এক অভূতপূর্ব সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। লাখ লাখ মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, প্রাণ যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। শুধু মহামারী আর মৃত্যুই নয়, প্রকৃতির কাছে এমন সর্বব্যাপী চপেটাঘাতের ঘটনাও মানুষের ইতিহাসে বিরল। অর্থনীতির ইতিহাসেও সবচেয়ে বড় মন্দার মুখে পড়েছে মানুষ। সেই মন্দায় কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা কল্পনা করা কঠিন, তবে সেটা যে পৃথিবীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেবে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
মানুষের এই পরিণতি কি অবধারিত ছিল? গত কয়েক শতকে মানুষ পৃথিবীর উপর কতৃত্ব ফলাতে গিয়ে মাটি-পানি-বাতাসকে বিপন্ন করেছে। পরিবেশের কথা না ভেবে উন্মাদের মত অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে, জিডিপির দিকে ছুটেছে। একটা গবেষণা বলছে, প্রতি ১০ লাখ ডলারের জিডিপির জন্য মানুষ বাতাসে ছাড়ে ৫০০ টন সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরোকার্বন) গ্যাস। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপির জন্য মানুষ পৃথিবীর বাতাসে ছেড়েছে প্রায় ৪০ বিলিয়ন টন সিএফসি গ্যাস। কোটি কোটি বছর ধরে গড়ে উঠা ওজোন স্তর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়েছে মাত্র কয়েক শতকে। মানুষের বিলাসী খাবার, চিকিৎসা আর বিনোদনের লালসার বলি হয়েছে লাখ লাখ পাখি আর বন্যপ্রাণী। বহু বন্যপ্রাণী চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে। বিপন্ন হয়েছে খাদ্যশৃঙ্খল, নষ্ট হয়েছে বাস্তুসংস্থান।
কিন্তু করোনা নামে এক ভাইরাসের টিকে থাকার লড়াইয়ের রেশ ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। পৃথিবীর উপর, প্রকৃতির উপর মানুষের দখল তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ছে। তথাকথিত ‘উন্নত’ প্রযুক্তি এবং ‘উন্নত’ সভ্যতার মেকি ক্ষমতার মুখোশ খুলে পড়ছে। করোনা কান ধরে বন্ধ করিয়েছে কলকারখানা, গাড়ির চাকা, জাহাজের ইঞ্জিন, থমকে দিয়েছে পার ক্যাপিটা-জিডিপি আর সর্বস্ব দখলের অর্থনীতি। জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো কমিয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে ‘গর্তে’ ঢুকছে পৃথিবীর ‘শ্রেষ্ঠ’ জীব।
নাসার সম্প্রতি বেশ কিছু স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে কীভাবে সারা বিশ্বের শহরগুলিতে দ্রুত দূষণের পরিমাণ কমছে। সবচেয়ে বেশি কার্বন উৎপাদনকারী ও করোনার উৎপত্তিস্থল চীনের শহরগুলোতে ব্যাপকভাবে বায়ু দূষণ হ্রাস পেয়েছে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি কোপার্নিকাস সেন্টিনেল স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছে করোনার প্রভাবে ইতালি ও চীনের আকাশে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমেছে ৪০-৬০
শতাংশ।
ফিনল্যান্ডের সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এন্ড ক্লিন এয়ার (CREA) বলছে, ১ মার্চ পর্যন্ত চীনে কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমন এক চতুর্থাংশ বা ২০ কোটি টন কমে গেছে, যা ব্রিটেনে এক বছরে নির্গমন হওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইডের অর্ধেক। তারা আরও জানিয়েছে, ২২ মার্চ টানা ১৪ ঘণ্টার কারফিউর ফলে ভারতের বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ বসন্তকালে ইতিহাসের সর্বনিম্ম পর্যায়ে নেমে গেছে। রেকর্ড না ভাঙলেও অন্যান্য বিষাক্ত কণার পরিমাণও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
কার্বন-সালফার মুক্ত পৃথিবী যেন বহু শতাব্দী পর একটু নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়েছে। কমছে পানি-মাটি-বায়ু-শব্দ দূষণ। ‘সভ্য’ মানুষের কাছ থেকে পৃথিবীর দখল কেড়ে নিয়ে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে পাখি, সমুদ্রের প্রাণী, বনের প্রাণী ও গাছেদের দখল। অতিষ্ঠ খাল-নদী, বনানী, আকাশ কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছে। একটু একটু করে ধরণী তার অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।
বহুদিন পরে মানুষশূন্য কক্সবাজার সৈকতে ফিরেছে ডলফিনরা। ব্যস্ত মুম্বইয়ের মেরিন ড্রাইভের দখল নিয়েছে পায়রারা। ইতালির ভেনিসের বিখ্যাত খালগুলিতে স্বচ্ছ জলের দেখা মিলেছে। সেখানে ফিরে এসেছে ডলফিন ও নানা প্রজাতির মাছেরা। ইউরোপজুড়ে ফিরে আসছে হাজার হাজার পাখি। পরিবেশবিদরা বলছেন মানুষের এই অভূতপূর্ব ‘বন্দিদশায়’ পৃথিবীর উষ্ণায়নে কিছুটা হলেও বাধা পড়বে। অন্তত ছয় মাস এভাবে চলতে থাকলে উত্তর-দক্ষিণ মেরুর গলে যাওয়া বরফ আবার জমতে শুরু করবে। পৃথিবী আবার শান্ত হয়ে আসবে। আপাতঃস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে স্থলচর-জলচর প্রাণীরা। হ্যাঁ, এটা অসম লড়াই নিশ্চয়ই। শীঘ্রই টিকা বা রোগ প্রতিরোধ শক্তিতে করোনাকে ‘জয়’ করবে মানুষ। এই লড়াইয়েরও শেষ হবে। মানুষের জীবন ‘স্বাভাবিক’ হবে। আবার জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়বে, কল-কারখানার বর্জ্য-ধোঁয়ায় পানি-বাতাস বিষাক্ত হবে, কার্বনে ছেয়ে যাবে আকাশ। তবে
মানুষ কি এই ধাক্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীর প্রতি কিছুটা হলেও সংযমী হবে? নাকি ‘ক্ষতি’ পুষিয়ে নিতে দ্বিগুণ উদ্যমে নতুন ধংসে মাতবে?
সুত্রঃ
১। https://www.newsweek.com/coronavirus-major-impact-environment-co2-air-quality-anim
als-1493812
২। India’s Coronavirus Curfew Resulted in the Lowest One-Day Traffic Pollution Levels
on Record.
৩। Airborne Nitrogen Dioxide Plummets Over China.
৪। কক্সবাজার সৈকতে ডলফিন খেলা করছে।
৫। জনতা কারফিউতে রাজপথে নিজেদের অধিকার ফলাল পক্ষিবাহিনী।