Sunday, March 20, 2022

বস্তুর ভরের সৃষ্টি হলো কেন এবং কিভাবে?

আপনাকে যদি কখনো জিজ্ঞেস করা হয় এই মহাবিশ্বে শুরু থেকে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কোনটি?
তখন এই প্রশ্নের উত্তরে আপনি কি বলবেন?
আপনি তখন নানান বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে থাকবেন! আপনার মনের মধ্যে এক গভীর চিন্তার জগৎ সৃষ্টি হবে। এই প্রশ্নে অনেকের উত্তর হয়তো ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কেউ বলবে আলোর সৃষ্টি কারণ আলোর সৃষ্টি না হলে আমরা কখনোই কোনো কিছু দেখতে পেতাম না, কেউ বলবে পরমাণুর সৃষ্টি কারণ পরমাণু সৃষ্টি না হলে আজকে কিছুই গঠিত হতো না, আবার কেউ বলবে নক্ষত্রের সৃষ্টি কারণ নক্ষত্রের সৃষ্টি না হলে আলো ও তাপের উৎপত্তি হতো না। আর আলো ও তাপ ছাড়া আমাদের অস্তিত্বও সম্ভব হতো না।
কিন্তু সত্য হলো এই যে মহাবিশ্বের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এই ঘটনাটি না ঘটলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই থাকতো না। আর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি হলো (Matter) বা বস্তুর ভরের সৃষ্টি হওয়া।

আমরা তো আকাশ-পাতাল অনেক কিছুর সৃষ্টি নিয়েই চিন্তা করি! যেমনঃ আলোর সৃষ্টি হলো কিভাবে? নক্ষত্রের জন্ম হলো কিভাবে, পদার্থের সৃষ্টি হলো কিভাবে? ইত্যাদি কিন্তু আমরা এটা কখনোই ভেবে দেখিনা সেসব সৃষ্টির মূলেই ছিলো মূলত ভর সৃষ্টির ঘটনাটা। আমাদের সকলেরই মনে হয় ভর বা বস্তু ব্যাপারটা হয়তো চিরকাল ধরেই ছিল। ভর যেহেতু শক্তিরই একটা রূপ সেহেতু শক্তির মতোই এর কোনো সৃষ্টি নেই এটার  কেবলমাত্র এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তর ঘটেছে। আমাদের এরকম চিন্তা ভাবনার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শক্তির এরকম রূপান্তরের ঘটনা প্রচুর দেখেছি এবং এখনও দেখছি প্রতিনিয়ত। আপনি নিশ্চয়ই এটা চিন্তা করছেন যে ভর সৃষ্টির ব্যাপারটি এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো কিভাবে? ভর সৃষ্টির বিষয়টি মহাবিশ্বের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হয়েছে এই কারণে যে কোনো কিছুর বস্তুরূপ না থাকলে এই মহাবিশ্বের কোনো কিছুই দৃশ্যমান হয়ে উঠত না। আর কোনো কিছু যদি দৃশ্যমান হয়ে ধরা না দিতো তাহলে কিছুই চোখে দেখা যেত না। আপনি আমি এবং আমাদের চারপাশের দৃশ্যমান জগতে যা কিছু আছে যেগুলো আপনি চোখে দেখতে পাচ্ছেন, সেগুলো দৃশ্যমান এই কারণে যে এদের ভর আছে অর্থাৎ বস্তুরূপ আছে।
