ঢাকার শহরতলীতে যেসব বাড়ীতে আমার শৈশব কেটেছে সেগুলোকে এখন বোধহয় বস্তি বলা চলে । ফ্লোরে বিছানা করে সারিবদ্ধভাবে শুয়ে দুই রুমে আট-দশজন মানুষ , ওকেশনাল গ্রাম থেকে আসা আত্নীয়সহ । বিছানার পাশেই হাঁড়িপাতিল বাসনকোশন বইপত্র আর একমাত্র ফার্নিচার আলনা । নাহ, সেগুলা নিয়া দুঃখ করতেছি না । ড্যাড ওয়াজ ডুয়িং হিজ বেস্ট ।
ঘটনা হইলো ঐসব বাড়ীতে যখন আপনি থাকবেন তখন আপনার প্রতিবেশীও এরকমই হয়তো এক রুমে তিন চারটা বাচ্চাসহ দম্পতি হয়তো কোনরকমে মাথাগুঁজে আছে । এইসব পাশাপাশি রুমের বয়স্কদের মধ্যে মাঝেমাঝে ঝগড়া লেগে যেতো ধুন্দুমার । হয়তো শিশুদেরই কোন সংঘর্ষের সূত্র ধরে অথবা বড়দের কোন কিছু নিয়ে । বড়দের ভিতর কি নিয়ে লাগতো সেবিষয়ে বিন্দুমাত্র স্মৃতি নাই । অযথা কথা বানিয়ে লাভ কি । স্মৃতিতে আছে কেবল এইসব ঝগড়ার বাইরের পর্ব শেষে ঘরে ফিরে আমার বাপের দেয়া কিছু উপদেশ । কোন এক উদ্ভট কারণে এসমস্ত ঝগড়ায় তিনি ঝগড়ার মাঝখানে হুট করে ঘরে চলে আসতেন, কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে গিয়ে ইংরেজিতে কিছু বলে আসতেন । আর আবার ঘরে ফিরে আমাদের উপদেশ দিতেন, ইংরেজি হইলো আসল জ্ঞান । কারো সাথে ঝগড়া লাগলে দুই লাইন ইংরেজি বলতে পারলে সব ঠান্ডা । ইংরেজি জানা লোকরে সবাই ভয় করে । এই উদ্ভট জ্ঞান সম্ভবত বংশপরম্পরায় পেয়েছিলেন বাপজান । ব্রিটিশ আমলের রেলওয়ে শ্রমিক দাদাজান সম্ভবত ইংরেজি জানা দেশী লোকের কদর দেখেছিলেন অফিশিয়াল সার্কেলে । সেখান থেকে বাপের মধ্যে প্রবাহিত সেই জ্ঞান বাপ চেয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্মে ট্রান্সমিট করে যেতে ।
আফসোস হইলো এতদিনেও বাপের সেই থিওরি প্রয়োগ করার মত ক্ষেত্র আসলো না । তেমন ঝগড়া কখনো বাস্তব জীবনে বাঁধলো না যেখানে কয়েক লাইন ইংরেজির ডান্ডা মেরে প্রতিপক্ষকে ঠান্ডা করে দেয়া যেতো । বাপের সন্তানরা হইলো সব মুখচোরা নির্বিবাদ লোকজন ।
ধানভানতে এই শিবের গীত কেনো ? হোয়াট দ্য ফাক ইজ ইওর পয়েন্ট ।
পয়েন্ট হইলো গাজ্জালি পড়তে গিয়ে মনে হইলো কোন মহাজাগতিক নিয়মে বাপের হাজার বছর পূর্বের ইসলামি দার্শণিক গাজ্জালি যেনো এই টেকনিকই প্রয়োগ করতেন তার একাডেমিক ও দার্শণিক আলোচনায় । গাজ্জালির রচনা ও যুক্তি প্রয়োগের পদ্ধতি অনেকটা সেরকম । নাহ, কয়েক লাইন ইংরেজি বলে প্রতিপক্ষকে ঠান্ডা করে দেয়া না । বরং একটা সামান্য পয়েন্ট প্রতিষ্ঠা করার জন্য গাজ্জালি উদাহরণের পর উদাহরণ, তারপর আরো উদাহরণ এবং তারপর আরো উদাহরণ ছুঁড়তে থাকতেন অটোমেটিক মেশিনগানের মত । আল্লাহর কেরামত বুঝানোর জন্য মশা, মাছি, পোকামাকড়, মানুষের হাত পা নাক মুখ চোখ কান হৃদপিন্ড রক্ত মাংস এমনকি একেকটা ইন্ডিভিজুয়াল হাড্ডি নিয়া পর্যন্ত প্যাঁচাল পাড়তেই থাকনে পাড়তেই থাকেন । তার প্রতিপক্ষ হয়তো চার পাঁচটা উদাহরণের পরই হাল ছেড়ে দিয়ে বরং পালাতে পারলেই যেনো বাঁচি , এই ধরণের মুডে চলে যেতেন ।
