Saturday, September 30, 2017

বাঙালি মুসলমানের পরিচয় সঙ্কট

লেখক: ঘুণপোকা
বাঙালি কি একই সাথে বাঙালি এবং মুসলিম? নাকি যে কোন একটা, নাকি উভয়ই তার পরিচয়? এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগাটা বাঙালি-মুসলমানের সবচেয়ে বড় সমস্যা। মনে হয় না পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোন জাতি আছে যারা এ ধরণের মনোজাগতিক সঙ্কটে ভোগে এবং এটা নিয়ে এতো বেশি আলোচনা হয়।
এই সঙ্কটের শেকড়টা যে খুব বেশী গভীর, তা কিন্তু নয়। মধ্যযুগ থেকেই এখানে মুসলিম ধর্মমত টিকে আছে, মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আছে। সঙ্কট তখনো ছিল, কিন্তু এখনকার মত এতো তীব্র নয়। এখানে একটা বিষয় পরিস্কার করা প্রয়োজন, বাঙালি মুসলিম হওয়ার আগে তার ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে জাতিসত্তার দ্বন্দ্ব ছিলনা, কারণ বাঙালির আদি ধর্মবিশ্বাসের গভীরে প্রোথিত ছিল তারই শত শত বছরের লালিত জীবনযাত্রার বিভিন্ন উপাদান। ধর্ম এখানে কখনো কখনো সংস্কৃতি হিসেবেই লালিত হয়েছে। কারণ বাঙালির প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস এবং সংস্কৃতি একই মাটি হতে উদ্ভুত। তাই এখানে ধর্ম এবং জাতিসত্তার পরিচয় কখনো মুখোমুখি দাঁড়ায়নি বরং পরিপূরক হিসেবেই পাশাপাশি এগিয়েছে।
যেহেতু এখানকার মানুষের জীবনাচরণ, সংস্কৃতি, জলবায়ুগত সুবিধা-অসুবিধা আরবের মরুচারীদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাই এই জলবায়ুতে বেড়ে ওঠা, এই মাটির সন্তানদের যাপিত জীবনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইসলামকে প্রবেশ করতে হয়েছে, টিকে থাকার প্রয়োজনে এখানকার ইসলাম প্রচারকদের নমনীয় হতে হয়েছে। মনে রাখা দরকার আরবের মুসলিমরা এখানে কিন্তু ব্যাপক আকারে মাইগ্রেট করেনি, হিন্দু কিংবা অন্যান্য ধর্মবিশ্বাস থেকে কনভার্ট করিয়ে আরবের মুসলিম দর্শন এখানে গেলানো হয়েছে। ইসলাম এবং আরব সংস্কৃতিও যেহেতু একই মাটি হতে উদ্ভূত এবং ইসলামে যা কিছু নিয়ম-কানুন তার প্রায় সব কিছুই আরব সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে, তাই আরবের ইসলাম মোটেই বিশ্বায়নের যোগ্য ছিল না; বিশেষকরে উপমহাদেশের মত এলাকায় । তাই এই অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সুফি ঘারানার যে সকল মুসলিম সাধক এসেছিলেন, তারাও এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই কাজ করেছিলেন। তাদের মরমী সুফি দর্শনের সাথে এখানকার মানুষের উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মিলে যায় বলেই তারা এখানে ধর্ম প্রচারে সফল হয়েছেন।
পাশাপাশি যেহেতু আরব অঞ্চলের সাথে আমাদের ভৌগলিক দূরত্ব অনেক বেশি তাই এখানকার হিন্দু বা বৌদ্ধদের কিন্তু কোরআন-হাদিস পড়ে কিংবা কাবা-রওজা দেখে ভক্তিতে বা বিশ্বাসে গদগদ হয়ে মুসলিম হওয়ার সুযোগ ছিল না এবং যেহেতু আরবি ভাষা যেহেতু এখানকার মানুষের ভাষা নয়, তাই সে ভাষার ধর্মগ্রন্থ পড়ে-বুঝে ঈমান আনাও সহজ ছিলনা। অর্থাৎ ইসলাম-আল্লাহ-নবীদের বিভিন্ন কেরামতি এই বিষয়গুলো সুফি-দরবেশদের মুখে মুখে বিভিন্ন কেচ্ছা-কাহিনি হিসেবে বর্ণিত হয়েই এখানে ইসলামে ঢুকেছে। সেই কেচ্ছা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তাদের স্থানীয় কিছু উপাদানও যোগ করতে হয়েছে। খোয়াজ-খিজির, কারবালার কাহিনি এখানকার ফ্লেভার মিশিয়ে পরিবেশিত হয়েছে, মানুষ গ্রহণ করেছে। তারা জাতপাতহীন উদার মানবিকতার গল্প শুনিয়েছেন, সেটাও মানুষ গ্রহণ করেছে। শুধু দোজখের ভয় বা বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে অমুসলিমদের আকৃষ্ট করা সম্ভব ছিল না, তাই এসব কেচ্ছা-কাহিনি আর উদার জীবনযাত্রার কথাই মানুষকে আগ্রহী করেছে।
এর ফলেই আস্তে আস্তে সৃষ্টি হয়েছে একধরণের সমন্বয়। মনে রাখতে হবে এখানকার নিন্মবর্ণের হিন্দুরা কিন্তু বর্ণবাদ কিংবা ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে মুক্তি চেয়েছে বলে ইসলামে এসেছে, কেউ কেউ অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার আশায় নিজের আদি ধর্ম ছেড়েছে, তাদের সংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে মুক্তি চাইতে কিন্তু নয়। বহু শতাব্দী থেকে এখানে আর্য-অনার্য আচার-সংস্কৃতি লালন করেছে সাধারণ মানুষ, ফলে হাজার মাইল দূরের ধর্মবিশ্বাস, জীবনযাত্রা গ্রহণ করা তাদের পক্ষে মোটেই সহজ ছিল না। এর ফলে আমরা দেখেতে পাই মাজার-খানকাভিত্তিক একধরণের প্রতিষ্ঠান, যেখানে সকল ধর্মের মানুষের অবাধ যাতায়াত। অন্যদিকে মনসা-সরস্বতী সহ বিভিন্ন পুজায় মুসলিমদের অবাধ অংশগ্রহণ। এই সমন্বয়ের ফলে ইসলাম ধর্ম এই জলবায়ুতে এক ভিন্ন রূপে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়, যাকে বর্তমান কট্টরপন্থী সালাফি-ওহাবিরা আসল ইসলাম বলে মানতে নারাজ।
এই সমন্বয়বাদী উদারপন্থী ইসলামের উপর নতুন করে তাহলে চরমপন্থার প্রলেপ পড়ল কিভাবে? এই সঙ্কট যে শুরু থেকেই ছিল না তা কিন্তু নয়, তবে এই অঞ্চলে মৌলবাদী ইসলামের প্রসার ঘটে আঠারো শতকের দিকে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের সুযোগে, যাতে প্রভাব ছিল ওহাবী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহহাব (১৭০৩-১৭৯২ খ্রি.)। ওহাবী মতবাদে বিশ্বাসীদের মতে ‘সে যুগে যে ব্যাপকভাবে পীরপূজা, গোরপূজা, ব্যক্তিপূজা শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং তুর্কী সুলতানরা ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে সরে যেভাবে আয়েশী রাজা-বাদশাহর জীবন যাত্রা শুরু করেছিলেন।’ ফলে মুসলিমদের এ ধরণের ‘বেদাতি কাজ’ থেকে বাঁচানোর জন্য হাজী শরিয়তুল্লাহ এবং তিতুমীর সহ অনেক সমাজ সংস্কারকদের হাত ধরে মৌলবাদীরা এখানে শিকড় গেড়ে বসে।
হাজী শরিয়তউল্লাহ ১৭৯৯ সালে হজ পালনে মক্কায় যান এবং ১৮১৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি ওহাবী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত এবং দীক্ষিত হন, দেশে ফিরে তিনি ওহাবী আন্দোলনের অনুরূপ ইসলামি সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। যা পরবর্তীকালে ফরায়েজী আন্দোলন নামে পরিচিতি পায়। এখানকার সমন্বয়বাদী দর্শনের প্রবল বিরোধিতা করেন শরিয়তুল্লাহ। ‘হেদায়া’তে উল্লিখিত মুসলিম আলেমদের শরীয়া অনুসারে তিনি ব্রিটিশ ভারতকে ‘দারুল হারব’ (শত্রুরাষ্ট্র) হিসেবে ঘোষণা দেন। ফলে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে এখানকার মুসলিমরা। একদিকে তাদের ধর্মবিশ্বাস অন্যদিকে হাজার বছরে লালিত সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ফলে স্পষ্টতই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে মুসলিম সমাজ।
এই বিভাজন চূড়ান্ত রূপ নেয় ব্রিটিশ শাসনের শেষদিকে। ভাষা, খাদ্যভ্যাস, সংস্কৃতি সহ কোন মিল না থাকা সত্ত্বেও যখন শুধুমাত্র ধর্মের খাতিরে হাজার মাইল ব্যবধানে থাকা দুটি ভূখণ্ডকে এক করে একটি অদ্ভুত রাষ্ট্র জন্ম নেয়; পাকিস্তান। একদিকে পাকিস্তানী শাসকদের এই বাঙলায় সাংস্কৃতিক দমন-পীড়ন, অপরদিকে ওহাবী-মউদুদিবাদের প্রসারে ক্ষত-বিক্ষত বাঙলা তেইশ বছর পর যখন নিজস্ব রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেল, ততদিনে বাঙালির নিজস্ব স্বকীয়তা যেটুকু ছিল সেটাও বিপন্ন হয়ে পড়ে। যদিও বাহাত্তরের সংবিধানে জোড়াতালি দিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদকে দমনের চেষ্টা করা হয়েছিল সেটাও সফল হয়নি।
এই মৌলবাদী ইসলামের পাশাপাশি এই ভূখণ্ডে উদার মতবাদে বিশ্বাসীদের অবস্থানও ছিল। চিরায়ত বাউল-সহজিয়াদের পাশাপাশি পীর-দরবেশ, সূফী-মাজারপন্থীগণও তাঁদের দর্শন প্রচার করে গেছেন। সমস্যাটা হয়েছে আসলে এখানেই। বাঙালি কি শুধুই ‘বাঙালি’, নাকি ‘মুসলিম’, নাকি দুটোর সমন্বয়?
সালাফি মোল্লা ঘোষণা দেয় গান হারাম, বাজনা হারাম, ছবি তোলা হারাম, ছবি, পহেলা বৈশাখ হারাম, মঙ্গল শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ, ভাস্কর্য রাখা যাবে না, নারীর ঘরের বাইরে যাওয়া হারাম, চাকরি করা হারাম, হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ বুকিশ ইসলাম। ধর্মীয় বইয়ে যা লেখা আছে অক্ষরে অক্ষরে সেটা মানা এবং অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। অন্য অর্থে দেড় হাজার বছর আগেকার আরব্য সংস্কৃতি আনকোরা টিকিয়ে রাখা। একদিন দুইদিন না, বছরের পর বছর ওয়াজ-মাহফিল, জুমার খুতবায়, আলোচনা অনুষ্ঠানে ‘হিন্দুয়ানি’ নাম দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলে গেছে ওহাবি মোল্লারা। কেউ বাধা দেয়নি।
অবস্থাটা এমন জায়গায় গেছে যে কেউ মুসলিম হলে সে আর বাঙালি হতে পারে না, আর বাঙালি সংস্কৃতি চর্চাকারী কখনো ‘সহিহ মুসলিম’ হতে পারে না। এসব প্রচার-প্রচারণার ফলাফল এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনেই। এমন একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে যারা না হতে পেরেছে আরবি মুসলিম, না হতে পেরেছে বাঙালি। শেষ কথা হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক অভীপ্সা পূরণের লক্ষ্যেই সংঘটিত হয়নি বরং বাঙালির স্বকীয় সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যেও পরিচালিত হয়েছে। সেই লক্ষ্য থেকে যত দূরে সরে যাবে, বাঙালির এই সঙ্কট ততবেশি ঘনীভূত হবে বলেই আশঙ্কা করি।

Sunday, September 17, 2017

জানি না আমরা সভ্য হচ্ছি কি না...তবে মনুষ্যত্ব হারাচ্ছি এটা সত্য......।

বুলবুল আহম্মেদ জয়,    
মানুষের মধ্যে পশুবৃত্তি আছে বলে সে ধর্ষণ করে- এই উত্তরটাকে আমার কাছে যথার্থ এবং যথেষ্ট মনে হয় না, খুবই ভাসাভাসা কথা, কথাটার মাঝে চিন্তাভাবনার অভাব আছে। যদি তাই হত, তাহলে এই একুশ শতকে হঠাৎ করে পুরো বিশ্বে পশুর সংখ্যা বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে কোন কারণ ছাড়া কেন বেড়ে গেল- এটা বোঝা বড়ই দায়।
যদি বলা হয়, অশালীন পোষাকই দায়ী, তাহলে ধর্ষক কিছুটা জাস্টিফিকেশন পেয়ে যায়। আবার যদি বলা হয়, “অশালীন পোষাক দায়ী নয়”, সেক্ষেত্রেও মনে হওয়ার কথা, “মানুষ কি ধ্বজ নাকি?”।
বিবর্তনবাদী নাস্তিকরা অবশ্য ব্যাপারটা কে অন্যভাবে দেখছে। তারা বলে মানুষ হল অন্য পশুর মতই পশু, যার বিবর্তনটা একটু বেশি হয়েছে, এই। “ধর্ষন একটা ন্যাচারাল ব্যাপার”- এই কথাটা সর্বপ্রথম প্রচার করে বিবর্তনবাদীরা, যেটা আসলে ধর্ষককে চুপেসারে একধরণের ধর্ষণের লাইসেন্সই দেয় !
"মন বলে তো কিছু নেই, সবই DNA এর খেলা !"
DNA তে নাকি ধর্ষণের জিন ছিল, ধর্ষকের কি করা !
আচ্ছা আমরা কি চিন্তা করেছি মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য কি ? অবশ্যই এটা লেজ নয়, পার্থক্যটা হল মানুষ চিন্তা(thinking) করতে পারে, তার মন(mind) আছে, পশু চিন্তা করতে পারে না, কারণ তার মন নাই। আর মিলটা হল, মানুষ এবং পশু উভয়ের কিছু প্রবৃত্তি(instinct) আছে, যেমন- survival instinct, procreation বা sexual instinct) ইত্যাদি।
সেক্সুয়াল ইন্সটিংট স্যাটিসফ্যাকশন খুজবে তখনই যখন তাকে বাহ্যিকভাবে উত্তেজিত (external stimulation) করা হয়, তা না হলে নয়। স্যাটিসফ্যাকশন না হলে একটা মানুষ অস্বস্তি এবং টেনশন বোধ করবে, মারা যাবে না, তবে স্যাটিসফাই করার পথ খুজতে থাকবে।
পশ্চিমা সমাজে আমরা দেখি এই ধরণের যৌনতা উদ্দীপক জিনিষের ব্যাপক ছড়াছড়ি। সেটা রাস্তার বিলবোর্ড থেকে শুরু করে লাস ভেগাসের বিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের গল্পে-কবিতা-সাহিত্য-মুভিতে অবাধ যৌনতার বিশাল সমারোহ। যেমন একনের একটা গান আছে।
“I wanna fuck you”।
তার আরেকটা গান আছে,
“I had just sex”.
মুন্নির বদনাম আর শিলার যৌবন তো আছেই! আছে স্পার্টাকাস।
বাস্তব জগতে আমরা আমাদের পাশের বাসার মেয়েটিকে দেখি তার আকর্ষনীয় দেহটাকে ফোকাস করে ঘুরে বেড়াতে।
আচ্ছা, সে চায়টা কি ? আমি দেখব আর সে দেখাতে চায়, তাই তো !
নাকি আবার অন্য কিছু আছে এটার মধ্যে! আমরা দেখি, আর সবাইকে ডেকে দেখাই, সেও খুশি হয়, তাই না?
আর আমাদেরকে তো কে যেন শিখিয়েই দিয়েছে, “চুমকী চলেছে একা পথে”, তার সঙ্গী হতে চাওয়াটা মোটেও দোষের কিছু না।
নকশা আমাদেরকে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করিয়ে দেয় ঠিক কতটুকু চিপা জিন্স হলে একটা মেয়েকে সবচেয়ে যৌনাবেদনময়ী দেখাবে।
তারা শিখিয়ে দেয় ওড়না পরে নিজের শরীর ঢেকে রাখার কোন প্রয়োজন নেই, কারণ, সে বিশ্বাস করে, “নারী, মূল্য তোমার শরীরে, মূল্য তোমার শরীরের কুঞ্চনে !”
মম আর বিন্দুদের দিকে তাকিয়ে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টারে জনৈক বুদ্ধিজীবি বলেন, “তোমার মধ্যে যৌবনের ভারি অভাব”, আর মেয়েটি তাতে মন খারাপ করে নিজেকে আরও যৌবনা হয়ে পুরূষের চোখে সুশোভিত হয়ে ধরা দিতে চায়।
আমেরিকান পাই থেকে আমরা শিখতে শুরু করি স্কুল লাইফের আগেই একটা মেয়েকে ধরে সবকিছু করে ফেলতে হবে, নয়তো আমরা “ব্যাকডেটেড”। আমরা দেখি টারজানকে নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াতে, দেখি সিন্ডারেলাকে রাত-বিরাতে পার্টিতে যেতে।
ছেলেরা যখন মেয়েদেরকে “slave” হিসেবে দেখতে শেখে তখন মেয়েরা শেখে শিলা হতে হবে, তাতে যৌবনজ্বালায় বিকারগ্রস্ত ছেলেদের চড়কির মত ঘোড়ানো যাবে। তারা শেখে পার্লারে গিয়ে কি সব পেডিকিউর মেনিকিউর না করলে নাকি স্ট্যাটাস থাকে না। তারা শেখে বড় মডেল কিংবা অভিনেত্রী হওয়ার জন্য নিজের চরিত্রকে ফটোগ্রাফার কিংবা প্রডিউসারের কাছে নিজের চরিত্র বিকিয়ে দেয়া দোষের কিছু না। তারা সানন্দা টাইপের ম্যাগাজিনগুলো বিমুগ্ধ নয়নে পড়তে থাকে আর বুঝে ফেলে শরীর দেখিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার মূলমন্ত্র। তারা হিন্দী সিরিয়াল দেখে আবিষ্কার করে নিজেকে সাজিয়ে রাখা হল স্মার্ট মেয়েদের কাজ !
এই যদি আমরা শিখি, আমরা কিভাবে আশা করতে পারি একটা ছেলে একটা মেয়েকে সম্মান করবে ? সম্মান অর্জন করা যায় শরীর দেখিয়ে? সৌন্দর্য দিয়ে ? সেক্সি মেয়ে দেখলে আমাদের চোখ বিনয়ে নুয়ে পড়ে নাকি কি যেন খুজে বেড়ায় ? একটা মেয়ে কি গায়ের উপর থেকে ওড়না ফেলে দিয়ে আশা করে তার দাম বাড়বে ? আজকে যে ছেলেটা জন্ম নিয়েছে সে শরীর নাচিয়ে কুদিয়ে বেড়ানো মিলার মিউজিক ভিডিও দেখে কি ভাববে সেটা কি আমরা চিন্তা করেছি ???
এরকম সেক্সুয়ালি স্টিমুলেটেড সমাজেই গড়ে ওঠে পরিমলরা, তাদের উদ্দেশ্য হয় ভোগ, তাই তাদের সামনে যখন এসে পড়ে কোন ছাত্রী, তাদের ড্রেসআপ শালীন হোক আর অশালীন হোক, তার মাথা চাড়া দেয় জন্মের পর থেকে তার চারপাশ থেকেই শিখে আসা নোংরামিগুলো। পরিমলের মনের এই নোংরামি সে মূহুর্তে সৃষ্টি হয় নি, এটা বছরের পর বছর লক্ষ লক্ষ মূহুর্তে শিখে আসা অনেকগুলো ঘটনা থেকে গড়ে ওঠা দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফল, সে ছাত্রী হয়ত শুধু এইসবে সামান্য নাড়া দিয়েছে।
পরিমলের চিন্তা নষ্ট হয়েছে বহু আগেই, এই সমাজেরই হাতে।
আজকাল সমাজে সবকিছুই ফ্যাশন। কেবল দামি মোবাইল, পোশাকেই এ ফ্যাশন সীমাবদ্ধ নয়, মানুষের প্রেম, ভালবাসা, আবেগ অনুভুতি নিয়েও ফ্যাশন চলছে।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে মেয়ে থেকে শুরু করে চাকুরীজীবী বিবাহিত অবিবাহিত সবাই এ ফ্যাশান এর পিছে ছুটছে। কয়েকটা গার্ল ফ্রেন্ড, বয় ফ্রেন্ড নিয়ে চলাটাই এখন ফ্যাশন।
... প্রেম নামক সাইনবোর্ড ঝোলানো এ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। আজ যে মেয়ে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ফেসবুক এ গ্রুপ পেজ 'আই হেইট দা বয়েজ' কাল সেই রিলেশনশিপ 'সিঙ্গেল' পালটে করে দেয় 'এনগেজড' ।
আর যে ছেলে আজ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে দেবদাস সাজে কাল সেই রোমিও হয়ে নতুন গার্লফ্রেন্ড এর প্রশংসায় মুখর হয়ে ওঠে। এমন ফ্যাশনপ্রেমীদের আবার বিয়েতে চরম আপত্তি "বিয়ে মানেই ত বন্দি জীবন"। বিয়ে নিয়ে তেমন তাড়াহুড়া না থাকলেও প্রেমের ক্ষেত্রে চরম তাড়াহুড়া "এখনও কাউকে পেলাম না!!"। মানুষের বিশ্বাস এখন এক টাকার বেলুনের মত তুচ্ছ খেলনার বস্তু।যেমন খুশি খেলা যায়।
অনেক মা বাবাই জানতে পারেন না তার আদরের অবুঝ ছেলে বা মেয়েটি কত বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। কেবল স্মার্ট, ফ্যাশনেবল তরুন তরুনীই নয়, ভদ্রবেশি, ধার্মিক লেবাসধারী মানুষও এ ফ্যাশনের প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পরতে চায় না।প্রেমের নামে চলছে অবাধ ব্যভিচার, চরিত্রহীনতা আর লাম্পট্য !

