultural Rights to Self Determination (ICESCR)
2. International Covenant on Civil and Political rights (ICCPR)
3. Convention of the Elimination of all forms of Discrimination Against Women (CEDAW)
যেমন ধরা যাক, প্রথম ঘোষণাটি বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। অর্থাৎ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীন। মানুষের এই স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারের ক্ষেত্রে আধুনিক রাষ্ট্র কোনো বাঁধা তৈরী করতে পারবে না। এই ঘোষণার অধীনে মানুষের প্রাপ্ত অধিকারটিকে অনেক সময় “ফ্রি চয়েস” বা “ফ্রি উইল” বলে প্রচার করা হয়ে থাকে। যারা যৌনতা কেনা-বেচার “নরডিক মডেল” এর বিরোধিতা করেন, তাঁরা ICESCR ঘোষণাকে উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন যে নরডিক মডেল মানুষের “ফ্রি চয়েস” বা স্বাধীনভাবে পেশা বা বৃত্তি বেছে নেবার অধিকারকে হরণ করে। যৌনকর্মীদের স্বাধীনভাবে পেশা বেছে নেবার অধিকারকে খর্ব করেছে “নরডিক মডেল”, অথচ স্বাধীনভাবে নিজের পেশা বা বৃত্তি বেছে নেবার অধিকার একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার। অন্যদিকে এর বিপরীতে CEDAW ঘোষণা আন্তর্জাতিকভাবে সকল নারীকে যেকোনো ধরনের নির্যাতন ও নিবর্তনমূলক পরিস্থিতি থেকে সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। CEDAW ঘোষণা নারীকে যে কোনো ধরনের যৌন হয়রানি থেকে মুক্ত রাখার নিশ্চয়তা দাবী করে এবং খোদ নারীর জন্যেই যেকোনো ধরনের বানিজ্যিক বা বাধ্যতামূলক যৌনতা বিক্রির পেশা ত্যাগ করার অধিকার প্রদান করে। জাতিসংঘের সকল ঘোষণার মাঝে একমাত্র CEDAW ঘোষণাতেই ইংরাজিতে ”Prostitution” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে ভিন্ন আরেকটি শব্দকে নিয়ে। যেভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে CEDAW ঘোষণাতে, তার নানান ধরনের ব্যাখ্যা হতে পারে। CEDAW ঘোষণাতে এই বিষয়টিকে এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে –
“Right to be free from exploitation of prostitution (CEDAW, Article 6)”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সকল prostitution কি exploitation বা শোষণমূলক? এ বিষয়ে বিভক্তি দেখা গেছে দেশে দেশে, রাজনীতিবিদদের মাঝে, নারীবাদীদের মাঝে এমনকি মানবতাবাদীদের মাঝেও। কেউ কেউ মনে করেন, prostitution সকল ক্ষেত্রে শোষণমূলক নাও হতে পারে। যদি যথাযথভাবে “মানব পাচার” কে প্রতিহত করা যায় এবং forced slavery বা বাধ্যতামূলক দাসত্বকে প্রতিহত করা যায় তাহলে prostitution সকল ক্ষেত্রে শোষণমূলক নাও হতে পারে। এবং রাষ্ট্র যদি এই পেশাকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হয় তাহলে এই পেশার মাঝে নিবর্তন বা শোষণমূলক ঘটনাগুলোকে কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। সেক্ষেত্রে prostitution বা বানিজ্যিক যৌনতা কেনা-বেচার পেশাটি নারীর জন্যে শোষণমূলক নাও হতে পারে। ঠিক এই যুক্তিটিতেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের সাথে এমনকি সারা বিশ্বের অন্যান্য সকল দেশের সাথে সুইডেন ও নরডিক দেশগুলোর প্রধান পার্থক্য। সুইডিশ সরকার এবং এখানকার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, পৃথিবীর সকল ধরনের prostitution বা বানিজ্যিক যৌনতার কেনা-বেচার ঘটনা মূলত নারীর প্রতি নিবর্তনমূলক ও শোষণমূলক। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর প্রতি কোনো নির্যাতন বা শোষণের ঘটনা না ঘটলেও, সম্ভাবনার হার খুব উল্লেখযোগ্য। সুইডিশ আমূল নারীবাদীদের (Radical Feminist ) একাংশ যাদের নির্মূলবাদী বা Abolitionist feminist বলা হয়ে থাকে, তারা মনে করেন, সকল অর্থেই নারীর জন্যে বানিজ্যিক যৌনতা বিক্রির পেশাটি অপমানজনক, নির্যাতনমূলক এবং এটা হচ্ছে পিতৃতন্ত্রের দ্বারা প্রাতিষ্ঠানিক নির্যাতনের একটি সুস্পষ্ট নজির। সুইডিশ গবেষণায় দেখা গেছে, বানিজ্যিক যৌনতা বিক্রির কাজে অর্থের লেনদেন হলেও এটা সবসময়ই নারীর প্রতি এক ধরনের বল প্রয়োগের ঘটনার জন্ম দেয় আর বল প্রয়োগের স্থানে কেবল পুরুষই ভূমিকা রাখে (Florin, 2012)। নির্মূলপন্থী নারীবাদীরা হচ্ছেন আমূল নারীবাদীদের একটি অংশ। আমূল নারীবাদীরা ষাটের দশকে প্রথম ঘোষণা করেন, নারী–পুরুষের রোম্যান্টিক সম্পর্কও রাজনৈতিক, এর মাঝেও রয়েছে পিতৃতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শোষণ, যেখানে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষ হচ্ছে শোষকের ভুমিকায় (Saunders, 2005)। তাই আমূল নারীবাদীদের শ্লোগান ছিলো “Personal is political” অর্থাৎ ব্যক্তিগত বিষয়ও রাজনীতির বাইরে নয়। সুইডিশ নারীবাদীদের এই অনড় অবস্থানের কারণেই মূলত আন্তর্জাতিক ঘোষণাগুলোর সাথে স্ববিরোধী অবস্থান সত্ত্বেও সুইডেনে এই আইনটি পাশ করা সম্ভব হয়েছিলো । সাম্প্রতিক জরিপগুলো বলছে, সুইডেনের প্রায় ৭০ ভাগ নাগরিক মনে করেন, এই আইনটি প্রত্যাশামাফিক কাজ করছে এবং এই আইনটি নারীর উপরে পুরুষের নির্যাতন কমিয়ে এনেছে এবং নারীর জন্যে একটি “অসম্মানজনক” বৃত্তির হার কমিয়ে আনছে। পুরুষের বানিজ্যিক যৌনতা কেনার হারও কমে এসেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
‘Free choice’ বা স্বাধীন পছন্দের অধিকার খর্ব করার প্রশ্নে সুইডিশ সরকার, ক্ষমতাসীন দল ও নারীবাদীদের পাল্টা যুক্তি হচ্ছে, ফ্রি চয়েস বা স্বাধীন পছন্দ নিশ্চিত করতে হলে মানুষকেও সত্যিকারের স্বাধীন করে দেয়া দরকার। অর্থাৎ, মানুষ বাধ্য হচ্ছে এমন যে কোনো অবস্থা দূর করার পরেই কেবল পরীক্ষা করা যেতে পারে, মানুষ আসলেই স্বাধীন পছন্দ হিসাবে বানিজ্যিক যৌনতাকে বেছে নিচ্ছে কিনা। অর্থাৎ, একজন নারীর ব্যক্তিগত দারিদ্র দূর করে, তার উপরে যেকোনো রকমের ভয়-ভীতি দূর করে, তারপরে তার সামনে যদি একই রকমের বেতন ও সুযোগ সুবিধার পাঁচটি চাকুরীর প্রস্তাব রাখা হয়, সেখান থেকে যদি কোনো নারী চারটিকে বাদ দিয়ে বানিজ্যিক যৌনতা বিক্রির পেশাকে বেছে নেন, তাহলেই কেবল সেটাকে বলা যেতে পারে নারী তাঁর স্বাধীন পছন্দ হিসাবেই যৌনতা বিক্রির পেশা বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু সুইডিশ অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বেশীরভাগ নারীই যৌনতা বিক্রির পেশাকে বেছে নিচ্ছেন অন্য কোনো কাজ না পেয়েই, নয়তো দালালের খপ্পরে পড়ে কিংবা ইমিগ্র্যান্ট হিসাবে নতুন সমাজে এসে কোনো রকমের অর্থনৈতিক সমাধান খুঁজে না পেয়ে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সম্ভাব্য দালালের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই সুইডিশ নারীবাদীদের মতে, স্বাধীন পছন্দ বা “ফ্রি চয়েস” এর যুক্তিটি এখানে একেবারেই প্রযোজ্য নয়।
৫.
দ্বিতীয় স্ববিরোধীতা – চাকুরীর বাজার ও সামাজিক কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়া
দ্বিতীয় সমস্যাটি তৈরী হয় এই আইনের ক্রেতা ও বিক্রেতার প্রতি আইনের বিচার ভিন্ন হওয়া থেকে। এই আইনটিতে একজন নারী, পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নিজের পেশা হিসাবে বানিজ্যিক যৌনতা বিক্রেতা হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করতে পারেন। এটাতে তাদের কোনো আইনী বাঁধা নেই। কিন্তু ক্রেতা হিসাবে সেই বাজারে আইনত কেউ উপস্থিত নেই, কারণ যৌনতা কেনা দণ্ডনীয় অপরাধ। সুতরাং এখানে পেশাদার যৌনতা বিক্রেতা আছেন কিন্তু তাদের কোনো বৈধ ক্রেতা নেই। যেহেতু তাদের কোনো বৈধ ক্রেতা নেই, তাই বাস্তবত তাদের কোনো আয়-রোজগার নেই। এই প্রশ্নে সুইডিশ ট্যাক্স অফিসের সাথে নারীবাদী ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার জায়গাটি দুর্বল। সুইডিশ ট্যাক্স অফিস বানিজ্যিক যৌনতা বিক্রিকে একটি পেশা বা কাজ মনে করেনা। কিন্তু যে কোনো নাগরিকের ঘোষিত আয় হচ্ছে করযোগ্য (অবশ্য একটি নির্দিষ্ট সীমার উপর থেকে প্রযোজ্য)। সুইডিশ ট্যাক্স অফিসের সাথে এটা একটা সরাসরি স্ববিরোধী অবস্থান যৌনতা বিক্রি বিষয়ক আইনের। আবার যখন একজন নারী বানিজ্যিক যৌনতা বিক্রি থেকে আয়-রোজগার শুরু করেন, তাই ধরে নেয়া যায় তার নিজেকে ও পরিবারকে চালানোর জন্যে অর্থনৈতিক সাহায্য দরকার নেই। তাই সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী তিনি আর বেকার ভাতা বা “সামাজিক কল্যাণ ভাতা” পাবার যোগ্যতা রাখেন না। একাধিক গবেষক দাবী করেছেন, এই স্ববিরোধ এর মূল শিকার হচ্ছেন নারী যৌনকর্মীরা যারা নিজেদের যৌনতা বিক্রেতা হিসাবে ঘোষণা করার কারণে সুইডিশ সামাজিক কল্যাণ থেকে আংশিক বা উল্লেখযোগ্যভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন অথচ নিজেদের জীবন ধারণের জন্যে যথেষ্ট আয়ের সুযোগ নেই তাদের। তাই এই মানুষেরা নিশ্চিতভাবে সামাজিক অবহেলার শিকার হচ্ছেন। যৌনতার ক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে যে সামাজিক বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন যৌনকর্মীরা তার নৈতিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

জার্মানি ও নেদারল্যান্ড সহ ইউরোপের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশে “সেক্স ওয়ার্ক” একটি বৈধ পেশা যা নরডিক দেশগুলোর মতামতের সরাসরি বিরোধী।
৬.
তৃতীয় স্ববিরোধীতা – সামাজিক কলংক, গোপনীয়তা ও নৈতিকতার প্রশ্ন
নরডিক মডেলের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো ক্রেতাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা এবং সামাজিকভাবে যৌনতা ক্রেতাকে অধিক উন্মোচিত করা। ফলে ক্রেতা, যার প্রায় ৯৫% হচ্ছে পুরুষ, সামাজিক কলংকের ভয়ে যৌনতা কেনা থেকে বিরত থাকবেন। এই উদ্দেশ্য অনেকাংশে সফল হয়েছে, অর্থাৎ, নরডিক সমাজে পুরুষের বানিজ্যিক যৌনকর্মীর কাছ থেকে যৌনতা কেনার হার অনেকাংশে কমে গেছে। কিন্তু এর ভিন্ন রকমের প্রভাব পড়েছে যৌনকর্মীদের উপরে, বিশেষত নারী যৌনকর্মীদের উপরে। যেহেতু প্রকাশ্যে যৌনতা কেনার সুযোগ নেই, তাই এর ক্রেতারা গোপনে যৌনতা কেনার শর্ত আরোপ করেন যৌনকর্মীদের উপরে এবং সেই গোপন বানিজ্যে নারীর প্রতি নিপীড়নের মাত্রা আরো বেশী হয় বলে গবেষণায় দেখা গেছে। চুড়ান্ত অর্থে গোপনে যৌনতা বিক্রির মন্দ প্রভাবের শিকার হচ্ছেন নারী যৌনকর্মীরা। গোপনে বানিজ্যিক যৌনতা বিক্রির জন্যে নারী যৌনকর্মীদেরকে নির্ভর করতে হয় দালালের উপরে। অনেক সময় এই দালালেরাই ব্যবস্থা করেন গোপন স্থান বা এপার্টমেন্টের। ফলে নানানভাবে, নারী যৌনকর্মীরা এক রকমের বন্দী জীবন যাপন করেন এই দালালদের হাতে। যদিও রাষ্ট্রীয় হিসাব মতে এই বন্দীত্বের শিকার নারীর সংখ্যা খুবই নগন্য, তবুও গবেষকেরা দাবী করেছেন এই খুব নগন্য সংখ্যক নারীর জীবনও ভয়াবহ হুমকীর মধ্যে থাকে সারা বছর। যেহেতু ক্রেতার সংখ্যা এখন একেবারেই কম, তাই অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে যৌনকর্মীদের দর কষাকষির ক্ষমতা বা বারগেইনিং পাওয়ার প্রায় নেই বললেই চলে, ফলে তারা বাজার মূল্যের চাইতে অনেক কম মজুরীতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এখানেও যৌনতার ক্রেতাদের চাইতে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন যৌনকর্মীরা। ফলে সুইডেনের নারীবাদীদের সাথে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের যে আদর্শবাদী ঐক্য তার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশটির যৌনকর্মীরা । তারা প্রশ্ন তুলেছেন, এটা কতটুকু নৈতিক যে নারীবাদীদের ও বামপন্থী ক্ষমতাসীন দলের আদর্শিক ঐক্যের কারণে স্বাধীন নাগরিক হিসাবে একজন যৌনকর্মী ভুক্তভোগী হবেন?
নৈতিকতার প্রশ্নে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। ইউরোপের নৈতিকতার মানদন্ড ঐতিহাসিকভাবেই খ্রিষ্টতান্ত্রিক ধর্মের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপরে নির্মিত। তাই এখানে এখনো সাধারণ জীবনযাত্রায় বা বানিজ্যিক যৌনতা বা Prostitution কে মনে করা হয় অনৈতিক পেশা বা অনৈতিক কর্ম। খ্রিষ্ট ধর্ম মতে সন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যে নয় এবং বিবাহ বহির্ভূত যৌন সঙ্গম সবসময়েই অনৈতিক। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, দারুণভাবে সেকুলার ও নিরীশ্বরবাদী সমাজ সুইডেনেও সরকারী নথিপত্রে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বানিজ্যিক যৌনকর্মীদের মানুষ হিসাবে মনে করা হতো অনৈতিক, অসৎ। অবশ্য, এখন নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রের কাছে একজন যৌনকর্মী সকল অর্থেই আর দশটা নাগরিকের মতোই সমান। কিন্তু সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এখনো একজন যৌনকর্মীর অবস্থান আরো দশটি নাগরিকের মতো নয়।
অধিকার প্রসঙ্গে একাডেমিক গবেষকদের কেউ কেউ এই ব্যাখ্যার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন (Dworkin, 2011: p.32-33)। এই সকল একাডেমিক গবেষকেরা ব্যাখ্যা করেন, অধিকার সব সময়ই “ব্যক্তিগত”। প্রতিটি মানুষ সমান অধিকার দাবী করেন। তাই একটি বিরাট অংশের “ক্ষতি” কমানোর জন্যে অন্য একটি সংখ্যালঘু অংশের ব্যক্তিগত অধিকার খর্ব করাটা কতটুকু নৈতিক- সেই প্রশ্ন তুলেছেন এদের কেউ কেউ। অর্থাৎ একটা বৃহত্তর অংশের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে একটা ক্ষুদ্রতর অংশের ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষুণ্ণ করাটা কতটুকু নৈতিক? এই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
৭.
চতুর্থ স্ববিরোধীতা – “বলির পাঁঠা” কে বা কারা হওয়া উচিৎ?
ইংরাজী শব্দ ”Victimhood” এর বাংলা অর্থ বলির পাঁঠা হয় কিনা আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু একদল গবেষক এই ”Victimhood” কে সামনে নিয়ে এসেছেন বানিজ্যিক যৌনতা কেনা-বেচার বিতর্কে। তারা প্রশ্ন তুলেছেন কেনো কেবল বানিজ্যিক যৌনকর্মীরাই বলির পাঁঠা বা ”Victimhood” এর শিকার হবেন (Jackson 2016)। সুইডিশ ফেমিনিস্টদের যুক্তির বিপরীতে এই গবেষকদের দাবী ও প্রশ্ন হচ্ছে – যদি বানিজ্যিক যৌনতা কেনা-বেচার মূল কারণ দারিদ্র্য, মানব পাচার, শৈশবের যৌন হয়রানী ও পিতৃতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক শোষণ হয়ে থাকে, তাহলে মূল কারণগুলো দূর করার উদ্যোগ নেয়াটাই তো প্রধান কর্মসূচী হওয়া দরকার এবং যদি এই কারণগুলোই নারীর উপরে এই আদিম নির্যাতনের মূল কারণ হয়ে থাকে, তাহলে তো যৌক্তিকভাবে এই কারণগুলো দূর করলেই তো বানিজ্যিক যৌনতার বাজার শুন্য হয়ে আসবে। অর্থাৎ, দারিদ্র যদি প্রধান কারণ হয়ে থাকে নারীর জন্যে যৌনতার বানিজ্যে অংশগ্রহণের, তাহলে কোনটা প্রধান উপায় হতে পারে প্রতিরোধের, দারিদ্র বিমোচন নাকি আইন করে নারীকে তার অর্থ উপার্জনের পথ বন্ধ করে দেয়া? যদি হিউম্যান ট্রাফিকিং বা মানব পাচার একটি প্রধান কারণ হয়ে থাকে বানিজ্যিকভাবে যৌনতা কেনা-বেচার, তাহলে নারীর উপরে এই নিবর্তন বন্ধ করার উপায় কি হতে পারে? মানব পাচার বন্ধ করা নাকি আইন করে রাস্তার যৌনকর্মীদের রুটি রুজির উপরে খড়গ-হস্ত হওয়া? এখানে যুক্তি ও নৈতিকতা দুটো বিষয়ই কাজ করছে। সুইডিশ ফেমিনিস্টদের মতে “ডিম্যান্ড সাইড” বা চাহিদাকে নিরুৎসাহিত করতে পারলে সরবরাহ ও কমে যাবে আর অপর পক্ষের অনেকের মতে যদি সরবরাহ দিক বা সাপ্লাই সাইড প্রি-কন্ডিশনগুলোকে (দারিদ্র, মানব পাচার ইত্যাদি) বন্ধ করা যায় তাহলে ডিম্যান্ড বা চাহিদাও তৈরী হবেনা। দুপক্ষেরই উদ্দেশ্য একই, কিন্তু একপক্ষ যৌনকর্মীদের দুর্ভোগের সম্পূর্ণ বিপক্ষে, যৌনকর্মীদের ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘনের সম্পূর্ণ বিপক্ষে, অপর দিকে নির্মূলপন্থী নারীবাদীদের মতে আইন করেই এই নিপীড়নমূলক বানিজ্যিক প্রথা দূর করা যাবে, তাতে আপাত একটি সময়ের জন্যে হয়তো কিছু নারীর ভোগান্তি হবে, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা নারীমুক্তি ও নারীর সমানাধিকারকেই নিশ্চিত করবে।
৮.
পঞ্চম স্ববিরোধীতাঃ বানিজ্যিক যৌনতা কেনার হার বনাম “সেক্স ট্যুরিজম”
এই লেখাটির জন্যে এই স্ববিরোধীতাটিই শেষ উল্লেখযোগ্য স্ববিরোধিতা। বাস্তব পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এই আইনটি কি আসলেই পুরুষের টাকা দিয়ে যৌনতা ক্রয় করাকে কমাতে পেরেছে? সুইডিশ জাতীয় পরিসংখ্যান বলছে, এই আইনের ফলে সুইডেনে টাকার বিনিময়ে যৌনতা কেনার হার কমেছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। আমেরিকায় যেখানে প্রতি পাঁচ জনে একজন পুরুষ বছরে অন্তত একবার বানিজ্যিকভাবে যৌনতা কিনে থাকেন সেখানে সুইডেনে এই অনুপাতটি প্রতি ১১২ জনে একজন। এটা সন্দেহাতীতভাবেই উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। কিন্তু অনেকেই এই পরিসংখ্যান সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। কেননা এই পরিসংখ্যান, সাম্প্রতিক সময়ের ক্রমবর্ধমান প্রপঞ্চ “সেক্সটুরিজম” কে অন্তর্ভুক্ত করেনা। সুইডিশ পুরুষদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে কিছু নির্দিষ্ট দেশে ভ্রমনের মাত্রা, যে দেশগুলোর খ্যাতি রয়েছে “সেক্স ট্যুরিজমের” জন্যে (থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, স্পেইন, ইউক্রেইন ইত্যাদি) । যদি এই সেক্স ট্যুরিজম এর হারকে সুইডিশ পরিসংখ্যানের অন্তর্গত করা হয়, তাহলে সত্যিকার অর্থে “নরডিক মডেল” এর প্রকৃত কার্যকারিতা বোঝা যেতে পারে। যা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। অপরদিকে সুইডিশ আইন বা “নরডিক মডেল” প্রবাসে সুইডিশ নাগরিকের যৌনতা ক্রয় করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করেনা, যদি সেই দেশটিতে তা বেআইনি না হয়ে থাকে। ফলে, একটা বিপুল সংখ্যক সুইডিশ পুরুষ ভিন্ন দেশে গিয়ে যৌনতা খরিদ করছেন, নীতিগতভাবে যা অগ্রহণযোগ্য।
৯.
যৌনতার বেচা-কেনারঃ পক্ষ-বিপক্ষ
বলাই বাহুল্য, নরডিক মডেল এর পক্ষে ও বিপক্ষে সমানভাবে সারা বিশ্বব্যাপী আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। বিশ্ব পুঁজিবাদের পরাক্রমশালী দেশগুলো এই আইনের তীব্র সমালোচনা করেছে এবং এখনো করছে। এই সমালোচকদের তালিকায় রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নারীবাদী, মানবাধিকার কর্মীসহ সমাজের প্রায় সকল স্তরের মানুষই আছেন। ক্যানাডা এবং ফ্রান্স সাম্প্রতিক সময়ে একই রকমের আইন পাস করেছে তাদের সংসদে। বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় দেশ ফ্রান্স এই আইন পাস করার পরে পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোর মাঝে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরী হয়েছে। মানব পাচার, ব্রোথেল এবং পর্ণোগ্রাফির ব্যবসার স্বপক্ষের শক্তিগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে এই আইনের বিরুদ্ধে। দুই পক্ষেরই রয়েছে নানান ধরনের যুক্তি পাল্টা যুক্তি। অনেক একাডেমিক গবেষক এই আইনকে নারীর আত্মমর্যাদাকর ভাবার বদলে বামপন্থিদের “ব্যর্থ দিবাস্বপ্নের” সাথে তুলনা করেছেন। অনেকেই মনে করছেন, নারীর সমানাধিকার তো দূরের কথা, এই আইনের একমাত্র ভুক্তভোগী হবে নারী।
৯.
সংক্ষেপে মূল বিতর্ক
নারীবাদীদের মূল যুক্তি
সুইডিশ ফেমিনিস্ট, ক্ষমতাসীন সোশ্যালডেমোক্র্যাট দল ও অন্যান্য বামপন্থী ও মধ্যপন্থী দলের মতে, বানিজ্যিক ভাবে যৌনতার কেনা-বেচার প্রথা আসলেঃ
১ – প্রস্টিটিউশন বা বানিজ্যিক ভাবে যৌনতা বিক্রি সকল অর্থেই নারীর উপরে পিতৃতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়নের আরেকটি ধরন।
২ – এই নিপীড়নের একমাত্র শিকার নারী আর নীপিড়কের ভুমিকায় পুরুষ। বানিজ্যিকভাবে যৌনতা কেনা-বেচার সাথে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ধরনের কাজে অবধারিত ভাবেই নারী শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতিত হয়।
৩ – বানিজ্যিক যৌনতা বেচা-কেনার সাথে সংশ্লিষ্টদের অধিকাংশই পুরুষ, এরা প্রায়শই অপরাধী, কখনও মানব পাচারকারী, কখনোবা নিপীড়ক দালাল আবার কখনোবা ক্রেতা নামের ধর্ষক। এরা অপরাধী, এদের আইনী শাস্তির বিধান বৈধ।
৪ – যৌনকর্মীদের মাঝে “ফ্রি চয়েস” বা স্বাধীন ইচ্ছার চর্চার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। হয় সত্যিকারের স্বাধীন ইচ্ছা গড়ে ওঠার অভাব অথবা যথেষ্ট সুযোগের অভাব এর কারণ। “ফ্রি চয়েস” বা “ফ্রি উইল” খর্ব হওয়া প্রসঙ্গে সুইডিশ নারীবাদীদের স্পষ্ট অবস্থান হচ্ছে, ফ্রি-চয়েস বা ফ্রি-উইল নিয়ে বিতর্কের আগে মানুষ সত্যিকারের অর্থে ফ্রি করে দিতে হবে। মানুষ তার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানগতভাবে ফ্রি না হলে তার চয়েস বা নির্বাচন ফ্রি হতে পারেনা। অর্থাৎ মানুষের সামনে তার যোগ্যতা অনুযায়ী আরো পাঁচটি পেশা বেছে নেবার সুযোগ তৈরির সাথে যদি তার পক্ষে যৌনতা কেনা-বেচার “পেশা”কেও একটি পছন্দ হিসাবে রাখা হয় এবং যদি নারীর আরো চারটি পেশা গ্রহনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যৌনতা বিক্রির পেশাকে গ্রহণ করে, তাহলেই সেটাকে নারীর “ফ্রি চয়েস” হিসাবে বলা যাবে। বাস্তবতা তার প্রমাণ দেয়না।
৫ – মূলত মানব পাচার ও যৌনদাসত্ব একই ধরনের অপরাধ। দুটোরই উদ্দেশ্য একই। তাই যৌনদাসত্বকে চিরতরে দূর করতে হবে, তাহলে মানব পাচার এর মতো ঘৃণ্যতম অপরাধকে দূর করা সম্ভব।
৬ – বানিজ্যিকভাবে যৌনতা কেনা-বেচার এই ব্যবসা সাম্প্রতিক সময়ে এতোটাই ফুলে ফেপে উঠেছে যে এর সাথে যুক্ত হয়েছে মানব পাচারের এক বিরাট গোপন বানিজ্য। এটা একটা বড়সড় সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যাকে দূর করতে হবে।
৭ – বানিজ্যিক যৌনতার কেনা-বেচাকে আইনত বৈধ ঘোষণা কেবল নারীর অবস্থানকেই আরো খারাপ করে তুলবে, বিশ্বব্যাপী মানব পাচারকে আরো বৃদ্ধি করবে যার একমাত্র পরিনতি হচ্ছে নারীর উপরে পুরুষের নিপীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি।
৮ – প্রস্টিটিউশন বা বানিজ্যিক যৌনকর্ম কোনো পেশা হতে পারেনা, কেননা এই পেশা মানুষকে বিশেষত নারীকে শক্তিমান করার বদলে বিচ্ছিন্ন করে, নারীর জীবন ও নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ করে এবং সামাজিকভাবে এই পেশা কোনো “মূল্য” উৎপাদন করেনা।
আমূল নারীবাদীদের যে অংশটি বানিজ্যিকভাবে যৌনতা বেচা-কেনা সম্পূর্ণ বন্ধ বা নির্মূল করতে চান, তাদের সর্বশেষ যুক্তিটি হচ্ছে – যৌনতার বানিজ্যিক কেনা-বেচা হচ্ছে বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক সমাজের একটি প্রকরন যা প্রমাণ করে, “চাহিবা মাত্রই পুরুষের সেবা করতে নারী বাধ্য”। এই প্রথা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে নারীর শরীর “বিক্রিযোগ্য” এবং তা কেবল পুরুষের সেবায় এবং যখনই দরকার, পুরুষ যেনো তা পায়, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। যে সমাজ নারী-পুরুষের সমানাধিকারের দর্শনে বিশ্বাসী, সেই সমাজে এই রকমের “অসমতা” শুধু অন্যায্য নয়, অমানবিক এবং আদিম। সুইডেন সমাজ হিসাবে এই অসমতা, অন্যায্যতা, অমানবিকতা ও আদিমতাকে প্রশ্রয় দিতে পারেনা।
যৌন কর্মীদের পক্ষের মূল যুক্তি
১ – যৌনতার বানিজ্যিক কেনা-বেচা বন্ধের এই আইন, মানুষের মৌলিক ব্যক্তি স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ। এটা আধুনিক রাষ্ট্রের এক ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক খবরদারী।
২ – এটা যৌনকর্মীদের মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
৩ – এই আইন, যৌন কর্মীদেরকে “ভুক্তভোগী”তে পরিনত করেছে। তাদেরকে বাধ্য করেছে অস্বাভাবিক, গোপন জীবন যাপনে। এর ফলে সমাজের কাছ থেকে, রাষ্ট্রের কাছ থেকে তাদের যে ন্যায্য “কল্যাণ” পাবার যে অধিকার তা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। পদ্ধতিগতভাবে যৌনকর্মীদেরকে সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। যা অমানবিক।
৪ – এই আইন যৌনকর্মীদেরকে আরো বেশী করে সামাজিক “কলংক”র মুখোমুখি করে তুলেছে। বহু বছর ধরে চলে আসা ধারণা যে যৌন কর্মীরা পাপী, মন্দ মানুষ, নীতিগতভাবে তারা স্ত্রী হতে পারেন না, মা হতে পারেন না, এই সকল নারী-বিরুদ্ধ ধারণাকেই আরো বদ্ধমূল করে তুলেছে।
৫ – এই আইন যৌনকর্মীদের উপরে অত্যাচার না কমিয়ে বরং আরো অনেক বেশী বৃদ্ধি করবে, কারণ এখন ক্রেতা অনেক শক্তিমান এবং বিক্রেতা হিসাবে নারীকে যেহেতু অনেক গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়, তাই তার উপরে শারীরিক জুলুমের আশংকা এখন আরো অনেক বেশী।
৬ – যৌনতা বেচা-কেনা একটি পেশা অথচ সুইডেন এই পেশার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। পেশার নিরাপত্তা দেয়ার বদলে তারা পেশাটিকেই “নিষিদ্ধ” করছে, এটা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
৭ – এই আইনটি মানুষের “স্বাধীন ইচ্ছা”র সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

