Tuesday, October 9, 2018

আলফা α- বিটা β- গামা- γ

লিখেছেন: গাজী ইয়াসিনুল ইসলাম
বিষয়বস্তু- মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
আলফা- যুগে যুগে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারনার পরিবর্তন ও বিভিন্ন বিজ্ঞানীর আবদান।
মহাবিশ্বের উৎপত্তি
বিটা- মহাবিশ্বের ক্রমবিকাশ- নক্ষত্রের জন্ম মৃত্যু পরিনতি এবং গালাক্সীর উৎপত্তি ও গঠন
গামা- পৃথিবীর বিবর্তন, প্রাণের উৎপত্তি ও প্রাণের ইতিহাস

(প্রথম অংশ)
আমরা কোথা থেকে এলাম? এই প্রশ্ন ভাবিয়েছে সব যুগের মানুষকে। সেই আদি বন্য মানুষ থেকে বর্তমান সভ্য মানুষ সবাই চেষ্টা করেছে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে। অনেকেই কল্পনা করেছেন যুক্তি তর্ক ছাড়া, জন্ম দিয়েছেন বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর। কিছু মানুষ তার চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সঠিক ভাবে ভাবতে পেরেছে। এদের বিজ্ঞান মানসিকতার জন্য আজ আমরা বুঝতে শিখেছি সৃষ্টির শুরুতে কী ঘটেছিল, কীভাবে মহাবিশ্ব তার বর্তমান অবস্থায় আসল, প্রাণের ইতিহাস এবং বুদ্ধিমান প্রাণীরা কখন প্রশ্ন করতে শিখল মহাবিশ্ব সম্পর্কে। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের পর থেকে মানুষ নিজেকে রক্ষার জন্যই সর্বদা ব্যস্ত থাকত। এরপর তারা নিজেদের জীবনকে সহজ করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভব করতে থাকে। তারা ভাবতে শুরু করে তাদের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে। দিনের আকাশে সূর্য, রাতের আকাশে চাঁদ ও নক্ষত্ররাজি নিয়ে গঠিত ছিল তাদের মহাবিশ্ব।
সুমেরীয় সভ্যতা ও চন্দ্র পঞ্জিকা :
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ ভূমির (মেসোপটেমিয়া) বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠেছে সভ্যতা। যেমন-সুমেরীয়, ব্যাবিলোনীয়, এসেরিয়ান সভ্যতা। এদের মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা সবচেয়ে পুরাতন। সুমেরিয়ানরা প্রথম চন্দ্র পঞ্জিকা (Lunar Calendar) চালু করে ৩২০০ BCE এর কাছাকাছি সময়ে। তারা দিনের হিসাব রাখত আকাশে চাঁদের আনাগোনার উপর ভিত্তি করে। চাঁদের বারটি চক্র (বারমাস) পূর্ণ হলে ঋতুর পুনারাবৃত্তি হয় (বছর) ।এ হিসাব ফসল লাগানো, আবহাওয়ার পরিবর্তন, নদী ও জলাশয়ে পানির পরিবর্তন বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাদের অবশ্য কোন ধারণাটি ছিল না যে বছর সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর পূর্ণ ঘূর্ণনের কারণে হয়। এক চন্দ্র মাসে উনত্রিশ এবং অর্ধ দিন (২৯.৫) থাকে। ফলে চন্দ্র বছর হয় (২৯.৫x১২) ৩৫৪ দিনে। যা সৌর বছর থেকে ১১ দিন কম। শত শত বছর ধরে তারা বুঝতে শেখে চন্দ্র মাস হিসাব করলে বছর বা ঋতুর আবর্তণ পূর্ণ হয় না। তারা এ সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েক বছর পরপর একটি অতিরিক্ত মাস যোগ করে বছর পূর্ণ করত। চাঁদের বিভিন্ন দশার সাথে দিন ও মাসের হিসাব রাখা অতি পুরাতন একটি পদ্ধতি।
মিশরীয় সভ্যতাও সৌর পঞ্জিকা :
চন্দ্র বছর ঋতু আবর্তনের সাথে সম্পূর্ণ মিলে না, তা মিশরীয়রাও পর্যবেক্ষণ করে। ২০০০ BCE এর কাছাকাছি সময়ে তারা সৌর পঞ্জিকা চালু করে। তারা খেয়াল করে যে একটি উজ্জ্বল তারা (যাকে আমরা সিরিস (Sirius) বলি) প্রতি বছর একদিন সকালে সূর্যের সাথে সরাসরি মিল রেখে ওঠে। এই দিনকে তারা নতুন বছরের প্রথম দিন ধরে হিসাব শুরু করে। এই নতুন হিসাব তাদের আরো সূক্ষতার সাথে ফসল বোনা ও নীলনদের বন্যার ভবিষৎবানীতে সাহায্য করত। তাদের গণিতও জ্যামিতিতে অসাধারণ দক্ষতা ছিল।
ব্যাবিলোনিয়ান সভ্যতা ও ভবঘুরে নক্ষত্র :
মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনে হাজার বছরের ব্যবধানে দুটি সভ্যতা গড়ে উঠে।এদের বলা হয় আদি (২০০০ BCE-১৬০০ BCE) এবং নব্য (c.৭৫০- c.৫৫০ BCE) ব্যাবিলোনিয়ান সভ্যতা। পৃথিবীর প্রথম লিখিত আইন ‘কোড অফ হামুরাবি (Code of Hammurabi) (c.১৭৯০ BCE)’ আদি ব্যাবিলোনিয়ান সভ্যতার নির্দশন। ঈশতার গেইট (Ishtar Gate), ঝুলন্ত উদ্দ্যান (Hanging Garden) নব্য ব্যাবিলোলিয়ান সভ্যতার নির্দশন।
আদি ব্যাবিলোনিয়ানদের গাণিতিক পদ্ধতি সম্পর্কে ভাল ধারণা ছিল। তারা দিনকে বার এককের দুইটি সেটে হিসাব করত [c.২০০০ –c.১৮০০ BCE মধ্যবর্তী সময়ে]। আপনি ভাবতে পারেন দিনকে হয়তো দশ এককে ভাগ করে হিসাব করা সহজ হত। কিন্তু কেন আমরা বার গুনিতকএককে দিনকে ভাগ করি? এই ভাগ আমরা অর্জন করেছি আদি ব্যাবিলোনিয়ানদের নিকট থেকে। তারা চন্দ্রের বার চক্রের সাথে বছর পরিবর্তনের মিল রেখেই এই হিসাব চালু করেছিল বলে ধারণা করা হয় (Duodecimal Time Reckoning) । যদিও সভ্যতার পর সভ্যতা পার হয়ে গেছে গেছে কিন্তু মূল ধারণা পরিবর্তন হয়নি।
নব্য ব্যাবিলোনিয়ানরা রাতের আকাশকে খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। তারা দেখেছে অন্যান্য তারা থেকে পাঁচটি তারা অনেক বেশী ঘুরাঘুরি করে আকাশ জুড়ে [৭৫০ BCE এর কাছাকাছি সময়ে] । গ্রীকরা এই জ্ঞান ব্যাবিলোনিয়ানদের নিকট থেকে অর্জন করে। গ্রীকরা এই তারার নাম দেয় Planet বা গ্রহ যার আবিধানিক অর্থ হল ভ্রাম্যমাণ তারা। তখন পাঁচটি গ্রহ সম্পর্কে মানুষের ধারনা ছিল। তবে সে সময়কার মানুষের ধারণা ছিল ন যে গ্রহের নিজস্ব আলো নেই।
এনুমা এলিশ (Enuma Elish):
ব্যাবিলোনিয়ান সৃষ্টি সম্পর্কিত পুরাণ এনুমা এলিশ নামে পরিচিত। এনুমা এলিশের বর্ণনা অনুসারে মহাবিশ্বের আবির্ভাব বিশাল আকৃতিহীন বিশৃঙ্খল জলীয় বিস্তার থেকে। এই আদি পতিত জলভূমি থেকে উন্থিত হয় আপসু (Apsu)- স্বাদু পানির দেবতা এবং তিয়ামাত (Tiamat)- লোনাপানির দেবতা। আপসু ও তিয়ামাত থেকেই অন্য দেবদেবীদের উদ্ভব। এই পুরাণ অনুসারে মারদুক (Marduk) নামক দেবতা পৃথিবী, আকাশ, চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্ররাজি তৈরি করেন।
মিশরীয় পুরাণে সৃষ্টি তত্ত্ব :
