ভূমিকা
তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। এদেশের অর্থনীতি মূলত: কৃষির ওপর নির্ভরশীল। পোল্ট্রি শিল্প কৃষি শিল্পের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। উৎপাদন খরচ অপেক্ষাকৃত কম, দ্রুত ডিম ও মাংস পাওয়ার নিশ্চয়তা, দ্রুততার সাথে ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ, এদের মাংসে সীমিত চর্বির উপস্থিতি, হজমে সুবিধা, সকল ধর্মের মানুষের কাছে সমানভাবে সমাদৃত; এ সকল কারণে পোল্ট্রি পালন এবং এদের থেকে উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রী (ডিম ও মাংস) মানুষের পুষ্টির যোগানে আদর্শ ও মানসম্পন্ন হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। দিন দিন এ শিল্পের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। কৃষি উন্নয়ন তথা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে
পোল্ট্রি পালন আজ একটি বিশাল শিল্পে পরিণত হয়েছে। গরিব, অল্প আয়ের লোক, বেকার শিক্ষিত যুবক ও যুব-মহিলাসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠী এই শিল্পের সাথে নিজেদের নিয়োজিত রেখে সাফল্য লাভ করেছে। পোল্ট্রি শিল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে নিচে পোল্ট্রি পালন এবং খামার ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ
পোল্ট্রি পালনের গুরুত্ব
* এরা ডিম ও মাংসের যোগান দিয়ে থাকে। মানুষের জন্য ডিম হলো উচ্চ পুষ্টিসম্পন্ন আমিষজাতীয় খাদ্য।
* বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পোল্ট্রি পালনের মাধ্যমে শহর ও গ্রামের সাধারণ জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
* অন্যান্য শিল্পের তুলনায় পোল্ট্রি খামার স্থাপনে স্বল্প মূলধনের প্রয়োজন হয়। তেমন জমির প্রয়োজন হয় না, ইচ্ছা করলেই বসত বাড়িতে, ঘরের ছাদে, শয়ন ঘরের বারান্দায় এমনকি পুকুরে মাচা তৈরি করেও পালন করা যায়।
* স্বল্পতম সময়ে অর্থ বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়া সম্ভব। কারণ এরা ৫-৬ মাস বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে এবং ব্রয়লার মুরগি ৫-৭ সপ্তাহ বয়সে মাংসের জন্য বিক্রয় উপযোগী হয়।
* এদের পালক হতে নানা রকম প্রসাধনী দ্রব্য যেমন-শ্যাম্পু, সুগন্ধি তৈল এবং ঘর সাজানোর সামগ্রী তৈরি করা যায়।
* ডিমের কুসুম গরুর জাত উন্নয়নে কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্যবহৃত হয়।
* ডিম পরীক্ষাগারে জীবাণুর বংশ বিস্তারের জন্য ব্যবহৃত হয়।
* মুরগির ডিম ও মাংসে পুষ্টি উপাদান গরুর দুধের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। যেমন, একটি ডিমে দুই গ্লাস দুধের সমান পুষ্টি থাকে।
সারণী-১ ঃ গরুর দুধ, হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংসে ভোজ্য পুষ্টি উপাদানের পার্থক্য
