Friday, August 18, 2017

বিগ ব্যাং-এর আগে কি ছিল? (১ম পর্ব), (শেষ পর্ব)

লিখেছেন: অভিজিৎ রায়- জুন ২৮, ২০১৩

মহাবিস্ফোরণের কথা 



আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান
মহাবিশ্ব সংক্রান্ত যে কোন বিজ্ঞানের বই খুললেই আমরা দেখি সেটা অবধারিতভাবে শুরু হয় বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ দিয়ে। সেই যে ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল তার বিখ্যাত টেলিস্কোপের সাহায্যে আকাশের গ্যালাক্সিগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন গ্যালাক্সিগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে – তা দেখেই কিন্তু এক ধরণের ধারনা পাওয়া যায়, দূর অতীতে নিশ্চয় তারা খুব কাছাকাছি ছিল, খুব ঘন সন্নিবদ্ধ অবস্থায় গাঁটবন্দি হয়ে। আর সেই গাঁট-পাকানো অবস্থা থেকেই সবকিছু চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আকস্মিক এক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। এটাই সেই বিখ্যাত ‘বিগ ব্যাং’- এর ধারণা। এ ধারণা অনুযায়ী, প্রায় ১৩৭০ কোটি বছর আগে অতি উত্তপ্ত এবং প্রায় অসীম ঘনত্বের এক পুঞ্জিভূত অবস্থা থেকে এক বিশাল বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে উদ্ভব ঘটেছে আমাদের এই চিরচেনা মহাবিশ্বের ।

অবশ্য আজকে আমরা মহাবিশ্বকে যেভাবে দেখি, মহাবিশ্বের ঊষালগ্নে এর প্রকৃতি কিন্তু একদমই এরকম ছিল না, ছিল অনেকটাই আলাদা। আজকে আমরা যে চারটি মৌলিক বলের কথা শুনতে পাই – সবল নিউক্লিয় বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল, তাড়িতচৌম্বক বল এবং মাধ্যাকর্ষণ বল – বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই চারটি বল ‘সুপার ফোর্স’ বা অতিবল হিসেবে একসাথে মিশে ছিল।  ওরকম ভাবেই ছিল তারা মহাবিস্ফোরণের ঊষালগ্ন থেকে শুরু করে ১০-৪৩ সেকেন্ড পর্যন্ত। প্রথম এক সেকেন্ড পর্যন্ত মহাবিশ্ব ছিল যেন জ্বলন্ত এক নিউক্লিয় চুল্লি।  তাপমাত্রা ছিল একশ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়েও বেশি। সেসময় কোন চেনা জানা কণা ছিল না, চারদিক পূর্ণ ছিল কেবল প্লাজমার ধোঁয়াশায়। এক সেকেন্ড পরে কোয়ার্ক, ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের মত মৌলিক কণিকাগুলি তৈরি হয়। তিন সেকেন্ড পরে প্রোটন আর নিউট্রন মিলে তৈরি হল নিউক্লিয়াস, এর পরে যথাক্রমে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম। কিন্তু মহাবিশ্বের উদ্ভবের প্রায় কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত আমরা যাকে জড়পদার্থ বা ম্যাটার বলি সেরকম কিছুই তৈরি হয় নি। তখন আসলে রঞ্জন রশ্মি, আর বেতার তরঙ্গের মত লম্বা দৈর্ঘ্যের অতি তেজী রশ্মিগুলোই বরং পদার্থের উপর রাজত্ব করছিল। প্রায় চার লক্ষ বছর পরে তাপমাত্রা খানিকটা কমে তিন হাজার ডিগ্রি কেলভিনে নেমে আসার পরই কেবল প্লাজমা থেকে স্থায়ী অণু গঠিত হবার মত পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছে। এসময়  মহাবিশ্বের কুয়াশার চাদর ধীরে ধীরে সরে গিয়ে  ক্রমশ  স্বচ্ছ হয়ে আসে, পথ তৈরি হয় ফোটন কণা চলাচলের। আর তার পরই কেবল তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমূহের উপর জড়-পদার্থের আধিপত্য শুরু হয়েছে। এর পর আরও প্রায় একশ কোটি বছর লেগেছে গ্যালাক্সি জাতীয় কিছু তৈরি হতে। আর আমাদের যে গ্যালাক্সি, যাকে আমরা আকাশগঙ্গা নামে ডাকি, সেখানে সূর্যের সৃষ্টি হয়েছে আজ থেকে প্রায় পাঁচশত কোটি বছর আগে। আর সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণ্যমান গ্যাসের চাকতি থেকে প্রায় ৪৫০-৪৬০ কোটি বছরের মধ্যে তৈরি হয়েছিল পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো।

চিত্র: মহাবিস্ফোরণের কালপঞ্জি (ছবির কৃতজ্ঞতা :অপূর্ব এই মহাবিশ্ব, এ এম হারুন-অর-রশীদ এবং ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী)
এই জায়গায় এসে একটি  মজার তথ্য উল্লেখ করব, আর তথ্যের  অভিব্যক্তিটি এতোই শক্তিশালী যে, এটা আমাদের মত কাঠখোট্টা বিজ্ঞান লেখকদেরও কাব্যিক করে তোলে প্রায়শই। বিষয়টা হল – বিগ ব্যাং থেকে সবকিছুর শুরু বলে আমরা জানি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাবিস্ফোরণের পর মুহূর্তে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম কিংবা লিথিয়ামের মত মৌল তৈরি হলেও আমাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে মৌলগুলো – কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং লৌহ – এগুলো কিন্তু সে সময় তৈরি হয়নি। এগুলো তৈরি হয়েছে অনেক অনেক পরে কোন না কোন নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ থেকে, যাদের আমরা মহাকাশে সুপারনোভা বলে জানি। ‘অনেক অনেক পরে’  বলছি কারণ, বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেছেন, প্রথম নক্ষত্র তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাং ঘটার অন্তত ৭৫ কোটি বছর পরে। আর তারকার  বিস্ফোরণ – মানে সুপারনোভার মত ব্যাপার স্যাপার ঘটতে সময় লেগেছিল আরো অনেক। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল – আমাদের এই দেহ কার্বন দিয়ে, কিংবা দেহের ভিতরকার হাড়গুলো ক্যালসিয়াম দিয়ে তৈরি হতে পেরেছে হয়তো এ জন্যই – কেননা সুদূর অতীতে কোন না কোন নক্ষত্র নিজেদের বিস্ফোরিত করে তার বহির্জগতের খোলস থেকে এই জীবনোপযোগী মৌলগুলো ছড়িয়ে দিয়েছিল মহাশূন্যে। অনেক পরে সেই মৌলগুলো শূন্যে ভাসতে ভাসতে জড়ো হয়েছে সূর্য নামক এক সাদামাঠা নক্ষত্রের চারপাশে ঘূর্ণনরত এক সুনীল গ্রহে, এবং শেষ পর্যন্ত তৈরি করেছে প্রাণের বিবর্তনীয় উপাদান। আমাদের ছায়াপথের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে অন্তত ২০ কোটি নক্ষত্র এভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে, হয়তো আমার আপনার ভবিষ্যৎ জন্মকে সার্থক করে তুলবে বলে। আমরা সবাই আসলে নক্ষত্রের ধূলি – স্টারডাস্ট

