Friday, March 4, 2016

উম হানী ও নবী মুহাম্মদ (পর্ব-১,২,৩,৪)

(পর্ব-১ ) ভূমিকাঃ-
উম হানী এবং নবী মুহাম্মদের মাঝে পরকীয়া প্রেমের বিষয়ে আলোকপাত করা অত্যন্ত জটিল এবং বিপদজনক। জটিল এই কারণে যে উম হানীর ব্যাপারে আধুনিক ইসলামী পণ্ডিতেরা কোন কিছুই জানাতে চান না। কারণ নবীর জীবনের এই অধ্যায় তেমন আনন্দদায়ক নয়। নবীর শিশু স্ত্রী আয়েশা, পালকপুত্রের স্ত্রী যয়নবের সাথে নবীর বিবাহ, এবং আরও অন্যান্য নারীদের সাথে নবীর যৌন এবং অ-যৌন সম্পর্কের ব্যাপার আজ আমরা বেশ ভাল ভাবেই জানতে পারি। তা সম্ভব হয়েছে আন্তর্জালের অবাধ শক্তির জন্যে। আজকাল এই সব নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে এবং আমরা নবীর জীবনের অনেক অপ্রকাশিত অন্ধকার দিকগুলি অবলোকন করতে পারছি। কিন্তু উম হানীর সাথে যে নবী আজীবন পরকীয়া প্রেম করে গেছেন—অগুনতি স্ত্রী ও যৌন দাসী থাকা সত্যেও—তা নিয়ে আজ পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য কোন প্রবন্ধ লিখা হয় নি। উম হানী ছিলেন নবী মুহাম্মদের প্রথম এবং আজীবন প্রেম। ধরা যায় নবী উম হানীকে মনঃপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন এবং কোন দিন এক মুহূর্তের জন্য উম হানীকে ভুলেন নাই। ইসলামের প্রাচীন এবং নির্ভরযোগ্য উৎস ঘেঁটে এই রচনা লিখা হয়েছে যাতে নবী জীবনের এই উপাখ্যান দীর্ঘ জানা যায়। যেহেতু উম হানীর জীবন এবং নবীর সাথে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে কোন ইসলামী পণ্ডিত ইচ্ছাকৃত ভাবেই তেমন মাথা ঘামাননি তাই অনেক কিছুই অনুমান করে নিতে হয়েছে। জোরালো হাদিস এবং প্রাচীন জীবনীকারদের থেকে জানা তথ্যই হচ্ছে এই অনুমানের ভিত্তি। এই রচনাতে নবী মুহাম্মদের পরকীয়া প্রেমের অনেক প্রশ্নের উত্তর পাঠকেরা হয়ত পাবেন।
এই রচনা লিখা বিপদজনক এই কারণে যে ইসলামি জিহাদিদের কাছে নবীর জীবনের এই গহীন গোপনীয় ব্যাপার খুবই স্পর্শকাতর। যে লেখকই এই উপাখ্যান লিখবে সেই ইসলামী সন্ত্রাসীদের শিকার হবে তা বলা বাহুল্য।
উম হানীর এবং মুহাম্মদের সম্পর্কের সাথে আয়েশা, সওদা, মেরাজ, মক্কা বিজয় এবং আরও কিছু প্রসঙ্গ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। কিছু প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছে—উপায় ছিল না। ইসলামি কিতাবসমূহ যে পুনরাবৃত্তিতে ভরপুর,
উম হানীর পরিচয়
নবী মুহাম্মদ জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা আবদুল্লাহকে হারান। ছয় বছর বয়সে নবীর মাতা আমিনাও মারা যান (ইবনে ইসহাক, পৃঃ ৭৪)। মুহাম্মদের আট বছর বয়স পর্যন্ত উনাকে লালন পালন করেন নবীর পিতামহ আবদুল মুত্তালিব। আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর মুহাম্মদের ভরণ পোষণের ভার ন্যস্ত হয় চাচা আবু তালেবের উপর। আবু তালেব নবীকে নিজের সন্তানের মতই লালন পালন করেন আমৃত্যু পর্যন্ত।
আমরা ইতিহাস থেকে আবু তালিব সম্পর্কে যা জানতে পাই তা হল এই:
আবু তালেব অর্থ হল তালেবের পিতা। আবু তালেবের আপন নাম ছিল আব্‌দ মানাফ। তালেব ছিল তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র। আব্‌দ মানাফের হয়ত অনেক স্ত্রী ছিল, কিন্তু ইসলামের ইতিহাস ঘেঁটে তাঁর দুই স্ত্রীর নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন—
ফাতেমা বিন্‌ত আসাদ। এঁর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন চার পুত্র এবং তিন কন্যা। পুত্ররা হলেন—যথাক্রমে তালিব, আকিল, জাফর এবং আলী। আর কন্যারা হলেন—উম হানী, জুমানা এবং রায়তা (আসমা বিন্‌ত আবু তালেব) (ইবনে সা’দ, খণ্ড ১, পৃঃ ১৩৫)।
আবু তালেবের অপর স্ত্রীর নাম ছিল ইল্লাহ বা এলাহ্‌। উনার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন এক পুত্র, তুলায়ক। এছাড়াও ইল্লাহ্‌র আগের স্বামীর ঔরসে জন্ম গ্রহণ করছিল আর এক পুত্র যার নাম ছিল আল হুয়েরেথ বিন আবু দুবাব (ঐ একই সূত্র)।
ইসলামের ইতিহাসে আব্‌দ মানাফের দুই ছেলে জাফর এবং আলী সম্বন্ধে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু আকিল ও তালেব সম্বদ্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। ইবনে সা’দ লিখেছেন তালেবকে বদর যুদ্ধে জোরপূর্বক যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়। কিন্তু তালেব যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন কি না তা পরিষ্কার নয়। কারণ বদর যুদ্ধে তাঁর মৃত দেহ কেউ পায়নি, আবার তাঁকে জীবিতও কেউ দেখেনি। ধরা যায় তালেব বদর যুদ্ধ থেকে পালিয়ে কোথাও চলে যান। এর পর থেকে আর কেউ তার খবর জানেনা—তালেব চিরকালের জন্য নিখোঁজ হয়ে গেলেন; তার কোন উত্তরসূরিও ছিল না (ইবনে সা’দ, খণ্ড-১, পৃঃ ১৩৫)।
আকিলের ব্যাপারেও কোন তথ্য পাওয়া যায় না। শুধু এইটুকু জানা যায় যে যখন নবী এবং আলী মদিনা চলে যান, আর জাফর যখন আবিসিনিয়ায় নির্বাসিত ছিলেন তখন আকিল আবু তালেবের মৃত্যুর পর সমস্ত পৈত্রিক সম্পত্তি নিজের হাতে নিয়ে নেন। কারণ নবী মুহাম্মদ যখন মক্কা জয় করেন তখন অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন উনি আবু তালেবের গৃহে যাবেন কি না। উত্তরে মুহাম্মদ বলেছিলেন যে ঐ গৃহে যাবার তাঁর কোন ইচ্ছাই নাই—কারণ আকিল তাঁদের জন্য কিছুই রাখে নাই। বলা যায় যে নবী যখন মক্কায় বিজয় পতাকা নিয়ে প্রবেশ করলেন তখন হয়ত আকিল কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এই সময় উম হানী মক্কায় ছিলেন, এবং অনুমান করা যেতে পারে উম হানী তাঁর পিতার ভিটেমাটির দখল পান।
ধরা যায় উম হানী ছিলেন আবু তালেবের জ্যৈষ্ঠ কন্যা। উম হানীর অর্থ হচ্ছে হানীর জননী বা মা। উম হানীর নিজস্ব নাম নিয়ে কিছু অস্পষ্টতা আছে।
ইবনে ইসহাক (পৃঃ ৫৫৭) লিখেছেন উম হানীর নাম ছিল হিন্দ । ইবনে সা’দও (খণ্ড ১, পৃঃ ১৩৫) তাই বলেন।
এদিকে মার্টিন লিঙ্গস্‌ (পৃঃ ১৩৫) লিখেছেন উম হানীর নাম ছিল ফাকিতাহ্‌।সে যাই হোক, ইসলামের ইতিহাসে এই নারী উম হানী হিসাবেই অধিক পরিচিত।
মার্টিন লিঙ্গস্‌ লিখেছেন তালেব এবং নবী প্রায় একই বয়সের ছিলেন। বাল্য বয়সে নবীর সাথে জাফরের বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল। এই সময় মুহাম্মদের বয়স ছিল ১২, আকিলের ১৩ আর জাফরের ৪। উম হানী ছিলেন মুহাম্মদের চাচাত বোন। অনুমান করা যায় উম হানী কিশোর মুহাম্মদের খেলার সাথী ছিলেন। এবং এই সময় মুহাম্মদ উম হানির প্রেমে পড়ে যান (লিঙ্গস্‌, পৃঃ ৩৩)।
যদি আমরা ধরে নেই যে উম হানী ছিলেন আবু তালেবের জ্যৈষ্ঠ কন্যা তখন আমরা অনুমান করে নিতে পারি যে উম হানীর বয়স নবীর বয়সের কাছাকাছি অথবা কিছু অল্প ছিল। অর্থাৎ, ১২ বছর বয়স থেকেই নবী মুহাম্মদ উম হানীর সাথে প্রেমে আবদ্ধ ছিলেন। এই প্রেম শুধু এক তরফা ছিল কি না বলা দায়, তবে এই রচনা সম্পূর্ণ পড়লে অনুমান করা যাবে যে উম হানীরও কিছু সাড়া ছিল মুহাম্মদের এই নিভৃত প্রেমের প্রতি।
হানী কি পুত্র না কন্যা? এই সরল প্রশ্নের উত্তর কোন জীবনীকার সহজ ভাবে দেন নাই। উইকিতে দেখা যায় হানীকে উম হানীর পুত্র বলা হয়েছে। কিন্তু এই তথ্যের কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র নাই। আরবিতে হানী সাধারণতঃ মেয়েদের নাম হয়—তবে পুরুষের নাম হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। যেমন বাঙ্গলাদেশে ‘শামিম’ ছেলে অথবা মেয়ে উভয়ের নাম হতে পারে।
উম হানী কবে মারা যান তার তথ্য ভাল ভাবে পাওয়া যায় না। তবে মুহাম্মদের মৃত্যুর পর উম হানী অনেক দিন জীবিত ছিলেন অনুমান করা যায়।
উম হানীর উপর নবীর আসক্তি
মুহাম্মদের জীবনী পড়লে বুঝা যায় যে উম হানীর প্রভাব মুহাম্মদের জীবনে ছিল অপরিসীম। মুহাম্মদ কোন দিনই উম হানীর প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ভুলেন নাই। আমরা লক্ষ্য করি বাল্য বয়সের সেই প্রেমের উচ্ছ্বাস নবী কোন দিনই দমিয়ে রাখতে পারেন নাই। মুহাম্মদের জীবনী রচয়িতারা উম হানীর সাথে মুহাম্মদের প্রেমের ব্যাপারটা যে ভাবেই হোক এড়িয়ে যেতে চান—যার ফলস্বরূপ নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং প্রচুর আজগুবি কাহিনী প্রচার করেন। মুহাম্মদ ছিলেন রক্ত মাংসের মানুষ। তাঁর মাঝেও ছিল অনেক কামনা বাসনা—ব্যর্থ প্রেমের আকুলতা এবং নিজের রিপু চরিতার্থ করার তীব্র অভিপ্রায়। জীবনীকারের যতই চেষ্টা করুন নবীর এই স্বাভাবিক বাসনাকে ধামা চাপা দিবার—মুহাম্মদ এবং উম হানীর জীবনের অনেক ঘটনার ফাঁক ফোঁকর থেকে অনেক সত্যই আমরা অনুমান করে নিতে পারি।
অনেক ইসলামী পণ্ডিতেরা উম হানীর সাথে নবীর প্রেমের ব্যাপারটা ধামা চাপা দিতে চান এই বলে যে মুহাম্মদ উম হানীকে নিজের ভগিনী হিসাবে জানতেন। প্রেম বলতে আমরা সাধারণভাবে যা বুঝি, অর্থাৎ দেহ এবং মনের সম্পর্ক—তা বিবাহ প্রসূতই হোক অথবা অন্য কোন ভাবে, তা ইসলামী পণ্ডিতেরা কোন ভাবেই স্বীকার করতে চান না। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে মুহাম্মদ চেয়েছিলেন উম হানীকে বিবাহ করে সংসার পাততে। বিবি খদেজার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবার আগে নবী চেয়েছিলেন উম হানীকে নিজের স্ত্রী বানাতে।
মুহাম্মদের জীবনী লেখক রডিন্সন লিখেছেন যে উম হানীকে বিবাহ করার জন্য নবী পিতৃব্য আবু তালেবের কাছে প্রস্তাব দেন। কিন্তু আবু তালেব তা নাকচ করে দেন। এর কারণ কি হতে পারে তা সম্বন্ধে অনেক কিছুই ভাবা যেতে পারে। যতটুকু জানা যায় এই সময় নিরক্ষর মুহাম্মদ ভেড়ার রাখালের কাজ ছাড়া আর কিছু করতেননা বা জানতেননা। হয়ত আবু তালেব চাননি এক ভেড়ার রাখালের সাথে তাঁর কন্যাকে সঁপে দিতে। আবু তালেব বেশ প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন—আমরা ধরে নিতে পারি আবু তালেব উচ্চ শিক্ষিত না হলেও নিরক্ষর ছিলেন না। তাই অনেক ভেবেচিন্তেই উনি হয়ত ঠিক করেছিলেন নিরক্ষর, সহায় সম্বলহীন, বেকার ভাতিজার সাথে উম হানীর বিবাহ শোভা পাবে না।
রডিন্সন লিখেছেন:
মুহাম্মদের সময় কেউ বেশী বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকত না। সেই অনুযায়ী মনে হয় মুহাম্মদের বিবাহের বয়স অনেক পেরিয়ে গিয়েছিল। এর কারণ হয়ত দরিদ্রতা। অনেকে বলেন মুহাম্মদ আবু তালেবের কাছে উম হানীকে বিবাহের প্রস্তাব করলেন। বেদুঈন সমাজে চাচাত, মামাত খালাত, ফুফাতো ভাই অথবা বোনদের সাথে বিবাহ প্রচলিত ছিল। কিন্তু আবু তালেব এই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। এর কারণ হতে পারে যে আবু তালেব চাইছিলেন আরও যোগ্য পাত্রের হাতে কন্যার হাত সমর্পণ করতে। এর বেশ কিছুদিন পরে উম হানী বিধবা হয়ে যান। তখন হয়ত উম হানী চেয়েছিলেন মুহাম্মদ আবার তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মুহাম্মদ এই ব্যাপারে আর আগ্রহী ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে ভাল সম্পর্ক থেকে যায়। যে রাত্রে উনি স্বর্গ ভ্রমণে যান সেই রাত্রে উনি উম হানীর গৃহে ঘুমিয়ে ছিলেন (রডিন্সন, পৃঃ ৪৯)
উম হানীর সাথে এই ভাল সম্পর্ক বলতে কি বুঝায়?