গাজ্জালির জীবনের মাস্টারপিস হচ্ছে ইহইয়া উলুম আল দীন । ইহইয়ার শুরু থেকেই গাজ্জালির এই মেশিনগান টেকনিক চোখে পড়ে কর্কশভাবে । গাজ্জালি শুরু করেন জ্ঞান ও জ্ঞানী লোকের কদর নিয়ে । কোরান থেকে, হাদিস থেকে, বুজুর্গদের থেকে, শিক্ষকদের থেকে একের পর এক একের পর এক কোট করতে থাকেন অনর্গল কেবল এই একটা পয়েন্টেই । কিছুদূর পর পড়ার পরেই হাঁপিয়ে উঠি । ওকে , ওকে, আই ফাকিং গেট ইট । গেট টু দ্যা নেক্সট টপিক ফর ফাকস সেইক । আরেকটা ঝামেলা হইলো সিস্টেমেটিক নন-ফিকশন পড়ার কারণে যে অভ্যাস, যেকোন কোটেশনের উৎস, রেফারেন্স , বিশ্বাসযোগ্যতার ক্রসচেক এগুলো করতে গেলে বারবার হোঁচট খেতে হয় । কোরানের যেকোন কোটেশনের সাথে সাথে সুরা আর আয়াতের নাম্বার উল্লেখ করলেও , কোরানের পর থেকেই হাদিস, বুজুর্গদের কথা আর শিক্ষকদের থেকে নেয়া কোটেশনের কোনরকম সোর্স রেফারেন্স নাই । বুজুর্গ আর শিক্ষকদের কথা না হয় চেক না করা গেলো । কিন্তু হাদিসগুলার সোর্স উল্লেখ করলেতো অন্তত ক্রসচেক করা যেতো । গাজ্জালি এই বিষয় এড়িয়ে গেছেন কেবল তার ক্ষমতার জোরে । ইসলামিক দুনিয়ায় গাজ্জালি তখন নিজেই সোর্স, নিজেই রেফারেন্স । সেই ক্ষমতাবলে তিনি তৈরী করে গেছেন অনেকগুলো দেলোয়ার জাহান ঝন্টু হাদিস । ইউ নো, লাইক, বাংলা সিনেমার স্বামীর পায়ের তলে স্ত্রীর বেহেশত । ইহইয়া উলুম আল দীনের শুরুতেই দেখা পাই এমন এক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু হাদিসের । জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে সূদুর চীনে যাও ।
নিজের জীবদ্দশায় উদাহরনের অটোমেটিক মেশিনগান আর খ্যাতি ও ক্ষমতার জোরে মোটামুটি নির্বিঘ্নে পার হয়ে গেলেও , ইহইয়া উলুম আল দিনে ছোট একটা কথা থেকে ইসলামি ধর্মতত্ত ও দর্শণের দুনিয়াতে প্রায় এক হাজার বছরব্যাপী এক তিক্ত মহাযুদ্ধের সূচনা করে যান গাজ্জালি । কথাটি হচ্ছে, এই দুনিয়াদারী এখন যে অবস্থায় আছে এটাই সম্ভাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থা । এর চাইতে ভালো কোন অবস্থা কোনভাবেই হওয়া সম্ভব ছিলো না ।
এই বোল্ড উচ্চারণের মধ্যে সমস্যা অনেক লেভেলের । একেবারে প্রাত্যাহিক পর্যায়ে সমস্যা হচ্ছে দুনিয়াদারীর যে অবস্থা গাজ্জালির সময়ে ছিলো বা এখনো আছে এর মধ্যে প্রতিটা মানুষই চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছে শত রকমের ঝামেলা, অন্যায় , অবিচার, অনর্থক কষ্ট, লাখ লাখ ক্ষুধার্ত শিশু, কোটি কোটি খুন হচ্ছে বিনা অপরাধে, বিনা কারণে । এতকিছু চোখে দেখেও গাজ্জালি কিভাবে বলতে পারেন দুনিয়ার এই অবস্থাই সম্ভাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থা ? একেশ্বরবাদী দুনিয়ায় এই সমস্যা একেশ্বরবাদের সমান পুরনো । প্রাচীন ভালো খারাপ ঝড় বৃষ্টি রোদ খরার আলাদা আলাদা দেবদেবীকে একত্র করে একের ভিতরে অনেক প্যাকেজ ঈশ্বর যখন আসলেন তখনই সমস্যাটা মাথাচাড়া দেয় । পরম দয়ালু আর ন্যায়বান যে আল্লাহ, সেই আল্লাহই কিভাবে পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষিত ও খুন হইতে দেন আরশ থেকে নিজের ফ্যাট এস সামান্য না নড়িয়ে ?
