Friday, April 30, 2021

এপোলো চন্দ্র অভিযান কেন সত্য?

 



এপোলো চন্দ্র অভিযান নিয়ে কথা উঠলেই একদল মানুষ এসে বলে যে চন্দ্র অভিযান কখনও সংগঠিত হয়নি এবং আমেরিকান সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে মহাকাশ প্রতিযোগিতায় হারাতে এই পদক্ষেপ নিয়েছিল। শেষের কথাটা সত্যি হলেও, প্রথম কথাটি সত্য না। কেন সত্য না এর পেছনে তিনটি কারণ আমি দেখাব।

প্রথম কারণ: লুনার লেজার রেঞ্জিং পরীক্ষণ
মিলিমিটার প্রিসিশনে পৃথিবী হতে চাঁদের প্রকৃত দুরত্ব মাপার জন্য, নাসা এপোলো ১১ মিশনে চাঁদে রেট্রো রিফ্লেকটর বা প্রতিফলক পাঠিয়েছিল। এই যন্ত্রটির মাধ্যমে পৃথিবী হতে বেতার বা লেজার রশ্নির মাধ্যমে একদম মিলিমিটার মাপে পৃথিবী হতে চাঁদের দুরত্ব মাপা যেত। এই পরীক্ষণটি সর্বপ্রথম ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির দুইজন গবেষক সম্পন্ন করেছিলেন। পরবর্তিতে একই পরীক্ষা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি গবেষক দল ক্রিমিয়ান এস্ট্রোফিজিকস অবসার্ভেটরি থেকেও করা হয়েছিল এবং আমেরিকান গবেষকদের পরীক্ষার প্রায় সমান ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল।
পরীক্ষণটি কেবল চাঁদ-পৃথিবীর মধ্যবর্তি দূরত্ব বের করার কাজেই ব্যবহার হয়নি। এই পরীক্ষা হতে প্রাপ্ত ফলাফল পরবর্তিতে চাঁদের মেরু অঞ্চলের সম্প্রসারণ ও সংকোচনের বিস্ময়কর ঘটনা আবিষ্কারে সহায়তা করেছিল। পরীক্ষণ লব্ধ ফলাফল, চাঁদের অভ্যন্তরিন গঠন সম্পর্কেও বিজ্ঞানীদের প্রাথমিক ধারণা প্রদান করেছিল। বিজ্ঞানীরা এপোলো মিশনে চাঁদে রেখে আশা বিভিন্ন সেন্সরের মাধ্যমে বুঝতে পারেন যে চাঁদের অভ্যন্তরের ক্রাস্ট ২০ পার্সেন্ট উত্তপ্ত তরল পদার্থ।
দ্বিতীয় কারণ: সোভিয়েত নজরদারি
আমেরিকার চন্দ্র অভিযান সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ গবেষণাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছিল। সোভিয়েতরা জানত, আমেরিকানরা চন্দ্রে পৌঁছে গেলে তাঁদের মহাকাশ গবেষণায় পিছিয়ে পড়তে হবে। এইজন্য তারা শুরু থেকেই মার্কিন মহাকাশ গবেষণার উপর নজরদারি করে আসছিল। বিভিন্ন সোভিয়েত উৎস হতে জানা যায়, সোভিয়েতরা প্রতিটি এপোলো অভিযান তাঁদের রেডিয়ো ও রাডার প্রযুক্তির মাধ্যমে ট্র্যাক করেছিল। এমনকি এপোলো ১১’র অভিযান পর্যবেক্ষন করার জন্য ইউএসএসআর পৃথিবীর কক্ষপথে একটা মহাকাশযানও প্রেরণ করে রেখেছিল। বলা বাহুল্য, সবগুলো পর্যবেক্ষণই সত্য ছিল।
তৃতীয় কারণ: চায়নিজ চ্যাং ই ২ এবং ভারতীয় চন্দ্রযান ১
চীন ২০১০ সালে চাঁদে চ্যাং ই ২ নামে যে মহাকাশযানটি পাঠিয়েছিল, সে মহাকাশযানটি চাঁদের ম্যাপিং করেছিল। এই ম্যাপিং এর সময় এপোলো মিশনের যন্ত্রপাতির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এপোলো মিশনের সময় তোলা বিভিন্ন ছবিরও সত্যতা পাওয়া গেছে। একইভাবে ভারতীয় চন্দ্রযান ১ অবতরনস্থলের মাটিতে এপোলো মিশনের মহাকাশযানের অবতরন করার অস্তিত্ব পেয়েছে।
এই তিনটি কারণ ছাড়াও চন্দ্র অভিযান বিশ্বাস করার মত অনেক কারণ আছে। এপোলোর চন্দ্রাভিযানের বিভিন্ন বিষয় পৃথিবীর হতে টেলিস্কোপের মাধ্যমে জোতির্বিদেরা দেখতে পেয়েছেন। এরকম প্রায় শতাধিক রিপোর্ট আছে। উল্লেখযোগ্য একটা রিপোর্ট হল, কেটারিং গ্রামার স্কুলের বেতার পর্যবেক্ষন। একটা বালক বিদ্যালয়ের ছাত্ররা হ্যাম রেডিও ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার করে এপোলো মিশন ও সোভিয়েত মিশনের বেতার যোগাযোগ পর্যবেক্ষন করে, পৃথিবী হতে এপোলো মহাকাশযান ও সোভিয়েত মহাকাশ যানের দূরত্ব বের করে ফেলেছিল। সেসময়ের একাধিক দেশ হতে এই অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ট্র্যাকিং করা হয়েছিল। শুধু তাই না, এপোলো মিশন শেষ হবার পর অনেকগুলো গবেষণা প্রতিবেদন পিয়ার রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। যারা পিয়ার রিভিউড জার্নাল সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর রাখে তারা জানে, এগুলো এত সহজে ফেইক করা যায় না।
ছবিতে লুনার লেজার রেঞ্জিং রেট্রোরিফ্লেক্টর এবং জাপানি কাগুয়া চন্দ্র অভিযান হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে চাঁদের ত্রিমাত্রিক ছবি, যার সাথে এপোলো ১৫'র একটি ছবির হুবুহু মিলে যায়।

Friday, April 23, 2021

ইমাম গাজ্জালী – ভাড়ায় খাটা ট্র্যাজিক বুদ্ধিজীবি।

ঢাকার শহরতলীতে যেসব বাড়ীতে আমার শৈশব কেটেছে সেগুলোকে এখন বোধহয় বস্তি বলা চলে । ফ্লোরে বিছানা করে সারিবদ্ধভাবে শুয়ে দুই রুমে আট-দশজন মানুষ , ওকেশনাল গ্রাম থেকে আসা আত্নীয়সহ । বিছানার পাশেই হাঁড়িপাতিল বাসনকোশন বইপত্র আর একমাত্র ফার্নিচার আলনা । নাহ, সেগুলা নিয়া দুঃখ করতেছি না । ড্যাড ওয়াজ ডুয়িং হিজ বেস্ট ।

ঘটনা হইলো ঐসব বাড়ীতে যখন আপনি থাকবেন তখন আপনার প্রতিবেশীও এরকমই হয়তো এক রুমে তিন চারটা বাচ্চাসহ দম্পতি হয়তো কোনরকমে মাথাগুঁজে আছে । এইসব পাশাপাশি রুমের বয়স্কদের মধ্যে মাঝেমাঝে ঝগড়া লেগে যেতো ধুন্দুমার । হয়তো শিশুদেরই কোন সংঘর্ষের সূত্র ধরে অথবা বড়দের কোন কিছু নিয়ে । বড়দের ভিতর কি নিয়ে লাগতো সেবিষয়ে বিন্দুমাত্র স্মৃতি নাই । অযথা কথা বানিয়ে লাভ কি । স্মৃতিতে আছে কেবল এইসব ঝগড়ার বাইরের পর্ব শেষে ঘরে ফিরে আমার বাপের দেয়া কিছু উপদেশ । কোন এক উদ্ভট কারণে এসমস্ত ঝগড়ায় তিনি ঝগড়ার মাঝখানে হুট করে ঘরে চলে আসতেন, কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে গিয়ে ইংরেজিতে কিছু বলে আসতেন । আর আবার ঘরে ফিরে আমাদের উপদেশ দিতেন, ইংরেজি হইলো আসল জ্ঞান । কারো সাথে ঝগড়া লাগলে দুই লাইন ইংরেজি বলতে পারলে সব ঠান্ডা । ইংরেজি জানা লোকরে সবাই ভয় করে । এই উদ্ভট জ্ঞান সম্ভবত বংশপরম্পরায় পেয়েছিলেন বাপজান । ব্রিটিশ আমলের রেলওয়ে শ্রমিক দাদাজান সম্ভবত ইংরেজি জানা দেশী লোকের কদর দেখেছিলেন অফিশিয়াল সার্কেলে । সেখান থেকে বাপের মধ্যে প্রবাহিত সেই জ্ঞান বাপ চেয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্মে ট্রান্সমিট করে যেতে ।

আফসোস হইলো এতদিনেও বাপের সেই থিওরি প্রয়োগ করার মত ক্ষেত্র আসলো না । তেমন ঝগড়া কখনো বাস্তব জীবনে বাঁধলো না যেখানে কয়েক লাইন ইংরেজির ডান্ডা মেরে প্রতিপক্ষকে ঠান্ডা করে দেয়া যেতো । বাপের সন্তানরা হইলো সব মুখচোরা নির্বিবাদ লোকজন ।

ধানভানতে এই শিবের গীত কেনো ? হোয়াট দ্য ফাক ইজ ইওর পয়েন্ট ।

পয়েন্ট হইলো গাজ্জালি পড়তে গিয়ে মনে হইলো কোন মহাজাগতিক নিয়মে বাপের হাজার বছর পূর্বের ইসলামি দার্শণিক গাজ্জালি যেনো এই টেকনিকই প্রয়োগ করতেন তার একাডেমিক ও দার্শণিক আলোচনায় । গাজ্জালির রচনা ও যুক্তি প্রয়োগের পদ্ধতি অনেকটা সেরকম । নাহ, কয়েক লাইন ইংরেজি বলে প্রতিপক্ষকে ঠান্ডা করে দেয়া না । বরং একটা সামান্য পয়েন্ট প্রতিষ্ঠা করার জন্য গাজ্জালি উদাহরণের পর উদাহরণ, তারপর আরো উদাহরণ এবং তারপর আরো উদাহরণ ছুঁড়তে থাকতেন অটোমেটিক মেশিনগানের মত । আল্লাহর কেরামত বুঝানোর জন্য মশা, মাছি, পোকামাকড়, মানুষের হাত পা নাক মুখ চোখ কান হৃদপিন্ড রক্ত মাংস এমনকি একেকটা ইন্ডিভিজুয়াল হাড্ডি নিয়া পর্যন্ত প্যাঁচাল পাড়তেই থাকনে পাড়তেই থাকেন । তার প্রতিপক্ষ হয়তো চার পাঁচটা উদাহরণের পরই হাল ছেড়ে দিয়ে বরং পালাতে পারলেই যেনো বাঁচি , এই ধরণের মুডে চলে যেতেন ।

