রাতের আকাশ আলোর ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দিয়ে যখন চাঁদ ওঠে। সেই চাঁদের বুকে কাউকে আপনি দেখতে পান ?
লোকগাথা বলে, সেখানে থাকেন এক চরকা কাটা বুড়ি। কিন্তু কেউ বলেন না চাঁদে আছেন এক মানুষ। ভূবিজ্ঞানী ও মহাকাশবিদ ইউজিন শুমেকার। যিনি ১৯৯৯ সালের ৩১ জুলাই থেকে চাঁদের ধুলোয় মিশে আছেন। পৃথিবীর একমাত্র মানুষ যাঁর দেহভস্ম চাঁদে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
ভূবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করলেও পৃথিবীর বুকে ধূমকেতু ও উল্কা পিণ্ডের আঘাতে তৈরি হওয়া বিভিন্ন গহ্বর বা ক্রেটার নিয়ে তাঁর ছিল অসামান্য কিছু গবেষণা। যা সেই সময়ে ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা ও মহাকাশ বিজ্ঞানকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল। আমেরিকার আরিজোনা মরুভূমিতে আছে বারিঙ্গার ক্রেটার নামে এক বিশাল গহ্বর। আগে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, এই বিশাল গহ্বরটি কোনও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ইউজিন শুমেকারের গবেষণা থেকে জানা গিয়েছিল, এই বিশাল গহ্বর কোনও গ্রহাণু বা ধূমকেতুর আঘাতের ফলে তৈরি হয়েছিল।
বন্ধু বিজ্ঞানী ডেভিড লেভি, স্ত্রী ক্যারোলিন শুমেকারের সঙ্গে ইউজিন শুমেকার আবিষ্কার করেছিলেন ‘শুমেকার-লেভি নাইন’ নামে একটি নতুন ধুমকেতু। আবিষ্কারের পর ডঃ শুমেকার বলেছিলেন কিছুদিনের মধ্যে ধুমকেতুটি ভেঙে পড়তে চলেছে বৃহস্পতির বুকে। বৃহস্পতি ও ‘শুমেকার-লেভি নাইন’ ধুমকেতুর মধ্যে ঘটতে যাওয়া সংঘর্ষের কথা সেই সময় বিশ্বে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকার পাহাড়ি অঞ্চল ওয়াইওমিং-এর একটি শহরে ‘গ্রেটার গ্রিন রিভার ইন্টারগ্যালাকটিক স্পেস পোর্ট’ নামে একটি বিশাল রানওয়ে বানিয়ে ফেলেছিল আমেরিকা। বৃহস্পতি থেকে ভিনগ্রহের কেউ আসতে পারে ভেবে। ঘটনাটির সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে পড়েছিলেন আমেরিকার মানুষ।
১৯৯৪ সালে ১৬ জুলাই, সত্যি সত্যি
শুমেকার-লেভি নাইন’ ধুমকেতুটি বিভক্ত হয়ে বৃহস্পতিকে আঘাত করেছিল। নির্ভুল হিসাবের জন্য সেলিব্রেটি হয়ে গিয়েছিলেন ইউজিন শুমেকার। বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর নাম। পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহলে তিনি অবশ্য অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত ছিলেন। কারণ, তিনি আর স্ত্রী ক্যারোলিন মিলে ৭১ টি ধুমকেতু ও ৮০০ গ্রহাণু আবিস্কার করেছিলেন। যা মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অসামান্য কীর্তি। এছাড়াও, চাঁদ থেকে নিয়ে আসা মাটি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তিনি। চাঁদের নির্ভুল ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছিলেন, পরবর্তীকালে যা চাঁদের আবহাওয়া এবং চাঁদে প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণায় বিরাট সাহায্য করেছে।
