Tuesday, January 4, 2022

কসমোলজিঃ- মহাবিশ্বের সৃষ্টির রহস্য।


♦মহাকাশের বিশালতা নিয়ে আমাদের কৌতুহলের শেষ নেই।ঘটনার শুরু সেই প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে। অতি ক্ষুদ্র এক বিন্দু যাকে বর্তমানে আমরা সিংগুলারিটি বলে চিনি সেটা খানিকটা বিস্ফোরিত হয়ে প্রচণ্ড গতিবেগে বেলুনের মতো এই মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে লাগলো।কসমোলজি বা বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব বিজ্ঞানের এমন শাখা যেটি ব্যাখা করে কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড! নিঃসন্দেহে এটি বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্ববহ বিষয়। এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও শেষ নিয়ে বহু বছর ধরে মাথা খাটাচ্ছেন কসমোলজিস্টরা। এ  পর্যন্ত বহু তত্ত্ব জন্ম নিয়েছে কসমোলজিতে। অনেকে ব্যাখা করার চেষ্টা করেছেন কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এই মহাবিশ্ব এবং আজকের মহাবিশ্বের রূপ এমনই কেন হলো। তবে এ পর্যন্ত সবচেয়ে সফল ও প্রমাণিত থিওরি হচ্ছে বিগ ব্যাং থিওরি। আমি বাজি ধরে বলতে পারি বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের নাম শুনেনি এমন কাউকে খুঁজে বের করতে বললে জেমস বন্ড কিংবা শার্লক হোমসও হাটু গেড়ে মাফ চাইবেন। আজকের এই আধুনিক কসমোলজি মূলত দাঁড়িয়ে আছে বিগ ব্যাং থিওরির উপর। একে  কসমোলজির প্রাণভোমরা বললেও দোষের কিছু হবে। 

♦আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি। এই তত্ত্ব  অনুযায়ী মহাবিশ্ব প্রসারমান। কিন্তু তিনি তো আবার স্থির মহাবিশ্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই একটা ধ্রুবক দিয়ে মহাবিশ্বকে স্থির করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মহাবিশ্ব তো আর ঐ ধ্রুবকের নিয়মানুযায়ী চলছিল না। এডুইন হাবল আলোর ডপলার শিফট ব্যবহার করে প্রমাণ করলেন যে মহাবিশ্বের ক্রমাগত  প্রসারণমুখীনতা। অগত্যা আইনস্টাইনকে নিজের ভুল স্বীকার করে ধ্রুবকটা সরিয়ে নিতে হলো। তবে এখন আমরা জানি যে ধ্রুবকটার প্রয়োজনীয়তা কতো! সেটা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করবো নাহয়।
 
♦ ডপলার ইফেক্ট আবার কি! 

যখন কোনো শব্দ কারো দিকে ধেয়ে আসে তখন মনে হয় শব্দটা ক্রমাগত তীক্ষ্ণ হচ্ছে। আবার যখন তাকে শব্দটা অতিক্রম করে চলে যায় তখন মনে হয় শব্দের তীক্ষ্ণতা কমে ভোতা হয়ে যাচ্ছে। একটি গাড়ি কিংবা ট্রেনের হর্ণের শব্দ এর জন্য আদর্শ উদাহরণ। তো এরকমটা কেন হয়? 
যখন উৎস থেকে শব্দ ধেয়ে আসতে থাকে তখন শব্দের তরঙ্গদদৈর্ঘ্য কমতে থাকে বিধায় শব্দ তীক্ষ্ণ হতে থাকে। আবার যখন উৎস আপনাকে অতিক্রম করে দূরে যেতে থাকে তখন উল্টোটা ঘটে। একেই ডপলার ইফেক্ট বলে। সব তরঙ্গই এই ধর্ম মেনে চলে। আলোও।তবে আলোর ক্ষেত্রে একে ডপলার শিফট বলে। যখন কোনো উজ্জ্বল বস্তু  ক্রমাগত দূরে সরে যায় তখন তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে। একে রেড শিফট বলে। আবার উজ্জ্বল বস্তুটি যখন ক্রমাগত কাছে আসতে থাকে তখন তার তরঙ্গদদৈর্ঘ্য কমতে থাকে। একে ব্লু শিফট বলে। এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করে এডুইন হাবল দেখেছিলেন যে মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি বস্তু একে অপরের কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠলো এমনটি কেন হচ্ছে?
 

