গত ৪০ বছর ধরে জ্যাতির্বিজ্ঞানের জগৎ এক অভূতপূর্ব রোমান্টিক জোয়ারে ভাসছে। আমাদের থেকে মাত্র ১,৭০,০০০ আলোক বর্ষ ( প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার যাওয়া যায়, এমন একটা গতিতে আপনার যদি ভ্রমন করার সুভাগ্য হয় তাহলে ১ লক্ষ ৭০ হাজার বছর গেলে আপনি যেখানে পৌছতে পারবেন।)দূরে দক্ষিণ আকাশে বৃহৎ ম্যাজেলানীয় মেঘপুঞ্জ নামে যে উপ-গ্যালাক্সিটি রয়েছে সেখানেই ১৯৮৭ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারীর মধ্যনিশীথে আন্ডিজ পর্বতমালার এক নিস্তব্ধ হিমজর্জর শিখরে দাঁড়িয়ে তরুন বিজ্ঞানী ইয়ান শেলটন সুপারনোভাটিকে আবিষ্কার করলেন। সুপারনোভাটি এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? সৌরজগতের অস্তিত্ব সম্বধে কি তা আলোকপাত করবে? পৃথিবীর বুকে প্রানের অস্তিত্বের সঙ্গে এর কোন তাৎপর্যের বন্ধন আছে কি? আমাদের মানবজাতির অস্তিত্বের সাথে কী এর সম্পর্ক আছে? বিনম্র শ্রদ্ধা হ্যা, আছে।
সুপারনোভা ঐ সব কারনেই অতটা গুরুত্বপূর্ণ।
সুপারনোভা বিস্ফোরণ কীভাবে হয় সেটা বুঝতে হলে প্রথমে বোঝা দরকার একটি তারকা কীভাবে তৈরি হয়।
মহাবিশ্বের 'প্রথম আদি' মৌল উপাদান হচ্ছে হাইড্রোজেন(৭৫%) আর হিলিয়াম(২৫%)। তারার উৎপত্তি হয় মহাশূন্যে অত্যান্ত ক্ষীণভাবে ব্যাপ্ত গ্যাস ও ধুলিকণার বিপুল নীহারিকা পর্যায়ে পর্যায়ে ঘনীভূত হয়ে। কোন এক সময়ে কোনও এক বিশেষ অবস্হায় কণাগুলির মধ্যে পারষ্পরিক মহাকর্ষের আকর্ষন শুরু হয় এবং ক্রমশই নীহারিকাটির সঙ্কোচন ঘটতে থাকে। সঙ্কুচিত হতে হতে নীহারিকাটি অনেক সময়ই বহু খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে বহু তারার এবং তারকাগুচ্ছের জন্ম দেয়। মহাকর্ষের কেন্দ্রমুখী আকর্ষনে উত্তরোত্তর ঘনীভূত হয়ে প্রত্যেকটি তারার কেন্দ্রস্হল এক সময়ে এত ভীষন ঘন হয়ে ওঠে এবং সেখানকার উত্তাপ
এমনই প্রচন্ড হয়ে ওঠে যে সেখানে তাপ-পারমানবিক বিক্রিয়া শুরু হয়। চারটি করে হাইড্রোজেন পরমানু (চারটি প্রোটন) জুড়ে গিয়ে একটি করে হিলিয়াম পরমানু সৃষ্টি হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছু উদ্বৃত্ত বস্তুভর শক্তিতে পরিনত হয় এবং ঐ শক্তি বিকীর্ণ হতে থাকে আলো ও তাপরুপে। সূর্য জাতীয় তারার কেন্দ্রস্হলে তাপমাত্রা প্রথম পর্যায়ে থাকে এক কোটি থেকে দুই কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মত। একটা পর্যায়ে কেন্দ্রের তাপমাত্রা ১০ কোটি ডিগ্রির মাত্রায় চড়ে ওঠলে হিলিয়ামই জ্বালানি হয়ে ওঠে এবং উচ্চতর তাপ-পারমানবিক বিক্রিয়া শুরু হয়ে কার্বন-১২, অক্সিজেন-১৬, নিয়ন-২০ পরমানু সৃষ্টি হয়। সূর্যের চেয়ে কয়েকগুণ বড় তারকার ক্ষেত্রে কেন্দ্রস্হলের তাপমাত্রা যখন ৬০ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ওঠে তখন কেন্দ্রের নিয়ন ও অক্সিজেনই জ্বালানি হয়ে ওঠে সিলিকন-২৯ গ্রুপের বিভিন্ন পরমানুর সৃষ্টি হয় এবং কেন্দ্রের তাপমাত্রা তখন ১৫০ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত ওঠে। আরও কয়েকটি জটিল বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রর তাপমাত্রা যখন ৫০০ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ওঠে তখন সিলিকন গ্রুপের পরমাণুগুলোই জ্বালানিতে পরিনত হয় এবং লৌহ গ্রুপের-৫৬ বিভিন্ন পরমাণুগুলোতে পরিনত হয়। এভাবেই কেন্দ্রে হিলিয়াম থেকে শুরু করে ইউরেনিয়াম-২৩৮ পর্যন্ত সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে মহাকর্ষের প্রচন্ড চাপে তারাটি বিস্ফোরিত হয় এবং আরও বেশী ভরের তারাগুলোতে তৈরি হয় পালসার, কোয়াসার এবং পরিশেষে ভয়াবহ মধ্যাকর্ষন শক্তিসম্পন্ন কৃষ্ণ গহব্বর।
এবং একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর চূর্ন বিচূর্ণ এই তারাটি থেকে যে গ্যাসপুঞ্জ উৎক্ষিপ্ত হয় তার মধ্যে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেনের সঙ্গে মিশে থাকে হিলিয়াম থেকে শুরু করে ইউরেনিয়াম পর্যন্ত সমস্ত রকমের উপাদান। এই মেঘপুঞ্জই পরিনত হয় পরের প্রজন্মের তারকাদের ব্যবহৃত কাঁচামালের একটি অংশে। আমাদের নিজেদের সূর্য দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় প্রজন্মের তারা। অতীতের সুপারনোভার ধ্বংসাবশেষযুক্ত ঘূর্ণায়মান বায়বীয় পদার্থের মেঘ থেকে প্রায় পাঁচশ কোটি বছর আগে আমাদের সূর্য গঠিত হয়েছে। অবশিষ্ট গল্প পরিমান কিছু ভারী মৌলিক পদার্থ সংযুক্ত হয়ে কতগুলি বস্তুপিণ্ড তৈরী হয়েছে। সেগুলিই এখন গ্রহ হয়ে সূর্যকে প্রদক্ষিন করে।পৃথিবী এমনই একটি গ্রহ। শুরুতে পৃথিবী ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত। কালে কালে পৃথিবী শীতল হল এবং নিজস্ব বায়ুমন্ডল গঠন করল। কতকগুলি পরমানুর আকস্মিক সমন্বয়ে কয়েকটি বৃহত্তর অবয়ব সৃষ্টি হয়েছিল। খুবই সংক্ষেপে -এভাবে ইউরাসিল, ডিএনএ, আরএনএ তৈরি হল। প্রথমে প্রোকারিয়ট তারপর সায়ানো ব্যাক্টোরিয়া, ইউকারিয়ট, মাছ, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী এবং পরিশেষে মানবজাতি।
সারকথাঃ আমাদের সৌরজগতের অস্তিত্বটাই আদিকালে এক বা একাধিক সুপারনোভার বিষ্ফোরনের দ্ধারা প্রভাবিত হয়েছিল। যে নীহারিকাটির মধ্য থেকে সূর্য এবং গ্রহগুলির জন্ম সেটির মধ্যে নিশ্চয়ই এক বা একাধিক সুপারনোভা বিস্ফোরণ-জাত ধ্বংসাবশেষের মিশ্রন ছিল এবং সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রচুর পরিমানে ভারী মৌল ( কার্বন, অক্সিজেন, ফসফরাস, নাইট্রোজেন, সালফার সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, থেকে ইউরেনিয়াম পর্যন্ত) ছিল। তা যদি না হ'ত তাহলে এমন একটা সূক্ষ্ম-জটিল গ্যাস মিশ্রন হিসাবে গড়ে ওঠার বদলে সূর্য হ'ত প্রায় বিশুদ্ধ এক হাইড্রোজেনগঠিত তারকা, যাতে মিশ্রিত থাকতো কেবল সিকিভাগ হিলিয়াম। শুধু তাই নয়, বৃহস্পতি বা শনির মতো বড় বড় গ্রহেরই গঠন একই হ'ত। আর পৃথিবী সমেত ছোট ছোট গ্রহগুলোর জন্মই হ'ত না এবং আমাদের অস্তিত্বের কোনও প্রশ্নই উঠত না। কারন ছোট ছোট গ্রহগুলোর অভিকর্ষ-শক্তি এতটা প্রবল নয় যে তার জোরে তারা হাইড্রোজেনের মতো অত হালকা পদার্থকে বেঁধে রাখতে পারে।
আর তাই, গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আমারা উচ্চারণ করতে পারিঃ সুপারনোভা ছাড়া মানুষ সৃষ্টি হতে পারতো না।