কুসংস্কার থেকে না মুক্তচিন্তা থেকে ওয়াক আউট?
আমরা সবাই জানি যে, গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ থেকে বিরোধী সাংসদরা সরকারী দলের সাথে মতামতে না মিললে মাঝে মাঝে ওয়াক আউট করেন, আবার অংশগ্রহণ করেন, কখনও বর্জন করেন, আবার অংশগ্রহণ করেন। তবে লম্বা সময় ধরে সংসদের বাইরে থাকেন না। আমাদের দেশে নিজের সাংসদ পদ বহাল রাখার জন্য যে সময়টুকু আইনী প্যাঁচে থাকা দরকার এর বেশি সংসদে থাকেন না।
তেমনি, সংস্কার, কুসংস্কার,নাস্তিক ও আস্তিকের বিষয়টিও অনেকের মনে এমনই দোলাচলে দোলায়িত। স্বার্থ, সময় ও সুযোগ বুঝে মুক্তচিন্তায় প্রবেশ করেন, মুক্তচিন্তা থেকে ওয়াক আউট করেন, মুক্তচিন্তায় অংশগ্রহণ করেন।
অন্যভাবে বলা যায়, সময় বুঝে কুসংস্কার থেকে ওয়াক আউট করেন, কুসংস্কার বর্জন করেন, আবার কুসংস্কারে বুঁদ হয়ে থাকেন। এ বুঁদ হয়ে থাকার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে তা আমার পর্যবেক্ষনের রাডারে ধরা পড়ছে না। কারণ আমাদের রঙ বদলানো চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য। ওয়াক আউটের নীতিহীনতা। যেমন, বামপন্থীদের হজ্বব্রত পালন।
শৈশবে দেখতাম পঞ্জিকা দেখে যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করা হত । দিনে না মিললে বলা হইতো বুধবার যাত্রা শুভ। অথবা ডাকে পাখি না ছাড়ে বাসা সেই সমকে বলে উষা এবং নিদেনপক্ষে যে কোনদিন ঐ সময়ে যাত্রা করা শুভ। আর যাত্রা বলতে বড় জোর মামার বাড়ী যাওয়া। বউদের বাপের বাড়ি যাওয়া। শ্বশুর বাড়ি যাওয়া।। পড়তে শহরে যাওয়া।
আবার এক ঘর থেকে ছেলের বউ ও মেয়ে একদিনে যেতে দিত না। এখনও আমি আমার বাপের বাড়ি নরসিংদী গেলে কোন কোন পরিবারে দেখি বা শুনি, না আজ মেয়ের যাওয়া উচিত না। বউ গেল। কাজেই মেয়ে খুশিতে ডগমগ, কিন্তু মেয়ের জামাইয়ের রাগারাগি। এ নিয়ম মানতে ও মানাতে গিয়ে অশান্তি।জামাইয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে ওয়াক আউট করার ঘটনার অঢেল উদাহরণ বিরাজমান।
বা আজ মেয়ে গেল। কাজেই বউ কাল যাবে। এদিকে বউয়ের গাল ফোলা। একদিন আগে বাপের বাড়ি যেতে পারল না। অসন্তোষ।বিক্ষোভও হয়।পাতিল ভাঙ্গার ঘটনাও নজিরবিহীন না।
অন্যদিকে, ভিসা পেলে প্লেনের টিকিট কাট। টিকিট আবার সস্তাটা খোঁজো বা উপো্যগী রুট খোঁজ কিংবা ট্রানজিটে সময় কম লাগে খোঁজ। অথবা, এক দেশে যেতে ট্রানজিটে আরেক দেশ দেখার সুযোগ খোঁজ। ভর্তির বা ক্লাস শুরুর তারিখ বা চাকরিতে যোগদানের সময় দেখে যাবার তারিখ ঠিক কর। কোথায় গেল পঞ্জিকা আর কোথায়ই বা শুভ দিনের গণনা! এক্ষেত্রে আমার মায়ের যুক্তি ছিল–মাসের ত্রিশ দিনই ভগবানের। এটা কি আস্তিকতা থেকে নাস্তিকতার দিকে যাত্রা নয়? আর প্রয়োজন, সময়ের চাহিদা, সমসাময়িক পরিস্থিতি কি মানুষকে অলৌকিক শক্তির অস্তিত্বকে অস্বীকার করার শক্তি যোগায় না? যোগায়।
এ অমোঘ সত্যটি আমরা কেউ কেউ মানি না। কেউ কেউ নিজে তো মানি ই না, অন্যে যাতে না মানে এর জন্য চাপাতি নিয়ে সদা প্রস্তুত। দিনে পাঁচবার অলৌকিক শক্তির অস্তিত্বকে জানান দেয়। আবার অন্য গোষ্ঠি তাদের বিশ্বস্ত অলৌকিক শক্তির কথা বলতে গেলে এরা আগুনে তাদের ঘর পোড়ায়। এ সদা প্রস্তুত মূর্খদের নিয়ে সরকার ভীত বা রাজনৈতিক খেলায় মত্ত, সাধারণ জনপদ সন্ত্রস্ত, মডারেটরা আহ্বলাদিত, পরহেজগাররা গর্বিত। আর? আর! নাস্তিকেরা তাদের মোকাবেলায় প্রস্তুত। তবে তীক্ষ্ণ যুক্তি নিয়ে। অকাট্য প্রমান দিয়ে। চাপাতি পার্টির সে ক্ষমতা নেই। তাদের যুক্তির ধার নেই, তবে চাপাতির ধার আছে।
২০১৪ সালে আমার চট্টগ্রামের বাসার রান্না ঘরে পাখির পায়খানাসহ খড়কুটোর আবর্জনায় ভরপুর। ঢাকা থেকে লম্বা ছুটি কাটিয়ে ভোরবেলা ঘরে ঢুকে তো এক মহা অস্বস্তিতে। বুঝতে পারছি না কোত্থেকে এসব এলো। পরে আবিষ্কার করলাম রান্না ঘরের এক্সজস্টেড পাখার নিচে জালালী কবুতরের বাসা।
