Saturday, December 8, 2018

পঁচিশ হাজার অযোগ্যদের কিছু কথা।

এক যে ছিল রাজা আমরা সকলে তার প্রজা। রাজার রাজত্ব বৈভব ও প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। রাজা মনের আনন্দে রাজ্য পরিচালনা করেন। হঠাৎ রাজার মনে হল মানুষকে শিক্ষিত করার প্রয়োজন আছে, আসলে এত মূর্খ প্রজা থাকলে রাজার হিসাবের কাজ দেখাশোনার বড্ড অসুবিধা, আর অন্য রাজারাও ঠাট্টা তামাশা করেন। তাই রাজা স্থির করলেন শিশু শিক্ষার জন্য বেশ কিছু শিক্ষক নিয়োগ করবেন তাও প্রায় তেতাল্লিশ হাজার। এখন আবার আধুনিক যুগের রাজা তাই পরীক্ষার ও ব্যবস্থা হল। প্রায় ছাব্বিশ লক্ষ পরীক্ষার্থী জোগাড় হল; রাজার তো গর্বে বুক ফুলে যাচ্ছে আমার রাজ্যে এত শিক্ষিত (বেকার)! আমার তো জানায় ছিল না?
আসলে রাজার রাজ্য বিভিন্ন রকম শিল্পে ভরপুর কোথাও মুড়িভাজা শিল্প, কোথাও তেলে ভাজা শিল্প, তোলাবাজি শিল্প, এগুলিই সম্বল; আবার কোথাও আবার ল্যাংচা হাব শিল্প। তাই চতুর্দিকে শিল্পের ছড়াছড়ি। রাজার আবার চিন্তা হয় এই রাজ্যে এত পরীক্ষার্থী অন্য রাজ্যের রাজার কারসাজি নয় তো? যাইহোক শেষ পর্যন্ত দেখা যায় পরীক্ষাতে পাশ করে প্রায় এক লক্ষ দশ হাজার পরীক্ষার্থী। এদের মধ্যে আবার বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। কেউ আছে আগে বড় বড় স্কুল থেকে প্রচুর টাকা খরচ করে কি ভাবে পড়াতে হবে তা শিখে এসেছেন, এদের প্রশিক্ষিত বলা হয়। আদতে এরা ধনী পরিবারের সন্তান। এছাড়া যারা আছে তারা কিন্তু এমনি পড়াতে সক্ষম, তবে বাপের পয়সা নেই তাই বড় বড় স্কুল থেকে বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে আসতে পারেন নি। কিন্তু তুলনা করে দেখলে বোঝা যায় পড়ানোর ক্ষেত্রে গুণগত কোন মৌলিক পার্থক্য নেই!
যাক শুরু হল নিয়োগ প্রক্রিয়া। প্রথমে কিছু প্রশিক্ষিতদের নিয়োগ করা হল, তারপর রাজ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদের নিয়োগ করা হল।এরপর এল আদতে শিক্ষিত ভিখারীদের পালা।রাজার চোখে শিক্ষিত ভিখারীদের বিশেষ কোন মূল্য নেই। তাই কিছু নিয়োগ হল কিন্তু মোট কত নিয়োগ হল এবং কিভাবে নিয়োগ হল তার বিশেষ সদুত্তর নেই? নিন্দুকেরা বলেন -“সবই টাকার খেলা”। আসলে কিছু দিন আগেই রাজা নাকি কোথায় এক জায়গায় বলেছিলেন – আজকাল চার-পাঁচ বছর অন্তর অন্তর বড় বড় যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে রাজা থাকবে কি, থাকবে না তার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। তাই যেমন করেই হোক রাজাকে গদিতে টিকে থাকতেই হবে, তাই তার জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন – সেনাবহিনী, হাতিয়ার সব তৈরী করতে হবে তো?