গাজ্জালির জীবনের মাস্টারপিস হচ্ছে ইহইয়া উলুম আল দীন । ইহইয়ার শুরু থেকেই গাজ্জালির এই মেশিনগান টেকনিক চোখে পড়ে কর্কশভাবে । গাজ্জালি শুরু করেন জ্ঞান ও জ্ঞানী লোকের কদর নিয়ে । কোরান থেকে, হাদিস থেকে, বুজুর্গদের থেকে, শিক্ষকদের থেকে একের পর এক একের পর এক কোট করতে থাকেন অনর্গল কেবল এই একটা পয়েন্টেই । কিছুদূর পর পড়ার পরেই হাঁপিয়ে উঠি । ওকে , ওকে, আই ফাকিং গেট ইট । গেট টু দ্যা নেক্সট টপিক ফর ফাকস সেইক । আরেকটা ঝামেলা হইলো সিস্টেমেটিক নন-ফিকশন পড়ার কারণে যে অভ্যাস, যেকোন কোটেশনের উৎস, রেফারেন্স , বিশ্বাসযোগ্যতার ক্রসচেক এগুলো করতে গেলে বারবার হোঁচট খেতে হয় । কোরানের যেকোন কোটেশনের সাথে সাথে সুরা আর আয়াতের নাম্বার উল্লেখ করলেও , কোরানের পর থেকেই হাদিস, বুজুর্গদের কথা আর শিক্ষকদের থেকে নেয়া কোটেশনের কোনরকম সোর্স রেফারেন্স নাই । বুজুর্গ আর শিক্ষকদের কথা না হয় চেক না করা গেলো । কিন্তু হাদিসগুলার সোর্স উল্লেখ করলেতো অন্তত ক্রসচেক করা যেতো । গাজ্জালি এই বিষয় এড়িয়ে গেছেন কেবল তার ক্ষমতার জোরে । ইসলামিক দুনিয়ায় গাজ্জালি তখন নিজেই সোর্স, নিজেই রেফারেন্স । সেই ক্ষমতাবলে তিনি তৈরী করে গেছেন অনেকগুলো দেলোয়ার জাহান ঝন্টু হাদিস । ইউ নো, লাইক, বাংলা সিনেমার স্বামীর পায়ের তলে স্ত্রীর বেহেশত । ইহইয়া উলুম আল দীনের শুরুতেই দেখা পাই এমন এক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু হাদিসের । জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে সূদুর চীনে যাও ।

নিজের জীবদ্দশায় উদাহরনের অটোমেটিক মেশিনগান আর খ্যাতি ও ক্ষমতার জোরে মোটামুটি নির্বিঘ্নে পার হয়ে গেলেও , ইহইয়া উলুম আল দিনে ছোট একটা কথা থেকে ইসলামি ধর্মতত্ত ও দর্শণের দুনিয়াতে প্রায় এক হাজার বছরব্যাপী এক তিক্ত মহাযুদ্ধের সূচনা করে যান গাজ্জালি । কথাটি হচ্ছে, এই দুনিয়াদারী এখন যে অবস্থায় আছে এটাই সম্ভাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থা । এর চাইতে ভালো কোন অবস্থা কোনভাবেই হওয়া সম্ভব ছিলো না ।

এই বোল্ড উচ্চারণের মধ্যে সমস্যা অনেক লেভেলের । একেবারে প্রাত্যাহিক পর্যায়ে সমস্যা হচ্ছে দুনিয়াদারীর যে অবস্থা গাজ্জালির সময়ে ছিলো বা এখনো আছে এর মধ্যে প্রতিটা মানুষই চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছে শত রকমের ঝামেলা, অন্যায় , অবিচার, অনর্থক কষ্ট, লাখ লাখ ক্ষুধার্ত শিশু, কোটি কোটি খুন হচ্ছে বিনা অপরাধে, বিনা কারণে । এতকিছু চোখে দেখেও গাজ্জালি কিভাবে বলতে পারেন দুনিয়ার এই অবস্থাই সম্ভাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থা ? একেশ্বরবাদী দুনিয়ায় এই সমস্যা একেশ্বরবাদের সমান পুরনো । প্রাচীন ভালো খারাপ ঝড় বৃষ্টি রোদ খরার আলাদা আলাদা দেবদেবীকে একত্র করে একের ভিতরে অনেক প্যাকেজ ঈশ্বর যখন আসলেন তখনই সমস্যাটা মাথাচাড়া দেয় । পরম দয়ালু আর ন্যায়বান যে আল্লাহ, সেই আল্লাহই কিভাবে পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষিত ও খুন হইতে দেন আরশ থেকে নিজের ফ্যাট এস সামান্য না নড়িয়ে ?

ইসলামের দুনিয়ায় এই সমস্যা সমাধানের প্রথম চেষ্টা চালান মুতাজিলা দার্শণিকরা । তাদের যুক্তি ছিলো দৃশ্যত এসব জঘন্য কার্যকলাপের মধ্যেও আল্লাহর পরম দয়ার সন্ধান পাওয়া সম্ভব । আর এটা সম্ভব মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞান দিয়ে করা বিবেচনাতেই । যে আজ কষ্ট পাচ্ছে তাকে আল্লাহ ডালি ভরে দেবেন পরকালে , ইহকালে একটু কষ্ট দিয়ে আসলে দাম শোধ করে নিচ্ছেন । তারা উদাহরণ হিসাবে নিয়ে আসেন কিছু কষ্ট যেগুলো সহ্য করলে বড় কিছু পাবার আশা থাকে । পরিশ্রমের কষ্ট শেষে ফসল, ফোঁড়া কাটার কষ্টের শেষে রোগমুক্তির আনন্দ , প্রবীনদের মৃত্যুর কষ্টের ফলে নবীনদের জন্য দুনিয়ার অবস্থান ও সুযোগসুবিধা আসা এইসব । আরেকটু নির্লজ্জ উদাহরণ , কষ্টের কারণেই মানুষ কষ্টহীনতার মর্ম বুঝতে পারে । কারো হাত নাই, চোখ নাই । তার দূরাবস্থা দেখে অন্যরা নিজেদের হাত আর চোখের মর্যাদা বুঝতে পারে । হাত আর চোখ দেনেওয়ালা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করতে পারে । এসবের মধ্যে নানানরকমের ফাঁকি আছে । শত শত হাজার হাজার লাখ লাখ কষ্ট যন্ত্রণা অন্যায় অবিচারের উদাহরণ দেয়া সম্ভব যেগুলোর থেকে ভালো কিছু কোনভাবেই মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানের বিবেচনায় দেখা যায় না । আর পরের যে নির্লজ্জ্ব উদাহরণ, তার বিরুদ্ধে আসে অন্ধকে দিয়ে কেনো চোখওয়ালাদের চোখের মর্ম বুঝাতে হবে । যে অন্ধ তার কি দোষ ? সর্বশক্তিমান প্যান গ্যালাকটিক রংবাজ আল্লাহ কেনো মানুষের অন্তরের মধ্যে আপোষে এই চোখ থাকার সুফলের জ্ঞান ঢুকিয়ে দিতে পারলেন না ? কেনো লাখ লাখ অন্ধের দরকার হইলো এইটুক কথা বুঝানোর জন্য । একটা দুইটা হইলেই কি চলতো না ?

মুতাজিলাদের এই নয়ছয় বুঝ দেয়ার কারণে যে আল্লার লুঙ্গিধুতিতে টান পড়ে যাবে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন তাদের দল থেকে বের হয়ে হয়ে যাওয়া আশ’আরি দার্শণিকেরা । যারা সামথিং সামথিং আশ’আরি নামে এক বড় গুরুর চ্যালা । এই ভাঙ্গন এবং আলাদা হয়ে যাওয়া নিয়ে ইসলামি ধর্মতত্বের দুনিয়াতে একটা কাহিনী প্রচলিত আছে । তিন ভাইয়ের গল্প । ঘটনা হইলো মুতাজিলা দার্শণিকরা যখন দুনিয়ার কোন অবিচার ও দুঃখ যন্ত্রণা থেকে ভালো কিছু আসার প্রক্রিয়া দেখাতে পারতেন না তখন তারা তোতাপাখির মত একটা বুলি আওড়াতেন । এই দুঃখ যন্ত্রণার কারণে আল্লাহ পরকালে পুরষ্কার দিবেন । কথিত আছে আশ’আরি স্বয়ং তার মুতাযিলা ওস্তাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন একটা হাইপোথিটিক্যাল তিন ভাই সমস্যা নিয়ে । তিনভাইয়ের একজন বৃদ্ধ বয়সে মারা যায় নেককার বান্দা হিসাবে । সে পায় বেহেশত । আরেকজনও বৃদ্ধ বয়সে মারা যায়, তবে পাপী হিসাবে । সে পাইলো দোযখ । আরেকজন অল্প বয়সে মারা যায় নেক বা পাপের দায়দায়িত্ব নেয়ার বয়সে যাবার আগেই । যেহেতু তার পূণ্যপাপ কিছুই নাই তাই সে বেহেশত দোযখের কিছুই পায় না । এখন এই শিশুবয়সে মারা যাওয়া ভাই আল্লাহর কাছে যদি ফরিয়াদ জানায় যে হে খোদা কেনো তুমি আমাকে শিশুবয়সেই মৃত্যু দিলা ? যদি আমাকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বাঁচতে দিতা তাহলে আমি নেক আমল করে বেহেশতে যেতে পারতাম । আল্লাহ এই শিশুকে কি জবাব দিবেন ? প্রশ্ন রাখেন আশ’আরি , তার ওস্তাদের কাছে । মুতাযিলি ওস্তাদ মুহূর্তের মধ্যে উত্তর দেন, আল্লাহ বলবেন , আমি সবজান্তা, অতীত ভবিষ্যত সবই আমি দেখি । আমি তোমার ভবিষ্যতে দেখেছিলাম যে তুমি বড় পাপী হবা । এজন্য তোমাকে অল্প বয়সেই উঠিয়ে নিয়েছি যাতে দোযখের যন্ত্রণায় পড়তে না হয় তোমাকে । বি গ্রেইটফুল, বিচ । আশ’আরি তখন ফান্দে আটকা পড়া বগা দেখার মত উত্তেজনায় বলেন, তাহলে যে ভাই বৃদ্ধাবস্থায় পাপী হিসাবে মারা গেলো সে কি বলতে পারে না যে হে খোদা কেনো তুমি আমাকে শিশুকালেই উঠায়া নিয়া গেলা না বা দড়ি ফালাইলানা যাতে আমি বেয়ে উঠে যেতে পারতাম ? ফাক বেহেশত, অন্তত দোযখের আগুনের এই নির্মম যন্ত্রণা থেকেতো বাঁচতাম । এই কথার বিপরীতে হতভম্ব হয়ে যান মুতাযিলি ওস্তাদ । কথিত আছে ।