বিল্ডিং এর কেয়ার টেকারকে বললাম একটা ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু এটা নাকি সৌভাগ্যের লক্ষণ।গৃহকর্মী ও কেয়ার টেকার আমার সৌভাগ্য নিয়ে আপ্লুত।ছোটবালায় দেখেছি দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের কাঠের দোতালার বারান্দায় জালালী কবুতরের বাসা। পায়খানা করে বারান্দা ভরিয়ে রাখত তবুও তাড়াতো না। এ জাতের কবুতরের বাচ্চা খাওয়াও যায় না। অথচ তাদের জন্য আমার ঠাকুমা, বোন ও কাকারা খাবার ছড়িয়ে রাখতেন।
আমার চট্টগ্রামের বাসা থেকে যেন না তাড়াই সে জন্য গৃহকর্মী ও কেয়ার টেকারের বলিষ্ঠ্য অনুরোধ ও পরামর্শ। এক্সজস্টেড পাখার ফাঁকে আমার সৌভাগ্যের স্থায়িত্বের জন্য নয়, কবুতরের দুটো বাচ্চা হয়েছে জেনে তাড়াইনি।পরে পর পর কয়েকদিন রান্না ঘরে ময়লা আবর্জনা সইতে না পেরে কবুতরের বাচ্চা দুটোকে বারান্দায় স্থানান্তরিত করি।। অবশেষে কবুতর নিজেই অন্যত্র স্থানান্তরিত হয় আমার তথাকথিত সৌভাগ্যের পাখায় ভর করে। কারণ, জালালী কবুতর অন্যত্র চলে যাওয়াতেই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছে। বাসায় ফিরে কবুতরের পায়খানাসহ আবর্জনার জঞ্জাল পরিস্কারের দায় থেকে মুক্তি মিলেছিলো।
ছুঁয়ে দেখা হয়নি:
(লেখাটি লিখতে শুরু করেছিলাম অভিজিৎ রায়ের ২০১৫ সালের জন্মদিনে মুক্তমনা ব্লগের আয়োজনে দেওয়ার জন্য। লেখাটি শেষ করতে এত সময় নেওয়ার পেছনে আলস্যের চেয়েও বেশি যে ভাবনাটা কাজ করেছে তা হল লেখাটি লিখতে বলা হয়েছিলো অভিজিৎ রায়কে নিয়ে।)
আমার নাস্তিক হওয়া হঠাৎ করেই। তথাকথিত ‘শয়তানী’ বা ‘কুফরি’ বই পড়ে নাস্তিক হইনি। হঠাৎ একদিন বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার যাবতীয় অর্জনের দায় আমারই, ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা সর্বশক্তিমান কারো নয়। দোয়া-মোনাজাত-প্রার্থনা কোনোই কাজে আসে না।
নাস্তিকতা গোপন রাখিনি কারো কাছেই। পরিণামে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম পর্যায়ে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে অনবরত তর্ক-বিতর্ক এবং পরবর্তী পর্যায়ে সকলের কাছে পরকালবিষয়ক করুণা ও হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হই। শেষ পর্যন্ত উভয় পংতিতেই অপাংতেয় ও অগ্রহণযোগ্য এক সত্ত্বায় পরিণত হই।
সেসময় অভিজিৎ রায়কে খুঁজে পেলে বা তার লেখনী পড়তে পারলে নিজের কাছেই নিজেকে সন্তুষ্ট করে তুলতে পারতাম। কারণ কুসংস্কার, ধর্মীয় কুসংস্কার তো বটেই, যুক্তির ধার ধারে না। কিন্তু তবু কূটতর্কে বা ভ্রমাত্মক যুক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা আমার জন্য কষ্টকর ছিল। এরকম বিজ্ঞানভিত্তিক লেখনীর অভাবে চেতনা ছিল অপুষ্ট। অবান্তর কথা বলে আমাকে রাগানোও সহজ, আজও।
এসময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়লাম মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে, পরকালবিষয়ক করুণা ও হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হলাম আরেক দফা। নতুনত্বের মধ্যে এইই যে, ঠাট্টা ও করুণা করার জন্য প্রসঙ্গের পাশাপাশি এবার বন্ধুতালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরাও যুক্ত হল। কিন্তু সমমনা কাউকে পাইনি খুঁজে।
