Saturday, June 30, 2018

শ্বেত সুন্দর, তুমি তৃষিত হৃদয়ে দিয়েছ অমৃত সুধা ।……..

ছবি-শীতকালীন সুইডেন  (গুগল)








 খুব ছোট বেলায় দেখিছি , আমাদের ড্রইংরুমের বা পাশের দেয়ালটাতে রাশিরাশি বরফেমোড়া ধূসর পর্বতমালার বড়সর একখানা পেইন্টিং ঝুলতে । পর্বতমালার ঠিক মাঝ খানটায় একটুখানি সোনালী আলো এসে পরেছে। ঐ একটুখানি আলোর জন্যই ছবিটার প্রতি দুর্দান্ত আকর্ষণ ছিল আমার। অবাক হয়ে ভাবতাম,শুভ্র বরফ কি করে এত সুন্দর হয় !
আমার সেই শৈশবের মুগ্ধতা হয়ত জমা ছিল স্মৃতির কোন এক খুপরিতে। সুইডেনে এসে টের পেলাম স্মৃতির পাতায় জমানো ছবিটি মিথ্যে ছিল না ।
জুন জুলাই এবং আগস্টের কিছু সময় এখানে সামার চলে। খুব সহজ করে বললে , তীব্র শীতের প্রকোপ কমে খানিকটা উষ্ণ আবহাওয়ার আমেজ পাওয়া যায় । তাপমাত্রা অঞ্চল ভেদে ১০ থেকে ২০ এর ভেতর ওঠানামা করে । তখন পুরো সুইডেন রঙে রঙে ভরে ওঠে। অসংখ্য ফুলের পশরা সাজিয়ে হাজির হয় প্রকৃতি । স্থানীয় সুইডিসরা ছোট বড় উৎসব করে , কেউ ঘুরতে বেড় হয় , কেউ নতুন জীবন শুরু করে , মোট কথা বছরের এই সময়টা তারা বেশ উপভোগ করেই কাটায়। আর আমরা যারা গরমে অভ্যস্ত তারাও ভারী কাপড়ের ভারমুক্ত হয়ে তুলামূলক হালকা কাপড় পরার সুযোগ পাই। কফির মগ হাতে বারান্দায় দাড়িয়ে ভাবি,
আহা ! সময়টা বেশ কাটছে।
জুনের মাঝামাঝি সময়ে সুইডিশরা তাদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব মিডসামার পালন করে। আমাদের দেশের পহেলা বৈশাখের সাথে মিডসামারের উদ্ভূত মিল । তখন এখানেও মেলা হয় , আমাদের মাটির পুতুল, মুড়িমুড়কির বদলে এখানে দেখা মেলে তুলতুলে কাপড়ের পুতুল, পপকর্ণ আর সাদা গোলাপী ক্যান্ডীফ্লসের ।
পৃথিবীর সব দেশের বাচ্চারাই এক ।সুইডিশ বাচ্চারা যখন দলবেঁধে বালুতে গড়াগড়ির খায়, গাছ থেকে মাটিতে লাফ দেয়, লুকুচুরি খেলে, তখন মনে হয় আমি আমার শৈশব দেখছি।
বড় শহর থেকে ছোট শহরগুলতে তুলনামূলক মানুষের ভিড় কম। স্থায়ী বসবাসের জন্য এই শহরগুলো বেশ আরাম দায়ক। সুইডিশরা স্বভাবে মিষ্টিভাষী এবং আন্তরিক। পশুপাখির প্রতি তাদের সীমাহীন ভালবাসা। কুকুর বিড়াল পোষা তাদের জীবনেরই একটা অংশ।
সুইডিস সম্ভ্রান্ত নারীদের খুব চমৎকার একটা শখ আছে। তারা ঘোড়া পোষে এবং রীতিমত ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ায়। বিশেষ করে সামারে এই দৃশ্য খুবই পরিচিত।
একজন ষাটোর্ধ নারী ঘোড়ায় চেপে চলছে এই দৃশ্য আমার কাছে মোটেও স্বাভাবিক নয় , তাই প্রথম প্রথম অবাক হতাম। ধীরে ধীরে বুঝে নিয়েছি ঘোড়াটা শুধুই তাদের বাহন নয়, ঘোড়া এবং তার বাহকের সম্পর্কটি ভালবাসার, পারস্পারিক নির্ভরশীলতারো বটে।

আমার সুইডিশ বন্ধু নিনা । তার বয়স তেষট্টি হলেও সে এখনো চঞ্চলা তরুণী। নিনার একটা চমৎকার ঘোড়া আছে। সে বলে তার ঘোড়া তাকে বোঝে, সে তার ঘোড়া কে বোঝে, তাই তারা অনেক ভাল বন্ধু। নিনা যতটা বলে, ওদের সম্পর্কটা আসলে তার চেয়েও অনেক বেশি মধুর। আমার বারবার মনে হয়েছে, নিনার আবেগগুলো ঘোড়াটা ঠিকঠিক উপলব্ধি করতে পারে। নিনার যখন মন খারাপ হয় ঘোড়াটারও তখন মন খারাপ হয়। নিনার প্রতিটা আচরণের জবাবে ওর ঘোড়ার রেসপন্স আমাকে বিস্মিত করেছে ।
নিনার বয়স যাই হোক সে আসলেই স্বভাবে তরণী। সে তার এই বয়সে এমন অসংখ্য কাজ করে যা আমি করার সাহস হয়ত করব না ।ওর এই অদম্য জীবনশক্তিই নিনা কে একজন সফল এবং বিখ্যাত সাংবাদিক করেছে।
বাংলা প্রবাদে হাতী পোষা যেমন ব্যয়বহুল ঠিক তেমনি এখানে ঘোড়া পুষতে হলে প্রচুর আয় এবং ধৈর্য থাকা আবশ্যক। এই বিষয়ে সুইডিস নারীরা শতভাগ সর্বগুণ সম্পন্না। তারা মাইলের পর মাইল হাটে। সংসার অফিস সবই সামলায়। অনেক সময় সঙ্গী বিহীন জীবনের ভার একাই বহন করে। বিচিত্র এদের জীবন ।এই বৈচিত্র্যময় জীবন অসংখ্য বর্ণিল অভিজ্ঞাতায় ভর্তি। আমাদের মা খালা, কিংবা নানী দাদীদের সাথে তাদের জীবন তুলনা করলে আফসোস হয়। বাঙালী নারীরা তাদের সমস্ত জীবনে কত রঙ, রূপ, রস, গন্ধ, থেকে বঞ্চিত হয় তারা সে খবর জানেই না । এখানকার নারীরা বয়সের সাথে সাথে জীবনের নতুন নতুন সাধ গ্রহণ করে।
অন্য কোন সময় এ নিয়ে লিখব।
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম বরফের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। শীতের সময়টাতে পুরো সুইডেন জুড়েই বরফের দেখা মিলবে কিন্তু সামারে বরফ দেখতে হলে নর্থের দিকে যেতে হবে। নর্থে কখনো ই তাপমাত্রা তেমন উষ্ণ হয় না।সামারেও তাপমাত্রা ৭ থেকে ১৪ ভেতরেই ওঠানামা করে। তাই সেখানে সারা বছরই বরফ থাকে । দুর পাহাড় চুড়ায় কিংবা বনের ভেতরে হাটতে হাটতেই ছোট ছোট বরফগলা নদীর দেখা মিলবে , হাল্কা স্রোতের সাথে সেখানে টুকরো টুকরো বরফ ভাসতে দেখা যায়।

বরফেমোড়া পর্বত চুড়ায় যখন সূর্যের আলো এসে পরে , তখন রিফ্লেকশন হয়। সোনালী আলোতে চারদিক ঝলমল করে ওঠে। বিশেষ করে একপশলা বৃষ্টির পরে যখন মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উঁকি দেয় তখন অর্ধবৃত্ত রংধনুর সৃষ্টি হয় , সেই আলোতে বরফরাশিও বর্ণিল দেখায়। ঠিক যেন রূপকথার গল্পের সেই পরীদের রাজ্য। এখানকার আবহওয়ার মেজাজ মর্জি ভারী অদ্ভুত। কখন সেই গোমড়ামুখো খিলখিলিয়ে হাসবে আঁচ করা কঠিন। এই ঝকঝকে আকাশ তো, এই টিপটিপ বৃষ্টি। কড়কড়া রোদেও হিমশীতল বাতাসের ঝাপটা মিললে অবাক হবার কিছু নেই। সুইডেনের এই পরিবর্তনশীল আবহওয়া নিয়ে স্থানীয় প্রবাদ আছে,
// আবহাওয়া আর মেয়েদের মন কখনো বিশ্বাস করতে নেই//
যদিও এখানকার মেয়েরা এমন নয় তবুও নিছক কৌতুক করেই প্রবাদটা বলা হয়।
এখানকার আকাশ ঠিক আমাদের মত নয়। আকাশের রঙ নীলচে আকাশী আর মেঘেদের রঙ যান্ত্রিক সাদা। খুব পরিপাটী মেঘ দেখে কেমন যেন প্রাণহীন মনে হয়। হয়ত আমি অভ্যস্ত নই বলে এমন লাগছে কিন্তু খুব গোছালো আকাশ দেখতে কেমন নিষ্প্রাণ লাগে । মনে হয় কোন পাঁচ তারা হোটেলের দেয়ালে ঝোলান দামী চিত্রকর্ম।
সমুদ্রের পাশের শহরগুলতে প্রচুর সামদ্রিক গাংচিলের দেখা মেলে । এছাড়াও নানা ধরণের হাঁস তো রয়েছেই। এখানকার পাখিরা খানিকটা ডাকাত টাইপের। মালমো তে দেখেছি সাদা শৃগালের দল রীতিমত খাবার ছিনতাই করে। ওদের অধিকার এখানে মানুষের চেয়ে বেশি। ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে এরা নির্ভয়ে ঢুকে যায়। বেশ রাগী ভঙ্গীতে খাবার চায়। কেউ ঝারি দিলে উল্টো তাকেই ঝাড়ি মারে । আদরে বাঁদর হয়েছে এখানকার পাখিগুলো।
তবুও ওরা সুন্দর। ওরা মানুষ কে ভয় পেতে শেখেনি। মানুষ আর পাখিদের এই মেলবন্ধনে এক ধরণের নির্মল আনন্দ আছে।

এখানে ঝোপেঝাড়ে প্রচুর খরগোশের দেখা মিলবে। এরা মানুষ দেখে একদম ভয় পায় না। মাঝে মাঝে ওরা দলবেঁধে রাস্তা পার হয়। তখন রাস্তার গারিগুলো চুপচাপ দাড়িয়ে ওদের পার হতে দেয়। কেউ হর্ন বাজালে ওরা মহা বিরক্ত হয়ে তাকায়। দৃশ্যটা খুবই মজার।
সামারের এই প্রকৃতি,উইন্টারে একদমই বদলে যায়। চারপাশে শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্য। তখন জীবনের রঙ বদলায় । রোজকার রুটিং বদলায়। বদলে যায় দৈনন্দিন কাজগুলো।
এর পর একটু একটু করে শ্বেত সুন্দরীরা আসে তুষারের বেশে। নতুন সৌন্দর্যের ভাণ্ডার থাকে তাদের আঁচলে। সে এক ভিন্ন আমেজ।

দর্শন আসলে কি ?

দর্শন বা ফিলোসফি নিয়ে এই লেখাটা লেখবার একটা উদ্দেশ্য আছে | সেটা হলো লোককে জানানো যে দর্শন আসলে কি আর তার উপযোগিতা কি ? আধুনিক কালে যেভাবে দর্শন পড়ানো হয় তাতে লোকের কানাকড়িও লাভ হয় না | দর্শন কিন্তু ফালতু বিষয় নয় | মানুষের অশেষ উপকারে সেটা আসে | তাই দর্শন কি সেটা যথাযথ বলাটা উচিত বলেই মনে করি |
প্রথমে আমরা প্রাচীন যুগের দার্শনিকদের মতামত শুনব |
ক] গ্রিক দার্শনিক
১] সক্রেটিস
ইনি বলেছিলেন : “The unexamined life is not worth living.” অর্থাৎ অপরীক্ষিত জীবন যাপন করার কোনো মূল্য নেই | তিনি জগতের সমস্ত কিছুকে পরীক্ষা করেছিলেন | সমস্ত কিছুকে অনুসন্ধান করেছিলেন | তার কাছে দর্শন হলো জীবনকে পরীক্ষা করা | এই পরীক্ষা কিভাবে করেন তিনি ? প্রশ্ন আর উত্তরের দ্বারা | অর্থাৎ প্রশ্ন করা আর উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়েই জীবনকে পরীক্ষা করা হলো দর্শন সক্রেটিসের মতে |
২] প্লাতো
ইনি সক্রেটিসের শিষ্য | ইনি তাঁর বই রিপাবলিক-এ দর্শন তথা দার্শনিকের বিবরণ দিয়েছেন | ওই বইয়ের ষষ্ঠ ও সপ্তম খন্ডে দার্শনিক তথা দর্শনের বিবরণ আছে | ওনার মতে দার্শনিক সর্বদা বিষয়ের চিরস্থায়ী প্রকৃত স্বরূপ জানবেন, পরিবর্তনশীল ওপর চাকচিক্য দেখে ভুলবেন না | তিনি সর্বদা সত্যপ্রিয় হবেন | কখনই মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না | দার্শনিক সর্বদা জ্ঞান ভালবাসবেন | তিনি জাগতিক বস্তুকে ভালবাসবেন না | [ এই কারণেই গ্রিক দার্শনিকদের আমরা অতি সাধারণ বেশে দেখতে পাই | ] দার্শনিক জীবন ও মৃত্যুকে ভয় পাবেন না | তিনি শিখতে ভালবাসবেন |অসাধারণ স্মৃতিশক্তি রাখবেন, জগতের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাবেন না ইত্যাদি |
৩] অ্যারিস্টট্ল
এনার মতে দর্শন হলো জ্ঞানসাধনা | দার্শনিক প্রথমে একটা দুর্বোধ্য হেয়ালির সম্মুখীন হবে | তারপর সেই হেয়ালির সমাধান করার চেষ্টা করবে দর্শন শাস্ত্রের মাধ্যমে | ওনার মেটাফিজিক্স বইতে এইরকমই সংজ্ঞা দেয়া আছে দর্শন তথা দার্শনিকের | দার্শনিক শুধু জ্ঞানের জন্য জ্ঞান চাইবে , অর্থের জন্য নয় | আর এই দার্শনিক খোঁজ কিভাবে হবে ? প্রথমে খোঁজার পথে যেসব বস্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেগুলিকে জানতে হবে | তাহলেই হেয়ালির সমাধান হয়ে যাবে | উনি মেটাফিজিক্সের বেটা বইতে এইরকম দার্শনিক হেয়ালির উদাহরণ ও সমাধান দুইই দেখিয়েছেন |
উনি দর্শনের কতগুলো সুত্র ওনার গামা বইতে দিয়েছেন | ল অফ আইডেন্টিটি , ল অফ নন কনট্রাডিক্সন আর ল অফ এক্সক্লুডেড মিডল | প্রথমটি বলে একই বস্তুর ব্যাপারে অনেক ভাবে অনেক কথা বলা যায় | যেমন স্বাস্থ্য | কিভাবে সুস্থ থাকবেন, কেন সুস্থ থাকবেন ইত্যাদি ওই একই স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বলা হয়েছে | দ্বিতীয়টি বলছে স্ববিরোধ থাকবে না | তৃতীয়টি বলছে হ্যা আর না-এর মাঝামাঝি কিছু থাকবে না | এইটি ফাজি লজিকের বিরুদ্ধে যায় |
খ] রোমান দার্শনিকগণ
এপিক্টেটাস ও স্টয়িক দার্শনিকরা
এনার মতে দার্শনিকদের কাজ হলো যা কিছু অনুভব করা যায় সেই সব কিছুকে পরীক্ষা করা | এই পরীক্ষার উপযুক্ত মানদন্ড নির্মান করা | এনার মতে বিরোধ বা contradiction হলো ভুল তথা মিথ্যা | সত্য হলো অবিরোধ | আরিস্ততলের দর্শনের সাথে মিল পাওয়া যায় |
দার্শনিকরা দেখবে কোনটি আমার আয়ত্তে আছে আর কোনটি নেই | এই কথার গভীর তাত্পর্য আছে | একমাত্র এইভাবেই মানুষ বাঁচতে পারে | বলাবাহুল্য যে এইসব করতে গেলে প্রশ্ন-উত্তরের খেলা ছাড়া আর কোনো ভাবে সম্ভব নয় |
গ] ভারতীয় দার্শনিকগণ
ন্যায় দর্শন
ন্যায় দর্শনে ১৬ টা পদার্থের বিচারের মাধ্যমে শ্রেয়ঃ লাভের কথা আছে | এই পদার্থগুলি হলো : প্রমান, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাস, ছল, জাতি, নিগ্রহস্থান | এইগুলি সবই বিচারে সাহায্য করে | কি বিচারে ? না জাগতিক পদার্থের বিচারে |
ঘ] চীনা দার্শনিকগণ
এঁদের মধ্যে কনফুসিয়াস-এর নাম উল্লেখযোগ্য | ইনি বলেছিলেন সমস্ত বিষয়ে প্রশ্ন করা উচিত |
তাহলে উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে দর্শন একটা এমন জিনিস যা মানুষকে বিচার করতে শেখায় | তা সে ভারতীয় ন্যায় দর্শনই হোক বা গ্রিক দর্শন হোক | দর্শনের বিষয় অনন্ত | পদ্ধতি একটাই | পৃথিবী জুড়ে এইরকম দর্শনই প্রাচীন যুগে প্রচলিত ছিল | দর্শন মানুষকে জগতের পদার্থগুলিকে পরীক্ষা করে হিতাহিত নির্ণয় করতে শেখায় | আর এইখানেই বিপদ |
যদি একটা লোক আজ রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-এর ব্যাপারে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করে আসল সত্যি জানতে চায় তাহলে শাসক শ্রেণী শোষণ করবে কি করে ? সমাজই বা অত্যাচার করবে কি করে ? অতএব দর্শনকে বাঁচতে দেয়া চলবে না | তাকে এখনি মারতে হবে | মধ্যযুগে পৃথিবী জুড়ে তাই দর্শনের মারণযজ্ঞ চলতে লাগলো |
মধ্যযুগ : দর্শনের মৃত্যুঘন্টা বেজে উঠলো
ক] ইউরোপ
খ্রীষ্টধর্ম নামে এক ধর্মের আবির্ভাব ঘটল | এই ধর্মের অধীনে দর্শনকে আনা হলো | শেষ স্বাধীন দার্শনিক ছিলেন হাইপেশিয়া | ইনি আলেকজান্দ্রিয়ার বাসিন্দা ছিলেন | এনাকে খ্রিস্টান বীরপুঙ্গবেরা নৃসংশ ভাবে হত্যা করে | মধ্যযুগে দর্শনকে ধর্মের পুল্টিশ চোখে লাগিয়ে বিচার করতে হত | প্রাচীন যুগের মত খোলামেলা বিচার ছিল না | আর কোনো ধারনাকে মাথায় গুঁজে সত্যকে খুঁজতে গেলে কখনই পাওয়া যায় না | মধ্যযুগীয় দর্শনও পেল না | দর্শনের প্রতিটা অনুসন্ধানকে বাইবেলের সাথে খাপ খাওয়াতে হত | অন্যথায় জুটত নির্মম অত্যাচার | এরই বলি হয়েছিল গ্যালিলিও, ব্রুনো, পারাসেলসাস ইত্যাদি বিজ্ঞানীরা | কোপার্নিকাস ভয়ের চোটে তার বই ছাপতে পারেন নি | দেকার্তে তার বই সব পুড়িয়ে দেবার কথা চিন্তা করেছিলেন | দার্শনিকরা হয়ে গেল চিড়িয়াখানার আজব জন্তু | মূর্খদের রমরমা হতে লাগলো |
খ] মধ্যপ্রাচ্য
ইসলামের আবির্ভাব হলো | তার হাতে দর্শন নিগৃহিত হতে লাগলো | ইসলাম সর্বপ্রকার দর্শন চর্চা নিষিদ্ধ করে | তবু আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে কিছুটা বিজ্ঞান চর্চা হয় | পরবর্তীরা সবই বন্ধ করে | এই সময়েই আরব দার্শনিকদের এক অংশ মুতাজিলি নাম নিয়ে দর্শনের চোখ দিয়ে ঈশ্বরকে খুঁজতে থাকে | আবার সেই ধর্মের পুল্টিশ চোখে লাগিয়ে দার্শনিক বিচার | ইউরোপের সাথে কি অদ্ভুত মিল, না ?
গ] ভারত
বৌদ্ধ ধর্মের আগমনের ফলে ন্যায় দর্শনের চর্চা ব্যাহত হয় | ধীরে ধীরে ন্যায় দর্শন শুধু তর্ক আর কচকচির মধ্যে আটকে পড়ে | কার্যক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না | মুসলিম আমলে ভারতে সম্পূর্ণভাবে দর্শন চর্চা বিনষ্ট হয় | মুঘল আমলে হিন্দু দার্শনিকদের অত্যন্ত দুর্দশার মুখে পড়তে হয় |
লোকাচারের অধীনে দর্শন চলে যায় | এখানেও দার্শনিকরা চিড়িয়াখানার আজব জন্তুতে পরিনত হয় |
ঘ] চীন
বর্বর ইউআন বংশের শাসন কালে চিনের সুকুমার বৃত্তি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয় | এরপর কিছু রাজা আসেন যারা শুধু আইনের শাসনকেই বড় করে দেখেন | এঁদের আমলে কনফুসিয়াসের যুক্তিবাদী দর্শন একেবারে নষ্ট হয় |
তখনও কিছুটা দর্শন অবশিষ্ট ছিল | মানুষ ভালো মন্দ বিচার করতে পারত | কিন্তু আধুনিক যুগের সূচনার পর থেকে দর্শনের সেই অবশিষ্ট ক্ষমতাটুকুও চিরতরে বিনষ্ট হলো | এই আধুনিক যুগে দর্শন শুধুমাত্র কতগুলো মতামত পথের মধ্যেই সীমাবদ্ধ | আমি আজ ৫ বছর ধরে দর্শন পড়ে আসছি | আমি প্রতিটা বইতে দেখি শুধু ভাববাদ আর বস্তুবাদের দ্বন্দ লেখা আছে | স্কুলপাঠ্য বইতে কোন দার্শনিক কি বলেছিল এইটাই শুধু পড়ানো হয় | দর্শনের ছাত্রদের বস্তুবিচার শিখানো হয় না | কোনো বস্তুর সত্য মিথ্যা কিভাবে বুঝবে তা শিখানো হয় না | শুধু কোন দার্শনিক কি বলেছিল | এর ফলে এখন দর্শনের ছাত্ররা তুলনাপুর্বক বিচার করতে শিখছে না | তারা শুধু মুখস্ত করছে আর বমি করছে | এটাই দর্শনের কফিনে শেষ পেরেক |
সক্রেটিসের মত কোনো দার্শনিক আজ আর প্রশ্ন করে না | প্রশ্ন করাটা তো আজ বারণ | যে করে , সে মরে | মুক্তমনারা প্রশ্ন করতে গিয়ে মরেছে | দেশে দেশে , এই আধুনিক যুগে | শুদ্ধু মেনে নাও | মুখ বুজে, ভারবাহী গাধার মত মেনে নাও | মুখ খুলেছ কি মরেছ | হাতে এবং ভাতে | এই তো এখনকার দস্তুর |
আজ কয়টা দর্শনের ক্লাসে প্রশ্ন করা শেখায় | অথচ প্রশ্ন হলো দর্শনের প্রাণ | প্রশ্ন না উঠলে দার্শনিক বিচার কখনই সম্ভব নয় | কিন্তু কয়টা স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে প্রশ্ন করা শেখানো হয় ? একটাও না | টিচারকে প্রশ্ন করার মানে হলো বিদ্রোহ করা | যাই হোক |
দর্শনের এই মরাঘটা অবস্থা থেকে দর্শনকে উদ্ধার আমাদের দর্শনপ্রেমিদেরকেই করতে হবে | কাজ খুবই কঠিন | তবুও করতে হবে আমাদের স্বার্থে | আজ বিচার না করলে আমাদের বাঁচার উপায় নেই | অজ্ঞানতার অন্ধকারে বাঁচার চেয়ে জ্ঞানের আলোয় মরাও ভালো |

