Monday, May 17, 2021

ছায়াপথ ধরে মহাকাশে ১তম - ৫ম পর্ব।

**************************
সন্ধ্যার তারকাখচিত আকাশে এক ঝলক চোখ পড়তেই প্রশ্নটা আবার একবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো ।আচ্ছা এই তারা গুলো লক্ষ কোটি বছর ধরে প্রজ্জ্বলিত , কোনটা আবার প্রচন্ডরকম ছুটছে, কোনটা স্থির ।তারার এই বিপুল পরিমান শক্তির উৎস কি  আর তার ভবিতব্যই বা কি ? এ প্রশ্ন যে শুধু আমার তা নয় ,আমার অসংখ্য ছাত্র ও বন্ধুদেরও ।আমি দেখেছি মহাকাশ নিয়ে তাদের ধারণা বাস্তব থেকে বেশ কিছুটা উপরে কল্পনার অদৃশ্য জগতে ।আমি চেষ্টা করবো বিশাল মহাকাশের যে অসীম রহস্য ,তার যতটুকু উৎঘাটন বিজ্ঞানীরা করেছেন তা সহজ ভাবে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে ।

তারা কিভাবে জ্বালানির ব্যবস্থা করে সে সমস্যাটি সমাধান করা হয়েছিল বিশ শতকের গোড়ায় । ১৯২৫ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী সিসিলিয়া পেইন-গাপোসকিন একটি চিত্তাকর্ষক থিসিস প্রকাশ করেন যেখানে তিনি স্পেকট্রোস্কোপিক পদ্ধতি ব্যবহার করে দাবি করেন  যে সূর্যের বেশিরভাগ অংশ আসলে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম দিয়ে তৈরি।যদিও তার এই দাবি নস্যাৎ করা হয় ,কারণ সেসময় মনে করা হয়েছিল পৃথিবী ও সূর্যের উপাদান এক নয় ।কিন্তু পরবর্তীতে বেশ কিছু স্বাধীন পরীক্ষা ও নিরীক্ষা  সিসিলিয়ার যুক্তিকে বলবৎ করে এবং তার দাবিকে সাদরে গ্রহণ করা হয় ।ব্রিটিশ-আমেরিকান এই মহিলা জ্যোতির্বিজ্ঞানী যখন  থিসিস প্রকাশ করেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর ।

এরপর ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট ডি এসকর্ট অ্যাটকিনসন এবং ডাচ-অস্ট্রিয়ান-জার্মান পদার্থবিদ ফ্রিটজ হিউটারম্যানস প্রথম পরামর্শ দিয়েছিলেন যে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসকে একে অপরের মিশিয়ে (নিউক্লিয়ার  ফিউশন ) বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত করা যেতে পারে।সালটা ছিল ১৯২৯ ।এর প্রায় ১০ বছর পর হ্যান্স বেথে এবং ভারতীয় বিজ্ঞানী সুব্রাহ্মণ্য চন্দ্রশেখর  দেখিয়েছিলেন যে তারাগুলির জ্বালানি আসলেই পারমাণবিক ফিউশন দ্বারা প্রাপ্ত শক্তি। 

নক্ষত্রের অস্তিত্বের আগে  মহাবিশ্বে কেবলমাত্র চারটি উপাদান ছিল। হাইড্রোজেন , হিলিয়াম এবং কিছু পরিমাণে লিথিয়াম এবং বেরিলিয়ামের সন্ধান পাওয়া যায় । প্রথম প্রজন্মের তারকাদের মধ্যে ভারী উপাদানগুলি প্রথম তৈরি হয়েছিল।,প্রথম প্রজন্মের তারকাগুলি গঠিত হয়েছিল বিগ ব্যাংয়ের প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর পরে ।এরপর ধীরে ধীরে গঠিত হয় ছায়াপথ । ১৯৫৪ সালে ফ্রেড হোয়েল দেখিয়েছিলেন যে অধিক ভরযুক্ত তারকাগুলির ক্ষেত্রে অন্তর্লীন সমস্ত উপাদান আয়রন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট হতে পারে। তারপরে তারা একটি সুপারনোভাতে বিস্ফোরিত হয়, যা আরও ভারী উপাদান তৈরি করতে পারে ।