টুটকা ফাটকা ছুতানাতা নিয়ে যারা মেতে থাকেন তেমন ইসলামি চিন্তাবিদরা বিভিন্নভাবে দেখানোর চেষ্টা করেন যে এই তিনভাইয়ের কাহিনী নিয়ে মুতাযিলি গুরুর সাথে আশ’আরির এই বাহাস আসলে বানানো ঘটনা । মিথ । ওয়েল, সেটা এই ধর্মতত্তের আলোচনায় একেবারেই অর্থহীন , পরম্পরাহীন । কারণ এই গল্প সত্য কি মিথ্যা , গল্পের পয়েন্ট সেটা না । গল্পের পয়েন্ট আরো বিস্তারিত । এর দার্শণিক মূল আরো অনেক গভীর । ইসলামের দুনিয়ায় পাপপূণ্য বেহেশত দোযখ এবং কর্মফল যতদিন আছে ততদিন এই প্রশ্ন প্রাসংগিক । কারণ কিছু ভালো লোক বৃদ্ধাবস্থায় মারা যায়, কিছু খারাপ লোক বৃদ্ধাবস্থায় মারা যায় , কিছু শিশু পাপপূণ্যের দায়িত্ব নেয়ার বয়স হবার আগেই মারা যায় । এটা সেই হাজার বছর আগে যেমন সত্য ছিলো এখনও আছে । পাপপূণ্যের হিসাবে যদি বেহেশত দোযখ আর অন্তর্বতী অবস্থার ফলাফল প্রাপ্তি ঠিক হয় তাহলে তিনভাই সমস্যা অত্যন্ত যৌক্তিক সমস্যা । একই দয়ালু আল্লাহ কিছুতেই তিনগোত্রের উপরই একইসাথে দয়ালু এবং ন্যায়বান হতে পারেন না । অন্তত মানুষের যুক্তিবুদ্ধিবিচারের জ্ঞানে কখনোই না ।

আশ’আরি দার্শণিকরা কুড়াল মারতে চান এই শেষের লাইনে । মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানের বিচারের উপর । মুতাযিলি দার্শণিকরা যে বলতেন মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানের বিচারেই আল্লাহর দয়া, ন্যায় ও অন্যান্য সব গুণ বুঝা সম্ভব , সেটা কেবল বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা বাস্তব উদাহরণ দিতে পারতেন বলে সেই আত্নবিশ্বাস থেকেই যে বলতেন, তা নয় । আসলে এরকম না হলে আরো গভীর একটা দার্শণিক সমস্যার তৈরী হয় সেটা তারা জানতেন । যদি মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞান দিয়ে আল্লাহকে বুঝা না যায় তাহলে আল্লাহতে বিশ্বাস করবে কিভাবে মানুষ ? যদি আল্লাহর ব্যাপারে যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানকে শিকেয় তুলতে হয় তাহলে কিভাবে একজন বিশ্বাসী আরেকজন অবিশ্বাসীকে আল্লাহর ব্যাপারে ইমান আনতে বলবে ? এমনকি যদি আল্লাহ যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানের অতীত হয় তাহলে এই আল্লাহ যে আসলে কোন সিক পার্ভার্ট না তার নিশ্চয়তা কি ? সে হয়তো দেখা যাবে সবাইকে বলছে নামায পড় নামায পড় , আর পরকালে গেলে ভিলেনের মত হাসি দিয়ে বলছে এই একটু পাইযলামি করছিলাম তোমাদের সাথে । নামায যারা পড়েছিস তারা সব দোযখে যা । যারা মদসেক্সজুয়াড্রাগ নিয়ে ছিলি তারা বেহেশতে গিয়ে এগুলো নিয়েই থাক ।

আশ’আরি দার্শণিকরা এই সমস্যা নিয়ে অবগত ছিলেন না যে তা নয় । কিন্তু তারা দেখলেন যে এই সমস্যার মুতাযিলি সমাধানে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না । এজন্য আশ’আরিদের সমাধান ছিলো যে মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানের বিচার দিয়ে আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা ও দয়ালুতার বিচার করা যাবে না । ইন ফ্যাক্ট, ন্যায়পরায়ণতা বা দয়ালুতার যে স্ট্যান্ডার্ড মানুষ তৈরী করে নিয়েছে , এর সাথে আল্লাহকে বাঁধা যাবে না । আল্লাহ যা করেন কেবল তার নিজের ইচ্ছাতেই করেন । তিনি যা ন্যায় বলেন সেটাই ন্যায় । তিনি যেটা অন্যায় বলবেন সেটাই অন্যায় । কালকে ভোরে যদি তিনি বলেন এতদিন যেটা ভালো ছিলো সেটা আজকে থেকে খারাপ আর এতদিন যা খারাপ ছিলো সেটা আজকে থেকে ভালো , তাহলেও মানুষের কিছুই করার থাকবে না মেনে নেয়া ছাড়া । তারা দুনিয়ার দৃশ্যমাণ দুঃখযন্ত্রণাঅন্যায়অবিচার এবং সাথে সাথে আল্লাহর দয়া, নেয়ামত এইগুলার ব্যাখ্যাতে একটা চিপাবুদ্ধি যোগ করেন অবশ্য । চিপাবুদ্ধিটা হচ্ছে আল্লাহ মানুষকে ভালো কিছু দিতে বাধ্য নন বা খারাপ কিছু থেকে বাঁচাতেও বাধ্য নন । দুনিয়াতে আমরা যে ভালো দেখি সেটা আল্লাহ কেবলমাত্র নিজের খেয়ালেই দিয়েছেন । আর যা খারাপ দেখি, ওয়েল, সেগুলোর জন্য , দ্যাট ওল্ড ফাকিং সেইয়িং , আল্লাহ নো’জ বেস্ট ।

এখন গাজ্জালি ছিলেন সেলযুক সুলতান ও তাদের দার্শণিক গুরু ও পরামর্শক নিযাম-উল-মূলকে ভাড়ায় খাটা বুদ্ধিজীবি । তার গডফাদার সেলযুক সুলতান আর নিযাম-উল-মূলকের ছত্রছায়াতেই তার পসার প্রতিপত্তি । নিযামিয়া মাদ্রাসার সেলিব্রেটি শিক্ষক গাজ্জালি । তার গডফাদারদের দার্শণিক অবস্থান, ধর্মতত্ত নিয়ে অবস্থান ছিলো আশ’আরি অবস্থান । হতে পারে এটা সহজ চিপাবুদ্ধি বলে অথবা হতে পারে এছাড়া আল্লাহর ধূতিলুঙ্গি বাঁচানোর অন্য কোন উপায় ছিলো না বলে । লেকচারে বিতর্কে একাডেমিতে গাজ্জালি ছিলেন তাই রূঢ়, কর্কশ, দুর্বার আশ’আরি দার্শণিক ।

কিন্তু অন্য যতকিছুই হোক, গাজ্জালি স্টুপিড ছিলেন, একথা বলা যায় না কোনভাবেই । যুক্তির কঠিন জ্ঞান, দর্শণের চিপাচাপা তার মুখস্ত ছিলো যদিও তিনি দার্শণিকদের ও নিয়মতান্ত্রিক ধর্মতাত্তিকদের উপর বেশ দুর্বার আক্রমণ করেছেন তার লেকচারে ও বিতর্কে ও একাডেমিক লেখায় । গডফাদারদের ফরমায়েশি দার্শণিকতা ও নিজের ভিতরের বুদ্ধিমান চিন্তাবিদের ক্রমাগত অন্তর্গত খোঁচার কারণে তাই গাজ্জালির ভিতর থেকে ভুটভাট নিজের অন্য কথার উল্টো কথা মাঝে মাঝেই বের হয়ে যেতো । নিজের ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে থেকে ও তার সেই অটোমেটিক মেশিনগানের মত উদাহরণের গুলি ঠা ঠা করে মেরে ব্যাক্তিজীবনে পার পেয়ে গেলেও সেইসব অন্তর্গত অসংগতি ধরা পড়তে থাকে পরবর্তীযুগের দার্শণিকদের কাছে । এমনকি ইহইয়া উলুম আল দিনের সেই ছোট কথার কারণে জীবদ্দশাতেও তার তিক্ত বিরোধীতা করেছে এমনকি তার ছাত্রদের কেউ কেউও । আবুবকর আল আরাবি নামে তার এক বিখ্যাত ছাত্র বলেন, আমাদের শেখ আবু হামিদ গাজ্জালি একটা কথা বলেছেন যার জন্য ইরাকের লোকেরা তার সমালোচনা করছে । আল্লাহর কসম, এটা সমালোচনা করার মতই কথা ।

“এই দুনিয়াদারীর এখন যে অবস্থায় আছে এটাই সম্ভাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থা । এর চাইতে ভালো কোন অবস্থা কোনভাবেই হওয়া সম্ভব ছিলো না । ” এই কথাটিতে কি এমন ঝামেলা আছে যে প্রায় সহস্রাব্দ ব্যাপী এক তিক্ত দার্শণিক, ধর্মতাত্তিক যুদ্ধের জন্ম হয়েছিলো এই এক কথাতে ? একটা বড় ঝামেলা ছিলো এ কথার ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে । গাজ্জালির নিজের যুগের ও পরবর্তী যুগের সমালোচকরা এই কথার বিভিন্ন অর্থ করেছেন নিজেরা । এই কথা থেকে যুক্তির পথ ধরে কি কি অনুস্বিদ্ধান্তে যাওয়া যায় সেগুলো তৈরী করেছেন নিজেরা । এইসব অনুস্বিদ্ধান্তগুলোই ছিলো তিক্ত ধর্মতাত্তিক যুদ্ধের মূল কাঁচামাল । গাজ্জালি হয়তো এতকিছু ভেবে বলে নাই, কিন্তু যদি তার কথা থেকে যৌক্তিকভাবে এগিয়েই কোন অনুস্বিদ্ধান্ত পাওয়া যায়, তবে তার দায়ভার গাজ্জালিকে নিতেই হবে ।

মূল যুদ্ধটা দুনিয়ার বর্তমান দুঃখযন্ত্রণাঅন্যায়অবিচারে ভরপুর থাকা সত্বেও কিভাবে এটাকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্ভাব্য অবস্থা বলা যায় তা নিয়ে হয় নাই । মূল যুদ্ধ হয়েছে এই সর্বোচ্চ সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থা তৈরীতে আল্লাহর ভূমিকা নিয়ে । দুনিয়ার এই অবস্থা যদি সম্ভাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থা হয় , তাহলে আখিরাতের দরকার কি ? এটা অবশ্য গাজ্জালি এক ফুৎকারেই উড়িয়ে দেন এই বলে যে দুনিয়া বলতে তিনি দুনিয়া আখিরাত বেহেশত দোযখ কর্মফল সবকিছু মিলিয়েই বলেছেন । ভালো কথা । তাহলে আল্লাহ কি এর চাইতে ভালো কোন দুনিয়া তৈরী করতে পারতেন না ? যদি না পারেন তাতে কি তার ধূতিলুঙ্গির সর্বশক্তিমাণ গিঁটটিতে হ্যাঁচকা টান পড়ে না ? আর যদি এর চাইতেও ভালো কোন দুনিয়া তিনি তৈরী করতে পারতেন কিন্তু করেন নাই তাহলে তো তাকে পরম দয়ালু বলা যায় না কারণ তিনি সবচে ভালোটা এখনো দেন নাই । আবার সেই পুরাতন পরম দয়ালু আর পরম ক্ষমতার ক্যাচাল । নতুন করে আবার মাথাচাড়া দেয় পুরনো সেই সমস্যা । দুনিয়ার এই অবস্থা থেকে ভালো অবস্থার কত রকম সম্ভাবণাতো নিতান্ত গন্ডমূর্খটাও দিতে পারে । যেই চৌদ্দ বছরের কিশোরী তার সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছে সে আজ মারা না গিয়ে সুস্থ্যসবল শিশুর জন্ম দিয়ে , ভালো কাজ করে বেহেশতে গেলে কি এমন ক্ষতি হতো । এমনতো অনেকের ক্ষেত্রেই হচ্ছে । গাজ্জালি সমাধান দেন , সবকিছু সব যদুমদুরামসাম বুঝবে না । আল্লাহর পরম জ্ঞানে নিশ্চয়ই এর মধ্যে ভালোকিছু আছে । এবার সামনে চলে আসে মুতাযিলি দার্শণিকদের সেই আদি সমস্যা । যদুমদুরামসামের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানে যদি না বুঝা যায় তাহলে যদুমদুরামসাম কোন ভরসায় আল্লাহর আদেশ পালন করবে ?

