Sunday, July 31, 2016

মাল!

লিখেছেন

[মুখবন্ধ: প্রবন্ধের নামটায় আপত্তির একটু গন্ধ রয়েই গেলো। হয়তবা এমন করে উস্কে দিতেই সন্দিহান নাসিকায় কিছু একটা ধরা পড়বে। তবুও আমার মনে হয়েছে আলোচ্য প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর সাথে এই নামকরণই সবচেয়ে মানানসই। পুরো ব্যাপারটার উপর পাঠককুলের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে যা বোধগম্য কারণে অনুমেয়। বস্তুত আধুনিক বাংলা ভাষায় “মাল” শব্দটির বিচিত্র, বহুবিধ অর্থ, ব্যবহার আর প্রাসঙ্গিক কিছু কথা নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে পাঠকদের মাঝে একটু অন্যরকম রসমালাই বিলনোর কিঞ্চিত দুষ্ট অভিপ্রায় থেকে এই রচনার বুৎপত্তি। আশা করব সবাই কৌতুক-ছলে হেসে খেলে লেখাটা পাঠ করার চেষ্টা করবেন। আর পাঠ অন্তে কারো কাছে তা সুখপাঠ্য বিবেচিত হলে কিংবা নিদেনপক্ষে লেখককেই একখান মাল বলে বিশেষায়িত না করলে লেখাটি সার্থক হলেও হতে পারে বলে ধরে নেব।]
সংস্কৃত “মল” ধাতুর সাথে ‘অ’ প্রত্যয় যোগে “মাল” শব্দটির আবির্ভাব যার একাধিক আভিধানিক অর্থ রয়েছে ।
যেমন: পণ্যদ্রব্য, ধনসম্পদ, কুস্তিগির, সাপের ওঝা, মদ-সুরা, খাজনা, মালা ইত্যাদি
[১,২] । সঙ্গীতে “মালকোষ” নামে একটি রাগ-ও পাওয়া যাবে। তবে অধুনা কথ্য বাংলা ভাষায় “মাল” একটি চমকপ্রদ শব্দ যার অর্থ ও প্রয়োগ ততোধিক ব্যাপক। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে “মাল” হতে পারে অর্থ-সম্পদ, জিনিস-পত্র, মদ-মাদক, বিতর্কিত/অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব (আজব চিজ বা আজীব), আবেদনীয় নারী/পুরুষ এবং আপত্তিকর কিছু অর্থ! শব্দটা নর-নারীর বিশেষণ হিসেবে অবমাননাকর হলেও দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার আমরা অহরহই দেখি। উল্লেখ্য, এখানে কোন লিঙ্গের প্রতি তাচ্ছিল্য করার অভিপ্রায় আমার একেবারেই শূন্য। তবে প্রসঙ্গক্রমে নানাভাবে শব্দটির ব্যবহার, বিশ্লেষণ চলে আসবে যা ভালো, মন্দ নির্বিশেষে বস্তুনিষ্ঠ বিবরণের অংশ-মাত্র । এ লেখায় “মাল কাহাকে বলে? উহা কত প্রকার ও কী কী? “–তা উদাহরণ সহকারে পুরোপুরি বুঝিয়ে দিতে না পারলেও চেষ্টা থাকবে বিভিন্ন বাস্তব ঘটনা থেকে পাঠককে এই বৈচিত্র্যময় মালের মাল্য-গাঁথা উপহার দিতে । আজকের পর্বে আলোকপাত করব মদ (Alcoholic drink) নামক মালটি নিয়ে।
ঘটনাটার উদ্ভব একটা অঘটন থেকে। আমাদের অঘটন-ঘটন পটীয়সী এক “ঘটক- ভাই” প্রবাসে এক সৌজন্য-ভোজে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ছিলেন তার সহপাঠী, সহকর্মী নানা দেশী-বিদেশী। তো, ভোজ শুরুর আগে স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী সবাই সবার মদের পেয়ালা উঁচু করে “ভোজ সম্ভাষণ” (toast) জানিয়ে যাচ্ছে। কথা হল, সবাইকে নিজের ভাষায় তা বলতে হবে। ইংরেজিতে “cheers” বা “bottom’s up” , তা তো সবারই জানা। চীনারা বলল “কান পেই”, জাপানিজরা বলে “খোং পে”, কোরিয়ানরা “গোম বে” ইত্যাদি
