১৭ই এপ্রিল ১৯৪৬ সালে ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা লাভ করা সিরিয়া ১৯৭১ সাল থেকে শাসন করে আসছে আসাদ ফ্যামিলি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদ ছিলেন বিমানবাহিনীর প্রধান। ১৯৬৬ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে বাথ পার্টি তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব দেয়। কিন্তু ১৯৭০ সালে হাফিজ আল আসাদ আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে বাথ পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কারাগারে ঢুকান এবং নিজেকে ঘোষণা দেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসাবে।
হাফিজ আল আসাদ
আসাদের গোত্র অ্যালাওয়াইটরা বিশ্বাসের দিক থেকে শিয়া মতালম্বি। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার(২২ মিলিয়ন) মধ্যে এই গোত্রের সদস্যরা ১২% হলেও আসাদ ফ্যামিলি ক্ষমতা দখল করার পর দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছে তারা। মেধা কিংবা যোগ্যতা নয়, সিরিয়ায় ভালো চাকরী পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় এই গোত্রের সদস্য হলে কিংবা তাদের গোলামি করলে। রাষ্ট্রের এই বঞ্চনা ক্ষোভের জন্ম দেয় সিরিয়ার অন্যান্য সাধারণ মানুষদের মনে।
সিরিয়ায় alawite গোত্রের অবস্থান
আজ যে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তার শুরুটা কিন্তু এখন নয়। বঞ্চনার বিরুদ্ধে সবসময়ই প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে আসছিলেন সাধারণ নাগরিকরা। কিন্তু প্রতিবাদ করার কোন অধিকার যেন ছিল না তাদের। যদি কোন দল বা গোষ্ঠী বিক্ষোভ করার চেষ্টা করত, তা অন্ত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করতেন হাফিজ আল আসাদ। যার মধ্যে Hama massacre খ্যাত ১৯৮২ সালের ঘটনাটি আজও মানুষ কষ্টের সাথে স্মরণ করে। যেই ঘটনায় হাফিজ আল আসাদের নির্দেশে হত্যা করা ৪০ হাজার বিক্ষোভকারীকে।
হামার গণহত্যার একটি দৃশ্য
হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু শোষণ-নিপীড়ন, নির্যাতনে বাবার চেয়েও কোন অংশে কম নয় বাশার। বাক অথবা ব্যক্তিস্বাধীনতার স্থান নেই সিরিয়ায়। বাশারকে সম্বোধন করতে হয় 'মি. প্রেসিডেন্ট' বলে, অন্যথায় জেল-জুলুল, শাস্তি নিশ্চিত।
বাশার আল আসাদ
এক মহিলা ডাক্তারকে গ্রেফতারের ঘটনায় বুঝা যায় কতটা নিয়ন্ত্রিত সে দেশের নিউজ মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া। সেই ডাক্তারের অপরাধ তিনি গাদ্দাফির স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ায় লিবিয়াবাসিকে অভিনন্দন জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। আর এতেই তাকে গ্রেফতার করে সিরিয় সরকার এবং মাথার চুল চেঁছে দিয়ে তাকে বন্দি করা হয় জেলে।
সালটা ২০১১, আরব বসন্তে একের পর এক পতন ঘটছে স্বৈরচার শাসকদের। যাতে উজ্জিবিত হয়ে স্বৈরশাসক আসাদবিরোধী সিরিয়ার নাগরিকরা (alawite গোত্র ব্যতিত দেশের প্রায় সকল নাগরিক) বিক্ষোভ শুরু করে আসাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাবার মতই আসাদের নির্দেশে সরকারী বাহিনী গুলি চালায় বিক্ষোভকারীদের উপর। প্রায় এক মাস চলছিল এমনি, যখনি চেষ্টা করা হয়েছে বিক্ষোভের, আসাদ বাহিনী গুলি চালিয়েছে নির্বিচারে। আর তাতেই এই বিক্ষোভ এক সময় রূপ নেয় সশস্ত্র বিদ্রোহে।0
আসাদবিরোধী বিক্ষোভের একটি দৃশ্য
এভাবে একের পর এক যখন বিক্ষোভকারীদের উপর গণহত্যা চালাচ্ছিল আসাদ বাহিনী। তখনই এক দল সৈন্য আসাদের পক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষোভকারীদের পক্ষে চলে আসে এবং ঘোষণা দেয় বিক্ষোভকারীদের রক্ষার। সাধারণ বিক্ষোভকারী যারা পূর্বে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল এবং অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক যোগ দেয় পক্ষ ত্যাগকারী এই আর্মিদের সাথে। যাদের সবার লক্ষ্য আসাদ ফ্যামিলিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা।