এই সবের মোটামুটি এক-ধরনের শেষ পরিনিতি হল অসময়ে প্রেগনেন্ট......যার ফলে অনাগত সন্তানটি দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে ভেবে ভ্রুণটি/সন্তানটি হত্যার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যদি ভ্রুণটি পৃথিবীতে আসতো তবে তাকে হত্যা করাটা কি এতটা সহজ হত?
চোখের আড়ালে, আধারে ঘটে যাওয়া এমন অনেক ঘটনার স্বাক্ষী অনেকে থাকে না;কিন্তু জানে অনেকেই।মানুষগুলো কত স্বাভাবিকভাবেই না নির্মম হয়!
একটি সন্তান-একটি মানুষ।
নিজেদের খারাপ ও অনৈতিক কাজের মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য অসুস্থ সমাজের জন্ম দিচ্ছি!!
জানি না আমরা সভ্য হচ্ছি কি না...তবে মনুষ্যত্ব হারাচ্ছি এটা সত্য।

অন্ধজনের রূপকথা

যা কিছু দৃশ্যমান, সবই এক প্রকার বিজ্ঞাপন। নিচে বোল্ড টাইপে ছাপা বহু শর্তে প্রস্তাবিত বিজ্ঞাপন-অন্ধ আফসানা মাহমুদের সেবিকাপ্রার্থীর জন্য। অন্ধজনের বেঁচে থাকার ঐশ্বর্য আর দারিদ্র্য- সব যাপনে যুদ্ধ করে নিরন্তর।
আবশ্যক : একজন সেবিকা প্রয়োজন। সন্তানহীনা। বিধবা। ভালো উচ্চারণে বাংলা বই, খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিন পড়া এবং ধৈর্যসহ কথা শুনতে এবং প্রয়োজনে বলতে হবে। অনেক প্রশ্ন শোনার মানসিকতাসহ টিভি, এবং কখনো কখনো পুরনো দিনের বাংলা সিনেমা দেখার জন্য বিশেষ ধৈর্য থাকা জরুরি। রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা বোঝা ও মতামত রাখতে পারাটা বিশেষ যোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে।
বাড়ির মানুষ যা খায়, সেবিকার জন্যও তা-ই। নিয়মিত ভালো কাপড়চোপড় পাবে। বাসার অন্য কোনো কাজ করতে হবে না। বাড়ি কুষ্টিয়া, পাবনা, যশোর, টাঙ্গাইল ও বগুড়া হলে ভালো হয়। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন পার্কে হাঁটতে হতে পারে। নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের অনুসারী হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়, নিজের ধর্মাচার যদি পালন করতে চায়, পারবে।
একজন ৬৫+ বছর বয়স্ক শিক্ষিত মহিলার সঙ্গে থাকতে হবে রাতদিন, তাঁর অন্যান্য কাজ সেবিকাকে করতে হবে না এবং প্রয়োজনে কখনো কখনো কঙ্বাজারে সমুদ্রতীরে যেতে হতে পারে। সেবিকার নিকটতম আত্মীয়রা মাসে একবার সারা দিন তার সঙ্গে থাকতে পারবে এবং বছরে একটি বড় উৎসবের জন্য পাবে সাত দিন ছুটি, ঈদ বা পূজার।
নিম্নতম শিক্ষাগত যোগ্যতা একাদশ শ্রেণি। দরখাস্তের সঙ্গে দিতে হবে লেখাপড়ার সত্যায়িত সার্টিফিকেট, দুই কপি সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের ছবি, ন্যাশনাল আইডি কার্ডের সত্যায়িত ফটোকপি, রেজিস্টার্ড এমবিবিএস ডাক্তারের দেওয়া হেলথ সার্টিফিকেট। যাদের হাঁপানি, কাশি, মধুমেহ, নাকডাকা, উচ্চ রক্তচাপ, তোতলামি ও মুখে গন্ধ আছে, তাদের দরখাস্ত করার দরকার নেই। বয়স ৪৫-৫০-এর মধ্যে। বেতন আট হাজার টাকা। প্রতি বছর শেষে বেতন ২০০০ টাকা বৃদ্ধি পাবে। এবং প্রতি মাসে ২০০ টাকা কলখরচসহ একটি মোবাইল ফোন দেওয়া হবে। আবেদনের শেষ তারিখ ১২.০৬.২০১৩ ইং। এএফএম, পোস্ট বঙ্ : ০০৮৭৬৫৪।
সেবিকার চাকরি পাওয়ার পর আমরা তাকে কখনো বলব রোকেয়া, কখনো আফসানা মাহমুদের সেবিকা।
সব অন্ধজনের চোখের সামনে অন্ধকার এবং স্মৃতিলব্ধ সত্য ও মিথ্যার বাস্তবতা ছাড়া সব কিছু অন্যনির্ভর। 'নির্ভরতা ছাড়া কে বাঁচতে পারে? আপনি কী বলেন?' ভবিষ্যতের সঙ্গী রোকেয়ার ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় আফসানা মাহমুদ জিজ্ঞেস করেন এবং উত্তরের অপেক্ষা না করেই শান্ত স্বরে যেন একটি মূল্যবান কথা, 'প্রকৃতিচক্র দেখলেই সাদা পাতায় ওই প্রশ্নের উত্তর, প্রশিক্ষণ পাওয়া একটি বানরও লিখতে পারে', তিনি বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর কথার গভীর অর্থ ইন্টারভিউয়ের সময় রোকেয়া বুঝতে পারেনি। ভদ্রমহিলার চোখে ছিল কালো চশমা, ফলে কথা বলার সময় মানুষের চোখে যে ভাব প্রকাশিত হয়, ভাবের থাকে অনেক রূপ, তা দেখতে পায়নি রোকেয়া; এবং ইন্টারভিউয়ের মাঝখানে তিনি না বললে রোকেয়া বুঝতে পারত না, তার হতে পারে নিয়োগকর্ত্রী অন্ধ। বুঝতে পারলে কি রোকেয়া চাকরি পাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিত? মনে হয় না। মামার বাড়িতে থাকার কষ্ট দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। নিজেকে প্রায় সব সময় মনে হতে থাকে বাড়তি মানুষ। রোকেয়া বেশ ভালোভাবেই বোঝে, অন্ধজনের মনে সব সময় একটা কিছু হারানোর ভয় থাকে, ফলে একটু বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অন্ধরা কথা বলে, আচরণ করে। আচরণ বড় বিচিত্র চরিত্র-প্রকাশ। রোকেয়াদের গ্রামের সবচেয়ে সুদর্শন তরুণ সূর্য ছিল অন্ধ। কী বিচিত্র সব কথা বলত, আচরণ করত! কোনো দিন কারো সঙ্গে অসভ্যতা করেনি। পুকুরঘাটে একা একা বসে নিজের বানানো মারফতি ধরনের গান গাইত। গলা বেশি ভালো ছিল না। সূর্যকে গ্রামের নাফিজা বিয়ে করতে চেয়েছিল। ওর প্রেমে পড়েছিল মেয়েটি। নাফিজার বাপ-মা বিয়ে দেয়নি। জেনেশুনে অন্ধর সঙ্গে বিয়ে দেয় কে? গুলি করতে করতে গ্রামে যখন ঢুকছিল সৈনিকরা, ওকে ফেলে চলে যায় বাড়ির মানুষরা। নাফিজা ওর ভাইকে বলেছিল, 'সূর্য ভাইকে নিয়ে চলো, অন্ধ, পালাতে পারবে না।' যুদ্ধের সময় সূর্যকে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈনিকরা গুলি করেছিল।
পনেরো বছর আগে আফসানা মাহমুদের যখন বয়স ৫০, দৃষ্টি বেশ ভালো ছিল। চশমা ছাড়া কাছের জিনিস ভালোই দেখতে পেতেন। দূরের কিছু দেখার জন্য পরতে হতো মাইনাস পাওয়ারের গ্লাস। নিজেকে আড়ালে স্বগতোক্তির ধীরকথনে বলতেন, এখনো বলেন, কেন যে বলতেন, 'অন্ধজন অন্ধকার নিয়ে যত স্বপ্ন বা রূপকথা বা গল্প বলতে পারে, চক্ষুুষ্মান তার চার ভাগের এক ভাগও বলতে পারে না; বলার চেষ্টা করে মাত্র এবং বেশির ভাগই হয় বানানো, যাকে বলে গালগল্প, আর গালগল্প না থাকলে মানুষ বেঁচে থাকার অনেক আনন্দ থেকে বাদ পড়ত।' জাফর মাহমুদ বিয়ের তিন দিনের মধ্যে বুঝতে পারেন, তাঁর চশমা পরা বউ আফসানা, ডাকনাম রাকা, একটু নার্ভাস হলেই বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নখ কামড়ায়, ঘুমের ভেতর এবং দিনের বেলা হয়তো আলনায় কাপড় রাখছে তখন, হয়তো টিভি বন্ধ করার সময়, সদ্য দেখা কোনো নাটকের শেষ সংলাপের পরে বা ঘরে অন্য কাজ করার সময়, নিজে নিজে কথা বলে।
বিয়ের তৃতীয় দিন, মধ্যরাতে, আকাশে ছিল পূর্ণিমার চাঁদ, শরীরের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ প্রেম শেষে, নতুন বউকে নিয়ে জাফর মাহমুদ ছাদে যান। সঙ্গে ফ্লাস্কে ছিল দুই কাপ গরম চা, মধু মেশানো। বিশেষ প্রয়োজন শেষে গরম দুধ বা চা মধু দিয়ে খাওয়ার কথা, যৌন বিশেষজ্ঞ তাঁর ডাক্তার বন্ধু, তাঁকে বলেছিলেন। ছাদে যাওয়ার পর, জাফর মাহমুদ ঘরে ফিরে যান সিগারেট আনার জন্য। ফিরে এসে ছাদের দরজার আড়ালে, জোছনায় নতুন বউকে কেমন দেখায়, দেখতে দাঁড়ান। ব্লাউজ ও পেটিকোট ছাড়া হালকা নীল শাড়ি পরা এক পরি দেখছে চাঁদ। পরি কথা বলছে, স্পষ্ট শোনা গেল : 'চাঁদ আকাশে একা কী করে?' তরুণ ব্যাংকার জাফর মাহমুদ স্কুল ও কলেজের বাংলা বইয়ে কিছু কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন, এই ভাষা কবিতার, তিনি খুশি হন। রাকা আরো কথা বলে কি না একটু অপেক্ষা করেন। আবার কিছু একটা বলল। বোঝা গেল না। এই পরিবেশ জাফর মাহমুদকে আবার তলপেটের নিচে এক প্ররোচনা দেয়। পা টিপে টিপে, টাকা গোনা মানুষের এক গোপন অভিসার, রাকাকে পেছন থেকে আলিঙ্গন করেন, ভেবেছিলেন, নতুন বউ চমকে উঠবে। ওঠেনি। গ্রীবায় চুমু দেন। রাকা বলে : 'এখানে কিন্তু অন্য কিছু নয়।' 'ঠিক আছে, কি, আমাকে একটা দেবে না?' রাকা হেসে আবেদন মঞ্জুর করে। এবং সেই রাত্রে ছাদে শুয়ে, চাঁদের নিচে, জাফরের অনুরোধে, রাকা আস্ত একটা সিগারেট খেয়েছিল। কেশেছিল তিনবার। সাদাটে জোছনায় সাদা ধোঁয়া মিশে ওড়ে একখণ্ড হালকা কুয়াশা এবং দুজনের হাসি শুনেছিল চাঁদ।
ছোট বোন, তার ভাইকে বলেছিল, 'ভাবি পাগল নাকি, একা একা কথা বলে কেন?' কিছুদিন পর বাড়ির সবাই বুঝতে পারে, নতুন বউ পাগল নয়, নিজে নিজে কথা বলা তার অভ্যাস। জাফর মাহমুদ গোপনে একজন মনোচিকিৎসকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলেন। বেশ জটিল ভাষায় কিছু পরামর্শ ও ব্যাখ্যা ছিল : একটি সাধারণ আচরণ, কখন যে অভ্যাসে পরিণত হয়, মানুষ খেয়াল করতে পারে না এবং যখন তা করে, মানুষটির মনে হয় না, অশোভন কিছু করছে। স্বামী হিসেবে এবং বাড়ির সবাই বন্ধুত্বসুলভ, মানে ফ্রেন্ডলি ব্যবহার করলে ধীরে ধীরে অভ্যাসটা দূর হবে। দেখা যাবে, অন্যের সামনে কথা বলছে না, যখন একা থাকছে আড়ালে, হয়তো বাথরুমে, কথা বলছে। অনেক মানুষ বাথরুমে কথা বলে, নিজের নগ্নতার সঙ্গে কথা বলে। মনে রাখতে হবে, তাকে যেন এই ব্যাপার নিয়ে অপমান করা না হয়। এই অভ্যাস নিয়ে হাসি-তামাশা করা যাবে না। তার প্রতি হিউমেন হতে হবে। এই রকমের মানুষরা সাধারণত ক্রিয়েটিভ হয়। অনেক বিখ্যাত মানুষও এই রকম নিজে নিজে কথা বলতেন। দার্শনিকরা তো সব সময় বিড়বিড় করতেই থাকেন। লোকে ভাবে, দর্শনচর্চা হচ্ছে। তা ছাড়া এভরি ওয়ান নোজ, সব মানুষই মনে মনে কথা বলে, কথা না বললে মানুষ নিজের কাছেই বোবা হয়ে যেত, পাগল হয়ে যেত, কথা তো মানুষের এক রকমের খাদ্য, বলে বলে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। দু-একজন কখনো কখনো স্বগতোক্তি করে, আই মিন সলিলোকি যাকে বলে। দেখা যায়, শিশুরা একা একা কথা বলে, তার পছন্দ বা অপছন্দের একজনের উদ্দেশে কথা বলে, বিড়ালের সঙ্গে গল্প করে, তখন কিন্তু বড়রা তাদের পাগল বলে না, কথা শুনে হাসে। সব মানুষ না দেখা ভীতির এ কাইন্ড অব স্লেভ। অবচেতন, আই মিন সাবকনশাস বা বিয়ন্ড কনশাস নলেজ বলতে পারেন, বলে একটা ব্যাপার আছে না? সেখানে অচেনা অন্ধকারের মধ্যে চলাফেরা করে মানসরাজ্যে ঘটে যাওয়া অনেক কিছু, এই যেমন- প্রেম, ভালোবাসা, সেঙ্, মারামারি, কাটাকাটি, দুঃখ, কষ্ট এবং ভালো ও মন্দ লাগার ঘটনাপ্রবাহ। যদি ফ্রয়েড পড়েন বুঝতে পারবেন, হি ওয়াজ রিয়াল জিনিয়াস। প্রকাশ্য দিবালোকে যত কিছু ঘটে, জন্ম নেয়, তার থেকে অনেক বেশি ঘটনা, গল্প আর ব্যাপারস্যাপার নিঃশব্দ বন্ধু বা কিলারের মতো অবচেতনে সাইলেন্টলি ঘোরাফেরা করে। ভেরি ইন্টারেস্টিং।' মনোচিকিৎসকের কথায় আস্থা পান জাফর মাহমুদ এবং পরে তিনি জানবেন তাঁর বউ শুধু নিজের জন্য, একজন আত্মকেন্দ্রিক ছোটগল্প ও নিবন্ধ লেখক।
আফসানা মাহমুদের কাজের জন্য চাকরি পাওয়া মানুষকে তিনি আগেও বলেছেন এবং পরেও অনেকবার বলবেন, মহাভারতের গান্ধারীর নাম শুনেছ, জানো তাঁর কষ্টের কথা, স্বামী ধৃতরাষ্ট্র, অন্ধ; গান্ধারী অন্ধ নন, স্বামীর চোখ শুধু অন্ধকার দেখে, তাই গান্ধারী নিজের চোখের ওপর বাঁধলেন কাপড়। এই কাজ তিনি যতটা না তাঁর স্বামীর প্রতি ভালোবাসা থেকে করেছিলেন, তার থেকে অনেক বেশি ছিল নিজেকে যেন ঘটনা দেখার পরও মিথ্যা না বলতে হয়, তার কৌশল; দুজন যত দিন বেঁচে ছিলেন, শুধু শুনে গেছেন যুদ্ধ, হিংসা, কুটিলতা, মৃত্যু, জন্ম, যৌনতা, প্রেম (এই শব্দটি বলে মৃদু হেসেছিলেন) এবং জয় আর পরাজয়ের কথা; মানুষ তো ওই সব নিয়েই বেঁচে থাকে। মরে যায়। এসবের বাইরে কেউ যেতে পারে না ।' গান্ধারীর অন্ধের মতো থাকার ব্যাপারটি রোকেয়া জানত না। গল্পটি শোনার পর, ওর মনে হয়, তাকেও কখনো কখনো চোখ বাঁধা গান্ধারী হতে হবে কি না। আগের সেবিকা শেফালী, তার এই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্যই নতুন সেবিকা রোকেয়ার নিয়োগ, গান্ধারীর কষ্টের কথা শুনে বলত, 'হয়তো গান্ধারী চোখে বাঁধা কাপড় গোপনে খুলতেন, তাঁর ছেলেপেলে ও আত্মীয়স্বজনের মুখ এবং চাঁদ, তারা, বৃষ্টি, ফুল, নদী আর সবুজ গাছগাছালি দেখতেন, মহাভারতের লেখক সে কথা লেখেননি।' শেফালীর কথা শুনে আফসানা মাহমুদ কিছু বলতেন না। ওই সহজ-সরল চিন্তাটি ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
আফসানা মাহমুদের মনে হয়, অন্ধতার অসুখটা তাঁর মা-বাবার বংশ থেকে এসেছে। নানা ছিলেন অন্ধ, শৈশবে, পাঁচ-ছয় বছর বয়স হবে তখন, রাকা অন্ধ নানাকে দেখেছিল। নানার মুখ আবছা মনে পড়ে। খুব সুন্দর মুখ। গায়ের রং ছিল ফরসা। তাঁর কাছে নাকি জিন আসত। অন্ধ হয়েও জিন দেখতে তাঁর কোনো অসুবিধা হতো না। জিনের শরীর আগুন দিয়ে তৈরি। রাকাকে ছোটবেলায় যেমন বলতেন তার মা, যখন জিন আসত, নানার অন্ধ চোখের মধ্যে চলে আসত সূর্যের আলোর মতো কিছু এবং তিনি দেখতে পেতেন তাঁর সামনে আগুনের তৈরি কখনো মানুষের, কখনো যেকোনো প্রাণীর আকারে জিনকে। একবার সন্ধ্যার কিছু পরে, চারদিক অন্ধকার, ঘরে তখনো সন্ধ্যাবাতি দেওয়া হয়নি, নানা সেদিন ঘরে বাতি পরে দিতে বলেছিলেন, তাঁর ঘরে রাকার নানি শুনতে পান, নানা ফিসফিস স্বরে কথা বলছেন, দরজা একটু ফাঁক করে তিনি দেখেন, ঘরের দক্ষিণের কোনা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে উজ্জ্বল আলো। তাঁর স্বামী মাওলানা তালেব খন্দকার হাত ইশারা করে বউকে চলে যেতে বলেন। নানার কাছে জিন আসার গল্প যখনই রাকা মায়ের কাছে শুনত, মনে পড়ে, মায়ের গলার স্বর হতো সমীহতে ভরপুর। একটু বড় হওয়ার পর, মাকে রাকা বলেছিল, নানার জিনপরির গল্পগুলো এক ধরনের কল্পনা। সত্য নয়। হ্যালুসিনেশন হতে পারে। মা মেয়ের কথায় খুশি হননি। নানা মানুষটার বেশ কিছু কাজকর্মের কথা শুনে রাকার মনে হয়েছিল, মানুষটা তাঁর সময়ে গ্রামের আর দশজনের থেকে ছিলেন আলাদা। জিনের সঙ্গে মেলামেশা আর কথা বলার ব্যাপারটা নানার মেজাজের সঙ্গে যায় না, মেলে না। দু-তিনটি বিপ্লবী, সেই সময়ের তুলনায়, কাজ করেছিলেন যে মানুষ, সে মানুষ কিভাবে জিনের সঙ্গে কথা বলে, জিন তার বন্ধু হয়, জিনকে পালতে পারে। নাকি সেটাও ছিল তাঁর একটা চালাকি! গ্রামে নিজেকে আলাদা মানুষ হিসেবে দাঁড় করানোর একটা কৌশলও হতে পারে। ঢেঁকিতে ধান পাড় দেওয়ার সময় নানির কষ্ট দেখে নানা ঢেঁকির কোমরের নিচের দিকে, মানে পায়ের দিকে, খুঁটির মতো দাঁড়ানো কাঠের গোলাকার যে দুটি থাম থাকে, যাকে বলে কাতলা, তার মাথার মাঝখানে ইংরেজি ইউসদৃশ গর্তের মধ্যে রিকশার বিয়ারিং লাগিয়ে গ্রামে নানা নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে করেছিলেন প্রতিষ্ঠিত। তাঁর এই কাজ কদিন পরই গ্রামে হাসি-ঠাট্টাতে পরিণত হয়, কাতলায় বিয়ারিং লাগানোর কারণে পাড়ের সময় ঢেঁকির ওঠানামার গতি বেড়ে যায় এবং গড় থেকে পাড় দেওয়া ধান তুলতে হাত ছেঁচে যায় নানির। নানা চিন্তা করে বললেন, ঢেঁকির ওঠানামার গতি বেড়ে যাওয়াতে ধরের ওঠানামার তাল নানি বুঝতে পারেননি, মাথায় কিছু নেই। আবার ইংরেজরা যখন বিনা পয়সায় চা খাওয়াতে এসেছিল গ্রামে, মসজিদের ইমামের সন্দেহ হয়, শুকনো কালচে পাতা জ্বাল দেওয়া জিনিসটা অন্য রকম মদ কি না এবং তিনি সমাজের সবাইকে নিষেধ করেছিলেন দুধ-চিনি মেশানো ওই হলুদ গরম পানি না খেতে। নানা ইমামের কথা শোনেননি। খেয়েছিলেন। তাঁর চা খাওয়া ভিড় করে দেখেছিল পাঁচ থেকে শুরু করে ৭০ বছর বয়সের অনেক মানুষ। বাড়ির পাশের মহিলারা দেখেছিল জানালা দিয়ে। হেসে 'ভেরি গুড' বলেছিল সাদা চামড়ার দুজন লোক। দর্শক ইংরেজি শব্দ দুটির অর্থ না বুঝলেও বিদেশি দুজনের হাসিমুখ দেখে বুঝে যায়, তাদের কাজ সফল। চা খাওয়ার কারণে নানি তিন দিন নানার সঙ্গে কথা বলেননি। তাঁর এই গুরুতর অপরাধ নিয়ে গ্রামে বসেছিল সালিস। কেউ কেউ বলেছিল তাঁকে একঘরে করতে। নানা বিধর্মীদের হাত থেকে যে জিনিস খেয়েছেন, তাতে ইসলাম থেকে খারিজ হওয়ার কথা। খারিজ করা হয়নি, কারণ নানা কোরআন তেলাওয়াত খুব সুন্দর করতেন। মসজিদে নামাজ পড়তেন নিয়মিত। মানুষের উপকারে তাঁকে পাওয়া যেত। তাঁর আরো একটি কাজ গ্রামে নিন্দা ও প্রশংসা দুটোই পেয়েছিল। তিনি মেয়েদের লেখাপড়া শেখার জন্য নিজের জমিতে একটি ঘর তুলে মক্তব চালু করেছিলেন। আরবির সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি ও ধারাপাত পড়তে হবে। নিন্দুকরা বলেছিল, 'ইংরেজদের বুদ্ধি নিয়ে তালেব চলতেছে।' এই রকম একটি মানুষ বুড়ো বয়সে কিভাবে জিনের সঙ্গে কথা বলে, মেলামেশা করে, যুক্তিশীল হয়ে ওঠা রাকার বুদ্ধি মেলাতে পারেনি।
অনেক বছর আগে পড়া একটি খবর, তখন রাকার বয়স হবে ১২ বা ১৪, আফসানা মাহমুদকে এখনো মাঝে মাঝে তাড়ায়। চশমা নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি তখন। একজন ডাকাতকে গ্রামের মানুষরা ধরে খেজুরের কাঁটা দিয়ে দুটো চোখ তুলে ছেড়ে দেয়। চোখ দুটি ডাকাতের হাতে দিয়ে তারা বলে, 'জানে মারলাম না।' খবরটা তাঁর স্মৃতি থেকে কখনো মুছে যায়নি। মাঝে মাঝে এখনো স্বপ্ন দেখেন, কজন মানুষ একজনের হাত-পা শক্ত দড়িতে বেঁধে, মাটিতে শুইয়ে চোখ তুলেছে। পরে চোখের ডাক্তার তাঁকে বলেছিলেন, এই আতঙ্কবোধকে বলে ট্রমা, যার থেকে সম্ভবত কখনো রেহাই পাওয়া যায় না। যেমন মনে করা যাক, কোনো অন্ধ মানুষকে দেখে ওই চোখ তোলার চিন্তা এসে ধাক্কা দিতে পারে এবং তখন একটা আতঙ্ক পেয়ে বসে। 'প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে একটি দুর্ঘটনার দুঃস্বপ্নে আক্রান্ত', বলেছিলেন ডাক্তার।
তাঁর মা ও বাবা শেষ বয়সে অন্ধ হয়ে যান। তিনি দেখেছেন, মা ও বাবা শূন্যতার দিকে হাত বাড়িয়ে অবলম্বন খুঁজে খুঁজে হেরে যাওয়া স্বরে বলতেন, 'কেউ আছ?' এক নাছোড় ভীতি আফসানা মাহমুদকে কখনো ছাড়ে না। চশমা নামের এক যন্ত্রণাকর বস্তু নাকের ওপর, চোখের সামনে রাখতে হচ্ছে ৫০ বছর ধরে। সেই ১৫ বছর বয়স থেকে, যখন চোখ ও মন প্রায় সব কিছুর মধ্যে দেখে আনন্দ, মনে হয় জীবনের মৃত্যু নেই, প্রেম শব্দটি শুনলেই চোয়ালে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়, বাংলা ও ইংরেজি অভিধানে যৌন ও সেঙ্ শব্দ দুটি বারবার দেখতে ইচ্ছা করে, পুরুষ নামের এক শরীরের গল্প ভালো লাগে, জটিল জ্ঞানের কথা শুনতে ভালো লাগে না, চশমার যন্ত্রণা ও বিরক্তি তাঁকে একটু লম্বাটে নাকের ওপর টেনে বেড়াতে হচ্ছে। তিনি মনে করতে পারেন, কোন কোন রঙের কতগুলো চশমা কখন কী কারণে ভেঙে গেছে, জাফরের আকস্মিক মধুর আক্রমণের জন্য তিনটি, মিছিলের চাপাচাপির মধ্যে দুটি এবং জামিলের সঙ্গে বাসে ওঠার সময় একটি এবং মোট কতগুলো তাঁকে পরতে হয়েছে। এবং সবাই নয়, কোনো কোনো চোখের ডাক্তার, বুড়ো আর তরুণ যে বয়সেরই হোক, ঘর অন্ধকার করে যখন তাঁর চোখের ওপর স্লিপ ল্যাম্প জ্বালিয়ে চোখের ভেতরের অসুখ দেখেছে বা চোখে নতুন লেন্স লাগিয়ে সামনের দেয়ালে সাঁটা আয়নায় প্রতিফলিত অক্ষর পড়তে বলেছে, যদিও তাঁর সঙ্গে থাকতেন বাবা বা মা বা ছোট বোন কাকলী, তখন ডাক্তার চিকিৎসার ভদ্রতার আড়ালে কনুই দিয়ে স্পর্শ করেছে স্তন। কোনো কোনো স্পর্শে তাঁর শরীরে বিশেষ শিহরণ জেগেছে।