Sunday, June 24, 2018

প্রেমের তালায় ভালোবাসা, নাকি কুসংস্কার?

premer tala 01


মানুষের জীবনে যতগুলো গোলমেলে ব্যাপার আছে- তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোলমাল যেটা করে তার নাম প্রেম। গোলমালের প্রধান কারণ হলো এর দুর্বোধ্যতা। ঠিকমতো বুঝতে না পারলেই ভুল বোঝাবুঝি, তারপর গোলমাল। প্রেম অনেকটা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো। ফাইনম্যানকে নকল করে বলা যায়, কেউ যদি খুব বড়াই করে বলেন যে খুব বুঝতে পেরেছেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি আসলে কিছুই বুঝতে পারেননি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো – বুঝি বা না বুঝি- প্রেম ছাড়া আমাদের চলে না। প্রেমে পড়বার জন্য আমরা পাগল হই, প্রেমে পড়বার পর আরো পাগল হয়ে যাই। তখন প্রচন্ড মুক্তিকামীও কেমন যেন বন্ধন-পিয়াসী হয়ে ওঠেন। স্বাধীনতা ও মুক্তি সমার্থক। কিন্তু প্রেম আর মুক্তি – পরস্পর ১৮০ ডিগ্রি কোণ। এই যে সারা পৃথিবীব্যাপী মুক্তির আন্দোলন চলছে – বুদ্ধির মুক্তি, চিন্তার মুক্তি, জড়তা থেকে মুক্তি, শোষণ থেকে মুক্তি – এরকম সমস্ত মুক্তির আন্দোলনের মূল বিষয় যেখানে মুক্তি -সেখানে এই মুক্তিকামী মানুষেরাই যখন প্রেমে পড়েন বা পড়ার জন্য ছটফট করতে থাকেন – তখন তাঁদের মূল উদ্দেশ্য হয়ে পড়ে – মুক্তি নয়, বন্ধন, প্রেমবন্ধন। প্রেমিক-প্রেমিকা তাঁদের নিজ নিজ ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসার বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার জন্য কী না করছে দুনিয়াভর। মানসিক বন্ধন তো আছেই- শারীরিক বন্ধনও কত সহজেই হাসি হাসি মুখ করে বয়ে বেড়ায় সবাই। আঙুলে, হাতে, কব্জিতে, বাহুতে, গলায়, পায়ে – ভালোবাসার শিকল পরানোর জন্য তো বটেই, পরার জন্যও মানুষের সে কি আকুলতা। প্রেমের ঘূর্ণিতে মানুষের অবস্থা যে কী হয় – রবীন্দ্রনাথের লাইন থেকে কিছুটা বোঝা যায়:
“আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়।।
যে জন দেয় না দেখা, যায় যে দেখে – ভালোবাসে আড়াল থেকে-
আমার মন মজেছে সেই গভীরের গোপন ভালোবাসায়।।”
গোপন ভালোবাসা যে বেশিদিন গোপন থাকে না তা রবিবাবুও জানতেন। “গোপন কথাটি রবে না গোপনে” তিনিই তো বলেছেন। গোপন প্রেমের আবেশের আবেদন গত শতাব্দীতে যতটা ছিল – এই টুইটার ফেসবুকের যুগে তার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। তিলকে তাল করে প্রকাশ করার যুগ এটা। নইলে স্ট্যাটাস ছ্যারাবেরা হয়ে যায়। সেই আমাদের প্রাচীন যুগেও গাছের গায়ে, স্কুল-কলেজের দেয়ালে, ক্লাসরুমের বেঞ্চে, ব্ল্যাকবোর্ডের কোণে সুখেন + লাকি, উর্মি + সাইফুল ইত্যাদি লেখা দেখা যেতো। এখনো সেই পাবলিসিটি স্টাইলের পুরোটাই বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। কেবল নামগুলো হয়তো একটু আধুনিক হয়েছে।
ভালোবাসা প্রকাশ করার ব্যাপারটা সুযোগ ও সামর্থ্য অনুযায়ী একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকমের হয়। শাহজাহানের সামর্থ্য ছিল বলে ভালোবাসা দেখানোর জন্য প্রকট একটা তাজমহল বানিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাজমহলের আবেদনও এখন বেশ সেকেলে হয়ে গেছে। তাজমহলের সামনে গিয়ে এখনো হাজার হাজার প্রেমিক-প্রেমিকা ছবি তোলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে তেমন একটা আধুনিকতার চার্ম থাকে না। প্রেমের জগতে একেবারে একবিংশ শতাব্দীর কনসেপ্ট হলো ‘লাভ লক’ – প্রেমের তালা। আক্ষরিক অর্থেই একটা ধাতব তালায় প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের নাম বা প্রেমের সংলাপ লিখে কোন ব্রিজের রেলিং-এ তালাটি লাগিয়ে দিয়ে চাবিগুলো নদীতে ফেলে দেয়। তারা বিশ্বাস করে তালাটি যতদিন বন্ধ থাকবে ততদিন তাদের দু’জনের হৃদয়ের বন্ধনও খুলবে না।
প্রেমের তালা এরকম প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে দেয়ার ধারণাটা ঠিক কার মাথা থেকে এসেছিল বা ঠিক কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যাচ্ছে না। গুগলবাবার দেয়া তথ্য অনুযায়ী এটা ২০০০ সালের পরবর্তী কোন এক সময়ে চীনের মাউন্ট হুয়াং থেকে শুরু হয়েছে। চীনের আনাচে কানাচে প্রাচীন সংস্কারের ছড়াছড়ি।
ঘটনাক্রমে ২০০৭ সালে চীনের মাউন্ট হুয়াং বা ইয়েলো মাউন্টেনে যাবার সুযোগ হয়েছিল। হুয়াংসান শহরে একটা সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে ইয়েলো মাউন্টেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্য ভ্রমণপিয়াসীরা যেমন আসেন, তার চেয়েও অনেক বেশি চাইনিজ আসেন পাহাড়ের কাছে মানত করার জন্য। চায়নিজ সহযাত্রীদের কাছ থেকে শুনেছি এই পাহাড়ে নাকি অমরত্বের ওষুধ পাওয়া যায়। চায়নিজরা বিশ্বাস করে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে চীনের ‘হলুদ সম্রাট’ হুয়াংডি এই পাহাড়ে গিয়েছিলেন অমরত্বের ওষুধ আবিষ্কার করার জন্য। সেই সময় এই পাহাড়ের নাম ছিল – মাউন্ট ই। সম্রাট হুয়াংডি অমরত্বের ওষুধ পেয়েছিলেন কিনা জানি না, তবে চায়নিজরা তাঁকে অমর করে রেখেছেন এই পাহাড়ে। ৭৪৭ সালে তাঁর নামানুসারে এই পাহাড়ের নাম রাখা হয় হুয়াং। শরীরের অমরতা লাভ দুরুহ হলেও প্রেমের অমরতা লাভের জন্য পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ির রেলিং-এর সাথে অনেকেই প্রেমের তালা ঝুলানো শুরু করেন এখানে। সেই ২০০৭ সালে লোহার শিকলে ঝুলন্ত বেশ কিছু তালা দেখেছিলাম। আট বছরে সেই তালার সংখ্যা বেড়ে গেছে কয়েক হাজার গুণ। এখন শুধু চায়নিজ নয়, সারা পৃথিবী থেকে মানুষ ইয়েলো মাউন্টেনে গিয়ে প্রেমের তালা ঝুলিয়ে চোখ বন্ধ করে চাবি ছুঁড়ে ফেলে দেয় পাহাড়ের ঢালুর গাছপালা আর মেঘের ঝোঁপে।
মাউন্ট হুয়াং-এ প্রেমের তালা
মাউন্ট হুয়াং-এ প্রেমের তালা
তারপর প্রেমের তালার ব্যাপক বিস্তার দেখেছি দক্ষিণ কোরিয়ায়। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সওলে গিয়েছিলাম প্রোটন রেডিওথেরাপি সংক্রান্ত একটা গবেষণার কাজে। দু’দিন কাজ করার পর কোরিয়ান সহযোগী ঘোষণা দিলো পরবর্তী দু’দিন হাসপাতালে আসতে পারবে না সে। পরের দু’দিন ছিল শনিবার ও রবিবার। কিন্তু সেজন্যে সে কাজে আসবে না তা নয়। গবেষণায় মাঝে মাঝে কোন উইকএন্ড থাকে না। সে আসবে না কারণ সে ভ্যালেন্টাইন্স ডে এবং পোস্ট-ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে পালন করবে তার ফিয়াঁসের সাথে। আমিও একটা সুযোগ পেলাম নিজের মতো করে সওল শহরটা ঘুরে দেখার। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে মাইনাস ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সওল শহরে হেঁটে বেড়ানো মোটেও উপভোগ্য নয় আমার জন্য। ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে’র পরদিন নামসান টাওয়ারে গিয়ে দেখি ভ্যালেন্টাইনদের মেলা বসে গেছে। ঋণাত্মক তাপমাত্রার পড়ন্ত বিকেলেও সবাই পরস্পরের প্রেমের উত্তাপে উষ্ণ। টাওয়ারের চত্বরে সারি সারি প্রেমের তালার ধাতব গাছ। শত শত প্রেমের তালা ঝুলছে সেসব গাছে। আমার কোরিয়ান সহযোগীকে দেখলাম তাঁর ফিয়াঁসেকে আক্ষরিক অর্থেই কাঁধে তুলে নিয়েছে, আর কোরিয়ান তরুণী প্রাণপন চেষ্টায় তালা বাঁধছে প্রেমের গাছের মগডালে।
premer tala 03
ছয় বছর আগে যেখানে শত শত তালা ছিল এখন সেখানে হাজার হাজার তালা ঝুলছে। প্রেমের তালার কী মহিমা। নতুন নতুন তালার দোকান খোলা হচ্ছে সেখানে।
সওলে প্রেমের তালা ২০১৫
সওলে প্রেমের তালা ২০১৫
চীন ও কোরিয়ার পাশাপাশি তাইওয়ানেও প্রেমের তালার বিস্তার ঘটলো অতিদ্রুত। কিন্তু তাইওয়ানিজরা নিজেদের সবসময় চাইনিজদের চেয়ে আলাদা মনে করে, কিছুটা উন্নত বলেও মনে করে। তাই প্রেমের তালার কুসংস্কারকে তারা কিছুটা বৈজ্ঞানিক যুক্তির মোড়কে পরিবেশন করলো। ফেংগুয়ান ডিস্ট্রিক্টের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনস্টেশনের উপরের ফুটব্রিজে প্রেমের তালা ঝুলানো শুরু করার পর তাইওয়ানিজরা প্রচার করতে শুরু করলো যে তাদের তালা শুধু ‘লাভ লক’ নয়, ‘উইশ লক’ – ইচ্ছাপূরণের তালা। কীভাবে ইচ্ছাপূরণ হয়? ট্রেন চলার সময় নাকি ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়। সেখান থেকে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এনার্জি তৈরি হয়ে তালার ভেতর ঢুকে ইচ্ছাপূরণ করে দেয়। প্রেম-পদার্থবিজ্ঞানের এই বিকট আবিষ্কার লইয়া আমরা কী করিব?? তাইওয়ানে উইশ লকের সংখ্যা বাড়ছে তো বাড়ছেই।
মালয়েশিয়াও থেমে নেই। পেনাং হিল কমপ্লেক্সে প্রেম চত্বর বানিয়ে প্রেমের তালা ঝুলানোর সুবন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছে। গত বছর এপ্রিল মাসে গিয়ে দেখে এসেছি প্রেমের তালা ঝুলতে শুরু করেছে। এই এক বছরে নিশ্চয় কয়েক হাজার গুণ বেড়ে গেছে তালার সংখ্যা।
পেনাং-এ প্রেমের তালা
পেনাং-এ প্রেমের তালা
এশিয়ার কয়েকটি দেশে প্রেমের তালা দেখে আমার ধারণা হয়েছিল – এটা মনে হয় শুধুমাত্র এশিয়ান কনসেপ্ট। কিন্তু এশিয়ায় শুরু হলেও ২০০৬-৭ সালের দিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও ঝুলে পড়তে শুরু করে প্রেমের তালা। ইতালিতে প্রেমের তালার ধারণা প্রবর্তনের কৃতিত্ব দেয়া হয় ইতালিয়ান সাহিত্যিক ফেডেরিকো ম’চাকে (Federico Moccia)। ২০০৬ সালে ফেডেরিকো ম’চার উপন্যাস ‘I Want You’ প্রকাশিত হবার পর ইতালিয়ান প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেমের তালার হদিশ পায়। অনেকটা আমাদের হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পড়ে জোছনা দেখা বৃষ্টিতে ভেজার মতো। উপন্যাস প্রকাশিত হবার এক বছরের মধ্যেই সিনেমা তৈরি হয় উপন্যাসটার গল্প নিয়ে। সিনেমার নায়কের মতো ল্যাম্পপোস্টে প্রেমের তালা ঝুলানো শুরু করলো রোমের তরুণ-তরুণীরা। উত্তর রোমের টাইবার নদীর ব্রিজের উপর প্রেমের তালা ঝুলতে শুরু করলো – একটা দুটো করতে করতে হাজার হাজার। প্রেমের তালা ঝুলাতে ঝুলাতে ল্যাম্পপোস্ট ভেঙে ফেলেছে অনেকবার। দুর্ঘটনাও ঘটেছে অনেক। কিন্তু প্রেম কি কেয়ার করে ওসব?
এদিকে সার্বিয়ার মানুষ দাবি করে প্রেমের তালার সূত্রপাত হয়েছে তাদের দেশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। সার্বিয়ার ভিয়স্কা বানিয়া (Vrnjacka Banja) শহর পর্যটকদের জন্য বেশ আকর্ষণীয় শহর। গরম পানির ঝর্ণাধারায় স্নান করতে আসে এখানে অনেক দেশের মানুষ। প্রেমের তালার ব্যাপারে এই শহরে যে গল্প চালু আছে তা এরকম: তরুণী স্কুল শিক্ষিকা নাদা প্রেমে পড়েছে সার্বিয়ান আর্মি অফিসার রেলিয়ার। ভিয়স্কা বানিয়ার একটি ছোট সেতুর উপর নির্জনে প্রেম করতো নাদা ও রেলিয়া। না, তখন প্রেমের তালার কোন ব্যাপার ছিল না। একদিন রেলিয়া গ্রিসে চলে যায় যুদ্ধ করার জন্য। কিন্তু প্রেমিকের মন থেমে থাকে না। রেলিয়া নাদাকে ভুলে গিয়ে দ্রুত প্রেমে পড়ে যায় কর্ফু নামে এক গ্রিক তরুণীর। নাদাকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেয় যে রেলিয়া। মন ভেঙে যায় নাদার। তারপর ব্যর্থ প্রেমিকারা সচরাচর যা করে – নাদাও তাই করলো। নিজেকে অযত্নে শেষ করে ফেললো। সেই সেতুর উপর গিয়ে দিনরাত বসে থাকতো নাদা। প্রচন্ড যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে একদিন সে মারা গেলো। ভিয়স্কা বানিয়ার তরুণ-তরুণীরা নাদা-রেলিয়ার প্রেমকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে সেতুর রেলিং-এ প্রেমের তালা ঝুলাতে শুরু করলো। কিন্তু অনেকবছর আগে শুরু হবার পরেও প্রেমের তালার সংস্কৃতি ইউরোপের আর কোন শহরে বিস্তার লাভ করেনি সেই সময়।
ইতালিতে প্রেমের তালা ঝুলবে আর প্রেমের রাজধানী প্যারিসে কিছুই হবে না তা কি হয়? ২০০৮ সাল থেকে প্যারিসের সেন (seine) নদীর ওপর পন ডিজ আর (Pont des Arts) ব্রিজ হয়ে ওঠে প্রেমের তালার তীর্থক্ষেত্র। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ পর্যটক প্যারিস শহর ভ্রমণে যায়। ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে পন ডিজ আর ব্রিজের রেলিং-এ একটা প্রেমের তালা ঝুলিয়ে দেয়াটা প্যারিস ভ্রমণের পূর্বশর্ত হয়ে ওঠে অনেকের ক্ষেত্রে। ২০০৬ সালের আগে যেখানে একটা তালাও দেখা যায়নি – ২০১৫ সালের মধ্যে সেখানে প্রায় সাত লক্ষ প্রেমের তালা ঝুলে পড়ে। শুধু তাই নয়, এক ব্রিজ থেকে অন্যব্রিজে ছড়িয়ে পড়তে থাকে প্রেমের তালা।
প্যারিসে প্রেমের তালা
প্যারিসে প্রেমের তালা
কিন্তু বাস্তব সমস্যা দেখা দিতে দেরি হলো না। পন ডিজ আর ব্রিজটি পথচারী ব্রিজ। ৭ লক্ষ ধাতব তালার ভর প্রায় ৪৫ টন। এই অতিরিক্ত ভর সইবার ক্ষমতা এই ব্রিজের নেই। ব্রিজটির কিছু অংশ ভেঙে পড়তে শুরু করে। শুধু তাই নয়, সাত লক্ষ প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের প্রেমের তালার চৌদ্দ লক্ষ চাবি নিক্ষেপ করেছে সেন নদীতে। প্রেমের নামে নদী ও ব্রিজের বারোটা বাজিয়ে ফেলতে সাত বছরও লাগেনি। কতৃপক্ষ বাধ্য হয়ে প্রেমের তালা সহ সব রেলিং খুলে সরিয়ে নিয়েছে। অনেকেই ‘হায় হায়’ করেছে। করার তো কথা। প্রেমের তালা সরিয়ে নেয়ার ফলে প্রেম সরে যাবে না তো আবার?
ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নেও প্রেমের তালার বিস্তার ঘটেছে কয়েক বছর আগে। ইয়ারা নদীর ওপর ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশন থেকে সাউথ ব্যাংকের সংযোগকারী পথচারী ব্রিজটির বয়স এখনো দশ পেরোয়নি। ২০১৩ সাল থেকে এর রেলিং-এ একটা দুটো করে প্রেমের তালা ঝুলতে শুরু করে ২০১৫’র মধ্যে তা বিশ হাজার ছাড়িয়ে যায়। রেলিং-এর ধাতব তার তালার ভারে বেঁকে গেছে। চল্লিশ হাজার চাবি এখন ইয়ারা নদীর তলদেশে।
মেলবোর্নে প্রেমের তালা
মেলবোর্নে প্রেমের তালা
মেলবোর্ন সিটি কাউন্সিলও তালাগুলো কেটে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয়ঘটিত সংস্কারে এরকম ধাতব হস্তক্ষেপ পছন্দ করছেন না অনেকেই। অনেকেই ভয় করছেন প্রেমের তালা কাটা পড়ার সাথে তাদের সম্পর্কচ্ছেদের সম্পর্ক কতটুকু।
অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য শহরের ব্রিজেও প্রেমের তালা দেখা যায়। তবে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিও আছে সেগুলোর উপর। বাড়াবাড়ি দেখলেই কেটে সরিয়ে দিচ্ছে। এই সুযোগে কিছু নতুন ব্যবসার পথও খুলে যাচ্ছে। পার্থ শহরের বেল টাওয়ারে একটা আলাদা সংরক্ষিত এলাকা করা হয়েছে প্রেমের তালা ঝুলানোর জন্য। তবে প্রেমের তালাটি কিনতে হবে তাদের কাছ থেকে ত্রিশ ডলার দামে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রেমের তালার জোয়ার-ভাটা চলছে এখন।
http://www.lovethesepics.com/2015/02/romantic-worldwide-phenomenon-of-love-locks-50-pics/ ওয়েবসাইটে চমৎকার সব ছবি আছে প্রেমের তালার।
প্রেমের তালায় সারাবিশ্ব বাঁধা পড়বে আর বাংলাদেশে কিছু হবে না তা কি হয়? হাতির ঝিলের ব্রিজের রেলিং-এ প্রেমের তালা ঝুলতে শুরু করেছে।
হাতির ঝিলে প্রেমের তালা
হাতির ঝিলে প্রেমের তালা
অচিরেই তালাময় হয়ে উঠবে হাতির ঝিল। হাজার হাজার নিকিতা ও হৃদয়ের হৃদয় বাঁধা পড়বে প্রেমের তালায়। ঘৃণার চেয়ে প্রেম অনেক বেশি আনন্দময়। তবে সংস্কারমুক্ত মানুষও অনেক সময় প্রেমের সংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এটাই শুধু কষ্টের।

Wednesday, June 13, 2018

সিনেস্থেশিয়া।

১.

