Sunday, July 31, 2016

সবাক---অত্যন্ত বেয়াদব এক ভূতের গল্প!

অত্যন্ত বেয়াদব এক ভূতের গল্প

লিখেছেন
১.
বেচারা রফিক মিয়া চৈত্রের অস্থির গরম থেকে বাঁচতে সন্ধ্যার পর বাড়ির দরজায় নারিকেল গাছের সাথে গা ঠেকিয়ে একটু বাতাস খেতে আসছেন। বাতাস খেতে ভালোও লাগছিলো। কিন্তু আচমকা কোন বদমাশ এসে দিলো পাছার উপর কষে এক থাপ্পড়! আজব ব্যাপার, কার হঠাৎ শখ জাগলো ৫৫ বছর বয়সী পাছায় থাপ্পড় মারার? কী বিচ্ছিরি বিষয়। এটা কোন কথায়ই না। থাপ্পড় মারার পর আবার বলে – কিরে সোহাগ, বাতাস খাইতে খুব ভালো লাগে? বাতাসের সাথে একটা থাপ্পড় হলে খারাপ হয় না, তাই না।
এটা শুনে রফিক মিয়া বললেন, “আমি সোহাগ না, রফিক।“ খাইছে! ব্যাপারটাতো পুরা কাবজাব হয়ে গেলো। যে থাপ্পড় মারছে, সে দিলো দৌড়। দৌড় দিবেই না কেন, বাপের পাছায় থাপ্পড় মারাতো যেনতেন ব্যাপার নয়। ছেলে বাপের পাছায় থাপ্পড় মেরে পরে বুঝতে পেরে দৌড় দিলো, আর বাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে – এ কী হলো! অন্ধকারে মুখ চেনা না গেলেও কণ্ঠ শুনে বুঝলেন এটা তারই ছেলে নাসির।
রফিক মিয়া খেয়াল করে দেখলেন থাপ্পড় মোটেও হালকা ছিলো না। ৫৫ বছর বয়সী পাছাটা খুব ব্যাথা করছে। অবশ্য ব্যাথার মাঝেও কিছুটা আনন্দ হচ্ছে। ছেলেটা খুব শক্তিমান হয়েছে। এটা রফিক মিয়ার একমাত্র ছেলে। নাম নাসির। নাসিরের জন্মের পর সবাই বলেছিলো এত ছোট সাইজের বাচ্চা বাঁচবে না। বাঁচলেও অনেক রোগা হবে, খাটো হবে। এখন নাসিরের বয়স ২০ বছর। যেমন লম্বা, তেমন স্বাস্থ্যবান। নিন্দুকের মুখে চুনকালি মেখে ছেলে এখন বাপের পাছায় থাপড়াইতে জানে। তাও যেনতেন থাপ্পড় না। থাবড়ে বাপের পাছা লাল করে দিয়েছে।
বাপ কী ভাবছে ছেলের জানার সুযোগ নেই। ছেলে আছে ভয়ে, আতংকে আর লজ্জায়। কত বড় কুলাঙ্গার সন্তান হলে বাপের পাছায় থাপ্পড় মারতে পারে! ছি ছি!! তাও ব্যাপারটা এমন না যে, বন্ধু বান্ধবের পাছায় থাপ্পড় মারার অভ্যাস আছে তার। দুষ্টুমির ছলে কিল ঘুষি লাত্থি মারে হয়তো, কিন্তু পাছা জিনিসটা অশ্লীলতো, তাই অন্যের পাছা ছুঁইতে নাসিরের তীব্র আপত্তি আছে। এখন সমস্যা সেটা না। সমস্যা হচ্ছে বাপকে মুখ দেখাবে কী করে? বাপের পাছায় থাপ্পড় মারা পরবর্তী কাজটাইবা কী? বাপের পা ধরে ক্ষমা চাইবে? বলবে, “আব্বা আমি ভুল করে থাপ্পড় মেরেছি। ভেবেছি চাচাতো ভাই সোহাগ দাঁড়িয়ে আছে। আব্বা আমারে মাফ করে দেন।“ কিন্তু এটা বলার জন্য বাপের সামনে কিভাবে যাবে!
মোটকথা হচ্ছে নাসির বিষয়টা মেনে নিতে পারছে না। জীবনে কখনো বাপের পাছার দিকেই তাকায়নি সে। আরে বাবা, পাছাটাতো বাপের, এটার দিকে কিভাবে তাকায়! আপনারা ভুল বুঝবেন না, নাসির কখনো বিপরীত লিঙ্গের মানুষের পাছার দিকেও লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায় না। নাসিরের সমস্ত আগ্রহ গরুর পাছার দিকে। গরুর পাছার মাংস খেতে খুব পছন্দ করে। নাসিরের বাপ আবার গরুর সিনার হাঁড় মাংস পছন্দ করে। কিন্তু মাংস কেনার সময় ছেলের কথা মাথায় রেখে পাছার মাংসও কিনে।
এখন এই সমস্যার সমাধান কিভাবে হবে? নাসির কখনোই বাপের পাছায় থাপ্পড় মারা ছেলে হতে চায়নি। বাপের মুখ উজ্জ্বল করা ছেলে হতে চেয়েছে। কিন্তু বাপের মুখ উজ্জ্বল করা বাদ দিয়ে পাছা লাল করে দিয়েছে। আপনারা হয়তো হাসছেন। কিন্তু নাসিরের ব্যাপারটা একবার বুঝার চেষ্টা করুন। এখনো নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি সে। বাপের টাকায় খেয়ে পরে বেঁচে আছে। ভুল করে বাপের পিঠে চাপড় দিলেও রক্ষে হয়, কিন্তু পাছা? এটাতো ভাই বড় অশ্লীল হয়ে গেলো! এখন বাপরে হয়তো বুঝানো গেলো চাচাতো ভাই মনে করে বাপের পাছায় থাপ্পড় মরেছে, কিন্তু বাপের মনতো উল্টাপাল্টাও বুঝতে পারে। বাপতো ভাবতে পারে তার ছেলের ইয়ের দোষ আছে। যৌবনের ক্ষুধায় ছেলেদেরকে পছন্দ করে সে। উফ! যদি এমন কিছু ভাবে, তাহলে বেদনায় বাপের বুক ভেঙ্গে যাবে। সব বাবাই চায় ধুমধাম করে একটি সুন্দরী মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিবে। কিন্তু ছেলের যদি অন্য দোষ থাকে, তাহলে আরেকটা ছেলেকে কিভাবে বৌ করে ঘরে আনবে? সমাজের মানুষরাইবা কী বলবে! সমাজ এখানে বিশাল ব্যাপার।
আপনারা মোটেও আন্দাজ করতে পারছেন না এই মুহূর্তে নাসিরের অবস্থা কত খারাপ। নাসির ভাবছে আত্মহত্যা করবে। অথবা পালিয়ে যাবে। কোনভাবেই এই মুখ নিয়ে বাপের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। এই মুহূর্তে নাসির অসহায়, বিপদে আছে। কিন্তু এতকিছুর পরও ছেলেটি বাস্তববাদী। আত্মহত্যা কিংবা পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবলেও আসলে সে অন্য কোন পথ খুঁজছে। পথের খোঁজও পেয়েছে। হয় পাগল সাজবে, নয়তো ভুতের আছরের নাটক করবে। যেন তার বাবা সমস্ত পুত্রস্নেহ দিয়ে ছেলেকে সুস্থ করে উঠেপড়ে লাগেন।
এক্ষেত্রে পাগলের বেশ ধরা রিস্কি। পাগল হলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। ডাক্তাররা চালাকি ধরে ফেলবে। কিন্তু ভুতের বিষয়টা সামনে আনলে ঘটনা আর হাসপাতালে যাবে না, যাবে ঠাকুর অথবা মসজিদের হুজুরের কাছে। এটা অনেক নিরাপদ। অন্ততপক্ষে নাসির সেটাই মনে করে।
নাসির বুদ্ধি করে ঘটনাটি পুরো গ্রামে ছড়িয়ে দিলো। বাজারে কয়েকশ মানুষের সামনে ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বারের পাছায় দিলো কষে এক থাপ্পড়! সবাইতো হতবাক। মেম্বারও ক্ষ্যাপা।
– তুই আমার পাছায় থাপ্পড় মারলি ক্যান?
– ওমা, পাছাতো থাপড়ানোরই জিনিস। তাই থাপড়াইছি। পেছনে ঘোরেন, আরেকটা থাপ্পড় মারি।
মেম্বারসাব মান সম্মান নিয়ে দৌড়ে পালানেন। বিচার গেলো নাসিরের বাপের কাছে। বাপ ভাবছে ঘটনা কী, ছেলে এভাবে পাছা থাপড়ানো শুরু করছে ক্যান!
বাপের সাথে চোখাচোখি হয় না। ছেলেকে দেখলে বাপ দূরে সরে যায়, বাপকে দেখলে ছেলে। পাছা কেলেংকারি বাপ ছেলের মাঝে একটি সুনির্দিষ্ট দূরত্ব সৃষ্টি করে দিয়েছে। দুপুর বেলা বাড়িতে গোসল করতে অন্য সবার সাথে ঘাটে গেছে নাসির। চাচাতো ভাই সোহাগের বাবা গোসল সেরে ঘাটে উঠে দাঁড়ালেন। নাসির খুব মনযোগ দিয়ে চাচার পাছা দেখছে। চাচা বিষয়টা খেয়াল করলেন। বিব্রত হলেন।
– চাচা, আপনার পাছাটা খুব সুন্দর। অনেক মাংস। এদিকে আসেন, একটু থাপড়ে দিই।
এই কথা শুনে কিছু বুঝে উঠার আগেই লুঙ্গির উপর দিয়ে ভেজা পাছাটায় কষে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো নাসির। নাসিরের চাচীও পুকুর ঘাটে। স্বামীর হৃষ্টপুষ্ট পাছাটা তার খুব প্রিয় হলেও কখনো থাপ্পড় দেয়ার চিন্তা করেননি। উল্টো এই লোভ মেটান নাতির পাছার উপর। ২ বছর বয়সী নাতিটারে উপুর করে আচ্ছামতো পাছায় থাপড়ান। কিন্তু এখন নাসির এটা কী করলো! ছি ছি! ছেলেটারে খুব আদর করতেন তিনি। নিজের ছেলের মত জানতেন। অথচ সেই ছেলেই কিনা চাচার পাছায় থাপ্পড় দিলো। তাও আবার ভেজা পাছা। ভেজা গায়ে থাপ্পড় যে কী জোরে লাগে! স্বামীর জন্য মনে মনে বেদনা অনুভব করলেন তিনি।
যথারীতি নাসিরের আব্বার কাছে বিচার গেলো। পড়লেন দুশ্চিন্তায়। তিনি তার বাকি দুই ভাইকে নিয়ে বসলেন আলোচনায়। নাসিরতো এরকম ছেলে না। হঠাৎ তার কী হলো! আলোচনার এক পর্যায়ে নাসিরকেও ডাকা হলো। নাসিরতো লজ্জায় শ্যাষ। অনেক কষ্ট করে গায়ের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণে এনে বাপ চাচাদের সামনে দাঁড়ায়। সকল জড়তা কাটিয়ে নাসিরকে জিজ্ঞাসা করা হলো সে কেন সবার পাছায় থাপ্পড় মারছে?
এটা শুনে নাসিরতো আকাশ থেকে পড়লো। লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। বিস্ময়ে চোখ দুইটা ঠেলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
– আব্বা, আব্বা, আপনি এসব কী বলতেছেন! ছি ছি! আপনাকে এসব কে বলেছে? আব্বা আপনিই বলেন আমি কেন সবার পাছায় থাপ্পড় মারবো?
– কিন্তু ঘটনাতো সত্য।
– আব্বা, বিশ্বাস করেন, আমি কারো পাছায় থাপ্পড় মারি নাই। পাছা একটা নোংরা ও অশ্লীল জিনিস। আব্বা, আমি কিভাবে যে বুঝাই, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। চাচার পাছায় থাপ্পড় মেরেছি! কী ভয়ংকর অশ্লীল অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে। আব্বা, আমার মরন ছাড়া আর উপায় নাই।
– তুই আমার পাছায়ও থাপ্পড় মেরেছিস, হারামজাদা।
এটা শুনে নাসির আর নাই। মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। বাপ চাচারা সবাই এসে নাসিরকে জড়িয়ে ধরেছে। চোখে মুখে জলের ছিটা দিচ্ছে। নাসিরতো ঘেমেটেমে একাকার। জলের ছিটা খেয়ে নিজের হারানো জ্ঞান ফিরিয়ে আনলো সে। সেজো চাচা আর ছোট চাচার দিকে তাকিয়ে রইলো। তাদেরকে দূরে উল্টো পাশে হাতের ইশারা দিয়ে বললো, “চাচা দেখতো ওইটা কী?” এটা শোনার পর চাচারা পাশ ঘুরলেই নাসির দুই হাত দিয়ে দুই চাচার পাছায় গায়ের সব শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মারলো। তারাও গায়ের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করলো। চিৎকার শুনে নাসির আবার অজ্ঞান হয়ে যায়।
এসব দেখে চাচারা বললো নিশ্চয় নাসিরকে ভূতে ধরেছে। নইলে সবার প্রিয় বুদ্ধিমান ছেলেটা এরকম কেন করবে? নাসিরের বাবা রফিক মিয়া ভাইদের কথায় সায় দিলো। নাসিরের ছোট চাচা বললো, তবে ভূতটা ভালো। শুধু পুরুষদের পাছায় থাপ্পড় মারতেছে। নিশ্চয় ভুতটা কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারের। ভদ্র এবং সভ্য।
ঘটনার এই পর্যায়ে এসে যেহেতু ভূতের বিষয়টা ধরা পড়লো, সেহেতু এখন ভূত তাড়ানোর জন্য এক্সপার্ট দরকার। এই গ্রামে দুইজন মানুষ ভূত তাড়ায়। একজন হলো ব্রাহ্মণ ভাসান ঠাকুর, আরেকজন মসজিদের ইমাম। ভাসান ঠাকুরদের ভূত তাড়ানোর ইতিহাস অনেকদিনের। তার বাবা অতীশ ঠাকুরও ভূত তাড়াতেন। তারা ভূতকে ঝাড়ুপেটা করে তাড়িয়ে দেয়। লতাপাতার ধোঁয়া দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। গু মাখানো জুতা শুঁকিয়ে তাড়িয়ে দেয়।
ঠাকুর আর হুজুরের প্রশ্নে নাসিরের বাবা ঠাকুরের পক্ষে। কিন্তু নাসিরতো সব শুনেছে। লতাপাতার ধোঁয়া না হয় মানা যায়, কিন্তু গু মাখানো জুতা সে কোনভাবেই শুঁকতে পারবে না। দেরি না করে অজ্ঞান নাসির সটান উঠে বসে হুংকার ছাড়লো, “কোন হিন্দু খোনকার ডাকলে আমি যাদের পাছায় থাপ্পড় দিয়েছি, তাদের পাছায় কাঁটাওয়ালা গাছের জন্ম হবে। এইসব কাঁটায় থাকবে ভয়ানক বিষ। পাছায় বিষকাঁটার গাছ নিয়ে এই মানুষগুলো বসতে পারবে না, চিৎ হয়ে শুইতে পারবে না, দেয়ালে ঠেক ধরতে পারবে না। কিন্তু যদি মসজিদের ইমাম আনে, তাহলে সবার পাছাই রবে অক্ষত এবং নিরাপদ। পাছায় কাঁটাওয়ালা গাছতো দূরে থাক, একটা ঘাসও গজাবে না।
নাসিরের মেজো চাচা খুব খুশি। কারণ সে চেয়েছে মসজিদের ইমামকে দিয়ে ভূত তাড়াতে। তার মতে ওইসব ঠাকুর মাকুর ভুয়া জিনিস। সব ধান্ধাবাজের দল। কিন্তু মসজিদের ইমাম, তার মাঝে কোন ধান্ধা নেই। তিনি ফেরেশতার চাইতেও ফ্রেশ। নিজ দায়িত্বে বেরিয়ে গেলেন ফ্রেশ ইমামকে নিয়ে আসতে।
নাসিরের অবস্থা ভালো না। তারচেও খারাপ হচ্ছে নাসিরের মা’র অবস্থা। একমাত্র ছেলেকে ভূতে ধরেছে। না জানি কোন ক্ষতি করে দেয়। ভূতে কোন বিশ্বাস নাই। ভূত খুব খারাপ জিনিস। নাসিরের মা ভূতকে দুই চোখের কোনায়ও দেখতে পারেন না। ঘৃণাভরে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন।
এখন চৈত্রের গরমে সবাই ঘামছে। কিন্তু নাসির একটু বেশিই ঘামছে। তার চোখ দুইটা কট্টর লাল। যেন ঠেলে বেরিয়ে আসবে। কী যে ভয়ংকর এক চেহারা হয়েছে নাসিরের! ছেলের এই অবস্থা দেখে নাসিরের মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ওইদিকে নাসিরের ছোট চাচা ছিলেন সুযোগের অপেক্ষায়। ভাবীর কান্না দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে দেবরও কান্না শুরু করে দিলো। দেবরটা ভালোই, কিন্তু ভাবীর প্রতি একটু দুর্বল আরকি!
নাসিরের এসব নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই। সে ভাবছে এই ফালতু ঝামেলাটা যত দ্রুত মিটে যায়, ততই মঙ্গল। অভিনয় খুব কষ্টের বিষয়। টানা এতক্ষণ অভিনয় করে সে হাঁপিয়ে উঠছে। কিন্তু তাকে যে আরো অনেকটা সময় অভিনয় করে যেতে হবে। কারণ ইমাম সাহেব নেই। কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গেছেন, পরশু আসবেন।
নাসিরের বাপ চাচারো পড়লো বিপদে। এখন নাসিরকে কী করবে? সেতো যাকে পাবে তার পাছায় থাপ্পড় মারবে। মনে মনে ভূতকে নোংরা সব গালি দিচ্ছেন। নাসির বুঝতে পারছে তার বাবা ভূতকে গালি দিচ্ছে। সে চিৎকার করে বললো – খবরদার, গালি দিবি না। আর দিলেও এত নোংরা গালি না।
২.
