লেখায় - সুপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়।
Albert Einstein এর আপেক্ষিকতাবাদ অনুসারে এই মহাবিশ্বে আলোর থেকে বেশী গতিতে ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার। একথা প্রায় সবারই জানা। কিন্তু, আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, এই আলোর গতি কে মেপেছিলো ? কে গণনা করেছিলো, আলোর এই বিশাল গতিবেগ। আজ আমরা "গল্পস্রোত"- এর পক্ষ থেকে সহজবোধ্য ভাষায় এই বিষয়ে এক বিস্তৃত আলোচনা করবো। আমাদের বিশ্বাস, এই লেখা টি পুরোটা পড়ার পরে, আলোর গতি গণনার ইতিহাস সহজভাবে বুঝতে আপনাদের আর কোনো অসুবিধা হবে না। মূল লেখায় যাওয়ার আগে আলো মূলত কী বা আলো কাকে বলে সেই বিষয়ে কিছু আলোচনা করে নেওয়া যাক।
আলো বলতে আমরা যা বুঝি সেটা হলো মূলত দৃশ্যমান আলো (visible light)। আলো বললেই প্রথমে আমাদের যে ছবি টা ভেসে ওঠে সেটা হলো সূর্য। বস্তুত, তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ পরিসর (electromagnetic wave range ) এর এই এক নির্দিষ্ট অংশ যা আমরা চোখে দেখতে পাই, তাই একে দৃশ্যমান আলো বা visible light বলা হয়। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার এর মধ্যে অবস্থান করে। শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ হলো ২.৯৯৭৯২৪৫৮ * ১০^৮ মিটার/সেকেন্ড। যেটাকে আমরা, আমাদের গণনার সুবিধার্থে সেকেন্ডে ৩*১০^৮ মিটার/সেকেন্ড অর্থাৎ সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার ধরে নিতে অভ্যস্ত।
সময় টা আনুমানিক ৪২৮-৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। গ্রীক দার্শনিক এম্পিডক্লিস পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য দাবি করেন আলোও এক ধরনের পদার্থ। এবং যদি তাই হয়, তাহলে আলোর ও একটা নির্দিষ্ট গতিবেগ হওয়া উচিত। যদিও তাকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, কারণ, তিনি এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও দিতে পারেননি এবং এই নির্দিষ্ট গতিবেগ এর মান ঠিক কতো সেটাও বলতে পারেননি। পরবর্তীতে এম্পিডক্লিস এর এই তত্ত্ব টেনে ধরে ইউক্লিড বলেন আলোর উৎস হলো মানুষ এর চোখ। আমরা যখন কোনো কিছু দেখি, তখন আলো আমাদের চোখ থেকে সেই বস্তুর দিকে যায়, তারপর আমরা সেটা দেখতে পাই। পরবর্তীতে, ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দে আরবি গণিতবিদ হাসান ইবনে আল হাইসেন ঠিক বিপরীত একটা তত্ত্ব আমাদের সামনে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, আলোর উৎস মানুষের চোখ নয়। বরং,বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে এসে যখন আমাদের চোখের ওপর পড়ে তখনই আমরা বস্তুটাকে দেখি। এর অর্থ, আলোও ভ্রমণ করে এবং তাই আলোর একটা সসীম (finite) গতিবেগ থাকা উচিত। যদি ভেবে নেওয়ার কারণ নেই, পৃথিবীর বেশীরভাগ পন্ডিত তখনও আলোর গতিবেগ সসীম (finite) মনে করতো। তার মধ্যে ছিলো রজার বেকন, জোহানস কেপলার এর মতো জ্ঞানীগুণী মানুষেরা, যারা মনে করতেন আলোর গতিবেগ অসীম (infinite) ই হওয়া উচিত, অন্তত শূন্য মাধ্যমে তো বটেই। যাই হোক, তখনও অবধি, আলোর গতিবেগ এর প্রকৃত মান গণনার পরীক্ষা কেউ করে দেখেননি।
ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য, এই সাহস দেখালেন ডাচ দার্শনিক আইজাক বিকম্যান। সময় টা ১৬২৯ সাল। আইজ্যাক বিকম্যান ঠিক করলেন কামান থেকে বেরোনো একটা আলোকরশ্মি, সেটাকে প্রতিফলিত করতে হবে এক মাইল দূরের কোনো আয়নায়। যদি দেখা যায় প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসতে সময় নিচ্ছে তাহলে নিশ্চিত হওয়া যাবে আলোর গতির সীমা আছে। তিনি এক মাইল দূরে এক পর্যবেক্ষক কে দাঁড় করিয়ে রেখে তাকে লক্ষ্য করতে বললেন আলোর এই ১ মাইল পথ ভ্রমন করতে ঠিক কতটা সময় লাগলো। কিন্তু, খুব স্বাভাবিকভাবেই যখন এই পরীক্ষা করা হলো, তখন ওই পর্যবেক্ষক এর পক্ষে কিছুই বুঝে ওঠা সম্ভব হলো না। কারণ, আজ আমরা জানি, আলোর কাছে এই ১ মাইল দুরত্ব খুব, খুব ই কম। প্রায়, আনুমানিক ৯ বছর পর বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি কিছুটা এরকমই পরীক্ষা করে বসলেন৷ ঠিক, তার এক সহযোগী কে পাহাড়ের চূড়ায় এক লন্ঠন হাতে ধরিয়ে দিয়ে দূরের এক পাহাড় থেকে লক্ষ্য করার চেষ্টা করলেন আলোর এই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী পথ ভ্রমন করতে ঠিক কতটা সময় লাগছে ? এক্ষেত্রেও ঠিক আইজাক বিকম্যান এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। গ্যালিলিও ঠিক কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। তবে, তিনি অন্তত এটা বুঝতে পারলেন আলোর গতি যদি সসীম হয়েও থাকে তাহলে সেই সসীম গতিবেগ খুব, খুব ই বেশী। যেটা গণনা করা কঠিন ই নয়, দুঃসাহসিক ও বটে।
