Tuesday, June 27, 2017

স্বামী কি চাইলেই স্ত্রীর গায়ে আঘাত করতে পারবে ? শরীয়াহ কি বলে ?


লিখেছেন: ফারাবী।
নাস্তিকরা প্রায়ই আল কোরআনের সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে অনেক মুসলমান কে বিভ্রান্ত করে। নাস্তিকরা বলতে চায় যে আল কোরআনে নাকি পুরুষদের কে বলছে তারা যেন ইচ্ছামত তাদের স্ত্রীদের গাঁয়ে হাত তুলে। আচ্ছা আসুন তো আমরা একটু দেখি সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আসলে কি বলেছেন ? ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত তাফসীরে মা আরেফুল কোরআনের যে বঙ্গানুবাদটা মাসিক মদীনা পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দীন খান করেছেন সেখানে সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতের বঙ্গানুবাদ টা হল- “ পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্ত্বশীল এইজন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ।” এই আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে যে স্বামীরা যেহেতু সংসারের অর্থ যোগান দিবে তাই স্বাভাবিকভাবেই একটি সংসারের মাঝে স্বামীরাই কর্তৃত্ত্বশীল থাকবে। ব্যস সহজ একটা ব্যাপার এখানে কোন জটিলতা নাই। পৃথিবীর সব দেশেই একটা সংসার চালাতে স্ত্রী স্বামীর মতামত কে প্রাধান্য দেয়। তারপর এই আয়াতে বলা হয়েছে যে স্ত্রী যদি তোমার কথামত না চলে তাইলে প্রথমে তুমি তাকে সদুপদেশ দিবে এতেও যদি কোন কাজ না হয় তাইলে তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে আলাদা শুবে অর্থাৎ স্ত্রীর শয্যা পৃথক করে দিবে আর এতেও যদি কাজ না হয় তাইলে তুমি তোমার স্ত্রীকে মৃদুভাবে মারধোর করতে পারবে তবে এতটা আঘাত তোমার স্ত্রীকে করতে পারবে না যাতে তোমার স্ত্রীর গাঁয়ে কোন জখম হয় বা কোন দাগ পরে। আর এই আয়াতটিতে আঘাত করার ব্যাপারে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা দ্বারা মোটা লাঠির আঘাত বা সজোরে কিলঘুষির কথা বলা হয় নি বরং তাফসীর ও আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী এই আঘাত বলতে মেসওয়াক দ্বারা আঘাতের মত আঘাতকেই বুঝানো হয়েছে, বলা চলে বর্তমানের টুথব্রাসের আঘাতের মতই। আল কোরআনের এই আয়াতে কোন স্বামীকে স্ত্রীর গাঁয়ে আঘাত করতে বলা হয় নাই শুধু স্বামীর জন্য এটা জায়েজ করা হয়েছে যে স্ত্রী যদি একান্তই তোমার কোন কথা না শুনে তাইলে তুমি তাকে প্রথমে সদুপদেশ দিবে তাতে কাজ না হলে স্ত্রীর বিছানা আলাদা করে দিবে আর এতেও কাজ না হলে তুমি তোমার স্ত্রীকে এতটুকু মারধোর করতে পারবে যেন তার গাঁয়ে কোন জখম না হয়। আদেশ করা এক জিনিস আর শুধু অনুমতি দিয়ে রাখা আরেক জিনিস। ইসলামে তালাক দেবার অনুমতি আছে কিন্তু তার মানে এই নয় যে ইসলাম বলছে যে তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের কে তালাক দিয়ে দাও। বরং স্বামী স্ত্রী কেউ যেন কাউকে তালাক দিতে বাধ্য না হয় ইসলাম ঠিক সেইভাবেই স্বামী স্ত্রীকে সংসার জীবন পরিচালনা করতে বলেছে। অর্থাৎ সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা স্ত্রীকে কোন মাইরধর করার নির্দেশ দেন নি স্ত্রী যদি কখনো স্বামীর চরম অবাধ্য হয়ে যায় তাইলে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা স্বামীকে শুধু স্ত্রীকে মৃদু আঘাত করার অনুমতি দিয়েছেন তাও এতটুকু যেন স্ত্রীর গাঁয়ে যেন কোন আঘাতের জখম না পরে। আর স্ত্রীর গাঁয়ে এই আঘাত টা করার আগে প্রথমে স্বামী তার স্ত্রীকে বুঝাবে তাতে কাজ না হলে শয্যা আলাদা করে দিবে আর এতেও কাজ না হলে সর্বশেষ তখন স্ত্রীকে মৃদু মারধোর করবে।