১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি রথখোলা মোড়ের কাছে নবাবপুর রোডের ওপর আমার একটা চেম্বার ছিল। নিচে ড্রেন পাইপের দোকান, সেটার সাথে একটা সরু গলি, দুজন মানুষও পাশাপাশি হাঁটতে পারে না, সেই গলির সাথেই লাগোয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে হত দোতলার একটা লম্বা বারান্দায়। বারান্দায় পরপর কয়েকটা দরজা। একটা দরজার ওপরে লেখা – ডঃ আবদুল মতিন, এম বি বি এস, সাইকিয়াট্রিস্ট। সন্ধ্যা ছটায় চেম্বারে যেতাম, চার ঘন্টা বসতাম, রোগীর দেখা খুব একটা মিলত না, মনোরোগী হওয়া সামাজিক ভাবে গৃহীত হতো না বলে পরিবার থেকে মনোচিকিৎসকের কাছে যাওয়াটাকে নিরুৎসাহিত করা হতো।
সেদিনটা খুব গরম পড়েছিল, জুন মাস হবে। বর্ষার দেখা নেই, গুমোট সন্ধ্যায় সাহানা নামে এক নারী আমার চেম্বারে আসে, বয়স হয়তো ত্রিশ বা পঁয়ত্রিশ। তার শাড়ির রঙটা মনে নেই, কিন্তু তার বাঁ হাতের ত্বকে একটা গভীর কালো দাগ ছিল, মনে হয়ে আগুনে পোড়া দাগ। আমার চেম্বারের একটা ছোট জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির ছাদ দেখা যায়, সেখানে কাপড় শুকানোর জন্য মেলা থাকত। হয়ত সেদিকে তাকিয়ে আনমনা ভাবেই সাহানা বলেছিল, “আমি শব্দের সঙ্গে রঙ দেখতে পাই।” এরকম অদ্ভুত ব্যাপার আগে শুনি নি, রাস্তার গোলমেলে আওয়াজ সাহানার মনে রূপান্তরিত হয় এক ধরণের ধূসর আলোর ওঠা-নামায়, কাকের কর্কশ ডাকের রঙ হয়ে যায় গাঢ় বেগুনী, মানুষের কথা বর্ণালীর প্রতিটি রঙকে ছুঁয়ে যায়। সাহানা ভেবেছিল এটা এক ধরণের মনোবিকলতা, এরপর সে তার একাত্তর সনের কাহিনী বলে।
১৯৭১ সনের জুলাই মাসে সাহানা খুলনা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে বলেশ্বর নদীর পাড়ে চিতলমারিতে তার পৈত্রিক বাড়িতে ছিল। সাহানার কন্যাসন্তান রেবার বয়স তখন কয়েক মাস। (আমি ভাবলাম সাহানার তাহলে খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছিল।) তার স্বামী আবু মুর্তজা এপ্রিল মাসেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে চলে যান। জুন মাসের শেষের দিকে এক দুপুরে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সেনারা গানবোট নিয়ে তাদের গ্রামে আসে। হিন্দুপ্রধান গ্রামটির প্রায় শখানেক নারী পুরুষকে স্কুলের মাঠে জড়ো করে। স্থানীয় হিন্দুদের সাথে সাহানার বাবা ও এক ভাইকেও আর্মি ধরে নিয়ে যায়। গ্রামের অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেশিনগানের গুলি এড়াতে পারে না। সাহানা আরে রেবাকে নিয়ে তাঁর মা নদীর ধারে নলবনে লুকিয়ে থাকেন, বিকেল হলে তারা বাড়িতে ফিরে কাউকে পায় না। সাহানা আর রেবাকে বাড়িতে রেখে সাহানার মা তার স্বামী ও পুত্রকে খুঁজতে বের হন।
সন্ধ্যা হয়ে আসে, কেউই আর ফিরে আসে না। (আষাঢ়ের ঐ দিনের পরে সাহানা তার মা, বাবা আর ভাইকে আর কোনোদিন দেখে নি।) ঝুপ করে অন্ধকার নামে, পাশের বাড়ির সালেহা দৌড়ে আসে, চিৎকার করে, “সাহানা আপা! রহম তালুকদার আসছে, তুমি পালাও।” সাহানাদের উঠোনের চারদিকে চারটা টিনের চালের ঘর, তার একটির পেছনে ডোবা। রেবাকে সালেহার কাছে দিয়ে, সন্ধ্যার অবরোহী অন্ধকারে, সাহানা দৌড়ে আকন্দ আর আঁশশেওড়ার মাঝে বৃষ্টির পানি জমা ছোট ছোট খানা পেরিয়ে বাঁশঝাড়ের পাশে কচুরিপানা ভরা ডোবায় পৌঁছায়। অন্ধকারে পথ চলতে তার কোনো অসুবিধা হয় না, অন্ধকারেও তার চোখে সবকিছু লাল আবছা আলোয় জ্বলে, তার চেয়েও বড় কথা যে কোনো শব্দ তার কাছে আলো হয়ে ধরা দেয়। ডোবায় নেমে কোমর জলে দাঁড়িয়ে সাহানা দেখে ডোবার পাড়ে কে যেন এসে টর্চ দিয়ে তার খোঁজ করছে।
অন্ধকারেও রহম রাজাকারকে চিনতে পারে সাহানা। রহম তালুকদার পাশের গ্রাম সন্তোষপুরের ছেলে, এই যুদ্ধের আগে সাহানা তাকে চিনত না। রহমের বয়স পঁচিশ হবে, তার বাবা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, আর রহম নাকি খুলনা গিয়েছিল রাজাকার ট্রেনিং নিতে। সে এখন পাকিস্তানীদের চর হয়ে কাজ করে, শহর থেকে কে কে পালিয়ে এসেছে তার হিসাবে রাখে। এর আগে তার দু-একজন চ্যালা নিয়ে সে সাহানাদের বাড়ি ঘুরে গেছে, তার ওপর যে রহমের বিশেষ দৃষ্টি পড়েছে সাহানা সেটা জানে।
রহম জানত সাহানা কাছেই কোথাও আছে, কিন্তু তার প্রতিটি পদশব্দ সাহানা অনুসরণ করতে পারছিল। খানার পানিতে পা পড়ে যেখানে ছলাৎ করে উঠছিল সেখানে সাহানা দেখছিল গাঢ় সবুজ আলো, আগাছায় কাপড়ের স্পর্শ হয়ে উঠছিল একটা অবর্ণনীয় গোলাপী। ডোবার জলে একটা পাকুড়গাছের ঝুরি নেমেছে, সে লুকায় তার পেছনে।

রহম টর্চের আলো নিভিয়ে দেয়। ডোবাটাকে ঘিরে সন্তর্পণে হাঁটে, তবু অন্ধকারে তাকে দেখতে পায় সাহানা। সরে আসে পাকুড়ের গভীরে। পাকুড়ের কাছে পৌঁছায় রহম, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শুনতে চায় সাহানার শ্বাস। তারপর টর্চের আলো জ্বালায় আবার, গাছের ঝুরির ওপর ফেলে। রহমের টর্চের আলো এড়াতে জলে ডুব দেয় সাহানা, ডুবে ডোবার আরো গভীরে চলে যায়। শব্দে ভরা ছিল সেই ডোবা, মাছের শব্দ, হয়তো বা সাপ, কাদা থেকে উঠে আসা অজানা গ্যাসের বুদবুদের শব্দ। সেইসব শব্দ সাদা আর সবুজ রঙে উজ্জ্বল হয়ে তার মনে ভেসে ওঠে। পানির ওপরে টর্চের আলো ধরা থাকে আরো কিছুক্ষণ। শুধুমাত্র তখনই যখন বুকটা মনে হয় ফেটে যাবে টর্চের আলো সরে যায়। পানির ওপরে মাথা তুলে নিঃশ্বাস নেয় সাহানা, রহম রাজাকার চলে গেছে।

স্তব্ধ হয়ে সাহানার কাহিনী শুনি, কিন্তু সাহানা আমাকে ১৯৭১র ইতিহাস শোনাতে আসে নি। শব্দ থেকে আলো সঞ্চারিত হয় – এ কি ধরণের মনোবৈকল্য? তার স্বামী – আবু মুর্তজা – এ নিয়ে তাকে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছে, পাছে লোকে তাকে হয় মিথ্যুক নয় ডাইনী ভাবে। কিন্তু যত দিন যায় তত সে শব্দে সংবেদী হয়ে উঠছে, রাতের পর রাত সে জেগে থাকে, রাস্তার সামান্য শব্দ ঘরকে আলো করে দেয়। এটুকু বলে সাহানা চুপ করে যায়, এমন যেন যা বলতে এসেছিল তার থেকে বেশী বলে ফেলেছে। জানি না সেদিন সাহানার কথা বিশ্বাস করেছিলাম কিনা, তাকে তার ঠিকানাটা রেখে যেতে বলি, যদি এ বিষয়ে কোনো গবেষণা আমার চোখে পড়ে তাকে জানাবো বলে আশ্বাস দিই। সাহানার আচরণে আমি কোনো অস্বাভাবিকতা পাই না, তাঁকে মাসখানেক পরে আবার চেম্বারে ফিরে আসতে বলি। সাহানা যুগীনগর রোডের একটা ঠিকানা দিয়েছিল।

কোনো কারণে সাহানাকে আমি চেম্বারের বাইরে বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিই। সরু সিঁড়িটা দিয়ে নামার সময় খেয়াল করি সাহানার শরীরে হঠাৎ কেমন যেন একটা স্থবিরতা এসেছে, যেন হঠাৎ করে তার বয়স বেড়ে গেছে, সিঁড়িটা দিয়ে নামতে তার অসুবিধা হচ্ছিল। সিঁড়ির শেষ ধাপে সে যখন পৌঁছায় আমি ঘুরে চেম্বারের দিকে এগোই। তখনই শুনি নারীকন্ঠের গান –
“মধু মালতী ডাকে আয়, ফুল ও ফাগুনের এ খেলায়…”
শুধু এটুকুই। চমকে উঠে ঘুরে সিঁড়ির নিচে সাহানাকে দেখতে চাই, সে ততক্ষণে অন্ধকারে দৃষ্টির বাইরে মিশে গেছে।

২.
এর পরে সাহানা আর ফিরে আসে নি। আমিও এর মধ্যে আবার যুক্তরাজ্য যাই একটা ডিগ্রীর জন্য। সেখানে যেয়ে সিনেস্থেশিয়া নামে একটি বৈশিষ্ট্যের কথা শুনি। অনেক মানুষ নাকি লিখিত সংখ্যা দেখলে তাতে রঙ দেখে, যেমন ১ হল লাল, ২ সবুজ ইত্যাদি। রঙটা যে খুব স্পষ্ট তা নয়, বরং সংখ্যাটা ঘিরে আবছা আলোয় জ্বলে। অনেকদিন পরে সাহানার কথা মনে পড়ে, সাহানা শব্দ থেকে রঙ দেখে, সংখ্যা দেখে রঙ দেখা কি তার থেকে খুব দূর হতে পারে? সিনেস্থেশিয়া মানেই হল একটি বোধ দিয়ে আর একটি বোধের জাগরণ। দেখলাম শব্দ থেকে আলো সঞ্চারণ সিনেস্থেশিয়ারই একটা অংশ, সেটাকে ক্রোমেস্থেশিয়া বলে। অনেক বড় বড় ক্লাসিকাল সুরকারদেরও নাকি এই বোধটা ছিল। সঙ্গীত শুনলে, বাজনা শুনলে, গান শুনলে একটা নির্দিষ্ট রঙ মনে সঞ্চারিত হতে পারে। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে অবাঞ্ছিত যোগাযোগ সিনেস্থেশিয়ার কারণ বলে অনেকে ব্যাখ্যা করলেও কিছু বিজ্ঞানীদের মতে এর কারণ আরো গভীর – মস্তিষ্ক ইন্দ্রিয়বোধকে কীভাবে ব্যাখা করছে বা কী অর্থ দিচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে সিনেস্থেশিয়া গড়ে ওঠে। ভাবি দেশে যেয়ে সাহানাকে খুঁজে বের করতে হবে।

দুবছর পরে দেশে ফিরে সাহানার খোঁজে তাদের বাসায় যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা এই নিয়ে বহু মাস চিন্তা করি। শেষাবধি একদিন সাহস করে ছুটির সন্ধ্যায় যুগীনগরের রাস্তায় বাসাটা খুঁজে বের করলাম। বাইরে নামফলকে লেখা ছিল – আবু মুর্তজা। এভাবে হুট করে সাহানার খোঁজে চলে আসা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু সাহস করে দরজায় কড়া নাড়লে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক দরজা খুললেন। আমার পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম উনি মুক্তিযোদ্ধা মুর্তজা কিনা। বললাম ওনার সঙ্গে কিছু কথা আছে, একটু যদি সময় দিতেন। ভেতরে এসে বসতে বললেন।

রাস্তার সঙ্গেই লাগোয়া ঘরটায় সন্ধ্যার আবছায়া আলো পৌঁছাতে পারছিল না। আবু মুর্তজা সুইচ টিপে একটা বাতি জ্বালালেন, তবে বাতির দুর্বল তরঙ্গ ঘরটাকে তেমন আলোকিত করতে পারল না। টিমটিমে আলোয় একটা সোফায় বসলাম, মুর্তজা সামনে একটা চেয়ারে বসলেন। হঠাৎ করে কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না, ওদিকে মুর্তজা সাহেব উৎসুক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। অবশেষে সাহস করে বলে ফেললাম, “আপনার স্ত্রী সাহানা কয়েক বছর আগে আমার চেম্বারে এসেছিলেন তাঁর একটা বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে।” কিন্তু সাহানার নামটা উচ্চারণ করা মাত্র ভদ্রলোক চমকে আমার মুখের দিকে চাইলেন, আধো-অন্ধকারে মনে হল তার মুখটা বদলে গিয়ে একটা কদাকার চেহারা ধারণ করল। মনে হল তার মুখ এক চাপা-ক্রোধে কাঁপছে, সেই ক্রোধ সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর শরীরে। আমার মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেঝের দিকে তাকালেন মুর্তজা। হয়তো চিৎকার করতে চাইলেন, কিন্তু তার বদলে এক সংযত শান্ত স্বরে বললেন “আপনি বের হয়ে যান, এই বাড়ি থেকে, এখনই!” ওনার কথাটা বুঝতে আমার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। ঐ সময়টুকুর মধ্যে মুর্তজা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়েছেন, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে দরজার দিকে ইঙ্গিত করলেন, বিড়বিড় করে যেন বললেন “মিথ্যুক।” এবার আর কোনো সন্দেহ রইল না।
সেই সন্ধ্যার অভিযানটা সম্পর্কে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ ছিল, তবু এর প্রতিক্রিয়াটা যে এত তীব্র হবে সেটা অনুমান করি নি। অপমানে, লজ্জায়, রাগে আমার শরীর যে পুড়ে গেল, মুহূর্তে ঘাম জমল কপালে। মাথা নিচু করে ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে গেলাম।

এরকম অপমানিত জীবনে হই নি। মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছি, সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, আর একটা রিক্সার খোঁজ করছি যাতে এই পাড়া থেকে পালাতে পারি। এই ছোট রাস্তায় রিক্সা দাঁড়ানোর কোনো জায়গা নেই, কাজেই রিক্সা পেতে হলে বড় রাস্তায় যেতে হবে। মনে হল এই পাড়ার সব মানুষেরা যেন আমার অপমানের কথা জেনে গেছে, তারা যেন তাকাচ্ছে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেল, রিক্সা আর মানুষ বাঁচিয়ে অন্ধকারে পথ চলতে অসুবিধে হচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন আমার জামাটা টেনে ধরল। ভাবলাম আবু মর্তুজা, এবার প্রাণ নিয়ে এখান থেকে যেতে পারলে হয়। ঘুরে তাকিয়ে দেখি একটি ১৭/১৮ বছরের মেয়ে। মুদির দোকানের মোমের কম্পমান আলোর শিখা তার মুখটা রহস্যময় করে তুলেছে। সে হাঁফাচ্ছিল, তাকে আমাকে ধরতে তার অনেকটা দৌড়াতেই হয়েছে। একটু লজ্জিত হয়ে মুখ নিচু করে সে বলল, “আমার নাম রেবা, সাহানা আমার মা’র নাম।” আমি স্তম্ভিত হলাম। সাহানার কাহিনী মনে করার চেষ্টা করলাম, রাজাকারের হাত থেকে রক্ষা পেতে সে রেবাকে প্রতিবেশী মেয়েটির কাছে গচ্ছিত রেখেছিল। রেবা বলল, “আপনাকে এগিয়ে দিই।” এই শহরে এরকম একটি কিশোরী মেয়ে নিজের নাম বলে পরিচয় দেয় না। তাছাড়া এই মেয়েটি আমাকে এগিয়ে দেবে মানে আমাকে এই পাড়া থেকে নিরাপদে বের করে দেবে, সেটাও আমাকে খুব আশ্চর্য করে। তবু মেয়েটির দৃঢ় উচ্চারণ ও আত্মবিশ্বাস আমাকে আশ্বস্ত করল, তার উপস্থিত আমার অপমানে উত্তপ্ত মুখকে ঠাণ্ডা করল।
রেবা বলল, “আপনি মিথ্যেবাদী নন।”

আমি কিছুটা সম্মোহিতের মতই বললাম, “না, আমি মিথ্যাবাদী নই।”
রেবা হাসল, তার তীক্ষ্ণ নাকের দুপাশে উজ্জ্বল চোখ সেই গলির অন্ধকারকে সহনীয় করে আনল। বললাম, “তুমি কী করে বুঝলে?”
“আমি বুঝি,” রেবার মৃদু হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে, “আপনার মুখ দেখেই আমি সেটা বুঝতে পেরেছি।”
এরকম একটি কিশোরী মেয়ে আমাকে বিশ্বাস করেছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কোনো দ্বিধা ছাড়া কথা বলছে, আমি বিস্মিত হই। শুনতে পাই রেবা বলছে, “মানুষ মিথ্যা বললে তার চামড়া গরম হয়ে যায়, আমি সেটা ধরতে পারি।” এটুকু বলে হাসে যেন খুব একটা মজার কথা বলেছে। ভাবি রেবা তার মায়ের গুণ পেয়েছে।
“আমার মাকে খুঁজতে আপনি এসেছিলেন, কিন্তু আমার মা তো বেঁচে নেই।”
“বেঁচে নেই? কবে উনি মারা গেলেন? কীভাবে?” প্রশ্নটা আমার মুখ থেকে কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই বের হল। হয়তো ওরকম একটি সুন্দর তরুণ মানুষ এত অল্প বয়সে চলে যাবে সেটা যেন আমার মন মানতে চাইল না। ভাবলাম একারণেই আবু মুর্তজা আমাকে ভুল বুঝেছেন কারণ আমি সাহানার সঙ্গে সাক্ষাতের সময়কালটা উল্লেখ করি নি।
“বহুদিন হল,” বলে রেবা। “মুক্তিযুদ্ধের সময়।”
আমার সাজানো ঘটনা-পরম্পরা ধ্বসে যায়। আমরা তো একটা বোধগম্য পৃথিবীতে বাস করতে চাই, তাই নয় কি? “তাহলে আমার চেম্বারে কে গিয়েছিল?” জিজ্ঞেস করি। মৃত সাহানা ফিরে এসেছিল? মুহুর্তখানেকের জন্য এক অবোধ্য ভীতি আমাকে গ্রাস করে, কিন্তু রেবার অমলিন হাসি আমাকে আশ্বস্ত করে। রেবা বলে, “আপনার কাছে যিনি গিয়েছিলেন তিনি আমার আসল মা নন, আমার সৎ মা।”
রেবা বলে, “আমার মার মৃত্যুর পরে বাবা সালেহা-মাকে বিয়ে করেন। সালেহা মা’দের বাড়ি ছিল আমার নানাবাড়ির পাশেই। সালেহা-মা আমার মাকে চিনতেন, কিন্তু উনি খুব ছোট ছিলেন। আব্বা ওনাকে আমার আসল মা সম্বন্ধে সবসময় গল্প করতেন, মা যে শব্দতে আলো দেখতে পেতেন, সে সব বলেন। এই শুনতে শুনতে সালেহা-মা বোধহয় এক ধরণের গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে যান। নিজেকে আমার মা – অর্থাৎ সাহানা – বলে ভাবতে শুরু করেন। আপনার চেম্বারে যখন তিনি যান নিজেকে সাহানা ভেবেই যান।”
আমার হাঁটা খুবই মন্থর হয়ে যায়। দোকানের লন্ঠনের আলো মিলিয়ে যায়, রেবা আমাকে হঠাৎ দুহাত দিয়ে ধরে একপাশে টানে, উচ্চস্বরে বলে, “ড্রেনে পড়তেন তো!”
রেবা আমাকে রাস্তার পাশের নর্দমায় পড়া থেকে বাঁচায়। এই কাজটা করতে আমাকে ধরতে তার কুন্ঠা হয় না। তারপর বলে, “সবসময়ই যে তিনি সাহানা থাকেন তা নয়, কিন্তু গত কয়েক বছরে এই আচরণটা বেড়েছে।”