* মুরগির ডিম গরুর দুধ অপেক্ষা অনেক বেশি ভিটামিনযুক্ত খাবার।
সারণী- ২ ঃ গরুর দুধ এবং মুরগির ডিম ও মাংসে গড় ভিটামিনের পরিমাণ নিম্নরূপ
* পোল্ট্রির বিষ্ঠা একটি উৎকৃষ্টমানের জৈব সার। গরু-মহিষের মল-মূত্র থেকে পোল্ট্রির বিষ্ঠায় বেশি পরিমাণে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়াম থাকে যা জমির ঊর্বরতা শক্তি বৃদ্ধিসহ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে।
* পোল্ট্রি খামারের বিষ্ঠা দ্বারা বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরির মাধ্যমে বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো যায়।
খামার ব্যবস্থাপনা
(ক) মুরগির বাচ্চার ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা
ব্রুডিং (Brooding)
ব্রুডিং শব্দটি এসেছে জার্মান শব্দ ব্রুড থেকে। যার অর্থ তাপ দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে ব্রুডিং বলতে ১ দিন বয়স থেকে ৪ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত মুরগির বাচ্চাকে সমস্ত প্রতিকূল অবস্থা যেমন প্রতিকূল আবহাওয়া, বন্যপ্রাণী এবং অন্যান্য সমস্যা থেকে রক্ষা করাকে বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ একদিন বয়সের মুরগীর বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা থাকে ১০৩ ডিগ্রী ফারেনহাইট আর বয়স্ক মুরগীর শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১০৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট। বাচ্চা অবস্থায় মুরগির বাচ্চা তার শরীরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না কারণ, এই সময় তাদের শরীরে তাপ নিয়ন্ত্রণকারী অঙ্গগুলির বিকাশ ঘটে না। ফলে ঠান্ডা, বাতাস প্রবাহ, বৃষ্টি বা অতিরিক্ত গরম সহ্য করতে পারে না। যার জন্য বাচ্চাকে এমন একটি কৃত্রিম অবস্থায় রাখতে হয় যাতে মুরগির বাচ্চা আরামদায়ক ও নিরাপদ থাকে এবং তাপ নিয়ন্ত্রয়ণকারী অঙ্গগুলির বিকাশ ঘটে। চার সপ্তাহ পর মুরগির তাপ নিয়ন্ত্রয়ণকারী অঙ্গগুলি পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং তখন থেকে মুরগি তাপ নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা অর্জন করে।
মুরগির বাচ্চার প্রথম খাদ্য
ডিম হতে সদ্য ফুটন্ত বাচ্চার উদর গহ্বরে কুসুমের কিছু অংশ থেকে যায় যা থেকে প্রথম ২-৩ দিন কোনো প্রকার খাদ্য বা পানি গ্রহণ ছাড়াই বাচ্চাগুলো বেঁচে থাকতে পারে। তবে বাচ্চাকে খামারে আনার পর দেরিতে খাদ্য ও পানি প্রদান করলে দৈহিক বৃদ্ধির হার কমে যায় এবং মৃত্যুর হার বেড়ে যেতে পারে, সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব বিশুদ্ধ পানি পান করতে দিতে হবে। পানি প্রদানের কমপক্ষে ৩-৬ ঘন্টা পর বাচ্চাগুলিকে খাদ্য দিতে