আমরা সকলেই জানি যে আমাদের এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছিল বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে। এ তত্ত্বের দ্বারা আমরা জানতে পেরেছি যে আদি অবস্থায় আমাদের এই  পুরো মহাবিশ্বই এক অসীম ঘনত্বের এবং অসীম তাপমাত্রার বিন্দুবৎ অবস্থায় কেন্দ্রীভূত ছিল। এখন বলাই বাহুল্য যে কোনো স্থানে অসীম তাপমাত্রা থাকলে সেখানে কোনো প্রকার বস্তুর অস্তিত্ব থাকার প্রশ্নই উঠে না। অতএব নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তখন মহাবিশ্বের সবকিছুই ছিল শক্তিরূপে। এই মহাবিশ্বের অভ্যন্তরীন সবকিছুই শক্তির ভিন্ন ভিন্ন রূপ। আর শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষনীয় বিষয় হলো খোদ শক্তিকে কখনোই চাক্ষুষ দেখা যায় না কিন্তু একে অনুভব করা যায়। যেমনঃ আপনি যদি আগুনের ওপর হাত রাখেন তাহলে আপনার গরম লাগবে! আর আপনি খুব ভালো করেই জানেন যে এই গরম লাগার কারণ হচ্ছে " তাপ "। কিন্তু আপনি কি তাপকে চাক্ষুষ দেখেছেন? না। আপনি একে শুধু অনুভব করেছেন। আবার আপনি যখন ভূপৃষ্ঠ থেকে লাফ দিয়ে উপরে ওঠেন তখন আপনি নিশ্চয়ই অনুভব করেছেন কোনো এক অদৃশ্য বল আপনাকে পুনরায় টেনে ভূপৃষ্ঠে নামিয়ে আনে! আপনি জানেন যে পৃথিবীর মহাকর্ষ বা অভিকর্ষ বলের কারণেই এমন হচ্ছে। কিন্তু আপনি কি সেই অভিকর্ষ বলকে কখনো চোখে দেখেছেন? দেখননি কিন্তু একে অনুভব করেছেন। 
এখন অনেকেই হয়তো ভাবছেন আলোও তো একপ্রকারের শক্তি। তাহলে আলোকে তো আমরা দেখতে পাই! কিন্তু আপনার এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল কারণ খোদ আলোকে আমরা কখনোই দেখি না আমার শুধুমাত্র আলোর কতগুলো বৈশিষ্ট্যের ফলাফল দেখি। যেমনঃ আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ, বিকিরণ, বিচ্ছুরণ, ব্যতিচার, অপবর্তন ইত্যাদি। আলোকে আমরা দেখি না বরং আলোই আমাদের দেখতে সাহায্য করে। আলো কোনো বস্তুর ওপর পতিত হয়ে তার প্রতিফলিত রশ্মিটি যখন আমাদের চোখে এসে পৌঁছায় কেবল তখনই আমরা ওই বস্তুটিকে দেখতে পাই। কোনো প্রকার আলোক প্রতিফলন ব্যাতিত আমরা কোনো কিছুই দেখতে পাই না।

তাহলে উপরোক্ত বিষয় গুলো থেকে কি বোঝা গেলো? বোঝা গেলো এই যে মূল শক্তিকে কখনোই দেখা যায় না। অর্থাৎ কোনো কিছু যদি শক্তিরূপে থাকে তাহলে তা কখনোই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে না। যদিও নানাভাবে সেটি তার অস্তিত্বের জানান দেয়। কেবল সেগুলোই দেখা যায় যাদের ভর রয়েছে অর্থাৎ বস্তুরূপে। এই যে ভর তৈরি হয়েছে সেজন্যই মহাবিশ্বের কিছু কিছু জিনিস দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

এবার আসা যাক মূল আলোচনায় বস্তুর ভর কি? ও কিভাবে সৃষ্টি হলো?