সিদ্ধেশ্বরীর এক তিনতলা বাড়ির দোতলার পূর্বমুখী একটি ১৪/১২ ঘরে থাকেন অন্ধ আফসানা মাহমুদ। ওঁর ৬৫ বছর বয়সের নামের আগে 'অন্ধ' শব্দটি তো লিখেছিলাম, আবার লিখলাম কেন? অধিক কথা ছাড়া যেন কোনো কিছুর ভেতরের শাঁস বের করে আনা যায় না। তাই বলতে হয়, ওঁর মুখ ছিল দুর্গা দেবীর মুখের মতো, চোখ যে কী সুন্দর ছিল! অনেকে এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারেনি, বাক্য ইনকমপ্লিট, বলবে কি, সুন্দরী নারীকে দেখলেই পুরুষরা এলোমেলো হয়ে যায়, একটু থেমে, একটি শ্বাস ছেড়ে, তারা আবার বলেছে : ওঁর যৌবনে তরুণরা আড়াল থেকে বলত, 'আমাদের সুচিত্রা সেন।' আড়াল কত নিরাপদ! আফসানা মাহমুদের আয়তাকার, লিকুইড আইজ, যাকে অনেকে হরিণের চোখের সঙ্গে তুলনা করত। ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর চোখ দুটি অন্ধ ছিল না। কী এক জ্বর হলো, আশপাশের মানুষরা বলল : টাইফয়েড। পরিতোষ ডাক্তারের পেঁয়াজের গন্ধওয়ালা লাল পানির তিতা ওষুধ আর কুইনাইন খেয়ে যদিও জ্বর চলে যায়, কিন্তু চোখ খারাপ হতে থাকল। ঢাকা, কলকাতা এবং সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররা অনেক চিকিৎসা করেও কিছু করতে পারেনি। আফসানা মাহমুদ তাঁর আগের সেবিকা শেফালীকে অনেকবার বলেছেন আর হেসেছেন এবং রোকেয়াকেও বলবেন আর আগের মতোই হাসবেন, চোখের ডাক্তারের কাছ থেকে শোনা কয়েকটি শব্দ বারবার শুনতে শুনতে তাঁর মুখস্থ হয়ে গেছে : কর্নিয়া, স্ক্লেরা, আইরিস, রেটিনা, চোখের লেন্স, লুটেয়াস ম্যাকুউলা, অপটিক নার্ভ। ডিটেইল টেস্ট করতে : ইকোগ্রাফি, এনসেফালোগ্রাম। শেফালীর মতো রোকেয়াও শব্দগুলো শুধুই শুনে যাবে। মনে রাখার চেষ্টা করবে না।
যখন একা থাকেন আফসানা মাহমুদ, কখনো কখনো অতিব্যবহৃত কথা, পড়া কথা, নিজেকে মুখস্থ শোনান। আগেকার এই অভ্যাস, জাফর মাহমুদের মৃত্যুর পর, সেই মৃত্যুও তো হয়ে গেছে ছয় বছর আগে, যেন ফিরে এসেছে অনেক অধিকার নিয়ে। কথা বলার সময়, বয়সী ঠোঁট দুটি নড়তে থাকে, কাঁপতে থাকে চোখের কোঁচকানো পাতা, ডান হাতের তর্জনী ও বুড়ো আঙুল দিয়ে জড়াতে ও খুলতে থাকেন শাড়ির আঁচল, যেন খোলা আর জড়ানোর মধ্যেই আছে তাঁর কথার গভীর অর্থ। বাড়ির সবাই জানে, যখন তিনি একা একা কথা বলবেন, তাঁকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, কোনো কথাও বলা যাবে না। তাঁর কথা বলার সময় কেউ যদি সামনে চলেও আসে, আগন্তুককে বাধ্য শিশুর মতো কথাগুলো শুনে যেতে হবে অথবা পা টিপে টিপে নিঃশব্দে সেখান থেকে চলে যেতে হবে। শেফালী ও রোকেয়া ইসলাম সেবিকার কাজ পাওয়ার পর আফসানা মাহমুদের একা একা কথা বলা দেখে ও শুনে মনে করেছিল, পাগল নাকি! তাঁর ছেলের বউ রিয়া সেবিকাদের ওই সময় কী করণীয় বলে দেন।
'মানুষকে কত কিছু কল্পনা করতে হয়, আর কল্পনা করতে না পারলে মানুষ পাথর হয়ে যেত। বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে অনেক গল্প শোনায় মানুষ, শুনতে হয় এবং কোনো কোনো গল্পে নিজেকে না রাখলে ব্যক্তি নিজের অস্তিত্ব টের পায় না। নিজেকে সহায়হীন মনে হয়। আকাশের নীল শূন্যতা থেকে, অন্ধকার থেকেও হতে পারে, নেমে আসা প্রথম মানব-মানবীর গল্প আগামীর মানুষ ও নিজেদের জন্য যাঁরা মুখে মুখে তৈরি করেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকে ছিলেন একেকজন হোমার বা রবীন্দ্রনাথ। বড় কবি ছাড়া এ রকম কল্পনা কে করতে পারে? বস্তু বা প্রাণের বাস্তবতার ওপর কবি ও শিল্পীরাই কল্পনার অনেক রং বসায়, কল্পনাকে প্রায় সত্য করে তোলে, সত্যকে করে তোলে গ্রহণযোগ্য ভালো লাগা মিথ্যা, আর সাধারণ মানুষ তা শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে একসময় বিশ্বাস করা শুরু করে। পৃথিবীতে মানুষের আগমনের শিকড়-গল্প না থাকলে মানুষ নিজের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়ত। এখন যতখানি অসহায় আর কষ্টপীড়িত অবস্থায় মানুষ দিন কাটায়, বহুগুণ বেড়ে যেত তার মাত্রা। যদিও মানুষ চিন্তার ভেতর সব সময় ভাসমান এক ধরনের বিবর্তিত হওয়া পশু। সঙ্গ খোঁজে, নিঃসঙ্গ হয়, সঙ্গ খোঁজে, হাসে, কৌতুক করে, কথাগুলো বারবার বলত জামিল। সব প্রাণীর গল্প আছে, অন্ধজনের কিছু বেশি। এই সব কথার বেশি অংশ জামিলের, যার কথা এখন রোকেয়াকে অনেকবার শুনতে হবে, যেমন আগে শুনতে হতো শেফালীকে।
রোকেয়া চাকরি পাওয়ার পর একদিন আফসানা মাহমুদ বলবেন, 'আমি আর তুমি যখন একসঙ্গে ঘরে থাকব, আমাকে শুধু রাকা বলে ডাকবে, আপা বলবে না, খালাম্মা বলবে না, আমার ডাকনাম এখন আর কেউ বলে না, আমরা তখন কানামাছি খেলব।' বিনীতভাবে কথাগুলো বলেই, যেন আচমকা, কোনো পূর্বাপর নেই, 'তুমি কি বোঝো মানুষের মন অন্ধকার আর আলোর এক মিশ্রণ।' 'কী আজগুবি প্রশ্ন' রোকেয়ার বিরক্তিকর ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই, উত্তর শোনার অপেক্ষা না করেই, 'শোনো, তা একরকম আশা নাই দৃশ্য, যার কোনো শব্দ নাই। কিন্তু সব সময় যাদের চোখ ভালো তাদেরও আশা প্রতিদিন থাপ্পড় মারে। যখন আমার চোখে আলো ছিল, আমাকেও কত আশার লাত্থি খেতে হয়েছে। আশার নাম ধাঁধা, যার প্রথম ও শেষ কাজ সারাক্ষণ যুদ্ধের মধ্যে মানুষকে উল্টেপাল্টে ফেলে রাখা, তাড়া দেওয়া, হতাশ করা। যুদ্ধ করতে করতে মানুষ কখন যে চলে যায় কবরে, কী যুদ্ধই না করতে হয়েছিল জামিলকে, বউটার হাই অ্যামবিশনের নিচে পড়ে পিষ্ট হয়ে গেল, আর পেরে ওঠেনি, আত্মহত্যাই করল, হাই অ্যামবিশন কী বোঝো? বাংলায় বলে উচ্চাভিলাষ, যার অভিলাষ খুব উঁচু, উঁচুর তো আর শেষ নেই, উচ্চ চাহিদার যে চাপ তা সহ্য করা যায় না, কাগজে খবর ছাপা হয়েছিল, বউয়ের হাই অ্যামবিশনের কথা কাগজ কিন্তু লেখেনি, শয়তান বউটা ওকে মেরে ফেলল। ও বউয়ের জন্য বাধ্য হয়ে বিদেশ যায়। দেশে বড় চাকরি করত, কত সম্মান ছিল! আমি শুনেছিলাম, আমার বোন কাকলী বলেছিল, ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হতো, ও থাকে নিউ ইয়র্কে, জামিল এক বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোরে সামান্য সেলসম্যান হয়েছিল। ওর জন্য খুবই ছোট চাকরি। অপমানের চাকরি। কিনা আমেরিকায় থাকতে হবে! বোঝেও না ওরা আমাদের চাকর-বাকর মনে করে। কাকলীকে আমার কথা জামিল জিজ্ঞেস করত। আমার বড় মেয়ে বাবলী জানত জামিলের কথা।' মা মেয়েকে নিজের প্রেমের কথা বলতে পারে কি না, ভেবেছিল রোকেয়া।
কোনো কোনো দিন বা রাতের যেকোনো সময় রোকেয়াকে দুটো মোটা খাতার যেকোনো একটি, খাতার ওপর লাল কালিতে ১ ও ২ লেখা আছে, আফসানা মাহমুদ বলবেন, '১ নম্বর আনো, পড়ো।' 'আজ ২ নম্বর আনো, পড়ো।' তাঁর গল্প ও নিবন্ধ লেখার খাতা। কদিন আগে মধ্যরাতে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। তিনি রোকেয়াকে ডেকে ২ নম্বর খাতা থেকে পড়তে বলেন।
'যত্ন করে ধরবে, খুলবে'- এক কথা প্রতিবারই বলেন খাতা নেওয়ার সময়। পুরনো খাতাটির কাভার, কালো না নীল ছিল, বোঝার উপায় নেই। খাতাটির বয়স অনেক। দ্বিতীয় খাতাটির বয়স অল্প। 'গল্পটা পড়ো, আস্তে আস্তে পড়বা, যত্ন করে পাতা উল্টাবা।' 'কোনটা পড়বো'- রোকেয়ার বিনীত জিজ্ঞাসায় উত্তর আসবে, 'যেটা তোমার ইচ্ছা।' গল্পগুলোর কোনো নাম নেই। প্রতিটি গল্পের ওপর আছে সংখ্যা- ১, ২, ৩ এই রকম। এবং গল্পের শেষ লাইনের নিচে হয় উড়ন্ত পাখির অথবা তিন পাপড়ির একটি বা দুটি ফুল আঁকা। 'কী ফুল, কী পাখি' রোকেয়া জানতে চেয়েছিল একবার। 'তোমার যে ফুল বা পাখি ভালো লাগে সেটা ভেবে নাও', আফসানা মাহমুদের স্বর ছিল নির্লিপ্ত।
'আজ সকালে একজন অন্ধ ফকিরের গান শুনলাম। পরপারের গান। গলায় কোনো সুর নেই। কী ভক্তি দিয়ে গাইছিল! ভক্তির কাছে সুর জরুরি নয়। প্রতিটি শব্দে কী আবেগ! গাইবার সময়, হাত দুটি যেভাবে নাড়ছিল, খুঁজছিল কিছু একটা, কাঁপছিল চোয়াল। মনে হয় পরমকে এখনই ছুঁয়ে ফেলবে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছিল, সে কি একা? এ রকম ফকিরকে কোনো একজন চোগলখোর ব্যবসায়ী সকালে এখানে রেখে যায়, সময়মতো সে বা তার নিয়োজিত লোক তুলে নিয়ে যাবে। তখন দুপুর। রৌদ্র তাকে কোনো আশ্রয় বা শান্তি দেবে না। চোখ দৃশ্য খোঁজে আর আশা করে, যেমন আশাবাদী মানুষরা বলে থাকে, কেউ আসবে, শান্তিদূত আসবে। ওই কেউ আলোর পরিপূরক। বীজ বোনা মানুষরা যেমন অপেক্ষা করে, ফসল হবে। মানুষ এবং চলমান ও স্থবির বস্তুসমূহ আলোর মধ্যে কত বিচিত্র প্রকারে রূপ বদলায়। আলোর মাত্রাহীন ব্যবহারে চক্ষুষ্মানের অবস্থাও একই হতে পারে। আলো কি এক রকমের প্রেম? স্থবিরতার বিপুল চাপ হিমালয়ের থেকেও ভারী, জামিলের আজ আসার কথা ছিল, পাশে থাকলে আমরা দুজন ফকিরটার সঙ্গে কথা বলতাম। জামিল হয়তো লোকটাকে বলত, 'চলুন আমাদের সঙ্গে, গান শুনব।' জামিলের নাম পড়ার পর রোকেয়া তাকাবে আফসানা মাহমুদের মুখের দিকে। তাঁর মুখের ওপর তখন একটা বিশেষ স্মৃতির ছায়া ভেসে যায়। অন্ধ ফকির বিষয়ক গল্পের আগামাথা রোকেয়া কিছুই বোঝে না, গল্পের শেষে কেন যে হঠাৎ জামিলের নাম এলো! পাঠ্য বইয়ে কিছু গল্প পড়া 'মহিলা পাগল নাকি' সেবিকা মুখ ফুটে এই কথা বলতে পারে না। পড়া শেষ হলে, আফসানা মাহমুদের হাহাকার মেশা শ্বাসের একটা ধ্বনি ঘরের শূন্যতায় মিলিয়ে যাবে। তিনি কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকবেন। তাঁর বয়সপীড়িত মৌনতা সুন্দর। রোকেয়া একসময় জেনে যাবে, তাকে গল্প নামের অনেক উদ্ভট লেখা পড়তে হবে। এবং মাঝে মাঝে, 'কী কেমন লাগল' লেখিকার প্রশ্নের উত্তরে তাকে বলতে হবে, 'ভালো', আবার কখনো কখনো 'বুঝলাম না।' কেন গল্পটি পাঠক বোঝেনি সেই ব্যাখ্যা লেখিকা জিজ্ঞেস করে না। রোকেয়া আশা করে, তাকে জিজ্ঞেস করা হোক, গল্পটির কোথায় বোঝা যায়নি। চাকরি পাওয়ার চার মাস পর, রোকেয়ার সঙ্গে আফসানা মাহমুদের যখন বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, তাঁকে দু-একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার সাহস অর্জন করেছে বলে ভাবতে শুরু করেছে রোকেয়া, তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই গল্পটার মানে কী?' আফসানা মাহমুদ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন, 'অন্য দিন বলব।' সেই অন্য দিন কবে আসবে, আদৌ আসবে কি না, কেউ জানে না।
এক সন্ধ্যায় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। কিছুক্ষণ আগে আরেকটি গল্পের কিছু অংশ পড়া হয়েছে। আফসানা মাহমুদকে প্রায় বন্ধুস্বরে রোকেয়া জিজ্ঞেস করে, 'এই গল্পগুলো আপনার স্বামী কখনো দেখেননি?' 'হ্যাঁ দেখেছিল, পড়েনি, ও মানে নাজিমের বাবা জাফর আমাকে বলত, সব মানুষের কিছু নিজস্ব গল্প থাকে, আমারও আছে, তোমারও থাকতে পারে, ওসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে আমাদের বর্তমানের জীবন ভালো যাবে না, নাজিমের বাবা খুবই ভালো মানুষ ছিল, ও আমার ডাকনাম রাকা বলত একটু টেনে, ভালো লাগত।'
'ভালো মানুষ মানে কী?' এই প্রশ্ন কখনো রোকেয়া তাঁকে জিজ্ঞেস করেনি। গ্রামে তাঁর স্বামী মোহাম্মদ সোলেমানকে সবাই ভালো মানুষ বলত। বিপদে-আপদে পরের উপকার করত, বুদ্ধি-পরামর্শ দিত মানুষটা। রোকেয়া জানে না, জাফর মাহমুদ মানুষের উপকার করত কি না। রোকেয়া কমবেশি জানে, ধনীরা বেশি কৃপণ হয়, এই দেশের ধনীরা মানুষের উপকার কম করে।
রোকেয়া, প্রস্থে সাড়ে ৩, দৈর্ঘ্যে ৭ সাইজের সিঙ্গল খাটে ঘুমায়। টিভি দেখতে হয়, আফসানা মাহমুদের পাশে চেয়ারে বসে। তিনি মাঝেমধ্যে রোকেয়াকে জিজ্ঞেস করেন, দৃশ্যটি কি বাড়িতে না বাইরে, নদীতীরে নাকি মাঠে? পাত্র-পাত্রী কী কী পোশাক পরেছে। তাঁর শ্রবণশক্তি ভালো। নাটকের সংলাপ, গানের কথা শুনতে অসুবিধা হয় না।
সেবিকার চাকরিটি পাওয়ার সময় রোকেয়ার বয়স ছিল ৪৭। গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল শ্যামলা। দিনরাত্রির বেশি সময় ঘরের মধ্যে থাকতে থাকতে রংটা হারাচ্ছে শ্যামলত্ব। কিছুটা ফরসা হয়ে উঠছে। শরীর অনেক দিন রোদ না পেলে যা হয়! কিছুদিন পর, ইটচাপা বন্দি ঘাসের মতো হলদে হয়ে যেতে পারে। দেখতে ভালো। গড়ন পাতলা। উচ্চতা মাঝারি। চুলে পাক ধরেছে। যখন চাকরিতে এসেছিল, মাসিক হতো। রক্তের আঁশটে গন্ধ পেয়েছিলেন আফসানা মাহমুদ। তিনি ভালো স্যানিটারি প্যাড কিনে দিয়েছিলেন। মনে একটা ভয়ও হয়েছিল তাঁর। শেফালীর মতো রোকেয়াও নতুন ড্রাইভার শওকতের সঙ্গে কিছু না করে ফেলে। সুন্দর প্যাড পেয়ে রোকেয়া টয়লেটে ঢুকে প্রথমে প্যাডের গন্ধ শুঁকেছিল। কী ছোট্ট চ্যাপটা একটা নরম বালিশ! এত সুন্দর জিনিসটাতে রক্ত লাগবে, ভেবে রেকেয়ার একটু ভাবনাও হয়েছিল। বড়লোকের মেয়ে-বউরা কত সুখে আছে! 'তুমি টেরই পাবে না কিছু পরে আছ কি না', তার হাতে দিয়ে বলেছিলেন আফসানা মাহমুদ। কিভাবে পরতে হবে সে নির্দেশনাও দিয়ে বলেছিলেন, 'তোমার আনা পুরান কাপড় আর গামছা ফেলে দেবে, ওসব আর ব্যবহার করবে না। ওসবে স্কিন ডিজিজ হয়।' নিজেকে আফসানা মাহমুদ প্রশ্ন করেছিলেন, চাকরি দেওয়ার আগে মেনোপজ হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। ভেবে খুশি হয়েছিলেন, বাসার গাড়িচালক, শিকদার, ৩৫ বছরের শক্তপোক্ত লোক, বাড়ি সিরাজগঞ্জ, তার বউ দুই বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে থাকে, কোনো কোনো রাতে হুটহাট বাড়ি চলে যায়, সকালে ফুরফুরে মেজাজে ফিরে আসে। তার সঙ্গে শেফালী কখনো কখনো হেসে হেসে কথা বললেও বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলেনি। ভাবনাটা ছিল ভুল। রোকেয়ার আগে এখানে কাজ করত বেশি বেশি কথা বলা ২৭-২৮ বছর বয়সের তালাক পাওয়া শেফালী, ড্রাইভার শিকদারের সঙ্গে চলে যায়। খুব ভদ্র ছিল। আমরা শেফালীর চিঠি পড়েছি। ওর কথা, ওর চিঠির কথা আফসানা মাহমুদ বলেছিলেন রোকেয়াকে। তবে চিঠির একটি লাইন ছিল 'এই বাসায় কয়েদির মতো লাগে', কখনো রোকেয়াকে বলেননি আফসানা মাহমুদ।
দুই
তাঁর সেবার জন্য যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, সেখানে কোথাও 'অন্ধ' শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। ব্যবহার করলে কি কম দরখাস্ত আসত? আগের সেবিকা শেফালী না বলে এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পেছনে অন্য একটি অন্যতম কারণ থাকলেও ওই কষ্টকর শব্দটির ভূমিকাও কম নয় জন্য, লেখা হয়নি। শেফালী চলে গেছে বাড়ির গাড়িচালক বিবাহিত শিকদারের সঙ্গে, তার সঙ্গে ছিল প্রেম। শেফালীর দিক থেকে আমরা ভাবতেই পারি, সে হয়তো নৈতিকতার বোধ থেকে আফসানা মাহমুদকে কোনো কষ্ট দিতে চায়নি জন্য, না বলে বাড়ি থেকে চলে গেছে। এই বাসস্থান আর নিয়মিত ভালো খাবারদাবারের নিশ্চয়তা তার প্রেম-পাওয়া জীবনের কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছিল। সব প্রাণীই প্রেম আর ভালোবাসা চায়। প্রেমে পড়ার কারণ-অকারণ নির্ধারণ করা খুব কঠিন। অন্ধজনের সেবা করতে না চাওয়া কারণ হতে পারে না? একজন অন্ধ মানুষের জীবন্ত লাঠি হওয়া দৃষ্টিপূর্ণজনকে একরকম অথর্ব করে ফেলে না? খাদ্য, বাসস্থান, কাপড়চোপড়, টিভি দেখা, জীবনযাপনের আশা ও আকাঙ্ক্ষার সব হিসাব সেলাই করতে পারে না। শেফালীর চলে যাওয়াকে আফসানা মাহমুদ বললেন না 'পালিয়ে গেছে', বললেন, 'চলে গেছে।' পালিয়ে যাওয়া আর না বলে চলে যাওয়ার মধ্যে কী পার্থক্য আছে, তা নিয়ে ছেলে নাজিমের বউ রিয়া দুবার কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন শাশুড়ির সঙ্গে। 'তুমি বুঝবে না'- খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল আফসানা মাহমুদের। শেফালীর একটি চিঠি পাওয়া গেল টিভির রিমোটের নিচে। বলপয়েন্টের নীল কালিতে লেখা, অক্ষর গোটা গোটা, 'খালাম্মা, সালাম জানবেন। শিকদার আমারে খুব ভালোবাসে, আমিও ওরে। আমরা চলে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে এই বাসায় আমার নিজেকে মনে হয়, কোনো অপরাধ না করেও কয়েদি। আপনার দেওয়া মোবাইলটা রেখে গেলাম। আপনি খুব ভালো মানুষ। কোনো দিন বেয়াদবি করে থাকলে মাফ চাই। বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ইতি- আপনার শেফালী।' ছোট্ট চিঠিটা দুবার বেশ জোরে জোরে রিয়াকে পড়তে হলো। নাজিম মাহমুদ বললেন, 'সব কিছু খুঁজে দেখো কী কী নিয়ে গেছে।' নাজিমের বিরক্তিকর হুকুম শেষ হতেই তাঁর মা বললেন, 'খোঁজার দরকার নেই, ও বাড়ির কিছুই নিয়ে যায়নি।' 'কী বলছ, মা?' নাজিমের প্রশ্ন শেষ হতেই রিয়া 'মা, আপনি ওকে কেন বিশ্বাস করছেন?' আফসানা মাহমুদের শান্ত নির্বিকার উত্তর, 'তোমরা ওকে চেনো না, দরকার হলে তোমাদের ঘর চেক করো, আমার এই ঘর নয়, দেখছ না মোবাইলটাও নেয়নি। এখন যাও।' 'একটা খারাপ মেয়ে মানুষ, কী বেয়াদব, শয়তান, অন্য কোনো উপায় ছিল না, এই কথার মানে কী।' কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে ওঠা রিয়ার ফরসা মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। আক্কেলমাড়ির দাঁতগুলোর কড়মড় শাশুড়ি শুনতে পেলেন না। রিয়ার পায়ে স্যান্ডেল ছিল না। নাজিমের কথায় তাড়াতাড়ি শাশুড়ির ঘরে চলে আসতে হয়। পরনে ছিল বুটিক প্রিন্টের ম্যাঙ্।ি খালি পায়ে হাঁটার শব্দ তুলে, একটা জরুরি কাজ পেয়ে রিয়া তাঁর ঘরে গেলেন, পেছন পেছন নাজিম মাহমুদ। তাঁদের ঘর থেকে কিছু হারানোর কোনো কারণ নেই। 'শেফালী, শেফালী' বলে সকালে, তখন সূর্য উঠে গেছে, আগে কখনো আফসানা মাহমুদ এইভাবে শেফালীকে ডাকেননি, ডাকার মধ্যে ছিল এক উৎকণ্ঠা, মায়ের গলা প্রথম শুনতে পান নাজিম। রিয়াকে ডেকে বলেন, 'দেখো তো, মা শেফালীকে ডাকছে কেন, এই সকালে কোথায় গেল মেয়েটা?' রিয়ার ঘুমভাঙা চোখে-মুখে বিরক্তি। দুই চোখ ডান হাতের তর্জনী ও বুড়ো আঙুল দিয়ে ডলতে ডলতে চলে যান শাশুড়ির ঘরে। নাজিম শুনতে পান, রিয়া জোরে জোরে ডাকছেন : শেফালী, শে-ফা-লী।' সারা বাড়ির কোথাও থেকে কোনো উত্তর আসে না।