[৩] । এবার আমাদের বঙ্গ-পুঙ্গব ঘটক ভাইয়ের পালা। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তার কুঞ্চিত ভ্রু দিয়ে মস্তিষ্কের সব বাংলা অভিধান হাতড়িয়েও তিনি “cheers” শব্দটির যুতসই কোন বাংলা বুলি খুঁজে পেলেন না। উনি মদ-মোদী লোক সমুখে কি করে বলেন যে আমাদের মদ-অচ্ছুৎ সমাজে এসব শব্দের কোন বালাই নেই। শব্দহীনতার এই লজ্জা নিঃশব্দে তিনি কিভাবে মাথা পেতে নেন? তাই তিনি ভাবলেন, যে ক্রিয়াটি তারা করছেন তার মূলে রয়েছে মদ তথা “মাল”। আর তাকেই পেয়ালায় পুরে বাড়ি দিয়ে যত বাড়াবাড়ি। অতএব তিনি ঘোষণা দিলেন, “Cheers” কে বাংলায় আমরা বলি “মালে বাড়ি”। বাংলাভাষায় এই অভিনব শব্দটি আবিষ্কার করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, অনেক বিদেশিকেও শব্দটি শিখিয়ে ছেড়েছেন। এই তিনিই আমাদেরকে সময় সুযোগ পেলে উপরোক্ত মাল সম্পর্কিত জ্ঞান দান করতেন।
সেই ছেলেবেলা থেকে মদকে শুধু মানবকুলের ষড়রিপুর (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) অন্যতম হিসাবে জেনে এসেছি । তবে আমাদের সমাজে মদ কেন যে এত ঘৃণ্য বস্তু তা নিয়ে কৌতূহলের কমতি ছিল না আমার কখনো । “মদ পান করলেই মদ্যপ টাল-মাতাল হয় আর অবধারিত ভাবেই সে অসামাজিক কাজ করে”—মূলত এই বদ্ধমূল ধারনা থেকে আলোচ্য মালের প্রতি এহেন নিষেধাজ্ঞা । এক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসনও একটি বড় ব্যাপার। তাছাড়া এ নিয়ে একটা চীনা কথা প্রচলিত আছে যা উপরিউক্ত ধারণার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। তা হল “চিও হোও লোয়ান সিং” (酒后乱性 / jiǔ hòu luàn xìng)-অর্থাৎ মদের পর অবাধ কাম। আমাদের দেশ ছাড়াও পৃথিবী জুড়ে বেশ কয়টি দেশে/অঞ্চলে সরকারীভাবে মদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তার মধ্যে আফগানিস্তান, ব্রুনেই, ভারতের গুজরাট, নাগা-ল্যান্ড, মিজোরাম, ইরান, কুয়েত, লিবিয়া, সৌদি আরব, সুদান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সারজা, ইয়েমেন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য
[৪, ৫]। এমনকি “মদুন্নত” দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত মদ নিষিদ্ধ ছিল। আবার এই মাল-নিষিদ্ধকরণের ঘটনা ইতিহাসে প্রথম ঘটে মালের বর্তমান স্বর্গরাজ্য চীনে, সিয়া রাজবংশের আমলে
[৫] (Xia Dynasty, খৃষ্টপূর্ব ২০৭০-খৃষ্টপূর্ব ১৬০০) ।তবে আমাদের অভিজ্ঞতায় যা বলে তা হল, যে মাল যত বেশি নিষিদ্ধ তার উপর তত বেশি আকর্ষণ । কৌতূহল মেটাতে সুযোগ সন্ধানী মন তাই কখনো-সখনো কি একটু বেপরোয়াও হয় না? হয় হয়ত। কিন্তু কী এমন আছে এই দুর্নিবার গন্দমে? কী-ই বা তার রহস্য?