ইসলামের দুনিয়ায় এই সমস্যা সমাধানের প্রথম চেষ্টা চালান মুতাজিলা দার্শণিকরা । তাদের যুক্তি ছিলো দৃশ্যত এসব জঘন্য কার্যকলাপের মধ্যেও আল্লাহর পরম দয়ার সন্ধান পাওয়া সম্ভব । আর এটা সম্ভব মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞান দিয়ে করা বিবেচনাতেই । যে আজ কষ্ট পাচ্ছে তাকে আল্লাহ ডালি ভরে দেবেন পরকালে , ইহকালে একটু কষ্ট দিয়ে আসলে দাম শোধ করে নিচ্ছেন । তারা উদাহরণ হিসাবে নিয়ে আসেন কিছু কষ্ট যেগুলো সহ্য করলে বড় কিছু পাবার আশা থাকে । পরিশ্রমের কষ্ট শেষে ফসল, ফোঁড়া কাটার কষ্টের শেষে রোগমুক্তির আনন্দ , প্রবীনদের মৃত্যুর কষ্টের ফলে নবীনদের জন্য দুনিয়ার অবস্থান ও সুযোগসুবিধা আসা এইসব । আরেকটু নির্লজ্জ উদাহরণ , কষ্টের কারণেই মানুষ কষ্টহীনতার মর্ম বুঝতে পারে । কারো হাত নাই, চোখ নাই । তার দূরাবস্থা দেখে অন্যরা নিজেদের হাত আর চোখের মর্যাদা বুঝতে পারে । হাত আর চোখ দেনেওয়ালা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করতে পারে । এসবের মধ্যে নানানরকমের ফাঁকি আছে । শত শত হাজার হাজার লাখ লাখ কষ্ট যন্ত্রণা অন্যায় অবিচারের উদাহরণ দেয়া সম্ভব যেগুলোর থেকে ভালো কিছু কোনভাবেই মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানের বিবেচনায় দেখা যায় না । আর পরের যে নির্লজ্জ্ব উদাহরণ, তার বিরুদ্ধে আসে অন্ধকে দিয়ে কেনো চোখওয়ালাদের চোখের মর্ম বুঝাতে হবে । যে অন্ধ তার কি দোষ ? সর্বশক্তিমান প্যান গ্যালাকটিক রংবাজ আল্লাহ কেনো মানুষের অন্তরের মধ্যে আপোষে এই চোখ থাকার সুফলের জ্ঞান ঢুকিয়ে দিতে পারলেন না ? কেনো লাখ লাখ অন্ধের দরকার হইলো এইটুক কথা বুঝানোর জন্য । একটা দুইটা হইলেই কি চলতো না ?