আসাদবিরোধী লড়াইয়ে অংশরত সবাই মিলে গঠন করে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি বা FSA
FSA এর প্রশিক্ষণের একটি দৃশ্য
আগস্ট, ২০১১ সালের দিকে সিরিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল নামে সরকার গঠন করে। ধারনা করা হচ্ছিল সিরিয়ায় বোধহয় লিবিয়ার অনুরূপ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। প্রথমে কিছু সেনাদের বিদ্রোহ, তারপর বিদ্রোহীদের সরকার ঘটন, তারপর পশ্চিমাদের সহায়তায় ক্ষমতায় আসা। সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের আগমনের পর এমনটাই হওয়া ছিল স্বাভাবিক।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের মিটিং
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুধু সিরিয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। যদিও এটি কোন বিশ্বযুদ্ধের রূপ ধারন করেনি অথবা ধারন করার কোন সম্ভাবনা নেই তবু বিশ্বের প্রায় সকল শক্তিধর রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে। আসাদ গোত্র শিয়া হওয়ার সুবাদে তাদের পক্ষ নিয়েছে ইরান ও লেবাননের হিযবুল্লাহ গ্রুপ এবং ইরান ও আসাদের সাথে সুসম্পর্কের কারণে চিন ও রাশিয়াও আসাদকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। সিরিয়ার ৭২% লোক সুন্নি মুসলিম, আরবের সুন্নি রাজারা যদিও নিজেরা ধার্মিক নয়, তবু শিয়াদের বিরুদ্ধে সুন্নিদের এই সশস্ত্র বিদ্রোহকে নানাভাবে সহায়তা করছে। আর ইসরাইলের সাথে সিরিয়ার এবং হিজবুল্লার কয়েকটি যুদ্ধের ইতিহাস থাকায় পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো পক্ষ নিয়েছে আসাদবিরোধীদের।
ইরান ও হিজবুল্লাহ অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে সরাসরি লড়াই করছে আসাদের পক্ষে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সহায়তা পাচ্ছে তারা চিন ও রাশিয়ার কাছ থেকে। ন্যাশনাল কাউন্সিল তাই কয়েক বার অস্ত্র সহযোগিতা চায় পশ্চিমাদের কাছ থেকে। কিন্তু পশ্চিমারা একটি ভয়ের কথা ব্যক্ত করে যে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের একটি অংশ কট্টর ইসলামপন্থী, তাই তারা ভীত যে অস্ত্র দিলে সেটা মুজাহিদিনদের হাতে চলে যাবে। সিরিয়ার জিহাদিরাও আমেরিকা থেকে অস্ত্র চায় না এবং প্রত্যাখ্যান করে বিদ্রোহী সরকারকে।
নামাজরত সিরিয়ার মুজাহিদিনরা
USA এবং ইসরাইলসহ পশ্চিমা বিশ্বের ভয়ের কারণ, মুজাহিদিনদের এই লড়াই শুধু আসাদকে হটানোতেই সীমাবদ্ধ নয়, তাদের টার্গেট সিরিয়ায় ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা এবং শরিয়াহ আইন চালু করা। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের প্রায় ৬০% ভাগ এই মুজাহিদিনদের পক্ষে, তাছাড়া সুন্নি মুসলিমদের উপর আসাদের নির্যাতনের ঘটনা এবং ইসলামী খেলাফতের স্বপ্ন সারা বিশ্বের মুসলিম তরুণদের নিয়ে আসছে সিরিয়ায়। যার মধ্যে ইরাক, আফগান, সোমালিয়া, বসনিয়া প্রভৃতি দেশসমুহের মুজাহিদীনরা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আরব এবং পশ্চিমা দেশসমূহের অনেক মুসলিম তরুণ, সিরিয়াতেই যাদের প্রথম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা।
চেচেন মুজাহিদের নেতৃত্বে অংশরত বিভিন্ন দেশের মুজাহিদরা
সিরিয়ায় এই তিন দলের বাহিরেও আরেকটি দল লড়াই করছে যাদের কথা তেমন আলোচনায় আসে না। উপরের তিনটি দলের লড়াইয়ের মৌলিক লক্ষ্যের মধ্যে সিরিয়া বিভক্ত করার বিষয়টি নেই। কিন্তু কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর লক্ষ্য সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি বিরাট অংশ দখলে নিয়ে স্বাধীন কুর্দিস্থান গঠন করা যে দেশের স্বাধিনতায় আর কোন আঘাত আসবে না। শুধু সিরিয়াতেই নয়, ইরাক, তুরস্কসহ আরও কয়েকটি দেশেও স্বাধীন ভূমির জন্য লড়াই করছে কুর্দি বিদ্রোহীরা।