রফিক মিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলেকে ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখবেন। কিন্তু নাসিরের চাচা বললো এটা নিরাপদ না। ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। তারচে ভালো পায়ে লোহার শিকল দিয়ে আটকে রাখা হোক। ভূত লোহা ভেঙ্গে যেতে পারবে না। এটা শুনে নাসিরের মা’তো পারলে দেবরের গলা ছিঁড়ে ফেলেন। তিনি বললেন, কোনভাবেই তার ছেলেকে পাগলের মত পায়ে শিকল পরিয়ে রাখা যাবে না। হুজুর আসা পর্যন্ত সে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করবে।
বিকাল বেলা নাসির গেলো বাজারে। বাজারে যাওয়ার সাথে সাথে মানুষ সব ভয়ে পালাচ্ছে। কেউই বেইজ্জতি হইতে চায় না। শুধু একজন মানুষ পালাচ্ছে না। যিনি ছোট বেলায় নাসিরকে পড়িয়েছেন। তার বিশ্বাস নাসিরের ভূত অন্তত তার শিক্ষককে অপমান করবে না। স্যার মানুষ, সাহস করে নাসিরের কাছে গেলেন। মাথায় হাত বুলালেন। জিজ্ঞাসা করলেন চা খাবে কিনা। কিন্তু নাসির কিছু কয় না। স্যার আবারো জিজ্ঞাসা করে, জুস খাবে কিনা, মিষ্টি খাবে কিনা। নাসির তাকিয়ে আছে স্যারের পাছার দিকে। স্যার সাহস করে বললেন –লুঙ্গিটা নতুন কিনেছি, সুন্দর না?
– সুন্দর। কিন্তু লুঙ্গির নিচে কী আছে স্যার?
– শর্ট প্যান্ট পরেছি। কারণ আমি শক্ত করে লুঙ্গি পরতে পারি না। যখন তখন খুলে যেতে পারে, এই ভয়ে।
– শর্ট প্যান্টের নিচে কী আছে স্যার?
এটা শুনে স্যার সত্যি সত্যি ভয় পেলেন। তিনি বিদায় নিয়ে চলে যেতে চাইলেন। পাশ ঘুরে পা ফেলতেই নাসির দিলো থাপ্পড়। অবশ্য হালকাভাবেই দিয়েছে। শত হলেও স্যার মানুষ। স্যারকে থাপ্পড় দিতে নাসিরের মোটেও ভালো লাগেনি। কিন্তু কোনভাবেই প্ল্যানে ফাঁক রাখা যাবে না। পিতা পুত্রের স্বাভাবিক সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার কাছে স্যারের পাছা মূল্যহীন। একটাইতো থাপ্পড়, পরে মাফ চেয়ে নিলে হবে।
যাইহোক, স্যার অপমানিত হয়ে চলে গেলেন। ওইদিকে নাসিরের চাচা থেমে নেই। তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে চলে গিয়েছেন হুজুরের আত্মীয়ের বাড়িতে। হুজুরকে নিয়েই ফিরলেন। তারপর নাসিরের বাবা ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে গেলেন। উঠানে বসলেন হুজুরসহ। হুজুর আর নাসির মুখোমুখি। নাসিরের দুই পাশে তার দুই চাচা। দূরে মুখে আঁচল কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে নাসিরের মা। আশপাশের বাড়ির মানুষরা ভিঁড় জমিয়েছে। নাসিরের ভূত তাড়ানো দেখবে।
হুজুরতো সেইরকম ভাব নিয়ে বললেন – অনেক জরুরী কাজ ফেলে রেখেছি। কই, দেখি বলতো তোমার নাম কী?
– মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন কুয়াবাসী
– তুমি এখানে কেন এসেছো?
– এটা আমার জন্মস্থান। আমার পূর্বপুরুষরাও এই গ্রামের বাসিন্দা।
– নাসিরের উপর কেন আছর করেছো, সেতো খুব ভালো ছেলে।
– নাসির কুয়ার জলে প্রস্রাব করেছে তাই। বেয়াদব ছেলে প্রস্রাব করেছেতো করেছে, তাও আবার দাঁড়িয়ে। ওর বাপও বেয়াদব। ছেলেকে বসে প্রস্রাব করা শেখায়নি।
– তো, এখন তোমার প্ল্যান কী?
– ভালোইতো আছি, আবার কিসের প্ল্যান?
– না, তোমাকেতো ছেড়ে যেতে হবে, তাই না? এর আগেও তিনজন ভূত এইভাবে চলে গেছে। কোন জোর জবরদস্তি করা লাগেনি।
– না, আমি যাবো না।
– বুঝছি। আচ্ছা বলো, কত টাকা দিলে যাবে?
এটা শুনে নাসির মনে মনে বলে, শালারপুত দেখি আমার বাবার টাকার দিকে নজর দিয়েছে। কখনো শুনিনাই ভূত কারো কাছ থেকে টাকা নেয়। একটু ভেবে চিন্তে নাসির (ভূত) সিদ্ধান্ত জানালো।
– এক লাখ এক টাকা।
– এত টাকা হবে না। সর্বোচ্চ দশ হাজার এক টাকা দেয়া যাবে।
– দুই লাখ দুই টাকা।
– আচ্ছা বাদ দাও, বিশ হাজার এক টাকা দিবো।
– তিন লাখ তিন টাকা।
– এতো মহা মুশকিল! ঠিক আছে, এক লাখ এক টাকাই দিবো।
– চার লাখ চার টাকা।
হুজুর ভাবলেন ভালোই হলো, লাভতো তারই হবে। এই টাকাতো আর ভুতের কাছে যাবে না, হুজুরের কাছেই যাবে। নাসিরও ভাবছে ঘরে বাগান বিক্রি করা ক্যাশ টাকা আছে। চার লাখ টাকা তার বাবার জন্য এখন কোন ব্যাপারই না। যাইহোক, হুজুর রাজি হয়ে গেলেন। নাসিরের বাবাও চার লাখ চার টাকায় রাজি। ছেলের জন্য তিনি আরো কিছু করতে প্রস্তুত।
– আর কী চাস বল? কোরমা, পোলাও, খাসি, মোরগ?
এই প্রশ্ন শুনে নাসির ভাবলো হুজুর বড় সেয়ানা মাল। এই উসিলায় কোরমা পোলাও খাইতে চাইছে। কিন্তু নাসির যদি খেতে না চায়, তাহলে জনমনে সন্দেহ জাগতে পারে। নাসির সম্মতি দিলো।
– আর কিছু চাওয়ার আছে?
– আছে।
– কী, তাড়াতাড়ি বলো।
– আপনার পাছায় একটা থাপ্পড় মারবো। এটাই হবে আমার জীবনের শেষ থাপ্পড়।
হুজুরতো ভীষণ রাগ করলেন। এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তিনি একজন মসজিদের ইমাম। সারা গ্রামের মুসলমানরা তার পেছনে নামাজ পড়ে। এখন যদি নাসিরকে আছর করা ভূত হুজুরের পাছায় থাপ্পড় মারে, তাহলে নামাজে দাঁড়িয়ে সবাই হুজুরের পাছার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কী বাজে অবস্থাটাই না হবে। হুজুর মোটেও রাজি হননি। তিনি বললেন থাকুক ভূত, আমি পাছা বাঁচাই। কিন্তু হুজুর বললেইতো আর হবে না। নাসিরের বাপ চাচা ও বাড়ির লোকজন হুজুরকে ধরলেন। বুঝালেন। এবং বললেন থাপ্পড় মারার সময় কারো নজর এখানে থাকবে না। সবাই অন্য দিকে তাকিয়ে থাকবে।
– ঠিক আছে, থাপ্পড় মারতে পারবে। কিন্তু এখানে কেউ থাকবে না। শুধু আমি আর তুমি থাকবো।
– তিন থাপ্পড় মারবো।
– আহা, ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করো। আমি চাইলেই কিন্তু তোমারে বোতলে ভরে ফেলতে পারি। অযথা ঝামেলা করছো কেন?
– ছয় থাপ্পড়।
হুজুর আড়ালে গিয়ে নাসিরের বাবার সাথে কথা বললেন এবং বুঝালেন এটা সম্ভব না। অনেক অনুরোধের পর নাসিরের বাবা খোলাখুলি বললেন, তিনি যদি ভূতের হাতে পাছায় থাপ্পড় থেকে রাজি হন, তাহলে তাকে ২০ হাজার টাকা দেয়া হবে। হুজুর তবুও আমতা আমতা করছেন। এরপর নাসিরের বাবা বললেন ৫০ হাজার দেয়া হবে। হুজুর মেনে নিয়ে ভূতের কাছে গেলেন।
– ঠিক আছে থাপ্পড় দাও।
– থাপ্পড়তো এখন দিবো বলিনি। কোরমা পোলাও খাওয়ার পর দিবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু কোন ঝামেলা যেন না করো, চুক্তি অনুযায়ী সব করতে হবে। নইলে কিন্তু বোতলে ভরে ফেলবো।
– সেই বোতল দুনিয়াতে এখনো বানানো হয় নাই। নয় থাপ্পড়।
৩.
টাকা প্যাকেট হলো, পোলাও কোরমা রান্না হলো। খাবারগুলো টেবিলে সাজানো। হুজুর বললেন, এই খাবার সবাই খেতে পারবে না। শুধু হুজুর আর ভূত খাবে। এটা শুনে নাসির মনে মনে হাসে। খাউয়া মার্কা হুজুরের পোলাও কোরমার কী শখ! নাসির গর্জে উঠে বললো, “এই খাবার শুধু মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন কুয়াবাসী খাবে। আর কেউ নয়।“ হুজুরের মুখতো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। যাইহোক, তিনি কোন দ্বিমত করেননি। ভূতের নামে নাসির বসে বসে খাচ্ছে। সবাই চারপাশে ভিঁড় করে আছে। ভূতের খাওয়া দেখছে। আর হুজুর সবাইকে এই গ্রামের ভূতের বিষয়টা বুঝিয়ে বলছে।
– এই গ্রামে ভূত মোট ২১ টা। এর আগে তিনটাকে তাড়ানো হয়েছে। এইটা সহ চারটা হবে। বাকি থাকবে আরো ১৭ টা। এখন এলাকাবাসীকে সাবধান থাকতে হবে। ডোবা, কুয়া, বেত বাগান আর বাঁশ বাগান এড়িয়ে চলতে হবে।
এটা শুনে নাসির ভাবলো হুজুরের কী লোভ! আরো ১৭ বার ভূত তাড়াবেন আর পোলাও কোরমা খাবেন! মনে মনে বলছে, তোর কোরমা পোলাওতে ছাই ঢালছি, দাঁড়া।
– ভূতের সংখ্যা সঠিক নয়। গত বিশ বছর ধরে এই গ্রামে শুধু আমিই ছিলাম। আর কোন ভূত নেই। আমিও থাকতাম না, অভিশাপ দিয়ে ফেলে চলে গেছে। গত বিশ বছর ধরে আমি নাসিরদের ওই কুয়াতে বন্দী ছিলাম। নাসির যখন দাঁড়িয়ে কুয়ার মাঝে প্রস্রাব করছিলো, আমি তার প্রস্ত্রাবের লাইন ধরে উঠে আসি। আমি চলে যাওয়ার পর এই গ্রামে আর কখনো ভূত আসবে না।
হুজুরের মুখে কোন কথা নাই। কিন্তু চারপাশের মানুষের মুখে অনেক কথা। সবাই খুশি। নিজেদের গ্রামকে বাংলাদেশের একমাত্র ভূতমুক্ত গ্রাম ঘোষনার প্রস্তাবও এসেছে। সবার মনে ভূতের ভয়হীন বসবাসের আনন্দ, কিন্তু হুজুরের মুখ কালো। চোখের সামনে টেবিলে এত মজার সব খাবার, ছুঁয়েও দেখতে পারলেন না। এখন আবার আজীবনের জন্য ভূত তাড়ানোর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে নাসিরের খাওয়া শেষ। ততক্ষণে এশার ওয়াক্ত হয়ে গেছে। আজান দিয়ে নাসিরদের উঠোনেই সবাই নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ শেষে ভূত তাড়ানোর পালা। ভূতকে জিজ্ঞাসা করা হলো সে কিভাবে যাবে। ভূত বললো, টাকা বুঝে পাওয়ার পর নাসিরদের বাড়ি থেকে উত্তর দিকে খালের উপর যে কালভার্টটা আছে, তার পাশে একটা বাঁশঝাড় আছে, সেই বাঁশঝাড়ের সামনে গিয়ে ভুত চলে যাবে। তার সাথে আর কেউ থাকতে পারবে না, শুধু হুজুর থাকবে। কারণ ভূত চলে যাওয়ার পর নাসির জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। হুজুর নাসিরকে ধরবে। ভূত আবারো মনে করিয়ে দিলো, তার সাথে শুধু হুজুর যাবে। অন্য কেউ যাওয়ার চেষ্টা করলে হুজুরের ঘাড় মটকে দিবে।
উপস্থিত মানুষের মধ্য থেকে একজন জানতে চাইলো হুজুরের পাছায় থাপ্পড় মারবে কখন? ভূত বললো গায়েব হওয়ার একটু আগে। তো, তারপর ভূতের (নাসিরের) হাতে ৪ লাখ ৪ টাকা তুলে দেয়া হলো। সবাই উঠোনে রয়ে গেলো, শুধু নাসির আর হুজুর কালভার্টের দিকে রওনা দিলেন। এদিকে হুজুরের আর কোন আশা রইলো না। খাবারও পেলেন না, টাকাও না। কপালে শুধু থাপ্পড়টাই রইলো।
বাড়ির দরজা পেরিয়ে রাস্তায়। পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন। অন্ধকার। কারো মুখে কোন কথা নাই। নিরবতা ভাঙলো নাসির।
– হুজুর, এভাবে আর কত?
হুজুর কিছু কয় না। চুপ মেরে আছে।
– এই গ্রামে এখনো ১৭টা ভূত আছে, তাই না? আচ্ছা বলেনতো, মানুষের সাথে এসব প্রতারণা করলে গুনাহ হয় না?
– দেখো, আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর সেজো মেয়েটার বিয়ে। জামাই পক্ষকে ৫০ হাজার টাকা যৌতুক দিতে হবে। তাই আমি ভেবেছি তোমার যাই হোক না কেন, আমি যেন টাকাটা পাই। এই জন্য নতুন তৃতীয় স্ত্রীর সাথে রাত কাটানোর লোভ সামলে তোমার ভূত তাড়াতে চলে এসেছি। এখন তুমিতো সব মাটি করে দিলা।
– আমিতো জানতাম আপনার এক স্ত্রী। এখন শুনি তিন স্ত্রী। গোপন রাখলেন কেন?
– এখনকার মুসলমানরা বহুবিবাহ ভালো চোখে দেখে না। যদিও ৪ বিয়ে পর্যন্ত করার অধিকার আমার আছে। তাছাড়া এটা খারাপ কী, আমিতো আর দাসী রাখছি না। বিয়ে করে নিচ্ছি।
– ভালোই। এখন কালভার্টতো এসে পড়লো। পাছায় থাপ্পড় খাওয়ার জন্য রেডিতো?
– দেখো, আসল কাহিনী আমিও জানি, তুমিও জানো। তাহলে হুদাই পাছায় থাপ্পড় মারবে কেন?! বাদ দাও না এসব।
– আপনার পাছাটা ভারী সুন্দর, হৃষ্টপুষ্ট। কিন্তু হুজুর, আমি বুঝি না বেশিরভাগ হুজুর এত স্বাস্থ্যবান হয় কিভাবে? আপনাদেরতো এত বেশি আয়ও নেই, খেতেও পারেন না ভালো। এটা বুঝি আল্লাহর রহমত?
– বাদ দাও না। আমারে টাকাগুলো দিয়ে তুমি অজ্ঞান হয়ে যাও। টাকাগুলো বাশঝাড়ে লুকিয়ে রেখে তোমারে কোলে করে ঘরে দিয়ে আসবো। পরে এসে টাকার প্যাকেট নিয়ে যাবো।
– কিন্তু এত হৃষ্টপুষ্ট পাছায় কয়টা থাপ্পড় মারতে না পারলে, পুরা মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। প্লীজ কালভার্টের উপর উপুর হয়ে শুয়ে পড়ুন। আমি থাপ্পড়গুলো দিয়ে নিই। বাবাতো বলছেই আপনাকে ৫০ হাজার টাকা দিবে। সমস্যা কী?
একরকম জোর করে হুজুরকে কালভার্টের উপর শুইয়ে পাছায় কষে নয়টা থাপ্পড় মারলো নাসির। আর মৃদু স্বরে বলছে, “ভূত তাড়াচ্ছি” “ভূত তাড়াচ্ছি।“ তারপর বললো ৪ লাখ ৪ টাকা তারই থাকবে। আর হুজুর পাবে তার বাবার কাছ থেকে থাপ্পড় বাবদ ৫০ হাজার টাকা।
৪.