শেষ কথা

এই সমগ্র লেখাটির প্রেরণা ছিলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম “ফেসবুক” এর একটি বিতর্ক। যে বিতর্কে বাংলাদেশের আত্মদাবীকৃত নারীবাদীদের সকলেই একমত ছিলেন “বেশ্যাবৃত্তি” থাকা উচিৎ কিনা- এই প্রশ্নে। কেবল একজন উল্লেখ করেছিলেন, তিনি মনে করেন “বেশ্যাবৃত্তি” থাকা উচিৎ নয়, কিন্তু কেউ যদি নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় এই পেশায় যুক্ত হতে চায়, তাহলে তার আপত্তি নেই। ব্যস, আর যায় কোথায়, বাকী সকলে মিলে তাকে কোণঠাসা করে ফেললেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ, গালিগালাজে তাকে সন্ত্রস্থ করে তুললেন এবং অবধারিত পরিণতি হিসাবে ব্যক্তিগত গালাগালি দিয়ে শেষ হলো সেই বিতর্কটি। যদিও, এই একই রকমের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্কটি চলছে বহু বছর ধরে, গালাগালি ছাড়াই, দারুন গঠনমূলকভাবে, সেখানে ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, নীতিশাস্ত্র সকল প্রেক্ষিত নিয়ে বিতর্কটি এগিয়ে চলেছে। এই বিতর্কের এখনো কোনো কূল কিনারা হয়নি। সম্ভবত এই বিতর্ক চলবে আরো বহু বছর, এর মধ্যে দিয়েই মানুষ আরো মানবিক মূল্যবোধ অর্জন করবে। সেখানে হয়তো বাঙালি হিসাবে আমাদের অবদান খুব সামান্যই থাকবে, কেননা আমরা আমাদের সময়গুলো ব্যয় করেছি ও করবো গালাগালিতে।
এই লেখাতে ব্যবহৃত সকল উৎসই ইংরাজী ও সুইডিশ ভাষার। কিন্তু এই লেখাটির পেছনে আমার প্রায় দুই সপ্তাহের পরিশ্রমের মূল কারণ হচ্ছে, এই বিতর্কটিকে বাংলা ভাষায় পরিচয় করিয়ে দেয়া। লেখার কোথাও আমি আমার নিজের মতামত ব্যক্ত করিনি, কারণ আমি শুধু এই আন্তর্জাতিক বিতর্কটিকে উপস্থাপন করতে চেয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে আমার পক্ষপাত সুইডিশ আমূল নারীবাদীদের মতের স্বপক্ষে, কিন্তু আমি মনে করি, এই আইনটির বিপক্ষে যারা কথা বলছেন, তাদের অনেক মতামতের পেছনে যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে যা ভবিষ্যতে সমাধান করতেই হবে।
আমি প্রত্যাশা করি, আগামীতে এই বিষয়ে আরো সৃজনশীল বিতর্ক আমরা দেখবো বাংলা ভাষায়।
বিশেষ নোটঃ এই লেখাটির প্রথম অংশ, ভুমিকার অংশটুকু ভিন্ন একটি ব্লগ সাইটে প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু দুই একটি নীতিগত কারণে আমি এই লেখাটি সেই ব্লগ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি মনে করি এই লেখাটি মুক্তমনার পাঠকদের জন্যে আরো অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক ও আগ্রহউদ্দীপক হবে। আশা করি মুক্তমনার পাঠকেরা লেখাটি উপভোগ করবেন।

যে সকল সুত্রের সাহায্য নিয়েছি এই লেখাটি লিখতেঃ

প্রকাশিত জার্নাল প্রবন্ধ – নিবন্ধ – রিপোর্ট সমুহঃ
Dworkin R (2011), Rights as trumps, Philosophy of human rights, 1st Ed. Westview press
Edwards S (1997), The legal regulation of prostitution: A human rights issue, Routledge, London
Gould A (2001), The criminalization of buying sex: the politics of prostitution in Sweden, J of Soc. Pol, 30 (3), p. 437 – 456
Green K (1989), Prostitution, exploitation and taboo, Philosophy, 64, p.525 – 34
Ekberg G (2004), The Swedish law that prohibits the purchase of a sexual service: Best practices for prevention of prostitution and trafficking in human beings, Violence against women, 2004, 10, p. 1187 – 1218
Florin O (2012), A particular kind of violence: Swedish social policy puzzles of a multipurpose criminal law, Sex Res Soc Policy, 9.3, p.269 – 278
Jackson CA (2016), Framing sex-worker rights: How US sex worker rights activists perceive and respond to mainstream anti-sex trafficking advocacy, Sociological Perspective, 59.1, p. 27 – 45
NSWP, The real impact of the Swedish model on sex workers, Edinburgh, Global Network of Sex work project, 2015
Saunders P (2005), Traffic violations: Determining the meaning of violence in sexual trafficking versus sex work, Journal of interpersonal violence, 20.3, p.343 – 360
অনলাইন সুত্রঃ
https://www.huffingtonpost.com/cas-mudde/the-paternalistic-fallacy_b_9644972.html
https://www.theguardian.com/commentisfree/2014/aug/08/criminsalise-buying-not-selling-sex
http://edition.cnn.com/2016/04/18/opinions/prostitution-nordic-model-peters/index.html

Wednesday, October 24, 2018

গণিতের বরপুত্র জন ন্যাশ এবং অনন্য ‘গেম থিওরি’

By
১৯৫০ সাল; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পর আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের ২১ বছর বয়সী একজন ছাত্র মাত্র ২৮ পৃষ্ঠার একটি পিএইচডি থিসিস জমা দেন। শিরোনাম ছিল, “Non Cooperative Games”। থিসিস পেপারটি কেবল দুইজন বিজ্ঞানীর (John von Neumann & Oskar Morgenstern) পূর্বের গবেষণার আলোকে লেখা হয়েছিল। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, স্বল্পদৈর্ঘ্য এই পেপারটির উপর ভিত্তি করে আবিষ্কৃত তত্ত্বের জন্যে অর্থনীতিতে ১৯৯৪ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
জন ন্যাশ

হ্যাঁ ! গণিত এবং অর্থনীতিতে গত শতাব্দীতে যাঁর অবদান জীববিজ্ঞানে ডিএনএ মডেল আবিষ্কারের সমতুল্য ধরা হয়, তিনি ‘অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড’ খ্যাত ‘জন ফোর্বস ন্যাশ’। তাঁর গবেষণাকর্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ‘গেম থিওরি’। শুধুমাত্র গণিতে নয়; অর্থনীতি, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা, নীতিশাস্ত্র, এবং বিশেষত বর্তমানে কম্পিউটার বিজ্ঞানের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা সাইবারনেটিক্সে ‘গেম থিওরি’র সফল ব্যবহার রয়েছে। জন ন্যাশ ১৯২৮ সালের ১৩ জুন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার ব্লু ফিল্ডে জন্ম গ্রহণ করেন। মা ল্যাটিন ভাষার শিক্ষক এবং বাবা তড়িৎ প্রকৌশলী। ছোটবেলা থেকেই ন্যাশের গণিতে আগ্রহ। গণিত নিয়ে পড়ে থাকা এই ছেলেটির বন্ধুমহলে তাই নাম জুটে গিয়েছিল ‘বড় মাথা’! বাবার কথামতো প্রথম জীবনে সে সময়ের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি টেক-এ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ালেখা শুরু করেন তিনি। কিন্তু ক্রমশই বুঝতে পারেন, তাঁর উপলব্ধজ্ঞান প্রায়োগিক বিজ্ঞানের চাইতে বেশি কিছু। তাই প্রকৌশল থেকে রসায়ন এবং শেষে তাঁর স্বকীয়ক্ষেত্র- গণিতে স্থিত হন। গণিতের মূল চর্চাকেন্দ্র তখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি। যেখানে আলবার্ট আইনস্টাইন, জন ভন নিউম্যান, রবার্ট ওপেনহেইমার, কার্ট গোয়েডলসহ আরো অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের আনাগোনা। জন ন্যাশের পিএইচডি থিসিস শুরু হয় এখানেই। তাঁর সুপারভাইসর তাকে প্রথম দেখাতেই বলেছিলেন, ‘হি ইজ অ্যা মেথেমেটিক্যাল জিনিয়াস’। আসলেই তাই, ১৯৫৮ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সেই ফরচুন ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের সেরা গণিতবিদদের একজন বলে স্বীকৃতি দেয়। যদিও বাস্তব জীবনে অসাধারণ প্রতিভার এই মানুষটি ছিলেন প্রচন্ড নিভৃতচারী। তাঁর আবিষ্কৃত তত্ত্বের স্বীকৃতি পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। এসময় তাঁর পারিবারিক এবং শারীরিক জীবনের নানা উত্থান-পতন ঘটে। অল্প বয়সেই তিনি স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন। এছাড়া বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদ, একের পর এক প্রেমিকা বদল এবং একাধিক সমকামী সম্পর্কের জন্যে পুলিশের কাছে গ্রেফতারও হন। এক গভীর অন্ধকার তাঁর জীবনে নেমে আসে। প্রায় উন্মাদের মতো প্যারিস আর লন্ডনের রাস্তায় হেঁটে বেড়াতেন। নিজেকে ভাবতে শুরু করলেন এ্যান্টার্ক্টিকার প্রেসিডেন্ট, যার কাছে টেরেস্ট্রিয়াল গোপন বার্তা পাঠানো হয়। এসময় তাঁর পাশে একজনই ছিলেন, স্ত্রী এ্যালিসিয়া। তার পরিচর্যায় ন্যাশ কিছুটা সুস্থতা লাভ করেন। এভাবে প্রথমে প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়া, তারপর সেখান থেকে ক্রমশ সুস্থ হয়ে ফিরে আসা এবং তারও অনেক পরে তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি পান নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে। যে কমিটি জন ন্যাশকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিল, তার প্রধান আসার লিন্ডবেক বলেছিলেন, ‘আমরা তাঁকে দিনের আলোতে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছি। নোবেল জেতা তাঁর জন্য ছিল পুনরুত্থান’। এরপর তিনি আরো অনেকগুলো পুরষ্কার পেয়েছেন। গণিতে নোবেল পুরস্কার খ্যাত ‘অ্যাবেল পুরস্কার’ পেয়েছিলেন ২০১৫-তে। এছাড়া সিলভিয়া নাসার লেখা জন ন্যাশের জীবনী নিয়ে ২০০১-এ ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ সিনেমাটি ন্যাশকে রাতারাতি তারকা খ্যাতি এনে দেয়। ২০১৫ সালের ২৩ মে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে স্ত্রী এ্যালিসিয়া এবং জন ন্যাশ দুজনই মারা যান। অসম্ভব প্রতিভাবান গণিতের এই বরপুত্রকে তাই শুধুমাত্র তত্ত্ব আলোচনার জন্য নয়, স্মরণ করতে হয় নিভৃত অথচ বিকশিত সুন্দর মননের প্রতিচ্ছবি রূপে।
জন ন্যাশের ‘গেম থিওরি’, যাকে বাংলায় ‘ক্রীড়াতত্ত্ব’ বলা যায়, মূলত ফলিত গণিত এবং অর্থশাস্ত্রের একটি শাখা। গণিতের অন্যান্য তত্ত্বের চাইতে এটা ব্যাখ্যা করা তুলনামূলক সহজ। কারণ, বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ এতো বেশি যে, আমরা হরহামেশাই নিজের অজান্তে ‘গেম থিওরি’ ব্যবহার করে থাকি! প্রথমে আমরা অর্থনীতির দিক থেকে ‘গেম থিওরি’কে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। অর্থনীতিতে এই তত্ত্ব এমন একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলাকে নির্দেশ করে, যেখানে খেলোয়াড়রা সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করবে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
‘ওয়ালকন’ কোম্পানি কোনো একটা স্মার্টফোন প্রোডাক্ট থেকে মাসিক মুনাফা পায়- ৫০,০০,০০,০০০ টাকা।
অন্যদিকে ‘সিমকনি’ কোম্পানিও সমান কনফিগারেশনের একটা স্মার্টফোন থেকে মাসিক মুনাফা পায়- ৫০,০০,০০,০০০ টাকা।
এখন ওয়ালকন ভাবল যে, তাদের পণ্যের দাম যদি খানিকটা কমানো যায়, তাহলে বিক্রি বেশি হবে। তখন লাভ আগের চাইতে বেশি হবে। ধরা যাক, তখন লাভ হল, ৫৫,০০,০০,০০০ টাকা। এতে ওয়ালকনের বিক্রি ও লাভ বাড়লেও সিমকনির কিন্তু বিক্রি কমবে, লাভও কমবে। কারণ, একই জিনিস বেশি দাম দিয়ে কে কিনতে চাইবে! তাই সিম্ফনিও একইভাবে দাম কমিয়ে আনবে। তখন এই দু’টো কোম্পানির অ্যাবসলিউট লাভ হয়ত আগের চাইতে বাড়বে, কিন্তু রিলেটিভ লাভ আগে যা ছিল তাই থাকবে। ফলে, পুরো ব্যবস্থাটি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।
এই জিনিসটা আরেকটু গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাক। ১৯৯৪ সালে কর্ণেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক কৌশিক বসু এই অবস্থাটিকে ব্যাখ্যা করার জন্যে ‘গেম থিওরি’র একটা মজার সমস্যা প্রস্তাবনা করেন। যা ‘ট্রাভেলারস ডিলেমা’(travelers dilemma) বা, ভ্রমণকারীর উভয়সঙ্কট নামে পরিচিত।
লুসি এবং পিট দুজন যাত্রী। যারা শখের বসে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ শেষে প্লেনে করে ফিরছিল। দুইজনই একদম একই রকম ও একই দামের একটা মূর্তি কিনেছিল। যাত্রাশেষে দেখা গেল, জিনিস দুটোই ভেঙে গেছে। এয়ারলাইন ম্যানেজার তাদেরকে বলল যে, তিনি ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি আছেন। কিন্তু তিনি ঠিক কতটা ক্ষতিপূরণ দেবেন তা বের করার জন্য তিনি একটা কৌশল অবলম্বন করলেন। তাদের দুজনকে আলাদা জায়গায় রেখে বলা হল জিনিসটার দাম লিখে ম্যানেজারকে লিখে দিতে। কিন্তু সেখানে কিছু শর্ত ছিলঃ
১। দামটা ২ থেকে ১০০ ডলারের মধ্যে হতে হবে।
২। যদি ২ জন একই দাম লিখে দেয়, তাহলে ম্যানেজার সেই ডলারই দুইজনকে দিয়ে দিবে। যেমনঃ লুসি এবং পিট দুইজনই যদি ৫০ ডলার লেখে, তাহলে দুইজনকেই ৫০ ডলার দিয়ে দেওয়া হবে।
৩। যদি দুইজনের মধ্যে কোন একজন আরেকজনের চেয়ে কম দাম লেখে, তাহলে ম্যানেজার কম পরিমানের ডলারটাকে আসল বা বেস ধরবে। একইসাথে যে কম ডলারটা লিখল তার ডলারের পরিমাণকে সত্যি ধরে সততার পুরস্কার হিসেবে তাকে ২ ডলার বেশি দিয়ে দিবে এবং যে বেশি পরিমাণ ডলার দাবি করল তাকে ২ ডলার কম দিবে। যেমনঃ লুসি যদি দাবি করে ৪৪ ডলার এবং পিট দাবি করে ৪৬ ডলার; তাহলে বেস ধরা হবে ৪৪ ডলার। লুসি যেহেতু কম বলল, সে পাবে (৪৪+২) বা ৪৬ ডলার। পিট যেহেতু বেশি বলল, সে পাবে (৪৪-২) বা ৪২ ডলার।
এই হল শর্ত। এগুলো আলাদা আলাদাভাবে বুঝিয়ে দিয়ে লুসি এবং পিটকে দু’টি আলাদা আলাদা ঘরে রাখা হলো এবং বলা হলো দামটা লিখে ম্যানেজারকে দিতে। এখানে ধরে নেওয়া যাক, লুসি এবং পিট দুজনই সমান এবং বেশ ভাল মানের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন। অর্থাৎ দুজনেই যুক্তিসঙ্গত চিন্তা করে। এবং তারা দু’জন দুজনের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কেও অবগত। সেইসাথে দুজনই অধিক মুনাফা লাভের ব্যাপারে আগ্রহী। এখন আমরা যুক্তির বিচারে তাদের দুজনের অবস্থাকে বর্ণনা করব। লুসি কাগজ পাওয়ার সাথে সাথেই হয়ত ১০০ ডলার লিখে ফেলবে। কারণ এটাই সবচেয়ে বেশি মানের ডলার যা সে পেতে পারে। জিনিসটার দাম যদি ১০০ ডলারের কম হয় তাহলে ১০০ ডলার পেলে তো তার লাভই হয়! কিন্তু ঠিক তখনি তার মাথায় আরেকটা ব্যাপারও আসবে। সে তখন ভাববে, পিটও হয়ত ১০০ ডলারই লিখবে। এর চেয়ে বরং আমি এক কাজ করি। আমি লিখে দেই ৯৯ ডলার। এতে করে সে সততার পুরস্কার হিসেবে (৯৯+২) বা ১০১ ডলার পেয়ে যাবে। ওদিকে পিট পাবে (৯৯-২) বা ৯৭ ডলার। ফলে, কৌশলগত কারণে লুসি পিটের চাইতে ৪ ডলার বেশি পাচ্ছে! এই ভেবে সে যখনই ৯৯ ডলার লিখে ফেলবে ঠিক তখনি তার মাথায় আরেকটা ব্যাপার খেলা করবে। সে ভাববে, পিটও নিশ্চয়ই আমি যা ভাবছি তা ভাবছে (কারণ দুজনই যুক্তিসঙ্গত চিন্তা করে এবং তা উভয়েই জানে) তাহলে সেও তো ৯৯ ডলারই লিখবে! তাহলে আমি ৯৯ ডলার না লিখে বরং ৯৮ ডলার লিখি তাহলে আমি পাব (৯৮+২) বা ১০০ ডলার আর পিট পাবে (৯৮-২) ডলার বা ৯৬ ডলার! এখানেও ৪ ডলার বেশি। এই যুক্তিকে আরো আগে বাড়তে দিলে দেখা যায় এই ব্যাপারটা একটা সিরিজের মত করে চলতে থাকবে আর লুসিও তার ডলারের পরিমানটা আস্তে আস্তে কমাতেই থাকবে! ৯৮ থেকে ৯৭, ৯৭ থেকে ৯৬, ৯৬ থেকে ৯৫- তাত্ত্বিকভাবে ডলারের পরিমানটা কমেই যেতে থাকবে। একটা সময় কমতে কমতে এটা তাত্ত্বিকভাবে ২ ডলারে গিয়ে থামবে! যেহেতু পণ্যের মূল্য সর্বনিম্ন ছিল ২। এই চিন্তাভাবনাগুলো কিন্তু পিটের মাথায়ও খেলা করতে থাকবে! কিভাবে নিজে একটু বেশি ডলার পাওয়া যায়, সেটার জন্য লুসি কম পেলে পাক! এখানেই ‘গেম থিওরি’র শুরু। ছোট্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে লুসি এবং পিটের মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য অনেকেই বলতে পারে, দুজনেই যদি সত্যিটা লিখে, তাহলে তো আর কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু বাস্তব জীবনে ব্যবসার ক্ষেত্রে হিসেব-নিকেশগুলো এরকময়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। যাহোক, লুসি এবং পিটের বিভিন্ন স্ট্রাটেজি ও তার ফলাফলকে আমরা বোঝার সুবিধার্তে নিচের ম্যাট্রিক্স আকারে সাজিয়ে লিখতে পারি-



গেম থিওরিতে এ ধরণের ম্যাট্রিক্সকে বলা হয় পে-অফ ম্যাট্রিক্স। পে-অফ ম্যাট্রিক্সটা খেয়াল করলে দেখা যাবে- এখানে লুসি এবং পিটের লেখা বিভিন্ন ডলার পরিমানের সাপেক্ষে তাদের প্রাপ্ত ক্ষতিপূরণকে দেখানো হয়েছে। যেমনঃ লুসি এবং পিট দু’জনই যদি ১০০ ডলার লেখে, আমরা জানি যে দুজনই ১০০ ডলার করে পাবে। একদম নিচে সবচেয়ে ডানের ঘরে তাই আমরা (100 100) দেখতে পাচ্ছি। আবার ধরি, লুসি লিখল ৩ ডলার, পিট লিখল ৪ ডলার। তাহলে আমরা জানি যে ম্যানেজার ৩ ডলারকে বেস হিসেবে ধরে লুসিকে দিবে (৩+২) বা ৫ ডলার। আর পিটকে দিবে (৩-২) বা ১ ডলার। (5 1) লেখা ঘরটা কিন্তু তাই নির্দেশ করে। এই পুরো ব্যাপারটা থেকে আসলে যে সিদ্ধান্তটা নেওয়া যায় তা হচ্ছে, সবসময় অসঙ্গতিপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমাদেরকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য দেয় না। সহযোগিতাপূর্ণ এবং নৈতিক চিন্তাভাবনা আমাদের জন্যে বেশি লাভজনক। ‘গেম থিওরি’র আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন, তা হল- ‘ন্যাশ সাম্যাবস্থা’ । পুরো পে-অফ ম্যাট্রিক্সের মধ্যে একটা বিশেষ ঘরের দিকে লক্ষ্য করা যাক। ঘরটা হচ্ছে (2 2)। মনে করে দেখি পিট এবং লুসির শেষমেশ দুইজনই ২ ডলার করে লিখেছিল। এই ঘরটার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যা অন্য ঘরগুলোর নেই। পে-অফ ম্যাট্রিক্সটা একটু ভালভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই যে, যে কোন একজন প্লেয়ারের সিদ্ধান্তকে অপরিবর্তিত রেখে যদি আরেকজন তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে থাকে তাহলে এই (2 2) বাদে বাকি সব ঘরের জন্যই দুই প্লেয়ারের অন্তত একজন হলেও লাভবান হয় অর্থাৎ বেশি ডলার পায়। ব্যাপারটা একটু বিস্তারিতভাবে বলা যাক। (2 2) ছাড়া ম্যাট্রিক্সের যে কোনো একটা ঘর নিই। ধরা যাক, লুসি লিখল ৩ এবং পিটও লিখল ৩। তাহলে আমরা পে-অফ ম্যাট্রিক্সের যে ঘরটায় থাকব তা হচ্ছে (3 3)। ধরে নিই পিট তার সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রাখবে অর্থাৎ সে ৩ ই লিখবে। এখন লুসি যদি তার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করে তাহলে কি হয় দেখা যাক। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাব যে লুসি যদি ৩ না লিখে ২ লিখে তাহলে আমরা থাকব (4 0) ঘরে অর্থাৎ লুসি ৪ ডলার (২+২) পাবে, যেখানে আগে সে পেত ৩ ডলার। আর পিট পাবে ০ ডলার (২-২)। আবার ধরি লুসি তার সিধান্তের পরিবর্তন করবেনা অর্থাৎ সে ৩ ই লিখবে। পিট যদি তার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করে ৩ না লিখে ২ লিখে তাহলে আমরা থাকব (0 4) ঘরে অর্থাৎ পিট পাবে ৪ ডলার, যেখানে আগে সে পেত ৩ ডলার। এখান থেকে আমরা যা বুঝতে পারি (3 3) ঘরে থাকলে লুসি তার পাওয়া ডলারের পরিমানটাকে কিন্তু বাড়িয়ে নিতে পারবে, যদি পিট তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। একই কথা পিটের জন্যেও খাটবে। কিন্তু এবার (2 2) ঘরটার কথা ভাবা যাক। আমরা যদি পে-অফ ম্যাট্রিক্সটা একটু ভালভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব, একজন প্লেয়ারের সিদ্ধান্তকে অপরিবর্তিত রেখে আরেকজন তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে সে কখনোই লাভবান হতে পারবেনা। ব্যাপারটাকে এভাবে বলা যায় যে লুসি যদি ২ ডলার লিখে সে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে যে পিট যাই লিখুক না কেন কখনোই ২ ডলারের চেয়ে বেশি পাবেনা আর সে নিজে অন্তত ২ ডলার পাবেই। আবার পিটও যদি ২ ডলার লিখে সে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে যে লুসি কখনোই ২ ডলারের চেয়ে বেশি পাবেনা এবং সে নিজে অন্তত ২ ডলার পাবেই। কারণ, ২ ডলারই বেস। ২ ডলার যে-ই লিখুক না কেন, ম্যানেজার তখন ২-কে বেজ ধরবে। তাই (2 2) ঘরেই এসে শেষমেশ তারা স্থির হবে। ফলে (2 2) ঘরটা একটা সাম্যাবস্থা নির্দেশ করবে। একেই বলা হয় Nash Equilibrium বা ‘ন্যাশের সাম্যাবস্থা’। এই তত্ত্বটি শুধুমাত্র কাগজে কলমে সত্যি এমন নয়। কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যদি বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আচরণের কারণে তার সমসাময়িক অন্য প্রতিষ্ঠানের কথা বিবেচনা না করে কোনো পণ্যের দাম কমিয়ে আনে এবং অন্য কোম্পানি না কমায়, তখন আলটিমেটলি লস হয়। এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। রবি ইয়োন্ডার মিউজিক অ্যাপ তাদের নতুন ক্যাম্পেইন ‘নো মানি ফর মিউজিক’ এর ঘোষণা দিয়েছে। এই ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে শ্রোতারা এখন ইন্টারনেট চার্জ ছাড়াই গান শুনতে পারেন। অন্যদিকে গ্রামীনফোনে মাসিক ৪২.৬১ টাকা দিয়ে অ্যাপের মাধ্যমে গান শোনা যায়। এখানে একক বা ইনডিভিজুয়ালি রবির লাভ হলেও সামগ্রিকভাবে ‘মিউজিক অ্যাপ’ তৈরির যে ক্ষেত্র বাংলাদেশে হতে পারত, রবির কারণে তা অনেকাংশেই ব্যাহত হবে। কারণ, বিখ্যাত একটা ব্রান্ড যেখানে ফ্রি সার্ভিস দিচ্ছে, সেখানে টাকা দিয়ে গান শোনার মতো অ্যাপ আর কে বানাতে যাবে? বানালেও মানুষ তো ফ্রি টা দিয়েই শুনবে! একই কথা ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জিরো ডট ফেসবুক এবং ফ্রি ম্যাসেঞ্জারের (ফ্রি বলতে ডেটা ছাড়াই ইউজ করা যায়) কারণেই বোধহয় বাংলাদেশ, এমনকি ভারতের টপ লিস্টেও এমন কোনো চ্যাট অ্যাপ দেখা যায় না, যেটা লোকাল ডেভেলপারদের তৈরি। যাহোক, ট্রাভেলারস এলগোরিদম দিয়ে শেষ একটা তথ্য দেওয়া প্রয়োজন, তা হল- এই ডিলেমা বা, উভয়সঙ্কট নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা আসলেই করা হয়েছে। ইসরায়েলের একজন ইকোনোমিস্ট Ariel Rubinstein একবার একটা ওয়েব বেসড পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। যেখানে ৭টি দেশের ২৫০০ জনের মত মানুষ অংশ নিয়েছিল। একদম একই রকম পরীক্ষা, শুধু তাদের ১৮০ থেকে ৩০০ ডলারের মধ্যে কোন একটা ডলারের পরিমান লিখতে বলা হয়েছিল এবং শাস্তি বা পুরস্কার হিসেবে আমাদের উদাহরণের ২ ডলারের জায়গায় ছিল ৫ ডলার। দেখা গিয়েছিল সাতজনের মধ্যে একজন মাত্র ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়ামের ডলার পরিমানটা লিখেছে। ৫৫ শতাংশ ৩০০ ডলার লিখে দিয়েছে। নিচে একটা পাই চার্টে ঐ পরীক্ষার রেসাল্ট এবং একইসাথে রেসপন্সের সময়টাও বার চার্ট দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া আছে। এটার দিকে একটু তাকালেই বোঝা যায় কতভাগ মানুষ আসলেই চিন্তা ভাবনা করে উত্তর করেছে, কতভাগ করেনি!



এখানে মনে হতে পারে, স্বতস্ফূর্তভাবে দাম লেখার সংখ্যা যেহেতু বেশি, তাই এটিই বেশি লাভজনক। আপাত দৃষ্টিতে এটা ঠিক। কারণ একক ব্যক্তির জন্যে হেড-টু-হেড ডিসিশনের ক্ষেত্রে সহযোগিতার চাইতে স্বার্থপরতা অনেক সময় বেশি সাফল্য এনে দেয়। কিন্তু একের অধিক খেলোয়াড়, যারা পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত একজন আরেকজনের প্রতি, যেমনঃ একটা গোষ্ঠী বা অনেক মানুষের কথা চিন্তা করা হলে, তখন সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ বা ‘ন্যাশ সাম্যাবস্থা’ই আমাদেরকে অধিক লাভের দিকে নিয়ে যায়। এখানে অধিক লাভ শুধুমাত্র একক ব্যক্তিস্বার্থের জন্যে ঘটে, এমন নয়। সিস্টেমে সকলের জন্যে তা মঙ্গলজনক হবে। এটাই ‘গেম থিওরি’র মূলকথা। ধ্রুপদী অর্থনীতিতে যেমন সবসময় পরিপূর্ণভাবে স্বার্থবাদী চিন্তা করা হয়, ‘গেম থিওরি’তে তা করা হয় না। ‘গেম থিওরি’ আমাদেরকে ‘বাউন্ডেডলি র‍্যাশনাল’ চিন্তা করতে শেখায়। কারণ, ট্রাভেলারস ডিলেমা থেকে আমরা দেখেছি দু’জন মানুষ নিজেদের সেরাটা দিয়ে চিন্তা করেও সব থেকে ভালো পরিস্থিতিতে পৌঁছাতে পারছেন না। এখানে মানুষের চিন্তাজগৎতে আমূল পরিবর্তন ঘটায় ‘গেম থিওরি’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার মাধ্যমে সর্বোচ্চ বুদ্ধি খরচ করে যে সিদ্ধান্তটি নেব, তা আমাদেরকে যে অভীষ্ট লক্ষ্য পোঁছে দেবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এই সহজ সত্যটা এই যুগে ক’জন বোঝে!
তথ্যসূত্রঃ
১। THE TRAVELER’S By Kaushik Basu
২। A Survey of Game Theory as Applied to Network Security by Sankardas Roy, Charles Ellis, Sajjan Shiva, Dipankar Dasgupta, Vivek Shandilya, Qishi Wu
৩। Game Theory Through Examples by Erich Prisner