আরজ আলী মাতুব্বর, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এদেরকে সঙ্গে নিয়ে এভাবেই কোণঠাসা জীবন চলছিল জীবনের নিজের মতো। দলের নেতাদের কর্মকান্ডে হতাশা পেয়ে বসতে শুরু করেছে তখন। সেই সময় ২০০৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অডিটোরিয়ামে শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ আয়োজিত ‘আইনস্টাইনের পদার্থবিদ্যার জগৎ ও বিজ্ঞানের দর্শন’ শীর্ষক দিনব্যাপী সেমিনারে এলাম। সেমিনারের বাইরে বিক্রয়ের জন্য কিছু বই রাখা ছিল। বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে চোখে আটকালো একটি বইয়ের নাম। চোখে আটকালো কারণ যেসব বইয়ের সঙ্গে বইটি ছিল সেসবের নামের সঙ্গে বইটির নামের ধরণে অমিল, যদিও প্রচ্ছদের ছবিটি ছিল অন্য বইগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ নামটির কারণেই বইটি উল্টে পালটে দেখার আগ্রহ হয়েছিলো সেদিন। বিষয়বস্তু ও সূচিপত্র দেখে বইটি কিনে নিতে দেরি করিনি সেদিন।
ব্রুনো, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও বা আইনস্টাইন আমার কাছে নতুন কেউ না হলেও স্ট্রিং থিওরির সঙ্গে অভিজিৎ রায়ের এই বইটি দিয়েই আমার প্রথম পরিচয়। বইটি আমাকে যেন কুয়া থেকে তুলে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল সেই সময়। আর বইটির সপ্তম পর্ব আমার অপুষ্ট চেতনাকে শক্তি দিয়েছিল সেদিন। কাঙ্ক্ষিত যুক্তিগুলো পেয়ে গিয়েছিলাম এই সপ্তম পর্বেই।
আমি জীবনটাকে সাধারণভাবেই নিয়েছি সবসময়। এই পৃথিবীতে জন্মানোর পেছনে ‘বিশেষ’ কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে ফিরিনি, নিজেকে প্রকৃতির বাস্তুতন্ত্রে বিশেষ কোনো অবস্থানে ভাবিনি। আমিও মনে করি জীবনের একমাত্র লক্ষ্য যাপন করে যাওয়া। আমি তাই করতে চেয়েছি সবসময়, আজও তাই চাই। ‘প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তি’র ইঁদুরদৌড়ে তাই আমি ছিলাম অনুপস্থিত। চাওয়ার মধ্যে ছিল শুধু সত্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা। অভিজিৎ রায় আমার হাতদুটো ধরে সত্যকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে শাহবাগে চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে কিনলাম তার ও রায়হান আবীরের সম্মিলিত প্রয়াস ‘অবিশ্বাসের দর্শন’। বইটি যেন আমার জন্যই লেখা। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট কান্ডজ্ঞানগুলো আরও পরিশীলিতভাবে জ্ঞান হয়ে উঠেছে এই বইয়ে। সমকালীন সমমনারূপী বর্ণচোরাদের মোকাবেলার রসদও পেয়ে গেলাম বইটিতে।
ততদিনে ব্লগ ব্লগার উভয়ই পরিণত হয়েছে অস্পৃশ্যে। ব্লগ পড়া আর ব্লগে লেখা দুটোই চরম ‘গুনাহ’র কাজ। আমি প্রস্তর যুগের মানুষ, শক্ত দুই মলাটে বাঁধা কাগজের বান্ডিলই তখনো আমার জ্ঞানের উৎস। কিন্তু আদম-ইভের সন্তান আমি, নিষিদ্ধ ফলের খোঁজ পেতেই সময় লেগেছে যা একটু, খেতে সময় লাগেনি। ব্লগে, ফেসবুকে পেয়ে গেলাম আসিফ মহিউদ্দীন, ওমর ফারুক লুক্স, সুষুপ্ত পাঠকসহ সমমনা আরও অনেকের অনেক অনেক লেখা। আমি আর একা নই।
২০১৪ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে উপহার পেলাম (সত্য হল আদায় করলাম এক বন্ধুর কাছ থেকে) ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’। আমার কছে বইটির বিষয়বস্তু ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটির কাছাকাছি মনে হলেও ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটি চিরসবুজ আর নতুন এই বইটি লেখা হয়েছে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে। ৭১এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণআন্দোলন, ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে স্থপতি ও ব্লগার রাজিব হায়দারের করুণ মৃত্যু, পরবর্তীতে মুক্তচিন্তার চর্চাকারী এবং যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াইয়ের পুরোধা ব্লগারদের প্রতি রাষ্ট্রীয় জুলুম-অন্যায়ও অভিজিৎ রায়ের লেখনী এড়ায়নি।