নাসিরকে কাঁধে তুলে নিলেন হুজুর। বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। হুজুরের কাঁধে শুয়ে নাসির মুখ চেপে ধরে হাসছে। হাসির ধাক্কায় হুজুরের পা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পায়ের কদমে ভুল হচ্ছে। ভারসাম্য রাখা মুশকিল।
ওইদিকে মুখ চেপে ধরে হাসির আড়ালে নাসির ভাবছে সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবার সাথে প্রথম কথাটা কী বলবে, আর আচরণইবা কেমন করবে। এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো জীবনে কখনো কারো পাছায় থাপ্পড় মারবে না।
[গল্পটি কোন সত্য ঘটনা অবলম্বনে নয়। আবার রূপকও নয়। এটা একটি গল্প। এমনিএমনি গল্প।]

নিহত ব্লগারদের লেখা খতিয়ে দেখে যেভাবে তদন্ত হয়

লিখেছেন
“ব্লগার হত্যা জাতির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ব্লগার হত্যা এমন একটা বিষয়, যার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা কোনভাবেই ব্লগার হত্যা এড়িয়ে যেতে পারি না। ব্লগার হত্যা এড়িয়ে জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়, এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যদি এগিয়ে যেতে চান, তাহলে ব্লগার হত্যার ঘটনা এড়িয়ে যাবেন না। সুতরাং এটা প্রমাণিত যে, ব্লগার হত্যা মোটেও অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমি বলতে চাই, পুলিশ বাহিনী এসব ব্লগার হত্যার রহস্যের উন্মোচন করতে প্রাণবাজি রাখবে। হত্যার পরিকল্পনাকারীকে গ্রেফতার করতে জানবাজি রাখবে। হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া খুনীদের ধরতে প্রাণবাজি রাখবে। তোমরা যেসব পুলিশ সদস্য প্রাণবাজি রাখতে অপারগতা জানাবে, বুঝতে হবে তাদের প্রাণের কোন মূল্য নাই, গুরুত্ব নাই। তাই নিজের প্রাণের মূল্য প্রমাণ করতে পুলিশ বাহিনীকে ব্লগার হত্যার তদন্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।“
– আবারো ব্লগার খুন হওয়া প্রেক্ষিতে ডাকা জরুরী বৈঠকে প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন পুলিশের আইজি।
এরপর তিনি উপস্থিত অধীনস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তদন্তের বিষয়ে আইডিয়া চাইলেন। আইজিপি বললেন, “একটি সফল তদন্তের জন্য সবার আগে প্রয়োজন ফাটাফাটি আইডিয়া। ফাটাফাটি আইডিয়া একটি সফল তদন্তের ভিত গড়ে দেয়। ফাটাফাটি আইডিয়া ছাড়া একটি তদন্ত সফল হয়ে উঠে না। আমরা একটি সফল তদন্তের জন্য ফাটাফাটি আইডিয়া চাই। এখানে যারা উপস্থিত আছেন, তারা সবাই একটি করে ফাটাফাটি আইডিয়া দেন। আমরা সবগুলো ফাটাফাটি আইডিয়ার সমন্বয় করে একটি সুপার ফাটাফাটি আইডিয়া বের করে নিবো।“
উপস্থিত সবাই তাদের আইডিয়াগুলো বলতে থাকলেন।
এডিশনাল আইজিপিঃ
স্যার, আমার মনে হয় আনসারুল্লাহ বাংলা টীমের বড়হুজুর রাহমানিকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেরিয়ে আসতে পারে মূল ঘটনা।
ডিএমপি কমিশনারঃ
পুলিশ বাহিনীর ভেতরেই টিকটিকি আছে। এই মুহূর্তে যেটা দরকার, সেটা হচ্ছে বাহিনীর মধ্যে ফাঁদ পাতা। এই ফাঁদে টিকটিকি ধরা পড়বেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, টিকটিকি ধরার জন্য ইঁদুর ধরার কল বসালে লবে না। টিকটিকির কলই বসাতে হবে।
যুগ্ম কমিশনার, ডিবিঃ
এসব কলে টলে হবে না। ব্লগার হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত যারা জামিনে আছে, তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিলে কিছু ক্লু পাওয়া যেতে পারে। আমরা সেইসব ক্লু ধরে এগিয়ে গেলে হত্যায় অংশ নেয়াদের শনাক্ত করতে পারবো।
ডিসি ওয়ারী জোনঃ
স্যার, আমার মনে হয় ওলামালীগ নেতাদের ফোনে আড়ি পাতলেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
ওসি, সূত্রাপুর থানাঃ
ওলামালীগ নয়। আড়ি পাততে হবে হেফাজত নেতাদের ফোনে। আমি মনে করি এটাতে কিছু ফল পাওয়া যেতে পারে।
এডিশনাল ডিআইজিপিঃ
ওলামা লীগ আর হেফাজততো খুব সহজ সন্দেহ। একটু ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। সরকারের কতিপয় বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রীর সাথে জঙ্গী কানেকশন আছে। তাদের প্রতি নজর রাখলেও কিছু একটা পাওয়া যেতে পারে।
ডিআইজিপিঃ
কথাতো অনেক বলা যায়। কিন্তু আমি যেটা বলতে চাই, সেটা হলো এই তদন্তটাও আগের তদন্তগুলোর মতো যেনতেনভাবে শেষ করে দিই। কিন্তু ভবিষ্যতে যেন খুন ঠেকাতে না পারলেও খুনীদের ধরতে পারি, সে বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে পারি। কিন্তু ঢাকা শহর এখনো পুরোপুরি সিসিটিভির আওতায় আসেনি। কিন্তু এক মাসের মধ্যে পুরো শহরকে সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
এএসপিঃ
আমি এই ভেবে অবাক হচ্ছি যে, কেউই দেখি তদন্তের কলাকৌশল নিয়ে কথা বলছে না। সবাই শুধু সস্তামার্কা বিপ্লবের থিওরি দিয়ে যাচ্ছে। আমরাতো আগে তদন্ত করতে হবে, পরে না খুনী ধরবো। আমাদেরকে যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে কতগুলো সূত্র ধরে এগুতে হবে। এর সব সূত্রই আমাদের জানা আছে। এটা নিশ্চিতভাবেই ইসলামী জঙ্গীদের কাজ। দুইজন জঙ্গীপোষককে ফেলে দিয়ে তৃতীজনের কাছে গেলেই সুরসুর করে পুরো ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
এএসআই মতিনঃ
কিন্তু আমাদেরতো আগে জানতে হবে তাকে কেন খুন করা হয়েছে। সে কী এমন লিখতো, যার কারণে তাকে খুন করতে হবে। আরো জানতে হবে সে কি কারো অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লিখতো? লিখলে কাকে আঘাত দিয়ে লিখতো? আসলে তদন্তের একমাত্র মোটিভ হতে হবে নিহত ব্লগারের লেখালেখি খতিয়ে দেখা। সে কী লিখতো, এটা যদি বুঝতে না পারি, তাহলে আমরা কখনো কাউকে বলতে পারবো না তাকে আসলে কেন খুন করা হয়েছে।
টেবিল চাপড়ানোর আওয়াজ, ধুম করে শব্দ হলো। শব্দ শুনে সবাই আইজিপির দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি বললেন, “ফাটাফাটি! ফাটাফাটি আইডিয়া!! লেখালেখি খতিয়ে দেখার আইডিয়াটাই ফাটাফাটি। অত্যন্ত ফাটাফাটি। আমাদের প্রত্যেকের উচিত যেসব ব্লগার মরে যাচ্ছে, তাদের লেখালেখি খতিয়ে দেখা। এটা খুবই জরুরী একটা ব্যাপার। লেখালেখি খতিয়ে দেখতেই হবে। আসলে লেখালেখি খতিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই।“
উপস্থিত সবাই সম্মতি জানালেন। একজন বললেন, সেক্ষেত্রে এই বৈঠকে বসেই লেখালেখি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। এবং এই মিটিংয়ে বসেই তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে ফেলা যায়।
আরেকজন বললেন কম্পিউটার অপারেটরকে এই বৈঠকে ডেকে আনতে। লেখা খতিয়ে যা যা পাওয়া যাবে, সে সাথে সাথে লিখে ফেলবে। তাহলে দ্রুততার সাথে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা যাবে।
যে ভদ্রলোক দুইজন জঙ্গীপোষককে মেরে ফেলার আইডিয়া দিয়েছেন, তিনি বললেন পুলিশ বাহিনীর সামনে একাধিক বিশ্বরেকর্ডের রেকর্ডের হাতছানি আছে। প্রথমত দ্রুততম সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির রেকর্ড, দ্বিতীয়ত মাঠে না গিয়ে একই স্থানে বসে থেকে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির রেকর্ড, তৃতীয়ত একটি টেবিলে বসে থেকে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির রেকর্ড। আমরা এমন কিছু রেকর্ড অর্জন করতে পারবো, যা পৃথিবীর কোন পুলিশ বাহিনী করতে পারেনি। এটা বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয় হবে।
লেখা খতিয়ে দেখার জন্য একজন ফেসবুক এক্সপার্ট এবং খতিয়ে দেখার পর ক্লুগুলো লেখার জন্য একজন টাইপরাইরাট প্রস্তুত। গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধানের নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে লেখা খতিয়ে দেখা শুরু হলো।
ফেসবুক এক্সপার্টঃ
স্যার শুরুতেই একটা ক্লু পাওয়া গেলো। নিহত লেখকের নাম দেখে বুঝা যাচ্ছে সে একটি মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার নামের আগে মুহম্মদ লাগানো নেই।
আইজিপিঃ
কী নাম লেখা আছে?
এক্সপার্টঃ
নাজিমুদ্দিন সামাদ।
আইজিপিঃ
হোয়াট ডু য়্যু মীন বাই নাজিমুদ্দিন সামাদ? ইজ ইট নাজিম উদদীন সামাদ?
এক্সপার্টঃ
না স্যার, এই যে প্রজেকশনে দেখুন।
ডিএমপি কমিশনারঃ
যা ভেবেছি তাই। এটাতো স্যার পুরাই একটা অনুভূতি কেইস। ভেরি স্যাড!
আইজিপিঃ
টাইপরাইটার লিখো, যেহেতু তার নামের আগে মুহম্মদ নাই এবং নামের বানান বিকৃত করেছে, সেহেতু খুনের ঘটনাটি সন্ধ্যায় ঘটেছে। এক্সপার্ট, তারপর খতিয়ে দেখো।
ডিআইজিপিঃ
স্যার, আমি একটা কথা বলবো। এই বৈঠকে, আই মীন এই টেবিলে বসে থাকাদের মাঝে অন্তত দুই জনের নামের আগে মুহম্মদ নেই। এটা স্যার পুলিশ বাহিনীর জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। আজ সাধারণ মানুষ যে পুলিশকে দুই চোখে দেখতে পারে না, তা এসব পাপিষ্ঠদের পাপের ফসল। মুসলমান হয়েছে, অথচ নামের আগে মুহম্মদ নেই। আমারতো সন্দেহ হয় এদেরকে মুসলমানি করানো হয়েছে কিনা।
এক্সপার্টঃ
মুহম্মদ নাজিম উদদীন সামাদের একটি কভার ফটোতে মানবজাতির উদ্ভব বিষয়ে বিজ্ঞানের সাথে ধর্মীয় মতবাদের তুলনা করে দেখানো হয়েছে ধর্মীয় মতবাদ ভুয়া।
আইজিপিঃ
ওহ মাই আল্লাহ! সত্যি সে এটা করেছে! আনবিলিভেবল!! ৯৫ ভাগ মুসলমানের দেশে বসবাস করে কভার ফটোতে মানুষ এসব কিভাবে শো করে! এটা পরিষ্কার কুফরী কাজ। টাইপরাইটার, তাহলে এর দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে যখন এই কাফিরকে খুন করা হয়, তখন সে রাস্তায় হাঁটছিলো। তারপর…
এক্সপার্টঃ
আরেকটি কভার ফটোতে সে নাস্তিক অভিজিৎ রায় এর ছবি ব্যবহার করেছে।
যুগ্ম কমিশনার ডিবিঃ
স্যার, একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে আমার অবজারর্ভেশন বলে এই খুনের পরিকল্পনা নিহত ব্লগার নিজেই করেছে। আপনি দেখুন স্যার, একজন নাস্তিকের ছবি কভার ফটোতে ঝুলানোর মানে হচ্ছে মুহম্মদ নাজিম উদদীন সামাদ নিজেকে নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। আমরা যদি এটাকে অনুবাদ করি, তাহলে যেটা পাই সেটা হলো, “আমি নাস্তিক, এসো আমাকে খুন করো।“
আইজিপিঃ
দারুণ বলেছো তুমি। টাইপরাইটার, স্পষ্ট করে লিখো খুনের পরিকল্পনাকারী নিহত নাস্তিক নিজেই।
এক্সপার্টঃ
এই নাস্তিকের ওয়ালে একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে সে উদাম গায়ে মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। বুকে আর পেটের উপর লেখা রাজাকার নিপাত যাক। এই যে স্যার, প্রজেকশনে বড় করে দেখুন।
ডিসি, ওয়ারী জোনঃ
নাউজুবিল্লাহ! স্যার, উদাম গায়ে জাতীয় পতাকা মাথায় বাঁধা জারাজার গুনাহ। তাছাড়া পতাকা ব্যবহারের কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী আছে। এটা স্যার কখনোই মাথায় বাঁধা যাবে না। এই নাস্তিক যা করেছে তা রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। সে রাষ্ট্রের নিশানার অপমান করেছে।
আইজিপিঃ
গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। নোট ইট। এক্ষেত্রে লিখতে হবে, নিহত নাস্তিক একই সাথে পুলিশকে আহবান করেছে তাকে গ্রেফতার করতে এবং পিটিয়ে পাছার ছাল তুলে ফেলতে। ভাগ্য ভালো সে মরে গেছে। জীবিত থাকলে এখন পুলিশ তার এই আহবানে সাড়া দিতো। স্টুপিড কোথাকার।
এক্সপার্টঃ
খতিয়ে দেখার এই অবস্থায় এসে দেখা যাচ্ছে এই নাস্তিক মরার পর তার ফেসবুক ওয়ালজুড়ে শত শত নাস্তিকদের পোস্ট। সবাই বিচার চাইছে। অনেকে কান্নাকাটি করছে।
আইজিপিঃ
এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এক নাস্তিকের জন্য অপর নাস্তিকের টান থাকবে। যেমন পুলিশের জন্য পুলিশের টান আছে। তো, এই টান বিশ্লেষণ করলে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে নাস্তিকটি আগে থেকে জানতো তাকে খুন করা হবে। কারণ সে নিজেই পরিকল্পনা করেছিলো। আর যেহেতু তার মৃত্যুর পর একাধিক নাস্তিক কান্নাকাটি করছে, সেহেতু হত্যাকান্ডে একাধিক খুনী অংশ নিয়েছে। এটা মোটেও একজন খুনীর কাজ নয়।
এক্সপার্টঃ
মৃত্যুর ২৪ ঘন্টা আগে দেয়া একটা পোস্টে দেখা যাচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমালোচনা করেছে এবং সরকারকে জনরোষের হুমকী দেখিয়েছে। বলেছে সরকার নাকি রেহাই পাবে না।
আইজিপিঃ
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমালোচনা! মানে নাস্তিকের বাচ্চা পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দিয়েছে। ব্লাডি নাস্তিক! আর সরকারকে হুমকী? মানে রাষ্ট্রকে হুমকী! মাথায় পতাকা বেঁধেই ক্ষান্ত হয়নি, আবার রাষ্ট্রকেও হুমকী দেয়। এখন আমরা যদি এই দুইটা বিষয়ে আলোকপাত করি, তাহলে দেখতে পাই যে, চাপাতির আঘাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। এবং সেটা একজনের চাপাতির আঘাতে নয়। একাধিক ব্যক্তির চাপাতির আঘাতে।
এক্সপার্টঃ
তার ওয়ালে অন্য একজনের পোস্ট করা একটা স্ক্রীণশটে দেখা যাচ্ছে, জানুয়ারি মাসে তার দেয়া এক পোস্টে বলেছে যারা শতভাগ ধর্ম মানতে চায়, তারা জঙ্গী। আর এই টেবিলে যারা আছি, মানে আমাদের মত যারা আংশিক ধর্ম মানি, তারা মডারেট। সে আরো বলেছে, আমরা, মানে মডারেটরা আছি বলেই ধর্ম এখনো বিশ্বমানবতার প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়নি।
আইজিপিঃ
যাক বাবা, সে পুলিশকে জঙ্গী বলেনি, মডারেট বলছে। এবং বাংলাদেশ পুলিশের কারণে ধর্ম এখনো বিশ্বমানবতার প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। কী দারুণ কমপ্লিমেন্ট! ভেরি ওয়েল সেইড। তো, এবার বোধহয় আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস উদঘাটন করতে পেরেছি। এই নাস্তিককে মারার সময় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও হয়েছে। অর্থাৎ চাপাতি দিয়ে কোপানোর পর তাকে গুলিও করা হয়েছে। এখানে ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট হলো, এর আগে কোন নাস্তিককে হত্যার সময় গুলি করা হয়নি। এটা কিন্তু ঘটনার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্ট।
এক্সপার্টঃ
স্যার, খতিয়ে দেখতে দেখতে এবারতো ভয়ংকর একটা জিনিস পেলাম। মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষার বিরোধিতা করেছে এই বদমাশ। সে বলেছে এর মাধ্যমে নাকি জঙ্গী উৎপাদন হবে।
আইজিপিঃ
উফ! আমি আর নিতে পারছি না। এসব কিছু আমার সহ্য ক্ষমতার বাইরে। এটা বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই না। টাইপরাইটার লিখো, যেহেতু নাস্তিকটা মসজিদ নিয়ে আকথা কুকথা লিখেছে, সেহেতু বুঝাই যাচ্ছে খুন করার সময় খুনীরা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে ঘটনাস্থল মুখরিত করে রেখেছিলো। এই লাইন লেখার পর সুবহানাল্লাহ লিখে বোল্ড আর ইটালিক করে দিও।
এক্সপার্টঃ
স্যারগো, এবার যা দেখলাম, তা বলার মতো সাহস আমার নাই। হারামজাদা তনু হত্যা নিয়ে খুব সেনসেটিভ মন্তব্য করেছে। এবং সারা দেশের মানুষকে কুমিল্লা গিয়ে ঝাঁকুনি দিতে বলেছে। স্যার, তনু হত্যা যেহেতু সেনানিবাসে হয়েছে, সেহেতু সে আসলে সেনানিবাসে ঝাঁকুনি দিতে বলেছে। কতটা সেনসেটিভ ইস্যু, আপনি খেয়াল করেছেন?
এসআই মতিনঃ
শেষপর্যন্ত আমাদের গর্বের সেনাবাহিনীকে ঝাঁকুনি দিতে বলে নাস্তিক **** পুত এই দেশের জনগণের সেনানুনুভূতিতে আঘাত করেছে। কী নোংরা একটা নাস্তিক! থু!!
আইজিপিঃ
খুবই হতাশাজনক বিষয়। এটা সে কিভাবে করলো! কিভাবে সে সেনাবাহিনী নিয়ে এরকম আচরণ করতে পারলো? এটাতো দেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত। খুব করুণা হচ্ছে এই অপদার্থ রাস্কেল নাস্তিকটার জন্য। যাইহোক, তার এসব স্পর্ধা ধারা প্রমাণিত হয়, খুন হওয়ার পর তার লাশ রাস্তায় পড়েছিলো, মিরপুর স্টেডিয়ামে কিংবা চন্দ্রিমা উদ্যানে নয়। অর্থাৎ এটা নিয়ে কোন বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।
ওসি, সূত্রাপুর থানাঃ
কিন্তু এক্সপার্ট, তুমি যেভাবে চুলচেরা খতিয়ে দেখছো, তাতেতো আমাদের বিশ্বরেকর্ডের বিষয়টা হুমকীর মুখে চলে যাচ্ছে। যতদ্রুত খতিয়ে দেখা শেষ করবে, ততদ্রুত তদন্ত শেষ হবে, তারচে অধিক দ্রুত আমাদের বিশ্বরেকর্ড হয়ে যাবে। শুনো, এরকম চান্স বারবার আসে না। তুমি একটু দ্রুত হাত চালাও।
এক্সপার্টঃ
চিন্তা করবেন না ওসি সাহেব। আমি খতিয়ে দেখার একেবারে শেষ পর্যায়ে। শেষ পর্যায়ে এসে একটি হৃদয় বিদারক বিষয় উল্লেখ করবো। আমি জানি এটা বলার পর এখানে অত্যন্ত আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমি দুঃখিত, অত্যন্ত দুঃখিত। কিছু করার নাই। এই নাস্তিকের প্রোফাইল ফটোতে দেখা যাচ্ছে তার গায়ে মুজিব কোট। আরো দুঃখের বিষয় হচ্ছে ঘৃনিত এই নাস্তিক বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ সিলেট শাখার তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক। এই পর্যায়ে আমি আর চোখের জল ধরে রাখতে পারছি না। আমায় আপনারা ক্ষমা করুন। জীবনে এই প্রথম টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে কান্না করছি। আমি লজ্জিত।
আইজিপিঃ
এখানে লজ্জার কিছু নাই এক্সপার্ট। তুমি যা বললে, তা শুনে এখানে উপস্থিত সবারই কমবেশি কান্না পাচ্ছে। কিন্তু আমার পাচ্ছে না। আমি আসলে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছি। বিশ্বাস করতে পারছি না এই ছেলে আওয়ামীলীগের কর্মী। কী বলবো বুঝতে পারছি না। আমার আর কীইবা বলার আছে। আওয়ামীলীগে এইভাবে নাস্তিক ঢুকে যাচ্ছে, অথচ ঠেকানোর কোন উপায় নেই। একটি আওয়ামীলীগ ধ্বংস করার জন্য একফোটা নাস্তিকই যথেষ্ট। সেই জায়গায় পুরো একপিস নাস্তিক! আওয়ামীলীগকে বুঝি আর টেকানো গেলো না। জনগণের আশা আকাংখার প্রতীক, মাটি ও মানুষের প্রাণের দল, মুসলিম জাহানের অংহকার, মদীনা সনদের পতাকাবাহী আওয়ামীলীগ এভাবে হারিয়ে যাবে!