“আর তোমার মা? উনি কীভাবে মারা গেলেন?”
“১৯৭১ সনে, জুন মাসে। দুপুরবেলা পাকিস্তানী আর্মি গ্রামে ঢোকে। রহম রাজাকার নামে গ্রামেরই একজন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। সারাদিন তাণ্ডব চলে। বাড়ির পেছনের ডোবায় মা লুকাতে গিয়েছিলেন। সেখানে তলিয়ে যান। সারা গ্রাম আর্মিরা জ্বালিয়ে দেয়, শ খানেক লোককে হত্যা করে, অনেক মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। আমার নানা নানী মামাও মারা যান। পরে ডোবায় মা’র দেহ ভেসে ওঠে, সালেহা-মাদের বাড়ির লোকেরা তাঁকে কবর দেন।”
ডোবার গভীরতা থেকে তাহলে সাহানা আর মুক্তি পায় নি। আমি কল্পনা করি ডোবার ঘোলাটে অস্বচ্ছ গভীরতায় গ্যাসের বুদবুদ, সাহানার পালকের দেহ তলিয়ে যায় বোয়াল মাছের নিরুদ্বেগ গতির নিচে, তলদেশের আঁঠালো কাদায় ছড়িয়ে পড়ে তার ঘন কালো চুল।
“আমি সালেহা-মাদের বাড়িতেই থাকি। বাবা কয়েক মাস পরে এক রাতে আমাকে ঐ বাড়িতেই নাকি দেখতে আসেন, আমার সেটা অবশ্য মনে নেই। স্বাধীনতার পরে উনি সালেহা-মাকে বিয়ে করেন। সালেহা-মাই আমাকে বড় করেছেন।”
সাহানা – না সাহানা নয়, তরুণী সালেহা আমার চেম্বারে এসবই বলেছিল, শুধু সাহানার মৃত্যুর সংবাদটা দেয় নি। কিন্তু সালেহা সেই ডোবার গুপ্তকথা জানতে পেরেছিল, আকন্দ, আঁশশেওড়া আর বাঁশঝাড়ের আলো দেখেছিল। এতদিন পরে মনে পড়ল আমার চেম্বার থেকে বের হবার সময় সালেহা কেমন ঝুঁকে পড়েছিল, যেন হঠাৎ বয়সের ভার বেড়ে গেছে। তারপর সিঁড়ি থেকে নেমে সে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একটি গানের কলি গেয়েছিল।

হাঁটতে হাঁটতে বনগ্রামের রাস্তা ধরে নবাবপুর রোডে চলে এসেছিলাম। রেবাকে বললাম, “তুমি এখান থেকে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে?” রেবা বলল, “এখান থেকে একটা রিক্সা নিয়ে নেব। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। মানুষ সত্য না মিথ্যা বলে তা যেমন বুঝি, লোকে কী করতে পারে তাও আগে থাকতে বুঝি। এটা আমার মা’র থেকে পাওয়া শক্তি। এই শহরে চলাফেরা করতে আমি ভয় পাই না।”
রেবার কথা আমি অবিশ্বাস করি না। যে কিশোরী নিশঙ্কচিত্তে একটি অপরিচিত পুরুষকে তার পরিচয় দেয় শুধুমাত্র সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, নির্দ্বিধায় সেই পুরুষের হাত ধরে তাকে নর্দমার দুর্ভোগ থেকে বাঁচায়, তার আত্মবিশ্বাস, পৃথিবীকে মুক্ত চোখে দেখার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। ভাবি, এই শহর কি রেবার জন্য প্রস্তুত, বনগ্রামের এই অন্ধকার গলি সইতে পারবে কি তার ছন্দময় গতি?
রেবাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে সেই রিক্সার দিকে বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। বিদ্যুৎ ফিরে আসে, আলো জ্বলে।

৩.
এর মাসখানেক পরে এক সন্ধ্যায় কোনো রুগী ছিল না, চেম্বারে বসে একটা মনোবিকলনের ওপর একটা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পড়ছিলাম, এমন সময় আমার সহকারী এক নারীকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঐ নারীকে খুব চেনা মনে হল, সহকারী তার নাম বলল, সালেহাকে চিনলাম। দুবছর আগে সে সাহানা নামে এখানে এসেছিল। সালেহাকে বসিয়ে সহকারী বাইরে চলে গেল। সেই সন্ধ্যায় সালেহা যে শাড়ি পরে এসেছিল সেটার রঙ আমার মনে আছে, হাল্কা বেগুনীতে গাঢ় লাল পাড়। দুটো ভিন্নধর্মী রঙের মিশ্রণ। ভিন্নধর্মী – দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীতে বেগুনী এক দিকে, আর লাল একেবারে অন্যদিকে। বেনীআসহকলা।
চেয়ারে বসে সালেহা বলল, “আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
কথা না বলে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ি।
“আপনাকে আমি গতবার মিথ্যা বলেছিলাম,” সালেহা মেঝের দিকে তাকিয়ে বলে। দেখি সে দু-হাত দিয়ে আঁচলে গিঁট দিচ্ছে আর খুলছে।
“আমি জানি।”
“আপনি জানেন?” সালেহা বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকায়।
“হ্যাঁ, আমি আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম। মুর্তজা সাহেব সাহানার নাম শোনা মাত্র আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। তারপর রেবা আমাকে রাস্তায় খুঁজে পেয়ে সব কথা বলে।”
“ওহ! আপনি যে আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন সেটা জানি, কিন্তু রেবার সঙ্গে যে আপনার কথা হয়েছে তা জানতাম না।”
আমরা দুজনেই মৌন থাকি। সালেহা খোলা জানালা দিয়ে রাতের অন্ধকার দেখে। পাশের বাড়ির ছাদে একটা বাতি ম্লানভাবে জ্বলে। এবার সালেহা বলে, “রেবা আপনাকে কী বলেছে?”
“রেবা বলল, তার মা সেই ডোবা থেকে আর বার হতে পারে নি, তার মৃতদেহ নাকি পরদিন ভেসে ওঠে।”
সালেহা কাপড়ের আঁচলে যে গিটটা দিয়েছে সেটা খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে। “আর কিছু বলল রেবা?” সালেহার গলা কাঁপে।
“আপনি সাহানাদের গ্রামেরই মেয়ে। আপনার কাছে রেবাকে রেখে মুর্তজা সাহেব যুদ্ধে ফিরে গিয়েছিলেন।”
সালেহার দেহ মৃদু কাঁপে, তার দৃষ্টি যেন তীব্র হয়ে জানালার বাইরে অন্ধকার ছাদের টিমটিমে বাতিটার আলোকে গ্রহণ করতে চায়। যেন সেই আলোর মধ্যে রয়েছে ত্রাণ।
আমি বলি, “রেবা আরো বলল, আপনি মুর্তজা সাহেবের কাছে সাহানার গল্প শুনতে শুনতে যেন নিজেই সাহানা হয়ে যান।”
সালেহা জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার মেঝের দিকে তাকায়, দুহাত দিয়ে আঁচলের কোণটা ধরে থাকে যেন এটাই তার একমাত্র সহায়। সে বলে, “না, মুর্তজার কাছে শুনে নয়। রেবা সেই সময়ের ঘটনা জানে না। সাহানা আপা আমার থেকে বড় হলেও আমার সই ছিলেন। উনি সুন্দর গান গাইতেন। তার সঙ্গে প্রথম যখন দেখা হয় আমি ক্লাস নাইনে পড়ি, দুপুরের পরে স্কুল থেকে ফিরেছি, শুনি মণি চাচার বাড়িতে কে যেন গাইছে। এমন গান আমি শুনি নি আগে কখনো। দৌড়ে গেলাম, ঐ বাড়ির আঙিনা ফুলে ভরা থাকত সব সময় – শীত গ্রীষ্ম সবসময়, মণি চাচা মানে সাহানা আপার বাবার খুব ফুলের শখ ছিল। যে ঘরে গান হচ্ছিল তার একটি জানালায় দাঁড়িয়ে দেখি খুব সুন্দর এক মেয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছে।”
আমি বললাম, “মধু মালতী ডাকে আয়?”
সালেহা আমার দিকে চেয়ে হাসল। বলল, “এরকমই একটা গান, তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত। জানালার কড়িবর্গা ধরে সম্মোহিত হয়ে দেখছিলাম তাঁকে, তো উনি আমাকে দেখে গান থামিয়ে হেসে বললেন, ‘এই মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এস।’ আমি খুব লজ্জা পেলাম, বুঝে পাচ্ছিলাম না কী করব। উনি বললেন, ‘লজ্জা কর না, ভেতরে এস।’ ঘরে আর কেউ ছিল না, ঢুকলে ওনার পাশে বসিয়ে আমার নাম-ধাম এসব জিজ্ঞেস করলেন। জিজ্ঞেস করলেন গান পারি কিনা। না বললাম। উনি বললেন, ‘এস তোমাকে গান শিখাই।’
এটুকু বলে সালেহা আবার চুপ হয়ে যায়। নবাবপুরের রাস্তা থেকে একটা ট্রাকের কর্কশ হর্ন শোনা যায়।
“উনি কি তখন আপনাকে শব্দের সঙ্গে আলো দেখার কথা বলেছিলেন?”
“ঐ দিন বলেন নি, কয়েক দিন পরে বলেছিলেন।”
“তারপর?”
“উনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, বছরে কয়েকবার আসতেন, তখনো ওনার বিয়ে হয় নি। উনি আমাকে গান শেখাতেন, তবে আমি কখনই ওনার মত গাইতে পারি নি। সাহানা আপা ছিলেন পরীর মত। সুন্দর দেখতে ছিলেন, গাইতেনও সেরকম। আমি ভাবতাম উনি যেন মোমের তৈরি, সামান্য গরমে গলে যাবেন।”
সালেহার বাঁ চোখের কোনায় একটা জলের ফোঁটা বড় হয়, তারপর গড়িয়ে পড়ে, সিক্ত পথ রেখে যায় উষ্ণ গালে।
“যুদ্ধের বছরখানেক আগে ওনার বিয়ে হয়। নির্বাচনের বছর ছিল সেটা, নৌকার ঢল। পরের বছর যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছি, তখন পাকিস্তানীরা মানুষ মারা শুরু করল। সাহানা আপাকে তার বাবা-মার কাছে রেখে মুর্তজা ভাই চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। রেবার বয়স তখন কয়েক মাস।”
সালেহা টেবিলের ওপর একটা কাচের পেপারওয়েটের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেটার কাচের গভীরতায় একটা নীল ফুল ফুটে আছে। প্রায় সেকেন্ড পনেরো চুপ করে থাকার পরে সে বলে, “আমাদের বাড়িতে একটা বকুল গাছ ছিল, সারাদিন টুপটাপ করে তার থেকে ফুল পড়ত। আমি মাঝে মধ্যেই সেগুলো দিয়ে মালা বানাতাম, সাহানা আপা আর আমি দুটো মালা পড়ে একসাথে গান গাইতাম। সেদিনও আমি ঘরের মাটিতে বসে বকুলের মালা বানাচ্ছিলাম যখন আর্মি আমাদের গ্রামে আসে। আমরা কাছেরই একটা পাটক্ষেতে লুকাই। বিকালে বাড়ি ফিরি, তখনও জানতাম না সাহানা আপা ছাড়া আর সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে। সন্ধ্যা হয় হয়, এই সময়ে আমার ছোট ভাইটা দৌড়ে এসে বলে, ‘রহম তালুকদার আসছে।’ আমরা জানতাম রহম রাজাকারের চোখ সাহানা আপার ওপর আছে, আমি সাহানা আপাকে সাবধান করে আসি। সাহানা আপা আমার কাছে রেবাকে দিয়ে পেছনের ডোবায় লুকাতে যায়।”
গতবার সালেহা সাহানা হয়ে সেই ডোবার কাহিনী আমাকে শুনিয়েছিল।
“আপনি এর পরের কাহিনী জানেন না,” বলে সালেহা। সে ডান হাত দিয়ে পেপারওয়েটটা ছোঁয়, এমন যেন সেটার মসৃণ ত্বকের অনুভূতি সে পেতে চায়। “সাহানা আপাকে না পেয়ে রহম আমাদের বাড়ি আসে, তার সাথে তিনজন মিলিটারি ছিল, আমার আব্বাকে আর মাকে চুল ধরে আঙিনায় নিয়ে এসে বসায়, এঁদের দুজনকে ক্রমাগতই লাথি ঘুঁষি মারতে থাকে। তাঁরা অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে মাটিতে, আমার ছোটো ভাইটা পালাতে পেরেছিল। রেবা ভেতরের একটা ঘরে কাঁদছিল। আর আমাকে ওরা টেনে হিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যায়।”
সালেহার মাথাটা ঝুঁকে পড়ে মেঝের দিকে, ও যেন এখনি পড়ে যাবে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠি ওকে ধরতে, কিন্তু সালেহা এর মধ্যেই সোজা হয়ে বসে। ওর চোখে বেদনা নয়, বরং এক ধরণের উজ্জ্বলতা, পোড়-খাওয়া ঔজল্য।
“আমাকে প্রথমে খুলনা, তারপর যশোহর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। পরের পাঁচ মাস ছিল এক নিরবচ্ছিন্ন বিভীষিকা।”
হঠাৎ আমি বুঝে পাই না আমার কী ভাবা উচিত। কী বলা উচিত।
বাইরে শরতের রাত, সালটা ছিল ১৯৮৭। আমি, ডাক্তার আবদুল মতিন, আমার সংক্ষিপ্ত পেশাদার জীবনে সালেহার মত কাউকে রোগী হিসাবে পাই নি। আমার পরিবার কখনো কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে জড়িত ছিল না যদিও আমার বাবা-মা এবং নিকট সকল আত্মীয়স্বজন নৌকাতে ভোট দিয়েছিল ১৯৭০এ। একাত্তর সনে আমরা ঢাকায় আটকা পড়ি, মার্চের শেষে ঢাকায় ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ আবার খোলে। আমি ছাত্র হিসাবে আবার সেখানে পড়তে যাই। আমার বন্ধুদের অনেকেই তখন ঢাকা-ছাড়া, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা, কেউই শরণার্থী। আমার পরিচিত অনেকেই নির্মমভাবে পাক বাহিনীর হাতে নিহত। সেই কঠিন সময়ে আমার মেডিক্যাল কলেজে ফিরে যাবার সিদ্ধান্তর ন্যায্যতা নিয়ে আমি এখানে কিছু লিখতে চাই না, কারণ এই কাহিনীটি আমার কাহিনী নয়, তবে এটুকু বলতে পারি আমার অসুস্থ বাবা মাকে ঢাকায় রেখে আমার পক্ষে চলে যাওয়া সম্ভব ছিল না, আর ঢাকায় থাকলে নিরাপত্তার জন্য একটা আবরণ লাগে, মেডিক্যাল কলেজ সেই আবরণটুকু দিত। কিন্তু ১৯৭১এর অজুহাত ১৯৮৭ সনে এসে এলোমেলো হয়ে গেল। আমি এখন পরিণত একজন মানুষ, তার ওপরে সাইকিয়াট্রিস্ট, আমার চিন্তা-চেতনায় কি সালেহার মত কেউ স্থান পেয়েছে?

আমার মনের কথাটাই যে সালেহা ধরতে পারে, বলে, “আপনি এই নিয়ে ভাববেন না, ডাক্তার সাহেব। পাঁচটি মাস আমাকে ক্যাম্পে রেখে ধর্ষণ করা হয়, উলঙ্গ করে হাত বেঁধে সারা শরীরে আগুনের ছ্যাঁকা দেয়া হয়, শুধু যে বিদেশী আর্মির লোকেরা করেছে তা নয়। আমি তখন কী বুঝতাম বলুন, আমার বয়স ত্খন ষোল। আমাকে বড় ছুরি দেখিয়ে বলত আমার শরীরের প্রতিটি অংশ কেটে বস্তায় পুরে নদীতে ফেলে দেবে। কাঁদতাম, যতটা না নিজের জন্য তার চেয়ে বেশী মা আর আব্বার জন্য, তাঁরা বেঁচে আছেন কিনা জানতাম না। ঐ ভয়াবহ সময়ে আমি আমাদের বাড়ির বকুল গাছটার কথা ভাবতাম, বকুল ফুলের মালা, সাহানা আপার সাথে গান। কল্পনা করতাম সাহানা আপার মত আমি শব্দে রঙ দেখতে পাই। সব সময় যে শব্দে রঙের কল্পনাটা যে সাহায্য করত তা নয়, কিন্তু নিজেকে ঐ ধরণের অলৌকিক একটা গুণের অধিকারী ভেবে ক্যাম্পের পশুদের থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখতে পেতাম। ঐ কল্পনা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, এজন্য সাহানা আপার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
“একাত্তরের ৭ই ডিসেম্বর যশোহর ক্যান্টনমেন্ট মুক্ত হয়। ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মুর্তজা ভাইও ছিলেন। আমি যে যশোহরে ছিলাম সেটা উনি জানতেন। উনি আমাকে চিতলমারী নিয়ে গেলেন। আমার আব্বা-আম্মা জীবিত ছিলেন, ভাইটারও কিছু হয় নি। কিন্তু সাহানা আপাদের পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ওদিকে গ্রামের মানুষেরা, যাদের আমরা নিজেদের লোক ভাবতাম, আমাদের পরিবারের সঙ্গে অদ্ভুত ব্যবহার করতে শুরু করল। আমার জন্যই। মৃত্যু হলে সবকিছুর শেষ হয়, কিন্তু যুদ্ধে ধর্ষিতার দুর্দশা শেষ হবার নয়। মানুষের মন এত ছোট হয়ে কেন, ডাক্তার সাহেব? মুর্তজা ভাই খুলনা ছিলেন, আব্বা তাঁকে ডেকে নিয়ে এসে অভিযোগ করলেন। উনি জানতেন এর হয়তো একটাই প্রতিকার, আব্বাকে বললেন আমাকে বিয়ে করবেন। এতে কারুরই অমত ছিল না, বুঝতেই পারছেন। বিয়ের পর কিছুদিন খুলনা থেকে ঢাকায় চলে এলাম।

“আর এখন এসব নিয়ে কিছুই বলা যায় না। মানুষ ভান করে যেন এসব কিছুই হয় নি। তারা শুনতেও চায় না যুদ্ধে কী হয়েছিল, আর মানুষ হত্যার কথা যাও বা বলা যায়, ধর্ষণের কথা বলা একদম বারণ। রাজাকাররা ক্ষমতায় গেছে, ইতিহাস এমন নির্দয় কেন, ডাক্তার সাহেব?”
সালেহার প্রশ্নের জবাব আমার কাছে ছিল না। আমার নিজের জীবনের সীমাবদ্ধতার কথা ভাবি। সেই সীমাবদ্ধতা উৎরে সালেহাকে উপদেশ দেবার ক্ষমতা আমার ছিল না। কিন্তু ঐ সন্ধ্যায় সালেহা আমার কাছে কোনো উপদেশ বা রোগ নিরাময়ের সন্ধানে আসে নি, বরং আমার মনের বিভ্রান্তি দূর করার জন্যই এসেছিল।
“আর রহম রাজাকার, তার কী হল?” জিজ্ঞেস করি আমি। “রহম?,” হাসে সালেহা, দুঃখের হাসি, “রহম এখন বড় ব্যবসায়ী, ওপরতলার সঙ্গে তার দহরম।”
আর কী বলব ভেবে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে আপনি আসলে শব্দের সঙ্গে রঙ দেখতে পান না?” আমার প্রশ্নটা সময়োপযোগী ছিল না, এখন বলব নিতান্তই স্থূল ও নির্বোধ ছিল, কিন্তু সালেহা কিছু মনে করল না। সেই সন্ধ্যায় ডাক্তার ও রুগীর স্থান বদল হয়েছিল।
“পাই না বললে ভুল হবে, ডাক্তার সাহেব। আমি নিজেকে এখন বুঝিয়েছি যে দেখতে পাই, তা না হলে একাত্তর সনে আমি বেঁচে ফিরতাম না।” এই বলে হাসে সালেহা, বিজয়িনী হাসি। বুঝি রেবার অমলিন হাসির উৎস তার সালেহা-মা। তারপর এক সময়ে হাসি মিলিয়ে যায়, বলে, “মুর্তজা এখনো সাহানা আপাকে ভালবাসে, তা বাসুক, ঐ ভালবাসাটুকু তার প্রাপ্য। আমি আপাকে ঈর্ষা করি না, তাকে আমিও কম ভালবাসতাম না।”
সালেহার বাঁ-হাতের পোড়া চামড়ার দিকে তাকাই, তারপর তার উজ্জ্বল মুখের দিকে। দুর্বৃত্তরা তার হৃদয়কে পোড়াতে পারে নি, আগ্নেয়গিরির গলন্ত লাভাস্রোত পার হয়ে সেটা যেন লুব্ধক তারার মত জ্বলে। আমি সালেহার সাথে নিচে নেমে তাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিতে যাই। রিক্সায় ওঠার আগে তাকে জিজ্ঞেস করি, “আমি বুঝতে পারছি কেন মুর্তজা সাহেব আমাকে মিথ্যাবাদী ভেবেছিলেন, কিন্তু উনি আমার একটা কথাও শুনতে চাইলেন না সেটা আমার আশ্চর্য লাগছে।”

