Monday, May 17, 2021

কেউ যদি মনে করেন যে মানুষ আসলে চাঁদে যায়নি তবে দয়া করে নিচের কথাগুলো একটু সময় নিয়ে পড়ে দেখুন। 🙂

“মানুষ আসলে চাঁদে যায়নি। পুরোটাই ছিল আমেরিকার সাজানো নাটক। এরিয়া ফিফটি ওয়ান নামের এক গোপন মরু এলাকায় চাঁদে অবতরণের শুটিং করে সেটাকেই অ্যাপোলো অভিযান নামে চালিয়ে দিয়েছিল মার্কিনিরা। পুরোটাই ভুয়া।” চন্দ্রবিজয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ ও ব্লগ মাধ্যমে খুবই পরিচিত একটি দাবী। অনেকেরই বিশ্বাস এটি একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, এর সম্পূর্ণটাই নাটক।

এর এক কথায় উত্তর হলো- অবশ্যই, ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো আসলেই মানুষ চাঁদে অবতরণ করেছিল। সেটি মোটেও এরিয়া ফিফটি ওয়ানে স্ট্যানলি কুব্রিকের শুটিং ছিল না। শুধু অ্যাপোলো-১১ এর দুজন নন, মোট ১২ জন মানুষ হেঁটেছেন চাঁদে। চাঁদে যাবার বিপক্ষে যে যে অভিযোগগুলো তোলা হয় এখানে সেগুলোর ব্যবচ্ছেদ করা হবে। বলে রাখা ভালো, চাঁদে মানুষ যায়নি- এ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জনক William Charles Kaysing যিনি ২০০৫ সালে মারা যান।

অভিযোগ ১: চাঁদের মাটিতে পতাকা উড়ছিল, অথচ চাঁদে তো বাতাস নেই।(চিত্রঃ১)

চাঁদের বুকে পতাকার ভিডিওতে দেখা যায়, পতাকা লাগাবার সময় আসলেই সেটি উড়ছে বলে মনে হচ্ছে। চাঁদে যেহেতু বাতাস নেই তাহলে পতাকাকে উড়াচ্ছে কে? পদার্থবিজ্ঞানের সরলতম সূত্র জানা মানুষের পক্ষেও এর কারণ বুঝতে পারা সম্ভব। বায়ুহীন পরিবেশে নড়ার রসদ দিচ্ছে গতি জড়তা। পতাকা লাগাবার সময় যে নড়াচড়া হচ্ছিল তার গতি জড়তার কারণে বায়ু না থাকা সত্ত্বেও পতাকা নড়ছিল একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। ঐ নড়াচড়ার সাথে বায়ুপ্রবাহের কোনো সম্পর্ক ছিল না। পতাকা বানিয়েছিল Annig Flagmakers, রেয়নের তৈরি সে পতাকার দাম ছিল তখন ৫ ডলার, এখন ৩২ মার্কিন ডলার।

ল্যাবরেটরিতেও বায়ুশূন্য স্থানে পরীক্ষাটি করে দেখা হয়। সেখানেও চাঁদের মতোই ফলাফল। চাঁদের অভিকর্ষের কারণে পতাকা সামান্য সময় পরেই নীচে নেমে যাবে বলে L আকৃতির একটি দণ্ডের সাহায্যে আটকে দেয়া হয়েছিল। বাতাসের বাধা না থাকায় জড়তা একটু বেশি সময় পর্যন্ত বোঝা গিয়েছিল। আর পদার্থবিজ্ঞানের দিক থেকে বিবেচনা না করে মানুষেরা সেটিকে ধরে নিয়েছিল বাতাসের প্রবাহ হিসেবে! ভিডিওতে দেখানো পরীক্ষাগারের ঐ পরীক্ষাটি দেখতে পারেন আপনিও।

অভিযোগ ২: চাঁদে তোলা ছবিতে কোনো তারাই দেখা যায় না।(চিত্রঃ২)