ঐতিহাসিক দলিল থেকে জানা যায়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মদের ইতিহাস মানব সভ্যতার কৃষি-শিল্পের মতই কয়েক হাজার বছরের পুরানো। খৃস্টপূর্ব ৮০০০ সাল থেকে ৬০০০ সাল সময়টাতে প্রাচীন জর্জিয়া, ইরান, আর্মেনিয়া অঞ্চলে প্রথম মদ উৎপাদনের প্রমাণ মেলে
[৬]। আদি গ্রীস(ম্যাসিডোনিয়া), মিশর এবং চীন দেশেও এই মাল বেশ শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। তখন মদ ছিল মূলত দ্রাক্ষারস বা প্রক্রিয়াজাত আঙ্গুর ফলের নির্যাস। এখনও, আঙ্গুর সহ অন্যান্য ফল, চাল, গম, ভুট্টা, দুধ, মধু, বিভিন্ন গাছ-গাছড়া প্রভৃতির ভিতর শর্করা বা চিনির যে অংশ থাকে তাকে “ঈস্ট” (Yeast, একধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভুঁইফোড় ছত্রাক) দিয়ে চোলাই করে বা গেঁজিয়ে এলকোহলে রূপান্তর করাই মদ-উৎপাদনের মূলনীতি
[৭]। যেমন: আঙ্গুর ফলের ৮০% ভাগ জল আর ২০% চিনি যা ঐ ভুঁইফোড় ঈস্ট লেলিয়ে “সাইজ” করলে জল, এলকো ও আঙ্গুরের একধরনের সুগন্ধদ্রব্যে সংশ্লেষিত হয়। এরসাথে আরও কিছু উপাদান বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে তৈরি হয় নানা কিসিমের মাল। এক-গ্লাস ৪ ওজনের সাধারণ মদে (a glass of 4oz wine) যেসব উপাদান থাকে তা মোটামুটিভাবে এরকম [৭] – ১) জল ২৫০ গ্রাম, ২) ইথাইল এলকোহল ২৫ গ্রাম, ৩) গ্লিসারিন ৩ গ্রাম, ৪) পেকটিন ১ গ্রাম, ৫) এসিড ১ গ্রাম, ৬) পলি-ফেনল ৫০০ গ্রাম এবং অন্যান্য সুগন্ধ দ্রব্য। দুনিয়া-ভর ছড়িয়ে আছে হাজার রকমের মাল যাদের সুনির্দিষ্ট শ্রেণীবিন্যাস বা রকমভেদ করা একটু কষ্টকর। তবে মদে এলকোর মাত্রানুযায়ী মাল সমাজকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়
[৮]। নিম্ন মাত্রার (মোটামুটি ভাবে ২০ থেকে ৩৮ মাত্রার), মধ্য মাত্রার (৪১ থেকে ৫০ মাত্রার) ও উচ্চ মাত্রার (৫৪ থেকে ৬৫ মাত্রার) মাল। এছাড়া ২০ মাত্রার নিচে অনেক এলকো-পানিয় আছে , প্রকৃষ্ট মাল-খোরদের কাছে যা নাকি মাল নামের কলঙ্ক বা “মাল স্কয়ার” {মাল২ = মালদের* মাল (MAL*= Most Attractive Lady, যা নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা হতে পারে)} । মাল-মাত্রার এই হিসাবটা হল: ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০০ মিলিলিটার মালে ৫০ মিলি এলকোহল থাকলে তাকে বলে ৫০ মাত্রার মাল। তবে মালের ধর্ম বা গুনাগুণের উপর ভিত্তি করে পণ্ডিতেরা মূল শ্রেণীবিন্যাসটা করে থাকেন যা-ও আবার তিনভাগে বিভক্ত: ১) গাঁজানো মদ (Fermented Liquors)- যেমন: দ্রাক্ষা মদ (Grape Wine), বিয়ার (Beer), তাড়ি, পান্তা মদ (Rice Wine, গ্রামবাংলায় অনেকেই পান্তা ভাত বেশ কিছুদিনের বাসি করে বা পচিয়ে খেতে পছন্দ করেন), আপেল মদ (Cider Wine/Applejack) ইত্যাদি; ২) পাতিত মদ (Spirituous Liquors/Distilled Liquors)- যেমন: হুইস্কি (Whisky), ব্রান্ডি (Brandy), ভদকা (Vodka), রাম (Rum), টাকিলা (Tequila), চীনা সাদা মদ (White Wine) ইত্যাদি; ৩) পরিশোধিত মিশ্র মদ (Refined & comprehensive drinks)-যেমন: জিন (Gin), লিকার (liqueur), ভেরমাউথ( Vermouth), বিটার (Bitter) প্রভৃতি। এখানে বিভিন্ন গোত্রের সুপরিচিত কিছু মদের প্রচলিত ইংরেজি নাম ও তাদের সম্ভাব্য বাংলা অনুবাদের একটি ছোট্ট তালিকা (১ নং ছক দ্রষ্টব্য) [৯,১০] এবং মদ-বোতলের একটি আলোকচিত্র দেওয়া হল