রডিন্সন আরও লিখেছেন:
আরবদের যৌন ক্ষুধা অতিশয় প্রবল। তলমুদ আইনজ্ঞ নাথন বলেছেন আরবদের মাঝে যৌন সম্ভোগের যে প্রবণতা আছে বিশ্বের আর কোন জাতির মাঝে তা নাই। পারস্যের যে বিশাল ক্ষমতার আধার, আর রোমানদের যেই বিশাল বিত্ত অথবা মিশরের যে মায়া ইন্দ্রজাল, আরবদের মাঝে সেই রকম হচ্ছে তাদের যৌন ক্ষুধা। এই আইনজ্ঞ আরও বলেছেন যে বিশ্বের যৌন ক্ষুধাকে দশ ভাগ করলে তার নয় ভাগ পড়বে আরবদের পাল্লায় আর এক ভাগ থাকবে বিশ্বের বাকী জাতিদের মাঝে। (রডিন্সন, পৃঃ ৫৪)
মুহাম্মদ কেন আরবদের মাঝে ব্যতিক্রম হবেন?
এদিকে ইসলামের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক তাবারি লিখেছেন মুহাম্মদ উম হানীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন, কিন্তু উম হানী তা গ্রহণ করলেন না—কারণ উম হানীর সাথে তাঁর শিশু ছিল (খণ্ড ৯, পৃঃ ১৪০)।
এই দুই ঘটনা কিছুটা পরস্পর বিরোধী হলেও আমরা অনুমান করতে পারি যে নবী উম হানীকে হয়ত দুবার বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন—প্রথমবার উম হানীর পিতা আবু তালেবের কাছে। সেই সময় মুহাম্মদ নিজেকে নবী বলে ঘোষণা দেন নাই; অর্থাৎ মুহাম্মদের বয়স অল্প ছিল, খুব সম্ভবত কুড়ি কিম্বা বাইশ। দ্বিতীয় বার উম হানীকে প্রস্তাব দেন আবু তালেবের মৃত্যুর পর, উম হানীর স্বামী যখন নিখোঁজ হয়ে যান (অনেকে, যেমন উপরে রডিন্সন লিখেছেন মারা যান) অথবা মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খদেজার মৃত্যুর পর। মুহাম্মদ নিজেকে নবী বলে ঘোষণা দেন যার ফলে সমগ্র কুরাইশদের বিরাগভাজন হন। এই সময় মুহাম্মদের বয়স সম্ভবত ৫০ অথবা ৫১ হবে। কারণ খদেজা এবং আবু তালেব মারা যাবার অল্প কিছু সময়ের মাঝেই মুহাম্মদ বিধবা সওদাকে বিবাহ করেন আর আাবু বকরকে প্রস্তাব দেন তাঁর কন্যা আয়েশাকে বিবাহ করার। সামান্য সময়ের ব্যবধানেই মুহাম্মদ ছয় বছরের শিশু আয়েশাকে বিবাহ করেন।
অনুমান করা যায় মুহাম্মদের এই দুই বিবাহের ব্যাপারে উম হানী জ্ঞাত ছিলেন। তাই মুহাম্মদ উম হানীকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে উম হানী আর এক সতীন হতে চাইলেন না। উম হানী স্বামী ছাড়া, এক সন্তানের মা হয়ে একা থাকা পছন্দ করলেন। কিন্তু মুহাম্মদের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে কুণ্ঠিত হলেন না। তার প্রমাণ আমরা দেখব নিচের অংশগুলিতে।
খদেজা মারা যাবার পর, উম হানীকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না করতে পারলেও মুহাম্মদ হাল ছেড়ে দিলেন না। আল্লাহ নবীর সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে আসলেন। আল্লা পাঠিয়ে দিলেন আয়াত ৩৩:৫০ যে আয়াতে নবীকে বলা হল উনি ইচ্ছে করলেই উনার যে কোন চাচাত, ফুফাতো, মামাত, খালাত বোনদের সাথে যৌন কর্মে লিপ্ত হতে পারবেন বিবাহ ছাড়াই—শুধু এই হবে যে ঐ বোনদেরকে মদিনায় হিজরত করতে হবে। কিন্তু নবী অত বোকা ছিলেন না। তিনি জানতেন এই আয়াতের প্রতিফল কি হবে তাঁর অনুসারীদের মাঝে। তাই আল্লা তাঁকে জানিয়ে দিলেন যে এই অতি নিকট আত্মীয়দের সাথে বিবাহ বহির্ভূত যৌন-লীলার অনুমতি শুধুমাত্র নবীর জন্যই বহাল থাকবে অন্য মুসলিমদের জন্য নয়।
আমরা আয়াত ৩৩:৫০ পড়ে নেই।
হে নবী। আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেন। আর দাসীদেরকে হালাল করেছি, যাদেরকে আল্লাহ্‌ আপনার করায়ত্ত করে দেন এবং বিবাহের জন্য বৈধ করেছি আপনার চাচাতো ভগ্নি, ফুফাতো ভগ্নি, মামাতো ভগ্নি ও খালাতো ভগ্নিকে যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে। কোন মুমিন নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পণ করে, নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সে—ও হালাল। এটা বিশেষ করে আপনারই জন্য—অন্য মুমিনদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশে। মুমিনগণের স্ত্রী ও দাসীদের ব্যাপারে যা নির্ধারিত করেছি আমার জানা আছে। আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, তাফসীর মাআরেফুল কোরআন)
এই বাঙলা অনুবাদে যে কারচুপি আছে তা পরিষ্কার হয় যখন ইংরাজি অনুবাদ দেখা যায়। আল্লাহ ত সব মুসলিমদের জন্যই তাদের চাচাত, ফুফাতো, খালাত, মামাত বোনদের বিবাহ হালাল করেছেন। কাজেই এই আয়াতে নতুনত্বের কি আছে? দেখা যাক ইংরাজি অনুবাদ:
033.050
YUSUFALI: O Prophet! We have made lawful to thee thy wives to whom thou hast paid their dowers; and those whom thy right hand possesses out of the prisoners of war whom Allah has assigned to thee; and daughters of thy paternal uncles and aunts, and daughters of thy maternal uncles and aunts, who migrated (from Makka) with thee; and any believing woman who dedicates her soul to the Prophet if the Prophet wishes to wed her;- this only for thee, and not for the Believers (at large); We know what We have appointed for them as to their wives and the captives whom their right hands possess;- in order that there should be no difficulty for thee. And Allah is Oft-Forgiving, Most Merciful.
Hilali and Khan
33:50. O Prophet (Muhammad)! Verily, We have made lawful to you your wives, to whom you have paid their Mahr (bridal money given by the husband to his wife at the time of marriage), and those (captives or slaves) whom your right hand possesses whom Allâh has given to you, and the daughters of your ‘Amm (paternal uncles) and the daughters of your ‘Ammah (paternal aunts) and the daughters of your Khâl (maternal uncles) and the daughters of your Khâlah (maternal aunts) who migrated (from Makkah) with you, and a believing woman if she offers herself to the Prophet, and the Prophet wishes to marry her; a privilege for you only, not for the (rest of) the believers. Indeed We know what We have enjoined upon them about their wives and those (captives or slaves) whom their right hands possess, – in order that there should be no difficulty on you. And Allâh is Ever Oft¬Forgiving, Most Merciful.
আয়াত ৩৩:৫০ সম্পর্কে ইবনে কাসীর লিখেছেন:
মহান আল্লাহ বলেন: যারা তোমার সাথে দেশ ত্যাগ করেছে। হযরত উম্মে হানী (রাঃ) বলেন: “আমার কাছে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পয়গাম এলো। আমি আমার অপরাগতা প্রকাশ করলাম। তিনি তা মেনে নিলেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা এই আয়াতটি নাযিল করলেন। আমি তাঁর জন্য বৈধকৃত স্ত্রীদের মধ্যেও ছিলাম না এবং তাঁর সাথে হিজরতকারিদের অন্তর্ভূক্তও না। বরং আমি মক্কা বিজয়ের পর ঈমান এনেছিলাম। আমি ছিলাম আযাদকৃতদের অন্তর্ভূক্ত।“ তাফসীর কারকগণও একথাই বলেছেন। আসল কথা হল যারা মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে হিজরত করেছেন। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর কিরআতে রয়েছে।
এরপর মহামহিমাম্বিত আল্লাহ বলেছেনঃ কোন মুমিনা নারী নবী (সঃ)-এর নিকট নিজেকে নিবেদন করলে এবং নবী (সঃ) তাকে বিয়ে করতে চাইলে সেও বৈধ। এ আদেশ দু’টি শর্তের উপর প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ হে নবী (সঃ)! মুমিনা নারী তোমার জন্য বৈধ যদি সে নিজেকে তোমার নিকট নিবেদন করে যে, তুমি ইচ্ছা করলে তাকে বিনা মহরে বিয়ে করতে পার। (তাফসীর ইবনে কাসীর, পঞ্চদশ খণ্ড, অনুবাদ ডঃ মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত, পৃঃ ৮২৯)
এবার আমরা তিরমিজি শরীফ থেকে একটা হাদীস পড়ব:
উম হানী বিন্‌ত আবু তালেব বর্ণনা করলেন: “আল্লাহর রসুল আমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু আমি উনার কাছে মাফ চাইলাম। উনিও আমাকে আর পীড়াপীড়ি করলেন না। এর পর আল্লাহ (সর্ব্বোচ্চ) নাজেল করলেন (৩৩:৫০) [এইখানে পাঠকেরা উপরে উদ্ধৃত আয়াতটা পড়ে নিতে পারেন]। উনি (উম হানী) বললেন: ‘এটা এই জন্য যে আমি উনার জন্য আইন সঙ্গত ছিলাম না কারণ আমি হিজরত করি নাই। আমি তুলাকাদের মধ্যে একজন ছিলাম ‘।
[পাদটীকা ২। তুলাকার অর্থ হল ঐসব ব্যক্তি যারা মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেছিল] (জামি আত তিরমিজি, খণ্ড ৫, হাদিস নম্বর ৩২১৪, পৃঃ ৫২২; অনুবাদ লেখকের)
এই আয়াতের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা নিম্নলিখিত ধারণা করতে পারি।
খদেজা মারা যাবার পর উম হানীকে মুহাম্মদ বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। উম হানী তা নাকচ করে দিলেন। মুহাম্মদ বিবাহ করলেন সওদাকে আর বগদত্ত হয়ে থাকলেন আবু বকরের ছয় বয়সের শিশু কন্যা আয়েশার সাথে। এর পর মুহাম্মদ মদিনায় হিজরতের আয়োজন করলেন। চাইলেন উম হানীকে সাথে নিতে। তাই উম হানিকে আবার প্রস্তাব দিলেন বিবাহের। উম হানী রাজী হলেন না, হয়ত উম হানী চাননি সতিনদের সাথে মুহাম্মদের সংসারে ঢুকতে। আল্লাহ পাঠিয়ে দিলেন আয়াত ৩৩:৫০। মুহাম্মদ উম হানীকে জানালেন আল্লাহ তাঁকে অনুমতি দিয়েছেন যে চাচাত (অথবা ফুফাতো, মামাত, খালাত) বোন যেই তাঁর সাথে হিজরত করবে তাকে বিবাহ করতে পারবেন। উম হানি বললেন যে তিনি হিজরতে যাবেন না। তাই মুহাম্মদের স্ত্রী হতে পারবেন না।
মুহাম্মদ এবার আর এক কৌশল করলেন। আল্লাহ পাঠিয়ে দিলেন আয়াত ৩৩:৫০-এর বাকী অংশটুকু। মুহাম্মদ উম হানীকে জানালেন যে হিজরত না করলেও অসুবিধা নাই—কারণ আল্লাহ্‌ বলেছেন যে কোন মুসলিম নারী যদি নিজের ইচ্ছায় মুহাম্মদের সঙ্গ পেতে চায় মুহাম্মদ তাকে নিতে পারবেন—তার জন্য কোন দেনমোহর দিতে হবে না। কিন্তু উম হানী মুসলিম হতে চাইলেন না। তাই অগত্যা মুহাম্মদকে উম হানী ছাড়াই মদিনায় হিজরত করতে হল।
এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে বর পক্ষ কনেকে দেনমোহর না দিলে অথবা তার প্রতিজ্ঞা না করলে কোন বিবাহ-ই ইসলামী আইন অনুযায়ী ন্যায় সঙ্গত নয়। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে উম হানী যখন মুহাম্মদের কোন প্রস্তাবেই রাজি হলেন না তখন মুহাম্মদ এই ফাঁদ পাতলেন—অর্থাৎ উম হানীকে ইসলামী বিবাহ ছাড়াই তাঁর হেরেমে নিতে পারবেন।