চাঁদেও কিন্তু সকাল হয়! সেখানে আকাশ নীলাভ নয় বাতাস নেই বিধায়, কিন্তু সূর্য তো আছে! যে সময়ে ছবিগুলো তোলা হয়েছিল তখন ছিল চাঁদের দিনের বেলা। সূর্যের আলোতে আকাশের তারকা তখন কীভাবেই বা ধরা পড়বে ছবিতে?
তাছাড়া, এখানে এক্সপোজারের ব্যাপার আছে। যদি আকাশের তারকার ক্ষীণ আলো ধরবার মতো করে এক্সপোজার রাখা হত, তবে দেখা যেত চাঁদের পৃষ্ঠ ও পৃথিবী অনেক সাদা হয়ে গিয়েছে! ক্যামেরার এক্সপোজার নিয়ে যারা ধারণা রাখেন, তারা বিষয়টি ভালো বুঝতে পারবেন।

অভিযোগ ৩: পায়ের ছাপ তো মেলে না!(চিত্রঃ৩,৪)
অনেকে বলে থাকেন চাঁদ থেকে তোলা ছবিতে দেখানো জুতার ছাপ এবং পরবর্তীতে দেখানো জুতার ছাপ মিলে না।আসলে ছবিতে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা ভেতরের জুতো। অথচ ছাপ তো পরবে বাইরের জুতোর, যেটি আউটার বুট নামে পরিচিত! 

অভিযোগ ৪: পাথরের ছায়া আর অবতরণ করা মুনল্যান্ডারের ছায়া তো একই দিকে না, অথচ সূর্য তো একটিই!(চিত্রঃ৫)

 ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পাথরের ছায়া কোণাকোণি পড়েছে, যেখানে ঈগল মুনল্যান্ডারের ছায়া পড়েছে সোজাসুজি। আসলে একটি বস্তুর ছায়া আপনি কীরকম দেখতে পাবেন সেটা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর, শুধু আলোক উৎসের উপর নয়। এক্ষেত্রে যেটা হয়েছে তা হলো চন্দ্রপৃষ্ঠের বন্ধুরতা। পাথরের ছায়া যেখানে পড়েছে সেখানে জায়গাটা বন্ধুর দেখে ছায়াটাকে সোজা লাগছে না।

অভিযোগ ৫: ছায়াতে এত স্পষ্ট ছবি দেখা যাচ্ছে কেন?(চিত্রঃ৬)

এ ব্যাপারটা চাঁদে তোলা অনেক ছবিতেই দেখা যায়। সূর্য সেখানে প্রধান আলোর উৎস হলেও একমাত্র উৎস নয়, চন্দ্রপৃষ্ঠ নিজেও আলো প্রতিফলন করে ও উৎস হিসেবে কাজ করে, এবং বায়ুমণ্ডল না থাকায় ছবি বেশ স্পষ্ট ও উজ্জ্বল আসে।

অভিযোগ ৬: বাজ অলড্রিনের এই ছবি তুলল কে?(চিত্রঃ৭)

ছবিটা তুলেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং। জুম করলে দেখা যাবে, বাজ অলড্রিনের হেলমেটে যে বিম্ব দেখা যাচ্ছে সেখানে নীল আর্মস্ট্রং আছেন, তিনিই ছবি তুলছেন। কিন্তু আর্মস্ট্রংয়ের হাত ওপরে ক্যামেরা ধরার মতো করে নেই। কারণ স্যুটে বুকের কাছে ক্যামেরা ফিক্স করে দেয়া ছিল। তিনি হাত বুকের কাছে এনেছেন ছবি তুলবার জন্য।

অভিযোগ ৭: ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশন বেল্ট নভোচারীরা কীভাবে পার হলেন?(চিত্রঃ৮)

ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রের ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশন বেল্ট পার হয়েই মহাশূন্যে আসতে হয় নভোচারীদের। কোনো শিল্ড ছাড়া কেউ যদি বছরখানেক সেখানে ভ্রমণ করেন তবে ২,৫০০ REM পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা ভোগ করতে হবে তাকে। কিন্তু অ্যাপোলো মিশনে তারা এত তাড়াতাড়ি সে অঞ্চল পেরিয়ে গিয়েছিলেন যে আসা-যাওয়া মিলিয়ে তারা মোটে মাত্র ০.৫ REM এর মতো তেজস্ক্রিয়তার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এমনকি সেটা যদি ২ REM হতো তবেও সেটা নিরাপদ বলা যেত।

অভিযোগ ৮: যেখানে মডিউল অবতরণ করে, সেখানে কোনো বিস্ফোরণজনিত গর্ত নেই কেন?