মিশরীয় পুরাণ (হেলিওপোলিস ভার্সন) অনুসারে সৃষ্টির আাদিতে ছিলেন নু (Nu)- সীমাহীন শূন্যতা ও অন্ধকার। নু থেকে নিজের প্রজ্ঞা ও সৃষ্টির ইচ্ছা থেকে জেগে উঠল অটম (Atum)। অটম জন্ম দিল শু (Shu) ও টেফনাট (Tefnut) নামের দেবতা। শু এবং টেফনাট মহাবিশ্বে শৃঙ্খলা নিয়ে আসল। এদের সন্তান জেব (Geb) ও নুট (Nut) । প্রথমে জেব ও নুট একতাবদ্ধ ছিল। শু নুটকে জেব থেকে পৃথক করে উপরে তুলে দিল । সৃষ্টি হল পৃথিবী (Geb) ও আকাশ (Nut). এদের সন্তানরা হল বিভিন্ন দেবতা (ওসাইরিস, আইসিস, সেথ) যারা মহাবিশ্ব শাসন করত। অন্যান্য সভ্যতা থেকে মিশরীয়রা মৃত্যু সম্পর্কে একটু বেশীই চিন্তা করত। অমর হবার প্রচেষ্টা এদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। গিজার বড় পিরামিড ত্রয় কালপুরুষের (Orion) কোমরে থাকা তিনটি উজ্জ্বল তারার সাথে মিল রেখেই তৈরি (সে সময়ের অবস্থান অুনযায়ী) । কালপুরুষ রাতের আকাশের একটি পরিচিত নক্ষত্র সজ্জা বা Star Constillation. এটি দেখতে অনেকটা অস্ত্র হাতে যোদ্ধার মত। পিরামিড ত্রয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়টিতে ফারাও কুফুর (Kufu) সমাধি। এই সমাধি কক্ষ থেকে দুটি ছিদ্র বাঁকাভাবে সরাসরি বাইরে উন্মুক্ত। এই ছিদ্র দুটির এলাইনমেন্ট একপাশে কালপুরুষের কোমরের একটি নক্ষত্র ও অন্য পাশে থুবান (Thuban) নক্ষত্রের সাথে সরাসরি যুক্ত (তখনকার আকাশ অনুসারে). ঠিক যেন কুফুর আত্ম ঐ পথে যাত্রা করে যাবে নক্ষত্র লোকে।

ছবি-১ কুফুর সমাধি ও নক্ষত্র সজ্জার মিল।
গ্রীক পুরাণে সৃষ্টিতত্ত্ব :
First there was chaos, the vast
Immeasurable abyss, outrageous
As a sea, dark, wasteful, wild. [Milton]
সৃষ্টির আদিতে ছিল বিশাল আকারহীন অন্ধকার, সীমাহীন হিংস্রতা, বিভৎস্য বন্যতা। এই বিশৃঙ্খল সংজ্ঞাবিহীন আকারহীনতা কে গ্রীকরা বলতে Chaos। ক্যাওস থেকে জন্ম নিল নিক্স (Nyx) এবং এরিবাস (Erebus) নামের দেবদেবী। নিক্স রাত্রি বা অন্ধকার তুল্য দেবী এবং এরিবাস মৃত্যুর তুল্য দেবতা। এই অন্ধকার ও মৃত্যু থেকে জন্ম হল আলো (Ather) ও দিনের (Hemera) । এদের জন্মের সাথে শূন্যতা, তিমিরও বন্যতা ভেদ করে শৃঙ্খলা, আলো ও সৌন্দর্যের আবির্ভাব হল। পূর্ণতা পেতে শুরু করল মহাবিশ্ব। এরপর এল গেইয়া (Gaea) ও ইউরেনাস (Urenus)। গেইয়া হল ধরনী মাতা এবং ইউরেনাস স্বর্গ পিতা (আকাশ ও পৃথিবী)। এদের থেকে ধীরে ধীরে টাইটান দেবতাদের আবির্ভাব হয়েছিল। এদের দ্বন্দ্ব ও সিংহাসন দখলের ইতিহাস অন্য সময়ে বলা যাবে । এখানে লক্ষ্যনীয় যে মিশরীয় ও গ্রীক পুরাণে সৃষ্টির আদি অবস্থার বর্ণনা প্রায় একই। Chaos বা Nu সীমাহীন অন্ধকার ও আকারহীনতার প্রতীক। এনুমা এলিশে এই প্রাথমিক অবস্হা শুধু পানি দ্বারা পূর্ণ। কিন্তু গ্রীকও মিশরীয় মিথে তা নয়। তবে সবাই বলতে চায় সংজ্ঞাবিহীন একটি অবস্থা থেকেই মহাবিশ্বের সূচনা।
গ্রীক সভ্যতা ও বিজ্ঞান :
দিন ও ঋতুর পরিবর্তন, রাতের আকাশে তারা সম্পর্কে প্রাচীনকালের মানুষের বিজ্ঞান ভিত্তিক ধারণা থাকলেও কুসংস্কারের অভাব ছিলনা। মহাবিশ্ব নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক ভাবে ভাবতে শুরু করে গ্রীক দার্শনিকরা। পূর্বে মানুষ পৃথিবীকে গোলাকার থালার মত মনে করত। গ্রীক দার্শনিকেরা ধারণাদেন যে পৃথিবী গোলাকার। অনেকে বলে পিথাগোরাস (৫৩০ BCE এর কাছাকাছি সময়ে) এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেন। পিথাগোরাস এখনো বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর বিখ্যাত থিওরামের জন্য (সমকোনী ত্রিভুজের অতিভুজের বর্গ বাকি দুই বাহুর বর্গের সমান)।
গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস (Democritus, ৪৬০-৩৭০ BCE) তত্ত্ব দেন যে, মহাবিশ্ব অসংখ্য অবিভাজ্য ক্ষুদ্রকণা দ্বারা গঠিত। যার নাম দেন Atom.
মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে সর্ব প্রথম ধারনা দেন প্লেটো (Plato, ৪২৯-৩৪৯ BCE)। প্লেটো এবং তার ছাত্র Eudoxus একটি মডেল দাঁড় করান। তবে মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে প্লেটোর আরেক ছাত্র অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ BCE) যে ধারনা দেন তা বেশী প্রচারনা পায়। এটি মূলত প্লেটোর ধারণার পূর্ণ রূপ।
অ্যারিস্টটলের মহাবিশ্ব :
মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের ধারণা নিম্ন রূপ-
ক) পৃথিবী গোলকার ও স্থির।
খ) পৃথিবী এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে একাধিক অদৃশ্য (Transparent) মহাজগাতিক গোলক (celestial sphere) রয়েছে। গ্রহ নক্ষত্র সবকিছুই এই গোলকে বসানো (attested) আছে।
গ) এই মহাজাগতিক গোলক গুলো স্বর্গীয় বস্তু (গ্রহ নক্ষত্র) নিয়ে ঘূর্ণয়মান।
ঘ) তিনি ৪৪ টি ভিন্ন ভিন্ন গোলকের কথা উল্লেখ করেন।
ঙ) মহাবিশ্ব অসীম নয়।
তার ধারণা ছিল উল্কা ও ধুমকেতু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলেই সৃষ্টি হয়। পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বসানোর অ্যারিস্টটলীয় ধারনা বহু বছর ধরে মানুষকে প্রভাবিত করে। কিন্তু কেন অ্যারিস্টটল পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বসালেন? পৃথিবী থেকে যা কিছু ছুড়ে মারা হয় তা পৃথিবীতে ফিরে আসে। তিনি ধারনা করলেন পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্র যার কারনে সব কিছু কেন্দ্রর দিকেই ফিরে আসে।
এরিস্টারকাসের আধুনিক চিন্তা :
সামোসের অধিবাসী এরিস্টারকাস (Aristarchus of Samos, ৩১০-২৩০ BCE) সৌরজগত সম্পর্কে যে ধারনা দেন তা আধুনিক চিন্তার কাছাকাছি। তার উল্লেখযোগ্য অবদান হল-
ক) তিনি চাঁদের ব্যাস পরিমাপ করেন পৃথিবীর একচতুর্থাংশ (সঠিক অনুপাতের কাছাকাছি)
খ) তিনি চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব হিসাব করেন (যা সঠিক পরিমাপের কাছাকাছি)