মুতাজিলাদের এই নয়ছয় বুঝ দেয়ার কারণে যে আল্লার লুঙ্গিধুতিতে টান পড়ে যাবে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন তাদের দল থেকে বের হয়ে হয়ে যাওয়া আশ’আরি দার্শণিকেরা । যারা সামথিং সামথিং আশ’আরি নামে এক বড় গুরুর চ্যালা । এই ভাঙ্গন এবং আলাদা হয়ে যাওয়া নিয়ে ইসলামি ধর্মতত্বের দুনিয়াতে একটা কাহিনী প্রচলিত আছে । তিন ভাইয়ের গল্প । ঘটনা হইলো মুতাজিলা দার্শণিকরা যখন দুনিয়ার কোন অবিচার ও দুঃখ যন্ত্রণা থেকে ভালো কিছু আসার প্রক্রিয়া দেখাতে পারতেন না তখন তারা তোতাপাখির মত একটা বুলি আওড়াতেন । এই দুঃখ যন্ত্রণার কারণে আল্লাহ পরকালে পুরষ্কার দিবেন । কথিত আছে আশ’আরি স্বয়ং তার মুতাযিলা ওস্তাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন একটা হাইপোথিটিক্যাল তিন ভাই সমস্যা নিয়ে । তিনভাইয়ের একজন বৃদ্ধ বয়সে মারা যায় নেককার বান্দা হিসাবে । সে পায় বেহেশত । আরেকজনও বৃদ্ধ বয়সে মারা যায়, তবে পাপী হিসাবে । সে পাইলো দোযখ । আরেকজন অল্প বয়সে মারা যায় নেক বা পাপের দায়দায়িত্ব নেয়ার বয়সে যাবার আগেই । যেহেতু তার পূণ্যপাপ কিছুই নাই তাই সে বেহেশত দোযখের কিছুই পায় না । এখন এই শিশুবয়সে মারা যাওয়া ভাই আল্লাহর কাছে যদি ফরিয়াদ জানায় যে হে খোদা কেনো তুমি আমাকে শিশুবয়সেই মৃত্যু দিলা ? যদি আমাকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বাঁচতে দিতা তাহলে আমি নেক আমল করে বেহেশতে যেতে পারতাম । আল্লাহ এই শিশুকে কি জবাব দিবেন ? প্রশ্ন রাখেন আশ’আরি , তার ওস্তাদের কাছে । মুতাযিলি ওস্তাদ মুহূর্তের মধ্যে উত্তর দেন, আল্লাহ বলবেন , আমি সবজান্তা, অতীত ভবিষ্যত সবই আমি দেখি । আমি তোমার ভবিষ্যতে দেখেছিলাম যে তুমি বড় পাপী হবা । এজন্য তোমাকে অল্প বয়সেই উঠিয়ে নিয়েছি যাতে দোযখের যন্ত্রণায় পড়তে না হয় তোমাকে । বি গ্রেইটফুল, বিচ । আশ’আরি তখন ফান্দে আটকা পড়া বগা দেখার মত উত্তেজনায় বলেন, তাহলে যে ভাই বৃদ্ধাবস্থায় পাপী হিসাবে মারা গেলো সে কি বলতে পারে না যে হে খোদা কেনো তুমি আমাকে শিশুকালেই উঠায়া নিয়া গেলা না বা দড়ি ফালাইলানা যাতে আমি বেয়ে উঠে যেতে পারতাম ? ফাক বেহেশত, অন্তত দোযখের আগুনের এই নির্মম যন্ত্রণা থেকেতো বাঁচতাম । এই কথার বিপরীতে হতভম্ব হয়ে যান মুতাযিলি ওস্তাদ । কথিত আছে ।
টুটকা ফাটকা ছুতানাতা নিয়ে যারা মেতে থাকেন তেমন ইসলামি চিন্তাবিদরা বিভিন্নভাবে দেখানোর চেষ্টা করেন যে এই তিনভাইয়ের কাহিনী নিয়ে মুতাযিলি গুরুর সাথে আশ’আরির এই বাহাস আসলে বানানো ঘটনা । মিথ । ওয়েল, সেটা এই ধর্মতত্তের আলোচনায় একেবারেই অর্থহীন , পরম্পরাহীন । কারণ এই গল্প সত্য কি মিথ্যা , গল্পের পয়েন্ট সেটা না । গল্পের পয়েন্ট আরো বিস্তারিত । এর দার্শণিক মূল আরো অনেক গভীর । ইসলামের দুনিয়ায় পাপপূণ্য বেহেশত দোযখ এবং কর্মফল যতদিন আছে ততদিন এই প্রশ্ন প্রাসংগিক । কারণ কিছু ভালো লোক বৃদ্ধাবস্থায় মারা যায়, কিছু খারাপ লোক