দুই বছর সাত মাস পূর্বে সিরিয়ায় শুরু হওয়ায় যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে সোয়া লাখের উপর মানুষ। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে প্রায় দুই লাখের বেশী শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়া গৃহহীন মানুষের সংখ্যা সাত লাখ বলা হয়েছে। যদিও এগুলো পরিসংখ্যান, কিন্তু বাস্তবতা এর চেয়ে ভয়াবহ।
জর্ডানের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার পথে বিশ্রাম নিচ্ছে কয়েকটি সিরিয় পরিবার
সিরিয়ার যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই বাশার বাহিনী সিরিয়ার অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। কিছুদিন পূর্বে ইরান বলেছিল, আমেরিকার সাথে তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে আগ্রহী। অর্থাৎ, আমেরিকার সহায়তায় ইরান সিরিয়ার মুজাহিদিনদের হারিয়ে আসাদকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। যদি আমেরিকা তাতে সম্মত হয়, তবে ইরান, হিযবুল্লাহ, রাশিয়া, চিন, আমেরিকা, ইসরাইলসহ পশ্চিমা বিশ্বের সব দেশকে এক কাতারে দেখতে পাওয়া যাবে। যদিও আসাদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে, তবু তারা এখন আসাদের পক্ষ নেওয়া অস্বাভাবিক নয় কারণ, আসাদকে পুনরায় ক্ষমতায় বসিয়ে দিলে সে পশ্চিমা বিশ্বের গোলাম হয়ে থাকবে এবং মুজাহিদিনরা যদি সিরিয়া দখল করে নেয় তবে সেই সিরিয়া হবে পশ্চিমাদের জন্য এক দুঃস্বপ্নের নাম। কিন্তু মেরুদণ্ডহীন আরব রাজাদের জন্য ইরান-আমেরিকার সুসম্পর্ক মেনে নেওয়াটা হবে কষ্টের।
অপরদিকে আরেকটি সম্ভাবনা রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো সিরিয়ায় হামলা করে আসাদকে হটিয়ে তাদের অনুগত ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে ক্ষমতায় বসাবে এবং মুজাহিদীনদের সন্ত্রাস আখ্যায়িত করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসাবে সিরিয়ায় নিজেদের সৈন্য রাখতে চাইতে পারে।তখন অবশ্য শান্তি ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। কারণ, একদিকে বাশার বাহিনী ও তাদের মিত্র হিজবুল্লাহ এই ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সরকারের উপর হামলা করবে, অপরদিকে মুজাহিদীনদের হামলা তো রয়েছেই। এই অবস্থায় আরব রাজারা থাকবে সবচেয়ে নির্ভাবনায় এবং নবগঠিত সরকারকে বিপুল অর্থ দিয়ে সহায়তা করবে এটা নিশ্চিতকরেই বলা যায়।
মুজাহিদীনরা এখন পর্যন্ত যেভাবে লড়ছে তাতে সমগ্র সিরিয়ায় তাদের বিজয় লাভ করা অসম্ভব নয়। কুর্দি বিদ্রোহীদের সাথে যদি শান্তিচুক্তি করে যে কুর্দিদের কোন নিপীড়ন করা হবে না, তাহলে হয়ত কুর্দিদেরও পাশে পাওয়া যাবে। কিছুদিন পূর্বে কুর্দিদের ছোট দুইটি বিদ্রোহী গ্রুপ শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুজাহিদীন দের সাথে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হল, মুজাহিদিনদের পাশে আন্তর্জাতিক কোন সমর্থন নেই যা একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র গঠন ও সরকারের স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করবে। কিন্তু যদি আমেরিকা অথবা ইসরাইল সেই মুজাহিদিনদের হামলা করে, তবে সেটা আরেক আফগানস্থানের মত হতে পারে এবং যুদ্ধ পুরা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে।
এই যুদ্ধের ফলাফল কি হবে? কে জয় লাভ করবে? কুর্দিরা কি পারবে তাদের স্বপ্নের স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করতে? সিরিয়ার শরণার্থীরা কবে তাদের নিজ গৃহে ফিরতে পারবে?