তারপর ফেসবুকে হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করি অভিজিৎ রায়কে। তখন আবার ফেক আইডির প্রাদুর্ভাব ফেসবুকজুড়ে। অভিজিৎ রায়ের নামেও একাধিক আইডি পেয়েছিলাম তখন। মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখে নিশ্চিত হয়ে যোগাযোগ করতেই সাড়া দিলেন তিনি। একটু অবাকও হয়েছিলাম একদিনের মাথায় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করায়। কারণ ফ্রেন্ড একসেপ্ট করার বিষয়ে ব্লগাররা তখন খুবই সাবধান। অভিজিৎ রায় বোধহয় সবসময়ই নিজের সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন।
‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ থেকেই ‘মুক্তমনা’ ব্লগের কথা জানলেও তা নানা কারণে ভুলে গিয়েছিলাম। অভিজিৎ রায়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেই ব্লগটি খুঁজে পাই।
আমি পারতপক্ষে অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে চ্যাট করতাম না, সংকোচ কাজ করত। তবে কথা বললে আন্তরিক জবাব পেয়েছি। মার্চ ২০১৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৫ অচেনা দূরের একজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য আমার পক্ষে অনেক কম সময়, তাই এর মাঝে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো কথাও নেই আমাদের মাঝে।
‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইটির সূত্র ধরে ২০১৫র ফেব্রুয়ারিতে অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে কদিন টানা চ্যাট চলে আমার। নির্ধারিত সময়ের বেশ পরে বের হয় বইটি, ১৬ তারিখে। সেবার প্রতিদিনই বই মেলায় গেলেও আমি জানতাম না তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। বইটির কিছু পাতা পড়ে তিনি আমেরিকাতে আছেন এমন ভেবে নিয়েই ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে মেসেজে মতামত জানাই। বিকেলে চাকরির জন্য একটি সাক্ষাৎকার থাকায় সেদিন বই মেলায় গিয়েছিলাম রাত করেই। বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় একপাক ঘুরে ঘরে ফেরার জন্য যখন টিএসসির কাছে পৌঁছলাম, অস্বাভাবিক একটা ভিড় চোখে পড়ে আমার। একজনকে জিজ্ঞেস করতে সে জানায়, একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে কারা যেন মেরেছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি সাধারণ ঘটনা, এরকম স্টেরিওটাইপ চিন্তায় ভর করেই এগিয়ে চলেছিলাম আমি। সিএনজি অটোরিকশাটাও দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিড় ঠেলে ফুটপাত ঘরে এগিয়ে যাওয়ার সময় ফুটপাত কালো করে রাখা পুডিংয়ের মতো রক্ত দেখি, পাশে পড়েছিল চশমা। জমে থাকা রক্তের পরিমান মারামারির তুলনায় অস্বাভাবিক বেশি মনে হলেও ‘একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে কারা যেন মেরেছে’ এই ভাবনা আমাকে বেশি কিছু ভাবতে দেয়নি, অভিজিৎ রায়ের কথা তো নয়ই। বাসায় ফিরে টিভিতে নিউজ ক্রলে দেখলাম আমি কার রক্তের উপর দিয়ে এসেছি। বন্ধুও বাসায় ফিরেই যা জানার জেনেছিল। আমাকে ফোন করে ও শুধু বলল, “সব শেষ হয়ে গেল রে ধ্রুব…”
পুরো লেখাটি পড়ে দেখলাম আমি নিজের কথাই লিখে গিয়েছি শুধু, এখানে অভিজিৎ রায়কে নিয়ে তেমন কোনো কথাই আমি লিখতে পারিনি। কারণ অভিজিৎ রায় সম্পর্কে আমি তো কিছুই জানি না। আমার কাছে অভিজিৎ রায় মানে মুক্তমনা ব্লগ। আমার কাছে অভিজিৎ রায় মানে ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ থেকে শুরু করে ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ পর্যন্ত কয়েকটি বই শুধু। অভিজিৎ রায়ের হাতের স্পর্শও এসব বইয়ে নেই।
অভিজিৎ রায়ের ডান হাতটি ধরে দেখতে কেমন লাগে তা আমার জানা নেই। কারণ আমি তার কফিন ছুঁয়ে দেখেছি শুধু। তাকে আমার ছুঁয়ে দেখা হয়নি।
মাল্টিভার্স সত্য হোক। দূরে বহুদূরে মৌলবাদহীন অন্য এক পৃথিবীতে বন্যা আহমেদকে নিয়ে আপনি অনেক অনেক ভাল থাকুন, অভিজিৎ রায়। আমরা আঁধারের যাত্রী, আমাদেরকে পথ পাড়ি দিতে হবে আরও হাজার বছর।
