৪০ বছর কেটে গেছে। ৮২৫ কিলোগ্রাম ওজনের ভয়েজার-১ আর পৃথিবীর মধ্যকার দুরত্ব এখন প্রায় ১৪ বিলিওন মাইল!
'লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ'এর সবচেয়ে বড় উদাহারণ হয়ে ভয়েজার-১ এখনো পৃথিবীর মানুষের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছে!
ভয়েজার বৃহষ্পতি গ্রহকে অতিক্রম করেছে ১৯৭৯ সালে। যাত্রাপথে সে আমাদেরকে পাঠিয়েছে বৃহষ্পতির ছবি। আমরা দেখেছি দানবগ্রহ বৃহষ্পতির বুকে ১৮৮ বছর ধরে বয়ে চলেছে এক দানবঝড় - দ্যা গ্রেট রেড স্পট। এই ঝড়ের আয়তন তিনটা পৃথিবীর সমান!
ভয়েজার-১ শনি গ্রহ অতিক্রম করে ১৯৮০ সালে। ভয়েজার আমাদেরকে জানিয়েছে শনিকে প্রদক্ষিণ করছে আরো অনেকগুলো বরফের তৈরী চাঁদ!
ভয়েজার তাঁর সর্বশেষ ছবিটি তুলেছিলো ১৯৯০ সালের ভালোবাসার দিবসে। অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। সর্বশেষ এই ছবিটি ভয়েজার তুলেছিলো কার্ল স্যাগান নামক একজন খেয়ালী বিজ্ঞানীর অনুরোধে।
'কার্ল স্যাগান' নামটি ভয়েজার-১এর সাথে মিশে আছে একটু ভিন্নভাবে। সংক্ষেপে বলা যাক।
ভয়েজার ১ তৈরির কাজ তখন প্রায় শেষ। নাসা দ্রুত ভয়েজারকে অনন্ত মহাশূণ্যের উদ্দেশ্যে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
৪০ বছর বয়েসী কার্ল স্যাগান তখন ভাবলেন একটা ভিন্ন ব্যাপার। তিনি ভাবলেন, এই স্পেসক্রাফটটি তো চলতেই থাকবে। এর গতি কমবে না, বরং বাড়বে। এক সময় এটা আমাদের সৌর জগতকে ছেড়ে চলে যাবে। হয়তো ছেড়ে যাবে আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথকেও। এমনও সময় আসবে যখন ভয়েজার থেকে আমাদের দূরত্ব হবে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ। এই দূরতম বন্ধুর সাথে আমাদের আর কোনো যোগাযোগই তখন থাকবেনা। কে বলতে পারে এই ভয়েজার কোনোদিন কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর দেখা পাবে না!
কী হবে যদি কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো স্বজনের সাথে দেখা হয় ভয়েজারের!
কার্ল স্যাগান দূরতম সেই স্বজনদের জন্য বার্তা এবং উপহার পাঠাতে চাইলেন।
নাসায় কমিটি তৈরী করা হলো। স্যাগান হলেন কমিটির প্রধান। এক বছর ধরে চললো ভীনগ্রহের স্বজনদের জন্য বার্তা সংগ্রহের কাজ।
৫৫ টি ভাষায় 'হাই' জানানো হলো দূরতম স্বজনদের।
প্রথম জানালেন, তৎকালিন জাতিসংঘের মহাসচিব কার্ট ওয়াল্ডহেইম। তিনি বললেন, "I send greetings on behalf of the people of our planet. We step out of our solar system into the universe seeking only peace and friendship, to teach if we are called upon, to be taught if we are fortunate."