এই রাজা আবার নিজের আইনের খাতায় লিখে রেখেছেন – সবাইকে সমান সুযোগ দিতে হবে, কারোর প্রতি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কোন বৈষম্য করা যাবে না, রাজার চোখে ‘সকলেই সমান’। কিন্তু প্রশ্ন হল এখানে রাজা কি সকলকে সমান চোখে দেখছেন? ধনী ও দরিদ্র কি সমান সুযোগ পাচ্ছেন? তাহলে রাজার চোখে ‘সকলে সমান’ এই কথাটির কি কোন মূল্য রইল? নিন্দুকেরা বলেন আগে ও রাজা ছিল তার সাঙ্গপাঙ্গারা ও চুরি করত; তবে তারা মাছ চুরি করত আর বর্তমানের রাজার সাঙ্গপাঙ্গারা পুকুর চুরি করে। নিন্দুকেরা বলেন সবই রাজার অঙ্গুলি হেলেনেই ঘটে চলেছে। আসলে ‘দুধের মধ্যে জল, না জলের মধ্যে দুধ’ তা বোঝায় বড় দায়!
রাজা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রায় তেতাল্লিশ হাজার প্রজাকে নিয়োগ করা হবে, কিন্তু তিনি আবার নূতন করে ঘোষণা করলেন- ‘নূতন করে পরীক্ষা নেওয়া হবে এবং পঁচিশ হাজার জনকে নিয়োগ করা হবে’। এই পরীক্ষাতে শুধুমাত্র বড় বড় স্কুল থেকে পড়া প্রশিক্ষিত বাবুদের ছেলেরাই সুযোগ পাবেন। যদিও কিছু গরীবের ছেলে এই সব স্কুল থেকে পড়াশোনা করছে তবে তারা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। হায়রে রাজা! তোমার এ কি বিচার?

তুমিই তো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে তেতাল্লিশ হাজার বেকারকে সুযোগ দেবে কিন্তু এখন তুমিই আবার বলছ, নূতন করে পরীক্ষা দিয়ে পঁচিশ হাজার জনকে নিয়োগ করা হবে। তাহলে কি এই পঁচিশ হাজার পদ রাতারাতি তৈরী হয়ে গেল? না, কি যাদের ন্যায্য সুযোগ পাওয়ার কথা ছিল তাদের সুযোগ দিলেন না? এই পঁচিশ হাজারের মধ্যে যদি দশ থেকে পনেরো হাজার ও শিক্ষিত বেকারদের সুযোগ দেওয়া হত তাহলে অতগুলি গরীব পরিবার বাঁচত। এই গরীব পরিবারের মানুষ গুলিকে ও না খেতে পেয়ে মরতে হত না! আসলে রাজার দৃষ্টিতে গরীব মানুষেরা কি মানুষ নাকি? আসলে এরা মানুষের মত দেখতে এক অদ্ভুত প্রাণী!

তাই তাদের দুঃখ, দুর্দশা, ভালমন্দ দেখার অত সময় রাজার নেই। রাজা আইন করতে পারেন যখন তখন, আসলে যারা ঠান্ডা ঘরে থেকে আইন তৈরী করেন তারা সাধারণ প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা বুঝবে কি করে? তাই আইন বাবুরা আইন করে এই সব প্রশিক্ষণ হীনদের পরীক্ষায় বসার শেষ সুযোগটুকু কেড়ে নিল। সত্যি কথা বলতে কি যারা মানুষই নয় তাদের নিয়ে অত চিন্তা কিসের?
এদের নিয়ে কারোর কোন মাথাব্যথা নেই। রাজ্যে কত গুণীজন, কত মগজধারী মানুষ আছেন, রাজার প্রতিপক্ষরা ও আছেন কিন্তু তাদের মুখে ও টু শব্দটি পর্যন্ত নেই! রাজ্যের যারা খবর সংগ্রহ করেন তারা ও নীরব, চারিদিকে যেন এক শ্মশানের শান্তি! কোন এক প্রতিবাদী শিল্পী ছিল যিনি প্রতি কথায় কথায় প্রতিবাদ করে বলত- প্রজারা শালা মাথা মোটা……..যায় নেচে….। এই সব প্রতিবাদীরা ও রাজার দুধ, ঘি ভক্ষণ করে বিষ ঝেড়ে শান্ত পোষ্যতে পরিণত হয়েছে। তাই কোন প্রতিবাদ প্রতিরোধ নেই, রাজা চলে নিজের খেয়ালে।

তাই এইসব বেকারদের ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে রাজা মোটেই চিন্তিত নয়। এখন প্রশ্ন হল এইসব শিক্ষিত বেকারদের কি হবে? রাজার পারিষদ বর্গরা বলবেন যান বড় বড় স্কুলে মোটা অর্থ খরচ করে ডিগ্রী নিয়ে আসুন। কিন্তু তারপর ও স্বচ্ছভাবে নিয়োগ হবে এই নিশ্চয়তা আছে কি? আসলে যারা দুবেলা দুমুঠো ভাল করে খেতে পায় না তারা আবার ডিগ্রী আনবে কোথা থেকে? এই সব মানুষগুলি অনেক লড়াই করে, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করে শিক্ষাটুকু অর্জন করেছেন।কিন্তু এই শিক্ষার আদেও কি কোন মূল্য আছে? এই শিক্ষিত বেকারদের দুর্নীবিত আত্মকথা শোনার সময় কি রাজামশাইয়ের আছে?
কারোর বৃদ্ধ পিতা মাতা জীবনের শেষ দিন গুনছে, যেন মৃত্যুর আগে নিজের সন্তানদের সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে দেখে যেতে পারেন। কারোর বাড়ির বাবা-মায়ের গভীর অসুখ, অর্থের অভাবে ভাল করে চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না। আশা ছিল ছেলেমেয়ের চাকরি হলে একটু ভাল করে চিকিৎসা করাবেন, কিন্তু তাদের এই স্বপ্ন আর পূরণ হওয়ার নয়! তাদের বিনা চিকিৎসাতেই ছটফট করে মরতে হবে, এটাই ভবিতব্য! কেউ হয়ত তার প্রেয়সীকে কথা দিয়েছিল চাকরিটা পেয়ে গেলেই স্বপ্নের নীড় বাঁধবো কিন্তু শাসকের এই নিষ্ঠুর পরিহাসে তাকে তার প্রিয়তমাকে অন্য জনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হতে হচ্ছে। নিজেকে মনে হচ্ছে পরাজিত ব্যার্থ সৈনিক!