গ) তিনি সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হিসাব করেন। যদিও এ হিসাব ভুল ছিল। তবে তার পদ্ধতি সঠিক ছিল। সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির অভাবে ভুল পরিমাপ হয়। চোখের উপর ভরসা করে কী সব হিসাব সঠিক হয়। তার পরিমাপ অনুসারে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব চাঁদের দূরত্বের প্রায় ২০ গুণ (আসলে তা ৩৯০ গুন)।
ঘ) তিনি অংক কষে বুঝতে পারেন যে সূর্য পৃথিবী থেকে আকারে অনেক বড় । তিনি তখন ধারনা দেন যে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে সূর্য অবস্থান করছে পৃথিবী নয়। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। তার এ চিন্তা যৌক্তিক হলেও প্রচার পায়নি এরিস্টটলের পৃথিবী কেন্দ্রিক তত্ত্বের জন্য। তবে সে সময়ে এরিসটারকাসের সূর্যকেন্দ্রিক ধারনা ছিল তার মুক্ত চিন্তার প্রতীক। এই সৌরকেন্দ্রিক ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে সময় লেগেছিল প্রায় এক হাজার বছর।
এর এক শত বছর পর সেলুকাস (Seleucus) নামক দার্শনিক আরো যুক্তি দিয়ে সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রচার করলেও তা জনপ্রিয়তা পায়নি।এরাটোসথেনিস (Eratosthenes, ২৭৬-১৯৬ BCE) সর্বপ্রথম জ্যামিতিক ও গাণিতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে পৃথিবীর পরিধি মাপেন যা সঠিক মাপের কাছাকাছি।

ছবি-২ পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব মাপার জন্য এরিসটারকাস প্রস্তাবিত পদ্ধতি।
টলেমীর মহাবিশ্ব :
ক্লডিয়াস টলেমী (Claudius Ptolemy, ১০০-১৭০ CE) ছিলেন গ্রীকো-মিশরীয় জ্যোতির্বিদ ও গাণিতবিদ। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার নিকট একটি মানমন্দিরে কাজ করতেন। আকাশে তারা ও গ্রহের আনাগোনা পর্যবেক্ষণ করে তিনি মহাবিশ্বের একটি মডেল দাড় করান। যা মূলত এরিস্টটলীয় মডেলের ভিন্ন রূপ। তার প্রধান কাজ যা বছরের পর বছর তার পর্যবেক্ষণের ফসল তা মূলত পরিচিতি পায় আরবী নাম Almagest (the great system) নামে। তার মতাদর্শ নিম্ন রূপ-
ক) তিনি সূর্য নয় পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থাপন করেন। পৃথিবীর চারপাশে বিভিন্ন গোলকে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান। পৃথিবী তার অবস্থানে স্থির।
খ) টলেমীর মতে প্রতিটি গ্রহ দুটি বৃত্তাকার পথে ঘোরে। বড়টিকে নাম দেন Deferent এবং ছোটটিকে নাম দেন Epicycle । Deferent বা বড় বৃত্তাকার পথের কেন্দ্র পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে আলাদা ।
গ) গ্রহগুলো ছোট বৃত্তাকার পথে (Epicycle) ঘুরতে ঘুরতে বড় বৃত্তাকার পথও (Deferent) প্রদক্ষিণ করে।
ঘ) গ্রহগুলোর গতির মূল কেন্দ্রকে বলা হয় Equant, যা পৃথিবীর কেন্দ্র ও Deferent এর কেন্দ্র থেকে আলাদা।
এ জটিল পদ্ধতিতে চিন্তার কারণ হল এই পদ্ধতিতে তখনকার সময়ে দৃশ্যমান গ্রহের গতি ও উজ্জ্বল্য ব্যাখ্যা করা যেত। যদিও তা সম্পূর্ণ সঠিক ছিল না।
টলেমীর এই ধারণা প্রায় এক হাজার বছর টিকে ছিল। টলেমীর পর বহু জ্যোতির্বিদের উল্লেখ পাওয়া যায় যারা সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন কিন্তু কোপার্নিকাসের পূর্বে কারো ধারণাই প্রতিষ্ঠা পায়নি।

ছবি-৩- টলেমীর মডেল
[CE = Common/Current Era, Anno Domini বা AD এর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়।
BCE = Before Current Era, Before Christ বা BC এর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়।
c = Circa, Latin for about or around. সালের পূর্বে ব্যবহার করা হয়]
কোপারনিকাস ও সূর্য :
নিকোলাস কোপারনিকাস (Nicholus Copernicus, ১৪৭৩-১৫৪৩) [এটি তার ল্যাটিনকৃত নাম, আসল নাম নিকোলাই কোপারনিক] বিখ্যাত হয়ে আছেন তার সৌরকেন্দ্রিক(Heliocentric) মহাবিশ্বের ধারনা প্রস্তাবের জন্য। কোপারনিকাসই প্রথম জ্যোতির্বিদ নন যিনি সৌরকেন্দ্রিক ধারণা প্রস্তাব করেন। এরিসটারকাস ১৭০০ বছর পূর্বেই এই ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন। সম্ভাবত কোপারনিকাস তার শিক্ষকের মাধ্যমে এরিসটারকাসের কাজ সম্পর্কে জানতে পারেন। কোপানিকাস ছিলেন একজন ক্যাথলিক যাজক। সৌরকেন্দ্রিক ধারণা বাইবেলের ধারণার পরিপন্থি বলে তিনি এ ধারণা প্রচারে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তবে তার জীবনের শেষ দিকে On the Revolution of Heavenly Sphere প্রকাশের মাধ্যমে সৌরকেন্দ্রিক ধারনা প্রস্তাব করেন। বইটি তার মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে প্রকাশিত হয়।
কোপারনিকাস প্রস্তাব করেন যে
ক) সূর্যই মহাবিশ্বের কেন্দ্র এবং তা স্থির।
খ) সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহ গুলো বৃত্তাকার পথে ঘুরছে।
গ) নক্ষত্রসকল স্থাপন করেন গ্রহগুলোর বাইরে অনেক অনেক দূরের একটি স্তর হিসাবে।
সৌরকেন্দ্রিক ধারণার প্রচারে তার ভূমিকা খুবই কম। বরং কেপলার ও গ্যালেলেও এই ধারনা প্রতিষ্ঠিত করেন। তাছাড়া তার ধারণায় অনেক ভুল ছিল। যেমন-তিনি মনে করতেন সূর্য স্থির এবং গ্রহ গুলো বৃত্তাকার পথে ঘুরছে। দুটো ধারণাই ভুল। আবার সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়। মহাবিশ্বের অসীম, এর কোন কেন্দ্র নেই।
টাইকো ব্রাহি
টাইকো ব্রাহি (Tycho Brahe,১৫৪৬-১৬০১) ছিলেন ড্যানিশ জ্যোতির্বিদ। তিনি খালি চোখে রাতের পর রাত আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছেন । বহু বছরের পর্যবেক্ষণের ফলে তিনি বিশাল ডাটা সংগ্রহে সমর্থ্য হন। ১৫৭২ সালে তিনি আকাশে হঠাৎ নতুন তারার আগমন পর্যবেক্ষণ করেন (এখন আমরা জানি, এটি ছিল সুপারনোভা)।
বহু বছরের পর্যবেক্ষণের পর তিনি নিজেই একটি মডেল দাঁড় করান। যার কেন্দ্রে পৃথিবী। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চন্দ্র ও সূর্য ঘুরছে এবং সূর্যকে কেন্দ্র করে বাকি সব গ্রহ ঘুরছে।

ছবি-ব্রাহির মডেল
কেপলার ও গ্রহ সমূহ :
I measured the havens, now I measure the shadows
Skyward was the mind, the body rests in the earth.
