যাদের বাড়ী নদী কিংবা সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে তারা প্রায় জোয়ার-ভাটার সম্মুখীন হন। হঠাৎ করে নদী কিংবা সমুদ্রের জল ফুলে-ফেঁপে উঠাকে বলা হয় জোয়ার আর সেই জল অন্য জায়গায় নেমে যাওয়াকে বলা হয় ভাটা। জোয়ার- ভাঁটা সৃষ্টির পিছনেও কিছু বৈজ্ঞানিক কারণ রয়েছে।
প্রথমেই জেনে নেয়া যাক জোয়ার-ভাটা বলতে কি বুঝায়?
চন্দ্র-সূর্যের আকর্ষণ শক্তি, পৃথিবীর কেন্দ্রাতিগ শক্তি এবং আহ্নিক গতির কারণে সমুদ্রের জল নির্দিষ্ট সময় অন্তর এক জায়গায় ফুলে ওঠে, আবার অন্য জায়গায় নেমে যায়। সমুদ্র জল এভাবে ফুলে ওঠাকে জোয়ার এবং নেমে যাওয়াকে ভাটা বলে। সমুদ্রের কোনো এক জায়গায় প্রতিদিন দুইবার করে জোয়ার-ভাঁটা সংঘটিত হতে পারে। উপকূলে কোনো একটি স্থানে পর পর দুটি জোয়ার বা পর পর দুটি ভাটার মধ্যে ব্যবধান হলো ১২ ঘণ্টা ২৬ মিনিট।
জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির কারণ:
জোয়ার-ভাটা সংঘটিত হওয়ার মূখ্য কারণ হচ্ছে চন্দ্র-সূর্যের আকর্ষণ শক্তি। তবে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টিতে চাঁদের আকর্ষণ বলই বেশী কাজ করে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, জোয়ার উৎপাদনের ক্ষেত্রে সূর্যের ক্ষমতা চাঁদের ক্ষমতার নয় ভাগের চার ভাগ। এছাড়াও জোয়ার-ভাটা সৃষ্টিতে আহ্নিক গতির প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। আমরা সকলেই জানি, পৃথিবীতে দিনরাত্রি হওয়ার প্রধান কারণও এই আহ্নিক গতি। এই গতির ফলে সমুদ্র-স্রোতের দিক পরিবর্তন হয়। ফলে স্রোত যেদিকে প্রবাহিত হয় সেদিকে জোয়ার এবং যেদিক হতে প্রবাহিত হয় সেদিক ভাঁটার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও পৃথিবীর আবর্তনের ফলে সৃষ্ট কেন্দ্রাতিগ শক্তি বা কেন্দ্রবিমুখী শক্তির ফলেও জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি হতে পারে।
এখন জানা যাক জোয়ার-ভাঁটা সৃষ্টিতে সূর্যের আকর্ষণ অপেক্ষা চাঁদের আকর্ষণ বেশী কার্যকর কেনো?
আমরা জানি, সূর্য চন্দ্র অপেক্ষা বহুগুণ বড়। কিন্তু দূরত্বের বেলায় চন্দ্র সূর্য হতে পৃথিবীর অনেক নিকটবর্তী। যেখানে সূর্যের গড় দূরত্ব পৃথিবী হতে ১৫ কোটি কি.মি. সেখানে চন্দ্রের গড় দূরত্ব মাত্র ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কি.মি.। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই সূর্য হতে চন্দ্রের আকর্ষণ শক্তি অনেক বেশী হবে। যার ফলে জোয়ার-ভাঁটা সৃষ্টিতে সূর্য অপেক্ষা চাঁদের প্রভাব বেশী।
জোয়ার প্রধানত দুই প্রকার।
(১)মুখ্য জোয়ার:
চাঁদ যখন পৃথিবীর চারদিকে আবর্তন করে তখন পৃথিবীর যে অংশ চাঁদের নিকটবর্তী হয়, সেই অংশে চাঁদের আকর্ষণের প্রভাবে জল ফুলে উঠে তথা জোয়ারের সৃষ্টি হয়। এরূপ জোয়ারকে মুখ্য জোয়ার বলে। কোনো স্থানে একবার মুখ্য জোয়ার হওয়ার পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিট সময় অতিক্রম করলে পুনরায় সেখানে মুখ্য জোয়ার সৃষ্টি হয়।
(২)গৌণ জোয়ার:
চাঁদ পৃথিবীর যে পাশে আকর্ষণ করে তার ঠিক অপর পাশে জলরাশির ওপর মহাকর্ষ বল অনেকাংশে কমে যায় এর ফলে সে স্থানে কেন্দ্রাতিগ শক্তির সৃষ্টি হয়। ফলস্বরুপ চারদিকের পানি ঐ স্থানে এসে জোয়ারের সৃষ্টি করে। এরূপ সৃষ্ট জোয়ারকে গৌণ জোয়ার বলে।
একই দিনে দুবার জোয়ার ভাটার কারন কি ?