অতিভারী প্রথম প্রজন্মের তারাগুলি সুপারনোভাতে বিস্ফোরিত হওয়ার পরে এবং মহাবিশ্ব জুড়ে ভারী উপাদানগুলি ছড়িয়ে দেওয়ার পরে গ্রহগুলির গঠন শুরু হয় । এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে লেগে যায়  কয়েক মিলিয়ন বছর। সূর্য কমপক্ষে দ্বিতীয় প্রজন্মের তারা, প্রায় ৪.৬  বিলিয়ন বছর আগে এটি তৈরি হয়েছিল। 

এখানে দুইটি শব্দ ভীষণভাবে প্রশ্ন তুলতে থাকে -বিগ ব্যং ও সুপারনোভা ।কিন্তু আলোচনার এই  মুহূর্তে আমাদের পথ ভ্রান্ত হলে চলবে না ।এই শব্দদুইটির অন্তরে যে অজানার গহ্বর রয়েছে আগে তা  আমাদের সঠিক ধারণা দ্বারা পূর্ণ করে নিতে হবে ।  

(ক্রমশ ....)
ছায়াপথ  ধরে  মহাকাশে
**********************
মহাকাশের সুদূরে এক অভাবনীয় অভিযানের পূর্বে আমরা নিজেদের সৌর মন্ডলের গঠন ইতিহাস দ্রুত ঘুরে আসবো।এর থেকে আমাদের কাছে পরিষ্কার ধারণা থাকবে ,কিভাবে একটি তারকার জন্ম হয় ।

১৮ শতকের প্রথমার্ধে সৌরজগতের গঠনগত পরিকাঠামোর প্রথম ব্যাখ্যাগুলি আসতে শুরু করেছিল ।১৭৩৪ সালে  সুইডিশ দার্শনিক ইমানুয়েল সুইডেনবার্গ পরামর্শ দিয়েছিলেন যে সূর্য এবং গ্রহগুলি একবারে একই ভর থেকে উৎপন্ন  হতে পারে। ১৭৫৫  সালে আরেক জার্মান দার্শনিক পরামর্শ দিলেন যে সৌরজগত একসময় গ্যাসের একটি বিশাল মেঘ ছিল অর্থাৎ একটি নীহারিকা(নেবুলা , না না এভেঞ্জার এর নেবুলা নয় ।এটি একধরণের স্টেলার অবজেক্ট ) ছিল।অদ্ভুদ ভাবে এই জার্মান দার্শনিকেরও নাম ছিল ইমানুয়েল ,ইমানুয়েল কান্ট্ ।ফরাসী গণিতবিদ পিয়েরে-সাইমন ল্যাপলাস এই তত্ত্বটি ১৭৯৬ সালে প্রবল জনপ্রিয় করে তোলেন ।তিনি বলেন যে, সূর্যের মূলত সৌরজগৎ জুড়েই বর্ধিত গরম পরিবেশ ছিল এবং এই "প্রোটোস্টারের মেঘ" শীতল এবং সঙ্কুচিত হয়েছিল। মেঘ আরও দ্রুত কাটতে থাকায় এটি এমন উপাদান বর্জন করে  যা অবশেষে ঘনীভূত হয়ে গ্রহ গঠন করে ।

এখানে একটি অব্যবহিত প্রশ্ন আসবেই ।প্রোটোস্টার কি ? যতটা সম্ভব সহজ ভাবে বলার চেষ্টা করছি ।

