রামায়ন, মহাভারত, গ্রীক পুরান, নর্স পুরান, মিশরীয় পুরান, সুমেরীয় পুরান সহ প্রাচীন পৃথিবীর বিবিধ পৌরাণিক গাঁথায় আমরা পড়েছি অতিকায় রাক্ষসদের লোকগাথা। সেইসব রাক্ষসদের ক্ষুধা নাকি ছিল অসীম। যা খাবার দেওয়া যেতো তাই উদরস্থ করতো। এমনকি হাতের মুঠোয় পুরে বেমালুম টপাটপ গিলে ফেলতো জলজ্যান্ত মানুষ আর বড় বড় গাছপালাকেও। হালের হলিউড চলচ্চিত্রেও আমরা দেখেছি অতিকায় কিংকং, গর্জিলা, ডায়নোসর, কাইজুদের মতো অতিকায় রাক্ষসদের। এইসব পৌরাণিক গাঁথা পাঠ করে এবং চলচ্চিত্র দেখে কিশোরকালে আমাদের মনে উদয় হয়েছে একটি অমোঘ প্রশ্ন, বাস্তবে সত্যিই কি আছে রাক্ষসদের অস্তিত্ব ? বড় হয়ে আমরা বুঝতে পেরেছি না বাস্তব নয় এইসব রাক্ষসদের অস্তিত্ব রয়েছে কেবলমাত্র কাল্পনিক জগতেই। কিন্তু সেই সাথে জানতে পেরেছি আরেকটি মহা সত্য। বাস্তবে প্রাণী জগতে রাক্ষসের অস্তিত্ব না থাকলেও রহস্যময় এই অনন্ত মহাকাশে কিন্তু সত্যিই রয়েছে রাক্ষসের অস্তিত্ব। না চমকে উঠবার কোন কারণ নেই। মহাকাশে অবস্থিত এই সর্বভুক রাক্ষসের নাম কৃষ্ণ গহ্বর। ইংরেজিতে আমরা যাকে ব্ল্যাক হোল নামে। ব্ল্যাক হোল নিয়ে পৃথিবীবাসীর মধ্যে রয়েছে অদম্য কৌতূহল আর নানাবিধ জিজ্ঞাসা। আজকের এই পোস্টে চেষ্টা করা হবে সহজ সরল বাংলা ভাষায় যতদূর সম্ভব তাঁদের সেই কৌতূহল নিরসনের।
কৃষ্ণ গহ্বর কি ?
==========
অনাদি আর অনন্ত এই ব্রহ্মাণ্ডে লুকিয়ে রয়েছে নানাবিধ অজানা রহস্য। সিংহভাগ রহস্যের সমাধান আজও করে উঠতে পারেননি পৃথিবীর তুচ্ছ মানব বৈজ্ঞানিকরা। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় তারই মধ্যে কিছু কিছু রহস্যের সমাধান করতে সফলও হয়েছেন তাঁরা। ব্রহ্মাণ্ডের অজানা আর অমীমাংসিত রহস্যগুলোর মধ্যে আজ সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো কৃষ্ণ গহ্বর অর্থাৎ ব্ল্যাক হোলের রহস্য। কৃষ্ণ গহ্বর জিনিষটা ঠিক কি ? সংক্ষেপে বলতে গেলে অনন্ত এই মহাকাশের কিছু কিছু রহস্যময় স্থানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব আচমকা এতটাই অধিক মাত্রায় বেড়ে যায় যে সেইসব স্থানের নিকটে কোন বস্তু উপস্থিত হলেই রহস্যময় সেই স্থান তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাহায্যে পুরানে বর্ণিত রাক্ষসের ন্যায় নিমেষের মধ্যে গিলে ফেলে সেইসব বস্তুকে। প্রবল সেই মাধ্যাকর্ষণের টান থেকে নিস্তার মেলে এমনকি আলোর গতিরেখাও। আলোকেও গিলে ফেলে সেই স্থান। এইসব রহস্যময় স্থানগুলিকেই পৃথিবীর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোল অর্থাৎ কৃষ্ণ গহ্বর বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি হয় কিভাবে ?