আমরা সবাই জানি যে, গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ থেকে বিরোধী সাংসদরা সরকারী দলের সাথে মতামতে না মিললে মাঝে মাঝে ওয়াক আউট করেন, আবার অংশগ্রহণ করেন, কখনও বর্জন করেন, আবার অংশগ্রহণ করেন। তবে লম্বা সময় ধরে সংসদের বাইরে থাকেন না। আমাদের দেশে নিজের সাংসদ পদ বহাল রাখার জন্য যে সময়টুকু আইনী প্যাঁচে থাকা দরকার এর বেশি সংসদে থাকেন না।
তেমনি, সংস্কার, কুসংস্কার,নাস্তিক ও আস্তিকের বিষয়টিও অনেকের মনে এমনই দোলাচলে দোলায়িত। স্বার্থ, সময় ও সুযোগ বুঝে মুক্তচিন্তায় প্রবেশ করেন, মুক্তচিন্তা থেকে ওয়াক আউট করেন, মুক্তচিন্তায় অংশগ্রহণ করেন।
অন্যভাবে বলা যায়, সময় বুঝে কুসংস্কার থেকে ওয়াক আউট করেন, কুসংস্কার বর্জন করেন, আবার কুসংস্কারে বুঁদ হয়ে থাকেন। এ বুঁদ হয়ে থাকার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে তা আমার পর্যবেক্ষনের রাডারে ধরা পড়ছে না। কারণ আমাদের রঙ বদলানো চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য। ওয়াক আউটের নীতিহীনতা। যেমন, বামপন্থীদের হজ্বব্রত পালন।
শৈশবে দেখতাম পঞ্জিকা দেখে যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করা হত । দিনে না মিললে বলা হইতো বুধবার যাত্রা শুভ। অথবা ডাকে পাখি না ছাড়ে বাসা সেই সমকে বলে উষা এবং নিদেনপক্ষে যে কোনদিন ঐ সময়ে যাত্রা করা শুভ। আর যাত্রা বলতে বড় জোর মামার বাড়ী যাওয়া। বউদের বাপের বাড়ি যাওয়া। শ্বশুর বাড়ি যাওয়া।। পড়তে শহরে যাওয়া।
আবার এক ঘর থেকে ছেলের বউ ও মেয়ে একদিনে যেতে দিত না। এখনও আমি আমার বাপের বাড়ি নরসিংদী গেলে কোন কোন পরিবারে দেখি বা শুনি, না আজ মেয়ের যাওয়া উচিত না। বউ গেল। কাজেই মেয়ে খুশিতে ডগমগ, কিন্তু মেয়ের জামাইয়ের রাগারাগি। এ নিয়ম মানতে ও মানাতে গিয়ে অশান্তি।জামাইয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে ওয়াক আউট করার ঘটনার অঢেল উদাহরণ বিরাজমান।
বা আজ মেয়ে গেল। কাজেই বউ কাল যাবে। এদিকে বউয়ের গাল ফোলা। একদিন আগে বাপের বাড়ি যেতে পারল না। অসন্তোষ।বিক্ষোভও হয়।পাতিল ভাঙ্গার ঘটনাও নজিরবিহীন না।
অন্যদিকে, ভিসা পেলে প্লেনের টিকিট কাট। টিকিট আবার সস্তাটা খোঁজো বা উপো্যগী রুট খোঁজ কিংবা ট্রানজিটে সময় কম লাগে খোঁজ। অথবা, এক দেশে যেতে ট্রানজিটে আরেক দেশ দেখার সুযোগ খোঁজ। ভর্তির বা ক্লাস শুরুর তারিখ বা চাকরিতে যোগদানের সময় দেখে যাবার তারিখ ঠিক কর। কোথায় গেল পঞ্জিকা আর কোথায়ই বা শুভ দিনের গণনা! এক্ষেত্রে আমার মায়ের যুক্তি ছিল–মাসের ত্রিশ দিনই ভগবানের। এটা কি আস্তিকতা থেকে নাস্তিকতার দিকে যাত্রা নয়? আর প্রয়োজন, সময়ের চাহিদা, সমসাময়িক পরিস্থিতি কি মানুষকে অলৌকিক শক্তির অস্তিত্বকে অস্বীকার করার শক্তি যোগায় না? যোগায়।
এ অমোঘ সত্যটি আমরা কেউ কেউ মানি না। কেউ কেউ নিজে তো মানি ই না, অন্যে যাতে না মানে এর জন্য চাপাতি নিয়ে সদা প্রস্তুত। দিনে পাঁচবার অলৌকিক শক্তির অস্তিত্বকে জানান দেয়। আবার অন্য গোষ্ঠি তাদের বিশ্বস্ত অলৌকিক শক্তির কথা বলতে গেলে এরা আগুনে তাদের ঘর পোড়ায়। এ সদা প্রস্তুত মূর্খদের নিয়ে সরকার ভীত বা রাজনৈতিক খেলায় মত্ত, সাধারণ জনপদ সন্ত্রস্ত, মডারেটরা আহ্বলাদিত, পরহেজগাররা গর্বিত। আর? আর! নাস্তিকেরা তাদের মোকাবেলায় প্রস্তুত। তবে তীক্ষ্ণ যুক্তি নিয়ে। অকাট্য প্রমান দিয়ে। চাপাতি পার্টির সে ক্ষমতা নেই। তাদের যুক্তির ধার নেই, তবে চাপাতির ধার আছে।
২০১৪ সালে আমার চট্টগ্রামের বাসার রান্না ঘরে পাখির পায়খানাসহ খড়কুটোর আবর্জনায় ভরপুর। ঢাকা থেকে লম্বা ছুটি কাটিয়ে ভোরবেলা ঘরে ঢুকে তো এক মহা অস্বস্তিতে। বুঝতে পারছি না কোত্থেকে এসব এলো। পরে আবিষ্কার করলাম রান্না ঘরের এক্সজস্টেড পাখার নিচে জালালী কবুতরের বাসা।