[1]। এর চেয়ে কাব্যিক অনুরণন আর কীই বা হতে পারে? সেজন্যই বোধ হয় লরেন্স ক্রাউস তার ‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’ গ্রন্থে বলেছেন

[2],
‘আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে সবচেয়ে কাব্যিক যে সত্যটা আমি জানি তা হল, আপনার দেহের প্রতিটি অণু পরমাণু একসময় লুকিয়ে ছিল একটি বিস্ফোরিত নক্ষত্রের অভ্যন্তরে। অধিকন্তু, আপনার বাম হাতের পরমাণুগুলো হয়তো এসেছে এক নক্ষত্র থেকে, আর ডান হাতের গুলো এসেছে ভিন্ন আরেকটি নক্ষত্র থেকে। আমরা আক্ষরিক ভাবেই সবাই নক্ষত্রের সন্তান, আমাদের সবার দেহ তৈরি হয়েছে কেবল নাক্ষত্রিক ধূলিকণা দিয়ে’।
  চিত্র: আমরা আক্ষরিক ভাবেই সবাই নক্ষত্রের সন্তান, আমাদের সবার দেহ তৈরি হয়েছে কেবল নাক্ষত্রিক ধূলিকণা দিয়ে।

রসিকরাজ গ্যামো ভাঁড়
ছোটবেলায় আমরা গোপাল ভাঁড়ের অনেক গল্প পড়তাম। গোপাল ভাঁড়ের একেকটা গল্প পড়তাম আর হাসির চোটে আমাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেত একেবারে। কিন্তু তখন কি কস্মিন কালেও জানতাম, গোপাল ভাঁড়ের চেয়েও রসিক এক বিজ্ঞানী আছেন, তার অবদানের কথা উল্লেখ না করলে বিগ ব্যাং এর ইতিহাসটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে!

তিনি জর্জ গ্যামো। আমরা যে বিগ ব্যাং এর কথা বলি সেই বৈজ্ঞানিক ধারণাটি বিজ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাথমিক কৃতিত্ব অবশ্যই এই কৃতি পদার্থ বিজ্ঞানীর; তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার স্পর্শ কেবল পদার্থবিদ্যা নয়, জ্যোতির্বিজ্ঞান, তেজস্ক্রিয়তা থেকে শুরু করে এমনকি জীববিজ্ঞানেরও নানা শাখায় ছড়িয়ে রয়েছে। রুশ-দেশের এই রসিক আর খেয়ালী বিজ্ঞানী, যিনি আবার শখের যাদুকরও ছিলেন, প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে একক চেষ্টাতেই বলা যায় ‘বিগ-ব্যাং’র ধারণাকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেজন্য অনেকে  আজ তাকে অভিহিত করেন ‘বিগ ব্যাং এর পিতা’ হিসেবেও।

গ্যামোর আদি নিবাস ছিল রাশিয়ায়। আমরা যে ফ্রিডম্যানের কথা জানি, যিনি এক সময় আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের গাণিতিক সমাধান হাজির করেছিলেন মহাবিশ্বের প্রসারণ তুলে ধরতে, সেই আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান ছিলেন এক সময় গ্যামোর শিক্ষক, পড়াতেন পেট্রোগ্রাডে ১৯২৩ -২৪ সালের দিকে

[3]। বোঝাই যায় গুরু মারা বিদ্যা ভালই রপ্ত করেছিলেন গ্যামো।

গ্যামোর প্রতিভার বর্ণিল আলোকচ্ছটার সাথে রাশিয়ার বাইরের পৃথিবী পরিচিত হয়েছিল সেই ১৯২৮ সালেই। গ্যামো তখন জার্মানির গোটিংগ্যান বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার সাথে পরিচিত হতে। গিয়েছিলেন অনেকটা তার শিক্ষক অরেস্ট কোভলসনের জোরাজুরিতেই। গ্রীষ্মকালীন অবকাশটাতে কৃতি ছাত্রকে যেন উপোষ করে কাটাতে না হয় সেজন্য একটা শিক্ষাভাতাও যোগাড় করে দিয়েছিলেন শিক্ষক মশাই। জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তখন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের নানামুখী গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। গ্যামো সেখানে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে ফেললেন।  তেজস্ক্রিয় পদার্থের অবক্ষয়কে ব্যাখ্যার জন্য সুরঙ্গ প্রভাব (‘টানেলিং এফেক্ট’) ব্যবহার করলেন, যা এতদিন কেবল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগতেই ব্যবহৃত হত। তার এই নতুন ব্যাখ্যা সরাসরি পরীক্ষণ থেকে হাতে কলমে পাওয়া উপাত্তের সাথে মিলেও গেল অবিকল।