অবতরণের সময় লুনার ল্যান্ডার রকেট নিক্ষেপ করে গতি কমাবার জন্য। তাহলে চাঁদের মাটিতে আমরা কেন কোনো বিস্ফোরণ থেকে উৎপন্ন গর্ত দেখতে পাইনি? এর কারণ, ল্যান্ডারের যে রকেট ছিল সেটি ১০,০০০ পাউন্ডের ধাক্কার (থ্রাস্ট) ক্ষমতা রাখত। কিন্তু নামবার জন্য দরকার ছিল মাত্র ৩,০০০ পাউন্ড থ্রাস্ট। নির্গত গ্যাসকে মাটির ঠিক এক জায়গায় গিয়ে আঘাত করবার মতো বায়ুচাপ চাঁদে অনুপস্থিত। হিসেব করে দেখা যায়, সেক্ষেত্রে চাপটা প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ছিল মাত্র দেড় পাউন্ড। গর্ত তৈরি হবার জন্য সেটা মোটেও যথেষ্ট ছিল না। তাছাড়া অবতরণ হয়েছিল নিরেট পাথরে, গর্ত হবার তো প্রশ্নই আসে না।

অভিযোগ ৯: চাঁদে উড্ডয়ন-অবতরণ কোনো ক্ষেত্রেই রকেট থেকে কোনো অগ্নিশিখা দেখা যায়নি কেন?(চিত্রঃ৯)

হাইড্রোজেন এবং ডাইনাইট্রোজেন টেট্রাঅক্সাইডের মিশ্রণে যে জ্বালানি ব্যবহার করা হয়েছিল সেটার প্রজ্জ্বলনে যে শিখা উৎপন্ন হতো সেটি স্বচ্ছ, এজন্য কোনো অগ্নিশিখা ‘দেখা’ যায়নি।

অভিযোগ ১০: ধুলোর উপর পায়ের ছাপ এত যত্ন করে সুরক্ষিত মনে হয় কেন?(চিত্রঃ১০)

এটার উত্তরও বায়ুর অনুপস্থিতি। যে ছাপ সেখানে আছে কোনো বাতাসের অভাবে ধুলোবালি না ওড়াতে সেটি অক্ষতই রয়ে গেছে, এবং সেরকমই থেকে যাবে।

অভিযোগ ১১: চাঁদ থেকে নিয়ে আসা পাথরগুলোর সাথে এন্টার্কটিকা মহাদেশ থেকে আনা কিছু পাথরের এত মিল কেন?(চিত্রঃ১১)

পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ৩০টির মতো পাথর পাওয়া গিয়েছে যা কিনা আসলে চাঁদের অংশ, চাঁদ থেকে ছুটে আসা। উল্কাপিণ্ড মানেই আসলে বহির্জগৎ থেকে ছুটে আসা পাথর। পৃথিবীতে পাওয়া চন্দ্রপাথরগুলো অগ্নিদগ্ধ এবং অক্সিডাইজড। ভূতত্ত্ববিদেরা নিশ্চিত করেছেন যে, নীল আর্মস্ট্রংদের আনা পাথরগুলো আসলেই চাঁদ থেকে আনা।

অভিযোগ ১২: এই C অক্ষরওয়ালা পাথর এলো কীভাবে?(চিত্রঃ১২,১৩)

এটা কিন্তু অ্যাপোলো-১১ নিয়ে কিছু না, বরং অ্যাপোলো-১৬ নিয়ে। এই পাথরের ছবি দেখিয়ে বলা হয়, পাথরের গায়ে C কেন? তার মানে নিশ্চয়ই এটা বানোয়াট। আমরা বরং আসল ছবিটা দেখি যেখানে চার্লস ডিউক লুনার রোভারের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।ভালো করে ছবিটি দেখুন এবং এরপর জুম করে দেখুন। আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন, সেই C আসলে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারকারীদের বানোয়াট একটা ব্যাপার।

অভিযোগ ১৩: নীল আর্মস্ট্রং যদি প্রথম চাঁদে অবতরণকারী হন তবে তার ভিডিও করল কে?(চিত্রঃ১৪,১৫)

এটার উত্তর এতই সোজা যে এটা নিয়ে প্রশ্ন কেন ওঠে সেটাই রহস্য। নীল আর্মস্ট্রং সিঁড়ি বেয়ে নামবার সময় একবার থেমে একটি ক্যাবল বের করেছিলেন। তখন লুনার মডিউলের পাশ থেকে টিভি ক্যামেরা বেরিয়ে আসে। সরাসরি সম্প্রচারের জন্য এটা করা হয়। অডিও রেকর্ডিং এ এখনো শোনা যায় নীল জিজ্ঞেস করছেন যে সবাই পরিষ্কার ছবি পাচ্ছেন কিনা।

অভিযোগ ১৪: চাঁদে যদি আসলেই গিয়ে থাকে মানুষ তবে এখন আর যায় না কেন? নিক্সন প্রশাসনের সময়ই কেন যাওয়া হয়েছিল কেবল?