ধর্মালয় নয়, প্রয়োজন মানবালয়…

লিখেছেন: সুমন চৌকিদার।
প্রাতঃস্মরণীয় কবিগুরুর কয়েকটি বাক্য:
“…আমাদের জাতি যেমন সত্যকে অবহেলা করে, এমন আর কোনো জাতি করে কি না জানি না। আমরা মিথ্যাকে মিথ্যা বলিয়া অনুভব করি না। মিথ্যা আমাদের পক্ষে অতিশয় সহজ স্বাভাবিক হইয়া গিয়াছে। আমরা অতি গুরুতর এবং অতি সামান্য বিষয়েও অকাতরে মিথ্যা বলি। … আমরা ছেলেদের সযত্নে ক খ শেখাই, কিন্তু সত্যপ্রিয়তা শেখাই না– তাহাদের একটি ইংরাজি শব্দের বানান ভুল দেখিলে আমাদের মাথায় বজ্রাঘাত হয়, কিন্তু তাহাদের প্রতিদিবসের সহস্র ক্ষুদ্র মিথ্যাচরণ দেখিয়া বিশেষ আশ্চর্য বোধ করি না। …তাহাদের সাক্ষাতে মিথ্যাকথা বলি ও স্পষ্টত তাহাদিগকে মিথ্যাকথা বলিতে শিক্ষা দিই। আমরা মিথ্যাবাদী বলিয়াই তো এত ভীরু! এবং ভীরু বলিয়াই এমন মিথ্যাবাদী। …স্পষ্ট করিয়া সত্য বলিতে পারি না বলিয়া আমরা এত হীন। …মিথ্যা আমাদের গলায় বাধে না বলিয়াই আমরা এত হীন। সত্য জানিয়া আমরা সত্যানুষ্ঠান করিতে পারি না বলিয়াই আমরা এত হীন। পাছে সত্যের দ্বারা আমাদের তিলার্ধমাত্র অনিষ্ট হয় এই ভয়েই আমরা মরিয়া আছি।”
যে দেশে সত্যের চর্চা নেই, সেখানে সত্যবাদিতা আশা করা বোকামি। সত্য বন্দি বলেই আমাদের হৃদয় বাড়ে না বরং সংকুচিত হয়। ধর্মশিক্ষার অবস্থাও তাই। কারণ ধর্ম সত্য প্রকাশে বাধা দেয়। কুসংস্কারগুলো ধামাচাপা দেয় বলেই সমাজে এর কোনো সুফল নেই। অর্থাৎ ধর্মের যেটুকু ভালো, সেটুকুর প্রভাবও এখন মানুষের উপর নেই।
লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি যতোটা চলে তারচেয়ে বেশি শব্দ করে। ধর্মও যতোটা না মানুষের উপকারে লাগে, তারচেয়ে বহুগুণ এবং অবিরতভাবে হৈচৈ-চেঁচামেচি করে জানান দেয়! অর্থাৎ উম্মাদনা সৃষ্টি, চেঁচিয়ে, দাপিয়ে, ধমকিয়ে দেখানে ও শেখানো, গোল বাঁধানো, গ্যালন গ্যালন অ্যালকোহল পান করানো…। সবকিছুতেই ঝনঝন, ঠনঠন, ঝরঝর, কড়কড়, ধরমার… শব্দ। কুফলগুলো বোঝাতে চাইলেও গোল বাঁধে। তবে এসব মোটেও অযথা নয়। ফলে ধর্মের ভয়ে সকলেই ভীত। যারা মানে না, তারাও! কারণ প্রাণের চেয়ে বড় কিছুই হতে পারে না।
শতকোটি মুখ থেকে একযোগে সহস্রকোটি প্রশংসা গ্রহণ যার প্রধান লালসা, না পাইলেই অভিশাপ। এক ইঞ্চিও ছাড় নয়, পুরোটাই চাই, না হলে কঠিন শাস্তি। এ ভয়ে মানুষ সৎ হোক বা না হোক, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই; ওর চাই প্রশংসা, আদার, সম্মান, সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান… কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। ত্যাগ করাও চলবে না। যদিও পরিসংখ্যান করলে দেখা যাবে- ধর্মের কারণে মানুষ সৎ হওয়ার গতি অত্যন্ত নিম্নমুখী। সততা নিম্নমুখী হলেও, ধর্মের গতিবেগ শুধু উর্দ্ধমুখীই নয়, আলোর গতিকেও হার মানিয়েছে! ধর্মের চলা, বলা, প্রচার-প্রসার, চিৎকার, চেঁচামেচি, শোরগোল… এতোটাই বিকট যে, কে কী প্রচার করছে বা বলছে, কাকে ডাকছে… প্রায়ই বোঝা যায় না। গলার শিরদ্বারা ফুলিয়ে চিৎকারের অর্থ বোঝা প্রায় অসম্ভব হলেও, ধার্মিকরা নাকি বোঝেন! আসলে কাজের কাজ কিছুই না। কী শুনলো, কী বুঝলো এসবের গুরুত্ব নেই, যেন শেখানো মন্ত্র প্রথামত কোটিকণ্ঠে চেঁচিয়ে যাওয়াই পূণ্যি।
অথচ ধর্ম পালন ও শেখাই মানুষের প্রধান কর্তব্য নয়। নিজেকে জানাই প্রধান। নিজেকে জানলে, অদৃশ্য-কাল্পনিক ঈশ্বর নামক কোনো জীবের কাছে মাথা নত করার প্রয়োজন নেই। নিজেই ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সবকিছু উপলব্ধি করতে পারেন। ফলে তিনি কারো ক্ষতি করেন না, অসৎ উপায়ে ধন-সম্পদ বা চুরি-ডাকাতি, ঘুষ-দুর্নীতি… করেন না। কোনোকিছুর কাছে আত্মসমর্পণও করেন না। বিপদে দুর্বল হয়ে কাতর কণ্ঠে কাউকে ডাকেন না। হে ঈশ্বর, হে ঈশ্বর, গুণা/পাপ মাফ কর বলে চিৎকার বা কান্নাকাটিও করেন না, পরকালে (থাকলেও) মহাসুখের আশাও করেন না…। অর্থাৎ কথিত ঈশ্বর খুঁজতে হয় না, বরং ঈশ্বরই (যদি থাকে) তাকে খুঁজবে। কারণ এরূপ হৃদয়ে যে প্রীতি, ভক্তি, দয়ামায়া, স্নেহ-ভালোবাসা, সৌন্দর্য… আছে তা অনন্ত। সেই অনন্তকে যে একবার হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন, তিনিই সফল এবং প্রকৃত মানুষ। অথচ মানুষ ঈশ্বর খুঁজছে ধর্মালয়ে, গৃহের কোণায়, গয়া-কাশি, বৃন্দাবন, মক্কা-মদিনায়…! বিদ্বানরা বলেন, সত্যই সীমা, সত্যই নিয়ম, সত্যের দ্বারাই সবকিছু প্রকাশিত। সত্যের ব্যতিক্রম হলেই সব উচ্ছৃঙ্খল। সত্যের অভাবেই ধর্ম লোকদেখানো পালনীয় অভ্যাসে পরিণত। অথচ কোনোকিছুই পালন করলেই হবে না, অন্তরে লালন/ধারণ করতে হবে। যদিও পালন করা সহজ কিন্তু লালন করা অত্যন্ত কঠিন। তবে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি- কঠিনকে নয়, সহজকেই গ্রহণ করা। তাই অধিকাংশই কঠিন মানবিক মূল্যবোধের পরিবর্তে সহজ ধর্মকেই বেছে নিয়েছে। অথচ ঈশ্বরদের প্রয়োজন মানুষের নেই, বরং ঈশ্বরদেরই মানুষের প্রয়োজন! কারণ মানুষ না বাঁচলে, কথিত একটা ঈশ্বরও বাঁচবে না। তাই হয়তো শতকরা ৯৯ ভাগ অসৎ মানুষ (বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের) দেখেও ঈশ্বরেরা কেউই আর (কথিত ওল্ডস্টেটামেন্ট অনুযায়ী) মহাপ্লাবন কিংবা অগ্নিবর্ষণ করে মানুষ ধ্বংস করছে না। বরং আরো অসৎ জন্ম দিচ্ছে। অন্যদিকে দেবতারা স্বর্গে কৃষ্ণলীলায় ব্যস্ত, ব্র‏হ্মাস্ত্র নিয়ে অসুরদের উপর আর ঝাপিয়ে পড়ে না। হয়তো রাজনীতিবিদদের ন্যায় ঈশ্বরেরাও মানুষকে অন্যায় করার সুযোগ দিয়ে দল টিকেয়ে রাখতে এবং অনুসারী বাড়াতে ব্যস্ত! কারণ, অন্যায় করার সুবিধা না দিলে, দল ভেঙ্গে যাবে যে!
প্রতিটি ধর্মই মারাত্মকভাবে শ্রেষ্ঠত্ব ও অহংবোধে আক্রান্ত। অংহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরার ফলেই মানবতাবোধ থেকে অনেকাংশেই বিচ্যুত। অহংবোধের কারণেই বিধর্মীদের ঈশ্বরের সন্তান ভাবতে পারে না। এমনকি একই ধর্মানুসারী হয়েও নিজেদের মধ্যে ঘৃণা, বিভেদ, বৈষম্য চরমে। অথচ মানুষ এসব বোঝে না; না বোঝাটাও অংহকারের ফল। কারণ প্রচণ্ড অহংকারে আক্রান্ত ও আলো থেকে বিচ্যুত এবং জন্মান্ধ ধর্মের আলোতে আসার ও ভুল-ক্রুটি স্বীকারের সাহস নেই। সুতরাং যা অহংবোধে ভরা, তা সত্য নয় বরং মিথ্যা, নোংরা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অথচ এটাই পুরো মানবজাতিকে কৌশলে অহংকারের বিষপান করিয়ে মানসিকভাবে পঙ্গু করে রেখেছে।
ধর্মান্ধ বলেই মানুষ মানবতার চেয়ে ধর্মকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য এবং মানবতাকে ধর্মের নিয়মে বেঁধে রেখেছে। কারণ ধর্মকে বড় করে দেখার অর্থই মানবতাকে ছোট করা। মানবতাকে ছোট করা মানেই, মনুষ্যত্বকে বলি দেয়া। মানুষ যেমনিভাবে প্রতিদিন চিরঅভ্যস্ত ও প্রথামত ঈশ্বরকে ডাকে, তেমনি রাগ, হিংসা, লোভ করে; মোহে পড়ে, ঘুষ-দুর্নীতি, মিথ্যাচার করে…। অথচ ধর্মকর্ম তথা বিধিব্যবস্থার তিলমাত্র ত্রুটি করে না এবং যতোই যুক্তিপূর্ণ হোক, ধর্মের বিপক্ষে যায় এমন কিছু সহ্য করে না! এসব কী আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়তই দেখছি না? নাকি মানুষ লাগমহীন দুর্নীতি করুক, মিথ্যা বলুক, ঠকবাজ হোক… ক্ষতি নেই, ধর্ম পালন করলেই হলো, অর্থাৎ এতেই ধর্মের সন্তুষ্টি? সুতরাং একই সাথে ধার্মিকতা ও দুর্নীতির মহামারী দেখে মনে হয়- মানব জীবনে ধর্মের প্রয়োজন শুধু ধার্মিক হবার জন্য; মানুষ হবার জন্য নয়। কেননা, মানুষ হওয়ার জন্য মনের পবিত্রতা ও দৃঢ়তাই যথেষ্ট। না হলে, প্রায় শতভাগ ধার্মিকের এই দেশ হতো- পৃথিবীর স্বর্গ!
সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, লোভ ও লাভের মহড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ধর্মের ঢাক পিটানো দেখে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক, সৎ হওয়ার জন্য নয়; নিষ্ঠুর ঈশ্বর ভীতির কারণেই মানুষ ধর্মকর্ম করে। ধর্ম যদি গুণা/পাপের তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা রাখতো এবং কার্যকরি ও চাক্ষুস প্রয়োগ থাকতো, তাহলে এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতাম না, বরং খুশি হতাম। কিন্তু এতো নৈতিকহীনতা সত্ত্বেও, ধর্ম স্বমহিমায় টিকেই শুধু নয়, বরং দিনদিনই আরো হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে। তাই মনে হয়, মানবজাতির দুর্ভোগ কোনোদিনও যাবে না বরং বাড়বে।
পূর্বেও বলেছি, ধর্মই একমাত্র বিষয়, যা সঠিকভাবে না পড়ে, না বুঝে… খাঁটি(!) ধার্মিক হওয়া ও থাকা সম্ভব। ফলে ধার্মিকের চিত্ত যে অতিসংকীর্ণ বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকে, যা জানতে/বুঝতে পারেন না। সঠিকভাবে না জানাটা অন্যায় নয়, তবে জানার চেষ্টা না করা অবশ্যই অন্যায়। সুতরাং ধর্মকে সঠিকভাবে জানা সমস্ত মানবজাতির জন্য অত্যন্ত জরুরি ও মঙ্গলজনক। অথচ ধর্ম মস্তবড় উপকারী, এ ছাড়া মানবজাতির উপায় নেই… সর্বক্ষণ এবং জোরালোভাবে চারিদিক থেকেই শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ধর্মের গুণগান একমুহূর্তের জন্য থামালেই মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে! ফলে ধর্মের নেশায় নেশাগ্রস্ত ও বিভোর মানুষগুলো একে অত্যন্ত উদার ও অত্যাবশ্যকীয় বলে প্রচার করছে। এসব মিথ্যা প্রচার একেবারে নির্মূল করতে না পারলে, সত্যের মৃত্যু ঘটতেই থাকবে।
ধর্মই মানবজাতির রক্ষক ও উন্নতির সোপান হলে ধর্মহীন ব্যক্তি ও জাতির কেনো এতো উন্নতি হচ্ছে? ধার্মিক ব্যক্তি ও জাতিগুলোরই বা এতো অবনতি কেনো? সন্দেহ নেই কথিত ধর্মে আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ, মহান… এ অহংবোধর মধ্যে কী হীনতা, শঠতা নেই? কারণ ধর্মের কী ক্ষতি হচ্ছে, কে করেছে, কেনো করেছে… এসব বিষয়ে সদাসতর্ক কিন্তু মনের দুর্দশার প্রতি কোনো খেয়াল নেই। ভেবে দেখি না, বিধর্মী বা ধর্মহীন জাতির মধ্যে এমন কী গুণ আছে, যার ফলে সেখানে প্রায় সব মহান বিজ্ঞানী, মাহান দার্শনিক জন্মাচ্ছে… অথচ ধার্মিক জাতিগুলোর মধ্যে উল্লেখ করার মতো মানুষ জন্মাচ্ছে না কেনো? কী এমন গুরুতর দোষ-ত্রুটির কারণে ধর্মরাষ্ট্রগুলোতে বেশিরভাগই স্বার্থপর, মিথ্যাবাদি, অহংকারী, লোভী, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, লুটেরা, ধর্মদানব… সৃষ্টি/জন্ম নিচ্ছে? এসব ভেবে দেখলে ও পরিবর্তনের চেষ্টা করলে জাতি উপকৃত হবে। তাছাড়া আমার ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ, অন্যেরটা মন্দ, বারবার, যখন-তখন এরূপ মিথ্যাচারে কোনো সুফল আনতে পারে না। যা প্রমাণিত সত্য।
সবচেয়ে অবাক ও ভয়ানক, এসব কেউ বোঝাতে চাইলেও ধার্মিকরা বুঝতে চায় না। ভয়ানক এজন্যই, যদি কেউ শিশুকালে ধর্মশিক্ষায় সন্ত্রাসী হওয়ার মন্ত্র পেয়ে থাকে, তাহলে তাকে দিয়ে যেকোনো নৃশংস্য হত্যাকাণ্ড/খারাপ কাজ করিয়ে নেয়া সম্ভব। কেননা ধর্মের বিভ্রান্তিকর শিক্ষার কারণেই- কারো চিত্ত বিকৃত, কারোটা জটিল, কারোটা অত্যন্ত জটিল; অনেকের সহজ-সরল হলেও, যতোটা হওয়ার কথা, ধর্ম কাউকেই ততোটা হতে দেয় না। কারণ হৃদয়কে সংকীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ রাখাই ধর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য। গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে না যাওয়ার জন্য দিবারাত্র সতর্ক ও ভয়ানক ভীতি প্রদর্শন আমৃত্যুই চলতে থাকে। অর্থাৎ ধর্ম মানব চিত্তের স্বাধীনতা দেওয়ার মতো উদার নয়। সেজন্যই ধর্মে-ধর্মে এমনকি একই ধর্মের মধ্যেও এতো মতপার্থক্য এবং বনিবনা হয় না। হতেই পারে না। কেননা যে শিক্ষা/অভ্যাস পড়ে-জেন-বুঝে নয়, বরং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া; যার আদর্শ/লক্ষ্য/উদ্দেশ্য মাপার/বোঝার… পূর্বে নিজের অজান্তেই গড়ে ওঠেছে, যে শিক্ষার মধ্যে ভালোর চেয়ে মন্দ মোটেও কম নয় বরং বেশি (কুসংস্কার, কুপ্রথা, ঘৃণা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা-পরনিন্দা, গরিমা, হুমকি, লোভ, শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার, বাড়াবাড়ি… ইত্যাদি)। অর্থাৎ যে অভ্যাস বাইরে থেকে চাপানো, চিত্ত তা গ্রহণ করে কেবল মঙ্গলজনক কাজে ব্যবহার করবে, না চাইলেও ভুল পথে পরিচালিত করবে না, কিংবা পরিচালিত করার মানসিকতায় প্রস্থত রাখবে না, এর গ্যারান্টি কোথায়?
কারণ সংশয়ের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত না হলে সুশিক্ষা সম্ভব না। যে ছাত্রটি বেশি প্রশ্ন করে, তার শিক্ষা আর প্রশ্নহীন ছাত্রটির শিক্ষার মান এক নয়। পৃথিবীর প্রায় সব বিষয়কেই প্রশ্নের সম্মুখীন এবং সত্য-মিথ্যার প্রমাণ দিতে হলেও, ধর্মশিক্ষায় যা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য ও নিষিদ্ধ। একমাত্র ধর্মের ব্যাপারে এহেন একচোখা নিয়ম, আইন, আচরণ তথা প্রশ্নহীন বিশ্বাসই মানবজাতির সবচেয়ে বড় বোকামি। অথচ এরূপ বোকামিকে মহৎ বলতে ও ভাবতে মানুষের দ্বিধা নেই বরং গর্ব আছে। ভাবখানা এমন- ধর্মে স্বোচ্ছাচারিতা বা ভুলভ্রান্তি আছে থাক না। খোঁজ-খবর বা পড়াশেনার দরকার কী? হোক না এ নিয়ে- বিতর্ক, হিংসা-বিদ্বেষ, অংহকার, লুটপাট, ধর্ষণ, পাশবিকতা, বিকৃত রুচির ও ভয়ংকরতম হত্যাযজ্ঞসহ নানা প্রলোভন, ভয়ভীতি, রক্তাক্ত যুদ্ধ-দাঙ্গা… (যেন এসব ধর্মের অঙ্গ)। দুঃখের বিষয়, এরূপ চিরবিবাদের পরেও তা আন্তর্জাকিতভাবে স্বীকৃত এবং কিচ্ছুটি বলা চলবে না; মহাকাশে তুলে রাখতেই হবে। বুঝলাম, কারো বিশ্বাসে হাত দেয়া উচিত নয়, কিন্তু যখন তা অবিরতভাবে মানবতায় আঘাত করে (শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও), একটি পবিত্র শিশুকে অপবিত্র তথা অহংকারী করে তোলে, ঘৃণা কিংবা নিজেকে শ্রেষ্ঠ এবং বিধর্মীদের খারাপ বা ছোট ভাবতে শেখায়… তথাপিও চুপ থাকতে হবে! এ কেমন আইন!
ক্ষমা করবেন, নিজে বোকা হলেও, ধর্মের প্রতি এরূপ একপেশে ও অন্ধ সমর্থনের জন্য পুরো মানবজাতিকেই দায়ী করছি! কারণ, সর্ববিষয়েই মানবজাতির অন্ধত্ব এবং বোকামির সীমা আছে; ভুল-ভ্রান্তি স্বীকার ও সংশোধনের চেষ্টাও আছে। একমাত্র ধর্মের ব্যাপারে বোকামির সীমা-পরিসীমা নেই। যদিও প্রচুর মানুষ আছে, যারা ধর্মের ভুল-ভ্রান্তি বুঝলেও স্বীকার করতে নারাজ বরং ভুল স্বীকারকে আজন্ম লালিত অংহবোধে আঘাত এবং ধর্মের হীনতা, অগৌরব, অপমান… বলে মনে করেন। অথচ এরা প্রত্যেকেই অন্য ধর্মের প্রচণ্ড সমালোচক (প্রকাশ্যে কম, গোপনেই বেশি)। এর প্রধান কারণ, সামান্যতম অপমান (যুক্তিপূর্ণ হলেও) সহ্য না করার মন-মানসিকতা সৃষ্টির মধ্যেমেই শিশুর ধর্মশিক্ষা শুরু, যা আমৃত্যু হৃদয়ের গভীরে চির অম্লান থাকে। ফলে দেখা যাচ্ছে, ধর্মের ভাগ্য অতি চমৎকার ও বিষ্ময়করই নয়, অতি নিরাপদও বটে। যদিও মানুষের উচিত ধর্মকে প্রশ্রয় না দিয়ে ক্রুশে দেয়া। অথচ ওটাকে কাঠগড়ায় তোলার বদলে তোলা হয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে (তাও নৃশংস্যতম হত্যাকাণ্ডের মতো কিছু ঘটালে)। বলা, ভাবা ও সমর্থন করা হয়- ধর্মের কোনো দোষ নেই, দোষ যা ব্যক্তির বা গোষ্ঠির! অথচ ধর্মই যে আড়ালে থেকে সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, শিক্ষা, আদেশ-নির্দেশ দিচ্ছে… মানুষের এই সামান্য বুদ্ধিটুকুও ধর্ম খেয়ে ফেলেছে! অধম মনে করে, এটাই মানবজাতির চরম ভুল এবং মানবতার চরম আতঙ্ক! যে আতঙ্কে সারাবিশ্ব ত্রাহিত্রাহি। বর্তমান বিশ্বে এতো ভয়ানক অন্য কোনো বিষয় আছে কী? রাজনৈতিক যুদ্ধও বোধকরি এর নৃশংস্যতার কাছে শিশু। প্রশ্ন হলো- ধর্ম কীভাবে বাঁধাহীন, স্বসম্মানে ও নিরাপদে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে? জানি না, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো কেনো ধর্মের উপকার-অপকার, প্রয়োজনীয়তা, আদর্শ-অনাদর্শ… নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না; সমীক্ষা বা পরিসংখ্যান করছে না? যথা, ধর্মের কারণে মানুষ কতোটা সৎ ও আদর্শবান হচ্ছে, পক্ষান্তরে অধার্মিক/নাস্তিকরা কতোটা হচ্ছে? অথবা ধার্মিক জাতির আদর্শ এবং অধার্মিক জাতির আদর্শের তফাৎ কতো? ইত্যাদি। এরূপ পরিসংখ্যান থাকলে, নিশ্চয়ই ধর্মের মুখোশ অনেকটাই উন্মোচিত হতো। এতে ধর্মের/ধার্মিকদের কিছুটা হলেও লজ্জা হতো এবং বাড়াবাড়ি, খুনাখুনি, দরিদ্র-অসহায় জনগণসহ সংখ্যালঘু নির্যাতন ও বিতাড়ন অবশ্যই কমতো।