নাসার অ্যাপোলো মিশনগুলিতে বিভিন্নভাবে যুক্ত থাকলেও সম্ভাব্য মহাকাশচারী হিসেবে সরাসরি যুক্ত হয়েছিলেন ঐতিহাসিক অ্যাপোলো-১১ মিশনটির সঙ্গে। নাসার যে মিশনে ভর করে চাঁদের বুকে প্রথম পড়তে চলেছিল মানুষের পা। অ্যাপোলো-১১ মিশনের সম্ভাব্য মহাকাশচারীদের ট্রেনিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইউজিন শুমেকার। অ্যারিজোনার ফ্ল্যাগস্টাফের কাছে উল্কার আঘাতে সৃষ্টি হওয়া ‘মেটিওর ক্রেটার ও সানসেট ক্রেটার’ অঞ্চলে মহাকাশচারীদের ট্রেনিং দিয়েছিলেন ইউজিন শুমেকার। ‘অ্যাপেলো-১১’ মিশনের সম্ভাব্য মহাকাশচারীদের তালিকার একবারে প্রথমে ছিল ইউজিন শুমেকারের নাম।
চাঁদের মাটিতে পা রাখা তাঁর অনেকদিনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন সফল হতে যাচ্ছিল। সেই চিন্তায় সারাদিন বিভোর থাকতেন শুমেকার। রাতের আকাশে ওঠা চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন অপলকে। আর মাত্র কয়েকমাস, তার পর এভাবেই চাঁদের বুক থেকে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকবেন। ভাবতে ভাবতে উত্তেজনায় ঘেমে যেতেন শুমেকার।
দিন ক্রমশ এগিয়ে আসছিল। নাসার সদর দপ্তর থেকে ইউজিনের কাছে চিঠিটি এসেছিল। আসার কথাই ছিলো। হাসি হাসি মুখেই চিঠিটি খুলেছিলেন ইউজিন শুমেকার। চিঠির বক্তব্য কী হবে, তা তাঁর জানাই ছিল। চিঠিতে লেখা থাকবে, নাসার অ্যাপোলো-১১ এর আরোহী হিসেবে আপনি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু, চিঠিটি খুলে চমকে উঠেছিলেন ইউজিন শুমেকার। তাঁর পুরো শরীর থর থর করে কাঁপছিল। এত দিনের স্বপ্ন এক লহমায় ভেঙে চুরমার। নাসা জানিয়েছে, অ্যাপেলো-১১ সওয়ার হয়ে চাঁদের মাটিতে পা রাখতে পারবেন না শুমেকার। কারণ তিনি অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি সংক্রান্ত রোগ অ্যাডিসন ডিজিজে আক্রান্ত। শুমেকারের পৃথিবীটা এক লহমায় পালটে গিয়েছিল। চোখ দিয়ে অবিরাম নেমে আসছিল জলের ধারা। দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়েছিলেন শুমেকার। তাঁর জীবনে পাওয়া সবচেয়ে বড় আঘাতটি যে এভাবে আসবে, তা তিনি কল্পনাই করতে পারেননি
কেপ কেনেডি লঞ্চ স্টেশন থেকে চাঁদের পথে রওনা হয়েছিল নাসার অ্যাপেলো-১১ মহাকাশযান। ২১ শে জুলাই চাঁদের মাটিতে পা পড়েছিল নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিনের। একগাল হাসি নিয়ে নাসার কন্ট্রোল রুমে মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত শুন্যে ছুড়েছিলেন, নাসার অ্যাপেলো-১১ মিশনের চিফ সায়েন্টিস্ট ইউজিন শুমেকার। বুকের ভিতরটা পুড়ছিল। সারা পৃথিবী যখন মানবজাতির এই ঐতিহাসিক সাফল্য সেলিব্রেট করছিল, শুমেকারের চোখের কোণায় থির থির করে কাঁপছিল জল। ইউজিন শুমেকারের মনে তখন উথাল পাথাল সাইক্লোন উঠেছিল, বুঝতে পেরেছিলেন স্ত্রী ক্যারোলিন। উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন স্বামীকে।
১৯৯৭ সালের ১৮ই জুলাই--
