Friday, March 31, 2017

আত্মহত্যা !!!

 এক

আত্মহত্যা করার ইচ্ছে বিভিন্ন সময়ে অনেকেরই হয়। আমার চারপাশের পরিচিত ও কাছের অনেক মানুষের কাছেই শুনেছি- বিভিন্ন সময়ে তাদের আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হয়েছিল। সাহিত্যেও এই প্রবণতা প্রচুর দেখেছি। গোটা দুনিয়া জুড়েই প্রতিবছর প্রচুর মানুষ আত্মহত্যা করে। ভারতের একদম হতদরিদ্র চাষী যেমন আত্মহত্যা করে, তেমনি জাপান সহ উন্নত বিশ্বেরও প্রচুর মানুষ প্রতিবছর আত্মহত্যা করে। অবশ্য আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হলেই যে আত্মহত্যা করে ফেলে মানুষ, তা নয়। আত্মহত্যা করা বাস্তবে খুবই কঠিন এক কাজ। নাহলে, বর্তমানে যত আত্মহত্যা আমরা দেখি- তার বহুগুন বেশি মানুষ আত্মহত্যা করতো। নানাবিধ কারণেই মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রচণ্ড ধার্মিক ব্যক্তি যেমন আত্মহত্যা করে, পাঁড় নাস্তিকও আত্মহত্যা করে। তবে, নাস্তিকের চাইতে একজন ধার্মিকের জন্যে আত্মহত্যা করা কঠিন, কেননা তাকে জান্নাতের লোভ বা দোজখের ভয়কে অতিক্রম করতে হয়, যেরকম কোন কিছু নাস্তিকের হয় না (আজকেও এক আত্মহত্যা করা মেয়ের শেষ মেসেজের একটা লাইন পড়লামঃ “জানি জান্নাত পাবো না”!)। কেউ আত্মহত্যা করলে- সাধারণত তার জন্যে আমার খুব কষ্টবোধ হয় না, বরং মনে হয়- যে জীবন যে বহন করতে পারছিলো না, সেখান থেকে একরকম মুক্তিই সে পেল! হ্যাঁ, কষ্টবোধ যতখানি হয়- সেটা তার কাছের মানুষের জন্যে, যদি কাছের মানুষ থেকে থাকে- এরকম মৃত্যু কাছের মানুষদের পক্ষে মেনে নেয়া আসলেই খুব কঠিন।

দুই
আত্মহত্যার ইচ্ছা যেমন বাস্তব, তেমনি তার চাইতেও বাস্তব হচ্ছে বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছা। সে কারণেই হয়তো আত্মহত্যা করাটা এত কঠিন। আত্মহত্যা করার পূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেও মানুষ তাই আত্মহত্যা করতে পারে না। তার সমস্ত শরীর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেস্টা করে। সেকারণে সম্ভবত নিজের হাত দিয়ে নিজের নাক মুখ চেপে শ্বাস বন্ধ করে আত্মহত্যা করা সম্ভব হয় না। যে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে- সেও শেষ মুহুর্তে পানিতে দাপাদাপি করে বেঁচে থাকার চেস্টায়। বিষ খেয়ে (হারপিক বা ঘুমের ওষুধ) আত্মহত্যার চেস্টা করা মানুষকে আমি দেখেছি- মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসার আপ্রাণ ও তীব্র সংগ্রাম করতে। সে কারণে বলা হয়- আত্মহত্যার প্রচেস্টা সফল হয় নিজেকে হত্যার আকস্মিক ও দ্রুত প্রচেস্টায়। নিজেকে মারার অসংখ্য উপাদান ও উপায় আমাদের চারপাশেই আছে, তারপরেও যারা বসে বসে সুন্দরতম উপায়ে আত্মহত্যার উপায় খুঁজে এবং নানাজনকে আত্মহত্যার ভয় দেখায়, বুঝতে হবে- তার পক্ষে আত্মহত্যা করা বেশ কঠিন, কেননা সে মরতে আসলে ভয় পায়।
তিন