রিয়া আর নাজিম ভেবে পান না, মা কেন শেফালীর শয়তানি নিয়ে কোনো কথা শুনতে চাইলেন না। হতে পারে, তিনি, ওদের মেলামেশার কথা জানতেন। হয়তো, তাঁর অন্ধ চোখের সামনেই ওরা কখনো কখনো শব্দ না করে চুমু খেত আর মা বুঝেও কিছু বলতেন না, বোধ হয় তাঁর ভালোই লাগত। শেফালীর প্রেম নিয়ে মাকে কিছু বললে, হয়তো তিনি বলতেন, 'কেন, গরিবদের কি প্রেম করতে নেই?'
'বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না', এই বাক্যে অনেক ঈঙ্গিত আছে। পশুরা পারে না, মানুষ ঈঙ্গিত নিয়ে অনেক গল্প করতে পারে, অনেক কথা ভাবতে পারে। রিয়া বেশ কিছু কথা নাজিমকে বলেছিলেন : 'শেফালী কি প্রেগন্যান্ট হয়েছিল?'
আফসানা মাহমুদ মনে করতে পারেন, কোনো কোনো সময় কানে এসেছে দুজন মানুষের শ্বাসের ঘন শব্দ। একদিন 'চকাশ' করে একটি শব্দ কানে এসেছিল। ড্রাইভার আর শেফালী তাঁর ঘরে, তাঁর সামনে কি তখন চুমু খেয়েছিল? ওরা নিশ্চিত ছিল, অন্ধ তো দেখছে না, তার সামনে অন্ধকার ছাড়া দৃশ্যমান বলে কিছু আছে নাকি? 'লেট দেম হ্যাভ সাম লাভ' কথাটা তাঁর মাথায় ইংরেজি ভাষাতেই এসেছিল। 'বাড়িতে কেউ নেই', 'ভাবি তার মার বাসায় গেছে।' আফসানা মাহমুদ 'বাড়িতে কেউ নেই' শুনেও কিছু বলেননি। বলতে পারতেন, 'আমি কি নেই?' তারপর তিনি শুনেছেন শাড়ির ঘসঘস শব্দ। চারটি সন্তর্পণ পায়ের চলে যাওয়ার গোপন শব্দ। ওরা চলে যায় পাশের ঘরে। জোরে হাসতে থাকে। একবার আফসানা মাহমুদের মনে হয়, শেফালীকে এখন কি ডাকা ঠিক হবে? তাঁর ভয় হয়। কদিন আগে শেফালী তাঁকে একটি খবর পড়ে শুনিয়েছিল। একটি শিশু তার মা ও বাবার বন্ধুকে তাদের শোবার ঘরে নগ্নাবস্থায় চুমু খেতে দেখে, শিশুর ভীত স্বর : 'মা, তুমি কী করছ?' মা ও মায়ের প্রেমিক শিশুটিকে খুন করে। যদি আফসানা মাহমুদ শেফালীকে ওই সময় ডাক দিতেন তাহলে শিকদারের মাথা কি ঠিক থাকত? পাশের ঘরে যা হয়েছিল তা নিয়ে ছেলের বউ রিয়ার সঙ্গে আফসানা মাহমুদ কথা বলতে চেয়েছিলেন। বলেননি। 'মেয়েটিকে সাবধান করতে হবে', তিনি এই পর্যন্তই ভেবেছিলেন। 'আমাকেও তো আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু কাশেম ভাই এক সন্ধ্যায় হঠাৎ চুমু খেয়েছিল আর চুমু খেয়েই দৌড় দিয়েছিল। আমি তো অপেক্ষা করেছিলাম সে আবার আসুক। কী ভীরু! পুরুষ মানুষ এত ভীরু হলে চলে?' শেফালী আর শিকদারের প্রেম চলুক, এই ভেবে তিনি নিজের সঙ্গে বিবিধ গল্প করে গেছেন। 'গোলাপ কি হাঁটতে পারে?' এই আশ্চর্য কথাটি বলে যে তরুণ ১৯৬৬ সালে কলেজের বারান্দা থেকে দ্রুত চলে গিয়েছিল, তাকে উত্তরটা বলার সুযোগ পায়নি। রাকা ভেবেছিল, তরুণের সঙ্গে দেখা হলে, আশপাশে শুধু সে থাকলে বলবে : 'মালির সামনে গোলাপও দাঁড়ায়।'
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বাড়িতে ছিলেন না নাজিমরা। পাশের ঘরে শিকদার আর শেফালী কথা বলছিল। মাঝেমধ্যে হাসছিল জোরে জোরে। কখনো কখনো কথা বলছিল ফিসফিসিয়ে। হয়তো তখনই এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা ওরা করে। আফসানা মাহমুদ খাট থেকে নেমে, খাটের মাথা ধরে দেয়ালে কান ঠেকান। ওদের কথা শোনা যায় না। মাঝেমধ্যে আসতে থাকে হাসির শব্দ। একবার স্পষ্ট শোনা গেল, 'তাড়াতাড়ি করো।' আফসানা মাহমুদ হাসেন। ফজল অনেক সময় নিত। স্তনে চুমু দিতে দিতে কখনো গান করত, কখনো বলত অশ্লীল শব্দ। শব্দগুলো তখন অশ্লীল মনে হতো না। প্রেমের সময় ওকে গুণ্ডা আর ডাকাত বললে জাফর বলত : 'আমার এখনকার সুন্দর কাজ লুণ্ঠন আর হত্যা করা।' 'যত পারো হত্যা করো' বলত রাকা। পাশের ঘর থেকে কাপড়ের খসখস শব্দ আসছে। দেয়ালের ঠাণ্ডা থেকে আফসানা মাহমুদ কান সরিয়ে নেন। মিনিট দুয়েক পরে শেফালী অন্ধজনের সেবা দিতে ঘরে আসে। 'খালাম্মা, নতুন সিরিয়ালটা দেখবেন না?' 'টিভি ছাড়ো' শান্ত, স্নিগ্ধ উত্তর ছিল আফসানা মাহমুদের।
টিভিতে কী একটা টক শো হচ্ছিল। শেফালী টিভি দেখছিল না, তার চোখ ছিল আফসানা মাহমুদের মুখের দিকে। পাশের ঘরের ঘটনাটি তার কর্ত্রী বুঝেছেন কি না, শেফালী অনুমান করার চেষ্টা করছে। 'আমার মনে হয়, শিকদারের সঙ্গে তুমি প্রেম করছ, ওর কিন্তু বউ আছে?' প্রশ্নটি আচমকা। শেফালী খুবই অবাক হয়ে যায়, মুখে ফ্যাকাসে রং ধরে। এ রকম একটি কথা বলার জন্য কি টিভি ছাড়াটা একটা ভূমিকা? শেফালী মিথ্যে বলেনি, 'শিকদাররে আমার ভালো লাগে।' কথাটা বলে আফসানা মাহমুদের মুখের দিকে তাকিয়েছিল শেফালী। তিনি শুধু মৃদু হেসে বলেছিলেন, 'আমার মনে হয় তুমি ঝামেলায় পড়ে যাবে, হয়তো তোমার পেট বাধায়ে ও চলে যাবে, পুরুষদের সহজে বিশ্বাস করতে নেই' বলে, 'শোনো, আজ রাতে আমি আর তুমি কানামাছি খেলব।' হয়তো একদিন আমরা দেখব, আফসানা মাহমুদ রাকা হয়ে রোকেয়ার সঙ্গেও খেলছেন কানামাছি। আর শেফালীর মতো রোকেয়ারও মনে হবে, এই খেলা কি আনন্দের, নাকি নিষ্ঠুরতার।
তিন
রিয়ার কাজের মেয়ে জাকিয়ার সঙ্গে রোকেয়াকে বেশি মেলামেশা করতে বারণ করেছিলেন আফসানা মাহমুদ। যেখানে নিষেধ থাকে, মানুষ সেখানে বেশি যেতে চায়। দুপুরে খাওয়ার পর তিনি একটানা ঘণ্টা দুয়েক ঘুমান। কোনো কোনো দিন দুপুরে রোকেয়া ডাক দেয় জাকিয়াকে। ওরা ছাদে যাওয়ার সিঁড়িতে বসে। জাকিয়া আফসানা মাহমুদকে পছন্দ করে না। তাঁর কথা বলার সময় জাকিয়া তাঁকে বুড়ি বলে। রোকেয়া জানে, কেন জাকিয়া তার কর্ত্রীকে পছন্দ করে না। সেবিকার চাকরিটা সে করতে চেয়েছিল। তাকে দেওয়া হয়নি, সে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিল বলে। জাকিয়া এই বাড়িতে অনেক দিন থেকে কাজ করছে। বাঁধা কাজের লোক। বেতন মাসে তিন হাজার টাকা। আফসানা মাহমুদের সেবিকা হতে পারলে বেতন হতো আট হাজার টাকা এবং ভালো ভালো খাবার আর এসি রুমে ঘুমানোর সুখ পাওয়া যেত। তা ছাড়া রিয়ার আঁসটেলিপনাও তাকে দেখতে হতো না, খুব ছোট ভুলের জন্য শুনতে হতো না গালাগালি। রোকেয়াকে একদিন বলেছিল, বুড়ির কাছ থেকে সাবধানে থাকতে, বুড়ি রেগে গেলে হাতের কাছে যা পায় ভাঙতে থাকে। একবার টেলিভিশনে 'সিরাজদৌলা' নামের একটি ছবি দেখাচ্ছিল, তখন কাজ করত শেফালী, সিরাজদৌলাকে যখন খুন করা হচ্ছিল আর খুনি কিসব বলছিল, বুড়ির খুব রাগ হয়ে যায়, আরে বাবা ওটা তো ছবি, রাগের কী আছে, বুড়ির হাতে ছিল পানির গ্লাস, আন্ধা বুড়ির কী নিশানা, টেলিভিশনের ওপর ছুড়ে মারল গ্লাস। ভাবি আর ভাই বুড়িরে কিছুই বলল না। তাই বলছি, সাবধানে থাকতে। বুড়ির আরো একটা রোগ আছে, যখন-তখন স্বপ্ন দেখে। রোকেয়া, জেনেছে, দেখেছে, দিনের বেলার ঘুমে তিনি স্বপ্ন দেখুন আর না দেখুন, প্রায়ই রোকেয়াকে বলেন, আজ দেখলাম যুদ্ধের সময়ের স্বপ্ন, আজ দেখলাম মার স্বপ্ন এবং জামিল বিষয়ে স্বপ্ন-কথা বলার আগে একটু হেসে নেন। দেখলাম, আমার মুখে, হাতে, বুকে মা কালি লাগাচ্ছে। মিলিটারির চোখে পড়লে যেন মনে করে কালো মেয়ে। মা কী বোকা ছিল! স্বপ্নে দেখলাম, একটি কালো মেয়েকে মিলিটারির পোশাক পরা তিনটি শকুন ঠোকরাচ্ছে। রোকেয়া, তুমি তো তখন খুব ছোট, যুদ্ধ কী বোঝার বয়স হয়নি। আফসানা মাহমুদ সম্পর্কে জাকিয়া কথা বলার সময় খেয়াল করেছে, রোকেয়া ভালোমন্দ কিছু বলে না। 'কিছু বলেন না কেন, একদিন আমার কথা ঠিক হবে'- জাকিয়ার গোস্বা-কথা শুনে রোকেয়া শুধুই হাসে।
চার
বিজ্ঞাপনটির খসড়া করা হয় তিনবার, করেছেন দুজন। আফসানা মাহমুদ আর রিয়া (২৫)। কোন বাক্য ও শব্দ কোথায় বসালে যথাযথ হবে, চাকরিপ্রার্থীর বুঝতে সুবিধে হবে, তখন 'মধুমেহ', 'অন্ধ' আর 'সন্তানহীনা'- শব্দ তিনটি বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হবে কি না তা-ই নিয়ে কেটে যায় দুই ঘণ্টা এবং খাওয়া হয় দুই কাপ কফি এবং উন্নতমানের কুকিজ এবং রিয়া দুবার বাথরুমে গিয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখেন। টিভি তখন বন্ধ ছিল। রিয়ার মত ছিল, মধুমেহ শব্দের বদলে ডায়াবেটিস শব্দটি বেশি চেনা ও জানা, আর 'অন্ধ' তথ্যটি দেওয়া উচিত; 'সন্তানহীনা' লেখা ঠিক না। আফসানা মাহমুদ বলেছিলেন, 'না, যে চাকরি নিতে আসবে এবং ইন্টারভিউয়ের সময় তার কথাবার্তা ও আচরণের শব্দ শুনে, বুঝে, বোঝা যাবে, সে অন্ধজনকে সেবা করতে পারবে কি না, তার সেনসিটিভিটি কেমন। আর সন্তান তো তার বন্ধন। সেবিকা বেশিদিন থাকবে না, মধুমেহ শব্দটি শুনতে ভালো।' রিয়া কিসব যুক্তি দিচ্ছিলেন, 'মা, তার মানে কি এই নয়, আপনি চাকরিপ্রার্থীকে সব কথা বলতে চান না।' আফসানা মাহমুদ বেশ বিরক্ত হন। রিয়ার বাস্তব জ্ঞানগম্মি নিয়ে তাঁর মনে আগেও সন্দেহ ছিল, আজকাল বেড়ে যাচ্ছে। মেয়েটি বাস্তবতা বোঝে না কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা কি একমুখী? তিনি মুখে কিছু বলেন না। মূর্খদের সঙ্গে বেশি কথা বলা ভালো নয়। তাঁর নিজের চোখ থাকলে তিনি কি আর এই ববছাঁটঅলা, যখন-তখন পারফিউম মাখা, হলিউড আর বলিউডপাড়ার কোন নায়ক-নায়িকা কার সঙ্গে কী কী করল, সেসব খবর শুনে ও রেখে সময় কাটানো, অস্থিরমতির রিয়াকে বিজ্ঞাপন লেখার সময় ডাকতেন? 'রিয়া, এখন রেখে দাও, নাজিম আসলে লেখা যাবে।'
নাজিম মাহমুদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কোনো এক মন্ত্রণালয়ের আমলা। 'কোনো এক মন্ত্রণালয়' বলা ভালো, আমরা জানি, যখন-তখন চাকরি অন্য মন্ত্রণালয়ে চলে যায়। আবার ওএসডিও হতে পারে। অমুক দলের অমুক পাতিনেতার সঙ্গে তাকে দেখা গেছে, সে মনে হয় 'জয় বাংলার'। আবার পল্টনের একটি অফিসের দেয়ালে ১৫ ফুট সাইজের হাস্যময় এক তরুণের ছবি, সে মানে আমলা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন, ছবির তরুণকে অনেকে এ দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার মনে করে, মনে করা এমন এক রহস্যময় ব্যাপার, যার কিনারাকূল পাওয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাথরবৎ কঠিন, অতএব, এটা গুরুতর অপরাধ, আসলে আমলা হয়তো কোনো বিয়েবাড়ি থেকে বের হয়ে ওখানে দাঁড়িয়েছিলেন এবং চোখ পড়েছিল ওই বড় ছবিতে, অথবা তাঁর প্রস্রাব পেয়েছিল, খুঁজছিলেন একটি নিরাপদ জায়গা, অতএব, তিনি হতে পারেন 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' ঘরানার। এই সব রহস্যাবৃত কারণেও মন্ত্রণালয় ঘন ঘন বদলে যেতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আমলা কোনো রকম চিন্তা না করে, স্বরে গম্ভীর ভাব তুলে বলে দিতে পারেন, গাধার দুধের ঘনত্ব কত, কত বছর আগে সাহারা মরুভূমি সবুজ ছিল। নাজিমের বয়স ৪২ প্লাস। খেয়া নামের চার বছর বয়সের এক কন্যা আছে তাঁর। কোনো এক মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। তাঁকে মাইনাস ২.৫০ গ্লাসের চশমা পরতে হয়। রিডিং গ্লাস ছাড়াই অফিসের নথিপত্র আর যেকোনো গোয়েন্দা গল্প পড়তে পারেন। বেশ কিছুদিন থেকে গোয়েন্দাদের আচার-আচরণের প্রভাব তাঁর ওপর পড়ছে। আজকাল যেকোনো বিষয়কে তিনি বিভিন্ন কোণ থেকে বিচার করছেন। বিশেষ করে রিয়ার কথা ও আচবণের মধ্যে খুঁজছেন রহস্য।
নাজিম মাহমুদ আজকাল, প্রতিদিন নয়, মাঝেমধ্যে বেশ রাত করে বাড়ি ফেরেন। অফিসের কাপড় আলনায় রেখে বাথরুমে যান। শরীরে জমা সারা দিনের ধুলোবালি ও ক্লান্তি ধুতে হবে। গরমকালে কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন শাওয়ারের নিচে। বাথরুমে বেশ বড় আয়না লাগিয়েছিলেন রিয়া। কোনো কোনো রাতে বাথরুমের নীল আলো জ্বেলে তিনি আর নাজিম একসঙ্গে গোসল করেন, শাওয়ার ওঁদের ভেজায়, আয়নার মধ্যে দুটো ভেজা শরীরে পড়তে থাকে বৃষ্টিধারা। ওঁরা তীব্র আলিঙ্গন করেন আর হাসেন। শীতের দিনে নাজিম মাহমুদকে কাপড় ছাড়তে হয় না। শুধু হাতমুখ ধুলেই হয়। যেদিন মুড ভালো থাকে, গুনগুন করেন। রিয়া বাথরুমের দরজায় সন্তর্পণে কান রাখেন, গানটি বিশেষ কারো উদ্দেশে গাইছেন? পৃথিবীর বেশির ভাগ গানেই 'তুমি' শব্দটি থাকে। নাজিমের গলায় কোনো সুর নেই। জোরে কথা বললে, যে কেউ বলবে, যদি পরজন্ম থেকে থাকে, ও যদি জন্ম পায়, ওর স্বর হবে ভেড়াজাতকের। 'তুমি' মানে কে? রিয়া চোখ কোঁচকান। তার পরই নাজিমের জামা শোঁকেন, নতুন কোনো পারফিউমের গন্ধ আছে কি না। লম্বা চুল খোঁজেন। সুদর্শন নাজিমের দিকে কত নারীর চোখ, হাসি, মার্জিত অর্থপূর্ণ আচরণের ভাষা কি রিয়া বোঝেন না? কদিন আগে এক বিয়েবাড়িতে রিয়ার এক খালাতো বোন যেভাবে দুলাভাই দুলাভাই বলে নাজিমের সঙ্গে শরীর ঘষে ছবি তুলল, মিনিং ছিল অন্য রকম, রাতে বাড়ি ফিরে তা নিয়ে দুজনের অনেক কথা-কাটাকাটি হলো। কথার তোড় শেষ হতেই নাজিমকে রিয়া টেনে নিয়ে গেলেন বাথরুমে। নিজ হাতে নাজিমের সব কাপড় খুললেন। 'আমাকে তুমি শান্ত করো' বলে রিয়া ছেড়ে দিলেন শাওয়ার। আয়না নিঃশব্দে শুধু সম্মুখ দ্যাখে।
জগতে কোন নারী বা কোন পুরুষ অথবা কোন প্রাণী তার প্রিয়জনকে হারাতে চায়? জামাকাপড় পরীক্ষার পর রিয়া দ্রুত চেক করেন মোবাইল, কলের সময়, অচেনা নম্বর দেখলেই নম্বরটা টুকে রাখেন। পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, পুরুষকে বিশ্বাস নেই। রিয়া বোঝেন না, আমলারা মানুষকে হ্যান্ডল করার ব্যাপারে বিশেষ ট্রেনিং নেয়। কোথায় কার সঙ্গে 'রডোডেনড্রনগুচ্ছ' নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে, কার সঙ্গে সিমেন্ট-বালু নিয়ে এবং ঘরের বউকে স্মিত হেসে কখন হাতে ধরিয়ে দিতে হবে পারফিউম, শাড়ি, প্লেবয় বা ফিল্মফেয়ার বা পেট ফোলা মানিব্যাগ; এসব দাবাবুদ্ধির ব্যবহার প্রায় সবখানেই করতে হয় আমলাদের। তার পরও নারীর গোয়েন্দা চোখে পুরুষের কাজকর্মের ভালোমন্দ ধরা পড়বেই। ঈশ্বর নারীদের এই গুণটি দিতে কার্পণ্য করেননি।
আজ নাজিম অফিস থেকে সরাসরি বাসায় এলেন। এই যথাসময়ে বাসায় ফেরা রিয়ার ভালো লাগল না। কিছুক্ষণ পর শুরু হবে একটি হিন্দি সিরিয়াল। সেটা শেষ হওয়ার পর হবে আরো একটা। নাজিম থাকলে দেখা হবে না। গত সপ্তাহের শুক্রবারে নাজিমের এক বন্ধুর মায়ের কুলখানি ছিল। সেখানে যাওয়ার ফলে দেখা হয়নি দুটি সিরিয়াল। মৌলবি সাহেব যখন কুলখানির মিলাদে, 'এই শানশওকতের জীবন কিছু না, সব শান্তি আর সুখ পরকালে' করুণ স্বরে বলছিলেন, রিয়ার কল্পনার জগতে তখন গতকালের দেখা সিরিয়ালের প্রেমিক-প্রেমিকার শেষ পর্যন্ত দেখা হলো কি না, বিষয়টি অস্থিরভাবে করছিল দৌড়াদৌড়ি। পরদিন সকালে রিয়াকে দুই ভাবির কাছে ফোন করে, মিস করা সিরিয়াল দুটিতে কী কী হয়েছিল, জানতে হলো, মোবাইল কম্পানির পেটে ব্যালান্স চলে গেল ৬০ টাকা।
নাজিমকে তিনি অনেকবার বলেছেন, 'মানুষ যে কত জঘন্য কুটিলতা আর কতভাবে প্রেম করতে পারে তা নাকি সিরিয়ালে দেখা যায়, কত কিছু শেখার আছে।' নাজিম নির্বিকার স্বরে বলেছিলেন, 'কতভাবে যৌনতা দেখাতে পারে, সেটা বললে না কেন?' নাজিমের জবাব শুনে রিয়া বলেন, 'পুরুষরা তো ওইটা ছাড়া আর কিছু বোঝে না, দেখে না।' 'নারীরা ওইটাতে বেশি সুখ আর আনন্দ পায়' বলে নাজিম মহাভারত আর গ্রিক মাইথোলজি থেকে একটা দু-তিন মিনিটের বক্তৃতা দিয়েছিলেন। 'ভীষ্মের কাছে যুধিষ্ঠির জানতে চেয়েছিলেন, স্ত্রী-পুরুষের মিলনকালে কার স্পর্শসুখ বেশি? ভীষ্ম রাজা ভঙ্গাস্বনের গল্প বলেন। ইন্দ্র রাজাকে নারীরূপ দেওয়ার পর, নারীরূপী ভঙ্গাস্বন এক তাপসীর সঙ্গে থাকেন এবং এক শ পুত্র জন্ম দেন। অভিশাপকাল শেষ হলে, ভঙ্গাস্বনের কাছে ইন্দ্র জানতে চান, 'তুমি পুরুষত্ব না স্ত্রীত্ব- কী চাও? রাজা পুরুষ হতে চাননি। ইন্দ্র কারণ জানতে চাইলে, ভঙ্গাস্বনের উত্তর ছিল, দেবরাজ, স্ত্রী ও পুরুষের মিলনের সময় স্ত্রীর সুখই বেশি হয়। প্রায় একই কাহিনী আছে গ্রিক মাইথোলজিতে। জিউস আর হেরার তর্ক, মিলনে কার সুখ ও আনন্দ বেশি? জিউস বলেছিলেন, নারীর। হেরা সে কথা মানতে নারাজ। তাঁর দৃঢ় মত হলো, সুখ ও আনন্দ পুরুষের বেশি। জ্ঞানী তাইরেসিয়াসকে ডাকা হলো মত দেওয়ার জন্য। তাইরেসিয়াস, অঙ্কে হিসাব দিলেন। পুরুষের এক ভাগ আর নারীর ৯। উত্তর শুনে হেরা তাইরেসিয়াসকে অভিশাপ দিলেন। হেসে উঠলেন বিজয়ী জিউস।' রিয়া নিজের ঠোঁটে কামড় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। বেশ শব্দে, যেন এক পরাজয়। হেসে দিলেন নাজিম।
নাজিমকে ডাকলেন, 'মা।' বিজ্ঞাপনের ভাষা ঠিক করতে হবে। নাজিম খসড়া পড়ে বললেন, 'ঠিকই তো আছে, কাল টাইপ করে বাংলা ও ইংরেজি কাগজে দিয়ে দেব।' 'রিয়া বলছিলেন অন্ধ, সন্তানহীনা আর মধুমেহ শব্দ তিনটি বাদ দিতে, আমি দিইনি, তুই কী মনে করিস?' মায়ের কথা শুনে, কারণ না শুনেই নাজিম বললেন, 'তুমি না চাইলে যাবে না।' রিয়া কী একটা বলতে চাইলেন। নাজিম কান না দিয়ে তাঁর মাকে জিজ্ঞেস করেন, 'চোখের ওষুধ আছে তো? আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।' মা জানালেন, তাঁর মনে আছে।
পাঁচ
বিজ্ঞাপন এক লৌকিক অথচ প্রায় অলৌকিক শক্তি ধারণ করে। মোসাম্মত রোকেয়া ইসলাম টিভিতে অন্য কোনো অনুষ্ঠান খুব একটা দেখত না। দেখত শুধু বিজ্ঞাপন। কী তার গতি! দ্রুত শেষ হয়ে যায় পণ্যবিষয়ক একটি ছোটগল্প। বিজ্ঞাপনের দর্শক ধীরে ধীরে নিজের অজান্তে দুপা, দুচোখ আর কিছু বুদ্ধি ও বাঁচার তাড়না নিয়ে একপ্রকার পণ্য হয়ে যায়। মুগ্ধ ও বিচলিত হয়, অনেকে হয় না। বিচলন মানুষকে নিয়ে যায় ঘোরের মধ্যে। সব মানুষের মধ্যে কোনো না কোনো বিষয়ে একটা ঘোর থাকেই, বিজ্ঞাপনেও থাকে। তাদের, কেন বিজ্ঞাপন দেখেন, জিজ্ঞেস করলে বলে, মাত্র ৫ সেকেন্ডের মধ্যে সুন্দর মানুষদের একটি চমক লাগানো গল্প দেখা যায়, ২ মিনিটের বেশি কোনো বিজ্ঞাপন কি হয়? ফাস্ট লাইফের যন্ত্রণার মধ্যে এই রকম এন্টারটেইনমেন্ট ভালো লাগে। পণ্য যদি কিনতে ইচ্ছে করে বাজারে যাবে, কিনবে, ইচ্ছে না হলে কিনবে না। তবে এ কথা ঠিক, বিজ্ঞাপন মানুষের বা ক্রেতার, কে নয় ক্রেতা, মনোজগৎকে প্রভাবিত করে। বিজ্ঞাপিত জিনিস তার চাই, জিনিস হাতে পেতে দ্রুত বাজারে দৌড়ায় সে। আফসানা মাহমুদের বিজ্ঞাপনটি রোকেয়াকে দিয়েছিলেন তার মামা মোহাম্মদ আফসারউদ্দিন। বলেছিলেন, 'তুই মনে করিস নে, আমি তোক আর টানবের পারতিছি নে, তুই একদিন কচ্ছিলু, আমাক আর কত দিন দেখপেন, একটা যেনতেন চাকরি পালি করতেম।'