নিউক্লিওসিনথেসিস অর্থাৎ হাইড্রোজেন বা প্রোটন গুলি একে অপরের সাথে জুড়ে যাওয়ার ঘটনা শুরু হওয়ার আগে গ্যাসের ভর ও আয়তন প্রবলভাবে সংকুচিত হয় ।এটি তারকা গঠনের প্রাথমিক পর্যায় ।এই পর্যায়ে মহাজাগতিক বস্তুটিকে প্রোটোস্টার বলা হয়ে থাকে ।নিউক্লিওসিন্থেসিস অর্থাৎ হালকা নিক্লিয়াসগুলি দুটি বিশেষ পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে পস্পরের সাথে জোটবদ্ধ হয় ।এই পদ্ধতির খুব বেশি ভিতরে আমরা আলোচনা করবো না ।অস্ট্রোফিজিক্স ছাত্রদের কাছে এই পদ্ধতি দুটিই হলো তাদের বর্ণপরিচয় ।এদের একটিকে বলা হয় -"প্রোটন-প্রোটন শিকল"(p -p chain ) এবং অপরটি হলো  CNO  চক্র  ।

ঘটনাক্রমে রাশিয়ান জ্যোতির্বিদ ভিক্টর সাফরনভ  ল্যাপ্লাসিয়ান মডেলটিকে গ্রহণ ও অভিযোজনের পর  সোলার নেবুলার ডিস্ক মডেল (এসএনডিএম) এ  রূপান্তর করেন ।যদিও কিছু কিছু সমস্যা এই মডেলটিতেও রয়ে গেছে তবুও বর্তমানে এটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মডেল। ১৯৭২ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়ার পরে সাফ্রোনভের কাজ জনসমক্ষে 
 আসে এবং প্রচারের আলোয় আসার সুযোগ পায় ।

SNDM অনুযায়ী তারার জন্ম হয় যে অঞ্চলে তা পরিচিত "তারার নার্সারি " নামে । এগুলি গ্যাসের ঘন মেঘ যার  বেশিরভাগ অণু হাইড্রোজেন - H2 দিয়ে তৈরি। স্থিতিস্থাপক মাধ্যমে তৈরী হওয়া শকওয়েভ , মেঘগুলিকে অস্থির করে তোলে  এবং মেঘরাজি  ঘনত্ব বাড়িয়ে কুঁচকে যায় । এর মধ্যে ঘন অঞ্চলটি প্রোটোস্টার গঠন করে এবং শেষ পর্যন্ত একটি তারকাতে পরিণত হয়। 

শক তরঙ্গগুলি সর্পিল ছায়াপথগুলির বাহু দ্বারা বা সুপারনোভা বিস্ফোরণ দ্বারা উৎপাদিত হয়। বিগ ব্যাংয়ের পরে পদার্থের বিতরণে সামান্য অসম্পূর্ণতার কারণে প্রথম প্রজন্মের তারকারা গঠিত হতে পারে বলে মনে করা হয় ।ভাবতে অবাক লাগে আসলে আমাদের উৎপত্তি একটি অসামান্য ভুল থেকে ।

একটি প্রোটোস্টার তার অক্ষের উপর ঘুরতে থাকে এবং আবর্তন শক্তির ফলে বাকী মেঘটি একটি ডিস্কের মতো  চ্যাপ্টা হয়ে যায়, যা প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্ক নামে পরিচিত। এই প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের বৃহত্তম সংকুচিত অংশগুলি গ্রহে পরিণত হয় এবং অপেক্ষাকৃত ছোট সংকোচন সমন্বিত অঞ্চলগুলি গ্রহাণু বা ধূমকেতুতে পরিণত হয়।

প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কে হাইড্রোজেনের সাথে অক্সিজেন সহ অন্যান্য উপাদানগুলির উপস্থিতি করা যায় । এদের মধ্যে জল গঠন করার সম্ভাবনা থাকে । প্রোটোস্টারের কাছে থাকা বস্তুগুলিতে, সমস্ত জল ফুটে যায় এবং তাই তাদের প্রকৃতি হয় পাথুরে। আরও দূরে বস্তুগুলিতে, সমস্ত জল জমে যায় এবং তাই তারা বরফ হয়। যদিও গ্যাসীয় গ্রহগুলি কীভাবে গঠিত হয় তা আমাদের পক্ষে এখনও জানা সম্ভব হয়নি ।