[৯] (১ নং ছবি দ্রষ্টব্য) ।


মালের এই কাঠখোট্টা প্রকারভেদের পর আসা যাক মাল-সংস্কৃতিতে। আমাদের কাছে অসভ্য এই মদ নিয়ে চীনা, ফরাসী, আমেরিকান, ও ইউরোপীয় অন্যান্য সভ্যতায় অনেক আদিখ্যেতা রয়েছে। চীনা সমাজে নিয়মিত মদ্যপান এবং অন্যকে মদ্যপানে উস্কানি দেওয়ার রেওয়াজ তো বড়ই অতুলনীয়। এরা নৈশভোজে মদ খায়; হালখাতা, পার্বণে, সময়ে-অসময়ে, সুখে,দুখে যেকোনো অজুহাতে ব্যাপক মদ গেলে। বাঙ্গালীরা যেমন খুশির খবরে, আনন্দঘন উপলক্ষে মিষ্টি বিলোয়, চীনারা তেমন বইয়ে দেয় মদের বন্যা। এখানে কে কত মদ গিলতে পারে অর্থাৎ গিলিত মালের পরিমাণের উপরও একধরনের প্রশংসা প্রকাশ করা হয়। অনেকটা আমরা যখন কাউকে উস্কানি দিয়ে বলি, “কিরে, দেখি তোর গায়ে জোর কত?”, কিংবা ” ওই ব্যাটা তুই কয় ক্যালাচ পর্যন্ত পড়ছোচ?” সেরকম চীনারা বলে, “কি মশাই, তোমার মাল টানার ক্ষ্যামতা ক্যামুন?” ইত্যাদি। বিশেষ উপলক্ষে, অতিথি আপ্যায়নে বা স্রেফ মজা করার জন্য চীনারা বাড়ির বাইরে কোন রেস্তোরাঁয় একসাথে খেতে পছন্দ করে। সেখানে সাধারণত একটা ঘূর্ণন-যোগ্য গোলটেবিলে দশ-বারোজন গোল হয়ে বসে নানা পদের হরেক রকমের “ছাই” (菜 cai == তরকারি, পদ) খায়। অনেকের জন্যে ছোট্ট এক বাটি, আধা বাটি ভাত বা একটুকরো করে রুটির অর্ডার দেওয়া হয় । ছাই খেয়ে পরে পেট না ভরলে তাই দিয়ে উদরপূর্তি করবে বলে। নিঃসন্দেহে এদেরকে আমার মতো “ভেতো বাঙ্গাল” বা “ভাতুড়ে” না বলে বলতে হবে “মদুড়ে” বা “মদু”। যাহোক, আহারের শুরুতেই সেখানে বোতল খুলে ছোট বড় পেয়ালায় ঢালা হয় মদ। এই মদ যত কড়া হয় পেয়ালার আকৃতি হয় তত ছোট । যেমন: বিয়ারের আধার হয় সবচেয়ে বড় যেমনটা হয় জলের পেয়ালা। রেড ওয়াইন বা লাল মদের পাত্র হয় একটু ছোট; মূলত একটা কাঁচ-দণ্ডের উপর বসানো অঞ্জলি আকৃতির বা উপবৃত্তাকার কাঁচ-পাত্রে ঢালা হয় হাল ফ্যাশনের লাল মদ গোত্রীয় মালগুলো। এরপর সবচেয়ে কড়া ৫৬ ডিগ্রি চাইনিজ পাই চিও বা সাদা মদের গ্লাস হয় এতটুকুন-অনেকটা আমরা ছোটবেলায় মিত্তি মিত্তি রান্না-বাটী খেলার সময় যে ধরনের ছোট ছোট মাটির গ্লাস ব্যাবহার করি সেরকম ক্ষুদ্রাকৃতির।

পেয়ালার আকার-প্রকৃতি যাই হোক না কেন মালটা শেষমেশ উদর-থলিতেই জমা হয়। তবে সেখানে তা জমা করার আগে পেয়ালায় পেয়ালায় বাড়ি দিয়ে টুং-টাং, খুট-খাট, ধ্রিম-ধ্রাম শব্দ করায় এবং গাদা-খানেক প্রশংসা মূলক, শুভেচ্ছা জ্ঞাপক বাণী ঢেলে অন্যকে ধরে-বেঁধে মদ গিলানোর মৌখিক শিল্পে চীনাদের জুড়ি মেলা ভার। ফরাসিরাও নাকি জলের মতো খাবার টেবিলে মদ খায়। আমাদের দেশে লঞ্চ, ফেরিঘাটে ভাতের হোটেলে যেমন ভাত ফ্রি দেওয়া হয় (সাথে নদীর ফিল্টার পানি), শুনেছি ফ্রান্সের সাধারণ রেস্তরা গুলোতে মধ্যাহ্ন ও নৈশভোজে নাকি নানা রকম আঙ্গুর মদ মাঙনা পাওয়া যায়। তবে ওরা এমন চিজ যে মালটাকে চিজ (cheese) দিয়ে মাখিয়ে খায় [১১]।
