আপেক্ষিকতাবাদের কাহিনি; পর্ব – এক: বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ
১৯১৬ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের আবিষ্কার সংক্রান্ত বিজ্ঞানপত্রটি দুনিয়ার সামনে প্রকাশিত হয়। এই বছর সেই দুনিয়া কাঁপানো আবিষ্কারের একশ বছর পূর্তি উদযাপিত হচ্ছে বিশ্বের নানা জায়গায় নানা ভাবে। সেই উপলক্ষে আমি এখানে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের দুই পর্ব সংক্ষেপে সকলের বোধগম্য ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করব। প্রথম পর্বে আলোচনা করা হবে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। পরের বার সাধারণ আপেক্ষিকতা।
একটু মন দিয়ে ভাবলে সকলেই বুঝবেন, এই জাতীয় কথার সঙ্গে আপেক্ষিকতার আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণার কোনো সম্পর্ক নেই। থাকার কথা নয়। উপরের কথাগুলো ভুল নয়। কিন্তু তা বুঝবার জন্য মানবজাতিকে আইনস্টাইন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, তাঁর আগে পর্যন্ত কেউ, এমনকি নিউটনও এসব জিনিস বুঝতে পারেননি, ভাবলে মানুষের বোধবুদ্ধির মাত্রাকে খুবই খারাপ চোখে দেখতে হয়। আইনস্টাইন যে জাতীয় আপেক্ষিকতার সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, তা এর চাইতে সামান্য কিছুটা কঠিন!
এবং সত্যি কথা বলতে গেলে, পদার্থবিজ্ঞানে আপেক্ষিকতার বিষয়টা এরকম কোনো গল্পকথার বিষয় নয়, কোনো কল্প কাহিনিও নয়, একেবারে বাস্তব প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু এই বিষয়টিকে বোঝার চাইতে না বোঝার বা ভুল বোঝার কাহিনি এত বেশি যে মাঝে মাঝেই আমাদের মুখ দিয়ে গল্প শব্দটি বেরিয়ে পড়ে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, এমনকি শুধু সাহিত্যিক বা সাংবাদিকরাও নয়, বহু বিজ্ঞানীও আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে বোঝাতে গিয়ে এমন সব কথা বলেছেন যার সাথে আসলে এই তত্ত্বের কোনো সম্পর্কই নেই। আর এই কারণে অধিকাংশ লোকপ্রিয় লেখক এই বিষয়ে লিখবার সময় দাবি করেছেন, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নাকি বিজ্ঞানের একটি ভীষণ দুরূহ জিনিস। একে বুঝে ওঠা সকলের কম্ম নয়! এও শোনা যায়, উনিশশ তিরিশের দশকে ইংল্যান্ডে আর্থার স্ট্যানলি এডিংটনকে তাঁর এক ছাত্র এসে বলেন, “স্যর, অনেকে বলছে, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নাকি পৃথিবীতে তিনজন মাত্র বিজ্ঞানী বোঝেন?” এডিংটন সঙ্গে সঙ্গে জানতে চান, “হুঁ, তাই নাকি? তা তোমার এই তৃতীয় ব্যক্তিটি কে বৎস?” [Cited, Kuznetsov 1965, 207-08]
অনেক বছর বাদে, ১৯৬৭ সালে রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর এক রচনায় অবশ্য আর একটু বেশি লোকজনকে তত্ত্বটি বোঝার অনুমোদন দেন। বলেন যে বিজ্ঞানীদের মধ্যে জন বারো এটা বুঝতে পেরেছেন। [Feynman 1992, 129]
এই শুচিবাইয়ের অবশ্য একটা কারণ আছে।
বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের বক্তব্য কাউকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে দেখলে দুঃখ পান। পাওয়ারই কথা। তার ফলে কিছু কিছু পদার্থবিজ্ঞানী লোকপ্রিয় ভাষ্যের খুব বিরোধী হয়ে থাকেন। আবদুস সালাম নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর ইলেকট্রো-উইক ক্ষেত্রতত্ত্ব কেন্দ্রিক গবেষণার বিষয় নিয়ে আমি একবার একটা সহজভাষ্য মূলক প্রবন্ধ লিখে ১৯৭৮ সালে (তখনকার) প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। যাতে খুঁটিনাটি বিষয়ে কোনো ভুল থাকলে তা সংশোধন করে নেওয়া যায়। প্রফেসর রায়চৌধুরী প্রবল আপত্তি নিয়ে পৃষ্ঠা চারেক মাত্র দেখে দেন। তাঁর মতে, “বিজ্ঞানকে লোকপ্রিয় করা যায় না। তুমি হয় বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে পার, অথবা লোকপ্রিয় প্রবন্ধ রচনা করতে পার। লোকপ্রিয় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখতে পারবে না।”
এত সব কথা বলবার উদ্দেশ্য একটাই। বিজ্ঞানীদের শুচিবাইকে সম্মান জানিয়ে একটা সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে রাখা। আমার এই নিবন্ধটিও একটি লোকপ্রিয় রচনা। এতেও অতএব ভুল ধারণা ঢুকে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যাঁরা পড়বেন, তাঁরা সাবধান থাকবেন, সম্ভব হলে অন্য উৎস থেকে যাচাই করে নেবেন।
গোড়ার কথা
আমরা শুরু করব সেই সরল জায়গা থেকে যেখানে বৈজ্ঞানিক ধারণা হিসাবে সমস্যাটার প্রথম জন্ম হয়েছিল।
আরিস্ততল। প্লাতোর ছাত্র। দার্শনিক। নৈয়ামিক তর্কশাস্ত্র (formal logic)-এর জন্মদাতা। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিস দেশের এই সুপণ্ডিত মনীষী বৈজ্ঞানিক প্রণালীবদ্ধ জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়ার সূত্রপাত করেছিলেন। বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের বহু শাখার নামকরণও তাঁর হাত দিয়েই হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানেরও। তিনিই প্রথম বস্তুর গতির সমস্যা, বল প্রয়োগের সাথে তার সম্পর্ক—ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটা সূত্রবদ্ধ ধারণা দেবার চেষ্টা করেছিলেন।
আমাদের মনে অনেক এরকম প্রশ্ন ওঠে; অন্তত সেই কালে উঠত: ধনুকের তির কখন ভীম বেগে ধেয়ে যায়? বল্লম জোরে ছুঁড়বার উপায় কী? এই ভারি প্রস্তরখণ্ডকে কীভাবে দূরে সরানো যাবে? গরুর গাড়ি কখন চলতে শুরু করে? নদী থেকে জল বয়ে আনব কী করে? নৌকা কেন চলে? এমনকি স্রোতের বিপরীতেও?
আরিস্ততল বললেন, এই সবের পেছনে আসলে একটাই মূল প্রশ্ন: অচল বস্তু কেন বা কীভাবে গতিশীল হয়? আসুন, ভাবনাচিন্তা করে তার উত্তর খোঁজা যাক। সেই উত্তর হল: যে কোনো স্থির বস্তুকে গতিশীল করতে হলে তার উপরে বল প্রয়োগ করতে হবে। ঠেলা, ধাক্কা, টানা, তোলা, হ্যাঁচকা-টান, গুঁতো, খোঁচা, কাটা, মারপিট—এই জাতীয় সব কাজই সেই বল প্রয়োগের বিচিত্র উদাহরণ। বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করলেই স্থির বস্তু চলতে শুরু করবে। যত বেশি বল প্রয়োগ করবেন, তত জোরে সে চলবে, তত দূরে সে চলে যাবে। বল দেওয়া বন্ধ করলেই সে ধীরে ধীরে থেমে যাবে।
মনে রাখবেন, বিজ্ঞানে সাধারণীকৃত সংজ্ঞার আকারে বল সম্পর্কে এই ধারণাটি আরিস্ততলের একটি অক্ষয় মূল্যবান অবদান।
পরবর্তী প্রায় দু হাজার বছর যাবত মানব জাতি এই কথাটাকে ধরে গতির রহস্য বুঝেছিল: বাহ্যিক বলই গতির সৃষ্টি করে। গতি মানেই তা সেই দৃষ্ট বস্তুর প্রকৃত গতি। বা পরম গতি। সেকালে অবশ্য এই গতি পরম না আপেক্ষিক তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি। ধরেই নিয়েছেন পরম বলে। আর তাতে অসুবিধাও কিছুই হয়নি। মানুষের দৈনন্দিন কাজ এতেই দিব্যি চলে গেছে। ধনুকের ছিলা যত শক্তিশালী হবে, তত জোরে শর নিক্ষেপ করা যাবে। গরুকে বেশি করে খড় খেতে দাও, তবেই না সে গাড়িটাকে ভালোভাবে টানতে পারবে। নদী থেকে জল আনতে যাচ্ছ, আচ্ছা যাও; তবে বেশি বড় বালতি বা কলসি নিও না। বয়ে আনতে কষ্ট হবে। খুঁটিটাকে মাটিতে আরও ঢোকানোর জন্য হাতুড়ি দিয়ে জোরে ঘাই মারো। ইত্যাদি।
শুধু তাই নয়, এই যে পৃথিবীর চার দিকে সূর্য চন্দ্র অন্যান্য গ্রহ এবং তারাগুলো ঘুরছে, তারাই বা এই ঘুরবার গতি পেল কোথায়? তারও উত্তর দিয়ে গেলেন এই বহুদর্শী দার্শনিক। একটা খুব সহজ উত্তর। ওরা থামবে কী করে? ঈশ্বর ওদের চালিয়ে দিচ্ছেন বল প্রয়োগ করে। প্রথম থেকেই। তিনিই এই বিশ্ব সংসারের প্রধান চালক (Prime Mover)। অবশ্য তখন ব্রহ্মাণ্ডের যেটুকু মানুষ জানতে পেরেছিল তাতে ভগবানের খুব বেশি খাটালি ছিল না এই জগতকে চলমান রাখতে। কটাই বা আর গ্রহ নক্ষত্রকে সেকালে চালাতে হত? দশ বিশটার বেশি তো নয়! তাই কখনও খুব একটা কারোর এতটুকুও সন্দেহ হয়নি এই সুশৃঙ্খল জগত-ব্যাপারে। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব নিশ্চিন্ত মনে এই ধারণাকে তাদের চিন্তাকাঠামোয় ঢুকিয়ে নিয়েছিল। এর ভিত্তিতেই প্রথম শতাব্দে ক্লদিউস তলেমি তাঁর ভূকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের রূপ দান করে ফেলেন। আর দ্বাদশ শতকে সন্ত তমাস আকুইনাস বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রধান চালকের এই ধারণাকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে একটি প্রধান যুক্তি হিসাবে স্থাপন করে যান!