(ক্রমশ ...)
পর্ব  ০২
https://m.facebook.com/groups/know.the.universe/permalink/1822003494625805/

পর্ব ০৩ -তারাদের কথা 
---------------------------
তারার জন্ম তো হলো, কিন্তু বেঁচে থাকার রসদ কি ?অবশ্যই পারমাণবিক সংশ্লেষণ ।কিন্তু সে শক্তির ভারসাম্য যদি সঠিক না হয় তবে তারার স্থায়িত্ব সম্বন্ধে আমাদের হতাশ হতে হবে ।ক্রমপর্যায়ের এই অংশে আমরা তারার স্থায়িত্ব নিয়ে  আলোচনা করবো ।বলে রাখা ভালো তারার স্থায়িত্বের উপরেই গ্রহগুলির অস্তিত্ব টিঁকে আছে ।আমরা মাঝে মধ্যেই শুনি আজ বা কাল বা কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে আমাদের পৃথিবী ধ্বংস হবে ।এটা যে কত বড় বৈজ্ঞানিক মিথ্যা হতে পারে আশা করি সে সম্বন্ধে এই আলোচনা থেকে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে ।
আগের পর্বটি যেখানে শেষ হয়েছিল ,আজকের শুরু ঠিক সেখান থেকেই -
একটি প্রোটোস্টার-এর ঘনত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে মহাকর্ষীয় স্থিতিশক্তি গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস এর বেগ বৃদ্ধি পায় এবং প্রোটোস্টারটি যথেষ্ট ভরসম্পন্ন হলে পারমাণবিক সংশ্লেষণের(নিউক্লিও  সিন্থেসিস ) জন্য পর্যাপ্ত শক্তি নিয়ে একে অপরের সাথে মিশে যায়। পরবর্তীতে সেটি  ফোটনের আকারে শক্তি উৎপাদনে সক্ষম হয়- যাকে আমরা আলোর কণিকা হিসাবে চিনি ।
পারমাণবিক সংযোজনের ফলে উৎপন্ন বিরাট শক্তি চায় তারাটিকে ছিন্নভিন্ন করে মহাকাশের অতলান্তে সরিয়ে দিতে ।কিন্তু তারার বিপুল ভরের জন্য যে মহাকর্ষ বল উপলব্ধ হয় ,সেটি  তারাটিকে একত্রিত করে রাখতে সচেষ্ট হয়।এই দুই বিপরীত বলের প্রভাব সমান হলে  ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হয় । এর খুব সহজ অর্থ হলো তারকাটিতে হাইড্রোস্ট্যাটিক প্রতিসাম্য  স্থাপিত হয়েছে । এই ধরণের তারকাগুলিকে আমরা প্রধান সিকোয়েন্স তারকা বলে থাকি । 
তারকাগুলি এরপর হাইড্রোজেন পরমাণুর  সমন্বয় ঘটিয়ে হিলিয়াম পরমাণুর জন্ম দেয়।পর্যায় সারণি খেয়াল করলেই বোঝা যাবে চারটি হাইড্রোজেন পরমাণু জুড়ে তৈরী হয় একটি হিলিয়াম পরমাণু ।প্রধান সিকোয়েন্স তারকা আমরা তাদেরকেই বলে থাকি যেসব তারার মধ্যে এখনো হাইড্রোজেন দহন হচ্ছে  ।অর্থাৎ যারা পারমাণবিক সমন্বয়ের দ্বারা হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম রূপান্তরিত হচ্ছে ।আমাদের সূর্য হলো একটি প্রধান সিকোয়েন্স তারকা ।
আমরা প্রোটন-প্রোটন শিকল ও CNO চক্রের সাথে পূর্বেই পরিচিত হয়েছি ।যদি প্রধান সিকোয়েন্স তারকার ভর যথেষ্ট কম হয় তাহলে তারা p -p  শিকল দ্বারা যুক্ত হয় ।এবং ভরের পরিমান বেশি হলে তা CNO চক্র দ্বারা যুক্ত হয় ।যদিও প্রথম প্রজন্মের তারকারা শুধুমাত্র p -p  শিকল দ্বারাই যুক্ত হতে পারতো ।কারণ সে সময় কার্বন ,নাইট্রোজেন বা অক্সিজেন প্রকৃতিতে ছিল না ।
 ডেনিশ জ্যোতির্বিদ ইজনার হার্টজস্প্রুং এবং আমেরিকান জ্যোতির্বিদ হেনরি নরিস রাসেল স্বাধীনভাবে ১৯১১ এবং ১৯১৩ সালে স্বাধীনভাবে একটি ডায়াগ্রাম তৈরি করেছিলেন।বিজ্ঞানীদ্বয়ের নামের আদ্যাক্ষরের সাথে মিলিয়ে এই ডায়গ্রামটিকে বলা হয় এইচ -আর  ডায়াগ্রাম।  এটি  তারার ভর ও উষ্ণতার উপর ভিত্তি করে তৈরী করা হয়েছিল ।
এখানে প্রধান অনুক্রমের তারাগুলিকে সাতটি বিভাগে বিভক্ত করা হয় ।যেমন - ও, বি, এ, এফ, জি, কে, এবং এম-প্রকারের  তারকা ।1920 সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিদ অ্যানি জাম্প ক্যানন এই শ্রেণিবদ্ধকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন । তাঁর এই কাজটি হার্ভার্ড শ্রেণিবদ্ধকরণ প্রকল্প হিসাবে পরিচিত।
ও-টাইপ তারকারা উষ্ণতম, নীলাভ, এবং সর্বাধিক ভরসম্পন্ন ।এবং এদের বেশির ভাগেরই  জীবন কাল সংক্ষিপ্ত, যদিও এই সংক্ষিপ্ততার হিসাব প্রায় কয়েক মিলিয়ন বছর । এম-টাইপের তারা  শীতল, রক্তিম ও সর্বাপেক্ষা হালকা হয় । শত শত বিলিয়ন বছর ধরে তারা মূল সিকোয়েন্স তারকা হিসাবেই থেকে যায়। সূর্য হলো একটি জি-টাইপ তারকা অর্থাৎ উপরিউক্ত দুই শ্রেণীর মাঝে অবস্থান করছে ।এবং সামনের কয়েক মিলিয়ন বছর অবলীলায় তার জীবন চালিয়ে নিতে সক্ষম ।
তারকার হাইড্রোজেন দহন সম্পন্ন হলে অর্থাৎ তার জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে সমগ্র তারকাটি তার মজ্জায় নিমজ্জিত হয় । সূর্য ও সূর্যের থেকে প্রায় দশ গুন পর্যন্ত ভারী তারকা গুলি প্রথমে "লাল দৈত্য" এবং তারপরে "সাদা বামন" হয়ে উঠবে । এর চেয়ে আরও বড় আকারের তারাগুলি পরিণত হবে "অতিদানবে" এবং অতঃপর একটি সুপারনোভায় ।অবশেষে তার পরিসমাপ্তি লেখা হবে একটি নিউট্রন তারকাতে অথবা একটি ব্ল্যাকহোলের অন্ধকূপে । 
যে প্রশ্ন ও ভ্রান্ত ধারণা আমাদের মধ্যে লুকিয়ে ছিল ,অর্থাৎ " সূর্য কি শেষ পর্যন্ত একটি ব্ল্যাক হলে পরিণত হবে ?"এর সরল উত্তর হলো -"না ,সে সম্ভাবনা নেই "।এবং অপর প্রশ্ন -"পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার কোনো সম্ভাবনা কি আছে ?" উত্তর হলো -" আছে ।তবে মানব বা বলা ভালো জীবকুলের ক্ষেত্রে তা উপলব্ধি করে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই ।

ক্রমশ...


পর্ব ০৪ - লাল দানব 
------------------------
 মহাকাশে সূর্যের মতো তারকাগুলির ভবিতব্যের না জানা গল্প আবার শুরু করা যাক ।আমরা জানি সূর্য প্রথমে একটি লাল দৈত্যে ও পরবর্তীতে সাদা বামনে পরিণত হবে তার বার্ধক্যে ।কিন্তু প্রশ্ন হলো কিভাবে? এর উত্তর পাওয়া সহজ নয় । বিলিয়ন বছরের প্রক্রিয়া ১০ মিনিটে  আয়ত্ত করার জন্য একটু ধৈর্য ও স্থিতধী এর প্রয়োজন হবে।

 আমাদের সূর্যের মতো মাঝারি ভরের তারকাগুলি তাদের মজ্জার মধ্যে হাইড্রোজেন সংযোজনের মাধ্যমে হিলিয়ামে পরিণত হয়ে বাঁচে। আমাদের সূর্য এখন ঠিক এই কাজটাই করছে। হাইড্রোজেন জ্বলতে থাকলে মজ্জার বাইরের অংশে হিলিয়াম অনু সঞ্চিত হতে থাকে ।এভাবে হাইড্রোজেন যত কমতে থাকে হিলিয়াম মজ্জার ভর ততো বাড়তে থাকে ।হাইড্রোজেন দহনের শেষ পর্যায়ে সূর্য জ্বালানির অভাব বোধ করে ।ফলে  নিউক্লিও বল  ও মহাকর্ষ বলের প্রতিসাম্য বিঘ্নিত  হয় ।যথেষ্ট পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন না করতে পারার জন্য তারকাটি মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সামান্য সংকুচিত হয় । ফলে এটির তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং হাইড্রোজেন মজ্জার বাইরের খোলকে অর্থাৎ হিলিয়াম মজ্জার শুরুতে পুনরায় হাইড্রোজেন দহন শুরু হয়ে যায় ।আগামী ৫ বিলিয়ন বছর ধরে সূর্যের মজ্জা  সমস্ত হাইড্রোজেন ব্যবহার করবে।

তারার এই পরিস্থিতি অনেকটা প্রেসার কুকারের মতো। বায়ুনিরুদ্ধ পাত্রে কিছু গরম করার ফলে পাত্রের ভিতরে চাপ বাড়তে থাকে। সূর্যের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটে। যদিও সূর্য নিখুঁত বায়ুনিরুদ্ধ পাত্রের মতো কাজ করে না।মহাকর্ষের কারণে মজ্জা টি  তারকাটির বাকি অংশ গুলোকে অভ্যন্তরে টানতে থাকে। যখন মজ্জার উত্তপ্ত গ্যাস দ্বারা তৈরি চাপটি বাইরে বেরিয়ে আসে তখন চাপ এবং মাধ্যাকর্ষণ এর মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় ।মজ্জা থেকে সমস্ত হাইড্রোজেন নিঃশোষিত হওয়ার ফলে সাম্য অভিকর্ষের পক্ষে হেলে পড়ে।অচিরেই তারার পতন শুরু হয় ।

হাইড্রোজেনের বাইরের স্তরগুলির জ্বলনকালে এটি রক্তিমাভ হয়ে ওঠে ।এই অবস্থায় তারকাকে বলা হয় " লাল দৈত্য"( RED GIANT ) । সমস্ত প্রধান অনুক্রমের তারা, যাদের ভর সূর্যের ভরের  প্রায়  ১/৫  থেকে ১০  গুণ হয় তারা প্রত্যেকেই হয়ে উঠবে একেকটি  রক্তাভ দৈত্য ।আমাদের সূর্যের এইরকম দৈত্য অবস্থাটি এত বড় হবে যে এটি বুধকে পুরোপুরি গ্রাস করে নেবে ।

যে সমস্ত নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের প্রায় ২.৫ গুণ কম হয়,তাদের ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন দহনের অন্তিম লগ্নে তারাটি অত্যন্ত  গরম হয়ে যায় ।এবং এটির অবক্ষয় রুদ্ধ হয়ে পড়ে ।তখন তারাটি অল্প সময়ে প্রচন্ড প্রসারিত ও শীতল হতে থাকে ।  এই প্রক্রিয়াটি 'হিলিয়াম ফ্ল্যাশ' হিসাবে পরিচিত। হিলিয়াম ফ্ল্যাশের কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে হিলিয়াম সংবদ্ধকরণ শুরু হয়ে যায় । এই তারাগুলি কখনও কখনও অনুভূমিক শাখা তারা বলে উল্লেখ করা হয় ।