এই প্রসঙ্গে মুহাম্মদের ফুফাতো বোন যয়নব বিন্‌ত জাহশের কথা উল্লেখ করা যায়। যয়নবের সাথে বিবাহ হয়েছিল মুহাম্মদের পালিত পুত্র যায়েদের সাথে। কিন্তু মুহাম্মদ যয়নবের রূপ দেখে তাকে বিবাহ করতে চাইলেন। যায়েদ যয়নবকে তালাক দিয়ে দিলে মুহাম্মদ যয়নবকে বিছানায় টেনে নিলেন—আরবেরা এই সম্পর্ককে ঢি ঢি করতে শুরু করলে মুহাম্মদ প্রচার করতে লাগলেন এই বিবাহে আল্লাহর অনুমতি আছে–আল্লাহ-পাক তাঁদের বিবাহ দিয়ে দিয়েছেন। যয়নব নবীর সাথে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। তাই দেখা যাচ্ছে মুহাম্মদ আয়াত ৩৩:৫০ ঠিক মতই প্রয়োগ করে নিয়েছিলেন।
কিন্তু মদিনা চলে গেলেও এবং অগুনতি স্ত্রী ও যৌন দাসী থাকা সত্ত্বেও নবী তাঁর বাল্য প্রেম ভুলেন নাই। উম হানীর সাথে নবীর প্রেম যে উনার প্রথম প্রেম ছিল তাতে আমাদের সন্দেহ থাকে না। সেই প্রথম প্রেমকে নবী কোন দিনই তাঁর হৃদয় থেকে বিতাড়িত করতে পারলেন না।
মক্কায় অবস্থানকালে এবং খাদিজাকে বিবাহ করার আগে মুহাম্মদ কি ভাবে উম হানীর সাথে মিলিত হতেন? নিচের কিছু হাদিস পড়লে অনুমান করা যায় যে, উম হানির গৃহে মুহাম্মদ প্রায়ই যাতায়াত করতেন।
এ ব্যাপারে দেখা যাক কয়েকটি হাদিস।
উম হানী বর্ণনা করলেন: “আমি নবীর সান্নিধ্যে বসে ছিলাম। এই সময় কেউ পানীয় কিছু নিয়ে আসল। উনি তা পান করলেন। তারপর আমাকে পান করতে বললেন। আমি পান করলাম। তারপর আমি বললাম: ‘আমি সত্যই পাপ করছি। আমার জন্য আপনি ক্ষমা প্রার্থনা করুন’। নবী বললেন: ‘কি হয়েছে?’ আমি বললাম; আমি যে রোজা (উপবাস) ছিলাম। এখন আমি তা ভেঙ্গে ফেলেছি।‘ উনি বললেন: ‘তুমি কি এমন রোজা রেখেছ যা ভেঙ্গে ফেললে আবার রাখতে হবে?’ আমি বললাম: ‘না’। উনি বললেন: ‘তাহলে তোমার কোন ক্ষতি নাই’ (জাইফ) । (জামি আত তিরমিজি, খণ্ড ২, হাদিস নম্বর ৭৩১, পৃঃ ১৭২; অনুবাদ লেখকের)
সিমাক বিন হার্‌ব বর্ণনা করলেন: “ উম হানীর এক সন্তান আমাকে বলল—আর সে ছিল সর্বাপেক্ষা ধার্মিক ব্যক্তি। তার নাম ছিল জা’দাহ্‌। উম হানী ছিলেন ঐ ব্যক্তির দাদীমা। সে তার দাদীমার কাছ থেকে শুনেছিল যে আল্লার রসূল উনার (উম হানীর) কাছে আসলেন এবং কিছু পানীয় চাইলেন। তিনি তা পান করলেন। তারপর উনি সেই পানীয় উম হানীকে দিলেন। উম হানী তা পান করলেন। উম হানী বললেন: ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি যে রোজা ছিলাম। তখন রসূলুল্লাহ বললেন: “নফল (ঐচ্ছিক) রোজা নির্ভর করে রোজদারের উপর। সে চাইলে রোজাটা পূর্ণ করতে পারে, চাইলে ভাঙ্গতে পারে।” শুবাহ্‌ (আরেকজন বর্ণনাকারী) বললেন: ‘আমি তাকে (জা’দাহকে ) জিজ্ঞাসা করলাম: ‘তুমি কি এটা উম হানীর কাছ থেকে শুনেছ?’ সে উত্তর দিল: ‘না। আবু সালেহ্‌ এবং আমাদের পরিবারের সদস্যরা আমাকে এই ব্যাপারটা জানিয়েছেন। (জাইফ) (জামি আত তিরমিজি, খণ্ড ৫, হাদিস নম্বর ৭৩২, পৃঃ ১৭৩; অনুবাদ লেখকের)
উম হানী বিন্‌তি আবু তালেব বর্ণনা করলেন: “আল্লার রসূল আমার ঘরে আসলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কাছে কি কিছু আছে?’ আমি বললাম, ‘না, শুধুমাত্র এক টুকরো শক্ত রুটি আর সির্কা ছাড়া।‘ তিনি উত্তর দিলেন: ‘তাই নিয়ে এস, কারণ যে গৃহে সির্কা থাকে সেই গৃহে মসল্লার অভাব থাকে না।‘ (হাসান) (জামি আত তিরমিজি, খণ্ড ৩, হাদিস নম্বর ১৮৪১, পৃঃ ৫৩৩; অনুবাদ লেখকের)
এই সব হাদিস থেকে অনুমান করা যেতে পারে উম হানীর সাথে নবী প্রায়ই মিলিত হতেন, একান্ত নিভৃতে। এই সব ঘটনা খুব সম্ভবত: নবীর মদিনায় হিজরতের আগেই ঘটেছিল। ধরা যেতে পারে উম হানী হয়ত নবীর কাছাকাছি কোথায় থাকতেন। এমনও হতে পারে যে উম হানী গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। উম হানী যে নবীর খুব সান্নিধ্যে থাকতেন তাও কয়েকটা হাদিস থেকে বুঝা যায়।
ইবনে মাজা ও বায়হাকী রেওয়ায়েত করেন যে, উম্মে হানী (রাঃ) বলেছেন—নবী করীম (সাঃ) কা’বার প্রাঙ্গণে রাতে যে কেরাত পাঠ করতেন, তা আমি আপন গৃহে শুয়ে শুনতে পেতাম। (খাসায়েসুল কুবরা, খণ্ড ১, পৃঃ ১২৫)
আর এই হাদিস:
তায়ালাসী, ইবনে সা’দ তিবরানী ও ইবনে আসাকিরের রেওয়ায়েতে হযরত উম্মে হানী (রাঃ) বলেন: আমি নবী করীম (সাঃ)—এর পেটের দিকে তাকালে মনে হত যেন উপরে নীচে সাদা কাগজ জড়িয়ে আছে। (খাসায়েসুল কুবরা, খণ্ড ১, পৃঃ ১৩১)
এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যা শুধু উম হানীই নয় অন্য এক বিবাহিতা মহিলার সাথেও নবীর বেশ সখ্যতা ছিল। সেটা নিচের হাদিস থেকে জানা যায়।
যায়দ ইবনে আলী ইবনে হুসায়ন রেওয়ায়েত করেন: নবুওয়তপ্রাপ্তির পর রসূলুল্লাহ (সাঃ) হালাল নয়—এমন কোন মহিলার কোলে আপন মস্তক রাখেননি; কিন্তু আব্বাস পত্নী উম্মুল ফযলের কোলে তিনি মস্তক রেখেছেন। উম্মুল ফযল তাঁর মাথায় উকুন তালাশ করতেন এবং চোখে সুরমা লাগাতেন। একদিন তিনি যখন সুরমা লাগাচ্ছিলেন, তখন তাঁর চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু রসূলুল্লাহর (সাঃ) গণ্ডদেশে পতিত হল। হুযুর (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন: তোমার কি হল? উম্মুল ফযল বললেন: আল্লাহ তা”আলা আপনার ওফাতের খবর আমাদের দিয়েছেন। আপনার পরে কে আপনার স্থলাভিষিক্ত হবে—একথা বলে গেলে ভাল হত। হুযুর (সাঃ) বললেন: আমার পর তোমরা নিগৃহিত ও অবহেলিত বিবেচিত হবে। (খাসায়েসুল কুবরা, খণ্ড ২, পৃঃ ১৫৪)
বলা বাহুল্য শারিয়া আইন অনুযায়ী এই ধরণের আচরণ একবারেই বে আইনী। দেখা যাচ্ছে মুহাম্মদ নিজের রচিত আইনের থোড়াই পাত্তা দিতেন।
মদিনায় যেয়ে নবী লুট তরাজ, ডাকাতি এবং জিহাদে মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু উম হানীকে ভুললেন না। যখন লুটের মাল ভাগ হত নবী উম হানীকে কিছু ভাগ দিয়ে দিতেন। ওয়াকেদি লিখেছেন যে মুহাম্মদ খায়বারের লুটের মালের কিছু অংশ উম হানীকে দিয়েছিলেন। এখানে বলা প্রয়োজন খায়বার ছিল মদিনার ইহুদীদের এক বিশাল বাসস্থল। মদিনার শস্যভাণ্ডার এই খায়বার ইহুদীদের হাতেই ছিল। নবী অতর্কিতে খায়বার আক্রমণ করেন, প্রচুর খাদ্যশস্য পেয়ে যান, যা উনি উনার নিকট আত্মীয়দের মাঝে বিতরণ করেন।
আল ওয়াকেদি লিখেছেন:
খায়বার লুটের পর মুহাম্মদ আশী ওয়াসাক খেজুর এবং বিশ ওয়াসাক যব দিলেন তাঁর প্রত্যেক স্ত্রীকে। এ ছাড়াও নবী উম হানী বিন্‌ত আবু তালেবকে দিলেন তিরিশ ওয়াসাক যব [তিনশত কিলোগ্রামের কিছু বেশী]। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ৩৪২)
অনুমান করা যায় উম হানী বেশ কষ্টের সাথে সংসার চালাতেন। তাই মুহাম্মদ প্রেরিত এই সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। উম হানীর স্বামী যে তাঁর সাথে থাকতেন না এও তার প্রমাণ হতে পারে।
উম হানী যে নবীর দেহের খুব সন্নিকটে থাকতেন তা বুঝা যায় উম হানী যখন নবীর দেহের বর্ণনা দেন, বিশেষত্ব উম হানী দেখা যায় নবীর পেটের চামড়ার ধরণ খুব ভালভাবে জানতেন। উম হানী ছাড়া নবীর এইরূপ উলঙ্গ দেহের এই বর্ণনা আর কারও কাছ থেকে পাওয়া যায় না—এমনকি নবীর অগুনতি স্ত্রীদের কাছ থেকেও নয়।
উম হানী বলতেন, “আমি আল্লাহর রসুলের চাইতে সুন্দর হাসি আর কারও মুখে দেখি নাই। আর আমি যখনই আল্লাহর রসূলের পেট দেখতাম তখনই আমার মনে পড়ে যেত। [এই খানে কিতাব আল মাগহাযির ইংরাজি অনুবাদক ব্র্যাকেটে লিখেছেন: উম হানী এখানে নবীর ত্বকের ভাঁজের কথা বলছেন—অর্থাৎ নগ্ন পেটের] আমি মক্কা বিজয়ের দিনে উনার মাথায় চারটি বেণী বাঁধা দেখেছি। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ৪২৭)
(পর্ব-২) উম হানীর বিবাহ এবং তাঁর স্বামীর পরিচয়ঃ-
আবু তালেব মুহাম্মদের উম হানীকে বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন না। মুহাম্মদ আহত হলেন, হয়ত রাগও করেছিলেন তাঁর পিতৃব্যের উপর। তার এক উদাহরণ হল মুহাম্মদ পরে বলেছিলেন যে আবু তালেব নরকে যাবেন এবং তাঁর পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত আগুন থাকবে—আবু তালেবের মগজ সেই আগুনের উত্তাপে টগবগ করে ফুটবে।
দোজখে আবু তালেবের শাস্তি সম্পর্কে একটি হাদিস দেওয়া হল:
আবু সায়ী’দ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, একদা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের সম্মুখে তাঁহার চাচা আবু তালেবের বিষয় উল্লেখ করা হইল। হযরত (সঃ) বলিলেন, আশা করি তাহার শাস্তি লাঘব করিতে, কেয়ামতের দিন আমার সুপারিশ সাহায্য করিবে। তাহাতে অল্প পরিমাণ দোযখের আগুনে রাখা হইবে; দোযখের আগুন তাহার পায়ের গিঁট পর্যন্ত থাকিবে, কিন্তু তাহা দ্বারাই তাহার মাথার মগজ পর্যন্ত টগবগ করিতে থাকিবে। (বোখারী শরীফ, খণ্ড ৬, হাদিস ১৬৯১, মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, মহাদ্দেছ জামিয়া কোরআনিয়া, লালবাগ ঢাকা কর্তৃক অনুদিত। ইংরাজি ৫.৫৮.২২৪, ২২৫)
বোখারী শরীফে এই ধরণের আরও বেশ কয়েকটি হাদিস আছে।
যাই হোক, আবু তালেব যথা সময়ে উম হানীর বিবাহ ঠিক করলেন এবং পৌত্তলিক কবি হুবায়রার সাথে উম হানীর বিবাহ দিয়ে দিলেন।
মনে হয় আবু তালেবও তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য নিজেকে একটু দোষী দোষী ভাবছিলেন। তাই উনি মুহাম্মদকে প্রস্তাব দিলেন খদেজাকে বিবাহের জন্য। মুহাম্মদ এতে রাজী হয়ে গেলেন। তখন মুহাম্মদ ২৫ বছরের এক পরিপূর্ণ যুবক এবং খদেজার ব্যবসায়ের কর্মচারী।
এই ব্যাপারে মার্টিন লিঙ্গস্‌ লিখেছেন:
কিন্তু মেয়ের (ফাকিতাহ্‌ বা উম হানী) বিবাহের ব্যাপারে আবু তালেবের অন্য পরিকল্পনা ছিল। আবু তালেবের মা ছিলেন মাখযুমি গোত্রের মহিলা। হুবায়রা ছিলেন আবু তালেবের মায়ের ভাই । তিনিও আবু তালেবের কাছে ফাকিতার (উম হানীর) হাত চেয়েছিলেন। হুবায়রা শুধুমাত্র বিত্তবানই নয় আবু তালেবের মতই প্রতিভাবান কবি ছিলেন। মক্কায় তখন মাখযুমি গোত্রের প্রভাব প্রতিপত্তি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছিল, আর হাশিমি গোত্রের প্রভাব ক্রমশঃ অধঃপতনের দিকে যাচ্ছিল। ভেবে চিন্তে আবু তালেব শেষ পর্যন্ত হুবায়রার সাথেই তাঁর কন্যা ফাকিতার (উম হানীর) বিবাহ দিয়ে দিলেন। আবু তালেবের ভাতিজা (নবী মুহাম্মদ) এই ব্যাপারে আবু তালেবকে মৃদুভাবে ভর্ৎসনা করলেন, তখন আবু তালেব উত্তর দিলেন: “তারা তাদের মেয়েকে আমাদের গোত্রে বিবাহ দিয়েছে—তাই একজন বদান্য পুরুষের জন্য অবশ্যই বদান্যতা দেখান প্রয়োজন।“ এই বাক্যের দ্বারা নিঃসন্দেহে আবু তালেব তাঁর মায়ের (মাখযুমি গোত্রের) সাথে আবু তালেবের গোত্রের বিবাহের ঘটনা বুঝাচ্ছিলেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যা খুব জোরালো ছিল না। কারণ, আবু তালেব যে ঋণের উল্লেখ করেছিলেন তা আবদুল মুত্তালিব পরিশোধ করেছিলেন তাঁর দুই কন্যা আতিকাহ্‌ এবং বারাহ্‌ কে মাখযুমি গোত্রের দুই পুরুষের সাথে বিবাহ দিয়ে। নিঃসন্দেহে বলা যায় তাঁর চাচা এই সিদ্ধান্তের দ্বারা সদয় ও ভদ্রভাবে মুহাম্মদকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে মুহাম্মদ তাঁর কন্যার যোগ্য ছিলেন না। যাই হোক, মুহাম্মদ এই পরিস্থিতি মেনে নিলেন। কিন্তু অল্পসময়েই মুহাম্মদের জীবনে পরিবর্তন এসে গেল (খদেজার সাথে মুহাম্মদের বিবাহ) (লিঙ্গস্‌, পৃঃ ৩৩)
আগেই লিখা হয়েছিল যে কৈশরে নবী মুহাম্মদ বিবি খদেজার বানিজ্যের কর্মচারী নিয়োগ হবার আগে ভেড়ার পালের রাখালের কাজ করতেন, যার জন্য আবু তালেব তাঁর কন্যকে এক রাখালের হাতে তুলে দিতে চাইলেন না। এই ব্যাপারে এখানে একটা হাদিস দেওয়া হল:
আহমদ ইব্‌ন মুহাম্মদ মক্কী (র.)…আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, নবী (স.) বলেছেন, আল্লাহ্‌ তা’আলা এমন কোন নবী পাঠাননি, যিনি বকরী চরান নি। তখন তাঁর সাহাবীগণ বলেন, আপনিও? তিনি বললেন, হ্যাঁ; আমি কয়েক কীরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের বকরী চরাতাম। (বুখারী শরীফ, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১১২, হাদিস নম্বর ২১১৯, ইসলামিক ফাইন্ডেশন বাংলাদেশ)
মার্টিন লিঙ্গস্‌ আরও লিখেছেন যে উম হানীর সাথে বিবাহের সময় হুবায়রা ছিলেন একজন পৌত্তলিক। (ঐ বই, পৃঃ ২৯৯)
বেঞ্জামিন ওয়াকার লিখেছেন:
মুহাম্মদ আবু তালেবকে প্রস্তাব দিলেন উম হানীকে বিবাহের জন্য। কিন্তু মুহাম্মদের প্রতি আবু তালেবের যথেষ্ট মায়া মমতা থাকে সত্ত্বেও তিনি এই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন যেহেতু মুহাম্মদ ছিলেন দরিদ্র। মুহাম্মদের বয়স যখন পঁচিশ তখন আবু তালেব মুহাম্মদকে প্রস্তাব দিলেন খদেজাকে বিবাহ করার জন্য। খদেজা ছিলেন কুরাইশ গোত্রের এবং খুয়েলিদের কন্যা। ইতিপূর্বে খদিজার দুইবার বিধবা হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দুই পুত্র এবং এক কন্যার মাতা। এরা সবাই ছিল তাঁর ভূতপূর্ব দুই স্বামীর ঔরসজাত। সেই সময় মুহাম্মদ খদিজার অধীনস্থ কর্মচারী ছিলেন—তাঁর বানিজ্যের দেখাশোনা করতেন। ইতিমধ্যেই খদিজার বাণিজ্যের জন্য মুহাম্মদকে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং সিরিয়া যেতে হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল দামেস্ক এবং আলেপ্পো শহর গুলিও। বাণিজ্যের উপর মুহাম্মদের প্রখর দক্ষতা খদেজাকে ইতিমধ্যে মুগ্ধ করেছিল। (ওয়াকার, পৃঃ ৯১)
এখন উম হানীর স্বামী হুবায়রা সম্বন্ধে কিছু জানা যাক। যতটুকু বুঝা যায় হুবায়রা উম হানীকে বেশ ভালবাসতেন। আর উম হানী হুবায়রাকে তৎপরিমাণ ভাল না বাসলেও তাঁর প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। তাঁদের মিলনে এক পুত্রের (?) জন্ম হয় যার নামা রাখা হয় হানী। ওদিকে উম হানী মুহাম্মদকেও ভুলেন নাই।
ইবনে ইসহাক লিখেছেন:
আবু উসামা মাবিয়া বিন জুহায়ের বিন কায়েস বিন আল হারিস বিন দুবায়াব বিন মাজিন বিন আদিয় বিন জুশাম বিন মাবিয়া ছিলেন মাখযুম গোত্রের এক মিত্র। বদরের যুদ্ধে যখন হুবায়রা বিন আবু ওহব্‌ তার দলবলসহ পালিয়ে যাচ্ছিল তখন সে তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হুবায়রা ক্লান্ত থাকায় যুদ্ধের বর্ম ফেলে দিল। তখন মাবিয়া সেই বর্ম তুলে নিল। সে (অর্থাৎ হুবায়রা) নিচের কবিতা রচনা করল:
যখন আমি দেখলাম সৈন্যদের মাঝে আতঙ্ক,
তারা পালিয়ে যাচ্ছিল প্রাণপণে, উচ্চ গতিতে,
আর তাদের নেতারা মৃত পড়ে রইল,
আমার মনে হচ্ছিল তাদের শ্রেষ্ঠতম,
যেন তারা প্রতিমাদের কাছে উৎসর্গ,
অনেকেই রইল পড়ে, মৃত,
এবং আমাদের ভাগ্যে যা ছিল তাই-ই হল বদরে। (ইবনে ইসহাক, পৃঃ ৩৫৫)
হুবায়রা যে সর্বদায় এক পলাতক সৈনিক ছিলেন তা নয়। তাঁর কিছু বীরত্বের পরিচয় পরিখার বা খন্দকের যুদ্ধে দেখা যায়। ইবনে ইসহাক লিখেছেন:
এই অবরোধ চলতে থাকল, কোন সত্যিকার যুদ্ধ ছাড়াই। কিন্তু কুরায়েশদের কিছু অশ্বারোহী সৈনিক, যথা বানু আমির বিন লুয়ায়ের ভ্রাতা আমর বিন আবদু ওদ বিন আবু কায়েস, দুই জন মাখযুমা গোত্রের ইকরিমা বিন আবু জহল ও হুবায়রা বিন আবু ওহব (উম হানীর স্বামী)। আরও ছিল কবি দিরার বিন আল খাত্তাব, বানু মুহারিব বিন ফিহরের ভাই বিন মিরদাস। এরা সবাই যুদ্ধের বর্ম পরে অশ্বে আরোহণ করে বানু কিনানার স্থানে গেল এবং তাদেরকে বলল, ‘যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক। আজই তোমরা জেনে যাবে কারা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সৈনিক।‘ তারপর তারা দ্রুত অশ্ব ছুটিয়ে পরিখার কিনারায় থামল। পরিখা দেখে তারা বলে উঠল, ‘এই ধরণের ফন্দি আরবেরা কখনই দেখে নাই।‘ (ইবনে ইসহাক, পৃঃ ৪৫৪)
আল ওয়াকেদির লেখা থেকে আমরা জানতে পারি যে বদরের যুদ্ধে হুবায়রা যোগদান করেছিলেন এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
তারা বলল সেই সময় আবু বকর ছিলেন ডানে। আর যামা বিন আল আসোয়াদ মূর্তিপূজকদের অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল। এদিকে ইয়াহিয়া বিন আল মুঘিরা বিন আবদ আল রাহমান তাঁর পিতার থেকে জেনে বললেন যে মূর্তিপূজকদের অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল আল হারিস বিন হিশাম। আর তার দক্ষিণে ছিল হুবায়রা বিন আবি ওহাব। তার বামে ছিল যামা বিন আল আসোয়াদ। অন্য আরেকজন বলল যে দক্ষিণে ছিল আল হারিস বিন আমির আর বামে ছিল আমির বিন আবদ ওয়াদ। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ৩০)
খন্দকের যুদ্ধে যখন আলী আমরকে হত্যা করেছিলেন তা দেখে হুবায়রার কবি মন উথলে উঠেছিল। আলীর এই নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে না পেরে হুবায়রা কেঁদে ফেলেন, যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন, এবং এক লম্বা কবিতা লিখেন। এই কবিতায় হুবায়রা আলীর নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করেন [পাঠকেরা এই দীর্ঘ কবিতা ইবনে ইসহাকের বইতে পৃঃ ৪৭৮-পড়তে পারেন।]
এটাও একটা কারণ হতে পারে যার জন্য আলী হুবায়রার উপর ভীষণ বিরাগ ছিলেন, এবং হয়ত প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সুযোগ পেলেই তাঁর ভগিনীপতি তথা হুবায়রাকে খুন করতে দ্বিধা করবেন না। এর প্রমাণ আমরা দেখব নিচের অংশে।
হুবায়রা হয়ত জানতেন আলী কোনদিন মক্কায় আসলে তাঁর কপালে কি ঘটবে। তাই নবী এবং আলী যখন মক্কা জয় করে নিলেন তখন হুবায়রা তড়িঘড়ি স্ত্রী (উম হানী), সন্তান এবং ভাইদেরকে চিরদিনের জন্য ছেড়ে মক্কা ত্যাগ করে অন্য কোথাও নির্বাসনে চলে যান—আর তাঁর কোন খবর পাওয়া যায়নি।
ইবনে ইসহাকের বই থেকে:
হুবায়রা বিন আবু ওহব আল মাখযুমি সম্পর্কে বলতে হয় যে সে ঐ স্থানে (অর্থাৎ নির্বাসনের স্থান হয়ত ইয়ামান অথবা নাজরান) আমৃত্যু বাস করেন। হুবায়রা যখন জানতে পারলেন যে তাঁর স্ত্রী উম হানী (ফাকিতাহ্‌) ইসলাম গ্রহণ করেছেন তখন গভীর আঘাত পেলেন। মনের দুঃখে এক কবিতাও লিখে ফেললেন (ইবনে ইসহাক পৃঃ ৫৫৭)
আবু মুরা ছিল আকিল বিন আবু তালেবের মুক্ত করা দাস। সায়ীদ বিন আবু হিন্দ আবু মুরার থেকে আমাকে বলল যে আবু তালেবের কন্যা উম হানী (উনি ছিলেন হুবায়রা বিন আবু ওহব আল মাখযুমির স্ত্রী) বলেছিলেন: ‘আল্লার রসূল যখন মক্কার উচ্চ প্রান্তে অবস্থান করছিলেন তখন আমার দুই দেবর যারা ছিল বানু মাখযুমি গোত্রের লোক তারা লুকিয়ে আমার গৃহে আসল। সেই সময় আলী আসলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে ঐ দুজনকে খুন করবেন। তাই আমি দুজনকে গৃহে আবদ্ধ করে দরজায় তালা মেরে আল্লার রসূলের কাছে গেলাম। সে সময় নবী এক গামলা থেকে পানি নিয়ে গোসল করছিলেন। ওই গামলায় মাখা ময়দার কিছু তালও দেখা যচ্ছিল। নবীর কন্যা ফাতেমা তাঁকে কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখছিলেন। নবী গোসল শেষ করে অঙ্গে কাপড় জড়িয়ে নিলেন। এরপর উনি ভোরের আট রাকাত নামাজ পড়লেন। তারপর নবী আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার আগমণের কারণ জানতে চাইলেন। আমি যখন ঐ দুই ব্যক্তির এবং আলীর ব্যাপারে জানালাম তখন নবী বললেন: ‘তুমি যাকে রক্ষা করতে চাও আমরাও তাকে রক্ষা করব। আর তুমি যাকে নিরাপত্তা দিবে আমরাও তাকে রক্ষা করব। আলী তাদেরকে খুন করতে পারবে না।‘ (ইবনে ইসহাক, পৃঃ ৫৫১)
ওয়াকেদির লেখা থেকে জানা যায় যে ওহোদের যুদ্ধের প্রস্তুতিতে কিছু বেদুঈনদের সাথে সমঝোতা আনার জন্য হুবায়রা কুরায়েশদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন (কিতাব আল মাগহাযি, পৃঃ ১০০), ওহোদের যুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং একজন মুসলিম সৈন্যকেও নিহত করেছিলেন (ঐ বই, পৃঃ ১৪৬)।
আল ওয়াকেদি আরও লিখেছেন যে খন্দক বা পরিখার যুদ্ধে হুবায়রা আবু সুফিয়ানের সাথে মুসলিম সৈন্যদের উপর নজর রেখেছিলেন।
তারা বলল যে পৌত্তলিকেরা একের পর এক দৈনিক টহলের ব্যবস্থা করল। আবু সুফিয়ান আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা একদিনের দায়িত্ব নিল। ঐ ভাবে টহল দিলেন হুবায়রা বিন আবি ওহব। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ২২৯)
খন্দকের যুদ্ধে যখন মুসলিমরা কুরায়েশদের আক্রমণ করে তখন হুবায়রাও আক্রান্ত হন।
