Monday, May 30, 2016

যৌন বিকারগ্রস্ত মুসলিম!


যৌন বিকারগ্রস্ত মুসলিমরা কথায় কথায় পাশ্চাত্ত্যের দেশসমূহে অধিক ধর্ষণের একটি তালিকা দেখিয়ে বলবে ওই লিস্টে মুসলিমদেশগুলোর স্থানই নেই তারমানে মুসলিম দেশে ধর্ষণ কম। আসলে কোন দেশগুলোতে ধর্ষণ বেশি হয় সেটি বুঝতে হলে যতোটুক কমন সেন্স থাকতে হবে সেই পরিমাপ কমন সেন্স থাকাটাই সাধারণ মুসলিমদের ক্ষেত্রে বিরল ঘটনা।

মুসলিম দেশে বা সমাজে ধর্ষিত হলে উলটো ধর্ষিতার "ইজ্জত চলে গেছে" বলে ধরা হয় আর মূলত এই কারণে ধর্ষিতারা নিজে ধর্ষণের ঘটনা আড়াল করতে চেষ্টা করে । এছাড়া বেশিরভাগ মুসলিম দেশে আইনের অনুশাসন না থাকায় ধর্ষক ক্ষমতাবান হলে আদৌ বিচার পাওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকেনা। উদাহরণস্বরূপ তনুর ঘটনায় সারা দেশের বিবেকবান মানুষেরা এগিয়ে এলেও সেনাবাহিনীর ধর্ষকগুলোর কিছুই হয়নি।

আমাদের গ্রামেগঞ্জে একটা জিনিস খুব প্রচলিত, সামর্থ্যবানের ছেলেপেলেরা গরীবের মেয়েদের ধর্ষণ করবে আর তারপর ক্ষমতাবানেরা ধর্ষিতার বাবা-মা-কে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে চুপ করিয়ে দিবে। খুব কম ক্ষেত্রেই ধর্ষণের ঘটনা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় আর পুলিশ পর্যন্ত গেলেও বিচার পাওয়া যায়।

মুসলিম সমাজে ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে একটা চক্র চলতে থাকে। প্রথমে ধর্ষিতার পরিবার ধর্ষিত বা ধর্ষিতা নিজে ঘটনা লজ্জায় প্রকাশ করেনা, তারপর ধর্ষিতা পরিবারবে কাছে জানালেও পরিবার সেটি সামাজিক সম্মান আর লোক-লজ্জার ভয়ে প্রকাশ করেনা। তারপর যেসব ক্ষেত্রে ধর্ষণের ফলে ধর্ষিতা অসুস্থ হয়ে পরে এবং হাসপাতালে নিতে হয় সেইসব ক্ষেত্রেই ধর্ষিতার পরিবার ঘটনা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। তারপর ধর্ষক আর ধর্ষিতার পরিবার এবং পঞ্চায়েত পর্যায়ে চেষ্টা করা ঘটনাটি মিটমাট করে ফেলতে এবং সেটি সম্ভব না হলে বা ধর্ষিতার অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে গেল তখন গিয়ে পুলিশ কেস আর মামলা-মোকদ্দমায় যায়। ঘটনাটি যখন পুলিশ কেস হয় শুধুমাত্র তখন এটি পরিসংখ্যানের হিসেবের খাতায় আসে। এইভাবে করে হাজারটা রেপের ঘটনার মধ্যে একটা হিসেবের খাতায় উঠে কিনা সন্দেহ ।

আবার যেসব মুসলিম রাষ্ট্র শরীয়া আইনে পরিচালিত সেখানেতো ধর্ষিত হলে উলটো ধর্ষিতাকেই শাস্তি পেতে হবে। ধর্ষণ প্রমাণে ধর্ষিতা যদি চারজন পুরুষ অথবা আটজন মহিলা সাক্ষী যোগার করতে না পারে তবে ধর্ষিতাকেই ব্যভিচারিণী হিসেবে হয় বেত্রাঘাত সহ্য করতে হবে  আর বিবাহিত হলে বুক/কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুতে প্রস্তর ছুড়ে হত্যা করতে হবে।

সৌদি আরবে তাই ধর্ষিত হলে চুপ থাকা আর কোন পথই খোলা থাকেনা। সৌদিতে নারী-পুরুষদের বিয়ের আগে যৌনতা প্রকাশের কোন সহজ সুযোগ না থাকায় পরিবারের ভিতরে ভাইয়ের দ্বারা বোন আর বাপের দ্বারা মেয়ে পর্যন্ত অহরহ ধর্ষিত হয় কিন্তু তাতে ধর্ষিতার মৃত্যু না হলে ঘটনাগুলো প্রকাশ পায়না।

কিছুদিন আগে সৌদির এক বিখ্যাত আলেম ধর্ম প্রচারক ফায়হান আল ঘামদি তার নিজের ৫ বছরের ছোট্ট মেয়ে শিশুকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলে। এই ঘটনায় সৌদি শরীয়া আদালতের রায়ে ফায়হান আল ঘামদিকে নিজেকে (স্ত্রীকে) নিজেই কিছু টাকা দিয়ে সে মুক্তি পেতে দেয়। এছাড়া সৌদি বা এরকম শরীয়া আইনে চলিত দেশে গণ ধর্ষিতাকে পর্যন্ত উল্টো ব্যভিচারিণী হিসেবে সাজা পেতে হয়।  এইকারণে সৌদিতে বাপ-ভাই মিলে নিজের পরিবারের ভিতরেই মন ইচ্ছেমত ধর্ষণ করলেও সেগুলো প্রকাশ পায়না।

গরিব দেশগুলো থেকে নারী শ্রমিক নিয়ে গিয়ে আরব্য শেখেরা বাপ-বেটা মিলে সেক্স করছে। প্রতিরাতে নারী গৃহিকর্মীদের কে কার বিছানায় নিতে পারে সেই নিয়ে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মধ্যে রীতিমতো কাড়াকাড়ি চলে। এইগুলো মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় কারণ মধ্যপ্রাচ্য যাওয়া সকল গৃহকর্মীরই একই অভিজ্ঞতা তবে সবাই মানইজ্জতের ভয়ে মুখ খুলে বলতে চাননা। তারা ভিসা দিয়ে স্পন্সরকৃত করে নিয়ে যাওয়ায় এসব নারী শ্রমিকদের কোরানে-হাদিসে অনুমোদিত কিনে নেওয়া যৌনদাসী মনে করে তাদের সাথে বাপ-বেটা মিলে সেক্স করা ওদের অধিকার বলেই মনে করে। সৌদি থেকে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের সাফ কথা
" আমরা হই দাসী আর সৌদিরা ভাবে যৌনদাসী"
কিংবা
"কাজ করে খেতে গিয়েছিলাম বেশ্যাবৃত্তি করতে যাইনি"।
সৌদি ফেরত নারী শ্রমিকদের কান্নাভেজা বর্ণনা দেখলে মন চায় সৌদিদের পেলে ওদের ইমানদণ্ডটাই সোজা কেটে হাতে ধরিয়ে দিই। মাত্র কিছুদিন আগে মানিকগঞ্জ থেকে সৌদিআরবের বনি ইয়াসায় কাজ করতে যাওয়া এক নারী নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে চারতলা থেকে লাফ দিয়ে আত্বহত্যা করতে গিয়ে শেষপর্যন্ত আধমরা পঙ্গু হয়েছেন। তবুও যখন মিসকিন বাঙ্গালী মুসলিমদের তাদের সৌদি আব্বাদের শরীয়া আইনের প্রশংসা করতে শুনি তখন মন চায় ওই নির্বোধদের জ্বিহবা টেনে ছিঁড়ে ফেলি।

নিচে কিছু নিউজ লিংক দিলাম।

★  http://m.youtube.com/watch?v=J3h-NHxkJj0

★  http://www.aaj24.com/আমরা-হই-দাসী-সৌদি-ভাবে-যৌন/BDNews

★  http://www.bbc.com/bengali/news/2016/02/160204_why_bangladeshi_women_dont_want_to_go_to_saudi_arabia

★ http://www.thetelegraph24.com/সৌদি-গৃহকর্তার-ধর্ষণের-শ/

অথচ পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে দেখি ঠিক বিপরীত দৃশ্য। ওইখানে হাজব্যান্ড যদি নিজের উয়াইফের সাথেই জোরপূর্বক সেক্স করে তাহলেই উয়াইফ তার নামে পুলিশ কেস টুকে দেয়। পশ্চিমা বিশ্বে ধর্ষিত হলে ধর্ষিতার সামাজিক মান বা ইজ্জত নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনা এই কারণে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই তারা পুলিশ রিপোর্ট করে। এছাড়া সামাজিক নিরপেক্ষতা এবং আইনের অনুশাসন থাকায় ধর্ষিতারা পুলিশের কাছে যেতে সাহস পায়।  এইসকল কারণে ওইসব দেশে একশোতে একশোটি ধর্ষণের ঘটনাই প্রকাশিত হয়ে পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ হয় আর সেই হিসেবে ওরা ধর্ষণের দেশের তালিকায় উপরে উঠে আসে।

উঠপাখি যেমন শিকারি দেখলে নিজের মাথা বালির নিচে ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবে শিকারীও তাকে দেখছেনা নির্বোধ যৌনবিকারগ্রস্ত মুসলমানেরাও ভাবে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছেনা মানেই বুঝি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছেনা।

Saturday, May 21, 2016

আপেক্ষিকতার গল্প দ্বিতীয় পর্ব: সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ!

[১৯১৬ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের আবিষ্কার     সংক্রান্ত বিজ্ঞানপত্রটি দুনিয়ার সামনে প্রকাশিত হয়। এই বছর সেই দুনিয়া কাঁপানো আবিষ্কারের একশ বছর পূর্তি উদযাপিত হচ্ছে বিশ্বের নানা জায়গায় নানা ভাবে। সেই উপলক্ষে আমি এখানে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের দুই পর্ব সংক্ষেপে সকলের বোধগম্য ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি। প্রথম পর্বে আলোচনা করা হয়েছিল বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। এবার লক্ষ্য: সাধারণ আপেক্ষিকতা।]

প্রথম পর্বে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে জানা গিয়েছিল, দৈর্ঘ্য সময় আর ভরকে বস্তুর কোনো শাশ্বত গুণ বা বৈশিষ্ট্য হিসাবে ভাবা যাবে না, বস্তুর গতির অবস্থার সাথে তার এই সব বৈশিষ্ট্যও সংযুক্ত এবং সেই অর্থে আপেক্ষিক বলে বুঝতে হবে। তার ফলে (শুধু বলবিদ্যার নয়) পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত নিয়ম পরস্পর সমবেগে চলমান নির্দেশাক্ষগুলিতে সমানভাবে খাটবে। তার জন্য নতুন (লোরেঞ্জ) পরিপাতন সম্পর্ক ব্যবহার করতে হবে। কে দেখবে, কোথা থেকে দেখবে, আদৌ কেউ দেখবার জন্য আছে কিনা—এরকম কোনো প্রশ্নই এর সঙ্গে জড়িত নয়। পদার্থবিজ্ঞানের আবিষ্কৃত নিয়ম বা সত্যগুলির গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে কোনো আপেক্ষিকতার অবকাশ নেই। এক একটা নির্দিষ্ট নির্দেশাক্ষ বরাবর কে কী দেখব তা কিন্তু দর্শক নিরপেক্ষভাবে প্রকৃতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসাবে নির্দিষ্ট আকারেই ঠিক হয়ে আছে।

কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখি, এত বড় একটা আবিষ্কার করেও আইনস্টাইনের কিন্তু মন ভরল না। তাঁর মনে একটা প্রশ্ন তখনও খচখচ করে যেতে লাগল, কেন, শুধু সমবেগে চলমান নির্দেশাক্ষ কেন, ত্বরিত নির্দেশাক্ষগুলিতেই বা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলি সমানভাবে সিদ্ধ হবে না কেন? তাছাড়া, পৃথিবী তো শুধু সমবেগে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে না। ঘুরছে মানেই অনবরত দিক বদল করছে। তার মানে, ক্রমাগত বেগের পরিবর্তন হচ্ছে, ত্বরণ নিয়ে চলছে। অথচ, পৃথিবীর বুকে আমরা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলিকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যে ফল পাচ্ছি, তা যথেষ্ট সন্তোষজনক। তাহলে সেটা আপেক্ষিকতার নিয়মে তত্ত্বগতভাবে ধরা পড়বে না কেন? ত্বরিত গতি সমবেগে গতির থেকে কোথায় আলাদা? কোথায় তাদের মিল?


তাঁর নিজের আবিষ্কারের ভিত্তিতে আরও একটা জরুরি বিষয় চিন্তায় আলোড়ন তুলল। বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী দেখা গেল, বস্তুর গতির ক্ষেত্রে আলোকের গতিবেগই সর্বোচ্চ; তার চেয়েও জোরে আর কিছুই ভ্রমণ করতে পারে না। তার মানে হল, যে কোনো ভৌত সঙ্কেতের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে কিছুটা সময় লাগেই। যেমন, আমরা জানি, সূর্য থেকে পৃথিবীর বুকে আলো এসে পৌঁছতে আট মিনিটের মতো সময় লাগে। কিন্তু সূর্য যে আকর্ষণ বল দিয়ে পৃথিবীকে (বা অন্য কোনো গ্রহকে) টানছে, তার এই অবধি আসতে সময় লাগে কি লাগে না? নাকি, অসীম বেগে তৎক্ষণাৎ এসে যায়? যদ্দুর মনে হয় নিউটনও এই সমস্যা নিয়ে ভেবেছিলেন, কিন্তু অনেক ভেবেও কোনো কূল-কিনারা পাননি। শেষ পর্যন্ত এটা সাবেকি বলবিদ্যায় যে কোনো দূরত্বে এক রহস্যময় তাৎক্ষণিক ক্রিয়া হিসাবেই জায়গা করে নেয়।
এই রকম অনেক প্রশ্ন তাঁর মাথায় ঘুর ঘুর করতে লাগল।

অত সহজ নয়!

পর পর অতগুলো যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেললেও এই বিষয়টির সমাধানে পৌঁছতে আইনস্টাইনের কিন্তু বেশ সময় লাগল। অন্তত দশ বছর। ১৯১৬ সালে তিনি তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব বিজ্ঞান পত্রের আকারে প্রকাশ করলেন। [Einstein 1916] এবারে দেখা গেল, অঙ্কগুলো আগেকার মতো অত সহজ নয়। প্রচণ্ড জটিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম গণিতের সাহায্য নিয়ে তবে এগোনো যাচ্ছে। খুব ভালো অঙ্ক না জানলে তার ধারে কাছেও পৌঁছনো যাবে না।

প্রসঙ্গত একটা কথা মনে পড়ে গেল।
আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সম্পর্কে লোকপ্রিয় ভাষ্য সম্বলিত বেশ কিছু ভালো বই লেখা হয়েছে। লিখেছেন পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ায় লান্দাউ ও রয়মার, স্মিলগা, ইংল্যান্ডে রাসেল এবং বার্নেট, আমেরিকায় গ্যামো, প্রমুখ বিশিষ্টরা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এঁরা কেউই সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে খুব একটা কিছু লেখেননি। আর্থার এডিংটন এবং হেরমান হ্বাইল—এই দুজনকে বাদ দিলে বাকি সকলেই কেবল মাত্র বিশেষ আপেক্ষিকতা নিয়ে লিখে গেছেন। সম্ভবত এর কারণও একটাই। এঁদের হয়ত উদ্বেগ ছিল, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে সহজ সরল করে লিখে আম পাঠকদের বোঝাতে গেলে বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি ব্যাপারে ছোট বড় নানা মাপের ভুল ধারণা চালান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই তাঁরা খুব সচেতন ভাবেই মনে হয় এই দায়িত্ব সযত্নে এড়িয়ে গেছেন।
অতএব পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, “হাতিঘোড়া গেল তল, মাছি মাপে কত জল”—আমার সেই দশা কিনা! দুঃসাহস দেখাচ্ছি, না, নিজের ঢাক পেটাতে চাইছি?


কোনোটাই নয়।
বলতে পারেন, অবস্থার সুযোগ নিচ্ছি। জিনিসটাকে যতটা কঠিন বলে প্রচার করা হয়েছে এত কাল ধরে, আসলে এখন আর বোধ হয় তত কঠিন নেই। আমাদের সাধারণ বোধভাষ্যির সাথে মেলাতে গেলে খুব অসুবিধা হয় বলে আমরা এর যুক্তি বা সংজ্ঞাগুলো মন থেকে সহজে মেনে নিতে পারি না। কিন্তু একটা তত্ত্বের উপলব্ধি তো আর এক জায়গায় পড়ে থাকে না। বহু লোক বহু কাল ধরে বুঝবার এবং বোঝাবার চেষ্টা করতে করতে এখন অনেক জিনিস এমনিতেই পরিষ্কার হয়ে এসেছে। সরল করে বোঝানোর ভাষাও অনেকখানি তৈরি হয়ে গেছে। অর্থাৎ, কঠিন কঠিন বলেও আমার কাজ পূর্বসূরীরা অনেকাংশে সহজ করে দিয়েছেন। আমরা আইনস্টাইনকে অনুসরণ করে একটা একটা করে সংশ্লিষ্ট সমস্যার জট খোলার কায়দাকানুন দেখতে দেখতে এগোব। তাহলেই, পুরোপুরি না হলেও, অনেকটাই সাধারণ পাঠকদের কাছে এই বিষয়টা খোলসা করে তুলে ধরতে পারব।

তফাত নেই কেন?

আইনস্টাইন প্রথম যে প্রশ্নটিতে মনঃসংযোগ করলেন তা হল, জড় ভর (inertial mass) এবং মহাকর্ষ ভর (gravitational mass) কীভাবে সমান হয়? কেন হয়?

সমস্যাটা এই রকম: আরিস্ততলের ধারণা ছিল, উপর থেকে শূন্যে (বাতাসে) ছেড়ে দিলে ভারি বস্তু হালকা বস্তুর চাইতে তাড়াতাড়ি নীচে পড়ে যায়। প্রচলিত অভিজ্ঞতার সারসঙ্কলন করেই তিনি এটা বলেছিলেন। সত্যিই তো, এক টুকরো কাগজ বা একটা পাখির পালক আর একটা পাথরের টুকরো বা ঢিল উপর থেকে নীচে ফেলে দিলে দেখা যায়, পাথরের টুকরো বা ঢিল অনেক আগেই মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাগজ বা পাখির পালকের পড়তে দেরি হচ্ছে। গ্যালিলেও এই ধারণাকেও চুনোতি জানালেন। বললেন: উপর থেকে একটা বড় পাথর আর একটা পাথরের টুকরো এক সঙ্গে ফেলে দিলেও কি দুটো আলাদা আলাদা সময়ে নীচে পড়বে? সহজ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, এর উত্তর কী হবে। তিনি বললেন, বায়ুর বাধার জন্য কাগজ বা পালকের পড়তে দেরি হচ্ছে। পাথরের টুকরো এই বাধা সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারে বলে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে আসছে। আমরা যদি শূন্যস্থানে পরীক্ষা করে দেখতে পারি, দেখা যাবে, ভারি পাথর আর কাগজের টুকরো এক সাথেই নীচে পড়ছে।
গ্যালিলেও এর ভিত্তিতে পদার্থবিজ্ঞানে আর একটা মৌল সিদ্ধান্তের কথা জানালেন: বাধাহীন ভাবে উপর থেকে নীচে পতনশীল যে কোনো বস্তু সমান দ্রুততায় নেমে আসে।

এই জিনিসটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিউটন দেখালেন, এই দ্রুততা আর কিছু নয়, অভিকর্ষজ ত্বরণ, যাকে ‘g’ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়ে থাকে। পৃথিবীর আকর্ষণ বল যে কোনো বস্তুর উপর এমনভাবে প্রযুক্ত হয় যে ভারি বা হালকা সমস্ত বস্তুই অবাধে পতনের সময়ে এই একই ত্বরণ সহ নীচে নামতে থাকে।


পদার্থবিজ্ঞানে যখন বল ও গতির সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামানো হয়, তখন আমরা একটা বস্তুর জড় ভর নিয়ে কাজ করি। এই জড় ভর বলতে বোঝানো হয়, একদিকে বস্তুতে পদার্থের মোট পরিমাণ, অপর দিকে বল প্রয়োগ করে গতিবেগ পরিবর্তন করার সময় এ কী পরিমাণে বাধা দেয়। একই ত্বরণ পেতে যত বেশি ভর তত বেশি বল প্রয়োগ করতে হয়। আর, অপর দিকে, মহাকর্ষের ফলে যখন একটা বস্তু পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে, তখন সেই বল যেন একটা ভার হিসাবে কাজ করে। ভর যত বেশি আকর্ষণ বলও তত বেশি হয়। বিপরীতভাবে যত বেশি ভরযুক্ত বস্তু তত তাকে উপরে তুলতে কষ্ট হয়। একে মহাকর্ষ ভর বললেও এ যে জড় ভরের সমান তা নিউটন বুঝেছিলেন। তাঁর সূত্রগুলির অঙ্ক থেকেই এটা বেরিয়ে আসে। এটাও তিনি বুঝেছিলেন, এই রহস্যের একটা চাবিকাঠি কোথাও নিহিত আছে, কিন্তু তা কোথায় তিনি খুঁজে পাননি।

আইনস্টাইন বিভিন্ন দিক থেকে ভাবনা চিন্তা করে এই সমস্যার সমাধান দুই ভাবে করে দেখালেন।
প্রথমত, অবাধে পতনশীল বস্তুর ক্ষেত্রে দুদিক থেকে বুঝবার চেষ্টা করা যায়: একটা হচ্ছে পৃথিবীর আকর্ষণ বল, যা বস্তুকে যেন নীচের দিকে ‘g’ ত্বরণ সহ নেমে আসার জন্য “আহ্বান” করছে, এবং যা সেই বস্তুর মহাকর্ষ ভরের সমানুপাতিক। অপর দিকে, মনে মনে পৃথিবীর কথা ভুলে গিয়ে এইভাবেও তাকে দেখা যেতে পারে যে তার উপর একটা যান্ত্রিক বল এমনভাবে কাজ করছে যে তার ফলে ‘g’ ত্বরণ উৎপন্ন হচ্ছে। বাস্তবে দুটো ছবি যেহেতু একই ঘটনাকে বোঝাচ্ছে, আইনস্টাইন বললেন, দুটো ভরের মানও সমান হওয়াই স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়ত, দুটো ছবিকে পৃথক পৃথকভাবে এইভাবেও দেখা যায়: পতনশীল বস্তুর ক্ষেত্রে একই বলের জন্য মহাকর্ষ ভর যত বেশি, পৃথিবীর টানে সাড়া দিয়ে ত্বরণও তত যেন বাড়তে চাইছে; পক্ষান্তরে, একই বল প্রয়োগ করে যান্ত্রিক সরণের সময় জড় ভর যত বেশি, গতিতে বাধা দানের ফলে ত্বরণ যেন ততই কমে যেতে চাইছে। বাস্তবে দুটো ছবি একই ঘটনাকে তুলে ধরছে এবং ত্বরণও অবাধে পতনের পুরো সময় ধরে একই থাকছে; অতএব দুটো ভরও পরস্পর সমানই। [Einstein and Infeld 1938, 37-38]

এইভাবে বিষয়টাকে বুঝতে গিয়ে আইনস্টাইন যেন নিজের সাথে নিজে স্বগতোক্তি করে যাচ্ছিলেন। শুধু তো আর দুরকম ভরই সমান—এইটুকু মাত্র ঘটনা নয়। “বস্তুর একই বিশেষত্ব পরিস্থিতি অনুযায়ী কোথাও “জাড্য” আবার কোথাও “ওজন” (আক্ষরিক অর্থে “ভার”) হিসাবে ব্যক্ত হয়।” [Einstein 1954, 65] সত্যিই কি গতির সাধারণ চিত্রের সঙ্গে পৃথিবীর টানে বস্তুর অবাধ পতনের মৌল চরিত্রগত কোনো পার্থক্য আছে?