বৃদ্ধাবস্থায় মারা যায় , কিছু শিশু পাপপূণ্যের দায়িত্ব নেয়ার বয়স হবার আগেই মারা যায় । এটা সেই হাজার বছর আগে যেমন সত্য ছিলো এখনও আছে । পাপপূণ্যের হিসাবে যদি বেহেশত দোযখ আর অন্তর্বতী অবস্থার ফলাফল প্রাপ্তি ঠিক হয় তাহলে তিনভাই সমস্যা অত্যন্ত যৌক্তিক সমস্যা । একই দয়ালু আল্লাহ কিছুতেই তিনগোত্রের উপরই একইসাথে দয়ালু এবং ন্যায়বান হতে পারেন না । অন্তত মানুষের যুক্তিবুদ্ধিবিচারের জ্ঞানে কখনোই না ।
আশ’আরি দার্শণিকরা কুড়াল মারতে চান এই শেষের লাইনে । মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানের বিচারের উপর । মুতাযিলি দার্শণিকরা যে বলতেন মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানের বিচারেই আল্লাহর দয়া, ন্যায় ও অন্যান্য সব গুণ বুঝা সম্ভব , সেটা কেবল বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা বাস্তব উদাহরণ দিতে পারতেন বলে সেই আত্নবিশ্বাস থেকেই যে বলতেন, তা নয় । আসলে এরকম না হলে আরো গভীর একটা দার্শণিক সমস্যার তৈরী হয় সেটা তারা জানতেন । যদি মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞান দিয়ে আল্লাহকে বুঝা না যায় তাহলে আল্লাহতে বিশ্বাস করবে কিভাবে মানুষ ? যদি আল্লাহর ব্যাপারে যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানকে শিকেয় তুলতে হয় তাহলে কিভাবে একজন বিশ্বাসী আরেকজন অবিশ্বাসীকে আল্লাহর ব্যাপারে ইমান আনতে বলবে ? এমনকি যদি আল্লাহ যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানের অতীত হয় তাহলে এই আল্লাহ যে আসলে কোন সিক পার্ভার্ট না তার নিশ্চয়তা কি ? সে হয়তো দেখা যাবে সবাইকে বলছে নামায পড় নামায পড় , আর পরকালে গেলে ভিলেনের মত হাসি দিয়ে বলছে এই একটু পাইযলামি করছিলাম তোমাদের সাথে । নামায যারা পড়েছিস তারা সব দোযখে যা । যারা মদসেক্সজুয়াড্রাগ নিয়ে ছিলি তারা বেহেশতে গিয়ে এগুলো নিয়েই থাক ।
আশ’আরি দার্শণিকরা এই সমস্যা নিয়ে অবগত ছিলেন না যে তা নয় । কিন্তু তারা দেখলেন যে এই সমস্যার মুতাযিলি সমাধানে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না । এজন্য আশ’আরিদের সমাধান ছিলো যে মানুষের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানের বিচার দিয়ে আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা ও দয়ালুতার বিচার করা যাবে না । ইন ফ্যাক্ট, ন্যায়পরায়ণতা বা দয়ালুতার যে স্ট্যান্ডার্ড মানুষ তৈরী করে নিয়েছে , এর সাথে আল্লাহকে বাঁধা যাবে না । আল্লাহ যা করেন কেবল তার নিজের ইচ্ছাতেই করেন । তিনি যা ন্যায় বলেন সেটাই ন্যায় । তিনি যেটা অন্যায় বলবেন সেটাই অন্যায় । কালকে ভোরে যদি তিনি বলেন এতদিন যেটা ভালো ছিলো সেটা আজকে থেকে খারাপ আর এতদিন যা খারাপ ছিলো সেটা আজকে থেকে ভালো , তাহলেও মানুষের কিছুই করার থাকবে না মেনে নেয়া ছাড়া । তারা দুনিয়ার দৃশ্যমাণ দুঃখযন্ত্রণাঅন্যায়অবিচার এবং সাথে সাথে আল্লাহর দয়া, নেয়ামত এইগুলার ব্যাখ্যাতে একটা চিপাবুদ্ধি যোগ করেন অবশ্য । চিপাবুদ্ধিটা হচ্ছে আল্লাহ মানুষকে ভালো কিছু দিতে বাধ্য নন বা খারাপ কিছু থেকে বাঁচাতেও বাধ্য নন । দুনিয়াতে আমরা যে ভালো দেখি সেটা আল্লাহ কেবলমাত্র নিজের খেয়ালেই দিয়েছেন । আর যা খারাপ দেখি, ওয়েল, সেগুলোর জন্য , দ্যাট ওল্ড ফাকিং সেইয়িং , আল্লাহ নো’জ বেস্ট ।