ততদিনে গাজ্জালির বয়স হয়েছে । এত এত দার্শণিক সমস্যার সমাধান দিতে গিয়ে গাজ্জালি ক্রমাগত পিছলাতে থাকেন রহস্যময়তা ও সূফি দর্শনের গভীরে । এমনকি তার সারাজীবনের দেয়া শিক্ষার বিপরীতে গিয়ে বলতে থাকেন , এত কথা জিগানি ভালো না । সব কথা সবার বুঝন লাগবো না । চুপ থাক । তাকদির বা ভালোমন্দের পূর্বনির্ধারিত হয়ে যাওয়া নিয়ে যাতে কেউ প্রশ্ন না তুলে । কারণ সেটা আল্লাহর একান্ত নিজের ব্যাপার । সাধারণ পাব্লিকের সেটা নিয়া চিন্তা করারও দরকার নাই । সমিস্যা আছে । বুদ্ধিবৃত্তিক সততার লেভেলে নীচে নামতে নামতে গাজ্জালি অতদূর পর্যন্ত চলে যান যে যুক্তি আর বিতর্কের বিপরীতে রুচির দাবী তুলেন । বলেন, সব কিছু বুঝার মত রুচি বা স্বাদ সবার নাই । যাদের আছে তারাই কেবল বুঝবে । এই কথা বললেতো আর প্রতিপক্ষের কিছু বলার থাকে না । এর সাথে যুক্তি দিয়ে মুখোমুখি হওয়ার মত অবস্থা আর নাই ।

অবশ্য ততদিনে নিজাম-উল-মূলক আর গাজ্জালির সবচে দীর্ঘতম গডফাদার পৃষ্ঠপোষক সেলযুক সুলতান মালিক শাহের মৃত্যু হয়েছে । দাপট, ক্ষমতা, সেলিব্রেটি স্ট্যাটাসও ততদিনে পড়তে শুরু করেছে । গাজ্জালি তখন পুরোদস্তুর সুফী । অবশ্য গাজ্জালির পুরো জীবন ও কর্ম একসাথে দেখলে বুঝা যায় তার ক্ষমতাবান, সেলিব্রেটি ও অটোমেটিক মেশিনগান পার্সোনালিটির অন্তরালে যে ক্ষুরধার চিন্তাবিদ ছিলো সেই চিন্তাবিদ শুরু থেকেই আল্লাহ ও তার বিভিন্ন গুনাগুন যেসব মৌলিক সমস্যা সেসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে উপায়ান্তর না দেখে সূফী রহস্যময়তার দিকে চলে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে অনেক আগে থেকেই । সমস্যা ছিলো তখনকার ইসলামি দুনিয়াতে বৃতের বাইরে চিন্তা করার উপায় ছিলো না । কারণ এসব বস্তা বস্তা বস্তাপচা যুক্তি দেয়ার চাইতে সহজ সমাধান ছিলো আল্লাহ বা স্রষ্টার ধারণা ত্যাগ করে বস্তুগত বিজ্ঞানের ভিত্তিতে দুনিয়া দেখা । আমার কেনো যেনো মনে হয়ে এখনকার দুনিয়াতে গাজ্জালি জন্ম নিলে সে পথেই আসতেন । তার যৌবনে একটা সময় স্রষ্টা নিয়ে সন্দেহে পড়েছিলেন সেই ইঙ্গিত ও পাওয়া যায় তার আত্নজীবনীতে ।

এতকিছুর শেষেও গাজ্জালিকে আমি শ্রদ্ধা করি । কারণ দিনশেষে তার ক্ষমতালোভী কপট ও কুতার্কিত সত্তার আড়ালে ছিলো আসলে পরমজ্ঞানপ্রাপ্ত এক চিন্তক । সেই চিন্তকের চিন্তাভাবনা মাঝে মাঝেই ভুটভাট বের হয়ে পড়তো আর সমালোচনার জন্ম দিতো । সেগুলোকে আবার ক্ষতার দাপট ও কুতর্ক দিয়েই চাপা দিতে হতো তাকে । যেমন ইহইয়া উলুম আল দীনের আগে লেখা আল ইকতিসাদ ফি-ইতিকাদ নামের বইয়ের একটা প্যারা ।

“মানুষের জন্য সবচে ভালো হত যদি তার জীবন হতো বেহেশতে দুঃখ শোক ছাড়া । কিন্তু বাস্তবতা যা তাতে, সত্যিকারের বুদ্ধিমান মানুষের সবচে প্রিয় চাওয়া হচ্ছে অস্তিত্বহীনতা । কোন বুদ্ধিমান বলেন, এমন যদি হতো আমি হতাম বিস্মৃত ও চিহ্নহীন, আরেকজন বলেন, আহা, আমার যদি অস্তিত্বই না থাকতো , আরেকজন বলেন, আমি যদি হতাম একটা খড়কূটো, অন্য আরেকন পাখির দিকে চেয়ে বলেন, আহা আমি যদি হতাম ঐ পাখির মত ।

এসব হচ্ছে নবী ও সত্যিকারের বুদ্ধিমান বুজুর্গদের কথা । এদের কেউ কেউ চাইতেন পরিপূর্ণ অস্তিত্বহীনতা আর কেউ কেউ চাইতেন তারা যেনো জড়বস্তু অথবা পশুপাখি হতেন, কারণ তাতে কোন দায়িত্ব থাকতো না । ”

উপরের এই প্যারারও সমালোচনা হয়েছে । কারণ এখানে গাজ্জালি যারা নিজেদের বর্তমান অবস্থার চাইতে ভালো কোন অবস্থা চাইছে তাদের সমর্থণ দিচ্ছেন । অথচ তার শিক্ষায় , বিতর্কে , একাডেমিক লেখায় তিনি এমন লোকদের খোদাদ্রোহীতার অভিযোগ করছিলেন ।

এমনই ছিলো গাজ্জালির ভিতরের মানুষটার অন্তর্দ্বন্দ আর বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকা আত্নার অবস্থা । ইকতিসাদের এই প্যারা দুইটা থেকে বুঝা যায় গাজ্জালি গৌতম বুদ্ধের পরম জ্ঞানের খবর পেয়ে গিয়েছিলেন নিজের ভিতরে । নিজের মত করে । দিনশেষে গাজ্জালি বুঝেছেন যা সমস্ত সত্যিকারের বুদ্ধিমান বুঝতে পারে নিজের ভিতরে নিজের মত করে । শালা দুইন্যাডাই একটা কুত্তার বাচ্চা ।

সূর্য কাকে কেন্দ্র করে ঘোরে❓

সৌরজগতের গ্রহরা যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরে থাকে তেমনি সূর্য নিজের চারিদিকে ঘোরার পাশাপাশি আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথের ভেতর দিয়ে নিজস্ব কক্ষপথে গ্যালাক্টিক সেন্টারকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে।

আমাদের মিল্কিওয়ে এজন্য বলা হচ্ছে কারণ, সূর্য যে ছায়াপথে বিচরণ করে সেই ছায়াপথের নাম মিল্কিওয়ে। মিল্কিওয়ে ছায়াপথ বাদেও মহাবিশ্বে লক্ষ কোটি ছায়াপথ রয়েছে। এই মিল্কিওয়ে ছায়াপথের কেন্দ্রকে বলা হয় গ্যালাক্টিক সেন্টার। এই গ্যালাক্টিক সেন্টারকে কেন্দ্র করে সেকেন্ডে ২২০ কিলোমিটার গতিবেগে সমগ্র সৌরজগৎ নিয়ে সূর্যের একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে প্রায় ২২৫ থেকে ২৫০ মিলিয়ন বছর। গ্যালাক্টিক সেন্টারকে কেন্দ্র করে সূর্যের একবার ঘুরে আসার এই সময়কে গ্যালাক্টিক বছর বলে।

হিসাবমতে, সৃষ্টির পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০-২৫ বার গ্যালাক্টিক সেন্টারকে কেন্দ্র করে সূর্য ঘুরতে পেরেছে। সূর্যের এই কক্ষপথ মোটামুটিভাবে উপবৃত্তাকার। সূর্য ছাড়াও সূর্যের থেকে অনেকগুণ বড় লক্ষ কোটি তারকা রয়েছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে।

গ্যালাক্টিক সেন্টার থেকে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির পরিব্যাপ্তি প্রায় ১,০০,০০০ আলোকবর্ষ পর্যন্ত। তবে কেন্দ্র থেকে মোটামুটি কাছেই রয়েছে সূর্য। গ্যালাক্টিক সেন্টার থেকে আমাদের সূর্য ২৭,২০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি দেখতে অনেকটা সর্পিল। কেন্দ্র থেকে এর চারিদিকে প্রধান বাহুগুলো চারিদিকে ছড়ানো। এছাড়া এর অনেকগুলো ছোট ছোট বাহুও রয়েছে। আসলে এই বাহু হল আলোকঅঞ্চল। আমাদের সূর্য এই বাহুর প্রধান দুই বাহু পার্সিয়াস এবং স্যাগিটার‍্যাস এর মাঝে ক্ষুদ্রতম ওরিয়ন অঞ্চলের কাছে অবস্থিত।

নিজের চারিদিকে ঘোরার পাশাপাশি সূর্য যেভাবে গ্যালাক্টিক সেন্টারকে কেন্দ্র করে উপবৃত্তাকার পথে আবর্তিত হয় তেমনি ঘুরে থাকে আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথও। পৃথিবী থেকে আমাদের প্রতিবেশী ছায়াপথ অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি ঘূর্ণনও পর্যবেক্ষণ করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। মহাজাগতিক নিয়ম অনুসারে ঘুরছে মহাবিশ্বের বাকি লক্ষ কোটি ছায়াপথ। কিন্তু এই ছায়াপথ আসলে কাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সে প্রশ্নের এখনো স্পষ্ট উত্তর পাননি বিজ্ঞানীরা। আগামীতে পাবেন কিনা সেটি অপেক্ষার বিষয়।