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? বেশ কঠিন প্রশ্ন। এবং এর জবাব নিশ্চয়ই সকল মানুষের জন্যে একরকম নয়। কেননা- মানুষ খুব বিচিত্র এক প্রাণী। দুনিয়ার ৭০০ কোটি মানুষ আসলে ৭০০ কোটি রকম। তারপরেও আত্মহত্যার প্রবণতার জন্যে মোটাদাগে যে কারণগুলির কথা বলা হয় সেগুলো হচ্ছে- হতাশা, বিষন্নতা, একাকিত্ব, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা, চরম ব্যর্থতা, নিজের প্রতি চরম আস্থাহীনতা তথা ভয়ানক হীনমন্যতা ইত্যাদি। এগুলো একটার সাথে আরেকটি সম্পর্কিত যেমন হতে পারে, তেমনি নানা কারণেই এগুলো একজন মানুষের মাঝে আসতে পারে।
চার
আমাদের এই অঞ্চলে প্রেম, প্রেমে ব্যর্থতা, প্রতারণা, ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে অবহেলা- এইসব কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা একটু আশঙ্কাজনকভাবেই বেশি। কেন জানি- এইসব কারণে আত্মহত্যা যারা করে- তাদের প্রতি আমার করুনাই হয়। যাকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি- সে আমাকে নাও ভালোবাসতে পারে- যত খারাপ লাগুক বা কষ্টই হোক- এটা মেনে নিতে পারাটা খুব জরুরি। কিংবা একদিন যে আমাকে ভালোবেসেছে- তার সেই ভালোবাসা সারাটা জীবন একইরকম নাই থাকতে পারে- বুঝতে হবে প্রেম ভালোবাসা দ্বিপাক্ষিক একটা ব্যাপার। যৌনতাও তাই। এবং পারস্পরিক প্রেম ভালোবাসা কিংবা যৌন আকাঙ্খা আজীবন একইরকম না থাকাটাও একটা বাস্তবতা। কেউ আমাকে আজ তীব্র ভালোবাসে বলে, কাল আমার প্রতি একই রকম ভালোবাসা না থাকলে- আমার দুনিয়া যদি অন্ধকার হয়ে যায়, তাহলে আমার চাইতে বেকুব কেউ আছে বলে মনে হয় না। আমার ভালোবাসার মানুষ যদি আমার সাথে প্রতারণা করে, আমার বিশ্বাস-আস্থা নষ্ট করে- তাহলেও যত কষ্ট হোক- মেনে নিতে হবে এই কারণে যে, এইসবই মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। বরং, এইসব প্রতারণার পরেও সেই ব্যক্তিকে যদি আমি একইরকম ভালোবেসে যাই এবং বসে বসে কষ্ট পাই- তার চাইতে চরম বেকুবি কিছু হতে পারে না। আমাদের সমাজে এইসব ছিলি ব্যাপারে মানুষ অহেতুক কষ্ট পায় এবং আত্মহত্যা প্রবণ হয়- তার কারণ সম্ভবত প্রেম- ভালোবাসা এবং যৌনতা খুব দুষ্প্রাপ্য বস্তু। ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক মেলামেশা, একসাথে মিলেমিশে- খেলেদুলে- ভালোবেসে- প্রেম করে- বেড়ে ওঠার সুযোগ কম। তার উপর আছে- যৌনতা, বিয়ে, পরিবার এইসব নিয়ে নানারকম ট্যাবু। তারও উপর আবার আছে- সামাজিক- পারিবারিক নানা বাঁধা। নারীর উপর তার সাথে যুক্ত হয়েছে- সতীত্ব নামক আরেক ট্যাবু এবং সামাজিক ভয়।
অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি- যে সমাজে ছেলেমেয়েরা পিওবার্টিতে আসার আগেই দুই তিনবার প্রেমে পড়েছে এবং বিচ্ছেদে অভ্যস্থ হয়েছে, পিওবার্টির পরের প্রেম-ভালোবাসার ব্যর্থতা কিংবা সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া মেনে নিতে তাদের সমস্যা কম হওয়ার কথা- এমনকি শৈশবে ছেলেমেয়েদের একসাথে বেড়ে উঠতে দিলে- খেলার সময়ে যে বন্ধুত্ব হয়- যে ঝগড়া হয়- আড়ি নেয় আবার আড়ি ভাঙে, একজনের সাথে আড়ি নেয়ার পরে আরেকজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়- তাদের মধ্যেও বড়কালের প্রেম-বিচ্ছেদ-বিরহ এইসবে মানসিক বৈকল্য কম আসে। যৌনতাকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রবণতা হিসেবে দেখতে শিখালে- এই কেন্দ্রিক ফ্যান্টাসি অনেক কমে আসবে বৈকি। কারো সাথে একবার যৌনতার সম্পর্ক হয়ে গেলে- দুনিয়ার আর সব পুরুষের কাছে অসতী, আর কেউ বিয়ে করতে আসবে না- এই ধারণা থেকে বের হতে না পারলে- কিভাবে ঐ নারীর পক্ষে তার সাথে যৌন সম্পর্ক করা ব্যক্তির সাথে সাম্ভাব্য সম্পর্কচ্ছেদ মেনে নেয়া সম্ভব হবে?
পাঁচ
কিছু আত্মহত্যাকে আমি হত্যা হিসেবে গণ্য করি। সেই মানুষগুলোর জন্যে প্রচণ্ড কষ্ট অনুভব করি এবং যারা এই আত্মহত্যা তথা হত্যার জন্যে দায়ী- সেই হত্যাকারীর প্রতি ক্ষুব্ধ হই। যেমন- স্বামীর সীমাহীন লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অত্যাচার, নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে যে নারী আত্মহত্যা করে কিংবা পাড়ার মাস্তানদের নির্যাতন- নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে যে আত্মহত্যা করা সীমা, ঋতু, মিনুরা আসলে হত্যার শিকার। একইভাবে গ্রামীণ ব্যাংক- ব্রাক সহ নানা প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র ঋণের জালে আটকা পড়ে যে সর্বস্বান্ত চাষী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় কিংবা শেয়ার বাজারে সর্বস্বান্ত হয়ে যে ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়- তাদের হত্যার জন্যে দায়ী যারা তাদের প্রতি এবং এই সমাজের প্রতি বিক্ষুব্ধ হই। ভারতে গত ২০ বছরে যে ৩ লাখ হতদরিদ্র চাষী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে- কিংবা দুনিয়াজুড়ে ক্ষূধা-দারিদ্রের কারণে যেসব বাবা-মা সন্তান সমেত আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় (সন্তানকে বাস্তবে হত্যা করে)- তাদের কথা ভাবলে সুস্থ হয়ে বসে থাকতে পারি না, নিজের মাঝে অপরাধবোধ তৈরি হয় এবং এরকম অসম, অসুন্দর দুনিয়ার প্রতি তথা জীবনের প্রতি একরকম বিতৃষ্ণা তৈরি হয়।
ছয়
জীবনের প্রতি বিভিন্ন সময়েই আমার বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে, এখনো হয়। সামাজিক নানা ন্যায়-নীতিবোধ, দায়িত্ব ইত্যাদি যেমন একরকম আমাকে চালনা করে, তেমনি একেক সময়ে এসব খুব ক্লান্ত করে। তখন এসব কোন কিছুর মানে খুঁজে পাই না। দৈনন্দিন রুটিনের প্রতিটা কাজ, বিশেষ বা সাধারণ- সব কিছুকেই অহেতুক, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। বেঁচে থাকাটাও মনে হয় একটা বোঝার মত। অন্যদের এরকম হয় কি না জানি না, আমার হয়। প্রতিটি মানুষই আসলে একা। যেহেতু সে আলাদা। আবার প্রতিটি মানুষই সামাজিক, ফলে অবশ্যই সে কোন না কোন সম্পর্কে যুক্ত। কোন কোন সম্পর্ক এমনই তীব্র- যার জন্যে সে বেঁচে থাকাকে কর্তব্যজ্ঞান করে। তারপরেও সে প্রচণ্ড একা হতে পারে। অন্যের জন্যে বেঁচে থাকার যে কর্তব্যজ্ঞান, সেটাও তাকে মাঝেমধ্যে ক্লান্ত করতে পারে।