এখন গাজ্জালি ছিলেন সেলযুক সুলতান ও তাদের দার্শণিক গুরু ও পরামর্শক নিযাম-উল-মূলকে ভাড়ায় খাটা বুদ্ধিজীবি । তার গডফাদার সেলযুক সুলতান আর নিযাম-উল-মূলকের ছত্রছায়াতেই তার পসার প্রতিপত্তি । নিযামিয়া মাদ্রাসার সেলিব্রেটি শিক্ষক গাজ্জালি । তার গডফাদারদের দার্শণিক অবস্থান, ধর্মতত্ত নিয়ে অবস্থান ছিলো আশ’আরি অবস্থান । হতে পারে এটা সহজ চিপাবুদ্ধি বলে অথবা হতে পারে এছাড়া আল্লাহর ধূতিলুঙ্গি বাঁচানোর অন্য কোন উপায় ছিলো না বলে । লেকচারে বিতর্কে একাডেমিতে গাজ্জালি ছিলেন তাই রূঢ়, কর্কশ, দুর্বার আশ’আরি দার্শণিক ।
কিন্তু অন্য যতকিছুই হোক, গাজ্জালি স্টুপিড ছিলেন, একথা বলা যায় না কোনভাবেই । যুক্তির কঠিন জ্ঞান, দর্শণের চিপাচাপা তার মুখস্ত ছিলো যদিও তিনি দার্শণিকদের ও নিয়মতান্ত্রিক ধর্মতাত্তিকদের উপর বেশ দুর্বার আক্রমণ করেছেন তার লেকচারে ও বিতর্কে ও একাডেমিক লেখায় । গডফাদারদের ফরমায়েশি দার্শণিকতা ও নিজের ভিতরের বুদ্ধিমান চিন্তাবিদের ক্রমাগত অন্তর্গত খোঁচার কারণে তাই গাজ্জালির ভিতর থেকে ভুটভাট নিজের অন্য কথার উল্টো কথা মাঝে মাঝেই বের হয়ে যেতো । নিজের ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে থেকে ও তার সেই অটোমেটিক মেশিনগানের মত উদাহরণের গুলি ঠা ঠা করে মেরে ব্যাক্তিজীবনে পার পেয়ে গেলেও সেইসব অন্তর্গত অসংগতি ধরা পড়তে থাকে পরবর্তীযুগের দার্শণিকদের কাছে । এমনকি ইহইয়া উলুম আল দিনের সেই ছোট কথার কারণে জীবদ্দশাতেও তার তিক্ত বিরোধীতা করেছে এমনকি তার ছাত্রদের কেউ কেউও । আবুবকর আল আরাবি নামে তার এক বিখ্যাত ছাত্র বলেন, আমাদের শেখ আবু হামিদ গাজ্জালি একটা কথা বলেছেন যার জন্য ইরাকের লোকেরা তার সমালোচনা করছে । আল্লাহর কসম, এটা সমালোচনা করার মতই কথা ।
“এই দুনিয়াদারীর এখন যে অবস্থায় আছে এটাই সম্ভাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থা । এর চাইতে ভালো কোন অবস্থা কোনভাবেই হওয়া সম্ভব ছিলো না । ” এই কথাটিতে কি এমন ঝামেলা আছে যে প্রায় সহস্রাব্দ ব্যাপী এক তিক্ত দার্শণিক, ধর্মতাত্তিক যুদ্ধের জন্ম হয়েছিলো এই এক কথাতে ? একটা বড় ঝামেলা ছিলো এ কথার ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে । গাজ্জালির নিজের যুগের ও পরবর্তী যুগের সমালোচকরা এই কথার বিভিন্ন অর্থ করেছেন নিজেরা । এই কথা থেকে যুক্তির পথ ধরে কি কি অনুস্বিদ্ধান্তে যাওয়া যায় সেগুলো তৈরী করেছেন নিজেরা । এইসব অনুস্বিদ্ধান্তগুলোই ছিলো তিক্ত ধর্মতাত্তিক যুদ্ধের মূল কাঁচামাল । গাজ্জালি হয়তো এতকিছু ভেবে বলে নাই, কিন্তু যদি তার কথা থেকে যৌক্তিকভাবে এগিয়েই কোন অনুস্বিদ্ধান্ত পাওয়া যায়, তবে তার দায়ভার গাজ্জালিকে নিতেই হবে ।
