Saturday, June 9, 2018

ঈশ্বর আমার মৃত্যু কামনা করেন। নিহত ব্লগারদের লেখা খতিয়ে দেখে যেভাবে তদন্ত হয় ও অবিশ্বাসের সূর্য্য মাথার ওপর উঠে – ১।

যার যার ঈশ্বর দেখতে তার তার পূর্ব পুরুষদের মতন। ঈশ্বরের চেহারায় পূর্ব পুরুষদের ছাপ থাকে। গতরাতে আমার ঘুম আসছিলো না। এমনিতে ঘুম না এলে স্বপ্ন আসে। এদিন স্বপ্ন আসেনি, তাই তিনি এলেন। তিনি বললেন, দেখো, আমার চেহারায় তোমার বাবা ও দাদার ছাপ আছে। আমিই তোমার ঈশ্বর।
নিজেকে আধুনিক ঈশ্বর বলে দাবি করেন এবং বলেন, তিনি আসবেন তাই আমার ঘুম আসেনি। আমি নাকি তার জন্য অপেক্ষা করছি। এ কথা শুনে কিছুক্ষণ হাসলাম। তিনিও হাসলেন।
ঈশ্বর এলেন মৃত্যুর দাবি নিয়ে। তিনি চান আমি যেন স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যুবরন করি। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, আমার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এনেছেন এবং বলেছেন এসব মেনে নিতে। ঈশ্বর যখন অভিযোগসমূহ বলছিলেন, তখন তাকে খুব রাগান্বিত দেখিয়েছে। বেশ ক্ষুব্ধতার সাথে তার অভিযোগ বললেন।
-গত বর্ষায় বৃষ্টির দিনে তোমার বাসার বাম পাশের গলির মুখে যমদূত পাঠিয়েছিলাম। কথা ছিলো তুমি খুন হবে এবং বৃষ্টির জলধারা রক্তে লাল হয়ে নেমে পড়বে ওয়াসার ড্রেনে। কিন্তু তুমি গেলে ডান পাশের গলি দিয়ে এক সুন্দরী নারীর ছাতা ভাগাভাগি করে।
-দুঃখিত। বিষয়টা আমি জানতাম না।
– তার কিছুদিন পর অফিসের পাশে আন্ডারপাসের সিঁড়িতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকার কথা ছিলো। যেখানে সিঁড়ি শেষ, সেখানে সামান্য জল জমে থাকবে আর তোমার রক্ত সিঁড়ি বেয়ে সেই জলে মিশে যাবে। অথচ তুমি সেদিন অফিসেই গেলে না। বাসায়ও ছিলে না।
– আপনার এই পরিকল্পনার কথাও আমার অজানা ছিলো।
– পরের সপ্তাহের একদিন রাত বারোটায় তোমার সিগারেট শেষ হয়ে গেলে সিগারেট কিনতে বের হবে। ওঁৎ পেতে থাকা যমদূত তোমার প্রাণ নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। এই দেখো, ঠিক এরকমই লেখা আছে তোমার প্ল্যান বুকে। সিগারেট ঠিকই শেষ হয়েছে। কিন্তু সিগারেট কিনতে বের হয়েছিলো তোমার বন্ধুর গাড়ির ড্রাইভার। এবং সেটা তোমার বন্ধুর বাসায়। মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বৌ বাচ্চাকে ঘরে একা রেখে বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলে মদ খেতে, আড্ডা দিতে। যমদূত দেখেছে তোমার স্ত্রী ভয়ে সারা রাত ঘরে আলো জ্বেলে রেখেছিলো। অথচ তোমার কোন লজ্জা হয়নি।
-বন্ধুর বাসায় গিয়ে মদ খাওয়া এবং আড্ডা দেয়ার বিষয়ে আমার স্ত্রীর কোন অভিযোগ ছিলো না। সে আলো ভালোবাসে, তাই আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলো। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের পরিবারের সবাই অন্ধকারে অনভ্যস্ত।
ঈশ্বর বললেন, আমাদের পারিবারিক বিষয়ে তার কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু আমি যা করেছি, কিছুই তার পরিকল্পনায় ছিলো না। আমি নিজ পরিকল্পনায় চলছি এবং আইন অনুযায়ী একজন বিদ্রোহী। কিন্তু যেহেতু নিজস্ব পরিকল্পনায় চলার যোগ্যতা অর্জন করেছি, সেহেতু যোগ্যতার মর্যাদাস্বরূপ কোন শাস্তি পেতে হবে না। শুধু তার পরিকল্পনা মতে মৃত্যুকে বরন করে নিলেই তিনি খুশি।
খুব জোরশব্দে হাসার চেষ্টা করলাম। পেরেছিও। এমন উচ্চস্বরে খুব টান টান দম নিয়ে এর আগে কখনো হাসিনি। আমি জানি কারো হাসির শব্দ দূর থেকে মনযোগ দিয়ে শুনলে খুব বিশ্রী লাগে। অস্বস্তিকর। হাসি থামিয়ে জানতে চাইলাম আমাকে কেন এভাবে পথে ঘাটে মরে থাকতে হবে এবং আমার রক্ত কেন উচ্ছিষ্ট জলে গিয়ে মিশবে? এমন অপ্রচলিত মৃত্যুর কারণ কী?
ইশ্বর ভরাট গলায় বললেন, তোমার দেশের বেশিরভাগ মানুষ এরকম মৃত্যু পছন্দ করে। তাছাড়া তোমার বন্ধুদের মধ্যে যারা এর আগে এভাবে মারা গেছে, তাদের মৃত্যু দেশের অধিকাংশ মানুষকে আহত করেনি। অর্থাৎ তোমাদের জন্য এটাই প্রচলিত মৃত্যু।
– কিন্তু বিষয়টাতো আমার উপর নির্ভর করছে। এভাবে মারা যাওয়া আমার পছন্দ নয়। আমি আরো সম্ভ্রান্ত মৃত্যু চাই।
– শোনো, তোমার দেশে এখন একপক্ষ মরছে, আরেকপক্ষ মারছে। এরা সংখ্যায় কম। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এসব মৃত্যুর জন্য যারা মরছে তাদেরকে দোষ দিচ্ছে। তোমার উচিত জনমতকে শ্রদ্ধা জানানো। আমি চাই তুমি আরো গণতান্ত্রিক হও।
– এসব কথা আপনার মত করে বলছেন। মানুষের মত পরিবর্তন হয়। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আপনি এমন একজনকে মানুষের মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মরে যেতে বলছেন, যে কিনা মানুষের মত পরিবর্তনের জন্য কাজ করে। আপনি যুক্তি ছাড়া কথা বলছেন। আপনি একজন অযৌক্তিক ঈশ্বর।
এরপর ঈশ্বর বললেন আমি যেন তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করি। তিনি আমার বয়সে ছোট। আমার আর আমার ঈশ্বরের জন্ম একই সময়ে হয়নি। আমার জন্মের অনেক পরে নাকি তাকে সৃষ্টি করেছি।
-মিথ্যা কথা। আমি তোমাকে সৃষ্টি করিনি।
– তোমার বাবা, দাদা, মক্তবের হুজুর, স্কুলের শিক্ষকরা মিলে আমাকে তোমার জন্য সৃষ্টি করেছে। এরপর তুমি ধারণ করেছো।
– কিন্তু শেষে তোমাকে ঘৃনা করেছি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি।
-হ্যাঁ, ঘৃনার আড়ালে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। সেই ভালোবাসার টানে এসেছি। তুমি রাজি হও, খুন হয়ে যাও। প্লীজ!
– কী অদ্ভুত!
– আচ্ছা তোমরা ঈশ্বরকে সৃষ্টি করার পর যে পরিমান ক্ষমতা বা পাওয়ার দিয়ে থাকো, সত্যি সত্যি যদি কেউ সমপরিমান মহাপরাক্রমশালী হয়ে তোমার প্রাণ নিতে আসে, তুমি কি তাকে বাধা দিতে পারবে?