কিন্তু “চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়”—কবি ঠিকই বলেছেন। এই সুখের সংসারে বাধ সাধলেন কোপারনিকাস। ১৫৪৩ সালে তাঁর প্রকাশিত ও লাতিন ভাষায় লিখিত “খ-গোলকদের আবর্তন প্রসঙ্গে” (De Revolutionibus Orbium Coelestium) বইতে নানা রকম অঙ্ক কষে নকশা এঁকে তিনি দাবি করে বসলেন, পৃথিবী সহ গ্রহগুলি সূর্যের চারদিকে ঘোরে, আমরা খালি চোখে যা দেখি বলে ভাবি, তা সত্য নয়। সেই প্রথম আরিস্ততলের গতিতত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠল। তার মানে, আমরা প্রতিদিন সূর্যকে যে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে দেখছি, তা সত্য নয়? বছর শেষে সূর্যকে যে ডান দিক বাঁ দিক করে শেষে একই জায়গায় ফিরে আসতে দেখি, তাও বুঝি মিথ্যা? বাস্তবে পৃথিবী ঘুরছে বলেই আমরা সূর্যকে ঘুরতে দেখি। এটা তাহলে তার সত্যিকারের গতি নয়, আপাত গতি। আপেক্ষিক গতি।
প্রথম প্রথম প্রচুর আপত্তি ছিল মানুষের। সমকালীন জ্ঞানীগুণীদেরও অনেকেই মানতে চাননি। তারপর এলেন গ্যালিলেও গ্যালিলেই (ব্রুনোর কথাটা এখানে খুব বেশি প্রয়োজন নেই বলে তুললাম না)। গতির ব্যাপারটাকে খোলসা করে তুলতে অনেক গবেষণা, অনেক পরিশ্রম করলেন। দেখালেন, কোনো বস্তুর তথাকথিত প্রকৃত গতি যে কী জিনিস তা আমরা কখনই জানতে পারব না। আমরা শুধু একটা বস্তুর সাপেক্ষে অন্য বস্তুর গতির কথাই বলতে পারি। তুলনামূলক বা আপেক্ষিক গতির কথাই জানা যায়। পরম গতি আছে কি নেই জানি না, থাকলেও তা জানবার কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই। বরং এই আপেক্ষিক গতিকেই বস্তুর প্রকৃত গতি হিসাবে মেনে নেওয়া ভালো।
সাধারণ মানুষকে বোঝাবার জন্য তিনি এক চমৎকার গল্পই ফেঁদে বসলেন। মনে কর, তুমি কোনো দিন শান্ত সমুদ্রে এক জাহাজের ভেতর বসে আছ। বাইরের তটভূমি বা আকাশের গ্রহ নক্ষত্র কিছুই দেখতে পাচ্ছ না। এই অবস্থায় মনে মনে জাহাজের মাস্তুলের ডগাটার দিকে তাকিয়ে বল তো, জাহাজ চলছে না থেমে আছে? বুঝতে পারছ তো, এটা বলা শুধু তোমার পক্ষে নয়, কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, হাতে একটা বল নিয়ে জাহাজে বসেই উপরে ছুঁড়ে দাও। দেখ, সেটা তোমার হাতেই পড়ছে। সেই জাহাজে বসে তুমি যা কিছু করবে, তীরের সাপেক্ষে থেমে থাকলে যা হবে, যা দেখবে, জাহাজ একই গতিবেগে চলতে থাকলেও একই জিনিস ঘটতে দেখা যাবে। (প্রিয় পাঠক! এই কথাটা কিন্তু খুব জরুরি! স্মৃতিতে ধরে রাখুন। পরেও বারবার প্রয়োজন পড়বে!)
তার মানে শুধু গতি নয়, স্থিতিও আপেক্ষিক। যে থেমে আছে বলে বলছি, সে একটা কিছুর সাপেক্ষে থেমে আছে। যে চলছে, সেও অন্য কারোর সাপেক্ষে চলছে বলে বোঝা যাবে। এই দুটো অবস্থার মধ্যে বাস্তবত কোনো পার্থক্য নেই।
আইনস্টাইন আরিস্ততলের চিন্তা থেকে গ্যালিলেওর এই উত্তরণ প্রসঙ্গেই বলেছিলেন: “অন্তর্বোধ থেকে প্রাপ্ত যুক্তির পদ্ধতিগত কারণেই গতি সম্পর্কে সেই ভ্রান্ত ধারণার জন্ম হয়েছিল; এবং তা শত শত বছর ধরে প্রচলিত ছিল। . . . গ্যালিলেও যে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্কের জন্ম দিলেন এবং কাজে লাগালেন তা মানব জাতির বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের ইতিহাসে এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এখান থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হল।” [Einstein and Infeld 1938, 6-7]
নিউটনের প্রথম গতিসূত্রের মধ্যে এই কথাটাকেই আর একটু গম্ভীর চালে বলা হল। বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করা না হলে স্থির বস্তু আপেক্ষিক অর্থে স্থির থাকবে, গতিশীল বস্তু আপেক্ষিক সমবেগে চলতে থাকবে। এভাবেই আমরা বইতে পড়ি সূত্রটাকে। সেখানেও যে আপেক্ষিক শব্দটা আছে সেটা প্রায় খেয়ালই করি না। করলে বুঝতে পারতাম, বলবিদ্যায় আপেক্ষিকতার ধারণাটা আইনস্টাইনেরই প্রথম ব্যবহার নয়। অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞানে ছিল।
শুধু তাই নয়। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল এই ঘটনা যে আমরা লক্ষই করি না, নিউটন আসলে সেই সূত্রে আপেক্ষিক অর্থে স্থির বস্তু আর গতিশীল বস্তুর দুই অবস্থার মধ্যে কোনো তারতম্য করেননি। অর্থাৎ, প্রথম সূত্রকে তিনি এইভাবেও বলতে পারতেন, বলবিদ্যার নিয়মগুলি পরস্পর সমবেগে চলমান সমস্ত নির্দেশাক্ষে একইভাবে প্রযোজ্য। তাতেও কোনো ভুল হত না।
সে কি মশাই? আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, না হয় মেনেই নিলাম, যে বস্তু চলছে বা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—তার দুটো অবস্থাই কারোর না কারোর সাপেক্ষে দেখা হচ্ছে; কিন্তু তাই বলে দু জায়গাতে নিয়মগুলি একই থাকে কী করে?
নিউটন সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। নির্দেশাক্ষ (frame of reference)-এর ধারণা তুলে ধরে (পার্শ্বটীকা-১ দ্রষ্টব্য)। যার সাপেক্ষে তুলনা করে গতির রহস্য বুঝতে চাইছেন তাকেই বলা হচ্ছে নির্দেশাক্ষ। সমুদ্র তীরের সাপেক্ষে জাহাজ থেমে আছে। তীর হচ্ছে এখানে জাহাজের গতি নির্ধারণের নির্দেশাক্ষ। বেশ। এবার জাহাজের মধ্যে আপনি যখন কোনো পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণের কাজ করছেন, জাহাজকেই তার জন্য নির্দেশাক্ষ ধরে নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে হল কি, জাহাজ চলতে শুরু করে দিল। সমুদ্র শান্ত থাকায়, হাওয়ার ধাক্কা নেই বলে, ঢেউ উঠছে না বলে, জাহাজের গতি আপনি বুঝতে পারছেন না। যা যেমন দেখছিলেন বা করছিলেন, দেখে এবং করে যাচ্ছেন।
এর মানে কি জানেন?