এর পর আবার একটা ছবির কথা তিনি ভাবলেন। এমন একটা ছোট আকারের পৃথিবীর কথা মনে মনে চিন্তা করলেন, যার উত্তর (বা দক্ষিণ) মেরুতে দাঁড়িয়ে বিষুব অঞ্চলের ঘটনাবলি দেখা যাবে। এইবার মনে করা যাক, উত্তর মেরুতে দাঁড়িয়ে একজন দর্শক উপরে একটি গোলক ছুঁড়ে দিচ্ছে এবং নীচে নামার সময় তা লুফে নিচ্ছে। তার কাছে এই ছবিটা নিউটনের মহাকর্ষের নিয়ম প্রদর্শনের একটা ভালো দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রতিভাত হচ্ছে। গোলকটা যে অভিকর্ষজ ত্বরণ নিয়ে নামছে এই ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ নেই। আর সেই সময় আর এক দর্শক, যে বিষুব অঞ্চলে দাঁড়িয়ে একই কাজ করছে, তার গোলকের ভূকেন্দ্রিক পতনশীল গতি দেখে মেরুর দর্শক ভাবছে, ওখানে নিশ্চয়ই কেউ বল প্রয়োগ করে গোলকটাকে পৃথিবীর দিকে ঠেলছে (চিত্র নং-৬ দ্রষ্টব্য)। আর সেইজন্য সেটা ক্রমবর্ধমান বেগে (অর্থাৎ, ত্বরণ সহ) ভূপৃষ্ঠের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। কেন না, সে বিষুব অঞ্চলের লোকটিকে দেখতে পাচ্ছে না, শুধু গোলকটির গতিই দেখছে। ঘটনাচক্রে, উভয় ক্ষেত্রেই সে দেখছে গোলক দুটি একই ত্বরণ নিয়ে ধাবমান। মজার কথা হল, এর বিপরীত চিত্রটিও একই রকম। অর্থাৎ, বিষুবীয় দর্শক নিজের ক্ষেত্রে মনে করবে মহাকর্ষের নিয়ম কাজ করছে, আর মেরু অঞ্চলে বলের গতি দেখে ভাববে, কেউ নিশ্চয়ই গোলকটির উপর যান্ত্রিক বল প্রয়োগ করছে।

একই ধরনের দুটো সমতুল ঘটনা, দুটো আলাদা আলাদা নির্দেশতন্ত্র থেকে দেখা হচ্ছে বলে দু রকম লাগছে। তার মানে হল, সমতলে বস্তুর ত্বরিত যান্ত্রিক গতি আর মহাকর্ষ বলের টানে বস্তুর পতন আসলে একই ঘটনা। বা অন্য ভাষায়, মহাকর্ষের টানও আসলে এক রকমের ত্বরণ যুক্ত গতি। কিংবা যদি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এক একটা বস্তুকে স্বতন্ত্রভাবে দেখা হয়, তাহলে আলাদা করে আর মহাকর্ষের টান নামক ঘটনাকে বিবেচনা করার দরকারই হয় না। কেন না, ব্রহ্মাণ্ডের বুকে উপর-নীচ ডান দিক বাঁ দিক—ইত্যাদির কোনো মানেই হয় না। সমস্ত দিকই সমতুল্য। অতএব বস্তুটির ত্বরিত গতি নিয়ে বিচার বিবেচনা করলেই চলে।
তবুও কিছু খটকা রয়েই গেল আইনস্টাইনের মনে।
সেগুলো কী কী?

দূর থেকে ক্রিয়া

এক নম্বর হচ্ছে, দূর থেকে ক্রিয়া। এর কথা আগেই উত্থাপন করে রেখেছি। এবারে আরও বিস্তারিতভাবে বুঝবার চেষ্টা করব। নিউটনীয় মহাকর্ষে আকর্ষণ বল ক্রিয়া করার জন্য দুটো বস্তু চাই। অথচ, তারা যে যে দূরত্বেই থাকুক না কেন, এই বলের ক্রিয়া ঘটতে কোনো সময়ের ব্যবধান নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। ভারি অদ্ভুত, তাই না? অন্তত, বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রস্তাবনার পর থেকে এটা মনে হওয়া আইনস্টাইনের কাছে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।

এই যেমন সূর্যের আকর্ষণ পৃথিবী কি সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করতে পারে? না, সময় লাগে খানিকটা? সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতেই সময় লাগে আট মিনিট কুড়ি সেকেন্ডের মতো। মহাকর্ষীয় টান নিশ্চয়ই তার চাইতেও তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারে না! আজ যদি হঠাৎ কোনো কারণে সূর্যের, ঠাকুর না করুন, ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে যায়, আমরা পৃথিবীর লোকেরা সেটা কখন টের পাব? সঙ্গে সঙ্গেই, না, কিঞ্চিত বিলম্বে?

অন্যান্য গ্রহগুলিও কি তাই? আবার তারা সকলে মিলে পৃথিবীকে যে বলের দ্বারা টানে তাও কি তৎক্ষণাৎ চলে আসে? আইনস্টাইন দেখলেন, নিউটনের সূত্রে এসব প্রশ্নের উত্তর তো দূরের কথা, উত্থাপন করার পর্যন্ত সুযোগ নেই। কেন না, তাতে দুটো বস্তুর ভর এবং তাদের মধ্যেকার দূরত্ব ছাড়া আর কিছু সেই মাধ্যাকর্ষণ বল পরিমাপ করতে লাগে না। সেখানে সময়কে কোথাও ধরাই হয়নি। এই ব্যাপারটাকে তাঁর নিতান্তই ভুতুড়ে বলে মনে হল। যতক্ষণ কাছাকাছি বিশ্ব নিয়ে কাজ হচ্ছে এতে মাথা না দিলেও হয়ত চলে যায়। অঙ্কে বা হিসাবে খুব বড় একটা ভুল হয় না। কেন না, সব রকম সঙ্কেতই আলোকের গতিবেগে প্রায় তৎক্ষণাৎ চলে আসে। সেই জন্যই হয়ত এতদিন এতে ভুল ধরা পড়েনি। কিন্তু আজ (১৯১০-২০) আমাদের জানা বিপুল বৃহত্তর যে ব্রহ্মাণ্ড, যেখানে এক একটা জ্যোতিষ্ক পরস্পর থেকে হাজার, লক্ষ, বা এমনকি কোটি আলোকবর্ষ দূরে দূরেও ছড়িয়ে আছে, তাদের বেলায়ও কি সময়কে উপেক্ষা করা যায়? যে তারা হয়ত দু চার লক্ষ বছর আগে মরে গেছে, তার কিছু সঙ্কেত পেয়ে কি বলব, সে এখনও মহাকর্ষীয় প্রভাব ফেলে চলেছে এই সংসারে?

দ্বিতীয় সমস্যা হল, যান্ত্রিক বল কাজ করে গায়ে গায়ে লেগে। বলে লাথি মেরে গোল দেওয়া বা ব্যাট দিয়ে মেরে বাউন্ডারিতে পাঠানোই হোক, কিংবা জলের বালতি তোলাই হোক, অথবা দড়ি টানাটানিই হোক, এমনকি দু জন লোকের মারামারির ঘটনাও যদি ধরি—বল প্রয়োগ কর্তাকে বল গ্রহীতার সঙ্গে সংস্পর্শে যেতেই হয়। কেউ কেউ আছেন যাঁরা দাবি করেন যে তাঁরা শুধুমাত্র ভেবে ভেবেই একটা জিনিসকে নাড়িয়ে দিতে পারেন। তার আবার একটা গালভরা নামও আছে—মানস-সঞ্চালন (psycho-kinesis)। তবে আমাদের মতো সাধারণ লোকেদের এরকম ক্ষমতা শুধু যে নেই তাই নয়, এই রকম সব ভোজবাজির ব্যাপার-স্যাপার চাক্ষুস দেখবারও সুযোগ হয়ে ওঠেনি আজ অবধি। এরকমও দেখিনি যে গরু আগে আগে জোয়াল ছাড়াই চলেছে, আর গাড়ি তার পেছনে কোনো যোগাযোগ ছাড়াই গড় গড় করে এগোচ্ছে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করে কাজ করার সময় সরাসরি ধাক্কা যে লাগছে আর তাতেই যে কাজ হচ্ছে, তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। মহাকর্ষের ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। যারা পরস্পরকে টানছে, তারা কেউ কারোর গায়ে গা লাগিয়ে বসে নেই, তবুও একটা আকর্ষণ বল দিব্যি কাজ করে যাচ্ছে। আইনস্টাইনের প্রশ্ন হল, কী করে এটা সম্ভব হচ্ছে?

এরও উত্তর তিনি খুঁজতে চাইলেন। মহাকর্ষের পরিঘটনাকে এমনভাবে যান্ত্রিক ত্বরিত গতির সাথে তুলনা করে দেখাতে চাইলেন, যেখানে এই দূর থেকে ক্রিয়ার সমস্যাটি থাকবেই না।

ক্ষেত্রতত্ত্ব

তবে তার জন্য এবার তিনি তাকালেন বলবিদ্যার গণ্ডী ছাড়িয়ে ফ্যারাডে-ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বক ক্ষেত্রতত্ত্বের দিকে। সর্বপ্রথম সেখান থেকেই তো তিনি আপেক্ষিকতার সমস্যা বুঝতে শুরু করেছিলেন কিনা!

ঊনবিংশ শতাব্দের প্রায় পুরো সময় ধরেই বিদ্যুৎ আর চুম্বক নিয়ে ইউরোপে গবেষণা চলেছিল। অ্যাম্পিয়র, কুলম্ব, ওয়ের্স্টেড, ফ্যারাডে, লেনৎস্‌, ম্যাক্সওয়েল, হারৎস্‌, প্রমুখ বিজ্ঞানীদের হাত ধরে ধাপে ধাপে বহু পরীক্ষানিরীক্ষা ও তাত্ত্বিক বিকাশের মধ্য দিয়ে একটু একটু জ্ঞানের ভাণ্ডার পূর্ণ হয়ে চলেছিল। তাতে দেখা গেল, দুটো চৌম্বক মেরু বা দুটো আধানের মধ্যে যে আকর্ষণ (বা বিকর্ষণ) বল কাজ করে তার পরিমাণ নির্ণায়ক সূত্রটি মহাকর্ষ সূত্রের সঙ্গে খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ।


যেখানে F = তড়িত বা চুম্বকীয় বল, d = আহিত/চৌম্বক বস্তুদ্বয়ের মধ্যেকার দূরত্ব, q1 ও q2 যথাক্রমে দুই বস্তুর চৌম্বক শক্তি বা আধানের পরিমাণ এবং E = সংশ্লিষ্ট ধ্রুবক রাশি।

আইনস্টাইনের মনে হল, এই সাদৃশ্য কি নেহাতই উপরে-উপরে দেখা অনুরূপ গাণিতিক আকার, নাকি, এর পেছনে বাস্তবের কোনো গভীর তাৎপর্য নিহিত রয়েছে? চিন্তাটাকে তিনি কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছিলেন না।
আচ্ছা যদি, গাণিতিক সাদৃশ্যের পেছনে বাস্তবেরও ভূমিকা থেকে থাকে, তাহলে কি কোনো সুবিধা পাওয়া যায়? উপরের অনুচ্ছেদে উল্লেখিত সমস্যাদুটির সমাধানের কি কোনো সম্ভাব্য রাস্তা চোখে পড়ে?

তা পড়ে। একদিকে তড়িচ্চুম্বকীয় বলের বিস্তারও অসীম; মহাকর্ষ বলের সঙ্গে এই জায়গায় তার খুবই মিল। অথচ, এই বলের ক্রিয়া যে কোনো দূরবর্তী অবস্থানে তৎক্ষণাৎ ছড়িয়ে পড়ে না। ধাপে ধাপে ছড়ায়। গায়ে গায়ে লেগে ছড়ায়। তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তির ক্ষেত্রে যে আন্দোলন উৎপন্ন হয় তা তরঙ্গের আকারেই ছড়িয়ে পড়ে। অপর দিকে এই বলের ক্রিয়ার প্রভাব বিস্তৃত হয় নির্দিষ্ট ও সসীম বেগে—আলোকের গতিবেগে।
আসুন দেখে নিই আইনস্টাইন নিজে এই সমস্যা নিয়ে কী বলেছেন তাঁর অনবদ্য ভাষায়: “ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বে কোনো বস্তুগত কারক নেই। এই তত্ত্বের সমীকরণগুচ্ছ তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্র সংক্রান্ত নিয়মগুলিকেই তুলে ধরে। নিউটনের সূত্রের মতো এখানে দুটো দূর দূরান্তে সংঘটিত ঘটনাকে যুক্ত করে দেখা হয় না; ওখানে কী অবস্থা ছিল দেখিয়ে এখানে কী ঘটছে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। একটা বিশেষ বিন্দুতে এই মুহূর্তে ক্ষেত্রের চরিত্র একটু আগেকার এবং নিতান্তই আশপাশের ক্ষেত্রের অবস্থার উপর নির্ভর করে। আমরা এখন এইখানটায় কী ঘটছে জানি, সমীকরণগুচ্ছ থেকে পরবর্তী মুহূর্তে পরবর্তী জায়গায় কী ঘটবে তার পূর্বাভাস দিতে পারি। ক্ষেত্র সম্পর্কে আমরা একটু একটু করে জানতে জানতে এগোতে পারি। আবার অনেক পেছন থেকে এই রকম ছোট ছোট ধাপগুলোতে কী ঘটেছিল জেনেই আমরা এখন কী ঘটতে চলেছে তা বের করে ফেলতে পারি।” [Einstein and Infeld 1938, 152-53]

আর একটা জিনিসও লক্ষ করার প্রয়োজন আছে। তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্র দেখানোর জন্য দুটো আহিত/চৌম্বক বস্তু থাকার প্রয়োজন পড়ে না। একটি আহিত বা চৌম্বক বস্তু থাকলেই তার প্রভাব তথা শক্তি ক্ষেত্রকে অনুভবও করা যায়, গণিতের মাধ্যমে প্রকাশও করা যায়।

এই সব দেখে আইনস্টাইন ভাবতে শুরু করলেন, মহাকর্ষের পরিঘটনাকে কোনোভাবে এই রকম একটা প্রভাব ক্ষেত্র হিসাবে দেখানো যায় কিনা। এর জন্য তাঁকে দুটো জায়গায় কাজ করতে হল: একটা হল, সর্বজনীনভাবে মহাকর্ষকে ত্বরিত গতির সাথে অভিন্ন ছবি বলে দেখানোর চেষ্টা করা; দ্বিতীয়ত, মহাকর্ষকে কীভাবে প্রভাবাধীন ক্ষেত্র হিসাবে চিত্রায়িত করা যায় তার বিজ্ঞানসম্মত যোগসূত্র খুঁজে বের করা।
একে একে। আমরাও এখানে তাঁর উপলব্ধির অগ্রগতির সরণি ধরেই এগোতে থাকব।

ত্বরিত গতি বনাম মহাকর্ষ!

কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না। কেন না, দেখাতে হবে, ত্বরিত গতির ক্ষেত্রেও যে কোনো একটি নির্দেশাক্ষে বসে কারোর পক্ষেই প্রকৃতপক্ষে সেই গতির আন্দাজ পাওয়া সম্ভব নয়। যে কাজ গ্যালিলেও বা নিউটন শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেননি।
সেটা সম্ভব হল আরও কয়েকটা কল্পিত পরীক্ষার আয়োজন করার দ্বারা। তবে গ্যালিলেও সমুদ্রে জাহাজ নামিয়েছিলেন; আইনস্টাইন আধুনিক কালের লিফটের সাহায্য নিলেন। [Einstein 1954, chapter XX; Einstein and Infeld 1938, 226-35; রায় ২০০৫; আমরা বর্তমান পাঠকদের কথা মনে রেখে এই পরীক্ষাকল্পনাগুলির উপস্থাপনায় সামান্য স্বাধীনতা নেব।]

প্রথম পরীক্ষা: তার জন্য প্রথমে আমাদের একটা লিফট নিয়ে মনে মনে অনেক দূরে চলে যেতে হবে। ব্রহ্মাণ্ডের এমন একটা ফাঁকা জায়গায়, যেখানে কোনো বড় জ্যোতিষ্কের আকর্ষণ কাজ করছে না। (যেতে অসুবিধা কিছুই নেই: কল্প-পরীক্ষায় “কোথাও আমাদের হারিয়ে যাবার নেই মানা”! বাস্তবে অবশ্য এরকম জায়গা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন; আমরাও পরীক্ষা হয়ে গেলেই সে জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে আসব।) সেখানে মনে করা যাক, একটা পাহাড়ের গা বেয়ে লিফটটা ত্বরিত গতি নিয়ে উপরে উঠছে। লিফটের ভেতরে একজন ব্যক্তি বেশ আরামেই দাঁড়িয়ে আছেন, যিনি বাইরের কোনো খবর রাখেন না। ফলে লিফটের ত্বরণ সহ উপরে ওঠার খবরও তাঁর জানা নেই। ওদিকে বাইরে, পাহাড়ের কোনো একটি চূড়ায় একজন শিকারী হাতে দূর পাল্লার খুব শক্তিশালী বন্দুক নিয়ে বসেছিলেন ওঁত পেতে। লিফট তাঁর কাছাকাছি উঠে আসতেই তিনি বন্দুক বাগিয়ে লিফট ভেদ করে গুলি চালিয়ে দিলেন। গুলিটা লিফটের উপরের দিকের দেওয়াল ভেদ করে ঢুকে গেল আর এক-আধ সেকেন্ড বাদেই উলটো দিকের দেওয়াল একটু নীচ দিয়ে ভেদ করে বেরিয়ে এল। শিকারী দেখলেন, গুলি একেবারে নিউটনের এক নম্বর গতিসূত্র মেনেই দিব্যি সরলরেখায় চলেছে

(৭ক চিত্র দেখুন)।



লিফটের আরোহী কী দেখবেন? তিনি হঠাৎ দুম করে একটা আওয়াজ শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখবেন, লিফটের ভেতরে উপর দিক দিয়ে একটা গুলি ঢুকেছে যেটা চলতে চলতে ক্রমাগত নীচে পড়ে যাচ্ছে। যেমনটা পৃথিবীর বুকে চলন্ত বস্তুর উপর মাধ্যাকর্ষণের টানে হয়ে থাকে আর কি! গুলিটা একটা অধিবৃত্তাকার পথ ধরে গড়িয়ে পড়ছে (চিত্র নং ৭খ দেখুন)। তিনি আবার নিউটনের গতিসূত্র, তথা মহাকর্ষ নিয়ম—সমস্ত ব্যাপারেই নিশ্চিত বোধ করবেন। সব কুছ ঠিক হ্যায়।

এইভাবে দুজনে যদি দুরকম দেখেন, তাহলে প্রকৃত সত্যটা কী?

সত্য ঘটনাটা হল, যাহা এক দর্শকের কাছে সরলরেখায় (প্রায়) সমবেগে গতিশীলতা, তাহাই আর এক দর্শকের কাছে মহাকর্ষ জনিত অধিবৃত্তাকার গতি। নির্দেশাক্ষ অনুযায়ী কে কী আপেক্ষিক গতি দেখবে তা ঠিক হচ্ছে। ঘটনা একটাই। সেই রেল গাড়িতে ভ্রমণের সময় মাঠঘাটের পিছিয়ে যাওয়ার মতন ব্যাপার!