এমন শত প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও দীর্ঘ সময়ের।
হাফিজ আল আসাদ
আসাদের গোত্র অ্যালাওয়াইটরা বিশ্বাসের দিক থেকে শিয়া মতালম্বি। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার(২২ মিলিয়ন) মধ্যে এই গোত্রের সদস্যরা ১২% হলেও আসাদ ফ্যামিলি ক্ষমতা দখল করার পর দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছে তারা। মেধা কিংবা যোগ্যতা নয়, সিরিয়ায় ভালো চাকরী পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় এই গোত্রের সদস্য হলে কিংবা তাদের গোলামি করলে। রাষ্ট্রের এই বঞ্চনা ক্ষোভের জন্ম দেয় সিরিয়ার অন্যান্য সাধারণ মানুষদের মনে।
সিরিয়ায় alawite গোত্রের অবস্থান
আজ যে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তার শুরুটা কিন্তু এখন নয়। বঞ্চনার বিরুদ্ধে সবসময়ই প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে আসছিলেন সাধারণ নাগরিকরা। কিন্তু প্রতিবাদ করার কোন অধিকার যেন ছিল না তাদের। যদি কোন দল বা গোষ্ঠী বিক্ষোভ করার চেষ্টা করত, তা অন্ত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করতেন হাফিজ আল আসাদ। যার মধ্যে Hama massacre খ্যাত ১৯৮২ সালের ঘটনাটি আজও মানুষ কষ্টের সাথে স্মরণ করে। যেই ঘটনায় হাফিজ আল আসাদের নির্দেশে হত্যা করা ৪০ হাজার বিক্ষোভকারীকে।
হামার গণহত্যার একটি দৃশ্য
হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর ২০০০ সালে সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু শোষণ-নিপীড়ন, নির্যাতনে বাবার চেয়েও কোন অংশে কম নয় বাশার। বাক অথবা ব্যক্তিস্বাধীনতার স্থান নেই সিরিয়ায়। বাশারকে সম্বোধন করতে হয় 'মি. প্রেসিডেন্ট' বলে, অন্যথায় জেল-জুলুল, শাস্তি নিশ্চিত।
এক মহিলা ডাক্তারকে গ্রেফতারের ঘটনায় বুঝা যায় কতটা নিয়ন্ত্রিত সে দেশের নিউজ মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া। সেই ডাক্তারের অপরাধ তিনি গাদ্দাফির স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ায় লিবিয়াবাসিকে অভিনন্দন জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। আর এতেই তাকে গ্রেফতার করে সিরিয় সরকার এবং মাথার চুল চেঁছে দিয়ে তাকে বন্দি করা হয় জেলে।
সালটা ২০১১, আরব বসন্তে একের পর এক পতন ঘটছে স্বৈরচার শাসকদের। যাতে উজ্জিবিত হয়ে স্বৈরশাসক আসাদবিরোধী সিরিয়ার নাগরিকরা (alawite গোত্র ব্যতিত দেশের প্রায় সকল নাগরিক) বিক্ষোভ শুরু করে আসাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাবার মতই আসাদের নির্দেশে সরকারী বাহিনী গুলি চালায় বিক্ষোভকারীদের উপর। প্রায় এক মাস চলছিল এমনি, যখনি চেষ্টা করা হয়েছে বিক্ষোভের, আসাদ বাহিনী গুলি চালিয়েছে নির্বিচারে। আর তাতেই এই বিক্ষোভ এক সময় রূপ নেয় সশস্ত্র বিদ্রোহে।0
এভাবে একের পর এক যখন বিক্ষোভকারীদের উপর গণহত্যা চালাচ্ছিল আসাদ বাহিনী। তখনই এক দল সৈন্য আসাদের পক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষোভকারীদের পক্ষে চলে আসে এবং ঘোষণা দেয় বিক্ষোভকারীদের রক্ষার। সাধারণ বিক্ষোভকারী যারা পূর্বে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল এবং অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক যোগ দেয় পক্ষ ত্যাগকারী এই আর্মিদের সাথে। যাদের সবার লক্ষ্য আসাদ ফ্যামিলিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা।
আসাদবিরোধী লড়াইয়ে অংশরত সবাই মিলে গঠন করে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি বা FSA
FSA এর প্রশিক্ষণের একটি দৃশ্য