এর মানে হল, আপনার কাজের জন্য যে নির্দেশাক্ষ আপনি নিয়েছিলেন, সে আবার সমুদ্র তীরের সাপেক্ষে চলমান। আর আপনি তীরকে নির্দেশাক্ষ ধরলে তার সাপেক্ষে আপনি চলমান এবং জাহাজকে ধরলে তার তুলনায় স্থির। একথার অর্থ দাঁড়াল যে, তীরের নির্দেশাক্ষ সাপেক্ষেই দেখুন, অথবা তার সাপেক্ষে সমবেগে চলমান জাহাজের নির্দেশাক্ষ ধরেই দেখুন, বলবিদ্যার নিয়মগুলি সমানভাবে খাটছে। আপনি (আপেক্ষিক অর্থে) স্থির বা চলমান দুই নির্দেশাক্ষর মধ্যে পার্থক্য দেখতে পাবেন না।
_________________________________________________________________________
পার্শ্বটীকা-১
নির্দেশাক্ষ ধরে কীভাবে নিউটনের এই ধারণাগুলিকে বোঝা
যাবে দেখে নিই (চিত্র নং – ১)। যদি একটি নির্দেশাক্ষ (x-y-z) সাপেক্ষে কোনো
বস্তু x-অক্ষ বরাবর অনুভূমিক অভিমুখে u সমবেগে গতিশীল হয়, এবং অন্য একটি
নির্দেশাক্ষ (X-Y-Z) প্রথম নির্দেশাক্ষের সাপেক্ষে সেই অভিমুখে একই অর্থাৎ,
u সমবেগে গতিশীল হয়, তবে দ্বিতীয় নির্দেশাক্ষ সাপেক্ষে সেই বস্তুটির
আপেক্ষিক গতি হবে শূন্য = ০। এখন t একক সময় পরে বস্তুটির অবস্থা বোঝানোর
জন্য দুই নির্দেশাক্ষে যে স্থানাঙ্কগুলি ব্যবহার করা হবে তাদের পারস্পরিক
সম্পর্ক হবে এই রকম:
চিত্র-১
এখানে চতুর্থ স্থানাঙ্ক দিয়ে উভয় নির্দেশাক্ষে সময়ের
সমপ্রবাহ বোঝানো হয়েছে। নিউটনীয় বলবিদ্যায় এর কোনো প্রয়োগ ছিল না। কেন না,
সমস্ত নির্দেশাক্ষেই সময়ের চলন ছিল একই প্রকার। তবে ১৯০৯ সালে
পদার্থবিজ্ঞানী ফিলিপ ফ্রাঙ্ক যখন এই স্থানাঙ্ক বদলের সম্পর্কগুলিকে
গ্যালিলেও পরিপাতন (Galilean Transformation) হিসাবে নামাঙ্কিত করে
দেখালেন, তিনি পরবর্তীকালের আপেক্ষিকতার নিয়মের সাথে সাযুজ্য রাখার জন্য
এটিকেও জুড়ে দেন।_________________________________________________________________________
এর থেকে দুটো জিনিস স্পষ্টভাবে বোঝা গেল: এক, পারস্পরিক সমবেগে চলমান নির্দেশাক্ষগুলির মধ্যে আপনি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না। কাউকে বেশি ভালো, কাউকে একটু খারাপ, এ ওর চাইতে সুবিধাজনক—এইভাবে বলতে পারা যাবে না। বলবিদ্যার চোখে তারা সকলেই তুল্যমূল্য। আর দুই, সমবেগে চলমান কোনো বস্তুর প্রকৃত বা পরম বেগ কত বা কেমন তাও আপনি বলতে পারবেন না। আপনি শুধু কোনো বিশেষ একটা নির্দেশাক্ষ ধরে নিয়ে তার সাপেক্ষে সেটি কী আপেক্ষিক বেগ নিয়ে চলছে তা বলতে পারেন। এর বেশি কিছু বলতে গেলেই বিপদে পড়ে যেতে পারেন কিন্তু। বিজ্ঞানীরা এমনিতে যথেষ্ট ভদ্রলোক। কিন্তু আমি দেখেছি, খেয়াল-খুশি মতো, অর্থাৎ, চলতি সাধারণ বুদ্ধির পরামর্শে প্রাকৃতিক নিয়ম-টিয়ম নিয়ে একটুও কচলাকচলি করতে গেলে তাঁরা বেজায় ক্ষেপে যান। আপনাকে তখন ওনারা অর্বাচীন, মূর্খ, মূঢ়, নির্বোধ, পামর, জ্ঞানদ্রোহী, সত্যদ্বেষী, ইত্যাদি অনেক কিছু কড়া কথা বলে দিতে পারেন! অন্তত মনে মনে!!
অথঃ ত্বরণ-রহস্য
নিউটনের গতিসূত্র কিন্তু একটি নয়, তিনটি। আমরা এযাবত একটার কথাই বলেছি। যেটার ধারণা তিনি গ্যালিলেওর থেকে নিয়ে গাণিতিক পরিভাষায় লিখে ফেললেন। এবার দ্বিতীয়টাতে যাওয়া যাক। প্রথম সূত্র থেকে জানা গিয়েছিল, বাইরে থেকে বল প্রয়োগ না করলে বস্তুর অবস্থার পরিবর্তন হয় না। দ্বিতীয় সূত্র থেকে জানা গেল, বল প্রয়োগ করলে ঠিক কী হয়। নিউটনের কথায়, বাহ্যিক বলের ঠেলায় পড়ে বস্তুর আপেক্ষিক বেগের পরিবর্তন হয় (বাড়ে বা কমে, এবং/অথবা, অভিমুখ বদল করে) এবং এই পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক। এই পরিবর্তন শব্দটা খুব জরুরি। এইখানেই যে আরিস্ততলের থেকে আধুনিক বলবিদ্যার ধ্যান-ধারণা আলাদা হয়ে গিয়েছিল তা অনেকে ধরতেই পারেননি। আরিস্ততল মনে করতেন, বল প্রয়োগ করলে গতির সৃষ্টি হয়; আর গ্যালিলেওকে অনুসরণ করে নিউটন জানালেন, “না দাদা, বল প্রয়োগ করলে গতিবেগের পরিবর্তন হয়। গতি সৃষ্টি করার আপনি আমি কেউ নই। দুনিয়া এমনিতেই গতিময় হয়ে আছে। আমরা শুধু এখানে ওখানে এর বদল করতেই পারি। কমাতে বা বাড়াতে পারি। তাও যেগুলো হাতের সামনে রয়েছে।”
যাঁরা গাড়ি চালাতে জানেন, হয়ত ঝপ করে বলে বসবেন, “কেন মশাই, আমরা কি ব্রেক কষে গাড়ি থামাই না? আমরা কি রাস্তা ফাঁকা পেলে এবং তাড়া থাকলে গাড়ির গতিবেগ বাড়াই না? গিয়ারের কাজই তো হল গিয়ে . . ., যাক গে, ওসব বাজে কথা ছাড়ুন। গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, নৌকা, জাহাজ, ইত্যাদির অ্যাক্সিলারেটর এবং ব্রেক-টেক বলে কিছু ছিল না বলেই নিউটন ওই সব আজগুবি কথা বলেছিলেন।”
আবার আমাকে বলতেই হচ্ছে, অত সহজে নিউটনের ভুল ধরতে যাবেন না। খুব সাবধানে ভাবুন। আপনি প্রকৃতই স্থির বস্তু বলে কিছু যে পাননি, সেটা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন না। যাকে স্থির বলে দেখেছেন, সে কারোর সাপেক্ষে স্থির, অন্য কারোর সাপেক্ষে আবার চলমান। কোনো বস্তুকেই আপনি স্থির বলে ধরে নিতে পারছেন না। সুতরাং দুনিয়ার সমস্ত বস্তুকেই আপেক্ষিক ভাবে চলমান ধরে নেওয়াই সুবিধাজনক। কেন না, স্থিরতা আর গতিশীলতার মধ্যে বলবিদ্যার দিক থেকে কোনো পার্থক্যই নেই। আর, সব কিছুই যখন (আপেক্ষিক অর্থে) চলমান, আপনি বল প্রয়োগ করে আবার কী করে তাকে চলমান করবেন? গতিশীল বস্তুর মধ্যে আবার নতুন করে গতি সৃষ্টি করার কথা ওঠে কীভাবে? আপনি বল প্রয়োগ করে শুধু তার গতির কম বেশিই করতে পারেন। অ্যাক্সিলারেটর মানে যে গতি বাড়ায়, আর ব্রেক মানে হচ্ছে যে গতি কমায়—অর্থাৎ, প্রথমটা যদি হয় ধনাত্মক ত্বারক, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঋণাত্মক ত্বারক। উভয়েরই কাজ বল প্রয়োগ করে ত্বরণ (acceleration) সৃষ্টি করা। গতির অভিমুখ বরাবর, অথবা, তার বিপরীত দিকে।
সময়ের সঙ্গে গতিবেগ পরিবর্তনের হারকে বলা হয় ত্বরণ। বস্তুর আসল অর্থাৎ নির্দেশাক্ষ-নিরপেক্ষ বেগ জানা না গেলেও নির্দিষ্ট ভরের বস্তুর উপর প্রযুক্ত বলের পরিমাণ অনুযায়ী উৎপন্ন ত্বরণ কিন্তু সঠিকভাবে জানা যায়। বিজ্ঞানীরা একে মাপজোক করে জানতে পারেন। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র এই ব্যাপারে তাঁদের খুবই সাহায্য করে থাকে। সাধারণ মানুষও ত্বরণের অস্তিত্ব যে কোনো যানবাহনের গতির ক্ষেত্রে বুঝতে পারেন। স্টেশনে থেমে থাকা গাড়ি চলতে শুরু করলে আমরা সামান্য পেছনে হেলে যাই। গাড়ি খুব দ্রুত চলতে চলতে ঝট করে থেমে গেলে আমরা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ি। গাড়ি এক দিকে বাঁক নিলে আমরা উলটো দিকে কাত হয়ে যাই একটু। এই সব ঘটনা আমাদের সকলেরই জানা আছে। কিন্তু এর ব্যাখ্যা যে এই ত্বরণের ধারণা থেকে পাওয়া যায় সেটা আমাদের অনেকের খেয়াল থাকে না। স্থিতিজাড্য (inertia of rest) আর গতিজাড্য (inertia of motion) দিয়ে ব্যাখ্যা করার ফলে ত্বরণের প্রশ্নটা অনেকেরই মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। অথচ, গাড়ির ক্ষেত্রে ত্বরণ আর যাত্রীর ক্ষেত্রে যে এটা জাড্যের বিষয়—এইভাবে এই সব ঘটনাকে বোঝা দরকার। কিংবা, জাড্য মানে হল সমবেগে চলবার আগ্রহ, এবং ত্বরণে অনীহা—এইভাবেও বুঝতে পারেন।
আবার আইনস্টাইনের কথায় ফিরে যাই: “বাইরে থেকে বল প্রয়োগের ফলে বেগের পরিবর্তন হয়। টানা বা ঠেলার ফল হিসাবে বেগ সৃষ্টি হয় না, বেগের পরিবর্তন হয়। বেগের একই অভিমুখে অথবা বিপরীত অভিমুখে ক্রিয়া করছে দেখে বুঝতে হবে, বেগ বাড়বে না কমবে। . . . এই সঠিক রাস্তা ধরে আমরা গতি সম্বন্ধে গভীরতর ধারণা লাভ করি। আমাদের স্বজ্ঞান বলের সাথে বেগের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক দেখালেও বলের সঙ্গে বেগের পরিবর্তনের যে সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়েছিল সেটাই নিউটন প্রবর্তিত সাবেকি বলবিদ্যার ভিত্তি।” [Ibid]
আইনস্টাইনের তত্ত্বকে বোঝার জন্য এই ত্বরণের প্রশ্নে আমাদের আবার পরে ফিরে যেতে হবে। আপাতত আর দু একটা সাধারণ জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে।
আরিস্ততলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে গ্যালিলেও-নিউটনের তত্ত্বের পার্থক্যের মাত্রাটা আমাদের বুঝে নেওয়া দরকার। এখনকার গাণিতিক পরিভাষায় দেখলে আরিস্ততলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতিবেগ হচ্ছে প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক; আর নিউটনের সূত্র অনুসারে গতিবেগ পরিবর্তনের হার (বা ত্বরণ) হচ্ছে প্রযুক্ত বলের সঙ্গে সমানুপাতিক (পার্শ্বটীকা-২ দ্রষ্টব্য)। দ্বিতীয়ত, আরিস্ততলের মতে, বল প্রয়োগ না করলে সচল বস্তু থেমে যাবে; আর গ্যালিলেও এবং নিউটন দেখালেন, বল প্রয়োগ না করলে সমবেগে সচল বস্তু চলতেই থাকবে। অর্থাৎ, বল-শূন্য অবস্থায় স্থির কিংবা সমবেগে গতিশীল বস্তুর মধ্যে বলবিদ্যার নিয়মের দিক থেকে তফাত করা যায় না। তৃতীয়ত, আরিস্ততলের সিদ্ধান্তটা মোটামুটি সঠিক হিসাব দেবে যদি একটা বস্তুকে কোনো (থকথকে কাদা, গাঢ় আঠা বা জেলির মতো) সান্দ্র মাধ্যম (viscous medium)-এ রেখে তার উপর বল প্রয়োগ করা হয় এবং সেখানে সেই বস্তুর বেগের সঙ্গে প্রযুক্ত বলের সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ, একটা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ও বিশেষ পরিস্থিতিতে আরিস্ততলের সূত্রও সঠিক। একেবারে সবটাই ভুল ছিল না। কিন্তু সাধারণভাবে গতির সূত্র হিসাবে অবশ্যই ভ্রান্ত ছিল।
_________________________________________________________________________
পার্শ্বটীকা-২
আরিস্ততলের ধারণাকে গ্রহণ করলে বলের সঙ্গে বেগের সম্পর্ক আমাদের এই সমীকরণ দিয়ে লিখতে হবে:
আরিস্ততলের ধারণাকে গ্রহণ করলে বলের সঙ্গে বেগের সম্পর্ক আমাদের এই সমীকরণ দিয়ে লিখতে হবে:
[এখানে = প্রযুক্ত বল, = ভর, = সরণ, এবং = সময়; এবং দ্বারা যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের অবকলন বোঝানো হয়েছে।]
_________________________________________________________________________
পরম বেগ কোথায় পাব?