রোকেয়ার সংসারে টাকা-পয়সা কখনো বেশি ছিল না। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারের বউয়ের হাতে আর কয় টাকা থাকে? তার ওপর মাস্টার মাঝে মাঝেই বলতেন, 'সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ না আসলে মানুষের শান্তি নাই, ভোগবাদী হলেই মরণ।' যার বিন্দুবিসর্গ কিছুই রোকেয়া বুঝত না। আর কিসব কঠিন কঠিন কথা আর বিদেশি অচেনা সব নাম বলতেন তার স্বামী! কার্ল মার্ঙ্, চে গুয়েভারা, মাও জে দং, হো চি মিন। মানুষটার বই কেনার শখ ছিল। অনেক কথার মধ্যে শোষক, শোষণ, শ্রেণিসংগ্রাম, ভোগ, বিজ্ঞাপন শব্দগুলো রোকেয়ার মাথার মধ্যে এখনো ঘুরপাক খায়। স্বামী মোহাম্মদ সোলেমানকে তার মনে হতো, লোকটা পাগল না কিন্তু সমাজের আর দশটা লোকের সঙ্গে লোকটার কথাবার্তা, চলাফেরা মেলেওনি। ছিলেন সৎ মানুষ। কখনো ধর্মকর্ম করতেন না, কিন্তু আশপাশের মানুষ, এমনকি মসজিদের ইমাম সাহেবও তাঁকে সালাম দিতেন। একদিন রোকেয়াকে বলেছিলেন, ইমাম সাহেব তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মাস্টার আল্লাহ মানেন কি না। তাঁর উত্তর ছিল : তিনি সত্যের অনুসারী। ইমাম সাহেব উত্তর শুনে বলেছিলেন, 'সত্যই আল্লাহ।' মানুষটা কঠিন ভাষায় কিসব লিখতেন। রোকেয়াকে শুনিয়ে বলতেন, 'কিছু বুঝলে?' 'খুব কঠিন', এর চেয়ে বেশি কিছু রোকেয়া বলত না।
সোলেমান মাস্টার কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। পাড়ার কিছু কিছু মানুষ তাঁকে বলত, কম্যুনিস্ট। মাস্টার নাকি ঈশ্বর বলেন, আল্লাহ বলেন না। কেউ জানে না, তিনি কাকে নাকি বলেছেন, ঈশ্বর কখনো ঘুমান না, কারণ হলো, তাঁর কোনো শান্তি বা সুখ নেই। যার কোনো শান্তি নেই, সুখ নেই সে ঘুমাবে কিভাবে। তাঁকে কেউই কখনো জিজ্ঞেস করেনি, 'আপনি কি কম্যুনিস্ট?' তাঁর পাড়ার মানুষরা হয়তো ওই শব্দটিই কোথাও থেকে শুনেছে, টেলিভিশনের টক শো থেকেও শুনতে পারে, কিন্তু কথাটার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কখনো শোনার দরকার মনে করেনি। করবে কেন? এই অঞ্চলের মানুষ সেই কবে থেকে নিয়তির দাস! এক নির্ধারিত চক্রের মধ্যে নিজেদের সঁপে দিয়ে খাদ্য খোঁজে, সন্তান উৎপাদন করে এবং কবরখানা বা শ্মশানের দিকে তাকিয়ে পরকাল যেন শান্তিতে কাটে সেই প্রার্থনা করে। 'ঘরের পাশে আরশিনগর, সেথা এক পড়শি বসত করে', 'কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার' গান শুনে চোখ বুজে মাথা দোলায়, যেন পরকালে চলে গেছে। তাদের কাছে বেঁচে থাকাটাই এক রহস্য।
তখন বিকেল প্রায় শেষ। সিঁদুরী আমগাছের পেছনে সূর্য। একটু পর দোহারপাড়া গ্রামে মাগরিবের আজান পড়বে। মুয়াজ্জিনকে রোকেয়া পছন্দ করে না। আজানের সুর খুব সুন্দর, লোকটার গলায় সুরও নেই। তাকে এবং তার গলা ভালো না লাগার কারণ দুটো, সে রোকেয়ার মৃত স্বামী সোলেমান সম্পর্কে এখনো বলে, 'মাস্টের ব্যাটা ছিল একটা নাস্তিক, কোনো দিন পশ্চিমমুখী হয়নি, দোজকের আগুন ব্যাটাক খাওয়ার জন্যি হাসতেছে।' এবং বিধবা হওয়ার পর মুয়াজ্জিন তার সম্পর্কে বলে : 'বিধবার পুরুষ ছাড়া থাকা ভালো না।' এই কথা গ্রামের কয়েকজনকে বলার পর তার, আসল উদ্দেশ্যটা সবাই বুঝে যায়। লোকটা রোকেয়াকে পছন্দ করে, বিয়ে করতে চায়। একদিন সে নাকি রোকেয়াকে স্বপ্নে দেখেছিল। আজান পড়ার ঠিক আগে কুরিয়ার সার্ভিসের পিয়নটা 'বাড়িতে কেউ আছেন' বলে দরজায় কড়া নাড়ে। রোকেয়ার মামা দরজা খোলেন। রোকেয়ার ইন্টারভিউ কার্ড এসেছে।
কাজের বিজ্ঞাপনটি রোকেয়ার মামা, পাবনা বাজারে কাপড়ের মাঝারি দোকানের মালিক মোহাম্মদ আফসারউদ্দিনের চোখে পড়েছিল। মানুষের অনেক রকম প্রবণতা থাকে। আফসারউদ্দিনের দিন ভালো যায় না খবরের কাগজ না পড়লে। তিনি সবচেয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়েন পাত্র ও পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন। তাঁর ভাষায়, বিবাহের বিজ্ঞাপনে সঠিকভাবে দেশের মানুষের মনমেজাজ ফুটে ওঠে। কারণ হলো, বিবাহের মতো একটি প্রতিষ্ঠান যদি ঠিক না থাকে তাহলে বুঝতে হবে পরিবার ভেঙে পড়ছে, আর পরিবার যদি ঠিক না থাকে, সব কিছু তছনছ হয়ে যায়। তিনি ১০ টাকা দামের একটি খবরের কাগজ বাড়িতে রাখেন। তাঁর বিশ্বাস, দুনিয়ার হালচাল বোঝার জন্য খবরের কাগজ পড়তেই হবে। কাগজ পড়া শিখেছিলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ার সময়। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়তে পেরেছিলেন, বিএ পড়া হয়নি। বাপটার হঠাৎ মাথা গরম হওয়ার অসুখ হলো, গ্রামের কেউ কেউ বলত, 'সাপা বাতাস লাগছে', কেউ বলত, 'খারাপ জিনের আসর পড়ছে', এক মধ্যরাতে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে মরে যায়। আফসারউদ্দিনের মাথার ওপর মা, ছোট ভাইবোন- আরো কত কী! বাপ বেশি জমিজিরাতও রেখে যায়নি। দোকানপাট বন্ধ করে রাতে বাড়ি ফেরার সময়, কখনো কখনো, বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে ২ টাকা দামের কাগজে ভিন্ন ধরনের হেডিং, যেমন- 'ওয়াদুদ আহম্মদ আড়ালে কেন? আবার কি ভোল পাল্টাবেন?' 'লীগ কি জামায়াতের সঙ্গে আবার আঁতাত করছে?' দেখলে কেনেন।
বাড়িতে রাখা খবরের কাগজে রোকেয়ার মামা বিজ্ঞাপনটি তিনবার পড়েছিলেন। আগে কখনো এ রকম বিষয়ের বিজ্ঞাপন তাঁর চোখে পড়েনি। ভাষাও আলাদা। তিনি বেশ যত্ন করে বিজ্ঞাপনটির চারপাশে নীল কালিতে দাগান। বলপয়েন্ট কলমটা কামড়েছিলেন দুইবার। এবং কাগজ থেকে চোখ তুলতেই দেখেছিলেন, রোকেয়া উঠানে কাপড় তুলছে। রোকেয়াকে হাতের ইশারায় ডাকেন, বিজ্ঞাপনটি দেখান। রোকেয়া দুইবার পড়ে। মামার চোখ ছিল রোকেয়ার মুখের ওপর। প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছিলেন। রোকেয়া দরখাস্ত পাঠাবে। 'তুই কইছিলু যদি এটা চাকরি পাওয়া যায়', বেশ নিচু স্বর, যেন একটা অপরাধের কথা বলছেন মামা, বাড়ির অন্য ঘরে যায় না।
ছয়
মোজাইক করা মেঝে। ১২/১৪ ফুটের ঘরটার মাঝখানে মাঝারি আকারের একটি টেবিল। রং আবলুশ। টেবিলের একদিকে কালো চশমা চোখে বসেছিলেন এক বৃদ্ধা। পরনে গরদের অফহোয়াইট শাড়ি। তাঁর পাশে বসে ছিল হালকা হলুদ রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা ২৫-২৬ বছর বয়সের একজন সুন্দরী তরুণী। তার চুল স্টেপ কাট। ঠোঁটে ন্যাচারাল কালারের লিপস্টিক। ঘরের জানলায় হালকা নীল কাপড়ের পর্দা। ঘরে দুটো খাট। রং আবলুশ। একটি সিঙ্গল। অন্যটি সেমিডাবল। দুটো খাটেই পাতা ছিল সাদা চাদর। সেমিডাবলে দুটি বালিশ। কাভার সাদা। সিঙ্গলে একটি। কাভার সাদা। উত্তরের দেয়ালে লাগানো ৩০ ইঞ্চির এলসিডি টিভি। সনি। টিভির বেশ ওপরে মোটা আর্ট পেপারে, লেমিনেট করা, বড় বড় অক্ষরে লেখা স্বামী বিবেকানন্দের একটি বাণী। পশ্চিমের দেয়ালে একটি বুকশেলফ। রং মেহগনি। বড়। অনেক বই। শেলফের পাশের ছোট টেবিলে অনেক খবরের কাগজ। গোছানো। পুব দেয়ালের মাঝখানে একটি পুরনো খাঁচা। পাবনার দোহারপাড়া গ্রামের মোসাম্মত রোকেয়া ইসলাম, গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ তাকে রোকেয়া বেওয়া বলে, বয়স ৪৭+, গায়ের রং শ্যামলা, এ রকম একটি ঘরে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিল। পরে, সিঙ্গল খাটে ঘুমাবে আর আফসানা মাহমুদের সঙ্গে বসে বসে ছবি ও টিভি দেখবে এবং বই ও খবরের কাগজ পড়বে, পড়তে হবে।
সিদ্ধেশ্বরীর এই বাসায় ঢোকার সময় রোকেয়া ভেবেছিল, তার মতো আরো কজন চাকরিপ্রার্থীকে সে দেখতে পাবে। কেউ ছিল না। সে একা। তার সঙ্গে ছিল ছোট খালার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়ে রিনা। তাকে একতলার অন্য একটি ঘরে বসানো হয়েছিল। এবং একজন কাজের মহিলা রিনাকে চা আর ভালো বিস্কুট দিয়ে বলেছিল, 'খান, ইন্টারভিউ অনেকক্ষণ হবে। কারো চাকরির জন্য প্রার্থীর সঙ্গে এসে যে চা-বিস্কুট পাওয়া যায়, রিনার কল্পনায়ও ছিল না। ভাবছিল, রোকেয়া আপাকেও নিশ্চয়ই আপ্যায়ন করা হচ্ছে আর চলছে ইন্টারভিউ। এই শান্ত বাড়ির লোকজনের ধীর পায়ে চলাফেরা ও কথা বলার ভদ্রতা দেখে রিনার বেশ সন্দেহ হয়েছিল, এরা দুই নম্বরি কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত নয় তো? আজকাল বিভিন্ন প্রকার বিনয়ের ব্যভিচার এই দেশে চলছে, সে রকম কোনো ফাঁদে তার বিধবা বোন পা দিল না তো, নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত না তো? রিনাকে কাজের মহিলা বাংলা ও ইংরেজি খবরের কাগজের সঙ্গে দু-তিনটি সিনে ম্যাগাজিন দিয়েছিল। রিনা, বলিউডের শাহরুখ খানের ভক্ত, সাতবার দেখেছে শাহরুখ অভিনীত দেবদাস, হিন্দি বলতে ও লিখতে পারে। রোকেয়া যতক্ষণ ইন্টারভিউ দেওয়ায় ব্যস্ত ছিল, রিনা পড়েছে সিনে ম্যাগাজিন। দুবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে শাহরুখের হাস্যময় ঠোঁটে চুমুও দেয়। এই বাড়ির এই ঘরে তার সময় ভালো কেটেছে।
পরে রোকেয়া জানবে, তার আগে আরো তিনজন ইন্টারভিউ দিয়ে গেছে। এবং কারো সঙ্গে কারো যেন দেখা না হয়, সেই হিসাব করে প্রার্থীদের ইন্টারভিউয়ের সময় দেওয়া হয়েছিল। আয়োজনটা বেশ, মনে করে এখনো ভালো লাগে তার। ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার পর রিনাকে রোকেয়া বাড়ির বাইরে এসে বলেছিল, 'এরা খুবই ভদ্র, আমাকে আপনি করে কথা বলেছে, কফি খেতে বলেছিল, আমি আগে তো কফি খাইনি, তারপর ভালো চা-বিস্কুট দিল, আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি আগামীকাল কাজে যোগ দিতে পারব কি না, না পারলে মোবাইলে জানাতে বলেছে, জানিস রিনা, মহিলা অন্ধ, চোখে কালো সানগ্লাস ছিল, ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার পর উনি চশমা খুলেছিল, দুটো চোখই বেশ ঘোলা, মানুষটা ফরসা, মুখটা সুন্দর, সব চুল পাকেনি, কলপ দেয় না মনে হয়, থুঁতনিতে সুন্দর একটা তিল আছে, যৌবনে দেখতে সুন্দর ছিল, খুব লেখাপড়া জানে।'
ইন্টারভিউ বোর্ডে নিয়োগকর্ত্রীর পাশে রিয়া বসেছিল কাগজ-কলম হাতে। কাগজে কিছুই লিখছিল না, কিছু একটা আঁকছিল। কলম চলার শব্দে একবার বৃদ্ধা তার দিকে মাথা ঘোরান। তরুণী আঁকাআঁকি বন্ধ করে। রোকেয়ার লেখাপড়ার সনদ ও অন্যান্য কাগজপত্র সে একবার দেখে নিয়োগকর্ত্রীকে বলেছিল, সব ঠিক আছে। সব প্রশ্ন নিয়োগকর্ত্রীই করেছিলেন।
: আমার নাম আফসানা মাহমুদ, ডাকনাম রাকা, আমি অন্ধ, আপনার নাম তো রোকেয়া, এই দেশে আপনার নামে একজন বিখ্যাত মহিলা ছিলেন, তাঁর পুরো নাম কী এবং বাড়ি কোথায়?
: রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, বাড়ি রংপুর, গ্রাম পায়রাবন্দ।
: জানলেন কিভাবে?
: আমার নামও রোকেয়া তো, তাই আমার স্কুলের আপা সব বলছিলেন।
: রোকেয়া নারী স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন, সে বিষয়ে কখনো কিছু শুনেছেন?
: জি, এনজিওর আপাদের মুখে শুনেছি।
: কী বলেছে তারা?
: সে অনেক কথা। বলে কি, মেয়েরা কয়টা ছেলেপেলে নেবে সেই সিদ্ধান্ত নাকি মেয়েরা নেবে। পুরুষের সমান অধিকার মেয়েদের দিতে হবে। আমাদের গ্রামের পারুল তার স্বামীরে বলছিল সন্তান কয়টা নেবে এই সিদ্ধান্ত নেবে নারী, এনজিওর আপা ট্রেনিং দেওয়ার সুময় বলছিল ওই কথা, ওর স্বামী খবির ওরে থাপ্পড় মারছিল আর খুব খারাপ কথা বলছিল। আমি জানি না, এই কথা কোন দেশ থেকে আসছে। তবে আমার মনে হয়, পুরুষরা মেয়েদের কোনো জায়গা দিতে চায় না, আমি বুঝি, নিজের জায়গা নিজে কইরে নিতে হয়, কে কার জন্যি জায়গা ছাড়ে? আমি এনজিওর আপারে বলছিলাম, নারী স্বাধীনতার ট্রেনিং পুরুষদের আগে দেওয়া দরকার। এনজিও আপা আমার কথার কোনো উত্তর দেয়নি।
মৃদু হেসে রিয়া বলেছিলেন : 'গুড, ইন্টেলিজেন্ট।' এবং কপালে তর্জনী দিয়ে দেখেছিলেন, তাঁর লাল টিপ ঠিক আছে।
রিয়ার কথা শুনে আফসানা মাহমুদ কোঁচকানো চামড়ার ফরসা হাত, ডান হাত, ডানে-বাঁয়ে, যেন হাত নাড়িয়ে কাউকে বিদায় দিচ্ছেন, দোলান। 'তা একপ্রকার নিষেধ, আমার কথার মধ্যে কথা বলো না।'
: কত দিন হলো স্বামী মারা গেছেন? তিনি কী করতেন?
: ছয় বছর আগে। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার ছিলেন।
: কোন ক্লাসে পড়াতেন? কী পড়াতেন?
: ক্লাস ফাইভে। বাংলা আর ইতিহাস পড়াতেন। আর উনি লেখক ছিলেন।
: কী লিখতেন- কবিতা, না গল্প?
: ছোট ছোট লেখা, কবিতা না, গল্প না, বলতেন নিবন্ধ। কঠিন সব কথা লিখতেন।
: সেগুলি আপনার কাছে আছে?
'আছে' শুনে আফসানা মাহমুদ বলেছিলেন, 'যদি আপনি চাকরি পান, লেখাগুলি আনবেন।' রোকেয়া 'আচ্ছা' বলেছিল।
: আপনি বই পড়েন? কী বই পড়েছেন?
: পড়ি। তবে বেশি পড়ি নাই, দেবদাস, আনোয়ারা, কপালকুণ্ডলা পড়ছি।
: কাকে বেশি ভালো লেগেছে- দেবদাসকে, নাকি কপালকুণ্ডলাকে?
: দুইজনের অবস্থা দুই রকম। দুইজনেরই খুব কষ্ট।
: ভালো বলেছেন। সিনেমা দেখতে কেমন লাগে?
প্রায় ২৮-২৯ বছর আগে রোকেয়ার বিয়ের তিন দিন পর, স্বামী মোহাম্মদ সোলেমান তাকে পাবনার বাণী সিনেমা হলে ছবি দেখাতে নিয়ে যান। ছবির নাম তার এখন মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে, ছবির একটি দৃশ্যে নদীতীরে নায়ক নায়িকার হাত ধরে বসে ছিল। নায়ক অনেক কথা বলছিল আর হাসছিল। রিয়া হাতের ইশারা করে বোঝান, উত্তর দেন।
: জি, সিনেমা দেখতে ভালো লাগে।
: কী ধরনের ছবি দেখতে ভালো লাগে?
রোকেয়া উত্তর দেয় না। তার ৪৭+ বছর বয়সের জীবনে খুব বেশি ছবি দেখেনি বা দেখার সুযোগ পায়নি। মোহাম্মদ সোলেমান তাকে দু-তিনবার ছবি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
: আমি তো বেশি ছবি দেখি নাই, তাই কবের পারবো না, কোন ছবির গল্প কী রকম।
আফসানা মাহমুদ উত্তর শুনে হেসে দেন, বলেন, 'গুড অ্যানসার।'
: খবরের কাগজ পড়তেন?
: জি।
: পেতেন কোথায়?
: মামা কাগজ রাখেন।
: মামার বাড়িতে থাকেন?
: জি।
রোকেয়া ভাবছিল, এখন আর কী প্রশ্ন হতে পারে। কিছুক্ষণ নীরবতা। ফ্যানের বাতাসে পর্দা দোলার খসখস শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ ঘরে নেই। রিয়ার মুখের দিকে তাকায়। কাগজে কিসব আঁকছেন। রোকেয়ার চুল বারবার কপালে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। ডান দিকে, কানের ওপরে হাত দিয়ে চুল সরায়। ফ্যানটা বন্ধ থাকলে ভালো হতো, চুল নড়ত না।
: আপনি চুল সরালেন?
রোকেয়া থতমত খেয়ে কোনোমতে বলেছিল : জি।
আফসানা মাহমুদ হেসে বলেছিলেন : অন্ধরা নড়াচড়া বুঝতে পারে।
: রাকা শব্দের অর্থ কী জানেন?
রোকেয়া জানে না। শুধু জানে, তার মৃত স্বামীর বন্ধুর এক মেয়ের নাম ছিল রাকা।
: আপনি রাকা মানে জানেন না। পূর্ণিমা দেখেছেন তো, পূর্ণিমা তিথিকে রাকা বলে।
'দাও' আফসানা মাহমুদের কথা শুনে রিয়া কয়েকটি কাগজ রোকেয়ার সামনে রেখেছিলেন। 'দাও' মানে যে খবরের কাগজ-কাটিং, এই কথা ভেবে এখনো মাঝে মাঝেই রোকেয়া হাসে। খালাতো বোন রিনা একদিন দেখা করতে এলে রোকেয়া তাকে বলেছিল, তার এই চাকরিটা একবার ভালো লাগে, একবার লাগে খারাপ, মনে হয় জেলখানায় আছে, মাঝে মাঝে পালাতে ইচ্ছে করে।
বেশ যত্নে, যেন লাল নেলপলিশ লাগানো সরু নখের খোঁচায় কাগজ ছিঁড়ে না যায়, এ-ফোর সাইজের একগোছা কাগজ রিয়া তুলেছিলেন পাশের টেবিল থেকে। খসখস শব্দ ঘরের দেয়ালে ধাক্কা খায়। কাগজগুলোতে বিভিন্ন খবর কেটে যত্নে সাঁটানো। এবং কোনো কোনো খবরের পাশে মন্তব্য লেখা।
: ওই খবরটা দাও, টিয়া পাখির মতো একটা পাখির ছবির পাশে যে খবরটা সেইটা, রিয়া, ঠিক বলছি না?
: হ্যাঁ মা, ঠিক বলছেন।
: রোকেয়া, ও আমার বউমা, নাম রিয়া, রোকেয়া 'ও পাখি তুই কান্দিস না' খবরটা পড়েন।
ধীরে ধীরে, যতটা স্পষ্ট উচ্চারণে পড়া যায় খবরটা পড়ে শেষ করল রোকেয়া।
: রিয়া, পরের দিনের খবরটা ওনাকে দাও।
রোকেয়া প্রতিবেদনের শিরোনাম 'এখনো প্রিন্সের অপেক্ষায়' পড়ে থেমে যায়। আফসানা মাহমুদের মুখোমুখি বসে কয়েক সেকেন্ড মনে মনে পড়তে থাকে। রিয়া বলেন, উচ্চারণ করে পড়ুন। দু-তিনবার ঢোক গেলে রোকেয়া। প্রতিবেদনটি পড়া শেষ করে।
'ব্লু গোল্ড ম্যাকাও দম্পতি প্রিন্স ও প্রিন্সেস দুই মালিকের হেফাজতে রয়েছে। তাই আলাদা দিন কাটছে তাদের। মামলার বিবাদী বলছেন, 'প্রিন্সকে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহানগর হাকিম আদালত। কিন্তু পুলিশ এ বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছে না।' আর মামলার বাদী বলছেন, 'আদালত এমন কোনো নির্দেশ দেননি। এ জন্য প্রিন্স তাঁর হেফাজতেই রয়েছে।'
পাখির প্রেম বিষয়ে প্রতিবেদন পড়ার সময় দু-তিনটি যুক্তাক্ষরের শব্দ পড়তে রোকেয়ার একটু বেধে গিয়েছিল। পড়ার পরে তার নিজেরই মনে হয়, কত দিন উচ্চারণ করে পড়া হয় না। উচ্চারণ করে পড়লে তো ভালোই লাগে। নিজেকে অপর করে শোনানো যায় অন্যের কথা।
: টেলিভিশন জিনিসটাকে আপনার কী মনে হয়?
প্রশ্নটি শুনে রোকেয়ার চোখ ও সামান্য মোটা ঠোঁট মৃদু হাসে। শব্দহীন। একটা শ্বাস পড়ে। রিয়া তাঁর সরু তর্জনী আর মধ্যমা নাড়িয়ে সন্তর্পণে ইশারা করেন। অর্থাৎ না হাসা ভালো। আফসানা মাহমুদ বলেন, 'প্রশ্ন শুনে হাসছেন কেন, আগে যিনি ইন্টারভিউ দিতে আসছিলেন, তিনিও হেসেছিলেন।' রোকেয়া অবাক, অন্ধ মানুষটার অনুমানও সত্য।
: টেলিভিশন জিনিসটা আমার ভালো লাগে, কত রকম গান-বাজনা, নাটক দেখা যায়, বিজ্ঞাপন দেখতে বেশি ভালো লাগে।
: কেন?
: অল্প সুময়ের মধ্যি একটা আনন্দ পাওয়া যায়।
রোকেয়ার উত্তর শুনে মৃদু হাসেন আফসানা মাহমুদ। তাঁর হাসির পর একটু শব্দ করে হাসেন রিয়া।
রোকেয়ার হাসি পাওয়ার কারণ তার শিক্ষক স্বামী মোহাম্মদ সোলেমানের 'টেলিভিশন জিনিসটা মানুষকে ছাগল বানায়', কথাটা মনে পড়েছিল। সোলেমান মাস্টার হেসে হেসে আরো বলতেন, 'টিভি হচ্ছে একটা চালাক নারী, শুধু রূপ বদলায়, কোনো দেবতাও টিভির কায়কারবার বুঝতে পারবে না, মানুষকে এক ঘোরের মধ্যে ফেইলে রাখে, যেমন রাখে সুন্দরী মেয়েরা, তুমি তো টক শো দেখো না, শোনো না; অ্যাড দেখতে তোমার ভালো লাগে, আমি অ্যাডের পর একটা নিবন্ধ লিখব।'
: 'এবার আমাকে যেকোনো প্রশ্ন করেন?' আফসানা মাহমুদের স্বর বেশ ভারী।