দ্বিতীয় পরীক্ষা: এদিকে হল কি, লিফটের যাত্রীর হাতে ছিল একটা ক্রিকেট বল। কথা নেই বার্তা নেই, বন্দুকের শব্দে চমকে ওঠায় তাঁর হাত ফস্কে আকস্মিকভাবে বলটা বেরিয়ে গেল। এইবার শুরু হল আর এক মজার কাণ্ড। আবার উপরোক্ত দুই দর্শক দু রকম জিনিস দেখতে পেলেন।
লিফটের আরোহী দেখলেন, বলটা তাঁর হাত ফস্কে গলে গিয়ে নীচে পড়ে গেল। লিফটের মেঝেয় গিয়ে ধুপ্‌ শব্দ করে ধাক্কাও খেল। ঠিক যেমনটা পৃথিবীর উপরে এরকম ঘটনায় হয়ে থাকে, হুবহু সেরকমই ঘটল ব্যাপারটা। আবার তিনি নিশ্চিত বোধ করলেন, নিউটনের মহাকর্ষ নিয়ম যথা পূর্বং কাজ করে চলেছে (চিত্র নং ৮ক দেখুন)। সাবেকি বলবিদ্যার প্রতি তাঁর বিশ্বাস অটুট রইল এই ঘটনায়।



ওদিকে, বাইরে যে শিকারী বসেছিলেন, তিনি দেখলেন একেবারে অন্য রকম ঘটনা। লিফটও উপরে উঠছে, বলও উপর দিকে যাচ্ছে। কিন্তু লিফটের ত্বরণ থাকায় সেটার গতিবেগ ক্রমশ বাড়ছে। আর বলটা যখন আরোহীর হাত থেকে গলে গেল, তখন তার (লিফটের সঙ্গে একসাথে চলার দরুন) যা বেগ ছিল সেই বেগেই সে গতিজাড্য নিয়ে উপরে উঠছে। নিউটনের প্রথম সূত্র অনুযায়ী। তার ফলে লিফটের মেঝে এক সময় তাকে ধরে ফেলে এবং টকাস করে শব্দ করে বলটাকে কোলে নিয়ে নেয় (চিত্র নং ৮খ দেখুন)। নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্রের সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখেই ব্যাপারটা ঘটে।

অর্থাৎ, একজনের কাছে যেটা ত্বরিত গতির সাপেক্ষে আপেক্ষিক সম বেগে চলন, আর একজনের কাছে সেটাই আবার মহাকর্ষীয় আকর্ষণের ব্যাপার বলে প্রতিভাত হচ্ছে।

তৃতীয় পরীক্ষা: এইবার আমাদের লিফটটাকে নিয়ে মনে মনে যেতে হবে ব্রহ্মাণ্ডের এমন জায়গায় যেখানে কোনো একটা খুব বড় নক্ষত্রের শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র কাজ করছে। বাস্তবে এরকম পরীক্ষা করা খুবই বিপজ্জনক; আমরাও এই শেষ মনোপরীক্ষাটা হয়ে গেলেই বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই লিফট থেকে বের করে ভদ্রলোককে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে চলে আসব। আপাতত লিফট সেই মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে অবাধে পতনের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তরতর করে সেটা নীচে নামছে। ভেতরের আরোহী অবশ্য এসব কিছুই জানেন না। তিনি হাত থেকে একটা রুমাল ছেড়ে দিলেন; সেটা তাঁর হাতের পাশেই ভেসে রইল। বলটা ছেড়ে দিয়ে দেখলেন, সেও একই ভাবেই ভাসমান। আরোহীর যদি পৃথিবীর অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে থেকে থাকে তিনি এই সব ঘটনাকে দেখে ভাববেন, তিনি পৃথিবীর একটা “মিনি” বা “পকেট সংস্করণ”-এর মধ্যেই আছেন। [Einstein and Infeld 1938, 228] গ্যালিলেওর সেই জাহাজের যাত্রীর মতোই তিনি যেভাবেই পরীক্ষা করুন না কেন, লিফটের গতি সম্পর্কে তিনি বিন্দুমাত্র আভাস পাবেন না—সেটা এক জায়গায় স্থির হয়ে থেমে আছে, না সমবেগে চলছে, নাকি ত্বরণ সহ চলমান। এমনকি লিফটটা অনুভূমিক দিকে চলছে না মহাকর্ষের টানে উপর থেকে নীচে পড়ছে—তাও তিনি টের পাবেন না। ভূপৃষ্ঠে বসে আমরা যেমন প্রতিদিনকার ছোটখাটো সাধারণ অভিজ্ঞতায় আকাশ না দেখে পৃথিবীর আহ্নিক বা বার্ষিক কোনো গতিরই হদিশ পাই না, সেই অর্থে, তার ত্বরণেরও কোনো সংবাদ পাই না, সেই লিফট যাত্রীর অবস্থাও সেই রকম। তিনিও তাঁর যানের প্রকৃত গতি কী প্রকারের তা বুঝতে সক্ষম হবেন না।

মজা হল, বাইরের সেই শিকারী যদি সেখানেও কাছাকাছি গিয়ে কোথাও এক জায়গায় বসে লক্ষ করেন, তিনি বলবেন, “না, না; কিছুই থেমে নেই। লিফট, লিফটের আরোহী, তাঁর রুমাল বা বল—সমস্ত কিছুই লিফটের সঙ্গে একই ত্বরিত বেগ নিয়ে এক নক্ষত্রের আকর্ষণে নীচের দিকে ধাবমান। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।” অর্থাৎ, আবার সেই নির্দেশাক্ষ অনুযায়ী গতি। লিফটের সাপেক্ষে ভেতরের সব কিছুই আপেক্ষিকভাবে স্থির বা সমবেগে চলমান। আবার বাইরের সেই শিকারীর নির্দেশাক্ষ অনুযায়ী লিফট এবং তার ভেতরের সব কিছুই এক মহাকর্ষজ ত্বরণ সহ নীচে অবাধে পতনশীল। এখানেও মহাকর্ষ আর যান্ত্রিক গতির মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত নিয়মগুলি উভয় ক্ষেত্রে একই ভাবে কার্যকর। অর্থাৎ, শুধু সমবেগে গতিশীল নয়, মহাকর্ষ সাপেক্ষে ত্বরিত বেগে গতিশীল নির্দেশাক্ষগুলির ক্ষেত্রেও সেই নিয়মগুলির কোনো ব্যতিক্রম হয় না।

এরকম তিনটি কাল্পনিক পরীক্ষার মাধ্যমে আইনস্টাইন আমাদের বোঝালেন যে মহাকর্ষ আসলে এক রকমের ত্বরিত গতি ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু এই ত্বরণের মান নির্দিষ্ট বস্তুস্থিতির উপর নির্ভর করে।


জ্যামিতির পাঠ

পাঠকদের অনেকেই হয়ত ভাবছেন, বাঃ বেশ সহজেই ব্যাপারটার সমাধান হয়ে গিয়েছিল তো! তাহলে আর এর অঙ্ক অত জটিল হতে গেল কেন? হ্যাঁ, যা বলেছেন! শুনুন মশাই, ধৈর্য, ধৈর্য চাই অফুরন্ত। এই অবধি এসে অনেকগুলো সমস্যার সমাধান হয়ে গেল ঠিকই। কিন্তু এক নতুন উপদ্রব এসে হাজির হল—সেটা খেয়াল করেছেন কী?

নিশ্চয়ই করেননি। আমাদের মতো আম আদমির আদৌ ধরতে পারার কথাই নয়। সেকালেও এমনকি বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই পারেননি। নইলে তো আরও অনেকেই আইনস্টাইনের জায়গাটা নিতে পারতেন।

সমস্যাটা হল: এই ত্বরণ কীভাবে সৃষ্টি হয়? বল কে প্রয়োগ করছে? সূর্য যদি পৃথিবীকে দূর থেকে টান দিয়ে না থাকে, পৃথিবী তার দিকে হেলে যায় কেন? নিউটনের হাতে তো একজন ঈশ্বর ছিলেন রামধাক্কা দেবার জন্য। আইনস্টাইন আবার অতটা ঈশ্বরভক্ত নন। তিনিও এক ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতেন। কিন্তু সে এক নিষ্ক্রিয় জগত-কার্যনিস্পৃহ নিয়মভক্ত জ্ঞানপ্রিয় অলস কিছুই না-করা না-দেখা ঈশ্বর। অনেকটা যেন শার্লক হোম্‌সের সেই দ্বিগুণ-বুদ্ধি দাদা, মাইক্রফট হোম্‌স—আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা The Adventure of the Greek Interpreter, সেই গল্পের নতুন নায়কের কথা মনে পড়ছে তো আপনাদের?—তাঁর মতো। বিপুল বুদ্ধি, কিন্তু নড়েচড়ে কিছু করার একেবারেই ইচ্ছা নেই। ওরকম ঈশ্বরকে এত বড় দায়িত্ব দেওয়া যায় না! অতএব এই মহাকর্ষীয় ত্বরণের জন্য কিছু ভৌত উৎস চাই।

আর একটা কারণেও সমস্যাটা বেশ জটিল। তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্র এক অর্থে অস্থায়ী। চুম্বক মেরু বা আহিত বস্তুকে সরিয়ে নিলে ক্ষেত্রও চলে যায়। চুম্বকত্ব বা আধান নষ্ট হলেও তাই। আবার বহু পদার্থই চৌম্বক গুণ বিশিষ্ট নয়। সমস্ত বস্তুও তড়িত পরিবাহী নয়। এছাড়া চৌম্বক বা বিদ্যুৎ পরিবাহীর উপরে কোনো চৌম্বক বা বৈদ্যুতিক পরিবাহী বস্তুর আবরণ দিয়ে দিলে তাদের ক্ষেত্রও আর সেই আবরণের বাইরে অনুভূত হয় না। কিন্তু মহাকর্ষ এত সহজে হার মানে না। সে এক ভয়ানক সর্বজনীন সার্বক্ষণিক বস্তুধর্ম। একমাত্র অন্য মহাকর্ষ ক্ষেত্রে অবাধে পতনশীল বস্তু সাময়িকভাবে তার নিজের মহাকর্ষ ধর্ম হারিয়ে বসে (যেমন সেই লিফটের অবাধ পতনের সময় হয়েছিল)। এছাড়া মহাকর্ষ ধর্ম কখনই বস্তুকে ছেড়ে যায় না।
এই সমস্যার সমাধানের সম্ভাব্য একটি মাত্র রাস্তার দিকে ইতিমধ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন হেরমান মিনকাউস্কি। যিনি বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের এক জ্যামিতিক ভাষ্য নির্মাণ করে ফেলেছিলেন ১৯০৬ সালেই। ইউক্লিদের জ্যামিতিকে তিন থেকে চার মাত্রায় উন্নীত করে। সতর্ক পাঠকের মনে আছে নিশ্চয়ই, আমি আগে একবার, সময়ের মাপ কীভাবে নির্দেশাক্ষের গতির উপরে নির্ভর করে বোঝাতে গিয়ে ফস্‌ করে এই জ্যামিতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে ফেলেছিলাম। এবার কিন্তু সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করতে হবে।

আমরা দেখব, আইনস্টাইনও এবার সেই দিকে চোখ ফেরালেন।

আসলে কাজটা নিউটনই শুরু করেছিলেন। তবে অনেকটা আনমনে, অখেয়ালে। সম্পূর্ণ তাৎপর্য হয়ত লক্ষ না করেই। গ্রহের গতি সম্পর্কে ধারণা করতে গিয়ে নিউটনের মনে হয়েছিল, প্রতিটি গ্রহের উপর যেন দুটো বল কাজ করছে। একটা সূর্যের দিক থেকে আসছে, কক্ষপথের অর্থে কেন্দ্রাভিগ (centrifugal force) আকর্ষণ বল। কক্ষপথের কোনো বিন্দুতে স্পর্শকের সঙ্গে উল্লম্ব দিক বরাবর সূর্যের অভিমুখে। আর একটা যেন বাকি বিশ্বের সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র মিলিয়ে সেই স্পর্শক বরাবর এক বহির্মুখী বল (৯ নং চিত্র দেখুন)।
গ্রহটি এখন কী করবে? সে নিশ্চয়ই এই দুই বলের লব্ধি (resultant) বরাবর যাত্রা করবে।

এই লব্ধি পাওয়া যাবে কী করে? সেও নিউটনেরই আবিষ্কার। জ্যামিতির সাহায্য নিয়েই। এই দুই বলের মান ও দিক ধরে একটা সামান্তরিক আঁকলে তার কর্ণ বরাবর হবে সেই লব্ধি (law of parallelogram of forces)। গ্রহটি সেই বিন্দু থেকে সূর্যের দিকে পুরোটা ঢলে পড়বে না, কিন্তু একটু বুঝি হেলে যাবে। এই ভাবে প্রতিটি পর পর বিন্দুতে লব্ধি এঁকে যেতে পারলে সেই উপবৃত্তাকার পথ পাওয়া যাবে, যার কথা কেপলার বলে গিয়েছিলেন। নিউটনের কাছে এই জ্যামিতি ছিল নেহাতই কাজের সুবিধার ব্যাপার। অঙ্কটা সহজে ধরে ফেলা যায়।
আইনস্টাইনের মনে হল, আচ্ছা, এটাই আসল কথা নয় তো?

অ-ইউক্লিদীয় জ্যামিতির দিকে নজর গেল তাঁর। ইউক্লিদের থেকে এই জ্যামিতিগুলি আলাদা কেন হল? দরকারই বা হল কেন এদের? উনিশ শতকে গাউস, রিমান, লোবাচেভস্কি—এঁরা সব এত সময় ব্যয় করলেন কেন এদের পেছনে?


সেই কারণটা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দেরই আর একজন গণিতবিদ। উইলিয়াম ক্লিফোর্ড। তিনি বলেছিলেন, জ্যামিতি মানে নিছকই বস্তুর আকার প্রকার নয়। বস্তুর নানা রকম ভৌত ধর্মের সাথে জ্যামিতিক আকারের সম্পর্ক রয়েছে। কথাটা সেকালে খুব একটা কেউ আমল দেয়নি। এবার আইনস্টাইন দিলেন।



তখন বোঝা গেল, জ্যামিতি কোনো বিশুদ্ধ কল্পনা নয়। বস্তুজগতকে আমরা যে আকারে দেখি তার মধ্যেই জ্যামিতি নিহিত। ইউক্লিদীয় জ্যামিতি বস্তুজগত থেকে কিছু আকার আকৃতির ধারণাকে বিচ্ছিন্ন করে বিমূর্ত রূপে বোঝার এবং বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। তাতে এমনিতে ভুল কিছু ছিল না। সুবিধাই বরং হয়েছে। কিন্তু আবার একটা ভ্রান্ত ধারণাও মনের মধ্যে বাসা বেঁধে ফেলেছিল এতকাল। যেমন, সরল রেখাকে আমরা যদ্দুর খুশি বাড়িয়ে ফেলতে পারি। ত্রিভুজ চাই—নাও না যত বড় ইচ্ছে। একটা সময় থেকে গণিতজ্ঞরা বুঝলেন, না, ইউক্লিদীয় জ্যামিতি হচ্ছে আসলে একটা সুবিধাজনক সংক্ষিপ্তসার। সাদা কাগজে, টেবিলের উপর, রাস্তার এপার-ওপার বরাবর সরল রেখা পেতে চান পাবেন। খুব কিছু অসুবিধা নেই। কিন্তু সমুদ্রের ধারে গিয়ে দাঁড়ান। দূর থেকে আসা নৌকোগুলোকে লক্ষ করুন। আপনার সঙ্গে ওগুলোর সংযোজক কোনো সরল রেখা আঁকা যাবে কিনা ভেবে দেখুন। দেখবেন, না, সম্ভব নয়। আপনার পায়ের তলা থেকে নৌকো পর্যন্ত যে রেখাটি আপনি আঁকবেন, সেটা সরল রেখা হবে না, জলতলের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে বেঁকে যাবে (চিত্র নং ১০ দ্রষ্টব্য)।



আর একটা পরিচিত উদাহরণ দিই। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী দিল্লির কুতুব মিনার আর কলকাতার শহিদ মিনারের পাদদেশের মধ্যে ক্ষুদ্রতম রেখাটি কি সরল রেখা হবে? তাকে ইউক্লিদীয় পদ্ধতিতে কি আঁকা যাবে? না। বরং, কেউ যদি সত্যিই আঁকতে যান, তিনি দেখবেন, একটুখানি এগিয়েই মাটি ভেদ করে যেতে হচ্ছে। অথবা, শহিদ মিনারের পাদদেশ থেকে আঁকা সরল রেখা কুতুব মিনারের উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর তা নয়ত আপনাকে ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে দূরত্ব-সূচক রেখাটিকে নিজে থেকেই বেঁকে যেতে দিতে হচ্ছে (চিত্র নং ১১ দ্রষ্টব্য)।
আচ্ছা, এইবার আকর্ষণ জিনিসটাকে নিয়েও ভাবা যাক।

মনে করুন, পৃথিবীর বিষুব রেখার উপরে তিন হাজার কিলোমিটার ব্যবধানে দুই বিন্দু থেকে দুজন ব্যক্তি দুটো দ্রাঘিমা রেখা ধরে সোজা বিমানে চড়ে উত্তর মেরুর দিকে যাত্রা শুরু করলেন। আর অনেক দূর থেকে, একটা কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে কেউ তাঁদের যাত্রা পথের উপর লক্ষ্য রাখছেন। কী দেখবেন তিনি?

প্রথম প্রথম তাঁর মনে হবে, দুজনে সমান্তরাল ভাবে, বিষুব রেখার উপর লম্বভাবে পথ বেছে নিয়ে যাত্রা করেছেন। কিন্তু তাঁরা উত্তরে বেশ খানিকটা এগোনোর পর তাঁর মনে হতে থাকবে, দুজন যেন ক্রমশ পরস্পরের কাছাকাছি এসে পড়ছেন। যত এগোচ্ছেন, বিমানদুটির যদি ত্বরণ থাকে, ততই তাঁদের কাছাকাছি চলে আসার হারও বেড়ে যাবে। যদি ভূপৃষ্ঠের চেহারা তাঁর চোখে খুব স্পষ্টভাবে ধরা না পড়ে, তিনি এও হয়ত তখন ভাবতে শুরু করবেন, বিমানদ্বয় একে অপরকে আকর্ষণ করছে এবং তার ফলে কাছাকাছি চলে আসছে। এমনকি, বিমানদ্বয়ের কাছাকাছি আসার হারকে তিনি এক রকমের মহাকর্ষীয় ত্বরণ ধরে নিয়ে হিসাব কষে বের করে নিতে পারেন। তারপর, নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র দিয়ে এই দুই বিমানের পরস্পর আকর্ষণ বলকে অঙ্ক কষে বের করেও ফেলতে পারেন। তাতে কোথাও একটুও ভুল হবে না। অথচ, তলিয়ে দেখলে, সবটাই কিন্তু বিশুদ্ধ জ্যামিতির ব্যাপার।

এবার আইনস্টাইনের সামনে রাস্তা খুলে গেল। আর প্রায় বন্ধ হয়ে গেল আমাদের বোঝার দরজা। কেন না, অঙ্কটা এবারে এত জটিল আকার ধারণ করল যে আগেরটার মতো অত সহজে তো দূরের কথা, খুব উচ্চমার্গীয় গণিতের সাথে আলাপ পরিচয় না থাকলে দাঁত ফোটায় সাধ্য কার! আইনস্টাইন সাবধান করে দিলেন: “সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সাহায্যে যে কোনো নির্দেশতন্ত্রে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলিকে সিদ্ধ বলে দেখানোর সমস্যার সমাধান করা হল; আগের তত্ত্বে, অর্থাৎ, বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে সমাধান হয়েছিল কেবল মাত্র সমবেগে গতিশীল নির্দেশতন্ত্রের সাপেক্ষে। . . . এই কাজটা যেভাবে করা হয়েছিল তা বলতে গেলে আগের তুলনায় বেশ অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে যাবে। বিজ্ঞানের বিকাশে নতুন ভাবে উত্থিত সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আমাদের তত্ত্ব ক্রমাগত বিমূর্ত হয়ে ওঠে। অপ্রত্যাশিত অভিযানে সামিল হতে হয়। কিন্তু আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য একটাই, বাস্তবের আরও উন্নততর উপলব্ধি। তত্ত্ব যেভাবে পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করে তার যুক্তিশৃঙ্খলে নতুন নতুন গ্রন্থি যোগ করতে হয়। তত্ত্ব থেকে পরীক্ষার দিকে যাওয়ার পথে অপ্রয়োজনীয় কৃত্রিম কল্পনাগুলিকে সরিয়ে দেবার জন্য, আরও নতুন নতুন তথ্যের এলাকায় প্রবেশের স্বার্থে আমাদের এই যুক্তিশৃঙ্খল দীর্ঘতর হতে থাকবে। আর আমাদের প্রাথমিক কল্পনাগুলি যতই গভীরে যেতে এবং সরলতর হতে থাকবে, গাণিতিক যুক্তির প্রক্রিয়া ততই জটিল হয়ে উঠবে; তত্ত্ব আর পর্যবেক্ষণের মাঝখানের পথটা ততই দীর্ঘতর, সূক্ষ্মতর ও জটিলতর হয়ে উঠতে থাকবে।” [Einstein and Infeld 1938, 224-25]

আইনস্টাইন তো বলে খালাশ। আমাদের তাহলে উপায় কী? এত দূর এসেও সরে যাব?

না, উপায় যে একেবারে নেই তা নয়। শুধু চিন্তার প্রক্রিয়াকে আগের তুলনায় আরও একটু বেশি ক্ষুরধার করে তুলতে হবে। ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির সঙ্গে প্রথমে বিভিন্ন বস্তুর বাহ্যিক আকৃতিগত ধর্মকে বুঝে ফেলতে হবে। তারপর তার সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বস্তুর ভৌত-রাসায়নিক ধর্মকেও বুঝে নিতে হবে। কার্বন অণুগুলোর বিভিন্ন জ্যামিতিক বিন্যাসের ফলেই যে কোনোটা হয় কয়লা, কোনোটা হয় গ্রাফাইট আর অন্য কোনোটা হয়ে ওঠে হীরা—এ যদি আমরা খেয়াল করি তখন জ্যামিতি এক অন্য মাত্রা নিয়ে আমাদের চোখে ধরা দেবে। সমতল আয়না উত্তল লেন্স আর অবতল লেন্স যে বিভিন্ন রকম ছবি দেখায় তার পেছনেও যে জ্যামিতির খেলা রয়েছে তখন আমাদের চট করে মনে পড়ে যাবে। এমনকি ইলেকট্রন প্রোটন মেসন গ্লুওন কোয়ার্কেরও অনেক কিছু জিনিস জ্যামিতি দিয়েই যে ভালো বোঝা যায় সে কথাও মনে রাখতে হবে। আপনার আমার শরীরে কোন অণুর সাথে কোন অণুর বিক্রিয়া হবে, কারা রক্তে মিশে যাবে, কারা কারা বাথরুমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবে, ওষুধের অণুগুলি কীভাবে শরীরের কোথায় কীভাবে কাজ করবে—যদি শোনেন, তাও একে অপরের জ্যামিতির উপর নির্ভরশীল, তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে?