আগস্ট, ২০১১ সালের দিকে সিরিয়ার সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল নামে সরকার গঠন করে। ধারনা করা হচ্ছিল সিরিয়ায় বোধহয় লিবিয়ার অনুরূপ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। প্রথমে কিছু সেনাদের বিদ্রোহ, তারপর বিদ্রোহীদের সরকার ঘটন, তারপর পশ্চিমাদের সহায়তায় ক্ষমতায় আসা। সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের আগমনের পর এমনটাই হওয়া ছিল স্বাভাবিক।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের মিটিং
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুধু সিরিয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। যদিও এটি কোন বিশ্বযুদ্ধের রূপ ধারন করেনি অথবা ধারন করার কোন সম্ভাবনা নেই তবু বিশ্বের প্রায় সকল শক্তিধর রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে। আসাদ গোত্র শিয়া হওয়ার সুবাদে তাদের পক্ষ নিয়েছে ইরান ও লেবাননের হিযবুল্লাহ গ্রুপ এবং ইরান ও আসাদের সাথে সুসম্পর্কের কারণে চিন ও রাশিয়াও আসাদকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। সিরিয়ার ৭২% লোক সুন্নি মুসলিম, আরবের সুন্নি রাজারা যদিও নিজেরা ধার্মিক নয়, তবু শিয়াদের বিরুদ্ধে সুন্নিদের এই সশস্ত্র বিদ্রোহকে নানাভাবে সহায়তা করছে। আর ইসরাইলের সাথে সিরিয়ার এবং হিজবুল্লার কয়েকটি যুদ্ধের ইতিহাস থাকায় পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো পক্ষ নিয়েছে আসাদবিরোধীদের।
ইরান ও হিজবুল্লাহ অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে সরাসরি লড়াই করছে আসাদের পক্ষে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সহায়তা পাচ্ছে তারা চিন ও রাশিয়ার কাছ থেকে। ন্যাশনাল কাউন্সিল তাই কয়েক বার অস্ত্র সহযোগিতা চায় পশ্চিমাদের কাছ থেকে। কিন্তু পশ্চিমারা একটি ভয়ের কথা ব্যক্ত করে যে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের একটি অংশ কট্টর ইসলামপন্থী, তাই তারা ভীত যে অস্ত্র দিলে সেটা মুজাহিদিনদের হাতে চলে যাবে। সিরিয়ার জিহাদিরাও আমেরিকা থেকে অস্ত্র চায় না এবং প্রত্যাখ্যান করে বিদ্রোহী সরকারকে।
নামাজরত সিরিয়ার মুজাহিদিনরা
USA এবং ইসরাইলসহ পশ্চিমা বিশ্বের ভয়ের কারণ, মুজাহিদিনদের এই লড়াই শুধু আসাদকে হটানোতেই সীমাবদ্ধ নয়, তাদের টার্গেট সিরিয়ায় ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা এবং শরিয়াহ আইন চালু করা। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের প্রায় ৬০% ভাগ এই মুজাহিদিনদের পক্ষে, তাছাড়া সুন্নি মুসলিমদের উপর আসাদের নির্যাতনের ঘটনা এবং ইসলামী খেলাফতের স্বপ্ন সারা বিশ্বের মুসলিম তরুণদের নিয়ে আসছে সিরিয়ায়। যার মধ্যে ইরাক, আফগান, সোমালিয়া, বসনিয়া প্রভৃতি দেশসমুহের মুজাহিদীনরা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আরব এবং পশ্চিমা দেশসমূহের অনেক মুসলিম তরুণ, সিরিয়াতেই যাদের প্রথম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা।
চেচেন মুজাহিদের নেতৃত্বে অংশরত বিভিন্ন দেশের মুজাহিদরা
সিরিয়ায় এই তিন দলের বাহিরেও আরেকটি দল লড়াই করছে যাদের কথা তেমন আলোচনায় আসে না। উপরের তিনটি দলের লড়াইয়ের মৌলিক লক্ষ্যের মধ্যে সিরিয়া বিভক্ত করার বিষয়টি নেই। কিন্তু কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর লক্ষ্য সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি বিরাট অংশ দখলে নিয়ে স্বাধীন কুর্দিস্থান গঠন করা যে দেশের স্বাধিনতায় আর কোন আঘাত আসবে না। শুধু সিরিয়াতেই নয়, ইরাক, তুরস্কসহ আরও কয়েকটি দেশেও স্বাধীন ভূমির জন্য লড়াই করছে কুর্দি বিদ্রোহীরা।
স্বপ্নের স্বাধীন কুর্দিস্তান