প্রথমে জানবো বস্তুর ভর আসলে কি? বস্তুর ভর কি এই কথা জিজ্ঞেস করলে অনেকেই উত্তর দেবে যে বস্তুটি যেসকল কণা দ্বারা গঠিত তাদের মোট ভরের পরিমাণই বস্তুর ভর। কিন্তু আপনি মানেন বা না মানেন এই কথাটা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। এখন জিজ্ঞেস করবেন কেন সঠিক নয়? তাহলে চলুন এর ব্যাখ্যাই আগে দেওয়া যাক। 
• আমরা আমাদের চারপাশে যত দৃশ্যমান বস্তু দেখি যেমনঃ লোহা, কাঠ, ইট, পাথর, মাটি এবং জীব ও জড় এই সবকিছুই (Atom) বা পরমাণু নামক এক অতি ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠত। একটি পরমাণুকে ভাঙলে সাধারণত পাওয়া যাবে পরমাণুর কেন্দ্রে থাকা নিউক্লিয়াস ও নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার/উপবৃত্তাকার কক্ষপথে  প্রদক্ষিণরত ইলেকট্রন। আমরা জানি একটি নিউক্লিয়াসে আছে প্রোটন ও নিউট্রন। মোট কথা একটি পরমাণুকে ভাঙলে মোট তিন ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা পাওয়া যাবে প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন। প্রোটন ও নিউট্রনের সম্মিলিত ভর ইলেকট্রনের ভর থেকে অনেক অনেক গুন বেশি। একটি ইলেকট্রনের ভর প্রোটনের থেকে প্রায় 1837 গুন কম এবং একটা ইলেকট্রনের ভর একটি নিউট্রন থেকে প্রায় 1800 গুন কম। এজন্য পরমাণুর কেন্দ্রে থাকা নিউক্লিয়াসের ভরকেই পরমাণুর মূল ভর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন ও নিউট্রন কিন্তু প্রকৃতির একেবারে মৌলিক কণিকা নয়। এরা আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত। কিন্তু পূর্বে মোটেই এরকম ভাবা হতো না। আগে ভাবা হতো যে একটি পরমাণু কে ভাঙলে পাওয়া যাবে নিউক্লিয়াস আর নিউক্লিয়াসকে ভাঙলে পাওয়া যাবে দুটি সুক্ষ্ম মৌলিক কণিকা প্রোটন ও নিউট্রন। ব্যাস এর পর আর বিভাজন সম্ভব নয়! কিন্তু এরপর জানা গেলো এদেরকেও বিভাজন করা সম্ভব। এবং এরা আরো সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কণিকার সমন্বয়ে গঠিত। প্রোটন ও নিউট্রন এরা কোয়ার্ক (quarks) নামক আরো এক অতি সূক্ষ্ম কণার সমন্বয়ে গঠিত। একটি প্রোটনকে ভাঙলে দুটি আপ কোয়ার্ক (up quarks) ও একটি ডাউন (down quarks) কোয়ার্ক পাওয়া যাবে। অপরদিকে একটি নিউট্রনকে ভাঙলে দুটি ডাউন কোয়ার্ক ও একটি আপ কোয়ার্ক পাওয়া যাবে।
 • (Proton---[u≈u≈d])
 • (Neutron---[u≈d≈d])
কোয়ার্ক খুবই সূক্ষ্ম কণা যাদের ভর এখনও সঠিক ভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি।
একটি আপ কোয়ার্কের ভর ধরা হয় প্রায় ~ {(1.8-3.0) MeV/c^2}। একটি ডাউন কোয়ার্কের ভর ধরা হয় প্রায় ~ {(4.5-5.3) MeV/c^2}।
• এখন অনেকের মনে এই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে MeV/c^2 কি? এটা আসলে অতি সূক্ষ্ণ বস্তুর ভর নির্ণয়ের সমীকরণ।
• MeV/c^2 ----> [MegaElectron Volt / Light Speed^2]
(1 MegaElectron Volt / C^2 = 1.7827×10^–30 Kilogram)
 চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক একটা প্রোটনের মূল ভর কত? আগেই বলে নিচ্ছি কেউ কিন্তু সেন্সলেস হয়ে যাবেন না!
একটি প্রোটনের ভর হলো প্রায় 938.2720 MeV/c^2।
আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো এখন বলবেন ইয়ার্কি হচ্ছে নাকি? এটা কিভাবে সম্ভব? কারণ হিসাব অনুযায়ী একটি প্রোটনের ভর হওয়া উচিৎ তাকে গঠনকারী দুটি আপ কোয়ার্কের ও একটি ডাউন কোয়ার্কের ভরের যোগফলের সমান। অর্থাৎ {(2×3.0)+5.3} = 11.3 MeV/c^2।  তাহলে একটি প্রোটনের এই 926.9720 MeV/c^2 বাড়তি ভর এলো কোথায় থেকে?