হ্যাঁ, সেই অনুভূতি দিয়েই বাকিটা বুঝতে হবে। ধীরে ধীরে। তার আগে এই অবধি এসে কী কী বুঝে নিলাম এখানে আর একবার পরিষ্কার করে বুঝে নিই। পরপর কয়েকটা জিনিস মনে রাখুন:
এক, মহাকর্ষ বস্তুজগতের এক সর্বত্রগামী ভৌত পরিঘটনা।
দুই, ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিও সমস্ত পদার্থের এক সর্বব্যাপক আকার ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য। [Vladimirov, Mitskievich and Horsky 1987, 29-30]
তিন, অতএব মহাবিশ্বের অন্যতম লক্ষণ হিসাবে মহাকর্ষের জন্যও জ্যামিতির কথা ভাবতে হবে।
চার, কিন্তু মহাবিশ্ব মানেই হল দেশ ও কাল মিলিয়ে এক চতুর্মাত্রিক সন্ততি (four-dimensional space-time continuum)।
পাঁচ, অতএব মহাকর্ষের জন্য দেশ-কাল মিলিয়ে এক চতুর্মাত্রিক জ্যামিতি নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে।
আগেই বলেছি, মিনকাউস্কি ইতিমধ্যেই এরকম জ্যামিতির কথা ভেবেছিলেন এবং তার গাণিতিক রূপ তৈরিও করে ফেলেছিলেন। সেই বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের জ্যামিতি হল আসলে চতুর্মাত্রিক ইউক্লিদীয় জ্যামিতি। যা এক অর্থে বস্তুজগতের চার মাত্রায় সমতলের প্রতিনিধিত্ব করে। তার প্রতিটি বিন্দু দিয়ে অঙ্কিত চারটি অক্ষ পরস্পর সমবেগে গতিশীল এক একটি নির্দেশাক্ষকে বোঝায়। অর্থাৎ, তারা কার্যত অভিন্ন। কিন্তু, এবারে যে জ্যামিতির কথা ভাবতে হচ্ছে তার বিভিন্ন বিন্দুতে অঙ্কিত চার-অক্ষ বিশিষ্ট নির্দেশতন্ত্রগুলি প্রত্যেকটাই এক একটি স্বতন্ত্র নির্দেশাক্ষ। এক এক রকম ত্বরণের সাপেক্ষে। অসমতল বা অ-ইউক্লিদীয় চতুর্মাত্রিক জ্যামিতি। সেই জ্যামিতির বক্রপৃষ্ঠতলই মহাকর্ষ ক্ষেত্রকে ধারণ করে।
কী হল ব্যাপারটা? সহজ হতে হতেও আবার কেমন যেন গোল পাকিয়ে গেল মনে হচ্ছে!

আচ্ছা, ঠিক আছে। অন্যভাবে এগোনো যাক। আমরা কাগজে যে ছবি আঁকতে পারি, তা দুই মাত্রার জ্যামিতি। নানা রকম কায়দা করে তাতেই আবার আমরা তিন মাত্রার ছবিও বোঝাতে পারি। চার মাত্রার ছবি কাগজের উপরে এঁকে দেখানো কিন্তু অসম্ভব। একটা চলমান বা অস্থির ত্রিমাত্রিক ছবি দেখাতে হবে। আপাতত সেই চলমান ছবিটির একটা বিশেষ মুহূর্তের ছবি দেখানোর চেষ্টা করি। ছবিটা আইনস্টাইনই এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তো জানতেন, আমাদের মতো লোকপ্রিয় ভাষ্যকাররা না বুঝে অনেক উল্টোপাল্টা কাণ্ড করে বসতে পারে। অতএব ঝুঁকি নেননি।

একটা নাইলনের বড়সড় চাদরের কথা ভাবুন। শামিয়ানার মতো করে টাঙানো আছে। বেশ টান-টান দেখাচ্ছে। এবার এর উপরে একটা বড় কাঠের গোলাকার বল এনে রাখা হল। কী হবে?

কেন, বলটা মাঝখানে চলে আসবে আর সেখানটায় একটা গর্ত মতো করে জমিয়ে বসে যাবে (চিত্র নং ১২ দেখুন)।
আইনস্টাইন বললেন, যথার্থ। দেশকালে যদি কিছু না থাকত সেও অমনি টানটান সমতলের মতো হয়েই থাকত। কিন্তু বস্তু আছে তো। আর যেখানেই বস্তু আছে, সেখানেই সে তুবড়ে যায়। সময়ের সাপেক্ষে অন্যান্য অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে সেই তোবড়ানোটা বাড়ে কমে। এইবার সেই চাদরের এক ধারে একটা মার্বেল গুলি এনে রেখে দিন। সেটার কী অবস্থা হবে? যেখানেই ছেড়ে দিলেন, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? না। সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, শামিয়ানার বক্রতল ধরে সেটি কাঠের গোলার দিকে এগোতে থাকবে। ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়বে। যত নীচের দিকে যাবে, গড়ানোর হার বেরে যাবে। নিউটনীয় সেই ত্বরণ। মনে আছে তো? তা, সেই রকমই ঘটতে থাকবে।
সূর্য পৃথিবীকে অনেকটা এইভাবেই নিজের দিকে টানছে।
“কিন্তু . . . !”

থাক থাক, বলতে হবে না। বুঝে গেছি কী জিগ্যেস করতে চাইছেন।
আরে মশাই, আমিও যেদিন প্রথম এই জিনিসটা শুনেছিলাম, একই প্রশ্ন করেছিলাম। হ্যাঁ, খুব স্বাভাবিক। আমাদের এই সব জটিল জিনিস বুঝতে যথেষ্ট সময় লাগে। আমরা একবারে সবটা ধরতে পারি না। “কিন্তু মা-ধরিত্রী তো একেবারে গড়িয়ে সূর্যমামার কোলে পড়ে যায় না! সে তো ঘুরতেই থাকে, চলতেই থাকে। তার কী ব্যাখ্যা দেবেন?” কি, ঠিক বলেছি না?



আসলে যদি মহাবিশ্বের বা এমনকি সৌরজগতের শামিয়ানায় শুধু সূর্য আর পৃথিবী থাকত, এবং তারা স্থির অবস্থায় থাকত, তাহলে জ্যামিতিটা অনেক সরল হত, পৃথিবী ওই মার্বেল গুলিটার মতোই গড়িয়ে একেবারে পড়েই যেত। কিন্তু এদিক ওদিক করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তো আরও অনেক কিছু। কতগুলো গ্রহই তো আছে। এদের ভারেও যে ব্রহ্মাণ্ড-রূপী শামিয়ানায় নানা জায়গাতে গর্ত তৈরি হয়ে উঁচুনীচু হয়ে আছে। আর এদের দূরত্ব আবার সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর থেকে অনেক কম। ফলে এদের যার যার সৃষ্ট বক্রতলের নীচের দিকেই পৃথিবীর অবস্থান। গড়িয়ে পড়ার হারও সেই অনুপাতে বেশি। আর, এই সমস্ত কিছুই গতিশীল। তার ফলে, পৃথিবী কার দিকে কতটা গড়াবে, সেটাও এই সমস্ত গতিশীল জ্যোতিষ্কের বক্রতলের মধ্যেকার ওঠানামার অবস্থা ও পরিমাণ দিয়ে ঠিক হয়। ফলে কখনই সে একেবারে পুরোটা সূর্যের দিকে (বা অন্য কারোর দিকেই) ঢলে পড়ে না। বাকিরা সকলে মিলে তার জন্য মহাবিশ্ব-জ্যামিতির চতুর্মাত্রিক বক্রপৃষ্ঠে যে ন্যূনতম দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট পথরেখা তৈরি করে দেয়, পৃথিবী সেই পথ ধরেই চলতে থাকে। অন্যান্য গ্রহের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। গোটা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি জ্যোতিষ্কের জন্যও একই রকম ব্যবস্থা। এই হল গিয়ে ঘটনা!

যখন বস্তুগুলো ছোট ছোট এবং/অথবা তাদের মধ্যেকার দূরত্ব অনেক—অর্থাৎ, একটা বিশেষ বস্তুকে ধরলে সে যে পথ দিয়ে গড়াচ্ছে সেটা খুব একটা বক্র বা উঁচুনীচু নয়, সেই সব ক্ষেত্রে নিউটন এবং আইনস্টাইনের গণনা একই ফল দেবে। আপনি নিউটনের সহজ ফরমুলা ধরেই কাজ গুছিয়ে নিতে পারবেন। বলের পরিমাণ কম বলে কোনো ভুলটুল চোখে পড়বে না। জ্যামিতি-ট্যামিতি না ধরে বল এবং দূরবর্তী ভুতুড়ে ক্রিয়া ধরে কাজ করলেও মহাভারত (বা অন্য যে কোনো প্রাচীন গ্রন্থ) অশুদ্ধ হবে না। এই জন্যই এতকাল নিউটনের ফরমুলায় কিছুই অসুবিধা হয়নি। কিন্তু যখন বস্তুগুলো ভারি ভারি এবং/অথবা তাদের মধ্যে দূরত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক কম—অর্থাৎ, ব্রহ্মাণ্ডের শামিয়ানা যেখানে ঘন ঘন বা অনেক বেশি তুবড়ে যাচ্ছে, সেই সব জায়গায় নিউটনের সূত্র ধরে কাজ করলে ভুলের পরিমাণ বেড়ে যাবে। তখন আইনস্টাইনের সূত্র ব্যবহার বাধ্যতামূলক।

দুটো উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
একটা বুধ গ্রহের চলন সম্পর্কিত গণনা। পাঠকরা অনেকেই হয়ত জানেন যে গ্রহগুলো যখন সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে, তখন একেবারে নিখুঁতভাবে নিজ অক্ষের চারধারে ঘুরে ঘুরে চলে না, একটু নেচে নেচে চলে, মাথাটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চলে। এই ঘোরানোর একটা হিসাব বিজ্ঞানীরা করতে পারেন। করেও থাকেন। অন্য গ্রহগুলোর ক্ষেত্রে নিউটনের ফরমুলা ধরে গণনা করে দেখা গিয়েছিল, পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তাত্ত্বিক গণনার খুব একটা তারতম্য হয় না। দিব্যি মিলে যায়। কিন্তু বাধ সাধল বুধ গ্রহ। তার বেলায় হিসাব কিছুতেই বিজ্ঞানীদের খুশি করার মতো নিখুঁত হচ্ছিল না। পর্যবেক্ষিত হিসাবের থেকে ফাঁক অনেকটাই বেশি হয়ে যাচ্ছিল। কেন মিলছিল না, তার কারণও সঠিকভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। এইবার আইনস্টাইনের তত্ত্ব প্রয়োগ করে যে হিসাব পাওয়া গেল, তা কিন্তু পর্যবেক্ষণের সঙ্গে খুব সুন্দরভাবে মিলে গেল। আর উপরি লাভ হল, আগের হিসাবের গণ্ডগোলের কারণও বোঝা গেল। বুধ সূর্যের সব চাইতে কাছের গ্রহ। সূর্যের তুলনায় বুধের ভর অত্যন্ত কম হলেও নৈকট্যের কারণে মহাকর্ষের সক্রিয়তা (অর্থাৎ, দেশ-কালের বক্রতা জনিত আঁকাবাঁকা ভ্রমণ)-ও খুবই বেশি। ফলে নিউটনের তত্ত্ব অনুযায়ী বুধ আর সূর্যের মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বল ধরে যে হিসাব পাওয়া যায়, তাতে এই বাড়তি ঝঞ্ঝাটের অঙ্কটা ঢোকে না বা ঢোকানো যায় না। এই হল গিয়ে না মেলার সেই রহস্য। এতে বোঝা গেল, আইনস্টাইনের জটিল অঙ্কটা বিজ্ঞানের স্বার্থে একটা যথার্থ প্রয়োজনীয় অগ্রগতি।



দ্বিতীয়টা ঘটনাটি নানা কারণে আরও চমকপ্রদ। শোনা যায় ১৮০৪ সাল নাগাদ একজন জার্মান বিজ্ঞানী, জোহান গেওর্গ ফন সোল্ডনার, বলেছিলেন, বড় এবং ভারি বস্তুর মহাকর্ষের প্রভাবে আলোর পথও বেঁকে যেতে পারে। আইনস্টাইনের ভর-শক্তি তুল্যাঙ্ক সূত্র আবিষ্কারের পর নিউটনের সূত্র প্রয়োগ করে সোল্ডনারের বক্তব্য অনুযায়ী হিসাব করে দেখা যায়, কতটা বাঁকতে পারে।. [Soldner 1804; Vladimirov et al. 1987, 69; & Narlikar 1980, 157] আইনস্টাইনও বলে বসলেন, দূরবর্তী তারার আলো সূর্যের পাশ দিয়ে আসার সময় দেশ-কালের বক্রতার কারণে বেঁকে যায়। কোন তারার আলো কতটা বেঁকে যেতে পারে, তাঁর তত্ত্ব

থেকে সেটা বের করাও গেল। এবার একটা সুযোগের অপেক্ষা। মেপে দেখতে হবে কোন হিসাবটা ঠিক। সুযোগ এসে গেল তিন বছরের মধ্যেই। ১৯১৯ সালের ২৯ মে। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। দেখা যাবে দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে। সেই সময় সূর্যের কাছাকাছি কোণে থাকবে এমন একটি তারাপুঞ্জ হায়াড-নক্ষত্র থেকে আসা আলোকে দিনের বেলায় গ্রহণের সময় একবার, আর ছমাস আগে বা পরে রাতের আকাশ দেখে আর একবার ছবি তুলে রাখলেই পরে মেপে দেখা যাবে, ওই দিন দিনের বেলায় সে কতটা বেঁকে গিয়েছিল। অতএব, চল . . . না, দিল্লি নয়, পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ!

তবে জার্মানির তখন ভিখিরির দশা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে গিয়ে জয়ী মিত্রশক্তির কাছে যুদ্ধপণ দিতে দিতে তার অর্থনীতির তখন নাভিশ্বাস উঠেছে। এরকম কোনো বৈজ্ঞানিক অভিযানে ঢালবার মতো অঢেল পয়সা তার নেই। তাতে কী হল? যুদ্ধের পরম শত্রু দেশ ইংল্যান্ড থেকে উদ্যোগ নিলেন আর্থার এডিংটন (বিজ্ঞানীদের দেশাত্মবোধ আবার বেশ কম। নিজের দেশের জন্য যুদ্ধ করলেও শ্ত্রু দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি ভীষণ টান থাকে তাঁদের। আর সত্যের প্রতি প্রেম তো ভয়ানক রকম বেশি)। রয়াল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল সোসাইটিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে তিনি দুটি পর্যবেক্ষক টিম গঠন করলেন। একটা দল গেল ব্রাজিলে। আর একটা দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে একটা দ্বীপে। ছবি তুলে আনলেন তাঁরা। ছমাস পরে আবার ছবি তোলা হল। অঙ্ক কষে হিসাব করে দেখা গেল, তাঁদের পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত হিসাব নিউটনীয় গণনা থেকে প্রাপ্ত চ্যুতির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ; আর, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তাত্ত্বিক গণনার সাথে প্রায় মিলে যাচ্ছে (চিত্র নং ১৩ দ্রষ্টব্য)।
সেই থেকেই হুলুস্থুলু কাণ্ড!

এখানে সোল্ডনারের কথা কীভাবে জানা গিয়েছিল সেই ব্যাপারে একটা মজার ঘটনা উল্লেখ করে যাওয়া দরকার। আইনস্টাইন মহাকর্ষ ক্ষেত্রে আলোকের বেঁকে যাওয়ার এই সম্ভাবনার কথা প্রথম বলেন ১৯১১ সালে, নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব ও তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভিত্তিতে। পরে ১৯১৬ সালে তিনি এই হিসাব সংশোধন করেন। এর কিছুদিন পরে জার্মানির আর একজন প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী, ফিলিপ লেনার্ড, আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে ১৯২১ সালের একটি বিজ্ঞানপত্রে অভিযোগ করেন, তিনি নাকি সোল্ডনারের কাজ চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন।

পরবর্তীকালে যাঁরা এই অভিযোগ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন, আইনস্টাইনের পক্ষে সোল্ডনারের কাজের কথা জানা না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। দ্বিতীয়ত, আলোকের বেঁকে যাওয়ার প্রসঙ্গটি বাদ দিলে আইনস্টাইনের মূল তত্ত্ব ও তার প্রয়োগের সঙ্গে সেই কাজের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং, বড় জোর একে একটা অনিচ্ছাকৃত বা অজ্ঞতাপ্রসূত অনুল্লেখ বলে অভিহিত করা যেতে পারে, ধারণা বা যুক্তি চুরির কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

লেনার্ডেরও একথা না বোঝার কথা নয়। আসলে তিনি প্রচণ্ড ইহুদি বিদ্বেষে ভুগতেন বলে আইনস্টাইনের খ্যাতির দীপ্তি সহ্য করতে পারছিলেন না। সেই বিদ্বেষ থেকেই এরকম একটি অন্যায় অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে লেনার্ড অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে হিটলারের নাৎসি দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আইনস্টাইনকে জার্মানি থেকে বিতাড়নের ক্ষেত্রে প্রধান পাণ্ডা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

মহাকর্ষীয় তরঙ্গ

তবে সেটাও শেষ নয়। এই সেদিন, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সারা পৃথিবীতে একটা খবর আবার নতুন করে তুমুল উত্তেজনা ছড়াল। শোনা গেল, আইনস্টাইন বলে যাওয়ার একশ বছর পরে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণগহ্বর থেকে আগত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। আইনস্টাইনের এরকম একটা ভবিষদ্বাণী এতদিনে সঠিক প্রমাণিত হল।

স্বভাবতই হইচই শুরু হয়ে গেছে খবরটা নিয়ে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব কী এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যা এই সেদিন নিশ্চিতভাবে পর্যবেক্ষণের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেল? প্রশ্নটা বিভিন্ন গণ-মাধ্যমে খানিকটা ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে; উত্তরটাও তার ফলে ভুল বা নিদেন পক্ষে অপর্যাপ্ত হতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে, কৃষ্ণগহ্বর জাতীয় কোনো কিছুর কথা আইনস্টাইন বলেননি বা এমনকি ভাবেনওনি। তিনি যা বলেছিলেন তা হল: ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ থেকে যেমন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের হদিশ পাওয়া যায়, সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে তেমনই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব ও অঙ্কের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ মানে যেমন তড়িচ্চুম্বক ক্ষেত্রের এক বিন্দু থেকে দূরস্থিত অপর কোনো বিন্দুতে একটা আলোড়নের ছড়িয়ে পড়া, মহাকর্ষের ঢেউ মানেও তেমনই দেশ-কাল চতুর্মাত্রিক জ্যামিতিতে কোনো বিন্দুতে ওঠা একটা ওঠানামা তার আশেপাশের বিন্দুগুলিতে ছড়িয়ে পড়া। এই দেশ-কাল জ্যামিতির ওঠানামা কখন ঘটে? যখন কোনো একটা ভারি বস্তু (যে কোনো কারণেই হোক) দ্রুত স্থান বদল করে। এই স্থান বদলের ফলে সেখানে সেই সংশ্লিষ্ট বস্তুর কিছু না কিছু শক্তিক্ষয় ঘটবে যা আবার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ রূপে ছড়িয়ে পড়বে। তখন সেই সব জ্যোতিষ্ক থেকে আসা আলোক তরঙ্গগুলির উপরেও তার কিছু না কিছু প্রভাব পড়বে। যদি কোনো একটা আলোকিত বস্তু থেকে নির্গত আলোকের এই রকম কিছু প্রত্যাশিত পরিবর্তন পৃথিবীতে বসে দেখা যায়, তাহলে অঙ্ক কষে হয়ত বোঝা যাবে, সেই আলোক প্রদানকারী বস্তুটির কাছে থাকা অন্য আর একটি ভারি বস্তু দ্রুত স্থান পরিবর্তন করার ফলে তারা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উৎপাদন করে চলেছে। (আসলে বলতে হবে, চলেছিল। যা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, তা আসলে লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি বছর আগেকার ঘটনা।)

আর একটা ঘটনার কথা এখন অনেকেই হয়ত ভুলে গেছেন। ১৯৭০-এর দশকে আমেরিকান জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী, জোসেফ টেলর এবং তাঁর ছাত্র রাশেল হাল্‌স, দুটো পরস্পর যুগ্মভাবে ঘুর্ণায়মান নিউট্রন তারাকে দেখে তাদের মধ্যে একটার (যেটা ছিল আদতে একটি পালসার) থেকে নির্গত আলোর ঝলকের (খুব সামান্য হলেও) সময়ান্তর লক্ষ করেন। তার ভিত্তিতে তখন তাঁরা সেই পালসারের আবর্তনকাল নির্ণয় করে ফেলেন। তারপর তাঁদের চোখে পড়ে, সেই আবর্তন কাল ধীরে ধীরে কমে আসছে। তাঁরা অনুমান করেন, পালসারটি ঘুরতে ঘুরতে শক্তি হারিয়ে অপর নিউট্রন তারাটির দিকে গড়িয়ে পড়ছে। এই শক্তি হ্রাসের পরিমাণ হিসাব কষে তাদের থেকে উৎপন্ন মহাকর্ষের তরঙ্গ সম্পর্কে একটা পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। কেন না, এই শক্তিই আসলে এদের পারস্পরিক স্থান বদলের চতুর্মাত্রিক জ্যামিতিক আলোড়ন হিসাবে, অর্থাৎ, মহাকর্ষীয় তরঙ্গরূপে ছড়িয়ে পড়ছে। সেই দুজন বিজ্ঞানী সেটা দেখে ও দেখিয়ে (এবং আরও অনেক কিছু বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম করে) তার সুবাদে ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। [পাল ২০১১, ১৩৩-৩৬]