যখন কোনও তারকা আকারে বড় হয়,এর সামগ্রিক তাপমাত্রা কমে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত হাইড্রোজেন ফিউশন থেকে তৈরি হিলিয়াম সংযোগ করার মতো পর্যাপ্ত গরম না হওয়া পর্যন্ত আমাদের লাল দৈত্যাকার সূর্যের মূল তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকবে । অবশেষে হিলিয়াম সংযুক্তকরণের মাধ্যমে এটি কার্বন ও অন্যান্য ভারী উপাদানগুলিতে রূপান্তরিত হবে । সূর্য কেবলমাত্র লাল রঙের দৈত্য হিসাবে এক বিলিয়ন বছর আকাশগঙ্গা ছায়াপথে বিরাজ করবে ।

সমস্ত হিলিয়াম অন্যান্য উপাদানগুলিতে মিশ্রিত হয়ে গেলে, বিকিরণের চাপ হ্রাস পায়। এবং তারা আবার মহাকর্ষের বলের খপ্পরে পড়ে ।তবে অক্সিজেন ফিউশন শুরু হওয়ার জন্য অনেক বেশি তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় ।সূর্যের ক্ষেত্রে কার্বন ফিউশন শুরু করার মতো পর্যাপ্ত তাপশক্তি থাকবে না ।ফলে এটির মজ্জা মহাকর্ষের প্রভাবে বাইরে বেরোতে পারেনা ।কিন্তু বাইরের খোলকের আয়তন অস্বাভাবিক রকম বৃদ্ধি পেতে থাকে।আমাদের সূর্যের ব্যাসার্ধ তখন পৃথিবীর কক্ষপথের চেয়েও বড় হয়ে উঠবে ।সূর্য এই সময়ে খুব স্থিতিশীল হবে না এবং ভর হারাবে। তারকা অবশেষে তার বাইরের স্তরগুলি বন্ধ করে না দেওয়া পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকে। তারাটির মজ্জাটি  অবশ্য অক্ষত থাকে এবং একটি সাদা বামনে পরিণত হয়।