গ্রীষ্মকালীন অবকাশ শেষে রাশিয়া ফেরার পথে ভ্রমণপ্রিয় গ্যামো ভাবলেন, ফিরে যখন যাচ্ছিই – একটু না হয় ডেনমার্ক ঘুরে যাওয়া যাক। সেখানে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের দিকপাল নিলস বোর কি করে যেন গ্যামোর তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজের (সেটা তখনো কোথাও প্রকাশিত হয়নি) খোঁজ পেয়েছিলেন।  ডেনমার্কে গ্যামোর সাথে সাক্ষাৎ করে আর তার কাজ সামনাসামনি দেখেশুনে বোর এতটাই মুগ্ধ হন যে, কোপেনহেগেনে তার ইন্সটিটিউটে গ্যামোকে ফেলোশিপের প্রস্তাব দিয়ে দিলেন। গ্যামো মহা উৎসাহে কাজ শুরু করে দিলেন তখনই। কিন্তু গ্যামো চাইলে কি হবে, বাধা আসলো খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেই। কিছুদিন বোরের ইন্সটিটিউটে কাজ করার পর গ্যামো তখন (১৯৩০) রোমে নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের এক সেমিনারে যোগদানের পায়তারা করছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত অ্যাম্বেসি থেকে বলা হল তার পাসপোর্টের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না, এত জায়গায় ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে তাকে ‘ঘরের ছেলে ঘরে’ মানে সোজা সোভিয়েত ইউনিয়নে ফেরত যেতে হবে।

গ্যামো ফিরলেন রুশ দেশে। স্ট্যালিনের জামানা চলছে তখন। গ্যামো নিজ দেশে ফিরে এমন এক জন্মভূমিকে দেখতে পেলেন যেখানে মহামতি স্ট্যালিন এবং তার স্তাবকেরা শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান সবকিছুকেই মার্ক্সিজমের নাগপাশে বন্দি করে রেখেছেন। ধর্মান্ধ এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের মত সেখানে সাহিত্য সংস্কৃতি সৃষ্টির গৎবাঁধা ছক বাৎলে দেওয়া হয়েছিলো, এর অন্যথা হলে তাদের ‘কমি-ধর্মানুভূতিতে’ আঘাত লাগত।  বাংলা ব্লগের ব্লগারদের লেখায় ধর্মের সমালোচনা,  কিংবা কোন কার্টুনিস্টের কার্টুন আঁকা কিংবা ‘মুহম্মদ বিড়াল’ নিয়ে নির্দোষ কৌতুকেও যেমন  ইসলামের অনুসারীদের পিত্তি জ্বলে যায়, তেমনি স্ট্যালিনকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে কমিউনিস্ট অনুসারীদের গায়ে লাল লাল ফোস্কা পড়তো। তার প্রমাণ পাওয়া যায়  ব্যঙ্গাত্মক রচনার জন্য স্ট্যালিনীয় জামানায় সিন্যভস্কি-দানিয়েলের বিচারের প্রহসনে। জেলখানায় সাত বছর বন্দি রাখা হয়েছিলো সিন্যভস্কিকে, দানিয়েলের কপালে জুটেছিলো পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। সলঝনিৎসনের উপন্যাস ‘ফার্স্ট সার্কেল’ (First Circle)-এ দেখানো হয়েছিলো কিভাবে উপন্যাসের নায়ক শেষ পর্যন্ত স্ট্যালিনের শ্রম শিবিরে নিজেকে খুঁজে পায়।  সলঝনিৎসনকে সে সময় দেশ ত্যাগ করতে কিংবা নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। আঁদ্রে শাখারভকে গোর্কিতে নির্বাসন দেওয়া হয়। এই উদাহরণগুলো উল্লেখ করে এক সময় একটা লেখা লিখেছিলাম ‘মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?’ (২০০৮) শিরোনামে যা বাংলা ব্লগস্ফিয়ারে পক্ষে বিপক্ষে নানা তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল

[4]। কেবল সাহিত্য নয়,স্ট্যালিন এবং তার আদর্শবাদী সৈনিকেরা ভাবতেন বিজ্ঞানকেও মার্কসীয় মতবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে, নইল চলবে না। মার্কসীয় মতবাদের সংগে সংগতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সময় সময় বিজ্ঞানের শাখাগুলোকে বিকৃত করতেও পিছপা হননি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শাখাটি ছিল জেনেটিক্স বা বংশগতিবিদ্যা। রাশিয়া একসময় সারা পৃথিবীতেই জেনেটিক্সের গবেষণায় শীর্ষস্থানে ছিলো, অথচ স্ট্যালিনের আমলে রাশিয়ায় জেনেটিক্সের উপর গবেষণার লালবাতি জ্বলে গিয়েছিল। তা হবে নাই বা কেন। মার্ক্সবাদকে বাঁচাতে বংশাণুবিদ্যাকেও বিকৃত করতে পিছপা হননি শাসকেরা। এই উদ্দেশ্যে সেসময় লাইসেঙ্কো নামক এক ঠগ বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করা হয়

[5]। যখন ভাভিলভ সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা লাইসেঙ্কোর তত্ত্বের ভুল ধরিয়ে দেন তখন স্ট্যালিন তাদের সবকটাকে ধরে গুলাগে পাঠিয়ে দেন। ভাবিলভকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শুধু ভাভিলভ নয়, স্ট্যালিনের প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে সে সময় আরো প্রাণ হারিয়েছিলেন কার্পেচেঙ্কো, সালমোন লেভিট, ম্যাক্স লেভিন, ইস্রায়েল আগলের মত বিজ্ঞানীরা।  লাইসেঙ্কোর পাশাপাশি  স্ট্যালিন জামানায় লেপিশিঙ্কায়া নামের আরেক ঠগ বিজ্ঞানীকে প্রমোট করা হয়েছিল – উদ্দেশ্য সেই  ‘পুঁজিবাদী জেনেটিক্স’ সরানো।  বিজ্ঞানকে অবশ্যই শ্রমজীবী বা প্রলেতারিয়েতের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে, তা নইলে চলবে না – এটাই বিজ্ঞান সম্পর্কে স্ট্যালিনীয় ঘরনার মানুষদের ‘বৈজ্ঞানিক থিওরি’

[6]

চিত্র: বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো (১৯০৪ – ১৯৬৮)
কেবল জীববিজ্ঞানী কিংবা বংশগতিবিদেরা নয়, সোভিয়েত পদার্থবিদরাও  সে সময় আগ্রাসন থেকে রেহাই পাননি