তথ্য সূত্র : * আর্থস্কাই ডট ওআরজি। * জার্নি ফ্রম দ্য সেন্টার অব দ্য সান : জে বি জিরকার। * গ্যালাক্সিস অ্যান্ড কসমিক ফ্রন্টিয়ার : ওয়াল্টার অ্যান্ড হজ। * দ্য মিল্কিওয়ে : মরিস মার্ক।

Saturday, April 10, 2021

আলোর চেয়েও দ্রুত বেগে যাত্রা কি সম্ভব ?---দ্বিতীয় পর্ব।


৩) Theory of Relativity
=================
কোন বস্তুর পক্ষে আলোর চেয়েও দ্রুত গতিবেগ অর্জন করা যে একেবারেই অসম্ভব তার সবচেয়ে বড় প্রমান বরেণ্য বৈজ্ঞানিক অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ মতবাদ সূত্র অর্থাৎ Thoery of Relativity। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ মতবাদ সূত্র অনুসারে যখনই কোন যান বা বস্তুর গতিবেগ বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন গতির সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে সেই যান বা বস্তুর Mass অর্থাৎ ভর। এই পর্যন্ত পড়ে আপনাদের অনেকেই হয়তো বলবেন এটা কি করে সম্ভব ? সব বস্তুর ভর তো অপরিবর্তনশীল। এক্ষেত্রে আপনারা সম্পূর্ণ সঠিক না হলেও কিছুটা সঠিক। যে কোন অচঞ্চল স্থির বস্তুর ক্ষেত্রে তার ভর বা mass সবসময় অপরিবর্তিত থাকে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় Rest Mass। কিন্তু যখনই কোন বস্তু বা মহাকাশযান দ্রুতবেগে চলতে শুরু করবে তখনই আইনস্টাইনের Relativity Mass Equation এর এই ফর্মুলার দ্বারা:
 m = m0/ √(1 − v2/c2)
where m=relativistic mass
m0=rest mass
v=m's velocity
c=constant speed of light in vacuum

সমীকরণ অনুসারে সেই বস্তুর ভর বৃদ্ধি পেতে শুরু করবে। কিন্তু যখনই বস্তু বা যানটি তার চলাচল বন্ধ করে দিয়ে স্থির অচঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে তখনই তার ভর কমে গিয়ে আবার আগের পর্যায়ে ফিরে যাবে। এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে যখনই কোন মহাকাশযানের গতিবেগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করবে তখনই সেই অনুপাতে তার ভরও বৃদ্ধি পেতে শুরু করবে। মহাকাশযানের ভর যত বেশি বৃদ্ধি পাবে তার ঊর্ধ্বমুখী গতিবেগ বজায় রাখার জন্য ইন্ধন বা জ্বালানি শক্তি হিসেবে মহাকাশযান টিকে তত অধিক পরিমাণে এনার্জি সরবরাহ করতে হবে। ক্রমে সেই মহাকাশযান যখন আলোর কাছাকাছি গতিবেগে পৌঁছবে তখন তার ভর এতটাই বৃদ্ধি পাবে যে তখন তার ইন্ধনশক্তির যোগান দেবার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়বে অজুত পরিমানের এনার্জি সরবরাহের। একসাথে প্রায় দশ লাখ পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েও যার কণামাত্র যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। আলোর সমান গতিবেগ অর্জনের জন্য যে অসীম পরিমানের এনার্জি সরবরাহের প্রয়োজন রয়েছে এখনও পর্যন্ত সেই পরিমানের এনার্জি ভাণ্ডারের হদিস মেলেনি পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের নিকটে। পদার্থ বিজ্ঞানীদের মতে ভর যুক্ত কোন বস্তু বা যানের পক্ষে খুব বেশি হলে আলোর গতিবেগের ৯৯.৯৯% গতিবেগ অর্জন করা সম্ভব আর আলোর চেয়েও দ্রুতগতি অর্জন তো শুধুমাত্র কল্প বিজ্ঞানেই সম্ভব।
 
৪) Mass–energy equivalence relation
=============================
আলোর চেয়ে দ্রুতগতি অর্জন যে নেহাতই অবাস্তব চিন্তাভাবনা তার অন্তিম আর সবচেয়ে বড় প্রমান লুকিয়ে রয়েছে মহান বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের Mass–energy equivalence relation সমীকরণের মধ্যে। এই সমীকরণ অধিক জনপ্রিয় E=(MC)2 সমীকরণ নামে। হয়তো সেই স্কুল পড়ার সময় থেকেই আইনস্টাইনের এই বিখ্যাত E=MC2 সমীকরণটি সাথে আপনারা পরিচিত রয়েছেন, কিন্তু আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন না যে এই সমীকরণটি আসলে একটি অর্ধ সমাপ্ত সমীকরণ। আইনস্টাইন তাঁর এই অর্ধ সমাপ্ত সমীকরণটি বানিয়েছেন ভর যুক্ত স্থির আর অচঞ্চল বস্তুদের জন্য। সম্পূর্ণ সমীকরণটি আসলে হলো E2=(MC2)2+(PC)2
এখানে E= Energy
P= Momentum অর্থাৎ গতিবেগ
M= Mass অর্থাৎ ভর
C= Speed of Light অর্থাৎ আলোর গতিবেগ।
 
এই ফর্মুলার সাথে সাযুজ্য রয়েছে Pythagoras theorem এর। আমরা সবাই জানি যে Pythagoras theorem এর ফর্মুলা অনুসারে একটি সমকোণী ত্রিভুজের ক্ষেত্রে Hypotenuse2 = Perpendicular2 + Base2 হয়। এবারে যদি Mass–energy equivalence সমীকরণকে এই পাইথাগোরাস থিওরেমের ফর্মুলা অনুসারে সাজানো হয় তাহলে সমকোণী ত্রিভুজের ক্ষেত্রে তার অতিভুজ (hypotenuse) হবে E, তলা (Base) হবে PC আর উচ্চতা (Height) হবে MC2। এর ফলে আমরা যে সমীকরণটি পাবো সেটা হলো এরকম: E2=(MC2)2+(PC)2।
এখানে E= Energy
P= Momentum অর্থাৎ গতিবেগ
M= Mass অর্থাৎ ভর
C= Speed of Light অর্থাৎ আলোর গতিবেগ

আমরা জানি যে যখন কোন যান বা বস্তু স্থির অবস্থায় থাকে তখন তার মোমেন্টাম শূন্য অর্থাৎ P=0 হয়ে যায়। এর ফলে Mass–energy equivalence সমীকরণটি হবে অনেকটা এরকম
E2=(MC2)2+(PC)2
E2=(MC2)2+(0xC)2
E2=(MC2)2
E=MC2
 
আমরা জানি যে আলোর ফোটন কণা একটি ভর শূন্য পদার্থ অর্থাৎ ফোটন কণার Mass শূন্য হয়। সুতরাং ফোটন কণা সহ যে কোন ভর শূন্য পদার্থের ক্ষেত্রে Mass–energy equivalence সমীকরণটি হবে অনেকটা এরকম
E2=(MC2)2+(PC)2
E2=(0)2+(PC)2
E2=(PC)2
E=PC
অর্থাৎ শুধুমাত্র ভর শূন্য পদার্থ বা বস্তু বা যানের ক্ষেত্রে তার গতিবেগ আলোর গতিবেগের সমান হবে। Mass–energy equivalence সমীকরণ দ্বারা প্রমানিত হয় যে ভর যুক্ত কোন পদার্থ বা যানের পক্ষে কখনোই আলোর সমান গতিবেগ অর্জন করা সম্ভব নয় আর আলোর চেয়েও দ্রুত গতি অর্জন করা শুধুমাত্র কল্প বিজ্ঞানেই সম্ভব।
 
আমরা জানি যে আমরা যখনই কোন দ্রুতগতির যানে সওয়ার হয়ে যাত্রা শুরু করবো তখনই আমাদের উপরে Time Dilation এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে। যানের গতি যত আলোর গতিবেগের কাছাকাছি যেতে শুরু করবে Time Dilation এর প্রভাবে আমাদের সময় পৃথিবীর সময়ের ঘড়ির কাঁটার তুলনায় অনেকটাই ধীর লয়ে প্রবাহিত হতে থাকবে। একই কথা প্রযোজ্য মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ক্ষেত্রেও। মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও যত বৃদ্ধি পেতে থাকবে স্পেস-টাইম দুমড়ে মুচড়ে গিয়ে আমরা তত Time Dilation এর দ্বারা আক্রান্ত হতে থাকবো। ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি গেলে আমাদের সময় পৃথিবীর সময়ের তুলনায় অনেকটাই ধীর গতিতে প্রবাহিত হবে। কিন্তু আমরা কি কখনও আলোক কণার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভেবে দেখেছি আলোর ক্ষেত্রে এর কি প্রভাব পড়বে ?
 
আপনি যদি আলোর ফোটন কণা হতেন তাহলে এই অভূতপূর্ব গতিবেগে যাত্রা করার ফলে সময়ের কাঁটা আপনার জন্য প্রায় সম্পূর্ণ রূপে স্তব্ধ হয়ে স্থির হয়ে যেতো আর এর ফলে হ্রাস পেয়ে অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়ে যেতো দূরত্ব। এর ফলে একটি আলোক কণার রেখা হিসেবে আপনি যখন ৮০০ আলোকবর্ষ দূরবর্তী অন্য কোন নক্ষত্র থেকে যাত্রা শুরু করে পৃথিবীতে এসে উপস্থিত হতেন তখন পৃথিবীর সময়ের হিসেবে ৮০০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও আপনার অর্থাৎ আলোক কণার হিসেবে কিন্তু অতিবাহিত হতো মাত্র কয়েক মুহূর্ত সময়।
 