আমার অনেকবারই আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হয়েছে। ‘আত্মহত্যা’ বিষয়টি নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেই- ইচ্ছেটা ফিরে আসে। আত্মহত্যাকে তখন খুব সুন্দর ও সাহসী একটা ব্যাপার মনে হয়। সাহসী ব্যাপার মনে হয়, কেননা আমার ধারণা আমি আত্মহত্যা করতে পারি না- কেননা আমার সেই পরিমাণ সাহস নেই। ফলে, যারা আত্মহত্যায় সফল হন- তাদের প্রতি একরকম শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। আমি যেটা পারি না, সেটা তারা পারে; আমার মত তারা ভীতু নয়। কেউ কেউ বলতে পারে, জীবনের প্রতি আমি যতখানি বীতশ্রদ্ধ- তার চাইতেও বাঁচার প্রতি আমার আকুতি বেশি, সে কারণেই আমি আত্মহত্যা করার মত সাহস অর্জন করতে পারিনি। হয়তো বা! হতে পারে। জীবনের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা আছে, নানা সময়ে নানা বিষয়ে হতাশা তৈরি হয়, নিজেকে নিয়েও আমার প্রচণ্ড হতাশা আছে, নিজের সারাজীবনের পাহাড়সম ব্যর্থতা শুধু নয়, সারাজীবনের যাবতীয় ভুল- অপরাধ- অন্যায় আমাকে ভোগায়, একই সাথে সফলতার আকাঙ্ক্ষা আর নীতি-নৈতিকতার বোঝা আমাকে প্রচণ্ড ক্লান্ত করে- সমস্ত বৈপরীত্য আর টানাপোড়েন আমার কাছে মাঝেমধ্যে অসহ্য লাগে। তারপরেও স্বীকার করি, জীবনের প্রতি একেবারেই বীতশ্রদ্ধ বলতে যা বুঝায়, সে অবস্থা আমার না। সারাক্ষণ বিষন্ন হয়ে বসে থাকি না, কিংবা বিষন্নতা এসে আমার অন্যসব আনন্দে ভাগ বসাতে পারে না। একটা ভালো বই, একটা ভালো সিনেমা, একটা বিতর্ক, আলোচনা, প্রিয় মানুষদের সাথে সময় কাটানো, কিংবা একটিভিজম- এসবে তীব্র আনন্দের সাথে মগ্ন হতে পারি। ফলে, বলা যায়- আমার বিষন্নতা সাময়িক এবং নিঃসঙ্গ ও অবসর সময়ের অনুষঙ্গ।
আত্মহত্যায় সফল অনেকের মত জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ না হলেও, বলতে পারি বেঁচে থাকার প্রতি তীব্র আকুতি বা আকর্ষণও আমি বোধ করি না। বেঁচে থাকার কোন অর্থ, মানে, উদ্দেশ্য খুঁজে পাই না। মাঝে মধ্যে বেঁচে থাকাটা প্রচণ্ড ক্লান্তিকর ও অনর্থক পণ্ডশ্রম মনে হয়। সেজায়গা থেকে আত্মহত্যার ইচ্ছেও হয় মাঝে মধ্যে, কিন্তু আত্মহত্যা করতে পারি না- তার প্রধান কারণ মৃত্যুর ভয়। আমার অবর্তমানে প্রিয় মানুষদের সীমাহীন কষ্টের কথা অনুভব করতে পারি, যখন ভাবি আমার প্রিয় মানুষ কেউ যদি একইভাবে আত্মহত্যা করে, তখন আমি কেমন অনুভব করবো! এই চিন্তাও আমাকে আত্মহত্যা করা থেকে বিরত রাখে। তবে, মাঝেমধ্যে মনে হয়- মৃত্যুভয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্যেই হয়তো এমন যুক্তি খুঁজে নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয়- আত্মহত্যা করারও বা মানে কি, অর্থ কি, কি এর প্রয়োজনীয়তা? আত্মহত্যার উদ্যোগও কম ক্লান্তিকর মনে হয় না তখন!