উদাহরণস্বরূপ, প্রায় সব ধর্মরাষ্ট্রগুলোই প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী, অগণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাচারি, একনায়ক কিংবা স্বৈরশাসক দ্বারা শাসিত। স্পষ্টতই এরা আইনের শাসনের চেয়ে ধর্মের শাসন বেশি পছন্দ করে। ফলে ক্ষমতা ধরে রাখতে কিংবা ক্ষমতায় যেতে, দরিদ্রের উন্নয়নের চেয়ে ধর্মের উন্নয়নকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। যদিও তাদের ক্ষমতার লড়াইয়ের জন্যই বিধর্মীই শুধু নয়, স্বধর্মীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। এরা ধর্ম ব্যবহার করে নানান জঙ্গিগোষ্ঠি সৃষ্টি করা ছাড়াও চিরস্থায়ীভাবে দাঙ্গা লাগিয়ে রাখছে। ফলে (ঘোষিত বা অঘোষিত) প্রায় সব ধর্মরাষ্ট্রগুলোতেই যুদ্ধ-দাঙ্গা, লুটপাট, ধর্ষণসহ বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে এবং হাজার হাজার শরণার্থী সৃষ্টি করছে। অথচ এসব শরণার্থী নিজ দেশে বা নিজ ধর্মের কাছে আশ্রয় না পেয়ে বিধর্মীদের দেশে ছুটছে (রোহিঙ্গা ব্যতিত)। পালাতে গিয়ে সাগরে ডুবে, মরুভূমিতে শুকিয়ে কিংবা বন্তেজঙ্গলে না খেয়ে মরছে। এতে ধার্মিক রাষ্ট্রগুলোর মহাধার্মিক কর্মকর্তাদের যে তেমন মাথাব্যথা নেই, তা বুঝতে আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ এদের প্রধান উদ্দেশ্য ধর্ম বাঁচানো, মানুষ নয়। এরা বিশ্বাস করে- ধর্ম নিয়ে ভাবলেই চলবে, মানুষ নিয়ে মাথাব্যথার বহু বিধর্মী রাষ্ট্র আছে! এরা মহাখুশি যে, মানুষ গোল্লায় যাক আমরা ধর্ম পালন ও রক্ষা করি, ধর্মালয় গড়ি, নিয়মিত-প্রতিদিন এবং বাৎসরিক সব ধর্মানুষ্ঠান করি… সেহেতু, আল্লা/ঈশ্বরেরা (কথিত প্রতিশ্রুতি মতো) অবশ্যই আশির্বাদ করতে বাধ্য! এসব কারণেই তাদেরকে বোকা বলতে এ মূর্খের দ্বিধা নেই। এসব ধর্ম-মদান্ধরা মানুষ মেরে ও তাড়িয়ে ধর্ম পালন করছে। অথচ বিধর্মী দেশগুলো শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে দিতে ক্লান্ত, এদের স্রোত সামাল দিতে প্রচণ্ড হিমশিম খাচ্ছে। অপারগ ও বাধ্য হয়ে নতুন আইন করে থামাতে চাইলেও মানবতার কারণে পারছে না। অথচ ধর্মরাষ্ট্রগুলোকেই শরণার্থীদের সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব যেচেই নেয়া উচিত ছিলো। কারণ অসহায়দের সহয়াতা পরম পূণ্যের কাজ, যা ধর্মেই নির্দেশ আছে। এরপরও ধর্মের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েও লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে আশ্রয় ও অন্ন, বস্ত্রহীন বানিয়েও ধার্মিক হিসেবে এবং নিশ্চিন্তেই আছে।
যদি এর উল্টাটি ঘটতো, অর্থাৎ বিধর্মীরা অত্যাচারিত হয়ে ওইসব ধার্মিক দেশেগুলোতে ঢোকার চেষ্টা করতো, তাহলে কী হতো? উত্তর পাঠকদের জন্য রইলো। আবার এসব শরণার্থীদের মধ্যেও বহু ধার্মিক আছে যারা বিধর্মীদের খেয়েপরে বেঁচে আছে, অথচ তাদের বিরুদ্ধেই মরণ কামড় দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সময় ও সুযোগ বুঝে সাধারণ মানুষগুলোকে নিত্য নতুন কৌশলে কিংবা গাড়িচাপা দিয়ে মরিচবাটা করে ফেলতেও হৃদয় একটুও কাঁপে না বরং সঙ্গে সঙ্গেই গর্বের সাথে স্বীকার করে। কাঁপবেই বা কেনো, এতো যে-সে শিক্ষা নয়, এক্কেবারে খাঁটি ধর্মীয় শিক্ষা! এরাই ধর্ম-মদান্ধ, নিজেদের ভাষায়- ধর্মবীর! কী হিংস্র এদের ধর্মশিক্ষা! এসব স্বধর্মী দানবদের ভয়েই, বেশিরভাগ স্বধর্মী রাষ্ট্র তাদের দরজা চিরতরে বন্ধ রেখেছে। তাদের বর্ডারে গেলে গলাধাক্কা থেকে গুলি পর্যন্ত খেতে হবে জেনেই স্বধর্মীদের দেশে ঢোকার চিন্তাও করে না, বরং দৌঁড়ায় বিধর্মীদের দেশে। কারণ তারা ভালো করেই জানে, স্বর্ধীদের ন্যায় বিধর্মীরা গুলি কেনো, গলাধাক্কাও দেবে না। বরং অনিচ্ছা ও অতিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আশ্রয় দেবেই। এর কারণ তারা ধার্মিক নয়, প্রকৃত মানুষ। কোনো কোনো বিধর্মী দেশ যতোই কড়াকাড়ি করুক, চোখের সামনে মানুষ মরতে দেখলে, আশ্রয় না দিয়ে পারে না। না দিলে, মানবতাবাদি এক্টিভিস্টদের কারণে বাধ্য হয়। এটাই মানবতাবাদিদের প্রকৃত ধর্ম; তারা সাধারণত আইন লঙ্ঘন করে না, কিন্তু মানুষ মরতে দেখলে আইনের তোয়াক্কা করে না। হয়তো বলবেন, ধর্মসন্ত্রাসীরা তো মুষ্টিমেয়। অস্বীকার করছি না, তবে সভ্যতা/মানবতা ধ্বংসের জন্য কয়েকটা দানবই তো যথেষ্ট! যদিও দানবের সংখ্যা কম কিন্তু দানব সৃষ্টির পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচুর সমর্থক ছাড়াও লাদেন অথবা জাকির নায়েকদের মতো ছোট-বড় বহু ধার্মিকই তৎপর! এরা বহু সাধারণ ধার্মিকদের কাছেই ঈশ্বরতুল্য।
বলছি- ধর্ম যদি একটা দানবও বানায়, তাহলে এর দায়িত্ব ধর্মের অর্থাৎ ধার্মিকদেরই। এ দায়িত্ব মানবতাবাদি কিংবা ধর্মহীনরা নেবে কোনো? এমন অভদ্র-অসভ্য যুক্তি মানবেই বা কেনো? কারণ ধর্ম যখন কোনো ভালো কাজ করে, তখন ধার্মিকরা গর্বে হিমালয়ের ন্যায় ফুলে ওঠে, খারাপ কাজ করলে দায় এড়িয়ে যায়, এসব কী অসভ্যতা নয়? কারণ এটাই- ধার্মিকরা ধর্ম বোঝে, মানবতা বোঝে না। আর মানবতাবাদি/নাস্তিকরা মানুষ বোঝে, ধর্ম বোঝে না। এতোকিছুর পরেও ধার্মিকরা কেবল ধর্ম রক্ষা ও বিস্তারের জন্যই উম্মাদ হচ্ছে, মানবতা তথা মানবধর্মের নাম মুখে আনছে না। অতএব প্রশ্ন- কাদের ধর্ম মহৎ, ধার্মিকদের নাকি মানবতাবাদি/নাস্তিকদের?
দেখুন, ধর্ম-মদান্ধদের বোকামি কতোটা প্রবল। কখন, কেথায়, কী বলতে হয়, বুঝেও না। সবকিছুতেই যেমন ধর্মের গন্ধ পায়, তেমনি ধর্মের আলতা লাগায়। যার বহু উদাহরণের মধ্যে (একজন উচ্চপদস্থর) একটি বক্তব্য:- দেবতা চটে যাওয়াতেই কেরলে বন্যা! বিতর্কিত মন্তব্য আরবিআই কর্তার যাহোক প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, যেখানে খুশি, যেমন খুশি ধর্মানুষ্ঠান কিংবা ধর্মালয় তৈরি করতে চাইলে, প্রায় সকলেই খুশি মনে ও বিনা প্রশ্নে জায়গা-জমি, অর্থ-সম্পদ দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মানবাধিকার, সত্যানুষ্ঠান, নৈতিক শিক্ষার… জন্য (বিশেষভাবে ধর্মরাষ্ট্রগুলোতে) একটুখানি জায়গা বা অর্থ চেয়ে দেখুন তো, কতোটুকু পান! অর্থাৎ ঈশ্বরদের অভিশাপের ভয়ে কিংবা অন্ধ মোহের বশে হোক, ধর্মশিক্ষা ও ধর্মানুষ্ঠানের মহামারী চলেছেই। কিন্তু মানবধর্ম শিক্ষায় আগ্রহ নেই। ফলে প্রচণ্ড যানজটের ঢাকা শহরে রাজপথ আটকে ধর্মানুষ্ঠান করলে মানুষ বিরক্ত হয় না বরং খুশিই হয়। আবার অনেক ধর্মালয়ই রাজপথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। জনগণের যতো অসুবিধাই হোক, ধর্মালয় ভেঙ্গে রাস্তা প্রশস্ত করা যাবে না; ধর্মানুষ্ঠান চলতে দিতেই হবে, বরং যেখানে খুশি, যেভাবে খুশি নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে ওসব করা/গড়া যাবে! অর্থাৎ মানুষের চলাচলের স্বাধীনতা যতোই বাঁধাগ্রস্ত হোক, ধর্মের স্বেচ্ছাচারিতায় হাত দেয়া চলবে না। অনিয়ন্ত্রিতভাবে ধর্মালয় গড়ে উঠুক প্রতিবাদ করাও যাবে না। প্রতিবাদীদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে খুনসহ দেশ ছাড়া ও নাস্তানাবুদ করতেও ধর্মের জুরি নেই (যাতে রাষ্ট্রসহ প্রায় সকলেরই সমর্থন থাকে)।
ধর্মের এরূপ বহু স্বেচ্ছাচারিতার জন্য দায়ী- পরিবার, সমাজ এবং ঘোষিত-অঘোষিত ধর্মরাষ্ট্রগুলো। এসব রাষ্ট্রের প্রায় সব সাধারণ মানুষ এবং কর্ণধারেরা ধার্মিক হলেও, দৈন্যতা এবং পরস্পরের প্রতি বৈরিতায় পৃথিবীর সেরা। ফলে তারা বারবার এবং চিরপ্রথা/অভ্যাসমতে একই ধর্মানুষ্ঠানের আয়োজন এবং ধর্মালয় তৈরির চেয়ে মহৎ ও জনহিতকর কাজ খুঁজে পায় না! ধর্মালয় তৈরি ও ধর্মানুষ্ঠানের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচকে হতদরিদ্রদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের… স্থায়ী ব্যবস্থার চেয়েও মহা পূণ্যের কাজ বলে মনে করে (যদিও দান-খয়রাত যৎসামন্য করে)। পাতলা ডাল ও শাক ভাত খাওয়া হাড়জিরজিরে এতিম বাচ্চাদের ধর্মশিক্ষা দেয়াই যেন মহৎ কাজ! অথচ এতিমখানার কর্ণধারদের ভুড়ি দেখলে মনে হবে- হাইব্রিড কোনো দৌত্য! অনেক দেশ (স্বধর্মী) অন্য দেশকেও ধর্মালয় তৈরিতে দান করে, অনুপ্রেরণা যোগায়…। মনে হয় যেন, একমাত্র ধর্ম বিস্তার, রক্ষা, প্রচার… করলেই মানুষ সৎ ও নীতিবান হবে ও থাকবে, অন্যথায় গোল্লায় যাবে। অথচ বাস্তব ফলাফল (ধর্ম পালনে মানুষ কতোটা সৎ হচ্ছে) কখনো পরিসংখ্যান করে না, আমলেই নেয় না। তাছাড়া এসব ধার্মিকদের চরিত্র, আচার-ব্যবহার বিশ্লেষণ করলে, হয়তো যে ফল প্রকাশ পাবে, তাতে বোধকরি কথিত ঈশ্বর/আল্লাও কেঁপে উঠবে! যাহোক, এসবে ধর্মের কী উপকার হয় জানি না, তবে মানবতার যে চরম সর্বনাশ, সেটা স্পষ্ট।
ধর্মকে আঘত দূরে থাক, সামান্য কটুকথা বললেই ধার্মিকদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। এ নষ্টানুভূতি আবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার স্বীকৃত! যা অত্যন্ত দুঃখজনকই নয়, চরম হতাশার এবং ভয়ংকরও বটে। মনে হচ্ছে, ধর্ম ব্যবহার করে মানুষ হত্যায় যে অন্যায় হয়, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি অন্যায় এর সমালোচনায়। ধার্মিকরা যে ধর্মই বোঝে, মানবতা বোঝে না, এর বহু উদাহরণের দু’টি:- প্রথমত: ১১/০৯/২০০১ থেকে ১১/০৯/২০১৮) পর্যন্ত (১৭ বছরে) ৩৩,৭৮৩টি রক্তাক্ত ধর্ম সন্ত্রাস (যা চলমান ও প্রতিদিনই বাড়ছে)। অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছর প্রায় ২,০০০টি, প্রতি মাসে প্রায় ১৬৬টি এবং প্রতিদিন প্রায় ৬টি হামলা। এরপরও ধর্ম কীভাবে এর দায় এড়িয়ে যাচ্ছে বোধগম্য নয়। এমন বেহায়া এ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি থাকলে দেখান। কারণ ধর্মের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কী, কেনো, কারণই বা কী… ইত্যাদি প্রশ্নগুলো যেমন নিজেরা করেন না, তেমনি শিশুর হার্ডডিস্ক থেকে চিরতরে মুছে ফেলা হয়। ফলে অন্য সব বিষয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহ থাকলেও, ধর্মবিষয়ে আজীবনের তরে মূক ও বধির। এভাবেই মানুষ চিরজীবনের তরে ধর্মের গোলাম হয়ে যায়। আর এ গোলামি থেকে বের হওয়া যে কতোটা কঠিন, কতোটা বিপজ্জনক, তা ধর্ম পরিত্যাগকারী ছাড়া কেউ বুঝবে না। তবে বের হতে পারলে, আত্মার যে প্রকৃত মুক্তি মেলে, তা কথিত স্বর্গপ্রাপ্তির চেয়েও অনেক বেশি আনন্দদায়ক।
দ্বিতীয়ত: বিধর্মী দূরে থাক, নিজের মিথ্যা অহংকার ও অস্তিত্ব রক্ষায় এরা স্বধর্মীদেরও ছাড়ে না। না হলে, ২৫ বছরে সোয়া কোটি স্বধর্মী খুন! এর কারণ ধর্মের অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো ধর্মযুদ্ধের ইতিহাস। ধর্মের নেশার সাথে যুদ্ধের নেশা ও অহংকারেও মানুষ পূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ ধর্মের ইতিহাসের একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে যুদ্ধ-দাঙ্গা-দখলবাজির ইতিহাস। ফলে ধর্ম ছাড়াও এরা অতি সামান্য বিষয় নিয়েও যুদ্ধ করতেই যেন ভালোবাসে।
এবার মূল প্রশ্ন- যে দেশে যতোবেশি ধর্মালয় এবং ধর্মকর্ম, সেই দেশের মানুষ কী ততোবেশি সৎ? ধর্মের কারণে কী দেশের মানুষ দ্রুতগতিতে সৎ হচ্ছে? দুর্নীতি, ঘুষ, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নাস্তিক হত্যা, ধর্ষণ, ঘৃণা, হিংসা-বিদ্বেষ, রাগ-ক্ষোভ, মিথ্যাচার… এসব কী কমে যাচ্ছে? নাকি এর উল্টাই হচ্ছে? না হলে, জনগণের অর্থে (বিধর্মীদের অর্থসহ) ৫৬০টি ‘মডেল’ মসজিদ তৈরি করা হচ্ছে কেনো? যে দেশের মানুষ ধর্মশিক্ষা করে সৎ হয়, সেদেশে ৫৬০টি নয়, ৫৬০ লক্ষ ধর্মালয় বানালেও খুশি হতাম। প্রয়োজনে ধর্মের গুণগানে রাস্তায় নামতাম। কিন্তু যে দেশে প্রতি পাড়ায় গড়ে ৪/৫টির অধিক ধর্মালয় (সংখ্যালঘু বাদে), সেই দেশে আরো ধর্মালয়ের প্রয়োজনে কোনো? বাস্তবে কী দেখছি! যতো ধর্মালয়, ততো মতভেদ, বিবাদ, ক্ষমতা ও অর্থের লড়াই… নয় কী? কোনো একটি ধর্মালয় আছে কী, যেখানে নোংরা পলিটিক্স নেই? ধর্মালয়, মাজার/দরগা/আশ্রম/দেবালয়… এসব দখলে রাখতে, হাতাহাতি থেকে মামলা-মোকদ্দমাসহ খুনাখুনি কী হচ্ছে না? এছাড়া, ক্ষমতা ও অর্থের লোভে এক ধর্মজীবি অন্য ধর্মজীবিকে হেয় করতে (প্রকাশ্য বা গোপন) যে কুটচাল চালছে, হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, তা কী কারো অজানা? তাহলে কীভাবে ও কেনো আশা করছেন- যতো ধর্মালয়, ততো সৎ মানুষ?
আরো প্রশ্ন- বর্তমানের লক্ষ লক্ষ ধর্মালয়গুলো কী মডেল বা আদর্শের নয়? তাহলে, হাজার হাজার বছর ধরে এগুলো কী- অনাদর্শ, অসততা, প্রলোভন, ঘৃণা, হিংসা, অহংকার, কুশিক্ষা, সন্ত্রাসের… শিক্ষা দিয়ে আসছে? এগুলো সব মানদণ্ডহীন বলেই কী দুর্নীতি কমছে না বরং বাড়ছেই? ‘মডেল মসজিদ’বানালে কী এসব বন্ধ হবে বা কমে যাবে? যদি মডেল মসজিদ বানিয়েও বাঙালিদের সৎ বানাতে ব্যর্থ হন, তাহলে- কী করবেন? আরো নতুন নতুন মহা-মডেল মসজিদ বানাতেই থাকবেন? অধমের মনে হচ্ছে- আপনারা ধর্মকে আদর্শ বানাতে মরিয়া, মানুষকে নয়! মানুষ যেহেতু অভ্যাসের দাস, সেহেতু হাজার হাজার বছরের অভ্যাস ছাড়াতে, হাজার হাজার ‘মডেল মসজিদ’ বানালেও হবে না। কারণ মানুষ যেমন ধর্মে শতভাগ অভ্যস্ত; দুর্নীতিতে তারচেয়ে একটুও কম অভ্যস্ত নয়।
গ্যারান্টি দিয়ে বলছি- ধর্ম পালন করে মানুষ ধার্মিক হতে পারে, সৎ হতে পারে না! যদি হতো, তাহলে ধার্মিকরাষ্ট্রগুলো প্রতিটিই বিশ্বের মডেল হতো! কিন্তু… হায়!!! তাই বলছি- মানুষকে আদর্শবান বানাতে হলে, কোন ধর্মালয়েরই প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার পরিবর্তন। অর্থাৎ ধর্ম নয়, সর্বপ্রথমেই শিশুকে নৈকিতকতা তথা মানবিক (মানুষের প্রকৃত ধর্ম) শিক্ষা দিতে হবে। জানি, একথা শুনে ধার্মিকদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে- ধর্ম গেলো, খেয়ে ফেললো… বলে চিৎকার করছেন! ভাবছেন, গর্দভটা বলে কী? ধর্মের পরিবর্ততে মানবিকতা শিক্ষা! হ্যাঁ, বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে দেখুন, ধর্মকে কোথায় নামিয়েছে, আর মানবিকতাকে কোথায় উঠিয়েছে! যে কারণে, মূল্যবান জিনিসপত্র হারিয়ে গেলেও থানায় কিংবা নির্দিষ্ট স্থান থেকে বেশিরভাগই খুঁজে পাওয়া যায়। আর আমাদের দেশে, হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া আর আকাশের চাঁদ পাওয়া একই কথা (ব্যতিক্রম থাকতেই পারে)! এমনকি চোরাকারবারিদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত/জব্দকৃত মালামাল, খাদ্যগুদাম থেকে খাদ্য, কয়লা, ব্যাংক থেকে অর্থ এবং স্বর্ণও গায়েব চলছেই। যদি আরো প্রমাণ চান, তাহলে তাদের দেশের পরিসংখ্যান দেখুন, কতো পার্সেন্ট ধার্মিক এবং কতো পার্সেন্ট সৎ। আর আমরা ধার্মিকতায় প্রায় শতভাগ হলেও কতো পার্সেন্ট সৎ, নির্লোভ ইত্যাদি।
দয়া করে বুঝতে চেষ্টা করুন, নাগরিকদেরকে আদর্শবান বানানোর জন্য ধর্মের উপর এতো অন্ধ এবং অকুণ্ঠ সমর্থন ও নির্ভরতা থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি কোনো আলোর গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে? কেনো শত-সহস্র বছর ধরে, আদর্শ মানুষ সৃষ্টিতে ধর্মের চরম ব্যর্থতা ও কার্যকরহীনতা? অতএব, আদর্শ মানুষ তৈরিতে ধর্ম যে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ, তা স্বীকার করাই অতীব মঙ্গলজনক। যা পশ্চিমারা বহু বছর পূর্বেই বুঝেছিলো কিন্তু ধার্মিক রাষ্ট্রগুলো আজে বুঝছে না, যা আপনাদের প্রচেষ্টায় ও কর্মকাণ্ডেই প্রমাণিত! না হলে- সর্বগ্রাসী দুর্নীতির এই দেশে, বাসগৃহের আশেপাশে, যত্রতত্র, এতো ধর্মালয় ও ধর্মশিক্ষার স্কুল-কলেজ… থাকতে কেউ কী আরো ধর্মালয় গড়ে? দেশের এক ইঞ্চি জায়গাও কী বাকি আছে যেখানে ধর্মের প্রচার/সাইবোর্ড/ব্যনার… বিশেষ করে ধর্মীয় বাণী শোনা যায় না? অতএব আর ধর্মালয় নয়, চাই মানবালয় (মানবিক শিক্ষাকেন্দ্র)। কারণ ধর্মের জাতপাত, বিভেদ, ঘৃণা, হিংসা, বৈষম্য… পূর্বেও ছিলো, আজো আছে, চিরদিনই থাকবে… মানবতায় ওসব নেই। ধর্মে যে নীতি-নৈতিকতা একেবারে নেই, তা বলছি না। কিন্তু ওসব তলানিতে পড়ে থাকে। সমাজে এর তেমন প্রয়োগ নেই। বিশেষ করে ধর্মজীবিদের বিচার-সালিশী করার অধিকার এখন আর তেমন নেই। এর কারণও ধর্মজীবিদের প্রতি সাধারণদের অনাস্থা। কারণ তারা যা করে প্রায়ই তা পক্ষপাতদুষ্ট, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই করে। এছাড়া, ধর্মজীবিরা কতো পার্সেন্ট সৎ সেটাও দেখার বিষয়। অধমের মনে হয় ধর্ম ব্যবসার সাথে যুক্তদের মধ্যে ১%ও সৎ আছে কিনা সন্দেহ।
যাহোক, প্রবাদ আছে, “যার হয়, তার নয়তেই (৯) হয়, যার হয় না তার নিরাব্বইতেও (৯৯) হয় না।” এ অধম মনে করে, শত-সহস্র বা কোটিতেও হয় না। তাই বলছি, কোটি কোটি ধর্ম প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেও মানুষ সৎ হবে না, হতে পারে না, হলে যা আছে তাতেই হতো। এর প্রমাণ কী সর্বত্রই অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে না? কোথায় মানুষের সততা! তাছাড়া মানুষকে সৎ বানাতে ধর্মালয় নয়, প্রয়োজন- কঠিন ও কঠোর আইন প্রয়োগ বিশেষ করে স্বচ্ছ বিচার ব্যবস্থা ও কঠিন শাস্তি প্রয়োগ করা। অর্থাৎ ধর্ম বিস্তারে কোনো লাভ নেই, যদি বিচার ব্যবস্থা তথা বিচারক এবং তদন্তকারীরা পাথরের ন্যায় কঠিন সৎ না থাকে। এর প্রমাণ উন্নত বিশ্বের বহু দেশ। যারা কয়েদির অভাবে কারাগার বন্ধ করে দিচ্ছে, আমরা বাড়াচ্ছি। অথচ তাদের সন্তানেরা স্কুলে, কলেজে, পথেঘাটে ধর্ম শিক্ষা পায় না, পায় নৈতিক শিক্ষা আর আমরা পাই ধর্মশিক্ষা! এ দুই শিক্ষার তফাৎ বোধহয় বুদ্ধিমান এ জাতি, আমি মূর্খের চেয়ে কম বোঝেন না। কিন্তু হায়! তবু তালগাছটাই চাই!
কবিগুরুর কথা দিয়েই শেষ করছি:-
“…আমরা যে আগাটায় জল ঢালিতেছি, তাহার গোড়া নাই, নানাবিধ অনুষ্ঠান করিতেছি কিন্তু তাহার মূলে সত্য নাই, এইজন্য ফললাভ হইতেছে না। …আমরা জানি শাস্ত্রেও মিথ্যা আছে, চিরন্তন প্রথার মধ্যেও মিথ্যা আছে, …অনেক সময়ে আমাদের হিতৈষী আত্মীয়েরা মিথ্যাকেই আমাদের যথার্থ হিতজ্ঞান করিয়া জ্ঞানত বা অজ্ঞানত আমাদিগকে মিথ্যা উপদেশ দিয়া থাকেন। ….মন্দ মনে করিয়া ভালোকে দূর করিয়া দিলে দেশের বিশেষ উপকার হয় না, …গোরা ডাকিয়া সিপাই তাড়াইলে, এখন গোরার উৎপাতে দেশছাড়া হইতে হয়! …সত্য সকলের গোড়ায় এবং সত্য সকলের শেষে, আরম্ভে সত্যবীজ রোপণ করিলে শেষে সত্যফল পাওয়া যায়; মিথ্যায় যাহার আরম্ভ মিথ্যায় তাহার শেষ।”
অতএব কবিগুরুর বক্তব্যের মর্মার্থ অনুধাবন করে- ধর্ম নয়, সর্বাগ্রে শিশুর খালি হার্ডডিস্কে সত্যবীজ (মানবধর্ম) রোপণ করাই হোক প্রতিটি মানুষের অঙ্গীকার! নতুবা ধর্মালয় বৃদ্ধিই পেলেও প্রকৃত মানুষ মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হবে!!! কারণ ধর্মের আরম্ভ মিথ্যায়, শেষও মিথ্যায়…! ফলে শিশুকালেই যার হার্ডডিস্ক মিথ্যা দিয়ে ঠাসা হয়, সে আর কোনোদিনও “সত্যের সন্ধান” করে না