মূল যুদ্ধটা দুনিয়ার বর্তমান দুঃখযন্ত্রণাঅন্যায়অবিচারে ভরপুর থাকা সত্বেও কিভাবে এটাকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্ভাব্য অবস্থা বলা যায় তা নিয়ে হয় নাই । মূল যুদ্ধ হয়েছে এই সর্বোচ্চ সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থা তৈরীতে আল্লাহর ভূমিকা নিয়ে । দুনিয়ার এই অবস্থা যদি সম্ভাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থা হয় , তাহলে আখিরাতের দরকার কি ? এটা অবশ্য গাজ্জালি এক ফুৎকারেই উড়িয়ে দেন এই বলে যে দুনিয়া বলতে তিনি দুনিয়া আখিরাত বেহেশত দোযখ কর্মফল সবকিছু মিলিয়েই বলেছেন । ভালো কথা । তাহলে আল্লাহ কি এর চাইতে ভালো কোন দুনিয়া তৈরী করতে পারতেন না ? যদি না পারেন তাতে কি তার ধূতিলুঙ্গির সর্বশক্তিমাণ গিঁটটিতে হ্যাঁচকা টান পড়ে না ? আর যদি এর চাইতেও ভালো কোন দুনিয়া তিনি তৈরী করতে পারতেন কিন্তু করেন নাই তাহলে তো তাকে পরম দয়ালু বলা যায় না কারণ তিনি সবচে ভালোটা এখনো দেন নাই । আবার সেই পুরাতন পরম দয়ালু আর পরম ক্ষমতার ক্যাচাল । নতুন করে আবার মাথাচাড়া দেয় পুরনো সেই সমস্যা । দুনিয়ার এই অবস্থা থেকে ভালো অবস্থার কত রকম সম্ভাবণাতো নিতান্ত গন্ডমূর্খটাও দিতে পারে । যেই চৌদ্দ বছরের কিশোরী তার সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছে সে আজ মারা না গিয়ে সুস্থ্যসবল শিশুর জন্ম দিয়ে , ভালো কাজ করে বেহেশতে গেলে কি এমন ক্ষতি হতো । এমনতো অনেকের ক্ষেত্রেই হচ্ছে । গাজ্জালি সমাধান দেন , সবকিছু সব যদুমদুরামসাম বুঝবে না । আল্লাহর পরম জ্ঞানে নিশ্চয়ই এর মধ্যে ভালোকিছু আছে । এবার সামনে চলে আসে মুতাযিলি দার্শণিকদের সেই আদি সমস্যা । যদুমদুরামসামের যুক্তিবুদ্ধিজ্ঞানে যদি না বুঝা যায় তাহলে যদুমদুরামসাম কোন ভরসায় আল্লাহর আদেশ পালন করবে ?
ততদিনে গাজ্জালির বয়স হয়েছে । এত এত দার্শণিক সমস্যার সমাধান দিতে গিয়ে গাজ্জালি ক্রমাগত পিছলাতে থাকেন রহস্যময়তা ও সূফি দর্শনের গভীরে । এমনকি তার সারাজীবনের দেয়া শিক্ষার বিপরীতে গিয়ে বলতে থাকেন , এত কথা জিগানি ভালো না । সব কথা সবার বুঝন লাগবো না । চুপ থাক । তাকদির বা ভালোমন্দের পূর্বনির্ধারিত হয়ে যাওয়া নিয়ে যাতে কেউ প্রশ্ন না তুলে । কারণ সেটা আল্লাহর একান্ত নিজের ব্যাপার । সাধারণ পাব্লিকের সেটা নিয়া চিন্তা করারও দরকার নাই । সমিস্যা আছে । বুদ্ধিবৃত্তিক সততার লেভেলে নীচে নামতে নামতে গাজ্জালি অতদূর পর্যন্ত চলে যান যে যুক্তি আর বিতর্কের বিপরীতে রুচির দাবী তুলেন । বলেন, সব কিছু বুঝার মত রুচি বা স্বাদ সবার নাই । যাদের আছে তারাই কেবল বুঝবে । এই কথা বললেতো আর প্রতিপক্ষের কিছু বলার থাকে না । এর সাথে যুক্তি দিয়ে মুখোমুখি হওয়ার মত অবস্থা আর নাই ।