সাত
আস্তিকদের সাথে তর্কের সময়ে অনেকেই বলতো ঈশ্বর না থাকলে, পরকাল না থাকলে, আল্লাহ’র ধারণা না থাকলে- বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যই তো নাই হয়ে যায়! আমি কথাটার সাথে একমত; কিন্তু বেঁচে থাকার জন্যে অতিপ্রাকৃত ও মিথ্যা উদ্দেশ্য রাখার কোন প্রয়োজনীয়তাও দেখি না। একইভাবে বিবর্তনের নিয়ম মোতাবেক প্রাকৃতিক সিলেকশন তথা প্রজাতি টিকে রাখার উদ্দেশ্যে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা বা দায় আমি ঠিক অনুভব করি না। দুনিয়ার অসংখ্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, আরো অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে, প্রকৃতি তা আপন নিয়মে নির্বাচন করবে- সেটা নিয়ে আমার কোন হেডেক নেই, কেননা মানুষ নামক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও আসলে কিছু যায় আসে না, কেননা মানুষের উদ্ভব ও মানুষের মানুষ হয়ে ওঠাটাই একটি আকস্মিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা। মানুষের উদ্ভব না ঘটলে, মানব সমাজ না তৈরি হলে, কিংবা আমার জন্ম না হলে- কোন কিছুরই কিছু যায় আসতো না। এই কোন কিছু যায় না আসার পরেও, এই চরমতম উদ্দেশ্যহীনতার পরেও বিবর্তনের নিয়মে মানুষের উদ্ভব হয়েছে, বিবর্তনের পথ ধরেই মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার তীব্র চেস্টা অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য হিসেবে বাসা বেঁধেছে এবং আমার জন্ম হয়েছে, আমার মাঝে হয়তো সেই বৈশিষ্ট যুক্ত হয়েছে। আত্মহত্যার প্রবণতাও বিবর্তনের ফল, কিন্তু মানুষ যে যুগ যুগ বেঁচে আছে- নিজের মত করে উদ্দেশ্যের কথা ভেবে কিংবা কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই, কিংবা বলতে গেলে বেঁচের থাকার উদ্দেশ্যেই বেঁচে থাকছে- সেটাও বিবর্তনের পথ ধরে এবং আমারও মাঝে যে মৃত্যু ভয় সেটাও হয়তো বিবর্তনের ফল।
আট
আর সেকারণেই হয়তো- যে আমি আত্মহত্যার সুখ কল্পনায় ভাসি, সেই আমিই আবার ধর্মান্ধদের চাপাতির কোপে বেঘোরে প্রাণ দিতে অস্বীকার করি। পালিয়ে বেড়াই, এবং সময় সুযোগে তীব্র ক্ষোভে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াই। উদ্দেশ্যহীন দুনিয়ায় আবার এই ধর্মান্ধ মানুষগুলোকে যখন নগন্য কীটের মত মনে হয়, সব ক্ষোভ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আর যখন বুঝতে পারি- মানুষ আসলে কীটের চাইতেও নগণ্য, তখন অসহায় লাগে। মানুষ তার হাতে তৈরি সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম, নীতি নৈতিকতা, জ্ঞান, বিজ্ঞানের দাস হয়ে উন্নত হচ্ছে, অবনত হচ্ছে, ভালোবাসছে, ঘৃণা করছে, একে অপরকে বাঁচাচ্ছে, মারছে- এ সমস্তকেই অনর্থক, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। কীটের জীবন, প্রাণীর জীবন, গাছের জীবনকে বড় আকর্ষণীয় মনে হয়, সভ্যতার কোন দায় নেই, নেই কোন বোঝা! সেই আদিম, বন্য, অসভ্য মানুষের জীবনকে আকর্ষণীয় মনে হয়, সভ্য হতে গিয়ে মানুষ কত কি যে হারিয়েছে, মানুষ কি তা জানে?