Tuesday, October 9, 2018

আলফা α- বিটা β- গামা- γ

লিখেছেন: গাজী ইয়াসিনুল ইসলাম
বিষয়বস্তু- মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
আলফা- যুগে যুগে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারনার পরিবর্তন ও বিভিন্ন বিজ্ঞানীর আবদান।
মহাবিশ্বের উৎপত্তি
বিটা- মহাবিশ্বের ক্রমবিকাশ- নক্ষত্রের জন্ম মৃত্যু পরিনতি এবং গালাক্সীর উৎপত্তি ও গঠন
গামা- পৃথিবীর বিবর্তন, প্রাণের উৎপত্তি ও প্রাণের ইতিহাস

(প্রথম অংশ)
আমরা কোথা থেকে এলাম? এই প্রশ্ন ভাবিয়েছে সব যুগের মানুষকে। সেই আদি বন্য মানুষ থেকে বর্তমান সভ্য মানুষ সবাই চেষ্টা করেছে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে। অনেকেই কল্পনা করেছেন যুক্তি তর্ক ছাড়া, জন্ম দিয়েছেন বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর। কিছু মানুষ তার চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সঠিক ভাবে ভাবতে পেরেছে। এদের বিজ্ঞান মানসিকতার জন্য আজ আমরা বুঝতে শিখেছি সৃষ্টির শুরুতে কী ঘটেছিল, কীভাবে মহাবিশ্ব তার বর্তমান অবস্থায় আসল, প্রাণের ইতিহাস এবং বুদ্ধিমান প্রাণীরা কখন প্রশ্ন করতে শিখল মহাবিশ্ব সম্পর্কে। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের পর থেকে মানুষ নিজেকে রক্ষার জন্যই সর্বদা ব্যস্ত থাকত। এরপর তারা নিজেদের জীবনকে সহজ করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভব করতে থাকে। তারা ভাবতে শুরু করে তাদের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে। দিনের আকাশে সূর্য, রাতের আকাশে চাঁদ ও নক্ষত্ররাজি নিয়ে গঠিত ছিল তাদের মহাবিশ্ব।
সুমেরীয় সভ্যতা ও চন্দ্র পঞ্জিকা :
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ ভূমির (মেসোপটেমিয়া) বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠেছে সভ্যতা। যেমন-সুমেরীয়, ব্যাবিলোনীয়, এসেরিয়ান সভ্যতা। এদের মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা সবচেয়ে পুরাতন। সুমেরিয়ানরা প্রথম চন্দ্র পঞ্জিকা (Lunar Calendar) চালু করে ৩২০০ BCE এর কাছাকাছি সময়ে। তারা দিনের হিসাব রাখত আকাশে চাঁদের আনাগোনার উপর ভিত্তি করে। চাঁদের বারটি চক্র (বারমাস) পূর্ণ হলে ঋতুর পুনারাবৃত্তি হয় (বছর) ।এ হিসাব ফসল লাগানো, আবহাওয়ার পরিবর্তন, নদী ও জলাশয়ে পানির পরিবর্তন বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের অবশ্য কোন ধারণাটি ছিল না যে বছর সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর পূর্ণ ঘূর্ণনের কারণে হয়। এক চন্দ্র মাসে উনত্রিশ এবং অর্ধ দিন (২৯.৫) থাকে। ফলে চন্দ্র বছর হয় (২৯.৫x১২) ৩৫৪ দিনে। যা সৌর বছর থেকে ১১ দিন কম। শত শত বছর ধরে তারা বুঝতে শেখে চন্দ্র মাস হিসাব করলে বছর বা ঋতুর আবর্তণ পূর্ণ হয় না। তারা এ সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েক বছর পরপর একটি অতিরিক্ত মাস যোগ করে বছর পূর্ণ করত। চাঁদের বিভিন্ন দশার সাথে দিন ও মাসের হিসাব রাখা অতি পুরাতন একটি পদ্ধতি।
মিশরীয় সভ্যতাও সৌর পঞ্জিকা :
চন্দ্র বছর ঋতু আবর্তনের সাথে সম্পূর্ণ মিলে না, তা মিশরীয়রাও পর্যবেক্ষণ করে। ২০০০ BCE এর কাছাকাছি সময়ে তারা সৌর পঞ্জিকা চালু করে। তারা খেয়াল করে যে একটি উজ্জ্বল তারা (যাকে আমরা সিরিস (Sirius) বলি) প্রতি বছর একদিন সকালে সূর্যের সাথে সরাসরি মিল রেখে ওঠে। এই দিনকে তারা নতুন বছরের প্রথম দিন ধরে হিসাব শুরু করে। এই নতুন হিসাব তাদের আরো সূক্ষতার সাথে ফসল বোনা ও নীলনদের বন্যার ভবিষৎবানীতে সাহায্য করত। তাদের গণিতও জ্যামিতিতে অসাধারণ দক্ষতা ছিল।
ব্যাবিলোনিয়ান সভ্যতা ও ভবঘুরে নক্ষত্র :
মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনে হাজার বছরের ব্যবধানে দুটি সভ্যতা গড়ে উঠে।এদের বলা হয় আদি (২০০০ BCE-১৬০০ BCE) এবং নব্য (c.৭৫০- c.৫৫০ BCE) ব্যাবিলোনিয়ান সভ্যতা। পৃথিবীর প্রথম লিখিত আইন ‘কোড অফ হামুরাবি (Code of Hammurabi) (c.১৭৯০ BCE)’ আদি ব্যাবিলোনিয়ান সভ্যতার নির্দশন। ঈশতার গেইট (Ishtar Gate), ঝুলন্ত উদ্দ্যান (Hanging Garden) নব্য ব্যাবিলোলিয়ান সভ্যতার নির্দশন।
আদি ব্যাবিলোনিয়ানদের গাণিতিক পদ্ধতি সম্পর্কে ভাল ধারণা ছিল। তারা দিনকে বার এককের দুইটি সেটে হিসাব করত [c.২০০০ –c.১৮০০ BCE মধ্যবর্তী সময়ে]। আপনি ভাবতে পারেন দিনকে হয়তো দশ এককে ভাগ করে হিসাব করা সহজ হত। কিন্তু কেন আমরা বার গুনিতকএককে দিনকে ভাগ করি? এই ভাগ আমরা অর্জন করেছি আদি ব্যাবিলোনিয়ানদের নিকট থেকে। তারা চন্দ্রের বার চক্রের সাথে বছর পরিবর্তনের মিল রেখেই এই হিসাব চালু করেছিল বলে ধারণা করা হয় (Duodecimal Time Reckoning) । যদিও সভ্যতার পর সভ্যতা পার হয়ে গেছে গেছে কিন্তু মূল ধারণা পরিবর্তন হয়নি।
নব্য ব্যাবিলোনিয়ানরা রাতের আকাশকে খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। তারা দেখেছে অন্যান্য তারা থেকে পাঁচটি তারা অনেক বেশী ঘুরাঘুরি করে আকাশ জুড়ে [৭৫০ BCE এর কাছাকাছি সময়ে] । গ্রীকরা এই জ্ঞান ব্যাবিলোনিয়ানদের নিকট থেকে অর্জন করে। গ্রীকরা এই তারার নাম দেয় Planet বা গ্রহ যার আবিধানিক অর্থ হল ভ্রাম্যমাণ তারা। তখন পাঁচটি গ্রহ সম্পর্কে মানুষের ধারনা ছিল। তবে সে সময়কার মানুষের ধারণা ছিল ন যে গ্রহের নিজস্ব আলো নেই।
এনুমা এলিশ (Enuma Elish):
ব্যাবিলোনিয়ান সৃষ্টি সম্পর্কিত পুরাণ এনুমা এলিশ নামে পরিচিত। এনুমা এলিশের বর্ণনা অনুসারে মহাবিশ্বের আবির্ভাব বিশাল আকৃতিহীন বিশৃঙ্খল জলীয় বিস্তার থেকে। এই আদি পতিত জলভূমি থেকে উন্থিত হয় আপসু (Apsu)- স্বাদু পানির দেবতা এবং তিয়ামাত (Tiamat)- লোনাপানির দেবতা। আপসু ও তিয়ামাত থেকেই অন্য দেবদেবীদের উদ্ভব। এই পুরাণ অনুসারে মারদুক (Marduk) নামক দেবতা পৃথিবী, আকাশ, চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্ররাজি তৈরি করেন।
মিশরীয় পুরাণে সৃষ্টি তত্ত্ব :
মিশরীয় পুরাণ (হেলিওপোলিস ভার্সন) অনুসারে সৃষ্টির আাদিতে ছিলেন নু (Nu)- সীমাহীন শূন্যতা ও অন্ধকার। নু থেকে নিজের প্রজ্ঞা ও সৃষ্টির ইচ্ছা থেকে জেগে উঠল অটম (Atum)। অটম জন্ম দিল শু (Shu) ও টেফনাট (Tefnut) নামের দেবতা। শু এবং টেফনাট মহাবিশ্বে শৃঙ্খলা নিয়ে আসল। এদের সন্তান জেব (Geb) ও নুট (Nut) । প্রথমে জেব ও নুট একতাবদ্ধ ছিল। শু নুটকে জেব থেকে পৃথক করে উপরে তুলে দিল । সৃষ্টি হল পৃথিবী (Geb) ও আকাশ (Nut). এদের সন্তানরা হল বিভিন্ন দেবতা (ওসাইরিস, আইসিস, সেথ) যারা মহাবিশ্ব শাসন করত। অন্যান্য সভ্যতা থেকে মিশরীয়রা মৃত্যু সম্পর্কে একটু বেশীই চিন্তা করত। অমর হবার প্রচেষ্টা এদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। গিজার বড় পিরামিড ত্রয় কালপুরুষের (Orion) কোমরে থাকা তিনটি উজ্জ্বল তারার সাথে মিল রেখেই তৈরি (সে সময়ের অবস্থান অুনযায়ী) । কালপুরুষ রাতের আকাশের একটি পরিচিত নক্ষত্র সজ্জা বা Star Constillation. এটি দেখতে অনেকটা অস্ত্র হাতে যোদ্ধার মত। পিরামিড ত্রয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়টিতে ফারাও কুফুর (Kufu) সমাধি। এই সমাধি কক্ষ থেকে দুটি ছিদ্র বাঁকাভাবে সরাসরি বাইরে উন্মুক্ত। এই ছিদ্র দুটির এলাইনমেন্ট একপাশে কালপুরুষের কোমরের একটি নক্ষত্র ও অন্য পাশে থুবান (Thuban) নক্ষত্রের সাথে সরাসরি যুক্ত (তখনকার আকাশ অনুসারে). ঠিক যেন কুফুর আত্ম ঐ পথে যাত্রা করে যাবে নক্ষত্র লোকে।

ছবি-১ কুফুর সমাধি ও নক্ষত্র সজ্জার মিল।
গ্রীক পুরাণে সৃষ্টিতত্ত্ব :
First there was chaos, the vast
Immeasurable abyss, outrageous
As a sea, dark, wasteful, wild. [Milton]
সৃষ্টির আদিতে ছিল বিশাল আকারহীন অন্ধকার, সীমাহীন হিংস্রতা, বিভৎস্য বন্যতা। এই বিশৃঙ্খল সংজ্ঞাবিহীন আকারহীনতা কে গ্রীকরা বলতে Chaos। ক্যাওস থেকে জন্ম নিল নিক্স (Nyx) এবং এরিবাস (Erebus) নামের দেবদেবী। নিক্স রাত্রি বা অন্ধকার তুল্য দেবী এবং এরিবাস মৃত্যুর তুল্য দেবতা। এই অন্ধকার ও মৃত্যু থেকে জন্ম হল আলো (Ather) ও দিনের (Hemera) । এদের জন্মের সাথে শূন্যতা, তিমিরও বন্যতা ভেদ করে শৃঙ্খলা, আলো ও সৌন্দর্যের আবির্ভাব হল। পূর্ণতা পেতে শুরু করল মহাবিশ্ব। এরপর এল গেইয়া (Gaea) ও ইউরেনাস (Urenus)। গেইয়া হল ধরনী মাতা এবং ইউরেনাস স্বর্গ পিতা (আকাশ ও পৃথিবী)। এদের থেকে ধীরে ধীরে টাইটান দেবতাদের আবির্ভাব হয়েছিল। এদের দ্বন্দ্ব ও সিংহাসন দখলের ইতিহাস অন্য সময়ে বলা যাবে । এখানে লক্ষ্যনীয় যে মিশরীয় ও গ্রীক পুরাণে সৃষ্টির আদি অবস্থার বর্ণনা প্রায় একই। Chaos বা Nu সীমাহীন অন্ধকার ও আকারহীনতার প্রতীক। এনুমা এলিশে এই প্রাথমিক অবস্হা শুধু পানি দ্বারা পূর্ণ। কিন্তু গ্রীকও মিশরীয় মিথে তা নয়। তবে সবাই বলতে চায় সংজ্ঞাবিহীন একটি অবস্থা থেকেই মহাবিশ্বের সূচনা।
গ্রীক সভ্যতা ও বিজ্ঞান :
দিন ও ঋতুর পরিবর্তন, রাতের আকাশে তারা সম্পর্কে প্রাচীনকালের মানুষের বিজ্ঞান ভিত্তিক ধারণা থাকলেও কুসংস্কারের অভাব ছিলনা। মহাবিশ্ব নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক ভাবে ভাবতে শুরু করে গ্রীক দার্শনিকরা। পূর্বে মানুষ পৃথিবীকে গোলাকার থালার মত মনে করত। গ্রীক দার্শনিকেরা ধারণাদেন যে পৃথিবী গোলাকার। অনেকে বলে পিথাগোরাস (৫৩০ BCE এর কাছাকাছি সময়ে) এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেন। পিথাগোরাস এখনো বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর বিখ্যাত থিওরামের জন্য (সমকোনী ত্রিভুজের অতিভুজের বর্গ বাকি দুই বাহুর বর্গের সমান)।
গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস (Democritus, ৪৬০-৩৭০ BCE) তত্ত্ব দেন যে, মহাবিশ্ব অসংখ্য অবিভাজ্য ক্ষুদ্রকণা দ্বারা গঠিত। যার নাম দেন Atom.
মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে সর্ব প্রথম ধারনা দেন প্লেটো (Plato, ৪২৯-৩৪৯ BCE)। প্লেটো এবং তার ছাত্র Eudoxus একটি মডেল দাঁড় করান। তবে মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে প্লেটোর আরেক ছাত্র অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ BCE) যে ধারনা দেন তা বেশী প্রচারনা পায়। এটি মূলত প্লেটোর ধারণার পূর্ণ রূপ।
অ্যারিস্টটলের মহাবিশ্ব :
মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের ধারণা নিম্ন রূপ-
ক) পৃথিবী গোলকার ও স্থির।
খ) পৃথিবী এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে একাধিক অদৃশ্য (Transparent) মহাজগাতিক গোলক (celestial sphere) রয়েছে। গ্রহ নক্ষত্র সবকিছুই এই গোলকে বসানো (attested) আছে।
গ) এই মহাজাগতিক গোলক গুলো স্বর্গীয় বস্তু (গ্রহ নক্ষত্র) নিয়ে ঘূর্ণয়মান।
ঘ) তিনি ৪৪ টি ভিন্ন ভিন্ন গোলকের কথা উল্লেখ করেন।
ঙ) মহাবিশ্ব অসীম নয়।
তার ধারণা ছিল উল্কা ও ধুমকেতু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলেই সৃষ্টি হয়। পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বসানোর অ্যারিস্টটলীয় ধারনা বহু বছর ধরে মানুষকে প্রভাবিত করে। কিন্তু কেন অ্যারিস্টটল পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বসালেন? পৃথিবী থেকে যা কিছু ছুড়ে মারা হয় তা পৃথিবীতে ফিরে আসে। তিনি ধারনা করলেন পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্র যার কারনে সব কিছু কেন্দ্রর দিকেই ফিরে আসে।
এরিস্টারকাসের আধুনিক চিন্তা :
সামোসের অধিবাসী এরিস্টারকাস (Aristarchus of Samos, ৩১০-২৩০ BCE) সৌরজগত সম্পর্কে যে ধারনা দেন তা আধুনিক চিন্তার কাছাকাছি। তার উল্লেখযোগ্য অবদান হল-
ক) তিনি চাঁদের ব্যাস পরিমাপ করেন পৃথিবীর একচতুর্থাংশ (সঠিক অনুপাতের কাছাকাছি)
খ) তিনি চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব হিসাব করেন (যা সঠিক পরিমাপের কাছাকাছি)
গ) তিনি সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হিসাব করেন। যদিও এ হিসাব ভুল ছিল। তবে তার পদ্ধতি সঠিক ছিল। সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির অভাবে ভুল পরিমাপ হয়। চোখের উপর ভরসা করে কী সব হিসাব সঠিক হয়। তার পরিমাপ অনুসারে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব চাঁদের দূরত্বের প্রায় ২০ গুণ (আসলে তা ৩৯০ গুন)।
ঘ) তিনি অংক কষে বুঝতে পারেন যে সূর্য পৃথিবী থেকে আকারে অনেক বড় । তিনি তখন ধারনা দেন যে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে সূর্য অবস্থান করছে পৃথিবী নয়। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। তার এ চিন্তা যৌক্তিক হলেও প্রচার পায়নি এরিস্টটলের পৃথিবী কেন্দ্রিক তত্ত্বের জন্য। তবে সে সময়ে এরিসটারকাসের সূর্যকেন্দ্রিক ধারনা ছিল তার মুক্ত চিন্তার প্রতীক। এই সৌরকেন্দ্রিক ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে সময় লেগেছিল প্রায় এক হাজার বছর।
এর এক শত বছর পর সেলুকাস (Seleucus) নামক দার্শনিক আরো যুক্তি দিয়ে সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রচার করলেও তা জনপ্রিয়তা পায়নি।এরাটোসথেনিস (Eratosthenes, ২৭৬-১৯৬ BCE) সর্বপ্রথম জ্যামিতিক ও গাণিতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে পৃথিবীর পরিধি মাপেন যা সঠিক মাপের কাছাকাছি।

ছবি-২ পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব মাপার জন্য এরিসটারকাস প্রস্তাবিত পদ্ধতি।
টলেমীর মহাবিশ্ব :
ক্লডিয়াস টলেমী (Claudius Ptolemy, ১০০-১৭০ CE) ছিলেন গ্রীকো-মিশরীয় জ্যোতির্বিদ ও গাণিতবিদ। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার নিকট একটি মানমন্দিরে কাজ করতেন। আকাশে তারা ও গ্রহের আনাগোনা পর্যবেক্ষণ করে তিনি মহাবিশ্বের একটি মডেল দাড় করান। যা মূলত এরিস্টটলীয় মডেলের ভিন্ন রূপ। তার প্রধান কাজ যা বছরের পর বছর তার পর্যবেক্ষণের ফসল তা মূলত পরিচিতি পায় আরবী নাম Almagest (the great system) নামে। তার মতাদর্শ নিম্ন রূপ-
ক) তিনি সূর্য নয় পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থাপন করেন। পৃথিবীর চারপাশে বিভিন্ন গোলকে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান। পৃথিবী তার অবস্থানে স্থির।
খ) টলেমীর মতে প্রতিটি গ্রহ দুটি বৃত্তাকার পথে ঘোরে। বড়টিকে নাম দেন Deferent এবং ছোটটিকে নাম দেন Epicycle । Deferent বা বড় বৃত্তাকার পথের কেন্দ্র পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে আলাদা ।
গ) গ্রহগুলো ছোট বৃত্তাকার পথে (Epicycle) ঘুরতে ঘুরতে বড় বৃত্তাকার পথও (Deferent) প্রদক্ষিণ করে।
ঘ) গ্রহগুলোর গতির মূল কেন্দ্রকে বলা হয় Equant, যা পৃথিবীর কেন্দ্র ও Deferent এর কেন্দ্র থেকে আলাদা।
এ জটিল পদ্ধতিতে চিন্তার কারণ হল এই পদ্ধতিতে তখনকার সময়ে দৃশ্যমান গ্রহের গতি ও উজ্জ্বল্য ব্যাখ্যা করা যেত। যদিও তা সম্পূর্ণ সঠিক ছিল না।
টলেমীর এই ধারণা প্রায় এক হাজার বছর টিকে ছিল। টলেমীর পর বহু জ্যোতির্বিদের উল্লেখ পাওয়া যায় যারা সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন কিন্তু কোপার্নিকাসের পূর্বে কারো ধারণাই প্রতিষ্ঠা পায়নি।

ছবি-৩- টলেমীর মডেল
[CE = Common/Current Era, Anno Domini বা AD এর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়।
BCE = Before Current Era, Before Christ বা BC এর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়।
c = Circa, Latin for about or around. সালের পূর্বে ব্যবহার করা হয়]
কোপারনিকাস ও সূর্য :
নিকোলাস কোপারনিকাস (Nicholus Copernicus, ১৪৭৩-১৫৪৩) [এটি তার ল্যাটিনকৃত নাম, আসল নাম নিকোলাই কোপারনিক] বিখ্যাত হয়ে আছেন তার সৌরকেন্দ্রিক(Heliocentric) মহাবিশ্বের ধারনা প্রস্তাবের জন্য। কোপারনিকাসই প্রথম জ্যোতির্বিদ নন যিনি সৌরকেন্দ্রিক ধারণা প্রস্তাব করেন। এরিসটারকাস ১৭০০ বছর পূর্বেই এই ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন। সম্ভাবত কোপারনিকাস তার শিক্ষকের মাধ্যমে এরিসটারকাসের কাজ সম্পর্কে জানতে পারেন। কোপানিকাস ছিলেন একজন ক্যাথলিক যাজক। সৌরকেন্দ্রিক ধারণা বাইবেলের ধারণার পরিপন্থি বলে তিনি এ ধারণা প্রচারে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তবে তার জীবনের শেষ দিকে On the Revolution of Heavenly Sphere প্রকাশের মাধ্যমে সৌরকেন্দ্রিক ধারনা প্রস্তাব করেন। বইটি তার মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে প্রকাশিত হয়।
কোপারনিকাস প্রস্তাব করেন যে
ক) সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র এবং তা স্থির।
খ) সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহ গুলো বৃত্তাকার পথে ঘুরছে।
গ) নক্ষত্রসকল স্থাপন করেন গ্রহগুলোর বাইরে অনেক অনেক দূরের একটি স্তর হিসাবে।
সৌরকেন্দ্রিক ধারণার প্রচারে তার ভূমিকা খুবই কম। বরং কেপলার ও গ্যালেলেও এই ধারনা প্রতিষ্ঠিত করেন। তাছাড়া তার ধারণায় অনেক ভুল ছিল। যেমন-তিনি মনে করতেন সূর্য স্থির এবং গ্রহ গুলো বৃত্তাকার পথে ঘুরছে। দুটো ধারণাই ভুল। আবার সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়। মহাবিশ্বের অসীম, এর কোন কেন্দ্র নেই।
টাইকো ব্রাহি
টাইকো ব্রাহি (Tycho Brahe,১৫৪৬-১৬০১) ছিলেন ড্যানিশ জ্যোতির্বিদ। তিনি খালি চোখে রাতের পর রাত আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছেন । বহু বছরের পর্যবেক্ষণের ফলে তিনি বিশাল ডাটা সংগ্রহে সমর্থ্য হন। ১৫৭২ সালে তিনি আকাশে হঠাৎ নতুন তারার আগমন পর্যবেক্ষণ করেন (এখন আমরা জানি, এটি ছিল সুপারনোভা)।
বহু বছরের পর্যবেক্ষণের পর তিনি নিজেই একটি মডেল দাঁড় করান। যার কেন্দ্রে পৃথিবী। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চন্দ্র ও সূর্য ঘুরছে এবং সূর্যকে কেন্দ্র করে বাকি সব গ্রহ ঘুরছে।