অবশ্য ততদিনে নিজাম-উল-মূলক আর গাজ্জালির সবচে দীর্ঘতম গডফাদার পৃষ্ঠপোষক সেলযুক সুলতান মালিক শাহের মৃত্যু হয়েছে । দাপট, ক্ষমতা, সেলিব্রেটি স্ট্যাটাসও ততদিনে পড়তে শুরু করেছে । গাজ্জালি তখন পুরোদস্তুর সুফী । অবশ্য গাজ্জালির পুরো জীবন ও কর্ম একসাথে দেখলে বুঝা যায় তার ক্ষমতাবান, সেলিব্রেটি ও অটোমেটিক মেশিনগান পার্সোনালিটির অন্তরালে যে ক্ষুরধার চিন্তাবিদ ছিলো সেই চিন্তাবিদ শুরু থেকেই আল্লাহ ও তার বিভিন্ন গুনাগুন যেসব মৌলিক সমস্যা সেসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে উপায়ান্তর না দেখে সূফী রহস্যময়তার দিকে চলে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে অনেক আগে থেকেই । সমস্যা ছিলো তখনকার ইসলামি দুনিয়াতে বৃতের বাইরে চিন্তা করার উপায় ছিলো না । কারণ এসব বস্তা বস্তা বস্তাপচা যুক্তি দেয়ার চাইতে সহজ সমাধান ছিলো আল্লাহ বা স্রষ্টার ধারণা ত্যাগ করে বস্তুগত বিজ্ঞানের ভিত্তিতে দুনিয়া দেখা । আমার কেনো যেনো মনে হয়ে এখনকার দুনিয়াতে গাজ্জালি জন্ম নিলে সে পথেই আসতেন । তার যৌবনে একটা সময় স্রষ্টা নিয়ে সন্দেহে পড়েছিলেন সেই ইঙ্গিত ও পাওয়া যায় তার আত্নজীবনীতে ।
এতকিছুর শেষেও গাজ্জালিকে আমি শ্রদ্ধা করি । কারণ দিনশেষে তার ক্ষমতালোভী কপট ও কুতার্কিত সত্তার আড়ালে ছিলো আসলে পরমজ্ঞানপ্রাপ্ত এক চিন্তক । সেই চিন্তকের চিন্তাভাবনা মাঝে মাঝেই ভুটভাট বের হয়ে পড়তো আর সমালোচনার জন্ম দিতো । সেগুলোকে আবার ক্ষতার দাপট ও কুতর্ক দিয়েই চাপা দিতে হতো তাকে । যেমন ইহইয়া উলুম আল দীনের আগে লেখা আল ইকতিসাদ ফি-ইতিকাদ নামের বইয়ের একটা প্যারা ।
“মানুষের জন্য সবচে ভালো হত যদি তার জীবন হতো বেহেশতে দুঃখ শোক ছাড়া । কিন্তু বাস্তবতা যা তাতে, সত্যিকারের বুদ্ধিমান মানুষের সবচে প্রিয় চাওয়া হচ্ছে অস্তিত্বহীনতা । কোন বুদ্ধিমান বলেন, এমন যদি হতো আমি হতাম বিস্মৃত ও চিহ্নহীন, আরেকজন বলেন, আহা, আমার যদি অস্তিত্বই না থাকতো , আরেকজন বলেন, আমি যদি হতাম একটা খড়কূটো, অন্য আরেকন পাখির দিকে চেয়ে বলেন, আহা আমি যদি হতাম ঐ পাখির মত ।
এসব হচ্ছে নবী ও সত্যিকারের বুদ্ধিমান বুজুর্গদের কথা । এদের কেউ কেউ চাইতেন পরিপূর্ণ অস্তিত্বহীনতা আর কেউ কেউ চাইতেন তারা যেনো জড়বস্তু অথবা পশুপাখি হতেন, কারণ তাতে কোন দায়িত্ব থাকতো না । ”
উপরের এই প্যারারও সমালোচনা হয়েছে । কারণ এখানে গাজ্জালি যারা নিজেদের বর্তমান অবস্থার চাইতে ভালো কোন অবস্থা চাইছে তাদের সমর্থণ দিচ্ছেন । অথচ তার শিক্ষায় , বিতর্কে , একাডেমিক লেখায় তিনি এমন লোকদের খোদাদ্রোহীতার অভিযোগ করছিলেন ।
এমনই ছিলো গাজ্জালির ভিতরের মানুষটার অন্তর্দ্বন্দ আর বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকা আত্নার অবস্থা । ইকতিসাদের এই প্যারা দুইটা থেকে বুঝা যায় গাজ্জালি গৌতম বুদ্ধের পরম জ্ঞানের খবর পেয়ে গিয়েছিলেন নিজের ভিতরে । নিজের মত করে । দিনশেষে গাজ্জালি বুঝেছেন যা সমস্ত সত্যিকারের বুদ্ধিমান বুঝতে পারে নিজের ভিতরে নিজের মত করে । শালা দুইন্যাডাই একটা কুত্তার বাচ্চা ।