রোকেয়া একটা বিষম ফাঁপড়ে পড়ে যায়। আগে কোনো দিন কোনো চাকরির জন্য ইন্টারভিউ তাকে দিতে হয়নি, জানেও না, অনেক রকম প্রশ্নের মধ্য দিয়ে নিয়োগকর্তা বা কর্ত্রী কোন কৌশলে চাকরিপ্রার্থীর কোন যোগ্যতা বা অযোগ্যতা বোঝার চেষ্টা করেন। রিয়ার মুখের দিকে তাকায়, যদি তিনি কিছু সাহায্য করেন। রিয়া চোখের ইশারায় বোঝান, যা ইচ্ছে প্রশ্ন করেন।
: আপনার কয় ছেলেমেয়ে?
: এক ছেলে দুই মেয়ে। ছেলে নাজিম, ওর বউ রিয়া, এই যে পাশে বসে আছে, ওদের এক মেয়ে, আমার নাতনি, নাম খেয়া। বড় মেয়ে বাবলী, ঢাকায় থাকে, তার স্বামী ডাক্তার। ছোট মেয়ে রূপালী, বিদেশে থাকে, নিউজিল্যান্ডে, দেশটি কোথায় জানেন?
রোকেয়া ভূগোলে কখনো ভালো ছিল না। বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আর উত্তরে হিমালয়, এইটুকু জানে। পৃথিবীর কোথায় কোন ল্যান্ড তার খবর রাখে না।
রোকেয়া আর প্রশ্ন খুঁজে পায় না। অন্ধ মানুষটির কালো চশমা দ্যাখে। তিনজন মানুষ কেবল বসে আছে। মানুষের স্থবির স্তূপ।
: আরো দু-একটি প্রশ্ন করেন।
: দেয়ালে খাঁচা কেন?
: আমার একটা কাকাতুয়া ছিল। তার খাঁচা। আমি কাকাতুয়ার সঙ্গে কথা বলতাম।
রোকেয়া ঘরটির চারদিকে তাকায়। দেয়াল থেকে প্রশ্ন খোঁজে, অন্ধজনের কালো চশমার কাচ থেকে প্রশ্ন খোঁজে। এ রকম কঠিন অবস্থায় আগে কখনো পড়েনি। নিজেকে খাঁচার মধ্যে দেখতে পায়।
: 'কী, কিছু বলেন?' আফসানা মাহমুদ এবার একটু অসহিষ্ণু।
: দেয়ালে একটি লেখার নিচে স্বামী বিবেকানন্দ লেখা, আমার স্বামীর কাছে ওনার নাম শুনেছিলাম?
: কী বলেছিলেন আপনার স্বামী?
রোকেয়া মনে করার চেষ্টা করে। চুলে হাত দেয়। বলে মনে পড়ছে না।
: আপনি ওখানে যান। লেখাটি দুইবার পড়বেন। একটু জোরে পড়বেন।
রোকেয়া টিভির সামনে যায়। পড়ে : 'জগতের সমুদয় ধনরাশির চেয়ে মানুষ বেশি মূল্যবান।...মানবপ্রকৃতির মহিমা কখনো ভুলো না। আমরাই সর্বোচ্চ ঈশ্বর : স্বামী বিবেকানন্দ।'
পড়া শেষ হলে রোকেয়া তার চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়ায়। আফসানা মাহমুদ হাতের ইশারায় বসতে বলেন।
: স্বামী বিবেকানন্দের আসল নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। এখন শুধু এইটুকু জেনে রাখুন, তিনি পৃথিবীর সব মানুষকে ভালোবাসতেন। মানুষ ও সমাজকে শিক্ষিত করার জন্য রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন স্থাপন করেন। যা পড়লেন, আগে কখনো এ রকম কথা শুনেছেন?
: না, শুনিনি। তবে আমার স্বামী এক কবির কবিতা বলে বলতেন : সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।
: আপনার স্বামী খুব শিক্ষিত মানুষ ছিলেন।
স্বামীর প্রশংসা শুনে রোকেয়ার মুখ উজ্জ্বল। ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নখ খোঁচায়।
রোকেয়ার আগে যে দুজন ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল, তারা প্রতিবেদন দুটি পড়ার পরে হেসেছিল এবং বলেছিল, আজগুবি ব্যাপার। ওই একটি কমেন্টের কারণেই তাদের চাকরি পাওয়ার সুযোগ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু রোকেয়ার চুপচাপ অবস্থা বুঝে আফসানা মাহমুদ ও তাঁর ছেলের বউ খুশি হয়। চাকরি পাওয়ার প্রায় দুই সপ্তাহ পরে আফসানা মাহমুদ রোকেয়াকে কেন ওই পাখি দুটির খবর পড়ে সে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে গিয়েছিল, জিজ্ঞেস করবেন। আর শুনবেন, এ রকম কথা জীবনে রোকেয়া শোনেনি যে পাখিদেরও প্রেম হয়, মানুষই প্রেম ভুলে যায়, আর পাখি, তার ওই সময় মনে হয়েছিল, পাখিরা মানুষের চেয়ে অনেক ভালো। পাখিদের মধ্যেও যে প্রেম ও বিরহের সত্যিকার ব্যথা আছে, এই খবর না পড়লে রোকেয়া বুঝতেই পারত না। আরো মনে পড়েছিল, সোলেমান মাস্টারের মুখ।
সাত
প্রায় ৩০ বছর আগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিল রোকেয়া। মানবিকে পড়ত। এখন বিধবা। মা হতে পারেনি। ডাক্তার, স্বামীর শুক্রাণু, স্ত্রীর ডিম্বাণু, মানব জন্মের জন্য অন্য কোনো বিকল্প নেই- এমন জরুরি দুই অণু পরীক্ষা করে বলেছিলেন, 'রোকেয়া কখনো মা হতে পারবে না, তার ডিম্বাণু নেই।' ডিম, এই বস্তুতে কত কী! শিশুমুখ, বংশমুখ, প্রাণধারার মুখ। প্রাইমারি স্কুল মাস্টার স্বামী মোহাম্মদ সোলেমানকে তার বাপ-মা ও বহু রকম আত্মীয়, পাড়া-পড়শি যারা পরামর্শবাতে ঘুমাতে পারে না, বলেছিল, 'বাইজে বউ দিয়ে কী করবু, তালাক দে, আরেকটা বিয়ে কর।' মাস্টার কারো কথা শোনেননি। রোকেয়াও তাঁকে বিয়ে করতে বলেছিল। সোলেমান মাস্টার, বউয়ের চোখের পানি খসখসে হাতে, ব্ল্যাকবোর্ডের চক মোছা হাত, মুছে দিয়ে বলেছিলেন, 'আমারে প্রেম আর ভালোবাসা যাবি কোনে।'
দুঃখীরা ভালোবাসার মানুষকে বেশি দিন কাছে বা পাশে পায় না। শহরে কী এক অদ্ভুত জ্বর এলো। ডাক্তার আর ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বললেন, নতুন ভাইরাস। কী একটা নামও দিতে হলো। নাম থাকা মানুষের যেমন অধিকার, রোগেও সে অধিকার আছে। কে না অধিকার চায়! কোনো কিছুর নাম না রাখতে পারলে মানুষ স্বস্তি পায় না। নিজের বাসনা বা কর্তৃত্ব জাহির করতে পারে না। একটা বড় শ্বাস পড়ল মোহাম্মদ সোলেমানের। চার দিনের তীব্র জ্বরে সোলেমান মাস্টার মরে গেলেন। মৃত্যুর সময় রোকেয়ার নরম হাত ছিল তার স্বামীর কপালে। পাশে থাকা কোনো এক আত্মীয় তার হাত সোলেমানের কপাল থেকে সরিয়ে নেয়। মৃতের কপালের সেই অদ্ভুত ঠাণ্ডা রোকেয়ার হাতে এখনো লেগে আছে।
আট
'টিভিটা বন্ধ করো, একটানা কতক্ষণ বিজ্ঞাপন হচ্ছে, ও, তোমার তো আবার বিজ্ঞাপন দেখতে ভালো লাগে।' রোকেয়া টিভি বন্ধ করে। দুজন মানুষের কোনো কাজ নেই। যেন জীবনের সব কাজ শেষ করে ফেলেছে। 'তুমি না ইন্টারভিউয়ের সময় বলেছিলে, তোমার স্বামী নিবন্ধ লিখতেন, এনেছিলে না? এখন আনো, পড়ো।'
লাল টিনের বাঙ্ ছিল রোকেয়ার ছোট্ট পৃথিবী। বেশি কিছু না, বিয়ের কাপড়চোপড়, পাউডার, সাবান, একটা সাধারণ সুগন্ধি, আয়না ও চিরুনি, মাস্টারের কিছু লেখা, 'কালিদাস পণ্ডিতের ধাঁধা', 'গোপাল ভাঁড়ের সেরা গল্প' এবং 'বিশ্ব বিচিত্রা'। তিনটি বইয়ের দাম পড়েছিল মাত্র ১০ টাকা। বই পড়তে পড়তে কত বিকেল আর সন্ধ্যা হাসতে হাসতে কেটেছে রোকেয়া আর সোলেমানের! মোহাম্মদ সোলেমান তিনটি বই কিনেছিলেন বাসের মধ্যে। বলেছিলেন, 'পড়লাম আর হাসলাম। জার্নির ধকলটা হাসির মধ্যে ঝামেলা করেনি। ধাঁধার খেলায় বুদ্ধি বাড়ে, তুমি পড়বা। জানো, দক্ষিণ সুদানের ছেলেরা বাপ মরে গেলে, সৎ মার সঙ্গে বিছানায় যায় আর যেসব সন্তান হয়, হয় বাপের নামে।' 'এর মধ্যি হাসির কী আছে, এই সব জ্ঞান আমার দরকার নেই'- বলেছিল রোকেয়া। 'না, এই কথা বিশ্ব বিচিত্রায় আছে।' 'আচ্ছা বলো তো, কে রক্তপাত বেশি দ্যাখে- নারী, না পুরুষ?' রোকেয়া বলেছিল, 'নারী, প্রতি মাসেই তো দেখতে হয়', এই ধাঁধার উত্তরে বউয়ের বুদ্ধিতে মাস্টার খুশি হয়েছিলেন।
'রোকেয়া, তুমি আর আমি কৌতুক করি না, ভালো করে হাসিও না, কী যে হলো আমাদের', আফসানা মাহমুদের বলার ধরনে রোকেয়ার মনে হয়, এটা কোনো প্রশ্ন নয়, কথাটির মধ্যে কোথাও একটা সত্য আছে। সে কিছু বলে না। ঘরের নিঃশব্দতার মধ্যে বয়সী মানুষের একটি অন্ধ দীর্ঘশ্বাস ঘুরে বেড়ায়।
নয়
নিবন্ধ পাঠ
কথা পুরনো, তবে শেষহীন, চোখ পাপের আঁতুড়ঘর। চোখ, চিরঘুমের দেশে চলে না যাওয়া পর্যন্ত এক অতৃপ্ত ইন্দ্রিয়, প্রায় সর্বদা বিচিত্র রকমের স্বপ্ন, সুখ, আনন্দ, ঈর্ষা, অপরাধ, খুন, প্রেম, যৌনতা, ভালোবাসা আর কাতরতার কাহিনী খুঁজে বেড়ায়। সেখান থেকে সব দৃশ্য চলে যায় মাথার ভেতরে থাকা সাদাটে অজস্র কোষে। আর সেখানে ক্রমেই উৎপন্ন হতে থাকে মানুষ আর পশুদের সব কলাপ আর প্রকাশ। চোখ শিক্ষা, অশিক্ষা আর অর্জিত অভিজ্ঞতার প্রথম সাক্ষী। এখনকার বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, খুন, গুম, লুটতরাজের সঙ্গে এক ভালো চোখ আর এক অন্ধ চোখ রাত-দিন ঝগড়া আর মারামারি করছে।
চোখ যা দেখেছে, মাথার ভেতরে সঞ্চয় করেছে বুদ্ধি বা স্মৃতি, স্মৃতি তো বুদ্ধির সহোদর, স্মৃতি নামের এক গুদামঘরে অভিজ্ঞতার শুকনো বালি, উর্বর মাটি, ভাঙন, ফলদ ও বাঁজা গাছপালা, মানুষের মুখ, হায় মুখ কত প্রকার এবং আনন্দ-যন্ত্রণার সব গোছালো-অগোছালো ফর্ম ঘুমায়, বসে থাকে, হাঁটে, কথা বলে। পুরনো বস্তুকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পরও, যারা একদা দেখেছিল, তাদের সঙ্গে কথা বলে বলে, আবার, যদি মনে করা হয়, না ওই পুরনোকে বিশেষভাবে প্রয়োজন, ঐতিহ্য বলে কথা না, জ্ঞান বলে কথা না, '৭১ বলে কথা না, '৭৫-এ ১৫ই আগস্ট এবং সামরিক শাসন বলে কথা না, নির্মাণ ছাড়া বাঁচা যে অর্থহীন, এই দেশের অন্ধজনও সেসবের হিসাব করে।
অসৃষ্টিশীলতার সঙ্গ কোনো প্রাণী ভালোবাসে না। কিছু না হোক, কথা বলা বা ইতিহাস বলা একজন মানুষের সঙ্গ আরেকজনের প্রয়োজন। কথা বা শব্দ বা সাউন্ড যা-ই হোক, বাঁচার অনুষঙ্গ বটে।
'আর পড়ো না, তোমার স্বামী অন্য রকমভাবে চিন্তা করতে পারতেন।' রোকেয়াকে থামিয়ে দেন আফসানা মাহমুদ।
'আমার গল্পের খাতাটা আনো। যেকোনো একটা গল্প পড়ো।' রোকেয়া গল্প নামের এই জিনিস আগেও পড়েছে।
জাফর আমাকে আজকাল বেশি সময় দিচ্ছে না। সেদিন বলল, একটি কাকাতুয়া কিনে আনবে, যেন আমি পাখিটাকে কথা শেখাতে পারি, কথা বলতে পারি পাখির সঙ্গে। পাখিকে কী কথা শেখাব। কার নাম প্রথমে শেখাব। রাকার নাম? তারপর 'আমি তোমাকে ভালোবাসি'। পাখির মুখে এই কথা শুনে জাফর খুব খুশি হবে। জাফর মনে করতে পারে, কথাটি তার জন্য নয়, জামিলের জন্য। আমি পাখিকে প্রথম শেখালাম 'জাফর', পরে 'রাকা', তারপর 'ছোলা দাও'। পড়া শেষ হলে শেফালীর প্রশ্ন, 'এটা কী গল্প?' শেফালীকে আফসানা মাহমুদ বলেছিলেন, 'একটা শেষ না-হওয়া গল্পের মূলকথা।' 'এখন কানামাছি খেলব', অনেক কাজের মধ্যে এই খেলাটি সবচেয়ে বিরক্তিকর লাগে রোকেয়ার।
আফসানা মাহমুদের কানামাছি খেলার একটি নিয়ম, রোকেয়ার চোখ বাঁধতে হবে। ঘরের মধ্যে তখন দুজনই অন্ধ। এবং খেলার সময়, তাঁকে ডাকতে হবে রাকা।
মাঝখানের টেবিল সরিয়ে টিভির সামনে রাখা হলো। কোনো অন্ধ যেন টিভির দেয়ালে চলে না যায়।
দুজন চলে গেল ঘরের দুই কোনায়। 'আয়' রাকার বন্ধুসুলভ ডাকে রোকেয়া দুহাত বাড়িয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে। রাকা হাসে। রোকেয়া জানে, রাকা কোন দিকে গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু ইচ্ছে করেই রোকেয়া ওদিকে যাবে না। দু-একবার এদিক-ওদিক ঘুরবে। অন্ধকার ঘরের মধ্যে রাকার হাসির শব্দ ভুতুড়ে শোনায়। 'মা তুমি কোথায়, আমি কানামাছি খেলব না; কাকলী তুই কই, আমি কানামাছি খেলব না'- রাকার এই সব অসহায়ত্বের আবেদনে রোকেয়া সাড়া দেয়, চোখে বাঁধা কাপড় খুলে ফেলে। আলো জ্বালে। রাকা হাসে। এবারের হাসি ভুতুড়ে নয়।
দশ
"উত্তমকুমারের ওই ছবিটা দাও, নাম 'থানা থেকে আসছি', ওইখানে আছে।" রোকেয়া ডিভিডি রমে ডিস্ক দেয়। আফসানা মাহমুদ এই ছবির সব দৃশ্য, সংলাপ, উত্তমের তাকানো- সব কিছু বিড়বিড় করে বলতে থাকেন। আর কিসব ব্যাখ্যা করেন। রোকেয়া বুড়িকে ভেংচি দেখায়। এই ছবির মূল বক্তব্য নিয়ে জামিল একটি চিঠি লিখেছিল রাকাকে। এই জীর্ণমতো চিঠিটাও রোকেয়াকে পড়তে হয়েছে অনেকবার।
'আলোর মধ্যে যত ঘটনা ঘটে, আমরা জেনেছি, অন্ধকারের মধ্যে ঘটে যায় অনেক বেশি। রাতে যত খুন হয়, দিনে তার সিকি ভাগও হয় না। সব মানুষের মন ও চিন্তার মধ্যে একটি কালো স্রোতোধারা, যা অপরাধের নামান্তর, মৃত্যু পর্যন্ত প্রবহমান থাকে। যে মানুষের মধ্যে নেগেটিভ অ্যাটিটিউড বেশি, কোথাও আমি পড়েছিলাম, তার পক্ষপাত থাকে কালো রঙের দিকে। খুন আর অপরাধ করার দিকে। এই দেশের সব কাজকর্মের দিকে তাকালে সব সময়ই বলতে হবে : থানা থেকে আসছি।
'পজিটিভ চিন্তাচেতনার মানুষরা কষ্ট পায় বেশি। চারদিকে নেতির বিজয় দেখে তারা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর দুঃখে হাত কামড়ায়। শূন্যতাকে খামচায়। কোনো মানুষের মধ্যে সর্বদা চলমান থাকা ওই কালো স্রোত যখন অন্য কোনোজনের সহজ জীবনযাপনের কূলকিনারা ডুবিয়ে দেয়, দেখা দেয় খুন, রক্তপাত বা বিচ্ছেদ। মানুষের জগতে শিশুর জন্য সম্ভবত নিরাপদ অন্ধকার আছে মাতৃগর্ভে। সেখানে থাকার সময় রক্তমিশ্রিত অন্ধকারের প্রভাব শিশুর মাতৃগর্ভকালীন মনস্তত্ত্বে কি পড়ে? মনে হয় পড়ে। যদি না-ই বা পড়বে, জন্মের পর মানুষ অন্ধকারকে ভয় পাবে কেন? অন্ধকারকে নিজের সুবিধামতো ব্যবহারই বা করে কেন? যেমন আমরা শুনে থাকি এবং শুনে কিছু রহস্যে অবাক হই, অবাক না হলে মানুষের বেঁচে থাকা একঘেয়ে লাগে, মারফতি গানে আছে না : 'আইছো তুমি আন্ধার কুঠরি থেকে, বান্দা যাইবা তুমি আন্ধারের ঘরে।' জীবনযাপনের যত রকম উত্থান-পতনের গর্ভে মানুষ যায়, যেতে হয়, সেখানে শুধু অন্ধকার অথবা কিছু আলোর সঙ্গে মানুষকে নিরন্তর করে যেতে হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া এক মুহূর্তও কেউ বেঁচে থাকে না। প্রকাশ্য আর অপ্রকাশ্য- এ দুই অবস্থার মধ্যে আমাদের চলাচল, জীবনযাপন, কথোপকথন, গ্রহণ ও ত্যাগ প্রায় সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। আর প্রশ্ন ও উত্তর ছাড়া আমরা কবে দরজার বাইরে যেতে পারি? রাকা, এই ছবির মানুষগুলি যে মুখোশ পরে আছে, আমরাও প্রায় তাদের মতোই। তুমি ভালো থেকো। তোমার জামিল।'
রোকেয়ার মনে হয়, প্রেমিক কি প্রেমিকাকে এই রকম চিঠি লেখে। কী কঠিন কঠিন আলাপসালাপ। প্রেমিক জামিলকে নিয়ে যেকোনো বিষয়ে আফসানা মাহমুদের চোখের পাতা কাঁপতে থাকে। অবশ্যই আনন্দে।
এগারো
কিছুক্ষণ আগে আফসানা মাহমুদ দুপুরের নিয়মিত ঘুম থেকে উঠেছেন। রোকেয়ার মনে হলো, নতুন কোনো স্বপ্নের কথা এখন শুনতে হতে পারে। প্রস্তুত ছিল সে। তাঁর ইচ্ছে হলো, বাঁধাই করা মোটা খাতার পাতায় সাঁটা একটি প্রতিবেদন শোনার। স্বপ্নে কি প্রতিবেদন শোনার মতো কিছু দেখেছে? রোকেয়া প্রশ্নটি করতে পারে না। এই খাতাটির প্রায় সব কিছু একাধিকবার রোকেয়াকে পড়তে হয়েছে। লেখাটি মনে হয়, প্রতিবেদন আকারে আফসানা মাহমুদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ছাপা হয়েছিল।
প্রশ্ন ও উত্তরেই নিহিত জগতের সচলতা, মানুষের বেঁচে থাকা। অন্ধরা অনেক প্রশ্ন করে না। সব উত্তরে স্যাটিসফায়েড হয় বলে মনে হয় না। তবে বেশির ভাগ সময় তার ৬৫ বছর বয়সের কপালে, উত্তর শুনে একটি কম্পন দেখা যায় এবং শোনা যায় দীর্ঘশ্বাস। যখন ঘরে একা থাকেন, কলম বা পেনসিল হাতে নিয়ে তিনি নিজের, মা-বাবার, যৌবনে চেনা এক তরুণের ও প্রিয় নদীর নাম এবং আলো, অন্ধকার, জীবন, কালো ও ভালোবাসা- শব্দগুলো সুন্দরভাবে, গোটা গোটা অক্ষরে লিখতে পারেন। তাঁর লেখা দেখে কেউ বলবে না, এই লেখা কোনো অন্ধজনের। তিনি কখনো কখনো, যখন তাঁর সেবিকার বই পড়া শুনতে ভালো লাগে না, ভালো না লাগার একটি কারণ, একই কণ্ঠস্বরের একঘেয়েমি; আরো একটি কারণ, বাক্যের কোথায় যতি হবে, তা পাঠের সময় সেবিকা মাঝেমধ্যে খেয়াল করে না, একটানে পড়ে যায়, তখন তিনি হাতের ইশারা করেন। সেবিকা পড়া বন্ধ করে। মাঝেমধ্যে তিনি সেবিকাকে জিজ্ঞেস করেন, 'লাবণ্যর বিয়ে অমিতের সাথে হলে কি ভালো হতো?' সেবিকা সহজ-সরল উত্তর দেয় : 'ভালো হতো না, ছেলেটাকে নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরা যায়, সে কানে দুল আর চোখের ভ্রুতে রিং পরা এখনকার কিছু ছেলের মতো, তাকে নিয়ে সংসার করা যায় না।' উত্তর শুনে তিনি মৃদু হাসেন, 'তুমি তো ভালোই বোঝো।'
কদিন আগে দুপুর ১২টার দিকে বৃষ্টি হচ্ছিল, শ্রাবণ মাস, কিছুক্ষণ আগে সেবিকা খবরের কাগজের একটি খবর পড়া শেষ করেছে। 'প্রেমিকার হাতে প্রেমিক খুন' খবরটি সেবিকাকে দুবার পড়তে হয়। পড়া শেষ হলে তিনি সেবিকাকে নাকি বলেছিলেন, 'জামিলকে আমার খুন করতে ইচ্ছে হয়েছিল।'
ঘন কালোর মধ্যে কখনো দৈবাৎ বহুবর্ণমিশ্রিত এক অচেনা রং, যাকে কোনো চেনা রঙের ঘরানায় রাখা যায় না, বলক তুলেই কোনো এক শূন্যতায় চলে যায়। ওই রং যে দৃশ্য দ্রুত এঁকে যায়, তার চিহ্ন মনে করতে করতেই আরেক ধূসর রঙের ঝাপটা এসে পড়ে চোখের সামনে। ওই হারিয়ে যাওয়া রং ছিল সামান্য উজ্জ্বল। যদিও ওই উজ্জ্বলতা অন্ধকারের নামান্তর। ঘন কুয়াশা, যা সাদা অন্ধকার, এক হাত দূরে ভালো চোখের দৃষ্টিও সাদা তুলোর ঠাণ্ডা দেয়াল ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না, চোখ থেকেও পথিক সেখানে অন্ধ। এই অসম খেলা, কালো শূন্যতার ঢেউ তোলা সীমাহীন স্তর চলতেই থাকে, যতক্ষণ তিনি জেগে থাকেন, তাঁর চোখের সামনে।
পড়া শেষ হলে রোকেয়াকে অন্য একটি গল্প পড়তে বলেন আফসানা মাহমুদ। রোকেয়া এত দিনে জেনে গেছে, কোন গল্প পড়লে বুড়ির মন ভালো থাকে।
শ্রাবণ মাস। খুব বৃষ্টি হচ্ছে। জামিল প্রথম আমাকে দেখেছিল বৃষ্টির দিনে। আমরা কজন ছাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলাম ডিপার্টমেন্টের বারান্দায়। আমার বন্ধু রেহানা হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরছিল। ওর চোখ ছিল বারান্দার পূর্ব দিকে, ওদিক থেকে আসবেন স্যার। জামিল যাচ্ছিল তার ক্লাসে। অন্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। রেহানা বৃষ্টি ধরতে ধরতেই খেয়াল করেছিল, জামিল আমাকে দেখতে দেখতে আসছে। পরের দিন বৃষ্টি ছিল না। জামিল ধীর পায়ে হেঁটে আমাদের পাশ দিয়ে চলে যায়। রেহানা বলে, 'ছেলেটি তোর প্রেমে পড়েছে মনে হয়।' তৃতীয় দিন জামিল আসে না। আমি রেহানাকে বলি, 'কই, ছেলেটি তো এলো না।' 'কালকে আসবেই, তোকে চিন্তা করার সময় দিল', রেহানার কথা সত্যি হয়েছিল। এই গল্পটির নিচে দুটি ফুল ও দুটি পাখি আঁকা ছিল।
বারো
'গান বন্ধ করো', কালো রিমোটের ৭ নম্বর টিপে রোকেয়া টিভি বন্ধ করে দিল।
'আপনি তো এই গানটা ভালোবাসেন', রোকেয়ার কথার জবাব না দিয়ে আফসানা মাহমুদ বললেন, 'পানি দাও, সন্ধ্যা না? ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।' ওষুধ খেয়ে বললেন, 'টিভিটা ছাড়ো।'
রোকেয়া যেসব শর্তে অন্ধজনকে সেবা দেওয়ার চাকরি নিয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো, সে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলতে পারবে না। আফসানা মাহমুদের শ্রবণেন্দ্রিয় এই ৬৫ বছর বয়সেও হরিণের কানের মতো সচেতন বা বলা যায় কুকুরের কানের মতো শার্প। তা হবেই তো, অন্ধদের অন্য সব ইন্দ্রিয়, আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে জেনেছি, খুবই সেনসিটিভ হয়। সাপোর্টিভ হয়। তাদের বেঁচে থাকাকে নির্ভরতা দেয়। যদিও করুণার বিবিধ ধারা সারাক্ষণ সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে চারপাশে ঘুরঘুর করে। রোকেয়া ঠোঁট উত্তর-দক্ষিণে বাড়িয়ে-কমিয়ে বিরক্তি শেয়ার করে নিজের সঙ্গে। টিভি খুলে দেয়।
