১.
১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি রথখোলা মোড়ের কাছে নবাবপুর রোডের ওপর আমার একটা
চেম্বার ছিল। নিচে ড্রেন পাইপের দোকান, সেটার সাথে একটা সরু গলি, দুজন
মানুষও পাশাপাশি হাঁটতে পারে না, সেই গলির সাথেই লাগোয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে
আসতে হত দোতলার একটা লম্বা বারান্দায়। বারান্দায় পরপর কয়েকটা দরজা। একটা
দরজার ওপরে লেখা – ডঃ আবদুল মতিন, এম বি বি এস, সাইকিয়াট্রিস্ট। সন্ধ্যা
ছটায় চেম্বারে যেতাম, চার ঘন্টা বসতাম, রোগীর দেখা খুব একটা মিলত না,
মনোরোগী হওয়া সামাজিক ভাবে গৃহীত হতো না বলে পরিবার থেকে মনোচিকিৎসকের
কাছে যাওয়াটাকে নিরুৎসাহিত করা হতো।
সেদিনটা খুব গরম পড়েছিল, জুন মাস হবে। বর্ষার দেখা নেই, গুমোট
সন্ধ্যায় সাহানা নামে এক নারী আমার চেম্বারে আসে, বয়স হয়তো ত্রিশ বা
পঁয়ত্রিশ। তার শাড়ির রঙটা মনে নেই, কিন্তু তার বাঁ হাতের ত্বকে একটা গভীর
কালো দাগ ছিল, মনে হয়ে আগুনে পোড়া দাগ। আমার চেম্বারের একটা ছোট জানালা
দিয়ে পাশের বাড়ির ছাদ দেখা যায়, সেখানে কাপড় শুকানোর জন্য মেলা থাকত।
হয়ত সেদিকে তাকিয়ে আনমনা ভাবেই সাহানা বলেছিল, “আমি শব্দের সঙ্গে রঙ
দেখতে পাই।” এরকম অদ্ভুত ব্যাপার আগে শুনি নি, রাস্তার গোলমেলে আওয়াজ
সাহানার মনে রূপান্তরিত হয় এক ধরণের ধূসর আলোর ওঠা-নামায়, কাকের কর্কশ
ডাকের রঙ হয়ে যায় গাঢ় বেগুনী, মানুষের কথা বর্ণালীর প্রতিটি রঙকে ছুঁয়ে
যায়। সাহানা ভেবেছিল এটা এক ধরণের মনোবিকলতা, এরপর সে তার একাত্তর সনের
কাহিনী বলে।
১৯৭১ সনের জুলাই মাসে সাহানা খুলনা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে বলেশ্বর নদীর
পাড়ে চিতলমারিতে তার পৈত্রিক বাড়িতে ছিল। সাহানার কন্যাসন্তান রেবার বয়স
তখন কয়েক মাস। (আমি ভাবলাম সাহানার তাহলে খুব অল্প বয়সেই বিয়ে
হয়েছিল।) তার স্বামী আবু মুর্তজা এপ্রিল মাসেই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে
চলে যান। জুন মাসের শেষের দিকে এক দুপুরে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায়
পাকিস্তানী সেনারা গানবোট নিয়ে তাদের গ্রামে আসে। হিন্দুপ্রধান গ্রামটির
প্রায় শখানেক নারী পুরুষকে স্কুলের মাঠে জড়ো করে। স্থানীয় হিন্দুদের
সাথে সাহানার বাবা ও এক ভাইকেও আর্মি ধরে নিয়ে যায়। গ্রামের অনেকেই নদীতে
ঝাঁপ দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেশিনগানের গুলি এড়াতে পারে না। সাহানা
আরে রেবাকে নিয়ে তাঁর মা নদীর ধারে নলবনে লুকিয়ে থাকেন, বিকেল হলে তারা
বাড়িতে ফিরে কাউকে পায় না। সাহানা আর রেবাকে বাড়িতে রেখে সাহানার মা তার
স্বামী ও পুত্রকে খুঁজতে বের হন।
সন্ধ্যা হয়ে আসে, কেউই আর ফিরে আসে না। (আষাঢ়ের ঐ দিনের পরে সাহানা
তার মা, বাবা আর ভাইকে আর কোনোদিন দেখে নি।) ঝুপ করে অন্ধকার নামে, পাশের
বাড়ির সালেহা দৌড়ে আসে, চিৎকার করে, “সাহানা আপা! রহম তালুকদার আসছে,
তুমি পালাও।” সাহানাদের উঠোনের চারদিকে চারটা টিনের চালের ঘর, তার একটির
পেছনে ডোবা। রেবাকে সালেহার কাছে দিয়ে, সন্ধ্যার অবরোহী অন্ধকারে, সাহানা
দৌড়ে আকন্দ আর আঁশশেওড়ার মাঝে বৃষ্টির পানি জমা ছোট ছোট খানা পেরিয়ে
বাঁশঝাড়ের পাশে কচুরিপানা ভরা ডোবায় পৌঁছায়। অন্ধকারে পথ চলতে তার কোনো
অসুবিধা হয় না, অন্ধকারেও তার চোখে সবকিছু লাল আবছা আলোয় জ্বলে, তার
