Sunday, October 1, 2017

কৃষিকেন্দ্রিক আদিম জাদুবিশ্বাস : নারী ও দেবী

ইসলামকে পচানোর জন্য নাস্তিকেরা প্রায়ই বলে থাকে যে ইসলাম নারীকে শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করেছে। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টিকে নারী অবমাননা মনে হলেও যদি এই কথার উৎস বা কেন এক ধরনের কথা বলা হয়েছিল, সেটা খুঁজে দেখার চেষ্টা করা হয়, তাহলে ধর্মের উৎপত্তি বিষয়ক একটি দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। সত্যি বলতে এই কথা ইসলামেই প্রথম নয়; হিন্দুধর্মে আরো অনেক আগেই বলা আছে। সেভাবে খুঁজলে হয়তো প্রায় সকল ধর্মেই বা সকল সমাজের গোড়াতেই, বিশেষ করে কৃষিকে কেন্দ্র করে যে লোকায়ত সমাজ বা সভ্যতা গড়ে উঠেছিলে, এই ধরনের কোনো না কোনো কথা পাওয়া যাবে।
২)
কৃষিকাজ নারীদের আবিষ্কার–এটা আর নতুন করে ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। প্যাট আর চ্যাট–অর্থাত খাদ্য–জীবনধারণ আর বংশরক্ষা–এই তো দুনিয়া! বাঁচার তাগিদেই মানুষ একসময় একত্রে বসবাস শুরু করে, অস্তিত্ব বজায় রাখতে মৃত্যুহারের সাথে পাল্লা দিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়। আর সেই সাথে খাদ্যের জোগান। মেয়েরা কৃষিকাজ আবিষ্কার করে ফেললে পরে খাদ্যের চাহিদা মিটতে শুরু করল। তখন তারা নজর দিল জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিকে।
তো সভ্যতাকে সামনে এগিয়ে নিতে এই খাদ্য উৎপাদন আর জনসংখ্যা বৃদ্ধি–দুইটি কাজেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল জমি ও গর্ভের উর্বরতা। সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা এবং শস্য ফলানোর পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য নারীরা হয়ে উঠল গুরুত্বপূর্ণ, এবং লাভ করল দেবীর আসন। তবে সন্তান উৎপাদনের রহস্যটা অনেক আগে থেকেই মানুষের জানা এবং তাতে নিশ্চয়তা ছিল–নারীকে রাজী করানো, আয়ত্বে আনা, সঙ্গম, গর্ভধারণ–এসব জানা ছিল। কিন্তু শস্য উৎপাদনের বিষয়টায় কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। জমির উর্বরতা, সেই সাথে প্রকৃতির আশীর্বাদ–রোদ-বৃষ্টি–এগুলো মানুষের হাতে ছিল না। এই প্রকৃতিকে আয়ত্বে আনার ইচ্ছা থেকেই কৃষিকেন্দ্রিক আদিম জাদুবিশ্বাসের জন্ম।
“কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাসের মূল কথাটা কী? মানবীয় প্রজননের সাহায্যে বা সংস্পর্শে প্রকৃতির উৎপাদনকে আয়ত্তে আনবার পরিকল্পনা।”–বলেছেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
৩)
এই বিশ্বাস নিয়ে বিস্তারিত বলতে গিয়ে ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তন্ত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন।
“তান্ত্রিকযোগসাধনার আলোচনা থেকে স্বভাবতই দেহতত্ত্বের আলোচনায় গিয়ে পড়তে হয়। লোকায়তরউৎস সন্ধানে এই দেহতত্ত্বের আলোচনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। …মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লোকায়তিকের সঙ্গে তান্ত্রিক বা কাপালিকাদির যে যোগাযোগের প্রতি আমাদের দৃষ্টিআকর্ষণ করেছেন, তার ভিত্তি বলতে শুধুমাত্র এইটুকুই নয় যে, পুরোনো পুঁথিপত্রে উভয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক স্বীকৃত হয়েছে। তাছাড়াও, দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকেও লোকায়তিকও তান্ত্রিকাদি ধ্যানধারণার মধ্যে যোগাযোগটা অস্পষ্ট নয়। লোকায়ত বলতে বোঝায় বস্তুবাদ, দেহাত্মবাদ; অর্থাৎ কিনা, আত্মা নেই, ঈশ্বর নেই, পরকাল নেই, পরলোক নেই, দেহই হলো চরম ও সার সত্য। আবার, দেহবাদই হলো তান্ত্রিকাদি বিশ্বাসের প্রাণবস্তু,—যদিও অবশ্যই আধুনিক বিদ্বানের আধুনিক ধ্যানধারণার প্রভাবে ওই দেহতত্ত্বের উপর বস্তুবাদ-বিরোধী —এবং অতএব বিজাতীয়—আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণা আরোপ করে বিষয়টিকে কৃত্রিমভাবে রহস্যময় করে তুলেছেন।”
লোকায়ত দর্শন-এর ‘তন্ত্রের দেহতত্ব’ অধ্যায়ে আরো কিছু কথা আছে–
‘দেহতত্ত্বের মূল কথা : যাহা আছে দেহভাণ্ডে, তাহাই আছে ব্ৰহ্মাণ্ডে। অর্থাৎ, “ব্ৰহ্মাণ্ডে যে গুণাঃ সন্তি তে তিষ্ঠন্তি কলেবরে”। ইহাই সকল তন্ত্রের সিদ্ধান্ত।… স্বভাবতই, এই তত্ত্বের দিক থেকে বিশ্বের উৎপত্তিকেও মানবীয় সন্তান উৎপত্তির অনুরূপ হিসেবেই কল্পনা করা হয়েছে : তন্ত্রমতে পুরুষ ও প্রকৃতির আদি-মৈথুন থেকেই বিশ্বের উৎপত্তি।…
পুরাণে হরগৌরীর কৃষ্ণরাধিকার যে-সব লীলা উপাখ্যানের আকারে বর্ণিত আছে, তাহা দেহগত স্ত্রীত্ব এবং পুংস্তের নানা লীলার বাহ্যিক অভিব্যঞ্জনা মাত্র। এই দেহতেই কৈলাস, এই দেহতেই হিমালয়,—এ দেহতেই বৃন্দাবন, এই দেহতেই গোবর্ধন; এই দেহাভ্যন্তরেই হরগৌরী বা কৃষ্ণরাধিকা নানা লীলানাট্য প্রকাশ করিতেছে…’
[তন্ত্র অনার্যদের তত্ত্ব। এই তন্ত্রেরই একটা ধারা হলো বৈষ্ণবমত। কৃষ্ণ বৈষ্ণব ছিলেন। তাহলে কৃষ্ণ অর্জনকে যে বিশ্বরূপ দর্শন করাইছিলেন, সেটা তাহলে এই দেহতত্ত্বের রূপক?!]
৪)
যা হোক, দেবীপ্রসাদ তারপর বলেছেন–
“কৃষিকেন্দ্রিক আদিম জাদুবিশ্বাস থেকেই যদি তন্ত্রের সৃষ্টিতত্ত্ব ও দেহতত্ত্বের উদ্ভব হয়ে থাকে,— তাহলে ওই সৃষ্টিতত্ত্ব ও দেহতত্ত্বের অনুরূপ চিন্তাধারার পরিচয় অন্যান্য কৃষিভিত্তিক সভ্যতার ক্ষেত্রেও খুঁজে পাওয়া উচিত। এবং তা পাওয়া যায়ও।…”
এরপর তিনি এই কৃষিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ট্রাইব্যাল সমাজের কিছু বিশ্বাস ও রীতিনীতি তুলে ধরেছেন–
“নিকরগুয়া বলে রেড-ইণ্ডিয়ানরা বীজ বোনবার সময়থেকে ফসল কাটার দিনটি পর্যন্ত সুকঠিন ব্রহ্মচর্য পালন করে; পুরুষেরা স্ত্রীদের সঙ্গে এক বাড়িতে রাত্রি যাপনকরে না, নুন বা তাড়ি খায় না—এককথায়, স্পানিস ঐতিহাসিক যেমন বলছেন, এই সময়টিতে তাদের কঠিন আত্মসংযমের পালা। আধুনিক যুগ পর্যন্ত মধ্য-আমেরিকারকোনো কোনো রেড-ইণ্ডিয়ান ট্রাইবকে শস্য বৃদ্ধির কামনায় ব্ৰহ্মচর্য পালন করতে দেখা গিয়েছে। কেকচি-জাতির মধ্যে বীজবপন প্রসঙ্গে পাঁচদিন এবং অন্য কোনো কোনো জাতির মধ্যে তেরো দিন কঠোর সংযম পালনের নিয়ম। হাঙ্গেরিতেও একই নিয়ম চোখে পড়ে : কৃষকদের বিশ্বাস এভাবে সংযম পালন না করলে শস্য দুর্বল হবে। মধ্য-অস্ট্রেলিয়ায়কাইটিস নামের ট্রাইবের মধ্যে প্রথা হলো, শস্য-বৃদ্ধি কামনায় মোড়ল যতোদিন জাদুআনুষ্ঠান চালাবে ততোদিন পর্যন্ত সে স্ত্রী-সংসর্গ করবে না; তার বিশ্বাস এই নিয়মটি ভঙ্গ হলে বীজ থেকে ঘাসউৎপন্ন হওয়া বন্ধ হবে।”