[7]। আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রদান করার পর, ব্যাপারটা মার্ক্সিজমের সাথে ‘সংগতিপূর্ণ’ মনে না করায় ‘সোভিয়েত এনসাইক্লোপিডিয়া’ প্রকাশ করা হয় রিলেটিভিটিকে ‘নস্যাৎ’ করে। রাশিয়ার একজন বিখ্যাত মার্ক্সবাদী দার্শনিক তার তখনকার লেখায় বলেছিলেন –
‘আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এটা প্রোলেতারিয়েতদের কাছে গ্রহণীয় নয়’।
এই নির্বোধ মন-মানসিকতা জর্জ গ্যামোর সহ্য হয়নি। তা হবেই বা কেন। কিছুদিন আগেই নিলস বোরের গবেষণাগারে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উপর হাতে কলমে কাজ করে এসেছেন। অথচ দেশে এসে দেখলেন, সেখানে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর আপেক্ষিক তত্ত্বকে দেখা হচ্ছে ‘অপবিজ্ঞান’ আর ‘মার্ক্সিজম-লেনিনিজম’ এর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয় হিসেবে

[8]।  এই সব কূপমণ্ডূকতার প্রতিবাদ করায় জর্জ গ্যামো স্ট্যালিনীয় বাহিনীর কোপানলে পড়লেন। হয়তো মারাই পড়তেন ভাভিলভের মত, কিংবা বছরের পর বছর থাকতে হত শ্রম-শিবিরে, কিন্তু তার আগেই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে  সস্ত্রীক পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

চিত্র: এ ধরণের একটি কায়াকে করেই স্ত্রীকে নিয়ে কৃষ্ণ সাগর পাড়ি দিয়ে রাশিয়া থেকে পালাতে মনস্থ করেছিলেন গ্যামো।

কিভাবে পালালেন সেও এক ইতিহাস। শুনলে মনে হবে যেন কোন হিন্দি মুভির প্লট।  তিনি কয়েকটা ডিম, চকলেট, স্ট্রবেরি এবং দুই বোতল ব্র্যাণ্ডি বগলদাবা করে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে একটা ছোট নৌকায় (এ নৌকাগুলো কায়াক নামে পরিচিত) উঠে পড়লেন। উদ্দেশ্য কৃষ্ণ সাগরে ১৭০ মাইল পাড়ি দিয়ে তুরস্ক পৌঁছবেন।  প্রায় ৩৬ ঘণ্টা প্যাডেল করে সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ এর সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত নাকানি চুবানি খেয়ে মাঝপথে তীরে এসে আছরে পড়লেন। হাসপাতালেও থাকতে হয়েছিল দিন কয়েক। সে যাত্রা দেশ ছেড়ে পালাতে না পারলেও এক সময় ঠিকই সুযোগ বুঝে  ব্রাসেলস হয়ে আমেরিকা চলে আসলেন। যোগ দিলেন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষক হিসেবে।

সেখানেই রালফ আলফারের সাথে তার পরিচয়। আলফার ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন পিএইচডি করার জন্য। আলফারের সাথে সাথে মিলে ‘বিগ-ব্যাং’র ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন গ্যামো। হাবলের মহাবিশ্বের প্রসারণ সূচক বিখ্যাত আবিষ্কারের সাথে তিনি পরিচিত তো ছিলেনই। সেই প্রসারণের ভিডিও টেপটিকে যদি পেছনের দিকে চালানো যায়, তবে সেটা নিশ্চয় একটা আদিম অবস্থায় এসে থামবে। তিনি এর নাম দিলেন ‘ইয়েল্‌ম’। সেই আদিম অবস্থারই গাণিতিক সিমুলেশন করবেন বলে তারা ঠিক করেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্যামো বা আলফার কেউ নিজে থেকে ‘বিগ ব্যাং’ শব্দটি চয়ন করেন নি। গ্যামোর ধারণাকে খণ্ডন করতে গিয়ে আর এক প্রখ্যাত তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রেডারিক হয়েল সর্ব প্রথম এই বিগ-ব্যাং শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। হয়েল ছিলেন বিগ-ব্যাং তত্ত্বের বিপরীতে স্থিতিশীল অবস্থা (Steady State) নামে মহাবিশ্বের অন্য একটি জনপ্রিয় মডেলের প্রবক্তা। হয়েলের তত্ত্বের সাথে প্রথম দিকে যুক্ত ছিলেন কেম্ব্রিজ কলেজের হারমান বন্দি, থমাস গোল্ড আর পরবর্তীকালে একজন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তাঁর নাম জয়ন্ত নারলিকর। ১৯৪০ সালে একটি রেডিও প্রোগ্রামে হয়েল গ্যামো আর তাঁর অনুসারীদের ধারণাকে খণ্ডন করতে গিয়ে বেশ বাঁকা সুরেই অধ্যাপক হয়েল বলেছিলেন, ‘হাঃ সেই উত্তপ্ত বিগ ব্যাং’ – এই বিস্ফোরণের ধারণা যদি সঠিকই হবে, তবে তো এর ছাই-ভস্ম এখনও কিছুটা থেকে যাওয়ার কথা। আমাকে ‘বিগ ব্যাং’ এর সেই ফসিল এনে দেখাও, তার পর অন্য কথা।’ এর পর থেকেই বিগ-ব্যাং শব্দটি ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের জগতে স্থায়ী আসন করে নেয়। সে যাই হোক, আলফারের পিএচডি’র শেষ পর্যায়ে আলফার ও গ্যামো যুক্তভাবে ‘Physical Review’ জার্নালের জন্য ‘Origin of the Chemical Elements’ শিরোনামে একটি গবেষণা নিবন্ধ লিখতে শুরু করলেন। আর এখানেই রসিকরাজ গ্যামো বিজ্ঞান জগতের সবচাইতে বড় রসিকতাটি করে বসলেন। জার্নালে ছাপানোর আগে তিনি তাঁর বন্ধু আর এক স্বনামখ্যাত পদার্থবিদ হ্যানস বিথের (কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, নিউইয়র্ক) নাম তাঁকে না জানিয়েই প্রবন্ধটির লেখক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। পরে কারণ হিসেবে বলেছিলেন, “ ‘আলফার’ আর ’গ্যামো’- এই দুই গ্রীক ধরণের নামের মাঝে ‘বিটা’ জাতীয় কিছু থাকবে না, এ হয় নাকি? তাই বিথেকে দলে নেওয়া!”   সত্য সত্যই ১৯৪৮ সালের ১লা এপ্রিলে এই তিন বিজ্ঞানীর নামে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল, আর গ্যামোর রসিকতাকে সত্যি প্রমাণিত করে পেপারটি এখন ‘আলফা-বিটা-গামা পেপার’ ( α-β-γ paper) নামেই বৈজ্ঞানিক মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত।