– আমরা কি কোন ব্যাটারিচালিত ঈশ্বর নিয়ে আলোচনা করছি? এ বিষয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই।
এবার তিনি খুব হতাশ হলেন। আমার কাছে এরকম আচরণ আশা করেননি। কথাটিকে গালি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তার মতে ঈশ্বররা অদৃশ্য ক্ষমতায় চলেন, তাদের কোন ব্যাটারির প্রয়োজন হয় না। অথচ তার মতামতকে আমি এতটুকু মূল্য দিইনি। এমন কথার জবাবে তাচ্ছিল্যে হাসি হাসলাম।
তার সাথে আলোচনায় আগ্রহ হারাচ্ছি দেখে তিনি আমার সাথে মৃত্যুর উপায় নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মৃত্যুর কথা বললেন। ঈশ্বরের মতে এটা একটা সুযোগ। তিনি আমাকে মৃত্যুর অপশন দিবেন। সেখান থেকে পছন্দসই উপায়ে মারা যেতে পারবো। এই বিশেষ সুযোগটি কেবল আমার জন্য। এরকম বললেন।
– মনে করো তারা তোমাকে নিয়ে একটি ৩০ তলা দালানের উপর উঠলো। তারপর চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। দালানের যে পাশে ধাক্কা মারবে, সে পাশে থাকবে একটি সুন্দর ফুলবাগান। সেক্ষেত্রে তোমার রক্ত ফুল বাগানের মাটিতে মিশে যাবে। সার হবে এবং সেই সারের পুষ্টিতে বাগানে আরো বেশি বেশি ফুল ফুটবে। রক্ত ড্রেনের জলে মিশে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
রক্তের শক্তিতে হৃষ্টপুষ্ট ফুলের জবাবে আমি কিছু বলিনি।
– অথবা ধরো তারা তোমাকে একটি বড় মাঠে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করলো। তারপর ঠিক সেখানেই মাটিতে পুঁতে ফেললো।
– জ্যন্ত পুঁতে ফেললে কী হয়?
– যাদের জন্য তুমি মারা যাবে, তাদের আত্মতৃপ্তির একটা ব্যাপার থাকে না! চাপাতি দিয়ে কোপানোর বিষয়টা এখন কালচার। এভাবেই হচ্ছে।
– বাদ দাও এসব।
– আচ্ছা, আরো একটা উপায় বলি। প্রথমে তারা একটি গর্ত খুঁড়লো। এরপর তোমাকে সেখানে শুইয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মাটিচাপা দিয়ে দিলো। এতে আপত্তি আছে?
– তুমি কি ঈশ্বর? নাকি ডেথ প্ল্যানার? এত নৃশংস মৃত্যু পরিকল্পনা নিয়ে বেঁচে আছো। তোমার লজ্জা করে না?
– দেখো, ঈশ্বর কখনো কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। তিনি যে কাজে দক্ষ, সেটা হচ্ছে মৃত্যু। আজ পর্যন্ত দেখেছো ঈশ্বর কাউকে বাঁচিয়ে রেখেছে? সবাই মরে যায়। মরতে হয়।
উনার কথা শুনে আমার গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো। তখনো ভোর হতে ঘন্টাখানেক বাকি ছিলো। বমি করার জন্য যথেষ্ট সময় ছিলো। চেষ্টাও করেছি, কিন্তু হয়নি। ঠান্ডা মাথায় তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি, যেহেতু আমি তাকে বিশ্বাস করি না, সেহেতু তিনি যেন আমার কাছে না আসেন। আমার এসব ভালো লাগে না।
আরেকটি কথা তাকে স্পষ্টভাবে বলেছি। তার ইচ্ছা অনুযায়ী মারা যাওয়ার কোন আগ্রহ আমার নেই। তিনি বললেন আগ্রহ যে নেই, এটা পুরোপুরি ঠিক না। তার দেয়া মৃত্যুর অপশন বিষয়ক আলোচনায় আমি অংশ নিয়েছি এবং জ্যন্ত পুঁতে ফেলার মত একটি অপশন প্রস্তাব করেছি। পরোক্ষভাবে এটা নাকি আমার সম্মতি। আমি বলেছি, এটা আমার সম্মতি নয়। বরং এটা হচ্ছে ভয়। কখনো যদি খুনীর মুখোমুখি হই, তখন হয়তো তাদের কাছে রক্তপাতহীন মৃত্যু দাবি করবো। আমি লাল গোলাপ, লাল শিমুল, লাল ফিতা, লাল চুড়ি, লাল জুতো, লাল সূর্য, লাল ওয়াইন পছন্দ করি। কিন্তু রক্ত নয়। এতকিছু বলার পরও তিনি আমার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলেন। খুব অসহায়বোধ করলাম।
-কিছু কথা বলি, মন দিয়ে শোনো। এই দেশে তুমি যখন তখন মরে যেতে পারো। মনে করো তুমি অটোরিক্সা করে কাওরান বাজার থেকে মতিঝিল যাচ্ছ। একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তোমাকে বহন করা অটোরিক্সাটি চাপা দিলো। তুমি গেলে। অথবা মনে করো শশুর বাড়ি যাওয়ার সময় লঞ্চে করে পদ্মা নদী পাড়ি দিচ্ছো। একটি ডুবো চরে ধাক্কা খেয়ে লঞ্চের তলায় ফাটল ধরে পানি ঢুকে ডুবে যেতে লাগলো। ক্লান্ত শরীরে তুমি তখন ঘুমিয়ে আছো। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে লঞ্চের সবগুলো লাইফবয় অন্য যাত্রীরা দখল করে নিলো। অনেক কিছু আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে চাইলে, কিন্তু পারলে না। ডুবে মরলে।
– প্লীজ, এসব বন্ধ করো। তুমি এত বর্বর কেন? একটি মৃত্যু নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন? এটা খুব বোরিং।
– এমনওতো হতে পারে তোমার বাসায় আগুন লাগলো। বৌ বাচ্চাদের বাসা থেকে বের করতে গিয়ে শেষে নিজেই আটকা পড়লে। আচ্ছা মানলাম তুমি আগুনে পুড়ে মরলে না। কিন্তু ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মরে গেলে। আসলে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে, জঙ্গীদের হাতে চাপাতির কোপ খেয়ে না মরলেও অন্য অনেক কারণে মরে যেতে পারো। এখানে মরার জন্য হাজারটা সহজলভ্য উপায় আছে। মরেই যখন যাবে, তখন আগামীকালই মরবে না কেন? আচ্ছা ঠিক আছে। পরশু মরো। অথবা তার পরদিন। তুমি একটা ডেট দাও। সেদিন যমদূত পাঠাবো। কোন ঝামেলা না করে মরে যাও।
– প্রয়োজনে আমি দেশ ছাড়বো। এমন দেশে যাবো, যেখানে মৃত্যুর হাজারটা সহজলভ্য উপায় নেই।
– কোথায় যাবে? জামার্নী, সুইডেন, নরওয়ে, কানাডা, নেদারল্যান্ডস অথবা মনে করো সুইজারল্যান্ডই গেলে। সবগুলো শীতের দেশ। মনে করো এমন শীত পড়লো যে, তুমি বরফে জমে গেলে। মৃত্যু কিন্তু তোমার পিছু ছাড়বে না। আচ্ছা বাদ দাও। শোনো, তোমার সাথে কথা বলাটা এখন আর এনজয় করছি না। খুব বোরড ফীল করছি। এটা দ্রুত শেষ করো।
আসলে ততক্ষণে আমিও খুব বিরক্ত ও বিব্রতবোধ করছিলাম। কখনো ভাবিনি ঈশ্বরের সাথে শুধু মৃত্যু নিয়ে কথা বলবো। কিছুদিন ধরে প্রচুর মুভি দেখছি। কয়েকটা মুভিতে ভয়াবহ প্লটহোল খুঁজে পেয়েছি। খুব ভালো হতো যদি উনার সাথে মুভি নিয়ে কথা বলতে পারতাম। অথবা আমার ছোট ছেলের মাথার চুল নিয়ে। তার চুলগুলো খুব দ্রুত বাড়ছে এবং বাদামী হয়ে যাচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা পারিবারিকভাবে অত্যন্ত ব্যস্ত। তার চুলের বেড়ে উঠা এবং রং পরিবর্তন নিয়ে বেশিরভাগ সময় আলোচনা করি। কিন্তু ঈশ্বর এলেন শুধুই মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে। অসহ্য। এমনকি আমার সাথে তার কোন ভালো সম্পর্কও নেই। আমার কাছে তিনি মঞ্চের ভাঁড়ের চাইতে হাস্যকর, এবং ভাঙা মদের গ্লাসের চাইতে বিরক্তিকর। কখনোই আমি তাকে আশা করিনি।