[কোপলারের এপিটাফে এই কথাগুলো লেখাছিল। এ কথাগুলো তার নিজের লেখা]
জোহানেস কেপলার [Johannes Kepler, ১৫৭১-১৬৩০] ছিলেন একজন মুক্তচিন্তাবিদ বিজ্ঞানী, তার সারা জীবনের কাজ খুব সুন্দর ভাবেই এপিটাফের বাক্য দুটিতে ফুটে উঠেছে। টাইকো ব্রাহির মৃত্যুর পর তার সংগ্রহ করা বিশাল ডাটা কেপলারের হাতে আসে। তিনি ডাটা গুলো ব্যবহার করে এমন একটি মডেল দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন যাতে গ্রহগুলোর গতি ব্যাখ্যা করা যায়। তিনি কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মডেলকে মানদণ্ড হিসাবে ধরে নেন। তবে বৃত্তাকার পথে গ্রহ প্রদক্ষিণ করলে তাদের গতি ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি দেখলেন যে, উপবৃত্ত (Ellipse) বা ডিম্বাকার কক্ষপথে গ্রহ ঘুরলে গতি ব্যাখ্যা করা সহজ হয়। উপবৃত্তকে বিকেন্দ্রিক বৃত্ত বলা যায়। উপবৃত্ত ডিম্বাকৃতির হয়। এর দুটি ফোকাই (foci, একবচনে focus) থাকে। ডিম্বাকৃতির হওয়ায় এর ব্যাস সবখানে সমান নয়। তাই এর বড় (major) এবং ছোট (minor) অক্ষ (axis) নামে দুটি অক্ষ থাকে। ফোকাস দুটে যতই দূরে সরে যায় উপবৃত্ত ততই ডিম্বাকৃতির হতে থাকে। ঠিক উল্টো ভাবে ফোকাস দুটোর দূরত্ব কমতে থাকলে তা বৃত্তের মতই দেখায় এবং ফোকাস দুটো একবিন্দুতে মিলে গেলে তা বৃত্তে পরিণত হয়। তখন অক্ষ দুটো সমান হয়ে যায়। গ্রহ গুলো সূর্যকে একটি ফোকাসে রেখে প্রদক্ষিণ করে। প্রতিটি গ্রহরে উপবৃত্তাকার পথের বিকেন্দ্রিকতা খুবই কম। পৃথিবীর কক্ষ পথের বড় ও ছোট অক্ষের দৈর্ঘ্যের পার্থক্য মাত্র ০.০১৪% । এই সামান্য পার্থক্যই গ্রহের গতি অনেক বদলে দেয়। কেপলারের আগে কেউ এইভাবে উপবৃত্তাকার কক্ষপথের কথা চিন্তা করেনি।
১৯২১ সালে কেপলার গ্রহের গতি সম্পর্কিত তিনটি সূত্র দেন। এই সূত্র নিউটনকে তার গ্রাভিটির সূত্র দাঁড় করাতে অনেক সাহায্য করেছিল।

ছবি-উপবৃত্ত
গ্যালেলে ও এবং বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদের নাচ :
সৌরকেন্দ্রিক মডেল প্রতিষ্ঠার পেছনে আরো একজন বিজ্ঞানীর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি হলেন গ্যালেলেও গ্যালেলেই (Galileo Galilei, ১৫৬৪-১৬৪২)। গ্যালেলেও টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। [টেলিস্কোপ আবিষ্কারের মূল কৃতিত্ব ডাচ লেন্স করিগর হ্যান্স লিপার্শেকে দেওয়া যেতে পারে। লিপার্শে উত্তল লেন্স ব্যবহার করে দূরের বস্তুকে দেখার পদ্ধতি বের করেন। গ্যালেলেও শুধু পদ্ধতি একটু পরিবর্তন করে আকাশ দেখার জন্য ব্যবহার করেন।] টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের দিকে চোখ দিলেই নতুন জগৎ। আগে যা খালি চোখে ধরা পড়েনি তা গ্যালেলেও দেখতে শুরু করলেন। চাঁদকে আমরা অতি সুন্দর হিসাবেই জানি। কিন্তু গ্যালেলেও টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলেন চাঁদের আসল রুপ। তিনি চাঁদের গায়ে পাহাড় ও খাদ সম্পর্কে ধারণা দেন। চন্দ্রপৃষ্ঠ মোটেও সমতল নয়। চাঁদের সৌন্দর্য শুধু কবিদের বাণিজ্যিক প্রচারণা। এই সত্য গ্যালেলেও প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন । তিনি মিল্কিওয়ে ছায়াপথের দিকে টেলিস্কোপ দিয়ে বললেন এটি আসলে অসংখ্যা তারার সমষ্টি। তিনি শুক্র গ্রহের বিভিন্ন দশা সমূহ বর্ণনা করেন।
গ্যালেলেওর সবচেয়ে বড় পর্যবেক্ষণ ছিল বৃহস্পতি গ্রহকে কেন্দ্র করে। তিনি বৃহস্পতির দিকে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলেন চারটি চাঁদ (উপগ্রহ) [বৃহস্পতি আরো উপগ্রহ আছে। কিন্তু এই বড় চারটি সহজেই দেখা যায়। গ্যালেলেওর কম শক্তির টেলিস্কোপ দিয়ে চারটি উপগ্রহই স্পষ্ট বোঝা যেত] তিনি বহুদিন পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলেন যে উপগ্রহ গুলো বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। ঐ চার চাঁদের নাচ গ্রহরাজ বৃহস্পতিকে ঘিরেই। এই পর্যবেক্ষণ বিজ্ঞানের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই পর্যবেক্ষণ থেকে গ্যালেলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। মহাবিশ্বের সবকিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে না। বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে তার উপগ্রহ গুলো ঘুরছে। সুতরাং পৃথিবী সব মহাজাগতিক গতির কেন্দ্র নয়। প্রায় দুই হাজার বছরের পুরাতন এরিস্টটলীয় ধারনা -‘পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র’ চূড়ান্ত ভাবে ভুল প্রমাণিত হল। দেখলেনতো সূর্যকে কেন্দ্র করে সব গ্রহ গুলো ঘুরছে তা বোঝার জন্য সৌরজগতের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখার প্রয়োজন পড়েনি। পর্যবেক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাই যথেষ্ট এবং তা পৃথিবীতে বসেই করা সম্ভব। একদিন পৃথিবীতে বসেই সমগ্র মহাবিশ্বকে দেখা যাবে। বোঝা যাবে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ।
গ্যালেলেও ইতালিয়ান ভাষায় The Starrry Massage বইটির মধ্যমে তার পর্যবেক্ষণের কথা সাধারন মানুষের কাছে তুলে ধরেন ( তখন বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা সাধারনত ল্যাটিন ভাষায় লেখা হত যা সাধারন মানুষের পড়ার উপযুক্ত নয়)। গ্যালেলেও সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের সপক্ষে জোর প্রচারনা শুরু করেন। সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রচারের কারনেই গ্যালেলেও ক্যাথোলিক চার্চের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ১৬৩৩ সালে প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে বলার জন্য তাকে বিচারের সম্মুক্ষীণ করা হয় এবং বাকি জীবন গৃহবন্দি রাখা হয়।
কেপলার এবং গ্যালেলেও হলেন এমন দুইজন বিজ্ঞানী যারা বিজ্ঞানকে দর্শন থেকে মুক্তি দিয়ে ডাটা, পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণ নির্ভর করে তোলেন।
জুলাই, ২০১৬এ NASA’র স্পেস প্রব জুনো বৃহস্পতি গ্রহের নিকট পৌঁছে। এতে অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি (রেডিয়েশন থেকে বাচানোর জন্য) গ্যালেলেওর লেগো মিনিফিগার দিয়ে দেওয়া হয়। অবশেষে গ্যালেলেও বৃহস্পতি দেখার সুযোগ পেলেন।
কোপারনিকাস, কেপলার ও গ্যালেলেও এটা প্রতিষ্ঠা করেন যে, সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলো ঘুরছে। মহাবিশ্ব অনেক বড় তারা সূর্যের মতই উজ্জ্বল বস্তু যা অনেক দূরে অবস্থিত।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফল ও মহাবিশ্বের গল্প :
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফল কোনটি? আমি উত্তর দেব আপেল। আপেল (বা আপেল জাতীয় ফল) খেয়েই আদম (Adam) স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হন। এক আপেলের কারণেই ট্রয়যুদ্ধ বেধেছিল (Apple of Discord) । সুন্দরী প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর প্রাপ্য সোনার আপেল প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির (Aphrodite) হাতে তুলে দিয়ে প্যারিসই ট্রয় যুদ্ধের সূচনা করেছিল (Judgement of Paris) । গ্রীক মিথলজিতে আরো অনেক আপেলের গল্প পাওয়া যায়। আপেলের কারণেই আটালান্টা (Atalanta) দৌঁড়ে হেরে বাধ্য হয়েছিল মেলানিয়ন (Melanion) কে বিয়ে করতে। হেস্পারাডিসের (Hesperides) সোনার আপেল আনতে গিয়ে মহাবীর হারকিউলিস আকাশে কাঁধে তুলেছিলেন। আকাশ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা টাইটান অ্যাটলাসের (Atlas) কাজ।
অবশেষে কোন একটা আাপেলকেই পড়তে হল নিউটনের সামনে। ইংল্যান্ডে কি আর কোন ফল জন্মায় না? নিউটনের সামনে আপেল পড়ায় নিউটন ভাবতে শুরু করলেন এমন এক বল নিয়ে যা সারা বিশ্বকে গঠন করেছে। নিউটন আর আপেল গল্পের সত্যতা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। বৃদ্ধ বয়সে গল্প করতে করতে নিউটন নাকি তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন, একটি আপেল তার সামনে পড়তে দেখে তিনি ভাবতে শুরু করলেন- যে বল আপেলকে পৃথিবী পৃষ্ঠে ফেলছে সেই বল কি চাঁদকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরানোর জন্য দায়ী হতে পারে?