কিন্তু সেই প্রবন্ধটিতে কি বলেছিলেন গ্যামো? তিনি ধারণা করেছিলেন যে, একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে যদি মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে সেই ভয়ঙ্কর বিকিরণের কিছুটা স্বাক্ষর, মানে বিকিরণ-রেশের কিছুটা এখনও বজায় থাকার কথা। গ্যামো হিসেব কষে দেখালেন যে, সৃষ্টির আদিতে যে তেজময় বিকিরণের উদ্ভব হয়েছিল, মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে তার বর্ণালী তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পেতে সেটা এখন পরম শূন্য তাপমাত্রার উপরে ৫ ডিগ্রি কেলভিনের মত হওয়া উচিত। এই তেজময় বিকিরণের অবশেষকেই বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিকিরণ’ বা ‘cosmic back ground radiation’। মহাশূন্যে এই বিকিরণের প্রকৃতি হবে মাইক্রোওয়েভ বা ক্ষুদ্র তরঙ্গ। সহজ কথায় বিষয়টি বুঝবার চেষ্টা করা যাক। সৃষ্টির আদিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছিল যেন একটি উত্তপ্ত মাইক্রোওয়েভ চুল্লি যা এখন ঠাণ্ডা হয়ে ৫ ডিগ্রি কেলভিনে এসে পৌঁছেছে। এই ব্যাপারটিই ধরা পড়ল ১৯৬৪ সালে আর্নো পেনজিয়াস আর রবার্ট উইলসনের পরীক্ষায়, গ্যামোর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবার ১৬ বছর পর। গ্যামোর সেই গবেষণাপত্রটির কথা ততোদিনে ভুলেই গিয়েছিল সবাই। কিন্তু সেখানে যাবার আগে আমাদের আরেকজন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীর  কথা  জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

জর্জ লেমিত্রি এবং তাঁর ‘আদিমতম কণা’
বিগ ব্যাং-এর কথা বললে এর পেছনে আরেকজন ব্যক্তির অবদানের কথা উল্লেখ না করলে তাঁর প্রতি নিতান্তই অবিচার করা হবে। তিনি হলেন জর্জ হেনরি লেমিত্রি (Georges Lemaître), বিগ ব্যাং তত্ত্বের আর একজন প্রবক্তা- যিনি ছিলেন একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী এবং সেই সাথে ধর্মযাজক।   নাস্তিক গ্যামোর মত ধর্মযাজক লেমিত্রিও কিন্তু  বিগ ব্যাং-এর পিতা খেতাব পাবার যোগ্য দাবীদার,এবং অনেকে সেটা তাকে ডাকেনও।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা থেকে প্রাপ্ত ক্ষেত্র সমীকরণের একটা সমাধান হাজির করেছিলেন লেমিত্রি, বিজ্ঞানী ফ্রিডম্যানের মতোই।  গ্যামোর মতো তিনিও ছিলেন মহাজাগতিক কালপঞ্জির এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি তার শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন প্রকৌশলী (পুরকৌশলী) হিসেবে, বেলজিয়ামের ক্যাথলিক লুভেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।  কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় জার্মান সৈন্যরা বেলজিয়াম আক্রমণ করলে তার পড়াশোনায় সাময়িক ছেদ পড়ে।  তিনি ‘আর্টিলারি অফিসার’ হিসেবে বেলজীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন আর সেখানে কাজ করেন চার বছরের জন্য। বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি সিভিল ইঞ্জিয়ারিং-এ আর না ফিরে গিয়ে পদার্থবিদ্যা এবং গণিত নিয়ে উৎসাহী হয়ে পড়েন তিনি। ১৯২০ সালে অর্জন করেন পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি।  পাশাপাশি ধর্মযাজকের পেশায়ও উৎসাহী হয়ে পড়েন তিনি।  তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সত্যে পৌঁছনোর দুইটি পথ। আমি দুটোই অনুসরণ করতে মনস্থ হলাম’।

পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি সে সময়কার বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের সাহচর্য লাভ করেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এডিংটন তার গাণিতিক দক্ষতা এবং পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এডিংটন তার সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘তুখোড় এক ছাত্র –  করিৎকর্মা, স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন এবং গনিতে দক্ষ’।  লেমেত্রি এক সময় কেম্ব্রিজের পাঠ চুকিয়ে চলে গেলেন আমেরিকায়।  এমআইটিতে করলেন পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় বারের মতো পিএচডি।

১৯২৫ সালে তিনি বেলজিয়ামে ফিরে গিয়ে তার পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে যোগ দিলেন। সেখানেই তিনি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণের উপর ভিত্তি করে নিজের মহাজাগতিক মডেল তৈরি করে ফেললেন।  তার সমাধান ছিল অনেকটা পূর্বসূরি ফ্রিডম্যানের মতোই। এ সমাধানে মহাজাগতিক ধ্রুবক গোনায় ধরার দরকার পড়েনি তার।  তার সমাধান থেকে বেরিয়ে আসলো মহাবিশ্ব ক্রমশঃ প্রসারিত হচ্ছে।  শুধু তাই নয়, সময়ের ঘড়িকে পেছনের দিকে চালিয়ে তিনি একদম শুরুর মানে ব্রাহ্ম-মুহূর্তের একটা ছবিও আঁকলেন তার গণিত আর বিজ্ঞানের কল্পনায়,  কাব্যিক ভাবে সে সময়টাকে অভিহিত করলেন ‘A Day without  yesterday’ হিসেবে। তিনি এই মহাবিশ্বের সমস্ত গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকাকে চেপে ঠেসে ঘন সন্নিবদ্ধ এক ছোট্ট মহাবিশ্বে পরিণত করলেন, আর তার নাম দিলেন  ‘প্রাইমিভাল এটম’  বা আদিম কণা নামে।  লেমেত্রির কাছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারটা ছিল সেই আদিম কণা নামের শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় কণাটির অবক্ষয়, যা থেকেই তৈরি  তৈরি হয়েছে এই বিশ্বজগত[9]