এবারকার ঘটনা কিন্তু সেই তুলনায় আরও অনেক বেশি চমকপ্রদ এবং নাটকীয়! এবারে আর নিছক আলোক সঙ্কেত নয়, সরাসরি দুটো কৃষ্ণগহ্বরের পারস্পরিক দ্রুত স্থান বদলের ফলে চতুর্মাত্রিক দেশ-কাল জ্যামিতিতে সেই অনুযায়ী দ্রুত ওঠানামার কম্পনই পৃথিবীর বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, আইনস্টাইনের দেশ-কাল বিষয়ক তত্ত্বটি আরও গভীরভাবে, আরও প্রত্যক্ষভাবে সত্য প্রমাণিত হল। ১৩০ কোটি বছর আগের ঘটনা এটা, যা বিজ্ঞানীরা এখন দেখতে পেলেন। দুটি কৃষ্ণগহ্বর, সূর্যের তুলনায় একটি ২৯ গুণ, আরেকটি ৩৬ গুন ভারি, যারা একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘুরছিল, তারাই নাকি এক সময় ঘুরতে ঘুরতে একজন আর একজনের ঘাড়ে এসে পড়ে এবং ধীরে ধীরে পরস্পর মিলে যায়। কিন্তু মজা হচ্ছে, তখন তাদের মিলিত ভর দাঁড়াল কত জানেন? ৬২ খানা সূর্য-সমান। অর্থাৎ, তিন সূর্য সমান ভর পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী শক্তিতে পরিণত হল। সে তো আর চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকবে না। সেই শক্তিই মহাকর্ষ তরঙ্গের আকারে আলোকের গতিবেগে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। চলতে চলতে আমাদের এই পৃথিবীতে সেই ঢেউ এসে পৌঁছল ১৩০ কোটি বছর বাদে এত দিনে (চিত্র নং ১৪ দ্রষ্টব্য)।

হ্যাঁ, আর সেই ঢেউ এল কিন্তু দেশ-কালের চার-মাত্রা জ্যামিতিতে ক্রমাগত মোচড় দিতে দিতে। পৃথিবীর বুকেও এই মোচড়ের অনুভূতি হল। ধরাও পড়ল। কেন না, বিজ্ঞানীরা এর জন্য খানিকটা প্রস্তুত ছিলেন। শিকারীদের বহু গুণ বেশি ধৈর্য নিয়ে। তাঁরা জানতেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আসা মানে তার একটা অন্যতম লক্ষণ হবে দৈর্ঘ্যের মাপ পরিবর্তন। তা সে যত সামান্যই হোক না কেন। কিন্তু তাকে কী দিয়ে মেপে ধরা হবে? সেই সময় ধারে কাছে যে কোনো বস্তু, যাকে দিয়েই মাপা হবে, সেও তো একইভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তার মানে যেমন-তেমন স্কেল দিয়ে মেপে বোঝা যাবে না। সুতরাং আবার সেই আলোকের শরণাপন্ন হলেন তাঁরা। তার গতিবেগ যে কোনো নির্দেশাক্ষ বরাবর যে কোনো দিকেই ধ্রুবক। অতএব, আলোকের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে যে সময় লাগছে তা অনবরত মাপা হতে থাকলে, কোনো সময়ে যদি দেখা যায়, একই দূরত্ব যেতে বেশি বা কম সময় লাগল, বোঝা যাবে, আপেক্ষিকতার অর্থে দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ ধরনের গবেষণাগার তৈরি করা হয়েছে এর জন্য। জার্মানিতে এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে। মাটির তলায় গর্ত করে ইংরেজি ‘এল’-আকৃতির দুটো করে ৪ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গগুলির মধ্যে লেজার রশ্মি চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাদের আসা-যাওয়ার সময় বছরের পর বছর ঘড়ি ধরে মেপে যাওয়া হচ্ছে।



সুড়ঙ্গগুলি ‘এল’-আকৃতি কেন?
মনে রাখতে হবে, মহাকর্ষীয় অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ আসছে চতুর্মাত্রিক পথ ধরে। আমরা জানি, ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিতে অনুদৈর্ঘ্যের কম্পন (ওঠাপড়া) হয় এক মাত্রায় (উল্লম্ব দিকে), আর তরঙ্গগতির অভিমুখ থাকে অন্য মাত্রায় (অনুভূমিক দৈর্ঘ্য বরাবর)। এই চতুর্মাত্রিক তরঙ্গগতির ক্ষেত্রে কম্পন হয় দেশ-এর দুই মাত্রায় আর তরঙ্গের গতির অভিমুখ থাকে দেশ-এর তৃতীয় মাত্রা বরাবর। কম্পনের এই বৈশিষ্ট্যের ফলে দেশের এক মাত্রায় প্রসারণ হলে অন্য মাত্রায় সঙ্কোচন হয়; আবার পরক্ষণেই প্রথম ক্ষেত্রে সঙ্কোচন হয়ে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রসারণ ঘটে। এইভাবেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের বিস্তার হতে থাকে। এই কথা মাথায় রেখেই ‘এল’-আকৃতির সুড়ঙ্গ বানানো হয়েছিল। একদিকে প্রসারণ (অর্থাৎ, আলোর যাতায়াতে সময় বেশি লাগছে) দেখলে অন্য সুড়ঙ্গ বরাবর সঙ্কোচন (অর্থাৎ, আলোর সময় কম লাগছে) দেখা যাবে। এই দুটো হিসাবের মধ্যেও এমন একটা সূক্ষ্ম সঙ্গতি থাকা দরকার যাতে বোঝা যায়, অন্য কোনো উপদ্রব এসে মাপের তরতম ঘটায়নি। যা ঘটেছে তার জন্য আপেক্ষিকতার ক্রিয়াই দায়ী।

এইভাবে চলতে চলতে গত ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার সুড়ঙ্গে প্রথম এই প্রসারণ ও সঙ্কোচন জনিত দৈর্ঘ্য পরিবর্তনের হদিশ পান বিজ্ঞানীরা। মনে হল যেন, আলো দুদিকের যাতায়াতে দুরকম সময় নিল। তখন থেকে মাপজোক করতে শুরু করে তাঁরা এই সেদিন নিশ্চিত হলেন, হ্যাঁ, ওরা এসেছিল। ঠিক যেমনটি ভেবেছিলেন সেই ঝাঁকড়া চুলওয়ালা বিজ্ঞানী তাঁর অদ্ভুত সমস্ত জটিল অঙ্কের সাহায্যে। নিশ্চিত হওয়া গেল, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দেশ-কাল চতুর্মাত্রিক জ্যামিতি অবলম্বন করে সমস্ত বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে।

কালে কালে আরও কত কী দেখতে পাব কে জানে!! আপাতত, আমাদের এই গল্পও ফুরচ্ছে না, নটে গাছকেও এক্ষুনি মুড়তে দেওয়া যাচ্ছে না!!! ◙

গ্রন্থপঞ্জি

পাল, পলাশ বরন (২০১১), আইনস্টাইনের উত্তরাধিকার; বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা।
রায়, দ্বিজেশ চন্দ্র (২০০৫), অ্যালবার্ট আইনস্টাইন; বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা।

Einstein, Albert (1916), “The foundation of the general theory of relativity” (in German); Annalen der Physik, 49 (1916).
Einstein, Albert and Infeld, Leopold (1938), The Evolution of Physics; Cambridge University Press, Cambridge.
Einstein Albert (1954), Relativity: the special and the general theory; Methuen & Co., London.
Mukhopadhyay, Ashoke (2009), The Science and Philosophy of Einstein’s Theory of Relativity; Bodhoday Mancha, Kolkata.
Narlikar, Jayant V. (1980), The Structure of the Universe; Oxford University Press.
Soldner, J. G. v. (1804), “On the deflection of a light ray from its rectilinear motion, by the attraction of a celestial body at which it nearly passes by”; Berliner Astronomisches Jahrbuch 1804.
Vladimirov, Yu; Mitskievich, N and Horsky, J. (1987), Space Time Gravitation; Mir Publishers, Moscow.
আপেক্ষিকতার গল্প দ্বিতীয় পর্ব: সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ





Saturday, May 14, 2016

আপেক্ষিকতাবাদের কাহিনি; পর্ব – এক: বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ

আপেক্ষিকতাবাদের কাহিনি; পর্ব – এক: বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ


১৯১৬ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের আবিষ্কার সংক্রান্ত বিজ্ঞানপত্রটি দুনিয়ার সামনে প্রকাশিত হয়। এই বছর সেই দুনিয়া কাঁপানো আবিষ্কারের একশ বছর পূর্তি উদযাপিত হচ্ছে বিশ্বের নানা জায়গায় নানা ভাবে। সেই উপলক্ষে আমি এখানে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের দুই পর্ব সংক্ষেপে সকলের বোধগম্য ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করব। প্রথম পর্বে আলোচনা করা হবে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। পরের বার সাধারণ আপেক্ষিকতা।
আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বললেই সকলের মনে ভেসে আসে এরকম একটা সর্বত্র প্রচলিত কথা: “দুনিয়ার সব কিছুই আপেক্ষিক।” স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইনকেও যখন কেউ প্রশ্ন করতেন, “আপনি কি দু এক কথায় আপেক্ষিকতার মূল ধারণাটা আমাদের বুঝিয়ে দিতে পারবেন?” আইনস্টাইন তাঁদের খুশি করার জন্য বলতেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারব। এই ধরুন, আপনি আপনার প্রেমিকার জন্য কাফেয় একলা বসে অপেক্ষা করছেন, তাঁরও আসতে কোনো কারণে হয়ত দেরি হচ্ছে; তখন আপনার মনে হচ্ছে, সময় যেন আর কাটতেই চায় না। আর যেই তিনি এসে গেলেন, আপনাদের গল্পটল্প শুরু হল, আপনার খালি মনে হবে, সময় কী তাড়াতাড়িই না বয়ে যাচ্ছে।” অনেকে এইভাবেও বলে থাকেন, “ধরা যাক, আপনি আর আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। আপনার যেদিকটা ডান দিক, আমার ডান দিক সেদিকে নয়। আমার সেটা হল বাঁ দিক। আর আমার যেটা ডান দিক, আপনার জন্য সেদিকটাই হবে বাঁ দিক। সামনে বা পেছনে, উপরে বা নীচে—সেও এইভাবেই আপেক্ষিক, এক এক জনের জন্য এক এক রকম। এই অর্থে সব কিছুই আপেক্ষিক, কোনো কিছুই পরম বা শাশ্বত নয়, সকলের জন্য বা চিরকালের জন্য সত্য নয় . . .।” কিংবা, আপনি হয়ত পছন্দ করেন লাল রঙের গোলাপ ফুল; আর আমার আবার ভীষণ পছন্দ নীল অপরাজিতা। এইসব পছন্দ অপছন্দও আপেক্ষিক কিনা! ইত্যাদি।
একটু মন দিয়ে ভাবলে সকলেই বুঝবেন, এই জাতীয় কথার সঙ্গে আপেক্ষিকতার আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণার কোনো সম্পর্ক নেই। থাকার কথা নয়। উপরের কথাগুলো ভুল নয়। কিন্তু তা বুঝবার জন্য মানবজাতিকে আইনস্টাইন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, তাঁর আগে পর্যন্ত কেউ, এমনকি নিউটনও এসব জিনিস বুঝতে পারেননি, ভাবলে মানুষের বোধবুদ্ধির মাত্রাকে খুবই খারাপ চোখে দেখতে হয়। আইনস্টাইন যে জাতীয় আপেক্ষিকতার সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, তা এর চাইতে সামান্য কিছুটা কঠিন!
এবং সত্যি কথা বলতে গেলে, পদার্থবিজ্ঞানে আপেক্ষিকতার বিষয়টা এরকম কোনো গল্পকথার বিষয় নয়, কোনো কল্প কাহিনিও নয়, একেবারে বাস্তব প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু এই বিষয়টিকে বোঝার চাইতে না বোঝার বা ভুল বোঝার কাহিনি এত বেশি যে মাঝে মাঝেই আমাদের মুখ দিয়ে গল্প শব্দটি বেরিয়ে পড়ে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, এমনকি শুধু সাহিত্যিক বা সাংবাদিকরাও নয়, বহু বিজ্ঞানীও আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে বোঝাতে গিয়ে এমন সব কথা বলেছেন যার সাথে আসলে এই তত্ত্বের কোনো সম্পর্কই নেই। আর এই কারণে অধিকাংশ লোকপ্রিয় লেখক এই বিষয়ে লিখবার সময় দাবি করেছেন, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নাকি বিজ্ঞানের একটি ভীষণ দুরূহ জিনিস। একে বুঝে ওঠা সকলের কম্ম নয়! এও শোনা যায়, উনিশশ তিরিশের দশকে ইংল্যান্ডে আর্থার স্ট্যানলি এডিংটনকে তাঁর এক ছাত্র এসে বলেন, “স্যর, অনেকে বলছে, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নাকি পৃথিবীতে তিনজন মাত্র বিজ্ঞানী বোঝেন?” এডিংটন সঙ্গে সঙ্গে জানতে চান, “হুঁ, তাই নাকি? তা তোমার এই তৃতীয় ব্যক্তিটি কে বৎস?” [Cited, Kuznetsov 1965, 207-08]
অনেক বছর বাদে, ১৯৬৭ সালে রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর এক রচনায় অবশ্য আর একটু বেশি লোকজনকে তত্ত্বটি বোঝার অনুমোদন দেন। বলেন যে বিজ্ঞানীদের মধ্যে জন বারো এটা বুঝতে পেরেছেন। [Feynman 1992, 129]
এই শুচিবাইয়ের অবশ্য একটা কারণ আছে।
বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের বক্তব্য কাউকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে দেখলে দুঃখ পান। পাওয়ারই কথা। তার ফলে কিছু কিছু পদার্থবিজ্ঞানী লোকপ্রিয় ভাষ্যের খুব বিরোধী হয়ে থাকেন। আবদুস সালাম নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর ইলেকট্রো-উইক ক্ষেত্রতত্ত্ব কেন্দ্রিক গবেষণার বিষয় নিয়ে আমি একবার একটা সহজভাষ্য মূলক প্রবন্ধ লিখে ১৯৭৮ সালে (তখনকার) প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। যাতে খুঁটিনাটি বিষয়ে কোনো ভুল থাকলে তা সংশোধন করে নেওয়া যায়। প্রফেসর রায়চৌধুরী প্রবল আপত্তি নিয়ে পৃষ্ঠা চারেক মাত্র দেখে দেন। তাঁর মতে, “বিজ্ঞানকে লোকপ্রিয় করা যায় না। তুমি হয় বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে পার, অথবা লোকপ্রিয় প্রবন্ধ রচনা করতে পার। লোকপ্রিয় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখতে পারবে না।”
এত সব কথা বলবার উদ্দেশ্য একটাই। বিজ্ঞানীদের শুচিবাইকে সম্মান জানিয়ে একটা সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে রাখা। আমার এই নিবন্ধটিও একটি লোকপ্রিয় রচনা। এতেও অতএব ভুল ধারণা ঢুকে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যাঁরা পড়বেন, তাঁরা সাবধান থাকবেন, সম্ভব হলে অন্য উৎস থেকে যাচাই করে নেবেন।