জোয়ার-ভাটা হয় মূলত সমুদ্রের জলের উপর চন্দ্রের আকর্ষণের কারণে। অবশ্য সূর্যের আকর্ষণও অল্প প্রভাব বিস্তার করে। চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। এই ঘূর্ণনজাত কেন্দ্রাতিক বলের ফলে পৃথিবী চাঁদ থেকে দূরে সরে যেতে চাচ্ছে আর তার বিপরীতে কাজ করছে চাঁদের আকর্ষণ। পৃথিবীর যে পৃষ্ঠ চাঁদের দিকে সেদিকে চাঁদের আকর্ষণ কেন্দ্রাতিক বলের চেয়ে বেশি বলে সেখানকার পানি ফুলে উঠে জোয়ারের সৃষ্টি করে। একই সময় পৃথিবীর অপরদিকে চাঁদের আকর্ষণ কেন্দ্রাতিগ বলের চেয়ে কম বলে সেখানকার পানিও ফুলে উঠে। এ দুটি পৃষ্ঠের লম্বভাবে অবস্থিত স্থানে চলে ভাটা। এ কারণেই কোনস্থানে দিনে দুবার জোয়ার-ভাটা হয়।
পৃথিবীর কোন অংশে প্রতিদিন একই সময়ে জোয়ার ভাটা হয় না এর কারণ হলো। পৃথিবী যেমন নিজের মেরু রেখার চারিদিকে 360 ডিগ্রি 24 ঘন্টায় একবার আবর্তন করে, চাঁদও তেমনি 27 দিনে পৃথিবীর চারিদিকে একবার ঘোরে। সুতরাং 24 ঘন্টায় চাঁদ পৃথিবীর কক্ষপথে 360÷27=13 ডিগ্রী পথ অতিক্রম করে বা 24 ঘন্টায় চাঁদ পৃথিবীর কক্ষপথ পৃথিবীর একবার আবর্তন চাঁদ প্রায় 13° পথ এগিয়ে যায়। এই 13° পথ অতিক্রম করতে পৃথিবীর সময় লাগে প্রায় 52 মিনিট। অর্থাৎ যে দ্রাঘিমারেখা টি চাঁদের সামনে আছে 24 ঘন্টা পরে 360° অতিক্রম করে এসেই দ্রাঘিমার পূর্ব অবস্থানে ফিরে আসার মধ্যে 13° পথ এগিয়ে যায়। ওই দ্রাঘিমারেখা টি পুনরায় তাদের সামনে আসার জন্য তাই আরো 13 ডিগ্রী বেশি আবর্তন করতে হয়। এর জন্য ওই দ্রাঘিমারেখা চাঁদের সামনে আসতে সময় লাগে আরও 52 মিনিট বেশি। তাই পৃথিবীর কোন নির্দিষ্ট স্থানে প্রত্যেক মুখ্য ও গৌণ জোয়ার এর পরবর্তী মুখ্য ও গৌণ জোয়ার আরও 52 মিনিট পর অনুষ্ঠিত হয়। কোন স্থানে এই মুহূর্তে মুখ্য জোয়ার হলে, পরবর্তী মুখ্য জোয়ার হবে 24 ঘন্টা 52 মিনিট পরে।
পরবর্তী গৌণ জোয়ার হবে 12 ঘন্টা 26 মিনিট পরে
পরবর্তী ভাটা হবে 6 ঘন্টা 13 মিনিট পর।
মাঝে মাঝে চন্দ্র ও সূর্যের মিলিত আকর্ষণের জন্য জোয়ারের জল অনেক বেশী ফুলে ওঠে। ফলে প্রবল জোয়ারের সৃষ্টি হয়, একে তেজ কটাল বলে। সাধারণত পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্য একই সরলরেখায় অবস্থান করলে তেজ কটালের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে চন্দ্র ও সূর্য যখন পৃথিবীর সাথে এক সমকোণে থেকে পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। তখন চাঁদের আকর্ষণ শক্তির প্রভাবে সেখানে জোয়ার হয় এবং সূর্যের আকর্ষণ শক্তির ফলে সেখানে ভাঁটা হয়। তবে চন্দ্রের আকর্ষণে যে জোয়ার হয়, সূর্যের আকর্ষণে তা বেশী স্ফীত হতে পারে না। এধরণের জোয়ার-ভাটাকে মরা কটাল বলে। সাধারণত অষ্টমীর তিথিতে মরা কটাল হয়। প্রতি এক মাসে দুইবার তেজ কটাল এবং দুইবার মরা কটাল হয়ে থাকে।
নদী-উপকূলীয় মানুষদের জীবনে জোয়ার-ভাটার প্রভাব ব্যাপক। জোয়ার-ভাটা নদীর মোহনা হতে স্রোতের সঙ্গে পরিবাহিত তলানি অপসারিত করে, নদীমুখকে জাহাজ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত রাখে। এছাড়াও এর ফলে নৌ চলাচলে সুবিধা হয়। তবে অনেক সময় প্রবল জোয়ারের সম্মুখীন হয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে নদী ধস হয় যা সমাজজীবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিস্বরুপ।