হবে। প্রাথামিকভাবে পানিতে গ্লুকোজ, ভিটামিন সি এবং মাল্টিভিটামিন ১ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। পানি প্রদানের পূর্বে খাদ্য প্রদান করা উচিত নয়। এতে করে বাচ্চার দৈহিক বৃদ্ধি এবং খাদ্য রূপান্তর দক্ষতা কমে যায় ও মৃত্যুহার অধিক হয়। প্রথম ২-৩ দিন খাদ্যের পাশাপাশি ইলেক্ট্রলাইট মিশ্রিত পানি দেয়া উচিত যা বাচ্চাগুলিকে পানিশূন্যতা এবং সকল প্রকার ধকল থেকে রক্ষা করে।
ব্রুডিং এর প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ
১. ব্রুডার ঘর
ব্রুডিং এর জন্য আলাদা ঘর হলে ভালো হয়। ব্রুডিং সাধারণত বড় মোরগ-মুরগীর ঘর থেকে কমপক্ষে ১০০ ফুট দূরে পৃথক স্থানে আলাদাভাবে করাই উত্তম। খেয়াল রাখতে হবে যেন বাইরের মুক্ত বাতাস ব্রুডার ঘরে ঢুকতে পারে এবং ভেতরের দূষিত বাতাস সহজে বাইরে যেতে পারে। লেয়ার বা ব্রয়লার পালনের ঘরও ব্রুডার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে নিম্নের কাজগুলি প্রথমে করতে হবে।
* বাচ্চা তোলার কমপক্ষে ১ সপ্তাহ আগে ঘরের মেঝে পরিষ্কার করে জীবাণুনাশক দ্বারা ভালোভাবে ধুয়ে শুকাতে হবে।
* সম্ভব হলে সম্পূর্ণ ঘর চট বা পলিথিন দিয়ে ধুয়ে মুছে ফিউমিগেশন করতে হবে। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও ফরমালিন দ্বারা ফরমালডিহাইড গ্যাস সৃষ্টির মাধ্যমে ফিউমিগেশন করা যায়। প্রতি ১০০ ঘনফুট জায়গার জন্য ১২০ মিলি. ফরমালিন এর সাথে ৬০ গ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ব্যবহার করা যায়।
২. হোভার
তাপ যাতে ওপরের দিকে চলে না যায় সেজন্য হোভার প্রয়োজন। হোভার টিন, কাঠ বা বাঁকা বাঁশ দ্বারা তৈরি করা যায়। হোভারকে সাধারণত ঝুলিয়ে রাখা হয়। তবে নিচে পা লাগিয়ে দাঁড় করিয়েও রাখা যায়। পাঁচ ফুট ব্যাসের হোভারের নিচে ৫০০ টি বাচ্চা রাখা যায়।
৩. ব্রুডার
মুরগির বাচ্চার ঘরে তাপের উৎসকে ব্রুডার বলে। ব্রুডার হিসেবে বৈদ্যুতিক হিটার, কেরোসিন বাতি, হ্যাজাক, ইত্যাদি ব্যবহার করে কৃত্রিম উপায়ে তাপ দেয়া যায়। সাধারণত গ্রীষ্মকালে ১০০ ওয়াটের ২টি বাল্ব এবং ৬০ ওয়াটের ১টি বাল্ব আর শীতকালে ২০০ ওয়াটের ২টি এবং ১০০ ওয়াটের ২টি বাল্ব প্রতি ৫০০ বাচ্চার জন্য ব্রুডারে ব্যবহার করা যথেষ্ট। বাচ্চা ব্রুডারে ছাড়ার ১০-১২ ঘন্টা পূর্বে ব্রুডার চালু করে প্রয়োজনীয় তাপ দিতে হবে।
৪. চিকগার্ড
ব্রুডার থেকে ১.৫-৩ ফুট দুরত্বে ১.৫ ফুট উচুঁ চাটাই বা হার্ডবোর্ডের বা তারের জালের বেষ্টনী তৈরি করা হয়। ফলে বাচ্চা ব্রুডার থেকে দূরে যেতে পারে না। প্রতি ৫০০ বাচ্চার জন্য চিকগার্ডের ব্যাস হবে ১২ ফুট (ব্যাসার্ধ ৬ ফুট। ক্ষেত্রফল = ৩.১৪ x ৩৬ = ১১৩.০৪ বর্গফুট)। প্রতিটি বাচ্চার জন্য জায়গা হবে ১১৩.০৪/৫০০ = ০.২১৮ বর্গফুট। চিকগার্ডের উচ্চতা গরমের সময় ১'-৬'' এবং শীতের সময় ২'-৬'' হবে। বাচ্চা বড় হবার সাথে সাথে চিকগার্ডের পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে।
৫. খাবার পাত্র ও খাবার ব্যবস্থাপনা
প্রথম ১-২ দিন কাগজের ওপর এবং পরবর্তীতে ১-২ সপ্তাহ ফ্লাট ট্রে ব্যবহার করা যায়। অতঃপর ৩য় সপ্তাহ থেকে হপার বা টিউব ফিডারে খাদ্য সরবরাহ করা যায়। প্রথম দুই সপ্তাহ ২ ঘন্টা অন্তর খাদ্য সরবরাহ করা ভালো। খাবার পাত্রের দৈর্ঘ্য = ২', প্রস্থ = ১'-৩' এবং কিনারা ১.৫'' হওয়া উচিত। প্রথম ৩ ঘন্টা ইলেক্ট্রলাইট মিশ্রিত পানি দিতে হবে। প্রথমে ভুট্টা ভাঙ্গা বা সাগুদানা খাবারের পাত্রে মিশিয়ে দিলে ভালো হয়। কারণ এগুলো সহজে হজম হয়। খাবার কখনোই ব্রুডারের নিচে ছিটানো উচিত নয় কেননা এতে বাচ্চা ছত্রাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। বাচ্চার ওজন এবং আকারে সমতা আনার জন্য খাবার শেষ হওয়ার আগেই খাবার দেয়া উচিত। চার সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত দৈনিক ৩-৪ গ্রাম খাদ্য দিতে হবে। এরপর দৈনিক ২-৩ বার দিলেই চলবে।
৬. পানির পাত্র ও পানি ব্যবস্থাপনা
বাচ্চার জন্য ছোট প্লাস্টিকের পানির পাত্র পাওয়া যায়। ছোট টিনের কৌটার নিচে থালা বসিয়েও পানির পাত্র বানানো যায়। পানির পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। প্রথম অবস্থায় ৫০০ টি বাচ্চার জন্য ১ লিটারের ৬-৮ টি ড্রিংকার দিতে হবে। এতে করে এক সঙ্গে সকল বাচ্চা পানি পান করতে পারে। প্রতি ১০০ লিটার পানিতে ৩-৫ গ্রাম ক্লোরিন মিশানো যেতে পারে। অবশ্য টিকা বা ওষুধ পানিতে মিশিয়ে খাওয়ানোর সময় ক্লোরিন মেশানো উচিত নয়। প্রথম অবস্থায় পানি (২৫-৩০) ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় রাখা ভালো। চিকস ড্রিংকার ৮-১০ দিন রাখতে হবে। প্রতিটি মুরগির পানি পান করানোর জন্য ২.৫ সেমি. জায়গা করে দিতে হবে।
৭. ঘরের আলো ও আলো ব্যবস্থাপনা
বাচ্চার ঘরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বাচ্চা খাদ্য ও পানির পাত্র সহজে দেখতে পারে। দিনের বেলা হলে আলাদা আলো প্রদানের প্রয়োজন নেই। তবে রাতে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে কৃত্রিম আলো প্রদান করতে হবে। ব্রুডারে বাচ্চা তোলার ৩ দিন পর হতে রাতে ১-২ ঘন্টা অন্ধকার রাখতে হবে। যাতে বাচ্চাগুলি অন্ধকারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং বিদ্যুৎ না থাকলে অন্ধকারে ভয় না পায়।
৮. তাপমাত্রা ও এর ব্যবস্থাপনা
ডিম হতে বাচ্চা ফুটার পর ৪ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চার দেহে তাপ নিয়ন্ত্রণকারী অঙ্গগুলির পরিপূর্ণতা লাভ করে না। তাই এই সময় বাচ্চাকে কৃত্রিম উপায়ে তাপ দিতে হয়। প্রথম সপ্তাহে সাধারণত ৯৫ক্ক ফারেনহাইট তাপ দিয়ে ব্রুডিং আরম্ভ করতে হয়। এই তাপমাত্রা পর্যায়ক্রমে কমিয়ে নিম্নলিখিত মাত্রায় আনতে হয়।
ওপরে যে তাপের তালিকা প্রদান করা হলো তা ব্রুডার ঘরের কাম্য তাপমাত্রা এবং থার্মোমিটারের সাহায্যে এই তাপমাত্রা সহজেই নিরূপন করা যায়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে টিকা দেয়ার পর তাপমাত্রা ১০ সে. বাড়িয়ে রাখতে হবে। এতে করে বাচ্চা টিকার প্রতি ভালো সাড়া দিয়ে থাকে।
৯. স্থান সংকুলান
ব্রুডার ঘরে পর্যাপ্ত জায়গা থাকতে হবে। শীতকালে নিম্নলিখিত পরিমাপ অনুযায়ী স্থান সঙ্কুলান করতে হবে।
গ্রীষ্মকালে নিম্নলিখিত পরিমাপ অনুযায়ী স্থান সঙ্কুলান করতে হবে।
১০. আলোর ব্যবস্থাপনা
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাড়ন্ত মুরগীর জন্য শুধু দিনের আলোই যথেষ্ট। নিম্নলিখিত বিষয়গুলির জন্য বাড়ন্ত এবং ডিম পাড়ার সময় আলোক দৈর্ঘ্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
* সঠিক বয়সে ও পূর্ণ গঠনে ডিম উৎপাদন শুরু এবং পরিপক্ক করার জন্য।
* সবচেয়ে ভালো ডিম উৎপাদনের হার অর্জনের জন্য।
* ডিমের আকার বড় হওয়ার জন্য।
* সঠিক শারীরিক ওজন অর্জনের জন্য।
(খ) বাড়ন্ত মুরগীর ব্যবস্থাপনা
মুরগীর ৬-১৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত সময়কেই বাড়ন্তকাল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাড়ন্তকালে মুরগীর নিম্নলিখিত তথ্যগুলি নিয়মিত সংরক্ষণ করতে হবে।
* শারীরিক ওজন
* খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ
* পানি গ্রহণের পরিমাণ
* আলোর পরিমাণ
* টিকাদান
* মৃত্যুহার
* তাপমাত্রা
* রোগের প্রাদুর্ভাব
* ঠোঁট কাটা
* খাদ্যের প্রকার (আমিষ ও শক্তির মাত্রা, ইত্যাদি)
সব সময় তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করতে হবে এবং নির্দিষ্ট বয়সের বৈশিষ্ট্যের সাথে প্রাপ্ত তথ্যগুলি তুলনা করতে হবে। ফলাফল প্রত্যাশিত না হলে ঝাঁকের মুরগীর সঠিক দক্ষতার জন্য ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই কোনো না কোনো পরিবর্তন আনতে হবে।
ঝাঁকের সুষম বৃদ্ধি
কাম্য উৎপাদন এবং সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য ঝাঁকের সুষম বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। যদি একটি ঝাঁকে ৮০% মুরগী ঝাঁকের গড় ওজনের ১০% কম বা বেশির মধ্যে থাকে, তবে ওই ঝাঁকের সুষম বৃদ্ধি হয়েছে বলে ধরা হয়।
বাড়ন্ত মুরগী পালনে অবশ্য করণীয় কাজ
৬ থেকে ১৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত মুরগীকে বাড়ন্ত মুরগী বলে। এই সময়ে এমনভাবে যত্ন নিতে হবে যেন ডিম উৎপাদনকালে ওজন (ভারী মুরগীর ক্ষেত্রে) কমপক্ষে ১.৫ কেজি হয়। বাড়ন্ত মুরগী পালনে নিম্নের বিষয়গুলি অনুসরণ করতে হবে।
* প্রথমত ঘরের পুরাতন লিটার ও আসবাবপত্রাদি বের করে ঘর সুন্দরভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
* পানিতে জীবাণুনাশক ওষুধ মিশিয়ে ঘর ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
* ঘরের মেঝেতে আয়তন অনুযায়ী বাড়ন্ত মুরগী রাখতে হবে।
* ঘরে কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র দিনের আলোতে পালন করতে হবে। দিনের আলো ব্যতিত রাতে ঘরে আলো জ্বেলে রাখলে শীঘ্র যৌবনপ্রাপ্ত হয় এবং ডিম পাড়া শুরু করে।
(গ) ডিমপাড়া মুরগী পালন ও তার ব্যবস্থাপনা
ডিমপাড়া মুরগী বাছাই
মুরগীসমূহ ডিমপাড়ার আগে বাছাই করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ ডিম উৎপাদনের ওপর খামারের লাভ-ক্ষতি নির্ভর করে। তাই পুলেটসমূহকে লেয়ার ঘরে নেয়ার পূর্বে তাদের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি দেখে বাছাই করতে হবে।
ঘর তৈরির জন্য স্থান নির্বাচন
* উঁচু জায়গা যেখানে পানি জমে না।
* লোকালয় থেকে দূরে।
* অন্য মুরগি এবং প্রাণীর ঘর থেকে দূরে হবে।
* যাতায়াত ব্যবস্থা সুবিধাজনক হতে হবে।
* বাজারজাতকরণের সুবিধা থাকবে।
* পানি ও বিদ্যুৎ এর সুবিধা থাকবে।
মুরগি পালনের পদ্ধতি
তিন পদ্ধতিতে মুরগি পালন করা হয়। যথাক্রমে- (১) লিটার বা বিছানা পদ্ধতি (২) মাঁচা পদ্ধতি (৩) খাঁচা পদ্ধতি
আমাদের দেশে সাধারণত দোচালা ঘরে মুরগি পালন সুবিধাজনক।
১। লিটার বা বিছানা পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে ঘরের মেঝের ওপর বিছানা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। যেমন-
তুঁষ, কাঠের গুঁড়া, বালি, ছাই, আখের ছোবড়া, খড়ের ছোট টুকরা, ইত্যাদি।
ভালো লিটার দ্রব্যের বৈশিষ্ট্য ও ব্যবস্থাপনা
* আরামপ্রদ
* অধিক পানি শোষণ ক্ষমতা সম্পন্ন
* অনার্দ্র ও শুষ্ক
* সহজলভ্য ও সস্তা
* ছত্রাক ও পরজীবী মুক্ত
* লিটার হিসেবে ব্যবহারের পর সার হিসেবে ব্যবহার করা যায় এমন।
মুরগি রাখার এক সপ্তাহ পূর্বে ঘরে লিটার দ্রব্য বিছাতে হবে। লিটারের পুরুত্ব কমপক্ষে ১.৫-২ ইঞ্চি হবে। লিটারের আর্দ্রতা ২০-২৫ ভাগের মধ্যে হতে হবে। লিটার মাঝে মধ্যে উল্টে পাল্টে দিতে হবে।
২. খাঁচা পদ্ধতিতে মুরগী পালন
আধুনিক বিশ্বে বর্তমানে খাঁচা পদ্ধতিতে অধিক দক্ষভাবে ডিম পাড়া মুরগী পালন করা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের খাঁচা বাজারে পাওয়া যায়।
খাঁচার মাপ হবে ১৮'' x ১২'' x ১৯'' (দৈর্ঘ্য x প্রস্থ x উচ্চতা )। এ ধরনের একটি খাঁচায় অনায়াসে ৩টি ডিম পাড়া মুরগী রাখা যায়।
ডিমপাড়া মুরগী পালনে করণীয় কাজ
খামার সুষ্ঠু ও সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলির প্রতি নজর দিতে হবে।
যেমন
* ডিমপাড়া মুরগীর ঘরের তাপমাত্রা (আদর্শ তাপমাত্রা ১৫-২৩ ডিগ্রী সে.)।
* খাবার পাত্রে জায়গার পরিমাণ (১৮-৭৫ সপ্তাহ বয়সে খাবার পাত্র থেকে প্রতি মুরগীর রৈখক দুরত্ব ১০ সেমি. এবং গোলাকার দুরত্ব ৪ সেমি.)
* পানির পাত্রে জায়গার পরিমাণ (বয়স ১৮-৭৫ সপ্তাহ পর্যন্ত ২.৫ সেমি./মুরগী)
* খাদ্য ও পানি প্রদান (খাদ্য = ১১৫-১২০ গ্রাম/দিন/মুরগী এবং পানি ৩০০-৫০০ মিলি/দিন/মুরগী)
* সঠিক আলোক ব্যবস্থাপনা
বাণিজ্যিক লেয়ারের আলোক কর্মসূচি
* ১০ লাক্স আলোক উজ্জ্বলতার জন্য ৭ ফুট উচ্চতায় ১টি ৬০ ওয়াট বিশিষ্ট বাল্ব প্রতি ২৪০ বর্গফুট জায়গার জন্য যথেষ্ট।
* ১৮ সপ্তাহ শেষে কাঙ্খিত ওজন আসলেই ১৯ সপ্তাহের শুরুতে কর্মসূচী অনুযায়ী আলো বাড়াতে হবে। যদি কাঙ্খিত ফল না আসে সে ক্ষেত্রে ১০% ডিম উৎপাদন হওয়া পর্যন্ত আলোক সময়কাল বাড়ানো বন্ধ রাখতে হবে।
বাণিজ্যিক লেয়ার মুরগীর নূন্যতম টিকাদান কর্মসূচী
এছাড়াও অভিজ্ঞ প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ফাউল কলেরা, মাইকোপ্লাজমোসিস, কক্সিডিওসিস, ই.ডি.এস, ইনফেকশাস করাইজা, ইত্যাদি রোগের বিরুদ্ধে টিকা প্রদান করা উচিত।
মুরগির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির পরিমাণ
যে সকল কারণে খামারের উৎপাদন ব্যহত হয়
নানাবিধ কারণে খামারের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। যেমন-
* হঠাৎ দৈহিক তাপমাত্রা পরিবর্তন।
* খাদ্যের পরিবর্তন বিশেষ করে আমিষ, এমাইনো এসিড, (লাইসিন, মিথিওনিন) এবং লিনোলেনিক এসিড পরিবর্তনের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
* ডিমপাড়া অবস্থায় মুরগীকে টিকা দেয়া হলে কয়েক দিনের জন্য ডিম উৎপাদন কমে যেতে পারে।
* এন্টিবায়োটিক এবং সালফার ড্রাগ সেবনের কারণে ডিম উৎপাদন সাময়িক কমে যেতে পারে।
* কৃমির ওষুধ নিয়মিত ও সময়মত না খাওয়ালে।
* ফাউল কলেরা, মাইকোপ্লাজমা, সালমোনেলা, ইত্যাদি জীবাণুর উপস্থিতি থাকলে ডিম উৎপাদন কমে যায়।
* মুরগী কোনো কারণে ভয় পেলে।
* হঠাৎ ঝড় বৃষ্টির কারণে মুরগী ভিজে গেলে।
* পরিবেশের তাপমাত্রা অত্যধিক ওঠানামা করলে।
* আফলাটক্সিকোসিস বা মাইকোটক্সিকোসিস হলে।
উপসংহার
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আমিষের চাহিদা পূরণ, বেকারত্ব হ্রাস, ইত্যাদি কারণে পোল্ট্রি শিল্প বর্তমানে একটি দ্রুত বিকাশমান খাত। সফলভাবে পোল্ট্রি পালন করতে হলে সুষ্ঠু পরিকল্পনা, খামার ব্যবস্থাপনার মৌলিক বিষয়গুলি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা লাভ এবং তার প্রয়োগ, রোগ নিয়ন্ত্রণ অথবা চিকিৎসা সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন অতীব প্রয়োজন। তবেই পোল্ট্রি পালনে আসবে সফলতা এবং ঘটবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।
সূত্র
১. বাণিজ্যিক পোল্ট্রি পালন ও খামার ব্যবস্থাপনা- প্রফেসর ড. মো. জালাল উদ্দিন সরদার।
২. হাঁস-মুরগির যতœ ও চিকিৎসা- এগ্রোভেট ডিভিশন, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিমিটেড।
৩. হাঁস-মুরগি পালন ও চিকিৎসা- ডাঃ এইচ.কে.নিয়োগি।
৪. নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা।
৫. Poultry Science & Medicine- Professor Dr. Md. Abdus Samad.
ডাঃ মোঃ আকতার ফেরদৌস রানা
ডি.ভি.এম (আর,ইউ) এম.এস ইন ফার্মাকোলজি (বি.এ.ইউ)
ফেলো, ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (জি.ও.বি)
ভেটেরিনারি প্রাকটিশনার
খানজাহান আলী, খুলনা।