গোড়ার কথা

আমরা শুরু করব সেই সরল জায়গা থেকে যেখানে বৈজ্ঞানিক ধারণা হিসাবে সমস্যাটার প্রথম জন্ম হয়েছিল।
আরিস্ততল। প্লাতোর ছাত্র। দার্শনিক। নৈয়ামিক তর্কশাস্ত্র (formal logic)-এর জন্মদাতা। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিস দেশের এই সুপণ্ডিত মনীষী বৈজ্ঞানিক প্রণালীবদ্ধ জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়ার সূত্রপাত করেছিলেন। বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বহু শাখার নামকরণও তাঁর হাত দিয়েই হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানেরও। তিনিই প্রথম বস্তুর গতির সমস্যা, বল প্রয়োগের সাথে তার সম্পর্ক—ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটা সূত্রবদ্ধ ধারণা দেবার চেষ্টা করেছিলেন।
আমাদের মনে অনেক এরকম প্রশ্ন ওঠে; অন্তত সেই কালে উঠত: ধনুকের তির কখন ভীম বেগে ধেয়ে যায়? বল্লম জোরে ছুঁড়বার উপায় কী? এই ভারি প্রস্তরখণ্ডকে কীভাবে দূরে সরানো যাবে? গরুর গাড়ি কখন চলতে শুরু করে? নদী থেকে জল বয়ে আনব কী করে? নৌকা কেন চলে? এমনকি স্রোতের বিপরীতেও?
আরিস্ততল বললেন, এই সবের পেছনে আসলে একটাই মূল প্রশ্ন: অচল বস্তু কেন বা কীভাবে গতিশীল হয়? আসুন, ভাবনাচিন্তা করে তার উত্তর খোঁজা যাক। সেই উত্তর হল: যে কোনো স্থির বস্তুকে গতিশীল করতে হলে তার উপরে বল প্রয়োগ করতে হবে। ঠেলা, ধাক্কা, টানা, তোলা, হ্যাঁচকা-টান, গুঁতো, খোঁচা, কাটা, মারপিট—এই জাতীয় সব কাজই সেই বল প্রয়োগের বিচিত্র উদাহরণ। বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করলেই স্থির বস্তু চলতে শুরু করবে। যত বেশি বল প্রয়োগ করবেন, তত জোরে সে চলবে, তত দূরে সে চলে যাবে। বল দেওয়া বন্ধ করলেই সে ধীরে ধীরে থেমে যাবে।
মনে রাখবেন, বিজ্ঞানে সাধারণীকৃত সংজ্ঞার আকারে বল সম্পর্কে এই ধারণাটি আরিস্ততলের একটি অক্ষয় মূল্যবান অবদান।
পরবর্তী প্রায় দু হাজার বছর যাবত মানব জাতি এই কথাটাকে ধরে গতির রহস্য বুঝেছিল: বাহ্যিক বলই গতির সৃষ্টি করে। গতি মানেই তা সেই দৃষ্ট বস্তুর প্রকৃত গতি। বা পরম গতি। সেকালে অবশ্য এই গতি পরম না আপেক্ষিক তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি। ধরেই নিয়েছেন পরম বলে। আর তাতে অসুবিধাও কিছুই হয়নি। মানুষের দৈনন্দিন কাজ এতেই দিব্যি চলে গেছে। ধনুকের ছিলা যত শক্তিশালী হবে, তত জোরে শর নিক্ষেপ করা যাবে। গরুকে বেশি করে খড় খেতে দাও, তবেই না সে গাড়িটাকে ভালোভাবে টানতে পারবে। নদী থেকে জল আনতে যাচ্ছ, আচ্ছা যাও; তবে বেশি বড় বালতি বা কলসি নিও না। বয়ে আনতে কষ্ট হবে। খুঁটিটাকে মাটিতে আরও ঢোকানোর জন্য হাতুড়ি দিয়ে জোরে ঘাই মারো। ইত্যাদি।
শুধু তাই নয়, এই যে পৃথিবীর চার দিকে সূর্য চন্দ্র অন্যান্য গ্রহ এবং তারাগুলো ঘুরছে, তারাই বা এই ঘুরবার গতি পেল কোথায়? তারও উত্তর দিয়ে গেলেন এই বহুদর্শী দার্শনিক। একটা খুব সহজ উত্তর। ওরা থামবে কী করে? ঈশ্বর ওদের চালিয়ে দিচ্ছেন বল প্রয়োগ করে। প্রথম থেকেই। তিনিই এই বিশ্ব সংসারের প্রধান চালক (Prime Mover)। অবশ্য তখন ব্রহ্মাণ্ডের যেটুকু মানুষ জানতে পেরেছিল তাতে ভগবানের খুব বেশি খাটালি ছিল না এই জগতকে চলমান রাখতে। কটাই বা আর গ্রহ নক্ষত্রকে সেকালে চালাতে হত? দশ বিশটার বেশি তো নয়! তাই কখনও খুব একটা কারোর এতটুকুও সন্দেহ হয়নি এই সুশৃঙ্খল জগত-ব্যাপারে। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব নিশ্চিন্ত মনে এই ধারণাকে তাদের চিন্তাকাঠামোয় ঢুকিয়ে নিয়েছিল। এর ভিত্তিতেই প্রথম শতাব্দে ক্লদিউস তলেমি তাঁর ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের রূপ দান করে ফেলেন। আর দ্বাদশ শতকে সন্ত তমাস আকুইনাস বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রধান চালকের এই ধারণাকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে একটি প্রধান যুক্তি হিসাবে স্থাপন করে যান!
কিন্তু “চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়”—কবি ঠিকই বলেছেন। এই সুখের সংসারে বাধ সাধলেন কোপারনিকাস। ১৫৪৩ সালে তাঁর প্রকাশিত ও লাতিন ভাষায় লিখিত “খ-গোলকদের আবর্তন প্রসঙ্গে” (De Revolutionibus Orbium Coelestium) বইতে নানা রকম অঙ্ক কষে নকশা এঁকে তিনি দাবি করে বসলেন, পৃথিবী সহ গ্রহগুলি সূর্যের চারদিকে ঘোরে, আমরা খালি চোখে যা দেখি বলে ভাবি, তা সত্য নয়। সেই প্রথম আরিস্ততলের গতিতত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠল। তার মানে, আমরা প্রতিদিন সূর্যকে যে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে দেখছি, তা সত্য নয়? বছর শেষে সূর্যকে যে ডান দিক বাঁ দিক করে শেষে একই জায়গায় ফিরে আসতে দেখি, তাও বুঝি মিথ্যা? বাস্তবে পৃথিবী ঘুরছে বলেই আমরা সূর্যকে ঘুরতে দেখি। এটা তাহলে তার সত্যিকারের গতি নয়, আপাত গতি। আপেক্ষিক গতি।
প্রথম প্রথম প্রচুর আপত্তি ছিল মানুষের। সমকালীন জ্ঞানীগুণীদেরও অনেকেই মানতে চাননি। তারপর এলেন গ্যালিলেও গ্যালিলেই (ব্রুনোর কথাটা এখানে খুব বেশি প্রয়োজন নেই বলে তুললাম না)। গতির ব্যাপারটাকে খোলসা করে তুলতে অনেক গবেষণা, অনেক পরিশ্রম করলেন। দেখালেন, কোনো বস্তুর তথাকথিত প্রকৃত গতি যে কী জিনিস তা আমরা কখনই জানতে পারব না। আমরা শুধু একটা বস্তুর সাপেক্ষে অন্য বস্তুর গতির কথাই বলতে পারি। তুলনামূলক বা আপেক্ষিক গতির কথাই জানা যায়। পরম গতি আছে কি নেই জানি না, থাকলেও তা জানবার কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। বরং এই আপেক্ষিক গতিকেই বস্তুর প্রকৃত গতি হিসাবে মেনে নেওয়া ভালো।
সাধারণ মানুষকে বোঝাবার জন্য তিনি এক চমৎকার গল্পই ফেঁদে বসলেন। মনে কর, তুমি কোনো দিন শান্ত সমুদ্রে এক জাহাজের ভেতর বসে আছ। বাইরের তটভূমি বা আকাশের গ্রহ নক্ষত্র কিছুই দেখতে পাচ্ছ না। এই অবস্থায় মনে মনে জাহাজের মাস্তুলের ডগাটার দিকে তাকিয়ে বল তো, জাহাজ চলছে না থেমে আছে? বুঝতে পারছ তো, এটা বলা শুধু তোমার পক্ষে নয়, কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, হাতে একটা বল নিয়ে জাহাজে বসেই উপরে ছুঁড়ে দাও। দেখ, সেটা তোমার হাতেই পড়ছে। সেই জাহাজে বসে তুমি যা কিছু করবে, তীরের সাপেক্ষে থেমে থাকলে যা হবে, যা দেখবে, জাহাজ একই গতিবেগে চলতে থাকলেও একই জিনিস ঘটতে দেখা যাবে। (প্রিয় পাঠক! এই কথাটা কিন্তু খুব জরুরি! স্মৃতিতে ধরে রাখুন। পরেও বারবার প্রয়োজন পড়বে!)
তার মানে শুধু গতি নয়, স্থিতিও আপেক্ষিক। যে থেমে আছে বলে বলছি, সে একটা কিছুর সাপেক্ষে থেমে আছে। যে চলছে, সেও অন্য কারোর সাপেক্ষে চলছে বলে বোঝা যাবে। এই দুটো অবস্থার মধ্যে বাস্তবত কোনো পার্থক্য নেই।
আইনস্টাইন আরিস্ততলের চিন্তা থেকে গ্যালিলেওর এই উত্তরণ প্রসঙ্গেই বলেছিলেন: “অন্তর্বোধ থেকে প্রাপ্ত যুক্তির পদ্ধতিগত কারণেই গতি সম্পর্কে সেই ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হয়েছিল; এবং তা শত শত বছর ধরে প্রচলিত ছিল। . . . গ্যালিলেও যে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্কের জন্ম দিলেন এবং কাজে লাগালেন তা মানব জাতির বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের ইতিহাসে এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এখান থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হল।” [Einstein and Infeld 1938, 6-7]
নিউটনের প্রথম গতিসূত্রের মধ্যে এই কথাটাকেই আর একটু গম্ভীর চালে বলা হল। বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করা না হলে স্থির বস্তু আপেক্ষিক অর্থে স্থির থাকবে, গতিশীল বস্তু আপেক্ষিক সমবেগে চলতে থাকবে। এভাবেই আমরা বইতে পড়ি সূত্রটাকে। সেখানেও যে আপেক্ষিক শব্দটা আছে সেটা প্রায় খেয়ালই করি না। করলে বুঝতে পারতাম, বলবিদ্যায় আপেক্ষিকতার ধারণাটা আইনস্টাইনেরই প্রথম ব্যবহার নয়। অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞানে ছিল।
শুধু তাই নয়। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল এই ঘটনা যে আমরা লক্ষই করি না, নিউটন আসলে সেই সূত্রে আপেক্ষিক অর্থে স্থির বস্তু আর গতিশীল বস্তুর দুই অবস্থার মধ্যে কোনো তারতম্য করেননি। অর্থাৎ, প্রথম সূত্রকে তিনি এইভাবেও বলতে পারতেন, বলবিদ্যার নিয়মগুলি পরস্পর সমবেগে চলমান সমস্ত নির্দেশাক্ষে একইভাবে প্রযোজ্য। তাতেও কোনো ভুল হত না।
সে কি মশাই? আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, না হয় মেনেই নিলাম, যে বস্তু চলছে বা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—তার দুটো অবস্থাই কারোর না কারোর সাপেক্ষে দেখা হচ্ছে; কিন্তু তাই বলে দু জায়গাতে নিয়মগুলি একই থাকে কী করে?
নিউটন সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। নির্দেশাক্ষ (frame of reference)-এর ধারণা তুলে ধরে (পার্শ্বটীকা-১ দ্রষ্টব্য)। যার সাপেক্ষে তুলনা করে গতির রহস্য বুঝতে চাইছেন তাকেই বলা হচ্ছে নির্দেশাক্ষ। সমুদ্র তীরের সাপেক্ষে জাহাজ থেমে আছে। তীর হচ্ছে এখানে জাহাজের গতি নির্ধারণের নির্দেশাক্ষ। বেশ। এবার জাহাজের মধ্যে আপনি যখন কোনো পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণের কাজ করছেন, জাহাজকেই তার জন্য নির্দেশাক্ষ ধরে নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে হল কি, জাহাজ চলতে শুরু করে দিল। সমুদ্র শান্ত থাকায়, হাওয়ার ধাক্কা নেই বলে, ঢেউ উঠছে না বলে, জাহাজের গতি আপনি বুঝতে পারছেন না। যা যেমন দেখছিলেন বা করছিলেন, দেখে এবং করে যাচ্ছেন।
এর মানে কি জানেন?
এর মানে হল, আপনার কাজের জন্য যে নির্দেশাক্ষ আপনি নিয়েছিলেন, সে আবার সমুদ্র তীরের সাপেক্ষে চলমান। আর আপনি তীরকে নির্দেশাক্ষ ধরলে তার সাপেক্ষে আপনি চলমান এবং জাহাজকে ধরলে তার তুলনায় স্থির। একথার অর্থ দাঁড়াল যে, তীরের নির্দেশাক্ষ সাপেক্ষেই দেখুন, অথবা তার সাপেক্ষে সমবেগে চলমান জাহাজের নির্দেশাক্ষ ধরেই দেখুন, বলবিদ্যার নিয়মগুলি সমানভাবে খাটছে। আপনি (আপেক্ষিক অর্থে) স্থির বা চলমান দুই নির্দেশাক্ষর মধ্যে পার্থক্য দেখতে পাবেন না।
_________________________________________________________________________
পার্শ্বটীকা-১
নির্দেশাক্ষ ধরে কীভাবে নিউটনের এই ধারণাগুলিকে বোঝা যাবে দেখে নিই (চিত্র নং – ১)। যদি একটি নির্দেশাক্ষ (x-y-z) সাপেক্ষে কোনো বস্তু x-অক্ষ বরাবর অনুভূমিক অভিমুখে u সমবেগে গতিশীল হয়, এবং অন্য একটি নির্দেশাক্ষ (X-Y-Z) প্রথম নির্দেশাক্ষের সাপেক্ষে সেই অভিমুখে একই অর্থাৎ, u সমবেগে গতিশীল হয়, তবে দ্বিতীয় নির্দেশাক্ষ সাপেক্ষে সেই বস্তুটির আপেক্ষিক গতি হবে শূন্য = ০। এখন t একক সময় পরে বস্তুটির অবস্থা বোঝানোর জন্য দুই নির্দেশাক্ষে যে স্থানাঙ্কগুলি ব্যবহার করা হবে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে এই রকম:
x' = x-ut,
y' = y,
z' = z,
t' = t.
MM
চিত্র-১
এখানে চতুর্থ স্থানাঙ্ক দিয়ে উভয় নির্দেশাক্ষে সময়ের সমপ্রবাহ বোঝানো হয়েছে। নিউটনীয় বলবিদ্যায় এর কোনো প্রয়োগ ছিল না। কেন না, সমস্ত নির্দেশাক্ষেই সময়ের চলন ছিল একই প্রকার। তবে ১৯০৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানী ফিলিপ ফ্রাঙ্ক যখন এই স্থানাঙ্ক বদলের সম্পর্কগুলিকে গ্যালিলেও পরিপাতন (Galilean Transformation) হিসাবে নামাঙ্কিত করে দেখালেন, তিনি পরবর্তীকালের আপেক্ষিকতার নিয়মের সাথে সাযুজ্য রাখার জন্য এটিকেও জুড়ে দেন।
_________________________________________________________________________
এর থেকে দুটো জিনিস স্পষ্টভাবে বোঝা গেল: এক, পারস্পরিক সমবেগে চলমান নির্দেশাক্ষগুলির মধ্যে আপনি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না। কাউকে বেশি ভালো, কাউকে একটু খারাপ, এ ওর চাইতে সুবিধাজনক—এইভাবে বলতে পারা যাবে না। বলবিদ্যার চোখে তারা সকলেই তুল্যমূল্য। আর দুই, সমবেগে চলমান কোনো বস্তুর প্রকৃত বা পরম বেগ কত বা কেমন তাও আপনি বলতে পারবেন না। আপনি শুধু কোনো বিশেষ একটা নির্দেশাক্ষ ধরে নিয়ে তার সাপেক্ষে সেটি কী আপেক্ষিক বেগ নিয়ে চলছে তা বলতে পারেন। এর বেশি কিছু বলতে গেলেই বিপদে পড়ে যেতে পারেন কিন্তু। বিজ্ঞানীরা এমনিতে যথেষ্ট ভদ্রলোক। কিন্তু আমি দেখেছি, খেয়াল-খুশি মতো, অর্থাৎ, চলতি সাধারণ বুদ্ধির পরামর্শে প্রাকৃতিক নিয়ম-টিয়ম নিয়ে একটুও কচলাকচলি করতে গেলে তাঁরা বেজায় ক্ষেপে যান। আপনাকে তখন ওনারা অর্বাচীন, মূর্খ, মূঢ়, নির্বোধ, পামর, জ্ঞানদ্রোহী, সত্যদ্বেষী, ইত্যাদি অনেক কিছু কড়া কথা বলে দিতে পারেন! অন্তত মনে মনে!!

অথঃ ত্বরণ-রহস্য

নিউটনের গতিসূত্র কিন্তু একটি নয়, তিনটি। আমরা এযাবত একটার কথাই বলেছি। যেটার ধারণা তিনি গ্যালিলেওর থেকে নিয়ে গাণিতিক পরিভাষায় লিখে ফেললেন। এবার দ্বিতীয়টাতে যাওয়া যাক। প্রথম সূত্র থেকে জানা গিয়েছিল, বাইরে থেকে বল প্রয়োগ না করলে বস্তুর অবস্থার পরিবর্তন হয় না। দ্বিতীয় সূত্র থেকে জানা গেল, বল প্রয়োগ করলে ঠিক কী হয়। নিউটনের কথায়, বাহ্যিক বলের ঠেলায় পড়ে বস্তুর আপেক্ষিক বেগের পরিবর্তন হয় (বাড়ে বা কমে, এবং/অথবা, অভিমুখ বদল করে) এবং এই পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক। এই পরিবর্তন শব্দটা খুব জরুরি। এইখানেই যে আরিস্ততলের থেকে আধুনিক বলবিদ্যার ধ্যান-ধারণা আলাদা হয়ে গিয়েছিল তা অনেকে ধরতেই পারেননি। আরিস্ততল মনে করতেন, বল প্রয়োগ করলে গতির সৃষ্টি হয়; আর গ্যালিলেওকে অনুসরণ করে নিউটন জানালেন, “না দাদা, বল প্রয়োগ করলে গতিবেগের পরিবর্তন হয়। গতি সৃষ্টি করার আপনি আমি কেউ নই। দুনিয়া এমনিতেই গতিময় হয়ে আছে। আমরা শুধু এখানে ওখানে এর বদল করতেই পারি। কমাতে বা বাড়াতে পারি। তাও যেগুলো হাতের সামনে রয়েছে।”
যাঁরা গাড়ি চালাতে জানেন, হয়ত ঝপ করে বলে বসবেন, “কেন মশাই, আমরা কি ব্রেক কষে গাড়ি থামাই না? আমরা কি রাস্তা ফাঁকা পেলে এবং তাড়া থাকলে গাড়ির গতিবেগ বাড়াই না? গিয়ারের কাজই তো হল গিয়ে . . ., যাক গে, ওসব বাজে কথা ছাড়ুন। গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, নৌকা, জাহাজ, ইত্যাদির অ্যাক্সিলারেটর এবং ব্রেক-টেক বলে কিছু ছিল না বলেই নিউটন ওই সব আজগুবি কথা বলেছিলেন।”
আবার আমাকে বলতেই হচ্ছে, অত সহজে নিউটনের ভুল ধরতে যাবেন না। খুব সাবধানে ভাবুন। আপনি প্রকৃতই স্থির বস্তু বলে কিছু যে পাননি, সেটা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন না। যাকে স্থির বলে দেখেছেন, সে কারোর সাপেক্ষে স্থির, অন্য কারোর সাপেক্ষে আবার চলমান। কোনো বস্তুকেই আপনি স্থির বলে ধরে নিতে পারছেন না। সুতরাং দুনিয়ার সমস্ত বস্তুকেই আপেক্ষিক ভাবে চলমান ধরে নেওয়াই সুবিধাজনক। কেন না, স্থিরতা আর গতিশীলতার মধ্যে বলবিদ্যার দিক থেকে কোনো পার্থক্যই নেই। আর, সব কিছুই যখন (আপেক্ষিক অর্থে) চলমান, আপনি বল প্রয়োগ করে আবার কী করে তাকে চলমান করবেন? গতিশীল বস্তুর মধ্যে আবার নতুন করে গতি সৃষ্টি করার কথা ওঠে কীভাবে? আপনি বল প্রয়োগ করে শুধু তার গতির কম বেশিই করতে পারেন। অ্যাক্সিলারেটর মানে যে গতি বাড়ায়, আর ব্রেক মানে হচ্ছে যে গতি কমায়—অর্থাৎ, প্রথমটা যদি হয় ধনাত্মক ত্বারক, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঋণাত্মক ত্বারক। উভয়েরই কাজ বল প্রয়োগ করে ত্বরণ (acceleration) সৃষ্টি করা। গতির অভিমুখ বরাবর, অথবা, তার বিপরীত দিকে।
সময়ের সঙ্গে গতিবেগ পরিবর্তনের হারকে বলা হয় ত্বরণ। বস্তুর আসল অর্থাৎ নির্দেশাক্ষ-নিরপেক্ষ বেগ জানা না গেলেও নির্দিষ্ট ভরের বস্তুর উপর প্রযুক্ত বলের পরিমাণ অনুযায়ী উৎপন্ন ত্বরণ কিন্তু সঠিকভাবে জানা যায়। বিজ্ঞানীরা একে মাপজোক করে জানতে পারেন। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র এই ব্যাপারে তাঁদের খুবই সাহায্য করে থাকে। সাধারণ মানুষও ত্বরণের অস্তিত্ব যে কোনো যানবাহনের গতির ক্ষেত্রে বুঝতে পারেন। স্টেশনে থেমে থাকা গাড়ি চলতে শুরু করলে আমরা সামান্য পেছনে হেলে যাই। গাড়ি খুব দ্রুত চলতে চলতে ঝট করে থেমে গেলে আমরা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ি। গাড়ি এক দিকে বাঁক নিলে আমরা উলটো দিকে কাত হয়ে যাই একটু। এই সব ঘটনা আমাদের সকলেরই জানা আছে। কিন্তু এর ব্যাখ্যা যে এই ত্বরণের ধারণা থেকে পাওয়া যায় সেটা আমাদের অনেকের খেয়াল থাকে না। স্থিতিজাড্য (inertia of rest) আর গতিজাড্য (inertia of motion) দিয়ে ব্যাখ্যা করার ফলে ত্বরণের প্রশ্নটা অনেকেরই মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। অথচ, গাড়ির ক্ষেত্রে ত্বরণ আর যাত্রীর ক্ষেত্রে যে এটা জাড্যের বিষয়—এইভাবে এই সব ঘটনাকে বোঝা দরকার। কিংবা, জাড্য মানে হল সমবেগে চলবার আগ্রহ, এবং ত্বরণে অনীহা—এইভাবেও বুঝতে পারেন।
আবার আইনস্টাইনের কথায় ফিরে যাই: “বাইরে থেকে বল প্রয়োগের ফলে বেগের পরিবর্তন হয়। টানা বা ঠেলার ফল হিসাবে বেগ সৃষ্টি হয় না, বেগের পরিবর্তন হয়। বেগের একই অভিমুখে অথবা বিপরীত অভিমুখে ক্রিয়া করছে দেখে বুঝতে হবে, বেগ বাড়বে না কমবে। . . . এই সঠিক রাস্তা ধরে আমরা গতি সম্বন্ধে গভীরতর ধারণা লাভ করি। আমাদের স্বজ্ঞান বলের সাথে বেগের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক দেখালেও বলের সঙ্গে বেগের পরিবর্তনের যে সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়েছিল সেটাই নিউটন প্রবর্তিত সাবেকি বলবিদ্যার ভিত্তি।” [Ibid]
আইনস্টাইনের তত্ত্বকে বোঝার জন্য এই ত্বরণের প্রশ্নে আমাদের আবার পরে ফিরে যেতে হবে। আপাতত আর দু একটা সাধারণ জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে।
আরিস্ততলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে গ্যালিলেও-নিউটনের তত্ত্বের পার্থক্যের মাত্রাটা আমাদের বুঝে নেওয়া দরকার। এখনকার গাণিতিক পরিভাষায় দেখলে আরিস্ততলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতিবেগ হচ্ছে প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক; আর নিউটনের সূত্র অনুসারে গতিবেগ পরিবর্তনের হার (বা ত্বরণ) হচ্ছে প্রযুক্ত বলের সঙ্গে সমানুপাতিক (পার্শ্বটীকা-২ দ্রষ্টব্য)। দ্বিতীয়ত, আরিস্ততলের মতে, বল প্রয়োগ না করলে সচল বস্তু থেমে যাবে; আর গ্যালিলেও এবং নিউটন দেখালেন, বল প্রয়োগ না করলে সমবেগে সচল বস্তু চলতেই থাকবে। অর্থাৎ, বল-শূন্য অবস্থায় স্থির কিংবা সমবেগে গতিশীল বস্তুর মধ্যে বলবিদ্যার নিয়মের দিক থেকে তফাত করা যায় না। তৃতীয়ত, আরিস্ততলের সিদ্ধান্তটা মোটামুটি সঠিক হিসাব দেবে যদি একটা বস্তুকে কোনো (থকথকে কাদা, গাঢ় আঠা বা জেলির মতো) সান্দ্র মাধ্যম (viscous medium)-এ রেখে তার উপর বল প্রয়োগ করা হয় এবং সেখানে সেই বস্তুর বেগের সঙ্গে প্রযুক্ত বলের সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ, একটা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ও বিশেষ পরিস্থিতিতে আরিস্ততলের সূত্রও সঠিক। একেবারে সবটাই ভুল ছিল না। কিন্তু সাধারণভাবে গতির সূত্র হিসাবে অবশ্যই ভ্রান্ত ছিল।
_________________________________________________________________________
পার্শ্বটীকা-২
আরিস্ততলের ধারণাকে গ্রহণ করলে বলের সঙ্গে বেগের সম্পর্ক আমাদের এই সমীকরণ দিয়ে লিখতে হবে:
F = m.v = m.ds/dt,
আর, পক্ষান্তরে নিউটনের ধারণাকে গ্রহণ করে বলের সঙ্গে বেগের পরিবর্তনের হার কীভাবে যুক্ত তা আমাদের এই সমীকরণ দিয়ে লিখতে হবে:
F = ma = m.dv/dt = m.d^2s/dt^2.
F=ma =m.dv/dt
অঙ্কের জগতে এই দুই ধারণার মধ্যে পার্থক্য বিরাট। অনেককেই দেখেছি, এই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে না পেরে, বা এমনকি চেষ্টাও না করে, আরিস্ততলের চিন্তাগুলিকেই নিউটনের বলবিদ্যার ধারণা বলে চালাতে।
[এখানে F = প্রযুক্ত বল, m = ভর, s = সরণ, এবং t = সময়; ds/dt এবং d^2s/dt^2 দ্বারা যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের অবকলন বোঝানো হয়েছে।]
_________________________________________________________________________

পরম বেগ কোথায় পাব?