ঠিক কি কারনে ও কতটুকু পরিমান স্ত্রীকে আঘাত করা যাবে এই কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিদায় হজ্জের ভাষণেই বলে গিয়েছেন। “ নারীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় কর। তোমরা তাদেরকে আল্লাহ্‌র আমানত হিসাবে গ্রহণ করেছ এবং তাদের সতীত্ব- সম্ভ্রমকে আল্লাহর কালেমার বিনিময়ে তোমাদের জন্য হালাল করেছ। আর তোমাদের ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল ( অর্থ্যাৎ নারীদের), কোন লোককে যেন তোমাদের শয্যাপাশে না আসতে দেয় যাকে তোমার অপছন্দ কর। তারা যদি তাও তা করে তবে তোমরা তাদেরকে প্রহার করতে পারবে, তবে এমনভাবে যেন তার চিহ্ন বাইরে ফুটে না উঠে। আর তাদের ব্যাপারে তোমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, তোমরা ন্যায়সঙ্গত ভাবে তাদের খোরপোশের ব্যবস্থা করবে। ”
অর্থ্যাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে আপনার স্ত্রী যদি পরকীয়ায় লিপ্ত হয় তাইলেই শুধু আপনি আপনার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে পারবেন। পরকীয়া ছাড়া অন্য কোন কারনে আপনার স্ত্রীর গায়ে হাত দেয়া জায়েজ নয়। নিছক সাংসারিক মতপার্থক্য বা তরকারীতে লবন কম হয়েছে এইসব কারনে যারা নিজ স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে তারা অবশ্যই শরীয়তের দৃষ্টিতে অপরাধী। শুধু তাই নয় স্বামী যদি বিনা কারনে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে তাইলে ইসলাম এক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছে। মাযহাব ভেদে বিনা কারনে স্ত্রীর গায়ে হাত তুললে কাজী স্বামীকে ২০ টি বেতের বারি দেবার নির্দেশ রাখেন। আর ইসলামী শরীয়তে বিয়ে কোন স্থায়ী জিনিস না। স্বামী স্ত্রীর মাঝে বনিবনা না হলে ইসলাম তো মেয়েদেরকে তালাক দেবার ক্ষমতা দিয়েছে। তাই কোন স্বামী যদি স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাইলে স্ত্রী চাইলেই পারবে সেই স্বামীকে তালাক দিয়ে দিতে। ইসলামে অনেক কিছুই জায়েজ আছে কিন্তু তার মানে এই নয় যে ইসলাম তা করতে বলেছে। যেমন তালাক দেওয়াও ইসলামে জায়েজ কিন্তু ইসলামের কোথাও বলা নাই যে তুমি তোমার স্ত্রীদের কে তালাক দাও। বরং বলা হয়েছে যে তালাক দেওয়া হচ্ছে ইসলামে খুবই ঘৃনিত একটা কাজ। ইসলাম স্বামী স্ত্রী কে যথাসম্ভব মিলমিশ করে থাকতে বলেছে যেন স্বামী স্ত্রীর কেউই কাউকে তালাক দেবার মত পরিস্থিতি না হয়। কোন জিনিস জায়েজ করা এক জিনিস আর নির্দেশ দেয়া আরেক জিনিস।
আর সূরা নিসার এই আয়াতের তাফসীরে তাফসীরে মা আরেফুল কোরআনে এই কথা লেখা আছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীর গাঁয়ে স্বামীর হাত দেয়াটা পছন্দ করতেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কথাও বলেছেন যে ভাল লোক কখনোই এমন করে না। মুয়ায ইবনে কুশায়রা থেকে বর্নিত আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞাস করলাম আমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে আপনি কি বলেন ? তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন- “ তুমি যা খাবে তাকে তাই খেতে দিবে তুমি যা পরবে তাকে তাই পরতে দিবে, কখনই তোমার স্ত্রীকে প্রহার করবে না এবং কখনই তোমার স্ত্রীকে গালিগালাজ করবে না। [সুনানে আবু দাউদ, বিবাহ অধ্যায়, হাদীস নং ২১৩৮ ]
একটা লোক কিভাবে তার স্ত্রীকে আস্তাবলের উটের ন্যায় মারধোর করে তারপর আবার রাতে তার সাথে বিছানায় শুয় ? [ বুখারী শরীফের বিবাহ অধ্যায় ]
ঠিক এই আয়াতের পরের আয়াত সূরা নিসার ৩৫ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে স্বামী স্ত্রীর মাঝে যদি আর বনীবনা না হয় তাহলে অভিভাবকরা যেন তাদের মাঝে তালাক হবার ব্যবস্থা করে। - " আর যদি তোমরা তাদের দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা কর, তাহলে পুরুষের পক্ষ/পরিবার থেকে একজন মধ্যস্থতাকারী এবং স্ত্রীর পক্ষ/পরিবার থেকে একজন মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত কর। যদি তারা উভয়ে (মধ্যস্থতাকারী) মিটমাট করতে চায়, তাহলে আল্লাহ তাদের দুজনের মধ্যে মিটমাটের ব্যবস্থা করে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সবকিছু সম্পর্কে অবগত। "