সেই সময় এটা জানা ছিল যে, কোন এক বলের কারণে বস্তু সমূহ পৃথিবী পৃষ্ঠে পড়ে। নিউটন এই বলকে স্বর্গীয় বস্তু সমূহের মধ্যেও ছড়িয়ে দিলেন এবং স্বর্গকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনলেন। তিনি ভাবতে শেখালেন যে গ্রাভিটি নামক বলের কারণে আপেল মাটিতে পড়ে সেই গ্রাভিটির কারণেই সূর্যের চারপাশে গ্রহ সমূহ এবং গ্রহের চার পাশে উপগ্রহ ঘুরতে থাকে। গ্রাভিটি হল মহাবিশ্ব পরিচালনাকারী বল। ১৬৮৭ সালে নিউটনের বিখ্যাত গ্রন্থ Philosophiae Naturalis Principia Mathematica (The Mathematical Principles of Natural Philosophy)) প্রকাশিত হয়। এটি প্রিন্সিপিয়া নামেই পরিচিত ছিল। প্রিন্সিপিয়া হয়তো বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ গ্রন্থ । এই গ্রন্থেই নিউটন গ্রাভিটির সূত্র প্রকাশ করেন । এই সূত্রটি ছিল মূলত গ্রাভিটি হিসাব করার গাণিতিক বর্ণনা।
F = G m1Xm2/r^2
“মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে নিজ দিকে আকর্ষন করে। এই আকর্ষন বলের মান বস্তুদ্বয়ের ভরের গুণফুলের সমানুপাতিক এবং দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। এই বল বস্তুদ্বয়ের কেন্দ্র বরাবর কার্যকর হয়।”
এখানে,G হল গ্রাভিটেশনাল ধ্রুবক। G এর মান নিউটনের মৃত্যুর পর নির্ধারণ করার হয়। গ্রাভিটির ধারণা মহাবিশ্বের গঠনকে বদলে ছিল মারাত্মক ভাবে।
নিউটনের মহাবিশ্ব :
ক) সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলো গ্রাভিটির কারণে উপবৃত্তকার পথে ঘুরছে।
খ) মহাবিশ্বে নক্ষত্র গতিশীল এবং সংখ্যায় অসীম।
গ) মহাবিশ্ব সীমাহীন বা অসীম ।
ঘ) মহাবিশ্ব চিরকালই অপরিবর্তনীয় বা স্থির (Static)। মহাবিশ্ব সংকুচিত বা প্রসারিত হচ্ছে না ।
গ্রাভিটির দ্বারা গঠিত মহাবিশ্বের নিউটনীয় মডেলে সমস্যা দেখা দিল। যদি সব বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে তাহলে এরা নিশ্চই একদিন এক বিন্দুতে পতিত হবে। নিউটন হয়তো বলতে পারতেন মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে তাই এরা সাংকুচিত হবে না। এ অনুমান করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু নিউটন স্থির মহাবিশ্বে বিশ্বাস করতেন। তিনি সমাধান দিলেন- অসীম মহাবিশ্বে, অসীম সংখ্যক গতিশীল তারা গ্রাভিটির কারণে কেন্দ্রে পতিত হবে না কারণ অসীম মহাবিশ্বের কোন বিন্দুই কেন্দ্র হতে পারেনা। আরো সমস্যা হল, একটি অসীম স্থির মহাবিশ্বে দৃষ্টির প্রতিটি রেখাই একটি তারার উপর শেষ হবে। সুতরাং রাতেও আকাশ দিনের মত উজ্জ্বল থাকবো। ১৮২৩ সালে জার্মান দার্শনিক হইনরিখ ওলবারস (Heinrich Olbers) আরো অনেক যুক্তি দিয়ে সমস্যাটিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন।
নিউটন বিজ্ঞানী হিসাবে যেমনি সমাদৃত তেমনি ব্যক্তি হিসাবে সমালোচিত ছিলেন। তার সহকর্মীদের অধিকাংশের সাথে তার সম্পর্ক ভাল ছিল না। শিক্ষক হিসাবেও তার তেমন দক্ষতা ছিল না। এডমান্ড হ্যালি (Edmund Hally, ১৬৫৬-১৭৪২) ই বোধহয় নিউটনের সত্যতিকারের বন্ধু ছিলেন। হ্যালি নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে প্রিন্সিপিয়া প্রকাশ করে। এই হ্যালিকে আমরা চিনি তার নামে নামকৃত ধূমকেতুর জন্য ।
ক্যালকুলাসের প্রবক্তা হিসাবে নিউটনের নামই আমরা জানি। গথফ্রীড লাইবিনেজ (Gottfried Leibniz) ও সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে ক্যালকুলাস পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। নিউটন অবশ্য কখনোই তা স্বীকার করেননি এবং লাইবিনেজের নাম প্রকাশে অসহযোগিতা করেন। তবে বর্তমানে দুজনকেই ক্যাললকুলাসের প্রবক্তা মনে করা হয়। নিউটন রয়েল সোসাইটি থেকে রবার্ট হুকের একমাত্র পোট্রেট টি সরিয়ে ফেলেন।
নিউটনের প্রিন্সিপিয়া প্রকাশিত হবার কয়েক বছর পর ১৬৯৩ সালে নিউটন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এটা হয়তো তার রাসায়নিক গবেষণার সময় পারদ বিষক্রিয়া থেকে ঘটে। তিনি সেরে উঠলেও পরবর্র্তী দিনগুলো বিজ্ঞানে তেমন কোন অবদান রাখতে পারেননি। তিনি ১৯২৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
নিউটনীয় পদার্থ বিজ্ঞানের অবসান ঘটান আইনস্টাইন। কিন্তু এখনো আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে নিউটনীয় পদার্থবিদ্যার ধারনা কাজে লাগে। নিউটনকে মনে করা হয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের অন্যতম।
আলো আমার আলো :
আলোই পৃথিবীতে শক্তির প্রধান উৎস। কিন্তু আলো কী? কী দিয়ে তৈরি? এটা মহাশূন্যে কিভাবে বেগমান হয়? আলোর কী কোন নির্দিষ্ট বেগ আছে নাকি এটি অসীমবেগে চলমান হয়? গ্যালেলেও এবং নিউটনই প্রথম বিজ্ঞানী যারা আলো সম্পর্কে সঠিক প্রশ্নগুলো করেন। কোন বিষয় বুঝতে হলে সঠিক প্রশ্ন করতে পারতে হবে। ঐ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলেই বিষয়টি বোঝা যাবে। গ্যালেলেও আলোর বেগ মাপতে পরীক্ষা চালান। কিন্তু তাৎকালীন প্রযুক্তি দিয়ে তিনি আলোর বেগ মাপতে ব্যর্থ হন। ১৬৭৬ সালে ড্যানিশ জ্যোতির্বিদ রোমের (Olaus Romer) বৃহস্পতির উপগ্রহের গ্রহণ (Eclipse) পর্যবেক্ষণ করে বলেন যে, আলো অসীম বেগে চলে না। তিনি আলোর বেগ মাপার জন্য একটি পদ্ধতি প্রস্তাব করেন। কিন্তু তখন পৃথিবীর আকার জানা ছিল না বিধায় সঠিক ভাবে আলোর বেগ মাপা সম্ভব হয়নি। তবে তার পদ্ধতি সঠিক ছিল। ১৮৫০ সালে দুইজন ফরাসী পদার্থবিদ (Armand Hipolyte Fizeu & Jean Foucanlt) আলোর বেগ মাপতে সমর্থ্য হন। শূন্যস্থানে আলোর প্রকৃত বেগ, ২,৯৯,৭৯২.৪৫৮ ≈ ৩x ১০৫ (৩,০০,০০০) কি.মি./সেকেন্ড। আলোর বেগ বিভিন্ন মধ্যম যেমন পানি, বাতাস, কাচ এ শূন্যস্থান থেকে কম। আলোর বেগ বলতে শূন্যস্থানে (Vaccum) আলোর বেগ বোঝানো হয়। মহাকাশে (Space) আলোর বেগ শূন্যস্থানের আলোর বেগের সমান বিবেচনা করা হয়।
নিউটন ও আলোর কণা :
নিউটন ১৬৭০ সালে কাঁচের প্রিজম দিয়ে পরীক্ষা চালান এবং তিনি দেখান যে সাদা আলো প্রিজমের মধ্যদিয়ে গেলে বর্ণালীতে ভাগ হয়ে যায়। অর্থাৎ (দূশ্যমান) সাদা আলো মূলত বেগুনী, নীল, আসমানি, হলুদ,কমলা ও লাল আলোর সমন্বয়ে গঠিত। নিউটন প্রস্তাব করেন যে, আলো অসংখ্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত। ১৬৭৮ সালে ডাচ পদার্থবিদ ক্রিস্টিয়ান হুইজেন (Christiaan Huygens) নিউটনের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন এবং বলেন যে, আলো কণা নয় বরং তরঙ্গ হিসাবে ছড়িয়ে পড়ে।
থমাস ইয়াং ও আলোর তরঙ্গ :
