আচ্ছা রাতের বজ্জাত কালো আকাশে আসলে কি কি দেখা যায়? অনেক কিছুই তো দেখা যায়! তাই নাহ! সাদাসিদে একখানা চাঁদ, গুটি কয়েক ফোঁটা ফোঁটা তারা, ভাগ্য ভালো থাকলে প্লেন, হেলিকাপ্টার,রকেট এসবের আলোও দেখা যায়। কেউ কেউ আবার (ভূতের আছর আছে যাদের) ভূতুড়ে আলো, কংকালের মুখ এসবও দেখে থাকেন আকাশে।
কিন্তু আমি বলি কি যারা রাতের আকাশে মজার কিছু দেখতে চাও যেমন ধরো বড়সড়, বিশাল রঙ্গিন টাইপের কিছু তাহলে দূরে কোথাও চলে যাও। ঐ মেরু আছে না, ওই যে বরফ, বরফ, খালি ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে ওইসব জায়গাগুলোতে, ওইখানে চলে যাও। আরেকটু specific করে জায়গাগুলোর নাম বলছি, যেমন আলাস্কা, কানাডা সেখানে চলে যাও। প্লেন ভাড়া না হয় আমিই দিবো। সেখানে উজ্জ্বল কিছু দেখতে পাবে রাতের আকাশে। আবার বিশেষ বিশেষ সময়ে ফ্লোরিডাতে, এমনকি এশিয়ার জাপানেও একটু আধটু ওদেরকে দেখা যায়। হালকা হালকা আলো ছড়ায় ওরা। ঠিক রাতের আকাশের ভূতের মত। উহু ভয় পেও না আবার, ওগুলো হচ্ছে পরী, সুন্দরী রঙিন পরী। তোমার জন্য ওরা.. এহেম, থাক, নাই বা বললাম, বুঝে নিলেই হবে।
এই যে বিশাল আকারের যেসব পরীগুলোকে দেখা যায় সেগুলোর গালভরা কিছু নাম আছে। যেমন “অরোরা” কিংবা “সুজোতিমেরু” অথবা “মেরুজ্যোতি”। সেখানকার লোকেরা আদর করে “উত্তরের আলো” বলে রাতের আকাশের এসব পরীগুলোকে। ওদের কিন্তু পৃথিবীর সব জায়গা থেকে দেখা যায় না, শুধু ওই মেরু অঞ্চলে গেলেই দেখা যায়। তাই বলে আবার ভেবো না যে বরফের দেশে পরীদের ছড়াছড়ি। পরী কিন্তু আমাদের দেশেও কম না!
অরোরাকে কিন্তু সব সময় আকাশে পাওয়া যায় না, লজ্জাবতী পরী তো তাই লুকিয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে এরা রূপের খেলা দেখায়, তখন এদের আকাশে দেখা যায়। এদের আলো অনেক কম বলে দিনের বেলা সূর্যের আলোর জন্য প্রায় চোখেই পড়ে না এদের। কিন্তু রাতে ভালো দেখা যায়। আবার ক্ষনে ক্ষনে আকৃতি পাল্টায় এরা। এমিবার কথা মনে আছে নাহ! ঠিক এমিবার মত।
নাম তো জানলাম পরীগুলোর, কিন্তু এসব পরীদের আবার ভাগ আছে। আমাদের পৃথিবীতে দুই দিকে তো দুটো গোলার্ধ, সবাই জানি। আর এই দুটো গোলার্ধেই দেখা যায় মেরুজ্যোতিকে। উত্তর গোলার্ধে একে বলে “অরোরা বোরিয়ালিস” আর দক্ষিনেরটাকে বলে “অরোরা অস্ট্রালিস”। বাংলায় আবার উদ্ভট দুটো নাম আছে এনাদের। উত্তরেরটা “উদীচী উষা” কিংবা “সুমেরুপ্রভা”, আর দক্ষিনেরটা “অবাচী উষা” অথবা “কুমেরুপ্রভা”। আহা! একবার উচ্চারন করলে দশ গ্লাস পানি খেতে হবে!