অন্যদিকে এই একই কথা প্রযোজ্য একটি নিউট্রন কণিকার ক্ষেত্রেও। একটি নিউট্রন কণিকার ভর হলো 939.5656 MeV/c^2। এটাও যথেষ্ট অবাক করার মতো বিষয় তাই না? একটি নিউট্রনের ভর হওয়া উচিত ছিলো তাকে গঠনকারী দুটি ডাউন কোয়ার্ক ও একটি আপ কোয়ার্কের ভরের যোগফলের সমান। অর্থাৎ {(5.3×2)+3.0} = 13.6 MeV/c^2। নিউট্রনেরও এই 925.9656 MeV/c^2 বাড়তি ভর এলো কোথায় থেকে?

আসলে নিউক্লিয়াস অর্থাৎ প্রোটন ও নিউট্রনের ভরের মূল উৎস তাদের গঠনকারী আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্কের ভর নয়। প্রোটন ও নিউট্রন কণিকার মোট ভরের মাত্র 1% আসে তাদের গঠনকারী আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্কের ভর থেকে! আর নিউট্রন ও প্রোটনের ভরের 99 শতাংশই আসে এদের গঠনকারী কোয়ার্কগুলোর গতিশক্তি ও এদের মধ্যে ক্রিয়াশীল গ্লুওন ফিল্ডের (gluon field) বন্ধন শক্তি থেকে। আর এই বন্ধন শক্তিই মূলত আপ ও ডাউন কোয়ার্কগুলোকে একত্রে যুক্ত করে প্রোটন ও নিউট্রন কণা গঠন করে।
তাহলে এর থেকে বোঝা গেলো আমরা যে বিভিন্ন বস্তুর একেবারে সূক্ষ্ম ভর পরিমাণ করি তার 1% মাত্র তাকে গঠনকারী পদার্থের ভর আর বাকি 99% তাকে গঠনকারী অতিব সূক্ষ্ম কণা সমূহের গতি শক্তি ও গ্লুওন ফিল্ডের বন্ধন শক্তি যে বন্ধনের দ্বারাই সেই অতি সূক্ষ্ণ কণিকা গুলো পদার্থকে গঠন করে। তাই বলা যায় যে একটি বস্তুর মধ্যে নিহিত থাকা শক্তিই তার ভরের কারণ। ভর হচ্ছে একটা বস্তুর ভেতরে থাকা মোট শক্তির পরিমাপক মাত্র।
কিন্তু এখানে ভাববার বিষয় হচ্ছে, আমরা উপরোক্ত আলোচনা থেকে জেনেছি যে প্রোটন ও নিউট্রনের বেশিরভাগ ভরের কারণ তাদের গঠনকারী আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্কের গতি শক্তি ও গ্লুওন ফিল্ডের বন্ধন শক্তি। কিন্তু প্রোটন ও নিউট্রনের অভ্যন্তরে উৎপন্ন হওয়া শক্তির জন্য এদের অধিকাংশ ভর সৃষ্টি হওয়ার বাদেও এদের নিজস্ব কিছু ভর রয়েছে যে ভরের কারণ তাদের গঠনকারী আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্কের গতিশক্তি ও গ্লুওন ফিল্ডের বন্ধন শক্তি নয়। এই ভর তাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থাৎ এই ভরের কারণ কোনো শক্তি নয়। একটি প্রোটন কণিকার ভর প্রায় 938.2720 MeV/c^2। কিন্তু প্রোটন গঠনকারী দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্কের যৌথ ভর মাত্র 11.3 MeV/c^2 আর বাকি, 926.9720 MeV/c^2 হলো গতিশক্তি ও গ্লুওন ফিল্ডের বন্ধন শক্তি ফলে তৈরি হওয়া ভর। তাহলে এখান থেকে বোঝা গেলো একটি প্রোটন কণিকার নিজস্ব ভর প্রায় 11.3 MeV/c^2 আর বাদবাকি 926.9720 MeV/c^2 ভর হলো শক্তি। প্রশ্ন তাহলে প্রোটনের এই নিজস্ব ভর এলো কোথায় থেকে? একটি প্রোটনের মোট ভরের প্রায় 99% হলো শক্তি আর মাত্র 1% হলো কণিকা সমূহের নিজস্ব ভর। তাহলে কণিকা সমূহের এই 1% ভর এলো কোথায় থেকে? একটু গভীর ভাবে বলতে গেলে প্রোটন গঠনকারী সেই আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্কের নিজস্ব ভর এলো কোথায় থেকে? এই একই কথাগুলো কিন্তু একটি নিউট্রন কণিকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