তাদের নেতারা একযোগে আক্রমণের জন্য পরিখার ধারে সমবেত হল। এই লক্ষ্যে আবু সুফিয়ান বিন হার্‌ব, ইকরিমা বিন আবু জহল, দিরার বিন খাত্তাব, খালিদ বিন আল ওলিদ, আমর বিন আল আস, হুবায়রা বিন আবি ওহব, নৌফল বিন আবদুল্লাহ আল মাখযুমি, আমর বিন আবদ, নৌফল বিন আবু মাবিয়া আল দিলি ছাড়াও আরও অনেকে এই উদ্দেশ্যে পরিখার তীরে ঘুরা ঘুরি করেত লাগল। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ২৩০)
খন্দকের যুদ্ধে হুবায়রার ঘোড়া আহত হয়, উনার বর্ম খসে যায়, উনি পালিয়ে যান।
ইকরিমা এবং হুবায়রা পালিয়ে গিয়ে আবু সুফিয়ানের সাথে যোগদান করল। আল যুবায়ের হুবায়রাকে আক্রমণ করে এবং তার অশ্বের পিছনে আঘাত করে। ফলে হুবায়রার অশ্বের পেটের নিচের বন্ধনী কেটে যায় এবং অশ্বের পিছনে যে বর্ম বাঁধা ছিল তা পড়ে যায়। আল যুবায়ের বর্মটি কুক্ষিগত করে নিলো। ইকরিমা বর্শা ফেলে চম্পট দিল। (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ২৩১)
খন্দকের যুদ্ধে হুবায়রা এক মুসলিম সৈন্যকে হত্যা করেন।
হুবায়রা বিন আবি ওহাব আল মাখযুমি হত্যা করেন সালাবা বিন ঘানামা বিন আদি বিন নাবী (আল ওয়াকেদী, পৃঃ ২৪৩)
এই ব্যাপারে মণ্টগোমারি ওয়াট লিখেছেন:
মুসলিমরা মক্কা দখল করার পর মুহাম্মদ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন, যার ফলে তারা কুরাইশ পৌত্তলিকদের আর তেমন হেনস্থা করল না। এই সময় আবদুল্লাহ বিন আবি রাবিয়া (অথবা যুবায়ের বিন আবদ ঊমাইয়া) এবং আল হারিস বিন হিশাম মাখযুমি গোত্রের এই দুই লোক যারা ইতিপূর্বে মুহাম্মদের খুজাদের উপর আক্রমণের নিন্দা করেছিল, তারা হুবায়রা বিন আবদ ওহবের গৃহে পলায়ন করে। হুবায়রার স্ত্রী ছিলেন আবু তালেবের কন্য। সেই সূত্রে এই মহিলা ছিলেন মুহাম্মদের চাচাত বোন। (ওয়াট, পৃঃ ৬৭)
মুহাম্মদ যে উম হানীর স্বামী হুবায়রাকে তীব্র ঘৃণা করতেন তা আমরা জানতে পারি আল ওয়াকেদির লেখা থেকে। কিতাব আল মাগহাযিতে ওয়াকেদি লিখেছেন যে বদরের যুদ্ধে হুবায়রা আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকেন। সে সময় হুবায়রার দুই সঙ্গী হুবায়রাকে তুলে নিয়ে যায়। মুহাম্মদ যখন এই সংবাদ জানলেন তখন ঐ দুজন সঙ্গীকে হুবায়রার দুই কুত্তা বলে গালি দিলেন।
হুবায়রা যখন দেখল যে তার পক্ষের সৈন্যরা পশ্চদাপসারণ করে যাচ্ছে তখন সে অত্যন্ত অসহায় বোধ করল। সেই সময় তার এক মিত্র তার নিজের বর্ম হুবায়রার গায়ে চাপিয়ে দিয়ে তাকে ঘাড়ে নিয়ে চলল। অন্যেরা বলে আবু দাউদ আল মাজনি তার তরবারি দ্বারা হুবায়রাকে আঘাত করে তার বর্ম কেটে ফেলে। হুবায়রা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। আবু দাউদ চলে যায়। তখন যুবায়ের আল জুশামির দুই পুত্র যাদের নাম আবু উসামা এবং মালিক তারা হুবায়রাকে চিনতে পারল। তারা ছিল হুবায়রার মিত্র। তারা হুবায়রার জীবন রক্ষা করল। আবু উসামা হুবায়রাকে ঘাড়ে নিয়ে নিলো আর মালিক তাকে প্রতিরোধ করল। নবী বললেন: “হুবায়রার দুই কুত্তা তাকে রক্ষা করল।“ আবু উসামার বন্ধুত্ব ছিল তাল গাছের মতই দৃঢ়। আর এক জন বলল যে হুবায়রাকে যে আঘাত করেছিল তার নাম ছিল আল মুজাস্‌সার বিন দিয়াদ। (আল ওয়াকেদি, পৃঃ ৪৮)
এই সব দলীল থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে হুবায়রার সাথে উম হানীর বিবাহকে মুহাম্মদ কখনই সহজভাবে নেন নাই। হুবায়রা শুধু ইসলামের শত্রুই ছিলেন না, উনি হয়ে গিয়েছিলেন মুহাম্মদের ব্যক্তিগত এক নম্বর শত্রু। হুবায়রাও এই সত্য ভালভাবেই জানতেন। তাই মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে হুবায়রা উম হানীকে ছেড়ে দেশান্তর হয়ে যান—নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য। এই ব্যাপারে আমরা আরও জানব নিচের লেখা হতে।
খদিজা ও আবু তালিবের মৃত্যুর পর
উইলিয়াম মুর (মুর, পৃঃ ১০৫) লিখেছেন যে মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খদিজা মারা যান ৬১৯ সালে। এর পাঁচ সপ্তাহ পরেই (জানুয়ারি ৬২০) সালে আবু তালেব মারা যান। এই সময়টা ছিল হিজরতের তিন বছর আগে। পর পর এই দুই বিয়োগান্ত ঘটনার ফলে মুহাম্মদ অতিশয় মুষড়ে পড়েন।
এই ব্যাপারে আরও এক প্রখ্যাত জীবনীকার লিখেছেন:
খদেজা এবং আবু তালেব মারা যান কয়েকদিনের ব্যবধানে। এই ঘটনা ঘটে ৬১৯ সালে। এরপর থেকে ধারাবাহিক ঘটনাগুলির সন ও তারিখ বেশ নির্ভরযোগ্য ভাবে গণনা করা যেতে পারে। কোন আরবই তার স্ত্রীর বিয়োগের পর বেশীদিন স্ত্রী ছাড়া থাকে না। আর তাছাড়া যার সন্তান আছে তার জন্যে ত কথাই নাই। কিছু দিন, অথবা সর্বোচ্চ কয়েক সপ্তাহ পরেই স্ত্রী হারা মুহাম্মদ সওদা নামে এক বিধবাকে বিবাহ করেন। পূর্বে মুহাম্মদের এক ভক্ত ছিল এই বিধবার স্বামী। সওদা তাঁর স্বামীর সাথে আবিসিনিয়া গিয়েছিলেন। সেখানে সওদার স্বামী খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। সওদা তরুণ বয়সের ছিলেন না এবং বেশ মুটিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সওদা গিন্নি হিসাবে ছিলেন অতি উত্তম। তাই মুহাম্মদের সন্তানদের দেখাশোনার জন্য খুব যোগ্য। এই জন্যই মুহাম্মদ সওদাকে বিবাহ্ করেন। নবীর জীবনে সওদার কোন প্রভাবই ছিল না। নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ ছিলেন সওদার প্রভুর মত। সওদা মুহাম্মদকে যৌন তৃপ্তি দিতে সক্ষম ছিলেন না। আর রাজনৈতিক ভাবে নবীর স্থান শক্তিশালী করার জন্য কোন অবদানও সওদার ছিল না। (রডিন্সন, পৃঃ ১৩৪)
মার্টিন লিঙ্গস্‌ লিখেছেন মৃত্যুকালে খদেজার বয়স ছিল ৬৫ এবং মুহাম্মদের বয়স প্রায় ৫০। (লিঙ্গস্‌, পৃঃ ৯৬)
খদেজার মৃত্যুর পর মুহাম্মদ ঘন ঘন কাবা শরীফে যাওয়া শুরু করলেন আর সেখানে খুব সম্ভবত: উচ্চৈঃস্বরে কোরান আবৃত্তি করতেন। আমরা আগেই এক হাদিসে দেখেছি যে উম হানীর গৃহ কাবার এত নিকটে ছিল যে উম হানী নবীর কোরান আবৃত্তি শুনতে পেতেন। আমরা ধরে নিতে পারি যে মুহাম্মদ এই সময়ে উম হানীর খুব সান্নিধ্যে আসেন—হয়ত বা তিনি নিয়মিত উম হানীর গৃহে যাতায়াত করতেন—হয়ত বা অনেক রাত্রি দিন উম হানীর গৃহেই কাটাতেন। একবার মুহাম্মদ কোরান আবৃত্তি শেষ করে মাটিতে মাথা ঠেকালেন। এই সময়ই দুষ্ট কিছু কোরায়েশ তাঁর ঘাড়ে ভেড়া (অথবা উটের) নাড়ীভুঁড়ি জড়িয়ে দিল। এই সময় মুহাম্মদ স্ত্রী হারা, নিতান্ত একাকী, অসহায়। শত্রু কোরায়েশদের থেকে একটু শান্তি এবং সহানুভূতির জন্য উম হানীর দ্বারস্থ হচ্ছিলেন। উম হানীই হয়ে উঠলেন নবীর একমাত্র নারী। উম হানীও সাদরে আপ্যায়ন করলেন নবীকে। তাঁদের দুজনের বাল্যপ্রেমের দিনগুলি আবার যেন উদ্ভাসিত হয়ে গেল। এই সব কিছুই কোরায়েশদের দৃষ্টি এড়াল না। তারা হয়ত উৎসুক হয়ে উঠল কিসের আনাগোনা মুহাম্মদের উমর হানীর গৃহে?
এই পরিস্থিতি এড়াতে মুহাম্মদ বোধকরি চিন্তা করলেন: না, এখানে আর নয়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমাকে যেতে হবে অন্য কোথায়—অন্য কারও কাছে—যারা আমাকে সামান্য ভাবে হলেও গ্রহণ করবে, একটু ভক্তি শ্রদ্ধা দেখাবে।। এই উদ্দেশ্যে নবী গেলেন তায়েফে। সেখানে থাকত সাকিফ (থাকিফ) লোকেরা। তারা উপাসনা করত দেবী আল লাতের। নবী অনেক চেষ্টা করলেন তাদেরকে ইসলামে দীক্ষিত করতে। কিন্তু তায়েফের লোকেরা তাঁর কথায় কর্ণপাত ত করলই না বরং তাদের বালকদেরকে লেলিয়ে দিল নবীর পেছনে। এই সব বখাটে রাস্তার বালকেরা নবীকে ঢিল মেরে বাধ্য করল তায়েফ ছাড়তে। মোহ-ভগ্ন, ভারাক্রান্ত, শোকা-হত হৃদয়ে মুহাম্মদ আবার ফিরে আসলেন মক্কায়, সেই উম হানীর কাছে। একমাত্র উম হানীর কাছেই নবী মনের কথা খুলে বলতে পারেন।
ইবনে ইসহাক লিখেছেন:
খদিজা এবং আবু তালেব দু’জন একই বৎসরে মারা গেলেন। খদিজার মৃত্যুর সাথেই একের পর এক সমস্যা আসতে লাগল। কারণ খদিজার কাছ থেকেই নবী পেয়েছিলেন ইসলামের সমর্থন। খদিজার কাছে মুহাম্মদ তাঁর সমস্যার কথা আলোচনা করতেন। আবু তালেবের মৃত্যুতে নবী হারালেন তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আর অন্য গোত্রের হামলা থেকে রক্ষার জামিন কবচ। মদিনায় অভিভাষণের বছর তিনেক আগে আবু তালেব মারা যান। এই সময়েই নবী কোরায়েশদের সাথে প্রতিকুল পরিবেশের সম্মূখীন হতে থাকলেন। আবু তালেবের মৃত্যুর পূর্বে নবী কখনই কোরায়েশদের কাছ হতে এমন শত্রুতামূলক ব্যবহার পান নাই। (ইবনে ইসহাক, পৃঃ ১৯১)
(পর্ব-৩)উম হানী এবং তাঁর মাতার ইসলাম গ্রহণঃ-
মার্টিন লিঙ্গস্‌ মনে করেন আবু তালেবের মৃত্যুর পর অথবা তার আগেই আবু তালেবের স্ত্রী ফাতেমা ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে এই ব্যাপারে অনেকেই সন্দেহ করেন। অনেকেই মনে করেন আবু তালেবের স্ত্রী কখনই ইসলাম গ্রহণ করেন নাই। আর আমরা উপরে একটা তিরমিজি হাদিসে দেখেছি যে উম হানী ছিলেন একজন তুলাকা—যার অর্থ হচ্ছে যে উম হানী মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। মার্টিন লিঙ্গস ছিলেন একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম। উনি ক্যাথলিক থেকে ইসলামে দীক্ষিত হন। উনার ইসলামী নাম হল আবু বকর সিরাজ আদ উদীন। মার্টিন লিঙ্গস্‌ যে ইসলামের গুণগান গাইবেন এবং মুহাম্মদকে উচ্চাসনে বসাবেন এটাই ত স্বাভাবিক। সে জন্য উনার লেখা মুহম্মদের জীবনী, যা উনি দাবী করেন যে সবচাইতে প্রাচীন উৎস থেকে নেয়া তথ্য থেকে লেখা তা সমগ্র ইসলামী জগতে অত্যন্ত কদরের সাথে গ্রহণ করা হয়। এখন উনার বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেখা যাক।
আবু তালেবের বিধবা স্ত্রী ফাতেমা ইসলামে দীক্ষিত হলেন। এটা হয়েছিল আবু তালেবের মৃত্যুর আগেই অথবা পরে। তাঁর কন্যা উম হানী যিনি ছিলেন আলী এবং জাফরের ভগিনী সেই সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু উম হানীর স্বামী হুবায়রা সর্বদায় একেশ্বরবাদের প্রতি বিরূপ ছিলেন। তা সত্যেও যখনই নবী তাঁর গৃহে আসতেন হুবায়রা নবীকে স্বাগতম জানাতেন। যদি তখন নামাযের সময় হত তখন গৃহের সব মুসলিমরা এক সাথে নামাজ পড়তেন। (লিঙ্গস্‌ পৃঃ ১০১)
ঐতিহাসিক তাবারি তাঁর ‘তারিখ আল তাবারি’ গ্রন্থে লিখেছেন:
হুবায়রা বিন আবি ওহব এক অবিশ্বাসীই রয়ে গেলেন। যখন তিনি জানতে পারলেন যে তার স্ত্রী উম হানী বিন্‌ত আবি তালেব (যার নিজস্ব নাম ছিল হিন্দ) মুসলিম হয়ে গেছেন তখন তিনি বললেন:
হিন্দ কি তোমাকে আর আকাঙ্ক্ষা করে?
অথবা সে কি তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে?