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, মানুষ এই কৃষি এবং শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়াটিকে সন্তান উৎপাদনের সাথে এক করে দেখছে। সন্তান-উৎপাদনের রহস্য আর শস্য-উৎপাদনের রহস্য এক হয়ে গিয়েছিল আদিম মানুষের কাছে। অর্থাৎ শস্য উৎপাদন = প্রজনন প্রক্রিয়া। লাঙ্গল = লিঙ্গ। ক্ষেত্র বা জমি = যোনি বা গর্ভ। বীজ = বীর্য। (এখানে উল্লেখ্য–লাঙ্গল, লিঙ্গ–শব্দ দুইটি একই ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে।) অর্থাৎ যেভাবে মায়ের থেকে সন্তানের জন্ম হয়, ঠিক একই ভাবে ভূমি কর্ষণ করে শস্য উৎপাদন সম্ভব, তাই ভূমিও মা। পৃথিবীকে আজও মানুষ ‘মাদার আর্থ’ বলেই সম্মান করে।
উপরে দেখেছি–“লোকায়ত বলতে বোঝায় বস্তুবাদ, দেহাত্মবাদ; অর্থাৎ কিনা, আত্মা নেই, ঈশ্বর নেই, পরকাল নেই, পরলোক নেই, দেহই হলো চরম ও সার সত্য। আবার, দেহবাদই হলো তান্ত্রিকাদি বিশ্বাসের প্রাণবস্তু।” আবার তান্ত্রিক সাহিত্যে কোথাও নারী না পেলে বোন বা মায়ের সাথে সাধনা করার কথা আছে। কেন আছে? সভ্যতার চাকা চালু রাখতে পুরাই বাস্তব চিন্তাভাবনা। এই চিন্তাভাবনা থেকেই প্রাচীন মিশরে ভাই-বোনের বিয়ে হত। আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে হাওয়ার সাথে তার সন্তানের বা ভাই-বোনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির ইঙ্গিত আছে, হিন্দুধর্মে সৃষ্টিকর্তার সাথে নিজ মেয়ের সঙ্গমের ইঙ্গিত আছে। [দেবীপ্রসাদ বলেন, “প্রাচীন বিশ্বাসের সঙ্গে আধুনিক জ্ঞানের অনেক তফাত।” তাই এখন আর এ ধরনের কাহিনীতে বা ইঙ্গিতে অবাক হই না। বরং এসব চিন্তাভাবনা বা বিশ্বাসটা কিভাবে এলো সেটা প্রাচীন মানুষের চিন্তাভাবনা, অবস্থার প্রেক্ষাপটে বোঝার চেষ্টা করছি।]
৫)
আগেই বলেছিলাম যে, কৃষিভিত্তিক সমাজে নারীরা লাভ করল দেবীর আসন। পুরুষতান্ত্রিক বৈদিক সাহিত্যে নারীর তুলনায় পুরুষ দেবতার সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু কৃষিকে কেন্দ্র করে যে হরপ্পা-মহেনজোদারো সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেখানে দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে অনেক বেশি। কৃষিকেন্দ্রিক বিভিন্ন সভ্যতায় দেবীদের প্রাধান্য দেখা যায়। যেমন, সিরিয়ায় অস্টারটি দেবী, এশিয়া-মাইনরে সিবেলি দেবী, মিশরে আইসিস দেবী, এবং একই ভাবে অনার্য ভারতীয় সমাজে শাক্তমতবাদ–কালী দেবী। আবার এই কালীই হলেন দেবী দুর্গা। দুর্গার আবার সরাসরি কিছু কৃষিকেন্দ্রিক দেবীর রূপ আছে–অন্নপূর্ণা (খাদ্যের দেবী), লক্ষ্মী (শস্যের দেবী)। একই ভাবে যদি ইসলামপূর্ব আরবে যান, সেখানেও চান্দ্রদেবতা হুবাল অর্থাৎ আল্যার তিন কন্যার একজনকে দেখবেন শস্য হাতে। অর্থাৎ এরকম সমাজগুলোতে মেয়েরাই কৃষিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখে পরবর্তীতে শস্যদেবীর আসন লাভ করেছিল। গ্রামের দিকে আজো মেয়েরা পুরুষের তেমন কোনো ভূমিকা ছাড়াই বাড়ি সংলগ্ন জমিতে বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি ফলিয়ে থাকে।
৬)
স্ত্রীবাচক শব্দগুলো ঐতিহ্য। তন্ত্রশাস্ত্র পড়েন। লোকায়তিক সংস্কৃতির দিকে তাকান। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে স্ত্রীবাচক শব্দের সংখ্যা বেশি। প্রকৃতি-পুরুষ। এদের কাছে পুরুষের ভূমিকা খুব কম। বাকি সব কিছুই এদের কাছে প্রকৃতি অর্থাৎ নারী। এজন্য এদের তৈরী বেশিরভাগ শব্দ স্ত্রীবাচক। এমনকি পৃথিবী নামক গ্রহটাও প্রায় সকল মানুষের কাছে মাতৃরূপে তথা নারী হিসেবেই ধরা দেয়। এগুলা দেখা নারীবাদীদের ‘অফেন্স’ হওয়ার কিছু নাই। পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাবে এসব নেগেটিভ ভাবে ব্যবহৃত হলেও মূলত এসবই আমাদের ঐতিহ্য এবং অতীত নিদর্শন।
tin-konya