আমার কথাটার উত্তর দিতে সালেহা কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়, রথখোলা মোড়ের নিয়ন বাতির বিজ্ঞাপনের সবুজ আলোতে ওর মুখটা বর্ণময় হয়ে ওঠে। তারপর সে বলে, “ডাক্তার সাহেব, আসলে সাহানা আপার মৃতদেহ পাওয়া যায় নি। মৃতদেহ আবিষ্কারের কাহিনীটা মুর্তজা তার মেয়ের জন্য বানিয়েছে।”
সালেহার কথা বুঝতে আমার সময় লাগে, যে ঘটনাটা মনে হয়েছিল ধীরে ধীরে বোধগম্য সেটা হঠাৎ আঁধারে মিলিয়ে যায়।
“একাত্তরের আগস্ট মাসে মুর্তজা গ্রামে ফিরে দেখে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে পাক বাহিনী, তার শ্বশুর, শাশুড়ি, শ্যালক মারা গেছে। রেবাকে আমার আব্বা আম্মার কাছে পায়। ঐ সময়ে মুর্তজা ডোবায় ডুব দিয়ে, জাল ফেলে আরো নানাভাবে সাহানার দেহ খোঁজে করে। কিন্তু দেহ পায় না। আমি তখন আর্মি ক্যাম্পে বন্দী। গ্রামবাসীরা কানাঘুষা করে যে আমাকে ছাড়াও আর একজন নারীকে আর্মি ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু এটা স্বচক্ষে দেখেছে এমন কাউকে পাওয়া গেল না। যুদ্ধের পরে মুর্তজা খুলনা, পিরোজপুর, বরিশাল এরকম দশটা ক্যাম্পে সাহানা আপাকে খুঁজেছে, কিন্তু সারা দেশে এত ক্যাম্প ছিল যে সে শেষ পর্যন্ত খোঁজা বন্ধ করে দেয়। রেবাকে প্রবোধ দেয়ার জন্য তাদের বাড়িতেই একটা কবর করে, কিন্তু সেই কবরে কোনো দেহ নেই।
“প্রতিবছর মুর্তজার কাছে কেউ না কেউ আসে, বলে যে সে সাহানা আপাকে দেখেছে। প্রথম প্রথম মুর্তজা তাদের কথা শুনে খুঁজতে গেছে, কিন্তু কিছুই পায় নি। তাই এখ্ন সে আর এসব শুনতে চায় না।”
রথখোলা মোড়ের ভীড়টা হাল্কা হচ্ছিল। লোকের গুঞ্জন, গাড়ির আওয়াজ কমে আসছিল। সালেহা রিক্সায় ওঠে, হুড তুলে দিতে দিতে বলে, “অন্ধকার হলে আলোর রঙগুলো আরো ভাল করে দেখা যায়।” আমি বিড়বিড় করে বলি, সিনেস্থেশিয়া। সালেহা জিজ্ঞেস করে, “কিছু বললেন?” আমি মাথা নাড়াই, সিনেস্থেশিয়ার ব্যাখ্যা দেবার সময় এটা নয়।

সালেহা হাসে, হয়তো শুনতে পেয়েছে আমার কথা। হুডের থেকে মাথা বের করে বলে, “ঐ মালতী লতা দোলে।” রিক্সা চলতে শুরু করে। আমি বুঝতে পারি না সালেহার কথা। সালেহা প্রায় চিৎকার করে বলে, “প্রথম যেদিন সাহানা আপাকে দেখি উনি এই গানটা গাইছিলেন।” রিকশাটা ভিড়ে যতক্ষণ না হারিয়ে যায় ততক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকি।
ঐ বছরের নভেম্বর মাসে নূর হোসেন পুলিশের গুলিতে মারা যায়, তার বুকে লেখা ছিল, “স্বৈরাচার নিপাত যাক।” মনে পড়ে রেবা আমাকে বনগ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে দিয়েছিল। নূর হোসেনের বাড়ির সামনে দিয়েই আমরা হেঁটে গিয়েছিলাম।

Tuesday, June 12, 2018

অনলাইনের মাধ্যমে জমির খতিয়ান তোলার নিয়ম।


8.jpg
বিডিলাইভ ডেস্ক :
দেশের যেকোন নাগরিক যেকোন জায়গা হতে অনলাইনের মাধ্যমে তার অথবা ক্রয় করতে ইচ্ছুক জমির খতিয়ান তুলতে পারবে।

অনলাইন আবেদনের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ডরুম থেকে জমির বিভিন্ন রেকর্ড যেমন- এসএ (SA), সিএস (CS), বিআরএস (BRS) নকল/পর্চা/খতিয়ান/সার্টিফাইড কপি এখন খুব সহজে সংগ্রহ করতে পারবেন।

এর ফলে একদিকে জনগণ যেমন কোনো রকম ভোগান্তি ছাড়াই দ্রুত সেবা পাচ্ছে, অন্যদিকে সরবরাহকৃত রেকর্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিজিটাইজ হয়ে যাচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও এটুআই প্রোগ্রামের যৌথ উদ্যেগে ৬৪ জেলার রেকর্ড রুমের সকল এসএ (SA), সিএস (CS), বিআরএস(BRS) ও খতিয়ান কপি ডিজিটাইজ করা হচ্ছে।

সাধারণ আবেদন ও জরুরি আবেদন:
জমির খতিয়ানের জন্য দুইভাবে আবেদন করা যায়। জরুরি আবেদনের জন্য সাধারণত তিন কার্যদিবস এবং সাধারণ আবেদনের জন্য ৭-১০ কার্যদিবস লাগে।

জমির খতিয়ান তোলার প্রক্রিয়া:
জেলা ই-সেবা কেন্দ্রঃ জেলা প্রশাসকের জেলা ই-সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে ওয়ানস্টপ সার্ভিস গ্রহণ করা যায়।

ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রঃ দেশের বিভিন্ন ইউনিয়েনর পরিষদে অবস্থিত ইউআইএসসি থেকে নাগরিকগণ আবেদন করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ইউআইএসসি উদ্যেক্তাগণ সরকার নির্ধারিত কোর্ট ফি ছাড়াও জেলা প্রশাসন হতে নির্ধারিত হারে প্রসেসিং ফি নিবেন।

জেলা ওয়েব পোর্টালঃ জেলা তথ্য বাতায়নের সংশ্লিষ্ট জেলার ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেই নির্ধারিত ফর্মে আবেদন করতে পারবেন। জেলা ওয়েব পোর্টাল পাওয়া জন্য
http://www.bangladesh.gov.bd/ ঠিকানায় গিয়ে জেলা বাতায়নে যেতে হবে।

এরপর নিজ নিজ জেলার পোর্টালে গেলে ডান দিকের নিচে নকলের জন্য আবেদন এ ক্লিক করতে হবে।
এরপর একটি ফরম আসবে, সেটি সঠিকভাবে পূরণ করে দাখিল বাটনে ক্লিক করার পর প্রাপ্ত রশিদ প্রিন্ট করে কোর্ট ফি লাগিয়ে জেলা ই-সেবা কেন্দ্র পৌঁছে দিন। ফরমটি প্রিন্ট করতে না পারলে যে কোন সাদা কাগজে প্রয়োজনীয় কোর্ট ফি যুক্ত করে জেলা সেবা কেন্দ্রে পৌঁছে দিন।

খতিয়ান উত্তোলনের সাধারণ কোর্ট ফি ১০ টাকা ডেলিভারি ফি ২ টাকা, আর জরুরি কোর্ট ফি ২০ টাকা ডেলিভারা ফি ২ টাকা।

খতিয়ান প্রাপ্তি:
খতিয়ান (পর্চা) আপনি ডাকযোগে পেতে নির্ধারিত কলাম সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে। আপনার আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা এসএমএস এর মাধ্যমে জানার জন্য আপনার বর্তমান মোবাইল নম্বর প্রদান করতে হবে।

ঘরে বসে যেভাবে ভোটার হবেন বা পরিচয়পত্র সংশোধন করবেন।

1256480985_1446441611.jpg
প্রতিদিন হাজার হাজার নাগরিক জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন। আমরা অনেকেই জানি না বর্তমানে অনলাইনে আবেদন করে নতুন ভোটার হওয়া যায়।

তাছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার আইডির জন্য আবেদন করে সংশোধন করা যায়। একইসঙ্গে হারিয়ে গেলে, কোনো তথ্য সংশোধন বা ছবি পরিবর্তনও করা যাবে অনলাইনে।

সচিত্রে আলোচনা দেখে খুব সহজেই অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র বা ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ছবি পরিবর্তন, তথ্য পরিবর্তন ও নতুন ভোটার হবার বিস্তারিত নিয়মকানুন জানতে পারবেন। জেনে নিন বিস্তারিত-

অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্রের কি কি পরিবর্তন আপনি নিজেই করতে পারবেন ?
# তথ্য পরিবর্তন
# ঠিকানা পরিবর্তন
# ভোটার এলাকা স্থানান্তর
# পুনঃমূদ্রণ
#  ছবি পরিবর্তন
# আবেদনপত্রের হাল অবস্থা

কিভাবে ছবি পরিবর্তন ও তথ্য হালনাগাদ ও আপনার সকল ডাটাবেজ দেখতে পারবেন?

প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করতে এই লিংকে যান  Click

( এই সাইট https ফরম্যাটে হওয়াতে আপনার ফায়ারফক্স ব্রাউজারে এটা লেখা আসতে পারে This Connection is Untrusted সেক্ষেত্রে সমাধান হলো প্রথমে I Understand the Risks ক্লিক করেন তারপর ।
# On the warning page, click I Understand the Risks.
#  Click “Add Exception‘…. The Add Security Exception dialog will appear.
# Click “Confirm Security Exception” ক্লিক করুন সাইট চলে আসবে । )

কারা অনলাইন সেবার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করতে পারবেন

আপনি ভোটার হয়ে থাকলে রেজিষ্ট্রেশন করে এই ওয়েবসাইটের সুবিধা নিন। রেজিষ্ট্রেশন করতে নিন্মের ধাপসমূহ অনুসরণ করুণ-

১.প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী পূরণ করে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করুন।
২. আপনার কার্ডের তথ্য ও মোবাইলে প্রাপ্ত এক্টিভেশন কোড সহকারে লগ ইন করুন।
৩. তথ্য পরিবর্তনের ফর্মে তথ্য হালনাগাদ করে সেটির প্রিন্ট নিয়ে নিন।
৪.পৃন্টকৃত ফর্মে স্বাক্ষর করে সেটির স্ক্যানকৃত কপি অনলাইনে জমা দিন।
৫. তথ্য পরিবর্তনের স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় দলিলাদি কালার স্ক্যান কপি অনলাইনে জমা দিন।

এবার “রেজিষ্ট্রেশনফরম পূরন করতে চাই” ক্লিক করুন ।

এবার ফরমটি সঠিক ভাবে পুরন করুনঃ

# এন.আই.ডি নম্বরঃ (আপনার এন.আই.ডি নম্বর যদি ১৩ সংখ্যার হয় তবে অবশ্যই প্রথমে আপনার জন্মসাল দিয়ে নিবেন উদাহরণঃ আপনার কার্ড নাম্বার ১২৩৪৫৬৭৮৯১০০০ ও জন্মসাল ১৯৯০ আপনি এভাবে দিবেন ১৯৯০১২৩৪৫৬৭৮৯১০০০)

# জন্ম তারিখঃ (কার্ড দেখে সিলেক্ট করুন)
# মোবাইল ফোন নম্বরঃ (আপনার সঠিক মোবাইল নাম্বার দিন কারন মোবাইলে ভেরিফাই কোড পাঠাবে )
# ইমেইলঃ (ইচ্ছা হলে দিতে পারেন না দিলে সমস্যা নাই, ইমেইল আইডি দিলে পরবর্তীতে লগইন করার সময় ভেরিফাই কোড ইমেইলে সেন্ড করতে পারবেন যদি মোবাইল হাতের কাছে না থাকে)

· বর্তমান ঠিকানা
বিভাগ জেলা উপজেলা/থানা সিলেক্ট করুন ভোটার হবার সময় যা দিয়েছিলেন ।

· স্থায়ী ঠিকানা
বিভাগ জেলা উপজেলা/থানা সিলেক্ট করুন ভোটার হবার সময় যা দিয়েছিলেন ।

· লগইন পাসওয়ার্ড
পাসওয়ার্ড অবশ্যই ৮ সংখ্যার হতে হবে বড় হাতের অক্ষর ও সংখ্যা থাকতে হবে যেমনঃ InfoPedia71

এবার সঠিক ভাবে ক্যাপচা পূরণ করুন ছোট হাতের বড় হাতের অক্ষর বা সংখ্যা যা দেওয়া আছে তাই বসান তবে স্পেস দিতে হবেনা ।

এবার “রেজিষ্টার” বাটন ক্লিক করে দ্বিতীয় ধাপে চলে যান।

ফরম টি সঠিক ও সফল ভাবে রেজিস্টার করার পর দেখুন আপনার মোবাইলে ভেরিফাই কোড এসেছে ও ব্রাউজারে ঐ কোড সামমিট করার অপশন এসেছে , নিচের ছবির মত স্থানে আপনার মোবাইলেরভেরিফিকেশন কোড বাসান ও রেজিস্টার বাঁটনে ক্লিক করুন ।

(২ মিনিটের মধ্যে মোবাইলে কোড না আসলে পুন রায় কোড পাঠান (SMS) ক্লিক করুন)

সঠিক ভাবে কোড প্রবেশ করার পর আপনার Account Active হয়ে যাবে এবার নিচের ছবির মত পেইজ আসবে আপনাকে লগইন করতে বলা হবে অথবা লগইন লিংক >>https://services.nidw.gov.bd/login
লগইন করতে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ( ১৩ সংখ্যার হলে অবশ্যই প্রথমে আপনার জন্মসাল দিয়ে নিবেন) জন্মতারিখ ও আপনার দেওয়া পাসওয়ার্ড দিয়ে ভেরিফাই কোড কিভাবে পেতে চান তা সিলেক্ট করতে হবে ।

রেজিস্ট্রেশন করা মোবাইল নাম্বার আপনার হাতের কাছে থাকলে মোবাইলে তা নাহলে ইমেইলে সিলেক্ট করুন ।

এবার “সামনে” ক্লিক করুন ।

এবার আপনার সিলেক্ট করা অপশন মোবাইলে বা ইমেইল থেকে ভেরিফাই কোড বসিয়ে লগইন করুন ।

২ মিনিটের মধ্যে যদি কোড না আসে তবে “পুনরায় কোড পাঠান” বাটনে ক্লিক করুন ।

নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকা আপনার ডাটাবেজের সব তথ্য দেখা যাবে এবার। নিচের যেকোনো অপশনে চাহিদা অনুযায়ী ক্লিক করুন আর তথ্য হালনাগাদ করুন। এভাবেই আপনি আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংশোধন কিংবা ছবি পরিবর্তন করতে পারবেন খুব সহজেই।

কিভাবে অনলাইনে নতুন ভোটার হওয়া যাবে ?

অনলাইনে ভোটার হবার আবেদন করতে এই লিংকে যান https://services.nidw.gov.bd/newVoter

আপনার ভোটার তথ্য পুরন করুন । অনলাইনে ভোটার হতে নিচের শর্ত গুলো ভাল করে পড়ে নিন এবং “আমিরাজিওনিবন্ধনফরমপূরণকরতেচাই” ক্লিক করুন ।

নতুন ভোটার নিবন্ধন !!

১) নতুন ভোটার হিসাবে নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় আপনাকে স্বাগত জানাই।

ক) ভূমিকাঃ

# অনলাইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আপনি সঠিকভাবে ভোটার রেজিষ্ট্রেশন ফর্ম পূরণ করতে পারবেন)
# আপনি ইতোমধ্যে ভোটার হয়ে থাকলে পুনরায় আবেদন করার প্রয়োজন নেই। নিবন্ধিত ব্যাক্তি পুনরায় আবেদন করলে সেটি দন্ডনীয় অপরাধ
# নতুন ১৮ বয়সের অধিক, প্রবাসী বা বাদপড়া ভোটারগণ এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিবন্ধন করতে পারবেন
# বিস্তারিত জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন ।

খ। ধাপসমূহঃ

# ধাপে ধাপে সকল তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করুন
# নিজের পূর্ণনাম ছাড়া সকল তথ্য বাংলায় ইউনিকোডে পুরণ করুন
# সকল ধাপ সম্পন্ন হবার পরে প্রিভিউএর মাধ্যমে সকল তথ্য পুনর্বার যাচাই করে নিন
# পিডিএফ ফাইল তৈরি করে সেটি প্রিন্ট করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ নিকটস্থ নির্বাচন অফিসে জমা দিন
# আপনার প্রদত্ত তথ্যাদি যাচাই এবং ঠিকানা যাচাইয়ের পরে তথ্যাদি সঠিক নিশ্চিত হলে আপনার কার্ড তৈরি হবে
# কার্ডের রশিদ জমা দিয়ে কার্ড সংগ্রহ করুন
# ফরমের সাথে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের কপি জমা দিন

জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন সংক্রান্ত

১। প্রশ্নঃ কার্ডের তথ্য কিভাবে সংশোধন করা যায়?
উত্তরঃ এনআইডি রেজিস্ট্রেশন উইং/উপজেলা/থানা/জেলা নির্বাচন অফিসে ভুল তথ্য সংশোধনের জন্য আবেদন করতে হবে। সংশোধনের পক্ষে পর্যাপ্ত উপযুক্ত দলিলাদি আবেদনের সাথে সংযুক্ত করতে হবে।

২। প্রশ্নঃ কার্ডে কোন সংশোধন করাহলে তার কি কোন রেকর্ড রাখা হবে?
উত্তরঃ সকল সংশোধনের রেকর্ড সেন্ট্রাল ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকে।

৩। প্রশ্নঃ ভুল ক্রমে পিতা/স্বামী/মাতাকে মৃত হিসেবে উল্লেখ করা হলে সংশোধনের জন্য কিকি সনদ দাখিল করতে হবে?
উত্তরঃ জীবিত পিতা/স্বামী/মাতাকে ভুলক্রমে মৃত হিসেবে উল্লেখ করার কারণে পরিচয়পত্র সংশোধন করতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিচয়পত্র দাখিল করতে হবে।

৪। প্রশ্নঃ আমি অবিবাহিত। আমার কার্ডে পিতা না লিখে স্বামী লেখাহ য়েছে। কিভাবে তা সংশোধন করা যাবে?
উত্তরঃ সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা/জেলা নির্বাচন অফিসে আপনি বিবাহিত নন মর্মে প্রমাণাদিসহ আবেদন করতে হবে।

৫। প্রশ্নঃ বিয়ের পর স্বামীর নাম সংযোজনের প্রক্রিয়া কি?
উত্তরঃ নিকাহনামা ও স্বামীর আইডি কার্ড এর ফটোকপি সংযুক্ত করে NID Registration Wing/ সংশ্লিষ্ট উপজেলা/ থানা/ জেলা নির্বাচন অফিস বরাবর আবেদন করতে হবে।

৬।প্রশ্নঃ বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। এখন ID Card থেকেস্বামীর নাম কিভাবে বাদ দিতে হবে?
উত্তরঃ বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত দলিল (তালাকনামা) সংযুক্ত করে NID Registration Wing/সংশ্লিষ্ট উপজেলা/ থানা/ জেলা নির্বাচন অফিসে আবেদন করতে হবে।

৭। প্রশ্নঃ বিবাহ বিচ্ছেদের পর নতুন বিবাহ করেছি এখন আগের স্বামীর নামের স্থলে বর্তমান স্বামীর নাম কি ভাবে সংযুক্ত করতে পারি?
উত্তরঃ প্রথম বিবাহ বিচ্ছেদের তালাকনামা ও পরবর্তী বিয়ে কাবিননামাসহ সংশোধন ফর্ম পূরণ করে আবেদন করতে হবে।

৮। প্রশ্নঃ আমি আমার পেশা পরিবর্তন করতে চাই কিন্তু কিভাবে করতে পারি?
উত্তরঃ এনআইডি রেজিস্ট্রেশন উইং/উপজেলা/জেলা নির্বাচন অফিসে প্রামাণিক কাগজপত্র দাখিল করতে হবে। উলেখ্য, আইডি কার্ডে এ তথ্য মুদ্রণ করা হয় না।

৯। প্রশ্নঃ আমার ID Card এরছবি অস্পষ্ট, ছবি পরিবর্তন করতেহলে কি করা দরকার?
উত্তরঃ এক্ষেত্রে নিজে সরাসরি উপস্থিত হয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে আবেদন করতে হবে।

১০। প্রশ্নঃ নিজ/পিতা/স্বামী/মাতার নামের বানান সংশোধন করতে আবেদনের সাথে কি কি দলিল জমা দিতে হবে?
উত্তরঃ এসএসসি/সমমান সনদ, জন্ম সনদ, পাসপোর্ট, নাগরিকত্ব সদন, চাকুরীর প্রমাণপত্র, নিকাহ্‌নামা, পিতা/স্বামী/মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি জমা দিতে হয়।

১১। প্রশ্নঃ নিজের ডাক নাম বা অন্যনামেনিবন্ধিত হলে সংশোধনে রজন্য আবেদনের সাথে কি কি দলিল জমা দিতে হবে?
উত্তরঃ এসএসসি/সমমান সনদ, বিবাহিতদের ক্ষেত্রে স্ত্রী/ স্বামীর জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি, ম্যাজিট্রেট কোর্টে সম্পাদিত এফিডেভিট ও জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি,ওয়ারিশ সনদ,ইউনিয়ন/পৌর বা সিটি কর্পোরেশন হতে আপনার নাম সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র।

১২। প্রশ্নঃ পিতা/মাতাকে ‘মৃত’ উল্লেখ করতে চাইলে কিকি সনদ দাখিল করতে হয়?
উত্তরঃ পিতা/মাতা/স্বামী মৃত উল্লেখ করতে চাইলে মৃত সনদ দাখিল করতে হবে।

১৩। প্রশ্নঃ ঠিকানা কিভাবে পরিবর্তন/ সংশোধন করা যায়?
উত্তরঃ শুধুমাত্র আবাসস্থল পরিবর্তনের কারনেই ঠিকানা পরিবর্তনের জন্য বর্তমানে যে এলাকায় বসবাস করছেন সেই এলাকার উপজেলা/ থানা নির্বাচন অফিসে ফর্ম ১৩ এর মাধ্যমে আবেদন করা যাবে। তবে একই ভোটার এলাকার মধ্যে পরিবর্তন বা ঠিকানার তথ্য বা বানানগত কোন ভুল থাকলে সাধারণ সংশোধনের আবেদন ফরমে আবেদন করে সংশোধন করা যাবে।

১৪। প্রশ্নঃ আমি বৃদ্ধ ও অত্যন্ত দরিদ্র ফলে বয়স্কভাতা বাঅন্য কোন ভাতা খুব প্রয়োজন।কিন্তু নির্দিষ্ট বয়স নাহওয়ার ফলে কোন সরকারী সুবিধা পাচ্ছিনা।লোকে বলে ID Card –এ বয়সটা বাড়ালে ঐ সকল ভাতা পাওয়া যাবে?
উত্তরঃ ID Card এ প্রদত্ত বয়স প্রামাণিক দলিল ব্যতিত পরিবর্তন সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, প্রামানিক দলিল তদন্ত ও পরীক্ষা করে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