কিন্তু আসল কথা হচ্ছে এরা কোত্থেকে আসে? কেনো এরা শুধুমাত্র মেরুতে রাতের বেলা দেখা যায়? সোজা বাংলায় বলতে গেলে আমাদের বায়ুমন্ডলটাই আসলে এদের উৎপত্তির জন্য দায়ী। আমাদের বায়ুমন্ডলের একটা স্তর আছে যেটার নাম থার্মোস্ফিয়ার, সেখানে কিছু অক্সিজেন আর নাইট্রোজেন পরমানু খুব সুখে শান্তিতে বসবাস করে। ভালো কথা, থাকুক তারা। কিন্তু তাদের সুখের সংসার নষ্ট করতে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার থেকে কিছু চার্জিত কনা আসে। প্রধানত ইলেকট্রন কনাটাই বেশি আসে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রোটনও আসে। ফলে এসব ইলেকট্রন-প্রোটনের সাথে ঘষাঘষি-রেষারেষি বাঁধে সেসব নাইট্রোজেন-অক্সিজেনের পরমানুর সাথে। তারপর হয় কি অক্সিজেন-নাইট্রোজেনের পরমানুগুলো কিছু শক্তি লাভ করে ইলেকট্রন-প্রোটন থেকে যেটা অভ্যন্তরীন শক্তি হিসেবে সঞ্চিত হয় তাদের শরীরে। কিন্তু এই অভ্যন্তরীন শক্তিটা না পরে আর ঠিক থাকতে পারে না। এক ধরনের গতিশক্তিতে রূপান্তর হয় এরা যেটার অপর রূপ আলোক শক্তি। ফলে রং-বেরঙের আলোকময় অরোরা তৈরি হয় আকাশে। এই অরোরা, সুন্দরী পরীরা ঠিক আমাদের থেকে ৮০ কিমি উপরে থাকে। খুব কাছে তাই নাহ! আবার কখনো ৫০০ কিমি উপরেও দেখা যায় এদেরকে।
ঠিক এই কথাটাই বলেছেন নরওয়ের এক বুড়ো বিজ্ঞানী সেই ১৯০০ সালের দিকে–
“যে উদ্ভট আলো আকাশে শুধু শুধু দেখা যাচ্ছে সেটা গঠিত হয় সৌরকলংক থেকে নির্গত চার্জিত কনা দ্বারা যেটা বিশ্বের আবহাওয়ামন্ডলের স্পর্শে এলে ভূচৌম্বকীয় শক্তি দ্বারা আকার বদলায়”।
তার তত্ত্ব সে সময়ে অনেকে বিশ্বাস করে নিলেও তখন প্রমান করতে পারেনি কেউ ব্যাপারটা। কারন এটি প্রমানের জন্য ৮০ কিমি উপরে আয়নমন্ডলে যাওয়া দরকার। তখন না ছিলো বিমান না ছিলো হেলিকাপ্টার, যাবে কিভাবে মানুষ! তাই অপেক্ষা করতে করতে শেষে একদিন ১৯৭৪ সালের দিকে ৮০ কিমি উপর সেখানে যায় মানুষ, প্রমান করে বেচারীর তত্ত্ব কত যুক্তিযুক্ত।
অরোরাকে পৃথিবীর অন্যান্য সাধারন জায়গা থেকে দেখা যায় না। কারন ঐ যে চার্জিত কনা, “ইলেকট্রন”, এরা সাধারনত পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র বরাবর ঘোরাঘোরি করে, তাই মেরু অঞ্চলেই তাদের উপস্থিতির জন্য মেরুজ্যোতি তৈরি হয়।
অরোরার গায়ের রং বিভিন্ন হতে পারে। এটা নির্ভর করে কোনো গ্যাসীয় পরমানু ইলেকট্রন দ্বারা সংঘর্ষের ফলে কতটুকু শক্তি বিনিময় হচ্ছে তার উপর। এটা লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, গোলাপি, মিশ্র রং, অতি বেগুনী রশ্মিও হতে পারে। তবে অরোরা বেশির ভাগ সময় সবুজাভ হলুদ থাকতে পছন্দ করে। পরী নাহ ওরা! উজ্জ্বল রং তো ওদের পছন্দ হবেই! অক্সিজেন পরমানুটা দায়ী তাদের সবুজ আর লাল রং এর জন্য। কিন্তু হাবাগোবা নাইট্রোজেন আবার নীল,গোলাপী আর গাড় লাল রং এর আলো গিফট করে অরোরাকে। তাই তো বলি ওদের গায়ে এত রঙ আসে কোথা থেকে!
অরোরার একটা সুবিধের দিক আছে। তুমি যদি খুব উজ্জ্বল একটা অরোরার সাক্ষাৎ পাও তবে তোমাকে রাতের বেলা কষ্ট করে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে অন্ধকার ছাদে বসে পড়তে হবে না কোনো কিছু। এটি মাঝে মাঝে এতই উজ্জ্বল হয় যে তুমি সহজেই রাতের বেলা পত্রিকা, বই এসব পরতে পারবে অরোরার আলোতে খোলা চোখে। কত উপকারী পরীটা তাই নাহ! ;)