লেমেত্রি তার  আদিম কণা তত্ত্ব আর মহাবিশ্বের প্রসারণের ব্যাপারে মহা উৎসাহী হয়ে উঠলেলেও তার উৎসাহের বেলুন কিন্তু রাতারাতি চুপসে গেল।  আর চুপসে দিয়েছিলেন আইনস্টাইন স্বয়ং।  আইনস্টাইনের মাথায় তখন ‘স্থিতিশীল মহাবিশ্বের’ ভুত। তার নিজের সমীকরণেই মহাবিশ্বের প্রসারণের ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকলেও  মহাজাগতিক ধ্রুবক ঢুকিয়ে সেটাকে স্থিতিশীল রূপ দিয়ে রেখেছেন তিনি। ফ্রিডম্যান কিংবা লেমেত্রি, যারাই  মহাজাগতিক ধ্রুবকের বাইরে গিয়ে সমাধান হাজির করছেন, তাদেরকে কান মলে দিয়ে বাতিল করে দিচ্ছেন। তাই ১৯২৭ সালে ব্রাসেলসের একটা সেমিনারে লেমিত্রি যখন তার মহাজাগতিক মডেল আইনস্টাইনের সামনে তুলে ধরলেন, আইনস্টাইন বিনা বাক্য ব্যয়ে বাতিল করে দিলেন এই বলে – ‘তোমার ক্যালকুলেশন ঠিকি আছে, কিন্তু তোমার ফিজিক্সটা তো বাপু জঘন্য’।

চিত্র: আইনস্টাইন এবং লেমিত্রি

কিন্তু আইনস্টাইনের ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। ১৯২৯ সালে হাবল যখন মাউন্ট উইলসন মানমন্দির থেকে সে সময়কার ১০০ ইঞ্চি ব্যাসের সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপের (হুকার প্রতিফলক) সাহায্যে প্রমাণ হাজির করলেন যে মহাবিশ্ব আসলে প্রসারিত হচ্ছে,  তখন কিন্তু আইনস্টাইনই ভুল প্রমাণিত হলেন, আর লেমেত্রি হলেন সঠিক।

লেমেত্রি নিঃসন্দেহে খুশি হয়েছিলেন। নিজের তত্ত্বের স্বপক্ষে প্রমাণ পেলে কার না খুশি লাগে। কিন্তু লেমেত্রি যত না খুশি হলেন, ধর্মের চিরন্তন ধ্বজাধারীরা মনে হয় খুশি হলেন তার চেয়েও ঢের বেশি। তারা বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ের সাথে এর মিল খুঁজতে শুরু করলেন, আর ‘বিগ ব্যাং’ কিংবা আদি কণাকে হাজির করলেন  ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে।  যেমন ১৯৫১ সালে  পোপ (Pope Pius XII) বলেছিলেন –
‘আজকে বিজ্ঞান শতাব্দী পাড়ি দিয়ে একটি জায়গায় পৌঁছেছে যখন সেই আদিম ফিয়াট লাক্স (লেট দেয়ার বি লাইট)কে অবলোকন করার মত পরিস্থিতি এসেছে – যে আদিম অবস্থা থেকে  আলো এবং শক্তির বিকিরণ ঘটেছে, আর উৎক্ষিপ্ত কণাগুলো দ্বিখণ্ডিত আর চূর্ণ হয়ে লক্ষ কোটি ছায়াপথে পরিণত হয়েছে।  কাজেই সুদৃঢ় বৈজ্ঞানিক কাঠামো থেকে পাওয়া ফলাফলের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত যে, এই মহাবিশ্বের শুরু  হয়েছিল সৃষ্টিকর্তার হাতে। যদি সৃষ্টির শুরু থাকে, তবে অবশ্যই এই সৃষ্টির একজন স্রষ্টাও রয়েছে, আর সেই স্রষ্টাই হলেন ঈশ্বর’।

লেমেত্রি যেহেতু ধর্মযাজক ছিলেন, ছিলেন খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী একজন বিজ্ঞানী, সেহেতু কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে পোপের এই উক্তিতে লেমেত্রি যার পর নাই খুশি হয়ে বগল বাজাবেন।  তা হয়নি। লেমেত্রি ধার্মিক হলেও তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনিষ্ঠ এক মানুষ। আদিম কণার ধারনা যেটাকে আধুনিক বিগ ব্যাং এর সার্থক প্রতিভাস বলে মনে করা হয়, সেটা তিনি পেয়েছিলেন নিগূঢ় গণিত আর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োগে, কোন ধর্মীয় ঐশী মন্ত্রে নয়। তিনি সেটা সোজাসুজি বলতেনও – ‘কোন ধর্মীয় চেতনা আমাকে মহাজাগতিক মডেল নির্মাণে কখনোই অনুপ্রাণিত করেনি’।  তিনি কূপমণ্ডূক ধর্মবাদীদের মত বাইবেলের আয়াতে বিজ্ঞান খোঁজা কিংবা বিজ্ঞান আর ধর্মের গোঁজামিল দেয়াকে  সবসময়ই অপছন্দ করতেন।  তাই পোপ যখন বাইবেলকে ঐশী-গ্রন্থ বানাতে বিগব্যাংকে সাক্ষীগোপাল হিসেবে হাজির করলেন, তখন তিনি এর জবাবে বললেন, ‘আমি যতদূর দেখছি, এই তত্ত্ব অধিপদার্থবিদ্যা আর ধর্মের চৌহদ্দির বাইরের জিনিস’।  শুধু তাই নয় পোপ যেন ভবিষ্যতে এ ধরণের ‘ছেলেমানুষি’ আর না করেন, সেজন্য তিনি ভ্যাটিকান মানমন্দিরের পরিচালক ড্যানিয়েল ও’কনেলের সাথে দেখা করলেন। ভবিষ্যতে পোপ যেন মহাজাগতিক ব্যাপারে তার লম্বা নাকটা আর না গলান – ব্যাপারটা দেখতে পরিচালক মশাইকে অনুরোধ করে আসেন লেমিত্রি।

