Wednesday, December 30, 2020

সময় কি?

সময় কি? উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞায় সময় হচ্ছে জগতের অস্তিত্বের ক্রমাগত অগ্রগতি এবং ঘটনাবলির অপরিবর্তনীয় পারম্পার্য যা অতীত থেকে বর্তমানের মধ্যদিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। সময় হলো সেই জিনিস যা বিভিন্ন রকম পরিমাপের পরিমান, ঘটনাবলীর ক্রম, স্থিতিকালের তুলনা কিংবা পার্থক্য, বাস্তব পরিমানের পরিবর্তনের হার নির্ণয়ে সাহায্য করে। দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সময় দীর্ঘকাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ স্থান জুড়ে রয়েছে। এছাড়া আমাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম যেমন ব্যবসা, কলকারখানা, খেলাধুলা, পড়াশুনা, শিল্পকলা সবকিছুতেই সময়ের ভুমিকা রয়েছে। আমরা সময়ের মধ্যেই বেড়ে উঠি, সময়ের মধ্য দিয়েই চলি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সময় অঙ্গাঅঙ্গি জড়িয়ে রয়েছে। অথচ সময় আমাদের কাছে এক প্রহেলিকা। প্রাচীন যুগ থেকেই দার্শনিক, বিজ্ঞানী, ধর্মশাস্ত্রবিদেরা সময়ের প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা কিংবা বিতর্ক করে আসছেন। সভ্যতার দীর্ঘ পথচলায় মানুষ ক্রমশঃ  সময় নামক ধারনাটির রহস্য উন্মোচন করে চলেছে। তবুও সময় নামক এই প্রহেলিকাটিকে মানুষ পুরোপুরি করায়ত্ব করতে পারেনি। এখনো অনেক কিছুই জানার বাকী রয়েছে। 

আজকের এই পর্ব দিয়ে আমি সময় নিয়ে একটি লেখা শুরু করছি। আমার লেখাটি সময়ের দার্শনিক দিক নিয়ে শুরু হবে। এরপর ক্রমশঃ মনস্তাত্বিক, ধ্রুপদ পদার্থ বিজ্ঞান, কোয়ান্টাম পদার্থ বিজ্ঞান, বিশেষ ও সাধারন  আপেক্ষিকতায় সময়ের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো। সবশেষে সময়ের প্রবাহের দিক বা সময়ের তীর নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রয়েছে। চেষ্টা করবো সহজ বোধগম্য ভাষায় সবকিছু বর্ণনা করার।  আমার লেখাটি একটু দীর্ঘ (প্রায় ১৫/১৬ পর্বের) হতে পারে। চেষ্টা করবো প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি করে পর্ব লেখার। আশা করি আপনারা ধৈর্য্য নিয়ে পড়বেন। 

