বিশ্বসংসার শূন্য, আমি তুমি সব শূন্য, শূন্য একক ভাবে একটি সংখ্যা ও
অস্তিত্বহীন তাকে বুঝায়, যার ব্যুৎপত্তিগত নৃতাত্ত্বিক যায়গা থেকে বিচার
করলে শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘সাফাইর’ থেকে যার অর্থ ”সেখানে কিছু ছিল না” ।
আমাদের সমাজের প্রচলিত কিছু শব্দ -সত্য, মিথ্যা, ভাল, খারাপ, পাপ, পুণ্য,
সুন্দর, অসুন্দর, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি শব্দগুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে
খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবে নানান সময়ে নানান ভবে ব্যবহার করে থাকি এবং
এমতাবস্থায় খুব প্রভাব বিস্তার করে আছে । প্রচলিত এই শব্দ গুলো একটা একটার
সাথে খুব অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত, ভাল মিশ্রিত মিথ্যা অথবা ভাল খারাপ মিশ্রিত
সত্য এই সব চলমান প্রচলিত কথার বাহিরে বস্তুবাদী নৃতাত্ত্বিক যায়গা থেকে
বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই সব শব্দের প্রধান মানদণ্ড কি তা নিয়ে দার্শনিক
মহলে নানা রকমের প্রশ্ন রয়েছে । এরিস্টটল
সবসময় মধ্যপন্থার উপর জোর দিতেন,মনে করতেন সত্য বা মিথ্যা অতিচরম বা
অতিনরমে নয় বরং মাঝামাঝি কোথাও থাকে । এই শব্দগুলোর ভিত্তি বুঝতে গেলে আগে
জ্ঞানের প্রচলিত সংজ্ঞায় যেতে হবে-
প্লেটোর পর থেকে জ্ঞানের সার্বজনীন সংজ্ঞা হচ্ছে ‘কোন ব্যক্তি কিছু একটা
জানে এর অর্থ হচ্ছে সে সেই কিছু একটা সম্পর্কে একটি সত্য এবং ন্যায্য
প্রতিপাদিত বিশ্বাস পোষণ করে । এখানে তিনটি ধারনা আছে -সত্যতা, ন্যায্যতা ও
বিশ্বাস আর এই তিনটি ধারণা সঠিক ভাবে একত্রিত হলেই জ্ঞান তৈরি হয় । এই
মতানুসারী জ্ঞান একটি বিশ্বাস আবার কেবল-ই বিশ্বাস নয় একটি সত্য বিশ্বাস
আবার কেবলই সত্য বিশ্বাস নয় বরং একটি ন্যায্য প্রতিপাদিত সত্য বিশ্বাস ।
জ্ঞান অনেকটা ধূম্রজালের মতো খেলা করে, তার চেয়ে সুস্পষ্ট সত্য, যেমন
মানুষের রক্ত লাল এইটা ন্যায্যতা মানে নির্ভরযোগ্যতা ও প্রমাণের উপর দাড়িয়ে
আছে । এই বাক্যটাকে আমরা সত্য বলতে পারি না,ঠিক তেমনি আমরা ছোটবেলায় পড়ে এসেছি সূর্য পূর্ব দিকে উঠে পশ্চিম দিকে অস্ত যায় যা সার্বজনীন চিরন্তন সত্য কিন্তু আদ্যতে সূর্য অস্ত ও যায় না বা পূর্ব দিকে উঠেও না । তাকে আমরা সত্য বা মিথ্যা কিছুই বলতে পারি না শুধু নিতান্তই নিয়মতান্ত্রিক ক্রমবর্ধমান ধারা ।
কোন কিছুকে আমরা ভাল খারাপ কিছুই বলতে পারি না, যেমন আপনি একটা মানুষকে ভাল ও বলতে পারবেন না বা খারাপ ও বলতে পারবেন না, যেই কারণে আপনি লোকটিকে ভালো বলছে ঠিক তার বিপরীতে অন্য কেও সেই কারণেই তাকে খারাপ বলছে, সংখ্যা গরিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে যদি বলেন লোকটি সব মিলিয়ে ভালো বা সব মিলিয়ে খারাপ তাহলেও ভালো খারাপের হিসেব মিলছে না, যেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে বলছে ভালো খারাপ সেই সংখ্যা গরিষ্ঠতা কিছুক্ষণের মধ্যে সংখ্যালঘিষ্ঠ হতে কতদূর । এখানে একপ্রকারের মধ্যস্থতা চলে আসছে । এর জন্য আপনি লোকটিকে ন্যায্যতার উপর বিচার করে চলতে পারে তার জন্য ভালো খারাপের
মধ্যে ফেলে দেয়া নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় এবং সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ।
এই বার আসি পাপ-পূর্ণতা নিয়ে । একটু সহজ করে বলতে গেলে আপনে পাপ না করলে আরেকজন পূণ্য করার সামর্থ্য রাখে না, আপনে পাপ করছেন বলেই আরেকজন পূণ্য করতে পারছে । যেমন একটা পাখি ধরে খাঁচায় বন্ধী করে বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে গেলো যেকোনো এক ব্যক্তি, অন্য কোন এক ব্যক্তি সেই পাখিটিকে কিনে ছেরে দিলো, আপনার দৃষ্টিতে নিশ্চয় প্রথম ব্যক্তি পাপ করছে পাখি শিকার করে ও খাঁচায় বন্ধী করে বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে আসার জন্য, তেমনি দ্বিতীয় ব্যক্তিটি পাখিটিকে কিনে ছেরে