(ক্রমশ ...)
পর্ব ০৫- গুপ্তধনের সন্ধানে 
---------------------------- 
"সাদা বামন" কে বলা হয় নক্ষত্রের বধ্যভূমি । মনে করা হয় আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের প্রায় ৯৭ শতাংশ নক্ষত্রই একসময় শ্বেত শুভ্র কাফন পরিবেষ্টিত পৃথিবীর আকারের বামনে পরিণত হবে । তো এই গোরস্থানে যদি হঠাৎ করে অতুল ঐশ্বর্যের সন্ধান পান কেমন লাগবে ?যে সে ঐশ্বর্য নয় ।একেবারে খাঁটি হিরে ।পরিমানে ধরুন পেয়ে গেলেন একটা আস্ত পৃথিবীর সমান খনি ।দাঁড়ান দাঁড়ান । এই গুপ্তধনের নকশা পেতে একটু তত্বের চড়াই উৎরাই অতিক্রম করতে হবে ।
আমরা ইতিমধ্যেই জানি যে সূর্যের মতো মাঝারি ভরের তারকাগুলি লাল দৈত্য হয়ে ওঠে।আমাদের লাল দৈত্য এরপর হিলিয়াম ভক্ষণ করবে এবং তৈরী করবে কার্বন । কিন্তু যখন এটি তার হিলিয়াম শেষ করবে তখন  কার্বন দহনের পক্ষে উপযুক্ত যথেষ্ট শক্তি এর মধ্যে অবশিষ্ট থাকবেনা । তাহলে এর পর কি ?
যেহেতু আমাদের সূর্য কার্বন মজ্জার মূল অংশটি প্রজ্বলিত করতে যথেষ্ট গরম হবে না, এটি আবার বলের প্রতিসাম্য যুদ্ধে মহাকর্ষের কাছে পরাজয় স্বীকার করবে।সমস্ত তারকাটি চাইবে নিজেকে যতটা সম্ভব দুমড়ে মুচড়ে ফেলা যায় ।অর্থাৎ তার আয়তন দ্রুত কমতে থাকলেও ভরের কোনো পরিবর্তন হবে না ।তখন এটির মধ্যে পারমাণবিক সংযোজন প্রক্রিয়াও রোধ হবে ।তবে সূর্যের মধ্যে যে তাপীয় শক্তি তখনও নিহিত ছিল তা আলোক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে এটিকে উজ্জ্বলতা প্রদান করবে।  
সাদা বামনগুলির মধ্যে যে পরিমান ভর থাকে ,তা  সূর্যের ভরের সাথে তুলনীয়। তবে আকারের দিক থেকে তাদের পৃথিবীর আকারের সাথে পার্থক্য খুবই কম।অর্থাৎ সাদা বামন পৃথিবীর মতো বড়ো কিন্তু সূর্যের মতো ভারী।অত্যন্ত ঘন এই সাদা বামন গুলির ভরের কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে আর এখানে এসে সমগ্র সভ্যতাকে এক ভারতীয় বিজ্ঞানীর   নাম একবার উচ্চারণ করতেই হবে । সূর্যের ভরের ১.৪ গুন ভরকে সাদা বামনের ভরের উচ্চতম সীমা হিসাবে বিবেচনা করা হয় ।সুব্রাহ্মণ্য চন্দ্রশেখর ১৯৩১ সালে প্রথম এই সীমা সম্বন্ধে ধারণা দিয়েছিলেন । তাঁর এই বিশেষ কাজের স্বীকৃতি হিসাবে এই সীমার নামকরণ করা হয়েছে "চন্দ্রশেখর লিমিট "। আজ অবধি পর্যবেক্ষণ করা গেছে এমন সবচেয়ে ভারী সাদা বামনের ভর প্রায় ১.২ গুন সৌর ভরের সমান । এবং  সবচেয়ে হালকা ভরের পরিমাণ প্রায় ০.১৫ গুন  সৌর ভর ।
এদের বায়ুমণ্ডলে একটি খুব পাতলা হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাসের স্তর থাকে।এদের ভূমি স্তর (যেটাকে ক্রাস্ট বলা হয়ে থাকে ) প্রায় ৫০ কিলোমিটার পুরু।মনে করা হয় যে এই ভূমি স্তরের নিচে এরা কার্বন এবং অক্সিজেন স্ফটিকের জাল বিস্তার করে রাখে । সমস্ত সাদা বামন কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যমান নয় ।সমস্ত নক্ষত্রের প্রায় অর্ধেক একটি দ্বিক( বাইনারি) সিস্টেমে তার সঙ্গী বামন তারার সাথে অবস্থান করে ।এবং সাথী বামনের থেকে ভর সংগ্রহ করতে পারে ।এইভাবে ক্রমাগত ভর সংগ্রহ করতে থাকলে দাতা বামনটির ক্রাস্ট একসময় ফেটে যাবে এবং মজ্জার অংশটি প্রকাশিত হয়ে পড়বে।এখন বলুন সাদা বামনের মজ্জায় কি থাকে ? কার্বন।কালো চারকোল নয় ,স্ফটিকাকার রূপভেদ ।হীরক ।
২০১১ সালে  পিএসআর জে ১৭১৯ -১৪৩৮ বি তারকার খোঁজ পাওয়া যায় যা নিজের দেহে শুধুমাত্র হীরক সঞ্চয় করে মিলিসেকেন্ড এর ও কম সময়ে তার সাথী বামন তারকাকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে ।রসিক বিজ্ঞানীদের অন্দরে অনেকেই মনে করেন এটা পুরুষ বামন ।

ক্রমশ...