বিজ্ঞানের দর্শন ভাবনা -(১ম পর্ব)
চারিদিকে চোখ মেলে তাকালে দেখা যায় অসংখ্য সৃষ্টির লহরী, যেমনি আকাশে তেমনি আমাদের চারিদিকে; অসংখ্য প্রজাতির ভিরে নিজের বিশেষত্বটুকুও ভুলে যাওয়ার মত অবস্থা মানুষের। এতসব সৃষ্টির মধ্যে মানুষ অনেকটাই উন্নত, তার ভাবনা-চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে।
তবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখা যায় মানুষ প্রচীণকাল থেকেই এতটা উন্নত ছিলনা। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের চিন্তাশক্তিতে এসেছে বিবর্তন। আজকের মানুষ মহাকাশ নিয়ে ভাবছে। এক সময় সে তার নিজের দেশটাকে নিয়েও ভালকরে ভাবতে পারতো না। ক্রমান্বয়ে এ ভাবনার জগতে এসেছে উন্নতি। এই ভাবনার জগতে রয়েছে বিভিন্ন ধারা। মানুষ তার খাওয়া পড়ার প্রয়োজনে ভাবে, সমাজের প্রয়োজনে ভাবে, দেশের প্রয়োজনে ভাবে; আবার কেউবা তন্ময় হয়ে আপন মনে এলোমেলো বা কোন কল্পিত লক্ষ্য নিয়ে ভাবে।
মানুষের এই ভাবনা থেকেই একসময় সৃষ্টি হয়েছে দর্শন, নানা যুক্তি। পরবর্তীতে পরীক্ষা পর্যোবেক্ষনের পথ পেরিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানকে দর্শনের গাণিতিক রূপও বলা চলে। ভাবনাগুলো যখন সুনির্দিষ্ট ছকে পড়ে পরীক্ষা পর্যোবেক্ষনের রূপ নেয় তখনই তা বিজ্ঞানে পরিনত হয়। ভাবুকদের ভাবনায় ধারণাগুলো যখন কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে নীরেট সত্যের রূপ নেয় তখন তা বিজ্ঞানের নীতি হয়ে দাঁড়ায়। এইভাবেই বিজ্ঞান সত্যের রায় দেয়। বিজ্ঞান নানা তত্ত্বের অবতারনা করে, আলোচনা ও পরীক্ষা নীরিক্ষা দ্বারা তাকে নীতিতে উন্নীত করে; এই ভাবেই চলে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা। বিজ্ঞান প্রত্যক্ষ ধারনার মাধ্যামে যেসকল রায় দেয় তা হয়ে যায় স্বতস্বিদ্ধ। দৈবাৎ তাও পাল্টে যেতে দেখা যায়, তখন আসে বিকল্প ধারনা। এভাবে অনেক ধারনা নতুন ভাবে শুদ্ধিলাভ করে থাকে। মোট কথা প্রকৃত সত্যকে খুঁজে বের করাই হল বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য ও তার সাধনা।
বিজ্ঞানের দর্শন ভাবনা -(২য় পর্ব)
বিজ্ঞান প্রকৃত সত্যের সন্ধানী। স্রষ্টার উপস্থিতি বিজ্ঞান যেমন চাক্ষুস প্রমান করতে পারেনি, ঠিক তেমনি স্রষ্টার অনুপুস্থিতিও প্রমান করতে পারেনি। স্রষ্টাকে দেখা যায়নি বলে তিনি নেই এমন যুক্তি কিন্তু বিজ্ঞান অনুমোদন করেনা। এখন কোন বিজ্ঞানী যদি আবেগতারিত হয়ে বলেন যে, ‘মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে স্রষ্টার প্রয়োজন হয়নি’ তবে তা বিজ্ঞানের কথা হতে পারে না।
এক একজন বিজ্ঞানী এক একজন দার্শনিক। তবে কোন বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের নিয়ামক নয়। বিজ্ঞানীর চিন্তাধারা ও আবিস্কৃত বিষয় যখন সত্য বলে প্রমানিত হয় তখনই তা বিজ্ঞান হয়ে উঠেনা। হতে পারে তা বিজ্ঞানীর প্রকল্পিত বিষয়। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ষ্টিফেন হকিন্স তাঁর গ্র্যান্ড ডিজাইন বইতে লিখেছেন, ‘আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে কোন স্রষ্টার প্রয়োজন হয়নি, মহাবিশ্ব একদিন আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছিল।’ হতে পারে তার এই উক্তি আবেগ তারিত, কারণ তিনি কিন্তু আপনা আপনি হয়ে যাওয়া তত্ত্বের কোন পরীক্ষামূলক প্রমান উপস্থাপন করেন নি।
