Sunday, December 20, 2015

হিস্টিরিয়া

হিস্টিরিয়া জিন-ভূতের আছর, পাগলামি এসব কিছু নয়, নিউরোসিস জাতীয় মানসিক রোগ।
মানসিক রোগ দুই প্রকারের হয়ে থাকে। একটি মৃদু মাত্রার তাকে নিউরোসিস বলা হয়, অপরটি জটিল মাত্রার একে সাইকোসিস বলা হয়। নিউরোসিস জাতীয় রোগগুলো যেন অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, অবসেশন, হিস্টিরিয়া, ফোবিয়া ইত্যাদি। সাইকোসিস জাতীয় রোগগুলো যেমন বিষণœতা, ম্যানিয়া, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি। হিস্টিরিয়া একটি নিউরোসিস রোগ। এ রোগটি শারীরিক সমস্যা বা মানসিক সমস্যা নিয়ে প্রকাশ পেতে পারে।
১৮১৫ সালে সর্বপ্রথম ফরাসি চিকিৎসাবিদ চারকোট এ রোগের পরীক্ষা করেন। তিনি সম্মোহন পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখলেন যে, সম্মোহিত অবস্থায় রোগীর মনে যদি এ ধারণা সঞ্চার করা যায় যে তার রোগ ভালো হয়ে গেছে তাহলে তার রোগ সত্যিই ভালো হয়ে যায়। আবার রোগীকে সম্মোহিত করে পুনরায় যদি তার মধ্যে এ ধারণা সঞ্চার করা যায় সে অসুস্থ তাহলে তার রোগ পুনরায় ফিরে এসেছে। এ ঘটনা থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন হিস্টিরিয়ার উৎপত্তির সাথে ধারণা বা রোগীর অবচেতন মনের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু পরে দেখা গেল ওই ধারণা অনুযায়ী সব রোগের কারণ ব্যাখ্যা করা যায় না। কোনো কোনো মনোবিজ্ঞানী মনে করেন মস্তিষ্কের কাজের গোলমালের ফলেই হিস্টিরিয়া রোগ হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই মতবাদকে প্রমাণ করা যায়নি। মনোসমীক্ষার মতামতই মোটামুটি বেশিরভাগ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেনে নেন। মনোসমীক্ষার তত্ত্বানুযায়ী নিজের মনের অজান্তে অবদমিত মানসিক দ্বন্দ্ব থেকেই হিস্টিরিয়ার লক্ষণ সৃষ্টি হয়। সহজাত আচরণ বাইরের জগতে প্রকাশ হতে গেলেই রোগীর মনে দারুণ উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়। সেই উৎকণ্ঠাকে দীর্ঘদিন সহ্য করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। ফলে আমাদের অজান্তেই মানসিক ক্রিয়া এই বৃত্তিগুলোকে অবদমন করে। এ অবদমনের অর্থ এই নয় যে, বৃত্তিগুলো চিরতরে নির্বাসিত হলো। মানসিক ক্রিয়াকে সবসময়ই সক্রিয়ভাবে অবদমিত রাখতে হয় বৃত্তিগুলোকে। অবদমনকারী শক্তিগুলো যখনই কোনো কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে, অবদমিত রাখতে হয় বৃত্তিগুলোকে। অবদমনকারী শক্তিগুলো যখনই কোনো কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে, অবদমিত বৃত্তিগুলো তখনই উঠে আসতে চায় চেতনায়। এ অবস্থা উপস্থিত হলে অবদমন ছাড়া মানসিক প্রক্রিয়ার সাহায্য নিতে হয়Ñ নিউরোসিসের লক্ষণ প্রকাশের সুযোগ ঘটে তখনই। এ ধরনের মানসিক প্রক্রিয়া অনুসারে নিউরোসিসের লক্ষণও ভিন্ন হয়। কনভারশন হিস্টিরিয়াতেও কনভারশন নামক প্রক্রিয়া এবং ডিসোসিয়েটিভ হিস্টিরিয়ার ক্ষেত্রে ডিসোসিয়েটিভ প্রক্রিয়া কাজ করে। যে হিস্টিরিয়াতে শারীরিক লক্ষণ দেখা যায় তাকে বলা হয় কনভারশন হিস্টিরিয়া। যেমন হঠাৎ করে হাত কিংবা পা প্যারাইলাইসিস হয়ে যাওয়া, হঠাৎ করে কথা বন্ধ হয়ে যাওয়া, চোখে দেখতে না পাওয়া ইত্যাদি। আর যে হিস্টিরিয়াতে মানসিক লক্ষণ দেখা যায় তাকে বলা হয় ডিসোসিয়েটিভ হিস্টিরিয়া। যেমন- এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো, খিঁচুনি রোগ, ঘুমের মধ্যে হাঁটা ইত্যাদি।
একটি কেস স্টাডি বর্ণনা করা যাক। নায়লা (কাল্পনিক নাম) বিয়ের দিন তার স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়িতে চলে আসে। আসার কয়েক ঘণ্টা পরই তার কথা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর কেটে গেছে ২-৩ দিন। মেয়েটির মুখে আর কথা ফুটছে না। শত চেষ্টা করেও তাকে কেউ কথা বলাতে পারছে না। খবর পেয়ে বাপের বাড়ির লোকজন এলো। তারা দোষ দিচ্ছে এই বলে যে, মেয়ে তো ভালোই ছিল, শ্বশুরবাড়িতে ঢুকতেই তার এ অবস্থা হলো কেন? নিশ্চয়ই এ বাড়ির লোক কিছু করেছে! হতবাক হয়ে পড়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। কিছুতেই বুঝতে পারছে না কী করে এমন হলো। তারা দেখেছে বউ যখন বাড়িতে পা দিয়েছে তখন মুখে ঠিকই কথা ফুটেছে। তবে কী কারো নজর লেগেছে নতুন বউয়ের ওপর। এ ভেবেই ডাকা হলো নামকরা ওঝাকে। ঝাড়-ফুক, তুক-তাক ইত্যাদি ভৌতিক ক্রিয়াকলাপও কিছু করা হলো। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। তখন প্রায় দু’দিন পর শহরের হাসপাতালে হাজির হয়েছে সবাই। প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ সংগ্রহ করলাম। তারপর আত্মীয়-স্বজনকে বাইরে বসিয়ে মেয়েটিকে আলাদা করে তার প্রতি মনোচিকিৎসার বিধিবিধান অনুযায়ী চিকিৎসা প্রয়োগ করলাম। নাটকীয়ভাবে মেয়েটির মুখে কথা ফুটলো সেদিনই। খুবই কম সময়ের মধ্যে সেদিন যতটা সহজে সুফল পেয়েছিলাম সাধারণত এত সহজে ফল পাওয়া যায় না। মেয়েটির মুখে কথা ফুটতে দেখে আশ্বস্ত হলো বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। দূর হলো উভয়পক্ষের লোকজনের মনোমালিন্য, দোষারোপ। এখন বিদ্বেষ ভুলে নিবিড় করে তুলল আত্মীয়তার বন্ধন। হাসিমুখে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার আগে অবশ্য তাদের কিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম। এই পরামর্শ দেয়া চলছিল ৪-৫ মাস যাবত। চিকিৎসা শেষে পরামর্শ দিলাম যে, ভবিষ্যতে যদি আবার এরকম ঘটে তখনি যেন জানানো হয় আমাদের।
৫ বছর পরে জানতে পারলাম ওরা এখন সুখেশান্তিতে ঘর করছে। কয়েক মাস আগে তাদের একটি মেয়েও হয়েছে।
এবার দেখা যাক নায়লার রোগটি কী ছিল। আসলে এমন কী হয়েছিল যে তার কথা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পরের দিন শ্বশুরবাড়িতে পা দিতে না দিতেই আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-পড়শীরা তার বাপের বাড়ি সম্পর্কে বেশ কিছু আপত্তিকর মন্তব্য করেছিল। সেসব মন্তব্যের বেশিরভাগই মেয়েটির বাবাকে কেন্দ্র করে। যেমন মেয়ের বাবা সুবিধার মানুষ নয়, নানাভাবে তারা জামাইকে ঠকিয়েছে, গয়নাগাটি, জিনিসপত্র ঠিকমতো দেয়নি, ওরা প্রতারক ইত্যাদি। এরপর কী হলো মেয়েটির পুরোপুরি মনে নেই। নায়লা বরাবর ছিল জেদি আর ডানপিটে ধরনের। বিয়ের আগে ওর বাবা-মা এবং আত্মীয়-স্বজন বারবার বলে দিয়েছিল শ্বশুড়বাড়ির লোকজন যে যাই বলুক এমনকি কোনো কটূক্তি করলেও তাকে সবই সহ্য করতে হবে মুখ বুজে, মা তার গা ছুঁয়ে বলেছিলেন- এ আমার দিব্যি রইল। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করেই সে শুনল তার বাবার সম্পর্কে বিশ্রী কটূক্তি। শুনেই তার প্রবল ইচ্ছা হয়েছিল প্রতিবাদ করতে কারণ সে বরাবর এমন প্রতিবাদীই ছিল। কিন্তু তা কী করে হয়! সে যে মায়ের কাছে শপথ করে এসেছে। কিন্তু সে প্রতিবাদ করতে না পারায় তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছিল প্রবল যন্ত্রণায়। মনে হচ্ছিল যেন এক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে যাবে। আর ঠিক তখন থেকেই লোপ পেল তার কথা বলার শক্তি। কথা বন্ধ হওয়া যে মেয়েটির ইচ্ছাকৃত ব্যাপার তা নয়। মানসিক জটিল প্রক্রিয়ার ফলে তার বাকরহিত হয়েছিল। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় কনভারশন অর্থাৎ দ্বন্দ্বজনিত মানসিক যন্ত্রণা যা শারীরিক অক্ষমতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই রূপান্তরিত অবস্থাকেই বলে কনভারশন হিস্টিরিয়া।
কথা বলার শক্তি হারানোর ফলে মেয়েটি সাময়িকভাবে অক্ষম হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একটি লাভও হয়েছিল। এ ঘটনার পর তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতই ভয় পেয়েছিল যে ভবিষ্যতে তার বাবা-মা সম্পর্কে আর কোনো বিরূপ মন্তব্য করেননি বরং তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছেন। একেই বলে হিস্টিরিয়াল গেইন বা হিস্টিরিয়ার প্রাপ্তিরোগ।
হিস্টিরিয়া রোগের চিকিৎসা : এ রোগের চিকিৎসায় ওষুধের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কাউন্সিলিং বা সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা প্রয়োগ করা প্রয়োজন বরং এই ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপী বেশী কার্যকর। প্রথমে রোগীকে মৃদুমাত্রার দুশ্চিন্তানাশক ওষুধ দেয়া হয় পরে তার সাথে গভীর সাক্ষাৎকার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।