♦♦এই রহস্যময় প্রশ্নের উত্তরে দু'টি থিওরি এসেছিল। তবে এখন আমরা শুধু একটা থিওরি নিয়ে আলোচনা করবো।

 তো এই প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে পদার্থবিদ  জর্জ গ্যামো বলেছিলেন যে যেহেতু এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে, সেহেতু পূর্বে কোনো এক সময় এই মহাবিশ্বের সকল কিছু একসাথে ছিল এবং এক সময় তা এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো। এই থিওরিটির নামই হচ্ছে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব। 

এই থিওরি অনুসারে ১৩.৮ বা ১৪ বিলিয়ন বছর আগে পুরো মহাবিশ্বের সকল কিছু এক অতি ক্ষুদ্র বিন্দুতে শক্তিরূপে ছিল। একে সিংগুলারিটি পয়েন্ট বলে আমরা জানি। তখন বিন্দুটিতে তাপ এবং চাপের পরিমাণ ছিল অসীম। এখন আমরা জানি ভর ও শক্তি আলাদা কিছু নয়। তো একসময় বিন্দুটির সকল কিছু এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল। এখান থেকেই সময়সহ অন্যান্য মাত্রাগুলোর সৃষ্টি ও শুরু হয়েছে। বিগ ব্যাংয়ের আগে সময়েরও অস্তিত্ব ছিল না। কি অদ্ভুত, তাই না! কিন্তু এটাই সত্যি। বিগ ব্যাংয়ের আগে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না এবং থাকলেও তা আমরা জানি না। আরো একটি মজার কথা হচ্ছে আজকে যে চারটি মৌলিক বল আমাদের মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে সিংগুলারিটিতে কিন্তু তারা একীভূত ছিল। বিজ্ঞানীরা আবারো চারটি বলকে এক করার করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

বিগ ব্যাংয়ের পর একটি নির্দিষ্ট সময়কে বলা হয় প্ল্যাঙ্ক টাইম। এই সময়ের মধ্যে কি কি ঘটেছিল তাও বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না। তবে বিগ ব্যাংয়ের থেকেই যে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি সেটা জোরালোভাবে বলা যায়। বিগ ব্যাং থেকে এই মহাবিশ্বের প্রকৃতি বেশ ভালোভাবে ব্যাখা করা হয় ( যদিও এখনো কিছু ত্রুটি থেকে গেছে )। যারা একটু বেশি খুতখুতে তারা নিশ্চয়ই বলবে বিগ ব্যাংয়ের কিছু প্রমাণ-ট্রমাণ দেও বাপু। নইলে বিশ্বাস করি ক্যামনে। এখন বিগ ব্যাংয়ের কয়েকটি বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ সম্পর্কে বলছি।

♦ মহাবিশ্বের প্রসারণমুখীনতাঃ  বিগ ব্যাংয়ের সবচেয়ে বড় প্রমাণ এটা।মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে মানে নিশ্চয়ই কোনো এক সময় পুরো মহাবিশ্ব এক জায়গায় ছিল এবং বিস্ফোরিত হয়ে তা ছড়িয়ে পড়েছে।কিন্তু মহাবিশ্ব  সম্প্রসারন থামছে না কেনো?।আসলে সম্প্রসারন থামছে না কেন তা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা শতভাগ নিশ্চিত নয়। কিন্তু পৃথিবীর সৃষ্ট বিজ্ঞানীরা যখন কোন কিছু বুঝতে পারে না তখন শূন্য থেকে তারা অসাধারণ কিছু থিউরি আবিষ্কার করে। কিছুদিনের মাঝেই আমরা ধরে নিলাম, আমাদের স্পেসে নিশ্চই ‘অজ্ঞাত’ কোন এক শক্তি ব্যাপক পরিমানে ছড়িয়ে আছে। এই শক্তি গ্র্যাভিটির বিরুদ্ধে কাজ করে। সবকিছু এক্সপেন্ড করে দিতে পারে সে। তার কারনেই মহাবিশ্ব সংকুচিত না হয়ে এখনো সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে।
তবে বিজ্ঞানীরা এর পিছনে ডার্ক ম্যাটারকেও দায়ী করে থাকেন।এই ডার্ক ম্যাটার আবার কি??