তো, মদ-সভ্যতা তা যেখানকারই হোক না কেন, একটা জিনিস প্রায় সব মদ-অনুমোদিত সমাজে ধ্রুব, তা হল মদ খেয়ে মাতাল হলে তার “সাতখুন” মাফ (মদ খেয়ে গাড়ি চালনা এর ব্যতিক্রম)। অর্থাৎ, যে কাজগুলো মদ না খেয়ে করলে আশেপাশের লোকজন তাকে এক বা একাধিক বৃহদাকার চড়-থাবড়া মেরে দাঁতের পাটী ঝুলিয়ে দিত, মাতাল হবার পর ঐ একই কাজে সবাই কেমন জানি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে। আর অনেক দুষ্ট লোকে নানা সময় বিভিন্নভাবে এই সুযোগটি কাজে লাগাতে তৎপর হয়। ব্যক্তিগতভাবে মদ খেয়ে মাতাল হবার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কখনো আমার হয়নি। হাতে গোনা যে দুই একবার “সহমোদীদের” জোরাজুরি আর স্থানীয় ভদ্রতার খাতিরে অনন্যোপায় পেটে মালটা একটু বেশি (আমার এই “বেশি” আবার জাত মাল-খোরদের কাছে নাকি নস্যি) পড়েছে তাতে উপসর্গ হিসাবে মাথাধরা আর কিঞ্চিত তন্দ্রাভাব অনুভব করেছি। সিনেমা, নাটকের মতো নিজের ব্যক্তিত্ব ভুলে আচানক লম্ফ-ঝম্পে তুলকালাম লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে, হৈ হৈ রৈ রৈ, হারে রে রে রবে “ভাঙ্গ গাড়ি” যোশ-উত্থিত রাজাধিরাজ ভাব নিয়ে, বমির বন্যায় গালির পাল তুলে তাণ্ডব নৃত্য কিংবা অন্ততপক্ষে রূপকথার রূপবানের মতন কোমর দুলাইয়া খ্যামটা নাচন নাচতে অথবা কাম-রিপুর প্রচণ্ড কামড়ে কামাতুর হয়ে নিজেকে শূন্যে উড়ে বেড়ানো স্বর্গীয় অপ্সরাদের মাঝে “আজিজ মোহাম্মদ ভাই” ভাবতে পারিনি। কারণ, প্রতিবারই হয়ত দেহ-মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগেই নিজের ওজন বুঝে সংযত থাকতে পেরেছিলাম। যাহোক, অন্যের কাছ থেকে শুনে ও পাণ্ডুলিপি পড়ে মাতলামির কারণটা যতদূর বোধগম্য হয় তাহলো: আলোচ্য পাগলা পানি বা মালের মধ্যে যে ইথাইল এলকোহল (ethyl alcohol/ethanol: CH3CH2OH) থাকে তা আমাদের দেহের পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র দ্বারা শোষিত হয়ে পৌঁছে যায় যকৃতে। সেখান থেকে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, পেশী, কলা সহ সারা দেহে [১২,১৩]। এই প্রক্রিয়াটা খুব দ্রুত ঘটে যায় এবং এটাই দেহে অনেক সময় উত্তেজনা বা সুখানুভূতির জন্ম দেয়। পূর্ণ-পাকস্থলী বা ভরা পেটে মাল গ্রহণে অবশ্য এলকোহল শোষণ হয় অপেক্ষাকৃত ধীরে। সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ার পর দেহের উপর এলকোহলের ক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় প্রতিক্রিয়া। আমাদের দেহে যেহেতু এলকোহল সঞ্চয় করার উপায় নেই দেহ মহাদেব তাই এই মাল গুলোকে প্রক্রিয়াজাত