ছবি-ব্রাহির মডেল
কেপলার ও গ্রহ সমূহ :
I measured the havens, now I measure the shadows
Skyward was the mind, the body rests in the earth.
[কোপলারের এপিটাফে এই কথাগুলো লেখাছিল। এ কথাগুলো তার নিজের লেখা]
জোহানেস কেপলার [Johannes Kepler, ১৫৭১-১৬৩০] ছিলেন একজন মুক্তচিন্তাবিদ বিজ্ঞানী, তার সারা জীবনের কাজ খুব সুন্দর ভাবেই এপিটাফের বাক্য দুটিতে ফুটে উঠেছে। টাইকো ব্রাহির মৃত্যুর পর তার সংগ্রহ করা বিশাল ডাটা কেপলারের হাতে আসে। তিনি ডাটা গুলো ব্যবহার করে এমন একটি মডেল দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন যাতে গ্রহগুলোর গতি ব্যাখ্যা করা যায়। তিনি কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মডেলকে মানদণ্ড হিসাবে ধরে নেন। তবে বৃত্তাকার পথে গ্রহ প্রদক্ষিণ করলে তাদের গতি ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি দেখলেন যে, উপবৃত্ত (Ellipse) বা ডিম্বাকার কক্ষপথে গ্রহ ঘুরলে গতি ব্যাখ্যা করা সহজ হয়। উপবৃত্তকে বিকেন্দ্রিক বৃত্ত বলা যায়। উপবৃত্ত ডিম্বাকৃতির হয়। এর দুটি ফোকাই (foci, একবচনে focus) থাকে। ডিম্বাকৃতির হওয়ায় এর ব্যাস সবখানে সমান নয়। তাই এর বড় (major) এবং ছোট (minor) অক্ষ (axis) নামে দুটি অক্ষ থাকে। ফোকাস দুটে যতই দূরে সরে যায় উপবৃত্ত ততই ডিম্বাকৃতির হতে থাকে। ঠিক উল্টো ভাবে ফোকাস দুটোর দূরত্ব কমতে থাকলে তা বৃত্তের মতই দেখায় এবং ফোকাস দুটো একবিন্দুতে মিলে গেলে তা বৃত্তে পরিণত হয়। তখন অক্ষ দুটো সমান হয়ে যায়। গ্রহ গুলো সূর্যকে একটি ফোকাসে রেখে প্রদক্ষিণ করে। প্রতিটি গ্রহরে উপবৃত্তাকার পথের বিকেন্দ্রিকতা খুবই কম। পৃথিবীর কক্ষ পথের বড় ও ছোট অক্ষের দৈর্ঘ্যের পার্থক্য মাত্র ০.০১৪% । এই সামান্য পার্থক্যই গ্রহের গতি অনেক বদলে দেয়। কেপলারের আগে কেউ এইভাবে উপবৃত্তাকার কক্ষপথের কথা চিন্তা করেনি।
১৯২১ সালে কেপলার গ্রহের গতি সম্পর্কিত তিনটি সূত্র দেন। এই সূত্র নিউটনকে তার গ্রাভিটির সূত্র দাঁড় করাতে অনেক সাহায্য করেছিল।

ছবি-উপবৃত্ত
গ্যালেলে ও এবং বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদের নাচ :
সৌরকেন্দ্রিক মডেল প্রতিষ্ঠার পেছনে আরো একজন বিজ্ঞানীর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হলেন গ্যালেলেও গ্যালেলেই (Galileo Galilei, ১৫৬৪-১৬৪২)। গ্যালেলেও টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। [টেলিস্কোপ আবিষ্কারের মূল কৃতিত্ব ডাচ লেন্স করিগর হ্যান্স লিপার্শেকে দেওয়া যেতে পারে। লিপার্শে উত্তল লেন্স ব্যবহার করে দূরের বস্তুকে দেখার পদ্ধতি বের করেন। গ্যালেলেও শুধু পদ্ধতি একটু পরিবর্তন করে আকাশ দেখার জন্য ব্যবহার করেন।] টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের দিকে চোখ দিলেই নতুন জগৎ। আগে যা খালি চোখে ধরা পড়েনি তা গ্যালেলেও দেখতে শুরু করলেন। চাঁদকে আমরা অতি সুন্দর হিসাবেই জানি। কিন্তু গ্যালেলেও টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলেন চাঁদের আসল রুপ। তিনি চাঁদের গায়ে পাহাড় ও খাদ সম্পর্কে ধারণা দেন। চন্দ্রপৃষ্ঠ মোটেও সমতল নয়। চাঁদের সৌন্দর্য শুধু কবিদের বাণিজ্যিক প্রচারণা। এই সত্য গ্যালেলেও প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন । তিনি মিল্কিওয়ে ছায়াপথের দিকে টেলিস্কোপ দিয়ে বললেন এটি আসলে অসংখ্যা তারার সমষ্টি। তিনি শুক্র গ্রহের বিভিন্ন দশা সমূহ বর্ণনা করেন।
গ্যালেলেওর সবচেয়ে বড় পর্যবেক্ষণ ছিল বৃহস্পতি গ্রহকে কেন্দ্র করে। তিনি বৃহস্পতির দিকে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলেন চারটি চাঁদ (উপগ্রহ) [বৃহস্পতি আরো উপগ্রহ আছে। কিন্তু এই বড় চারটি সহজেই দেখা যায়। গ্যালেলেওর কম শক্তির টেলিস্কোপ দিয়ে চারটি উপগ্রহই স্পষ্ট বোঝা যেত] তিনি বহুদিন পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলেন যে উপগ্রহ গুলো বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। ঐ চার চাঁদের নাচ গ্রহরাজ বৃহস্পতিকে ঘিরেই। এই পর্যবেক্ষণ বিজ্ঞানের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই পর্যবেক্ষণ থেকে গ্যালেলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। মহাবিশ্বের সবকিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে না। বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে তার উপগ্রহ গুলো ঘুরছে। সুতরাং পৃথিবী সব মহাজাগতিক গতির কেন্দ্র নয়। প্রায় দুই হাজার বছরের পুরাতন এরিস্টটলীয় ধারনা -‘পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র’ চূড়ান্ত ভাবে ভুল প্রমাণিত হল। দেখলেনতো সূর্যকে কেন্দ্র করে সব গ্রহ গুলো ঘুরছে তা বোঝার জন্য সৌরজগতের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখার প্রয়োজন পড়েনি। পর্যবেক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাই যথেষ্ট এবং তা পৃথিবীতে বসেই করা সম্ভব। একদিন পৃথিবীতে বসেই সমগ্র মহাবিশ্বকে দেখা যাবে। বোঝা যাবে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ।
গ্যালেলেও ইতালিয়ান ভাষায় The Starrry Massage বইটির মধ্যমে তার পর্যবেক্ষণের কথা সাধারন মানুষের কাছে তুলে ধরেন ( তখন বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা সাধারনত ল্যাটিন ভাষায় লেখা হত যা সাধারন মানুষের পড়ার উপযুক্ত নয়)। গ্যালেলেও সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের সপক্ষে জোর প্রচারনা শুরু করেন। সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রচারের কারনেই গ্যালেলেও ক্যাথোলিক চার্চের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ১৬৩৩ সালে প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে বলার জন্য তাকে বিচারের সম্মুক্ষীণ করা হয় এবং বাকি জীবন গৃহবন্দি রাখা হয়।
কেপলার এবং গ্যালেলেও হলেন এমন দুইজন বিজ্ঞানী যারা বিজ্ঞানকে দর্শন থেকে মুক্তি দিয়ে ডাটা, পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণ নির্ভর করে তোলেন।
জুলাই, ২০১৬এ NASA’র স্পেস প্রব জুনো বৃহস্পতি গ্রহের নিকট পৌঁছে। এতে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি (রেডিয়েশন থেকে বাচানোর জন্য) গ্যালেলেওর লেগো মিনিফিগার দিয়ে দেওয়া হয়। অবশেষে গ্যালেলেও বৃহস্পতি দেখার সুযোগ পেলেন।
কোপারনিকাস, কেপলার ও গ্যালেলেও এটা প্রতিষ্ঠা করেন যে, সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলো ঘুরছে। মহাবিশ্ব অনেক বড় তারা সূর্যের মতই উজ্জ্বল বস্তু যা অনেক দূরে অবস্থিত।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফল ও মহাবিশ্বের গল্প :
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফল কোনটি? আমি উত্তর দেব আপেল। আপেল (বা আপেল জাতীয় ফল) খেয়েই আদম (Adam) স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হন। এক আপেলের কারণেই ট্রয়যুদ্ধ বেধেছিল (Apple of Discord) । সুন্দরী প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর প্রাপ্য সোনার আপেল প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির (Aphrodite) হাতে তুলে দিয়ে প্যারিসই ট্রয় যুদ্ধের সূচনা করেছিল (Judgement of Paris) । গ্রীক মিথলজিতে আরো অনেক আপেলের গল্প পাওয়া যায়। আপেলের কারণেই আটালান্টা (Atalanta) দৌঁড়ে হেরে বাধ্য হয়েছিল মেলানিয়ন (Melanion) কে বিয়ে করতে। হেস্পারাডিসের (Hesperides) সোনার আপেল আনতে গিয়ে মহাবীর হারকিউলিস আকাশে কাঁধে তুলেছিলেন। আকাশ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা টাইটান অ্যাটলাসের (Atlas) কাজ।
অবশেষে কোন একটা আাপেলকেই পড়তে হল নিউটনের সামনে। ইংল্যান্ডে কি আর কোন ফল জন্মায় না? নিউটনের সামনে আপেল পড়ায় নিউটন ভাবতে শুরু করলেন এমন এক বল নিয়ে যা সারা বিশ্বকে গঠন করেছে। নিউটন আর আপেল গল্পের সত্যতা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। বৃদ্ধ বয়সে গল্প করতে করতে নিউটন নাকি তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন, একটি আপেল তার সামনে পড়তে দেখে তিনি ভাবতে শুরু করলেন- যে বল আপেলকে পৃথিবী পৃষ্ঠে ফেলছে সেই বল কি চাঁদকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরানোর জন্য দায়ী হতে পারে?
সেই সময় এটা জানা ছিল যে, কোন এক বলের কারণে বস্তু সমূহ পৃথিবী পৃষ্ঠে পড়ে। নিউটন এই বলকে স্বর্গীয় বস্তু সমূহের মধ্যেও ছড়িয়ে দিলেন এবং স্বর্গকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনলেন। তিনি ভাবতে শেখালেন যে গ্রাভিটি নামক বলের কারণে আপেল মাটিতে পড়ে সেই গ্রাভিটির কারণেই সূর্যের চারপাশে গ্রহ সমূহ এবং গ্রহের চার পাশে উপগ্রহ ঘুরতে থাকে। গ্রাভিটি হল মহাবিশ্ব পরিচালনাকারী বল। ১৬৮৭ সালে নিউটনের বিখ্যাত গ্রন্থ Philosophiae Naturalis Principia Mathematica (The Mathematical Principles of Natural Philosophy)) প্রকাশিত হয়। এটি প্রিন্সিপিয়া নামেই পরিচিত ছিল। প্রিন্সিপিয়া হয়তো বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ গ্রন্থ । এই গ্রন্থেই নিউটন গ্রাভিটির সূত্র প্রকাশ করেন । এই সূত্রটি ছিল মূলত গ্রাভিটি হিসাব করার গাণিতিক বর্ণনা।
F = G m1Xm2/r^2
“মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে নিজ দিকে আকর্ষন করে। এই আকর্ষন বলের মান বস্তুদ্বয়ের ভরের গুণফুলের সমানুপাতিক এবং দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। এই বল বস্তুদ্বয়ের কেন্দ্র বরাবর কার্যকর হয়।”
এখানে,G হল গ্রাভিটেশনাল ধ্রুবক। G এর মান নিউটনের মৃত্যুর পর নির্ধারণ করার হয়। গ্রাভিটির ধারণা মহাবিশ্বের গঠনকে বদলে ছিল মারাত্মক ভাবে।
নিউটনের মহাবিশ্ব :
ক) সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলো গ্রাভিটির কারণে উপবৃত্তকার পথে ঘুরছে।
খ) মহাবিশ্বে নক্ষত্র গতিশীল এবং সংখ্যায় অসীম।
গ) মহাবিশ্ব সীমাহীন বা অসীম ।
ঘ) মহাবিশ্ব চিরকালই অপরিবর্তনীয় বা স্থির (Static)। মহাবিশ্ব সংকুচিত বা প্রসারিত হচ্ছে না ।
গ্রাভিটির দ্বারা গঠিত মহাবিশ্বের নিউটনীয় মডেলে সমস্যা দেখা দিল। যদি সব বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে তাহলে এরা নিশ্চই একদিন এক বিন্দুতে পতিত হবে। নিউটন হয়তো বলতে পারতেন মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে তাই এরা সাংকুচিত হবে না। এ অনুমান করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু নিউটন স্থির মহাবিশ্বে বিশ্বাস করতেন। তিনি সমাধান দিলেন- অসীম মহাবিশ্বে, অসীম সংখ্যক গতিশীল তারা গ্রাভিটির কারণে কেন্দ্রে পতিত হবে না কারণ অসীম মহাবিশ্বের কোন বিন্দুই কেন্দ্র হতে পারেনা। আরো সমস্যা হল, একটি অসীম স্থির মহাবিশ্বে দৃষ্টির প্রতিটি রেখাই একটি তারার উপর শেষ হবে। সুতরাং রাতেও আকাশ দিনের মত উজ্জ্বল থাকবো। ১৮২৩ সালে জার্মান দার্শনিক হইনরিখ ওলবারস (Heinrich Olbers) আরো অনেক যুক্তি দিয়ে সমস্যাটিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন।
নিউটন বিজ্ঞানী হিসাবে যেমনি সমাদৃত তেমনি ব্যক্তি হিসাবে সমালোচিত ছিলেন। তার সহকর্মীদের অধিকাংশের সাথে তার সম্পর্ক ভাল ছিল না। শিক্ষক হিসাবেও তার তেমন দক্ষতা ছিল না। এডমান্ড হ্যালি (Edmund Hally, ১৬৫৬-১৭৪২) ই বোধহয় নিউটনের সত্যতিকারের বন্ধু ছিলেন। হ্যালি নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে প্রিন্সিপিয়া প্রকাশ করে। এই হ্যালিকে আমরা চিনি তার নামে নামকৃত ধূমকেতুর জন্য ।
ক্যালকুলাসের প্রবক্তা হিসাবে নিউটনের নামই আমরা জানি। গথফ্রীড লাইবিনেজ (Gottfried Leibniz) ও সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে ক্যালকুলাস পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। নিউটন অবশ্য কখনোই তা স্বীকার করেননি এবং লাইবিনেজের নাম প্রকাশে অসহযোগিতা করেন। তবে বর্তমানে দুজনকেই ক্যাললকুলাসের প্রবক্তা মনে করা হয়। নিউটন রয়েল সোসাইটি থেকে রবার্ট হুকের একমাত্র পোট্রেট টি সরিয়ে ফেলেন।
নিউটনের প্রিন্সিপিয়া প্রকাশিত হবার কয়েক বছর পর ১৬৯৩ সালে নিউটন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এটা হয়তো তার রাসায়নিক গবেষণার সময় পারদ বিষক্রিয়া থেকে ঘটে। তিনি সেরে উঠলেও পরবর্র্তী দিনগুলো বিজ্ঞানে তেমন কোন অবদান রাখতে পারেননি। তিনি ১৯২৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
নিউটনীয় পদার্থ বিজ্ঞানের অবসান ঘটান আইনস্টাইন। কিন্তু এখনো আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে নিউটনীয় পদার্থবিদ্যার ধারনা কাজে লাগে। নিউটনকে মনে করা হয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের অন্যতম।
আলো আমার আলো :
আলোই পৃথিবীতে শক্তির প্রধান উৎস। কিন্তু আলো কী? কী দিয়ে তৈরি? এটা মহাশূন্যে কিভাবে বেগমান হয়? আলোর কী কোন নির্দিষ্ট বেগ আছে নাকি এটি অসীমবেগে চলমান হয়? গ্যালেলেও এবং নিউটনই প্রথম বিজ্ঞানী যারা আলো সম্পর্কে সঠিক প্রশ্নগুলো করেন। কোন বিষয় বুঝতে হলে সঠিক প্রশ্ন করতে পারতে হবে। ঐ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলেই বিষয়টি বোঝা যাবে। গ্যালেলেও আলোর বেগ মাপতে পরীক্ষা চালান। কিন্তু তাৎকালীন প্রযুক্তি দিয়ে তিনি আলোর বেগ মাপতে ব্যর্থ হন। ১৬৭৬ সালে ড্যানিশ জ্যোতির্বিদ রোমের (Olaus Romer) বৃহস্পতির উপগ্রহের গ্রহণ (Eclipse) পর্যবেক্ষণ করে বলেন যে, আলো অসীম বেগে চলে না। তিনি আলোর বেগ মাপার জন্য একটি পদ্ধতি প্রস্তাব করেন। কিন্তু তখন পৃথিবীর আকার জানা ছিল না বিধায় সঠিক ভাবে আলোর বেগ মাপা সম্ভব হয়নি। তবে তার পদ্ধতি সঠিক ছিল। ১৮৫০ সালে দুইজন ফরাসী পদার্থবিদ (Armand Hipolyte Fizeu & Jean Foucanlt) আলোর বেগ মাপতে সমর্থ্য হন। শূন্যস্থানে আলোর প্রকৃত বেগ, ২,৯৯,৭৯২.৪৫৮ ≈ ৩x ১০৫ (৩,০০,০০০) কি.মি./সেকেন্ড। আলোর বেগ বিভিন্ন মধ্যম যেমন পানি, বাতাস, কাচ এ শূন্যস্থান থেকে কম। আলোর বেগ বলতে শূন্যস্থানে (Vaccum) আলোর বেগ বোঝানো হয়। মহাকাশে (Space) আলোর বেগ শূন্যস্থানের আলোর বেগের সমান বিবেচনা করা হয়।
নিউটন ও আলোর কণা :
নিউটন ১৬৭০ সালে কাঁচের প্রিজম দিয়ে পরীক্ষা চালান এবং তিনি দেখান যে সাদা আলো প্রিজমের মধ্যদিয়ে গেলে বর্ণালীতে ভাগ হয়ে যায়। অর্থাৎ (দূশ্যমান) সাদা আলো মূলত বেগুনী, নীল, আসমানি, হলুদ,কমলা ও লাল আলোর সমন্বয়ে গঠিত। নিউটন প্রস্তাব করেন যে, আলো অসংখ্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত। ১৬৭৮ সালে ডাচ পদার্থবিদ ক্রিস্টিয়ান হুইজেন (Christiaan Huygens) নিউটনের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন এবং বলেন যে, আলো কণা নয় বরং তরঙ্গ হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে।
থমাস ইয়াং ও আলোর তরঙ্গ :
১৮০১ সালে ইংলিশ পদার্থবিদ থমাস ইয়াং (Thomas Youngh) একটি পরীক্ষা চালান। একে বলা হয় আলোর দ্বিচির পরীক্ষা বা ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট (Double Slit Experiment)। এই পরীক্ষা প্রমাণ করে আলো আসলে তরঙ্গ। ফলে নিউটনের কণাতত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়। আধুনিক কালেও এই পরীক্ষাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। বিখ্যাত আমেরিকান পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনমেনের মতে কোয়ান্টম থিওরীকে এই পরীক্ষার মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। যদিও কোয়ান্টম থিওরী প্রতিষ্ঠিত হয় এই পরীক্ষা প্রায় ১৩০ বছর পর।
ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট :
পরীক্ষাটির জন্য একটি অন্ধকার কক্ষে দুটি সমান্তরাল ও সুরু ছিদ্র যুক্ত একটি বোর্ডের একপাশে নির্দিষ্ট রঙ্গের (অর্থাৎ নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে) আলো এবং অন্য পাশে একটি পার্দ রাখা হয়।
ক. দুটি ছিদ্রের একটি খোলা রেখে আলো ফেললে, পর্দায় একটি লম্বা আলোর ব্যান্ড তৈরি করে।
খ. কিন্তু দুটি ছিদ্র খোলা রেখে আলো ফেললে, পর্দায় আলো ও আধারের পাশপাশি ব্যান্ড তৈরি হয় যাকে বলা হয় ইন্টারফেরেন্স প্যাটার্ন।

ছবি: থমাস ইয়াং এর ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট।
যদি নিউটনের আলোক কণা তত্ত্ব সঠিক হত তবে এই পরীক্ষায় দুটি খোলা ছিদ্রের জন্য পর্দায় পাশাপাশি দুটি আলোর ব্যান্ড তৈরি হত। পরীক্ষায় প্রাপ্ত ইন্টারফোরেন্স প্যাটার্ণ কেবলমাত্র আলোকে তরঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করলেই ব্যাখ্যা করা যায়।
এনালজি :
ধরা যাক সমুদ্রের ঢেউ দুটি ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে উপকূলে আঘাত হানছে। দুই ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করা ঢেউ/তরঙ্গ একসাথে মিশে কোথাও একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করে স্থির পানি তৈরি করে (দুটি তরঙ্গের শীর্ষ-Crest এবং খাঁজ-Trough পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে) এবং কোথাও উঁচু ঢেউ তৈরি করে (দুটি তরঙ্গের শীর্ষ-crest এক হয়ে বড় ঢেউ তৈরি করে) এর ফলে উঁচু ঢেউ এবং স্থির পানির একটি প্যাটার্ণ তৈরি হয়। থমাস ইয়াং এর পরীক্ষায়ও একই ঘটনা ঘটে। উজ্জ্বল ব্যান্ড যেখানে আলোক তরঙ্গ মিশে বড় তরঙ্গ তৈরি করে এবং অন্ধকার ব্যান্ড যেখানে আলোক তরঙ্গ পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
ম্যাক্সওয়েল ও তড়িৎ চৌম্বকীয় বল :
১৮৬০ সালে স্কটিশ গণিতবিদ ও পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (James Clerk Maxwell) চারটি সমীকরণের মাধ্যমে তড়িৎ ও চৌম্বক বলের ধর্ম ব্যাখ্যা করেন। তিনি দেখান যে তড়িৎ ও চৌম্বকীয় বল মূলত একটি বলের দুটি ভিন্নরূপ যাকে আমরা এখন তড়িৎচৌম্বকীয় বল (ElectroMagnatic Force) বলি। তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ শূন্যস্থানে ৩,০০,০০০ কি.মি/সে বেগে ধাবমান হয়। আলোক তরঙ্গ ও একই বেগে চলে। তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ এবং আলো মূলত একই।