চেয়েও বড় কথা যে কোনো শব্দ তার কাছে আলো হয়ে ধরা দেয়। ডোবায় নেমে কোমর
জলে দাঁড়িয়ে সাহানা দেখে ডোবার পাড়ে কে যেন এসে টর্চ দিয়ে তার খোঁজ
করছে।
অন্ধকারেও রহম রাজাকারকে চিনতে পারে সাহানা। রহম তালুকদার পাশের গ্রাম
সন্তোষপুরের ছেলে, এই যুদ্ধের আগে সাহানা তাকে চিনত না। রহমের বয়স পঁচিশ
হবে, তার বাবা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, আর রহম নাকি খুলনা গিয়েছিল
রাজাকার ট্রেনিং নিতে। সে এখন পাকিস্তানীদের চর হয়ে কাজ করে, শহর থেকে কে
কে পালিয়ে এসেছে তার হিসাবে রাখে। এর আগে তার দু-একজন চ্যালা নিয়ে সে
সাহানাদের বাড়ি ঘুরে গেছে, তার ওপর যে রহমের বিশেষ দৃষ্টি পড়েছে সাহানা
সেটা জানে।
রহম জানত সাহানা কাছেই কোথাও আছে, কিন্তু তার প্রতিটি পদশব্দ সাহানা
অনুসরণ করতে পারছিল। খানার পানিতে পা পড়ে যেখানে ছলাৎ করে উঠছিল সেখানে
সাহানা দেখছিল গাঢ় সবুজ আলো, আগাছায় কাপড়ের স্পর্শ হয়ে উঠছিল একটা
অবর্ণনীয় গোলাপী। ডোবার জলে একটা পাকুড়গাছের ঝুরি নেমেছে, সে লুকায় তার
পেছনে।
রহম টর্চের আলো নিভিয়ে দেয়। ডোবাটাকে ঘিরে সন্তর্পণে হাঁটে, তবু
অন্ধকারে তাকে দেখতে পায় সাহানা। সরে আসে পাকুড়ের গভীরে। পাকুড়ের কাছে
পৌঁছায় রহম, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শুনতে চায় সাহানার শ্বাস। তারপর টর্চের
আলো জ্বালায় আবার, গাছের ঝুরির ওপর ফেলে। রহমের টর্চের আলো এড়াতে জলে ডুব
দেয় সাহানা, ডুবে ডোবার আরো গভীরে চলে যায়। শব্দে ভরা ছিল সেই ডোবা,
মাছের শব্দ, হয়তো বা সাপ, কাদা থেকে উঠে আসা অজানা গ্যাসের বুদবুদের শব্দ।
সেইসব শব্দ সাদা আর সবুজ রঙে উজ্জ্বল হয়ে তার মনে ভেসে ওঠে। পানির ওপরে
টর্চের আলো ধরা থাকে আরো কিছুক্ষণ। শুধুমাত্র তখনই যখন বুকটা মনে হয় ফেটে
যাবে টর্চের আলো সরে যায়। পানির ওপরে মাথা তুলে নিঃশ্বাস নেয় সাহানা, রহম
রাজাকার চলে গেছে।
স্তব্ধ হয়ে সাহানার কাহিনী শুনি, কিন্তু সাহানা আমাকে ১৯৭১র ইতিহাস
শোনাতে আসে নি। শব্দ থেকে আলো সঞ্চারিত হয় – এ কি ধরণের মনোবৈকল্য? তার
স্বামী – আবু মুর্তজা – এ নিয়ে তাকে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছে,
পাছে লোকে তাকে হয় মিথ্যুক নয় ডাইনী ভাবে। কিন্তু যত দিন যায় তত সে
শব্দে সংবেদী হয়ে উঠছে, রাতের পর রাত সে জেগে থাকে, রাস্তার সামান্য শব্দ
ঘরকে আলো করে দেয়। এটুকু বলে সাহানা চুপ করে যায়, এমন যেন যা বলতে এসেছিল
তার থেকে বেশী বলে ফেলেছে। জানি না সেদিন সাহানার কথা বিশ্বাস করেছিলাম
কিনা, তাকে তার ঠিকানাটা রেখে যেতে বলি, যদি এ বিষয়ে কোনো গবেষণা আমার
চোখে পড়ে তাকে জানাবো বলে আশ্বাস দিই। সাহানার আচরণে আমি কোনো
অস্বাভাবিকতা পাই না, তাঁকে মাসখানেক পরে আবার চেম্বারে ফিরে আসতে বলি।
সাহানা যুগীনগর রোডের একটা ঠিকানা দিয়েছিল।
কোনো কারণে সাহানাকে আমি চেম্বারের বাইরে বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিই।
সরু সিঁড়িটা দিয়ে নামার সময় খেয়াল করি সাহানার শরীরে হঠাৎ কেমন যেন
একটা স্থবিরতা এসেছে, যেন হঠাৎ করে তার বয়স বেড়ে গেছে, সিঁড়িটা দিয়ে
নামতে তার অসুবিধা হচ্ছিল। সিঁড়ির শেষ ধাপে সে যখন পৌঁছায় আমি ঘুরে
চেম্বারের দিকে এগোই। তখনই শুনি নারীকন্ঠের গান –
“মধু মালতী ডাকে আয়, ফুল ও ফাগুনের এ খেলায়…”
শুধু এটুকুই। চমকে উঠে ঘুরে সিঁড়ির নিচে সাহানাকে দেখতে চাই, সে ততক্ষণে অন্ধকারে দৃষ্টির বাইরে মিশে গেছে।
২.