ভর কি? ভরের চরিত্র কিরকম? সেটা বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা বহুকাল ধরে চেষ্টা করছেন। বস্তুর একটা বৈশিষ্ট্য হিসেবে ভরের চরিত্র বোঝার জন্য আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে একটি ধারণার উদ্ভব হয়েছিল। আর এই ধারণা অনুযায়ী ভরকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না কেবল রূপান্তর করা যায়। অর্থাৎ যেকোনো স্থানে যে কোনো অবস্থায় বস্তুর মোট ভর সব সময় একই থাকে। এই ধারণাটি ভরের নিত্যতা সূত্র হিসেবে পরিচিত। এদিকে আবার উনিশ শতকে উদ্ভব হলো শক্তির নিত্যতা সূত্রের। শক্তির নিত্যতা বা শক্তির সংরক্ষণশীলতার এই সূত্রমতে " শক্তিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না কেবল এক রূপ থেকে অন্য একটি রূপে রূপান্তর করা যায় কিন্তু এতে মোট শক্তির পরিমাণ সব সময় একই থাকে " এভাবে পূর্বে এই সূত্রগুলোর দ্বারা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে ভর ও শক্তির সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন দুটি বিষয়। কিন্তু বিশ শতকের গোড়ার দিকে আলবার্ট আইনস্টাইনের হাত ধরে এলো ভর-শক্তির সমতা সূত্র (Mass=Energy equivalence)। আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে তাঁর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের বিখ্যাত সূত্র E = mc2 প্রতিপাদন করেন। (এখানে, E= Energy বা শক্তি, M= Mass বস্তুর আপেক্ষিক ভর, আর C^2= Light Speed বা আলোর বেগ)। আর এই সূত্রের মূলকথা হলো—ভর আসলে আর কিছুই নয় এটা হচ্ছে একটা বস্তুর ভেতরে থাকা মোট শক্তির পরিমাপক মাত্র। আইনস্টাইনের এই সূত্রের দ্বারা শক্তির নিত্যতা সূত্রের বক্তব্যও পাল্টে গেলো। তখন বলা হলো শক্তিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা সম্ভব তবে শক্তিকে সৃষ্টি করতে হলে তার সমপরিমাণ ভর ধ্বংস করতে হবে। আর কোনো কারণে যদি শক্তি বিলীন হয়ে যায় তাহলে ভরের সৃষ্টি হবে। ভর সৃষ্টির এক অপূর্ব ব্যাখ্যা পাওয়া গেল আইনস্টাইনের এই কালজয়ী সূত্রের দ্বারা। তার মানে শক্তি থেকেই ভরের সৃষ্টি। আর সেজন্যই ভরসম্পন্ন বস্তুর ভেতরে সঞ্চিত থাকে বিপুল পরিমাণ শক্তি। এখন এই প্রশ্ন সামনে আসবে একটা কণার ভর আছে বুঝলাম কিন্তু ভরটা সে পেলো কোথায়? এবং কীভাবে পেলো?