নিউটনের বলবিদ্যার সাফল্য এক কথায় বলতে গেলে বিরাট। অন্তত দুশ বছর (১৬৮৭-১৮৮৭) এর রাজত্ব ছিল অবিসম্বাদিত। কেউ এর বিরুদ্ধে ট্যাঁ-ফো করতে পারেনি। কয়েকটা খুব ছোটখাটো সূত্রের সাহায্যে যেভাবে পার্থিব বস্তু থেকে শুরু করে গ্রহ নক্ষত্র পর্যন্ত সব কিছুর গতির রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়েছিল তা এক কথায় প্রচণ্ড বিস্ময়কর। এই সূত্রের সাহায্যে এডমন্ড হ্যালি একটা ধূমকেতুর কক্ষপথ ও আবর্তন কাল অঙ্ক কষে বের করে বললেন, সে ৭৫-৭৬ বছর পরে পরে পৃথিবীর আকাশে ফিরে ফিরে দেখা দেবে, এবং হ্যালি ততদিন বেঁচে না থাকলেও সত্যিই নির্দিষ্ট সময়ে সে দেখা দিল, বোঝা গেল এই তত্ত্বের শক্তি কেমন!
এই তত্ত্বের সাহায্যেই কিছু আকাশ পর্যবেক্ষকের সন্দেহ হল, শনির পরেও হয়ত আর একটা গ্রহ আছে যাকে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না। টেলিস্কোপ তাক করে বসে থাকতে থাকতে আবিষ্কার হল ইউরেনাস। তারপর এক শতক বাদে নেপচুন। আরও বছর পঞ্চাশেক বাদে পাওয়া গেল প্লূটোকে। এইভাবেই খুঁজে পাওয়া গেল বহু ধূমকেতুকে, মঙ্গল আর বৃহস্পতির মধ্যেকার সদা ঘুর্ণায়মান গ্রহচূর্ণরাশিকে। তারপর . . .
মজার কথা হল, নিউটন তাঁর সমগ্র তত্ত্বকাঠামোয় বিশ্ব চরাচরের সমস্ত বস্তুর আপেক্ষিক স্থিতি ও গতি নিয়ে কাজ করলেও আরিস্ততলের সেই পরম স্থিতি ও গতির ধারণাকে একেবারে ছাড়তে পারলেন না। বেগ = দূরত্ব/সময়। বেগ যদি আপেক্ষিক হয়, দূরত্বের মাপ বা সময়কেই বা পরম বলা যায় কীভাবে? আবার এটাও ঠিক যে একটা বস্তুর দৈর্ঘ্য কিংবা একটা ঘটনার প্রবাহকাল নির্দেশাক্ষ নির্বিশেষে একই থাকে। আমি যে জামা পরে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি, গাড়িতে উঠলে সে তো আর ছোট-বড় হয়ে যায় না। হাতঘড়িতে সময় দেখে গ্যালোপিং ট্রেনেও স্টেশনের ঘড়ির সাথে মেলাতে পারি। তার মানে এই মাপগুলি পরম বলাই যায়। অতএব, এমনিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও পরম গতির দেখা না পেলেও তিনি ধরে নিলেন, কোনো এক সুদূর অতীতে এই বিশ্বজগত একদম স্থির ছিল। খুব দূরের কোনো প্রান্তে নিশ্চয়ই এখনও তার চিহ্ন থেকে গেছে, যা হয়ত একদিন আবিষ্কার হবে। তার সাপেক্ষে অন্য সমস্ত বস্তুর গতিই পরম গতি হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে।
তখন নিউটনের সামনেও এই প্রশ্ন এসে গেল, তাহলে প্রথম গতির উৎস কী ছিল? পরম স্থিতি থেকে প্রথম দিনের সেই পরম গতির উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল? উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনিও শেষ পর্যন্ত সন্ত আকুইনাস হয়ে আরিস্ততলের দ্বারস্থ হলেন। বা বলা ভালো, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের।
তবে তখন বিশ্ব ধারণার ব্যাপ্তি বেড়েছে। আবার জ্ঞানও বেড়েছে। অতএব নিউটন ভগবানের কাজের বোঝা যথেষ্ট কমিয়ে দিলেন। রোজ রোজ ঠেলাঠেলি করতে হচ্ছে না। সেই অতীতের চরম স্থির বিশ্বকে তিনি শুধু একবার এক রামধাক্কা দিয়ে চালু করে দিয়েছিলেন। ব্যস! তারপর থেকে আর কিছু করতে হচ্ছে না ওনাকে। এই বিশ্বজগত সেই থেকে সেই ঐশ্বরিক প্রথম ধাক্কা (First Impulse)-এর ঠেলায় নিউটনের বাতলানো গতি সূত্র মেনে ঘুরে চলেছে তো চলেছেই। সেরকম একটাও যদি পরম স্থির জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়, তার সাপেক্ষে অন্য সব কিছুরই গতি হবে পরম।
বোঝাই যাচ্ছে, বিজ্ঞানের তরফে এখানে একটা ফাঁকি রয়ে গেল!
সে যাই হোক, উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এসে প্রথম বিজ্ঞানীদের সন্দেহ হল, দুনিয়ার সমস্ত সমস্যা নিউটনের তত্ত্বের আওতায় বোধ হয় আসে না। বা আনা যাবে না। মাইকেল ফ্যারাডে ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ এবং চুম্বক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যে সমস্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, তাতে একটা জিনিস পরিষ্কার হতে শুরু করল, এদের ব্যাপারস্যাপার ঠিক নিউটনীয় গতিবিদ্যার নিয়ম মেনে চলতে রাজী নয়। তারপর ১৮৬০-এর দশকে জেম্‌স ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল বিদ্যুৎ এবং চুম্বকের বিভিন্ন ধর্মগুলোকে সংযোজিত করে গণিতের ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে এক দারুণ জিনিস আবিষ্কার করে বসলেন। তিনি দেখলেন, বিদ্যুৎ আর চুম্বকের মৌল বৈশিষ্ট্যগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, বরং গভীরভাবে অন্বিষ্ট। চৌম্বক ক্ষেত্রে একটা তড়িৎ পরিবাহীকে দ্রুত চালিত করলে তার মধ্যে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র উৎপন্ন হয়; আবার বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের মধ্যে একটা লোহার রডকে নাড়ালে তাতে চুম্বকত্ব দেখা যায়। তার মানে এরা কেউ একে অপরের থেকে একেবারে আলাদা কিছু নয়। শুধু তাই নয়, চুম্বক এবং বিদ্যুতের প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়াকে একই রকম সমীকরণের সাহায্যে একই সঙ্গে প্রকাশ করা যাচ্ছে।
এর পর ম্যাক্সওয়েল যা দেখলেন তা আরও বিস্ময়কর। তাঁর সমীকরণগুচ্ছ থেকে তিনি তড়িচ্চৌম্বক তরঙ্গের যে গতিবেগ পেলেন তা আলোকের গতিবেগের সমান। এবং এই সব তরঙ্গ কোনো মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যেমন যেতে পারে, তেমনই শূন্য মাধ্যমেও চলাচল করতে পারে। তিনি দাবি করলেন, আলোও নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিস্তারের সীমানার মধ্যে এক রকম তড়িচৌম্বক তরঙ্গ। তিনি এই তরঙ্গের যে গতিবেগ নির্ধারণ করার একটি সরল সূত্র পেলেন তা হল নিম্নরূপ:
MM
এইবার এক বড় সমস্যার সামনে পড়া গেল। নিউটনের গতিসূত্র এবং আপেক্ষিকতা অনুযায়ী কোনো কিছুর গতিবেগ তার নির্দেশাক্ষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধরা যাক, নদীতে নৌকায় করে আপনি কোথাও যাচ্ছেন। সকলেই জানেন, নৌকা যদি জলের স্রোতের সঙ্গে একই দিকে যায়, দুটো বেগ যুক্ত হয়ে নৌকা জোরে ছুটবে। আর বিপরীত দিকে গেলে আস্তে আস্তে চলবে। এমনকি এও জানা আছে যে নদী আড়াআড়িভাবে পার হতে হলে নৌকাকে স্রোতের বিপরীত দিকে একটু কোনাকুনি করে যাত্রা করতে হবে। তার মানে হল, বস্তুর গতিবেগ তার মাধ্যমের গতিবেগের সাথে ভীষণভাবে যুক্ত। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের সূত্র থেকে দেখা যাচ্ছে যে তড়িচ্চৌম্বক তরঙ্গের বিস্তার সে যে মাধ্যমে প্রসারিত হচ্ছে তার অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল নয়। শূন্য মাধ্যমেও সে বিস্তার লাভ করতে পারে। আর এদের গতিবেগ মাধ্যমের গতিবেগের সাথে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নয়। বরং উল্টোদিকে, নির্দেশতন্ত্র বদলে দিলে ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের চেহারাই বদলে যায়, যা এমনকি গ্যালিলীয় আপেক্ষিকতার ধারণার সাথেও খাপ খায় না। অর্থাৎ, আমরা যে আশা করেছিলাম, গতিসূত্রের নিয়মগুলি নির্দেশতন্ত্রের উপর নির্ভর করা উচিত না, সেখানেই সমস্যা দেখা দিল।
এইখানে এসে নিউটনের গতিবিদ্যার সাথে ম্যাক্সওয়েলের সূত্রের ব্যাপক বিরোধ হয়ে গেল। মুশকিল হচ্ছে, কাউকেই ছাড়া যাচ্ছে না। নিউটনের সূত্রগুলো এতভাবে এত জায়গায় প্রযুক্ত ও পরীক্ষিত হয়ে উঠে এসেছে যে তাকে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার ম্যাক্সওয়েলের সূত্রগুলিও একদিকে অন্য ধরনের বহু পরীক্ষার ফসল এবং তার পেছনেও রয়েছে এক নিশ্ছিদ্র তাত্ত্বিক ও গাণিতিক বিজ্ঞানের বিকাশ। তাকেই বা অস্বীকার করার উপায় কী?
অধিকাংশ বিজ্ঞানীই নিউটনকে বাঁচিয়ে সমস্যাটার সমাধান খুঁজতে চাইলেন। তাঁরা ভাবলেন, নিশ্চয়ই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চারদিকে একটা কোনো মাধ্যম আছে যা অদৃশ্যভাবে পরিব্যাপ্ত বলে আমরা তার অস্তিত্ব টের পাই না। ইথার। কত গুণ যে তার উপর আরোপিত হল: টানলে বাড়ে আবার ছেড়ে দিলেই যে কে সেই। স্থির, নিঃশব্দ, সর্বভেদী, নিখুঁতভাবে স্থিতিস্থাপক, ইত্যাদি। (দেশে দেশে কত ধর্মতাত্ত্বিক তখন সরল বিশ্বাসে ইথারের সাথে আত্মার ধারণাকে মেলাতে পেরে পুলকিত!) তখন ভাবা হল, আচ্ছা, এমন একটা পরীক্ষার আয়োজন করা যাক, যাতে ইথার মাধ্যমে বিভিন্ন দিকে আলোকের গতিবেগ মাপার চেষ্টা করা হবে। যদি দুদিকে দুরকম মান পাওয়া যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে। নিউটনকে বাঁচিয়েই ম্যাক্সওয়েলকে মেনে নেওয়া যাবে। ১৮৮১ সালে এডওয়ার্ড মাইকেলসন, ১৮৮৭ সালে মাইকেলসন ও অ্যালবার্ট মর্লি দু দুবার খুব সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি সাজিয়ে পরীক্ষা করলেন। কিন্তু কোথায় কী? আলোকে যেদিকেই মাপা হচ্ছে, বেগ একই দেখাচ্ছে।
কী দুঃসংবাদ ভেবে দেখুন একবার। সেই একটা পরম বেগ হাতের কাছেই খুঁজে পাওয়া গেল, কিন্তু যিনি এর কথা কত আগে ভেবে রেখেছিলেন, তাঁর এযাবতকালের বিপুলভাবে সফল তত্ত্বের সাথেই সে অসহযোগিতা করবে বলে পণ করেছে।
ঊনবিংশ শতাব্দ তখন সমাপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। ১৮৭৮ সালে একদিন প্রথিতযশা পদার্থবিজ্ঞানী জোহান ফিলিপ ফন জোলির কাছে যুবক মাক্স প্লাঙ্ক গিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে। জোলি তাঁকে বোঝালেন, “দেখ বৎস, সত্যি কথা বলতে কি, পদার্থবিজ্ঞানে আর বিশেষ নতুন কিছু করার নেই। দুনিয়ার প্রায় সমস্ত দুর্জ্ঞেয় রহস্য উন্মোচিত হয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় মাপজোক এখনও বাকি আছে। তুমি বরং রসায়ন বা জীববিজ্ঞানের কিছু ভালো সমস্যা নিয়ে ভাবতে পার।” সেরকম সময়ে নিউটন-ম্যাক্সওয়েল তত্ত্বের এই ঝামেলা মেটাতে হেন্ড্রিক আন্টুন লোরেঞ্জ, জর্জ ফ্র্যান্সিস ফিটজেরাল্ড, হ্বোলডেমার ফয়েগট, প্রমুখ বললেন, এক কাজ করা যাক, ধরে নেওয়া যাক, ইথারের মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে বস্তুর দৈর্ঘ্য কমে যায় আর সময় মন্থর হয়ে পড়তে থাকে। তাতে সব দিকই বজায় থাকে। অঙ্কগুলো মিলে যায়। অঁরি পোয়াকার বললেন, “আরে বাবা, দৈর্ঘ্য বল আর প্রস্থ, সে সবই তো আমাদেরই হিসাব নিকাশ। তাতে সামান্য এদিক ওদিক করলে কী-ই-বা এসে যায়? সময়কেও না হয় সেভাবেই মাপা যাবে!”
নিউটনের রেখে যাওয়া সেই ফাঁকিকে কীভাবে পদার্থবিজ্ঞানের এলাকা থেকে হঠানো যাবে তা নিয়ে তখনও কেউ ভাবতে শুরু করেননি। পরম স্থিতি, পরম গতি আর ইথার! ফাঁকির উপরে ফাঁকি!!
শতাব্দের শেষটা তাঁদের কিন্তু ভালো কাটল না।
আপেক্ষিকতার নতুন বেশ: সমকালিকতা
এর কিছু কাল পরেই আইনস্টাইনের মঞ্চে প্রবেশ। তিনি তখন ভালো কোনো চাকরি পাননি। একে তাকে ধরে জুরিখের পেটেন্ট অফিসে একটা টেকনিক্যাল পোস্টে কাজ পেয়েছেন। বিকেলে বিজ্ঞান পাঠরত বা গবেষণারত বন্ধুদের সঙ্গে কাফেতে বসে আড্ডা দেন। সন্ধেবেলায় বাড়ি এসে নিজের মতো করে বিজ্ঞানের কিছু কিছু সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামান।
সেই তিনি ১৯০৫ সালে তিন চার মাসের মধ্যে এক বিজ্ঞান পত্রিকায় পরপর এমন পাঁচখানা গবেষণাপত্র পাঠালেন, যার প্রত্যেকটাই এক একটা যুগান্তকারী কাজ। তারই একটার জন্য তিনি আঠের বছর বাদে নোবেল পুরস্কার পাবেন, কিন্তু সব কটার জন্যও পেতে পারতেন অন্তত পাঁচটা নোবেল। কারোর তাতে মন খারাপ হত না! আমরা এখানে অন্যগুলো নিয়ে মাথা ঘামাব না। শুধু একটা দুটো পত্রের কথাই বেশি করে আলোচনা করব; তবে পাঠকদের বলব, সময় সুযোগ পেলে বাকিগুলোর সম্বন্ধেও জেনে নেবেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এরকম কাণ্ড আর কখনও ঘটেনি, এর আগেও না, পরেও না। অন্তত আজ অবধি।
আপেক্ষিকতার পত্রের নিরীহ শিরোনাম দেখে প্রথমটায় কেউ বুঝতেই পারেননি তাতে কী সাংঘাতিক একখানা টাইমবোমা পুরে দেওয়া আছে। ভারি সহজ সরল সব অঙ্ক। যুক্তির ধার খুব সাদামাটা। কিন্তু . . .
প্রথমেই এ কী বলেছেন তিনি? আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বস্তুর গতির রহস্য পুরোপুরি বুঝতে হলে আমাদের মেনে নিতে হবে দুটো খুব সরল বিবৃতি: (১) পারস্পরিকভাবে সমবেগে গতিশীল সমস্ত নির্দেশাক্ষে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলি সিদ্ধ; (২) অতএব, ম্যাক্সওয়েলের আবিষ্কৃত নিয়মটিও এরকম যে কোনো নির্দেশাক্ষেই সমানভাবে সত্য, অর্থাৎ, যে কোনো নির্দেশাক্ষের সাপেক্ষেই আলোকের গতিবেগ ধ্রুবক।
তার মানে কী?
প্রথমত, নিউটনের সময়ে মূলত বলবিদ্যাতে যান্ত্রিক শক্তি ও গতির বিষয় নিয়ে চর্চা হলেও এখন তার পাশাপাশি তড়িচ্চুম্বকীয় গতিও সমান গুরুত্ব অর্জন করেছে; সুতরাং তাকেও গতি সংক্রান্ত বিচার বিবেচনায় আমাদের ধরতে হচ্ছে। তাই শুধু বলবিদ্যার নিয়ম নয়, সমগ্র পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলির কথা মাথায় রেখেই এগোতে হবে। দ্বিতীয়ত, তারই ফল স্বরূপ, গ্যালিলেওর আবিষ্কৃত মৌল নিয়ম, অর্থাৎ, কোনো নির্দেশাক্ষে বসেই বস্তুর গতি বা স্থিতির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করা যায় না, তেমনই আলোকের গতিবেগ যে মাধ্যমের গতিবেগ নিরপেক্ষ, সেই তথ্যটিকেও মাথায় রেখেই গতির প্রশ্নের মীমাংসা করা উচিত। যদি দেখা যায়, পুরনো নির্দেশাক্ষ ধরে এগোতে গেলে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, তাহলে নির্দেশাক্ষের সমীকরণগুলোকেই বরং পালটে ফেলার সময় হয়েছে।
তার আরও মানে হল, আমরা এযাবত যেভাবে ধরে নিয়েছিলাম, (ক) দৈর্ঘ্যের মাপ নির্দেশাক্ষ নিরপেক্ষ, (খ) সময়ের মাপও নির্দেশাক্ষের উপর নির্ভর করে না, (গ) দেশ ও কাল পরস্পর নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল, ইত্যাদি, সেই ধারণাগুলো আমাদের এখন বদলাতে হবে। একমাত্র তাহলেই সব দিক বজায় থাকবে। সমস্ত ফাঁকিগুলো ফুকে যাবে। ইথার-ফিথার সব (এ মাঃ, এবার তাহলে আত্মাকে কার ঘাড়ে চাপাব?)!
আইনস্টাইন একেবারে মূলে চলে গেলেন। বললেন, এতদিন আমরা সময়কে সর্বত্র ধ্রুবক ভেবে এসেছি। আর তার ফলে বলের ক্রিয়া বোঝার সময় সময়ের প্রশ্নটাকে কার্যত বাদ দিয়ে রেখেছি। কিন্তু না। এখন আলোকের গতিবেগ ছাড়া আর কোনো কিছুকেই ধ্রুবক ভাবা চলবে না। দরকারও নেই। আর সময়ের ব্যাপারটাকে ভালো করে বুঝে নিতে হবে। কেন না, আমরা দৈর্ঘ্যই মাপি আর সময়, আসলে সব জায়গাতেই সময় দিয়েই মাপতে হয়। আর, আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, সময়ের সমকালিকতা (simultaneity)–ই হচ্ছে সব রকম মাপনের আসল চাবিকাঠি।
কথাটা নিশ্চয়ই স্পষ্ট হল না। ভয়ের কিছু নেই। কারোর কাছেই হয়নি। আইনস্টাইন বুঝিয়ে দেবার পর অবশ্য খুব সহজ মনে হয়েছে। আমরা যখন বলি ঘড়িতে সাতটা বেজেছে, এর মানে কী? ভেবে দেখুন, এর মানে দাঁড় করাতে হলে একটা নয়, কম পক্ষে দুটো ঘটনার উল্লেখ করতে হবে। যেমন, ঘড়ির ছোট কাঁটা সাতের ঘরে পৌঁছেছে, বড় কাঁটা বারোর ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। মানে এই দুটো ঘটনা এক সাথে, বা, যুগপৎ, ঘটেছে। এইভাবে বলা ছাড়া ঘড়িতে সময় বলার অন্য কোনো উপায় আছে কিনা ভেবে দেখতে পারেন। কিংবা যদি বলা হয়, হাওড়া দিল্লি কালকা মেল দিল্লি জংশনে সাড়ে সাতটায় পৌঁছল—এই কথারই বা মানে কী? এরও মানে হল, ট্রেনটির দিল্লি জংশনের কোনো একটা প্ল্যাটফর্মে ঢোকা আর স্টেশনের ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজা—এই দুটো ঘটনা এক সঙ্গেই ঘটল। যে কোনো ঘটনার বর্ণনা দিতে গেলে আমাদের এইভাবে বলা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
বেশ। এটা বোঝা যাচ্ছে। সত্যিই সহজ সরল কথা।
কিন্তু দৈর্ঘ্য মাপার সঙ্গে সময়ের সমকালিকতার সম্পর্ক কী?
আছে, আছে। ধৈর্য ধরে ভাবুন। মনে করুন, আপনি জলের মধ্যে ছুটে বেড়ানো অবস্থায় একটা কাতলা মাছের দৈর্ঘ্য মাপতে চাইছেন। কী করবেন? একটা মাপন যন্ত্র (যেমন, জ্যামিতির বাক্সের কাঁটা-কম্পাস, শুদ্ধ বাংলায় যাকে বলে ডিভাইডার) নিয়ে তার দুই প্রান্ত মাছের লেজ এবং মুড়োর পাশে ধরে সেই ফাঁকটা স্কেলের সাথে তুলনা করে নেবেন। তাই না? কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, আপনাকে সেই দুই প্রান্ত অতি অবশ্য এক সাথে (অর্থাৎ, যুগপৎ) ঠেকাতে হবে মাছের লেজের ধারে এবং মাথার প্রান্তে। যদি আগে-পরে হয়ে যায় মাপেরও পুরো গণ্ডগোল হয়ে যাবে। কেন না, মাছটা জলের মধ্যে চলাফেরা করছে যে!
আপনি বলতে পারেন, মাছটা এক জায়গায় স্থির থাকলে তো আমাদের এইভাবে যুগপৎ ব্যবহার করতে হত না। ধীরে সুস্থে প্রথমে এই প্রান্তে একটা কাঁটা পরে আর এক প্রান্তে অন্যটা ঠেকালেই হত। তা ঠিক। কিন্তু দুনিয়ায় কে আর এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে আপনার মাপার অপেক্ষায়? সকলেই তো কোনো না কোনোভাবে চলছে। জায়গা বদলাচ্ছে। তাছাড়া আমরা তো আর পৃথিবীর বুকে হালকা চালের গতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বুকে গতি স্থিতির সমস্যা বুঝতে চাইছি। সেখানে কে কার সাপেক্ষে স্থির হয়ে বসে আছে আমার বা আপনার জন্য? তার থেকে আইনস্টাইনের এই সমকালিকতার ব্যবস্থাপনা মেনে নেওয়াই ঢের বেশি সহজ এবং স্বাভাবিক।
MM
চিত্র নং – ২: মাছের দৈর্ঘ্য মাপছেন
এর পর আইনস্টাইন আরও গভীরে গিয়ে প্রশ্ন তুললেন, দুটো ঘটনার সমকালিকতা কি সকল দর্শক একই রকম দেখবেন? যে কোনো নির্দেশাক্ষ থেকে যে দেখবে সেই কি যুগপৎ ঘটতে দেখবে?
এবার একটা কাল্পনিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন তিনি, যাতে সমস্যাটা সবাই বুঝতে পারে।
ধরা যাক, একটা বড় গাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার কোনো কামরার দুই প্রান্তে দুটো আলোক উৎস লাগানো আছে। কামরাটির ঠিক মাঝখানে একজন নিরীহ যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। এবার ধরা যাক, দুটো বাল্ব থেকে এক সঙ্গে আলোর ঝলক বেরল। স্বভাবতই গাড়ির যাত্রীর কাছে সেই দুদিকের আলো (দূরত্ব এবং আলোকের গতিবেগ সমান হওয়ার কারণে) এক সঙ্গেই এসে পৌঁছবে (চিত্র নং – ৩ক)। তিনি সিদ্ধান্ত করবেন, এই বাল্বদুটির ঝলক যুগপৎ ঘটেছে।
এইবার ভাবা যাক, গাড়িটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে এবং সেখানে দাঁড়িয়ে অন্য এক দর্শকও সেই দুদিকের আলোর ঝলকানি দেখলেন। নিশ্চয়ই তিনিও দেখতে পাবেন যে দুই বাল্বের আলোর ঝলকানি একই সময়ে সেই যাত্রীর গায়ে এসে পড়েছে। কেন না, তাঁরা দুজনে কার্যত একই নির্দেশাক্ষ সাপেক্ষে ঘটনাটি দেখছেন (চিত্র নং – ৩খ)।
আচ্ছা, তারপর মনে করুন, গাড়িটি সমবেগে চলতে শুরু করল। তখন কী হবে? তখনও কামরার দুই প্রান্ত থেকে আলোর ঝলকানি আসছে। দুজনে কি এবারেও একই দৃশ্য দেখবেন?
MM
চিত্র নং – ৩ক
MM
চিত্র নং – ৩খ
না, গাড়িটি সমবেগে চলতে শুরু করলেও গ্যালিলেওর সূত্র অনুসারে যাত্রীর কাছে উপরোক্ত ঘটনার কোনো হেরফের হবে না। (হে পাঠক! সেই যে কথাটা কিছুক্ষণ আগে মনে রাখতে বলেছিলাম, সেটাকে এখানে স্মরণ করুন!) তিনি আগের মতোই দুদিক থেকে ঝলকানির যুগপত্তা দেখতে থাকবেন। কেন না, গাড়ির সাপেক্ষে তিনি এখনও একই নির্দেশাক্ষে অবস্থান করছেন। এই জাতীয় পরীক্ষা/পর্যবেক্ষণ করার সময় গাড়িটি থেমে আছে না সমবেগে চলমান—তাঁর কাছে তার কোনো গুরুত্ব নেই, বা বোঝার কোনো উপায়ও নেই। কিন্তু প্ল্যাটফর্মের ব্যক্তির কাছে ঘটনাটা আর আগের মতন নয়। কারণ, এখন যাত্রীর তুলনায় তিনি এক ভিন্ন নির্দেশাক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি দেখবেন, চলমান অবস্থায় এগিয়ে যাওয়ার কারণে দূরত্ব কমে যাওয়ার ফলে সম্মুখের বাল্ব থেকে আলোর ঝলকানি যাত্রীর কাছে একটু আগে পৌঁছে যাবে। আর পেছনের বাল্ব থেকে আলো যেহেতু বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে যাত্রীর কাছে পৌঁছবে, তার আসতে সামান্য হলেও বেশি সময় লাগবে (চিত্র নং ৩গ)। কেন না, উভয় দিকেই আলোর গতিবেগ একই। গাড়ির গতিবেগ তার সাথে যোগ করাও যাচ্ছে না, বিয়োগ করাও যাচ্ছে না। তিনি আর অতএব যাত্রীর গায়ে দুদিকের আলোর যুগপৎ ঝলকানি দেখতে পাবেন না। সামনের আলোর ঝলক যাত্রীর কাছে পৌঁছানোর একটু পরে দ্বিতীয় ঝলক আসতে দেখবেন।
MM
চিত্র নং – ৩গ
এই জায়গাটা আইনস্টাইন চমৎকার করে বুঝিয়ে দিলেন। তাঁর সেই পত্রে। সমকালিকতা যদি নির্দেশাক্ষ নির্ভর হয়, আর মাপজোক যদি সমকালিকতা ভিত্তিক হয়, তার মানে হল, পারস্পরিক সাপেক্ষে সমবেগে চলমান দুটো ভিন্ন নির্দেশাক্ষে সময় এবং দৈর্ঘ্যের মাপ এক হবে না। সামান্য হলেও উনিশ বিশ হয়ে যাবে। কতটা আলাদা হবে, সেটা নির্ভর করবে আলোর গতিবেগের তুলনায় সেই পারস্পরিক বেগ কতটা তার উপর। যদি আলোর তুলনায় গতিবেগ সামান্য হয়, তাহলে নিউটনের সূত্রে কোনো ভুল ধরা পড়বে না। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা সূত্রের দরকার পড়বে না। সেই কারণেই আমরা এতকাল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত ঘটনাবলির ক্ষেত্রে নিউটনের গতিসূত্র নিয়ে কাজ করতে কখনও কোনো অসুবিধায় পড়িনি।
কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে বস্তুর গতিবেগ খুব বেশি এবং আলোর গতিবেগের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে ওঠে, সেই সব জায়গায় আর নিউটনের সূত্র দিয়ে কাজ করা যাবে না। আইনস্টাইনের সাহায্য নিতেই হবে। যেমন পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনের গতিকে বুঝতে গেলে আর নিউটনীয় ফরমুলা দিয়ে কাজ হয় না। সেখানে এই আইনস্টাইনীয় ফরমুলাই কাজ করবে। কিংবা অনেক দূরের মহাজাগতিক ঘটনাবলি বোঝার ক্ষেত্রে।
আপেক্ষিকতার শিকার: সময় দৈর্ঘ্য ভর
ও হো, দুঃখিত, একটু বেশি এগিয়ে গেছি আমরা। মাপগুলো কীভাবে আলাদা হবে সেটা এখনও বলাই হয়নি। ঠিক আছে, সময় দিয়েই শুরু করি।
সেই যাত্রীকে এবার আমরা বসিয়ে দিচ্ছি গাড়ির ভেতরেই একটা ঘড়ির সামনে। ঘড়িটা একটু বিশেষ ধরনের। যে কোনো ঘড়ি হলেই কাজ হত, কিন্তু ব্যাপারটাকে নাটকীয় করে তোলার জন্য এই আয়োজনটা করতে হচ্ছে। মেঝেয় একটা আলোকের উৎস রয়েছে; তার থেকে উৎসারিত রঙিন আলোর ঝিলিক গাড়ির ছাদের নীচেতে রাখা একটা দর্পণে প্রতিফলিত হয়ে আবার নীচে ফিরে আসছে এবং সেখানে রাখা আর একটা দর্পণ থেকে একইভাবে আবার উপরে চলে যাচ্ছে। একবার উপরে গিয়ে প্রতিফলিত রশ্মি নীচে নেমে এলে পাশে রাখা মনিটরে সময় দেখাচ্ছে—ধরা যাক, ৪-২৬-০৫, ৪-২৬-১০, ৪-২৬-১৫, . . ., এইভাবে। মানে, একবার উঠে নীচে নেমে আসতে সেই ঝিলিকের সময় লাগছে (ধরে নিন) পাঁচ ন্যানোসেকেন্ড।
প্ল্যাটফর্মেও এরকমই একটা ঘড়ি রাখা আছে। দুটো ঘড়ি পরীক্ষার আগে মিলিয়ে নেওয়া হয়েছে। দেখাও যাচ্ছে, গাড়ির যাত্রী গাড়িতে যে সময় দেখতে পাচ্ছেন, বাইরের প্ল্যাটফর্মের দর্শকও তাঁর সামনের ঘড়িতে সেই একই সময় দেখছেন। ব্যাপারটা হল, দুজনে একই নির্দেশাক্ষে আছেন, বা পরস্পর আপেক্ষিকভাবে গতিহীন দুই নির্দেশাক্ষে অবস্থান করছেন বলেই দুজনের ঘড়ি একই রকম সময় দেখাছে (চিত্র নং ৪ক)।
এইবার গাড়িটি চলতে শুরু করল।
MM
চিত্র নং – ৪ ক (বাম) ও খ (ডান)
এখন কী হবে? এখনও কি দুজনে একই সময় দেখতে থাকবেন দুই ঘড়িতে?
না।
চিত্র নং ৪খ-তে লক্ষ করুন, প্ল্যাটফর্ম থেকে দর্শক দেখছেন, চলমান অবস্থায় গাড়ির আলোর ঝিলিক নীচ থেকে উপরে যাওয়ার সময় তির্যক পথে ভ্রমণ করছে বলে আগের তুলনায় উপরে উঠতে সময় বেশি নিচ্ছে, আবার নেমে আসার বেলায়ও তাই। ফলে নেমে আসার পর গাড়ির ঘড়ি সময়ের অঙ্কটা একই দেখালেও প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির তুলনায় সেই অঙ্কটা কিন্তু একটু পরে দৃশ্যমান হচ্ছে।
সরল জ্যামিতি আর কি। (এই যাঃ! একটা খুব দরকারি কথা ফস্‌ করে আগেই বলে ফেললাম। জমি তৈরি না করেই। ঠিক আছে, আব্বুলিশ দিয়ে রাখছি। এটা পরের অধ্যায়ে বলার কথা ছিল। আপাতত ভুলে যান।)
অর্থাৎ, প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির পাঁচ ন্যানোসেকেন্ডের তুলনায় গাড়ির ঘড়িতে পাঁচ ন্যানোসেকেন্ড একটু দেরিতে বাজবে। গাড়ির গতিবেগ যত বাড়বে, সেই ঘড়ির পিছিয়ে পড়াও ততই বেশি হবে। সেই হিসাব কষবার জন্য আইনস্টাইন একটা নতুন আপেক্ষিকতার সমীকরণও বের করে ফেললেন।
এবার দৈর্ঘ্য।
সেও খুব সহজ হিসাব। ধরুন, সেই দর্শক প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য বের করে নিলেন। তিনি গাড়িটির পেছনের দিক প্ল্যাটফর্ম পার হতে কত সময় নিল নিজের ঘড়িতে দেখে নিলেন। এর থেকে প্ল্যাটফর্ম সাপেক্ষে গাড়ির গতিবেগ বের করে ফেলা গেল। এবার গাড়িটির ভেতরের ঘড়ি অনুযায়ী কত সময় লাগল সেটাও যদি তিনি দেখে নিতে পারেন, তাহলে গাড়ির নির্দেশাক্ষ সাপেক্ষে প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য কত হবে তাও তিনি পেয়ে যাবেন। গতিবেগকে সময় দিয়ে গুণ করে। অর্থাৎ, গতিবেগ যত বাড়বে, গাড়ির সাপেক্ষে প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য সেই অনুযায়ী কম দেখাবে (পার্শ্বটীকা-৩ দ্রষ্টব্য)।
_________________________________________________________________________
পার্শ্বটীকা-৩
আপেক্ষিকতার নতুন ধারণার ভিত্তিতে দুই নির্দেশাক্ষের মধ্যে পরিপাতন সম্পর্কগুলিকেও নতুন করে লিখতে হল। ইতিমধ্যেই ফয়েগট, ফিটজেরাল্ড এবং লোরেঞ্জ আলাদা আলাদা ভাবে গতির সঙ্গে দৈর্ঘ্য ও সময়ের পরিবর্তন কী রকম হতে পারে তার একটা সম্ভাব্য গাণিতিক পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে তা ছিল নেহাতই অঙ্ক মেলানোর অঙ্ক। আর আইনস্টাইন সেই সম্পর্কগুলিকেই নতুন পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবে দৈর্ঘ্য ও সময়ের মাপ কেন পরিবর্তিত হয় দেখিয়ে স্বতন্ত্রভাবে লিখে ফেললেন:
MM
[এখানে xyzt এবং x'y'z't' দ্বারা যথাক্রমে একটি (আপেক্ষিক অর্থে) স্থির ও তার সংগে v সমবেগে চলমান অপর একটি নির্দেশাক্ষ সাপেক্ষে একটি বস্তুর স্থানাঙ্কগুলিকে সূচিত করা হচ্ছে। শেষের সমীকরণগুলি যথাক্রমে সময়ের অলসন, দৈর্ঘ্যের সঙ্কোচন ও ভরের বৃদ্ধি সূচিত করছে।]