জন টিটর আর মহাভারতের টাইম ট্রাভেলের রহস্য
====================================
তাহলে টাইম ট্রাভেল করে কি কখনও অতীতকালে যাত্রা করা আদৌ সম্ভব নয় ? তাহলে আসলে কে ছিল রহস্যময় ব্যক্তি জন টিটর ? তখন ২০০০ সালের অন্তিম ভাগ। সবেমাত্র মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পথ চলতে শুরু করেছে ইন্টারনেট পরিষেবা। এমন সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট জাত একটি অনলাইন বুলেটিন বোর্ডের Time Travel Institute Forum এর আলোচনা সভায় এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি নিজেকে জন টিটর নামে পরিচয় দিয়ে জানান যে তিনি নাকি ভবিষ্যতের ২০৩৬ সাল থেকে আগত মার্কিন সেনাবাহিনীর এক সামরিক টাইম ট্রাভেলার। জন টিটর দাবি করেছিলেন যে তিনি তাঁর সময়কালে মার্কিন মেরিন্সের অন্তর্ভুক্ত এক সেনা অফিসার। ব্যাক টু ফিউচার মুভি সিরিজে দেখানো পুরাতন ডিলোরিয়ান টাইম মেশিনের মডেল অনুকরণ করে তিনি C-204 সাঙ্কেতিক নামধারি এক ক্ষুদ্র টাইম মেশিনকে তাঁর গাড়ির ইঞ্জিনের সাথে সংযুক্ত করে গাড়ির সাহায্যে সময় যাত্রা করেছেন। টিটরের দাবি অনুযায়ী তাঁর টাইম মেশিনের চালক নিজের ইচ্ছামতো অতীত আর ভবিষ্যতকালে যাত্রা করতে সক্ষম। তাঁর টাইম মেশিনের ভেতরে অবস্থিত দুটো মাইক্রো সিঙ্গুলারটি চিপের সাহায্যে ঋণাত্মক মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অর্থাৎ Negetive gravitational pool কাজে লাগিয়ে তিনি ২০৩৬ সাল থেকে সময় যাত্রা করে প্রথমে এসেছিলেন ১৯৭৫ সালে তৎকালীন যুগের প্রচলিত IBM 5100 মডেলের একটি কম্পিউটার সংগ্রহ করবার জন্য। ১৯৭৫ সাল থেকে নিজের সময়কালে প্রত্যাবর্তন করবার সময় বিখ্যাত Y2K সমস্যা দূর করে তৎকালীন মানবজাতিকে সাহায্য করবার অভিপ্রায়ে তিনি উপস্থিত হয়েছেন ২০০০ সালে। তিনি আরও দাবি করেছিলেন যে তাঁর টাইম মেশিনে ভ্রমণকারী সময় যাত্রী আর টাইম মেশিনকে একসূত্রে বেঁধে রেখে অতীত আর ভবিষ্যৎকালে যাতায়াতের সুবিধার জন্য Gravity Sensor ও সংযুক্ত করা রয়েছে। ২০০১ সালের ২৪শে মার্চ আচমকা অদ্ভুতভাবে গায়েব হয়ে যান জন টিটর। এখন প্রশ্ন হচ্ছে পদার্থ বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র অনুসারে টাইম ট্রাভেল যদি অসম্ভব হয় তাহলে জন টিটর কিভাবে ২০৩৬ সাল থেকে ২০০০ সালে এলেন ? তাহলে কি জন টিটর আসলে একজন জুমলাবাজ ফেকু ব্যক্তি, যিনি নিজেকে সময় যাত্রীর মিথ্যা পরিচয়ে ভূষিত করে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভ করতে চাইছিলেন ? জন টিটর যদি একজন ফেকুই হবেন তাহলে ২০০১ সালে হটাৎ গায়েব হয়ে কোথায় গেলেন তিনি ? নাকি আসলে জন টিটর নামে আদৌ কোন ব্যক্তির অস্তিত্বই ছিল না, সবই তৎকালীন মার্কিন মিডিয়ার দ্বারা রচিত মুখরোচক সায়েন্স ফিকশন।
 
অনেকে আবার হয়তো প্রশ্ন করবেন সময় যাত্রা যদি বাস্তবে সম্ভবই হতো তাহলে আমরা কেন আমাদের আশেপাশে ভবিষ্যৎকাল থেকে আগত কোন সময় যাত্রীর দেখা পাই না ? নাকি ভবিষ্যতের সময় যাত্রীরা তাঁদের অত্যাধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সাহায্যে আমাদের আশেপাশেই উপস্থিত রয়েছেন এখনকার দিনের কোন ব্যক্তির মতোই সাধারন রূপ ধারন করে বা tactical camouflage যুক্ত অত্যাধুনিক জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে আলোর ফোটন কণাকে কৃত্তিম উপায়ে নিজেদের শরীরের উপর প্রতিসরণ করিয়ে অদৃশ্য অবস্থায়। মাঝেমধ্যে অদৃশ্য সময় যাত্রীদের উপস্থিতি অনুভূত করেই কি আমরা অশরীরী প্রেতাত্মাদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ি ? টাইম ট্রাভেল কি সত্যি সত্যি সম্ভব ? এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে যা সম্ভব নয় তার সমাধান হয়তো লুকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যৎকালের বিজ্ঞানীদের গবেষণাগারে। এমনকি ইন্টারস্টেলার ছায়াছবিতেও খ্রিষ্টোফার নোলান দেখিয়েছিলেন যে ভবিষ্যৎকালের বিজ্ঞানীরা সেই সময়কার মানবজাতিকে সাহায্য করার জন্য কৃত্তিম উপায়ে নির্মাণ করেছিলেন আমাদের সৌরমণ্ডল থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরের ভিন্ন নক্ষত্রমণ্ডলে দ্রুত যাতায়াতের ওয়ার্মহোলের।
(সমাপ্ত)
প্রথম পর্বের লিঙ্ক: https://www.facebook.com/groups/know.the.universe/permalink/1793184547507700/
লেখকঃ বিরিঞ্চি বন্দ্যোপাধ্যায় 🙏🙏🙏

Friday, April 9, 2021

অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া এক নিঃসঙ্গ মঙ্গল যোদ্ধার গল্প 🙂

সময় তখন ২০০৩। নাসা মঙ্গলের উদ্দেশ্যে রোবটিক রোভার অপরচুনিটি পাঠাবে। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।

রোভার Mars Exploration Rover (‘MER-B’) Opportunity. যার ডাকনাম oppy।
মার্স এক্সপ্লোরেশন রোভার বি (MER-B)  নাসার এই রোবটের প্রোগ্রামে প্রধান কাজ ছিলো চারটি, তা হলো

★আমাদের নিকটতম গ্রহ মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধান করা।
★মঙ্গলের সারফেস বা পৃষ্ঠতলের ভূতত্ত্ব বিশ্লেষণ করা।
★ মঙ্গলের আবহওয়ার সম্পর্কে জানা।
★ এবং মানুষের মঙ্গল যাত্রার পথ প্রশস্ত করা।

৭ জুলাই ২০০৩।  যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ কানাভেরাল থেকে লঞ্চ হয় ডেল্টা টু রকেট। এর উপর চড়েই যাত্রা করেছে অপরচুনিটি।

প্রায় দীর্ঘ ৬ মাস মহাশূন্য পাড়ি দিয়ে ২০০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মঙ্গলের মেরিডিয়ানি প্লানামে অবতরণ করে  opportunity.

নাসার সাইন্টিস্টরা এই রোভার মিশনের সময় বেধে দিয়েছিলো ৯০ সোল। [১ সোল মানে মঙ্গলের ১ দিন যা পৃথিবীর ১ দিনের চাইতে সামান্য বড়]

মানে অপরচুনিটি মার্সে বেচে থাকবে ৯০ দিন, এ ৯০ দিন ই ছিলো নাসার টার্গেট।

কিন্তু না তা হয়নি, সবাইকে তাক লাগিয়ে সে বেচে ছিলো ৫৩৫২ সোলস পর্যন্ত। মঙ্গলের ৮ বছর আর পৃথিবীর হিসেবে ১৪ বছর ১৩৬ দিন। যা নাসার বিজ্ঞানিদের এস্টিমেশনের ৫৫ গুন বেশি।
তার ১৪ বছরের আবিষ্কার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছি পৃথিবী বাসীর নিকট।

অপরচুনিটির আবিষ্কার গুলো হলো:-
★ প্রাচীনে মঙ্গলের আবহাওয়া ছিলো আদ্র এবং উষ্ণ
★অপরচুনিটি প্রথমবার পৃথিবীর বাইরের গ্রহে, পাললিক শীলা পাথরের আবিষ্কার করে। তাছাড়াও অপরচুনিটি ছোট হেমাটাইটের পাথর আবিষ্কার করে, যাকে বিজ্ঞানীরা আদর করে ‘ব্লুবেরি’ নামে ডেকে থাকেন।
★অপরচুনিটির সবচেয়ে আশা জাগানো ডিসকভার হচ্ছে সে মঙ্গলে একধরনের মাটির মিনারেল আবিষ্কার করে, যা তৈরি হয়েছিলো পানি দিয়ে। যার পিএইচ ছিলো নিউট্রাল। যা মঙ্গলে পানি থাকার সম্ভাবনাকে দৃঢ় করে।

অপরচুনিটি রোভার তাঁর জীবদ্দশায় মার্স সার্ফেসে প্রায় ৪৫.১৬ কিলোমিটার চষে বেড়িয়েছিলো ।

আপনি হয়তো ভাবছেন, এ আর এমন কি দূরত্ব? একটু পরেই আপনি বুঝতে পারবেন কতোটা ইম্প্রেসিভ ছিলো অপরচুনিটির যাত্রা।
অপরচুনিটি রোভার মঙ্গলে চলার সময় মুখোমুখি হয়েছিলো, শত ধুলোর ঝড়ের। সাধারণ অপরচুনিটি চলতো সোলার শক্তির উপর। আর মার্সে বিশাল ধুলি ঝড়ের কারণে রোভার হাইবারনেশনে চলে যায়।
২০০৫ সালেও এমন একটি ঝড়ের সম্মুখীন হয়ে, অপরচুনির প্রায় সবকটি চাকা ডুবে গিয়েছিলো নরম বালির নিচে। ছয় সপ্তাহ বিভিন্নরকম উদ্দীপনার সাহায্যে রোভারটি মুক্ত হতে পারে সে যাত্রায়। আগেই বলেছিলাম প্রতিটি মুভমেন্ট অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এই গ্রহে। এই নরম বালি থেকে নিজেকে বাঁচাতে রোভারটির চাকাকে ঘুরোতে হয়েছিলো প্রায় ৬২৯ ফিট সমপরিমাণে।

১৪ বছরের পথচলায় এরকম শত মহাপ্রলয়েও হিমালয়ের মতো ঠাই দাঁড়িয়ে ছিলো অপরচুনিটি।
২০১৮’র জুনে বিশাল ধুলি ঝড়ে আক্রান্ত হয় Oppy। ধারণা করা হয় এই দৈত্যাকার ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় রোভারের সোলার প্যানেল, যার ফলে এটি যোগাযোগ রক্ষায় ব্যর্থ হয়।
১০ জুন সর্বশেষ সিগন্যাল পাঠায় সে। যাতে লিখা ছিলো ‘মাই ব্যাটারি ইজ লো, ইটস গেটিং ডার্ক’। যার বাংলা অর্থ আমার ব্যাটারি লো, আর অন্ধকার নেমে আসছে।
নাসার বিজ্ঞানীরা প্রায় এক বছর পর্যন্ত আশা নিয়ে অপেক্ষা করেছিলো সবার প্রিয় এই রোভারটি ফিরে আসবে।
নাসা প্রায় ১ বছর যাবত সিগন্যাল পাঠিয়েই যাচ্ছিলো, পায়নি কোনো প্রতিউত্তর।
সর্বশেষ ১৩ ফেব্রুয়ারি, প্রায় ৮৩৫ টি রিকভারি কমান্ড অপরচুনিটিকে দেয়ার পরও যখন অপরচুনিটি যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়, তখন নাসা ঐ দিন ই অফিশিয়ালি ‘অপরচুনিটি রোভারের’ যাত্রা সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