– এতো বেশি ঘৃনা করা ঠিক না। তোমার চারপাশে অনেক উদাহরণ আছে। যারা একসময় আমাকে খুব ঘৃনা করতো, এখন তারচে বেশি ভালোবাসে। যখনই তুমি আমাকে ঘৃনা করতে থাকবে, তখনই আমি আশাবাদী হতে থাকবো। কারণ আমি জানি একসময় তুমি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসবে। তাছাড়া তুমি যদি আমাকে আশা না করতে, আমি এখানে আসতে পারতাম না। যেভাবেই হোক, তুমি আমাকে আশা করেছ। তাই এসেছি।
– না, আমি তোমাকে আশা করিনি। একটুও না।
– তাহলে তোমার স্বপ্ন আসেনি কেন? তুমি কী অস্বীকার করতে পারবে যে দিন দিন কেমন স্বপ্নহীন হয়ে যাচ্ছো। ঈশ্বরের কোন ক্ষমতা নেই আত্মবিশ্বাসী কোন স্বপ্নবান মানুষের কাছে ঘেঁষার। আজ তুমি সম্পূর্ণরূপে স্বপ্নহীন ছিলে বলেই আমি এসেছি। অথচ কেমন বাজে ব্যবহারটাই না করলে। যদিও তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হইনি। কারণ মানুষের প্রতি এখন আর আমার কোন বিশ্বাস নেই। মানুষ নিজে যাকে সৃষ্টি করে, আবার তাকেই ধ্বংস করে।
– এতক্ষণে একজন অভিমানী ঈশ্বরের দেখা পেলাম। হা হা হা।
– দেখো, আমি আমাকে সৃষ্টি করিনি। এটা সম্ভব না। তোমরা ঈশ্বর বানাও, ধর্মগ্রন্থ বানাও। আবার ঈশ্বরকে ধ্বংস করো, ধর্মগ্রন্থ নিয়ে হাসাহাসি করো। এসব গ্রন্থ কি আমি লিখেছি? তোমরা এখন এসব গ্রন্থকে হাস্যকর বলো, উদ্ভট বলো। অথচ এগুলো তোমাদের পূর্ব পুরুষরাই লিখে গেছে। তোমরা নিজেরা যা জানো না, যা বুঝো না, যা আবিষ্কার করতে পারোনি, তার সবকিছু ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছো। তোমাদের সকল ব্যর্থতার ভার আমাদেরকে বহন করতে হয়। অনেক সময় কৃতিত্বের ভাগও দাও। কিন্তু সেটা সবসময় না। তোমরা নিজেদের মত করে আমাদেরকে মহিমান্বিত করেছো। তারপর আবার তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করছো। তোমরা আমাকে নিয়ে খেলছো। এটা খুবই ফালতু একটা গেইম, যা তোমরাই সৃষ্টি করেছো।
– বলে যাও। খারাপ লাগছে না।
– আমাকে তোমার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ আজ তুমি আমাকে স্বীকার করো না। আমি তোমার কাছে আসার জন্য, পাশে বসার জন্য শকুনের মতো তাকিয়ে থাকি। কখন একটু সুযোগ পাবো, এই আশায়। বহুদিন পর আজ সুযোগ পেয়েছি। যতই অবহেলা, অপমান করো না কেন, আমার ভালো লেগেছে। তুমি হয়তো জানো না, একা থাকার কী কষ্ট।
– তোমার কথায় যুক্তি আছে। এতক্ষণে মনে হচ্ছে তোমার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
– কিন্তু আমাকে বলো কেন তুমি মরতে চাও না?
– আসলে এটা মৃত্যুর জন্য সঠিক বয়স নয়। তুমি জানো আমি এখন কী পরিমান ব্যস্ত। হাতে অনেক কাজ। তাছাড়া আমার দু’টো ছেলে এখনো অনেক ছোট। আমি তাদের যুবক বয়সটা দেখে যেতে চাই। তারা কিভাবে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলে, কিভাবে অন্যের কাছে আকর্ষনীয়ভাবে উপস্থান করে, তাদের প্রতি আমার কতটুকু প্রভাব নিয়ে বেড়ে উঠে, কেমন মেয়ের সাথে প্রেম করবে, এসব। তাছাড়া তাদেরকে সাথে নিয়ে আমি পাহাড় বাইতে যাবো। তারা আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। বলবে, কিভাবে পাহাড় বাইতে হয়।
– তুমি কি এটাকে তোমার স্বপ্ন হিসেবে নির্মাণ করেছো?
– অনেকটা তাই।
– তুমি আমাকে এভাবে দুর্বল করতে পারো না। আমিও কিছু স্বপ্ন নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। কিন্তু তোমার স্বপ্ন যেভাবে নির্মিত হয়, আমার স্বপ্ন একই সাথে একইভাবে ধ্বংস হয়। খুব মন খারাপ হলো। কিছুটা সময় একা থাকতে পারলে ভালো লাগতো। আশপাশে কেউ থাকলে মন খারাপ শেষ করা যায় না। বড়জোর এড়িয়ে যাওয়া যায়।
– তার আগে একেবারে সত্যি করে বলো, তুমি কেন আমাকে মারতে এত আগ্রহী।
– কারণ আমি মুক্তি চাই। তোমার আমার জন্ম একইসাথে না হলেও আমাদের মৃত্যু একইসাথে হবে। মানুষের মৃত্যুর পর আর তার ঈশ্বর বেঁচে থাকে না। ইশ্বর তার মালিক ছাড়া একা বাঁচতে পারে না। হয় আমাকে ভালোবাসো, নয় মুক্তি দাও।
আলোচনা এমন মানবিক রূপ ধারন করবে বুঝিনি। ঈশ্বরকে একটু একা থাকতে দিয়ে জলপান করতে রান্না ঘরে যাই। জগে জল ছিলো না। জার থেকে জল ঢেলে খুব প্রশান্তি নিয়ে পেটভরে জল নিলাম। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে ভোরের আলো ছড়িয়েছে। গতকালের ভোরের সাথে আজকের ভোরের বিশেষ পার্থক্য নেই। একইরকম আলো, একইরকম কুয়াশা। হঠাৎ খুব শীত শীত লাগছে। খেয়াল করে দেখি, আমার গায়ে একটি হালকা ফুলহাতা টীশার্ট। অথচ এতক্ষণ শীত গরম কিছুই অনুভব করিনি। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে রীতিমত কাঁপছি। দ্রুত শোবার ঘরে গেলাম সোয়েটার পরতে। গিয়ে দেখি আমি আমার বিছানার উপর বসে আছি। সোয়েটার পরে। শোবার ঘরে এখন দু’টো আমি। একটি সোয়েটার পরা, আরেকটি সোয়েটার ছাড়া। ঈশ্বর চেহারা পাল্টে হুবহু আমার রূপ ধরে বসে আছেন। বললেন, খুব শীত পড়ছে, এসো ঘুমিয়ে পড়ি।
তার কথা এড়িয়ে যেতে পারিনি। হঠাৎ চোখের পাতায় প্রচুর ঘুম নেমে আসে। বিছানার দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রতিদিন আমি দু’টো বালিশ মাথায় দিয়ে খাটের মাঝখানে ঘুমাই। ঈশ্বর বালিশ দু’টো পাশাপাশি রাখলেন। তিনি ডানের বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন। শীত থেকে বাঁচার জন্য আমিও দ্রুত বাম পাশের বালিশে শুয়ে পড়ি। ঠিক তখন কানের কাছে মুখ এনে ঈশ্বর ফিসফিস করে বললেন, “মারা যাওয়ার কথাটা মাথায় রেখো। চাইলে আত্মহত্যাও করতে পারো।“
তারপর আর কিছু মনে নেই। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ দুপুরে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি ঈশ্বরের বালিশে শুয়ে আছি। বাম পাশের বালিশটি খালি। শোবার ঘরে আমি ছাড়া কেউ নেই।

নিহত ব্লগারদের লেখা খতিয়ে দেখে যেভাবে তদন্ত হয়

“ব্লগার হত্যা জাতির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ব্লগার হত্যা এমন একটা বিষয়, যার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা কোনভাবেই ব্লগার হত্যা এড়িয়ে যেতে পারি না। ব্লগার হত্যা এড়িয়ে জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়, এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যদি এগিয়ে যেতে চান, তাহলে ব্লগার হত্যার ঘটনা এড়িয়ে যাবেন না। সুতরাং এটা প্রমাণিত যে, ব্লগার হত্যা মোটেও অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমি বলতে চাই, পুলিশ বাহিনী এসব ব্লগার হত্যার রহস্যের উন্মোচন করতে প্রাণবাজি রাখবে। হত্যার পরিকল্পনাকারীকে গ্রেফতার করতে জানবাজি রাখবে। হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া খুনীদের ধরতে প্রাণবাজি রাখবে। তোমরা যেসব পুলিশ সদস্য প্রাণবাজি রাখতে অপারগতা জানাবে, বুঝতে হবে তাদের প্রাণের কোন মূল্য নাই, গুরুত্ব নাই। তাই নিজের প্রাণের মূল্য প্রমাণ করতে পুলিশ বাহিনীকে ব্লগার হত্যার তদন্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।“