নিউটনের বলবিদ্যার সাফল্য এক কথায় বলতে গেলে বিরাট। অন্তত দুশ বছর (১৬৮৭-১৮৮৭) এর রাজত্ব ছিল অবিসম্বাদিত। কেউ এর বিরুদ্ধে ট্যাঁ-ফো করতে পারেনি। কয়েকটা খুব ছোটখাটো সূত্রের সাহায্যে যেভাবে পার্থিব বস্তু থেকে শুরু করে গ্রহ নক্ষত্র পর্যন্ত সব কিছুর গতির রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়েছিল তা এক কথায় প্রচণ্ড বিস্ময়কর। এই সূত্রের সাহায্যে এডমন্ড হ্যালি একটা ধূমকেতুর কক্ষপথ ও আবর্তন কাল অঙ্ক কষে বের করে বললেন, সে ৭৫-৭৬ বছর পরে পরে পৃথিবীর আকাশে ফিরে ফিরে দেখা দেবে, এবং হ্যালি ততদিন বেঁচে না থাকলেও সত্যিই নির্দিষ্ট সময়ে সে দেখা দিল, বোঝা গেল এই তত্ত্বের শক্তি কেমন!
এই তত্ত্বের সাহায্যেই কিছু আকাশ পর্যবেক্ষকের সন্দেহ হল, শনির পরেও হয়ত আর একটা গ্রহ আছে যাকে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না। টেলিস্কোপ তাক করে বসে থাকতে থাকতে আবিষ্কার হল ইউরেনাস। তারপর এক শতক বাদে নেপচুন। আরও বছর পঞ্চাশেক বাদে পাওয়া গেল প্লূটোকে। এইভাবেই খুঁজে পাওয়া গেল বহু ধূমকেতুকে, মঙ্গল আর বৃহস্পতির মধ্যেকার সদা ঘুর্ণায়মান গ্রহচূর্ণরাশিকে। তারপর . . .
মজার কথা হল, নিউটন তাঁর সমগ্র তত্ত্বকাঠামোয় বিশ্ব চরাচরের সমস্ত বস্তুর আপেক্ষিক স্থিতি ও গতি নিয়ে কাজ করলেও আরিস্ততলের সেই পরম স্থিতি ও গতির ধারণাকে একেবারে ছাড়তে পারলেন না। বেগ = দূরত্ব/সময়। বেগ যদি আপেক্ষিক হয়, দূরত্বের মাপ বা সময়কেই বা পরম বলা যায় কীভাবে? আবার এটাও ঠিক যে একটা বস্তুর দৈর্ঘ্য কিংবা একটা ঘটনার প্রবাহকাল নির্দেশাক্ষ নির্বিশেষে একই থাকে। আমি যে জামা পরে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি, গাড়িতে উঠলে সে তো আর ছোট-বড় হয়ে যায় না। হাতঘড়িতে সময় দেখে গ্যালোপিং ট্রেনেও স্টেশনের ঘড়ির সাথে মেলাতে পারি। তার মানে এই মাপগুলি পরম বলাই যায়। অতএব, এমনিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও পরম গতির দেখা না পেলেও তিনি ধরে নিলেন, কোনো এক সুদূর অতীতে এই বিশ্বজগত একদম স্থির ছিল। খুব দূরের কোনো প্রান্তে নিশ্চয়ই এখনও তার চিহ্ন থেকে গেছে, যা হয়ত একদিন আবিষ্কার হবে। তার সাপেক্ষে অন্য সমস্ত বস্তুর গতিই পরম গতি হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে।
তখন নিউটনের সামনেও এই প্রশ্ন এসে গেল, তাহলে প্রথম গতির উৎস কী ছিল? পরম স্থিতি থেকে প্রথম দিনের সেই পরম গতির উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল? উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনিও শেষ পর্যন্ত সন্ত আকুইনাস হয়ে আরিস্ততলের দ্বারস্থ হলেন। বা বলা ভালো, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের।
তবে তখন বিশ্ব ধারণার ব্যাপ্তি বেড়েছে। আবার জ্ঞানও বেড়েছে। অতএব নিউটন ভগবানের কাজের বোঝা যথেষ্ট কমিয়ে দিলেন। রোজ রোজ ঠেলাঠেলি করতে হচ্ছে না। সেই অতীতের চরম স্থির বিশ্বকে তিনি শুধু একবার এক রামধাক্কা দিয়ে চালু করে দিয়েছিলেন। ব্যস! তারপর থেকে আর কিছু করতে হচ্ছে না ওনাকে। এই বিশ্বজগত সেই থেকে সেই ঐশ্বরিক প্রথম ধাক্কা (First Impulse)-এর ঠেলায় নিউটনের বাতলানো গতি সূত্র মেনে ঘুরে চলেছে তো চলেছেই। সেরকম একটাও যদি পরম স্থির জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়, তার সাপেক্ষে অন্য সব কিছুরই গতি হবে পরম।
বোঝাই যাচ্ছে, বিজ্ঞানের তরফে এখানে একটা ফাঁকি রয়ে গেল!
সে যাই হোক, উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এসে প্রথম বিজ্ঞানীদের সন্দেহ হল, দুনিয়ার সমস্ত সমস্যা নিউটনের তত্ত্বের আওতায় বোধ হয় আসে না। বা আনা যাবে না। মাইকেল ফ্যারাডে ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ এবং চুম্বক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যে সমস্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, তাতে একটা জিনিস পরিষ্কার হতে শুরু করল, এদের ব্যাপারস্যাপার ঠিক নিউটনীয় গতিবিদ্যার নিয়ম মেনে চলতে রাজী নয়। তারপর ১৮৬০-এর দশকে জেম্স ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল বিদ্যুৎ এবং চুম্বকের বিভিন্ন ধর্মগুলোকে সংযোজিত করে গণিতের ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে এক দারুণ জিনিস আবিষ্কার করে বসলেন। তিনি দেখলেন, বিদ্যুৎ আর চুম্বকের মৌল বৈশিষ্ট্যগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, বরং গভীরভাবে অন্বিষ্ট। চৌম্বক ক্ষেত্রে একটা তড়িৎ পরিবাহীকে দ্রুত চালিত করলে তার মধ্যে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র উৎপন্ন হয়; আবার বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের মধ্যে একটা লোহার রডকে নাড়ালে তাতে চুম্বকত্ব দেখা যায়। তার মানে এরা কেউ একে অপরের থেকে একেবারে আলাদা কিছু নয়। শুধু তাই নয়, চুম্বক এবং বিদ্যুতের প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়াকে একই রকম সমীকরণের সাহায্যে একই সঙ্গে প্রকাশ করা যাচ্ছে।
এর পর ম্যাক্সওয়েল যা দেখলেন তা আরও বিস্ময়কর। তাঁর সমীকরণগুচ্ছ থেকে তিনি তড়িচ্চৌম্বক তরঙ্গের যে গতিবেগ পেলেন তা আলোকের গতিবেগের সমান। এবং এই সব তরঙ্গ কোনো মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যেমন যেতে পারে, তেমনই শূন্য মাধ্যমেও চলাচল করতে পারে। তিনি দাবি করলেন, আলোও নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিস্তারের সীমানার মধ্যে এক রকম তড়িচৌম্বক তরঙ্গ। তিনি এই তরঙ্গের যে গতিবেগ নির্ধারণ করার একটি সরল সূত্র পেলেন তা হল নিম্নরূপ:
এইবার এক বড় সমস্যার সামনে পড়া গেল। নিউটনের গতিসূত্র এবং আপেক্ষিকতা অনুযায়ী কোনো কিছুর গতিবেগ তার নির্দেশাক্ষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধরা যাক, নদীতে নৌকায় করে আপনি কোথাও যাচ্ছেন। সকলেই জানেন, নৌকা যদি জলের স্রোতের সঙ্গে একই দিকে যায়, দুটো বেগ যুক্ত হয়ে নৌকা জোরে ছুটবে। আর বিপরীত দিকে গেলে আস্তে আস্তে চলবে। এমনকি এও জানা আছে যে নদী আড়াআড়িভাবে পার হতে হলে নৌকাকে স্রোতের বিপরীত দিকে একটু কোনাকুনি করে যাত্রা করতে হবে। তার মানে হল, বস্তুর গতিবেগ তার মাধ্যমের গতিবেগের সাথে ভীষণভাবে যুক্ত। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের সূত্র থেকে দেখা যাচ্ছে যে তড়িচ্চৌম্বক তরঙ্গের বিস্তার সে যে মাধ্যমে প্রসারিত হচ্ছে তার অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল নয়। শূন্য মাধ্যমেও সে বিস্তার লাভ করতে পারে। আর এদের গতিবেগ মাধ্যমের গতিবেগের সাথে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নয়। বরং উল্টোদিকে, নির্দেশতন্ত্র বদলে দিলে ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের চেহারাই বদলে যায়, যা এমনকি গ্যালিলীয় আপেক্ষিকতার ধারণার সাথেও খাপ খায় না। অর্থাৎ, আমরা যে আশা করেছিলাম, গতিসূত্রের নিয়মগুলি নির্দেশতন্ত্রের উপর নির্ভর করা উচিত না, সেখানেই সমস্যা দেখা দিল।
এইখানে এসে নিউটনের গতিবিদ্যার সাথে ম্যাক্সওয়েলের সূত্রের ব্যাপক বিরোধ হয়ে গেল। মুশকিল হচ্ছে, কাউকেই ছাড়া যাচ্ছে না। নিউটনের সূত্রগুলো এতভাবে এত জায়গায় প্রযুক্ত ও পরীক্ষিত হয়ে উঠে এসেছে যে তাকে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবার ম্যাক্সওয়েলের সূত্রগুলিও একদিকে অন্য ধরনের বহু পরীক্ষার ফসল এবং তার পেছনেও রয়েছে এক নিশ্ছিদ্র তাত্ত্বিক ও গাণিতিক বিজ্ঞানের বিকাশ। তাকেই বা অস্বীকার করার উপায় কী?
অধিকাংশ বিজ্ঞানীই নিউটনকে বাঁচিয়ে সমস্যাটার সমাধান খুঁজতে চাইলেন। তাঁরা ভাবলেন, নিশ্চয়ই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চারদিকে একটা কোনো মাধ্যম আছে যা অদৃশ্যভাবে পরিব্যাপ্ত বলে আমরা তার অস্তিত্ব টের পাই না। ইথার। কত গুণ যে তার উপর আরোপিত হল: টানলে বাড়ে আবার ছেড়ে দিলেই যে কে সেই। স্থির, নিঃশব্দ, সর্বভেদী, নিখুঁতভাবে স্থিতিস্থাপক, ইত্যাদি। (দেশে দেশে কত ধর্মতাত্ত্বিক তখন সরল বিশ্বাসে ইথারের সাথে আত্মার ধারণাকে মেলাতে পেরে পুলকিত!) তখন ভাবা হল, আচ্ছা, এমন একটা পরীক্ষার আয়োজন করা যাক, যাতে ইথার মাধ্যমে বিভিন্ন দিকে আলোকের গতিবেগ মাপার চেষ্টা করা হবে। যদি দুদিকে দুরকম মান পাওয়া যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে। নিউটনকে বাঁচিয়েই ম্যাক্সওয়েলকে মেনে নেওয়া যাবে। ১৮৮১ সালে এডওয়ার্ড মাইকেলসন, ১৮৮৭ সালে মাইকেলসন ও অ্যালবার্ট মর্লি দু দুবার খুব সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি সাজিয়ে পরীক্ষা করলেন। কিন্তু কোথায় কী? আলোকে যেদিকেই মাপা হচ্ছে, বেগ একই দেখাচ্ছে।
কী দুঃসংবাদ ভেবে দেখুন একবার। সেই একটা পরম বেগ হাতের কাছেই খুঁজে পাওয়া গেল, কিন্তু যিনি এর কথা কত আগে ভেবে রেখেছিলেন, তাঁর এযাবতকালের বিপুলভাবে সফল তত্ত্বের সাথেই সে অসহযোগিতা করবে বলে পণ করেছে।
ঊনবিংশ শতাব্দ তখন সমাপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। ১৮৭৮ সালে একদিন প্রথিতযশা পদার্থবিজ্ঞানী জোহান ফিলিপ ফন জোলির কাছে যুবক মাক্স প্লাঙ্ক গিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে। জোলি তাঁকে বোঝালেন, “দেখ বৎস, সত্যি কথা বলতে কি, পদার্থবিজ্ঞানে আর বিশেষ নতুন কিছু করার নেই। দুনিয়ার প্রায় সমস্ত দুর্জ্ঞেয় রহস্য উন্মোচিত হয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় মাপজোক এখনও বাকি আছে। তুমি বরং রসায়ন বা জীববিজ্ঞানের কিছু ভালো সমস্যা নিয়ে ভাবতে পার।” সেরকম সময়ে নিউটন-ম্যাক্সওয়েল তত্ত্বের এই ঝামেলা মেটাতে হেন্ড্রিক আন্টুন লোরেঞ্জ, জর্জ ফ্র্যান্সিস ফিটজেরাল্ড, হ্বোলডেমার ফয়েগট, প্রমুখ বললেন, এক কাজ করা যাক, ধরে নেওয়া যাক, ইথারের মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে বস্তুর দৈর্ঘ্য কমে যায় আর সময় মন্থর হয়ে পড়তে থাকে। তাতে সব দিকই বজায় থাকে। অঙ্কগুলো মিলে যায়। অঁরি পোয়াকার বললেন, “আরে বাবা, দৈর্ঘ্য বল আর প্রস্থ, সে সবই তো আমাদেরই হিসাব নিকাশ। তাতে সামান্য এদিক ওদিক করলে কী-ই-বা এসে যায়? সময়কেও না হয় সেভাবেই মাপা যাবে!”
নিউটনের রেখে যাওয়া সেই ফাঁকিকে কীভাবে পদার্থবিজ্ঞানের এলাকা থেকে হঠানো যাবে তা নিয়ে তখনও কেউ ভাবতে শুরু করেননি। পরম স্থিতি, পরম গতি আর ইথার! ফাঁকির উপরে ফাঁকি!!
শতাব্দের শেষটা তাঁদের কিন্তু ভালো কাটল না।
আপেক্ষিকতার নতুন বেশ: সমকালিকতা
এর কিছু কাল পরেই আইনস্টাইনের মঞ্চে প্রবেশ। তিনি তখন ভালো কোনো চাকরি পাননি। একে তাকে ধরে জুরিখের পেটেন্ট অফিসে একটা টেকনিক্যাল পোস্টে কাজ পেয়েছেন। বিকেলে বিজ্ঞান পাঠরত বা গবেষণারত বন্ধুদের সঙ্গে কাফেতে বসে আড্ডা দেন। সন্ধেবেলায় বাড়ি এসে নিজের মতো করে বিজ্ঞানের কিছু কিছু সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামান।
সেই তিনি ১৯০৫ সালে তিন চার মাসের মধ্যে এক বিজ্ঞান পত্রিকায় পরপর এমন পাঁচখানা গবেষণাপত্র পাঠালেন, যার প্রত্যেকটাই এক একটা যুগান্তকারী কাজ। তারই একটার জন্য তিনি আঠের বছর বাদে নোবেল পুরস্কার পাবেন, কিন্তু সব কটার জন্যও পেতে পারতেন অন্তত পাঁচটা নোবেল। কারোর তাতে মন খারাপ হত না! আমরা এখানে অন্যগুলো নিয়ে মাথা ঘামাব না। শুধু একটা দুটো পত্রের কথাই বেশি করে আলোচনা করব; তবে পাঠকদের বলব, সময় সুযোগ পেলে বাকিগুলোর সম্বন্ধেও জেনে নেবেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এরকম কাণ্ড আর কখনও ঘটেনি, এর আগেও না, পরেও না। অন্তত আজ অবধি।
আপেক্ষিকতার পত্রের নিরীহ শিরোনাম দেখে প্রথমটায় কেউ বুঝতেই পারেননি তাতে কী সাংঘাতিক একখানা টাইমবোমা পুরে দেওয়া আছে। ভারি সহজ সরল সব অঙ্ক। যুক্তির ধার খুব সাদামাটা। কিন্তু . . .
প্রথমেই এ কী বলেছেন তিনি? আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বস্তুর গতির রহস্য পুরোপুরি বুঝতে হলে আমাদের মেনে নিতে হবে দুটো খুব সরল বিবৃতি: (১) পারস্পরিকভাবে সমবেগে গতিশীল সমস্ত নির্দেশাক্ষে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলি সিদ্ধ; (২) অতএব, ম্যাক্সওয়েলের আবিষ্কৃত নিয়মটিও এরকম যে কোনো নির্দেশাক্ষেই সমানভাবে সত্য, অর্থাৎ, যে কোনো নির্দেশাক্ষের সাপেক্ষেই আলোকের গতিবেগ ধ্রুবক।
তার মানে কী?
প্রথমত, নিউটনের সময়ে মূলত বলবিদ্যাতে যান্ত্রিক শক্তি ও গতির বিষয় নিয়ে চর্চা হলেও এখন তার পাশাপাশি তড়িচ্চুম্বকীয় গতিও সমান গুরুত্ব অর্জন করেছে; সুতরাং তাকেও গতি সংক্রান্ত বিচার বিবেচনায় আমাদের ধরতে হচ্ছে। তাই শুধু বলবিদ্যার নিয়ম নয়, সমগ্র পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলির কথা মাথায় রেখেই এগোতে হবে। দ্বিতীয়ত, তারই ফল স্বরূপ, গ্যালিলেওর আবিষ্কৃত মৌল নিয়ম, অর্থাৎ, কোনো নির্দেশাক্ষে বসেই বস্তুর গতি বা স্থিতির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করা যায় না, তেমনই আলোকের গতিবেগ যে মাধ্যমের গতিবেগ নিরপেক্ষ, সেই তথ্যটিকেও মাথায় রেখেই গতির প্রশ্নের মীমাংসা করা উচিত। যদি দেখা যায়, পুরনো নির্দেশাক্ষ ধরে এগোতে গেলে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, তাহলে নির্দেশাক্ষের সমীকরণগুলোকেই বরং পালটে ফেলার সময় হয়েছে।
তার আরও মানে হল, আমরা এযাবত যেভাবে ধরে নিয়েছিলাম, (ক) দৈর্ঘ্যের মাপ নির্দেশাক্ষ নিরপেক্ষ, (খ) সময়ের মাপও নির্দেশাক্ষের উপর নির্ভর করে না, (গ) দেশ ও কাল পরস্পর নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল, ইত্যাদি, সেই ধারণাগুলো আমাদের এখন বদলাতে হবে। একমাত্র তাহলেই সব দিক বজায় থাকবে। সমস্ত ফাঁকিগুলো ফুকে যাবে। ইথার-ফিথার সব (এ মাঃ, এবার তাহলে আত্মাকে কার ঘাড়ে চাপাব?)!
আইনস্টাইন একেবারে মূলে চলে গেলেন। বললেন, এতদিন আমরা সময়কে সর্বত্র ধ্রুবক ভেবে এসেছি। আর তার ফলে বলের ক্রিয়া বোঝার সময় সময়ের প্রশ্নটাকে কার্যত বাদ দিয়ে রেখেছি। কিন্তু না। এখন আলোকের গতিবেগ ছাড়া আর কোনো কিছুকেই ধ্রুবক ভাবা চলবে না। দরকারও নেই। আর সময়ের ব্যাপারটাকে ভালো করে বুঝে নিতে হবে। কেন না, আমরা দৈর্ঘ্যই মাপি আর সময়, আসলে সব জায়গাতেই সময় দিয়েই মাপতে হয়। আর, আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, সময়ের সমকালিকতা (simultaneity)–ই হচ্ছে সব রকম মাপনের আসল চাবিকাঠি।
কথাটা নিশ্চয়ই স্পষ্ট হল না। ভয়ের কিছু নেই। কারোর কাছেই হয়নি। আইনস্টাইন বুঝিয়ে দেবার পর অবশ্য খুব সহজ মনে হয়েছে। আমরা যখন বলি ঘড়িতে সাতটা বেজেছে, এর মানে কী? ভেবে দেখুন, এর মানে দাঁড় করাতে হলে একটা নয়, কম পক্ষে দুটো ঘটনার উল্লেখ করতে হবে। যেমন, ঘড়ির ছোট কাঁটা সাতের ঘরে পৌঁছেছে, বড় কাঁটা বারোর ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। মানে এই দুটো ঘটনা এক সাথে, বা, যুগপৎ, ঘটেছে। এইভাবে বলা ছাড়া ঘড়িতে সময় বলার অন্য কোনো উপায় আছে কিনা ভেবে দেখতে পারেন। কিংবা যদি বলা হয়, হাওড়া দিল্লি কালকা মেল দিল্লি জংশনে সাড়ে সাতটায় পৌঁছল—এই কথারই বা মানে কী? এরও মানে হল, ট্রেনটির দিল্লি জংশনের কোনো একটা প্ল্যাটফর্মে ঢোকা আর স্টেশনের ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজা—এই দুটো ঘটনা এক সঙ্গেই ঘটল। যে কোনো ঘটনার বর্ণনা দিতে গেলে আমাদের এইভাবে বলা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
বেশ। এটা বোঝা যাচ্ছে। সত্যিই সহজ সরল কথা।
কিন্তু দৈর্ঘ্য মাপার সঙ্গে সময়ের সমকালিকতার সম্পর্ক কী?
আছে, আছে। ধৈর্য ধরে ভাবুন। মনে করুন, আপনি জলের মধ্যে ছুটে বেড়ানো অবস্থায় একটা কাতলা মাছের দৈর্ঘ্য মাপতে চাইছেন। কী করবেন? একটা মাপন যন্ত্র (যেমন, জ্যামিতির বাক্সের কাঁটা-কম্পাস, শুদ্ধ বাংলায় যাকে বলে ডিভাইডার) নিয়ে তার দুই প্রান্ত মাছের লেজ এবং মুড়োর পাশে ধরে সেই ফাঁকটা স্কেলের সাথে তুলনা করে নেবেন। তাই না? কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, আপনাকে সেই দুই প্রান্ত অতি অবশ্য এক সাথে (অর্থাৎ, যুগপৎ) ঠেকাতে হবে মাছের লেজের ধারে এবং মাথার প্রান্তে। যদি আগে-পরে হয়ে যায় মাপেরও পুরো গণ্ডগোল হয়ে যাবে। কেন না, মাছটা জলের মধ্যে চলাফেরা করছে যে!
আপনি বলতে পারেন, মাছটা এক জায়গায় স্থির থাকলে তো আমাদের এইভাবে যুগপৎ ব্যবহার করতে হত না। ধীরে সুস্থে প্রথমে এই প্রান্তে একটা কাঁটা পরে আর এক প্রান্তে অন্যটা ঠেকালেই হত। তা ঠিক। কিন্তু দুনিয়ায় কে আর এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে আপনার মাপার অপেক্ষায়? সকলেই তো কোনো না কোনোভাবে চলছে। জায়গা বদলাচ্ছে। তাছাড়া আমরা তো আর পৃথিবীর বুকে হালকা চালের গতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বুকে গতি স্থিতির সমস্যা বুঝতে চাইছি। সেখানে কে কার সাপেক্ষে স্থির হয়ে বসে আছে আমার বা আপনার জন্য? তার থেকে আইনস্টাইনের এই সমকালিকতার ব্যবস্থাপনা মেনে নেওয়াই ঢের বেশি সহজ এবং স্বাভাবিক।
চিত্র নং – ২: মাছের দৈর্ঘ্য মাপছেন
এর পর আইনস্টাইন আরও গভীরে গিয়ে প্রশ্ন তুললেন, দুটো ঘটনার সমকালিকতা কি
সকল দর্শক একই রকম দেখবেন? যে কোনো নির্দেশাক্ষ থেকে যে দেখবে সেই কি
যুগপৎ ঘটতে দেখবে? এবার একটা কাল্পনিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন তিনি, যাতে সমস্যাটা সবাই বুঝতে পারে।
ধরা যাক, একটা বড় গাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার কোনো কামরার দুই প্রান্তে দুটো আলোক উৎস লাগানো আছে। কামরাটির ঠিক মাঝখানে একজন নিরীহ যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। এবার ধরা যাক, দুটো বাল্ব থেকে এক সঙ্গে আলোর ঝলক বেরল। স্বভাবতই গাড়ির যাত্রীর কাছে সেই দুদিকের আলো (দূরত্ব এবং আলোকের গতিবেগ সমান হওয়ার কারণে) এক সঙ্গেই এসে পৌঁছবে (চিত্র নং – ৩ক)। তিনি সিদ্ধান্ত করবেন, এই বাল্বদুটির ঝলক যুগপৎ ঘটেছে।
এইবার ভাবা যাক, গাড়িটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে এবং সেখানে দাঁড়িয়ে অন্য এক দর্শকও সেই দুদিকের আলোর ঝলকানি দেখলেন। নিশ্চয়ই তিনিও দেখতে পাবেন যে দুই বাল্বের আলোর ঝলকানি একই সময়ে সেই যাত্রীর গায়ে এসে পড়েছে। কেন না, তাঁরা দুজনে কার্যত একই নির্দেশাক্ষ সাপেক্ষে ঘটনাটি দেখছেন (চিত্র নং – ৩খ)।
আচ্ছা, তারপর মনে করুন, গাড়িটি সমবেগে চলতে শুরু করল। তখন কী হবে? তখনও কামরার দুই প্রান্ত থেকে আলোর ঝলকানি আসছে। দুজনে কি এবারেও একই দৃশ্য দেখবেন?
চিত্র নং – ৩ক
চিত্র নং – ৩খ
না, গাড়িটি সমবেগে চলতে শুরু করলেও গ্যালিলেওর সূত্র অনুসারে যাত্রীর
কাছে উপরোক্ত ঘটনার কোনো হেরফের হবে না। (হে পাঠক! সেই যে কথাটা কিছুক্ষণ
আগে মনে রাখতে বলেছিলাম, সেটাকে এখানে স্মরণ করুন!) তিনি আগের মতোই দুদিক
থেকে ঝলকানির যুগপত্তা দেখতে থাকবেন। কেন না, গাড়ির সাপেক্ষে তিনি এখনও একই
নির্দেশাক্ষে অবস্থান করছেন। এই জাতীয় পরীক্ষা/পর্যবেক্ষণ করার সময় গাড়িটি
থেমে আছে না সমবেগে চলমান—তাঁর কাছে তার কোনো গুরুত্ব নেই, বা বোঝার কোনো
উপায়ও নেই। কিন্তু প্ল্যাটফর্মের ব্যক্তির কাছে ঘটনাটা আর আগের মতন নয়।
কারণ, এখন যাত্রীর তুলনায় তিনি এক ভিন্ন নির্দেশাক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি
দেখবেন, চলমান অবস্থায় এগিয়ে যাওয়ার কারণে দূরত্ব কমে যাওয়ার ফলে সম্মুখের
বাল্ব থেকে আলোর ঝলকানি যাত্রীর কাছে একটু আগে পৌঁছে যাবে। আর পেছনের বাল্ব
থেকে আলো যেহেতু বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে যাত্রীর কাছে পৌঁছবে, তার আসতে
সামান্য হলেও বেশি সময় লাগবে (চিত্র নং ৩গ)। কেন না, উভয় দিকেই আলোর গতিবেগ
একই। গাড়ির গতিবেগ তার সাথে যোগ করাও যাচ্ছে না, বিয়োগ করাও যাচ্ছে না।
তিনি আর অতএব যাত্রীর গায়ে দুদিকের আলোর যুগপৎ ঝলকানি দেখতে পাবেন না।
সামনের আলোর ঝলক যাত্রীর কাছে পৌঁছানোর একটু পরে দ্বিতীয় ঝলক আসতে দেখবেন।
চিত্র নং – ৩গ
এই জায়গাটা আইনস্টাইন চমৎকার করে বুঝিয়ে দিলেন। তাঁর সেই পত্রে।
সমকালিকতা যদি নির্দেশাক্ষ নির্ভর হয়, আর মাপজোক যদি সমকালিকতা ভিত্তিক হয়,
তার মানে হল, পারস্পরিক সাপেক্ষে সমবেগে চলমান দুটো ভিন্ন নির্দেশাক্ষে
সময় এবং দৈর্ঘ্যের মাপ এক হবে না। সামান্য হলেও উনিশ বিশ হয়ে যাবে। কতটা
আলাদা হবে, সেটা নির্ভর করবে আলোর গতিবেগের তুলনায় সেই পারস্পরিক বেগ কতটা
তার উপর। যদি আলোর তুলনায় গতিবেগ সামান্য হয়, তাহলে নিউটনের সূত্রে কোনো
ভুল ধরা পড়বে না। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা সূত্রের দরকার পড়বে না। সেই
কারণেই আমরা এতকাল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত ঘটনাবলির ক্ষেত্রে
নিউটনের গতিসূত্র নিয়ে কাজ করতে কখনও কোনো অসুবিধায় পড়িনি। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে বস্তুর গতিবেগ খুব বেশি এবং আলোর গতিবেগের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে ওঠে, সেই সব জায়গায় আর নিউটনের সূত্র দিয়ে কাজ করা যাবে না। আইনস্টাইনের সাহায্য নিতেই হবে। যেমন পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনের গতিকে বুঝতে গেলে আর নিউটনীয় ফরমুলা দিয়ে কাজ হয় না। সেখানে এই আইনস্টাইনীয় ফরমুলাই কাজ করবে। কিংবা অনেক দূরের মহাজাগতিক ঘটনাবলি বোঝার ক্ষেত্রে।
আপেক্ষিকতার শিকার: সময় দৈর্ঘ্য ভর
ও হো, দুঃখিত, একটু বেশি এগিয়ে গেছি আমরা। মাপগুলো কীভাবে আলাদা হবে সেটা এখনও বলাই হয়নি। ঠিক আছে, সময় দিয়েই শুরু করি।
সেই যাত্রীকে এবার আমরা বসিয়ে দিচ্ছি গাড়ির ভেতরেই একটা ঘড়ির সামনে। ঘড়িটা একটু বিশেষ ধরনের। যে কোনো ঘড়ি হলেই কাজ হত, কিন্তু ব্যাপারটাকে নাটকীয় করে তোলার জন্য এই আয়োজনটা করতে হচ্ছে। মেঝেয় একটা আলোকের উৎস রয়েছে; তার থেকে উৎসারিত রঙিন আলোর ঝিলিক গাড়ির ছাদের নীচেতে রাখা একটা দর্পণে প্রতিফলিত হয়ে আবার নীচে ফিরে আসছে এবং সেখানে রাখা আর একটা দর্পণ থেকে একইভাবে আবার উপরে চলে যাচ্ছে। একবার উপরে গিয়ে প্রতিফলিত রশ্মি নীচে নেমে এলে পাশে রাখা মনিটরে সময় দেখাচ্ছে—ধরা যাক, ৪-২৬-০৫, ৪-২৬-১০, ৪-২৬-১৫, . . ., এইভাবে। মানে, একবার উঠে নীচে নেমে আসতে সেই ঝিলিকের সময় লাগছে (ধরে নিন) পাঁচ ন্যানোসেকেন্ড।
প্ল্যাটফর্মেও এরকমই একটা ঘড়ি রাখা আছে। দুটো ঘড়ি পরীক্ষার আগে মিলিয়ে নেওয়া হয়েছে। দেখাও যাচ্ছে, গাড়ির যাত্রী গাড়িতে যে সময় দেখতে পাচ্ছেন, বাইরের প্ল্যাটফর্মের দর্শকও তাঁর সামনের ঘড়িতে সেই একই সময় দেখছেন। ব্যাপারটা হল, দুজনে একই নির্দেশাক্ষে আছেন, বা পরস্পর আপেক্ষিকভাবে গতিহীন দুই নির্দেশাক্ষে অবস্থান করছেন বলেই দুজনের ঘড়ি একই রকম সময় দেখাছে (চিত্র নং ৪ক)।
এইবার গাড়িটি চলতে শুরু করল।
চিত্র নং – ৪ ক (বাম) ও খ (ডান)
এখন কী হবে? এখনও কি দুজনে একই সময় দেখতে থাকবেন দুই ঘড়িতে? না।
চিত্র নং ৪খ-তে লক্ষ করুন, প্ল্যাটফর্ম থেকে দর্শক দেখছেন, চলমান অবস্থায় গাড়ির আলোর ঝিলিক নীচ থেকে উপরে যাওয়ার সময় তির্যক পথে ভ্রমণ করছে বলে আগের তুলনায় উপরে উঠতে সময় বেশি নিচ্ছে, আবার নেমে আসার বেলায়ও তাই। ফলে নেমে আসার পর গাড়ির ঘড়ি সময়ের অঙ্কটা একই দেখালেও প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির তুলনায় সেই অঙ্কটা কিন্তু একটু পরে দৃশ্যমান হচ্ছে।
সরল জ্যামিতি আর কি। (এই যাঃ! একটা খুব দরকারি কথা ফস্ করে আগেই বলে ফেললাম। জমি তৈরি না করেই। ঠিক আছে, আব্বুলিশ দিয়ে রাখছি। এটা পরের অধ্যায়ে বলার কথা ছিল। আপাতত ভুলে যান।)
অর্থাৎ, প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির পাঁচ ন্যানোসেকেন্ডের তুলনায় গাড়ির ঘড়িতে পাঁচ ন্যানোসেকেন্ড একটু দেরিতে বাজবে। গাড়ির গতিবেগ যত বাড়বে, সেই ঘড়ির পিছিয়ে পড়াও ততই বেশি হবে। সেই হিসাব কষবার জন্য আইনস্টাইন একটা নতুন আপেক্ষিকতার সমীকরণও বের করে ফেললেন।
এবার দৈর্ঘ্য।
সেও খুব সহজ হিসাব। ধরুন, সেই দর্শক প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য বের করে নিলেন। তিনি গাড়িটির পেছনের দিক প্ল্যাটফর্ম পার হতে কত সময় নিল নিজের ঘড়িতে দেখে নিলেন। এর থেকে প্ল্যাটফর্ম সাপেক্ষে গাড়ির গতিবেগ বের করে ফেলা গেল। এবার গাড়িটির ভেতরের ঘড়ি অনুযায়ী কত সময় লাগল সেটাও যদি তিনি দেখে নিতে পারেন, তাহলে গাড়ির নির্দেশাক্ষ সাপেক্ষে প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য কত হবে তাও তিনি পেয়ে যাবেন। গতিবেগকে সময় দিয়ে গুণ করে। অর্থাৎ, গতিবেগ যত বাড়বে, গাড়ির সাপেক্ষে প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য সেই অনুযায়ী কম দেখাবে (পার্শ্বটীকা-৩ দ্রষ্টব্য)।
_________________________________________________________________________
পার্শ্বটীকা-৩
আপেক্ষিকতার নতুন ধারণার ভিত্তিতে দুই নির্দেশাক্ষের
মধ্যে পরিপাতন সম্পর্কগুলিকেও নতুন করে লিখতে হল। ইতিমধ্যেই ফয়েগট,
ফিটজেরাল্ড এবং লোরেঞ্জ আলাদা আলাদা ভাবে গতির সঙ্গে দৈর্ঘ্য ও সময়ের
পরিবর্তন কী রকম হতে পারে তার একটা সম্ভাব্য গাণিতিক পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে
তা ছিল নেহাতই অঙ্ক মেলানোর অঙ্ক। আর আইনস্টাইন সেই সম্পর্কগুলিকেই নতুন
পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবে দৈর্ঘ্য ও সময়ের মাপ কেন পরিবর্তিত হয় দেখিয়ে
স্বতন্ত্রভাবে লিখে ফেললেন: [এখানে এবং দ্বারা যথাক্রমে একটি (আপেক্ষিক অর্থে) স্থির ও তার সংগে সমবেগে চলমান অপর একটি নির্দেশাক্ষ সাপেক্ষে একটি বস্তুর স্থানাঙ্কগুলিকে সূচিত করা হচ্ছে। শেষের সমীকরণগুলি যথাক্রমে সময়ের অলসন, দৈর্ঘ্যের সঙ্কোচন ও ভরের বৃদ্ধি সূচিত করছে।]
হ্যাঁ, এই অবধি পড়ে কারোর কারোর মনে হতে পারে, আমরা না হয় কায়দা করে একটা ডিজিটাল ঘড়ির বন্দোবস্ত করে ব্যাপারটা দিব্যি সহজভাবে বুঝিয়ে দিলাম। আইনস্টাইনের হাতে তো সেকালে এরকম ঘড়ি নিশ্চয়ই ছিল না। তাঁকে তো সেই পুরনো আমলের গোল ডায়াল আর তাতে ঘন্টা-মিনিটের কাঁটা লাগানো যান্ত্রিক ঘড়ি দিয়েই এই সব ঘটনার ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল।
তিনি সেটা কীভাবে করেছিলেন?
বেশ, সেই চেষ্টাও করে দেখা যাক। উপরের ছবিতে দেখুন স্টেশন ও গাড়িতে রাখা দুটো যান্ত্রিক ঘড়ি। আপাতত আমরা শুধু ছোট (এখানে ন্যানোসেকেন্ডের) কাঁটাটির চলার পথের উপরই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখব। যখন গাড়ি থেমে আছে, অর্থাৎ, যাত্রী এবং দর্শক পরস্পর সাপেক্ষে স্থির দুই নির্দেশাক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন, দুজনের (আগে থেকে মেলানো) ঘড়ির কাঁটার চলার মধ্যে কোনো রকম অসামঞ্জস্য দেখা যাবে না (চিত্র নং ৫ক)। কিন্তু যেই গাড়িটা চলতে শুরু করল, এইবার ভালো করে খেয়াল করে দেখুন, স্টেশনের ঘড়িতে যখন ছোট কাঁটার মুণ্ড বৃত্তচাপ ধরে চলে ছবিতে দেখানো জায়গায় এসে যাবে, প্ল্যাটফর্ম থেকে দর্শক দেখবেন, গাড়ির অনুরূপ কাঁটার মুণ্ড তখনও অনুরূপ অবস্থানে এসে পৌঁছায়নি। সেটির সেই অবস্থানে এসে পড়তে একটু বেশি সময় লাগছে। কেন না, সে আর তখন বৃত্তচাপ ধরে এগোচ্ছে না, ট্রেনের গতির দরুন তাকে যেতে হচ্ছে একটা যেন লম্বাটে উপবৃত্তাকার চাপ বরাবর, যার দৈর্ঘ্য পূর্বোক্ত বৃত্তচাপের তুলনায় সামান্য হলেও বেশি (চিত্র নং ৫খ)। অতএব বুঝতেই পারছেন, ঘড়ির ডিজাইন কেমন তার উপর আপেক্ষিকতার বিষয়টা নির্ভর করছে না।
তাহলে এটা বোঝা গেল, দৈর্ঘ্য আর সময়ের মাপ যে কোনো অবস্থায়, যে কোনো নির্দেশাক্ষে এক হবে না। যাকে মাপা হচ্ছে আর যেখান থেকে মাপা হচ্ছে, এই দুইয়ের মধ্যে পারস্পরিক সমবেগ থাকলে গতির অভিমুখ বরাবর দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে যাবে আর সময় মন্থর হয়ে পড়বে।
আইনস্টাইন যদিও দর্শক দিয়ে বিষয়টা বুঝিয়েছিলেন, আমরাও এখানে তাই করেছি, তথাপি এটা মনে রাখতে হবে: এই দৈর্ঘ্য আর সময়ের মাপের আপেক্ষিকতার ব্যাপারটা কিন্তু দর্শক নির্ভর ব্যাপার নয়; কেউ দেখছে বলে ঘটছে, এমন নয়। কেউ না দেখলে, এমনকি দেখার কেউ না থাকলেও, এইভাবেই ঘটবে সব কিছু। কেউ না দেখলে কি ঘড়ির কাঁটা অন্যভাবে চলবে? আবার পরমাণু বিজ্ঞান কিছু দূর এগোনোর পর দেখা গেল, মহাবিশ্বের সুদূর প্রান্ত থেকে এমন সব কণা পৃথিবীর বুকে প্রবল বেগে এসে আছড়ে পড়ছে, যাদের অর্ধায়ুষ্কাল (half-life period) এত কম যে পার্থিব সময়ের মাপে অত দূর থেকে এখানে পৌঁছানোর অনেক আগেই তাদের মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। হচ্ছে না কেন? কারণ, প্রায় আলোকের গতিবেগে চলার জন্য ওদের নিজস্ব সময়ের ঘড়ি প্রায় স্থির হয়ে থাকে; ভীষণ আস্তে আস্তে চলে। পৃথিবী থেকে কেউ যে তা দেখতে পায় তা কিন্তু নয়। তবুও। ফলে পৃথিবীর বুকে এসে পৌঁছনো পর্যন্ত সেই ঘড়ি অনুযায়ী ওদের অর্ধায়ুষ্কাল শেষ হয় না। ওরা দিব্যি জ্যান্ত অবস্থাতেই কাছাকাছি এসে পড়ে। তারপর অবশ্য বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে এবং অন্যান্য পারমাণবিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ঠেলায় ওদের গতিবেগ একেবারে কমে যায়, ঘড়ি পৃথিবীর ঘড়ির সঙ্গে মিলে যেতে থাকে, ওদের অর্ধায়ুষ্কালও শেষ হয়ে ওরা মুখ থুবড়ে পড়ে। তাই বলছিলাম, ভাগ্যিস আপেক্ষিকতাবাদ ছিল, তাই তো ওদের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হল।
আর একটা ছোট খবর দিলেই আপেক্ষিকতা সংক্রান্ত এই পর্ব আমাদের মোটামুটি চুকে যাবে। আপেক্ষিকতার এই পত্রটি প্রকাশিত হওয়ার তিন চার মাস পরে আইনস্টাইন আবার একখনা পত্র লিখে পাঠালেন। তাতে তিনি দেখালেন বস্তুর ভরের আপেক্ষিকতা। এতদিন জানা ছিল ভর হচ্ছে যে কোনো বস্তুতে পদার্থের মোট পরিমাণ, যা তার একটা নিজস্ব পরম বৈশিষ্ট্য। নির্দিষ্ট বস্তুর ভরও নির্দিষ্ট। সুকুমার রায়ের অনবদ্য ভাষা চুরি করে বলা যেত: “ভরের আমি ভরের তুমি, ভর দিয়ে যায় চেনা!” আইনস্টাইন বললেন, এযাবত যা বলে এসেছ ভুলে যাও; এখন অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে শিখতে হবে। গতি যে বস্তুকে কত ভাবে বদলে দেয় তোমরা ধারণাই করতে পারনি। এবার দেখ। সাধারণ গতিবেগে চলার সময় একটা বস্তু যে শক্তি অর্জন করে তাকে বলে গতিশক্তি। কিন্তু গতিবেগ বাড়তে বাড়তে যখন তা আলোকের গতিবেগের সঙ্গে তুলনীয় মাত্রায় পৌঁছে যায়, তখন গতিশক্তির কিছু অংশ বাড়তি ভর হিসাবে যুক্ত হয়ে যায়। এই বিষয়টিকেই তিনি তাঁর বিখ্যাত সেই $latex E = mc^2& সূত্রে লিপিবদ্ধ করেন। ফলে ভর আর শক্তি মিলিয়েই বস্তুতে পদার্থের পরিমাণ ভাবতে হবে। সংরক্ষণ সূত্রকেও নতুন ভাবে বলতে হবে। আলাদা আলাদা ভর ও শক্তির দুটো সংরক্ষণ সূত্র নয়; এক সংরক্ষণ সূত্রেই ভর এবং শক্তি—উভয়কে বাঁধতে হবে।
অঙ্কে মিলে গেলেও অনেকেরই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। কোথায় ভর আর কোথায় শক্তি? কিন্তু চল্লিশের দশকে যখন কণা ত্বারক যন্ত্র উদ্ভাবিত হল, তাতে পরীক্ষা করে একেবারে নিঃসন্দেহ হওয়া গেল। দেখা গেল, দশ মিলিয়ন-ভোল্ট বিভব প্রভেদ প্রয়োগ করলে ইলেকট্রনের গতিবেগ আলোকের বেগের ৯৯.৮৮ শতাংশ অর্জন করে। এবার বিভব প্রভেদ যদি বাড়িয়ে ৪০ মিলিয়ন ভোল্ট করে দেওয়া হয়, গতিবেগ কিন্তু গতিশক্তির সাবেকি ফরমুলা () অনুযায়ী দ্বিগুণ হয় না। সামান্য বেড়ে হয় আলোকের গতিবেগের ৯৯.৯৯ শতাংশ। বাকি শক্তি তখন কোথায় চলে যায়? সে তখন সেই ইলেকট্রনের ভর বাড়িয়ে দেয় আরও খানিকটা। আইনস্টাইনের ফরমুলা অনুসারে। না করে যাবেই বা কোথায়? ইলেকট্রন বলে আলোকের গতিবেগকে তো আর সে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। অতএব প্রদত্ত বাড়তি শক্তি তখন গতিশক্তি আর ভরের মধ্যেই ভাগাভাগি হয়ে যায়।
এই কারণেই আধুনিক কালে কণা পদার্থবিজ্ঞানে কোনো কণার ভরই আর সাবেকি এককে বলা হয় না। শক্তির মাপকাঠিতেই তাকে প্রকাশ করা হয়। তাতে আর আলাদা করে একবার ভর আর একবার শক্তি মাপতে আর বলতে হয় না। বিজ্ঞানীদের কাজ কমে গেছে, সুবিধাও হয়েছে। খালি আমাদের মতো সাধারণ বিজ্ঞান পাঠকদের বুঝতে একটু যা বেশি সময় লাগে—এই যা!
তাহলে কী দাঁড়াল?
তাহলে এই পর্যন্ত পড়ে আমরা বোধ হয় এটুকু বুঝেছি বলে দাবি করতে পারি, দৈর্ঘ্য সময় আর ভর আর আগের মতো বস্তুর কোনো শাশ্বত গুণ বা বৈশিষ্ট্য নয়। বস্তুর গতির অবস্থার সাথে তার এই সব বৈশিষ্ট্যও সংযুক্ত। সেই অনুযায়ী পরিবর্তনশীল ও আপেক্ষিক। তার মানে আমি বা আপনি যা খুশি দেখব বা পাব—এমন নয় বিষয়টা। এক একটা নির্দিষ্ট নির্দেশাক্ষ বরাবর কে কী দেখব তা কিন্তু নির্দিষ্টভাবেই ঠিক হয়ে থাকে। যেই দেখুক, বা কেউ আদৌ যদি না দেখে, পরিমাপগুলো একই রকম হবে।
এই হল সংক্ষেপে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব।◙
গ্রন্থপঞ্জি
Einstein, Albert and Infeld, Leopold (1938), The Evolution of Physics; Cambridge University Press, Cambridge.
Feynman, Richard (1992), The Character of Physical Law; Penguin Books, London.
Kuznetsov, B. (1965), Einstein; Progress Publishers, Moscow.
Ashoke Mukhopadhyay (2009), The Science and Philosophy of Einstein’s Theory of Relativity; Bodhoday Mancha, Kolkata.