এই-ই দূরে থাকা—তার বন্ধন, (তারপর) তার চলে যাওয়া। (তাবারি, খণ্ড ৮, পৃঃ ১৮৬)
পূর্বেই ইবনে ইসহাকের উদ্ধৃতিতেও এই প্রসঙ্গে হুবায়রার একটি কবিতা দেওয়া হয়েছে।
এখানে বলা প্রয়োজন যে তাবারি এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের সময়। অর্থাৎ মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের পরই উম হানি ইসলাম গ্রহণ করেন—কিন্তু তাঁর স্বামী হুবায়রা ইসলাম গ্রহণ করেন নাই, বরং চিরজীবন অমুসলিম থেকে যান। উম হানীর ইসলাম গ্রহণে হুবায়রা অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন এবং উম হানীকে ছেড়ে নির্বাসনে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। কারণ মুহাম্মদ নিয়ন্ত্রিত মক্কায় মুসলিম অমুসলিম দম্পতির একত্রে বসবাস নিষিদ্ধ ছিল। আগেই লিখা হয়েছে যে মুহাম্মদ হুবায়রাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। কাজেই মুহাম্মদ নিয়ন্ত্রিত মক্কায় পৌত্তলিক হুবায়রার ভাগ্যে কি ছিল তা সহজেই অনুমেয়।
দেখা যায়, তাবারি এবং ইবনে ইসহাক একই কথা লিখেছেন—উম হানী ইসলাম গ্রহণ করেন মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের পর তার আগে নয়। মার্টিন লিঙ্গস কতটুকু সত্য লিখেছেন তা ভাবার বিষয়।
তবে এই বিভ্রান্তির একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে এই ভাবে। এমন হয়ত হয়েছিল যে উম হানী মুহাম্মদকে খুশী করার জন্য গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হুবায়রাকে বিবাহের পর উম হানী ইসলাম ত্যাগ করে পৌত্তলিকতায় ফিরে গেলেন। আর মুহাম্মদ বিবাহ করেন খদেজাকে। আল্লাহ যখন মুহাম্মদকে নবী বানালেন, তখন হয়ত মুহাম্মদ যখন কাবায় আসতেন তখন উম হানীর সাথে কিছু সময় কাটাতেন। আমরা আগেই দেখেছি যে উম হানীর গৃহ এবং কাবা একেবারে পাশাপাশি ছিল। নবীও তখন পরকীয়া প্রেম চালাতেন আর তাতে উম হানীরও সায় ছিল। তাই উম হানী তখন নবীর অবস্থানে এক গোপন মুসলিম হিসাবে থাকতে চাইতেন।
যাই হোক, এই সবই অনুমান।এই সব ঘটনার ইসলামি উৎস এতই বিপরীত তথ্য, তালগোল পাকানো এবং বিশৃঙ্খল যে সত্য বাহির করা দুরূহ।
এত-সত্ত্বেও এটা পরিষ্কার যে নবী মুহাম্মদ উম হানীকে মনঃপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন—যদিও তার জন্য দরকার ছিল পরকীয়া প্রেমের। মনে হয় নবী উম হানীকে (হিন্দ) যে পরিমাণে ভালবাসতেন সেই পরিমাণে অন্য কোন নারীকেই সেই ভাবে ভালবাসেন নাই—এমনকি উনার অগুনতি স্ত্রী ও উপপত্নীদের কাউকেও না।
নবীর স্বপ্ন আয়েশা/সওদাকে বিবাহ
পূর্বেই সওদাকে বিবাহের ব্যাপারে কিছু লিখা হয়েছিল এখানে আরও কিছু তথ্য দেওয়া হল।
খদিজার সাথে বিবাহের আগে উম হানী ছাড়া নবীর জীবনে অন্য কোন নারীর অনুপ্রবেশের উল্লেখ আমরা ‘সিরা’ (মুহাম্মদের জীবনী)তে দেখিনা। যদিও ২৫ বছরের মুহাম্মদের সাথে চল্লিশোর্দ্ধ খদিজার বিবাহের ঘটনা বেশ বিরল তবুও মুহাম্মদ এই বিয়েতে মোটামুটি শান্তিতেই ছিলেন। তখন আরব সমাজে মহিলাদের বিবাহ অল্প বয়সেই হয়ে যেত—খুব সম্ভবতঃ ১৫-১৬ বছরেই। সেই হিসাবে বলা যেতে পারে যে মুহাম্মদ বিবাহ করলেন তাঁর মায়ের বয়সী এক মহিলাকে। এর আগে খদিজার দু’বার বিবাহ হয়েছিল। তাই সংসার এবং দাম্পত্য জীবনে ছিল খদিজার প্রচুর অভিজ্ঞতা। আর খদিজা ছিলেন ধনকুবের। তাই মুহাম্মদের প্রায় সব চাহিদাই খদিজা মিটাতে পেরেছিলেন শুধু একটা শর্তে—তা ছিল যে খদিজার জীবদ্দশায় মুহাম্মদ আর কোন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবেন না।
এই প্রসঙ্গে রডিন্সন লিখেছেন:
…অনেকে বলেন আরব সমাজে বহু বিবাহ অবাধে প্রচলিত ছিল কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তেমন ছিলনা। যতটুকু মনে করা হয় বহুবিবাহ প্রথা তার চাইতে অনেক কম ছিল। কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদ ছিল বহুল প্রচলিত এবং সহজ। এছাড়াও বেশ্যাবৃত্তি, যার অপর নাম ছিল অস্থায়ী বিবা‌হ তাও প্রচলিত ছিল। ধর্মের রীতিনীতি সমর্থিত যৌনসংগম অনেক সময় করা যেত। খুব সহজেই কেনা যেত সুন্দরী এবং তরুণী যৌন-দাসীদের। খুব সম্ভবত তাঁদের বিবাহের সর্ত ছিল যে মুহাম্মদ কোন দ্বিতীয় স্ত্রী নিতে পারবেন না। ধনবতী খদেজার পক্ষে এই দাবী করা ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক। (রডিন্সন, পৃঃ ৫৫)
স্যার উইলিয়াম মুর লিখেছেন:
খাদিজার মৃত্যুর দুই অথবা তিন মাসের ব্যবধানে মুহাম্মদ সওদাকে বিবাহ করলেন এবং সেই সাথে আবু বকরের কন্যা আয়েশাকে বাগদত্তা স্ত্রীও বানালেন। অনেকেই বলেন আয়েশার সাথে বিবাহের কারণ ছিল দুই বন্ধুর মধ্যে বন্ধুত্ব গাড় করা। (উইলিয়াম মুর, পৃঃ ১০৯)
খদিজার মৃত্যুর পর মুহাম্মদ প্রথমে বিবাহ করেন সওদাকে। সওদা ছিলেন বয়স্কা, স্থূল, অনাকর্ষণীয় এবং গরীব। খদিজা এবং সওদা মুহাম্মদকে যা দিতে পারেন নাই—যৌবন, সৌন্দর্য এবং শিশুশুলভ চপলতা এই সবই মুহাম্মদ দেখলেন উনার অন্তরঙ্গ বন্ধু আবু বকরের ছয় বয়স্ক শিশু কন্যা আয়েশার মাঝে। একই সাথে উম হানীর সাথেও নবী চালিয়ে যেতে থাকলেন পরকীয়া প্রেম।
শিশু আয়েশার সাথে ৫১ বছর বয়স্ক মুহাম্মদের বিবাহ নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। তাই এই নিয়ে এখানে বেশী লিখার প্রয়োজন নাই। শুধু আমাদের কৌতূহল হল এই দুই বিবাহ (সওদা এবং আয়েশা) কি নবীর মেরাজের আগে হয়েছিল না পরে? এই ব্যাপারেও এখনও কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না।
এই সময় নির্ধারণ একটু গুরুত্বপূর্ণ; কারণ আমরা একটু পরেই দেখব যে নবী যে রাত্রিতে আকাশ ভ্রমণে (ঈস্‌রা এবং মেরাজ) করেছিলেন তা কোথা থেকে শুরু করেছিলেন—উম হানীর ঘর হতে না অন্য কোন স্থান হতে। কারণ ইসলামকে রক্ষা করতে গিয়ে অনেকে বলে থাকেন যে নবী কোনদিনই রাত্রিবেলা উম হানীর গৃহে ঘুমিয়ে মেরাজ করেন নাই। তার কারণ তিনি তখন সওদার সাথে বিবাহিত, আর আয়েশার সাথে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন আবু বকরকে। তাই উনি কেমন করে উম হানীর ঘরে রাত্রি যাপন করবেন?
এর উত্তর তেমন জটিল নয়। প্রথমে রডিন্সনের উদ্ধৃতি পড়লে বুঝা যায় যে খদিজার মৃত্যুতে মুহাম্মদ উপরে উপরে দুঃখ প্রকাশ করলেও মনে মনে হয়ত একটু স্বস্তি পেয়েছিলেন। কারণ এখন তিনি খদিজার হাতের মুঠো থেকে মুক্ত। এখন যা খুশী তাই করতে পারবেন—যে মেয়েকে পছন্দ তার সাথেই রাত কাটাতে পারবেন—বিবাহ করেই হোক বা না করেই হোক। যদি পরকীয়াও হয় তাতেই বা কি অসুবিধা?
যাক, এই ব্যাপারে আমরা পরে দীর্ঘ জানব। এখন আয়েশা এবং সওদাকে বিবাহ নিয়ে কিছু চমৎকার হাদিস পড়ে নিব।
প্রথমেই দেখা যাক মার্টিন লিঙ্গস্‌ কি লিখেছেন:
এই একই বছরে (খুব সম্ভবত: ৬১৯ ৬২০ সালে) যখন খদিজার মৃত্যু ঘটল তখন নবী এক স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নটা ছিল এই রকম: নবী দেখলেন এক পুরুষ লোক কাউকে এক টুকরো রেশমি কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঐ ব্যক্তি তাঁকে বলল: “এই-ই হচ্ছে তোমার নববধূ। তুমি একে খুলে দেখ।“ নবী রেশমি কাপড়টা উন্মুক্ত করে দেখলেন যে ঐ মেয়েটি হচ্ছে আয়েশা। কিন্তু আয়েশা তখন মাত্র ছয় বছরের। আর নবী পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছেন। তা ছাড়াও আবু বকর কথা দিয়েছেন মুতিম কে যে তিনি আয়েশাকে তুলে দিবেন মুতিমের পুত্র যুবায়েরের হাতে। তার পর নবী স্বগতোক্তি করলেন: “এই-ই যদি আল্লাহর ইচ্ছা, তবে তাই হোক।’’ কয়েক রাত্রির পর নবী দেবদূতকে (ফেরেশতা) বললেন: “আমাকে দেখান।’’ফেরেশতা রেশমি কাপড় উঠালো, আবার দেখা গেল আয়েশাকে। আবার নবী বললেন: “এই-ই যদি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে, তবে তাই-ই হোক।’’ (লিঙ্গস্‌, পৃঃ ১০৬)
এই স্বপ্নের কথা বোখারী শরীফ এবং মুসলিম শরীফেও লেখা হয়েছে। এখানে মাত্র একটি উল্লেখ করা হচ্ছে:
আয়েশা (রা:) হইতে বর্ণিত আছে, হযরত নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাঁহাকে বলিয়াছেন, স্বপ্নে আমায় দুই বার তোমাকে দেখান হইয়াছে—এক লোক রেশমি কাপড়ে তোমাকে বহন করিয়া নিয়া আসিয়াছে, অতঃপর তিনি আমাকে বলিলেন, এইটি আপনার স্ত্রী। সেমতে আমি রেশমি কাপড়ের আবরণ উন্মোচন করিলাম এবং দেখিতে পাইলাম তুমি-ই।
নিদ্রা ভঙ্গের পর আমি ভাবিলাম, ইহা যখন আল্লাহর তরফ হইতে তবে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই বাস্তবায়িত করিবেন। (বোখারী শরীফ, মাওলানা আজিজুল হক সাহেব অনুদিত, খণ্ড ৫, হাদিস ১৬৯২)
এবারে কিছু হাদিস দেখা যাক খাসায়েসুল কুবরা থেকে। এই বইটির লেখক হচ্ছেন ইমাম সিয়ুতী যিনি ইসলামের সর্বোচ্চ পণ্ডিতদের একজন:
হযরত আয়েশার (রাঃ) সাথে বিবাহ
ওয়াকেদী ও হাকেম ওরয়ার মুক্ত ক্রীতদাস হাবীব থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত খাদিজার (রাঃ) ইন্তিকালের কারণে নবী করীম (সাঃ) খুবই মর্মাহত হন। হযরত জিবরাইল আয়েশা (রাঃ) কে দোলনায় নিয়ে তাঁর কাছে এলেন এবং বললেন: এই বালিকা আপনার দুঃখ বেদনা লাঘব করে দিবে। সে খাদিজার (রাঃ) স্থলাভিষিক্ত হবে।
আবূ ইয়ালা, বাযযার, ইবনে ওমর, আদনী ও হাকেমের রেওয়ায়েতে হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন: রসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে বিয়ে করেননি, যতদিন না জিবরাঈল আমার আকার আকৃতি তাঁর সামনে প্রকাশ করে দেন। তিনি আমাকে এমন অবস্থায় বিয়ে করেন যে, আমি শিশুদের পোশাক পরিহিত ছিলাম। আমার বয়স কম ছিল। তিনি যখন আমাকে বিয়ে করলেন, তখন আল্লাহতায়ালা কম বয়সেই আমার মধ্যে লজ্জা শরম সৃষ্টি করে দেন। (খাসায়েসুল কুবরা, খণ্ড ১, পৃঃ ৩৪৩)
হযরত সওদা বিনতে যমআর সাথে বিবাহ
ইবনে সা’দ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, হযরত সওদা বিনতে যমআ (রাঃ) সুহায়ল ইবনে আমরের ভাই সকরান ইবনে আমরের বিবাহে ছিলেন। তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, রসূলে আকরাম (সাঃ) তাঁর সম্মুখ দিয়ে আসছেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর ঘাড়ে পা রেখে দিয়েছেন। তিনি স্বীয় স্বামীর কাছে এই স্বপ্ন বর্ণনা করলেন। স্বামী বললেন: এই স্বপ্ন সত্য হলে আমি মারা যাব এবং রসূলুল্লাহ (সাঃ) তোমাকে বিয়ে করবেন। এরপর সওদা (রাঃ) দ্বিতীয় রাতে স্বপ্ন দেখলেন সে, আকাশ থেকে একটি চাঁদ তাঁর উপর নেমে এসেছে এবং তিনি শায়িত। এ স্বপ্নের কথা স্বামীর কাছে ব্যক্ত করলে স্বামী বললেনঃ যদি তোমার স্বপ্ন সত্য হয়, তবে আমি আর কয়েকদিন মাত্র জীবিত থাকব, এরপর ইন্তেকাল করব। আমার পরে তুমি বিয়ে করবে। সকরান সেদিনই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কয়েকদিন পরেই ইন্তেকাল করেন। এরপর হযরত সওদা (রাঃ) রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বিবাহে আসেন। (খাসায়েসুল কুবরা, খণ্ড ১, পৃঃ ৩৪৩-৩৪৪)

(পর্ব-৪) উম হানীর ঘরে নবীর রাত্রি যাপন এবং মেরাজঃ
আগেই লিখা হয়েছে যে নবীর ঈস্‌রা এবং মেরাজ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। বিগত দেড় হাজার বছর ধরে এই বিতর্ক চলছে এবং ভবিষ্যতেও যে চলবে তাতে সন্দেহ নাই। কয়েকটি ব্যাপারে অনেক মতবিরোধ দেখা যায়। সেগুলি হলঃ-
এই রাত্রি ভ্রমণ (ঈসরা এবং মেরাজ) কখন হয়েছিল?
এই রাত্রি ভ্রমণ কোথা হতে হয়েছিল?
উম হানীর সাথে নবীর এই রাত্রি সফরের কি সম্পর্ক?