আগের রাতে উত্তেজনায় ঘুমাননি শুমেকার। ভোর হতেই মধ্য অস্ট্রেলিয়ার তানামি ট্র্যাকে দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছিল শুমেকারের গাড়ি। সঙ্গে ছিলেন ক্যারোলিনও। নতুন এক উল্কাপিণ্ডের আঘাতে অস্ট্রেলিয়ার এই অঞ্চলে তৈরি হয়েছিল এক অতিকায় ক্রেটার। সেটা খোঁজার জন্য দুজনে উড়ে এসেছিলেন আমেরিকা থেকে। নতুন এক গবেষণা শুরু করার উদ্দেশ্যে। যাঁর নেশায় তাঁরা বুদ হয়ে ছিলেন দশকের পর দশক। কিন্তু নিয়তির গতিপথ ছিল আলাদা। মধ্য অস্ট্রেলিয়ার অ্যালিস স্প্রিং থেকে ৩১০ মাইল উত্তরে একটি গাড়ির সঙ্গে শুমেকারের গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬৯ বছরের শুমেকার। স্ত্রী ক্যারোলিন গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তাঁকে হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাসপাতালে।
ইউজিন শুমেকারের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল গোটা বিশ্বে। শুমেকারের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশ্বের বিজ্ঞানীরা যখন নানা প্রস্তাব দিচ্ছিলেন, শুমেকারেরর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ক্যারোলিন পোর্সো নিয়েছিলেন এক অবিস্মরণীয় সিদ্ধান্ত। চাঁদে সমাধিস্থ করা হবে বিজ্ঞানী শুমেকারকে। সারা জীবন ধরে যেখানে যাবার স্বপ্ন দেখেছিলেন শুমেকার। শুমেকারের শব দাহ করা হয়েছিল, ক্যারোলিন পোর্সো তুলে নিয়েছিলেন এক আউন্স পরিমাণ দেহভস্ম। নিয়ে গিয়েছিলেন নাসার দপ্তরে। কারণ নাসার ‘লুনার প্রসপেক্টর’ মহাকাশযানটির কিছুদিন পরেই চাঁদে যাওয়ার কথা ছিল। শুমেকারের দেহভস্ম চাঁদে ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি সাদরে গ্রহণ করেছিল নাসা। তার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল।
পৃথিবী ছেড়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ‘লুনার প্রসপেক্টর’ মহাকাশযান। মহাকাশযানটির ভেতরে একটি পলি-কার্বোনেট দিয়ে তৈরি একটি ক্যাপসুলের ভিতর রাখা ছিল ইউজিন শুমেকারের দেহভস্ম। ক্যাপসুলটকে রাখা হয়েছিল একটি পিতলের পাত্রের মধ্যে। পাত্রটির ওপর লেখা ছিল ডঃ ইউজিন শুমেকারের নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ ও রোমিও জুলিয়েট থেকে নেওয়া একটি কোটেশন।
" And, when he shall die
Take him and cut him out in little stars
And he will make the face of heaven so fine
That all the world will be in love with night
And pay no worship to the garish sun"
মিশনের শেষে পরিকল্পিত ভাবেই চাঁদের বুকে ‘লুনার প্রসপেক্টর’ মহাকাশযানটির ক্র্যাশ লান্ডিং করিয়েছিল নাসা। চূর্ণবিচুর্ণ হতে থাকা মহাকাশযানটির ভিতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল আঘাত প্রতিরোধে সক্ষম পলি-কার্বোনেটের সেই ক্যাপসুল। যার ভিতরে ছিল ইউজিন শুমেকারের দেহভস্ম। ক্যাপসুলটি নিমেষের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল চাঁদের বুকে। নাসার কন্ট্রোল রুমে বসে এই অবিস্মরণীয় ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করতে করতে স্ত্রী ক্যারোলিন ধরা গলায় বলেছিলেন, “এখন থেকে আমরা যখনই চাঁদের দিকে তাকাবো, আমাদের মনে হবে, আমাদের ইউজিন ওখানে ঘুমিয়ে আছে।”