==================
কৃষ্ণ গহ্বর ঠিক কি বস্তু সেটা তো আপনারা জানলেন কিন্তু কিভাবে তৈরি হয় এই কৃষ্ণ গহ্বর তা জানেন কি ? কৃষ্ণ গহ্বরের উপস্থিতির বিষয়ে সর্ব প্রথম মতবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে। তৎকালীন সমাজের আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ থিয়োরির কথা মাথায় রেখে নিজের সেই মতবাদে খুব সহজ সরলভাবে ইংরেজ পাদ্রি জন মিচেল জানিয়েছিলেন যে যদি কোন বিশাল তারকার ভেতরে অবস্থিত যাবতীয় পদার্থ কোন এক ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত করে রেখে দেওয়া যায় তাহলে সেই তারকা রূপান্তরিত হবে এক কৃষ্ণ গহ্বরে। কিন্তু কোন জাদুমন্ত্র বলে এক বিশাল তারকার সমস্ত পদার্থ খুব ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত করে রাখা সম্ভব ? না সেদিন এর বেশি কিছু আর জানাতে পারেননি জন মিচেল।
কিন্তু যত গড়িয়েছে সময়ের চাকা ততই উন্নত হয়েছে বিজ্ঞান, নিত্য নতুন প্রযুক্তি হস্তগত হয়েছে বিজ্ঞানীদের। তাঁরা তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে আরও বিস্তারিতভাবে জানতে পেরেছেন কৃষ্ণ গহ্বরের সৃষ্টির কারণ। আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতানুসারে মহাকাশে যখনই কোন তারকার ভেতরে অবস্থিত হাইড্রোজেন গ্যাস সহ যাবতীয় ইন্ধন আর তেজ নিঃশেষিত হয়ে এসে সেই তারকাটি পৌঁছে যায় ধ্বংস বা মৃত্যুর মুখে তখনই ঘটে যায় সুপারনোভা বিস্ফোরণ। আমরা জানি যে মহাকাশে অবস্থিত একেকটি অতিকায় তারকা বা নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সূর্যের থেকেও অনেকটাই বেশি। এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আরও বৃদ্ধি পায় নক্ষত্রের ভেতরে কেন্দ্রস্থলের দিকে। একটি নক্ষত্র যে সব পদার্থ নিয়ে গঠিত সেইসব পদার্থগুলোকে প্রবলভাবে ভেতরের দিকে টানতে থাকে এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। নক্ষত্রের ভেতরে উপস্থিত হাইড্রোজেন এবং অনান্য জ্বালানি গ্যাসের প্রভাবে আবার নক্ষত্রের অন্দরে সৃষ্টি হয় প্রবল তাপের। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিরোধী হিসেবে কাজ করা এই প্রবল তাপ নক্ষত্রের ভেতর থেকে আসা প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব খর্ব করে নক্ষত্রের পদার্থগুলোকে তাদের মূল স্থানে থাকতে সাহায্য করে।
কিন্তু যত নক্ষত্রের বয়স বৃদ্ধি পায় ততই নক্ষত্রের ভেতরে অবস্থিত হাইড্রোজেন সহ অনান্য জ্বালানি গ্যাস নিঃশেষিত হয়ে আসতে থাকে। একসময় ঘটে সুপারনোভা বিস্ফোরণ। এর ফলে আচমকা একটি নক্ষত্রের যাবতীয় জ্বালানি খতম হয়ে যায়। জ্বালানি খতম হবার সাথে সাথেই বাতাসের অভাবে বেলুন যেমন চুপসে যায়, ঠিক তেমনি নক্ষত্রের কেন্দ্রস্থল থেকে আসা প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে নক্ষত্রের যাবতীয় পদার্থ তার গহ্বরে প্রবেশ করে এক ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে জন্ম দেয় কৃষ্ণ গহ্বরের।
আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে এই ব্রহ্মাণ্ডে অবস্থিত যে কোন বস্তু দ্বারাই নির্মিত হতে পারে কৃষ্ণ গহ্বর। এমনকি থিয়োরি অনুসারে আমার বা আপনার দেহাবশেষ দিয়েও গঠন করা যেতে পারে কৃষ্ণ গহ্বর। শুনে চমকে উঠলেন ? না চমকানোর কোন প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানীদের মতানুসারে প্রত্যেক বস্তুই ভরযুক্ত। যদি কোন বস্তুর সমস্ত ভর সেই বস্তুর Schwarzschild radius এর সীমার মধ্যে সঙ্কুচিত করে পুরে দেওয়া যায় তাহলে সেই বস্তু তৎক্ষণাৎ রূপান্তরিত হবে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরে। আমরা জানি যে একটি গোলক বা বর্তুলকার গোলকের সীমান্তবর্তী স্থান থেকে তার মধ্যবর্তী স্থান পর্যন্ত দূরত্ব একই থাকে। এই দূরত্বকে একটি সরলরেখা দ্বারা যুক্ত করা হলে তাকে ইংরেজিতে বলে radius অর্থাৎ ব্যাসার্ধ। Schwarzschild radius ও অনেকটা এরকমই একটা ব্যাসার্ধ। কিন্তু সাধারণ ব্যাসার্ধ আর Schwarzschild ব্যাসার্ধের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো আমরা যদি কোন বস্তু বা গোলক বা বর্তুলকার গোলকের যাবতীয় ভর তার Schwarzschild ব্যাসার্ধের মধ্যে সঙ্কুচিত করে পুরে দিতে সফল হই তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই বস্তু বা গোলক বা বর্তুলকার গোলক রূপান্তরিত হবে ব্ল্যাক হোলে।
প্রত্যেক বস্তুর Schwarzschild ব্যাসার্ধ ভিন্ন ভিন্ন হয়। এই ব্যাসার্ধ বের করবার জন্য ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী Karl Schwarzschild একটি সূত্র বের করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক কার্ল সুয়ার্সচাইল্ডের সূত্র দ্বারা নির্ণয় করা সূর্যের সুয়ার্সচাইল্ড ব্যাসার্ধ হলো প্রায় ৩ কিলোমিটারের মতো। অর্থাৎ আমরা যদি কোন উপায়ে সূর্যের ভেতরে অবস্থিত যাবতীয় পদার্থ সঙ্কুচিত করে সেইসব পদার্থ ৩ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ যুক্ত কোন বর্তুলকার গোলকের ভেতরে পুরে দিতে সফল হই তাহলে সূর্য পরিণত হবে কৃষ্ণ গহ্বরে। আবার পৃথিবীকে ব্ল্যাক হোলে পরিণত করতে গেলে পৃথিবীর যাবতীয় পদার্থ ৯ মিলিমিটার ব্যাসার্ধ যুক্ত কোন গোলকের মধ্যে পুরে ফেলতে হবে। বাস্তবে পৃথিবী বা সূর্যের সমস্ত পদার্থ এতো ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত করে রাখা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডে অবস্থিত একাধিক সুবিশাল নক্ষত্রের সুয়ার্সচাইল্ড ব্যাসার্ধ সূর্যের সুয়ার্সচাইল্ড ব্যাসার্ধের চেয়ে অনেকটাই বেশি হয় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন তাদের হাইড্রোজেন গ্যাস সহ অনান্য জ্বালানির পরিসমাপ্তি ঘটে তখন আর সেইসব তারকা গুলি নিজেদের আগের মতো তপ্ত বা গরম রাখতে পারে না। এর ফলে সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে আর তারকাগুলির যাবতীয় ভর আর পদার্থ সঙ্কুচিত হয়ে খুবই অল্প পরিসরের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে তারকা গুলিকে ব্ল্যাক হোলে পরিণত করে। মহাকাশ বিজ্ঞানের ভাষায় এই অতি স্বল্প পরিসরকে “সিঙ্গুলারিটি পয়েন্ট” নামে অভিহিত করা হয়েছে।
কৃষ্ণ গহ্বরকে চিহ্নিত করা হয় কিভাবে ?
========================
এই পর্যন্ত পাঠ করে এখন নিশ্চয়ই আপনাদের অনেকের মনের ভেতরে উদিত হয়েছে এক নতুন প্রশ্নের। কৃষ্ণ গহ্বর যদি আলোকেও গিলে ফেলে তাহলে বিজ্ঞানিরা কিভাবে সন্ধান পায় ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতির ? যার অনন্ত আর অফুরান ক্ষুধা থেকে রেহাই মেলে না আলোরও তাহলে কোন জাদুমন্ত্র বলে তাকে শনাক্ত করে পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা আবিষ্কৃত টেলিস্কোপ গুলি ?