এক অচেনা শিল্পীর শ্রবণসহন কণ্ঠ তখন গেয়ে উঠল 'নিবিড় সুখে মধুর দুখে জড়িত ছিল সেই দিন।' আর আশ্চর্য, বিজয়ী বা পরাজিত মানুষ, যে বয়সেরই হোক না কেন, ঘটনা, যদি তা নিজের পক্ষে যায়, তার সঙ্গে একাত্ম বোধ করে। কিন্তু আফসানা মাহমুদ পরের লাইন 'দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বীণ' শিল্পীর সঙ্গে গুনগুন করে গাইলেন না। এই কাজটি তিনি প্রায়ই করেন। করে একটু হাসেন। এই হাসি, হয়তো কোনো স্মৃতির সঙ্গে হাঁটতে থাকেন তখন। আর স্মৃতি এমন এক পরবাস, যার থেকে মানুষের কোনো রেহাই নেই। কোনো কোনো স্মৃতি মানুষ ভুলে যেতে চায়, পারে না। তিনি সাদা শাড়ির লক্ষ্মীর পা-ছবির আঁচল শুকনো কোঁচকানো সাদাটে চামড়ার স্তনের ওপর টেনে, এই অঞ্চলের প্রায় সব বয়সের নারীরা, যাদের স্তনের স্ফীতি থাকুক আর না-ই থাকুক, বুকে টানে কাপড়, অন্য গানে তার সুরহীন ঘসঘসে গলায়, 'আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে/তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগনতলে' গাইলেন নিচু স্বরে। মুখে আবার হাসি দেখা গেল। বয়সী ঠোঁটের হাসি ধরল যৌবনপ্রভা। 'হাসির কি বয়স হয়?' রোকেয়াকে কেন যেন এই বিষণ্ন প্রশ্নটি তাঁর করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তিনি করলেন না।
'রবীন্দ্রসংগীত খুব একটা ভালো লাগত না জামিলের। আমি ওকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি, রবীন্দ্রনাথের গানে মানুষের যত রকম অনুভব আর অনুভূতি আছে, যেমন- ভালোবাসা, বিরহ, ব্যথা, কষ্ট, একাকিত্ব, প্রেরণাবোধ- সব, সব কিছু পাওয়া যাবে, পাওয়া যাবে বাংলার সব ঋতুর রূপ। আমার কথা শুনে জামিল শুধু হাসত আর বলত, 'ঠিক আছে, তোমার জন্য রবীন্দ্রসংগীতের সব রেকর্ড কিনব। এখনকার মতো তখন তো আর সিডি ছিল না।' এটাও নাকি আফসানা মাহমুদের একটি ছোট গল্প। রোকেয়া জিজ্ঞেস করেছিল, 'জামিল সাহেবের কী রকম গান ভালো লাগত?' 'ও শুনত বিদেশি গান, মানে ইংলিশ আর পল্লীগীতি, লালন, হাসন রাজা, দুইমুখী ব্যাপার, দুইমুখী কেন বললাম, বুঝলা?' আফসানা মাহমুদের প্রশ্ন।
'ইংলিশ গান আর পল্লীগীতি বা লালন কি একসঙ্গে যায়? আমি জামিলকে প্রশ্ন করতাম। এই সব নিয়ে ও কিসব বলত। প্রতিটি মানুষ নাকি দুই রকম জীবন নিয়ে বেঁচে থাকে, রোকেয়া, তোমার কি তা-ই মনে হয়?' আফসানা মাহমুদের আবার সেই আচমকা প্রশ্ন। রোকেয়া উত্তর খোঁজে। মিউট করা সনি টিভির দিকে তাকায়। বাথটাবে গোলাপের পাপড়ির মধ্যে একজন সুন্দরী কী একটা সাবান মাখছে। 'কি, কথা বলো না কেন?' 'মনে হয় জামিল সাহেব ঠিকই বলতেন।' রোকেয়ার কথা শুনে আফসানা মাহমুদ খুশি হন এবং বলেন, 'টিভির ভলিউম দাও।'
'একটা হাসির বই কিনতে হবে, রিয়াকে বলতে হবে, রিয়া ঘরে এলে আমারে মনে করাবা।' রোকেয়া তাঁকে বলল : 'আমার কাছে হাসির আর ধাঁধার বই আছে।'
'কোথায় পেয়েছ?' আফসানা মাহমুদ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। 'আমার স্বামী কিনছিল, আমরা একসাথে পড়তাম আর হাসতাম।' 'ঠিক আছে।'
'গান গাচ্ছে যে মেয়েটি তার বয়স কত?' রোকেয়া জানে, গান শেষে আফসানা মাহমুদ এইভাবে বেশ কিছু প্রশ্ন করবেন।
'মনে হচ্ছে পঁচিশের নিচে হবে।'
'কী রঙের শাড়ি পরেছে?'
'লাল', রোকেয়ার উত্তর শোনার পর আফসানা মাহমুদের চোখের পাতার স্ফীতি সামান্য কেঁপে উঠল। কী একটা অপছন্দের হাসি দেখা গেল শুকনো ফ্যাকাসে ঠোঁটে।
'ঘন, না হালকা লাল?
'হালকা।'
'কী রঙের ব্লাউজ পরেছে?'
'কালো।'
'হাতে কি চুড়ি আছে, রং কী?'
'কাচের চুড়ি, লাল আর কালো।'
'আজকালকার গায়ক-গায়িকারা জানে না রবীন্দ্রনাথের কোন কোন গানে কী রঙের শাড়ি পরতে হয়। কী রকম সাজতে হয়। গান গাইলেই চলে? কেউ তাদের এই সব জরুরি বিষয় বলেও দেয় না? কবে এদের শিল্পসম্মত বসনরুচি তৈরি হবে?' কথাগুলো তিনি বললেন নিজেকেই। তিনি জানেন না, আজকাল জিন্সের টাইট প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে পাহাড় থেকে লাফ দিতে দিতে রবীন্দ্রসংগীতের গানের মডেল ঠোঁট নাড়ছে, দর্শক শুনছে : 'যামিনী না যেতে কেন জাগালে না।' সব কিছুতে সেঙ্ িঅ্যাপিল না দিলে নাকি দর্শকদের আজকাল ধরে রাখা যাচ্ছে না।
তেরো
হালকা নীল ঢেউ তোলা শিল্পশোভা টাইলসে সকালের রোদ পড়লে শিল্প হয় অন্য শোভার। আফসানা মাহমুদের খাটের দক্ষিণ দিকে ৫/৪ সাইজের বড় জানলায় হালকা নীলের পর্দা টানা। দেয়াল ঘেঁষে বেঁচে আছে একটি বুড়ো নিমগাছ। তিনি শুনেছেন, ঠিক জানলার কাছাকাছি, হাত বাড়ালেই নাকি ধরা যায়, আছে একটি কাকের বাসা। তিনি কথাটি বিশ্বাস করেননি। কাক বোকা পাখি না। মানুষের হাতের নাগালে বাসা করবে। সন্ধ্যার আগে আগে কাকদের বাসায় ফেরা, আর ফজরের আজানের পরে জানলার পাশে কাকের ডাক শুনে তাঁর মনে হয়েছে, হতেও পারে, জানলার কাছেই কাকের বাসা। তার পর থেকে রোকেয়ার আরো একটি কাজ বেড়ে গিয়েছিল, প্রতিদিন সকাল ১০টার দিকে কাকদের খাবার দেওয়া। বাড়ির কেউ কেউ বলেছিল, 'কাকদের খাবার দিলে খুবই ঝামেলা হবে।' 'ভাত ছিটালে কাকের অভাব'- এই প্রবাদ নিয়ে কথাও হয়। তা ছাড়া কাকের কর্কশ ডাকাডাকিতে কান ঝালাপালা হয়ে যাবে, বলেছিল কেউ কেউ। আফসানা মাহমুদের বড় মেয়ে বাবলী উত্তরা থেকে মোবাইলে বলেছিলেন : 'মা, তুমি নাকি তোমার জানলার পাশে একটা মাটির শানকিতে কাকরে প্রতিদিন খাবার দিচ্ছ আর কাকের ডাকাডাকি শুনে হাসছ?' মেয়ের কথা শুনে, কানে তখনো মোবাইল, আফসানা মাহমুদ বুঝেছিলেন, নাজিমের বউ রিয়া সব খবর দিয়েছে। 'মা, কথা বলছ না কেন?' 'শুনছি, বল'- জবাবটা শুকনো। 'মা, তুমি তো খাবার নিয়ে কাকদের কাড়াকড়ি দেখতে পাবে না, খামাখা প্রতিদিন মাছ ও মুরগির নাড়িভুঁড়ি দিয়ে জানলার ওখানে গন্ধ করার দরকার কী?' বাবলীকে তিনি কিছুই বললেন না। মোবাইল অফ করে দিলেন। 'কত দিন রিয়াকে বলেছি, বাসার সব কথা বাইরে বলতে নেই, মেয়েটার কবে যে বুদ্ধিসুদ্ধি হবে!'
বাবলীর পাশে তাঁর ডাক্তার স্বামী কবীর হোসেন বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। 'মার সাথে কাকের কী হয়েছে?' বাবলীর কাছে সব শোনার পর বললেন, 'মানুষটাকে বিরক্ত করা ঠিক না, তাঁরও তো সঙ্গ প্রয়োজন, কিছু আনন্দ প্রয়োজন।' স্বামীর বেশির ভাগ কথার সঙ্গে বাবলী একমত হতে পারেন না। কখনো কখনো বেশ অভিমান করে বলেন, 'তুমি আমাকে কোনো দিন বোঝোনি আর বুঝবেও না।' এই কথা যতবার ডাক্তার শোনেন, একটা জবাবই শোনেন বাবলী : 'পৃথিবীর সব বউয়ের স্বামীর বিরুদ্ধে এটা একটা কমন অভিযোগ।' বাবলী কথা বাড়ান না। এই মানুষটির সঙ্গে কথা বাড়িয়ে আজ পর্যন্ত কোনো ফায়দা হয়নি বাবলীর। বললেন : 'আজ বিকেলে মায়ের বাসায় যাব। বিষয়টি নিয়ে মার সাথে কথা বলব।' ডাক্তার বুঝে যান, রিয়া ভাবি কাকদের এই আপ্যায়ন বাড়িতে অ্যালাও করতে চাইছেন না। ডাক্তার বললেন, 'মা যদি কাকদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটায়ে আনন্দ পান, তাতে বাধা দেওয়া ঠিক না।' কোনো কথা না বলে ঘর থেকে চলে গেলেন বাবলী। 'কসমেটিক কালচারে দিন কাটানো রিয়া অন্ধজনের কষ্ট কী বুঝবে', কথাগুলো কবীর হোসেন তাঁর বউকে বললেন না।
পুব দিকের দেয়ালের জানলাও ওই মাপের। সকালের ঝকঝকে রোদ, যদি বৃষ্টিপাত না থাকে, তাঁর ভালো লাগে। দেখতে পান না, কেবল অনুভব করেন। তাপ আছে না? 'জানো রোকেয়া, রোদেরও গন্ধ আছে', কথা শুনে রোকেয়া বেশ জোরে হেসে 'কী যে কন না আপা! কবিরা ওই সব বলে।' মেয়েটা কিছু বোঝে না, আফসানা মাহমুদ নিঃশব্দে হাসেন।
সোলেমানও এ রকম কথা বলতেন। পূর্ণিমার রাত। মাথার ওপর বড় চাঁদ। রোকেয়া আর সোলেমান বসেছিল উঠানের মাঝখানে। সোলেমান বলেছিলেন, 'জুছনার গন্ধ টের পাও', সেই রাতে রোকেয়া কি হেসেছিল। রোকেয়াকে পুকুরের পাড়ে নিয়ে যান সোলেমান। 'চুপ করে বসে থাকো আর আস্তে আস্তে শ্বাস নাও, জুছনার গন্ধ পাবা।' পুকুরের মাঝখানে পানির নিচে চাঁদের প্রতিবিম্বের দিকে রোকেয়ার চোখ। আবেশে দৃষ্টি প্রসন্ন। আগে কোনো দিন কখনো রোকেয়া সোলেমানকে যা বলতে পারেনি, বলার কথা মাথায়ও আসেনি, বলল, 'এইখানে পুকুরঘাটে তুমি আমারে একটু আদর করো না।'
চৌদ্দ
সোলেমান মাস্টারের নিবন্ধ। পড়ছে রোকেয়া। শুনছেন আফসানা মাহমুদ-
'রূপকথা কী? অনেক রকম রূপের সমষ্টি হতে পারে, যার মধ্যে সাধারণ মানুষ, দেবদূত, রাক্ষস, জাদুকর, রাজা, রানি, রাজকন্যা, উড়ন্ত তলোয়ার যদি থাকতে পারে তাহলে বর্তমানের রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি এবং নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতিও থাকতে পারে। স্মৃতি কি রূপকথা? অন্ধজনের সামনে টিভিতে যা হচ্ছে তা বর্তমান। অন্ধকার মানেই কি অতীত? মানুষের পেছনের দিনগুলো স্মৃতির মধ্যে যদিও জীবিত, কিন্তু অনেক দিন আগের বলে, অন্ধকারে নিমজ্জিত। যদিও মানুষ যখন স্মৃতিচারণা করে তখন স্মৃতিতে একপ্রকার সুখ খোঁজে। রূপকথায় গভীর কষ্টের ও দুঃখের স্মৃতিতেও মানুষ হাসে, কারণ ওই দুঃখ বা কষ্টর বাস্তবতায় এই বর্তমানে তাকে আর ফেলতে পারছে না। কখনো কখনো মানুষ কাঁদে, কারণ বর্তমানের নিষ্ঠুরতা রূপকথাকে হার মানায়।' এই পর্যন্ত পড়ার পর আফসানা মাহমুদ আর পড়তে নিষেধ করেন। বাজাতে বলেন রবীন্দ্রসংগীত। প্রায় চার মিনিট ধরে রোকেয়া ও তিনি কোনো কথা না বলে শোনেন 'অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিল আলো।'
পনেরো
বেশ কিছুদিন হলো রাতে রোকেয়ার ভালো ঘুম হচ্ছে না। বিছানায় বসে থাকে। রাত্রির কুকুরের ডাকে ভয় লাগে।
আফসানা মাহমুদের কাছে রোকেয়া কদিনের ছুটি চাইল। মঞ্জুর হলো না। বলা হলো, সামনের ঈদে যেতে পারবে। বাড়ির সবার ইদানীং সন্দেহ হচ্ছে, রোকেয়া চাকরিটি আর করতে চাইছে না। মাঝেমধ্যে খবর বা বই পড়তে পড়তে রোকেয়া থেমে যায়। টিভিতে চলা নাটক বা সিনেমার দৃশ্য বর্ণনা আগের মতো উৎসাহ নিয়ে করে না। কী এক ক্লান্তিতে তার বিষণ্নতা বেড়ে যাচ্ছে।
রোকেয়ার মন ভালো করার জন্য তার পছন্দের একটি প্রতিবেদন 'ঊনসত্তরে বিয়ের পিঁড়িতে', আফসানা মাহমুদ পড়তে বললেন-
ঊনসত্তরে বিয়ের পিঁড়িতে
প্রেম-ভালোবাসার কোনো বয়স নেই, এই কথার প্রমাণ দিলেন ৬৯ বছর বয়সী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সুফিয়া খাতুন। ৩ জানুয়ারি সকালে নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাছে গিয়ে সুফিয়া খাতুন তাঁর প্রেমিক একরামুল ইসলামকে (৬৫) ইসলামী শরিয়া মোতাবেক বিয়ে করেন। এটি একরামুল ও সুফিয়ার দ্বিতীয় বিয়ে।
একরামুলের প্রথম স্ত্রী তাঁর সঙ্গেই থাকেন, আর সুফিয়ার প্রথম স্বামী ১৫ বছর আগে মারা গেছেন। এই বিয়েতে একরামুলের প্রথম স্ত্রীর সম্মতি ছিল, তিনি বিয়েতে উপস্থিতও ছিলেন। তাঁরা পেশায় ভিক্ষুক। একরামুল দুই স্ত্রীকে নিয়ে পৌর শহরের রেলগেটসংলগ্ন শহীদ ছমিরউদ্দিন মণ্ডল স্মৃতি পার্কে অবস্থান নিয়েছেন।
নবদম্পতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুফিয়া খাতুন তাঁর প্রথম স্বামী ধনা মিয়ার সঙ্গে আক্কেলপুর উপজেলায় ভিক্ষা করতেন। ১৫ বছর আগে স্বামী মারা গেলে তিনি ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। একরামুল ইসলাম প্রথম স্ত্রী ছোবেদা বেগমকে নিয়ে এই উপজেলায় ভিক্ষা করছিলেন। প্রায় এক মাস আগে একরামুল ইসলাম প্রথম স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নাটোরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ট্রেনে চড়েন। নাটোর রেলস্টেশনে না নেমে তাঁরা ভুলে আব্দুলপুর স্টেশনে নামেন। ভিক্ষা করতে করতে একরামুলের সঙ্গে সুফিয়ার পরিচয় ও ভালো লাগা।
একরামুল দম্পতি অনেক দিন পর আবার আক্কেলপুর ফিরে আসেন। ভালোবাসার টানে সুফিয়া খাতুন গত মঙ্গলবার ট্রেনে চড়ে আক্কেলপুর চলে আসেন, অনেক খোঁজাখুঁজির পর একরামুলের সন্ধান পান। একরামুলকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। একরামুলের প্রথম স্ত্রী এতে সম্মতি দেন।
সুফিয়া খাতুন জানান, এই বয়সে তিনি একা চলাফেরাও করতে পারেন না। পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই। বিয়ের মাধ্যমে আপন মানুষ খুঁজে পেয়েছেন। এখন মৃত্যু হলেও স্বামী ভালোভাবে দাফন করবেন। একরামুলের প্রথম স্ত্রী ছোবেদা বেগম বলেন, 'সুফিয়া অন্ধ মানুষ। সেই মুক কল তোর স্বামী দিয়ে আমাক বিয়া দে। মুই সুফিয়ার কথায় রাজি হয়ে গেনু। মোরা কাজির বাড়িত য্যায়া মুই নিজেই বিয়্যাত টিপসই দিচি।'
পড়া শেষ হলে আফসানা মাহমুদ আগের মতোই বলেন, 'এখানে ভালোবাসা ও প্রেমের থেকে স্বার্থটা বেশি। মরার সময় স্বামীর ভালোভাবে দাফন পাবে- এই স্বার্থটা বেশি কাজ করেছে। তা ছাড়া প্রথম বউ জানে, তিনজনের ভিক্ষার আয় বেশি হবে। শারীরিক সম্পর্কের কোনো বালাই তো নেই, থাকলে স্বামীকে বিয়ে দিত না, ওই মহত্ত্ব দেখাত না।' রোকেয়া কোনো মন্তব্য করে না।
ষোলো
কিছুক্ষণ আগে মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। খাটের মাথায় সাদা কাভারের পরিষ্কার দুটো বালিশ, আফসানা মাহমুদ হেলান দেবেন, রোকেয়া একটু বাঁকা করে দাঁড় করিয়ে দিল। প্রতিদিনের মতো এখন টিভি ছাড়তে হবে।
টক শো হচ্ছে। বিষয়, হেফাজতের ধ্বংসযজ্ঞের এক বছর পূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের রাজনীতি-ধর্ম-ইসলামের পবিত্রতা-রাত্রির অ্যাকশন-বড় দলগুলোর ফায়দা লোটা নিয়ে কথাগুলো, কথার অক্ষরগুলো চিৎকারের ঝড়ে তছনছ হয়ে এক তালগোল, উড়ে যাচ্ছে দিশাহীন। রোকেয়া খেয়াল করল, আফসানা মাহমুদের অস্থিরতা। কাঁপছে চোখের পাতা। ঘোলা চোখে জমছে রক্তরেখা। ঊনসত্তরের মিছিল-মধুর ক্যান্টিন-পল্টন মাঠ-ভাসানী-শেখ মুজিব-পাকিস্তানের সামরিক জান্তা-গুলির শব্দ-জামিলের সঙ্গে দৌড়- সব কিছু আফসানা মাহমুদের মাথার ভেতরের প্রায় গোলাকার পৃথিবীতে, যেকোনো বৃত্তাকার জিনিসই তো শেষহীন, এক ধ্বনিতরঙ্গে লাফাতে থাকে।
'চ্যানেল বদলাও।'
রোকেয়া নিজেই এক রিমোট-অভ্যাসে দ্রুত বদলে দিল চ্যানেল। বলল : 'এখানে নাচ হচ্ছে।'
"আমাকে মা নাচ শিখতে দেয়নি, বাবা চেয়েছিলেন আমি নাচি, ছোটকালে 'বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আ হা তোমারই মালা' গানের সাথে আমি আর আমার চাচাতো ভাই পুলক নাচতাম। দুজনেরই হাতে থাকত মালা। শেষবারে 'আ হা তোমারই মালা' শোনার সাথে সাথে আমি পুলককে, পুলক আমাকে মালা পরিয়ে দিত আর তখন বাড়ির বড় সিঁড়িতে বসা দর্শকদের কী হাততালি! বড় হয়ে পুলক বলেছিল, 'তোকে কেন যে মালা পরালাম না।' চ্যানেল বদলাও।"
'একটার শিশুর পাছা টিপছে একটি ববছাঁট মেয়ে। ডায়াপার না কী বলে' রোকেয়ার কণ্ঠ যন্ত্রবৎ।
'শিশুগুলি শান্তিমতো প্রস্রাব-পায়খানাও করতে পারবে না, সব কিছু বেঁধে রাখো, শহরের মারা টেরই পায় না, শিশুর পাছায় ঘা হতে পারে, বদলাও।'
'এখানে মাসিকের ন্যাপকিন।'
'বদলাও।'
'আবার টক শো।'
'চ্যানেল বদলাও।'
'এখানে মোবাইল নিয়ে কজন যুবক-যুবতী লাফাচ্ছে।'
'সারা দিন এরা কথা বলে, এদের কোনো লেখাপড়া বা কাজ নাই, কম্পানিগুলি দেশের টাকা কিভাবে যে নিয়ে যাচ্ছে, বদলাও।'
'এখানে ইংলিশ সিনেমা, নায়ক-নায়িকা চুমু খাচ্ছে।'
'খেতে দাও, শেষ হলে বদলাবে।'
'এখানে নাটক হচ্ছে, একজন চোখের ডাক্তার একটি মেয়ের চোখ দেখছে।'
'ডাক্তারের কনুই কোথায়?'
'মেয়েটির বুকের ওপর।'
'শুয়োরের বাচ্চা, পারভার্ট, চ্যানেল বদলাও।'
'এখানে ক্রিকেট হচ্ছে।'
'খেলাটা আমার ভালো লাগত, বাবা কয়েকবার আমাকে মাঠে নিয়ে গেছে, জাফরও নিত, ব্যাট করছে কারা?'
'বাংলাদেশ, মনে হয় হেরে যাচ্ছে, বল আছে ৫টা, রান লাগবে ১৯টা।'
'বদলাও।'
গান হচ্ছে। রবীন্দ্রসংগীত : অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ।
'ঘরের আলো নিভিয়ে দাও।'
রোকেয়ার ভয় হলো, কর্ত্রী এখন কানামাছি খেলা শুরু করবেন কি না। টিভি থেকে আসা সাদাটে আলোয় রোকেয়ার মুখ বিষণ্ন, আফসানা মাহমুদের মুখ প্রসন্ন দেখায়।
সতেরো
সকাল। রিয়া খবরের কাগজ দিয়ে গেলেন। যথারীতি সিনেমার পাতাটি রয়ে গেছে তাঁর ঘরে। কিছুক্ষণ পর আফসানা মাহমুদ শুনবেন কাগজ পড়া। রোকেয়া পড়া শুরু করার আগে টেবিলের ওপর রাখবে, কাঁচি, গ্লু, কলম আর এ-ফোর সাইজের কাগজ। কী কী ধরনের খবর আর প্রতিবেদন আফসানা মাহমুদের ভালো লাগে, রোকেয়া কাজের পুনরাবৃত্তিতে সেসব বিষয়ে এখন দক্ষ। সেগুলো কেটে কাগজে লাগিয়ে, পত্রিকার নাম ও তারিখসহ করতে হয় ফাইলবন্দি। কোনো কোনো দিন আফসানা মাহমুদের মনে হয় না, একটিও খবর বা প্রতিবেদন কেটে রাখার মতো। রোকেয়া খুশি হয় সেদিন।
পুব দেয়ালের একসময়ের কাকাতুয়ার খাঁচার মধ্যে অনেক দিন আগের, ৪০ বা ৫০ বছর আগেরও হতে পারে, আবার কিছুদিন আগেরও হতে পারে, রোকেয়া দেখেছিল একটি খবরের কাগজের অংশ। একদিন কৌতূহলে, পাখির সাদা-কালো শুকনো বিষ্ঠায় অতীত চিহ্নমাখা কাগজটি তার পড়তে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে এক নাছোড় প্রবণতা। সব শব্দ পড়া যায়নি। কোনো কোনো শব্দ ঠোকরানো। বাংলাদেশ শব্দটির 'বাং' নেই। আরেক জায়গায় 'দেশ' নেই। 'রাজ' আছে, সঙ্গের অক্ষরগুলো কী হবে রোকেয়া বুঝতে পারে না। সামরিক, খুন, রক্ত ও লুটপাট- শব্দ চারটি স্পষ্ট পড়া যায়। 'অন্ধ' শব্দটির পর তিন-চারটি শব্দ নেই, তারপর আছে 'আলো'। রোকেয়া ওই না থাকা শব্দগুলো কী হতে পারে ভাবতে চেষ্টা করে। সেই কবে স্কুল-কলেজে শূন্যস্থান পূরণ করেছিল। যদিও শূন্যস্থান পূরণে নম্বর কখনো বেশি পেত না। সোলেমান মাস্টার মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে শূন্যস্থান পূরণের খেলা খেলতেন। একবার 'আমি ... তোমাকে...' শূন্যস্থান পূরণ দিয়ে বলেছিলেন, 'পূরণ করো।' এই খেলায় রোকেয়া জিতে যায়। আরেকবার 'অন্ধজনে ...' দিয়ে বলেছিলেন, 'পূরণ করো।' রোকেয়া পারেনি।
রোকেয়ার মনে হয়, খাঁচা থেকে কাগজটি নিয়ে এ-ফোর সাইজের কাগজে ভালো গ্লু দিয়ে খাতায় সেঁটে রাখা দরকার।