১৮০১ সালে ইংলিশ পদার্থবিদ থমাস ইয়াং (Thomas Youngh) একটি পরীক্ষা চালান। একে বলা হয় আলোর দ্বিচির পরীক্ষা বা ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট (Double Slit Experiment)। এই পরীক্ষা প্রমাণ করে আলো আসলে তরঙ্গ। ফলে নিউটনের কণাতত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়। আধুনিক কালেও এই পরীক্ষাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। বিখ্যাত আমেরিকান পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনমেনের মতে কোয়ান্টম থিওরীকে এই পরীক্ষার মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। যদিও কোয়ান্টম থিওরী প্রতিষ্ঠিত হয় এই পরীক্ষা প্রায় ১৩০ বছর পর।
ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট :
পরীক্ষাটির জন্য একটি অন্ধকার কক্ষে দুটি সমান্তরাল ও সুরু ছিদ্র যুক্ত একটি বোর্ডের একপাশে নির্দিষ্ট রঙ্গের (অর্থাৎ নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে) আলো এবং অন্য পাশে একটি পার্দ রাখা হয়।
ক. দুটি ছিদ্রের একটি খোলা রেখে আলো ফেললে, পর্দায় একটি লম্বা আলোর ব্যান্ড তৈরি করে।
খ. কিন্তু দুটি ছিদ্র খোলা রেখে আলো ফেললে, পর্দায় আলো ও আধারের পাশপাশি ব্যান্ড তৈরি হয় যাকে বলা হয় ইন্টারফেরেন্স প্যাটার্ন।

ছবি: থমাস ইয়াং এর ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট।
যদি নিউটনের আলোক কণা তত্ত্ব সঠিক হত তবে এই পরীক্ষায় দুটি খোলা ছিদ্রের জন্য পর্দায় পাশাপাশি দুটি আলোর ব্যান্ড তৈরি হত। পরীক্ষায় প্রাপ্ত ইন্টারফোরেন্স প্যাটার্ণ কেবলমাত্র আলোকে তরঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করলেই ব্যাখ্যা করা যায়।
এনালজি :
ধরা যাক সমুদ্রের ঢেউ দুটি ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে উপকূলে আঘাত হানছে। দুই ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করা ঢেউ/তরঙ্গ একসাথে মিশে কোথাও একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করে স্থির পানি তৈরি করে (দুটি তরঙ্গের শীর্ষ-Crest এবং খাঁজ-Trough পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে) এবং কোথাও উঁচু ঢেউ তৈরি করে (দুটি তরঙ্গের শীর্ষ-crest এক হয়ে বড় ঢেউ তৈরি করে) এর ফলে উঁচু ঢেউ এবং স্থির পানির একটি প্যাটার্ণ তৈরি হয়। থমাস ইয়াং এর পরীক্ষায়ও একই ঘটনা ঘটে। উজ্জ্বল ব্যান্ড যেখানে আলোক তরঙ্গ মিশে বড় তরঙ্গ তৈরি করে এবং অন্ধকার ব্যান্ড যেখানে আলোক তরঙ্গ পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
ম্যাক্সওয়েল ও তড়িৎ চৌম্বকীয় বল :
১৮৬০ সালে স্কটিশ গণিতবিদ ও পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (James Clerk Maxwell) চারটি সমীকরণের মাধ্যমে তড়িৎ ও চৌম্বক বলের ধর্ম ব্যাখ্যা করেন। তিনি দেখান যে তড়িৎ ও চৌম্বকীয় বল মূলত একটি বলের দুটি ভিন্নরূপ যাকে আমরা এখন তড়িৎচৌম্বকীয় বল (ElectroMagnatic Force) বলি। তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ শূন্যস্থানে ৩,০০,০০০ কি.মি/সে বেগে ধাবমান হয়। আলোক তরঙ্গ ও একই বেগে চলে। তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ এবং আলো মূলত একই।

ছবি: বিভিন্ন তরঙ্গ দৈঘ্যের ও কম্পাঙ্গের আলো।
তড়িৎ চৌম্বকীয় বলের একীভূত করণের পর বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিল। যেমন ব্লাকবডি রেডিয়েশন, ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট এবং আলোর বেগের আপেক্ষিকতা। আমরা পর্যায়ক্রমে এগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
ব্লাকবডি রেডিয়েশন :
ব্লাক বডি- যারা সব কম্পাঙ্কের ও তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ শোষণ করে নেয়।
হোয়াইট বডি- যারা তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ সবদিকে প্রতিফলিত করে দেয়।
সূর্য বা অন্যান্য নক্ষত্র ব্লাকবডির উদাহরণ। কারণ নক্ষত্র সকল বিকিরণ শোষণ করে নেয় কোন বিকিরণ প্রতিফলিত করে না। ব্লাকবডিকে কালো দেখাতে হবে এমন কোন কথা নেই। সূর্য ব্লাক বডি হলেও এর তাপমাত্রা প্রায় ৫৮০০ K হওয়ার এটি উজ্জ্বল দেখায়। টেবিল, বই, খাতা হোয়াইট বডির উদাহরণ। কারণ এরা আলোর প্রতিফলন ঘটায়।
বিজ্ঞানীরা যখন সূর্য বা অন্য নক্ষত্র থেকে বিকিরিত তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের শক্তির হিসাব শুরু করে তখন দেখা গেল নক্ষত্র অসীম হারে শক্তি বিকিরণ করে। (তখনকার জ্ঞান মতে) কোন উত্তপ্ত বস্তু থেকে উৎপ্নন সকল তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ সমান শক্তি বহন করে তা তার কম্পাঙ্ক/তরঙ্গদৈর্ঘ্য যাই হোক না কেন। আবার কোন উত্তপ্ত বস্তু সমভাবে সকল কম্পাঙ্কের তরঙ্গ উৎপন্ন করতে পারে। অর্থাৎ উত্তপ্ত বস্তু অসীম সংখ্যক তরঙ্গ উৎপন্ন করতে পারে। সুতরাং উত্তপ্ত বস্তুবা ব্লাক বডি থেকে বিকিরিত শক্তির পরিমান হবে অসীম। এ গণনা সঠিক নয় এবং আজগুবি তা বিজ্ঞানীরা জনত। তারা অন্যকোন উপায় খুজছিল ব্লাক বডি রেডিয়েশন ব্যাখ্যার জন্য।
ফটো ইলেক্ট্রিক ইফেক্ট :
১৮৮৭ সালে জার্মান পদার্থবিদ হায়েনরিখ হার্জ (Heinrich Hertz) দেখলেন যে, কোন কোন ধাতব পদার্থের উপর তড়িৎ চৌম্বকীয় রেডিয়েশন বা আলো ফেললে তা থেকে ইলেক্ট্রন নির্গত হয়। এই নির্গত ইলেক্ট্রনের গতি আলো তীব্রতার উপর নির্ভর করেনা, কম্পাঙ্গের উপর নির্ভর করে। কম কম্পাঙ্গের আলো ফেললে ইলেক্ট্রন নির্গত হয় না। বেশী কম্পাঙ্গের আলো ফেললে ইলেক্ট্রন নির্গত হয় এবং এর বেগ কম্পাঙ্গের উপর নির্ভর করে।
ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ও কোয়ান্টা :
১৯০০ সালে জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্লাঙ্ক (Max Plank) প্রস্তাব করেন যে, আলো ও অন্যান্য তরঙ্গ যেমন ইচ্ছা বিকিরিত হতে পারে না। বিকিরিত হতে পারে কেবলমাত্র বিশেষ প্যাকেট আকারে। যার নাম তিনি দিয়েছিলেন কোয়ান্টা (Quanta, যা কোয়ান্টাম-Quantum এর বহুবচন)। প্রতিটি কোয়ান্টামে একটি বিশেষ পরিমান শক্তি থাকে এবং তরঙ্গের শক্তি কম্পাঙ্গের সমানুপাতিক। যে তরঙ্গের কম্পাঙ্গ বেশী সে বেশী শক্তি বহন করে। ফলে বেশী কম্পঙ্গের তরঙ্গ বিকিরণে বেশী শক্তির প্রয়োজন হবে। সুতরাং উচ্চ কম্পাঙ্গে বিকিরণ কমে যাবে । এই কোয়ান্টম হাইপোথিসিসের দ্বারা ব্লাক বডির অসীম হারে তাপ বা শক্তি বিকিরণ সমস্যার ব্যাখ্যা দেওয়া যায়।