বিজ্ঞানী ষ্টিফেন হকিন্স আরও বলেছেন, ‘পরীক্ষাগারে আপনা থেকেই পদার্থ জন্মলাভ করেছে’। তিনি এমনটা বললেও ভৌত পদার্থবিদরা এ কথা মানতে নারাজ যে, আপনা থেকে কোন কিছু সৃষ্টি হতে পারে।
আজকের বিজ্ঞান মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে এক অদৃশ্য শক্তিকে খুঁজে পেয়েছে, যার নাম কৃষ্ণশক্তি। বিজ্ঞানের ভাষায় এই শক্তি সমগ্র মহাবিশ্ব জুড়ে রয়েছে, আর সকল মহাজাগতিক বস্তু সৃষ্টির মূল উৎস এটি। হকিন্স সাহেব বেমালূম ভুলে গিয়েছিলেন যে, তার পরীক্ষাগারটিও এই অদৃশ্য শক্তিতে পরিপূর্ণ।
১৮ শতকের মাঝামাঝি এসে ডারউইন তার প্রকৃতিক নির্বাচন মতবাদে বলেছিলেন, এই প্রাণীজগৎ সৃষ্টিতে স্রষ্টার কোন প্রয়োজন হয়নি, তা প্রকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যামে বিবর্তনের ধারায় সৃষ্টি হয়েছে, প্রজাতি থেকে প্রজাতির রূপান্তর ঘটেছে। তার এই ধারনা তৎকালীন সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, বিজ্ঞানীরা দল বেঁধে সমর্থনের মাধ্যামে ডারউইনকে উৎসাহিত করেছিল। তবে প্রথম সৃষ্টি কিভাবে হয়েছিল ডারউইন তার কোন ব্যাখ্যা দেননি। প্রকৃতিক নির্বাচন অধিকাংশ বিজ্ঞানীর কাছে সমাদৃত হলেও তা কিন্তু নীরেট বিজ্ঞান হয়ে উঠেনি।
এই মতবাদ প্রচারের কয়েক বছর পরেই বিজ্ঞানীরা যখন প্রাণী কোষে ডি এন এ আবিস্কার করে বসল, তখন ধারণা গেল পাল্টে, প্রাকৃতিক নির্বাচন গেল ফিকে হয়ে। ধীরে ধীরে বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞান সমাজে তা হয়ে পড়লো বিতর্কিত।
বিজ্ঞানের দর্শন ভাবনা -(৩য় পর্ব)
এই বিশ্ব সংসার সৃষ্টি হয়েছে অনেক সময় আগে; বিজ্ঞান বলছে আমাদের মহাবিশ্বের বয়স প্রায় ১৪ শত কোটি বছর; আর মানুষের মাঝে বিজ্ঞান মনস্কতা তৈরী হয়েছে, বেশী হলে হাজার চারেক বছর। মহাবিশ্বের বয়সের তুলনায় তা অতি নগন্য। এই অল্প সময়ের মধ্যেই বিজ্ঞান কিন্তু সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক দূর এগিয়েছে। নিত্য নতুন ধারণা দিয়ে মানুষকে চমকিত করে তুলছে।
বিংশ সতাব্দীর প্রারম্ভে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনষ্টাইন এক আলোড়ণ সৃষ্টিকারী তত্ত্বের সূচনা করলেন, তিনি ১৯০৫ সালে তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ m=e/c2 প্রকাশ করলেন। এখানে তিনি পদার্থকে শক্তির আঁধার রূপে দেখাতে চেয়েছেন। পরীক্ষাগারে তা প্রমাণিত হয়েছে, তার উদাহরণ পারমানবিক বোমা। বিজ্ঞান সমাজে আলোড়ণ সৃষ্টি হল। ধরে নেওয়া হল পদার্থ থেকে বিপুল শক্তি উৎপাদন সম্ভব।
লক্ষ্য করে দেখুন আইনষ্টাইন কি বলছেন; আইনষ্টাইন বলছেন, পদার্থ থেকে শক্তি উৎপাদন যেমন সম্ভব তেমনি শক্তি থেকে পদার্থ উৎপাদনও সম্ভব। এবার দেখুন, একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞান কৃষ্ণশক্তিকে খুঁজে পেয়েছে। বিজ্ঞান বলছে, এই কৃষ্ণ শক্তিই মহাবিশ্বে পদার্থ সৃষ্টির কাঁচামাল।