ডিআইজিপিঃ
স্যার, তদন্ত প্রতিবেদনে এটা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে যে, দলে নাস্তিকের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতাদের আরো কঠোর ও বিচক্ষণ হতে হবে। নইলে আওয়ামীলীগের গৌরব ধুলিস্মাৎ হয়ে যাবে। ডজন ডজন নাস্তিক হত্যা করেও তা ফিরে পাওয়া যাবে না।
আইজিপিঃ
যাইহোক তদন্তের বিষয়ে আসি। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। এটা আনপ্রেডিক্টেবল ছিলো। তদন্তের বিষয়টাকে যত সহজ ও সরল ভেবেছি, ততটাই দুর্বোধ্য হয়ে গেছে। গন্ডমূর্খটা যেসব লিখেছে, তা পড়ার পর মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। আপনাদেরকে কিভাবে বুঝাই, মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে এই পোশাক খুলে চাপাতি হাতে দ্বীনের পথে বেরিয়ে যাই। থাক, তদন্তে ফিরে যাই। এখানে নিহত নাস্তিকের গায়ে মুজিব কোট থাকার মানে হচ্ছে চাপাতি দিয়ে কোপানোর পর আবার গুলি করে মারার বিষয়টি দুঃখজনক। আর আওয়ামীলীগের সহযোগী সংগঠনের সংগঠক হওয়ার মানে হচ্ছে, তার এসব লেখালেখি করা ঠিক হয়নি। তো, আমরাতো তদন্ত প্রতিবেদনের সবকিছু বের করলাম, এবার দরকার উপসংহারের জন্য দুইটা লাইন। এটা হতে পারে “ব্লগার খুন একটি অপরাধ। আর মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে লেখালেখি করা এক্সট্রিমলি গর্হিত অপরাধ।“
ডিএমপি কমিশনারঃ
তারপরও আমরা যদি কয়েকজন জঙ্গীর সাথে কথা বলে তাদের বক্তব্য এই প্রতিবেদনে এড করি, তাহলে ভালো হতো না?
আইজিপিঃ
স্যরি কমিশনার, আপনার আইডিয়াটা রাখতে পারলাম না। জঙ্গীদের বক্তব্য নিতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। বিশ্বরেকর্ড হবে না। তদন্ত এখানেই শেষ। এবার ঘড়ি দেখে বলুন, তদন্ত শেষ করতে ঠিক কত মিনিট সময় লেগেছে। তারপর গিনেস বুককে ফোন লাগান।
লেখা খতিয়ে দেখা শেষ, মদীনা সনদের বাংলাদেশ।

ঈশ্বর আমার মৃত্যু কামনা করেন

লিখেছেন
যার যার ঈশ্বর দেখতে তার তার পূর্ব পুরুষদের মতন। ঈশ্বরের চেহারায় পূর্ব পুরুষদের ছাপ থাকে। গতরাতে আমার ঘুম আসছিলো না। এমনিতে ঘুম না এলে স্বপ্ন আসে। এদিন স্বপ্ন আসেনি, তাই তিনি এলেন। তিনি বললেন, দেখো, আমার চেহারায় তোমার বাবা ও দাদার ছাপ আছে। আমিই তোমার ঈশ্বর।
নিজেকে আধুনিক ঈশ্বর বলে দাবি করেন এবং বলেন, তিনি আসবেন তাই আমার ঘুম আসেনি। আমি নাকি তার জন্য অপেক্ষা করছি। এ কথা শুনে কিছুক্ষণ হাসলাম। তিনিও হাসলেন।
ঈশ্বর এলেন মৃত্যুর দাবি নিয়ে। তিনি চান আমি যেন স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যুবরন করি। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, আমার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এনেছেন এবং বলেছেন এসব মেনে নিতে। ঈশ্বর যখন অভিযোগসমূহ বলছিলেন, তখন তাকে খুব রাগান্বিত দেখিয়েছে। বেশ ক্ষুব্ধতার সাথে তার অভিযোগ বললেন।
-গত বর্ষায় বৃষ্টির দিনে তোমার বাসার বাম পাশের গলির মুখে যমদূত পাঠিয়েছিলাম। কথা ছিলো তুমি খুন হবে এবং বৃষ্টির জলধারা রক্তে লাল হয়ে নেমে পড়বে ওয়াসার ড্রেনে। কিন্তু তুমি গেলে ডান পাশের গলি দিয়ে এক সুন্দরী নারীর ছাতা ভাগাভাগি করে।
-দুঃখিত। বিষয়টা আমি জানতাম না।
– তার কিছুদিন পর অফিসের পাশে আন্ডারপাসের সিঁড়িতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকার কথা ছিলো। যেখানে সিঁড়ি শেষ, সেখানে সামান্য জল জমে থাকবে আর তোমার রক্ত সিঁড়ি বেয়ে সেই জলে মিশে যাবে। অথচ তুমি সেদিন অফিসেই গেলে না। বাসায়ও ছিলে না।
– আপনার এই পরিকল্পনার কথাও আমার অজানা ছিলো।
– পরের সপ্তাহের একদিন রাত বারোটায় তোমার সিগারেট শেষ হয়ে গেলে সিগারেট কিনতে বের হবে। ওঁৎ পেতে থাকা যমদূত তোমার প্রাণ নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। এই দেখো, ঠিক এরকমই লেখা আছে তোমার প্ল্যান বুকে। সিগারেট ঠিকই শেষ হয়েছে। কিন্তু সিগারেট কিনতে বের হয়েছিলো তোমার বন্ধুর গাড়ির ড্রাইভার। এবং সেটা তোমার বন্ধুর বাসায়। মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বৌ বাচ্চাকে ঘরে একা রেখে বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলে মদ খেতে, আড্ডা দিতে। যমদূত দেখেছে তোমার স্ত্রী ভয়ে সারা রাত ঘরে আলো জ্বেলে রেখেছিলো। অথচ তোমার কোন লজ্জা হয়নি।
-বন্ধুর বাসায় গিয়ে মদ খাওয়া এবং আড্ডা দেয়ার বিষয়ে আমার স্ত্রীর কোন অভিযোগ ছিলো না। সে আলো ভালোবাসে, তাই আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলো। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের পরিবারের সবাই অন্ধকারে অনভ্যস্ত।
ঈশ্বর বললেন, আমাদের পারিবারিক বিষয়ে তার কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু আমি যা করেছি, কিছুই তার পরিকল্পনায় ছিলো না। আমি নিজ পরিকল্পনায় চলছি এবং আইন অনুযায়ী একজন বিদ্রোহী। কিন্তু যেহেতু নিজস্ব পরিকল্পনায় চলার যোগ্যতা অর্জন করেছি, সেহেতু যোগ্যতার মর্যাদাস্বরূপ কোন শাস্তি পেতে হবে না। শুধু তার পরিকল্পনা মতে মৃত্যুকে বরন করে নিলেই তিনি খুশি।
খুব জোরশব্দে হাসার চেষ্টা করলাম। পেরেছিও। এমন উচ্চস্বরে খুব টান টান দম নিয়ে এর আগে কখনো হাসিনি। আমি জানি কারো হাসির শব্দ দূর থেকে মনযোগ দিয়ে শুনলে খুব বিশ্রী লাগে। অস্বস্তিকর। হাসি থামিয়ে জানতে চাইলাম আমাকে কেন এভাবে পথে ঘাটে মরে থাকতে হবে এবং আমার রক্ত কেন উচ্ছিষ্ট জলে গিয়ে মিশবে? এমন অপ্রচলিত মৃত্যুর কারণ কী?
ইশ্বর ভরাট গলায় বললেন, তোমার দেশের বেশিরভাগ মানুষ এরকম মৃত্যু পছন্দ করে। তাছাড়া তোমার বন্ধুদের মধ্যে যারা এর আগে এভাবে মারা গেছে, তাদের মৃত্যু দেশের অধিকাংশ মানুষকে আহত করেনি। অর্থাৎ তোমাদের জন্য এটাই প্রচলিত মৃত্যু।
– কিন্তু বিষয়টাতো আমার উপর নির্ভর করছে। এভাবে মারা যাওয়া আমার পছন্দ নয়। আমি আরো সম্ভ্রান্ত মৃত্যু চাই।
– শোনো, তোমার দেশে এখন একপক্ষ মরছে, আরেকপক্ষ মারছে। এরা সংখ্যায় কম। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এসব মৃত্যুর জন্য যারা মরছে তাদেরকে দোষ দিচ্ছে। তোমার উচিত জনমতকে শ্রদ্ধা জানানো। আমি চাই তুমি আরো গণতান্ত্রিক হও।
– এসব কথা আপনার মত করে বলছেন। মানুষের মত পরিবর্তন হয়। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আপনি এমন একজনকে মানুষের মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মরে যেতে বলছেন, যে কিনা মানুষের মত পরিবর্তনের জন্য কাজ করে। আপনি যুক্তি ছাড়া কথা বলছেন। আপনি একজন অযৌক্তিক ঈশ্বর।
এরপর ঈশ্বর বললেন আমি যেন তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করি। তিনি আমার বয়সে ছোট। আমার আর আমার ঈশ্বরের জন্ম একই সময়ে হয়নি। আমার জন্মের অনেক পরে নাকি তাকে সৃষ্টি করেছি।
-মিথ্যা কথা। আমি তোমাকে সৃষ্টি করিনি।
– তোমার বাবা, দাদা, মক্তবের হুজুর, স্কুলের শিক্ষকরা মিলে আমাকে তোমার জন্য সৃষ্টি করেছে। এরপর তুমি ধারণ করেছো।
– কিন্তু শেষে তোমাকে ঘৃনা করেছি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি।
-হ্যাঁ, ঘৃনার আড়ালে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। সেই ভালোবাসার টানে এসেছি। তুমি রাজি হও, খুন হয়ে যাও। প্লীজ!
– কী অদ্ভুত!
– আচ্ছা তোমরা ঈশ্বরকে সৃষ্টি করার পর যে পরিমান ক্ষমতা বা পাওয়ার দিয়ে থাকো, সত্যি সত্যি যদি কেউ সমপরিমান মহাপরাক্রমশালী হয়ে তোমার প্রাণ নিতে আসে, তুমি কি তাকে বাধা দিতে পারবে?
– আমরা কি কোন ব্যাটারিচালিত ঈশ্বর নিয়ে আলোচনা করছি? এ বিষয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই।
এবার তিনি খুব হতাশ হলেন। আমার কাছে এরকম আচরণ আশা করেননি। কথাটিকে গালি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তার মতে ঈশ্বররা অদৃশ্য ক্ষমতায় চলেন, তাদের কোন ব্যাটারির প্রয়োজন হয় না। অথচ তার মতামতকে আমি এতটুকু মূল্য দিইনি। এমন কথার জবাবে তাচ্ছিল্যে হাসি হাসলাম।
তার সাথে আলোচনায় আগ্রহ হারাচ্ছি দেখে তিনি আমার সাথে মৃত্যুর উপায় নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মৃত্যুর কথা বললেন। ঈশ্বরের মতে এটা একটা সুযোগ। তিনি আমাকে মৃত্যুর অপশন দিবেন। সেখান থেকে পছন্দসই উপায়ে মারা যেতে পারবো। এই বিশেষ সুযোগটি কেবল আমার জন্য। এরকম বললেন।
– মনে করো তারা তোমাকে নিয়ে একটি ৩০ তলা দালানের উপর উঠলো। তারপর চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। দালানের যে পাশে ধাক্কা মারবে, সে পাশে থাকবে একটি সুন্দর ফুলবাগান। সেক্ষেত্রে তোমার রক্ত ফুল বাগানের মাটিতে মিশে যাবে। সার হবে এবং সেই সারের পুষ্টিতে বাগানে আরো বেশি বেশি ফুল ফুটবে। রক্ত ড্রেনের জলে মিশে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
রক্তের শক্তিতে হৃষ্টপুষ্ট ফুলের জবাবে আমি কিছু বলিনি।
– অথবা ধরো তারা তোমাকে একটি বড় মাঠে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করলো। তারপর ঠিক সেখানেই মাটিতে পুঁতে ফেললো।
– জ্যন্ত পুঁতে ফেললে কী হয়?
– যাদের জন্য তুমি মারা যাবে, তাদের আত্মতৃপ্তির একটা ব্যাপার থাকে না! চাপাতি দিয়ে কোপানোর বিষয়টা এখন কালচার। এভাবেই হচ্ছে।
– বাদ দাও এসব।
– আচ্ছা, আরো একটা উপায় বলি। প্রথমে তারা একটি গর্ত খুঁড়লো। এরপর তোমাকে সেখানে শুইয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মাটিচাপা দিয়ে দিলো। এতে আপত্তি আছে?
– তুমি কি ঈশ্বর? নাকি ডেথ প্ল্যানার? এত নৃশংস মৃত্যু পরিকল্পনা নিয়ে বেঁচে আছো। তোমার লজ্জা করে না?