এটা খুবই জনপ্রিয় একটি প্রশ্ন। সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকার একটা বিজয় দরকার ছিল, চন্দ্রবিজয়ের দ্বারা সেই ‘স্পেস রেস’-এ জিতে যায় আমেরিকা। বাড়াবাড়ি রকমের অর্থ খরচ হয়ে গিয়েছিল এই প্রতিযোগিতায় জিততে। উভয় পক্ষই বুঝতে পারে যে, পৃথিবীর কক্ষপথে মিশন রাখাই বরং বেশি অর্থসাশ্রয়ী এবং কাজের, চন্দ্রবিজয়ের বাস্তবিক আর কোনো কারণ তেমন ছিল না। তবে চাঁদে এখন আর না যাবার পরিকল্পনা না থাকলেও, মঙ্গল বিজয়ের রূপরেখা কিন্তু বানানো চলছে!

এই গেল মূল অভিযোগগুলোর উত্তর। এবার আমরা নজর দেব নাসার হাত নেই এমন উৎস থেকে আমরা কী করে নিশ্চিত হতে পারি চন্দ্রবিজয়ের ব্যাপারে।

২০০৮ সালে জাপানের Japan Aerospace Exploration Agency (JAXA) থেকে পাঠানো লুনার প্রোব SELENE কিছু ছবি তোলে যা চন্দ্রবিজয়ের প্রমাণ দেয়।(চিত্রঃ১৬)
চাঁদে মানুষ অবতরণের সবচেয়ে অকাট্য প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় LRRR (Laser Ranging Retro-Reflectors) এক্সপেরিমেন্ট। অ্যাপোলো-১১ এর মহাকাশচারীরা চাঁদের মাটিতে ঠিক এভাবে লেজার রিফ্লেকটর রেখে এসেছিলেন।(চিত্রঃ১৭)

পৃথিবী থেকে চাঁদে লেজার নিক্ষেপ করা হলে, ঠিক রিফ্লেকটরে পড়লে নির্দিষ্ট সময়ে আলো ফিরে আসে পৃথিবীতে। Observatoire de la Côte d’Azur, McDonald, Apache Point এবং Haleakalā অবজারভেটরি নিয়মিত এই অ্যাপোলো রিফ্লেক্টর ব্যবহার করে। Lick Observatory ১৯৬৯ সালের ১ আগস্ট নভোচারীদের রেখে আসা রিফ্লেক্টরের অস্তিত্ব এ পরীক্ষার মাধ্যমে খুঁজে পায়। ১৯৭১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অ্যাপোলো-১৪ এর নভোচারীরা রিফ্লেক্টর রেখে আসেন, যা ম্যাকডোনাল্ড অবজার্ভেটরি সেদিনই খুঁজে পায়, অর্থাৎ কোনো মানুষই সেটা সেখানে রেখেছে। অ্যাপোলো-১৫ এর রিফ্লেক্টর রাখা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই এবং কিছুদিনের মাঝেই ম্যাকডোনাল্ড অবজার্ভেটরি সেটা খুঁজে পেতে সক্ষম হয়। এছাড়া নানা ছবির মাধ্যমেও প্রমাণ পাওয়া যায়।

তার চেয়েও বড় কথা, আমেরিকা ছয় ছয় বার চাঁদে মানুষ পাঠাবে, অথচ সোভিয়েত ইউনিয়ন একে ‘নাটক’ জেনেও আমেরিকার ‘গোমর’ ফাঁস করে অপমান করবার চেষ্টা করবে না, এ হতে পারে না। কারণ তারা যে সাপে নেউলের মতো লেগে থাকত তখন একে অন্যের পিছে!

সূত্রঃরোর মিডিয়া।