১৫। প্রশ্নঃ একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের কার্ডে পিতা/মাতার নাম বিভিন্ন ভাবে লেখাহয়েছে কিভাবে তাসংশোধন করা যায়?
উত্তরঃ সকলের কার্ডের কপি ও সম্পর্কের বিবরণ দিয়ে NID Registration Wing/ উপজেলা/ জেলা নির্বাচন অফিস বরাবর পর্যাপ্ত প্রামাণিক দলিলসহ আবেদন করতে হবে।

১৬। প্রশ্নঃ আমি পাশনাকরে ও অজ্ঞতা বশতঃশিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা তদুর্দ্ধ লিখেছিলাম এখন আমার বয়স বা অন্যান্য তথ্যা দিসংশোধনের উপায়কি?
উত্তরঃ আপনি ম্যাজিট্রেট আদালতে এস.এস.সি পাশ করেননি, ভুলক্রমে লিখেছিলেন মর্মে হলফনামা করে এর কপিসহ সংশোধনের আবেদন করলে তা সংশোধন করা যাবে।

১৭। প্রশ্নঃ ID Card এঅন্য ব্যক্তির তথ্য চলেএ সেছে।এ ভুল কি ভাবে সংশোধন করা যাবে?
উত্তরঃ ভুল তথ্যের সংশোধনের পক্ষে পর্যাপ্ত দলিল উপস্থাপন করে NID Registration Wing/সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা/জেলা নির্বাচন অফিসে আবেদন করতে হবে।এক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক যাচাই করার পর সঠিক পাওয়া গেলে সংশোধনের প্রক্রিয়া করা হবে।

১৮। প্রশ্নঃ রক্তের গ্রুপ অন্তর্ভূক্ত বা সংশোধনের জন্য কি করতে হয়?
উত্তরঃ রক্তের গ্রুপ অন্তর্ভুক্ত বা সংশোধন করতে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়কৃত ডায়াগনোসটিক রিপোর্ট দাখিল করতে হয়।

১৯। প্রশ্নঃবয়স/ জন্ম তারিখ পরিবর্তন করার প্রক্রিয়া কি?
উত্তরঃ এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার সনদের সত্যায়িত ফটোকপি আবেদনের সাথে জমা দিতে হবে। এসএসসি বা সমমানের সনদ প্রাপ্ত না হয়ে থাকলে সঠিক বয়সের পক্ষে সকল দলিল উপস্থাপনপূর্বক আবেদন করতে হবে। আবেদনের পর বিষয়টি তদন্তপূর্বক প্রয়োজনে ডাক্তারী পরীক্ষা সাপেক্ষে সঠিক নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে।

২০। প্রশ্নঃ স্বাক্ষর পরিবর্তন করতে চাই, কিভাবে করতে পারি?
উত্তরঃ নতুন স্বাক্ষর এর নমুনাসহ গ্রহণযোগ্য প্রমাণপত্র সংযুক্ত করে আবেদন করতে হবে। তবে স্বাক্ষর একবারই পরিবর্তন করা যাবে।

২১। প্রশ্নঃ আমার জন্মতারিখ যথাযথ ভাবে লেখা হয় নি, আমার কাছে প্রামাণিক কোন দলিল নেই, কিভাবে সংশোধন করা যাবে?
উত্তরঃ সংশ্লিষ্ট উপজেলা/জেলা নির্বাচন অফিসে আবেদন করতে হবে। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

২২। প্রশ্নঃএকটি কার্ড কতবা রসংশোধন করা যায়?
উত্তরঃ এক তথ্য শুধুমাত্র একবার সংশোধন করা যাবে। তবে যুক্তিযুক্ত না হলে কোন সংশোধন গ্রহণযোগ্য হবে না।

১। প্রশ্নঃ ID Card হারিয়ে গিয়েছে। কিভাবে নতুন কার্ড পেতে পারি?উত্তরঃ নিকটতম থানায় জিডি করে জিডির মূল কপিসহ সংশ্লিষ্ট উপজেল/থানা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়ে অথবা ঢাকায় জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে আবেদন করতে হবে।

২। প্রশ্নঃ হারা নোআইডি কার্ড পেতে বা তথ্য সংশোধনের জন্য কি কোন ফি দিতে হয়?উত্তরঃ এখনো হারানো কার্ড পেতে কোন প্রকার ফি দিতে হয় না। তবে ভবিষ্যতে হারানো আইডি কার্ড পেতে/সংশোধন করতে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফি ধার্য করা হবে।

৩। প্রশ্নঃ হারানো ওসংশোধন একই সাথে করাযায় কি?
উত্তরঃ হারানো ও সংশোধন একই সাথে সম্ভব নয়। আগে হারানো কার্ড তুলতে হবে, পরবর্তীতে সংশোধনের জন্য আবেদন করা যাবে।

৪। প্রশ্নঃ হারিয়ে যাওয়া আইডিকার্ড কি ভাবে সংশোধন করব?
উত্তরঃ প্রথমে হারানো আইডি কার্ড উত্তোলন করে তারপর সংশোধনের আবেদন করতে হবে।

৫। প্রশ্নঃ প্রাপ্তিস্বীকার পত্র / স্লিপ হারালে করণীয় কি?
উত্তরঃ স্লিপ হারালেও থানায় জিডি করে সঠিক ভোটার আইডি নাম্বার দিয়ে হারানো কার্ডের জন্য আবেদন পত্র জমা দিতে হবে।

৬। প্রশ্নঃ প্রাপ্তিস্বীকারপত্র / ID Card হারিয়ে গেছে কিন্তু কোন Document নেইবা NID নম্বর/ ভোটার নম্বর/ স্লিপের নম্বর নেই, সেক্ষেত্রে কি করণীয়?
উত্তরঃ সংশ্লিষ্ট উপজেলা/ থানা/ জেলা নির্বাচন অফিস থেকে Voter Number সংগ্রহ করে NID Registration Wing/ উপজেলা/ থানা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়ে আবেদন করতে হবে।

৭। প্রশ্নঃ জাতীয় পরিচয় পত্রে নেই কিন্তু তথ্য পরিবর্তিত হয়েছে এমন তথ্যাদিপরিবর্তন কি ভাবে সম্ভব?
উত্তরঃজাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে এ সংক্রান্ত কাগজপত্রাদি সহ আবেদন করলে যাচাই-বাছাই করে বিবেচনা করা হবে।

৮। প্রশ্নঃ জাতীয় পরিচয়পত্রের মান বর্তমানে তেমন ভালো না এটা কি ভবিষ্যতে উন্নতকরা রসম্ভাব না আছে?
উত্তরঃ হ্যাঁ। আগামীতে স্মার্ট আইডি কার্ড প্রদানের জন্য কাযর্ক্রম চলমান আছে যাতে অনেক উন্নত ও আধুনিক ফিচার সমৃদ্ধ থাকবে এবং মান অনেক উন্নত হবে।

১। প্রশ্নঃ আমি যথাসময়ে ভোটার হিসেবে Registration করতে পারিনি।এখন কি করা যাবে?
উত্তরঃ সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা/জেলা নির্বাচন অফিসে যথাযথ কারণ উল্লেখপূর্বক আবেদন করতে পারেন।

২। প্রশ্নঃ আমি বিদেশে অবস্থানের কারণে Voter Registration করতে পারিনি, এখন কি ভাবে করতে পারবো?
উত্তরঃ সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা/জেলা নির্বাচন অফিসে বাংলাদেশ পাসপোর্ট-এর অনুলিপিসহ জন্ম সনদ, নাগরিকত্ব সনদ, এসএসসি (প্রযোজ্যক্ষেত্রে) সনদ, ঠিকানার সমর্থনে ইউটিলিটি বিলের কপি বা বাড়ী ভাড়া বা হোল্ডিং ট্যাক্সের রশিদের কপিসহ আবেদন করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ফর্মসমূহ পূরণ করতে হবে।

৩। প্রশ্নঃ আমি২০০৭/২০০৮ অথবা ২০০৯/২০১০ সালে ভোটার রেজিস্ট্রেশন করেছি কিন্তু সেইসময় আইডিকার্ড গ্রহণ করিনি।এখন কিভাবে আইডিকার্ড পেতে পারি?

উত্তরঃ আপনি আপনার ভোটার রেজিস্ট্রেশনের সময় প্রদত্ত প্রাপ্তি স্বীকার পত্রটি নিয়ে যে স্থানে ভোটার হয়েছেন সেই এলাকার উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসে যোগাযোগ করুন। যদি সেখানেও না পাওয়া যায় তাহলে প্রাপ্তি রশিদে উপজেলা নির্বাচন অফিসারের মন্তব্যসহ স্বাক্ষর ও সিল দিয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে যোগাযোগ করা যাবে।

৪। প্রশ্নঃ ভোটার তালিকার নামের সাথে বিভিন্ন খেতাব, পেশা, ধর্মীয় উপাধি, পদবী ইত্যাদি যুক্ত করা যাবে কি না?

উত্তরঃ ভোটার তালিকার ডাটাবেজে শুধুমাত্র নাম সংযুক্ত করা হয়, কোন উপাধি বা অর্জিত পদবী তাতে সংযুক্ত করার অবকাশ নাই।

৫। প্রশ্নঃ কোথা হতে ID Card সংগ্রহ করা যাবে?
উত্তরঃ যে এলাকায় ভোটার রেজিস্ট্রেশন করেছেন সেই এলাকার উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিস থেকে ID Card সংগ্রহ করা যাবে।

৬। প্রশ্নঃআমি বিদেশে চলে যাব।আমার কার্ডকি অন্য কেউ উত্তোলন করতে পারবে?
উত্তরঃ হ্যাঁ । আপনার ক্ষমতা প্রাপ্ত প্রতিনিধির যথাযথ ক্ষমতাপত্র ও প্রাপ্তি স্বীকারপত্র (Authorization Letter) নিয়ে তা সংগ্রহ করাতে পারবে।

৭। প্রশ্নঃ কার্ডে ইচ্ছাকৃ তভুল তথ্য দিলে কিহবে?
উত্তরঃ জেল বা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দণ্ডিত হতে পারে।

৮। জাতীয় পরিচয় পত্রন ম্বর১৩ আবার কারো ১৭কেন?
উত্তরঃ ২০০৮ এর পরে যত আইডি কার্ড প্রিন্ট করা হচ্ছে বা পুণঃ তৈরি হচ্ছে সে সকল কার্ডের নম্বর ১৭ ডিজিট হয়ে থাকে।

৯। প্রশ্নঃ বিভিন্ন দলিলে আমার বিভিন্ন বয়স/নাম আছে।কোনটা ভোটার রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে?
উত্তরঃ এসএসসি অথবা সমমানের পরীক্ষার সনদে উল্লেখিত বয়স ও নাম। ভবিষ্যতে ৫ম/৮ম সমাপনী পরীক্ষার সনদ ও গ্রহণযোগ্য হবে।লেখাপড়া না জানা থাকলে জন্ম সনদ,পাসপোর্ট,ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে ও আবেদন করা যাবে।

১০। প্রশ্নঃ আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে কি ডুপ্লিকেট এন্ট্রিসনাক্ত করা সম্ভব?
উত্তরঃ হ্যাঁ, সনাক্ত করা সম্ভব।

১১। প্রশ্নঃ এক ব্যক্তির পক্ষেকি একাধিক নামেও বয়সে একাধিক কার্ডপাওয়া সম্ভব?
উত্তরঃ না। একজন একটি মাত্র কার্ড করতে পারবেন। তথ্য গোপন করে একাধিক স্থানে ভোটার হলে কেন্দ্রীয় সার্ভারে আঙুলের ছাপ দ্বারা তা ধরা পড়বে এবং তার বিরুদ্ধে মামলা হবে।

১২। প্রশ্নঃ নতুন ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে কি কি কাগজ পত্রাদি প্রয়োজন?
উত্তরঃ জন্ম নিবন্ধন সনদ, এস,এস,সি বা সমমানের পরীক্ষা পাসের সনদ (যদি থাকে), ঠিকানা প্রমানের জন্য কোন ইউটিলিটি বিলের কপি, নাগরিক সনদ, বাবা-মা এবং বিবাহিত হলে স্বামী/স্ত্রীর NID কার্ডের ফটোকপি, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, TIN নম্বর (যদি থাকে)।

১৩। প্রশ্নঃ আমি খুব দরিদ্র ও বয়স ১৮বছরে রকম।১৮ বছরে রউপরে বয়স দেখিয়ে একটি ID Card পেলে গার্মেন্টেস ফ্যাক্টরিতে বা অন্য কোথাও চাকুরী পেতে পারি।মানবিক কারণে এই পরিস্থিতি বিবেচনা করা যায় কি?
উত্তরঃ না। ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।মানবিক বিবেচনার কোন সুযোগ নেই।

১৪। প্রশ্নঃ আমি ভুলে দু’বার রেজিস্ট্রেশন করে ফেলে ছি এখন কিকরবো?
উত্তরঃ যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টি সংশ্লিষ্ট জেলা নির্বাচন অফিসে লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা জানান। বর্তমানে Finger Print Matching কার্যক্রম চলছে। অচিরেই সকল Duplicate Entry সনাক্ত করা হবে। উল্লেখ্য, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

১৫। প্রশ্নঃ ID Card আছে কিন্তু ২০০৮ এর সংসদনির্বাচনের সময় ভোটার তালিকায় নাম ছিল না।এরূপ সমস্যা সমাধানে রউপায় কি?
উত্তরঃ অবিলম্বে NID Registration Wing/ উপজেলা/ জেলা নির্বাচন অফিসে যোগাযোগ করুন।

১৬। প্রশ্নঃ এক জনের কার্ডঅ ন্যজন সংগ্রহ করতে পারবে কি না?
উত্তরঃ ক্ষমতাপত্র ও প্রাপ্তিস্বীকার রশিদ নিয়ে আসলে সংগ্রহ করা যাবে।

১৭। প্রশ্নঃ আপনারা বিভিন্ন ফরমের কথা বলেছেন? এগুলো কোথায় পাওয়া যাবে?
উত্তরঃ NID Registration Wing/উপজেলা/জেলা নির্বাচন অফিসে যোগাযোগ করে সংগ্রহ করা যাবে অথবা Website : http://www.ecs.gov.bd বা http://www.nidw.gov.bd থেকে ডাউন-লোড করা যাবে।

১৮। প্রশ্নঃ এইসমস্ত ফরমের জন্য কোন মূল্য পরিশোধ করতে হয় কি না?
উত্তরঃ না।

জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়ে গেলে করণীয়

১। প্রশ্নঃ কার্ডের তথ্য কিভাবে সংশোধন করা যায়?
উত্তরঃ এনআইডি রেজিস্ট্রেশন উইং/উপজেলা/থানা/জেলা নির্বাচন অফিসে ভুল তথ্য সংশোধনের জন্য আবেদন করতে হবে। সংশোধনের পক্ষে পর্যাপ্ত উপযুক্ত দলিলাদি আবেদনের সাথে সংযুক্ত করতে হবে।

২। প্রশ্নঃ কার্ডে কোন সংশোধন করা হলে তারকি কোন রেকর্ড রাখা হবে?
উত্তরঃ সকল সংশোধনের রেকর্ড সেন্ট্রাল ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকে।

৩। প্রশ্নঃ ভুল ক্রমে পিতা/স্বামী/মাতাকে মৃতহিসেবে উল্লেখ করা হলে সংশোধনের জন্য কি কি সনদ দাখিল করতে হবে?
উত্তরঃ জীবিত পিতা/স্বামী/মাতাকে ভুলক্রমে মৃত হিসেবে উল্লেখ করার কারণে পরিচয়পত্র সংশোধন করতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিচয়পত্র দাখিল করতে হবে।

৪। প্রশ্নঃ আমি অবিবাহিত। আমার কার্ডে পিতা না লিখে স্বামী লেখা হয়েছে। কিভাবে তা সংশোধন করা যাবে?
উত্তরঃ সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা/জেলা নির্বাচন অফিসে আপনি বিবাহিত নন মর্মে প্রমাণাদিসহ আবেদন করতে হবে।

৫। প্রশ্নঃ বিয়ের পর স্বামীর নাম সংযোজনের প্রক্রিয়া কি?
উত্তরঃ নিকাহনামা ও স্বামীর আইডি কার্ড এর ফটোকপি সংযুক্ত করে NID Registration Wing/ সংশ্লিষ্ট উপজেলা/ থানা/ জেলা নির্বাচন অফিস বরাবর আবেদন করতে হবে।

৬। প্রশ্নঃ বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।এখন ID Card থেকেস্বামীর নাম বিভাবে বাদ দিতে হবে?
উত্তরঃ বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত দলিল (তালাকনামা) সংযুক্ত করে NID Registration Wing/সংশ্লিষ্ট উপজেলা/ থানা/ জেলা নির্বাচন অফিসে আবেদন করতে হবে।

৭। প্রশ্নঃ বিবাহ বিচ্ছেদের পর নতুন বিবাহ করেছি এখন আগের স্বামীর নামের স্থলে বর্তমান স্বামীর নাম কিভাবে সংযুক্ত করতে পারি?
উত্তরঃ প্রথম বিবাহ বিচ্ছেদের তালাকনামা ও পরবর্তী বিয়ে কাবিননামাসহ সংশোধন ফর্ম পূরণ করে আবেদন করতে হবে।

৮। প্রশ্নঃ আমি আমার পেশা পরিবর্তন করতে চাই কিন্তু কি ভাবে করতে পারি?
উত্তরঃ এনআইডি রেজিস্ট্রেশন উইং/উপজেলা/জেলা নির্বাচন অফিসে প্রামাণিক কাগজপত্র দাখিল করতে হবে। উলেখ্য, আইডি কার্ডে এ তথ্য মুদ্রণ করা হয় না।

৯। প্রশ্নঃ আমার ID Card এর ছবি অস্পষ্ট, ছবি পরিবর্তন করতে হলে কি করা দর কার?
উত্তরঃ এক্ষেত্রে নিজে সরাসরি উপস্থিত হয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে আবেদন করতে হবে।

১০। প্রশ্নঃ নিজ/পিতা/স্বামী/মাতার নামের বানান সংশোধন করতে আবেদনের সাথে কি কি দলিল জমা দিতে হবে?
উত্তরঃ এসএসসি/সমমান সনদ, জন্ম সনদ, পাসপোর্ট, নাগরিকত্ব সদন, চাকুরীর প্রমাণপত্র, নিকাহ্‌নামা, পিতা/স্বামী/মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি জমা দিতে হয়।

১১। প্রশ্নঃ নিজের ডাক নাম বা অন্য নামে নিবন্ধিত হলে সংশোধনের জন্য আবেদনের সাথে কি কি দলিল জমা দিতে হবে?
উত্তরঃ এসএসসি/সমমান সনদ, বিবাহিতদের ক্ষেত্রে স্ত্রী/ স্বামীর জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি, ম্যাজিট্রেট কোর্টে সম্পাদিত এফিডেভিট ও জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি,ওয়ারিশ সনদ,ইউনিয়ন/পৌর বা সিটি কর্পোরেশন হতে আপনার নাম সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র।

১২। প্রশ্নঃ পিতা/ মাতাকে ‘মৃত’ উল্লেখ করতে চাইলে কি কি সনদ দাখিল করতে হয়?
উত্তরঃ পিতা/মাতা/স্বামী মৃত উল্লেখ করতে চাইলে মৃত সনদ দাখিল করতে হবে।

১৩। প্রশ্নঃ ঠিকানা কিভাবে পরিবর্তন/ সংশোধন করা যায়?
উত্তরঃ শুধুমাত্র আবাসস্থল পরিবর্তনের কারনেই ঠিকানা পরিবর্তনের জন্য বর্তমানে যে এলাকায় বসবাস করছেন সেই এলাকার উপজেলা/ থানা নির্বাচন অফিসে ফর্ম ১৩ এর মাধ্যমে আবেদন করা যাবে। তবে একই ভোটার এলাকার মধ্যে পরিবর্তন বা ঠিকানার তথ্য বা বানানগত কোন ভুল থাকলে সাধারণ সংশোধনের আবেদন ফরমে আবেদন করে সংশোধন করা যাবে।

১৪। প্রশ্নঃ আমি বৃদ্ধ ও অত্যন্ত দরিদ্র ফলে বয়স্ক ভাতা বা অন্য কোন ভাতা খুব প্রয়োজন। কিন্তু নির্দিষ্ট বয়স না হওয়ার ফলে কোন সরকারী সুবিধা পাচ্ছিনা। লোকে বলে ID Card –এবয়স টা বাড়ালে ঐসকল ভাতা পাওয়া যাবে?

উত্তরঃ ID Card এ প্রদত্ত বয়স প্রামাণিক দলিল ব্যতিত পরিবর্তন সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, প্রামানিক দলিল তদন্ত ও পরীক্ষা করে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

র গ্রুপ অন্তর্ভুক্ত বা সংশোধন করতে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়কৃত ডায়াগনোসটিক রিপোর্ট দাখিল করতে হয়।

উল্লেখ্য, ১ সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নবায়ন এবং হারানো বা নষ্ট হলে নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র নেয়ার জন্য আলাদা আলাদা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বর্তমানে লাগেনা।

পরিচয়পত্র নবায়ন করতে সাধারণ ১শ’ টাকা ও জরুরি ১৫০ টাকা দিতে হবে। হারিয়ে ফেললে বা নষ্ট হলে নতুন পরিচয়পত্র নিতে প্রথমবার আবেদনে ২শ’ টাকা, জরুরি ভিত্তিতে ৩শ’ টাকা। দ্বিতীয়বার আবেদনে ৩শ’ টাকা জরুরি ভিত্তিতে ৫শ’ এবং পরবর্তী যে কোনো ৫শ’ টাকা ও জরুরি প্রয়োজনে ১ হাজার টাকা দিতে হবে ।

বর্তমানে ৯ কোটি ৬২ লাখেরও বেশি ভোটারের জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। তাদেরকে বিনামূল্যে লেমিনেটে পরিচয়পত্র দেয়া হয়। এর মেয়াদ রয়েছে ১৫ বছর। এ সময়ের পরেই নবায়ন করা যাবে এ পরিচয়পত্র। তবে হারানো বা নষ্ট হলে গেলে ডুপ্লিকেট পরিচয়পত্র সংগ্রহে ইসির পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে আবেদন করতে হয়। এ আবেদনের মাধ্যমে এতদিন বিনামূল্যে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা যেত। এখন থেকে নির্ধারিত ফি ইসি সচিব বরাবর পে অর্ডার বা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জমা দিয়ে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে হবে।

Saturday, June 9, 2018

ধর্মের প্রধান ধর্মপ্রবর্তক-ঈশ্বর ও শয়তান প্রধান স্তম্ভ!