– আবারো ব্লগার খুন হওয়া প্রেক্ষিতে ডাকা জরুরী বৈঠকে প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন পুলিশের আইজি।
এরপর তিনি উপস্থিত অধীনস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তদন্তের বিষয়ে আইডিয়া চাইলেন। আইজিপি বললেন, “একটি সফল তদন্তের জন্য সবার আগে প্রয়োজন ফাটাফাটি আইডিয়া। ফাটাফাটি আইডিয়া একটি সফল তদন্তের ভিত গড়ে দেয়। ফাটাফাটি আইডিয়া ছাড়া একটি তদন্ত সফল হয়ে উঠে না। আমরা একটি সফল তদন্তের জন্য ফাটাফাটি আইডিয়া চাই। এখানে যারা উপস্থিত আছেন, তারা সবাই একটি করে ফাটাফাটি আইডিয়া দেন। আমরা সবগুলো ফাটাফাটি আইডিয়ার সমন্বয় করে একটি সুপার ফাটাফাটি আইডিয়া বের করে নিবো।“
উপস্থিত সবাই তাদের আইডিয়াগুলো বলতে থাকলেন।
এডিশনাল আইজিপিঃ
স্যার, আমার মনে হয় আনসারুল্লাহ বাংলা টীমের বড়হুজুর রাহমানিকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেরিয়ে আসতে পারে মূল ঘটনা।
ডিএমপি কমিশনারঃ
পুলিশ বাহিনীর ভেতরেই টিকটিকি আছে। এই মুহূর্তে যেটা দরকার, সেটা হচ্ছে বাহিনীর মধ্যে ফাঁদ পাতা। এই ফাঁদে টিকটিকি ধরা পড়বেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, টিকটিকি ধরার জন্য ইঁদুর ধরার কল বসালে লবে না। টিকটিকির কলই বসাতে হবে।
যুগ্ম কমিশনার, ডিবিঃ
এসব কলে টলে হবে না। ব্লগার হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত যারা জামিনে আছে, তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিলে কিছু ক্লু পাওয়া যেতে পারে। আমরা সেইসব ক্লু ধরে এগিয়ে গেলে হত্যায় অংশ নেয়াদের শনাক্ত করতে পারবো।
ডিসি ওয়ারী জোনঃ
স্যার, আমার মনে হয় ওলামালীগ নেতাদের ফোনে আড়ি পাতলেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
ওসি, সূত্রাপুর থানাঃ
ওলামালীগ নয়। আড়ি পাততে হবে হেফাজত নেতাদের ফোনে। আমি মনে করি এটাতে কিছু ফল পাওয়া যেতে পারে।
এডিশনাল ডিআইজিপিঃ
ওলামা লীগ আর হেফাজততো খুব সহজ সন্দেহ। একটু ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। সরকারের কতিপয় বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রীর সাথে জঙ্গী কানেকশন আছে। তাদের প্রতি নজর রাখলেও কিছু একটা পাওয়া যেতে পারে।
ডিআইজিপিঃ
কথাতো অনেক বলা যায়। কিন্তু আমি যেটা বলতে চাই, সেটা হলো এই তদন্তটাও আগের তদন্তগুলোর মতো যেনতেনভাবে শেষ করে দিই। কিন্তু ভবিষ্যতে যেন খুন ঠেকাতে না পারলেও খুনীদের ধরতে পারি, সে বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে পারি। কিন্তু ঢাকা শহর এখনো পুরোপুরি সিসিটিভির আওতায় আসেনি। কিন্তু এক মাসের মধ্যে পুরো শহরকে সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
এএসপিঃ
আমি এই ভেবে অবাক হচ্ছি যে, কেউই দেখি তদন্তের কলাকৌশল নিয়ে কথা বলছে না। সবাই শুধু সস্তামার্কা বিপ্লবের থিওরি দিয়ে যাচ্ছে। আমরাতো আগে তদন্ত করতে হবে, পরে না খুনী ধরবো। আমাদেরকে যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে কতগুলো সূত্র ধরে এগুতে হবে। এর সব সূত্রই আমাদের জানা আছে। এটা নিশ্চিতভাবেই ইসলামী জঙ্গীদের কাজ। দুইজন জঙ্গীপোষককে ফেলে দিয়ে তৃতীজনের কাছে গেলেই সুরসুর করে পুরো ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
এএসআই মতিনঃ
কিন্তু আমাদেরতো আগে জানতে হবে তাকে কেন খুন করা হয়েছে। সে কী এমন লিখতো, যার কারণে তাকে খুন করতে হবে। আরো জানতে হবে সে কি কারো অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লিখতো? লিখলে কাকে আঘাত দিয়ে লিখতো? আসলে তদন্তের একমাত্র মোটিভ হতে হবে নিহত ব্লগারের লেখালেখি খতিয়ে দেখা। সে কী লিখতো, এটা যদি বুঝতে না পারি, তাহলে আমরা কখনো কাউকে বলতে পারবো না তাকে আসলে কেন খুন করা হয়েছে।
টেবিল চাপড়ানোর আওয়াজ, ধুম করে শব্দ হলো। শব্দ শুনে সবাই আইজিপির দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি বললেন, “ফাটাফাটি! ফাটাফাটি আইডিয়া!! লেখালেখি খতিয়ে দেখার আইডিয়াটাই ফাটাফাটি। অত্যন্ত ফাটাফাটি। আমাদের প্রত্যেকের উচিত যেসব ব্লগার মরে যাচ্ছে, তাদের লেখালেখি খতিয়ে দেখা। এটা খুবই জরুরী একটা ব্যাপার। লেখালেখি খতিয়ে দেখতেই হবে। আসলে লেখালেখি খতিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।“
উপস্থিত সবাই সম্মতি জানালেন। একজন বললেন, সেক্ষেত্রে এই বৈঠকে বসেই লেখালেখি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। এবং এই মিটিংয়ে বসেই তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে ফেলা যায়।
আরেকজন বললেন কম্পিউটার অপারেটরকে এই বৈঠকে ডেকে আনতে। লেখা খতিয়ে যা যা পাওয়া যাবে, সে সাথে সাথে লিখে ফেলবে। তাহলে দ্রুততার সাথে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা যাবে।
যে ভদ্রলোক দুইজন জঙ্গীপোষককে মেরে ফেলার আইডিয়া দিয়েছেন, তিনি বললেন পুলিশ বাহিনীর সামনে একাধিক বিশ্বরেকর্ডের রেকর্ডের হাতছানি আছে। প্রথমত দ্রুততম সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির রেকর্ড, দ্বিতীয়ত মাঠে না গিয়ে একই স্থানে বসে থেকে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির রেকর্ড, তৃতীয়ত একটি টেবিলে বসে থেকে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির রেকর্ড। আমরা এমন কিছু রেকর্ড অর্জন করতে পারবো, যা পৃথিবীর কোন পুলিশ বাহিনী করতে পারেনি। এটা বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয় হবে।
লেখা খতিয়ে দেখার জন্য একজন ফেসবুক এক্সপার্ট এবং খতিয়ে দেখার পর ক্লুগুলো লেখার জন্য একজন টাইপরাইরাট প্রস্তুত। গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধানের নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে লেখা খতিয়ে দেখা শুরু হলো।
ফেসবুক এক্সপার্টঃ
স্যার শুরুতেই একটা ক্লু পাওয়া গেলো। নিহত লেখকের নাম দেখে বুঝা যাচ্ছে সে একটি মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার নামের আগে মুহম্মদ লাগানো নেই।
আইজিপিঃ
কী নাম লেখা আছে?