বিল্ডিং এর কেয়ার টেকারকে বললাম একটা ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু এটা নাকি সৌভাগ্যের লক্ষণ।গৃহকর্মী ও কেয়ার টেকার আমার সৌভাগ্য নিয়ে আপ্লুত।ছোটবালায় দেখেছি দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের কাঠের দোতালার বারান্দায় জালালী কবুতরের বাসা। পায়খানা করে বারান্দা ভরিয়ে রাখত তবুও তাড়াতো না। এ জাতের কবুতরের বাচ্চা খাওয়াও যায় না। অথচ তাদের জন্য আমার ঠাকুমা, বোন ও কাকারা খাবার ছড়িয়ে রাখতেন।
আমার চট্টগ্রামের বাসা থেকে যেন না তাড়াই সে জন্য গৃহকর্মী ও কেয়ার টেকারের বলিষ্ঠ্য অনুরোধ ও পরামর্শ। এক্সজস্টেড পাখার ফাঁকে আমার সৌভাগ্যের স্থায়িত্বের জন্য নয়, কবুতরের দুটো বাচ্চা হয়েছে জেনে তাড়াইনি।পরে পর পর কয়েকদিন রান্না ঘরে ময়লা আবর্জনা সইতে না পেরে কবুতরের বাচ্চা দুটোকে বারান্দায় স্থানান্তরিত করি।। অবশেষে কবুতর নিজেই অন্যত্র স্থানান্তরিত হয় আমার তথাকথিত সৌভাগ্যের পাখায় ভর করে। কারণ, জালালী কবুতর অন্যত্র চলে যাওয়াতেই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছে। বাসায় ফিরে কবুতরের পায়খানাসহ আবর্জনার জঞ্জাল পরিস্কারের দায় থেকে মুক্তি মিলেছিলো।
ছুঁয়ে দেখা হয়নি:
(লেখাটি লিখতে শুরু করেছিলাম অভিজিৎ রায়ের ২০১৫ সালের জন্মদিনে মুক্তমনা ব্লগের আয়োজনে দেওয়ার জন্য। লেখাটি শেষ করতে এত সময় নেওয়ার পেছনে আলস্যের চেয়েও বেশি যে ভাবনাটা কাজ করেছে তা হল লেখাটি লিখতে বলা হয়েছিলো অভিজিৎ রায়কে নিয়ে।)
আমার নাস্তিক হওয়া হঠাৎ করেই। তথাকথিত ‘শয়তানী’ বা ‘কুফরি’ বই পড়ে নাস্তিক হইনি। হঠাৎ একদিন বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার যাবতীয় অর্জনের দায় আমারই, ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা সর্বশক্তিমান কারো নয়। দোয়া-মোনাজাত-প্রার্থনা কোনোই কাজে আসে না।
নাস্তিকতা গোপন রাখিনি কারো কাছেই। পরিণামে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম পর্যায়ে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে অনবরত তর্ক-বিতর্ক এবং পরবর্তী পর্যায়ে সকলের কাছে পরকালবিষয়ক করুণা ও হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হই। শেষ পর্যন্ত উভয় পংতিতেই অপাংতেয় ও অগ্রহণযোগ্য এক সত্ত্বায় পরিণত হই।
সেসময় অভিজিৎ রায়কে খুঁজে পেলে বা তার লেখনী পড়তে পারলে নিজের কাছেই নিজেকে সন্তুষ্ট করে তুলতে পারতাম। কারণ কুসংস্কার, ধর্মীয় কুসংস্কার তো বটেই, যুক্তির ধার ধারে না। কিন্তু তবু কূটতর্কে বা ভ্রমাত্মক যুক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা আমার জন্য কষ্টকর ছিল। এরকম বিজ্ঞানভিত্তিক লেখনীর অভাবে চেতনা ছিল অপুষ্ট। অবান্তর কথা বলে আমাকে রাগানোও সহজ, আজও।
এসময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়লাম মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে, পরকালবিষয়ক করুণা ও হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হলাম আরেক দফা। নতুনত্বের মধ্যে এইই যে, ঠাট্টা ও করুণা করার জন্য প্রসঙ্গের পাশাপাশি এবার বন্ধুতালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরাও যুক্ত হল। কিন্তু সমমনা কাউকে পাইনি খুঁজে।
আরজ আলী মাতুব্বর, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এদেরকে সঙ্গে নিয়ে এভাবেই কোণঠাসা জীবন চলছিল জীবনের নিজের মতো। দলের নেতাদের কর্মকান্ডে হতাশা পেয়ে বসতে শুরু করেছে তখন। সেই সময় ২০০৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অডিটোরিয়ামে শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ আয়োজিত ‘আইনস্টাইনের পদার্থবিদ্যার জগৎ ও বিজ্ঞানের দর্শন’ শীর্ষক দিনব্যাপী সেমিনারে এলাম। সেমিনারের বাইরে বিক্রয়ের জন্য কিছু বই রাখা ছিল। বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে চোখে আটকালো একটি বইয়ের নাম। চোখে আটকালো কারণ যেসব বইয়ের সঙ্গে বইটি ছিল সেসবের নামের সঙ্গে বইটির নামের ধরণে অমিল, যদিও প্রচ্ছদের ছবিটি ছিল অন্য বইগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ নামটির কারণেই বইটি উল্টে পালটে দেখার আগ্রহ হয়েছিলো সেদিন। বিষয়বস্তু ও সূচিপত্র দেখে বইটি কিনে নিতে দেরি করিনি সেদিন।
ব্রুনো, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও বা আইনস্টাইন আমার কাছে নতুন কেউ না হলেও স্ট্রিং থিওরির সঙ্গে অভিজিৎ রায়ের এই বইটি দিয়েই আমার প্রথম পরিচয়। বইটি আমাকে যেন কুয়া থেকে তুলে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল সেই সময়। আর বইটির সপ্তম পর্ব আমার অপুষ্ট চেতনাকে শক্তি দিয়েছিল সেদিন। কাঙ্ক্ষিত যুক্তিগুলো পেয়ে গিয়েছিলাম এই সপ্তম পর্বেই।
আমি জীবনটাকে সাধারণভাবেই নিয়েছি সবসময়। এই পৃথিবীতে জন্মানোর পেছনে ‘বিশেষ’ কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে ফিরিনি, নিজেকে প্রকৃতির বাস্তুতন্ত্রে বিশেষ কোনো অবস্থানে ভাবিনি। আমিও মনে করি জীবনের একমাত্র লক্ষ্য যাপন করে যাওয়া। আমি তাই করতে চেয়েছি সবসময়, আজও তাই চাই। ‘প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তি’র ইঁদুরদৌড়ে তাই আমি ছিলাম অনুপস্থিত। চাওয়ার মধ্যে ছিল শুধু সত্যকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা। অভিজিৎ রায় আমার হাতদুটো ধরে সত্যকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে শাহবাগে চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে কিনলাম তার ও রায়হান আবীরের সম্মিলিত প্রয়াস ‘অবিশ্বাসের দর্শন’। বইটি যেন আমার জন্যই লেখা। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট কান্ডজ্ঞানগুলো আরও পরিশীলিতভাবে জ্ঞান হয়ে উঠেছে এই বইয়ে। সমকালীন সমমনারূপী বর্ণচোরাদের মোকাবেলার রসদও পেয়ে গেলাম বইটিতে।
ততদিনে ব্লগ ব্লগার উভয়ই পরিণত হয়েছে অস্পৃশ্যে। ব্লগ পড়া আর ব্লগে লেখা দুটোই চরম ‘গুনাহ’র কাজ। আমি প্রস্তর যুগের মানুষ, শক্ত দুই মলাটে বাঁধা কাগজের বান্ডিলই তখনো আমার জ্ঞানের উৎস। কিন্তু আদম-ইভের সন্তান আমি, নিষিদ্ধ ফলের খোঁজ পেতেই সময় লেগেছে যা একটু, খেতে সময় লাগেনি। ব্লগে, ফেসবুকে পেয়ে গেলাম আসিফ মহিউদ্দীন, ওমর ফারুক লুক্স, সুষুপ্ত পাঠকসহ সমমনা আরও অনেকের অনেক অনেক লেখা। আমি আর একা নই।
২০১৪ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে উপহার পেলাম (সত্য হল আদায় করলাম এক বন্ধুর কাছ থেকে) ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’। আমার কছে বইটির বিষয়বস্তু ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটির কাছাকাছি মনে হলেও ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটি চিরসবুজ আর নতুন এই বইটি লেখা হয়েছে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে। ৭১এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণআন্দোলন, ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে স্থপতি ও ব্লগার রাজিব হায়দারের করুণ মৃত্যু, পরবর্তীতে মুক্তচিন্তার চর্চাকারী এবং যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াইয়ের পুরোধা ব্লগারদের প্রতি রাষ্ট্রীয় জুলুম-অন্যায়ও অভিজিৎ রায়ের লেখনী এড়ায়নি।