করতে এবং কিছুটা দেহ হতে বিতাড়িত করতে উঠে পড়ে লাগে। বৃক্ক বাবু বা কিডনি আর ফুসফুস মিলে দেহের প্রায় ১০% এলকো-মামাকে মূত্র ও প্রশ্বাসের মাধ্যমে ঝেটিয়ে বিদেয় করে। (এই কারণেই মাল-খোর গাড়ী-চালক ধরতে প্রশ্বাস-বিশ্লেষক যন্ত্রের মাধ্যমে রক্তে এলকোর পরিমাপ করা হয়) । আর যকৃত গোঁসাই বাকি ৯০% কারারুদ্ধ এলকো-ডাকুর হাড়-গোড় ভেঙ্গে, বিশ্লেষণ করে তৈরি করে এসিটেট (acetate, CH3CO2−)। আর এই পুরো প্রক্রিয়ার ফলে মানব শরীর ও মনে নানা ধরনের প্রভাব পড়ে। যেমন: ঠিকমতো কথা বলতে না পারা, অকারণে হাসা, একটা খুশি খুশি মেজাজে থাকা, ঠিকমতো হাঁটতে না পারা, বমি করা, মাথা ধরা, অপেক্ষাকৃত বেশি কামাতুর হওয়া, স্মৃতি শক্তি লোপ পাওয়া ইত্যাদি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এর মানে এই নয় যে, কেউ মাল মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই উপরিউক্ত উপসর্গে আক্রান্ত হবে। কতখানি মালাসক্ত হয়ে কে কোন ধরনের আচরণ করবে তা নির্ভর করে, ঐ ব্যক্তির মাল-টানার অভ্যাস, বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক অবস্থা ও বিশেষ করে মালের পরিমাণের উপর। তবে কার জন্য কতটুকু মাল প্রযোজ্য তা বলা কষ্ট এবং তা পরীক্ষা নিরীক্ষা সাপেক্ষ। এজন্য দরকার হতে পারে ছোট-ক্লাসের বিজ্ঞান বইয়ের মতো অনুসন্ধান: “এসো নিজে করি- মাল পয়েন্ট এক” । এক্ষেত্রে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: “মাল খেয়ে টাল হলে নিজ দায়িত্বে পকেট এবং দেহ সাবধান”।
সামগ্রিক বিচারে মাল খাওয়ায় উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি। সীমা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত মদপান করলে যকৃত, অগ্ন্যাশয়, মস্তিষ্ক সহ অন্যান্য প্রত্যঙ্গে নানাবিধ ব্যাধি হতে পারে । তবে ধারণা করা হয়, সীমিত পরিমাণে (১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের জন্য সপ্তাহে দুই এক গ্লাস থেকে প্রতিদিন এক গ্লাস পর্যন্ত) নিয়ন্ত্রিত কিছু মদ্যপানে (যেমন: লাল মদ) হৃদপিণ্ড, মূত্রাশয়ের কাজ ভাল চলে এবং দেহে তাৎক্ষনিক শক্তি সঞ্চার হয় [১৪,১৫]। যে কারণে শীত প্রধান অঞ্চলে উচ্চ মাত্রার মদ পান একটি নৈমিত্তিক অভ্যাস যা সবার জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে একজন যোগ্য চিকিৎসকই পারে আপনাকে সঠিক পরামর্শ দিতে।
তবে এত কিছুর পরেও কেন জানি প্রাচীন চীনা কবিগুরু লি পাই (李白/ lǐ bái ৭০১-৭৬২)এর ছিয়াং চিন চিও (将进酒qiang jìn jiǔ=এসো মাতাল হই)কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেল। মদ-কাতর কবির কাছে মাতাল হয়ে ধুম মেরে থাকাই যেন জন্ম-জন্মান্তরের তপস্যা। তিনি কিছুতেই মাতলামির ঘোর থেকে পঙ্কিল বাস্তব জীবনের রূঢ়তায় জেগে উঠতে চাইতেন না। কবিতা লেখা আর মাল টানাই ছিল তার ধ্যান জ্ঞান। ভাবখানা অনেকটা এরকম:
“কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর?
মালেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মালেতেই সুরাসুর।”
শুনুন তার “ছিয়াং চিন চিও” কবিতার দুটি লাইন [১৬] –
人生得意须尽欢,莫使金樽空对月。
(rén shēng dé yì xū jìn huān, mò shǐ jīn zūn kòng duì yuè
রেন সং দো ঈ শুই চিন হুয়ান, মো স্রি চিন চোন খুং তোয়ে ইউয়ে। )
(人生/ rén shēng/রেন সং==মানব জীবন; 得意/ dé yì/ দো ঈ==বড় গর্বের; 须尽欢/ xū jìn huān/ শুই চিন হুয়ান==যত পার মজা কর; 莫使/ mò shǐ/ মো স্রি==রেখো না; 金樽/ jīn zūn/চিন চোন==স্বর্ণ খচিত মদের পেয়ালা/ সাধের মদ পাত্র; 空对月/kòng duì yuè/খুং তোয়ে ইউয়ে==চাঁদ মুখো খালি করে/ উপরের দিক মুখ করা অবস্থায় মদ পাত্র খালি থাকতে দিও না। শুধুমাত্র নিচের দিকে মুখ করার সময়, মানে মাল মুখে ঢালার সময়ই মদ পাত্র খালি রাখতে পারবে।)
অর্থাৎ কবির কথাগুলোকে সোজা বাংলায় একটু গুছিয়ে লিখলে যা হয় তা হল:
মানব জীবন মধুর জীবন, মজা লোট যখন তখন।
মদ পাত্র পূর্ণ রেখ, খালি হবে গিলবে যখন
। ”
সবাইকে সুস্বাস্থ্য কামনায় এই পর্বের ইতি টানছি।
(চললেও চলতে পারে…)
তথ্যসূত্র:
[১] সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান; আহমদ শরীফ; পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ; বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৯
[২] সংসদ বাংলা অভিধান; শৈলেন্দ্র বিশ্বাস; পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত পঞ্চম সংস্করণ; সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০০
[৩] http://matadornetwork.com/nights/how-to-say-cheers-in-50-languages/
[৪] http://en.wikipedia.org/wiki/List_of_countries_with_alcohol_prohibition
[৫] http://en.wikipedia.org/wiki/Prohibition
[৬] http://en.wikipedia.org/wiki/History_of_wine
[৭] http://wineintro.com/basics/health/chemistry.html
[৮] http://zhidao.baidu.com/question/3839501.html
[৯] http://www.thevirtualbar.com/Entertain/BrandNames.html
[১০] http://www.alcoholbars.com/alcohol-brands
[১১] http://www.2020site.org/fun-facts/Fun-Facts-About-France.html
[১২] http://www.drinkingandyou.com/site/uk/health/male%20body.htm
[১৩] http://science.howstuffworks.com/environmental/life/human-biology/alcoholism3.htm
[১৪] http://www.alcoholdrinkers.com/articles/134/1/Health-benefits-and-disadvantages-of-alcohol.html
[১৫] http://www.livestrong.com/article/517854-the-advantages-disadvantages-of-drinking-alcoholic-beverages/
[১৬] http://baike.baidu.com/view/31478.htm