-আরজ আলী(জুনয়ির)

ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বুঝি, ধর্মের মূল উপাদান চারটি। যথাক্রমে- ১) ধর্মপ্রবর্তক, ২) ঈশ্বর, ৩) শয়তান এবং ৪) ঐশ্বী বাণী (গ্রন্থ)। ধর্মে বিশ্বাসী হতে হলে এ চারটি মূল উপাদানে সম্পূর্ণ ও প্রশ্নহীন বিশ্বাসী হলেই চলবে না, আমৃত্যু এবং অবশ্য-অবশ্যই হিমালয়ের ন্যায় অটল এবং গর্বিত থাকতে হবে। একবিন্দু দ্বিধা কিংবা সংশয় থাকলে স্বর্গপ্রাপ্তির আশা শেষ। যদিও সন্দেহ-সংশয়, যুক্তিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা, অজানাকে জানার দুর্দমনীয় বাসনা… না থাকলে সত্য জানা সম্ভব না, ধর্মে যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জানি, তিন নম্বর (শয়তান) ছাড়া অন্য উপাদানগুলো নিয়ে ধার্মিকরা প্রশ্ন তুলবে না। তিন নম্বর নিয়ে উঠবে- “শয়তান কীভাবে ধর্মের উপাদন হলো?” মূলত শয়তান ছাড়া ঈশ্বর এবং ধর্ম দুটোই অসম্পূর্ণ, বরং এরা একে অপরের পরিপূরক। যেমন, শয়তান মানুষকে মন্দ কাজে প্ররোচিত করে, তা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ ঈশ্বরকে ডাকে। ধর্মসৃষ্টিকারীরা হয়তো ভেবেছিলো, শয়তানের ভয়ে মানুষ ঈশ্বর এবং তাদেরকে বেশি বেশি ডাকবে! এজন্যই শয়তানকে তাদের খুব বেশি প্রয়োজন। না হলে শয়তান সৃষ্টি করতোই না। অতএব ঈশ্বর আছে, তাই শয়তানও আছে কিংবা শয়তান আছে, তাই ঈশ্বরও আছে। সেহেতু ঈশ্বর এবং শয়তান দুটোই ধর্মের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। কারণ (ধর্মানুসারে), এ দুটোই মানুষের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখে এবং প্রকৃতির উপর প্রভাব খাটানো ছাড়াও মানুষ দিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত যা খুশি করতে বা করাতে পারে। আবার, দু’জনেই মানুষকে নিজেদের বাধ্য রাখতে লোভ দেখায়। ঈশ্বর দেখায় স্বর্গের, শয়তান দেখায়- ধন-সম্পদ, নারী, বাড়ি, গাড়ি, ক্ষমতা, দুর্নীতি, লুটপাট… (ধর্মানুসারে নরকের)। মানুষকে লোভে ফেলতে ঈশ্বর ও শয়তানের যেন নিরন্তর যুদ্ধ চলছেই (ভালো বা খারাপ), এ থেকে মানুষের মুক্তির পথ দেখি না! জানি না, বিদ্বানগণ দেখতে বা জানতে পারছেন কিনা! এব্যাপারে ঈশ্বর ও শয়তানের ক্ষমতা প্রায় সমান সমান। যদিও ঈশ্বর এবং শয়তান দুটোই অদৃশ্য ও মারাত্মক ভাইরাস! একইসঙ্গে এ দুটো মানুষের হার্ডডিস্কের (মস্তিষ্কের) প্রচণ্ড ক্ষতি করছে!
যদিও ভালো কিংবা মন্দ, কোনটার জন্যই লোভ দেখানো অন্যায়। যেমন, ভালো ফলপ্রাপ্তির জন্য লোভ দেখানো হলেও কেউ যখন বারবার অকৃতকার্য হয়, তখন ভালোর জন্য লোভেও কাজ হয় না। উদাহরণস্বরূপ, চুরি করা মহাপাপ (নিঃসন্দেহে ভালো কথা)। কিংবা পাপ করলে স্বর্গলাভ হবে না। ধর্ম স্বর্গের লোভ দেখিয়ে চুরি বন্ধ করতে চেয়েছে। কিন্তু হায়! ধর্মের দেখানো লোভেই যদি চুরি বন্ধ হতো, তাহলে স্বর্গের কী প্রয়োজন ছিলো? পুরো পৃথিবীটাই তো স্বর্গ হয়ে যেতো। ভাগ্যিস পাপের ভয়ে বাঙালি চুরি বন্ধ রাখেনি, রাখলে লক্ষ লক্ষ নিরাপত্তা রক্ষি এবং তাদের পরিবারদের ভাতে মরতে হতো! যাহোক- চালাক, ধনী, পুঁজিবাদি, ক্ষমতাধর… চোরদের কথা নয়। বলছি, অতি দরিদ্ররা যখন দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে এবং বাধ্য হয়ে চুরি করে, তখনও কিন্তু স্বর্গলোভে কাজ হয় না। তেমনি কোনো জাতি যখন ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার লোভে মত্ত থাকে, তখন ধর্মের তথা স্বর্গের লোভে তা বন্ধ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব এবং লোকদেখানো। তাছাড়া ধনাসক্তি, ক্ষমতাসক্তি… এসবের ফলাফল নগদ বা তাৎক্ষণিক আর স্বর্গের ফলাফল সম্পূর্ণটাই বাকি এবং অদৃশ্য ও অনিশ্চিত। অতএব, অদৃশ্য লোভের কারণে মানুষ কেনো নিশ্চিত প্রাপ্য ছেড়ে দেবে? যার প্রমাণ বাংলাদেশের মানুষ, এরা যেমন প্রায় শতভাগ ধার্মিক তথা স্বর্গলোভে মত্ত, তেমনি প্রায় শতভাগই দুর্নীতিপরায়ন অর্থাৎ নগদ প্রাপ্তির নেশায় মত্ত। ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার লোভ যেমনি মারাত্মক/ভয়ানক হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি ধর্মের লোভগুলোও কখনো কখনো মারাত্মক/ভয়ানক আকার ধারণ করে। ফলে ঈশ্বরের নামে যেমন ধর্মসন্ত্রাস হচ্ছে, শয়তানের নামেও (প্ররোচনায়ও) হচ্ছে। অর্থাৎ শয়তানের হুকুমে যেমন কেউ সন্ত্রাসী হয়, ঈশ্বরের হুকুমেও হয়। পরিপূরক হলেও, এরা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিও বটে। যদিও ধর্মানুসারে শয়তান মানুষকে দিয়ে শুধু খারাপ কাজই করায়, ঈশ্বর ভালো কাজ করায়! তথাপিও বহু খারাপ বা মানবতাবিরোধি কাজ আছে, যাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঈশ্বরেরও নির্দেশ থাকে। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- শয়তান যদি ঈশ্বরের অনুসারীদের দিয়ে খারাপ কাজ করাতে পারে, তাহলে শয়তান কী ঈশ্বরের চাইতেও শক্তিশালী? অথবা ঈশ্বর যা চায়, এর বিপরীত কাজ শয়তান দ্বারা সাধিত হলে ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠত্ব থাকে কীভাবে?
যদিও ধর্মের একান্ত আবশ্যকীয় চরিত্র হলো- ধর্মসৃষ্টিকারী(রা)। তারাই শয়তান ও ঈশ্বরদের ধর্মের একান্ত ও অপরিহার্য অংশীদার বানিয়ে নিজেরা হয়েছে- সর্বাধিনায়ক। কারণ, ধর্মপ্রবর্তক ছাড়া কোনো ধর্ম আছে কী-না, জানা নেই। তাছাড়া ঈশ্বরের নামের সাথে, তাদের নাম স্মরণ করাও বাধ্যতামূলক। তবে জানি না, ধর্মসৃষ্টিকারীরা শয়তানবিহীন ধর্ম সৃষ্টি করেনি কেনো? শয়তান ছাড়া কেবল ঈশ্বর থাকলে এমন কী এমন ক্ষতি হতো? তাছাড়া ধর্মের এতো শত্রুই বা কেনো? এতো শত্রু নিয়ে কীভাবে ধর্ম অস্থির না হয়ে পারে? কারণ প্রতিটি ধর্মই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অন্য ধর্মগুলোকে শত্রু মনে করে এবং ধর্মানুসারীদের প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে শিক্ষা দেয়। শত্রু নিধনের জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে নিরন্তর প্রচারণা ও পরামর্শ দেয়। শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত থাকতেও পরামর্শ দেয়। ফলে স্ব-স্ব ধর্মশত্রু নিধনের জন্যই সৃষ্টি হচ্ছে নিত্য-নতুন ধর্মদানব কিংবা মহাদানব।
তাহলে কী ধর্মসৃষ্টিকারীদের নিজেদের এবং নিজেদের সৃষ্ট ঈশ্বরদের ক্ষমতার উপর পূর্ণ আস্থা নেই? থাকলে- ক্ষমতাময়, সর্বশক্তিমান, সর্বশ্রেষ্ঠ… হয়েও মানব জাতিকে শাসন করতে এবং ভয় দেখাতে শয়তানের সাহায্য নিতে হচ্ছে কেনো? ধর্মানুসারে জগত ও জীব সৃষ্টি যদি সত্য ধরে নেই, বলতেই হয়- ধর্মসৃষ্টিকারীদের নিজেদের এবং ঈশ্বরদের কারো ক্ষমতার উপরই যেমন আস্থা নেই, তেমনি শুভবুদ্ধিও নেই। সুবুদ্ধি থাকলে অন্তত শয়তান সৃষ্টি করতো না। কেননা, ঈশ্বর সুবুদ্ধির কিংবা মঙ্গলময় এবং শয়তান কুবুদ্ধি বা অমঙ্গলের। অথচ যে মঙ্গলময়, সে নিশ্চয়ই অমঙ্গলকারীকে স্থান দেবে না। হয়তো ঈশ্বর শয়তানের কাছে পরাজিত হয়ে, ক্ষমতা ভাগাভাগি করেছে বা আপোষ করেছে! ফলে পৃথিবীতে কখনো শয়তানের, কখনো ঈশ্বরের রাজত্ব চলছে! নাকি ধর্মসৃষ্টিকারী কিংবা ঈশ্বর জেনেশুনে ও ইচ্ছা করেই শত্রু (শয়তান) সৃষ্টি করেছে, যেন নিজেদের দোষ শয়তানের উপর চাপাতে পারে? কারণ ধর্মানুসারে, ঈশ্বরের কথিত মঙ্গলজনক কাজ, শয়তানের অমঙ্গলজনক কাজের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত এবং বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। প্রকৃত পরোপকারী বা মঙ্গলময় কখনো শত্রু সৃষ্টি করবে না, ভুল করে করলেও চিরস্থায়ীভাবে জীবিত রাখবে না, যে/যারা কিনা তার সৃষ্টির ক্ষতি করে! তাহলে শয়তান সৃষ্টি কি, ধর্মসৃষ্টিকারীদের ইচ্ছাকৃত এবং মারাত্মক ভুল! যার খেসারত দিচ্ছে মানুষ।
তথাপিও, শয়তানকে মুক্ত রেখে অবিশ্বাসীদের জন্য নিশ্চিত নরক বানিয়েছে ধর্মসৃষ্টিকারীরা! বুঝলাম, কিন্তু অবিশ্বাসীরা কী শয়তানের চাইতেও বেশি ক্ষতিকর? তা না হলে- শয়তানকে মুক্ত রেখে অবিশ্বাসীদের নরকে পাঠানোর হুকুম এবং খুনের নির্দেশ কেনো? ধর্মসৃষ্টিকারী এবং ঈশ্বরেরা যদি খুনী হয়, এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কী আছে? শয়তানকে ভয় না করে অবিশ্বাসীদের এতো ভয়ই বা কেনো? শয়তানদের জন্য নরক নয় কেনো? মন্দ কাজ বা নিষিদ্ধ খাবার খেলে যদি মানুষের শাস্তি হয়, তাহলে- যে/যারা মানুষকে মন্দ কাজে প্ররোচিত করে, তাদের শাস্তি হবে না কোন যুক্তিতে? সুতরাং, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, দয়াময়, ন্যায় বিচারক ইত্যাদি উপাধির মর্যাদা কোথায়? সব মানুষের শ্রেষ্ঠ মানুষ- ধর্মসৃষ্টিকারীদের মর্যাদাই বা থাকে কীভাবে? কারণ তারা চাইলেই তো কেউই মন্দ কাজ করতে পারে না এবং অবিশ্বাসী/নাস্তিকরাও জন্ম নিতে পারে না। তাহলে? অবিশ্বাসীরা না থাকলে তো তাদের রাজত্ব আরো নিষ্কন্টক হতো- নয় কী? আর শয়তান না থাকলে তো পুরোপুরি নিরাপদে ও নিশ্চিন্তেই থাকতে পারতো। অথচ এক শয়তানই তাদের ঘুম হারাম করে চলেছে (যা আবার চিরস্থায়ী)! যাহোক, হয়তো অবিশ্বাসীদের ব্যাপারে ধর্মসৃষ্টিকারীদের জ্ঞানের অভাব আছে। তারা নাস্তিকদের ধ্বংস চাইলেও, নাস্তিকরা চায় তারা যেন নিজেদের ভুল শোধরায় এবং স্বীকার করে! কারণ ভুল স্বীকারের মধ্যে গৌরব আছে! অস্বীকার করা মানেই বহু ভুলের জন্ম দেয়া, যা তারা চিরকালই অত্যন্ত লজ্জাহীভাবে করেই চলেছে। কারণ তারা যেমন শয়তান সৃষ্টি করে নিজেদের এবং মানবজাতির মহাসর্বনাশ করছে, তেমনি অবিশ্বাসী জন্ম দিয়েও ঝঞ্জাট পোহাচ্ছে। এরূপ দ্বিচারিতার অর্থ কী? আবার অবিশ্বাসী হত্যার হুকুম দিয়েছে, শয়তানকে নয়, বরং ওগুলোকে হৃষ্টপুষ্ট রাখার চিরস্থায়ী ব্যবস্থা! আর এসব বিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে ধার্মিকরা (যদিও সবাই নয়), যাতে রাষ্ট্র ও সমাজের সমর্থন ষ্পষ্ট। যা মারাত্মক অন্যায়। এজন্য ধর্মসৃষ্টিকারী এবং ঈশ্বরেরা নরহত্যার দায়ে দোষী। অতএব, এসব তাদের সর্বশ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ নয় বরং কাপুরুষতার লক্ষণ। তারা এতোই কাপুরুষ যে, অবিশ্বাসীদের সামান্যতম সমালোচনাও সহ্য হয় না, যুক্তি মানবেই না। সুতরাং যুক্তি ও ভুল স্বীকারে অবিশ্বাসীরা তাদের চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। মূলত এবিষয়ে ধর্মসৃষ্টিকারী এবং ঈশ্বরেরা সর্বশ্রেষ্ঠ স্বৈরাচার।
যাহোক, কতোজন ধার্মিকের মধ্যে আমরা নম্রতা ও শুচিতা দেখতে পাই? কতোজন আছেন, যারা শুচিশুভ্র চিত্তের? ঘরের ও শরীরের ময়লা বারবার পরিষ্কার করলেই শুচিশুভ্র হওয়া যায় না। ধর্মকর্মে বসার পূর্বে গোসল কিংবা হাতমুখ ধুয়ে ধর্মকর্ম করলেই শুচি হয়ে গেলাম… এমন দৃঢ় বিশ্বাস বোকামি ছাড়া কিছু নয়। যা বর্তমানের ধার্মিকদের মধ্যে খুবই স্পষ্ট।
যেমন কবিগুরু বলেছেন, “…পাওয়া এক জিনিস, আর সেই পাওয়া ব্যাপারটাকে বিশ্লেষণ করিয়া জানা আর এক জিনিস।” মানুষ যেমন ধর্ম, ধর্মবতার ও ঈশ্বরদের পায় বংশপরম্পরায়, মোটেও জানার মাধ্যমে নয়। পেয়েই খুশি, জানার চেষ্টা নেই, সংশয় নেই, প্রশ্ন নেই; আছে শুধু দাম্ভিকতা, গোড়ামি, পুলক, উম্মাদনা… ইত্যাদি। বিশ্লেষণ করে সত্যাসত্য খোঁজার প্রয়োজন মনে করে না। ফলে ধর্মকর্ম যেভাবে চলে, ঘুষ-দুর্নীতিও সমান তালে চলে। এর বহু উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন, পকেটে ঘুষের টাকা নিয়ে ধর্মালয়ে যেতে দেখেছি, ফিরে এসে আবার ঘুষের টাকা পকেটে পুরতে দেখেছি। অনর্গল মিথ্যা এবং ঘুরিয়ে-প্যাচিয়ে কথা বলার মানুষে সমাজ পূর্ণ। এরা ঠিক সময়মত ধর্মকর্ম করছে, অথচ ঘুষ-দুর্নীতিও সমানতালে চালাচ্ছে। এরা ধর্মের একবিন্দু-বিসর্গও ভুল করে না। তারপরেও সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিতেও এরাই ভালো মানুষ, কারণ এরা ধার্মিক এবং ধর্মের জন্য প্রচুর খরচও করে! তাই মনে হয়, ভদ্রভাবে লুটেপুটে খাবার ও সম্মান বজায় রাখার প্রধান অস্ত্রটির নাম- ধর্ম।
জানি না, রাষ্ট্র ধার্মিক হলে মানুষের উপকার কী? হয়তো নিজেরা ধার্মিক, তাই রাষ্ট্রকেও ধার্মিক বানাতে ও রাখতে হবে! সম্ভবত, রাষ্ট্র ধার্মিক হলে- দুর্নীতিবাজ জাতির বদনাম না ঘুচলেও, আত্মগরিমা, অহংকার, মর্যাদা… ইত্যাদি বাড়ে! এবিষয়ে বিদ্বানরাই ভালো বলতে পারবেন! তবে এটা বুঝি, তখন রাষ্ট্রধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের বেশকিছু দায়িত্ব বেড়ে যায়। প্রধান দায়িত্ব- স্বধর্মের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বা সুরক্ষাসহ সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে রাখা। ফলে মানুষ যেমন ধর্মমাতাল, তেমনি রাষ্ট্রও ধর্মমাতাল হয়। এ রাষ্ট্রগুলো তখন স্বধর্ম রক্ষায় যতোটা আগ্রাসী, মানবাধিকার রক্ষায় ততোটা অনাগ্রহী (যা এদেশসহ বহু দেশেই বিধর্মী নির্যাতন, বিতাড়ন, জমি/বাড়ি দখল, ধর্ষণ, লুটপাটে… প্রমাণিত)। এছাড়াও পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রায় সর্বত্রই ধর্ম ঢুকিয়ে বিধর্মীদের তা শুনতে/জানতে বাধ্য করে। রাষ্ট্র তার ধর্মের প্রতি একপেশে সমর্থন, প্রয়োজনে কঠিন আইন প্রয়োগ করে, যাতে বিধর্মী/নাস্তিকরা কোণঠাসা হতে বাধ্য। ফলে সংখ্যাগুরু সমপ্রদায়ের অশিক্ষিত, শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, পণ্ডিত… পর্যন্ত প্রায় সকলেই অন্যরকম এক অনুভূতিতে মত্ত থাকে, যার নাম দেয়া যেতে পারে- ধর্মোম্মাদনা বা ধর্মমাতাল। কথিত এ উম্মাদনায় সামান্যতম আঘাত লাগলেই উগ্রতা হিমালয় ছাড়িয়ে যায়। আর যদি বিশেষ কেউ (ধর্মব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সমাজপতি…) তা উষ্কে দেয় তাহলে তো কথাই নেই, প্রলয়ংকারী তান্ডব শুরু হয় পুরো রাষ্ট্র জুড়ে (যার অজস্র ছোট-বড় প্রমাণ আছে এবং যা চলমান)। বেশি বড় রকমের অপবাদ কিংবা আঘাত লাগলে, তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে অন্যান্য স্বধর্মী রাষ্ট্র্রগুলোতেও। দুঃখের বিষয়, মানবানুভূতিতে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আঘাত লাগলেও কিন্তু এরা উম্মাদ কেনো, বেশিরভাগই সাধারণ প্রতিবাদটুকুও করে না। তথাপিও রাষ্ট্র ও সমাজ ওইসব পুরানো বিশ্বাসকেই বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া। কারণ শুধুমাত্র ধর্মজীবিরাই নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের নেতারা ধর্মের কাছ থেকে যেসব বৈধ-অবৈধ এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুযোগ-সুবিধা পায়, তা অন্য কোনো কিছু থেকে পায় না। যদিও ধর্মরাষ্ট্রের নাগরিকরা নীতি-নৈতিকতায় পৃথিবীর সবচাইতে বেশি সৎ তথা সুনাগরিক হওয়ার কথা! কিন্তু ধর্মরাষ্ট্রগুলোতে এর ১% সুফলও কী দেখতে পাই? নাকি উল্টা কিছু দেখতে পাই?