– দেখো, ঈশ্বর কখনো কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। তিনি যে কাজে দক্ষ, সেটা হচ্ছে মৃত্যু। আজ পর্যন্ত দেখেছো ঈশ্বর কাউকে বাঁচিয়ে রেখেছে? সবাই মরে যায়। মরতে হয়।
উনার কথা শুনে আমার গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো। তখনো ভোর হতে ঘন্টাখানেক বাকি ছিলো। বমি করার জন্য যথেষ্ট সময় ছিলো। চেষ্টাও করেছি, কিন্তু হয়নি। ঠান্ডা মাথায় তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি, যেহেতু আমি তাকে বিশ্বাস করি না, সেহেতু তিনি যেন আমার কাছে না আসেন। আমার এসব ভালো লাগে না।
আরেকটি কথা তাকে স্পষ্টভাবে বলেছি। তার ইচ্ছা অনুযায়ী মারা যাওয়ার কোন আগ্রহ আমার নেই। তিনি বললেন আগ্রহ যে নেই, এটা পুরোপুরি ঠিক না। তার দেয়া মৃত্যুর অপশন বিষয়ক আলোচনায় আমি অংশ নিয়েছি এবং জ্যন্ত পুঁতে ফেলার মত একটি অপশন প্রস্তাব করেছি। পরোক্ষভাবে এটা নাকি আমার সম্মতি। আমি বলেছি, এটা আমার সম্মতি নয়। বরং এটা হচ্ছে ভয়। কখনো যদি খুনীর মুখোমুখি হই, তখন হয়তো তাদের কাছে রক্তপাতহীন মৃত্যু দাবি করবো। আমি লাল গোলাপ, লাল শিমুল, লাল ফিতা, লাল চুড়ি, লাল জুতো, লাল সূর্য, লাল ওয়াইন পছন্দ করি। কিন্তু রক্ত নয়। এতকিছু বলার পরও তিনি আমার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলেন। খুব অসহায়বোধ করলাম।
-কিছু কথা বলি, মন দিয়ে শোনো। এই দেশে তুমি যখন তখন মরে যেতে পারো। মনে করো তুমি অটোরিক্সা করে কাওরান বাজার থেকে মতিঝিল যাচ্ছ। একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তোমাকে বহন করা অটোরিক্সাটি চাপা দিলো। তুমি গেলে। অথবা মনে করো শশুর বাড়ি যাওয়ার সময় লঞ্চে করে পদ্মা নদী পাড়ি দিচ্ছো। একটি ডুবো চরে ধাক্কা খেয়ে লঞ্চের তলায় ফাটল ধরে পানি ঢুকে ডুবে যেতে লাগলো। ক্লান্ত শরীরে তুমি তখন ঘুমিয়ে আছো। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে লঞ্চের সবগুলো লাইফবয় অন্য যাত্রীরা দখল করে নিলো। অনেক কিছু আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে চাইলে, কিন্তু পারলে না। ডুবে মরলে।
– প্লীজ, এসব বন্ধ করো। তুমি এত বর্বর কেন? একটি মৃত্যু নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন? এটা খুব বোরিং।
– এমনওতো হতে পারে তোমার বাসায় আগুন লাগলো। বৌ বাচ্চাদের বাসা থেকে বের করতে গিয়ে শেষে নিজেই আটকা পড়লে। আচ্ছা মানলাম তুমি আগুনে পুড়ে মরলে না। কিন্তু ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মরে গেলে। আসলে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে, জঙ্গীদের হাতে চাপাতির কোপ খেয়ে না মরলেও অন্য অনেক কারণে মরে যেতে পারো। এখানে মরার জন্য হাজারটা সহজলভ্য উপায় আছে। মরেই যখন যাবে, তখন আগামীকালই মরবে না কেন? আচ্ছা ঠিক আছে। পরশু মরো। অথবা তার পরদিন। তুমি একটা ডেট দাও। সেদিন যমদূত পাঠাবো। কোন ঝামেলা না করে মরে যাও।
– প্রয়োজনে আমি দেশ ছাড়বো। এমন দেশে যাবো, যেখানে মৃত্যুর হাজারটা সহজলভ্য উপায় নেই।
– কোথায় যাবে? জামার্নী, সুইডেন, নরওয়ে, কানাডা, নেদারল্যান্ডস অথবা মনে করো সুইজারল্যান্ডই গেলে। সবগুলো শীতের দেশ। মনে করো এমন শীত পড়লো যে, তুমি বরফে জমে গেলে। মৃত্যু কিন্তু তোমার পিছু ছাড়বে না। আচ্ছা বাদ দাও। শোনো, তোমার সাথে কথা বলাটা এখন আর এনজয় করছি না। খুব বোরড ফীল করছি। এটা দ্রুত শেষ করো।
আসলে ততক্ষণে আমিও খুব বিরক্ত ও বিব্রতবোধ করছিলাম। কখনো ভাবিনি ঈশ্বরের সাথে শুধু মৃত্যু নিয়ে কথা বলবো। কিছুদিন ধরে প্রচুর মুভি দেখছি। কয়েকটা মুভিতে ভয়াবহ প্লটহোল খুঁজে পেয়েছি। খুব ভালো হতো যদি উনার সাথে মুভি নিয়ে কথা বলতে পারতাম। অথবা আমার ছোট ছেলের মাথার চুল নিয়ে। তার চুলগুলো খুব দ্রুত বাড়ছে এবং বাদামী হয়ে যাচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা পারিবারিকভাবে অত্যন্ত ব্যস্ত। তার চুলের বেড়ে উঠা এবং রং পরিবর্তন নিয়ে বেশিরভাগ সময় আলোচনা করি। কিন্তু ঈশ্বর এলেন শুধুই মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে। অসহ্য। এমনকি আমার সাথে তার কোন ভালো সম্পর্কও নেই। আমার কাছে তিনি মঞ্চের ভাঁড়ের চাইতে হাস্যকর, এবং ভাঙা মদের গ্লাসের চাইতে বিরক্তিকর। কখনোই আমি তাকে আশা করিনি।
– এতো বেশি ঘৃনা করা ঠিক না। তোমার চারপাশে অনেক উদাহরণ আছে। যারা একসময় আমাকে খুব ঘৃনা করতো, এখন তারচে বেশি ভালোবাসে। যখনই তুমি আমাকে ঘৃনা করতে থাকবে, তখনই আমি আশাবাদী হতে থাকবো। কারণ আমি জানি একসময় তুমি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসবে। তাছাড়া তুমি যদি আমাকে আশা না করতে, আমি এখানে আসতে পারতাম না। যেভাবেই হোক, তুমি আমাকে আশা করেছ। তাই এসেছি।
– না, আমি তোমাকে আশা করিনি। একটুও না।
– তাহলে তোমার স্বপ্ন আসেনি কেন? তুমি কী অস্বীকার করতে পারবে যে দিন দিন কেমন স্বপ্নহীন হয়ে যাচ্ছো। ঈশ্বরের কোন ক্ষমতা নেই আত্মবিশ্বাসী কোন স্বপ্নবান মানুষের কাছে ঘেঁষার। আজ তুমি সম্পূর্ণরূপে স্বপ্নহীন ছিলে বলেই আমি এসেছি। অথচ কেমন বাজে ব্যবহারটাই না করলে। যদিও তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হইনি। কারণ মানুষের প্রতি এখন আর আমার কোন বিশ্বাস নেই। মানুষ নিজে যাকে সৃষ্টি করে, আবার তাকেই ধ্বংস করে।
– এতক্ষণে একজন অভিমানী ঈশ্বরের দেখা পেলাম। হা হা হা।
– দেখো, আমি আমাকে সৃষ্টি করিনি। এটা সম্ভব না। তোমরা ঈশ্বর বানাও, ধর্মগ্রন্থ বানাও। আবার ঈশ্বরকে ধ্বংস করো, ধর্মগ্রন্থ নিয়ে হাসাহাসি করো। এসব গ্রন্থ কি আমি লিখেছি? তোমরা এখন এসব গ্রন্থকে হাস্যকর বলো, উদ্ভট বলো। অথচ এগুলো তোমাদের পূর্ব পুরুষরাই লিখে গেছে। তোমরা নিজেরা যা জানো না, যা বুঝো না, যা আবিষ্কার করতে পারোনি, তার সবকিছু ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছো। তোমাদের সকল ব্যর্থতার ভার আমাদেরকে বহন করতে হয়। অনেক সময় কৃতিত্বের ভাগও দাও। কিন্তু সেটা সবসময় না। তোমরা নিজেদের মত করে আমাদেরকে মহিমান্বিত করেছো। তারপর আবার তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করছো। তোমরা আমাকে নিয়ে খেলছো। এটা খুবই ফালতু একটা গেইম, যা তোমরাই সৃষ্টি করেছো।
– বলে যাও। খারাপ লাগছে না।
– আমাকে তোমার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ আজ তুমি আমাকে স্বীকার করো না। আমি তোমার কাছে আসার জন্য, পাশে বসার জন্য শকুনের মতো তাকিয়ে থাকি। কখন একটু সুযোগ পাবো, এই আশায়। বহুদিন পর আজ সুযোগ পেয়েছি। যতই অবহেলা, অপমান করো না কেন, আমার ভালো লেগেছে। তুমি হয়তো জানো না, একা থাকার কী কষ্ট।
– তোমার কথায় যুক্তি আছে। এতক্ষণে মনে হচ্ছে তোমার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
– কিন্তু আমাকে বলো কেন তুমি মরতে চাও না?
– আসলে এটা মৃত্যুর জন্য সঠিক বয়স নয়। তুমি জানো আমি এখন কী পরিমান ব্যস্ত। হাতে অনেক কাজ। তাছাড়া আমার দু’টো ছেলে এখনো অনেক ছোট। আমি তাদের যুবক বয়সটা দেখে যেতে চাই। তারা কিভাবে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলে, কিভাবে অন্যের কাছে আকর্ষনীয়ভাবে উপস্থান করে, তাদের প্রতি আমার কতটুকু প্রভাব নিয়ে বেড়ে উঠে, কেমন মেয়ের সাথে প্রেম করবে, এসব। তাছাড়া তাদেরকে সাথে নিয়ে আমি পাহাড় বাইতে যাবো। তারা আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। বলবে, কিভাবে পাহাড় বাইতে হয়।
– তুমি কি এটাকে তোমার স্বপ্ন হিসেবে নির্মাণ করেছো?
– অনেকটা তাই।
– তুমি আমাকে এভাবে দুর্বল করতে পারো না। আমিও কিছু স্বপ্ন নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। কিন্তু তোমার স্বপ্ন যেভাবে নির্মিত হয়, আমার স্বপ্ন একই সাথে একইভাবে ধ্বংস হয়। খুব মন খারাপ হলো। কিছুটা সময় একা থাকতে পারলে ভালো লাগতো। আশপাশে কেউ থাকলে মন খারাপ শেষ করা যায় না। বড়জোর এড়িয়ে যাওয়া যায়।
– তার আগে একেবারে সত্যি করে বলো, তুমি কেন আমাকে মারতে এত আগ্রহী।
– কারণ আমি মুক্তি চাই। তোমার আমার জন্ম একইসাথে না হলেও আমাদের মৃত্যু একইসাথে হবে। মানুষের মৃত্যুর পর আর তার ঈশ্বর বেঁচে থাকে না। ইশ্বর তার মালিক ছাড়া একা বাঁচতে পারে না। হয় আমাকে ভালোবাসো, নয় মুক্তি দাও।
আলোচনা এমন মানবিক রূপ ধারন করবে বুঝিনি। ঈশ্বরকে একটু একা থাকতে দিয়ে জলপান করতে রান্না ঘরে যাই। জগে জল ছিলো না। জার থেকে জল ঢেলে খুব প্রশান্তি নিয়ে পেটভরে জল নিলাম। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে ভোরের আলো ছড়িয়েছে। গতকালের ভোরের সাথে আজকের ভোরের বিশেষ পার্থক্য নেই। একইরকম আলো, একইরকম কুয়াশা। হঠাৎ খুব শীত শীত লাগছে। খেয়াল করে দেখি, আমার গায়ে একটি হালকা ফুলহাতা টীশার্ট। অথচ এতক্ষণ শীত গরম কিছুই অনুভব করিনি। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে রীতিমত কাঁপছি। দ্রুত শোবার ঘরে গেলাম সোয়েটার পরতে। গিয়ে দেখি আমি আমার বিছানার উপর বসে আছি। সোয়েটার পরে। শোবার ঘরে এখন দু’টো আমি। একটি সোয়েটার পরা, আরেকটি সোয়েটার ছাড়া। ঈশ্বর চেহারা পাল্টে হুবহু আমার রূপ ধরে বসে আছেন। বললেন, খুব শীত পড়ছে, এসো ঘুমিয়ে পড়ি।
তার কথা এড়িয়ে যেতে পারিনি। হঠাৎ চোখের পাতায় প্রচুর ঘুম নেমে আসে। বিছানার দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রতিদিন আমি দু’টো বালিশ মাথায় দিয়ে খাটের মাঝখানে ঘুমাই। ঈশ্বর বালিশ দু’টো পাশাপাশি রাখলেন। তিনি ডানের বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন। শীত থেকে বাঁচার জন্য আমিও দ্রুত বাম পাশের বালিশে শুয়ে পড়ি। ঠিক তখন কানের কাছে মুখ এনে ঈশ্বর ফিসফিস করে বললেন, “মারা যাওয়ার কথাটা মাথায় রেখো। চাইলে আত্মহত্যাও করতে পারো।“
তারপর আর কিছু মনে নেই। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ দুপুরে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি ঈশ্বরের বালিশে শুয়ে আছি। বাম পাশের বালিশটি খালি। শোবার ঘরে আমি ছাড়া কেউ নেই।

তার অনেকগুলো বদ অভ্যাসের একটি ছিলো উল্লাপাল্টা স্বপ্ন দেখা

লিখেছেন
শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটা যায় না। ডানে বামে তাকাতে হয়। এখন আবার পেছনেও তাকাতে হয়। পেছনে ঠিক কয়জন মানুষ হাঁটছে, কে কত দূরে আছে, কার হাঁটার গতি কেমন, একা কয়জন আর দলবেঁধে কয়জন, কার গালে দাঁড়ি আছে কার গালে নাই, ব্যাকপ্যাক আছে কিনা, যাদের ব্যাকপ্যাক আছে তাদের দৈহিক গড়ন কেমন, বয়স কত হতে পারে, আরো কত কী যে ভাবতে হয়! এক দেখায় এত কিছু মার্ক করা যায় না, কারণ পেছনে তাকিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে পারেন না মাঝ বয়সী লেখক ও কলামিস্ট কাজল মাহমুদ। তাই বার বার পেছনে তাকাতে হয়। গত এক বছর ধরে হাঁটার সময় এভাবে পিছনে তাকিয়ে এখন তার ঘাড় ব্যাথা রোগে ধরেছে। প্রতি সপ্তাহে একবার ডাক্তারের কাছে যান। এখনও ডাক্তারের কাছে যাবেন বলেই বাসা থেকে বেরিয়েছেন। বেরিয়েই গাড়ি পাওয়া যায় না। একটু হেঁটে সিএনজি অটোরিক্সা নিতে হয়।
বছরখানেক আগে এক ব্লগারের মৃত্যুর পর দৈনিক পত্রিকায় বিশাল প্রবন্ধ লিখেছিলেন। একটি ইসলামিক জঙ্গী সংগঠনের খুনী দল ওই ব্লগারকে তার বাসার কাছে কুপিয়ে হত্যা করে। পত্রিকার প্রবন্ধে কাজল মাহমুদ লিখেছেন “কোরআনে যুদ্ধ ও হত্যা বিষয়ক বিভিন্ন আয়াত পড়ে এবং সাহাবীদের জীবনী পড়ে বর্তমান সময়ের মুসলিম তরুণরা ধর্ম বিরুদ্ধ মানুষদের খুন করার উৎসাহ পায়।“ তিনি আরো লিখেছেন “যেসব মুসলমান ওইসব আয়াত ও জীবনী পড়ে খুন করতে উদ্বুদ্ধ হয় না, তাদের উচিত এসব খুনের প্রতিবাদ করা।“ ব্যস! তিনদিন পর ফোনে হুমকী পেলেন, এরপর পেলেন চিঠি। তার কয়দিন পর পেলেন ফেসবুকে মেসেজ। এরপর ইমেইল। পরপর এতগুলো মাধ্যমে হুমকী পেয়ে ভয় পেলেও একেবারে ভেঙ্গে পড়েননি তিনি।
এরপর থেকে হাঁটার সময় কিছুক্ষণ পর পর পেছনে তাকানোর অভ্যাস করতে হয়েছে। অভ্যাস নয় ঠিক, নিয়ম হয়ে গেছে। কারণ জঙ্গিরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে। তারা অসম্ভব ভীতু এবং সাহসী। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মানুষ খুন করার সাহস আছে তাদের।
এখন কাজল মাহমুদের পেছনে যারা হাঁটছে, তাদের মাঝে ৪ জনের একটা দল আছে। দুই জনের গালে দাঁড়ি আছে, দুই জনের নাই। একজনের হালকা দাঁড়ি, আরেকজনের খোঁচা খোঁচা। ব্যাকপ্যাক আছে সবারই। বয়স গড়ে বাইশ তেইশ হবে। বেশ সুন্দর সুঠাম দেহ সবার। এই মুহূর্তে এদেরকে নিয়েই কাজল মাহমুদের যত ভয়। ব্লগারদেরকে মারার অপারেশনে যারা যায়, তাদের সাথে এদের হুবহু মিল। তাই বার বার তাকাচ্ছেন।
এবার পেছনে তাকিয়ে ভালো করে দেখেন সবাই তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে এবং বেশিরভাগ মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কেউই সামনের দিকে আসছে না। কাজল মাহমুদ ভাবলেন, এটা আবার কী হলো! ওরা সবাই এভাবে দাঁড়িয়ে গেলো কেন। ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখেন পাঁচ জন যুবক চাপাতি তাক করে তার পথরোধ করে আছে। সবার মুখে কালো কাপড় বাঁধা। চেহারা দেখে চেনা যাচ্ছে না। এরা সবাই ফুটপাতের পাশে একটি দোকানে অপেক্ষমান ছিলো। কাজল মাহমুদ বুঝতেই পারেননি কখন তারা হুট করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো!
বুঝতে পারছেন না তার এখন কী করা উচিত। দৌড় দিবেন নাকি চিৎকার করবেন। কিন্তু চিৎকার করবেন কিভাবে, গলা একদম শুকিয়ে গেছে। ঢোক গিলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তিনি খেয়াল করলেন গায়ে কোন শক্তি নেই। কিছুক্ষণ আগে প্রস্রাবের বেগ ছিলো, এখন আর নেই। ঘাড়ের ব্যাথাও নেই। কোপ খেলে অনেক ব্যাথা লাগবে, এই বিষয়টাও মাথা থেকে চলে গেছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখে কোন বোধ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আশপাশে অনেক মানুষ, আবার মনে হচ্ছে কেউ নেই। এইখানে এই মুহূর্তে তিনি ভীষন একা। খুব দ্রুত প্রচন্ড শীতে গ্রাস হয়ে যাচ্ছেন। শরীরের ভেতরে শীতের ঢেউ টের পাচ্ছেন তিনি। অনেক শীত। পূর্ণ মাঘেও কখনো এতো শীত লাগেনি তার। তাছাড়া এটা কেমন যেন কাঁচা কাঁচা শীত, তরতাজা শীত। প্রথমে গায়ে এসে লেপ্টে যাচ্ছে, তারপর কামড়ে ধরছে। ঘটনার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এমন কাঁপুনি এলো যে দাঁতের দুই পাটি একে অপরের শত্রু হয়ে খুব পেটাচ্ছে। ঘাড়ের চারপাশ, চেয়াল ও মাথার বিভিন্ন জায়গায় কুঁচকানো শীতে শির শির করছে। মনে হচ্ছে চাপাতির কোপগুলো এসব জায়গায় পড়বে। নিহত ব্লগারদের ছবি দেখেছেন তিনি, এসব জায়গাতেই কোপায় তারা।
এটা ঘোর না, আবার বোধহীনও না। আবার অচেতন অবস্থা কিংবা তন্দ্রাচ্ছন্নতাও নয়। কেমন একটা শোধবোধহীন জেগে থাকা অবস্থা। এই অবস্থা ভেঙে গেলো মুখ ঢাকা যুবকদের একজনের কথায়।
– ভয় পাচ্ছেন কেন? আমরা আপনাকে মারতে আসিনি।
এমন সাবলীল কণ্ঠে কথাটি বললো, যেন চাপাতি দিয়ে টেবিল টেনিস খেলতে আসছে। বিশ্বাস হয় না কাজল মাহমুদের। তবুও মনে মনে খুশি হয়েছেন এই ভেবে যে, যেহেতু তিনি ব্লগার নন, সেহেতু হয়তো প্রাণে মারবে না। কয় কোপ দিয়ে ফেলে রেখে চলে যাবে। তারপর আশপাশের মানুষরা যদি সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং ডাক্তার পাওয়া যায় এবং অপারেশন থিয়েটার খালি পাওয়া যায় এবং পর্যাপ্ত রক্ত হাতের কাছে মিলে যায়, তাহলে এ যাত্রায় বেঁচে যাবেন।
– না, আমরা আপনাকে আঘাত করতে আসিনি। বিশ্বাস করুন, আপনার ঘাড়, মাথা কিংবা মুখে একটা কোপও দিবো না। অভ্যাসবশতঃ মুখোশ পরে এবং চাপাতি হাতে করে চলে এসেছি। এর মানে এই না যে আমরা আপনাকে কোপাবো। আবার এর মানে এও না যে আমরা আপনাকে ছেড়ে দিবো।
কাজল মাহমুদ মনে মনে বললেন, “বুঝলাম না!”