প্রথম প্রশ্নের আংশিক উত্তর আগে দেওয়া হয়েছে। এখন একটু বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন।
মুহাম্মদের এই রাত্রি ভ্রমণ যে মদিনায় হিজরতের আগেই হয়েছে তাতে কোন বিতর্ক নাই। অনেক নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে বুঝা যায় যে এই আশ্চর্যজনক ঘটনা খুব সম্ভবত: ৬১৯-৬২০ সালে হয়েছিল। আগেই জানানো হয়েছে যে এই ঘটনার আগে নবী সওদাকে বিবাহ করেন। কিন্তু মুহাম্মদের জীবনী থেকে এটা পরিষ্কার হয়না যে সওদাকে মুহাম্মদ কোথায় রাখতেন? সওদাকে যে তিনি কাবা ঘরে কিম্বা তার কাছাকাছি কোথাও রাখতেননা তা বুঝা যায়। খুব সম্ভবত: সওদা থাকতেন খদিজার গৃহে, কারণ সেখানেই ছিল মুহাম্মদের কন্যারা। সওদা তাদের দেখাশোনা করতেন এবং সাংসারিক অন্য কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আর মুহাম্মদ বেশীরভাগ সময়ই কাটাতেন কাবা প্রাঙ্গণে—জিকির, নামায আর কোরান আবৃত্তি করে। কাবা প্রাঙ্গণেই মুহাম্মদ অনেক রাত্রি কাটাতেন। আমরা আগেই দেখেছি কাবার যেখানে মুহাম্মদ কোরান পড়তেন সে স্থান উম হানীর ঘরের খুব সন্নিকটে ছিল—একেবারে পাশের বাড়ির মত। উম হানীর সাথে রাত্রে মিলিত হবার এর চাইতে ভাল অবস্থা আর কি হতে পারে? তাই বিশ্বাস করা যায় যে মুহাম্মদ অনেক সময়েই কাবা থেকে নিখোঁজ হয়ে যেতেন। অনেকেই এ নিয়ে হয়ত প্রশ্ন করত। তিনি হয়ত সদুত্তর দিতে পারতেন না। এই ভাবেই একবার তিনি সহসা রাত্রিকালে কাবা থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। লোকে তাঁর খোঁজ করতে তাকে। নিখোঁজের কারণ হিসাবে নবী ঈস্‌রা এবং মেরাজের উল্লেখ করেন। এর সমর্থনে কিছু হাদিস এবং ঘটনার বিবরণ দেওয়া হবে। পাঠকদের মনে রাখা দরকার যে কাবার যে অংশে মুহাম্মদ কোরান পড়তেন এবং শুয়ে রাত্রি কাটাতেন সেই স্থানকে হিজর বলা হত। কাবার এই স্থানে কোরায়েশরা ব্যবস্থা করেছিল গরীব এবং পথিকদের বিশ্রাম অথবা নিদ্রার।
মার্টিন লিঙ্গস্‌-এর মতে এই ঘটনা হয়েছিল উম হানীর এবং আবু তালেবের অন্যান্য পরিবারের সদস্যদের ইসলাম গ্রহণের পর—অর্থাৎ মুহাম্মদের মদিনায় হিজরত করার আগে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে উম হানীর স্বামী হুবায়রা কক্ষনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাই এক পৌত্তলিক স্বামী নিয়ে কি ভাবে উম হানী একই গৃহে বাস করেন তাও চিন্তার বিষয়। উম হানী তা করে থাকলে উনি নিশ্চয় ইসলামি আইন লঙ্ঘন করেছিলেন। যতটুকু ধারণা করা যায় উম হানীর স্বামী হুবায়রা গৃহে থাকতেন না। আমরা আগেই দেখেছি উম হানীর ইসলাম গ্রহণের সংবাদে হুবায়রা মনের দুঃখে কবিতা রচনা করেছিলেন এবং নির্বাসনে চলে যান।
দেখা যাক মার্টিন লিঙ্গস্‌ কি লিখেছেন ঈসরা এবং মেরাজ সম্পর্কে:
একবার উনারা সবাই নবীর পিছনে নামাজ পড়লেন। এর পর উম হানী নবীকে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁদের সাথে রাত্রি যাপনের। মুহাম্মদ সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ ঘুমের পরই উঠলেন এবং মসজিদে চলে গেলেন। কেননা কাবায় রাত্রি কাটাতে নবী অতিশয় পছন্দ করতেন। সেখানে যাবার পর নবীর ঘুম আসতে থাকল; তিনি হিজরে ঘুমিয়ে পড়লেন।
তিনি বললেন, “আমি যখন যখন হিজরে ঘুমিয়ে ছিলাম তখন তখন জিব্রাঈল আমার কাছে আসলেন এবং তাঁর পা দিয়ে লাথি মারলেন। আমি সোজা হয়ে বসলাম। কিন্তু কিছুই দেখলাম না। তাই আবার শুয়ে পড়লাম। দ্বিতীয়বার জিব্রাঈল আসলেন। তারপর তৃতীয়বার। এইবার তিনি আমার হাত ধরলেন। আমি উঠলাম এবং জিব্রাঈলের পাশে দাঁড়ালাম। জিব্রাঈল আমাকে নিয়ে মসজিদের দরজার বাইরে এলেন। বাইরে একটা সাদা জানোয়ার দেখলাম। দেখতে গাধা এবং খচ্চরের মাঝামাঝি। জানোয়ারটির দুই পাশে ডানা ছিল। তার দ্বারা সে তার পা নাড়াচাড়া করছিল। তার প্রত্যেক পদক্ষেপ ছিল দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত। (লিঙ্গস্‌, পৃঃ ১০১)
এরপর মার্টিন লিঙ্গস্‌ বর্ণনা দিয়েছেন নবীর আকাশ ভ্রমণ, যার বিস্তারিত বিবরণ আমরা পরে দেখব। মজার ব্যাপার হল রাত্রি শেষ হবার আগেই নবী আবার চলে যান উম হানীর গৃহে। এবং তাঁকে বর্ণনা করেন রাত্রি ভ্রমণের কথা। এই থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে হিজর এবং উম হানীর গৃহ ছিল খুবই নিকটবর্তী যা আগেই বলা হয়েছে। তা না হলে মুহাম্মদের পক্ষে হুট করে, রাত থাকতে থাকতে আবার উম হানীর গৃহে যাওয়া সম্ভব হত না।
দেখা যাক মার্টিন লিঙ্গস্‌ কি লিখেছেন:
যখন নবী এবং জিব্রাঈল জেরুজালেমের মসজিদে অবতরণ করলেন তখন মক্কায় ফিরে গেলেন যে পথ ধরে এসেছিলেন সেই পথ ধরে। ফিরার পথে অনেক দক্ষিণ-গামী কাফেলাকে অতিক্রম করলেন। যখন কাবায় ফিরে আসলেন তখনও গভীর রাত ছিল। কাবা থেকে নবী আবার গেলেন তাঁর চাচাত বোনের গৃহে। উম হানী নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন এই ভাবে: “ভোর হবার অল্পক্ষণ পূর্বেই নবী আমাদেরকে ঘুম হতে উঠালেন। এরপর আমরা ভোরের (ফজরের) নামায শেষ করলাম। তিনি বললেন: ‘ওগো উম হানী! তুমি ত জানই, আমি তোমার সাথে এই উপত্যকাতেই গতকালের সন্ধ্যা নামায পড়েছিলাম। এর পর আমি জেরুজালেমে যাই। সেখানেও নামায পড়লাম। এখন ত তুমি দেখছ, আমি তোমার সাথে ভোরের নামায পড়লাম।‘ নবী উঠলেন চলে যাবার জন্য। আমি তাঁর পরনের ধুতি ধরে এত জোরে টানাটানি করলাম যাতে ধুতি আলগা হয়ে পড়ে গেল। এর ফলে আমি তাঁর পেট দেখে ফেললাম। তাঁর পেট মনে হচ্ছিল যেন তুলা দিয়ে ঢাকা। আমি বললাম: ‘হে আল্লাহর নবী। এই কথা লোকজনকে জানাবেন না। কেননা তারা আপনাকে মিথ্যুক বলবে আর অপমান করবে।‘ নবী বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি তাদেরকে বলব।‘(লিঙ্গস্‌, পৃঃ ১০৩)
এখন ইবনে সা’দের লেখা আল তাবাকাত আল কবির থেকে কিছু জানা যাক।
ইবনে সা’দ লিখেছেন ঈস্‌রা এবং মেরাজ উম হানীর গৃহ থেকেই হয়েছিল।
রাত্রে শোবার আগে উনি উম হানীর সাথে এশার (সন্ধ্যা) নামায পড়েন। কোন কোন বর্ণনাকারী বলেছেন: ঐ রাত্রে নবী (স.) নিখোঁজ হয়ে যান। তাই আবদুল মুত্তালিবের পরিবারের সদস্যরা নবীর খোঁজে বাহির হন। আল আব্বাস জু তুয়াসে গিয়ে চিৎকার করলেন: ওহে মুহাম্মদ! ওহে মুহাম্মদ! আল্লাহর রসূল (স.) জবাব দিলেন: আমি যে এখানে। আল আব্বাস বললেন: হে আমার ভায়ের পুত্র! রাত্রির শুরুর থেকেই আপনি আমাদেরকে উদবিঘ্ন করে তুলেছেন। আপনি কোথায় ছিলেন? নবী উত্তর দিলেন: আমি বায়তুল মোকাদ্দিস থেকে আসছি। আল আব্বাস বললেন: এক রাত্রিতেই? নবী উত্তর দিলেন: হাঁ, তাই। আল আব্বাস জিজ্ঞাসা করলেন: ‘আপনি কি ভাল ছাড়া খারাপ কিছু অভিজ্ঞতা পেয়েছেন?’ নবী উত্তর দিলেন: আমার সব অভিজ্ঞতাই ভাল। উম হানী বললেন: নবীর রাত্রি ভ্রমণ আমার গৃহ থেকেই হয়েছে। ঐ রাতে নবী আমাদের গৃহে ঘুমান। এশার নামায শেষ করে উনি ঘুমাতে যান। অতি প্রত্যুষে আমরা উনাকে ভোরের নামাযের (ফজরের) জন্য জাগালাম। তিনি বললেন: ওহে উম হানী! তুমি ত সাক্ষী, আমি তোমার সাথে এশার নামায পড়েছি। এর পর আমি বায়তুল মোকাদ্দিস গেলাম এবং সেখানে নামায পড়লাম। এরপর আমি ফজরের নামায পড়লাম তোমার সামনেই। এরপর নবী চলে যাবার উদ্যোগ করলেন। আমি বললাম: এই ঘটনা কাউকে বলবেন না। কারণ তারা আপনাকে মিথ্যুক বলবে এবং আপনার ক্ষতি করবে। তিনি বললেন; আল্লাহর কসম, আমি এই ঘটনা সবাইকে জানাব। লোকেরা যখন জানল তখন বলল: আমরা কস্মিনকালেও এই ধরণের কাহিনী শুনি নাই। আল্লার রসূল (স.) জিব্রাঈলকে বললেন: ওহে জিব্রাঈল! ওহে জিব্রাঈল! ওহে জিব্রাঈল! আমার লোকজন বিশ্বাস করবে না। আবু বকরই এর সত্যতা স্বীকার করবে। কারণ আবু বকর হচ্ছেন আল সিদ্দিক। বর্ণনাকারী জানালেন: অনেক ব্যক্তিই যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং নামায পড়েছিল—তারা ইসলাম ছেড়ে দিল। নবী বলতে লাগলেন: আমি হিজরে দাঁড়িয়েছিলাম। বায়তুল মোকাদ্দিস আমি চাক্ষুষ দেখছিলাম এবং এর বর্ণনা দিচ্ছিলাম। কেউ কেউ জিজ্ঞাস করল: ঐ মসজিদের কয়টা দরজা? আমি ত তা গণনা করি নাই। তাই কল্পনায় আমি মসজিদের প্রতি লক্ষ্য করলাম এবং এক এক করে দরজার সংখ্যা গণনা করলাম। তারপর এই তথ্য জানালাম। আমি যে সব কাফেলা দেখছিলাম সেগুলোরও বিবরণ জানালাম। লোকেরা দেখল ঐ কাফেলা হুবহু আমি যা বলেছি সেই রকম। এর পরেই আল্লাহ-পাক পাঠিয়ে দিলেন তাঁর বাণী: আমরা আপনাকে সেই দৃষ্টি দিলাম যেই দৃষ্টি দ্বারা আমরা আপনাকে দেখিয়েছি মানব জাতির অগ্নিপরীক্ষা। উনি (ইবনে সা’দ) বললেন এর মানে হল: নবী যা চাক্ষুষ দেখেছেন তারই বর্ণনা। (ইবনে সা’দ, খণ্ড ১, পৃঃ ২৪৮)
এখন আমরা ইবনে ইসহাকের বর্ণনা দেখব:
উম হানী বিন্‌ত আবু তালেব, যাঁর আসল নাম হচ্ছে হিন্দ, তাঁর থেকে রসূলের রাত্রি ভ্রমণ সম্পর্কে আমি এই বর্ণনা শুনেছি:
তিনি (উম হানী) বললেন: আল্লাহর রসূলের রাত্রি ভ্রমণ আমার গৃহ ছাড়া অন্য কোথা হতে হয় নাই। ঐ রাত্রে উনি আমার গৃহে ঘুমান। রাতের সর্বশেষ নামাজ শেষ করে উনি ঘুমাতে যান; সেই সাথে আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরের কিছু আগেই উনি আমাদেরকে জাগিয়ে তুললেন। আমরা ফজরের নামাজ পড়লাম। তারপর উনি বললেন: “তুমি ত জানই তোমার সাথে এই স্থানেই (উপত্যকায়) আমি সান্ধ্য নামায পড়েছিলাম। তারপর আমি জেরুজালেমে যাই এবং সেখানেও নামায পড়ি। তারপরই তুমি ত দেখলে আমি তোমার সাথে এই ফজরের নামায পড়লাম।“ এই বলে নবী চলে যেতে চাইলেন। আমি উনার আলখাল্লা ধরে টান দিলে তা খুলে পড়ে গেল। আমি নবীর উলঙ্গ পেট দেখতে পেলাম। তাঁর সেই পেট দেখতে ছিল ভাঁজ করা মিশরীয় তুলার তৈরি পোশাক। আমি বললাম: “হে আল্লাহর নবী, আপনি এই সংবাদ কাউকে জানাবেন না। কারণ এই সংবাদ জানলে তারা আপনাকে মিথ্যুক বলবে এবং অপমান করবে।“ তিনি বললেন: “আল্লাহর কসম, আমি তাদেরকে জানাবই।“ আমার নিগ্রো ক্রীতদাসীকে নির্দেশ দিলাম: “তুমি নবীকে অনুসরণ কর আর শ্রবণ কর উনি কি বলেন, আর তারা কি বলে।“ সত্যি-সত্যি নবী উপস্থিত লোকদের ঘটনার বিবরণ দিলেন। এই শুনে তারা আশ্চর্য্যাম্বিত হয়ে গেল। তারা তাঁর দাবীর প্রমাণ চাইল। নবী বললেন তিনি অমুক অমুক কাফেলা দেখেছেন অমুক অমুক স্থানে। এই কাফেলাগুলো তাঁর বাহন দেখে ভীত হয়ে গেল। এমনকি একটা উট দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি তাদেরকে জানালাম কোথায় এই ঘটনা ঘটল। আমি বললাম যে ঐ সময় আমি সিরিয়ার পথে ছিলাম। এর পর আমি দাজানান পর্যন্ত গেলাম। সেখানে আমি অমুক গোত্রের কাফেলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম লোকজন নিদ্রিত। তাদের সাথে বয়মে ভরা পানি ছিল। বয়মের মুখ কিছু ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা ছিল। আমি ঢাকনা খুলে পানি পান করলাম। তারপর ঢাকনা লাগিয়া দিলাম। এর প্রমাণ এই যে এই মুহূর্তে ঐ কাফেলাটি তানিমের গিরিপথ দিয়ে বায়দা থেকে আসছে। কাফেলাটির অগ্রে রয়েছে কালচে রঙ্গের এক উট যার পিঠে রয়েছে দুটি বস্তা—একটি কালো আরেকটি নানাবর্ণের।“ লোকজন হুড়হুড় করে গিরিপথের মুখে চলে গেল ঐ কাফেলার আগমন দেখতে। প্রথম যে উটটি তারা দেখল তা হুবহু আমি যে রূপ বলেছিলাম সেই রূপ ছিল। তারা কাফেলার লোকদেরকে ঐ বয়েমের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করল। তারা উত্তর দিল যে বয়েমটা তারা পানি ভর্তি করে তার মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। তারা ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করল যে বয়েমের মুখ বন্ধই ছিল কিন্তু বয়েমের ভিতর ছিল শূন্য। মক্কার অন্যান্য লোকেরাও তাদের সাথে সায় দিল। এ জেনে কাফেলার লোকেরা ভীত হয়ে পড়ল এবং সে সাথে তাদের এক উটও পালিয়ে গেল। এরপর তাদের একজন উটকে ডাকতে থাকল। পরে সে উটটি ফিরে পেল। (ইবনে ইসহাক, পৃঃ ১৮৪)
আশ শিফা গ্রন্থে মেরাজ ঘটনা এই ভাবে লিখিত হয়েছে:
উম হানি বর্ণনা করলেন: “যে রাতে আল্লাহর রসূল রাত্রি ভ্রমণে যান সেই রাত্রে উনি আমার গৃহে ছিলেন। উনি আমাদের সাথে রাত্রির শেষ নামায পড়লেন এবং আমাদের সাথে ঘুমিয়ে গেলেন। ফজরের নামাযের সময় উনি আমাদেরকে জাগিয়ে দিলেন। তারপর আমাদের সাথে ফজরের নামায পড়লেন। উনি বললেন: ‘উম হানী, আমি গতরাত্রের শেষ নামায তোমার সাথে পড়েছিলাম, যা তুমি জান। তারপর আমি জেরুজালেমে গিয়ে নামায পড়েছি। আর এখন তুমি দেখছ আমি তোমার সাথে ভোরের নামায পড়েছি।‘ (আশ শিফা, পৃঃ ৯৮)
মুহাম্মদের মিশরীয় জীবনীকার হুসায়েন হাইকল লিখেছেন:
ঈস্‌রার রাত্রে মুহাম্মদ তাঁর চাচাত বোন হিন্দ বিন্‌ত আবু তালেবের গৃহে ছিলেন। হিন্দকে উম হানী বলেও ডাকা হত। হিন্দ বর্ণনা করলেন: ‘’আল্লাহর রসূল আমার ঘরে রাত্রি কাটালেন। রাত্রের নামায শেষ করে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ভোরের অল্পকিছু পূর্বে উনি আমাদেরকে জাগিয়ে দিলেন এবং আমরা সবাই একত্রে ভোরের নামায পড়লাম। নামায শেষ হলে নবী বললেন: ‘উম হানী আমি এই স্থানে তোমার সাথে রাত্রির নামায পড়েছি। তারপর আমি জেরুজালেমে গেলাম এবং সেখানে নামায পড়লাম। আর এখন ত দেখলেই আমি তোমার সাথে ভোরের নামায পড়লাম।‘ আমি উত্তর দিলাম, ‘হে আল্লাহর রসূল, আপনি কাউকে এই সংবাদ দিবেন না, কেননা তারা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলবে এবং আপনার ক্ষতি করবে।‘ উনি বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি সবাইকে জানাব।‘’’
স্যার উইলিয়াম মুরের মতে মুহাম্মদের রাত্রি ভ্রমণ হয়েছিল খুব সম্ভবত ৬২১-৬২২ সালের কোন এক সময়। অর্থাৎ মদিনায় হিজরতের বছর খানেক আগে। এবং এই সফর হয়েছিল আবু তালেবের গৃহ হতে। এখানে আবু তালেবের গৃহ বলতে কি বুঝান হয়েছে তা পরিষ্কার নয়। খুব সম্ভবত: উম হানীর গৃহ এবং আবু তালেবের গৃহ একই ছিল—কাবার একেবারেই কাছাকাছি।
পরের দিন ভোর বেলায় আবু তালেবের গৃহে যখন উনি (মুহাম্মদ) ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন তখনও উনার তন্দ্রায় সে রাতের স্বপ্নের রেশ লেগে ছিল বেশ পরিষ্কার ভাবে—যেন বাস্তবের মত। তিনি চিৎকার করে আবু তালেবের কন্যাকে বলে উঠলেন যে রাত্রি বেলায় তিনি জেরুজালেমের মসজিদে প্রার্থনা করেছেন। তারপর বললেন যে এই ঘটনা তিনি সবাইকে জানাবেন। সে সময় আবু তালেবের কন্যা উনার পোশাক ধরে মিনতি করলেন এই ব্যাপার কাউকে না জানানোর জন্য। কিন্তু নবী নিজের কথায় অটল থাকলেন। (উইলিয়াম মুর, পৃঃ ১২১)
নীচে খাসায়েসুল কুবরা থেকে মেরাজ এবং উম হানী সংক্রান্ত কিছু হাদিস দেওয়া হল:
হযরত উম্মে হানীর (রাঃ) হাদিস
ইবনে ইসহাক ও ইবনে জরীর আবূ ছালেহ এর বরাত দিয়ে রেওয়ায়েত করেছেন যে, উম্মে হানী বিনতে আবূ তালেব (রাঃ) বর্ণনা করেন, শবে মে’রাজে নবী করীম (সাঃ) আমার গৃহে নিদ্রিত ছিলেন। এর আগে তিনি এশার নামায পড়েন। এরপর তিনিও ঘুমিয়ে পড়েন এবং আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরের আগে তিনি আমাদেরকে জাগ্রত করলেন। তাঁর সাথে আমরাও যখন ভোরের নামায পড়ে নিলাম, তখন তিনি বললেন: উম্মেহানী! আমি তোমাদের সাথে এখানে এশার নামায পড়েছিলাম, যা তুমি নিজে দেখেছ এরপর আমি বায়তূল মোকাদ্দাসে চলে যাই। আমি সেখানে নামায পড়েছি। এখন আবার তোমাদের সাথে ফজরের নামায পড়লাম, যা তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছ।
তিবরানী, ইবনে মরদুওয়াইহি হযরত উম্মে হানী (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত করেন যে, শবে মে’রাজে নবী করীম (সাঃ) আমার গৃহে নিদ্রিত ছিলেন। আমি রাতে তাঁকে পেলাম না। ফলে এ আশংকায় সারারাত আমার ঘুম হল না যে, কোথাও কোরায়শরা তাঁকে অপহরণ করেনি তো?
এরপর হুযুর (সাঃ) বললেন: জিবরাঈল আমার কাছে এলেন এবং আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। আমি দরজার বাইরে একটি চতুষ্পদ জন্তু দেখলাম, যা খচ্চর অপেক্ষা নিচু ও গাধা অপেক্ষা উঁচু ছিল। জিবরাঈল আমাকে তাঁর উপর সওয়ার করিয়ে বায়তুল মকাদ্দাস নিয়ে গেলেন। আমাকে হযরত ইবরাহীম (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করালেন। তাঁর দৈহিক গড়ন আমার গড়নের অনুরূপ ছিল। জিবরাঈল মূসা (আঃ) এর সাথে দেখা করালেন। তিনি গোধুম বর্ণের, লম্বা গড়নের এবং সোজা চুলওয়ালা ছিলেন। শানওয়া গোত্রের পুরুষদের সাথে তার বহুলাংশে মিল ছিল। হযরত ঈসা (আঃ) এর সাথেও সাক্ষাৎ হয়। তিনি মাঝারি গড়নের সাদা চুলওয়ালা ছিলেন। তাঁর রঙে লালিমার ঝলক ছিল। ওরওয়া ইবনে মসউদ ছকফীর সাথে তাঁর মিল ছিল। আমাকে দাজ্জালও দেখানো হয়। তার ডান চক্ষু নিশ্চিহ্ন ছিল। সে কুতুন ইবনে আবদুল ওযযার অনুরূপ ছিল।
উম্মে হানী বর্ণনা করেন—অতঃপর হুযুর (সাঃ) দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন: আমি মে’রাজের ঘটনা বলার জন্যে কোরায়শদের কাছে যেতে চাই। উম্মে হানী বলেন; আমি হুযুর (সাঃ) এর কাপড় ধরে ফেললাম এবং বললাম; আল্লাহর কসম, যারা আপনাকে মিথ্যারোপ করে এবং আপনার কথা মেনে নিতে অস্বীকার করে, আপনি তাদের কাছে যাবেন না। তারা আপনার বাড়াবাড়ি করবে। কিন্তু তিনি আমার কথায় কর্ণপাত করলেন না এবং আমার হাত থেকে কাপড় ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন। কয়েকজন কোরায়েশ নেতা এক জায়গায় সমবেত ছিল। হুযুর (সাঃ) সেখানে যেয়ে মে’রাজের ঘটনা বর্ণনা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুতয়িম ইবনে আদী দাঁড়িয়ে গেল এবং বলল: মোহাম্মদ! যদি তুমি সুস্থ চিন্তা ভাবনার অধিকারী হতে, তবে এমন আজগুবী কথা বলতে না। এরপর উপস্থিত লোকদের একজন বলল: মোহাম্মদ! আপনি অমুক অমুক জায়গায় আমাদের উটদের কাছে গিয়েছিলেন?
আবূ ইয়ালা ও ইবনে আসাকির রেওয়ায়েতে হযরত উম্মে হানী (রাঃ) বলেন: নবী করীম (সাঃ) ভোর বেলায় আমার কাছে আগমন করলেন। আমি তখন শয্যায় ছিলাম। তিনি বললেন: তুমি তো জান আমি আজ রাতে মসজিদে হারামে নিদ্রিত ছিলাম। জিবরাইল আমার কাছে এসে আমাকে মসজিদের দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। আমি একটা সাদা চতুষ্পদ জন্তু দেখলাম, যা গাধার চেয়ে উঁচু এবং খচ্চরের চেয়ে নীচু ছিল।
তার উভয় কান স্থির ছিল না—কেবলি আন্দোলিত হচ্ছিল। আমি তাতে সওয়ার হলাম। জিবরাঈল আমার সঙ্গে ছিলেন। জন্তুটি আপন পা দৃষ্টির শেষ সীমায় রেখে রেখে চলতে লাগল। যখন সে নিম্নভূমিতে চলত, তখন তার হাত লম্বা এবং পা খাটো হয়ে যেত, আর যখন উঁচু জায়গায় আরোহণ করত, তখন পা লম্বা ও হাত খাটো হয়ে যেত।
আমরা বায়তুল মোকাদ্দাসে পৌঁছলাম। আমি জন্তুটি সেই বৃত্তের সাথে বেঁধে দিলাম, যেখানে পয়গাম্বারগণ আপন আপন সওয়ারী বাঁধতেন। পয়গাম্বারগণকে আমার সামনে প্রকাশ করা হল। তাঁদের মধ্যে হযরত ইবরাহীম, মূসা, ও ঈসা (আঃ) ছিলেন। আমি তাঁদেরকে নামায পড়ালাম এবং তাঁদের সাথে কথাবার্তা বললাম। এরপর আমার সামনে লাল ও সাদা দুটি পাত্র আনা হল। আমি সাদা পাত্রটি পান করলাম। জিবরাঈল বললেন: আপনি দুধ পান করেছেন এবং শরাব প্রত্যাখান করেছেন। শরাব পান করলে আপনার উম্মত মুরতাদ হয়ে যেত। এরপর আমি সওয়ারীতে সওয়ার হয়ে মসজিদে হারামে এলে ফজরের নামায পড়েছি।
উম্মে হানী বর্ণনা করেন—একথা শুনে আমি হুযুর (সাঃ) এর চাদর ধরে ফেললাম এবং বললাম: ভাই। আমি আপনাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি, যদি আপনি কোরায়শদের সামনে একথা প্রকাশ করেন, তবে যারা এখন ঈমানদার, তারাও বেঈমান হয়ে যাবে। হুযুর (সাঃ) চাদরের উপর হাত মেরে সেটি আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। চাদর তার পেট থেকে সরে গেল। আমি তার লুঙ্গির উপর পেটের ভাজকে জড়ানো কাগজের ন্যায় দেখতে পেলাম। আমি আরও দেখলাম, তাঁর হৃদপিণ্ডের জায়গা থেকে নূর বিচ্ছুরিত হচ্ছিল এবং আমার দৃষ্টি ছিনিয়ে নেয়ার উপক্রম হচ্ছিল। আমি অভিভূত হয়ে সিজদায় পড়ে গেলাম। যখন মাথা তুললাম তখন দেখি হুযুর (সাঃ) চলে গেছেন। আমি কাল বিলম্ব না করে বাঁদীকে বললাম: জলদি তাঁর পিছনে পিছনে যা। তিনি কি বলেন এবং শ্রোতারা কি জওয়াব দেয়, তা শুনে তাড়াতাড়ি আমার কাছে আয়। (খাসায়েসুল কুবরা, খণ্ড ১, পৃঃ ৩৩৪ ৩৩৮)