দুই বছর সাত মাস পূর্বে সিরিয়ায় শুরু হওয়ায় যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে সোয়া লাখের উপর মানুষ। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে প্রায় দুই লাখের বেশী শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়া গৃহহীন মানুষের সংখ্যা সাত লাখ বলা হয়েছে। যদিও এগুলো পরিসংখ্যান, কিন্তু বাস্তবতা এর চেয়ে ভয়াবহ।
জর্ডানের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার পথে বিশ্রাম নিচ্ছে কয়েকটি সিরিয় পরিবার
সিরিয়ার যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই বাশার বাহিনী সিরিয়ার অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। কিছুদিন পূর্বে ইরান বলেছিল, আমেরিকার সাথে তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে আগ্রহী। অর্থাৎ, আমেরিকার সহায়তায় ইরান সিরিয়ার মুজাহিদিনদের হারিয়ে আসাদকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। যদি আমেরিকা তাতে সম্মত হয়, তবে ইরান, হিযবুল্লাহ, রাশিয়া, চিন, আমেরিকা, ইসরাইলসহ পশ্চিমা বিশ্বের সব দেশকে এক কাতারে দেখতে পাওয়া যাবে। যদিও আসাদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে, তবু তারা এখন আসাদের পক্ষ নেওয়া অস্বাভাবিক নয় কারণ, আসাদকে পুনরায় ক্ষমতায় বসিয়ে দিলে সে পশ্চিমা বিশ্বের গোলাম হয়ে থাকবে এবং মুজাহিদিনরা যদি সিরিয়া দখল করে নেয় তবে সেই সিরিয়া হবে পশ্চিমাদের জন্য এক দুঃস্বপ্নের নাম। কিন্তু মেরুদণ্ডহীন আরব রাজাদের জন্য ইরান-আমেরিকার সুসম্পর্ক মেনে নেওয়াটা হবে কষ্টের।
অপরদিকে আরেকটি সম্ভাবনা রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো সিরিয়ায় হামলা করে আসাদকে হটিয়ে তাদের অনুগত ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে ক্ষমতায় বসাবে এবং মুজাহিদীনদের সন্ত্রাস আখ্যায়িত করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসাবে সিরিয়ায় নিজেদের সৈন্য রাখতে চাইতে পারে।তখন অবশ্য শান্তি ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। কারণ, একদিকে বাশার বাহিনী ও তাদের মিত্র হিজবুল্লাহ এই ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সরকারের উপর হামলা করবে, অপরদিকে মুজাহিদীনদের হামলা তো রয়েছেই। এই অবস্থায় আরব রাজারা থাকবে সবচেয়ে নির্ভাবনায় এবং নবগঠিত সরকারকে বিপুল অর্থ দিয়ে সহায়তা করবে এটা নিশ্চিতকরেই বলা যায়।
মুজাহিদীনরা এখন পর্যন্ত যেভাবে লড়ছে তাতে সমগ্র সিরিয়ায় তাদের বিজয় লাভ করা অসম্ভব নয়। কুর্দি বিদ্রোহীদের সাথে যদি শান্তিচুক্তি করে যে কুর্দিদের কোন নিপীড়ন করা হবে না, তাহলে হয়ত কুর্দিদেরও পাশে পাওয়া যাবে। কিছুদিন পূর্বে কুর্দিদের ছোট দুইটি বিদ্রোহী গ্রুপ শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুজাহিদীন দের সাথে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হল, মুজাহিদিনদের পাশে আন্তর্জাতিক কোন সমর্থন নেই যা একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র গঠন ও সরকারের স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করবে। কিন্তু যদি আমেরিকা অথবা ইসরাইল সেই মুজাহিদিনদের হামলা করে, তবে সেটা আরেক আফগানস্থানের মত হতে পারে এবং যুদ্ধ পুরা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে।
এই যুদ্ধের ফলাফল কি হবে? কে জয় লাভ করবে? কুর্দিরা কি পারবে তাদের স্বপ্নের স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করতে? সিরিয়ার শরণার্থীরা কবে তাদের নিজ গৃহে ফিরতে পারবে?
এমন শত প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও দীর্ঘ সময়ের।