পর্ব ১ঃ সময়ের দর্শন

দর্শনের ইতিহাসে সময়।

একমাত্র মানুষ ছাড়া পৃথিবীর সব প্রানী শুধুমাত্র বর্তমান সময়ে বাস করে, তাদের চেতনায় অতীত কিংবা ভবিষ্যত বলে কিছু নাই। সময়ের ব্যাপারে আমাদের সচেতনতাই আমাদের অনন্যতা দিয়েছে এবং অন্য প্রানী থেকে গুরুত্বপূর্ন পার্থক্য দান করেছে। স্মরনাতীত কাল থেকে দার্শনিক, ধর্মতত্ববিদ, শিক্ষাগুরুরা সময়ের প্রকৃতি নিয়ে ভেবেছেন। সময় কি কোন পদার্থ? সময়ের অস্তিত্ব আমরা কিভাবে প্রমান করতে পারি? সময়ের কি কোন শুরু বা শেষ আছে? এটা কি সরল রৈখিক নাকি বৃত্তাকার?
সময়ের ধারাবাহিকতা (continuous) সম্পর্কে সব দার্শনিকেরা মনে করেন যে এর কোন থামা নাই, যা আছে তা শুধু একটানা একদিকে চলা, অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে। সময় যে একটি বস্তুগত (objective) ব্যাপার, বিষয়ী (subjective) নয়, এ নিয়েও দার্শনিকদের মোটামুটি ঐক্যমত্য রয়েছে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সকল ভৌত ঘটনা একটি সার্বজনীন  সময় কাঠামো মেনে চলে। পৃথিবীর আবর্তন থেকে ঘড়ির পেন্ডুলামের দোলন সবই একই সময়ের সাথে সমঞ্জস্যপূর্ন। এর পরেও অনেক শতাব্দী যাবত সময়ের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে বিতর্ক চলছে। 
প্রাচীন ভারত ও গ্রীস দর্শনে 'সময়'  ছিল অন্যতম আলোচনার বিষয়। প্রাচীন এসব দর্শনে সময় সম্পর্কিত অন্যতম বিতর্ক ছিল এটা সরল রৈখিক নাকি চক্রাকার। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট এর সময় আধুনিক দর্শনের শুরুতে পুরনো একটি প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়, সময় বাস্তব এবং পরম, নাকি মানব মননের বিমূর্ত একটি ধারনা যার সাহায্যে মানুষ ঘটনার ক্রম সংরক্ষন করে। সময় বাস্তব নাকি অবাস্তব এ নিয়ে অতি সম্প্রতি আধুনিক দর্শনে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এর সাথে আরো কিছু দার্শনিক সমস্যা সামনে চলে এসেছে। যেমন, সময় প্রসারিত হতে পারে কিনা, বর্তমান সময় কি বিশেষ মুহূর্ত নাকি চলমান ঘটনা, অতীত কিংবা ভবিষ্যতের সত্যিই কোন অস্তিত্ব আছে কি না, বস্তু কিভাবে সময়ে অবস্থান করে, ইত্যাদি। দর্শন থেকে বিজ্ঞান আলাদা হওয়ার পর আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার সময়ের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রতি নিয়ত নিত্য নতুন দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে চলেছে। 

প্রাচীন দর্শন

প্রধানত প্রাচীন ভারতীয় ও গ্রীস দার্শনিকেরা সময় সম্পর্কে মূল সত্য উদ্ঘাটনে চিন্তা ভাবনা করেছিলেন। এই সব অঞ্চলের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী এবং গল্পগাথায়  মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারনা গুলো ফুটে উঠেছে। গ্রীক পুরানে 'ক্রোনোস' (khronos) শব্দটি দিয়ে সময়কে একজন লম্বা সাদা দাড়ি ওয়ালা মানুষ (father time) রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ঋতুচক্র এবং সময়ের স্বাভাবিক প্রবাহের দেবীদের নাম Horae বা Hours। Geras ছিলেন বৃদ্ধ বয়সের দেবতা। মিশরীয় পৌরানিক কাহিনীতে Heh হলো চিরন্তন সময়,  Zurvan the Zoroastrian হচ্ছেন অসীম সময়ের দেবতা। Elli হলো নর্সদের বৃদ্ধ বয়সের দেবতা।

কালচক্র (Wheel of time)

খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে রচিত বেদ গ্রন্থে সময় কে অসংখ্য চক্রের সমাহার বা কালচক্র রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। গাড়ি চলার সময় এর চাকা যেমন কিছুক্ষন পর পর একটি ঘুর্ণন শেষ করে তেমনি প্রতি চক্রে মহাবিশ্ব একবার সৃষ্টি হয় এবং চক্রের শেষে ধংস হয়। আবার  নতুন চক্র সৃষ্টি হয়। আবার ধংস হয়। এটা চলছে অসীম সময় ধরে।  প্রতিটি চক্রের সময়কাল চার হাজার বছরের চেয়ে কিছু বেশী। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলেছে প্রতিটি মানুষের অসংখ্য বার জন্ম মৃত্যু। মানুষের পুনর্জন্মের এই বিশ্বাস হিন্দু, বৌদ্ধ, মায়া, পেরুর এবং আরিজোনার হোপি ইন্ডিয়ানদের ধর্মেও পাওয়া যায়। মনে করা হয়  দিন- রাত্রি, চাঁদের পুর্ণিমা-অমাবস্যা, জোয়ার-ভাটা, ঋতু চক্র প্রভৃতি প্রাকৃতিক চক্রের পর্যবেক্ষন থেকেই কালচক্র ও পুর্জন্মের ধারনা এসেছে। জুরাথ্রুস্টবাদে আমাদের চতুর্পার্শ্বের জগতকে দেখা হয় ভাল ও খারাপের যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে এবং সময় সেই যুদ্ধের স্থিতিকাল।
প্রাচীন গ্রীস- পারমেনিডেস ও জেনোর কূটাভাস (Zeno's Paradoxes)