পরবর্তী ইতিহাস থেকে দেখা যায়, পোপ কিন্তু লেমেত্রির অনুরোধ ঠিকই রেখেছিলেন। বিগ ব্যাং এর ব্যাপারে তিনি আর কখনোই কোন অভিমত দেননি, করেননি ‘আম গাছে নিমের সন্ধান’

[10]।  আজকের দিনে জাকির নায়েক আর হারুন ইয়াহিয়ার অনুসারীরা যারা সুযোগ পেলেই তাদের শতাব্দী-প্রাচীন  ‘বিজ্ঞানময় ধর্মগ্রন্থ’ গুলোর মধ্যকার নানা আয়াতের সাথে বিগ ব্যাং এর মিল খুঁজে পান, তারা ধর্মযাজক লেমেত্রির এই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে পারেন

[11]


প্রমাণ মিললো বিগ ব্যাং এর
গ্যামোর সেই বিখ্যাত আলফা-বিটা-গামা পেপারের কাহিনিতে আরেকবার ফিরে যাওয়া যাক। গ্যামো আর আলফার বুঝেছিলেন, মহাবিস্ফোরণের পর থেকে শুরু করে তিন লক্ষ আশি হাজার বছর পর্যন্ত মহাবিশ্ব অস্বচ্ছ গোলকের মত ছিল অনেকটা। প্লাজমা অবস্থায় অণুরা জোড় বাধতে পারেনি। প্রায় চার লক্ষ বছর পরে তাপমাত্রা খানিকটা কমে তিন হাজার ডিগ্রি কেলভিনে নেমে আসল। ঐ সময়টার পরই কেবল স্থায়ী অণু গঠিত হবার মত পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছে।  এই সময়টাকে বলে রিকম্বিনেশন বা পুনর্মিলনের যুগ। এ সময়ই মহাবিশ্ব ক্রমশঃ স্বচ্ছ হয়ে আসে। আর আলোক কণা প্লাজমার খাঁচায় আটকে না থেকে পাড়ি দিতে শুরু করে অন্তবিহীন পথ। গ্যামো, আলফার আর আলফারের আরেক সঙ্গী হারমান তাদের গবেষণায়  দেখিয়েছিলেন, বিগ ব্যাং যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সেই আলোর অপভ্রংশ  আমাদের এখন খুঁজে পাবার কথা। সেটাই হবে বিগ ব্যাং এর ফসিল, যেটার জন্য হয়েল আর গোল্ডেরা উৎসুক ছিলেন, আর ওটার অনুপস্থিতির সুযোগে মহাবিস্ফোরণের সমর্থকদের দেদারসে ব্যাঙ্গ করেছেন । গ্যামোরা জানতেন, বিগ ব্যাং এর পর থেকে মহাবিশ্ব হাজার গুণ  প্রসারিত হয়েছে। তাই যে আলোক তরঙ্গ দেখবার প্রয়াস নেয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটা আজকের দিনে হবে মোটামুটি ১ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের কাছাকাছি কোন তরঙ্গ।    অর্থাৎ, তড়িচ্চুম্বকীয় পরিসীমায় যাকে সনাক্ত করা যাবে বেতার তরঙ্গ হিসেবে। আর এই বিকিরণের তাপমাত্রা হবে পাঁচ ডিগ্রি কেলভিনের মত।

মুশকিলটা হল পেপারটা প্রকাশিত হবার কিছুদিন পরেই এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কথা ভুলেই গিয়েছিল সবাই। আসলে গ্যামোর সময়ে মহাবিশ্বের প্রান্তিক বিষয় নিয়ে গবেষণাগুলোকে পদার্থবিজ্ঞানের মূল ধারা হিসেবে না দেখে দেখা হত পাগলাটে বিজ্ঞানীদের কল্পনাবিলাস হিসেবে। আরেকটা মূল কারণ অনেকে মনে করেন জর্জ গ্যামোর স্বভাবসিদ্ধ ভাঁড়ামি  আর রঙ্গপ্রিয়তা

[12]। আলফা-বিটা-গামা নামের পেপার বানানোর জন্য বিথের নাম তাকে না জানিয়েই লেখক তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন গ্যামো, আমরা সেটা আগেই জেনেছি। এ ধরণের অনেক কিছুই গ্যামো করতেন, যার কারণে গ্যামোকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন না তার সহকর্মীরা কিংবা অন্যান্য রাশভারী গবেষকেরা। গ্যামো একবার গণনা করে দেখালেন ঈশ্বর মশাই নাকি পৃথিবী থেকে ৯.৫ আলোকবর্ষ দূরে থাকেন। গণনার হিসেবটা এসেছিল ১৯০৪ সালে জাপান-রাশিয়া যুদ্ধের সময়, রাশিয়ার কিছু চার্চ নাকি যুদ্ধের ভয়াবহতা কমানোর জন্য বিশেষ গণপ্রার্থনার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সে প্রার্থনায় তাৎক্ষণিক কোন ফল না হলেও বেশ ক’বছর পর – ১৯২৩ সালের দিকে  ক্যান্টো ভূমিকম্পে জাপানের বিরাট ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল।  এ থেকে রসিকরাজ গ্যামো সিদ্ধান্তে আসেন, ঈশ্বরের অভিশাপ আলোর বেগে এসে পৌঁছাতে যে সময় লেগেছে তাতে করে পাওয়া যায় ঈশ্বর থাকেন পৃথিবী থেকে ৯.৫ আলোকবর্ষ দূরে! তিনি একটা সময় বিজ্ঞানী হয়েলকে নিয়ে বাইবেলের জেনেসিসের আদলে নিজস্ব এক নতুন জেনেসিসও লিখেছিলেন।  এর পাশাপাশি ছিল তার শিশু কিশোরদের জন্য লেখা মজাদার ‘মিস্টার টম্পকিন্স’ সিরিজ।  বিজ্ঞানের ফ্যান্টাসি মিশিয়ে নানা ধরণের গালগপ্প বানাতেন গ্যামো। এমনি একটা বইয়ে (মিস্টার টম্পকিন্স ইন ওয়াণ্ডারল্যনাড) তিনি এমন একটা রাজ্যের কল্পনা করলেন যেখানে আলোর গতি প্রতি ঘণ্টায় মাত্র কয়েক কিলোমিটার। ফলে সেই রাজ্যের সাইকেল  আরোহীরা সাইকেল চালাতে চালাতেই সময়ের শ্লথতা কিংবা দৈর্ঘ্যের সংকোচনের মত আপেক্ষিকতার প্রভাবগুলো চোখের সামনে দেখতে আর অনুভব করতে পারেন।  বিজ্ঞানের গল্পপ্রিয় শিশু কিশোর আর কল্পনাবিলাসী পাঠকেরা এগুলোতে নির্মল আনন্দ পেলেও গ্যামোর প্রতিপক্ষদের  কাছে এগুলো ছিল স্রেফ ছেলেমানুষি, আর তুচ্ছ।  তার ছাত্র আলফারের সমস্যা হয়েছিল আরো বেশি।  গ্যামোর  তদারকিতে পিএইচডি করায় অনেকেই আড়ালে আবডালে বলতেন, ‘জোকারের আণ্ডারে’ পিএইচডি করছেন আলফার। যদিও মহাজাগতিক বিকিরণের মূল গণনাগুলো করেছিলেন আলফারই।