এই প্রশ্নের সমাধান করতে, ১৯৬৪ সালে পিটার হিগস নামক এক ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ভরের উৎসের সন্ধানে এক নতুন ধারণা প্রবর্তন করেন। পিটার হিগস তখন " হিগস বোসন " নামে একটা কণার কথা বলেন। পিটার হিগস বলেন বস্তুর ভর সৃষ্টির জন্য এই কণাটিই দায়ী। (God Particles) বা " ঈশ্বর কণা " নামের যে কণাটির কথা আজকাল অহরহ শোনা যায়।

হিগস বোসন ঈশ্বর কণা নাম পেলো কিভাবে? বিখ্যাত পদার্থবিদ লিওন লেডারম্যানের জনপ্রিয় বিজ্ঞান বই (The God Particle: If the Universe Is the Answer, What Is the Question?) মূলত এই বইয়ের নাম থেকেই হিগস বোসন ঈশ্বর কণার নাম লাভ করে। এবার মূল আলোচনায় ফেরা যাক। হিগস বোসন নামের এই কণাটি খুঁজে পাওয়া ভারি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর এই কণার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বের যাবতীয় রহস্য। 
এবার জানবো হিগস বোসন নামের এই কণা আসলে কি এবং কেমন এই কণা? সহজভাবে বলতে গেলে মহাবিস্ফোরণের পর মহাবিশ্ব যখন দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছিল তখন সম্প্রসারণের সাথে সাথে মহাবিশ্ব তখন দ্রুত ঠান্ডাও হচ্ছিলো। আর মহাবিশ্বের তাপমাত্রা একটা নির্দিষ্ট মানের নিচে নেমে যাওয়ার পর একটা অদৃশ্য অথচ সর্বত্র পরিব্যাপ্ত ফিল্ড বা ক্ষেত্রের আবির্ভাব হয়, আর এই  ফিল্ডের নাম হিগস ফিল্ড। (উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ যেমন চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সৃষ্টি করে তেমনই হিগস বোসন হিগস ফিল্ড সৃষ্টি করে) আর এই ফিল্ডের সঙ্গেই যুক্ত কণাটির নামই হলো " হিগস বোসন "। হিগস বোসনের সঙ্গে যে কণাগুলো মিথস্ক্রিয়ায় (Interaction) লিপ্ত হয় তারা মিথস্ক্রিয়ার ফলে ভরপ্রাপ্ত হয়। যেমনঃ- প্রোটন, নিউট্রন, ইলেকট্রন ইত্যাদি। আর যেসব কণা মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়নি তারা ভর অর্জন করতে সক্ষম হয় না। যেমনঃ আলোর ফোটন কণিকা। আলোর ফোটন কণিকা হিগস বোসনের সঙ্গে কোনো প্রকার মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়নি বলেই সে ভর শূন্য। অর্থাৎ কোনো বস্তুকে ভরপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য হিগস বোসনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হতেই হবে। কোনো বস্তুর ভর অর্জনের জন্য হিগস বোসনের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়া আবশ্যক। যে বস্তু যত বেশি হিগস বোসনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করবে সে তত বেশি ভর অর্জন করবে! ১৯৬৪ সালে মূলত এই ধারণাটি প্রবর্তিত হলেও এই কণাটিকে ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত পরীক্ষাগারে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই বছর বিজ্ঞানীরা সেটি খুঁজে পাওয়ার ঘোষণা দেন। সে জন্য পিটার হিগস ২০১৩ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে কী দরকার ছিলো এই ভর সৃষ্টির? সবকিছু শক্তি রূপে ছিলো শক্তি রূপেই থাকতো! প্রশ্নকর্তার প্রশ্নটা যদি এমন হয় তাহলে এই প্রশ্নের উত্তরটি হয়তো তখন অধিবিদ্যার দিকে চলে যাবে। ভর সৃষ্টি না হলে যেহেতু কোনো কিছুরই দৃশ্যমান অস্তিত্ব ফুটে উঠতো না তাই হয়তো সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিকে আমাদের নিকট দৃশ্যমান করে তোলার জন্যই বস্তুর ভরের সৃষ্টি করেছেন।