প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা মহাবিশ্ব এবং সময়কে অসীম মনে করতেন। এদের কোন শুরু বা শেষ নাই। প্রাক সক্রেটিস পঞ্চম খৃষ্ট পুর্বাব্দের সোফিস্ট দার্শনিক এন্টিফেন এর মতে সময় কোন বাস্তবতা নয়, এটা একধরনের পরিমাপ কিংবা ধারনা মাত্র। অন্যদিকে তার সমসাময়িক গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস মনে করতেন সময়ের প্রবাহ বাস্তব। 
 
পারমেনিডেস এবং জেনো খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর  দুজন দার্শনিক ছিলেন ।  ইতালীর দক্ষিন প্রান্তে টিরেনিয়ান সাগর তীরে অবস্থিত Elea শহরের অধিবাসী ছিলেন তারা। পারমেনিডেস এর মতে বাস্তবতা পরিবর্তন ও সময় নিরেপেক্ষ। সময় এবং গতি সহ আমাদের দৈনন্দিন আরো অনেক অভিজ্ঞতাকে মনে করতেন এক ধরনের মায়া। পারমেনিডেস এর মতে অতীত এবং ভবিষ্যত দুটোই অবাস্তব এবং কাল্পনিক। বাস্তব হচ্ছে বর্তমান। দার্শনিক জেনো (Zeno of Ilea) ছিলেন পারমেনিডেসের ছাত্র। তার বিখ্যাত রচনা সমূহ জেনোর কূটাভাস (Zeno's paradoxes) নামে পরিচিত। ।  পারমেনিডেস এর দর্শনকে সমর্থন করে মূলত এগুলো তৈরী হয়। এদের সব চেয়ে বিখ্যাত হলো একিলিস এবং কচ্ছপ। এটা অনেকেরই জানা। প্যারাডক্সটি এরকম,  মনে করা যাক একদিন গ্রীক বীর একিলিসকে  একটি কচ্ছপ দৌড় প্রতিযোগীতায় চ্যালেঞ্জ জানালো। একিলিস সানন্দ চিত্তে রাজী হলেন। সাধারন ভাবে চিন্তা করলে সবাই বলবে একিলিস জিতবে। কিন্তু জেনোর মতে সেটা হবার নয়। তিনি যুক্তি দিলেন এরকম। একিলিস কচ্ছপের কিছুটা পেছনে থেকে  দৌড় শুরু করলেন। মনে করা যাক একশত মিটার। একিলিস যখন কচ্ছপের দৌড় শুরুর জায়গায় পৌছুলেন তখন কচ্ছপটি দশ মিটার সামনে এগিয়ে গেছে। কচ্ছপের এই নতুন স্থানে পৌছুতে একিলিসের আরো  সামান্য কিছু সময় লাগবে যে সময়ের মধ্যে কচ্ছপটি আরো সামান্য এগিয়ে যাবে। এভাবে একিলিস যতবারই কচ্ছপকে ধরার জন্য তার জায়গায় উপস্থিত হবে ততবারই কচ্ছপ সামান্য এগিয়ে থাকবে। এভাবে একিলিস ও কচ্ছপের মধ্যেকার দুরত্ব কমে আসবে। কিন্তু কখনো শুন্য হবে না কারন দুজনের মধ্যে অসীম সংখ্যক বিন্দু রয়েছে। সুতরাং অসীম বিন্দুকে অতিক্রম করতে একিলিসের অসীম সময়ের প্রয়োজন হবে। তাই একিলিসের পক্ষে কচ্ছপকে ধরা অসম্ভব এবং কচ্ছপই প্রতিযোগীতায় জিতবে। জেনো বলেন, "অসীম সংখ্যক জিনিসকে সসীম সময়ে অতিক্রম করা কখনোই সম্ভব নয়"। 