নয়
বেঁচে থাকা যেমন অর্থহীন, মৃত্যুও তাই। অথচ, আমরা কেবল মৃত্যুকে জয় করতে চাই। কেননা আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই। কিন্তু কেবল মৃত্যু ভয়ই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে না, সে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে, উদ্দেশ্য খুঁজে। অলৌকিক, অপ্রাকৃত, মিথ্যা উদ্দেশ্য ও অর্থ যেমন অনেকে খুঁজে, তেমনি অনেকে – এমনকি চরম ধার্মিক ব্যক্তিও- কেবল এইসব অপ্রাকৃত মিথ্যার মাঝে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। তারা প্রাত্যহিক ছোট ছোট নানা কিছুর মাঝে জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়ায়। বেঁচে থাকা অনেকটা সংগ্রামের মত, অনেকের কাছে এই সংগ্রামে প্রতিনিয়ত জয়ী হওয়াটাই জীবনের উদ্দেশ্য, অনেকের কাছে একটা সম্পর্কই হয়তো তার জীবনের উদ্দেশ্য, অনেকের কাছে ছোট ছোট সুখ- আনন্দ- অনুভূতি- হাসি -কান্না, এইসবও জীবনের উদ্দেশ্য।
দশ
আমার কাছে এগুলো জীবনের বা বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য বা অর্থ নয়। এরকম ছোটখাট টুকরো টুকরো বিষয়গুলো আমার সামনে চলার অনুপ্রেরণা। আমি হাঁসতে ভালোবাসি, কাঁদতে ভালোবাসি, প্রচণ্ড আনন্দে কাঁদার মাঝে আনন্দ আছে, প্রচণ্ড দুঃখে পাগলের মত হাসার মাঝে একরকম মাদকতা আছে। আমি শান্তির বানীকে ঘৃণা করি, আমি ধ্বংসকে ভালোবাসি। কেননা আমি জানি যাবতীয় যুদ্ধের মূলে আছে শান্তি নামক প্রতারণা, ঠিক শান্তির ধর্মের মতই। তাই আমি ধ্বংস কামনা করি- সমাজ সভ্যতার, ধর্মের, অসাম্যের, ভেদাভেদের। সে কারণে আমি মৃত্যুকেও ভালোবাসি- কেননা মৃত্যুর সাথে সাথে সমাজ- সভ্যতা- ধর্ম- অসাম্য- ভেদাভেদ সবেরই সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু কাঁদার জন্যে, হাঁসার জন্যে, ঘৃণার জন্যে, ভালোবাসার জন্যে, ধ্বংস করার জন্যে, সৃষ্টি করার জন্যে, এমনকি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্যেও অন্তত বেঁচে থাকতে হয় বৈকি। তাই আমি বেঁচে থাকতেও ভালোবাসি। এবং এ কারণেই হয়তো- বেঁচে থাকি …
আত্মহত্যার পরিসংখ্যানঃ
http://www.suicide.org/international-suicide-statistics.html