– বুঝাবুঝির কিছু নাই। হুজুর বলেছেন আপনাকে সাথে করে নিয়ে যেতে। কী একটা বিষয়ে জরুরী আলাপ আছে। আপাতত কোন কথা না বলে চুপচাপ আমাদের সাথে গাড়িতে উঠেন। ফেয়ার এন্ড ফ্রেন্ডলি। -শেষের শব্দ তিনটি একটু ধমকের সুরে বললো ছেলেটি।
কাজল মাহমুদের হঠাৎ মনে পড়লো ঘাড়ে ব্যাথার কথা। মনে পড়লো ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। ভাবছেন যেহেতু এরা তাকে মারতে আসেনি, সেহেতু মনে হয় ডাক্তারের কথা বললে ছেড়ে দিবে। কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। ডিম পাড়া মুরগির ডাকের মত কক কক শব্দ হলেও সেটা অন্য কেউ শুনতে পায়নি।
– সমস্যা নেই, পথে আপনাকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে যাবো। ঘাড় খুব সেনসেটিভ অঙ্গ। তাছাড়া আপনি চিন্তাশীল লেখক। মুক্তচিন্তার মানুষ। মানুষের সব চিন্তা থাকে মাথায়, ঘাড়ের উপর ভর করে মাথা থাকে। অর্থাৎ ঘাড় হচ্ছে মানুষের চিন্তার স্ট্যান্ড। স্ট্যান্ডে গল্ডগোল থাকলে মাথা ঠিকমতো কাজ করবে না। এতে করে চিন্তায়ও গোলমাল হতে পারে।
এই কথা বলে মুখোশধারী ছেলেগুলো কাজল মাহমুদকে একটা কালো গ্লাসের ঝকঝকে চকচকে নতুন মাইক্রোবাসে তুললো। গাড়িতে উঠে সিটে বসার সময় তার সবকিছু সচল হলো। চিন্তাশক্তি, বাকশক্তি, শরীরের চেতন ফিরে ফেলেন। কিন্তু বুঝতে পারছেন না এতক্ষণ কোন ছেলেটি তার সাথে কথা বলেছে। ছেলেটির কথার বুনন খুব সুন্দর। বাক্য গঠন ও শব্দচয়ন বেশ কমিউনিকেটিভ ও ইনোভেটিভ। এরকম ভাবতে ভাবতে দেখলেন সবগুলো ছেলে মুখের কালো কাপড় সরিয়ে নিলো। তাদের চেহারা দেখে কাজল মাহমুদ নিজের অজান্তে একেবারে আওয়াজ করে বলে ফেললেন – বাহ্ তোমাদের চেহারাও খুব সুন্দর। অসাধারণ।
একটি ছেলে বললো – মাহমুদ সাহেব, আপনার সাথে আমিই কথা বলেছি এতক্ষণ।
একে একে সবাই পরিচিত হলো। কিন্তু মাহমুদ সাহেব বুঝে ফেললেন এগুলো একটাও অরজিনাল নাম নয়। এসব তাদের ছদ্মনাম। বখতিয়ারের ঘোড়া, লাল তলোয়ার, নিপাট সত্য, মরু বীর, নিঃসঙ্গ আকাশ, এগুলো কোন মানুষের নাম হতে পারে না।
নিপাট সত্য নামের ছেলেটি বললো, আরে এসবতো আমাদের ফেসবুক প্রোফাইলের নাম। নাম নিয়ে আপনি এত চিন্তা করছেন কেন? মুক্তচিন্তার মানুষ হয়েছেন বলে কি সবকিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে? তাছাড়া নাম দিয়ে কী হয়! আমাদের প্রত্যেকেরই দশটি করে গুনবাচক নাম আছে। যেমন আমার দশটি গুনবাচক নাম হচ্ছে, পরোপকারী, সত্যবাদী, একনিষ্ঠ, সৎখেয়ালী, বিশ্বস্ত, অনুগত, ভ্রাতৃপ্রতীম, মিষ্টভাষী, মনযোগী ও একাগ্রচিত্তের মানুষ। এভাবে এখানে আমরা পাঁচজনের পঞ্চাশটি নাম আছে। সবগুলো গুণবাচক নাম। এসব নাম হুজুর দিয়েছেন। শুধু নাম নয়, হুজুর আমাদেরকে আরো অনেক কিছু দেন। বিশেষত প্রচুর দোয়া দেন। তার দোয়ায় আজ পর্যন্ত কোন অপারেশন ব্যর্থ হয়নি। তিনি অত্যন্ত দোয়াশীল হুজুর।
মাহমুদ সাহেব ভাবলেন ছেলেগুলো ভালো আছে। গাড়িতে যেতে যেতে তাদের সাথে আলোচনা করা দরকার। অনেক কিছু জানার আছে, জেনে নেয়া যাবে। সাহস করে বলে ফেললেন, কিন্তু তোমাদের বুকের ভেতরে আমি একজন করে খুনী দেখতে পাচ্ছি যারা মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যা করে।
– হ্যাঁ, আমরা খুন করতামতো। সর্বশেষ যে ব্লগার নিহত হয়েছে, আমরা এই পাঁচজন তাকে নির্মমভাবে খুন করেছি। শেষ কোপটা আমিই দিয়েছি। প্রথম কোপ দিয়েছে মরু বীর। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়েছিলো। কিছু রক্ত মরু বীরের হা হয়ে থাকা মুখের ভেতর ঢুকে যায়। কিন্তু জানেন, খুনোখুনি একটা বোরিং কাজ। তাছাড়া আমরা এখন আর খুনের পক্ষে নই। খুনের সংস্কৃতি থেকে সরে আসার সময় হয়েছে। রক্তভেজা ঐতিহ্য ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় খুন কোন ভূমিকা রাখে না। অযথা টাইম লস, এনার্জি লস।
– বাহ! খুব ভালো কথা।
– শুধু কি তাই! আমরা এখন একে অপরের সমালোচনা করতে পারি। সইতেও পারি। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে হুজুরের সাথে গ্রুপ চ্যাট করি। চ্যাটে আমরা সবাই মিলে হুজুরের সমালোচনা করি, হুজুর তা খন্ডন করার চেষ্টা করেন। কখনো পারেন, কখনো পারেন না।
– খুব ভালো উদ্যোগ। আলোচনা সমালোচনা করলে জ্ঞানের চাষাবাদ হয়। নতুন নতুন চিন্তার সাথে যুক্ত হওয়া যায়।
– আপনারা মুক্তচিন্তার মানুষ। কিন্তু কীইবা এমন চিন্তা করেন। আমাদের হুজুর অনেক বড় চিন্তাশীল মানুষ। তিনি মানুষের স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা করেন। হুজুর বলেছেন, “আর কখনো মানুষ খুন করবে না। একজন মানুষ খুন হওয়ার সাথে সাথে তার স্বপ্নও খুন হয়ে যায়। কারণ খুন হয়ে যাওয়ার মানুষটির উত্তরসূরীরা হয়তো তার স্বপ্ন বয়ে বেড়াতে রাজি নাও হতে পারে।“
– হুজুর কি নিজের বাড়িতে থাকেন, নাকি ভাড়া বাড়িতে? যেতে আর কতক্ষণ লাগবে?
– আপনি হয়তো জানেন হুজুরেরও হুজুর আছে। তো, সেই হুজুরেরা আমাদের হুজুরকে একটা বাড়ি দিয়েছিলেন। সেটা ছেড়ে দিয়ে এখন একটা ভাড়া বাড়িতে থাকেন। বাড়ি বলতে বাসা আরকি। এক রুমের বাসা। যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না। সামনেইতো আপনার ডাক্তারের চেম্বার। একটা ব্রেক নিবো আমরা।
– ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। ঘাড়ে ব্যাথা ভালো হয়ে গেছে। আর কখনো ব্যাথা হবে না মনে হয়।
– বাহ্! বেশতো। বেঁচে গেলেন। ঘাড়ে ব্যাথা খুব বিরক্তির। অসহ্য যন্ত্রনাকর। জানেন, পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার ওই বিশাল প্রবন্ধটিই আমাদেরকে বদলে দিয়েছে। ওই প্রবন্ধ পড়ার পর হুজুর আমাদেরকে নতুন করে চিন্তা করতে বলেছেন।
– তাই নাকি! কিন্তু সেটাতো অনেক আগে লিখেছি। এতদিন পর কেন পরিবর্তন হলো?
– আরে, ওইসময়তো শুধু টাইটেল পড়েই হুজুর আপনার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে দিয়েছিলেন। সপ্তাহখানেক আগে কীভাবে যেন পুরো লেখাটি পড়ে ফেললেন। তারপর এই ঘটনা। আপনি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। ভাবনার জগতে ফাটল ধরিয়েছেন। আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
মাহমুদ সাহেব ভাবছেন এসব হচ্ছেটা কী! সত্যিকার অর্থে পত্রিকার লেখাটি অনেক আবেগী ছিলো। এই আবেগী লেখা জঙ্গীদের জীবনবোধ পাল্টে দিবে ভাবেননি। কিন্তু সব চিন্তা কি ওদের হুজুরই করে। ওরা কোন চিন্তা করে না?
– চিন্তাতো আগে থেকেই করতাম। ব্লগারদেরকে মারতে যাওয়ার আগে সারারাত চিন্তা করতাম। কতকিছু ভাবতাম! ভাবতাম এমন যদি হয় যে, তার ঘাড়ে শুধু কুপিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কাটা যাচ্ছে না, মাথায় কোপ দিলে আগুন ধরে যাচ্ছে; তখন আমি কী করবো? আল্লাহু আকবার বলে তার সামনে সিজদায় পড়ে যাবো? নাকি ভূত ভূত বলে চিল্লানি দিবো?
লাল তলোয়ার নামে ছেলেটির এই কথা শুনে নিঃসঙ্গ আকাশের মনে পড়লো একটি দুঃস্বপ্নের কথা। – একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলাম এক ব্লগারকে জবাই করার সময় রক্তের সাথে অনেকগুলো বাংলা বর্ণমালা বেরিয়ে আসছে। তারপর সেগুলো দিয়ে শব্দ হলো, আপনা আপনি বাক্য হলো। শেষে সবগুলো বর্ণ শব্দ আর বাক্য মিলে একটি কবিতা হলো। কৌতুহলে কবিতার গায়ে হাত দিতেই আমার আঙ্গুল কাটা গেলো। কী ধারালো! ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর সারারাত ঘুমাতে পারিনি। খুব ভয় পেয়েছি।
অদ্ভুত! হরর গল্পের মতো। কিন্তু এমনিতে তোমরা কী চিন্তা করো? – বললেন মাহমুদ সাহেব।
জবাবে বখতিয়ারের ঘোড়া বললো, আমরাতো এখন আর চিন্তা করি না; মুক্তচিন্তা করি। আমাদের প্রত্যেকের একটি করে মুক্তচিন্তা আছে। আপনি শুনে দেখেন, ভালো লাগবে।
– আমার মুক্তচিন্তা হচ্ছে, খুন করার চাইতে একটি গাছ লাগানো অনেক ভালো। এর অক্সিজেন দিয়ে অনেক মানুষ বাঁচতে পারবে।
– রং অনেক শক্তিশালী একটা জিনিস। আমরা পানি দেখলে সাতার কাটার জন্য ঝাঁপ দিই কিন্তু লাল রঙের পানি দেখলে রক্ত ভেবে ভয় পাই। রঙ সবকিছু বদলে দেয়। পানিকে রক্ত বানিয়ে দেয়। এই জন্য হুজুররা রক্ত ভয় পায় না, রঙ ভয় পায়।
– নদী, বন এসব বাঁচানোর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে কোন লাভ নাই। যেখানে মানুষের হাত পড়ে যায়, ঈশ্বর সেখানে অসহায়।
– দ্বিমত করার অভ্যাস গড়ার আগে একমত হওয়া শিখতে হয়। তা না হলে দ্বিমত করার সাহস অরক্ষিত হয়ে পড়ে।
– ঈশ্বরের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। মানুষ ঈশ্বরকে যতটুকু ক্ষমতাবান মনে করে, তিনি কেবল ততটুকুই ক্ষমতাবান। মানুষ নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ঈশ্বরকে ক্ষমতা দান করে। ঈশ্বর বেঁচে থাকেন মানুষের দয়ায়।
সবার চিন্তা শুনে ভাবনার জটে পড়ে যান মাহমুদ সাহেব। তিনি ভাবেন, মাত্র এক সপ্তাহে এরা এত জটিল কিছু চিন্তা করতে শিখে ফেলেছে! নাকি এরা আগে যা চিন্তা করতো, এখন তার উল্টোটা চিন্তা করে?
– কী যা তা ভাবছেন! একেবারে ঘাড় থেকে কল্লা আলাদা করে দিবো। আমাদের চিন্তা নিয়ে মশকরা করেন? একদম জিহ্বা কেটে দিবো। শালা ফাউল কোথাকার!
লাল তলোয়ার নামের ছেলেটির মুখে এমন কথা শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না মাহমুদ সাহেব। আচমকা ভয়ে জড়সড় হয়ে যান। শরীরে চিকন ঘাম ছেড়ে দেয়ার আগেই ছেলেটি সংশোধন করে দিলো। – স্যরি, অভ্যাসবশতঃ বলে ফেলেছি। আমরা যা চিন্তা করেছি, তা নিয়ে আপনি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবেন। এটা আপনার অধিকার।
তবুও ভয় কাটে না মাহমুদ সাহেবের। ঘোর সন্দেহ হয়। ভাবছেন এরা বোধহয় জবাই করার জন্যই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো হুজুরের ইচ্ছে হয়েছে নিজ হাতে জবাই করবে, তাই লোক পাঠিয়ে সিস্টেমে নিয়ে যাচ্ছে। আরামসে নিজের ঘরে বসে বসে জবাই করবে। ছেলেগুলো গাড়িতে ভালো ভালো কথা বলছে ধরা খাওয়ার ভয়ে। যদি চিল্লাপাল্লা করে, ঝামেলা করে! কিন্তু কী করা যায়, তাই ভাবছেন। এখনও সময় আছে, পালিয়ে যাওয়ার। প্রস্রাবের কথা বলে গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দেয়া যায় কিনা ভেবে দেখছেন। নাকি পকেট থেকে কলমটা বের করে ড্রাইভাবের ঘাড়ে গেঁথে দিবেন! তাহলে গাড়ি এলোমেলো চলবে, এই সুযোগে দরজা খুলে লাফ দেয়া যাবে। কিন্তু হালকা ব্রেক কষে গাড়িটি থেমে গেলো।
– আমরা চলে এসেছি, গাড়ি থেকে নামুন। আপনার জন্য হুজুর অপেক্ষা করছেন।
শুনে হতাশ হলেন মাহমুদ সাহেব। খুব অসহায় বোধ করছেন। ভাবলেন ওদেরকে বিশ্বাস করে ভুল হয়েছে। আরো আগে পালানোর কথা চিন্তা করা উচিত ছিলো। গাড়ি থেকে নেমেই দৌড় দেয়ার চিন্তা করেছেন। কিন্তু ওরা এমনভাবে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, দৌড় দেয়ার কোন উপায় নেই। ওদের সাথে হুজুরের বাসায় যাওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। উপায়ন্ত না দেখে ঘটনার শেষ দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন।
হুজুরের রুমে ঢুকতেই বসা থেকে উঠে কাজল মাহমুদকে অভ্যর্থনা জানালেন দারুন এক হুজুর। আসার সময় কোন অসুবিধা হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। কিন্তু হুজুরকে দেখে অবাক হলেন মাহমুদ সাহেব। মনে মনে ভাবলেন হুজুরের দাঁড়ি কই? তাছাড়া টিশার্টটিও বোধহয় আজিজ সুপার মার্কেট থেকে কেনা। জীবনানন্দ দাশের কবিতার স্ক্রীণ প্রিন্ট। পরনে থ্রি কোর্যার্টার প্যান্ট। এরকম হুজুর এর আগে দেখেননি তিনি।
– আমার গেটআপ নিয়ে কী সব উদ্ভট চিন্তা করছেন! দাঁড়ি দিয়ে হুজুর চেনার চেষ্টা করছেন? আরে ভাই, আমরাতো বানরের বংশধর। গায়ে একটু আধটু চুল থাকবেই। গালের চুলগুলো গতকাল কেটে ফেলেছি। এখন কিছুটা ফ্রেশ লাগছে। পরে ভালো লাগলে আবার রেখে দিবো, সমস্যা কী? এসব চুল টুল নিয়ে না ভেবে আসেন গুরুত্বপূর্ণ আলাপটা সেরে ফেলি। তারপর একসাথে দুপুরের খাবার খাবো।
আরো একবার অবাক হলেন মাহমুদ সাহেব। ভাবলেন অন্যকিছু চিন্তা না করে বরং হুজুরের কথাগুলো শুনি। মনে হয় না জবাই টবাই করবে। হুজুর এখন জবাইয়ের মোডে নেই। হুজুরের চোখ ভরা কৌতুহল। নিশ্চয় চিত্তাকর্ষক কিছু নিয়ে ভাবছিলেন বসে বসে। চিত্তাকর্ষক চোখ খুবই নিরাপদ। আস্থা রাখা যায়। নিশ্চিন্তমনে হুজুরের মুখোমুখি চেয়ারে বসে চোখ ঘুরিয়ে ঘরটা দেখে নিলেন। সাদামাটা। কিছু ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস, একটা খাট, তিনটা চেয়ার, একটা টেবিল, একটা আলমারি আর একটা বইয়ের তাক। খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো। রুমে কেউ নেই। ওই পাঁচজন যুবক এখন বাইরে।
– তাহলে শুরু করা যাক। আসার পথে ছেলেগুলো কী কী বলছে, সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। ওরা নিশ্চয় আপনার মাথায় চিন্তার ঝট পাকিয়ে দিয়েছে। আমি জানি আপনি বেশ স্বপ্নবান একজন মানুষ। আমিও আপনার মতোই। তো, স্বপ্নই সমস্যা আবার স্বপ্নই সম্ভাবনা। আমরা প্রত্যেকে স্বপ্ন দেখি। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, সবারই অনেক অনেক স্বপ্ন। কিছু স্বপ্ন পূরণ হয়, আবার কিছু হয় না। তবুও মানুষ নতুন নতুন স্বপ্ন দেখে। আবার কিছু স্বপ্ন মানুষ নিজের থেকে বাদ করে দেয়। যেমন আমার স্বপ্ন ছিলো বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট এর খলিফা হওয়ার। কিন্তু গত সপ্তাহে এই স্বপ্নটি বাদ করে দিয়েছি। এখন নতুন স্বপ্ন দেখছি। অনেকগুলো মানুষের স্বপ্ন নিয়ে আমার স্বপ্ন। আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কথা?