ম্যাক্স প্লাঙ্ককে বলা হয় কোয়ান্টম থিওরীর জনক। তার কোয়ান্টম ও হাইপোথিসিসই কোয়ান্টম মিকানিক্সের ভিত্তি স্থাপন করে। পরবর্তী প্রায় ত্রিশ বছর ধরে বিভিন্ন বিজ্ঞানী কোয়ান্টম মিকানিক্সকে পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব হিসাবে দাড় করান। তবে কোয়ান্টম থিওরীর যাত্রা এভাবেই শুরু হয়েছিল আলো ও আলোর বিভিন্ন ধর্মের ব্যাখ্যার মাধ্যমে। আমরা এর পরের ঘটনাগুলিও আস্তে আস্তে জানব।
ইথার ও আলোর বেগ :
১৮৬০ সালের দিকে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ চৌম্বকীয় তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বানী ছিল আলোক তরঙ্গগুলো একটি বিশেষ স্থির দ্রুতিতে চলমান হবে। কিন্তু নিউটনীয় পদার্থ বিদ্যা পরম স্থিতির (Absolute Rest) ধারণা দূর করেছিল। যদি আলো নির্দিষ্ট স্থির গতিতে চলে তাহলে বলতে হবে আলো কিসের সাপেক্ষে স্থির গতিতে চলে? তরঙ্গ যেমন শব্দ তরঙ্গ কোন মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে চলে। আলোক তরঙ্গ কিসের মধ্যে দিয়ে চলে? তখন ইথার বা লুমিনিফেরাস ইথার (Luminiferous Ether) এর ধারণা প্রবর্তণ করা হয়। ইথার ভরহীন, অদৃশ্য, নিষ্ক্রিয় একটি পদার্থ যা সবখানে এমনকী মহাশূন্যেও বিদ্যমান। আলোক তরঙ্গ ইথারের মধ্যদিয়ে চলাচল করে যেমন শব্দ তরঙ্গ বাতাসের মধ্যে দিয়ে চলে। আলোক তরঙ্গ ইথারের সাপেক্ষে নির্দিষ্ট বেগে চলাচল করে। ইথারের সাপেক্ষে চলমান বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের নিকট আলোর বেগ বিভিন্ন মনে হবে কিন্তু ইথারের সাপেক্ষে তা ধ্রুব। বছরের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবী ইথারের সাপেক্ষে বিভিন্ন দিকে চলমান হয়। ফলে পৃথিবী ইথারের দিকে চলমান হলে আলোর বেগ যা হবে, পৃথিবী ইথারের সমকোণে গেলে আলোর বেগ তার কম হবে।

ছবি-ইথার পৃথিবী ও আলোর বেগ।
মাইকেলসন-মর্লি পরীক্ষা:
১৮৮৭ সালে বিজ্ঞানী এলবার্ট মাইকেলসন (Albert Michelson) এবং এডওয়ার্ড মর্লি (Edward Morley) একটি পরীক্ষা করেন। তারা একটি হাফ-গ্লেজড (Half Glazed) আয়নার উপর আলো ফেলে বোঝার চেস্টা করেন যে দিক পরিবর্তন করলে আলোর বেগ পরিবর্তন হয় কীনা। তারা এর সাথে পৃথিবীর গতি ও আলোর গতির দিক এক হলে বা সমকোণ হলে আলোর বেগ পরিবর্তনের তুলনা করেন। কিন্তু তারা বিস্ময়ের সাথে দেখলেন দুটি বেগই নির্ভুল ভাবে একই। পরীক্ষার ফলাফল ইথারের ধারণার পরিপন্থি। অনেকেই মাইকেল অন মর্লি পরীক্ষার ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন।

ছবি-মাইকেলসন মাল পরীক্ষা।
এক কেরাণীর স্পর্ধা:
১৯০৫ সালে সুইজারল্যান্ডের পেটেন্ট অফিসের জনৈক কেরাণী তিনটি বিজ্ঞান পত্র প্রকাশ করেন। এর মধ্যে দুটি গবেষণা পত্র ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট ও ইথার-আলোর বেগ সমস্যার সমাধান এনে দিল। এই অখ্যাত কেরানী দ্রুতই বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। তিনি বদলে দিলেন মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারনা। তিনি হলেন আমাদের মিস্টার ইউনিভার্স অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (Albart Einstein, ১৮৭৯-১৯৫৫)
আইনস্টাইনের তিনটি বিজ্ঞান পত্রের মধ্যে একটি ছিল ব্রাউনীয় গতি সম্পর্কে। তার দ্বিতীয় পত্রটি ছিল ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট সম্পর্কে। ম্যাক্স প্লাঙ্কের কোয়ান্টম হাইপোথিসিস মাথায় রেখে আইনস্টাইন প্রস্তাব করেন যে, আলো অসংখ্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোয়ান্টা বা প্যাকেট দিয়ে গঠিত (আইনস্টাইন নিউটনের আলোর কণা তত্ত্ব ফিরিয়ে দেন)। আইনস্টাইন আলোর কোয়ান্টাকে ফোটন (Photon) নাম দেন। যখন আলো অর্থাৎ ফোটন ইলেক্ট্রনকে আঘাত করে তখন ইলেক্ট্রন ফোটন থেকে শক্তি নিয়ে কক্ষপথ থেকে বের হয়ে আসে। ফোটনের এই শক্তি আলোক তরঙ্গের কম্পাঙ্কের সমানুপতিক (অর্থাৎ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ব্যাস্তানুপাতিক)। বেশী কম্পাঙ্কের আলোর (যেমন UV আলো) ফোটনের শক্তিও বেশী তাই এরা ইলেক্ট্রনকে বেশী শক্তি দেয়। আবার কম কম্পাঙ্গের আলোর (যেমন ইনফ্রারেড আলো) ফোটনের শক্তি কম তাই এরা ইলেক্ট্রনকে কম শক্তি দেয় ফলে ইলেক্ট্রন তার কক্ষপথ থেকে বের হতে পারে না। ধাবত পদার্থের উপর ইনফ্রারেড আলো ফেললে তাই ফটোইলেক্ট্রিক ইফেক্ট পর্যবেক্ষণ করা যায় না। ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট ব্যাখ্যার জন্য আইনস্টাইন ১৯২১ সালে নোবেল পুরুস্কার পান।
স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভিটি:
আইনস্টাইনের তৃতীয় পত্রটি ছিল Zur Elektrodynamik Bewegter Korper(On Electrodynamic of Moving Bodies)। এই বিজ্ঞাপনটিই পরবর্তীতে স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভিটির ভিত্তি স্থাপন করে। আইনস্টাইনের দুটি স্বীকার্য ছিল-
ক. অবাধে চলমান ব্যক্তি বা বস্তুর ক্ষেত্রে তার গতি যাই হোক না কেন) বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গুলো একাই হবে [এটা নিউটনীয় তত্ত্বও সমর্থন করে]
খ. সকল ব্যক্তি যে গতিতে চলুক না কেন সকলেই আলোর একই গতি মাপবেন। [এটা নিউটনীয় তত্ত্বের বাইরে নতুন ধারনা প্রবর্তন করে]
দ্বিতীয় স্বীকার্যটি মূলত স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভিটির ভিত্তি স্থাপন করে। এর ফলে ইথারের ধারনার আর প্রয়োজন পড়ে না এবং মাইকেলসন-মর্লি পরীক্ষার ফলাফলের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। নিউটন পরম স্থিতির ধারনা থেকে মুক্তি দেন এবং আইনস্টাইন পরম কালের (Absolute Time) ধারনা থেকে মুক্তি দেন। স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভিটি অনুসারে-
১। স্থান-কাল: স্পেশাল রিলেটিভিটি পরম কালের ধারনা সমাপ্তি ঘটায়। এই তত্ত্ব অনুসারে সময় পরম নয়, সময়ও পরিবর্তনীয়। আমাদের দৈনিক জীবনেরও অবস্থান দৈর্ঘ্য, প্রস্থ , উচ্চতার সাথে যোগ হল সময়। এখান থেকেই স্থান-কালের (Space-Time) এর ধারণা শুরু হল।
২। সময় সম্প্রসারণ : গতিশীল ঘড়ি স্থির ঘড়ির তুলনায় ধীরে চলে। অর্থাৎ গতিশীল থাকলে সময় ধীরে বাহিত হয়। দুই জমজ ভাই সোহেল ও রাসেল। রাসেল বিশ বছর বয়সে মহাশূন্যে পাড়ি দিল আলোর বেগের কাছাকাছি গতিতে। সোহেল পৃথিবীতে থেকে গেল। রাসেল মহাশূন্যে দশ বছর পার করে পৃথিবীতে ফিরে আসলে দেখবে তার জমজ ভাই সোহেল তার থেকে বুড়ো হয়ে গেছে। কারণ গতিতে সময় ধীরে চলে।
৩। দৈর্ঘ্য সংকোচন : চলমান লাঠির দৈর্ঘ্য স্থির লাঠির দৈর্ঘ্যের চেয়ে কম হবে।