এক্সপার্টঃ
নাজিমুদ্দিন সামাদ।
আইজিপিঃ
হোয়াট ডু য়্যু মীন বাই নাজিমুদ্দিন সামাদ? ইজ ইট নাজিম উদদীন সামাদ?
এক্সপার্টঃ
না স্যার, এই যে প্রজেকশনে দেখুন।
ডিএমপি কমিশনারঃ
যা ভেবেছি তাই। এটাতো স্যার পুরাই একটা অনুভূতি কেইস। ভেরি স্যাড!
আইজিপিঃ
টাইপরাইটার লিখো, যেহেতু তার নামের আগে মুহম্মদ নাই এবং নামের বানান বিকৃত করেছে, সেহেতু খুনের ঘটনাটি সন্ধ্যায় ঘটেছে। এক্সপার্ট, তারপর খতিয়ে দেখো।
ডিআইজিপিঃ
স্যার, আমি একটা কথা বলবো। এই বৈঠকে, আই মীন এই টেবিলে বসে থাকাদের মাঝে অন্তত দুই জনের নামের আগে মুহম্মদ নেই। এটা স্যার পুলিশ বাহিনীর জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। আজ সাধারণ মানুষ যে পুলিশকে দুই চোখে দেখতে পারে না, তা এসব পাপিষ্ঠদের পাপের ফসল। মুসলমান হয়েছে, অথচ নামের আগে মুহম্মদ নেই। আমারতো সন্দেহ হয় এদেরকে মুসলমানি করানো হয়েছে কিনা।
এক্সপার্টঃ
মুহম্মদ নাজিম উদদীন সামাদের একটি কভার ফটোতে মানবজাতির উদ্ভব বিষয়ে বিজ্ঞানের সাথে ধর্মীয় মতবাদের তুলনা করে দেখানো হয়েছে ধর্মীয় মতবাদ ভুয়া।
আইজিপিঃ
ওহ মাই আল্লাহ! সত্যি সে এটা করেছে! আনবিলিভেবল!! ৯৫ ভাগ মুসলমানের দেশে বসবাস করে কভার ফটোতে মানুষ এসব কিভাবে শো করে! এটা পরিষ্কার কুফরী কাজ। টাইপরাইটার, তাহলে এর দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে যখন এই কাফিরকে খুন করা হয়, তখন সে রাস্তায় হাঁটছিলো। তারপর…
এক্সপার্টঃ
আরেকটি কভার ফটোতে সে নাস্তিক অভিজিৎ রায় এর ছবি ব্যবহার করেছে।
যুগ্ম কমিশনার ডিবিঃ
স্যার, একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে আমার অবজারর্ভেশন বলে এই খুনের পরিকল্পনা নিহত ব্লগার নিজেই করেছে। আপনি দেখুন স্যার, একজন নাস্তিকের ছবি কভার ফটোতে ঝুলানোর মানে হচ্ছে মুহম্মদ নাজিম উদদীন সামাদ নিজেকে নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। আমরা যদি এটাকে অনুবাদ করি, তাহলে যেটা পাই সেটা হলো, “আমি নাস্তিক, এসো আমাকে খুন করো।“
আইজিপিঃ
দারুণ বলেছো তুমি। টাইপরাইটার, স্পষ্ট করে লিখো খুনের পরিকল্পনাকারী নিহত নাস্তিক নিজেই।
এক্সপার্টঃ
এই নাস্তিকের ওয়ালে একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে সে উদাম গায়ে মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। বুকে আর পেটের উপর লেখা রাজাকার নিপাত যাক। এই যে স্যার, প্রজেকশনে বড় করে দেখুন।
ডিসি, ওয়ারী জোনঃ
নাউজুবিল্লাহ! স্যার, উদাম গায়ে জাতীয় পতাকা মাথায় বাঁধা জারাজার গুনাহ। তাছাড়া পতাকা ব্যবহারের কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী আছে। এটা স্যার কখনোই মাথায় বাঁধা যাবে না। এই নাস্তিক যা করেছে তা রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। সে রাষ্ট্রের নিশানার অপমান করেছে।
আইজিপিঃ
গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। নোট ইট। এক্ষেত্রে লিখতে হবে, নিহত নাস্তিক একই সাথে পুলিশকে আহবান করেছে তাকে গ্রেফতার করতে এবং পিটিয়ে পাছার ছাল তুলে ফেলতে। ভাগ্য ভালো সে মরে গেছে। জীবিত থাকলে এখন পুলিশ তার এই আহবানে সাড়া দিতো। স্টুপিড কোথাকার।
এক্সপার্টঃ
খতিয়ে দেখার এই অবস্থায় এসে দেখা যাচ্ছে এই নাস্তিক মরার পর তার ফেসবুক ওয়ালজুড়ে শত শত নাস্তিকদের পোস্ট। সবাই বিচার চাইছে। অনেকে কান্নাকাটি করছে।
আইজিপিঃ
এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এক নাস্তিকের জন্য অপর নাস্তিকের টান থাকবে। যেমন পুলিশের জন্য পুলিশের টান আছে। তো, এই টান বিশ্লেষণ করলে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে নাস্তিকটি আগে থেকে জানতো তাকে খুন করা হবে। কারণ সে নিজেই পরিকল্পনা করেছিলো। আর যেহেতু তার মৃত্যুর পর একাধিক নাস্তিক কান্নাকাটি করছে, সেহেতু হত্যাকান্ডে একাধিক খুনী অংশ নিয়েছে। এটা মোটেও একজন খুনীর কাজ নয়।
এক্সপার্টঃ
মৃত্যুর ২৪ ঘন্টা আগে দেয়া একটা পোস্টে দেখা যাচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমালোচনা করেছে এবং সরকারকে জনরোষের হুমকী দেখিয়েছে। বলেছে সরকার নাকি রেহাই পাবে না।
আইজিপিঃ
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমালোচনা! মানে নাস্তিকের বাচ্চা পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দিয়েছে। ব্লাডি নাস্তিক! আর সরকারকে হুমকী? মানে রাষ্ট্রকে হুমকী! মাথায় পতাকা বেঁধেই ক্ষান্ত হয়নি, আবার রাষ্ট্রকেও হুমকী দেয়। এখন আমরা যদি এই দুইটা বিষয়ে আলোকপাত করি, তাহলে দেখতে পাই যে, চাপাতির আঘাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। এবং সেটা একজনের চাপাতির আঘাতে নয়। একাধিক ব্যক্তির চাপাতির আঘাতে।
এক্সপার্টঃ