অথচ অতি অল্পসংখ্যক যারা ধর্ম বিশ্বাস করে না, ধর্মরাষ্ট্রের বিরোধিতা করে, কুসংষ্কারের প্রতিবাদ করে… তারাই বরং ছলেছুতায় আক্রান্ত হয়। যেহেতু ধর্মের দোহাই দিয়ে আক্রমণ করার চেয়ে মারাত্মক আক্রমণ আর যে হতেই পারে না। কারণ ধর্মের আক্রমণের কাছে পরমাণু বোমাও পরাজিত হতে বাধ্য হবে। অথচ যারা ধর্ম মানে, তারা চরম থেকে চরমতর দুর্নীতি করলেও সাচ্ছন্দ্যে ও বিলাসী জীবনযাপন করছে। এর কারণ, ধার্মিক এবং ধর্মরাষ্ট্রগুলোর মূল শক্তি বহু পুরানো কিছু বিভ্রান্তে ভরা পুস্তক, যা সঠিকভাবে পড়লে গোমড় ফাঁস হওয়ার কথা কিন্তু প্রায় সকলেই তা না পড়েই পবিত্র ও মহান মানছেন! মূলত মতলবাজ ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরাই নিজেদের দুর্বলতা, চাতুরি, নানাবিধ অপরাধ ঢাকতে ধর্মকে সুরক্ষিত রাখে, বিশেষ করে এর উগ্রতা (কথিত ধর্মানুভূতি) কাজে লাগায়। ফলে দেশ যেভাবে ধর্মালয়ে ভরে উঠছে, যেভাবে ধার্মিকদের সংখ্যা বাড়ছে, সেইহারে সৎ লোক বা সততা বাড়ছে না বরং কমছে! তাহলে কী ধর্ম সৎ মানুষ বানাতে ব্যর্থ? কারণ ধর্মানুসারে ধার্মিকতা বাড়লে সততাও বাড়ার কথা, কিন্তু বাস্তব কী সেকথা বলে?
তবে বুঝি না, মানুষ কেনো ধর্ম রক্ষার জন্য এতো নৃশংস্য হয়? কারণ দেখা যাচ্ছে, ধর্মদানবরা হত্যাযজ্ঞের ধরণ পাল্টিয়ে নৃশংস্য থেকে নৃশংস্যতর হচ্ছে এবং বিরামহীনভাবে দানবীয়তা ঘটিয়েই চলেছে। অন্যদিকে প্রতিটি হত্যাযজ্ঞের পর জ্ঞানীগুণিরা ধর্মরক্ষার জন্য উঠেপড়ে লাগে। একই সুরে একই গান গায়- হত্যাকারীদের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, এরা খাঁটি ধামির্ক নয়, এরা প্রকৃত ধর্ম জানে না, ধর্মে এসব নেই, ধর্ম এসব বলে না…! প্রশ্ন- তাহলে ধর্মে আছেটা কী? বলেই বা কী? খাঁটি ধার্মিকই বা কী? যুগযুগ ধরে একই প্যাঁচাল না পেড়ে, যুক্তিসহকারে ব্যাখ্যা করে বলুন তো, কথিত পবিত্র(!) শাস্ত্রের কোন কোন আদেশ-নির্দেশ ধর্মদানবরা লংঘন করছে এবং আপনারা কথিত খাঁটি ধার্মিকেরা কী কী পালন করে খাঁটি(!) ধার্মিক হয়েছেন? জানি না, মহাসত্য(!) ধর্ম পালন করে কীভাবে একজন খাঁটি ধার্মিক হয়, আর একজন খাঁটি দানব হয়! আপনার উভয়পক্ষ (ধর্মজঙ্গি ও কথিত খাঁটি ধার্মিক) কী একই ধর্মপুস্তক, একই ঈশ্বর, একই ধর্মপ্রবর্তকের অনুসারী নন? তাহলে কেনো ধর্মের বাণী ও নিয়ম-কানুনগুলো নিয়ে একমত হতে পারছেন না? যা মহাসত্য(!) তা কেনো সার্বজননীন বা সর্বত্র একই কর্মকাণ্ডে বিশ্বাসী নয়? কেনো একটি সুনির্দিষ্ট মত মেনে চলতে পারছেন না? অর্থাৎ কেউ কারোটা নিয়ে সমালোচনা করবে না, দাঙ্গা বাধাবে না, কেউ কাউকে মারার জন্য চাপাতি হাতে ঘুমাতে যাবে না, কোনো গোষ্ঠি, অন্য গোষ্ঠিকে অতর্কিতে আক্রমণ করবে না (যদিও এগুলো ঐতিহাসিক সত্য এবং ধর্ম সমর্থিত), ধর্মযুদ্ধগুলো পাঠ্যপুস্তকের কিংবা ধর্মশিক্ষার অংশ হবে না (কারণ যুদ্ধ যে কারণেই হোক, তা মঙ্গলজনক নয়)…। অর্থাৎ যে ধর্মমত হবে অত্যন্ত মানবিক ও সকলের কাছে সমানভাবে প্রিয়। বিধর্মীদের ধর্মের সাথে একমত হওয়ার কথা বলছি না, কেবলমাত্র স্বধর্মীদের মধ্যে এই কাজটি করতে পারবেন কী? চ্যালেঞ্জ দিলাম, কোনোদিনও পারবেন না। যদি পারেন, পিতা-মাতার দিব্যি রইলো, অবশ্যই ধর্মদানবদের তরবারির নিচে মাথা পেতে দেবো। পারবেন না কারণ- যে বিশ্বাস সত্য নয়, তার ফলাফলও সত্য-সুন্দর হতেই পারে না এবং তাতে হাজার হাজার বিভ্রান্তিকর ব্যবস্থা, প্রথা, ব্যাখ্যা, বিতর্ক তথা কুসংস্কার থাকে; যা নিয়ে কোনো বিশ্বনেতা কিংবা কথিত মহামানব অথবা কথিত বিশ্বসেরা ধর্মগুরুরাও একমত হতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও সম্ভব না। অতএব ধর্মগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত দানব ও মহাদানব সৃষ্টির পথও কখনোই বন্ধ হবে না।
যদিও যুদ্ধ-দাঙ্গা পৃথিবীর জঘন্যতম কাজ অথচ এ নিয়েই ধর্মগুলো যখন গর্বিত হয়, মহিমা-গৌরব করে, উৎসাহ দেয়; তখন নিশ্চয়ই এর আদেশদাতাগণের (ধর্মপ্রবর্তক ও ঈশ্বর) ধৈর্য-সহ্য ও ক্ষমতার বিষয়গুলো পরিষ্কার। কোনো তারা কথিত ‘ন্যায়’ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের বিকল্প খুঁজে পায়নি? এতো বিশাল ক্ষমতাধর, সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বমহান ধর্মপ্রবর্তক ও ঈশ্বরদের কিনা অস্ত্র ধরতে হয়েছে, বানর পিটিয়ে মানুষ করার জন্য? অর্থাৎ মানুষদের বিধর্ম থেকে স্বধর্মে আনতে এবং পাপমুক্ত রাখতে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নামতে হচ্ছে কিংবা শাস্তির ভয় দেখাতে হচ্ছে! এর চেয়ে লজ্জার, অপমানের, অসহায়েত্বর, কাপুরুষতার… আর কী হতে পারে? সুতরাং ঈশ্বর ও ধর্মনির্মাতা এবং বর্তমানের ধর্মজীবি, যারা ধর্ম রক্ষার উছিলায় যুদ্ধ-দাঙ্গা বাঁধায়, সমর্থন করে, ধর্মযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে গর্বিত হয়, প্রশংসা করে, প্রচার করে… এরা সকলেই মানবতাবিরোধি অপরাধে দোষী! না হলে- কেনো নয়? অথচ মানবাধিকার এবং রাষ্ট্রের আইনে যুদ্ধবাজ খুনিরা অপরাধী হলেও, ধর্মযুদ্ধ-দাঙ্গা সৃষ্টিকারীরা (ঈশ্বর-ধর্মপ্রবর্তক) নিরাপরাধ কীভাবে? কেউ তাদের বিচার চাওয়া দূরে থাক, বরং প্রশংসা করে। যদিও যুদ্ধ মানেই খুন করা, নয় খুন হওয়া। তাই যারা যুদ্ধ করে (সৈনিক) তাদের চেয়ে আদেশদানকারীরাই জঘন্যতম অন্যায়কারী তথা পাপী। কারণ, যাদের দেখে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়, তারাই যদি যুদ্ধাংদেহী হয়, যুদ্ধের আদেশ-নির্দেশ দেয়, তাহলে মানুষের দোষ কী? রাজপ্রাসাদে মহাবিলাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত রাজা (বর্তমানের শাসকরা), যারা যুদ্ধের হুমকি দেয় ও বাঁধায় তারাও একই রকমের পাপী। কারণ ধর্মযুদ্ধকারীরা যুদ্ধে জয়ী হলে যেমন ঈশ্বরের প্রশংসা করে, তেমনি যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক নেতারাও জয়ী হলে ঈশ্বরদের ধন্যবাদ দেয়, আর জীবিতদের কথিত বীর উপাধি দিয়ে গর্বিত করে! কিন্তু যুদ্ধ মানেই বহু খুন ও বহু কান্না। অথচ এ খুনে কারো মনেই কোনো পাববোধ হয় না, কেনো? কারণ সব ধর্মেই তো নরহত্যা মহাপাপ! তাহলে? যুদ্ধে কী শুধু কথিত শত্রু হত্যা করা হয়, নাকি সাধারণ মানুষই বেশি হত্যা করা হয়? তর্ক এড়াতে ধরে নিলাম- যুদ্ধে শুধু শত্রু (বয়ষ্ক যোদ্ধা) খুন করার আদেশ-নির্দেশ রয়েছে, কিন্তু তা তো নয়, এতে বরং বেশিরভাগই নিরাপরাধ শিশু ও নারী খুন হচ্ছে। বছরের পর বছর ঘরবাড়ি ছেড়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহায় সাধারণ মানুষই। অতএব, কথিত ন্যায়ের যুদ্ধ বলে কিছু নেই, যুদ্ধ মানেই মহা অন্যায়, মহাপাপ। হোক তা কথিত ধর্মের জন্য বা রাষ্ট্রের জন্য। বিশেষ করে ধর্মযুদ্ধকে যারা ‘ন্যায়ের যুদ্ধ’ বলেন, তারা নিকৃষ্টতম মনমানসিকতার অধিকারী তথা ইতর প্রবৃত্তির। অতএব, নরহত্যার জন্য যুদ্ধবাজ শাসক যেমন দোষী, তেমনি যুদ্ধবাজ ঈশ্বর এবং ধর্মসৃষ্টিকারীরাও দোষী। মানুষের পাপমুক্তি ও অন্যায়ের কথা এরা যতোই বলুক, নিজেদেরই পাপবোধ নেই। তা না হলে- কথিত মঙ্গলময়, দয়াময়, শান্তিময়, প্রেমময়… ঈশ্বর ও ধর্মসৃষ্টিকারীই কখনোই, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধের আদেশ দিতো না।
তাছাড়া, ঐতিহাসিক বহু যুদ্ধ-দাঙ্গার কাহিনী পড়ে মনে হয়, এসব ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ; যা নিয়ে ধর্মপ্রতর্ক এবং অনুসারীদের গর্বের সীমা-পরিসীমা নেই। কী চমৎকার! এক ধর্ম, অন্য ধর্মের সাথে যুদ্ধ করে রাজ্য জয় করেছে, সব পুরুষ খুন করেছে, তাদের গরু-ছাগল, ধন-সম্পদ এমনকি নারী ও শিশু লুটে নিয়ে ভাগবণ্টন করে নিয়েছে… স্বধর্ম অর্থাৎ খাঁটি ধর্ম, সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, মহাধর্ম… প্রতিষ্ঠা করেছে (যা এখনো চলমান)! কী করে যে এমন যুদ্ধ-দাঙ্গার ইতিহাস মহান ও গৌরবের হলো, সুখপাঠ্য হলো, শিক্ষার অন্যতম বিষয় হলো- একদমই বোধগম্য নয়। ফলশ্রুতিতে, ধর্মে-ধর্মে প্রকাশ্যে যে ঐক্য তা সাময়িক এবং লোকদেখানো কিন্তু যুদ্ধ, বিবাদ, সংঘর্ষ, লুটপাট, ধর্ষণ, সামপ্রদায়িকতা, ঘৃণা… চিরস্থায়ী (ঐতিহাসিক বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে)। আবার এসব যুদ্ধের কাহিনী পড়েই অনেকে ডিগ্রি লাভ করে। আগেও বলেছি, যুদ্ধ কখনোই মঙ্গল বয়ে আনে না, যুদ্ধ মানেই রক্তপাত, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ…। অথচ দেবতা থেকে শুরু করে বিশেষ বিশেষ ধর্মের প্রায় প্রতিটি ঈশ্বর এবং ধর্মপ্রবর্তকই যুদ্ধের নির্দেশদাতা অথবা সমর্থক। অর্থাৎ তারা মুখে যা-ই বলুক, যুদ্ধ করে শান্তি আনায় বিশ্বাসী, শান্তির পথে শান্তি আনায় বিশ্বাসী নয়। অনেক দেবতা ও ধর্মপ্রবর্তক শুধু হুকুম দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, নিজেরাও সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। ঈশ্বরেরাও কথিত স্বর্গদূত পাঠিয়ে সাহায্য করেছে! যা ধার্মিকরা অত্যন্ত গৌরবের বিষয় বলে গর্ব করেন, প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাসই শুধু নয়, বুক ফুলিয়ে প্রচারও করেন। অতএব, ধর্মযুদ্ধের ইতিহাস তথা যুদ্ধ বিজয়ের কাহিনী নিয়ে ধার্মিকরা যেভাবে গর্বিত, এতে মনে হয়- যুদ্ধ যেন ধর্মরক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। যেন যুদ্ধ করেই ধর্ম রক্ষা ও বিস্তার ঘটানো সম্ভব (যা চলমান), অন্য কোনো উপায় তাদের হাতে নেই! এটাই যদি সত্য হয়, তাহলে- এরা কীসের সর্বশক্তিমান ও সর্বশ্রেষ্ঠ?
ফলে ধার্মিকদের দৃঢ় বিশ্বাস, দেবতা ও ধর্মপ্রবর্তকরা যেহেতু যুদ্ধ করেছে, সেহেতু তাদেরকেও এরকম একটি নৃশংস্যতম, মানবতাবিরোধি প্রথার সমর্থন ও প্রশংসা করতে হবে এবং ধর্মের ব্যাপারে সদাই যুদ্ধাংদেহী থাকতে হবে, নতুবা ঈশ্বর আশির্বাদ করবে না, ধার্মিক থাকা যাবে না… ইত্যাদি। সুতরাং এক ধর্মের অনুসারীরা যখন অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে কীভাবে, কখন, কোথায়, কতো অল্প সৈনিক নিয়ে ঐতিহাসিক যুদ্ধ জয়ের কাহিনী শোনায়, টিটকারী মারে… তখন পুনরায় নতুন করে যুদ্ধ-দাঙ্গা লেগে যাওয়ার শতভাগ সম্ভবনা থাকে। কেননা মানুষের মন থেকে অনেক পুরানো ক্ষত (দুঃখ-ব্যাথা…) চিরতরে বিলীন হতে পারে কিন্তু ধর্মের ক্ষত কখনোই শুকায় না, মৃত্যু পর্যন্ত জ্বলন্ত থাকে। অথচ ধর্মজীবিদের অন্যতম প্রধান কাজ হলো- ওইসব যুদ্ধ-দাঙ্গার ঘটনাগুলো বারবার এবং গর্বভরে শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হিসেবে জনগণকে জানান দেয়া। অর্থাৎ শত-সহস্র বছরের পুরানো যুদ্ধ-দাঙ্গার কাহিনী শুনিয়ে সাধারণ মানুষদের স্বধর্ম রক্ষায় উজ্জিবীত রাখা। শুধু তাই-ই নয়, ধর্মপুস্তকেও এর গৌরবগাঁথা রয়েছে, যা পড়ে বহু মানুষই মনে মনে যুদ্ধ-দাঙ্গার জন্য তৈরি থাকতে কিংবা দানবও হতে পারে। এর ফলে যখন-তখন যেকোনো সময় সামপ্রদায়িকতার বিস্ফোরণ অতি সহজ (যা নির্ভুল, প্রামাণিত ও চিরস্থায়ী সত্য)। ক্ষুদ্র জ্ঞানে বুঝি, এর থেকে মুক্তি পেতে হলে, কথিত ‘পবিত্র যুদ্ধের’(!) সব ইতিহাস ধর্মপুস্তক ও পাঠ্যপুস্তক থেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলতে হবে এবং ধর্মজীবিরা কখনোই এসব প্রচার করতে পারবে না অর্থাৎ বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে এসব শেখানো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে।
যদিও উচ্চশিক্ষিত রাষ্ট্রনায়ক থেকে বিদ্বানগণ এবং ধর্মজীবিসহ সাধারণ জ্ঞানীরা প্রায়ই বলেন, সন্তান যেন জঙ্গি না হয় সেজন্য পিতামাতাকে সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু তারা একথা বলেন না যে, ধর্মের মধ্যে যেসব কুসংস্কার ও বিভ্রান্তি এবং যুদ্ধ-দাঙ্গার ইতিহাস রয়েছে, যেসব দৃষ্টান্ত অতি গৌরবের সাথে সন্তানকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ ও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হোক। ধর্মপুস্তক সংশোধনসহ যাবতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এসব নিষিদ্ধ করা হোক! কারণ ওখানেই সন্তান জঙ্গি হবার সর্বোত্তম শিক্ষা রয়েছে। তারা বলেন না, ধর্মের মধ্যে শয়তান রয়েছে (যে/যারা মানুষকে বিপথে চালায়), সেই শতয়ানকে ধর্ম থেকে বহিষ্কার করা হোক! অর্থাৎ ঈশ্বরের কথিত পবিত্র(!) বাণীগুলোও সংশেধন করা হোক। যেসব তথাকথিত ঐশ্বী বাণী শুনে এক ধর্মালম্বীরা অন্য ধর্মালম্বীদের অধার্মিক ভাবে, ছোট ভাবে, হীন কিংবা জঘন্য ভাবে, ঘৃণা করে, শত্রু ভাবে… ধর্ম থেকে ওইসব বাক্য/শব্দ সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলা হোক! না হলে, সন্তানকে আপনি যতো ভালো শিক্ষাই দিন, যতো ভালো স্কুল-কলেজে পাঠান, চোখে-চোখে রাখেন… এক সময় না এক সময় তাকে ছেড়ে দিতে হবে। তারা যখন স্বাধীনভাবে সমাজে মিশবে, তখন যে পরিবেশ ও পরিস্থিতির শিকার হবে না, এমন গ্যারান্টি কোথায়? কারণ যে সমাজে সব শিক্ষার মূল শিক্ষা- ধর্ম, যে সমাজে শিশু বয়স থেকে ধার্মিক বানানো হয় এবং আজীবন ধার্মিক রাখা হয়, সেই সমাজে সন্তানকে চোখে-চোখে রাখলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটা আশা করা আর উম্মাদের সঙ্গে থাকা সমান। তবে ধর্মশিক্ষার পরিবর্তন না করে, সন্তানকে চোখে-চোখে রেখে জঙ্গি হবার সম্ভাবনা কমানো কিংবা দমানো গেলেও নির্মূল করা কিংবা সুন্দর মনমানসিকতার সন্তান তথা জাতি গঠন করা অসম্ভব। কারণ বীজ এবং শিকড় থেকে গেলে চারা তো গজাবেই।
যাহোক, নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে হলে- কাউকে তো লাগবেই। হয়তো তাই ধর্মসৃষ্টিকারীরা শয়তান বানিয়ে সব দোষ ওটার ঘাড়ে চিরস্থায় এবং চিরদিনের জন্য চাপিয়ে দিয়েছে। যেমন শয়তান রোগ-শোক ছড়ায়, যুদ্ধ বাধায়, ঝড়-বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী… ইত্যাদি সৃষ্টি করে। অথচ এটাও বিশ্বাস করা হয়, ঈশ্বর না চাইলে শয়তান কিছুই করতে পারে না! তাহলে কী শয়তান যখন মানুষের বিরুদ্ধে এসব করে, তখন ঈশ্বর নাকে ঘি মেখে ঘুমায়? নাকি শয়তান ও ঈশ্বরের সাথে বোঝাপড়া হয়েছে, তুই যখন কাজ করবি আমি বাধা দেবো না, আমি যখন করবো তুই বাধা দিবি না…! কী চমৎকার বোঝাপড়া তাই না? অন্যদিকে, ঈশ্বরেরা যেমন নিজেদের দোষ চাপানোর জন্য শয়তান সৃষ্টি করেছে, মানুষও তেমনি স্বধর্মের দোষ, অন্য ধর্মের উপর চাপিয়ে নিজেরটা জায়েজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, এক ধর্মের কুসংস্কার প্রশ্নে অন্য ধর্মের তুলনা টেনে বলা হয়- অন্য ধর্মে দাসত্ববাদ আছে, যুদ্ধ-দাঙ্গা আছে, বিভক্তি-বিভ্রান্তি-বিতর্ক আছে, নারী ও সংখ্যালঘু নির্যাতন আছে, ভুল ব্যাখ্যা, কুসংস্কার রয়েছে… তাহলে শুধু আমারটার সমালোচনা হচ্ছে কেনো? অন্যগুলোকে ধরা হচ্ছে না কেনো? ওগুলো দোষের না হলে, আমারটা দোষের নয়… ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো- অন্য ধর্মে যা আছে, তা যদি আপনার ধর্মে থাকে, তাহলে আপনারটা সর্বোত্তম হলো কীভাবে? যেহেতু ধর্মে-ধর্মে মতোবিরোধ চিরস্থায়ী, অখণ্ডণীয়, অলঙ্ঘনীয়… তবু তা মানবজাতির জন্য মঙ্গলজনক কিংবা শান্তির হলো- কীভাবে?
জানি না, পরকালে সুখে থাকার জন্য ধর্ম পালন, নাকি এ পৃথিবীতে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য ধর্ম পালন, কোনটা হওয়া উচিত? তবে এটা জানি, ধর্মজঙ্গি দমন নয়, এর কারখানা তথা ধর্ম দমন করলেই তা নির্মূল হবে, এর আগে নয়। কিন্তু তা হবার নয় কারণ, ধূর্ত ধর্মপ্রবর্তকদের কল্পিত ধর্ম শোষকদের (রাজনীতিবিদদের) প্রধান হাতিয়ার। মূলত শোষিত জনগণকে অধীনে রাখতে এর আধ্যাত্মিক মন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অসামান্য।