শুরুতেই একটা জিনিস বলে রাখি এই পোস্টে অনেক জায়গাতেই পুরুষতন্ত্র
প্রসঙ্গটি আসবে। আর ধর্ম ত তার দন্ড নিয়ে দাঁড়ানো আছেই। আমি কিন্তু এই
দুটোকেই এক বস্তু হিসেবে বিবেচনা করব। কারণ সৃষ্টির শুরু থেকেই এরা একে
অন্যের পরিপূরক,পৃষ্ঠপোষক ও অনুমোদনকারী। অনেক জায়গায় কোনো পার্থক্যই নেই।
তাই আমি ধর্ম বা পুরুষতন্ত্র যেই শব্দটিরই উল্লেখ করি না কেন তা আসলে দুটো
জিনিসকেই বোঝাবে।
নারীর সাথে ধর্মের মিথ:স্ক্রিয়া নিয়ে আমার কৌতুহল সেই ছোটবেলা থেকেই।
যখন কোন বিয়েতে নিমন্ত্রণ পেয়ে অতিথি হিসেবে গিয়েছি বা বরযাত্রী হিসেবে
তখনই বিয়ে শেষ হবার পর,মেয়েকে তার বাপের বাড়ী থেকে বিদায় দেবার সময় যে
উচ্চস্বরে কান্নার রোল পরে যেত তা আমার মনে যথেষ্ট প্রশ্ন তৈরি করত। কেন?
মেয়েকে কেন তার বাপের বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে? সারাজীবনের জন্য তার বাড়িতে সে
কেন অতিথি হয়ে যাবে? পক্ষান্তরে ছেলেটিকে ত কিছুই ত্যাগ করতে হচ্ছে না।
চারপাশে এত জ্ঞানীগুণী,আধুনিক শিক্ষিত মানুষ থাকা সত্ত্বেও তারা সবাই বিনা
প্রশ্নে এই বর্বর প্রথাগুলো কেন মেনে চলছে? উল্লেখ্য আমি এখানে মূলত হিন্দু
বিয়ের অভিজ্ঞতার কথাই বলছি। পারিবারিকসূত্রেই সেই অভিজ্ঞতাই আমার বেশি।
অবশ্য বিয়ের ধর্মীয় রীতিনীতি ছাড়া মুসলিম বা অন্যান্য ধর্মের বিয়ের দৃশ্য
প্রায় একই। আর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার কথা যদি বলতে হয় তাহলে ত হিন্দু ধর্মীয়
বৈবাহিক প্রথা বা আচার আচরণ মধ্যযুগীয়,বর্বর,পুরুষতান্ত্রিকতার চুড়ান্ত।
ধর্ম যার একশভাগেরও বেশি অনুমোদন দেয়।
এছাড়া বিয়ের পর স্বামীর পদবী গ্রহণ করা ও সন্তানের নামের শেষে স্বামীর পদবী
যোগ করা জিনিসগুলো সেই ছেলেবেলা থেকেই আমার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগত। আজকাল
অবশ্য অনেকেই আর নামের শেষে স্বামীর পদবী গ্রহণ করেন না। তবে সংখ্যাটা
শতাংশের হিসেবে খুব বেশি হবে না। আর সার্টিফিকেট সংক্রান্ত জটিলতাও একটি বড়
কারণ। তবে বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত,বিখ্যাত নারীদের মধ্যে আবার এর ব্যাপক
প্রাদুর্ভাব। বর্তমানে পৃথিবীর শক্তিশালী নারী বলে যারা পরিচিত যেমন হিলারী
ক্লিনটন,এঞ্জেলা মের্কেল,তেরেসা মে,সোনিয়া গান্ধী তারা সবাই তাদের স্বামীর
পদবী গৌরবের সাথে ব্যবহার করছেন। অথচ এরা প্রায় সবাই কিন্তু নিজের
যোগ্যতায় এতদূর এসেছেন। এতে কি সফল,ব্যক্তিত্বসম্পন্ন,আত্ননির্ভর নারীদের
মনোজগতেও ঘাপটি মেরে বসে থাকা পুরুষতন্ত্রের ভূতের এক ঝলক দেখতে পাওয়া যায়
না? এমনকি খুঁজলে অনেক প্রগতিশীল, মুক্তমনা,নাস্তিক নারীদেরকেও এর মধ্যে
পাওয়া যাবে। সুকৌশলে এর সমর্থনকারী একই গোত্রের পুরুষদের কথা বাদই দিলাম।
