Sunday, July 31, 2016

প্রেম ও কাম দেশ চেনে না, সমাজ চেনে না, ধর্ম চেনে না


লিখেছেন: হাসিবুল হাসান শারদ
দুটি মেয়ে যারা লেসবিয়ান, ঘর থেকে পালিয়ে যায় এবং সংসারজীবন আরম্ভ করে। প্রথমেই তাদের দুঃসাহসের কথা ভেবে বিস্মিত হতে হচ্ছে। এটা বাংলাদেশ। তা আবার ঐ মেয়ে দুটির একটি হিন্দু, অপরটি মুসলমান।
কিন্তু প্রেম ও কাম দেশ চেনে না, সমাজ চেনে না, ধর্ম চেনে না। মেয়ে দুটি কাউকে খুন করেনি, কোনো দুর্নীতি করেনি, অর্থপাচার করেনি, আয়কর ফাঁকি দেয়নি, ধর্মরাজনীতি করেনি, মাদকব্যবসা করেনি বা ধর্ষণ করেনি; তারা কেবল নিজেদের যৌনস্বাধীনতা চেয়েছিল। তাদের অত সাহসী কাণ্ড দেখে বোঝা গেছে কারোরই যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞান হয়নি। বয়সেও প্রায় অপরিণত উভয়েই। তারা বুঝতেই পারেনি ধরা পড়লে কী দুর্বিষহ হয়ে উঠবে তাদের জীবন। ধরা পড়ারই কথা ছিল, পড়েছেও। পুলিশ, সাংবাদিক ও পরিবারের সদস্যসহ যারাই এ খবর শুনেছে, ছি ছি করেছে। এখন মেয়েদুটোর জীবনে নেমে আসবে আক্ষরিক অর্থেই নরক। বাবা-মা রাগলে যেমন বলে যে, তোকে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেব, সেইভাবে পরিবার দুটি এখন সত্যিই রাগে, লজ্জায়, ক্ষোভে ও সর্বনাশে মেয়ে দুটিকে কেটে কেটে টুকরো করে ফেললেও আশ্চর্য হব না। এ সমাজে সবকাম সবচেয়ে গর্হিত, তা আবার যদি হয় মেয়েদের সমকাম। এটা শুনেই হয়তো কূপমণ্ডুকেরা কেউ কেউ হার্টফেল করে বসবে, অথচ কাম থাকলে সমকাম থাকবেই, কাম আর সমকাম সমান বাস্তব। সমকামকে ঘৃণা করা যায়, সমকামীকে শাস্তি দেয়া যায়, কিন্তু কেউ সমকামী হতে পারবে না, সকলকেই হতে হবে বিষমকামী, তা বলা যায় না। জন্মগতভাবেই কেউ কেউ সমকামী হয়ে জন্ম নেয়। এটাকে তাই ঘৃণা করার কিছু নেই। এবং বিশ্বে অসংখ্য নারীপুরুষ ছিল ও আছে সমকামী।
উন্নতবিশ্ব এখন তাদের বিয়ে করার আইনগত অধিকার দিচ্ছে এবং ওসব দেশের ক্ষমতাশালী সমকামীরা তা নির্দ্বিধায় এবং খোলামেলা স্বীকারও করছে। তাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তাদের। কিন্তু এটা বাংলাদেশ। এখানে অগণিত অপরাধ সাধনযোগ্য, অপরাধের প্রবণতা সমাধান-অযোগ্য। তাই অপরাধীদের তীর্থভূমি স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু নিরপরাধ সমকাম, যা একান্তই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ব্যাপার, তা এখানে বোধ করি সবচেয়ে গর্হিত ব্যাপার। বৈজ্ঞানিক ও মানবিক দৃষ্টিতে সমকাম অপরাধ নয়, অথচ সমকামীমাত্রেই এখানে একটি গণহত্যাকারীর চেয়েও জঘন্য অপরাধী।