এর পরে সাহানা আর ফিরে আসে নি। আমিও এর মধ্যে আবার যুক্তরাজ্য যাই একটা
ডিগ্রীর জন্য। সেখানে যেয়ে সিনেস্থেশিয়া নামে একটি বৈশিষ্ট্যের কথা শুনি।
অনেক মানুষ নাকি লিখিত সংখ্যা দেখলে তাতে রঙ দেখে, যেমন ১ হল লাল, ২ সবুজ
ইত্যাদি। রঙটা যে খুব স্পষ্ট তা নয়, বরং সংখ্যাটা ঘিরে আবছা আলোয় জ্বলে।
অনেকদিন পরে সাহানার কথা মনে পড়ে, সাহানা শব্দ থেকে রঙ দেখে, সংখ্যা দেখে
রঙ দেখা কি তার থেকে খুব দূর হতে পারে? সিনেস্থেশিয়া মানেই হল একটি বোধ
দিয়ে আর একটি বোধের জাগরণ। দেখলাম শব্দ থেকে আলো সঞ্চারণ সিনেস্থেশিয়ারই
একটা অংশ, সেটাকে ক্রোমেস্থেশিয়া বলে। অনেক বড় বড় ক্লাসিকাল সুরকারদেরও
নাকি এই বোধটা ছিল। সঙ্গীত শুনলে, বাজনা শুনলে, গান শুনলে একটা নির্দিষ্ট
রঙ মনে সঞ্চারিত হতে পারে। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে অবাঞ্ছিত
যোগাযোগ সিনেস্থেশিয়ার কারণ বলে অনেকে ব্যাখ্যা করলেও কিছু বিজ্ঞানীদের
মতে এর কারণ আরো গভীর – মস্তিষ্ক ইন্দ্রিয়বোধকে কীভাবে ব্যাখা করছে বা কী
অর্থ দিচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে সিনেস্থেশিয়া গড়ে ওঠে। ভাবি দেশে যেয়ে
সাহানাকে খুঁজে বের করতে হবে।
দুবছর পরে দেশে ফিরে সাহানার খোঁজে তাদের বাসায় যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা
এই নিয়ে বহু মাস চিন্তা করি। শেষাবধি একদিন সাহস করে ছুটির সন্ধ্যায়
যুগীনগরের রাস্তায় বাসাটা খুঁজে বের করলাম। বাইরে নামফলকে লেখা ছিল – আবু
মুর্তজা। এভাবে হুট করে সাহানার খোঁজে চলে আসা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম
না, কিন্তু সাহস করে দরজায় কড়া নাড়লে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক দরজা
খুললেন। আমার পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম উনি মুক্তিযোদ্ধা মুর্তজা কিনা।
বললাম ওনার সঙ্গে কিছু কথা আছে, একটু যদি সময় দিতেন। ভেতরে এসে বসতে
বললেন।
রাস্তার সঙ্গেই লাগোয়া ঘরটায় সন্ধ্যার আবছায়া আলো পৌঁছাতে পারছিল না।
আবু মুর্তজা সুইচ টিপে একটা বাতি জ্বালালেন, তবে বাতির দুর্বল তরঙ্গ
ঘরটাকে তেমন আলোকিত করতে পারল না। টিমটিমে আলোয় একটা সোফায় বসলাম,
মুর্তজা সামনে একটা চেয়ারে বসলেন। হঠাৎ করে কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে
পারছিলাম না, ওদিকে মুর্তজা সাহেব উৎসুক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে
আছেন। অবশেষে সাহস করে বলে ফেললাম, “আপনার স্ত্রী সাহানা কয়েক বছর আগে
আমার চেম্বারে এসেছিলেন তাঁর একটা বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে।” কিন্তু সাহানার
নামটা উচ্চারণ করা মাত্র ভদ্রলোক চমকে আমার মুখের দিকে চাইলেন,
আধো-অন্ধকারে মনে হল তার মুখটা বদলে গিয়ে একটা কদাকার চেহারা ধারণ করল।
মনে হল তার মুখ এক চাপা-ক্রোধে কাঁপছে, সেই ক্রোধ সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর
শরীরে। আমার মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেঝের দিকে তাকালেন মুর্তজা। হয়তো
চিৎকার করতে চাইলেন, কিন্তু তার বদলে এক সংযত শান্ত স্বরে বললেন “আপনি বের
হয়ে যান, এই বাড়ি থেকে, এখনই!” ওনার কথাটা বুঝতে আমার কয়েক সেকেন্ড সময়
লাগল। ঐ সময়টুকুর মধ্যে মুর্তজা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়েছেন, আমার মুখের
দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে দরজার দিকে ইঙ্গিত করলেন, বিড়বিড় করে যেন বললেন
“মিথ্যুক।” এবার আর কোনো সন্দেহ রইল না।
সেই সন্ধ্যার অভিযানটা সম্পর্কে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ ছিল, তবু এর
প্রতিক্রিয়াটা যে এত তীব্র হবে সেটা অনুমান করি নি। অপমানে, লজ্জায়, রাগে
আমার শরীর যে পুড়ে গেল, মুহূর্তে ঘাম জমল কপালে। মাথা নিচু করে ঘর থেকে
রাস্তায় বেরিয়ে গেলাম।
এরকম অপমানিত জীবনে হই নি। মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছি, সারা শরীর ঘামে
ভিজে গেছে, আর একটা রিক্সার খোঁজ করছি যাতে এই পাড়া থেকে পালাতে পারি। এই
ছোট রাস্তায় রিক্সা দাঁড়ানোর কোনো জায়গা নেই, কাজেই রিক্সা পেতে হলে বড়
রাস্তায় যেতে হবে। মনে হল এই পাড়ার সব মানুষেরা যেন আমার অপমানের কথা
জেনে গেছে, তারা যেন তাকাচ্ছে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ
চলে গেল, রিক্সা আর মানুষ বাঁচিয়ে অন্ধকারে পথ চলতে অসুবিধে হচ্ছিল। হঠাৎ
পেছন থেকে কে যেন আমার জামাটা টেনে ধরল। ভাবলাম আবু মর্তুজা, এবার প্রাণ
নিয়ে এখান থেকে যেতে পারলে হয়। ঘুরে তাকিয়ে দেখি একটি ১৭/১৮ বছরের
মেয়ে। মুদির দোকানের মোমের কম্পমান আলোর শিখা তার মুখটা রহস্যময় করে
তুলেছে। সে হাঁফাচ্ছিল, তাকে আমাকে ধরতে তার অনেকটা দৌড়াতেই হয়েছে। একটু
লজ্জিত হয়ে মুখ নিচু করে সে বলল, “আমার নাম রেবা, সাহানা আমার মা’র নাম।”
আমি স্তম্ভিত হলাম। সাহানার কাহিনী মনে করার চেষ্টা করলাম, রাজাকারের হাত
থেকে রক্ষা পেতে সে রেবাকে প্রতিবেশী মেয়েটির কাছে গচ্ছিত রেখেছিল। রেবা
বলল, “আপনাকে এগিয়ে দিই।” এই শহরে এরকম একটি কিশোরী মেয়ে নিজের নাম বলে
পরিচয় দেয় না। তাছাড়া এই মেয়েটি আমাকে এগিয়ে দেবে মানে আমাকে এই পাড়া
থেকে নিরাপদে বের করে দেবে, সেটাও আমাকে খুব আশ্চর্য করে। তবু মেয়েটির
দৃঢ় উচ্চারণ ও আত্মবিশ্বাস আমাকে আশ্বস্ত করল, তার উপস্থিত আমার অপমানে
উত্তপ্ত মুখকে ঠাণ্ডা করল।
রেবা বলল, “আপনি মিথ্যেবাদী নন।”
আমি কিছুটা সম্মোহিতের মতই বললাম, “না, আমি মিথ্যাবাদী নই।”
রেবা হাসল, তার তীক্ষ্ণ নাকের দুপাশে উজ্জ্বল চোখ সেই গলির অন্ধকারকে সহনীয় করে আনল। বললাম, “তুমি কী করে বুঝলে?”
“আমি বুঝি,” রেবার মৃদু হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে, “আপনার মুখ দেখেই আমি সেটা বুঝতে পেরেছি।”
এরকম একটি কিশোরী মেয়ে আমাকে বিশ্বাস করেছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার
সঙ্গে কোনো দ্বিধা ছাড়া কথা বলছে, আমি বিস্মিত হই। শুনতে পাই রেবা বলছে,
“মানুষ মিথ্যা বললে তার চামড়া গরম হয়ে যায়, আমি সেটা ধরতে পারি।” এটুকু
বলে হাসে যেন খুব একটা মজার কথা বলেছে। ভাবি রেবা তার মায়ের গুণ পেয়েছে।
“আমার মাকে খুঁজতে আপনি এসেছিলেন, কিন্তু আমার মা তো বেঁচে নেই।”
“বেঁচে নেই? কবে উনি মারা গেলেন? কীভাবে?” প্রশ্নটা আমার মুখ থেকে
কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই বের হল। হয়তো ওরকম একটি সুন্দর তরুণ মানুষ এত
অল্প বয়সে চলে যাবে সেটা যেন আমার মন মানতে চাইল না। ভাবলাম একারণেই আবু
মুর্তজা আমাকে ভুল বুঝেছেন কারণ আমি সাহানার সঙ্গে সাক্ষাতের সময়কালটা
উল্লেখ করি নি।
“বহুদিন হল,” বলে রেবা। “মুক্তিযুদ্ধের সময়।”
আমার সাজানো ঘটনা-পরম্পরা ধ্বসে যায়। আমরা তো একটা বোধগম্য পৃথিবীতে
বাস করতে চাই, তাই নয় কি? “তাহলে আমার চেম্বারে কে গিয়েছিল?” জিজ্ঞেস
করি। মৃত সাহানা ফিরে এসেছিল? মুহুর্তখানেকের জন্য এক অবোধ্য ভীতি আমাকে
গ্রাস করে, কিন্তু রেবার অমলিন হাসি আমাকে আশ্বস্ত করে। রেবা বলে, “আপনার
কাছে যিনি গিয়েছিলেন তিনি আমার আসল মা নন, আমার সৎ মা।”
রেবা বলে, “আমার মার মৃত্যুর পরে বাবা সালেহা-মাকে বিয়ে করেন। সালেহা
মা’দের বাড়ি ছিল আমার নানাবাড়ির পাশেই। সালেহা-মা আমার মাকে চিনতেন,
কিন্তু উনি খুব ছোট ছিলেন। আব্বা ওনাকে আমার আসল মা সম্বন্ধে সবসময় গল্প
করতেন, মা যে শব্দতে আলো দেখতে পেতেন, সে সব বলেন। এই শুনতে শুনতে
সালেহা-মা বোধহয় এক ধরণের গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে যান। নিজেকে আমার মা –
অর্থাৎ সাহানা – বলে ভাবতে শুরু করেন। আপনার চেম্বারে যখন তিনি যান নিজেকে
সাহানা ভেবেই যান।”
আমার হাঁটা খুবই মন্থর হয়ে যায়। দোকানের লন্ঠনের আলো মিলিয়ে যায়,
রেবা আমাকে হঠাৎ দুহাত দিয়ে ধরে একপাশে টানে, উচ্চস্বরে বলে, “ড্রেনে
পড়তেন তো!”
রেবা আমাকে রাস্তার পাশের নর্দমায় পড়া থেকে বাঁচায়। এই কাজটা করতে
আমাকে ধরতে তার কুন্ঠা হয় না। তারপর বলে, “সবসময়ই যে তিনি সাহানা থাকেন
তা নয়, কিন্তু গত কয়েক বছরে এই আচরণটা বেড়েছে।”
“আর তোমার মা? উনি কীভাবে মারা গেলেন?”
“১৯৭১ সনে, জুন মাসে। দুপুরবেলা পাকিস্তানী আর্মি গ্রামে ঢোকে। রহম
রাজাকার নামে গ্রামেরই একজন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। সারাদিন তাণ্ডব
চলে। বাড়ির পেছনের ডোবায় মা লুকাতে গিয়েছিলেন। সেখানে তলিয়ে যান। সারা
গ্রাম আর্মিরা জ্বালিয়ে দেয়, শ খানেক লোককে হত্যা করে, অনেক মেয়েদের ধরে
নিয়ে যায়। আমার নানা নানী মামাও মারা যান। পরে ডোবায় মা’র দেহ ভেসে
ওঠে, সালেহা-মাদের বাড়ির লোকেরা তাঁকে কবর দেন।”
ডোবার গভীরতা থেকে তাহলে সাহানা আর মুক্তি পায় নি। আমি কল্পনা করি
ডোবার ঘোলাটে অস্বচ্ছ গভীরতায় গ্যাসের বুদবুদ, সাহানার পালকের দেহ তলিয়ে
যায় বোয়াল মাছের নিরুদ্বেগ গতির নিচে, তলদেশের আঁঠালো কাদায় ছড়িয়ে
পড়ে তার ঘন কালো চুল।
“আমি সালেহা-মাদের বাড়িতেই থাকি। বাবা কয়েক মাস পরে এক রাতে আমাকে ঐ
বাড়িতেই নাকি দেখতে আসেন, আমার সেটা অবশ্য মনে নেই। স্বাধীনতার পরে উনি
সালেহা-মাকে বিয়ে করেন। সালেহা-মাই আমাকে বড় করেছেন।”
সাহানা – না সাহানা নয়, তরুণী সালেহা আমার চেম্বারে এসবই বলেছিল, শুধু
সাহানার মৃত্যুর সংবাদটা দেয় নি। কিন্তু সালেহা সেই ডোবার গুপ্তকথা জানতে
পেরেছিল, আকন্দ, আঁশশেওড়া আর বাঁশঝাড়ের আলো দেখেছিল। এতদিন পরে মনে পড়ল
আমার চেম্বার থেকে বের হবার সময় সালেহা কেমন ঝুঁকে পড়েছিল, যেন হঠাৎ
বয়সের ভার বেড়ে গেছে। তারপর সিঁড়ি থেকে নেমে সে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের
একটি গানের কলি গেয়েছিল।
হাঁটতে হাঁটতে বনগ্রামের রাস্তা ধরে নবাবপুর রোডে চলে এসেছিলাম। রেবাকে
বললাম, “তুমি এখান থেকে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে?” রেবা বলল, “এখান থেকে একটা
রিক্সা নিয়ে নেব। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। মানুষ সত্য না মিথ্যা বলে
তা যেমন বুঝি, লোকে কী করতে পারে তাও আগে থাকতে বুঝি। এটা আমার মা’র থেকে
পাওয়া শক্তি। এই শহরে চলাফেরা করতে আমি ভয় পাই না।”
রেবার কথা আমি অবিশ্বাস করি না। যে কিশোরী নিশঙ্কচিত্তে একটি অপরিচিত
পুরুষকে তার পরিচয় দেয় শুধুমাত্র সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, নির্দ্বিধায়
সেই পুরুষের হাত ধরে তাকে নর্দমার দুর্ভোগ থেকে বাঁচায়, তার আত্মবিশ্বাস,
পৃথিবীকে মুক্ত চোখে দেখার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। ভাবি, এই শহর কি রেবার জন্য
প্রস্তুত, বনগ্রামের এই অন্ধকার গলি সইতে পারবে কি তার ছন্দময় গতি?
রেবাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে সেই রিক্সার দিকে বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। বিদ্যুৎ ফিরে আসে, আলো জ্বলে।
৩.
এর মাসখানেক পরে এক সন্ধ্যায় কোনো রুগী ছিল না, চেম্বারে বসে একটা
মনোবিকলনের ওপর একটা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পড়ছিলাম, এমন সময় আমার সহকারী এক
নারীকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঐ নারীকে খুব চেনা মনে হল, সহকারী তার নাম বলল,
সালেহাকে চিনলাম। দুবছর আগে সে সাহানা নামে এখানে এসেছিল। সালেহাকে বসিয়ে
সহকারী বাইরে চলে গেল। সেই সন্ধ্যায় সালেহা যে শাড়ি পরে এসেছিল সেটার রঙ
আমার মনে আছে, হাল্কা বেগুনীতে গাঢ় লাল পাড়। দুটো ভিন্নধর্মী রঙের
মিশ্রণ। ভিন্নধর্মী – দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীতে বেগুনী এক দিকে, আর লাল
একেবারে অন্যদিকে। বেনীআসহকলা।
চেয়ারে বসে সালেহা বলল, “আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
কথা না বলে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ি।
“আপনাকে আমি গতবার মিথ্যা বলেছিলাম,” সালেহা মেঝের দিকে তাকিয়ে বলে। দেখি সে দু-হাত দিয়ে আঁচলে গিঁট দিচ্ছে আর খুলছে।
“আমি জানি।”
“আপনি জানেন?” সালেহা বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকায়।
“হ্যাঁ, আমি আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম। মুর্তজা সাহেব সাহানার নাম শোনা
মাত্র আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। তারপর রেবা আমাকে রাস্তায় খুঁজে
পেয়ে সব কথা বলে।”
“ওহ! আপনি যে আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন সেটা জানি, কিন্তু রেবার সঙ্গে যে আপনার কথা হয়েছে তা জানতাম না।”
আমরা দুজনেই মৌন থাকি। সালেহা খোলা জানালা দিয়ে রাতের অন্ধকার দেখে।
পাশের বাড়ির ছাদে একটা বাতি ম্লানভাবে জ্বলে। এবার সালেহা বলে, “রেবা
আপনাকে কী বলেছে?”
“রেবা বলল, তার মা সেই ডোবা থেকে আর বার হতে পারে নি, তার মৃতদেহ নাকি পরদিন ভেসে ওঠে।”
সালেহা কাপড়ের আঁচলে যে গিটটা দিয়েছে সেটা খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে। “আর কিছু বলল রেবা?” সালেহার গলা কাঁপে।
“আপনি সাহানাদের গ্রামেরই মেয়ে। আপনার কাছে রেবাকে রেখে মুর্তজা সাহেব যুদ্ধে ফিরে গিয়েছিলেন।”
সালেহার দেহ মৃদু কাঁপে, তার দৃষ্টি যেন তীব্র হয়ে জানালার বাইরে
অন্ধকার ছাদের টিমটিমে বাতিটার আলোকে গ্রহণ করতে চায়। যেন সেই আলোর মধ্যে
রয়েছে ত্রাণ।
আমি বলি, “রেবা আরো বলল, আপনি মুর্তজা সাহেবের কাছে সাহানার গল্প শুনতে শুনতে যেন নিজেই সাহানা হয়ে যান।”
সালেহা জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার মেঝের দিকে তাকায়, দুহাত দিয়ে
আঁচলের কোণটা ধরে থাকে যেন এটাই তার একমাত্র সহায়। সে বলে, “না, মুর্তজার
কাছে শুনে নয়। রেবা সেই সময়ের ঘটনা জানে না। সাহানা আপা আমার থেকে বড়
হলেও আমার সই ছিলেন। উনি সুন্দর গান গাইতেন। তার সঙ্গে প্রথম যখন দেখা হয়
আমি ক্লাস নাইনে পড়ি, দুপুরের পরে স্কুল থেকে ফিরেছি, শুনি মণি চাচার
বাড়িতে কে যেন গাইছে। এমন গান আমি শুনি নি আগে কখনো। দৌড়ে গেলাম, ঐ
বাড়ির আঙিনা ফুলে ভরা থাকত সব সময় – শীত গ্রীষ্ম সবসময়, মণি চাচা মানে
সাহানা আপার বাবার খুব ফুলের শখ ছিল। যে ঘরে গান হচ্ছিল তার একটি জানালায়
দাঁড়িয়ে দেখি খুব সুন্দর এক মেয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছে।”
আমি বললাম, “মধু মালতী ডাকে আয়?”
সালেহা আমার দিকে চেয়ে হাসল। বলল, “এরকমই একটা গান, তবে
রবীন্দ্রসঙ্গীত। জানালার কড়িবর্গা ধরে সম্মোহিত হয়ে দেখছিলাম তাঁকে, তো
উনি আমাকে দেখে গান থামিয়ে হেসে বললেন, ‘এই মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে কেন,
ভেতরে এস।’ আমি খুব লজ্জা পেলাম, বুঝে পাচ্ছিলাম না কী করব। উনি বললেন,
‘লজ্জা কর না, ভেতরে এস।’ ঘরে আর কেউ ছিল না, ঢুকলে ওনার পাশে বসিয়ে আমার
নাম-ধাম এসব জিজ্ঞেস করলেন। জিজ্ঞেস করলেন গান পারি কিনা। না বললাম। উনি
বললেন, ‘এস তোমাকে গান শিখাই।’
এটুকু বলে সালেহা আবার চুপ হয়ে যায়। নবাবপুরের রাস্তা থেকে একটা ট্রাকের কর্কশ হর্ন শোনা যায়।
“উনি কি তখন আপনাকে শব্দের সঙ্গে আলো দেখার কথা বলেছিলেন?”
“ঐ দিন বলেন নি, কয়েক দিন পরে বলেছিলেন।”
“তারপর?”
“উনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, বছরে কয়েকবার আসতেন, তখনো ওনার
বিয়ে হয় নি। উনি আমাকে গান শেখাতেন, তবে আমি কখনই ওনার মত গাইতে পারি নি।
সাহানা আপা ছিলেন পরীর মত। সুন্দর দেখতে ছিলেন, গাইতেনও সেরকম। আমি ভাবতাম
উনি যেন মোমের তৈরি, সামান্য গরমে গলে যাবেন।”
সালেহার বাঁ চোখের কোনায় একটা জলের ফোঁটা বড় হয়, তারপর গড়িয়ে পড়ে, সিক্ত পথ রেখে যায় উষ্ণ গালে।
“যুদ্ধের বছরখানেক আগে ওনার বিয়ে হয়। নির্বাচনের বছর ছিল সেটা, নৌকার
ঢল। পরের বছর যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছি, তখন পাকিস্তানীরা
মানুষ মারা শুরু করল। সাহানা আপাকে তার বাবা-মার কাছে রেখে মুর্তজা ভাই চলে
গেলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। রেবার বয়স তখন কয়েক মাস।”
সালেহা টেবিলের ওপর একটা কাচের পেপারওয়েটের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেটার
কাচের গভীরতায় একটা নীল ফুল ফুটে আছে। প্রায় সেকেন্ড পনেরো চুপ করে থাকার
পরে সে বলে, “আমাদের বাড়িতে একটা বকুল গাছ ছিল, সারাদিন টুপটাপ করে তার
থেকে ফুল পড়ত। আমি মাঝে মধ্যেই সেগুলো দিয়ে মালা বানাতাম, সাহানা আপা আর
আমি দুটো মালা পড়ে একসাথে গান গাইতাম। সেদিনও আমি ঘরের মাটিতে বসে বকুলের
মালা বানাচ্ছিলাম যখন আর্মি আমাদের গ্রামে আসে। আমরা কাছেরই একটা পাটক্ষেতে
লুকাই। বিকালে বাড়ি ফিরি, তখনও জানতাম না সাহানা আপা ছাড়া আর সবাইকে ধরে
নিয়ে গেছে। সন্ধ্যা হয় হয়, এই সময়ে আমার ছোট ভাইটা দৌড়ে এসে বলে,
‘রহম তালুকদার আসছে।’ আমরা জানতাম রহম রাজাকারের চোখ সাহানা আপার ওপর আছে,
আমি সাহানা আপাকে সাবধান করে আসি। সাহানা আপা আমার কাছে রেবাকে দিয়ে
পেছনের ডোবায় লুকাতে যায়।”
গতবার সালেহা সাহানা হয়ে সেই ডোবার কাহিনী আমাকে শুনিয়েছিল।
“আপনি এর পরের কাহিনী জানেন না,” বলে সালেহা। সে ডান হাত দিয়ে
পেপারওয়েটটা ছোঁয়, এমন যেন সেটার মসৃণ ত্বকের অনুভূতি সে পেতে চায়।
“সাহানা আপাকে না পেয়ে রহম আমাদের বাড়ি আসে, তার সাথে তিনজন মিলিটারি
ছিল, আমার আব্বাকে আর মাকে চুল ধরে আঙিনায় নিয়ে এসে বসায়, এঁদের দুজনকে
ক্রমাগতই লাথি ঘুঁষি মারতে থাকে। তাঁরা অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে মাটিতে, আমার
ছোটো ভাইটা পালাতে পেরেছিল। রেবা ভেতরের একটা ঘরে কাঁদছিল। আর আমাকে ওরা
টেনে হিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যায়।”
সালেহার মাথাটা ঝুঁকে পড়ে মেঝের দিকে, ও যেন এখনি পড়ে যাবে। আমি
চেয়ার ছেড়ে উঠি ওকে ধরতে, কিন্তু সালেহা এর মধ্যেই সোজা হয়ে বসে। ওর
চোখে বেদনা নয়, বরং এক ধরণের উজ্জ্বলতা, পোড়-খাওয়া ঔজল্য।
“আমাকে প্রথমে খুলনা, তারপর যশোহর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। পরের পাঁচ মাস ছিল এক নিরবচ্ছিন্ন বিভীষিকা।”
হঠাৎ আমি বুঝে পাই না আমার কী ভাবা উচিত। কী বলা উচিত।
বাইরে শরতের রাত, সালটা ছিল ১৯৮৭। আমি, ডাক্তার আবদুল মতিন, আমার
সংক্ষিপ্ত পেশাদার জীবনে সালেহার মত কাউকে রোগী হিসাবে পাই নি। আমার পরিবার
কখনো কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে জড়িত ছিল না যদিও আমার বাবা-মা এবং
নিকট সকল আত্মীয়স্বজন নৌকাতে ভোট দিয়েছিল ১৯৭০এ। একাত্তর সনে আমরা ঢাকায়
আটকা পড়ি, মার্চের শেষে ঢাকায় ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পরে ঢাকা মেডিক্যাল
কলেজ আবার খোলে। আমি ছাত্র হিসাবে আবার সেখানে পড়তে যাই। আমার বন্ধুদের
অনেকেই তখন ঢাকা-ছাড়া, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা, কেউই শরণার্থী।
আমার পরিচিত অনেকেই নির্মমভাবে পাক বাহিনীর হাতে নিহত। সেই কঠিন সময়ে আমার
মেডিক্যাল কলেজে ফিরে যাবার সিদ্ধান্তর ন্যায্যতা নিয়ে আমি এখানে কিছু
লিখতে চাই না, কারণ এই কাহিনীটি আমার কাহিনী নয়, তবে এটুকু বলতে পারি আমার
অসুস্থ বাবা মাকে ঢাকায় রেখে আমার পক্ষে চলে যাওয়া সম্ভব ছিল না, আর
ঢাকায় থাকলে নিরাপত্তার জন্য একটা আবরণ লাগে, মেডিক্যাল কলেজ সেই আবরণটুকু
দিত। কিন্তু ১৯৭১এর অজুহাত ১৯৮৭ সনে এসে এলোমেলো হয়ে গেল। আমি এখন পরিণত
একজন মানুষ, তার ওপরে সাইকিয়াট্রিস্ট, আমার চিন্তা-চেতনায় কি সালেহার মত
কেউ স্থান পেয়েছে?
আমার মনের কথাটাই যে সালেহা ধরতে পারে, বলে, “আপনি এই নিয়ে ভাববেন না,
ডাক্তার সাহেব। পাঁচটি মাস আমাকে ক্যাম্পে রেখে ধর্ষণ করা হয়, উলঙ্গ করে
হাত বেঁধে সারা শরীরে আগুনের ছ্যাঁকা দেয়া হয়, শুধু যে বিদেশী আর্মির
লোকেরা করেছে তা নয়। আমি তখন কী বুঝতাম বলুন, আমার বয়স ত্খন ষোল। আমাকে
বড় ছুরি দেখিয়ে বলত আমার শরীরের প্রতিটি অংশ কেটে বস্তায় পুরে নদীতে
ফেলে দেবে। কাঁদতাম, যতটা না নিজের জন্য তার চেয়ে বেশী মা আর আব্বার জন্য,
তাঁরা বেঁচে আছেন কিনা জানতাম না। ঐ ভয়াবহ সময়ে আমি আমাদের বাড়ির বকুল
গাছটার কথা ভাবতাম, বকুল ফুলের মালা, সাহানা আপার সাথে গান। কল্পনা করতাম
সাহানা আপার মত আমি শব্দে রঙ দেখতে পাই। সব সময় যে শব্দে রঙের কল্পনাটা যে
সাহায্য করত তা নয়, কিন্তু নিজেকে ঐ ধরণের অলৌকিক একটা গুণের অধিকারী
ভেবে ক্যাম্পের পশুদের থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখতে পেতাম। ঐ কল্পনা আমাকে
বাঁচিয়ে রেখেছিল, এজন্য সাহানা আপার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
“একাত্তরের ৭ই ডিসেম্বর যশোহর ক্যান্টনমেন্ট মুক্ত হয়। ভারতীয় বাহিনীর
সঙ্গে মুর্তজা ভাইও ছিলেন। আমি যে যশোহরে ছিলাম সেটা উনি জানতেন। উনি
আমাকে চিতলমারী নিয়ে গেলেন। আমার আব্বা-আম্মা জীবিত ছিলেন, ভাইটারও কিছু
হয় নি। কিন্তু সাহানা আপাদের পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ওদিকে
গ্রামের মানুষেরা, যাদের আমরা নিজেদের লোক ভাবতাম, আমাদের পরিবারের সঙ্গে
অদ্ভুত ব্যবহার করতে শুরু করল। আমার জন্যই। মৃত্যু হলে সবকিছুর শেষ হয়,
কিন্তু যুদ্ধে ধর্ষিতার দুর্দশা শেষ হবার নয়। মানুষের মন এত ছোট হয়ে কেন,
ডাক্তার সাহেব? মুর্তজা ভাই খুলনা ছিলেন, আব্বা তাঁকে ডেকে নিয়ে এসে
অভিযোগ করলেন। উনি জানতেন এর হয়তো একটাই প্রতিকার, আব্বাকে বললেন আমাকে
বিয়ে করবেন। এতে কারুরই অমত ছিল না, বুঝতেই পারছেন। বিয়ের পর কিছুদিন
খুলনা থেকে ঢাকায় চলে এলাম।
“আর এখন এসব নিয়ে কিছুই বলা যায় না। মানুষ ভান করে যেন এসব কিছুই হয়
নি। তারা শুনতেও চায় না যুদ্ধে কী হয়েছিল, আর মানুষ হত্যার কথা যাও বা
বলা যায়, ধর্ষণের কথা বলা একদম বারণ। রাজাকাররা ক্ষমতায় গেছে, ইতিহাস এমন
নির্দয় কেন, ডাক্তার সাহেব?”