কারোর হয়ত মাথা গোজার ঠাঁই নেই আশা ছিল এবার মাথা গোজার একটা ঠাঁই হবে। কেউ বা স্বপ্ন দেখেছিল বোনের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব সম্পন্ন করবেন ইত্যাদি…। এই সব ছোট ছোট মানুষের পঁচিশ হাজারটি ছোট ছোট স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল রাজার নিষ্ঠুর পরিহাসে। আসলে ছোট ছোট মানুষের ছোট খাটো স্বপ্ন তাদের সামর্থ্য ও অনেক কম তাই অনেকেই ভেঙ্গে পড়েন, অনেকে চরম হতাশা গ্রস্থ হয়ে আবার বলছেন -“মরে গেলেই বুঝি ভাল হত”! তাদের উদ্দেশ্যে বলি- না মরে গেলেই সব সমস্যার সমাধান নয়। যাদের জন্য আজ আপনাদের এই দুরবস্থা তাদের চিনতে শিখুন এবং সঠিক সময় হলে তাদের যোগ্য জবাব দিন। রাজার লাল চোখকে ভয় পাবেন না, নিজের ভিতরের আগুন জ্বালিয়ে রাখুন। নিজের বিবেককে জাগ্রত করুন, রাজার নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে সঠিক সময় যথাযোগ্য জবাব দিন।
সময় মানুষকে একবার হলে ও সুযোগ দেবে যে দিন এই দুর্বল মানুষগুলিই হয়ে উঠবে ভাগ্যবিধাতা, সেদিন আপনার ও তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করুন এবং যোগ্য জবাব দিন। মনে করবেন না আপনি একা, আপনি বন্ধুহীন। আপনি একা নন আপনার সঙ্গে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষ ও তাদের পরিজন। তারাও আপনার সমব্যাথী। আমার ক্ষমতা খুবই সীমিত কিন্তু আমাদের ক্ষমতা অসীম। তাই সংগঠিত হোন ও নিজেদের দাবি আদায়ে সচেষ্ট হোন। রাজা মানুষকে ভাত দিতে পারেন না কিন্তু ধর্মের আফিম দেয় যে আফিম খেয়ে মানুষ বোধ- বুদ্ধিহীন বন্য পশুতে পরিণত হচ্ছে! আসলে এতে প্রজারা নিজেরাই হানাহানিতে লিপ্ত থাকবে এবং শাসনকার্য পরিচালনা সহজ হবে।

জনগণ যত বিছিন্ন হবে রাজার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন তত সুসংগঠিত হবে। তাই রাজা শুরু করেছেন ভাগ কর ও শাসন কর নীতি। তবে কালের নিয়মে কোন নীতিই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।আজ যে রাজার দুর্ভেদ্য দূর্গ গড়ে উঠেছে তার প্রতিটি ইট এই সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষের রক্তবিন্দু দিয়ে গাঁথা! তাই আমরা যদি একটা একটা করে দূর্গের ইট খসিয়ে দিয় তাহলে এই দুর্ভেদ্য দূর্গ ও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। অত্যাচারী শাসক যতই শক্তিশালী হোক না কেন তার ও বিনাশ হয় অতি নিষ্ঠুর ভাবেই। তাই আপনারা জেগে উঠুন ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় অত্যাচারী শাসনের প্রতীক বাস্তিল দূর্গের ও পতন হয়েছিল! আসুন আমরা সকলে ও এই অমানবিক রাজার নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে সংগ্রামি লড়াইয়ের পণ করি। আমাদের যথার্থ আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই স্বৈরাচারী রাজার রাজত্বের দীপ শিখা অস্তমিত হওয়া এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা!