একাত্তরে তুরস্কের সাথে যুদ্ধ হলে শহীদের সংখ্যা হতো ৯৭ লক্ষ…
প্রত্যেক ঘটনার দুটো দিক থাকে। নিজামীর ফাঁসির পর তুরস্কের মন্তব্য সামনে নিয়ে আসছে তুরস্কের গনহত্যার কথা। যেই গনহত্যা ছাড়িয়ে যায় ১৯৭১ সালে পাক আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চালানো গনহত্যাকেও।
১৯১৫ সালে তুরস্ক আর্মেনিয়ানদের ওপর যে গনহত্যা পরিচালনা করা হয়েছিলো তার ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে গত বছর। আর্মেনিয়ানরা এখনো স্বীকৃতি পায়নি ঘাতক তুর্কিদের কাছ থেকে, আমরাও স্বীকৃতি পাইনি পাকিস্তানের কাছে। এখনো আর্মেনিয়ানরা লড়ছে তাদের কাঙ্ক্ষিত গনহত্যার স্বীকৃতির জন্য। তুরস্কই সম্ভবত পৃথিবীর গণহত্যার ইতিহাসে এক মাত্র জাতি যারা লাগাতার ১০০ বছর একটা জাতির আর্মেনিয়ার ওপর চালানো নির্মম গণহত্যাকে অস্বীকার করে আসছে। আর্মেনিয়ানর মানুষও লাগাতার বিগত ১০০ বছর ধরে ১৯১৫ সালে তাদের ওপর চালানো গনহত্যার স্বীকৃতি চেয়ে আসছে তুরস্কের কাছে।
সে হিসেবে পাকিস্তান তো নবীন।
পাকিস্তান তো মাত্র ৪৫ বছর ধরে অস্বীকার করছে নিজেদের অপরাধ…
তুরস্ক আর পাকিস্তান একই কোম্পানির একই প্রোডাক্ট, খালি মোড়কটা আলাদা- এই যা। নিপীড়ক তুরস্কের কাছ থেকে কিছু শেখার না থাকলেও আমাদের নিপীড়িত বন্ধু আর্মেনিয়ার কাছে শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছু। অন্তত দুইটা জিনিস আর্জেন্ট শেখা দরকার আমাদেরঃ
১) আর্মেনিয়া আমাদের মত স্বজাতির গনহত্যা লুকায় না।
২) আর্মেনিয়ায় জেনোসাইড ডিনায়াল’ল আছে।
পৃথিবীর যে কোন মানুষ যদি গনহত্যা নিয়ে একাডেমিক পড়ালেখা করতে চায়, যদি তারা গনহত্যা পরিচালনাকারী প্রথম পাঁচটা দেশের নাম খোঁজ করে পড়ালেখা করে তাহলে তাদের পাকিস্তানের আগে তুরস্কের নাম পড়তে হয়। দুটো দেশই গনহত্যার ভয়াবহতায় লিস্টের প্রথম দিকে স্থান করে নিয়েছে।
আর্মেনিয়া জর্জিয়া ও আজারবাইজানের সাথে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের স্থলযোজকের উপর অবস্থিত। ইয়েরেভান আর্মেনিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। জাতিগত আর্মেনীয়রা নিজেদের “হায়” বলে থাকে। আর্মেনিয়ার ৯০% লোক এই “হায়ঃ জাতির লোক। দেশটি ১৯২২ সালে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রটি স্বাধীনতা লাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কিরা আর্মেনিয়াদের ওপর নির্বিচারে গনহত্যা চালায়।
একটি রাষ্ট্রে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ধরে নিলে তাদের ওপর গনহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হয়। ১৯১৫ সালের আর্মেনিয় গনহত্যা তারই উজ্জ্বল প্রমান। ষাটের দশকে আমারাও ছিলাম পাকিস্থানী শাসকগোষ্ঠীর চোখে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। সামরিক রাষ্ট্র অটোমানদের সঙ্গে পাকিস্থানের অনেক অনেক মিল। তিন বছরে ধরে চলমান এই গনহত্যায় সেই দেশে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়। সে সময় সেই গণহত্যায় আর্মেনিয়ার প্রায় ৪৩% থেকে ৫৮% জনগোষ্ঠী নিঃশেষে হয়ে যায় মাত্র তিন বছরে।
একটু লক্ষ্য করলে আমরা দেখি একটা দিক দিয়ে কিন্তু আর্মেনিয়ানরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। সেটা হচ্ছে তারা অন্তত তাদের নিজের দেশের ওপর চলা গনহত্যাকে অস্বীকার করে না, আমরা করি। তারা পনেরো লাখ শহীদ কে দেড় লাখ বলে না যেমন আমরা অনেকে ১৯৭১ সালের শহীদের সংখ্যা তিরিশ লাখ থেকে তিন লাখে নামিয়ে আনতে কুণ্ঠা বোধ করি না।
মূলত আর্মেনিয়ার গনহত্যার নিয়ে তিনটা বয়ান শোনা যায়- ৮ লাখ, ১৫ লাখ, ২০ লাখ।
তবে সবাই মিলে সংখ্যাটা ১৫ লক্ষ বলে মেনে নিয়েছে।
এটা সেখানে একটা আইকনিক ফিগার।
এই ১৫ লাখ শহীদদের নিয়ে অসংখ্য সাহিত্য রচনা করা হয়েছে।
কেউ এটা নিয়ে বিতর্ক করে না।
গণহত্যা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের জন্য আর্মেনিয়ার গনহত্যা থেকে একটা শিক্ষাও নেয়ার আছে।
এই গনহত্যায় তাদের জনসংখ্যার ৪৩%-৫৮%কে হত্যা করেছিলো।
১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখে শুরু হয়ে চলতে থাকে ১১ নভেম্বর ১৯১৮
অর্থাৎ প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই গনহত্যা চলতে থাকে।
অর্থাৎ এই গণহত্যা চলেছে ৪০ মাস ১৮ দিন ধরে।
আসুন হিসেব করে দেখা যাক যদি ৪০ মাসে যদি আর্মেনিয়ার মোট জনগোষ্ঠীর ৪৩%-৫৮% কে মেরে ফেলতে পারে তুর্কিরা,
তাহলে একই অনুপাতে তারা ৯ মাসে কত বাঙালীকে হত্যা করতে পারতো?
হিসাব করে দেখা যায় সংখ্যাটা ১৩% এর উপরে।
পাকিস্তানীরা নয় মাসে হত্যা করেছিলো আমাদের জনগোষ্ঠীর ৪%।
অর্থাৎ আর্মেনিয়ার গনহত্যা আমাদের তুলনায় ৩ গুণের বেশি ভয়াবহ ছিলো।
অথচ এই ৪%- অর্থাৎ তিরিশ লক্ষ শহীদকে মেনে নিতেই আমাদের এত সমস্যা এত প্রশ্ন!!!
এই হিসাবে চিন্তা করলে ১৯৭১ সালে যদি তুরস্ক বাংলাদেশে আক্রমণ করতো তাহলে শহীদের সংখ্যা হত ৯৭ লক্ষ ৫০ হাজার কিংবা তার চেয়েও বেশি। দেখা যাচ্ছে তুরস্কের নিজামীর ফাঁসি নিয়ে বাড়াবাড়ি আমাদের একটা উপকার করেছে- মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতাকে নিয়ে যারা সন্দেহ করে তাদের ধরে ধরে দেখানো যাচ্ছে বিশ্বময় গনহত্যার খতিয়ান।