Saturday, April 10, 2021

আলোর চেয়েও দ্রুত বেগে যাত্রা কি সম্ভব ?---দ্বিতীয় পর্ব।


৩) Theory of Relativity
=================
কোন বস্তুর পক্ষে আলোর চেয়েও দ্রুত গতিবেগ অর্জন করা যে একেবারেই অসম্ভব তার সবচেয়ে বড় প্রমান বরেণ্য বৈজ্ঞানিক অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ মতবাদ সূত্র অর্থাৎ Thoery of Relativity। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ মতবাদ সূত্র অনুসারে যখনই কোন যান বা বস্তুর গতিবেগ বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন গতির সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে সেই যান বা বস্তুর Mass অর্থাৎ ভর। এই পর্যন্ত পড়ে আপনাদের অনেকেই হয়তো বলবেন এটা কি করে সম্ভব ? সব বস্তুর ভর তো অপরিবর্তনশীল। এক্ষেত্রে আপনারা সম্পূর্ণ সঠিক না হলেও কিছুটা সঠিক। যে কোন অচঞ্চল স্থির বস্তুর ক্ষেত্রে তার ভর বা mass সবসময় অপরিবর্তিত থাকে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় Rest Mass। কিন্তু যখনই কোন বস্তু বা মহাকাশযান দ্রুতবেগে চলতে শুরু করবে তখনই আইনস্টাইনের Relativity Mass Equation এর এই ফর্মুলার দ্বারা:
 m = m0/ √(1 − v2/c2)
where m=relativistic mass
m0=rest mass
v=m's velocity
c=constant speed of light in vacuum

সমীকরণ অনুসারে সেই বস্তুর ভর বৃদ্ধি পেতে শুরু করবে। কিন্তু যখনই বস্তু বা যানটি তার চলাচল বন্ধ করে দিয়ে স্থির অচঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে তখনই তার ভর কমে গিয়ে আবার আগের পর্যায়ে ফিরে যাবে। এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে যখনই কোন মহাকাশযানের গতিবেগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করবে তখনই সেই অনুপাতে তার ভরও বৃদ্ধি পেতে শুরু করবে। মহাকাশযানের ভর যত বেশি বৃদ্ধি পাবে তার ঊর্ধ্বমুখী গতিবেগ বজায় রাখার জন্য ইন্ধন বা জ্বালানি শক্তি হিসেবে মহাকাশযান টিকে তত অধিক পরিমাণে এনার্জি সরবরাহ করতে হবে। ক্রমে সেই মহাকাশযান যখন আলোর কাছাকাছি গতিবেগে পৌঁছবে তখন তার ভর এতটাই বৃদ্ধি পাবে যে তখন তার ইন্ধনশক্তির যোগান দেবার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়বে অজুত পরিমানের এনার্জি সরবরাহের। একসাথে প্রায় দশ লাখ পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েও যার কণামাত্র যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। আলোর সমান গতিবেগ অর্জনের জন্য যে অসীম পরিমানের এনার্জি সরবরাহের প্রয়োজন রয়েছে এখনও পর্যন্ত সেই পরিমানের এনার্জি ভাণ্ডারের হদিস মেলেনি পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের নিকটে। পদার্থ বিজ্ঞানীদের মতে ভর যুক্ত কোন বস্তু বা যানের পক্ষে খুব বেশি হলে আলোর গতিবেগের ৯৯.৯৯% গতিবেগ অর্জন করা সম্ভব আর আলোর চেয়েও দ্রুতগতি অর্জন তো শুধুমাত্র কল্প বিজ্ঞানেই সম্ভব।
 
৪) Mass–energy equivalence relation
=============================
আলোর চেয়ে দ্রুতগতি অর্জন যে নেহাতই অবাস্তব চিন্তাভাবনা তার অন্তিম আর সবচেয়ে বড় প্রমান লুকিয়ে রয়েছে মহান বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের Mass–energy equivalence relation সমীকরণের মধ্যে। এই সমীকরণ অধিক জনপ্রিয় E=(MC)2 সমীকরণ নামে। হয়তো সেই স্কুল পড়ার সময় থেকেই আইনস্টাইনের এই বিখ্যাত E=MC2 সমীকরণটি সাথে আপনারা পরিচিত রয়েছেন, কিন্তু আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন না যে এই সমীকরণটি আসলে একটি অর্ধ সমাপ্ত সমীকরণ। আইনস্টাইন তাঁর এই অর্ধ সমাপ্ত সমীকরণটি বানিয়েছেন ভর যুক্ত স্থির আর অচঞ্চল বস্তুদের জন্য। সম্পূর্ণ সমীকরণটি আসলে হলো E2=(MC2)2+(PC)2
এখানে E= Energy
P= Momentum অর্থাৎ গতিবেগ
M= Mass অর্থাৎ ভর
C= Speed of Light অর্থাৎ আলোর গতিবেগ।
 
এই ফর্মুলার সাথে সাযুজ্য রয়েছে Pythagoras theorem এর। আমরা সবাই জানি যে Pythagoras theorem এর ফর্মুলা অনুসারে একটি সমকোণী ত্রিভুজের ক্ষেত্রে Hypotenuse2 = Perpendicular2 + Base2 হয়। এবারে যদি Mass–energy equivalence সমীকরণকে এই পাইথাগোরাস থিওরেমের ফর্মুলা অনুসারে সাজানো হয় তাহলে সমকোণী ত্রিভুজের ক্ষেত্রে তার অতিভুজ (hypotenuse) হবে E, তলা (Base) হবে PC আর উচ্চতা (Height) হবে MC2। এর ফলে আমরা যে সমীকরণটি পাবো সেটা হলো এরকম: E2=(MC2)2+(PC)2।
এখানে E= Energy
P= Momentum অর্থাৎ গতিবেগ
M= Mass অর্থাৎ ভর
C= Speed of Light অর্থাৎ আলোর গতিবেগ

আমরা জানি যে যখন কোন যান বা বস্তু স্থির অবস্থায় থাকে তখন তার মোমেন্টাম শূন্য অর্থাৎ P=0 হয়ে যায়। এর ফলে Mass–energy equivalence সমীকরণটি হবে অনেকটা এরকম
E2=(MC2)2+(PC)2
E2=(MC2)2+(0xC)2
E2=(MC2)2
E=MC2
 
আমরা জানি যে আলোর ফোটন কণা একটি ভর শূন্য পদার্থ অর্থাৎ ফোটন কণার Mass শূন্য হয়। সুতরাং ফোটন কণা সহ যে কোন ভর শূন্য পদার্থের ক্ষেত্রে Mass–energy equivalence সমীকরণটি হবে অনেকটা এরকম
E2=(MC2)2+(PC)2
E2=(0)2+(PC)2
E2=(PC)2
E=PC
অর্থাৎ শুধুমাত্র ভর শূন্য পদার্থ বা বস্তু বা যানের ক্ষেত্রে তার গতিবেগ আলোর গতিবেগের সমান হবে। Mass–energy equivalence সমীকরণ দ্বারা প্রমানিত হয় যে ভর যুক্ত কোন পদার্থ বা যানের পক্ষে কখনোই আলোর সমান গতিবেগ অর্জন করা সম্ভব নয় আর আলোর চেয়েও দ্রুত গতি অর্জন করা শুধুমাত্র কল্প বিজ্ঞানেই সম্ভব।
 
আমরা জানি যে আমরা যখনই কোন দ্রুতগতির যানে সওয়ার হয়ে যাত্রা শুরু করবো তখনই আমাদের উপরে Time Dilation এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে। যানের গতি যত আলোর গতিবেগের কাছাকাছি যেতে শুরু করবে Time Dilation এর প্রভাবে আমাদের সময় পৃথিবীর সময়ের ঘড়ির কাঁটার তুলনায় অনেকটাই ধীর লয়ে প্রবাহিত হতে থাকবে। একই কথা প্রযোজ্য মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ক্ষেত্রেও। মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও যত বৃদ্ধি পেতে থাকবে স্পেস-টাইম দুমড়ে মুচড়ে গিয়ে আমরা তত Time Dilation এর দ্বারা আক্রান্ত হতে থাকবো। ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি গেলে আমাদের সময় পৃথিবীর সময়ের তুলনায় অনেকটাই ধীর গতিতে প্রবাহিত হবে। কিন্তু আমরা কি কখনও আলোক কণার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভেবে দেখেছি আলোর ক্ষেত্রে এর কি প্রভাব পড়বে ?
 
আপনি যদি আলোর ফোটন কণা হতেন তাহলে এই অভূতপূর্ব গতিবেগে যাত্রা করার ফলে সময়ের কাঁটা আপনার জন্য প্রায় সম্পূর্ণ রূপে স্তব্ধ হয়ে স্থির হয়ে যেতো আর এর ফলে হ্রাস পেয়ে অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়ে যেতো দূরত্ব। এর ফলে একটি আলোক কণার রেখা হিসেবে আপনি যখন ৮০০ আলোকবর্ষ দূরবর্তী অন্য কোন নক্ষত্র থেকে যাত্রা শুরু করে পৃথিবীতে এসে উপস্থিত হতেন তখন পৃথিবীর সময়ের হিসেবে ৮০০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও আপনার অর্থাৎ আলোক কণার হিসেবে কিন্তু অতিবাহিত হতো মাত্র কয়েক মুহূর্ত সময়।
 
জন টিটর আর মহাভারতের টাইম ট্রাভেলের রহস্য
====================================
তাহলে টাইম ট্রাভেল করে কি কখনও অতীতকালে যাত্রা করা আদৌ সম্ভব নয় ? তাহলে আসলে কে ছিল রহস্যময় ব্যক্তি জন টিটর ? তখন ২০০০ সালের অন্তিম ভাগ। সবেমাত্র মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পথ চলতে শুরু করেছে ইন্টারনেট পরিষেবা। এমন সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট জাত একটি অনলাইন বুলেটিন বোর্ডের Time Travel Institute Forum এর আলোচনা সভায় এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি নিজেকে জন টিটর নামে পরিচয় দিয়ে জানান যে তিনি নাকি ভবিষ্যতের ২০৩৬ সাল থেকে আগত মার্কিন সেনাবাহিনীর এক সামরিক টাইম ট্রাভেলার। জন টিটর দাবি করেছিলেন যে তিনি তাঁর সময়কালে মার্কিন মেরিন্সের অন্তর্ভুক্ত এক সেনা অফিসার। ব্যাক টু ফিউচার মুভি সিরিজে দেখানো পুরাতন ডিলোরিয়ান টাইম মেশিনের মডেল অনুকরণ করে তিনি C-204 সাঙ্কেতিক নামধারি এক ক্ষুদ্র টাইম মেশিনকে তাঁর গাড়ির ইঞ্জিনের সাথে সংযুক্ত করে গাড়ির সাহায্যে সময় যাত্রা করেছেন। টিটরের দাবি অনুযায়ী তাঁর টাইম মেশিনের চালক নিজের ইচ্ছামতো অতীত আর ভবিষ্যতকালে যাত্রা করতে সক্ষম। তাঁর টাইম মেশিনের ভেতরে অবস্থিত দুটো মাইক্রো সিঙ্গুলারটি চিপের সাহায্যে ঋণাত্মক মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অর্থাৎ Negetive gravitational pool কাজে লাগিয়ে তিনি ২০৩৬ সাল থেকে সময় যাত্রা করে প্রথমে এসেছিলেন ১৯৭৫ সালে তৎকালীন যুগের প্রচলিত IBM 5100 মডেলের একটি কম্পিউটার সংগ্রহ করবার জন্য। ১৯৭৫ সাল থেকে নিজের সময়কালে প্রত্যাবর্তন করবার সময় বিখ্যাত Y2K সমস্যা দূর করে তৎকালীন মানবজাতিকে সাহায্য করবার অভিপ্রায়ে তিনি উপস্থিত হয়েছেন ২০০০ সালে। তিনি আরও দাবি করেছিলেন যে তাঁর টাইম মেশিনে ভ্রমণকারী সময় যাত্রী আর টাইম মেশিনকে একসূত্রে বেঁধে রেখে অতীত আর ভবিষ্যৎকালে যাতায়াতের সুবিধার জন্য Gravity Sensor ও সংযুক্ত করা রয়েছে। ২০০১ সালের ২৪শে মার্চ আচমকা অদ্ভুতভাবে গায়েব হয়ে যান জন টিটর। এখন প্রশ্ন হচ্ছে পদার্থ বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র অনুসারে টাইম ট্রাভেল যদি অসম্ভব হয় তাহলে জন টিটর কিভাবে ২০৩৬ সাল থেকে ২০০০ সালে এলেন ? তাহলে কি জন টিটর আসলে একজন জুমলাবাজ ফেকু ব্যক্তি, যিনি নিজেকে সময় যাত্রীর মিথ্যা পরিচয়ে ভূষিত করে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভ করতে চাইছিলেন ? জন টিটর যদি একজন ফেকুই হবেন তাহলে ২০০১ সালে হটাৎ গায়েব হয়ে কোথায় গেলেন তিনি ? নাকি আসলে জন টিটর নামে আদৌ কোন ব্যক্তির অস্তিত্বই ছিল না, সবই তৎকালীন মার্কিন মিডিয়ার দ্বারা রচিত মুখরোচক সায়েন্স ফিকশন।
 
অনেকে আবার হয়তো প্রশ্ন করবেন সময় যাত্রা যদি বাস্তবে সম্ভবই হতো তাহলে আমরা কেন আমাদের আশেপাশে ভবিষ্যৎকাল থেকে আগত কোন সময় যাত্রীর দেখা পাই না ? নাকি ভবিষ্যতের সময় যাত্রীরা তাঁদের অত্যাধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সাহায্যে আমাদের আশেপাশেই উপস্থিত রয়েছেন এখনকার দিনের কোন ব্যক্তির মতোই সাধারন রূপ ধারন করে বা tactical camouflage যুক্ত অত্যাধুনিক জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে আলোর ফোটন কণাকে কৃত্তিম উপায়ে নিজেদের শরীরের উপর প্রতিসরণ করিয়ে অদৃশ্য অবস্থায়। মাঝেমধ্যে অদৃশ্য সময় যাত্রীদের উপস্থিতি অনুভূত করেই কি আমরা অশরীরী প্রেতাত্মাদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ি ? টাইম ট্রাভেল কি সত্যি সত্যি সম্ভব ? এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে যা সম্ভব নয় তার সমাধান হয়তো লুকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যৎকালের বিজ্ঞানীদের গবেষণাগারে। এমনকি ইন্টারস্টেলার ছায়াছবিতেও খ্রিষ্টোফার নোলান দেখিয়েছিলেন যে ভবিষ্যৎকালের বিজ্ঞানীরা সেই সময়কার মানবজাতিকে সাহায্য করার জন্য কৃত্তিম উপায়ে নির্মাণ করেছিলেন আমাদের সৌরমণ্ডল থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরের ভিন্ন নক্ষত্রমণ্ডলে দ্রুত যাতায়াতের ওয়ার্মহোলের।
(সমাপ্ত)
প্রথম পর্বের লিঙ্ক: https://www.facebook.com/groups/know.the.universe/permalink/1793184547507700/
লেখকঃ বিরিঞ্চি বন্দ্যোপাধ্যায় 🙏🙏🙏