দেওয়াতে সে পূণ্য করেছে । প্রকৃতপক্ষে প্রথম ব্যক্তি পাপ করার জন্য দ্বিতীয় ব্যক্তি পুণ্য করার অধিকার পেয়েছে । এই সমাজে সব নষ্টের দানব মুঠোতে বিনষ্ট হবে প্রতিনিয়ত আবার তার বিপরীতে কেও তিলে তিলে নিপুণ হাতে গরে তুলবে সব কিছু । প্রকৃতি তার রহস্যময় ধুম্রজালের নিপুণ ভারসাম্যতায় কিছু দাড়িয়ে আছে আর অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে অসীম শূন্যতায়, একটা সময় তার অপার ভারসাম্যতা খসে খসে বিনষ্ট হবে, তখন সব কিছু ধ্বংসের শেষ পতন থেকে আবার সৃষ্টি হবে সেই ছোট্ট অংকুর গাছের চারার মতো, মেলে ধরবে সর্বাঙ্গে তার রূপ বিচিত্রতা নিয়ে ।
সুন্দর বা অসুন্দর । সুন্দরকে চলমান দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে না ফেলে নৃতাত্ত্বিক জায়গা থেকে বিচার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি । আমরা কখন একটা কিছুকে সুন্দর বা অসুন্দর বলে আখ্যায়িত করি ? দার্শনিকদের মতে আমাদের চোখে কোন কিছু যখন তার নির্দিষ্ট উপাদান সমূহে পরিপূর্ণতা পায় তখন সেটি সুন্দর হয়, আবার অনেক দার্শনিক যুক্তি তর্কের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন সুন্দর যে কোন রকম আনন্দ ও দক্ষতা শিল্পমূল্যের অন্তর্গত,সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা হচ্ছে ব্যক্তির অনুভূতির তীব্রতা ও আনন্দসহ যা বিকশিত মনের অংশ । সৌন্দর্য একটা অভিযোজিত পরিণতি যা আমরা প্রসারিত বা তীব্র করি সৃষ্টি, কাজ, শিল্প ও বিনোদনের মধ্যমে । সৌন্দর্য হল দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রাকৃতিক উপায় । আমরা নিশ্চয়ই আমাদের শিশু, প্রেমিক অথবা কোন একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য খেয়ে ফেলার চেষ্টা করি না, বিবর্তনের কৌশল হল আমাদের চোখে তাদের এরকম আকর্ষণীয় করে তোলা, যাতে তাকিয়ে থাকতেই ভালো লাগে ।
দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে মানুষের মন ও মস্তিষ্ক আর তা নিয়ে দশকের পর দশকব্যাপী গবেষণা ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সাইকো-নিউরো-ইমিউনলজি নামে বিজ্ঞানের নতুন শাখা । তারা বলছে মস্তিষ্ক হচ্ছে হার্ডওয়ার আর মন হচ্ছে সফটওয়্যার । নতুন তথ্য ও নতুন বিশ্বাস মস্তিষ্কের নিউরনে নতুন ডেনড্রাইট সৃষ্টি করে । নতুন সন্যাপসের মাধ্যমে তৈরি হয় সংযোগের নতুন রাস্তা । বদলে যায় মস্তিষ্কের কর্ম প্রবাহের প্যাটার্ন । তখন মস্তিষ্ক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নতুন বাস্তবতা উপহার দেয় । তাছাড়া প্রো-একটিভ ও
রি-একটিভ দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব প্রাত্যহিক ভাবেই লক্ষণীয় ।
সর্বশেষে কেমন যেন সব কিছু শূন্যে হারিয়ে যাচ্ছে, জীবন অনর্থক, তাকে প্রতিনিয়ত অর্থবোধক করে তুলার চেষ্টা করে যাচ্ছি । খুব ভালোভাবে জীবনের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন ”এসে এক্সিস্টেনসিয়াল নিহিলসাম” মতে – মানুষের জীবনের কোন অর্থ বা মূল্য নেই । প্রতিটি মানুষ এমনকি সমগ্র মানবজাতি অপ্রয়োজনীয়, উদ্দেশ্যবিহীন ।
মানুষকে পৃথিবীতে ছুড়ে ফেলা হয়েছে প্রকৃতিগত ভাবে । আর মানুষ নিজেই জানে না, সেটা কেন । অস্তিত্ববাদের মতে, ব্যক্তিসত্তা সার্বিক সত্তার পূর্বগামী এবং নৈতিকতা বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে অস্তিত্ববাদীরা অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক । সুতরাং জীবনের অর্থ হল শুধুমাত্র একক ব্যক্তির জন্য । সেটা হতে পারে নিরীশ্বরবাদী হয়ে কিংবা পরকাল এবং নিজের কর্মফলে বিশ্বাস করার মধ্যমে । আদিকাল থেকেই ধর্মও পুঁজি করে নিজস্ব ধারণা তৈরি করে নিয়েছে ।
জীবনের অর্থ নিয়ে সবচেয়ে ভাল উক্তিটি হয়ত Colorado State University এর দর্শনের প্রখ্যাত প্রফেসর Donald A. Crosby এর দেয়া এই উক্তিটি,
“There is no justification for life,
but also no reason not to live.
Those who claim to find meaning in
their lives are either dishonest or deluded.
In either case, they fail to face up to the
harsh reality of the human situation”.
“জীবনের কোন অর্থ বা যৌক্তিকতা নেই। তাই বলে জীবন উপভোগ না করারও কোন কারণ নেই। যারা জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছে বলে দাবী করে তারা হয় মিথ্যা বলছে অথবা কোন মিথ্যা বিষয়ে বিশ্বাস করছে। দু’টো ক্ষেত্রেই তারা মানব জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করতে বিফল হয়।”