@আমাদের মহাবিশ্বে শতকরা প্রায় ৮০-৯০ ভাগ এমন পদার্থ  রয়েছে যা বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না।এমনকি এই বিষয়ে ধারণাও করতে পারে না। এই শতকরা ৯০ ভাগ পদার্থকে বিজ্ঞানীরা ডার্ক ম্যাটার নামে ডাকে।মহাকাশের যে পদার্থ আমাদের পরিচিত তার নাম হল “ব্যারিয়নিক ম্যাটার”, যা প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেক্ট্রনের তৈরি। ডার্ক ম্যাটার হয়ত ব্যারিয়নিক ম্যাটার দিয়ে তৈরি হতেও পারে আবার নাও পারে। কিন্তু মহাবিশ্বের উপাদান সমূহকে একত্রিত রাখতে হলে ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ হতেই হবে। আগেই বলা হয়েছে এই নিরুদ্দেশ পদার্থ ব্যারিয়নিক পদার্থের তৈরি হতেও পারে, কিন্তু আমরা কোনও কারনে তা এখনও ডিটেক্ট করতে পারছিনা। সন্দেহের তালিকায় যেসব বস্তু আছে তা হল অনুজ্বল ব্রাউন ডোয়রফ, হোয়াইট ডোয়রফ এবং নিউট্রিনো স্টার। সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলও এই তালিকার ভেতর হতে পারে। বিজ্ঞানীরা যে নিরুদ্দেশ পদার্থের খোঁজ করছেন মহাকাশে তার ভুমিকা সাধারণ ব্যারিয়নিক পদার্থের চেয়েও বেশী হতে পারে। কারণ অন্যান্য যেসব উপাদান আছে তা বলছে ডার্ক ম্যাটার সাধারণ পদার্থের চেয়ে অনেক আকর্ষণীয়।
বেশীরভাগ বিজ্ঞানীদের মতে ডার্ক ম্যাটার নন-ব্যারিয়নিক পদার্থের তৈরি। এদের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ডব্লিউআইএমপিএস বা উইকলি ইন্টার‍্যাক্টিং  ম্যাসিভ পারটিকেল। এই ধরণের কণার ভর প্রোটনের চেয়ে প্রায় শতগুন বেশী। কিন্তু সাধারণ পদার্থের সাথে এর খুবই কম মিথস্ক্রিয়ার জন্য এটাকে ডিটেক্ট করা প্রায় অসম্ভব

♦ সিএমবিঃ ১৯৬৫ সালে বিজ্ঞানী পেনজিয়া এবং উইলসনের মাইক্রোওয়েভ এন্টেনায় ধরা পরে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমি বিকিরণ। এই বিকিরণটি বিগ ব্যাংয়ের কাছাকাছি সময়ের আলোর বিকিরণ। টিভিতে আমরা যে ঝিরিঝিরি জাতীয় কিছু দেখি তার কারণও কিন্তু সিএমবি। ডিশ এন্টেনায় সিএমবি হিট করায় এমনটি হয়। সিএমবি দ্বারা আমরা বিগ ব্যাংয়ের কাছাকাছি সময়ের অবস্থা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। এটাকে মহাবিশ্বের আদি আলোও বলা যায়।

♦ মহাবিশ্বের তাপমাত্রাঃ বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুসারে এতদিনে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কমতে কমতে গড় তাপমাত্রা হওয়া উচিত প্রায় ৩ ডিগ্রী কেলভিন। আশ্চর্যের কথা হলো, বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি বর্তমানে মহাবিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩ ডিগ্রী কেলভিন!

ডার্ক এনার্জিঃ মহাবিশ্ব যে ক্রমশই অধিক দ্রুত তালে প্রসারিত হচ্ছে।তার একটি কারণ হলাে এই ডার্ক এনার্জি । মহাবিশ্বের শুরুতে পদার্থের গড় ঘনত্ব ( p_m ) ডার্ক এনার্জির গড় ঘনত্ব ( p_A ) থেকে অনেক বেশি ছিল । প্রায় ৯ বিলিয়ন বছর ধরে সম্প্রসারণের ফলে পদার্থের গড় ঘনত্ব হ্রাস পায় । কিন্তু ডার্ক এনার্জির ঘনত্ব একই থাকে । মহাবিশ্বের সবখানেই ডার্ক এনার্জি বেশ সুষমভাবে ছড়িয়ে আছে । ডার্ক এনার্জির অতিমাত্রায় কম ঘনত্বের ( মােটামুটি প্রতি ঘনমিটারে মাত্র ১০ ^ -২৭ কিলােগ্রাম ) কারণে এটি  অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য । মহাকর্ষ ছাড়া প্রকৃতির বাকি তিনটি মৌলিক বলের ওপর এর কোনাে প্রভাব আদৌও আছে কিনা তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি।তবে ডার্ক এনার্জি অনেকটা এখনাে কল্পনার পর্যায়ে ।