– জ্বি বলুন। শুনতে খুব ভালো লাগছে।
– ধন্যবাদ। আপনি নিশ্চয় ফরিদপুর জেলা সম্পর্কে জানেন। এই জেলার বেশিরভাগ ভূমি পদ্মা নদীতে ভেঙ্গে যাওয়া আবার বেশিরভাগ ভূমি নদী থেকে উঠে আসা। চর মির্জাপুর সেরকমই একটি এলাকা। চর ভদ্রাসন উপজেলার এই চরের মানুষ মূলত কৃষক ও মৎস্যজীবী। শিক্ষার হার খুবই কম। কিন্তু এই চরের মানুষ বেশ স্বপ্নবান। তারা প্রচুর স্বপ্ন দেখে। যখন তখন স্বপ্ন দেখে। এদের স্বপ্ন দেখার কোন রুটিন নেই। এবং স্বপ্নের হারও ব্যাপক। কিন্তু বেশিরভাগ স্বপ্নই পূরণ হয় না। চরের মানুষগুলো স্বপ্ন সচেতন নয়। তারা স্বপ্নের যত্ন নিতে পারে না বলে প্রায় সব স্বপ্ন মরে যায়। অথবা নদী ভেঙে নিয়ে যায়। এখন আমি চাইছি তাদের স্বপ্নগুলো টিকে থাকুক এবং পূরণ হোক। এই জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রকল্পের দায়িত্বটা আপনাকেই দিতে চাই। আপনি আমার অনেক পছন্দের মানুষ। অনেক আস্থা আপনার প্রতি। আশাকরি আপনি মনযোগ দিয়ে শুনছেন।
কিছুই বুঝতে পারছেন না মাহমুদ সাহেব। পুরো বিষয়টা ক্লীয়ার হওয়ার জন্য দেরি সইছে না। চোখে মুখে দুনিয়ার সব কৌতুহল এক করে বললেন, -জ্বি বলুন।
– ওই চরে নদীর তীর ঘেঁষে একটি কাঠের ঘর বানিয়েছি। ঘরের চালও কাঠের, বেড়াও কাঠের। শরতে হেমন্তে চারপাশ কাশফুলে সাদা হয়ে থাকে। উপজেলা থেকে আসা একটি রাস্তা সোজা এসে ঘর থেকে কিছুটা দূরে বাঁক নিয়েছে। সেই বাঁক থেকে আরেকটি নতুন রাস্তা ওই ঘরের দিকে গেছে আর বাঁক নেয়া রাস্তাটি গেছে গ্রামের দিকে। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে আপনি সেই ঘরে উঠবেন। সেখানে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করা আছে। খাবারের ব্যবস্থাও আছে। পড়ার জন্য আছে বিশাল একটি লাইব্রেরি। গান শোনার, মুভি দেখার ব্যবস্থাও আছে। চব্বিশ ঘন্টা বিদ্যুত থাকবে। ইন্টারনেট আছে। আর আছে একটি ল্যাবরেটরি। সেখানে একটি মেশিন বসানো আছে। অনেকগুলো তাকে সাজানো আছে ছোটবড় কয়েক হাজার বয়াম। এরমধ্যে কিছু বয়াম ড্রাম সাইজের আবার কিছু পেনিসিলিন লিকুইডের ছোট্ট শিশির সমান। চরের বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে পারে না তারা আসলে কী স্বপ্ন দেখে। আপনি মেশিন দিয়ে তাদের স্বপ্ন নির্ণয় করবেন। তারপর তাদেরকে সেটা বলবেন এবং সেই স্বপ্ন সাইজ অনুযায়ী বয়ামে ভরে রাখবেন। আমরা এসব স্বপ্ন লালন পালন করবো এবং একটা সময় তাদের সব স্বপ্ন পূরণ করে দিবো। এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এবার আপনার সিদ্ধান্ত বলুন।
– অসাধারণ প্রকল্প। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কী সুন্দর চিন্তা আপনার! সত্যিই অসাধারণ! আমি এক কথায় রাজি। নিঃশর্তভাবে রাজি। আপনার আইডিয়াটা খুবই ভালো লাগলো। সবকিছু শুনে আমার বাবার কথা মনে পড়লো। তার একটা স্বপ্ন ছিলো। মনে হয় কখনো পূরণ হবে না। বাবা বেঁচে নেই, থাকলে উনার স্বপ্নটিও বয়ামে ভরে রাখতাম। তারপর একটা সময় পূরণ হতো। উনি স্বপ্ন দেখতেন আমি একদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবো। তারপর আমার বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় দেশ ভরে উঠবে সুখ ও সমৃদ্ধিতে। গতরাতেও ভেবেছি, বাবার স্বপ্ন যদি পূরণ হতো, আর আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হতাম, তাহলে এখন এভাবে চাপাতির আতংক নিয়ে বেঁচে থাকতে হতো না। আমার নিরাপত্তার জন্য কত মানুষ নিযুক্ত থাকতো। তাদের নিরাপত্তার চাদর ডিঙিয়ে চাপাতিতো দূরে থাক, একটা সুঁইও বের হতে পারবে না। আহা! কী যে মজা হতো।
কথাগুলো বলতে বলতে কাজল মাহমুদ টের পেলেন তার শরীরটা ক্রমশ হালকা হয়ে যাচ্ছে। দেহের ভেতরে খুব শূন্যতা অনুভব করছেন। হাত পা নাড়াতে পারছেন না। চোখ দু’টো বুঁজে আসতে চাইছে। ঘোলাটে দেখছেন সবকিছু। বহুকষ্টে ভালো করে চেয়ে দেখলেন তার পুরো শরীর রক্তে ভেজা। রক্ত গড়িয়ে ফুটপাতের পাশে ড্রেনে গিয়ে পড়ছে। অনেক রক্ত। লাল রক্ত। এর আগে কখনো কাছ থেকে এত রক্ত একসাথে দেখেননি। চাপাতির কোপে হা হয়ে থাকা গালের মাংসে বাতাস লাগছে। খুব শীত লাগছে ওইসব কাটা স্থানে।
তাকে ঘিরে মানুষের জটলা, কেউ কেউ বলছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা। কেউ বলছে একটু সাহস করলেই খুনীদের ধরা যেতো। কেউ বলছে নিশ্চয় ব্লগার, ব্লগার ছাড়াতো কাউকে এভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে না।
মানুষের জটলা থেকে ভেসে আসা শেষের কথাগুলো ঠিকমতো শুনতে পাননি লেখক ও কলামিস্ট কাজল মাহমুদ। নিজেকে বাঁচাতে পারেননি তিনি। মরে গেলেন। মরে যেতে যেতে কিছু স্বপ্ন দেখেছেন। এটা নতুন কিছু নয়। উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখা ছিলো লেখক ও কলামিস্ট কাজল মাহমুদের অনেকগুলো বদ অভ্যাসের একটি।


প্রধানমন্ত্রীর পোষা বাঘ

লিখেছেন
প্রধানমন্ত্রী বাঘ কিনেছেন। পুষবেন, তাই।
গৃহপালিত বাঘ, খুব সুন্দর, হৃষ্টপুষ্ট। গায়ের পশমগুলো চিকচিক করছে। হলুদের উপর কালো ডোরাকাটা দাগ। কোনরকম তর্জন গর্জন ছাড়াই ভয়ংকর মিষ্টি দেখায়, দারুণ আকর্ষনীয়। তর্জন গর্জন শুধু তখনই করবে, যখন প্রধানমন্ত্রীর সাহসের প্রয়োজন হবে। এখন থেকে সুদর্শন এই বাঘটি প্রধানমন্ত্রীকে সাহস দিবে।
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সব কর্মকর্তা কর্মচারী ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বাঘ দেখছেন, প্রধানমন্ত্রীর বাঘ। তিনি সবাইকে ডেকেছেন তার ক্ষমতা ও সাহসের প্রতীক মনযোগের সাথে দেখে তারপর গুণগান গাইবার জন্য। সবাই গুণগান গাইছে।
– আমার জীবনে দেখা সেরা বাঘ, অকল্পনীয় একটা বাঘ।
– আপা, কী বলবো, সবকিছুই অসাধারণ! কিন্তু চোখের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। বাঘের চোখে আপনার ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি। সমৃদ্ধি ও সুখ শান্তিতে ভরপুর।
– আমি এত প্রগাঢ় ও বিদগ্ধ থাবার বাঘ এর আগে দেখিনি। যেমন থাবার আকার, তেমন তার আকৃতি। এই থাবার প্রভাব বিশাল ও বিস্তৃত হবে। আমি নিশ্চিত।
– এখনো একটা দাঁতও পড়েনি। একেবারে ভার্জিন বাঘ। বুঝা যাচ্ছে বেশ ক্ষিপ্র হবে। প্রথম দেখায় আপনার বাঘের ভক্ত হয়ে গেলাম। আমি মুগ্ধ।
– সত্যি কথা বলতে কী, এর আগে এতো কাছ থেকে কখনো বাঘ দেখিনি। বাঘ পোষার সাহস আছে, এমন কোন মানুষকেও চিনতাম না। বাঘের কথা আর কী বলবো, আপনার কথা ভাবছি। আমি খুব ভাগ্যবান, আপনার কর্মচারী হতে পেরে।
– কোন খুঁত নাই। একদম নিখুঁত। এরকম নিখুঁত বাঘ সমাজে বিরল। কী বলবো, বুঝতে পারছি না। বিশ্বে সেরা একশ বাঘের তালিকা করলে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বাঘ নিশ্চিত এক নাম্বারে থাকবে। এটা হলফ করে বলতে পারি।
– আপা, সবাই বলে ফেলেছে। আমি আর কী বলবো। রহমত ভাই’র কথার সূত্র ধরে বলি, এই বাঘ যদি হয় এতো সাহসী, তাহলে সেই বাঘ যার পোষ মেনেছে, সে না জানি কতো সাহসী!
প্রধানমন্ত্রী সবার কথা শুনে খুব একটা খুশি হতে পারলেন না। তার বাসভবনের কর্মকর্তা কর্মচারীরা শুধু বাঘের সাহসের কথা বললো, বুদ্ধির কথা বললো না। একটা বিশেষ ধরনের বাঘ, অর্ডার দিয়ে বানানো। এটা তারা বুঝলোই না! বাঘটি শুধু সাহস ও ক্ষমতার প্রহরী নয়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার ভূমিকাও পালন করবে। তিনি সবার উদ্দেশ্য বললেন, “পৃথিবীতে এই প্রথম কোন শাসক তার উপদেষ্টা হিসেবে একজন বাঘ নিয়োগ দিয়েছে।“ শুনে সবাই বললো – বাহ্, কী অসাধারণ! কী সুন্দর! সাবাশ আপা, সাবাশ।
প্রশংসা অনুষ্ঠান শেষে সবাই যার যার কাজে চলে গেলো। শুক্রবার, ঘরে নতুন গৃহপালিত পশু এসেছে। তাও আবার উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। এই উছিলায় আজ সবাই একটু ভালোমন্দ খাবে। ওইদিকে কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী আসছেন বাঘের সাথে দুপুরের খাবার খাবেন বলে। তাই দ্রুত রান্না ঘরে গেলো পাচক হোসনেআরা ও রহমত ভাই। কিন্তু হোসনেআরার চেহারায় অনেক সন্দেহ। রান্নায় তার সহকারি রহমত ভাই’র উপরও খানিকটা ক্ষ্যাপা। রহমত ভাই জিজ্ঞাসা করেন – কী হইছে তোর? হোসনেআরা কয় – আপনি যে বাঘের এত প্রশংসা করে আসলেন, বিষয়টা আমার ভালো লাগে নাই। আপনি কি দেখেন নাই বাঘের চোখের চারপাশ কালো করার জন্য বাড়তি কাজল ব্যবহার করা হইছে। এটাতো একটা মেকআপ করা বাঘ। এত প্রশংসার কী আছে!
রহমত ভাই যতটুকু পেরেছেন হোসনেআরাকে সাবধান করে দিয়েছেন। এসব কথা আপার কানে গেলে চাকরি চলে যাবে। এই আরামের কাজ হারাম হয়ে যাবে। বাঘ নিয়ে কারো কোন অসন্তুষ্টি আপায় সহ্য করবেন না। সাফ বলে দিয়েছেন তিনি।
বাঘকে গোসল করাতে হবে। এই পদে গণভবনে কোন কর্মচারী ছিলো না। গতকাল দু’জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। হাশেম আর কাশেম নামে দুই সুঠামদেহী সহোদর যুবক বাঘকে গোসল করাতে নিয়ে গেলো। অসম্ভব খুশী দু’জন। জীবনে বহুবার গরু ছাগল গোসল করিয়েছে, কিন্তু বাঘকে গোসল করানোর সুযোগ পাবে ভাবেনি। একটা বাঘকে গোসল করানোর জন্য কত প্রসাধনী, কত সুগন্ধি, কত আয়োজন! হাশেম কাশেম দেখে আর অবাক হয়।
নাচতে নাচতে জল ঢেলে তোয়ালেতে প্রসাধনী মেখে বাঘের গায়ে ঘষা দিতেই “আল্লাহগো” বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো কাশেম। বাঘের গায়ের রং উঠে যাচ্ছে! হলুদ রং উঠে ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। চিৎকার শুনে প্রধানমন্ত্রী চলে আসলেন।
– কী হয়েছে, এত জোরে চিৎকার করো কেন?
– আপা সর্বনাশ হয়ে গেছে। বাঘের গায়ের রং উঠে গেছে। এটাতো সাদাকালো বাঘ!
– তাতে কী হয়েছে? সাদা আর কালো দু’টোই পবিত্র রং। ভালোই হয়েছে।
– কিন্তু আপা, আমার মনে হয় এটা নকল বাঘ। রং করে তেল মেখে পশমগুলো চিকচিকে করে আপনার কাছে বিক্রি করেছে।
– এই কে কোথায় আছিস? এই মূর্খটাকে কে নিয়োগ দিয়েছে? এর চাকরি নট করে দাও। সাহস কত আমার বাঘের গায়ের রং নিয়ে কথা বলে!
কাজের প্রথম দিনই চাকরি খোয়ালো কাশেম। কী দরকার ছিলো অযথা গায়ের রং নিয়ে এত কথা বলার। তাছাড়া গায়ের রং সাদা হলেই কী আর বেগুনী হলেই কী, বাঘটাতো প্রধানমন্ত্রীর। ভাইয়ের জন্য মনের ভেতর খুব দুঃখ অনুভব করলো হাশেম। একা একা পবিত্র বাঘটাকে গোসল করালো। গোসল শেষে দেখে বাঘের গায়ে কালো ডোরাকাটা দাগও নেই। পুরো বাঘ সাদা হয়ে গেছে। এটা দেখে হাশেম আর ভয়ে কিছু কয় না। প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঘের গোসল করানো দেখছিলেন। হাশেমকে জিজ্ঞাসা করলেন – কী হাশেম, কী বুঝলে?
হাশেম কয় – আপা, বাঘ এবার পুরোপুরি পবিত্র হয়ে গেছে। আর কোন কালো দাগ নাই। কী যে সুন্দর লাগতেছে!
প্রধানমন্ত্রী বললেন- বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার চাকরি পাকা।
২.
কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এসেছেন বাঘের সাথে পরিচিত হতে। পরিচয় পর্ব শেষে এখন দুপুরে সবাই একসাথে খাবেন। খাবার টেবিলে প্রধানমন্ত্রী, বাঘ ও মন্ত্রীবর্গ আছেন। সবাই খুব খুশি। এতজন মন্ত্রীর সামনে বাঘকে কিছুটা লাজুক লাজুক মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বললেন এটা হচ্ছে বিনয়। খুব সাহসী, ক্ষমতাশালী ও বুদ্ধিমান হলেও বাঘটা বিনয়ী। অন্তত মনিবের অতিথিদের সামনে। মন্ত্রীরা সবাই বাঘ দেখে যারপরনাই খুশি। সব মন্ত্রীই স্ব-স্ব মন্ত্রণালয় থেকে বাঘের জন্য কিছু বরাদ্ধ দিতে চান।
– আমার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিদিন বাঘের খাবারের জন্য মোরগ, হাঁস ও ছাগল সাপ্লাই দিতে চাই।
– তার চাইতে বরং আপনি আর আমার কৃষি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে একটি হাঁস, মুরগি ও ছাগলের খামার করি। আপনার পরিকল্পনার অংশ হতে চাই।
– রেলওয়ের প্রচুর খালি জমি পড়ে আছে। অসভ্য লোকজন বাড়িঘর বানিয়ে দখল করে রেখেছে। আপনাদের খামারের জন্য আমি রেলওয়ের কিছু জমি বরাদ্ধ দিতে চাই।
– এই খামার নির্মাণের জন্য যদি কোন নির্মাণ সামগ্রী আমদানি করতে হয়, তাহলে আমি বন্দরের শুল্ক বিভাগকে বলে দিবো যেন কোন শুল্ক আদায় না করে। এটা নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সামান্য কন্ট্রিবিউশন।
– এক্ষেত্রে আপনাদের সবার জন্য ফিন্যান্স মিনিস্ট্রি একটা ডিসেন্সি এ্যালটমেন্ট দিবে। এ্যাজ সুন এ্যাজ পসিবল। আসলে পুরো ব্যাপারটা অ্যামাজিং। আই উড লাইক টু এনশিওর মাই এফোর্ট।
এতসব বরাদ্দের কথা শুনে বাঘ সত্যি সত্যি লজ্জা পেয়েছে। লজ্জায় চোখের পাতা নিচের দিকে নামিয়ে বসে আছে। একেবারে মুখ ফুটে বলেই ফেললো – আপনাদের এমন উষ্ণ অভ্যর্থনা আমার জীবনকে ধন্য করেছে। এখানে এসে এমন অনেক কিছু পেয়েছি, যা এর আগে কখনো পাইনি। সব মিলিয়ে আমি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
বাঘের মুখে কথা শুনে সবাই অবাক। তাও আবার অসম্ভব সুরেলা, কানায় কানায় ভরাট দারুন মিষ্টি কণ্ঠ। কী যে ভালো একটা বাঘ কিনে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী, ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মন্ত্রীরা মনে মনে ভাবছেন, এজন্যই তিনি প্রধানমন্ত্রী আর তারা শুধু মন্ত্রী। পার্থক্যটা যোগ্যতা, মেধা আর দক্ষতার। এমনও হতে পারতো মন্ত্রীদেরকে বাঘ কিনতে পাঠালে তারা বড় সাইজের একটা বিলাই নিয়ে আসতেন এবং প্রধানমন্ত্রীর বকা খেতেন। বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী তাই বাঘ কেনার কথা আগে কাউকে জানাননি। এমন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়ে সবাই মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানালেন।
৩.
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। ফর্সা আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত। প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকখানার বারান্দার ছোট্ট বাগানের ফুলগুলো চাঁদের আলোয় হাসছে। সবুজ পাতাগুলো চিকচিক করছে। বারান্দা আলোকিত করে বসে আছেন তিনি ও তার গৃহপালিত বাঘ। তাই এখানে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি আলো। নিরব কিন্তু মুখরিত আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন দু’জনে। নিরবতা ভেঙে প্রধানমন্ত্রী বললেন-কেমন আছো প্রিয় বাঘ?