সালেহার প্রশ্নের জবাব আমার কাছে ছিল না। আমার নিজের জীবনের সীমাবদ্ধতার
কথা ভাবি। সেই সীমাবদ্ধতা উৎরে সালেহাকে উপদেশ দেবার ক্ষমতা আমার ছিল না।
কিন্তু ঐ সন্ধ্যায় সালেহা আমার কাছে কোনো উপদেশ বা রোগ নিরাময়ের সন্ধানে
আসে নি, বরং আমার মনের বিভ্রান্তি দূর করার জন্যই এসেছিল।
“আর রহম রাজাকার, তার কী হল?” জিজ্ঞেস করি আমি। “রহম?,” হাসে সালেহা,
দুঃখের হাসি, “রহম এখন বড় ব্যবসায়ী, ওপরতলার সঙ্গে তার দহরম।”
আর কী বলব ভেবে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে আপনি আসলে শব্দের সঙ্গে
রঙ দেখতে পান না?” আমার প্রশ্নটা সময়োপযোগী ছিল না, এখন বলব নিতান্তই
স্থূল ও নির্বোধ ছিল, কিন্তু সালেহা কিছু মনে করল না। সেই সন্ধ্যায়
ডাক্তার ও রুগীর স্থান বদল হয়েছিল।
“পাই না বললে ভুল হবে, ডাক্তার সাহেব। আমি নিজেকে এখন বুঝিয়েছি যে
দেখতে পাই, তা না হলে একাত্তর সনে আমি বেঁচে ফিরতাম না।” এই বলে হাসে
সালেহা, বিজয়িনী হাসি। বুঝি রেবার অমলিন হাসির উৎস তার সালেহা-মা। তারপর
এক সময়ে হাসি মিলিয়ে যায়, বলে, “মুর্তজা এখনো সাহানা আপাকে ভালবাসে, তা
বাসুক, ঐ ভালবাসাটুকু তার প্রাপ্য। আমি আপাকে ঈর্ষা করি না, তাকে আমিও কম
ভালবাসতাম না।”
সালেহার বাঁ-হাতের পোড়া চামড়ার দিকে তাকাই, তারপর তার উজ্জ্বল মুখের
দিকে। দুর্বৃত্তরা তার হৃদয়কে পোড়াতে পারে নি, আগ্নেয়গিরির গলন্ত
লাভাস্রোত পার হয়ে সেটা যেন লুব্ধক তারার মত জ্বলে। আমি সালেহার সাথে নিচে
নেমে তাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিতে যাই। রিক্সায় ওঠার আগে তাকে জিজ্ঞেস করি,
“আমি বুঝতে পারছি কেন মুর্তজা সাহেব আমাকে মিথ্যাবাদী ভেবেছিলেন, কিন্তু
উনি আমার একটা কথাও শুনতে চাইলেন না সেটা আমার আশ্চর্য লাগছে।”
আমার কথাটার উত্তর দিতে সালেহা কয়েক সেকেন্ড সময় নেয়, রথখোলা মোড়ের
নিয়ন বাতির বিজ্ঞাপনের সবুজ আলোতে ওর মুখটা বর্ণময় হয়ে ওঠে। তারপর সে
বলে, “ডাক্তার সাহেব, আসলে সাহানা আপার মৃতদেহ পাওয়া যায় নি। মৃতদেহ
আবিষ্কারের কাহিনীটা মুর্তজা তার মেয়ের জন্য বানিয়েছে।”
সালেহার কথা বুঝতে আমার সময় লাগে, যে ঘটনাটা মনে হয়েছিল ধীরে ধীরে বোধগম্য সেটা হঠাৎ আঁধারে মিলিয়ে যায়।
“একাত্তরের আগস্ট মাসে মুর্তজা গ্রামে ফিরে দেখে গ্রাম জ্বালিয়ে
দিয়েছে পাক বাহিনী, তার শ্বশুর, শাশুড়ি, শ্যালক মারা গেছে। রেবাকে আমার
আব্বা আম্মার কাছে পায়। ঐ সময়ে মুর্তজা ডোবায় ডুব দিয়ে, জাল ফেলে আরো
নানাভাবে সাহানার দেহ খোঁজে করে। কিন্তু দেহ পায় না। আমি তখন আর্মি
ক্যাম্পে বন্দী। গ্রামবাসীরা কানাঘুষা করে যে আমাকে ছাড়াও আর একজন নারীকে
আর্মি ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু এটা স্বচক্ষে দেখেছে এমন কাউকে পাওয়া গেল
না। যুদ্ধের পরে মুর্তজা খুলনা, পিরোজপুর, বরিশাল এরকম দশটা ক্যাম্পে
সাহানা আপাকে খুঁজেছে, কিন্তু সারা দেশে এত ক্যাম্প ছিল যে সে শেষ পর্যন্ত
খোঁজা বন্ধ করে দেয়। রেবাকে প্রবোধ দেয়ার জন্য তাদের বাড়িতেই একটা কবর
করে, কিন্তু সেই কবরে কোনো দেহ নেই।
“প্রতিবছর মুর্তজার কাছে কেউ না কেউ আসে, বলে যে সে সাহানা আপাকে
দেখেছে। প্রথম প্রথম মুর্তজা তাদের কথা শুনে খুঁজতে গেছে, কিন্তু কিছুই
পায় নি। তাই এখ্ন সে আর এসব শুনতে চায় না।”
রথখোলা মোড়ের ভীড়টা হাল্কা হচ্ছিল। লোকের গুঞ্জন, গাড়ির আওয়াজ কমে
আসছিল। সালেহা রিক্সায় ওঠে, হুড তুলে দিতে দিতে বলে, “অন্ধকার হলে আলোর
রঙগুলো আরো ভাল করে দেখা যায়।” আমি বিড়বিড় করে বলি, সিনেস্থেশিয়া।
সালেহা জিজ্ঞেস করে, “কিছু বললেন?” আমি মাথা নাড়াই, সিনেস্থেশিয়ার
ব্যাখ্যা দেবার সময় এটা নয়।
সালেহা হাসে, হয়তো শুনতে পেয়েছে আমার কথা। হুডের থেকে মাথা বের করে
বলে, “ঐ মালতী লতা দোলে।” রিক্সা চলতে শুরু করে। আমি বুঝতে পারি না সালেহার
কথা। সালেহা প্রায় চিৎকার করে বলে, “প্রথম যেদিন সাহানা আপাকে দেখি উনি
এই গানটা গাইছিলেন।” রিকশাটা ভিড়ে যতক্ষণ না হারিয়ে যায় ততক্ষণ সেদিকে
তাকিয়ে থাকি।
ঐ বছরের নভেম্বর মাসে নূর হোসেন পুলিশের গুলিতে মারা যায়, তার বুকে
লেখা ছিল, “স্বৈরাচার নিপাত যাক।” মনে পড়ে রেবা আমাকে বনগ্রামের রাস্তা
ধরে এগিয়ে দিয়েছিল। নূর হোসেনের বাড়ির সামনে দিয়েই আমরা হেঁটে
গিয়েছিলাম।