সম্পাদক : ইমদাদুল হক মিলন,
নির্বাহী সম্পাদক : মোস্তফা কামাল,
ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের পক্ষে ময়নাল হোসেন চৌধুরী কর্তৃক প্লট-৩৭১/এ, ব্লক-ডি, বসুন্ধরা, বারিধারা থেকে প্রকাশিত এবং প্লট-সি/৫২, ব্লক-কে, বসুন্ধরা, খিলক্ষেত, বাড্ডা, ঢাকা-১২২৯ থেকে মুদ্রিত।
বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ : বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, প্লট-৩৭১/এ, ব্লক-ডি, বারিধারা, ঢাকা-১২২৯। পিএবিএক্স : ০২৮৪০২৩৭২-৭৫, ফ্যাক্স : ৮৪০২৩৬৮-৯, বিজ্ঞাপন ফোন : ৮১৫৮০১২, ৮৪০২০৪৮, বিজ্ঞাপন ফ্যাক্স : ৮১৫৮৮৬২, ৮৪০২০৪৭। E-mail : info@kalerkantho.com

Wednesday, September 13, 2017

জীবনানন্দ দাশের ২টি কবিতা।


১/ এখানে নক্ষত্রে ভ’রে [অগ্রন্থিত কবিতা]

এখানে নক্ষত্রে ভ’রে রয়েছে আকাশ,
সারা দিন সূর্য আর প্রান্তরের ঘাস;
ডালপালা ফাঁক ক’রে উঁচু-উঁচু গাছে
নীলিমা সিঁড়ির মতো সোজা, আঁকাবাঁকা হ’য়ে আছে

যে যাবে – যে যেতে পারে তার; নিচে রোদের ভিতরে
অনেক জলের শব্দে দিন
হৃদয়ের গ্লানি ক্ষয় কালিমা মুছায়ে
শুশ্রূষার মতো অন্তহীন।

[কবিতাটি ‘কাব্যসম্ভার’ সাহিত্য পত্রিকায় ভাদ্র ১৩৭৬ বাংলা সনে প্রথম প্রকাশিত হয়]

২/ কোথায় গিয়েছে

কোথায় গিয়েছে আজ সেইসব পাখি, – আর সেইসব ঘোড়া –
সেই শাদা দালানের নারী ?
বাবলা ফুলের গন্ধে, সোনালি রোদের রঙে ওড়া
সেইসব পাখি, আর সেইসব ঘোড়া
চ’লে গেছে আমাদের এ – পৃথিবী ছেড়ে;
হৃদয়, কোথায় বলো – কোথায় গিয়েছে আর সব !
অন্ধকারঃ মৃত নাসপাতিটির মতন নীরব

[১৩৯২ বাংলা সনে প্রথম প্রকাশিত]
—————————

ইউরেকা!


ওদের মনে হবে আমরা ভিনগ্রহের ভাষায় বলছি,
যেখানে বর্ণমালা ব্যাকরণ যেন অদ্ভুত এক দীর্ঘশ্বাস;
বিন্যাস শর্তহীন, একাকার কাঠামো, অনুভবটাই ভাষা,
হয়তো, একদিন, ওরা ইউরেকা চিৎকারে মেনে নেবে।
ভেবোনা। ভেবোনা একদম। 

গ্রহান্তরের আগন্তকের মতো,
আবছা মতো; আছে কিন্তু নেই এর মত, অধরার মতো,
নাটোরের বনলতার মতো, জীবনের ভালবাসার মতো,
অন্যরকম একটা কিছুর মত, দৃশ্যমান সত্যির মতো, বন্ধুর মতো, একটু উষ্ণতার মতো,
ওরা, 
ওরা ঠিক একদিন একাকার হবে। ভেবোনা।
বুঝতে শিখবে। একটুও ভেবোনা। ওরাও ভালবাসতে শিখবে।