তার ওয়ালে অন্য একজনের পোস্ট করা একটা স্ক্রীণশটে দেখা যাচ্ছে, জানুয়ারি মাসে তার দেয়া এক পোস্টে বলেছে যারা শতভাগ ধর্ম মানতে চায়, তারা জঙ্গী। আর এই টেবিলে যারা আছি, মানে আমাদের মত যারা আংশিক ধর্ম মানি, তারা মডারেট। সে আরো বলেছে, আমরা, মানে মডারেটরা আছি বলেই ধর্ম এখনো বিশ্বমানবতার প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়নি।
আইজিপিঃ
যাক বাবা, সে পুলিশকে জঙ্গী বলেনি, মডারেট বলছে। এবং বাংলাদেশ পুলিশের কারণে ধর্ম এখনো বিশ্বমানবতার প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। কী দারুণ কমপ্লিমেন্ট! ভেরি ওয়েল সেইড। তো, এবার বোধহয় আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস উদঘাটন করতে পেরেছি। এই নাস্তিককে মারার সময় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও হয়েছে। অর্থাৎ চাপাতি দিয়ে কোপানোর পর তাকে গুলিও করা হয়েছে। এখানে ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট হলো, এর আগে কোন নাস্তিককে হত্যার সময় গুলি করা হয়নি। এটা কিন্তু ঘটনার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্ট।
এক্সপার্টঃ
স্যার, খতিয়ে দেখতে দেখতে এবারতো ভয়ংকর একটা জিনিস পেলাম। মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষার বিরোধিতা করেছে এই বদমাশ। সে বলেছে এর মাধ্যমে নাকি জঙ্গী উৎপাদন হবে।
আইজিপিঃ
উফ! আমি আর নিতে পারছি না। এসব কিছু আমার সহ্য ক্ষমতার বাইরে। এটা বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই না। টাইপরাইটার লিখো, যেহেতু নাস্তিকটা মসজিদ নিয়ে আকথা কুকথা লিখেছে, সেহেতু বুঝাই যাচ্ছে খুন করার সময় খুনীরা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে ঘটনাস্থল মুখরিত করে রেখেছিলো। এই লাইন লেখার পর সুবহানাল্লাহ লিখে বোল্ড আর ইটালিক করে দিও।
এক্সপার্টঃ
স্যারগো, এবার যা দেখলাম, তা বলার মতো সাহস আমার নাই। হারামজাদা তনু হত্যা নিয়ে খুব সেনসেটিভ মন্তব্য করেছে। এবং সারা দেশের মানুষকে কুমিল্লা গিয়ে ঝাঁকুনি দিতে বলেছে। স্যার, তনু হত্যা যেহেতু সেনানিবাসে হয়েছে, সেহেতু সে আসলে সেনানিবাসে ঝাঁকুনি দিতে বলেছে। কতটা সেনসেটিভ ইস্যু, আপনি খেয়াল করেছেন?
এসআই মতিনঃ
শেষপর্যন্ত আমাদের গর্বের সেনাবাহিনীকে ঝাঁকুনি দিতে বলে নাস্তিক **** পুত এই দেশের জনগণের সেনানুনুভূতিতে আঘাত করেছে। কী নোংরা একটা নাস্তিক! থু!!
আইজিপিঃ
খুবই হতাশাজনক বিষয়। এটা সে কিভাবে করলো! কিভাবে সে সেনাবাহিনী নিয়ে এরকম আচরণ করতে পারলো? এটাতো দেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত। খুব করুণা হচ্ছে এই অপদার্থ রাস্কেল নাস্তিকটার জন্য। যাইহোক, তার এসব স্পর্ধা ধারা প্রমাণিত হয়, খুন হওয়ার পর তার লাশ রাস্তায় পড়েছিলো, মিরপুর স্টেডিয়ামে কিংবা চন্দ্রিমা উদ্যানে নয়। অর্থাৎ এটা নিয়ে কোন বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।
ওসি, সূত্রাপুর থানাঃ
কিন্তু এক্সপার্ট, তুমি যেভাবে চুলচেরা খতিয়ে দেখছো, তাতেতো আমাদের বিশ্বরেকর্ডের বিষয়টা হুমকীর মুখে চলে যাচ্ছে। যতদ্রুত খতিয়ে দেখা শেষ করবে, ততদ্রুত তদন্ত শেষ হবে, তারচে অধিক দ্রুত আমাদের বিশ্বরেকর্ড হয়ে যাবে। শুনো, এরকম চান্স বারবার আসে না। তুমি একটু দ্রুত হাত চালাও।
এক্সপার্টঃ
চিন্তা করবেন না ওসি সাহেব। আমি খতিয়ে দেখার একেবারে শেষ পর্যায়ে। শেষ পর্যায়ে এসে একটি হৃদয় বিদারক বিষয় উল্লেখ করবো। আমি জানি এটা বলার পর এখানে অত্যন্ত আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমি দুঃখিত, অত্যন্ত দুঃখিত। কিছু করার নাই। এই নাস্তিকের প্রোফাইল ফটোতে দেখা যাচ্ছে তার গায়ে মুজিব কোট। আরো দুঃখের বিষয় হচ্ছে ঘৃনিত এই নাস্তিক বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ সিলেট শাখার তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক। এই পর্যায়ে আমি আর চোখের জল ধরে রাখতে পারছি না। আমায় আপনারা ক্ষমা করুন। জীবনে এই প্রথম টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে কান্না করছি। আমি লজ্জিত।
আইজিপিঃ
এখানে লজ্জার কিছু নাই এক্সপার্ট। তুমি যা বললে, তা শুনে এখানে উপস্থিত সবারই কমবেশি কান্না পাচ্ছে। কিন্তু আমার পাচ্ছে না। আমি আসলে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছি। বিশ্বাস করতে পারছি না এই ছেলে আওয়ামীলীগের কর্মী। কী বলবো বুঝতে পারছি না। আমার আর কীইবা বলার আছে। আওয়ামীলীগে এইভাবে নাস্তিক ঢুকে যাচ্ছে, অথচ ঠেকানোর কোন উপায় নেই। একটি আওয়ামীলীগ ধ্বংস করার জন্য একফোটা নাস্তিকই যথেষ্ট। সেই জায়গায় পুরো একপিস নাস্তিক! আওয়ামীলীগকে বুঝি আর টেকানো গেলো না। জনগণের আশা আকাংখার প্রতীক, মাটি ও মানুষের প্রাণের দল, মুসলিম জাহানের অংহকার, মদীনা সনদের পতাকাবাহী আওয়ামীলীগ এভাবে হারিয়ে যাবে!