যখনই কোন নক্ষত্র কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হয় তখনই তার ঘনত্ব অর্থাৎ “density” infinite অর্থাৎ অসীম হয়ে যায় আর এর ফলে সেই কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সংশ্লিষ্ট কৃষ্ণ গহ্বরটি এক রাক্ষস বা দৈত্যের ন্যায় তার নিকটে অবস্থিত যাবতীয় গ্রহাণুকে মুহূর্তের মধ্যে নিজের দিকে টেনে এনে গিলে ফেলে। এমনকি আলোর গতিরেখারও রেহাই মেলে না কৃষ্ণ গহ্বরের গ্রাস থেকে। কিন্তু তার মানেই এই নয় যে ব্ল্যাক হোলের নিকটে উপস্থিত যাবতীয় গ্রহাণু আর বস্তু কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণের টানে সোজা গিয়ে প্রবেশ করে ব্ল্যাক হোলের ভেতরে। ব্ল্যাক হোলের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সেইসব বস্তুগুলো ব্ল্যাক হোলের মাধ্যাকর্ষণের টানে এক চক্রাকার চাকির ন্যায় কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে এক বিশেষ কক্ষপথ সৃষ্ট করে তিরবেগে ঘুরতে থাকে। এইভাবে প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে একসময় গ্রহাণু আর অনান্য বস্তুরা প্রবেশ করে কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে। এই চক্রাকার চাকিকে বিজ্ঞানের ভাষায় অভিহিত করা হয় Accleration Disk নামে। যখন একসাথে অনেক গ্রহাণু বা বস্তু কোন কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে অবস্থিত এই Accleration Disk বলয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে তখন প্রবল ঘর্ষণ আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে তাদের মধ্যে প্রবল তাপের সৃষ্টি হয়। এই প্রবল তাপের কারনে সেইসব বস্তুগুলি থেকে নির্গত হয় এক ঘন আর অপার্থিব আলোকরশ্মি দ্যুতির বিকিরণ। এর ফলে ব্ল্যাক হোলের নিজস্ব কোন আলোকরেখা না থাকলেও (আলোকে পর্যন্ত গিলে ফেলে ব্ল্যাক হোল) এই আলোকরশ্মি দ্যুতির বিকিরণের সাহায্যেই অনেকটা দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত হ্যাবল বা অন্য কোন শক্তিশালী মহাকাশ দূরবীক্ষণ স্পেস টেলিস্কোপ থেকে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করেন কৃষ্ণ গহ্বরের উপস্থিতি। খ্রিষ্টোফার নোলানের সাইফাই চলচ্চিত্র “ইন্টারস্টেলার” এ এরকমই এক হতভাগ্য গ্রহকে গরগন্তুয়া কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে চক্কর খেতে দেখা গিয়েছিল। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই আলোক রশ্মির দ্যুতিকে কুয়াসার (Quasar) বলা হয়।
এই পর্যন্ত পড়ে অনেকে হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন যে যদি বস্তুগুলোর মধ্যে ঘর্ষণের ফলে আলোকরশ্মির দ্যুতি বিচ্ছুরিত না হতো তাহলে বিজ্ঞানীরা কিভাবে টের পেতেন ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতি ? এর উত্তর হলো মহাসাগরের বুকে কোন নৌকো বা জাহাজকে প্রবলবেগে ঘুরপাক খেতে খেতে কোন বিশেষ একটি দিকে প্রবাহিত হতে দেখে নাবিক বা মাল্লারা যেমন অতি সহজেই বুঝে যান সাগরের বুকে ঘূর্ণির উপস্থিতির কথা ঠিক তেমনি বিজ্ঞানীরাও তাঁদের টেলিস্কোপে যখনই মহাকাশে কোন একটি বিশেষ স্থানকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে অনবরতভাবে প্রবলবেগে ঘুরপাক খেতে দেখবেন কিছু গ্রহাণুকে তখনই তাঁরা বুঝে যাবেন এসব কিছু হচ্ছে সেই স্থানে উপস্থিত প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে আর একমাত্র কৃষ্ণ গহ্বরের দ্বারাই এহেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রাদুর্ভাব ঘটানো সম্ভব।
একটি কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে ঠিক কতকাল দেখা যেতে পারে আলোকরশ্মির দ্যুতি কুয়াসার (Quasar) ?
মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতানুসারে যখন কোন নতুন নক্ষত্রপুঞ্জ বা ছায়াপথের (Galaxy) মধ্যে সৃষ্টি হয় কোন কৃষ্ণ গহ্বরের তখন ক্ষুণ্ণি বৃত্তির জন্য তার চারপাশে মজুদ থাকে প্রচুর পরিমাণে গ্রহাণু আর স্পেস ডেব্রিস। এছাড়া যখন কোন দুটি ভিন্ন ভিন্ন ছায়াপথের মধ্যে আচমকা সংঘর্ষ হয় তখনও অনেক গ্রহ আর নক্ষত্র টুকরো টুকরো হয়ে ব্ল্যাক হোলের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে। এর ফলে সৃষ্ট হয় অপার্থিব আলোকরশ্মির দ্যুতির বিকিরণ কুয়াসার (Quasar)। কিন্তু ছায়াপথ যত প্রাচীন হতে থাকে ততই শেষ হয়ে আসতে থাকে গ্রহাণু আর স্পেস ডেব্রিস বস্তুর সংখ্যা। যখন আর গিলবার মতো কোন বস্তু বা গ্রহাণু উপস্থিত থাকবে না ব্ল্যাক হোলের সম্মুখে তখন হয়তো আর দেখা যাবে না Quasar দ্যুতিও। মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতানুসারে একটি সর্ব বৃহতাকারের সুপার ম্যাসিভ কৃষ্ণ গহ্বর প্রতি বছর আমাদের সূর্যের ভরের সমান ওজনের বস্তু গলাধঃকরণ করে। এর ফলে এইসব সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল তাদের উত্তর আর দক্ষিণ মেরু দিয়ে প্রভূত পরিমাণে এনার্জি অর্থাৎ তেজ উদ্গিরণ করে। মহাকাশ বিজ্ঞানের ভাষায় এই পক্রিয়াকে কসমিক ইজেক্ট নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই কুয়াশার (Quasar) আলোকরশ্মি দ্যুতি বিকিরণকে অনেক মহাকাশ বিজ্ঞানী আবার নতুন ছায়াপথ সৃষ্টির প্রাথমিক পর্ব বলেও অভিহিত করেছেন।
কৃষ্ণ গহ্বর কয় প্রকার ?
==============
আকারগত দিক দিয়ে বিচার করে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণ গহ্বরকে মূলত তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকারের কৃষ্ণ গহ্বরকে Primordial black hole নামে অভিহিত করা হয়। মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতে বিগ ব্যাং মহা-বিস্ফোরণের পর পরই সৃষ্টি হয়েছিল Primordial black hole এর। Primordial black hole আকারে পরমাণুর ন্যায় ক্ষুদ্র হলেও তাদের ভর হিমালয় পর্বতের আকারের ন্যায় বিশাল হয়। মধ্যম আকারের কৃষ্ণ গহ্বরকে Stellar black hole নামে অভিহিত করা হয়। মহাকাশে সবচেয়ে অধিক পরিমাণে দর্শন মেলে এই Stellar black hole এরই। Stellar black hole এর ভর আমাদের সূর্যের ভরের থেকেও কুড়ি গুণ অধিক হয়। কিন্তু ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবার পর তাদের অভ্যন্তরের যাবতীয় পদার্থ মাত্র ১০ মাইল ব্যাসার্ধের বর্তুলকার গোলকের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে থেকে যায়। আবার কিছু কিছু কৃষ্ণ গহ্বর বিশাল আকারের হয়। এদের Super Massive black hole নামে অভিহিত করা হয়। আমাদের সূর্যের আকারের সাথে সাথে আরও দশ লক্ষ তাঁরার আকার একত্রিত হয়ে যতটা ভরের (Mass) সৃষ্টি হবে একটা সুপার ম্যাসিভ কৃষ্ণ গহ্বরের ভর ঠিক ততটাই। কিন্তু কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হবার পর এদের সমস্ত পদার্থ আমাদের সৌর মণ্ডলের ব্যাসরেখার সমান আয়তন যুক্ত বর্তুলকার গোলকের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে থেকে যায়।
মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতানুসারে প্রায় সমস্ত গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের কেন্দ্রস্থলে এরকমই এক সুপার ম্যাসিভ কৃষ্ণ গহ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে।
(পরবর্তী পর্বে আমরা জানবো ব্ল্যাক হোলের নানান অজানা রহস্য, কি হতো যদি আপনি ইন্টারস্টেলার মুভির মহাকাশচারী জোসেফ কুপারের মতো বাস্তবে পাড়ি জমাতেন ব্ল্যাক হোলের দিকে, ব্ল্যাক হোল কি চির অমর নাকি ধ্বংসযোগ্য আর আমাদের সূর্য কি কখনও রূপান্তরিত হতে পারে একটি ব্ল্যাক হোলে)
নিচের প্রথম চিত্রে শিল্পির কল্পনায় Primordial Blackhole, Stellar Blackhole আর Supermassive Sagittarius Blackhole
লেখক: বিরিঞ্চি বন্দ্যোপাধ্যায়।