জেনোর এরকম আরো কিছু প্যারাডক্স রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো জেনোর প্যারাডক্সের সমাধান নিয়ে প্রাচীন যুগের দার্শনিক এরিস্টল, থমাস একুইনাস থেকে বর্তমান সময়ের হারম্যান ভাইল, নিক হাগেট, পিটার লিন্ডস, বার্ট্রান্ড রাসেল প্রমুখ  দার্শনিক, পদার্থ বিজ্ঞানী এবং গনিতবিদেরা চিন্তা ভাবনা করেছেন। কিন্তু কেউ নির্দিষ্ট সমাধান দিতে পারেন নাই। আবার অনেকের মতে জেনোর প্যারাডক্স দার্শনিক যুক্তির চমৎকারিত্ব, গানিতিক সমস্যা নয়।

খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রীক দার্শনিক প্লেটো বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর স্বর্গ সৃষ্টির মুহূর্তেই সময় সৃষ্টি করেছেন। তবে কিছুটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি সময়কে স্বর্গীয় বা মহাকাশের বস্তু সমূহের গতিবিধির সাথে সম্পর্কীত করেছেন। প্লেটো মহাবর্ষ (great year যে সময়ে পৃথিবীর মেরুঅক্ষ একটি ঘুর্ণন সম্পন্ন করে। ২৫,৮০০ বছরে এক মহাবর্ষ সম্পন্ন হয়।) সম্পর্কেও জ্ঞাত ছিলেন। পিথাগোরিয়ান এবং স্টয়িক দার্শনিকেরা বিশেষত ক্রিসিপাস মহাবর্ষকে সময়ের ধারক মনে করতেন। প্রতি মহাবর্ষ শুরুর সাথে সময়ের যাত্রা শুরু হয় এবং শেষের সাথে সময়ও শেষ হয়ে যায়। এভাবে অনন্তকাল ধরে অসংখ্য চক্রের পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে।

প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে সময় সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্তৃত ধারনা দিয়েছেন প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটল। তিনি সময়কে গতি বা movement এর ধর্ম মনে করতেন। অর্থাৎ সময়ের অস্তিত্ব জিনিসের গতির উপর নির্ভরশীল। তার মতে সময় হচ্ছে অবস্থানের ধারাবাহিক পরিবর্তনের পরিমাপ। তার কথায়, “neither does time exist without change”। তিনি এটাও মনে করতেন যে, সময় যেহেতু পরিবর্তনের পরিমাপ সেহেতু পরিবর্তন ছাড়া সময়ের অস্তিত্ব থাকে না এবং এই পরিবর্তন গননা করার জন্য একটি সচেতন সত্ত্বার উপস্থিতি আবশ্যক। তিনি সময়কে পরিবর্তনের পরিমাপ মনে করলেও পরিবর্তন ও সময়কে এক মনে করতেন না। কারন পরিবর্তন দ্রুত কিংবা ধীর হতে পারে। তিনি মনে করতেন মহাবিশ্ব সসীম কিন্তু সময় অসীম। মহাবিশ্বের অস্তিত্ব অসীম সময় ধরে রয়েছে এবং ভবিষ্যতে চিরদিন থাকবে। তিনি আরো মনে করতেন সময় একটি রেখার মত নিরবিচ্ছিন্ন এক রাশি। রেখার মতই সময়কে অসীম খন্ডে বিভক্ত করা সম্ভব। এর ক্ষুদ্রতম কোন একক নাই। 

এরিস্টটল সময় সম্পর্কিত একটি প্রচলিত প্যারাডক্স প্রথম উত্থাপন করেছিলেন। কয়েক শতক পর সেন্ট অগাস্টিন পুনরায় সেটা নিয়ে আলোচনায় এনেছিলেন। প্যারাডক্সটি হলো, যদি অতীত এক অস্তিত্বহীন স্মৃতি এবং ভবিষ্যত অনাগত কল্পনা হয় আর সময়ের এই দুই অংশ বর্তমান নামক মরীচিকা দিয়ে বিভক্ত হয় তাহলে সময়ের অস্তিত্ব কিভাবে সম্ভব?

পরবর্তী পর্বঃ ২
সময়ের দর্শনঃ মধ্য ও আধুনিক যুগ।