ডিআইজিপিঃ
স্যার, তদন্ত প্রতিবেদনে এটা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে যে, দলে নাস্তিকের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতাদের আরো কঠোর ও বিচক্ষণ হতে হবে। নইলে আওয়ামীলীগের গৌরব ধুলিস্মাৎ হয়ে যাবে। ডজন ডজন নাস্তিক হত্যা করেও তা ফিরে পাওয়া যাবে না।
আইজিপিঃ
যাইহোক তদন্তের বিষয়ে আসি। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। এটা আনপ্রেডিক্টেবল ছিলো। তদন্তের বিষয়টাকে যত সহজ ও সরল ভেবেছি, ততটাই দুর্বোধ্য হয়ে গেছে। গন্ডমূর্খটা যেসব লিখেছে, তা পড়ার পর মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। আপনাদেরকে কিভাবে বুঝাই, মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে এই পোশাক খুলে চাপাতি হাতে দ্বীনের পথে বেরিয়ে যাই। থাক, তদন্তে ফিরে যাই। এখানে নিহত নাস্তিকের গায়ে মুজিব কোট থাকার মানে হচ্ছে চাপাতি দিয়ে কোপানোর পর আবার গুলি করে মারার বিষয়টি দুঃখজনক। আর আওয়ামীলীগের সহযোগী সংগঠনের সংগঠক হওয়ার মানে হচ্ছে, তার এসব লেখালেখি করা ঠিক হয়নি। তো, আমরাতো তদন্ত প্রতিবেদনের সবকিছু বের করলাম, এবার দরকার উপসংহারের জন্য দুইটা লাইন। এটা হতে পারে “ব্লগার খুন একটি অপরাধ। আর মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখালেখি করা এক্সট্রিমলি গর্হিত অপরাধ।“
ডিএমপি কমিশনারঃ
তারপরও আমরা যদি কয়েকজন জঙ্গীর সাথে কথা বলে তাদের বক্তব্য এই প্রতিবেদনে এড করি, তাহলে ভালো হতো না?
আইজিপিঃ
স্যরি কমিশনার, আপনার আইডিয়াটা রাখতে পারলাম না। জঙ্গীদের বক্তব্য নিতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। বিশ্বরেকর্ড হবে না। তদন্ত এখানেই শেষ। এবার ঘড়ি দেখে বলুন, তদন্ত শেষ করতে ঠিক কত মিনিট সময় লেগেছে। তারপর গিনেস বুককে ফোন লাগান।
লেখা খতিয়ে দেখা শেষ, মদীনা সনদের বাংলাদেশ।


অবিশ্বাসের সূর্য্য মাথার ওপর উঠে – ১

সেভেন এইটের সময়, আস্তে আস্তে লাটিম মারবেল ছেড়ে টেনিস বলের দিকে দখল নিচ্ছিলাম। আমরা আবার টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলতাম। প্রতিদিন ভোরে বিছানায় থেকে সাদা কাপড়ে মা’কে দেখতাম পাটিপাতার বিছানায়। আঙ্গুলের করে সৃষ্টিকর্তার পুঁথিপাঠ করেন। ওই সময় মা’কে নিস্ক্রিয় এক অকার্যকর প্রাণীর মতো লাগতো। আমার অসহায় মা তখন শক্তি অর্জনের জন্য সাধনা করতেন। মা’কে খুব পরপর মনে হতো। বাবা আর মা একসাথে শক্তি অর্জনের সাধনা করতেন না। মা আমার রুমে এসে এ কাজটি করতেন। শুয়ে শুয়ে মা’র দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর এক ভয়ংকর স্বার্থপর রমনীকে দেখতাম।
সন্ধ্যা হলে ভাইবোনগুলো দলবেঁধে পুকুর ঘাটে পা ধু’তে যেতাম। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো। কারণ তারপরই সবাই গোল হয়ে বসে জিকির করতে হতো। “আল্লায় যদি দিতো পাখি বানায়া//উড়ে উড়ে যাইতাম আমি মদীনায়//মদিনাতে যাইয়ারে সেলাম জানাইতাম…..।” এসব বুঝতাম। কিন্তু “হাঁসকি রাব্বি সল্লাল্লাহ”, “মাফি কলমি গাইরুল্লাহ”- এসবের অর্থ বুঝতাম না। তবুও মা’ শিখিয়ে দিতেন বলে বকে যেতাম। মা মানেতো “মা”। ঈশ্বরের কাছাকাছি। আর এ কাছাকাছি থাকার উদ্দেশ্য ভয়াবহ খারাপ। মা’কে ঈশ্বরের কাছাকাছি রেখে ঈশ্বর একটা মই বানিয়ে নিলেন আসলে। বাংলা ভাষায় জিকির করতে কবিতার মতো ছন্দ পেতাম। এক ধরনের মেলোডি খুঁজে পেতাম। তাই ভালোও লাগতো। কিন্তু আরবী নাকি ফার্সি ভাষায় যেটা পড়তে বলতেন সেটা ভালো লাগতো না। চিরতার মতো তিতা লাগতো। মাঝে মাঝে আইষ্টার গন্ধ পেতাম।
ভাইবোনদের কথা বলতে পারবো না। আমি এসবে ফাঁকি দিতে চাইতাম। অল্প কিছুক্ষণ বকাবকি করে প্রিয় “পরিবেশ পরিচিতি সমাজ” বইটা নিয়ে বসে পড়তাম। মা বলতেন “বাংলা পড়লে চলবে? আরবী না পড়লে আগুনে জ্বালাবে, রাসুলের জিকির না করলে তিনি সুপারিশ করবেন না, ইত্যাদি ইত্যাদি।” আমি তখন বড়জোর পরের দিনের পাশের গ্রামের সাথে ক্রিকেট ম্যাচ নিয়েই বেশি চিন্তা করতাম। মা’র কথায় কান দেয়ার মতো টাইম ছিলো না।
গ্রামে হিন্দু ধর্মালম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমাদের বাড়ি আর তার সামনের বাড়িতে বেশ ঘনবসতি। এ দু’বাড়ির পুরুষেরা ছিলো উগ্র এবং কালা বধির মুসলমান। হিন্দু পাড়ার মানুষগুলো আমাদের বাড়ি ক্রস করে বাজারে যেতো। যাওয়ার পথে তাদেরকে নানা ধরনের উস্কানীমূলক কথা বলতো। হিন্দুদেরকে ব্যঙ্গ করে “ডান্ডি” “ড্যাঁডা” ইত্যাদি শব্দে ডাকতো। “ড্যাঁডারা-হ্যাঁডারা”-এ অপমানজনক কথাটি হিন্দুদেরকে দেখলেই মুসলমানরা চিৎকার করে উচ্চারণ করতো। এমনকি বাপ পোলা একসাথেও বলতে দেখেছি। হয়তো এক ভাই আরেক ভাইকে “শালারপুত” বলে গালি দিলেই সমস্যা হতো। কিন্তু বাপ পোলা মিলে অন্য ধর্মের মানুষকে এতো বিশ্রি গালি দেয়াও জায়েজ ছিলো।
পাশের পাড়া হিন্দু অধ্যুষিত বলে মুসলমানদের অঞ্চলে গালগল্পের বেশিরভাগ জুড়েই ছিলো হিন্দুদের বেহেশতে না যাওয়া নিয়ে। মুসলমানদের মধ্যে যারা কোন হিন্দুকে পছন্দ করতো, সুযোগ পেলেই তাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার সুপারিশ করতো। না পারলে যেনো অন্তত মরার সময় কালেমা পড়ে মরে। … এ বিষয়টি আমার মাথায় ইট ভাটা বসিয়েছিলো। কেন হিন্দুরা বেহেশতে যাবে না? তাদেরকে কে সৃষ্টি করেছে? তাদের হায়াত মওত রিজিক এসবের ব্যবস্থাপনায় কে আছেন? হিন্দুরা তাদের মূল উপাস্যকে বলেন “ভগবান”। ভগবানের অর্থ খুঁজতে গিয়ে পেলাম “যৌনাঙ্গে সমৃদ্ধ”! মানে তাদের উপাসকের অনেকগুলো যৌনাঙ্গ আছে! মুসলমানরা বলেন “আল্লাহ”। এটার আবার ৯৯টা গুনবাচক মানে আছে। তার মানে হিন্দুদেরকে অধিক যৌনাঙ্গ সমৃদ্ধ একজন আর মুসলমানকে মাত্র ৯৯ গুনের অধিকারী একজন নিয়ন্ত্রন করেন। এভাবে করে অন্যান্য ধর্মেরও একজন করে আছেন।