মঙ্গল মিশনে অপরচুনিটি রোভার একটি হিস্টোরিক্যাল মাইলস্টোন, অম্লান হয়ে বেচে থাকবে হাজারো মহাকাশপ্রেমীর হৃদয়ে 🖤

[ছবি এবং তথ্য নাসার অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহীত]

Saturday, April 3, 2021

ব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য---প্রথম পর্ব।

রামায়ন, মহাভারত, গ্রীক পুরান, নর্স পুরান, মিশরীয় পুরান, সুমেরীয় পুরান সহ প্রাচীন পৃথিবীর বিবিধ পৌরাণিক গাঁথায় আমরা পড়েছি অতিকায় রাক্ষসদের লোকগাথা। সেইসব রাক্ষসদের ক্ষুধা নাকি ছিল অসীম। যা খাবার দেওয়া যেতো তাই উদরস্থ করতো। এমনকি হাতের মুঠোয় পুরে বেমালুম টপাটপ গিলে ফেলতো জলজ্যান্ত মানুষ আর বড় বড় গাছপালাকেও। হালের হলিউড চলচ্চিত্রেও আমরা দেখেছি অতিকায় কিংকং, গর্জিলা, ডায়নোসর, কাইজুদের মতো অতিকায় রাক্ষসদের। এইসব পৌরাণিক গাঁথা পাঠ করে এবং চলচ্চিত্র দেখে কিশোরকালে আমাদের মনে উদয় হয়েছে একটি অমোঘ প্রশ্ন, বাস্তবে সত্যিই কি আছে রাক্ষসদের অস্তিত্ব ? বড় হয়ে আমরা বুঝতে পেরেছি না বাস্তব নয় এইসব রাক্ষসদের অস্তিত্ব রয়েছে কেবলমাত্র কাল্পনিক জগতেই। কিন্তু সেই সাথে জানতে পেরেছি আরেকটি মহা সত্য। বাস্তবে প্রাণী জগতে রাক্ষসের অস্তিত্ব না থাকলেও রহস্যময় এই অনন্ত মহাকাশে কিন্তু সত্যিই রয়েছে রাক্ষসের অস্তিত্ব। না চমকে উঠবার কোন কারণ নেই। মহাকাশে অবস্থিত এই সর্বভুক রাক্ষসের নাম কৃষ্ণ গহ্বর। ইংরেজিতে আমরা যাকে ব্ল্যাক হোল নামে। ব্ল্যাক হোল নিয়ে পৃথিবীবাসীর মধ্যে রয়েছে অদম্য কৌতূহল আর নানাবিধ জিজ্ঞাসা। আজকের এই পোস্টে চেষ্টা করা হবে সহজ সরল বাংলা ভাষায় যতদূর সম্ভব তাঁদের সেই কৌতূহল নিরসনের।

কৃষ্ণ গহ্বর কি ?
==========
অনাদি আর অনন্ত এই ব্রহ্মাণ্ডে লুকিয়ে রয়েছে নানাবিধ অজানা রহস্য। সিংহভাগ রহস্যের সমাধান আজও করে উঠতে পারেননি পৃথিবীর তুচ্ছ মানব বৈজ্ঞানিকরা। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় তারই মধ্যে কিছু কিছু রহস্যের সমাধান করতে সফলও হয়েছেন তাঁরা। ব্রহ্মাণ্ডের অজানা আর অমীমাংসিত রহস্যগুলোর মধ্যে আজ সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো কৃষ্ণ গহ্বর অর্থাৎ ব্ল্যাক হোলের রহস্য। কৃষ্ণ গহ্বর জিনিষটা ঠিক কি ? সংক্ষেপে বলতে গেলে অনন্ত এই মহাকাশের কিছু কিছু রহস্যময় স্থানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব আচমকা এতটাই অধিক মাত্রায় বেড়ে যায় যে সেইসব স্থানের নিকটে কোন বস্তু উপস্থিত হলেই রহস্যময় সেই স্থান তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাহায্যে পুরানে বর্ণিত রাক্ষসের ন্যায় নিমেষের মধ্যে গিলে ফেলে সেইসব বস্তুকে। প্রবল সেই মাধ্যাকর্ষণের টান থেকে নিস্তার মেলে এমনকি আলোর গতিরেখাও। আলোকেও গিলে ফেলে সেই স্থান। এইসব রহস্যময় স্থানগুলিকেই পৃথিবীর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোল অর্থাৎ কৃষ্ণ গহ্বর বলে আখ্যায়িত করেছেন।

কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি হয় কিভাবে ?
==================
কৃষ্ণ গহ্বর ঠিক কি বস্তু সেটা তো আপনারা জানলেন কিন্তু কিভাবে তৈরি হয় এই কৃষ্ণ গহ্বর তা জানেন কি ? কৃষ্ণ গহ্বরের উপস্থিতির বিষয়ে সর্ব প্রথম মতবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে। তৎকালীন সমাজের আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ থিয়োরির কথা মাথায় রেখে নিজের সেই মতবাদে খুব সহজ সরলভাবে ইংরেজ পাদ্রি জন মিচেল জানিয়েছিলেন যে যদি কোন বিশাল তারকার ভেতরে অবস্থিত যাবতীয় পদার্থ কোন এক ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত করে রেখে দেওয়া যায় তাহলে সেই তারকা রূপান্তরিত হবে এক কৃষ্ণ গহ্বরে। কিন্তু কোন জাদুমন্ত্র বলে এক বিশাল তারকার সমস্ত পদার্থ খুব ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত করে রাখা সম্ভব ? না সেদিন এর বেশি কিছু আর জানাতে পারেননি জন মিচেল।

কিন্তু যত গড়িয়েছে সময়ের চাকা ততই উন্নত হয়েছে বিজ্ঞান, নিত্য নতুন প্রযুক্তি হস্তগত হয়েছে বিজ্ঞানীদের। তাঁরা তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে আরও বিস্তারিতভাবে জানতে পেরেছেন কৃষ্ণ গহ্বরের সৃষ্টির কারণ। আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতানুসারে মহাকাশে যখনই কোন তারকার ভেতরে অবস্থিত হাইড্রোজেন গ্যাস সহ যাবতীয় ইন্ধন আর তেজ নিঃশেষিত হয়ে এসে সেই তারকাটি পৌঁছে যায় ধ্বংস বা মৃত্যুর মুখে তখনই ঘটে যায় সুপারনোভা বিস্ফোরণ। আমরা জানি যে মহাকাশে অবস্থিত একেকটি অতিকায় তারকা বা নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সূর্যের থেকেও অনেকটাই বেশি। এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আরও বৃদ্ধি পায় নক্ষত্রের ভেতরে কেন্দ্রস্থলের দিকে। একটি নক্ষত্র যে সব পদার্থ নিয়ে গঠিত সেইসব পদার্থগুলোকে প্রবলভাবে ভেতরের দিকে টানতে থাকে এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। নক্ষত্রের ভেতরে উপস্থিত হাইড্রোজেন এবং অনান্য জ্বালানি গ্যাসের প্রভাবে আবার নক্ষত্রের অন্দরে সৃষ্টি হয় প্রবল তাপের। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিরোধী হিসেবে কাজ করা এই প্রবল তাপ নক্ষত্রের ভেতর থেকে আসা প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব খর্ব করে নক্ষত্রের পদার্থগুলোকে তাদের মূল স্থানে থাকতে সাহায্য করে।

কিন্তু যত নক্ষত্রের বয়স বৃদ্ধি পায় ততই নক্ষত্রের ভেতরে অবস্থিত হাইড্রোজেন সহ অনান্য জ্বালানি গ্যাস নিঃশেষিত হয়ে আসতে থাকে। একসময় ঘটে সুপারনোভা বিস্ফোরণ। এর ফলে আচমকা একটি নক্ষত্রের যাবতীয় জ্বালানি খতম হয়ে যায়। জ্বালানি খতম হবার সাথে সাথেই বাতাসের অভাবে বেলুন যেমন চুপসে যায়, ঠিক তেমনি নক্ষত্রের কেন্দ্রস্থল থেকে আসা প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে নক্ষত্রের যাবতীয় পদার্থ তার গহ্বরে প্রবেশ করে এক ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে জন্ম দেয় কৃষ্ণ গহ্বরের।

আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে এই ব্রহ্মাণ্ডে অবস্থিত যে কোন বস্তু দ্বারাই নির্মিত হতে পারে কৃষ্ণ গহ্বর। এমনকি থিয়োরি অনুসারে আমার বা আপনার দেহাবশেষ দিয়েও গঠন করা যেতে পারে কৃষ্ণ গহ্বর। শুনে চমকে উঠলেন ? না চমকানোর কোন প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানীদের মতানুসারে প্রত্যেক বস্তুই ভরযুক্ত। যদি কোন বস্তুর সমস্ত ভর সেই বস্তুর Schwarzschild radius এর সীমার মধ্যে সঙ্কুচিত করে পুরে দেওয়া যায় তাহলে সেই বস্তু তৎক্ষণাৎ রূপান্তরিত হবে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরে। আমরা জানি যে একটি গোলক বা বর্তুলকার গোলকের সীমান্তবর্তী স্থান থেকে তার মধ্যবর্তী স্থান পর্যন্ত দূরত্ব একই থাকে। এই দূরত্বকে একটি সরলরেখা দ্বারা যুক্ত করা হলে তাকে ইংরেজিতে বলে radius অর্থাৎ ব্যাসার্ধ। Schwarzschild radius ও অনেকটা এরকমই একটা ব্যাসার্ধ। কিন্তু সাধারণ ব্যাসার্ধ আর Schwarzschild ব্যাসার্ধের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো আমরা যদি কোন বস্তু বা গোলক বা বর্তুলকার গোলকের যাবতীয় ভর তার Schwarzschild ব্যাসার্ধের মধ্যে সঙ্কুচিত করে পুরে দিতে সফল হই তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই বস্তু বা গোলক বা বর্তুলকার গোলক রূপান্তরিত হবে ব্ল্যাক হোলে।

প্রত্যেক বস্তুর Schwarzschild ব্যাসার্ধ ভিন্ন ভিন্ন হয়। এই ব্যাসার্ধ বের করবার জন্য ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী Karl Schwarzschild একটি সূত্র বের করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক কার্ল সুয়ার্সচাইল্ডের সূত্র দ্বারা নির্ণয় করা সূর্যের সুয়ার্সচাইল্ড ব্যাসার্ধ হলো প্রায় ৩ কিলোমিটারের মতো। অর্থাৎ আমরা যদি কোন উপায়ে সূর্যের ভেতরে অবস্থিত যাবতীয় পদার্থ সঙ্কুচিত করে সেইসব পদার্থ ৩ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ যুক্ত কোন বর্তুলকার গোলকের ভেতরে পুরে দিতে সফল হই তাহলে সূর্য পরিণত হবে কৃষ্ণ গহ্বরে। আবার পৃথিবীকে ব্ল্যাক হোলে পরিণত করতে গেলে পৃথিবীর যাবতীয় পদার্থ ৯ মিলিমিটার ব্যাসার্ধ যুক্ত কোন গোলকের মধ্যে পুরে ফেলতে হবে। বাস্তবে পৃথিবী বা সূর্যের সমস্ত পদার্থ এতো ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত করে রাখা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডে অবস্থিত একাধিক সুবিশাল নক্ষত্রের সুয়ার্সচাইল্ড ব্যাসার্ধ সূর্যের সুয়ার্সচাইল্ড ব্যাসার্ধের চেয়ে অনেকটাই বেশি হয় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন তাদের হাইড্রোজেন গ্যাস সহ অনান্য জ্বালানির পরিসমাপ্তি ঘটে তখন আর সেইসব তারকা গুলি নিজেদের আগের মতো তপ্ত বা গরম রাখতে পারে না। এর ফলে সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে আর তারকাগুলির যাবতীয় ভর আর পদার্থ সঙ্কুচিত হয়ে খুবই অল্প পরিসরের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে তারকা গুলিকে ব্ল্যাক হোলে পরিণত করে। মহাকাশ বিজ্ঞানের ভাষায় এই অতি স্বল্প পরিসরকে “সিঙ্গুলারিটি পয়েন্ট” নামে অভিহিত করা হয়েছে।