– আমাদের সামনে বরকতময় ভবিষ্যত। আপনি সমৃদ্ধ হবেন। আপনার জনগণ সুখী হবে।
– তোমার মত বুদ্ধিমান, স্মার্ট ও সাহসী বাঘের সমর্থন আমাকে খুব ক্ষমতাবান করবে। তাছাড়া বেশ সাহস পাচ্ছি।
-আপনার যত সাহস লাগে নেন। আমার কাছে অফুরন্ত সাহস আছে।
– ক্ষমতার কথা কিছু বলো। আমার আসলে ওটাই দরকার।
– শোনেন, পৃথিবী যেমন সূর্যের চারপাশে ঘোরে, বাংলাদেশের ক্ষমতাও এখন আপনার চারপাশে ঘুরবে। আপনি-ক্ষমতা, ক্ষমতা-আপনি, এভাবে একে অন্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হবেন। আমি যখন আপনার পাশে আছি, তখন আর কোন ভাবনা নেই। আপনিই ক্ষমতার প্রাণ।
– তা জানি প্রিয়। আমি আর আমার প্রিয় বাঘ একসাথে থাকলে সবকিছু হাতের মুঠোয় চলে আসবে।
– ঠিক তাই। আমি বলি কী, আপনি একটা সিংহাসন বানান। স্বর্ণের কাঠামোর উপর হীরক খচিত। বাঘ, সিংহ, সূর্যসহ বিভিন্ন শক্তি ও ক্ষমতার আকৃতি আঁকা থাকবে সিংহাসনের গায়ে। সেই সিংহাসনে আপনি বসবেন। আমি বসবো নিচে আপনার পায়ের কাছে। বসে সবার দিকে চোখ রাঙিয়ে করে তাকাবো, আপনি সিংহাসনে বসে মন্ত্রীদেরকে দিক নির্দেশনা দিবেন। দেখবেন কাজ কর্মের গতি পাল্টে যাবে। সবাই খুব কর্মমূখর হয়ে উঠবে। একটা চঞ্চলতা দেখা দিবে। আপনি বলবেন এটা হয়ে যাক, মুহূর্তের মধ্যে হয়ে যাবে। জাস্ট বলার দেরি আর হওয়ার দেরি। কারণ আপনার পায়ের কাছে বসে থাকবে দুর্নিবার দুর্ধর্ষ, ভয়ংকর ক্ষিপ্র, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন পৃথিবীর সবচে সাহসী বাঘ।
– আহা! সিংহাসনের ডিজাইনটা আমার চোখের সামনে ভাসছে। দারুণ হবে।
– অনেক রাত হয়েছে। আমি ঘুমোতে যাবো। প্রতিদিন রাত দশটায় ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস আমার। আপনিও ঘুমোতে যান।
ঘুমাতে যাওয়ার সময় বাঘ দেখে একটি রুমের দরজা খোলা। সেই রুমে থাকে পিয়নদের কো-অর্ডিনেটর হারুন। কানে কম শোনে, তাই রাতে দরজা খোলা রাখে। যেন কোন প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী ডাকলেই সাড়া দিতে পারে। হারুনের রুমের সামনে চারটি ফুল গাছের টব। একটি গাছে অনেক ফুল ধরেছে। সাদা গোলাপ। বাঘটি সোজা গিয়ে সেই টবে ছ্যার ছ্যার করে প্রস্রাব করে দিলো। প্রস্রাবের বিশ্রি শব্দে কানে কম শোনা হারুনের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে দেখে এই তামাশা। রাগে তার পুরো শরীর গরগর করে কাঁপছে। কিন্তু কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে রইলো। প্রস্রাব শেষ করে বাঘ চলে যাওয়ার পর হারুন গেলো সিনিয়র কর্মচারী শমসের আলীর রুমে। গিয়ে ঘটনাটি বললো। এরকম বিচ্ছিরি ঘটনা শুনে শমসের খুব হতাশ হলেন। প্রধানমন্ত্রী কেন এমন বাঘ কিনলেন, যে বাঘ গাছ দেখলেই কুকুরের মত ছ্যার ছ্যার করে মুতে দেয়! একজন সিনিয়র কর্মচারী হিসেবে এটা কিভাবে মেনে নিবেন, তাই ভাবছেন।
শমসেরের রুমে তার সাথে ভাতিজা সম্পর্কের এক পিয়ন থাকে। নাম জহির। ঘুমের ভান করে সবকিছু শুনেছে। তার সাথে হারুনের সম্পর্ক ভালো না। হারুন অনেক বকাবকি করে জহিরকে। তাই হারুনের উপর রাগ আছে তার। পরদিন সকালে জহির সবাইকে বলে বেড়িয়েছে, “হারুন ভাই’র ফুল গাছে আপার পবিত্র বাঘ প্রস্রাব করেছে। আর এটা উনি সবার কাছে বলে বেড়াচ্ছেন। হারুন ভাই কি কাজটা ঠিক করলেন?” ব্যস, দুই কান চার কান করে এটা প্রধানমন্ত্রীর কানেও গেলো। তিনিতো মহা ক্ষ্যাপা। কীসব বাজে ব্যাপার। এরা বাঘের নামে কানাঘুষা করে! এটা চলতে দেয়া যাবে না। হারুন, জহিরসহ দশ জনকে ছাঁটাই করে দিলেন। সিনিয়র হিসেবে শমসের আলীকে সতর্ক করলেন। বাগানের মালিকে ডেকে বললেন বাঘের ঘরে এটাচ বাথরুমে অনেকগুলো ফুল গাছের টব দিয়ে দিতে। তার প্রিয় বাঘ যেন প্রকৃতির কাছে গিয়েই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারে।
একসাথে দশ জনের চাকরি চলে যাওয়ার পর অবস্থা বেগতিক দেখে বাকিদের নিয়ে মিটিং করলেন শমসের আলী। সবাইকে খুব ভালোভাবে বুঝালেন বাঘের বিষয়ে মুখে তালা লাগাতে। এই জিনিস নিয়ে কোন কথা বলা যাবে না। বাঘ যা খুশি তা বলে বেড়াবে, করে বেড়াবে। সবাই বাঘের কৃতকর্মে সমর্থন জানাবে। কেউ যেন কোন আপত্তি না করে। আপত্তি করলেই চাকরি চলে যাবে। চাকরি বাঁচাতে চাইলে মুখ বন্ধ। সবাই শমসের আলীর পরামর্শ মেনে চলার বিষয়ে সম্মতি দিলো।
কর্মচারীদের মিটিংয়ের কথা জানতে পেরে প্রধানমন্ত্রী খুব খুশি। তার পোষা বাঘ নিয়ে কথা যত কম হবে, ততই ভালো। তিনি চান না তার পছন্দের কিছু নিয়ে খুব বেশি ওজর আপত্তি চলুক। এটা খুবই বিরক্তিকর। তাই এরকম একটা মিটিংয়ের আয়োজন করার জন্য শমসেরকে ধন্যবাদ ও কিছু বকসিশ দিলেন।
৪.
প্রধানমন্ত্রীর জন্য সিংহাসন বানানো হয়েছে। ঠিক যেমনটি চেয়েছেন, তেমন। ক’দিন হলো সিংহাসনে বসে দাপ্তরিক কাজকর্ম করার প্র্যাকটিস করছেন। বাঘ তখন তার পায়ের কাছে বসে থাকে। চোখ রাঙানোর রিহার্সাল দেয়।
বাঘের বলে বলীয়ান প্রধানমন্ত্রীর সাহস বেড়েছে কয়েকগুন। চারদিকে সংস্কার চালাচ্ছেন নিজের ইচ্ছেমত। পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলে কথা বলেন। অনেক দেশের তুলনায় তার দেশ এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সব ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকে তিনি অন্য সবার চেয়ে দ্রুত দৌড়াচ্ছেন।
দেশে এখন প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীপক্ষ বলে কিছু নেই। সব শালা কুপোকাত। তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনরকম আন্দোলন সংগ্রাম নাই। সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। যাদের সুখ নাই, শান্তি নাই, তারা চুপ থাকে। কথা কয় না। চোখ তুলে তাকায় না। গোঁ গোঁ করে না।
এই সুযোগে দেশের সব সুখী মানুষ মিলে প্রধানমন্ত্রীর বিশাল এক ভাবমূর্তি নির্মাণ করছে। এই মূর্তি মহাকায়, বিশাল। তার নিচে সবাই তুচ্ছ, ছোট্ট, পতঙ্গসম। দেশের ইতিহাসে তিনি হয়ে উঠলেন এক মহাপরাক্রমশালী অধ্যায়। নিজের ক্ষমতার বাহার দেখে নিজেই হাততালি দেন। হাসেন।
৫.
কিন্তু অবস্থা আসলে খুব একটা ভালো না। যেই বাঘের বলে প্রধানমন্ত্রী আজ ব্যাখ্যাতীত বলীয়ান, সেই বাঘ অসহ্যকর একটা বাঘ। এটাকে কোনভাবেই সহ্য করতে পারেনি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কর্মকচারীরা। করবে কিভাবে? সে কাউকে গান শুনতে দেয় না, বই পড়তে দেয় না, কবিতা আবৃত্তি করতে দেয় না। এমনকি রাতের বেলা জানালা খুলে একটু আকাশের তারা গুনতেও দেয় না। সবকিছুতে তার আপত্তি। বাঘের অত্যাচার সইতে না পেরে কয়েকজন কর্মচারি চাকরি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আর কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চেয়ে চাকরি হারিয়েছে। সর্বশেষ পুরো বাসভবনে শুধু শমসের আলী ও পাচক হোসনেআরা ছিলেন। আজ সকাল থেকে হোসনেআরাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী বললেন, জাহান্নামে যাক সবাই। একটা পোষা বাঘ যারা সইতে পারে না, তাদের কারোরই এখানে থাকার দরকার নাই। আমি নিজেই রান্না করতে পারি। নিজের ভাত নিজে রেঁধে খাবো। কোন রাধুনি লাগবে না।
এই অবস্থায় শমসের আলী খুব একা হয়ে গেলেন। এত বড় বাড়িতে দুইজন মানুষ ও একটি পশু। অথচ কিছুদিন আগেও এখানে দুই ডজন কাজের মানুষ ছিলো। তাদের পায়ের শব্দে সারা বাড়ি কাঁপতো। কত মানুষ, কত কাজ, কত কথা। আজ মানুষ নাই, কথা নাই, কাজও নাই। একটি বাঘ একা একা সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কী অশ্লীল, কী নোংরা তার চলাফেরা!
শমসের আলী প্রথম বাঘ দেখেছিলেন ছোটবেলায় ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানায়। তারপর যৌবনে এসে সুন্দরবন গিয়ে বাঘ দেখেছেন। চিড়িয়াখানার ওই রোগা বাঘটিও অনেক স্মার্ট। আর সুন্দরবনের বাঘেরতো কোন তুলনা নেই। দেখলেই বুকটা সাহসে ভরে যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এ কেমন বাঘ কিনে আনলেন। গায়ের রঙ উঠে যায়, গাছের গোড়ায় প্রস্রাব করে, পঁচা-বাসি মাংস খায়। অলক্ষ্মী অপয়া বাঘটি আসার পর থেকে এই বাড়িতে যেন অন্ধকার নেমেছে। কোন আলো নেই। সব আলো এই ভয়ংকর বাঘ একা গিলে খেয়েছে। এসব আর ভালো লাগছে না শমসের আলীর। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তার অনেক মায়া। অনেক শ্রদ্ধা। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে শমসেরের অনেক ভয়। নিজের সন্তানের প্রতিও এত খেয়াল রাখেন না, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি যত খেয়াল রাখেন।
মন ভরা বিষন্নতা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে শুয়ে আছেন। ঘুম আসছে না। খাঁ খাঁ বাড়িতে রাতের বেলা খুব ভয় লাগে। তাই আলো জ্বালিয়ে রাখেন শমসের আলী। হঠাৎ খেয়াল করলেন প্রধানমন্ত্রীর পোষা বাঘ তার ঘরে। বিছানার পাশে বসে আছে। কখন এসেছে, টেরই পাননি। ভীষন চমকালেন। কী বলবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। বাঘটি উঠে দাঁড়ায়।
– তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি যা বলি শুনে যাও। বুঝতেইতো পারছো এই বাড়িতে আর থাকতে পারবে না। সবাই চলে গেছে, তুমিও যাবে। এই বাড়ি সাহসীদের, ক্ষমতাবানদের। তুমি শমসেরের কোন সাহস নাই, ক্ষমতা নাই। মাথায় দুই এক ফোটা বুদ্ধিও নাই। তাহলে এখানে তুমি কিভাবে থাকবে? একদিন না একদিনতো যেতেই হবে। তারচে ভালো আজ রাত পোহানোর সময় চলে যাও। নিজে থেকে না গেলে অপমানিত হয়ে যেতে হবে। এটা কি ভালো হবে? তাছাড়া আমার স্বভাব চরিত্র খুব একটা ভালো না। কোন সময় দুই চার ঘা বসিয়ে দিই, তার ঠিক নেই। এই বুড়ো বয়সে বাঘের ঘা সইতে পারবে না। একদম মরে যাবে।
৬.
রাত পোহানোর আর বেশি দেরি নেই। শমসের আলীর চোখে জল। এভাবে এই বাড়ি থেকে বিদায় নিতে হবে ভাবেননি। এমনিতেও আর বেশিদিন চাকরি করতে পারতেন না। বড়জোর এক বছর। কিন্তু সেই বিদায় এমন হতো না। এখন এই বাড়িতে শমসের আলীকে বিদায় দেয়ার জন্য একজন মানুষও নেই। প্রধানমন্ত্রী ঘুমে। তার পোষা বাঘ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে শমসের আলী বেরিয়ে যাচ্ছে কিনা। বিদায় বেলায় এমন একটা বিশ্রি বাঘ সাক্ষি হিসেবে দাঁড়িয়ে রইলো, মেনে নিতে পারছেন না তিনি। জীবনে এমন কোন পাপ করেননি, যে পাপের ফল এত নির্মম হতে পারে।
সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সবচে প্রবীণ এবং সর্বশেষ কর্মচারী শমসের আলী বিদায় নিলেন। এখন পুরো বাড়িতে মহাপরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রী ও তার পোষা বাঘ ছাড়া আর কেউ নেই।
প্রধানমন্ত্রী ঘুম থেকে উঠে শমসেরকে না পেয়ে কিছুটা নাখোশ হলেন। মনে মনে বললেন, শমসের তুমিও! তুমিও থাকতে পারলে না!! একটা বাঘ সইতে পারলে না, শমসের!!! শমসেরকে না পেয়ে বাঘের ঘরে গিয়ে দেখলেন বাঘও নেই। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখেন সিংহাসনে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে তার গৃহপালিত পোষা বাঘ। দেখে প্রথম ধাক্কায় ব্যাপারটা হজম করতে পারেননি। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ নিয়ে হাসতে হাসতে বলার চেষ্টা করলেন, – বাহ্, তোমাকে খুব মানিয়েছে।
– তাই নাকি! ভালোতো। তো আসো, তুমি আমার জায়গায় বসো। দেখি তোমাকে কেমন মানায়।
“তুমি আমার জায়গায় বসো।“ মানে প্রধানমন্ত্রীকে বাঘের পায়ের কাছে বসতে বলছে! পোষা বাঘের মুখে এমন কথা শুনে এক অচেনা শংকার বিষে নীল হয়ে গেলেন আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকা মহাকায় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না তার প্রিয় বাঘ সত্যি সত্যি এমন করছে কিনা, নাকি স্বপ্ন দেখছেন। বুঝতে পারছেন না এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত। এই বিশাল বাড়িতে আর কেউ নেই। খুব একা লাগছে তার। বাঘের আচরণ অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এমনতো হওয়ার কথা ছিলো না।
– এমনই হওয়ার কথা ছিলো। আমি তোমার পায়ের কাছে বসে বসে সাহস দেয়ার চাইতে নিজের সাহসে সিংহাসনে বসা বেটার না? তাছাড়া দেশটাতো আসলে আমরাই চালাই। এই দেশে আমার স্বজাতির শাসন কায়েম হবে, এই স্বপ্নতো আজ কালের নয়।
এই কথা বলে সিংহাসনে বসে খুব ভয়ংকরভাবে হাসছে প্রধানমন্ত্রীর বাঘ। বিদঘুটে গলার স্বর, অচেনা অঙ্গভঙ্গি। এটা বাঘের সাথে যায় না। বাঘের অঙ্গভঙ্গি এমন হয় না। সবকিছু কেমন গোলমেলে ঠেকছে।
– ভালো, ভালো। গোলমেলে ঠেকা ভালো। মাত্রতো শুরু হলো। আরো কতকিছু যে গোলমেলে ঠেকবে! বোকা প্রধানমন্ত্রী!
আবার সেই ভয়ংকর বিদঘুটে হাসি। এবার বিস্ময়ের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো যখন দেখলেন সিংহাসন থেকে উঠে তেড়েফুড়ে প্রধানমন্ত্রীর বাঘ তার দিকে এগিয়ে আসছে। এটা নিশ্চিত আক্রমণের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসা। এবার চূড়ান্ত ভয় পেলেন তিনি। কৌশলে পিছু হটে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে যা দেখলেন, তা দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রস্তুত ছিলেন না। এমদমই না। তার পোষা বাঘ আসলে বাঘ নয়। অন্য কিছু। ছদ্মবেশ ধারণ করে ছিলো। শরীর থেকে এক এক করে ছদ্মবেশ খুলছে আর ভয়ংকরভাবে হাত পা ছুঁড়ে নাচছে। ভয়ে, আতংকে প্রধানমন্ত্রী কাঁপছেন। রাগে ক্ষোভে ফুঁসছেন। নিজেকে নিজে ধিক্কার দিচ্ছেন। বাঘের মুখোশ পরা আস্ত একটা হায়েনা কিনে এনেছেন পোষার জন্য। ছদ্মবেশ খুলে হায়েনা এখন পুরো বাসভবনে তান্ডব চালাচ্ছে। সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। উপায় না দেখে ফোন দিলেন তার সেনাপ্রধানের কাছে।
– খুব বিপদে আছি। আমাকে উদ্ধার করুন। আমার অনেক দামে কেনা হায়েনা সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাকে থামান।
– কী বলছেন এসব! হায়েনা পেলেন কোথায়? আমরাতো শুনেছি আপনি খুব সুন্দর, বিচক্ষণ, সাহসী বাঘ কিনেছেন পুষবেন বলে।
– ওটা বাঘ নয়। ওরা বাঘের মুখোশ পরিয়ে আমাকে একটা ভয়ংকর ধুরন্ধর হায়েনা ধরিয়ে দিয়েছে। আমি বুঝতে পারিনি।
ফোন রেখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে একা একা হায়েনার তান্ডব দেখছেন, আর সৈন্যবাহিনীর অপেক্ষা করছেন বিপদগ্রস্থ প্রধানমন্ত্রী। সবমিলিয়ে হয়তো তিনি একা নন, কিন্তু সবাইকে আগেই তাড়িয়ে দিয়েছেন।