হ্যাঁ, এই অবধি পড়ে কারোর কারোর মনে হতে পারে, আমরা না হয় কায়দা করে একটা ডিজিটাল ঘড়ির বন্দোবস্ত করে ব্যাপারটা দিব্যি সহজভাবে বুঝিয়ে দিলাম। আইনস্টাইনের হাতে তো সেকালে এরকম ঘড়ি নিশ্চয়ই ছিল না। তাঁকে তো সেই পুরনো আমলের গোল ডায়াল আর তাতে ঘন্টা-মিনিটের কাঁটা লাগানো যান্ত্রিক ঘড়ি দিয়েই এই সব ঘটনার ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল।
তিনি সেটা কীভাবে করেছিলেন?
বেশ, সেই চেষ্টাও করে দেখা যাক। উপরের ছবিতে দেখুন স্টেশন ও গাড়িতে রাখা দুটো যান্ত্রিক ঘড়ি। আপাতত আমরা শুধু ছোট (এখানে ন্যানোসেকেন্ডের) কাঁটাটির চলার পথের উপরই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখব। যখন গাড়ি থেমে আছে, অর্থাৎ, যাত্রী এবং দর্শক পরস্পর সাপেক্ষে স্থির দুই নির্দেশাক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন, দুজনের (আগে থেকে মেলানো) ঘড়ির কাঁটার চলার মধ্যে কোনো রকম অসামঞ্জস্য দেখা যাবে না (চিত্র নং ৫ক)। কিন্তু যেই গাড়িটা চলতে শুরু করল, এইবার ভালো করে খেয়াল করে দেখুন, স্টেশনের ঘড়িতে যখন ছোট কাঁটার মুণ্ড বৃত্তচাপ ধরে চলে ছবিতে দেখানো জায়গায় এসে যাবে, প্ল্যাটফর্ম থেকে দর্শক দেখবেন, গাড়ির অনুরূপ কাঁটার মুণ্ড তখনও অনুরূপ অবস্থানে এসে পৌঁছায়নি। সেটির সেই অবস্থানে এসে পড়তে একটু বেশি সময় লাগছে। কেন না, সে আর তখন বৃত্তচাপ ধরে এগোচ্ছে না, ট্রেনের গতির দরুন তাকে যেতে হচ্ছে একটা যেন লম্বাটে উপবৃত্তাকার চাপ বরাবর, যার দৈর্ঘ্য পূর্বোক্ত বৃত্তচাপের তুলনায় সামান্য হলেও বেশি (চিত্র নং ৫খ)। অতএব বুঝতেই পারছেন, ঘড়ির ডিজাইন কেমন তার উপর আপেক্ষিকতার বিষয়টা নির্ভর করছে না।
MM
তাহলে এটা বোঝা গেল, দৈর্ঘ্য আর সময়ের মাপ যে কোনো অবস্থায়, যে কোনো নির্দেশাক্ষে এক হবে না। যাকে মাপা হচ্ছে আর যেখান থেকে মাপা হচ্ছে, এই দুইয়ের মধ্যে পারস্পরিক সমবেগ থাকলে গতির অভিমুখ বরাবর দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে যাবে আর সময় মন্থর হয়ে পড়বে।
আইনস্টাইন যদিও দর্শক দিয়ে বিষয়টা বুঝিয়েছিলেন, আমরাও এখানে তাই করেছি, তথাপি এটা মনে রাখতে হবে: এই দৈর্ঘ্য আর সময়ের মাপের আপেক্ষিকতার ব্যাপারটা কিন্তু দর্শক নির্ভর ব্যাপার নয়; কেউ দেখছে বলে ঘটছে, এমন নয়। কেউ না দেখলে, এমনকি দেখার কেউ না থাকলেও, এইভাবেই ঘটবে সব কিছু। কেউ না দেখলে কি ঘড়ির কাঁটা অন্যভাবে চলবে? আবার পরমাণু বিজ্ঞান কিছু দূর এগোনোর পর দেখা গেল, মহাবিশ্বের সুদূর প্রান্ত থেকে এমন সব কণা পৃথিবীর বুকে প্রবল বেগে এসে আছড়ে পড়ছে, যাদের অর্ধায়ুষ্কাল (half-life period) এত কম যে পার্থিব সময়ের মাপে অত দূর থেকে এখানে পৌঁছানোর অনেক আগেই তাদের মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। হচ্ছে না কেন? কারণ, প্রায় আলোকের গতিবেগে চলার জন্য ওদের নিজস্ব সময়ের ঘড়ি প্রায় স্থির হয়ে থাকে; ভীষণ আস্তে আস্তে চলে। পৃথিবী থেকে কেউ যে তা দেখতে পায় তা কিন্তু নয়। তবুও। ফলে পৃথিবীর বুকে এসে পৌঁছনো পর্যন্ত সেই ঘড়ি অনুযায়ী ওদের অর্ধায়ুষ্কাল শেষ হয় না। ওরা দিব্যি জ্যান্ত অবস্থাতেই কাছাকাছি এসে পড়ে। তারপর অবশ্য বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে এবং অন্যান্য পারমাণবিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ঠেলায় ওদের গতিবেগ একেবারে কমে যায়, ঘড়ি পৃথিবীর ঘড়ির সঙ্গে মিলে যেতে থাকে, ওদের অর্ধায়ুষ্কালও শেষ হয়ে ওরা মুখ থুবড়ে পড়ে। তাই বলছিলাম, ভাগ্যিস আপেক্ষিকতাবাদ ছিল, তাই তো ওদের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হল।
আর একটা ছোট খবর দিলেই আপেক্ষিকতা সংক্রান্ত এই পর্ব আমাদের মোটামুটি চুকে যাবে। আপেক্ষিকতার এই পত্রটি প্রকাশিত হওয়ার তিন চার মাস পরে আইনস্টাইন আবার একখনা পত্র লিখে পাঠালেন। তাতে তিনি দেখালেন বস্তুর ভরের আপেক্ষিকতা। এতদিন জানা ছিল ভর হচ্ছে যে কোনো বস্তুতে পদার্থের মোট পরিমাণ, যা তার একটা নিজস্ব পরম বৈশিষ্ট্য। নির্দিষ্ট বস্তুর ভরও নির্দিষ্ট। সুকুমার রায়ের অনবদ্য ভাষা চুরি করে বলা যেত: “ভরের আমি ভরের তুমি, ভর দিয়ে যায় চেনা!” আইনস্টাইন বললেন, এযাবত যা বলে এসেছ ভুলে যাও; এখন অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে শিখতে হবে। গতি যে বস্তুকে কত ভাবে বদলে দেয় তোমরা ধারণাই করতে পারনি। এবার দেখ। সাধারণ গতিবেগে চলার সময় একটা বস্তু যে শক্তি অর্জন করে তাকে বলে গতিশক্তি। কিন্তু গতিবেগ বাড়তে বাড়তে যখন তা আলোকের গতিবেগের সঙ্গে তুলনীয় মাত্রায় পৌঁছে যায়, তখন গতিশক্তির কিছু অংশ বাড়তি ভর হিসাবে যুক্ত হয়ে যায়। এই বিষয়টিকেই তিনি তাঁর বিখ্যাত সেই $latex E = mc^2& সূত্রে লিপিবদ্ধ করেন। ফলে ভর আর শক্তি মিলিয়েই বস্তুতে পদার্থের পরিমাণ ভাবতে হবে। সংরক্ষণ সূত্রকেও নতুন ভাবে বলতে হবে। আলাদা আলাদা ভর ও শক্তির দুটো সংরক্ষণ সূত্র নয়; এক সংরক্ষণ সূত্রেই ভর এবং শক্তি—উভয়কে বাঁধতে হবে।
অঙ্কে মিলে গেলেও অনেকেরই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। কোথায় ভর আর কোথায় শক্তি? কিন্তু চল্লিশের দশকে যখন কণা ত্বারক যন্ত্র উদ্ভাবিত হল, তাতে পরীক্ষা করে একেবারে নিঃসন্দেহ হওয়া গেল। দেখা গেল, দশ মিলিয়ন-ভোল্ট বিভব প্রভেদ প্রয়োগ করলে ইলেকট্রনের গতিবেগ আলোকের বেগের ৯৯.৮৮ শতাংশ অর্জন করে। এবার বিভব প্রভেদ যদি বাড়িয়ে ৪০ মিলিয়ন ভোল্ট করে দেওয়া হয়, গতিবেগ কিন্তু গতিশক্তির সাবেকি ফরমুলা (Ke = 1/2mv^2) অনুযায়ী দ্বিগুণ হয় না। সামান্য বেড়ে হয় আলোকের গতিবেগের ৯৯.৯৯ শতাংশ। বাকি শক্তি তখন কোথায় চলে যায়? সে তখন সেই ইলেকট্রনের ভর বাড়িয়ে দেয় আরও খানিকটা। আইনস্টাইনের ফরমুলা অনুসারে। না করে যাবেই বা কোথায়? ইলেকট্রন বলে আলোকের গতিবেগকে তো আর সে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। অতএব প্রদত্ত বাড়তি শক্তি তখন গতিশক্তি আর ভরের মধ্যেই ভাগাভাগি হয়ে যায়।
এই কারণেই আধুনিক কালে কণা পদার্থবিজ্ঞানে কোনো কণার ভরই আর সাবেকি এককে বলা হয় না। শক্তির মাপকাঠিতেই তাকে প্রকাশ করা হয়। তাতে আর আলাদা করে একবার ভর আর একবার শক্তি মাপতে আর বলতে হয় না। বিজ্ঞানীদের কাজ কমে গেছে, সুবিধাও হয়েছে। খালি আমাদের মতো সাধারণ বিজ্ঞান পাঠকদের বুঝতে একটু যা বেশি সময় লাগে—এই যা!
তাহলে কী দাঁড়াল?
তাহলে এই পর্যন্ত পড়ে আমরা বোধ হয় এটুকু বুঝেছি বলে দাবি করতে পারি, দৈর্ঘ্য সময় আর ভর আর আগের মতো বস্তুর কোনো শাশ্বত গুণ বা বৈশিষ্ট্য নয়। বস্তুর গতির অবস্থার সাথে তার এই সব বৈশিষ্ট্যও সংযুক্ত। সেই অনুযায়ী পরিবর্তনশীল ও আপেক্ষিক। তার মানে আমি বা আপনি যা খুশি দেখব বা পাব—এমন নয় বিষয়টা। এক একটা নির্দিষ্ট নির্দেশাক্ষ বরাবর কে কী দেখব তা কিন্তু নির্দিষ্টভাবেই ঠিক হয়ে থাকে। যেই দেখুক, বা কেউ আদৌ যদি না দেখে, পরিমাপগুলো একই রকম হবে।
এই হল সংক্ষেপে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব।◙

গ্রন্থপঞ্জি

Einstein, Albert and Infeld, Leopold (1938), The Evolution of Physics; Cambridge University Press, Cambridge.
Feynman, Richard (1992), The Character of Physical Law; Penguin Books, London.
Kuznetsov, B. (1965), Einstein; Progress Publishers, Moscow.
Ashoke Mukhopadhyay (2009), The Science and Philosophy of Einstein’s Theory of Relativity; Bodhoday Mancha, Kolkata.