Thursday, October 22, 2020

হাপাইতে হাপাইতে এক বৃদ্ধ রিক্সাচালক আমাকে বললো!

হাপাইতে হাপাইতে এক বৃদ্ধ রিক্সাচালক আমাকে বললো, সাহেব আমার লগে চলেন, ১০ ট্যাহা কম দিয়েন। আমার আরো ৫০ ট্যাহা লাগবো। আমি আমার বউয়ের লাইগ্যা সবজী, ডাইল-ভাত কিনুম।  

একথা শুনে তখন আর না করতে পারি নি। রিকশায় উঠে বসি। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। একটু যাচ্ছে তো  একটু থামছে। সামনেই দেখছি বৃদ্ধলোকটা খুব কষ্ট করে গাড়ি চালাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করি মামা, তুমি এই বয়সে রিক্সা চালাও কেনো? তোমার কি ছেলে মেয়ে কেউ নাই? 

 কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে সে বলে উঠল,
সাহেব, মগবাজার যাইতে আরো চল্লিশ মিনিট লাগবো তাইলে হুনেন আস্তে ধীরে।

আমি মনু (৭১) আইজ থেইক্যা বছর তিনেক আগে জেল থেইক্যা ছাড়া পাইছি। তেরোডা বছর বিনা দোষে জেল খাটছি।

খিলক্ষেতে, খা-পাড়ায় আমার একটা মুদির দোকান আছিল। আশে-পাশে অনেক গার্মেন্টস আছিল। অনেক মাইনসে কাম করত। ভালোই  ইনকাম হইতো আমার। ম্যালা সুখেই দিন যাইত আমাগো। মাঝে মাঝে বাকীও দিতাম। আমার দুই পোলা। করিম আর রহিম। বড় পোলা রহিম হার্টের রুগী। আল্লাহ দিছে অসুখ সাহেব, কি করতাম আর। প্রত্যেক মাসে  রহিমের ডাক্তার খরচ দিয়া কোন রকম জীবন যাপন করতাম। ম্যালা টেহা যাইত।

মাঝে মাঝে দোকানে কিছু পোলাপাইন বইয়া আড্ডা দিত। ঢাকাইয়া পোলাপাইন অনেক দিন ধইরা চিনতাম।আমারে মাঝে মইধ্যে ভাই ভাই কইয়া ডাকতো। কাম কাইজে সাহায্য করতো। আমিও একা মানুষ বিশ্বাস করতাম। আমার একদিন খুব শইল খারাপ করে। বউ, রমিজারে কইয়া আমি ফার্মেসি থেইক্কা ওষুধ আনতে গেছি।

এই ফাঁকে  একটু  পরে পোলাপাইন গুলা আমারে ফোন করে। কয় ভাই,দোকানে দুই গাড়ি পুলিশ আইছে, আপনারে খুঁজে। আমি ওষুধ আর না কিন্নাই হাঁটা ধরছি। যাইয়া দেহি, বড় বড় দুইডা গাড়ি আমার দোকানে সব সময় মাল ডেলিবারি দিতো হেই ড্রাইবার।

আমি যাওয়া মাত্রই আমার দোকান খুইল্লা চিনির বস্তা থেইক্যা লাল দুই পেকেট ইয়াবা বাইর করে। আমি হেডির নাম জানতাম না ধরা খাওনের পরে নাম হুনছি। আমি জানতাম না কিছুই, আমার হাতে রশি  লাগাইয়া থানায় নিয়া কোটে চালান কইরা দিলো।

 রমিজা অনেক কষ্টে আমার সাথে দেখা করবার যায়। আমারে ছাড়াইতে পারে নাই। ধরার তিনমাস পরে আমারে তের বছরের সাজা দিলো। ছয় মাস পর পর রমিজা দেখা করতো আমার লগে।। ছেলে গুলার খুঁজ নিতাম, বড় পোলাডা আমার টাকার অভাবেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। রমিজা আমার কাছে লুকায়ে রাখছে। ছোডো পোলাডা  ফুটপাতে টোকাই। মা পোলায়  মিল্লা কোন রকম বাইচ্চা থাকতো।

ওহন আমার কোন ব্যাবসা করতে মন বসে না। এক জায়গাই তিনজন দেখলে সইরা যাই। এই শহরের মানুষ গুলা খারাপ। বিনা দোষে জেল দেয়, গরীব বইলা দাম দেয় না সাহেব, চোর বাটপার মনে করে আমাগো। ভরসা পাই নাহ্।

এহন রিক্স চালাই। দিন আনি দিন খাই। বাসায় অসুস্থ বউ, বয়স হইছে এহন আর কামে কাজে যাইবার পারে না। ছোট পুলাডা বড় হইছে, কই যায় কি করে খোঁজ পাই না।

তিনদিন হইয়া গেলো বউটা উইঠ্যা রানবার পারে না। সারাদিন গাড়ী চালাই মালিকরে ১৬০ টাকা, ভাড়া দিয়ে যা'ই থাকে দুইজনে খাওন কিন্না খাই। রমিজা আমারে ছাড়া খাইবার পারে না। আমি নিজ হাতে খাইয়ে দেই সাহেব। আমি বুড়া বয়সে তার জন্য কিছুই করবার পারলাম। আমি জেলে থাকতে রমিজা আমার লাই কত কি না করলো। তেরডা বছর আমার লেইগ্যা অপেক্ষা কইরা রাস্তায় দিন কাটাইছে।

আজকে অনেক কষ্ট হইতাছে। এহনো  ৪০ ট্যাহা হইলে দুইজনের দুই বেলা খাওনের টাহা হইবো। 

আমি জানিনা  সাহেব কোন কারণে আমার লগে এইগুলান করলো। আমি জেলে না থাকলে আমার রহিম মরতো না। আমার রমিজা মাইনষের বাসায় এক প্লেট ভাতের জন্য কাজ করতো নাহ। আমিও আজকে রিক্সা চালাইতাম না। আমার বউ আইজ বিনা চিকিৎসায় ঘরে হুইয়া থাকতো না।  সাহেব আমি ক্ষতি করি নাই আল্লাহ দেখছে, আমি কোটে বিচার না পাইলেও আল্লাহর কাছে পামু। আল্লাহ আমার বিচার করবো। আমি দুখি না সাহেব আমি সুখি। আমার জীবনে কোন পাপ নাই। আমি হালাল কামাই হালাল খাই।

উনি কথা গুলা বললেন আর কাঁদলেন। আমি বনানী থেকে মগবাজার যাই। রাস্তায় প্রতিটা চোখের ফোঁটা যেন বৃষ্টির মতো টপ টপ করে পড়লো। 

নাহ আমি ওনাকে শান্তনা দিতে পারি নি। এমন দুখি মানুষের আমার সামান্য শান্তনায় ক্ষতি পরিপুরণ হবে না। 
"Collected"