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম আর ইহুদী ধর্ম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম সম্পর্কে জানতাম না। ভাবতাম মোট পাঁচজন মহাপরাক্রমশালী মানুষ আছেন যারা এ পৃথিবী দখল করেছেন। বাংলাদেশ দখল করেছেন আল্লাহ। তাই এখানে মুসলমান থাকেন। তাহলে অন্য ধর্মালম্বীদেরকে তাদের উপাসক কিভাবে নিয়ন্ত্রন করতেন? মসজিদের ইমাম আর পুরোহিতের মাঝে যে বাজে সম্পর্ক! নিশ্চয় উপাসকদের মাঝেও এমন সম্পর্ক। হিসেব মিলতো না।
একবার খরায় হিন্দুদের নামযজ্ঞের মঞ্চে ব্যাপক আরাধনার ব্যবস্থা করা হয় বৃষ্টি নামানোর জন্য। পরদিনই বৃষ্টি হলো। গ্রামের মুসলমানরা তখন ঠিকমতো বাজারে উঠতো না। তাদেরকে লজ্জা পেয়ে বসলো। তবে ধর্মান্তরিত হওয়ার কোন ঘটনা ঘটেনি। পরের বছর হিন্দুদের পূঁজার পাশাপাশি মুসলমানদের মুনাজাতও অনুষ্ঠিত হয়। এমন আরাধনার ১ মাসের মধ্যেও বৃষ্টি না হওয়ায় হিন্দুরা মুসলমানদেরকে দোষারোপ করা শুরু করে। … পুরো বিশ্ব নিয়ে ভাবতে পারতাম না। ভাবতাম আমাদের বাড়িতে বৃষ্টি হলেও বড়বোনের জামাইর বাড়িতে বৃষ্টি হয়নি। বিটিভির খবরে দেখতাম কতগুলো জেলায় বৃষ্টি হবে আর কতগুলো জেলায় আকাশ আংশিক মেঘলা থাকবে। বৃষ্টিপাতের জন্য স্থানগুলো কিভাবে নির্বাচিত করা হতো? কখন এ কাজ করতো? কই, কাউকেতো ফিতা দিয়ে আমীনশীপের কাজ করতে দেখিনা! আর বৃষ্টিপাত বা ভূমিকম্প সহ অন্যান্য কিছু কিভাবে ঘটতো? এটা কি ওই পাঁচ মহাপরাক্রমশালীর মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে ঘটতো? আবার ভাবতাম- না, তাহলেতো পৃথিবী পুরো ধ্বংস হয়ে যেতো। হিসাব মেলাতে পারতাম না।
সূর্যটা যেভাবে উদিত হয় :
আমার চোখে খড়ের টুকরো পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও কুঁটোখানা বের করতে পারেনি। বড়বোন চোখে পানি দেয়ার জন্য নিয়ে যাবার সময় আমার কুরআনের হাফেজ ফুফা “পাকাশাফনা আন্কাগিতাকা ফাবাশ্বারুকাল ইয়াহুমা হাদীদুন” পড়ে চোখের পাতা উল্টিয়ে ফুঁ দিতে থাকলেন। তার মুখের গন্ধ নাকে এসে লাগতে বমি করে দিই। তারপর বমির জন্য কোন দোয়া পড়লেন কি না আর জানি না।
ঘুমের মাঝে খালি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখতাম। মা ঘুমানোর সময় “আল্লাহুমা বিহিসমেকা আহমুতোয়াহা” পড়ার জন্য শিখিয়ে দিলেন। এতোদিন দেখতাম কেউ একজন আমার কল্লা কেটে নেয়ার জন্য দৌড়াচ্ছে। দোয়া পড়ার রাতে দেখি কল্লা কেটেই নিয়ে গেছে। তখন বুঝিনি- বাড়ির পাশে কালভার্ট বানানোর সময় কল্লা লাগবে বলে একটা গুজব উঠেছিলো। সে ভয় থেকেই স্বপ্নের উৎপত্তি। যাহোক, পরে আয়াতুল কুরসী সুরাও এমন স্বপ্ন থেকে আমাকে বাঁচায়নি। উল্টো স্বপ্ন নিয়ে পানিপড়া আর তাবিজ আনার জন্য মায়ের উৎকন্ঠা আমাকে আরো ভীত বানিয়েছিলো।
অমৃত লাল ঘোষ নামে আমার একজন প্রিয় স্যার ছিলেন। তার সুনাম করতে গেলেই মা বলতেন- ভালো হলে কি হবে? উনিতো বেহেশতে যাবেন না! – এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি বেশিরভাগ সময় আল্লাহকে খুঁজতাম। কিন্তু পেতাম না।
কোরআন শরীফের শক্তি নিয়ে কথা উঠলেই শুনতাম- অমুক বাড়িতে আগুন লাগার পর সবাই কোরআন শরীফ খুঁজতেছে। আগুন নিভে গেলে কোরআন শরীফকে নারিকেল গাছের আগায় খুঁজে পায়। কোথাওবা পেয়ারা গাছের ডালে। একবার আমাদের পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে লোহার রেলের উপর ভস্মীভূত কোরআন দেখতে পাই।
জন্মের সময় নাকি হায়াত মওত লেখা হয়ে গেছে। তবুও আবার চিকিৎসার জন্য কোরআনের আয়াত বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে। এটা খুবই বিস্ময়কর। এরকম ভাবনা পেয়েছিলো ক্লাস নাইনে উঠার পর।
একবার বলে আমাকে বিবেক বুদ্ধি সব দেয়া আছে। আবার বলে আল্লাহর হুকুম ছাড়া একটা ধূলির কণাও নড়ে না! আল্লাহর মা বাপ তুলে গালি দিলে সেটার দায়ভার আল্লাহ নেয় না কেন?
কোরআনের আয়াত দিয়ে নাকি আরোগ্যলাভ করা সম্ভব। কিন্তু পাঠের পর আরোগ্যলাভ না হলে তখন বলে- আমল না থাকলে এসবে হবে না। হায় হায়! তাহলে অসুস্থ থেকে নিজেকে শুধরানোর উপায় কি?
কোন এক ব্যক্তি নাকি কেয়ামতের দিন বেহেশতের টিকিট পেলেন। কিন্তু সে ইহলোকে খুবই বদ ছিলো। পরে সে আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলে আল্লাহ নাকি বলেন- তুমি একদিন শীতের রাতে একটি বিড়ালকে কম্বলের নীচে আশ্রয় দিয়েছিলে, তাই তোমার জন্য এ পুরস্কার! – ভাবলাম, কেয়ামতই এখনো হয়নি, লোকটা বেহেশতের চাবি পেলো কিভাবে?
এক বর্ষায় শুনলাম আমাদের ইউনিয়নের ৩ ইউনিয়ন পরের ইউনিয়নের এক গ্রামে মা’কে লাত্থি দেয়ার কারণে সাথে সাথে ছেলে পঙ্গু হয়ে গেছে! মা’কে লাত্থি দেয়ার বিষয়টিতে খুব ঘেন্না লেগেছে। কিন্তু মা’র অভিশাপে সাথে সাথে পঙ্গু হবার বিষয়টি মেনে নিতে পারিনি। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে বৃষ্টি ধরলেও থামিনি। ভিজতে ভিজতে ওই গ্রামে পৌঁছে গেলাম। মসজিদের ইমামের কাছে গিয়ে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন উনাদের ইউনিয়নে নয়, এটা আসলে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার (পাশের উপজেলা) এক গ্রামে ঘটেছে। কিন্তু উনি দেখেননি, শুনেছেন। বললাম চলেন আমার সাথে। ভদ্রলোক কিছুতেই রাজি নয়।
আমি আসলে অন্তত একটি সত্য নিদর্শনের অপেক্ষায় ছিলাম। এভাবে বেশ কিছুদিন অলৌকিক গজব কিংবা রহমতের খবর পেলেই ছুটে যেতাম। কিন্তু রেফারেন্সের পর রেফারেন্স পাড়ি দিয়েও গজব উল্লা আর রহমত মিয়ার একটা কেশের সন্ধানও পাই নাই।
(চলবে)