সেই দুঃসাহসিক কাজ করে দেখালেন ডেনমার্ক এর জ্যোতির্বিদ ওলে রোমার। যেখানে এর পূর্বে বিজ্ঞানীরা ১ মাইল বা দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী দুরত্ব নিয়ে আলোর বিশাল গতিবেগ মাপার কথা ভাবছিলেন, সেখানে রোমার এর চোখ গেলো বৃহস্পতির উপগ্রহ "আয়ো"-র ওপর। ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার অসম্ভব পান্ডিত্য ও পরিশ্রম দিয়ে পৃথিবীতে আলোর গতি মাপার দিশা বদলে দিলেন। তিনি বললেন, পৃথিবী থেকে দেখলে দেখা যায় কখনো কখনো বৃহস্পতির উপগ্রহ "আয়ো"- বৃহস্পতির চারিদিকে জলদি ঘূর্ণন সম্পূর্ণ করছে, কখন ও বা ধীরে। কিন্তু,এটা কীকরে হয় ? রোমার তার অসম্ভব মেধা দিয়ে এর কারন বার করলেন। তিনি বললেন, এর কারণ হলো পৃথিবী ও বৃহস্পতির উপগ্রহ "আয়ো"-র সদা পরিবর্তনশীল দুরত্ব। যখন পৃথিবী থেকে " আয়ো"-র দূরত্ব বেশী থাকে তখন "আয়ো"- থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছাতে বেশী সময় নেয়, তাই মনে হয় " আয়ো"- বৃহস্পতি কে ধীরে ঘূর্ণন করছে। ঠিক উল্টো টা মনে হয় যখন দূরত্ব কম থাকে, কারন তখন আলো "আয়ো- থেকে পৃথিবী তে পৌঁছাতে কম সময় নেয়। স্পষ্ট হয়ে যায়, আলোর গতিবেগ ও সসীম (finite). অনেক বছরের পরিশ্রমের পর রোমার আলোর গতিবেগ বের করেন ২.২*১০^৮ মিটার/সেকেন্ড। যদিও, এই মান আলোর প্রকৃত গতিবেগ এর থেকে কিছুটা কম। কিন্তু, রোমার এর কাছে যদি পৃথিবী ও বৃহস্পতি গ্রহের ব্যাসার্ধ ও কক্ষপথের সঠিক মান থাকতো তাহলে হয়তো তার গণনার মান আলোর গতিবেগ এর প্রকৃত মান এর অনেকটাই কাছাকাছি যেতে পারতো। কোনো উন্নত প্রযুক্তি ও যন্ত্র ছাড়াও ওলে রোমার যে সাহস দেখিয়েছিলেন তার জন্য সত্যিই অবাক হতে হয়৷
সময় বদলাতে থাকলো। বিজ্ঞান আমাদের একের পর এক উপহার দিতে থাকলো নতুন নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি পদার্থবিদ হিপোলাইট ফিজিও ৮ কিলোমিটার দূরে রাখা একটা reflecting mirror ও rotating while এর সাহায্যে আলোর গতিবেগ এর মান বের করলেন ৩.১*১০^৮ মিটার/সেকেন্ড। এর কিছুদিন পরে আর এক ফরাসি পদার্থবিদ লিওন ফুকো ওই একই পরীক্ষায় কিছু পরিবর্তন নিয়ে এসে এর মান বার করলেন ২.৯৮*১০^৮ মিটার/সেকেন্ড। যা আজকের স্বীকার্য মানের মাত্র ০.৬ ℅ কম। যাই হোক, এবার সময় চলে এলো তড়িৎচুম্বত্বর (electromagnetism)। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে এর সাহায্যে রোসা ও ডরসি নামক দুই বিজ্ঞানী আলোর গতিবেগ এর মান বার করলেন ২.৯৯৭১০*১০^৮ মিটার/সেকেন্ড। এই মান সময়ের সাথে সাথে আরো নিখুঁত ও সঠিক হতে থাকলো। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে "General conference on weights & measures"- মিটার ও সেকেন্ড এর সংজ্ঞা (definition) এ কিছু পরিবর্তন আনলো। যার পর থেকে আলোর গতিবেগ এর প্রকৃত মান হয়ে দাঁড়ালো - ২.৯৯৭৯২৪৫৮ *১০^৮ মিটার/সেকেন্ড। যা আজ ও সারা পৃথিবীতে সমানভাবে গ্রহনযোগ্য ও স্বীকার্য।
আলোর গতি গণনা মানুষের কাছে কোনো সহজ কাজ ছিলো না৷ বিগত ১০০ বছর ধরে প্রযুক্তির উন্নতি তে হয়তো আলোর গতির সঠিক মান আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু, আজ থেকে ৩৫০ বছর আগের পৃথিবীতে এই কাজ শুধু কঠিন ই ছিলো না, ছিলো দুঃসাহসিক। এবং, সেই দুঃসাহসিক কাজ এর সাহস যিনি দেখিয়েছিলেন তিনি ওলে রোমার ছাড়া কেউ নন। যিনি আলোর গতিবেগ মাপা কে সামান্য কয়েক কিলোমিটার দুরত্বের পরিবর্তে পৃথিবী ও বৃহস্পতি গ্রহের দূরত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পান্ডিত্য দেখিয়েছিলেন।
- সুপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়।