কৃষ্ণ গহ্বরকে চিহ্নিত করা হয় কিভাবে ?
========================
এই পর্যন্ত পাঠ করে এখন নিশ্চয়ই আপনাদের অনেকের মনের ভেতরে উদিত হয়েছে এক নতুন প্রশ্নের। কৃষ্ণ গহ্বর যদি আলোকেও গিলে ফেলে তাহলে বিজ্ঞানিরা কিভাবে সন্ধান পায় ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতির ? যার অনন্ত আর অফুরান ক্ষুধা থেকে রেহাই মেলে না আলোরও তাহলে কোন জাদুমন্ত্র বলে তাকে শনাক্ত করে পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা আবিষ্কৃত টেলিস্কোপ গুলি ?

যখনই কোন নক্ষত্র কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হয় তখনই তার ঘনত্ব অর্থাৎ “density” infinite অর্থাৎ অসীম হয়ে যায় আর এর ফলে সেই কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সংশ্লিষ্ট কৃষ্ণ গহ্বরটি এক রাক্ষস বা দৈত্যের ন্যায় তার নিকটে অবস্থিত যাবতীয় গ্রহাণুকে মুহূর্তের মধ্যে নিজের দিকে টেনে এনে গিলে ফেলে। এমনকি আলোর গতিরেখারও রেহাই মেলে না কৃষ্ণ গহ্বরের গ্রাস থেকে। কিন্তু তার মানেই এই নয় যে ব্ল্যাক হোলের নিকটে উপস্থিত যাবতীয় গ্রহাণু আর বস্তু কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণের টানে সোজা গিয়ে প্রবেশ করে ব্ল্যাক হোলের ভেতরে। ব্ল্যাক হোলের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সেইসব বস্তুগুলো ব্ল্যাক হোলের মাধ্যাকর্ষণের টানে এক চক্রাকার চাকির ন্যায় কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে এক বিশেষ কক্ষপথ সৃষ্ট করে তিরবেগে ঘুরতে থাকে। এইভাবে প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে একসময় গ্রহাণু আর অনান্য বস্তুরা প্রবেশ করে কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে। এই চক্রাকার চাকিকে বিজ্ঞানের ভাষায় অভিহিত করা হয় Accleration Disk নামে। যখন একসাথে অনেক গ্রহাণু বা বস্তু কোন কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে অবস্থিত এই Accleration Disk বলয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে তখন প্রবল ঘর্ষণ আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে তাদের মধ্যে প্রবল তাপের সৃষ্টি হয়। এই প্রবল তাপের কারনে সেইসব বস্তুগুলি থেকে নির্গত হয় এক ঘন আর অপার্থিব আলোকরশ্মি দ্যুতির বিকিরণ। এর ফলে ব্ল্যাক হোলের নিজস্ব কোন আলোকরেখা না থাকলেও (আলোকে পর্যন্ত গিলে ফেলে ব্ল্যাক হোল) এই আলোকরশ্মি দ্যুতির বিকিরণের সাহায্যেই অনেকটা দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত হ্যাবল বা অন্য কোন শক্তিশালী মহাকাশ দূরবীক্ষণ স্পেস টেলিস্কোপ থেকে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করেন কৃষ্ণ গহ্বরের উপস্থিতি। খ্রিষ্টোফার নোলানের সাইফাই চলচ্চিত্র “ইন্টারস্টেলার” এ এরকমই এক হতভাগ্য গ্রহকে গরগন্তুয়া কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে চক্কর খেতে দেখা গিয়েছিল। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই আলোক রশ্মির দ্যুতিকে কুয়াসার (Quasar) বলা হয়।

এই পর্যন্ত পড়ে অনেকে হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন যে যদি বস্তুগুলোর মধ্যে ঘর্ষণের ফলে আলোকরশ্মির দ্যুতি বিচ্ছুরিত না হতো তাহলে বিজ্ঞানীরা কিভাবে টের পেতেন ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতি ? এর উত্তর হলো মহাসাগরের বুকে কোন নৌকো বা জাহাজকে প্রবলবেগে ঘুরপাক খেতে খেতে কোন বিশেষ একটি দিকে প্রবাহিত হতে দেখে নাবিক বা মাল্লারা যেমন অতি সহজেই বুঝে যান সাগরের বুকে ঘূর্ণির উপস্থিতির কথা ঠিক তেমনি বিজ্ঞানীরাও তাঁদের টেলিস্কোপে যখনই মহাকাশে কোন একটি বিশেষ স্থানকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে অনবরতভাবে প্রবলবেগে ঘুরপাক খেতে দেখবেন কিছু গ্রহাণুকে তখনই তাঁরা বুঝে যাবেন এসব কিছু হচ্ছে সেই স্থানে উপস্থিত প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে আর একমাত্র কৃষ্ণ গহ্বরের দ্বারাই এহেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রাদুর্ভাব ঘটানো সম্ভব।

একটি কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে ঠিক কতকাল দেখা যেতে পারে আলোকরশ্মির দ্যুতি কুয়াসার (Quasar) ? 
মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতানুসারে যখন কোন নতুন নক্ষত্রপুঞ্জ বা ছায়াপথের (Galaxy) মধ্যে সৃষ্টি হয় কোন কৃষ্ণ গহ্বরের তখন ক্ষুণ্ণি বৃত্তির জন্য তার চারপাশে মজুদ থাকে প্রচুর পরিমাণে গ্রহাণু আর স্পেস ডেব্রিস। এছাড়া যখন কোন দুটি ভিন্ন ভিন্ন ছায়াপথের মধ্যে আচমকা সংঘর্ষ হয় তখনও অনেক গ্রহ আর নক্ষত্র টুকরো টুকরো হয়ে ব্ল্যাক হোলের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে। এর ফলে সৃষ্ট হয় অপার্থিব আলোকরশ্মির দ্যুতির বিকিরণ কুয়াসার (Quasar)। কিন্তু ছায়াপথ যত প্রাচীন হতে থাকে ততই শেষ হয়ে আসতে থাকে গ্রহাণু আর স্পেস ডেব্রিস বস্তুর সংখ্যা। যখন আর গিলবার মতো কোন বস্তু বা গ্রহাণু উপস্থিত থাকবে না ব্ল্যাক হোলের সম্মুখে তখন হয়তো আর দেখা যাবে না Quasar দ্যুতিও। মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতানুসারে একটি সর্ব বৃহতাকারের সুপার ম্যাসিভ কৃষ্ণ গহ্বর প্রতি বছর আমাদের সূর্যের ভরের সমান ওজনের বস্তু গলাধঃকরণ করে। এর ফলে এইসব সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল তাদের উত্তর আর দক্ষিণ মেরু দিয়ে প্রভূত পরিমাণে এনার্জি অর্থাৎ তেজ উদ্গিরণ করে। মহাকাশ বিজ্ঞানের ভাষায় এই পক্রিয়াকে কসমিক ইজেক্ট নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই কুয়াশার (Quasar) আলোকরশ্মি দ্যুতি বিকিরণকে অনেক মহাকাশ বিজ্ঞানী আবার নতুন ছায়াপথ সৃষ্টির প্রাথমিক পর্ব বলেও অভিহিত করেছেন।

কৃষ্ণ গহ্বর কয় প্রকার ?
==============
আকারগত দিক দিয়ে বিচার করে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণ গহ্বরকে মূলত তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকারের কৃষ্ণ গহ্বরকে Primordial black hole নামে অভিহিত করা হয়। মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতে বিগ ব্যাং মহা-বিস্ফোরণের পর পরই সৃষ্টি হয়েছিল Primordial black hole এর। Primordial black hole আকারে পরমাণুর ন্যায় ক্ষুদ্র হলেও তাদের ভর হিমালয় পর্বতের আকারের ন্যায় বিশাল হয়। মধ্যম আকারের কৃষ্ণ গহ্বরকে Stellar black hole নামে অভিহিত করা হয়। মহাকাশে সবচেয়ে অধিক পরিমাণে দর্শন মেলে এই Stellar black hole এরই। Stellar black hole এর ভর আমাদের সূর্যের ভরের থেকেও কুড়ি গুণ অধিক হয়। কিন্তু ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবার পর তাদের অভ্যন্তরের যাবতীয় পদার্থ মাত্র ১০ মাইল ব্যাসার্ধের বর্তুলকার গোলকের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে থেকে যায়। আবার কিছু কিছু কৃষ্ণ গহ্বর বিশাল আকারের হয়। এদের Super Massive black hole নামে অভিহিত করা হয়। আমাদের সূর্যের আকারের সাথে সাথে আরও দশ লক্ষ তাঁরার আকার একত্রিত হয়ে যতটা ভরের (Mass) সৃষ্টি হবে একটা সুপার ম্যাসিভ কৃষ্ণ গহ্বরের ভর ঠিক ততটাই। কিন্তু কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হবার পর এদের সমস্ত পদার্থ আমাদের সৌর মণ্ডলের ব্যাসরেখার সমান আয়তন যুক্ত বর্তুলকার গোলকের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে থেকে যায়।

মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতানুসারে প্রায় সমস্ত গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের কেন্দ্রস্থলে এরকমই এক সুপার ম্যাসিভ কৃষ্ণ গহ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে।
(পরবর্তী পর্বে আমরা জানবো ব্ল্যাক হোলের নানান অজানা রহস্য, কি হতো যদি আপনি ইন্টারস্টেলার মুভির মহাকাশচারী জোসেফ কুপারের মতো বাস্তবে পাড়ি জমাতেন ব্ল্যাক হোলের দিকে, ব্ল্যাক হোল কি চির অমর নাকি ধ্বংসযোগ্য আর আমাদের সূর্য কি কখনও রূপান্তরিত হতে পারে একটি ব্ল্যাক হোলে)
নিচের প্রথম চিত্রে শিল্পির কল্পনায় Primordial Blackhole, Stellar Blackhole আর Supermassive Sagittarius Blackhole
লেখক: বিরিঞ্চি বন্দ্যোপাধ্যায়।