আছে বাংলা ভাষাও। কন্ঠ দিয়েছেন সুব্রত মূখার্জি। তিনি বলেছেন 'নমস্কার, বিশ্বের শান্তি হোক।'
পাঠানো হলো বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের শব্দ, হাসির শব্দ। হেসেছিলেন কার্ল স্যাগান নিজেই।
পাঠানো হলো পাখির ডাক, ঝিঝি পোকার ডাক।
ভয়েজারের সাথে পাঠানো হলো ৯০ মিনিট দীর্ঘ গান এবং সুর। এর মধ্যে ছিলো সাড়ে তিন মিনিটের একটি ভারতীয় সুরও।
অচেনা স্বজনদের জন্য ছবি পাঠানো হলো ১১৬টি। এর মধ্যে আছে আমাদের ডিএনএর ছবি, হাঁড়ের ছবি,পাখির ছবি, সূর্যদয়ের ছবি, সূর্যাস্তের ছবি, নারী পুরুষের জননাঙ্গের ছবি, মিলনের ছবি! খাওয়ার ছবি, পান করার ছবি, শিশুকে স্তন পান করানোর ছবি!
যুদ্ধ আর অস্ত্রের ছবি পাঠানোর কথা থাকলেও পরে আর পাঠানো হয়নি।
কার্ল স্যাগান তখন ভয়েজার-১ এর জন্য 'গোল্ডেন রেকর্ড' তৈরীর কাজে দিনরাত ব্যাস্ত এবং ভীষণ উত্তেজিত।
একদিন ভোরবেলা তিনি তার সুন্দরী সহকর্মী অ্যান ড্রুয়ানকে ফোন করলেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোন রেখে দিলেন।
ফোন রাখার পর স্যাগান আবিষ্কার করলেন তিনি ড্রুয়ানের প্রেমে পড়েছেন! স্যাগান মনের কথা জানালেন ড্রুয়ানকে। ড্রুয়ান জানালেন, তিনিও...।
এরপর কার্ল স্যাগান করলেন আরেক ছেলেমানুষী কাজ। তিনি তাঁর প্রেমিকাকে এক ঘন্টা চুপচাপ শুয়ে থেকে পৃথিবীর কথা, মানব সভ্যতার কথা এবং স্যাগানের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা ভাবতে বললেন।
বেচারী ড্রুয়ান এক ঘন্টা চোখ বন্ধ করে এসব ভাবলেন। এই সময় তাঁর ব্রেইনওয়েভ রেকর্ড করা হলো।
এই ব্রেইনওয়েভও জুড়ে দেয়া হলো ভয়েজার ওয়ানের সাথে!
ভয়েজার ওয়ান ৪০ বছর থেকে ছুটছে।
যাত্রার ১৩ বছর পর ভয়েজার-১ তখন পৃথিবী থেকে ৬ বিলিওন কিলোমিটার দূরে। আমাদের সৌরজগতকে শুভ বিদায় জানাচ্ছে এই স্পেসক্রাফট।
কার্ল স্যাগান তখন তাঁর শেষ পাগলামীটা করলেন। নাসার বিজ্ঞানীদের তিনি অনুরোধ করলেন এত দূরত্ব থেকে ভয়েজার-১ পৃথিবী নামক গ্রহের একটা ছবি তুলে পাঠাক।
অনেক বিজ্ঞানীদের আপত্তি ছিলো। তারা বলেছিলেন ভয়েজারের ক্যামেরা পৃথিবীর দিকে ঘুরালে সূর্যের আলোতে সেটার ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু স্যাগানের অনুরোধে শেষবারের মতো পৃথিবীর ছবি তুলেছিলো ভয়েজার-১। একটা বিন্দুর চেয়েও ছোট দেখাচ্ছিলো আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে!
কার্ল স্যাগান মারা গেছেন ১৯৯৬ সালে।
ভয়েজার -১ আমাদের সৌরজগতকে চির বিদায় বলেছে ১৯৯০ সালেই। হেলিওশিথকে বিদায় বলেছে ২০১২ সালে। ভয়েজার -১ এখন আছে ইন্টারস্টেলার স্পেসে। নিঃসীম শীতল অন্ধকারে ঘন্টায় ৬২ হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে ভয়েজার-১।
আর কয়েকটা বছর মাত্র। তারপর আমরা যোগাযোগ হারিয়ে ফেলবো আমাদের দূরতম এই বন্ধুটির সাথে। ... এবং তারপর কোথায় যাবে ভয়েজার-১, কোথায় থাকবে আমাদের প্রিয় গ্রহের কয়েক কিলোবাইট স্মৃতি আমরা জানতে পারবো না কোনোদিনও!