এদেশে বহু মাদ্রাসা শিক্ষকসহ অনেকেই আছেন যারা সমকামী। তারা ধরা খান শিশুধর্ষণ করে। আর তারাই ধরা খাবার আগে মুখে বলেন যে সমকাম ঘোরতর অপরাধ। এটা ভণ্ডামি। সমকামীর অধিকার তাদের দেয়া হলে তারা যেখানে-সেখানে যখন-তখন যাকে-তাকে যৌনহয়রানি হয়তোবা করত না, অথচ সেই স্বাধীনতার পথও তারা নিজেরাই আটকে রেখেছে। ফলে একদম নিরীহ সমকামী ছেলে বা মেয়েটিও বঞ্চিত হচ্ছে তার প্রকৃতিগত অধিকার থেকে।

সমকাম সমাজের বড় কোনো অসঙ্গতি বা অবক্ষয় না, কিন্তু এটাতে বাধা দেয়ার জন্য প্রাণপণ লাগাটা একটা বড় রোগের মতোই। একটা প্রকৃতিগত ব্যাপারে কাউকে বাধা দিতে গেলে তার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি ও কারণ থাকা চাই। কী কারণ আছে নির্বিবাদ একজন সমকামীকে তার সঙ্গীর সাথে থাকতে বাধা দেয়ায়? ওরা সমকামী বলে ওদের ঘটনাস্থলেই পিটিয়ে মারা যতটা মর্মান্তিক ও পৈশাচিক তার সহস্রভাগও কি ন্যাক্কারজনক ওদের প্রকৃতিগত সমকাম? তবে কেন মানুষজন একজন সমকামীর ওপর এত ক্রুদ্ধ?
অবশ্য কথা আছে : সমকামী যদি কাউকে বলপূর্বক ধর্ষণ করতে চায় সেটা আলাদা কথা। কিন্তু তাদের নিজস্ব জগতে তারা কী করল, না করল সেটা আমাদের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ হবে? ধর্মে সমকামকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে? ধর্মে তো কত কিছুই নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কত কিছু করারই আদেশ আছে, সেগুলো কি সবাই যথাযথভাবে পালন করছে প্রতিদিন? একজন ঘুষখোর পুলিশ অফিসার বা মন্ত্রীর ঘুষ খাওয়া ঠেকানোর জন্য কেউ কি আছে এই ষোলো কোটি লোকের দেশে? অথচ নির্দোষ একজন নিরীহ মানুষ, যে কেবলমাত্র জন্মগতভাবে লেসবিয়ান বা গে, তাকে ঘৃণা করার- এমনকি পিটিয়ে মারবার মতো সমাজসচেতন বীরে ভরতি এদেশ। ছিঃ!

যাহোক, আমার শুভকামনা রইল পিরোজপুরের মেয়ে দুটোর জন্য। আর অন্যান্য সমকামীদের বলব, এদেশে থেকে ওদের মতো কাঁচা কাজ করবেন না কেউ, খুব পস্তাবেন, নিষ্ঠুরেরা হত্যাও করতে পারে আপনাদের। শত হলেও এদেশের সমাজকে উপেক্ষা করতে পারি না আমরা কেউ। এদেশ কখনো একটু উদার হবে একদিন, সেদিন যৌন স্বাধীনতা পাবেন, এই প্রত্যাশা রাখুন। তার আগে এখানে রইতে হলে অকারণ অজাচার সইতে হবে আপনাদেরকে, কিছু করার নেই। এদেশে শুধু আপনারা না, মানবিক অনেক প্রশ্নেই তারা নিজেরাও আটকে পড়ে আছে, বের হতে চাচ্ছে না। যত দিন পারে, থাকুক এভাবে। মনে রাখবেন, তারা সব কিছুর গতিই কেবল কমিয়ে দিতে পারে, কিন্তু একেবারে বন্ধ করে দিতে পারে না।