এসব ব্যাপার নিয়ে যতবারই আমার পরিচিত মানুষদের সাথে কথা বলতে গিয়েছি
সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার হয়েছি নারীদের কাছ থেকেই। অবশ্য তাদের মূল
সুরটা ছিল ধর্মকে এর বাইরে রাখা। যেন ধর্মের এর পেছনে কোন দায় নাই। কিন্তু
ধর্ম আর পুরুষতন্ত্রের অস্তিত্ব যে অঙ্গাঙ্গীভাবে গাঁথা সেটা নিয়ে চিন্তা
করার ইচ্ছা মনে হয় তাদের ছিল না। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই নারীদের অধিকাংশই
উচ্চশিক্ষিত,আর্থিকভাবে মোটামুটি আত্ননির্ভর ও স্বাবলম্বী। এই
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও ধর্মই যে তাদের চোখে ঠুলি পড়িয়ে রেখেছে এই জিনিসটা
বোঝার ক্ষমতাই তাদের নেই। উপরন্তু তাদের ধর্মই যে নারীদের সবচেয়ে বেশি
মর্যাদা দিয়েছে এই কথা বলতে বলতে তারা মুখে ফেনা তুলে ফেলেন।
উল্লেখযোগ্যভাবে এই দলে উচ্চশিক্ষিত নারীদের সংখ্যাই বেশি। কেউই বোধহয় এ
বিষয়ে দ্বিমত করবেন না। আজকাল ফেসবুকের ছাগসমাজে এই নারীদের ক্রমবর্ধমান
সংখ্যা চোখে পড়ার মত। তাদের সম্মিলিত ব্যা ব্যা রবে তারা পুরুষদেরকেউ
ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। তা সে জাকির নায়েক রক্ষা মিশন,এরদোগান সমর্থক পরিষদ,হিজাব
বোরকা রক্ষা ও প্রচলন সমিতি,সহীহ মুসলমান খোঁজা কমিটি বা অন্য যেকোনো বিষয়ই
হোক না কেন।
দুদিন আগে পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া মডেল কান্দিল হত্যার পরেও তারা যথারীতি
ধর্মরক্ষা মিশন নিয়ে মাঠে নেমে পরেছে। মানে এর সাথে ধর্মের কোনোই সম্পর্ক
নেই। কান্দিলের ভাই ছাড়া আর কারোরই কোন দায় নেই। সম্ভবত সেও রহস্যময়
কেপ্টাগন ওষুধ খেয়েই এই কাজটি করেছে ভাবখানা এমন। কিন্তু এই বর্বর অনার
কিলিং প্রথা প্রায় একশভাগ ক্ষেত্রেই মুসলমান সমাজেই কেন ঘটে এই কথাটি কি
তারা কখনো ভেবে দেখেছেন? এমনকি পাশ্চাত্যেও এধরণের ঘটনা মুসলমান কমিউনিটিতে
মোটেও বিরল নয়। আর কান্দিল যেধরণের ফ্যাশন বা ড্রেসের মাধ্যমে খ্যাতি
অর্জন করেছিল তা কতটুকু ইসলামসম্মত ছিল? তার সাহসী, আত্নপ্রত্যয়ী ও
নারীবাদী চিন্তাভাবনা কতটুকু ইসলাম অনুমোদিত ছিল? এসব বিষয়ে তারা কি বলেন
তা জানতে পারলে অবশ্য খুব ভাল লাগত। এধরণের আধুনিক,পাশ্চাত্যধাঁচের পোশাক ও
নারীবাদী আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মে যে পরিমাণ ঘৃণা বর্ষিত
হয়েছে সেটাই যদি কান্দিলের ভাইকে হত্যাকান্ডে উস্কিয়ে দিয়েছে বলে ধারণা
করা হয় তবে কি খুব ভুল বলা হবে?
তাই বলতে হয় হাজার বছর ধরে যারা ধর্মের দ্বারা সবচেয়ে বেশি নিষ্পেষিত,
নির্যাতিত, লাঞ্ছিত সেই নারীসমাজের মধ্য থেকেই যখন ধর্মের সবচেয়ে দৃঢ়চিত্ত
সমর্থকগোষ্ঠির উৎপত্তি হয়;তখন মনে হয় পথ শেষ হতে এখনো অনেক দেরী। অন্ধকার
কেটে আলোর রেখা সহসাই দেখা দিচ্ছে না।