আজকের বিজ্ঞানীরা নিঃসঙ্কোচে বলতে বাধ্য হচ্ছে যে, আমাদের মহাবিশ্বে বিপুল শক্তির প্রবাহ রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এই শক্তি বিগ ব্যাঙের সময় প্রবাহিত হয়েছিল; আবার অনেকে এই শক্তি প্রবাহের উৎসকে খুঁজছেন।
বিজ্ঞানের দর্শন ভাবনা (শেষ পর্ব)
বিজ্ঞান কোন কিছুকে খুঁজে বের করে বা কোন কিছুকে ব্যাখ্যা করে, যা আগে থেকেই কোথাও না কোথাও সৃষ্টি হয়ে আছে। বিজ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে সঠিক তথ্যকে খুঁজে বের করে আনে। সমস্যা ও সমাধান প্রকৃতিতেই নিহিত, তারা শুধু খুঁজে বের করে।
‘কোথা হতে এল এই সমাধান’? যত ভাবেই বিবেচনা করে দেখা যাকনা কেন, নিরঙ্কুশ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই মহাবিশ্ব ও প্রাণীজগৎ সৃষ্টিকে কোন যুগপৎ ঘটনা রূপে বর্ণনা করা যায়না। অনেক নিবেদিত প্রাণ বিজ্ঞানী তাদের সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই বাস্তবতাকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। মানুষ যতই মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানবে, নিখুঁত বিন্যাসের জন্য তার অভিভুত হওয়ার শক্তি ততই বেড়ে যাবে।
মানুষ যেদিন থেকে সৃষ্টিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে সেদিন থেকে তার ভাবনার অন্তরালে একজন প্রচ্ছন্ন স্রষ্টা এসে স্থান করে নিয়েছে; অবশ্য এটি সম্পূর্ণই কল্পনা নির্ভর, কারণ স্রষ্টাকে সামনা সামনি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ কারোর জন্যেই সম্ভব হয়নি। ফলে এই কল্পনা নির্ভর স্রষ্টার অনুভূতি একক জনের মনে একেক রকম তৈরী হয়েছে, সৃষ্টির প্রাবল্যতা দেখে কারোর মনে হয়েছে, বিভিন্ন সৃষ্টি বিভিন্ন স্রষ্টার মাধ্যামে হয়েছে, কারোর মনে হয়েছে স্রষ্টা বিভিন্ন দেবদেবীর মাধ্যামে তার বিভিন্ন পরিচালনা করেন, আবার কারোর মনে হয়েছে সবকিছু এক স্রষ্টার দ্বারাই সৃষ্ট। আবার অনেকে ধরে নিয়েছে স্রষ্টা বলে কিছু নেই, সবকিছু আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে; এই ভাবে এই মহাবিশ্বের স্রষ্টার ধারণা নানা স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে।
তবে এই ধারণাকে দু’টি প্রধান ধারায় ভাগ করা যায়, একটি হল কোন না কোন উপায়ে স্রষ্টাতে বিশ্বাসী আর দ্বিতীয়টি হল স্রষ্টাতে অবিশ্বাসী। যারা স্রষ্টাতে অবিশ্বাসী তাদেরকে বলা হয় নাস্তিক, আা যারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী তারা হলেন আস্তিক।
বহু প্রাচীন কাল থেকেই নাস্তিকতার বিস্তার রয়েছে। মানুষ বিজ্ঞান মনস্ক হওয়ার আগে থেকে অর্থাৎ মানুষের মনে যখন দর্শন জন্মলাভ করেছে তখন থেকেই এই দু’টি ধারা চলে এসেছে। কালক্রমে দর্শন থেকে বিজ্ঞানের জন্মলাভ হলেও, নাস্তিকতা কিন্তু বিজ্ঞানের কোন বিষয় নয়। বিজ্ঞান এক বিষয়, আর নাস্তিকতা আরেক বিষয়। বিজ্ঞান বলে না, আস্তিক হতে কিংবা নাস্তিক।
একটু ভুল ৯০টি মৌলিক পদার্থ প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। Periodic table
বাকি গুলো নিউক্লিয়ার Reactor মানুষ তৈরী
করেছে। এই
পর্যন্ত ১৩৩ মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার
হয়েছে।