তারপর ফেসবুকে হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করি অভিজিৎ রায়কে। তখন আবার ফেক আইডির প্রাদুর্ভাব ফেসবুকজুড়ে। অভিজিৎ রায়ের নামেও একাধিক আইডি পেয়েছিলাম তখন। মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখে নিশ্চিত হয়ে যোগাযোগ করতেই সাড়া দিলেন তিনি। একটু অবাকও হয়েছিলাম একদিনের মাথায় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করায়। কারণ ফ্রেন্ড একসেপ্ট করার বিষয়ে ব্লগাররা তখন খুবই সাবধান। অভিজিৎ রায় বোধহয় সবসময়ই নিজের সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন।
‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ থেকেই ‘মুক্তমনা’ ব্লগের কথা জানলেও তা নানা কারণে ভুলে গিয়েছিলাম। অভিজিৎ রায়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেই ব্লগটি খুঁজে পাই।
আমি পারতপক্ষে অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে চ্যাট করতাম না, সংকোচ কাজ করত। তবে কথা বললে আন্তরিক জবাব পেয়েছি। মার্চ ২০১৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৫ অচেনা দূরের একজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য আমার পক্ষে অনেক কম সময়, তাই এর মাঝে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো কথাও নেই আমাদের মাঝে।
‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইটির সূত্র ধরে ২০১৫র ফেব্রুয়ারিতে অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে কদিন টানা চ্যাট চলে আমার। নির্ধারিত সময়ের বেশ পরে বের হয় বইটি, ১৬ তারিখে। সেবার প্রতিদিনই বই মেলায় গেলেও আমি জানতাম না তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। বইটির কিছু পাতা পড়ে তিনি আমেরিকাতে আছেন এমন ভেবে নিয়েই ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে মেসেজে মতামত জানাই। বিকেলে চাকরির জন্য একটি সাক্ষাৎকার থাকায় সেদিন বই মেলায় গিয়েছিলাম রাত করেই। বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় একপাক ঘুরে ঘরে ফেরার জন্য যখন টিএসসির কাছে পৌঁছলাম, অস্বাভাবিক একটা ভিড় চোখে পড়ে আমার। একজনকে জিজ্ঞেস করতে সে জানায়, একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে কারা যেন মেরেছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি সাধারণ ঘটনা, এরকম স্টেরিওটাইপ চিন্তায় ভর করেই এগিয়ে চলেছিলাম আমি। সিএনজি অটোরিকশাটাও দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিড় ঠেলে ফুটপাত ঘরে এগিয়ে যাওয়ার সময় ফুটপাত কালো করে রাখা পুডিংয়ের মতো রক্ত দেখি, পাশে পড়েছিল চশমা। জমে থাকা রক্তের পরিমান মারামারির তুলনায় অস্বাভাবিক বেশি মনে হলেও ‘একটি ছেলে আর একটি মেয়েকে কারা যেন মেরেছে’ এই ভাবনা আমাকে বেশি কিছু ভাবতে দেয়নি, অভিজিৎ রায়ের কথা তো নয়ই। বাসায় ফিরে টিভিতে নিউজ ক্রলে দেখলাম আমি কার রক্তের উপর দিয়ে এসেছি। বন্ধুও বাসায় ফিরেই যা জানার জেনেছিল। আমাকে ফোন করে ও শুধু বলল, “সব শেষ হয়ে গেল রে ধ্রুব…”
পুরো লেখাটি পড়ে দেখলাম আমি নিজের কথাই লিখে গিয়েছি শুধু, এখানে অভিজিৎ রায়কে নিয়ে তেমন কোনো কথাই আমি লিখতে পারিনি। কারণ অভিজিৎ রায় সম্পর্কে আমি তো কিছুই জানি না। আমার কাছে অভিজিৎ রায় মানে মুক্তমনা ব্লগ। আমার কাছে অভিজিৎ রায় মানে ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ থেকে শুরু করে ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ পর্যন্ত কয়েকটি বই শুধু। অভিজিৎ রায়ের হাতের স্পর্শও এসব বইয়ে নেই।
অভিজিৎ রায়ের ডান হাতটি ধরে দেখতে কেমন লাগে তা আমার জানা নেই। কারণ আমি তার কফিন ছুঁয়ে দেখেছি শুধু। তাকে আমার ছুঁয়ে দেখা হয়নি।
মাল্টিভার্স সত্য হোক। দূরে বহুদূরে মৌলবাদহীন অন্য এক পৃথিবীতে বন্যা আহমেদকে নিয়ে আপনি অনেক অনেক ভাল থাকুন, অভিজিৎ রায়। আমরা আঁধারের যাত্রী, আমাদেরকে পথ পাড়ি দিতে হবে আরও হাজার বছর।