ছবি: বিভিন্ন তরঙ্গ দৈঘ্যের ও কম্পাঙ্গের আলো।
তড়িৎ চৌম্বকীয় বলের একীভূত করণের পর বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিল। যেমন ব্লাকবডি রেডিয়েশন, ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট এবং আলোর বেগের আপেক্ষিকতা। আমরা পর্যায়ক্রমে এগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
ব্লাকবডি রেডিয়েশন :
ব্লাক বডি- যারা সব কম্পাঙ্কের ও তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ শোষণ করে নেয়।
হোয়াইট বডি- যারা তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ সবদিকে প্রতিফলিত করে দেয়।
সূর্য বা অন্যান্য নক্ষত্র ব্লাকবডির উদাহরণ। কারণ নক্ষত্র সকল বিকিরণ শোষণ করে নেয় কোন বিকিরণ প্রতিফলিত করে না। ব্লাকবডিকে কালো দেখাতে হবে এমন কোন কথা নেই। সূর্য ব্লাক বডি হলেও এর তাপমাত্রা প্রায় ৫৮০০ K হওয়ার এটি উজ্জ্বল দেখায়। টেবিল, বই, খাতা হোয়াইট বডির উদাহরণ। কারণ এরা আলোর প্রতিফলন ঘটায়।
বিজ্ঞানীরা যখন সূর্য বা অন্য নক্ষত্র থেকে বিকিরিত তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের শক্তির হিসাব শুরু করে তখন দেখা গেল নক্ষত্র অসীম হারে শক্তি বিকিরণ করে। (তখনকার জ্ঞান মতে) কোন উত্তপ্ত বস্তু থেকে উৎপ্নন সকল তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ সমান শক্তি বহন করে তা তার কম্পাঙ্ক/তরঙ্গদৈর্ঘ্য যাই হোক না কেন। আবার কোন উত্তপ্ত বস্তু সমভাবে সকল কম্পাঙ্কের তরঙ্গ উৎপন্ন করতে পারে। অর্থাৎ উত্তপ্ত বস্তু অসীম সংখ্যক তরঙ্গ উৎপন্ন করতে পারে। সুতরাং উত্তপ্ত বস্তুবা ব্লাক বডি থেকে বিকিরিত শক্তির পরিমান হবে অসীম। এ গণনা সঠিক নয় এবং আজগুবি তা বিজ্ঞানীরা জনত। তারা অন্যকোন উপায় খুজছিল ব্লাক বডি রেডিয়েশন ব্যাখ্যার জন্য।
ফটো ইলেক্ট্রিক ইফেক্ট :
১৮৮৭ সালে জার্মান পদার্থবিদ হায়েনরিখ হার্জ (Heinrich Hertz) দেখলেন যে, কোন কোন ধাতব পদার্থের উপর তড়িৎ চৌম্বকীয় রেডিয়েশন বা আলো ফেললে তা থেকে ইলেক্ট্রন নির্গত হয়। এই নির্গত ইলেক্ট্রনের গতি আলো তীব্রতার উপর নির্ভর করেনা, কম্পাঙ্গের উপর নির্ভর করে। কম কম্পাঙ্গের আলো ফেললে ইলেক্ট্রন নির্গত হয় না। বেশী কম্পাঙ্গের আলো ফেললে ইলেক্ট্রন নির্গত হয় এবং এর বেগ কম্পাঙ্গের উপর নির্ভর করে।
ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ও কোয়ান্টা :
১৯০০ সালে জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্লাঙ্ক (Max Plank) প্রস্তাব করেন যে, আলো ও অন্যান্য তরঙ্গ যেমন ইচ্ছা বিকিরিত হতে পারে না। বিকিরিত হতে পারে কেবলমাত্র বিশেষ প্যাকেট আকারে। যার নাম তিনি দিয়েছিলেন কোয়ান্টা (Quanta, যা কোয়ান্টাম-Quantum এর বহুবচন)। প্রতিটি কোয়ান্টামে একটি বিশেষ পরিমান শক্তি থাকে এবং তরঙ্গের শক্তি কম্পাঙ্গের সমানুপাতিক। যে তরঙ্গের কম্পাঙ্গ বেশী সে বেশী শক্তি বহন করে। ফলে বেশী কম্পঙ্গের তরঙ্গ বিকিরণে বেশী শক্তির প্রয়োজন হবে। সুতরাং উচ্চ কম্পাঙ্গে বিকিরণ কমে যাবে । এই কোয়ান্টম হাইপোথিসিসের দ্বারা ব্লাক বডির অসীম হারে তাপ বা শক্তি বিকিরণ সমস্যার ব্যাখ্যা দেওয়া যায়।
ম্যাক্স প্লাঙ্ককে বলা হয় কোয়ান্টম থিওরীর জনক। তার কোয়ান্টম ও হাইপোথিসিসই কোয়ান্টম মিকানিক্সের ভিত্তি স্থাপন করে। পরবর্তী প্রায় ত্রিশ বছর ধরে বিভিন্ন বিজ্ঞানী কোয়ান্টম মিকানিক্সকে পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব হিসাবে দাড় করান। তবে কোয়ান্টম থিওরীর যাত্রা এভাবেই শুরু হয়েছিল আলো ও আলোর বিভিন্ন ধর্মের ব্যাখ্যার মাধ্যমে। আমরা এর পরের ঘটনাগুলিও আস্তে আস্তে জানব।
ইথার ও আলোর বেগ :
১৮৬০ সালের দিকে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ চৌম্বকীয় তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বানী ছিল আলোক তরঙ্গগুলো একটি বিশেষ স্থির দ্রুতিতে চলমান হবে। কিন্তু নিউটনীয় পদার্থ বিদ্যা পরম স্থিতির (Absolute Rest) ধারণা দূর করেছিল। যদি আলো নির্দিষ্ট স্থির গতিতে চলে তাহলে বলতে হবে আলো কিসের সাপেক্ষে স্থির গতিতে চলে? তরঙ্গ যেমন শব্দ তরঙ্গ কোন মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে চলে। আলোক তরঙ্গ কিসের মধ্যে দিয়ে চলে? তখন ইথার বা লুমিনিফেরাস ইথার (Luminiferous Ether) এর ধারণা প্রবর্তণ করা হয়। ইথার ভরহীন, অদৃশ্য, নিষ্ক্রিয় একটি পদার্থ যা সবখানে এমনকী মহাশূন্যেও বিদ্যমান। আলোক তরঙ্গ ইথারের মধ্যদিয়ে চলাচল করে যেমন শব্দ তরঙ্গ বাতাসের মধ্যে দিয়ে চলে। আলোক তরঙ্গ ইথারের সাপেক্ষে নির্দিষ্ট বেগে চলাচল করে। ইথারের সাপেক্ষে চলমান বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের নিকট আলোর বেগ বিভিন্ন মনে হবে কিন্তু ইথারের সাপেক্ষে তা ধ্রুব। বছরের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবী ইথারের সাপেক্ষে বিভিন্ন দিকে চলমান হয়। ফলে পৃথিবী ইথারের দিকে চলমান হলে আলোর বেগ যা হবে, পৃথিবী ইথারের সমকোণে গেলে আলোর বেগ তার কম হবে।

ছবি-ইথার পৃথিবী ও আলোর বেগ।
মাইকেলসন-মর্লি পরীক্ষা:
১৮৮৭ সালে বিজ্ঞানী এলবার্ট মাইকেলসন (Albert Michelson) এবং এডওয়ার্ড মর্লি (Edward Morley) একটি পরীক্ষা করেন। তারা একটি হাফ-গ্লেজড (Half Glazed) আয়নার উপর আলো ফেলে বোঝার চেস্টা করেন যে দিক পরিবর্তন করলে আলোর বেগ পরিবর্তন হয় কীনা। তারা এর সাথে পৃথিবীর গতি ও আলোর গতির দিক এক হলে বা সমকোণ হলে আলোর বেগ পরিবর্তনের তুলনা করেন। কিন্তু তারা বিস্ময়ের সাথে দেখলেন দুটি বেগই নির্ভুল ভাবে একই। পরীক্ষার ফলাফল ইথারের ধারণার পরিপন্থি। অনেকেই মাইকেল অন মর্লি পরীক্ষার ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন।

ছবি-মাইকেলসন মাল পরীক্ষা।
এক কেরাণীর স্পর্ধা:
১৯০৫ সালে সুইজারল্যান্ডের পেটেন্ট অফিসের জনৈক কেরাণী তিনটি বিজ্ঞান পত্র প্রকাশ করেন। এর মধ্যে দুটি গবেষণা পত্র ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট ও ইথার-আলোর বেগ সমস্যার সমাধান এনে দিল। এই অখ্যাত কেরানী দ্রুতই বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। তিনি বদলে দিলেন মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারনা। তিনি হলেন আমাদের মিস্টার ইউনিভার্স অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (Albart Einstein, ১৮৭৯-১৯৫৫)
আইনস্টাইনের তিনটি বিজ্ঞান পত্রের মধ্যে একটি ছিল ব্রাউনীয় গতি সম্পর্কে। তার দ্বিতীয় পত্রটি ছিল ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট সম্পর্কে। ম্যাক্স প্লাঙ্কের কোয়ান্টম হাইপোথিসিস মাথায় রেখে আইনস্টাইন প্রস্তাব করেন যে, আলো অসংখ্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোয়ান্টা বা প্যাকেট দিয়ে গঠিত (আইনস্টাইন নিউটনের আলোর কণা তত্ত্ব ফিরিয়ে দেন)। আইনস্টাইন আলোর কোয়ান্টাকে ফোটন (Photon) নাম দেন। যখন আলো অর্থাৎ ফোটন ইলেক্ট্রনকে আঘাত করে তখন ইলেক্ট্রন ফোটন থেকে শক্তি নিয়ে কক্ষপথ থেকে বের হয়ে আসে। ফোটনের এই শক্তি আলোক তরঙ্গের কম্পাঙ্কের সমানুপতিক (অর্থাৎ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ব্যাস্তানুপাতিক)। বেশী কম্পাঙ্কের আলোর (যেমন UV আলো) ফোটনের শক্তিও বেশী তাই এরা ইলেক্ট্রনকে বেশী শক্তি দেয়। আবার কম কম্পাঙ্গের আলোর (যেমন ইনফ্রারেড আলো) ফোটনের শক্তি কম তাই এরা ইলেক্ট্রনকে কম শক্তি দেয় ফলে ইলেক্ট্রন তার কক্ষপথ থেকে বের হতে পারে না। ধাবত পদার্থের উপর ইনফ্রারেড আলো ফেললে তাই ফটোইলেক্ট্রিক ইফেক্ট পর্যবেক্ষণ করা যায় না। ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট ব্যাখ্যার জন্য আইনস্টাইন ১৯২১ সালে নোবেল পুরুস্কার পান।
স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভিটি:
আইনস্টাইনের তৃতীয় পত্রটি ছিল Zur Elektrodynamik Bewegter Korper(On Electrodynamic of Moving Bodies)। এই বিজ্ঞাপনটিই পরবর্তীতে স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভিটির ভিত্তি স্থাপন করে। আইনস্টাইনের দুটি স্বীকার্য ছিল-
ক. অবাধে চলমান ব্যক্তি বা বস্তুর ক্ষেত্রে তার গতি যাই হোক না কেন) বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গুলো একাই হবে [এটা নিউটনীয় তত্ত্বও সমর্থন করে]
খ. সকল ব্যক্তি যে গতিতে চলুক না কেন সকলেই আলোর একই গতি মাপবেন। [এটা নিউটনীয় তত্ত্বের বাইরে নতুন ধারনা প্রবর্তন করে]
দ্বিতীয় স্বীকার্যটি মূলত স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভিটির ভিত্তি স্থাপন করে। এর ফলে ইথারের ধারনার আর প্রয়োজন পড়ে না এবং মাইকেলসন-মর্লি পরীক্ষার ফলাফলের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। নিউটন পরম স্থিতির ধারনা থেকে মুক্তি দেন এবং আইনস্টাইন পরম কালের (Absolute Time) ধারনা থেকে মুক্তি দেন। স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভিটি অনুসারে-
১। স্থান-কাল: স্পেশাল রিলেটিভিটি পরম কালের ধারনা সমাপ্তি ঘটায়। এই তত্ত্ব অনুসারে সময় পরম নয়, সময়ও পরিবর্তনীয়। আমাদের দৈনিক জীবনেরও অবস্থান দৈর্ঘ্য, প্রস্থ , উচ্চতার সাথে যোগ হল সময়। এখান থেকেই স্থান-কালের (Space-Time) এর ধারণা শুরু হল।
২। সময় সম্প্রসারণ : গতিশীল ঘড়ি স্থির ঘড়ির তুলনায় ধীরে চলে। অর্থাৎ গতিশীল থাকলে সময় ধীরে বাহিত হয়। দুই জমজ ভাই সোহেল ও রাসেল। রাসেল বিশ বছর বয়সে মহাশূন্যে পাড়ি দিল আলোর বেগের কাছাকাছি গতিতে। সোহেল পৃথিবীতে থেকে গেল। রাসেল মহাশূন্যে দশ বছর পার করে পৃথিবীতে ফিরে আসলে দেখবে তার জমজ ভাই সোহেল তার থেকে বুড়ো হয়ে গেছে। কারণ গতিতে সময় ধীরে চলে।
৩। দৈর্ঘ্য সংকোচন : চলমান লাঠির দৈর্ঘ্য স্থির লাঠির দৈর্ঘ্যের চেয়ে কম হবে।
৪। E=mc^2পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত সমীকরণ। এটি থি.স্পে.রিলেটিভিটিরই ফলশ্রুতি। এই সমীকরণ অনুসারে E ∞ m [এখানে c আলোর বেগ ধ্রুবক] অর্থাৎ শক্তি ও ভর সমানুপাতিক। শক্তিকে ভরে রূপান্তর সম্ভব আবার ভরকেও শক্তিতে রূপান্তর সম্ভব। E=mc^2মহাবিশ্বের শুরুর ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তখন আমরা দেখব কীভাবে শক্তি থেকে পদার্থ (ভর) তৈরি হতে পারে।
৫। সর্বোচ্চ গতিসীমা : এই তত্ত্ব অনুসারে কোন কিছুই মহাশূন্যে (Space) আলোর গতি থেকে দ্রুত চলতে পারে না।
৬। আলোর গতির সমান গতি আমাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। আমরা ৯৯.৯৯৯% পর্যন্ত অর্জন করতে পারি কিন্তু এই শেষ ভগ্নাংশটুকু আর অর্জন সম্ভব নয়। কারণ E=mc^2 অনুসারে শক্তি ও ভর সমানুপাতিক। গতিবৃদ্ধির জন্য শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং শক্তি বৃদ্ধির জন্য ভরও বৃদ্ধি পায় ফলে তখন আরো গতি বৃদ্ধির জন্য আরো শক্তি দরকার হয়। কোন বস্তু আলোর বেগের ১০% বেগে চললে তার ভর বৃদ্ধি হবে ০.৫% । এবং আলোর বেগ পৌছালে ভর হবে অসীম । অসীম ভরের বস্তুর গতির জন্য অসীম শক্তি প্রয়োজন। অসীম শক্তি অর্জন করা সম্ভব নয়। আলোর কণা ফোটনের কোন ভর নেই। কেবল ভরহীন কণাই আলোর গতিতে যেতে পারে।
স্পেশাল রিলেটিভিটির ইফেক্ট বোঝা যায় যদি আলোর বেগ বা তার কাছাকাছি বেগে চলা যায়। এই পার্থিব গতির জন্য নিউটনের সূত্র গুলোই যথেষ্ট।
ক্লাশ অফ দি টাইটান- আইনস্টাইন ও নিউটনের দ্বন্দ্ব :
আলোর বেগ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কি.মি. বা এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় আট মিনিট। যদি হঠাৎ সূর্য ধ্বংস হয় তারপরও আট মিনিট পৃথিবীতে আলো থাকবে। কিন্তু সূর্য ধ্বংসের পর কতক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবী সূর্যের গ্রাভিটির কারনে ঘুরতে থাকবে? নিউটনীয় তত্ত্ব মতে গ্রাভিটি অসীম বেগে কার্যকর হয়। তাই সূর্য ধ্বংস হবার সাথে সাথেই পৃথিবী সূর্যের মহাকর্ষ থেকে মুক্ত হবে। তাহলে গ্রাভিটির গতিবেগ আলোর গতিবেগ থেকে বেশী। কিন্তু স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভিটির একটি অনুসিদ্ধান্ত হল কিছুই আলোর থেকে বেশী বেগে যেতে পারেনা। এটা আমরা একটু আগেই বর্ননা করেছি। তাহলে তত্ত্ব টিকাতে হলে আইনস্টাইনকে গ্রাভিটির নতুন ব্যাখ্যা দিতে হবে। আমরা দেখেছি নিউটন গ্রাভিটি হিসাবের জন্য সূত্র দিলেও কেন এই বল অনুভুত হয় তা ব্যাখ্যা করেননি। আইনস্টাইন তার চিন্তা ভাবনাকে গ্রাভিটির ব্যাখ্যা দেবার জন্য ব্যায় করতে শুরু করলেন। প্রায় দশ বছর চেস্টার পর তিনি গ্রাভিটির নতুন ব্যাখ্যা ও গাণিতিক সমীকরন দাঁড় করাতে সমর্থ্য হন। গ্রাভিটির এই নতুন তত্ত্বই জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি হিসাবে পরবর্তীতে প্রচার পায়। জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটির সমীকরণ গুলো ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়।
জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি :
আইনস্টাইন বলেন যে, কোন ভর বিশিষ্ট বস্তু মহাবিশ্বের গঠনকে বিকৃত করে (Wraps the febric of Space-Time) । মহাবিশ্বের গঠনকে কল্পনা করা যেতে পারে একটি সমতল রাবারের সীট হিসাবে। কোন রাবারের সীটে গোলক রাখা হলে তা ডেবে যাবে বা বেঁকে যাবে। ঠিক তেমনি মহাবিশ্বে কোন ভর বিশিষ্ট বস্তু তার চারপাশের স্থান-কাল (Space-Time) কে বাকিয়ে দেয়। এই বেঁকে যাওয়া স্থান কালই গ্রাভিটির কারন। মহাবিশ্বের গঠন (Febric of Cosmos) এর উপর কোন বস্তুর প্রতিক্রিয়াই হল গ্রাভিটি। এই বল আলোর গতিতেই কার্যকর হয়। এর বেশী বেগে নয়। সূর্য ধ্বংস হলেও পৃথিবীতে আট মিনিট আলো থাকবে এবং আট মিনিট পৃথিবী সূর্যের গ্রাভিটির কারনে ঘুরতে থাকবে। আইনস্টাইন নিউটনের গ্রাভিটির ধারণা বদলে দিলেন।
আইনস্টাইন তার জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি দিয়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারনা চিরতরে বদলে দেন। আইনস্টাইনের সমীকরন ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের অনেক মডেল দাঁড় করানো শুরু করলেন।
রিলেটিভিটির স্পেশাল তত্ত্ব কেবল মাত্র বিশেষ অবস্থা অর্থাৎ আলোর বেগ বা তার কাছাকাছি বেগে চলমান বস্তুর জন্য প্রযোজ্য হয়। তাই একে স্পেশাল বা বিশেষ তত্ত্ব বলা হয়। রিলেটিভিটির জেনারেল তত্ত্ব মহাবিশ্বের সবখানে সব সময় প্রযোজ্য হয়। গ্রাভিটি সবার জন্য সব সময়ের জন্য সত্য। গ্রাভিটি মহাবিশ্ব গঠনকারী বল। তাই একে রিলেটিভিটির জেনারেল বা সাধারণ তত্ত্ব বলা হয়।

ছবি: গ্রাভিটি এবং মহাবিশ্বের গঠন
জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি অনুসারে-
১। গ্রাভিটেশনাল ওয়েব (Gravitational Wave) :
আইনস্টাইন সমীকরণ অনুসারে মহাবিশ্বের গঠন (Geometry)= ভর (Matter) +শক্তি (Energy)। এই সমীকরণের ডান পাশ (ভর ও শক্তি) পরিবর্তন হলে বাম পাশ (মহাবিশ্বের গঠন) ও পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ মহাকর্ষ ক্ষেত্র মহাবিশ্বের গঠনকে প্রভাবিত করে তরঙ্গ তৈরি করতে পারে। যা গ্রাভিটেশনাল ওয়েব বা মহাকষীয় তরঙ্গ নামে পরিচিত। অতি সম্প্রতি LIGO টিম মহাকষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ত্ব সনাক্ত করতে সমর্থ্য হয়েছে।
২। সময়ের উপর গ্রাভিটির প্রভাব :
গ্রাভিটি যতই বাড়বে সময় ততই সংকুচিত হবে। অনেক বড় গ্রহ বা নক্ষত্র যার মহাকর্ষ বল বেশী তার পৃষ্ঠে সময় ধীরে চলবে। এমনকী পৃথিবীর পৃষ্ঠের ঘড়ি মহাশূন্যের ঘড়ি থেকে ধীরে চলে। তবে পৃথিবীর গ্রাভিটি কম হওয়ায় তা সাধারন চোখে ধরা পড়ে না। কোন বড় নক্ষত্রের বা ব্লাকহোলের পাশে থাকলে সময় কম দ্রুত যাবে কারণ সময় যেখানে সংকুচিত হয়।
৩। আলোর গতি ধ্রুব তবে গ্রাভিটি আলোর গতিকে কমিয়ে দিতে পারে।
৪। গ্রাভিটি আলোর গতি পথকে বাকিয়ে দিতে পারে। দূরবর্তী কোন নক্ষত্র থেকে আসা আলো পথে অনেক নক্ষত্র বা গ্যালাক্সীর গ্রাভিটির কারনে বাকিয়ে আমাদের চোখে পড়ে। ফলে আমরা দূরের নক্ষত্র যেখানে দেখি আসলে সে ঐ স্থানে নেই। গ্রাভিটির কারনে আলোর গতিপথ বেকে যাওয়ার এমন মনে হয়।
৫। ব্লাক হোল ও ওয়ার্ম হোল :
এই বিষয় দুটি নিয়ে আরো আলোচনা করব। এখন শুধু এইটুকু জানি যে এদের ধারন জেনারেল রিলেটিভিটির মধ্যেই সৃষ্টি। গ্রাভিটি আলোর বেগ কমিয়ে দিতে পারে। তাহলে এমন ক্রিটিকাল গ্রাভিটি আছে যার থেকে বেশী বল হলে আলোও স্থির হয়ে যাবে। এমন হাইপোথিটিকাল স্থানকেই বলে ব্লাকহোল।