৪। E=mc^2পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত সমীকরণ। এটি থি.স্পে.রিলেটিভিটিরই ফলশ্রুতি। এই সমীকরণ অনুসারে E ∞ m [এখানে c আলোর বেগ ধ্রুবক] অর্থাৎ শক্তি ও ভর সমানুপাতিক। শক্তিকে ভরে রূপান্তর সম্ভব আবার ভরকেও শক্তিতে রূপান্তর সম্ভব। E=mc^2মহাবিশ্বের শুরুর ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তখন আমরা দেখব কীভাবে শক্তি থেকে পদার্থ (ভর) তৈরি হতে পারে।
৫। সর্বোচ্চ গতিসীমা : এই তত্ত্ব অনুসারে কোন কিছুই মহাশূন্যে (Space) আলোর গতি থেকে দ্রুত চলতে পারে না।
৬। আলোর গতির সমান গতি আমাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। আমরা ৯৯.৯৯৯% পর্যন্ত অর্জন করতে পারি কিন্তু এই শেষ ভগ্নাংশটুকু আর অর্জন সম্ভব নয়। কারণ E=mc^2 অনুসারে শক্তি ও ভর সমানুপাতিক। গতিবৃদ্ধির জন্য শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং শক্তি বৃদ্ধির জন্য ভরও বৃদ্ধি পায় ফলে তখন আরো গতি বৃদ্ধির জন্য আরো শক্তি দরকার হয়। কোন বস্তু আলোর বেগের ১০% বেগে চললে তার ভর বৃদ্ধি হবে ০.৫% । এবং আলোর বেগ পৌছালে ভর হবে অসীম । অসীম ভরের বস্তুর গতির জন্য অসীম শক্তি প্রয়োজন। অসীম শক্তি অর্জন করা সম্ভব নয়। আলোর কণা ফোটনের কোন ভর নেই। কেবল ভরহীন কণাই আলোর গতিতে যেতে পারে।
স্পেশাল রিলেটিভিটির ইফেক্ট বোঝা যায় যদি আলোর বেগ বা তার কাছাকাছি বেগে চলা যায়। এই পার্থিব গতির জন্য নিউটনের সূত্র গুলোই যথেষ্ট।
ক্লাশ অফ দি টাইটান- আইনস্টাইন ও নিউটনের দ্বন্দ্ব :
আলোর বেগ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কি.মি. বা এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় আট মিনিট। যদি হঠাৎ সূর্য ধ্বংস হয় তারপরও আট মিনিট পৃথিবীতে আলো থাকবে। কিন্তু সূর্য ধ্বংসের পর কতক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবী সূর্যের গ্রাভিটির কারনে ঘুরতে থাকবে? নিউটনীয় তত্ত্ব মতে গ্রাভিটি অসীম বেগে কার্যকর হয়। তাই সূর্য ধ্বংস হবার সাথে সাথেই পৃথিবী সূর্যের মহাকর্ষ থেকে মুক্ত হবে। তাহলে গ্রাভিটির গতিবেগ আলোর গতিবেগ থেকে বেশী। কিন্তু স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভিটির একটি অনুসিদ্ধান্ত হল কিছুই আলোর থেকে বেশী বেগে যেতে পারেনা। এটা আমরা একটু আগেই বর্ননা করেছি। তাহলে তত্ত্ব টিকাতে হলে আইনস্টাইনকে গ্রাভিটির নতুন ব্যাখ্যা দিতে হবে। আমরা দেখেছি নিউটন গ্রাভিটি হিসাবের জন্য সূত্র দিলেও কেন এই বল অনুভুত হয় তা ব্যাখ্যা করেননি। আইনস্টাইন তার চিন্তা ভাবনাকে গ্রাভিটির ব্যাখ্যা দেবার জন্য ব্যায় করতে শুরু করলেন। প্রায় দশ বছর চেস্টার পর তিনি গ্রাভিটির নতুন ব্যাখ্যা ও গাণিতিক সমীকরন দাঁড় করাতে সমর্থ্য হন। গ্রাভিটির এই নতুন তত্ত্বই জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি হিসাবে পরবর্তীতে প্রচার পায়। জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটির সমীকরণ গুলো ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়।
জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি :
আইনস্টাইন বলেন যে, কোন ভর বিশিষ্ট বস্তু মহাবিশ্বের গঠনকে বিকৃত করে (Wraps the febric of Space-Time) । মহাবিশ্বের গঠনকে কল্পনা করা যেতে পারে একটি সমতল রাবারের সীট হিসাবে। কোন রাবারের সীটে গোলক রাখা হলে তা ডেবে যাবে বা বেঁকে যাবে। ঠিক তেমনি মহাবিশ্বে কোন ভর বিশিষ্ট বস্তু তার চারপাশের স্থান-কাল (Space-Time) কে বাকিয়ে দেয়। এই বেঁকে যাওয়া স্থান কালই গ্রাভিটির কারন। মহাবিশ্বের গঠন (Febric of Cosmos) এর উপর কোন বস্তুর প্রতিক্রিয়াই হল গ্রাভিটি। এই বল আলোর গতিতেই কার্যকর হয়। এর বেশী বেগে নয়। সূর্য ধ্বংস হলেও পৃথিবীতে আট মিনিট আলো থাকবে এবং আট মিনিট পৃথিবী সূর্যের গ্রাভিটির কারনে ঘুরতে থাকবে। আইনস্টাইন নিউটনের গ্রাভিটির ধারণা বদলে দিলেন।
আইনস্টাইন তার জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি দিয়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারনা চিরতরে বদলে দেন। আইনস্টাইনের সমীকরন ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের অনেক মডেল দাঁড় করানো শুরু করলেন।
রিলেটিভিটির স্পেশাল তত্ত্ব কেবল মাত্র বিশেষ অবস্থা অর্থাৎ আলোর বেগ বা তার কাছাকাছি বেগে চলমান বস্তুর জন্য প্রযোজ্য হয়। তাই একে স্পেশাল বা বিশেষ তত্ত্ব বলা হয়। রিলেটিভিটির জেনারেল তত্ত্ব মহাবিশ্বের সবখানে সব সময় প্রযোজ্য হয়। গ্রাভিটি সবার জন্য সব সময়ের জন্য সত্য। গ্রাভিটি মহাবিশ্ব গঠনকারী বল। তাই একে রিলেটিভিটির জেনারেল বা সাধারণ তত্ত্ব বলা হয়।

ছবি: গ্রাভিটি এবং মহাবিশ্বের গঠন
জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি অনুসারে-
১। গ্রাভিটেশনাল ওয়েব (Gravitational Wave) :
আইনস্টাইন সমীকরণ অনুসারে মহাবিশ্বের গঠন (Geometry)= ভর (Matter) +শক্তি (Energy)। এই সমীকরণের ডান পাশ (ভর ও শক্তি) পরিবর্তন হলে বাম পাশ (মহাবিশ্বের গঠন) ও পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ মহাকর্ষ ক্ষেত্র মহাবিশ্বের গঠনকে প্রভাবিত করে তরঙ্গ তৈরি করতে পারে। যা গ্রাভিটেশনাল ওয়েব বা মহাকষীয় তরঙ্গ নামে পরিচিত। অতি সম্প্রতি LIGO টিম মহাকষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ত্ব সনাক্ত করতে সমর্থ্য হয়েছে।
২। সময়ের উপর গ্রাভিটির প্রভাব :
গ্রাভিটি যতই বাড়বে সময় ততই সংকুচিত হবে। অনেক বড় গ্রহ বা নক্ষত্র যার মহাকর্ষ বল বেশী তার পৃষ্ঠে সময় ধীরে চলবে। এমনকী পৃথিবীর পৃষ্ঠের ঘড়ি মহাশূন্যের ঘড়ি থেকে ধীরে চলে। তবে পৃথিবীর গ্রাভিটি কম হওয়ায় তা সাধারন চোখে ধরা পড়ে না। কোন বড় নক্ষত্রের বা ব্লাকহোলের পাশে থাকলে সময় কম দ্রুত যাবে কারণ সময় যেখানে সংকুচিত হয়।
৩। আলোর গতি ধ্রুব তবে গ্রাভিটি আলোর গতিকে কমিয়ে দিতে পারে।
৪। গ্রাভিটি আলোর গতি পথকে বাকিয়ে দিতে পারে। দূরবর্তী কোন নক্ষত্র থেকে আসা আলো পথে অনেক নক্ষত্র বা গ্যালাক্সীর গ্রাভিটির কারনে বাকিয়ে আমাদের চোখে পড়ে। ফলে আমরা দূরের নক্ষত্র যেখানে দেখি আসলে সে ঐ স্থানে নেই। গ্রাভিটির কারনে আলোর গতিপথ বেকে যাওয়ার এমন মনে হয়।
৫। ব্লাক হোল ও ওয়ার্ম হোল :
এই বিষয় দুটি নিয়ে আরো আলোচনা করব। এখন শুধু এইটুকু জানি যে এদের ধারন জেনারেল রিলেটিভিটির মধ্যেই সৃষ্টি। গ্রাভিটি আলোর বেগ কমিয়ে দিতে পারে। তাহলে এমন ক্রিটিকাল গ্রাভিটি আছে যার থেকে বেশী বল হলে আলোও স্থির হয়ে যাবে। এমন হাইপোথিটিকাল স্থানকেই বলে ব্লাকহোল।