তো স্ত্রীকে মাইরধর করেই যদি সব সমস্যা মিটে যেত তাইলে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা কেন ঠিক এর পরের আয়াতে তালাকের কথা বলবেন ? সূরা নিসার ৩৫ নম্বর আয়াত পড়ে তো ঠিকই বুঝা যাচ্ছে বৈবাহিক জীবনে স্বামী স্ত্রী উভয়ের মতামতেরই গুরুত্ব আছে। এই জন্য আল্লাহ সুবহানাতায়ালা স্বামী স্ত্রী উভয় পরিবারের মাঝখান থেকেই সালিশ নিযুক্ত করতে বলেছে। ইসলামী শরীয়তে বিয়ে হচ্ছে just একটা সামাজিক চুক্তি। বিয়ে কোন স্থায়ী বিষয় না। স্ত্রী চাইলেও স্বামীকে যে কোন সময় তালাক দিতে পারবে।
মেয়েদের সাথেভাল ব্যবহার করার কথা খোদ আল কোরআনেই বলা হয়েছে। “ তোমরা নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতঃপর, যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ তোমাদের জন্য অনেক কল্যাণ রেখেছেন। ” [সুরা আন-নিসাঃ ১৯] আল কোরআনে স্বামী স্ত্রী একজন আরেকজনকে পোশাকের ন্যায় তুলনা করা হয়েছে। “তারা তোমাদের পরিচ্ছদ আর তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। ” [ সূরা বাকারা- ১৮৭ ] তোমরা প্রফুল্ল চিত্তে স্ত্রীদের মোহরানা দিয়ে দাও।’ [নিসা : ৪]
আচ্ছা আপনারা কি কখনই কোন হাদিসে পেয়েছেন যে যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের কে বলেছে যে তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের কে মাইরধর কর ? বা এমন কি কোন বর্ননা পেয়েছন যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখন উম্মুল মুমেনীনদের গাঁয়ে হাত তুলেছেন ? বা এমন কি কোন বর্ননা পাওয়া যায় যে কোন মহিলা সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে অভিযোগ করেছে যে আমার স্বামী আমার গাঁয়ে হাত তুলেছে ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ৪ কন্যা ছিল। হযরত যয়নব, হযরত রুকাইয়া, হযরত উমমে কুলসুম ও ফাতেমা রযিয়াল্লাহু আনহা। কই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই ৪ কন্যা তো কখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এমন কোন অভিযোগ করে নি যে উনাদের স্বামীরা কখনো উনাদের গায়ে হাত তুলেছে। হাদিস শরীফেও স্ত্রীর সাথে সৎ ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।” তিরমিযীঃ ১১৬২; হাদীস সহীহ, সিলসিলাহ ছহীহাহঃ ২৮৪। ] “শুধুমাত্র সম্মানিত লোকেরাই নারীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করে। আর যারা অসম্মানিত, নারীদের প্রতি তাদের আচরণও হয় অসম্মানজনক।” সুনানে আত-তিরমিযী। ফিকাহ শাস্ত্রের কোথাও কি লেখা আছে যে ইসলামে বলেছে স্বামী যেন স্ত্রীর গাঁয়ে আঘাত করে ? তাইলে নাস্তিকদের এই স্ত্রীকে মাইরধর করার বিষয় টা নিয়ে এত আগ্রহ কেন ? আর আপনারা কখনই কি কোন নাস্তিককে দেখেছেন সূরা নিসার ১১,১২, ১৭৬ নং আয়াত নিয়ে আলোচনা করতে ? নাস্তিকরা কিন্তু কখনই সূরা নিসার ১১,১২, ১৭৬ নং আয়াতগুলি নিয়ে কোন আলোচনা করবে না কারন কোরআনের এইসব আয়াতে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা মেয়েরা তার বাপ মা স্বামী পুত্রের কতটুকু সম্পত্তি পাবে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

শুধু তাই নয় জোর করে কোন মেয়েকে বিয়ে করাও ইসলামে হারাম। আল কোরআনের সূরা নিসার ১৯ নাম্বার আয়াতেই বলা হয়েছে যে -“ হে ঈমানদারগণ ! বলপূর্বক নারীদের কে উত্তরাধিকারীরুপে গ্রহণ করা তোমাদের জন্য হালাল নয় এবং তাদের কে আটকিয়ে রেখো না। আবার এই আয়াতেই বলা হয়েছে যে- “ নারীদের সাথে তোমরা সদ্ভাবে জীবন যাপন কর।’’ অর্থ্যাৎ স্ত্রীদের সাথে যে সদ্ভাবে জীবন যাপন করতে হবে এই কথা কোরআনেই বলা আছে