অবশ্য তাদের গবেষণাকে ভুলে যাবার পেছনে গ্যামোর স্বভাবজাত তারল্যই একমাত্র কারণ ছিল না। গ্যামো নিজেও একটা সময় পদার্থবিজ্ঞানের বিশেষতঃ মহাবিশ্বের প্রান্তিক গবেষণা বাদ দিয়ে রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানে উৎসাহী হয়ে পড়েন, এবং ডিএনএ র রহস্যভেদ করা নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেন। আলফারও একাডেমিয়া ছেড়ে দিয়ে আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি জেনেরাল ইলেকট্রিকে (GE) গবেষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।  এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলো বিগ ব্যাং নিয়ে গ্যামোর গবেষণা, এক সময় পড়ল বিস্মৃতির ধুলোর পুরু স্তর।  ‘আউট অব সাইট, আউট অব মাইণ্ড’ বলে কথা!

এর পরের দশ বছর এভাবেই চলেছিল। এর মধ্যে ১৯৬০ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ রবার্ট ডিকি এবং জিম পিবলস স্বাধীনভাবে গবেষণা করে সিদ্ধান্তে আসেন যে বিগ ব্যাং এর প্রমাণ যদি কিছু থেকে থাকে তা থাকবে সেই  মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের মধ্যেই। তারাও গ্যামোর কাছকাছিই ফলাফল পেয়েছিলেন। তাদের হিসেব ছিল, বিকিরণের তাপমাত্রা হবে ১০ ডিগ্রী কেলভিন বা তার নীচে, আর বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কয়েক সেন্টিমিটার। তারা গ্যামো আর তার দলের মতোই একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করার চিন্তা করছিলেন এ নিয়ে।  কিন্তু গবেষকদের গবেষণাপত্রে যাই থাকুক না কেন, বাস্তবে এর খোঁজ তখনো পাওয়া যায়নি।

আসলে মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের খোঁজ পাওয়াটা একটা সৌভাগ্যপ্রসূত ঘটনাই বলতে হবে। ১৯৬৫ সালের দিকে আমেরিকার নিউ জার্সির বিখ্যাত বেল ল্যাবে আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন বেতার যোগাযোগের মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ নিয়ে কাজ করছিলেন। এমন নয় যে কোন তরঙ্গ ফরঙ্গ খোঁজার মত কোন কিছু তাদের মাথায় ছিল। তাদের লক্ষ্য আসলে ছিল উপগ্রহ যোগাযোগব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ করা। বেল ল্যাবের অনতিদূরে ক্রেফর্ড হিল বলে একটা জায়গায়  ৬ মিটার (প্রায় ২০ ফুট)  লম্বা একটা ‘হর্ন এন্টেনা’ পড়ে ছিল। এই একসময় বেল ল্যাবের ‘ইকো প্রজেক্ট’ বলে একটা প্রকল্পে এটা ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য নানা কারণে সেই প্রকল্প থেকে যন্ত্রটাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তারপর থেকে ওটা ওভাবেই পড়ে ছিল। পরিত্যক্ত এই এন্টেনাকে রেডিও টেলিস্কোপের মতো কোন কিছুতে স্থানান্তরিত করা যায় কিনা, এ নিয়ে কাজ করতেই মূলতঃ উদ্যোগী হন পেনজিয়াস আর উইলসন। তারা বেল ল্যাব থেকে অনুমতি নিয়ে আসলেন যাতে এই এন্টেনা ব্যবহার করে তারা অন্তত কিছুদিন আকাশের দিকে তাক করে বেতার তরঙ্গ অনুসন্ধান করতে পারেন।

কিন্তু অনুসন্ধান করতে চাইলে কি হবে, আকাশের যেদিকেই এন্টেনা তাক করেন না কেন, তারা দেখেন এক অপ্রীতিকর আওয়াজ বা নয়েজ এসে সব ভজকট লাগিয়ে দিচ্ছে। এই নয়েজের মাত্রা এমনিতে খুবই কম, কিন্তু এই নয়েজ থেকে কোনভাবেই মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না যে!  এমন নয় যে এই আওয়াজ তাদের কাজে খুব বেশি সমস্যা করছিল।  সাধারণত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ ধরণের নয়েজকে  সিস্টেমের ভ্রান্তি ধরে নিয়ে মূল কাজে এগিয়ে যান, কিন্তু পেনজিয়াস আর উইলসন নাছোড়বান্দা হয়ে পড়েই রইলেন – তারা এই আওয়াজের উৎস খুঁজে বের করবেন বলে।

এ ধরণের ক্ষেত্রে নয়েজের উৎস এবং প্রকৃতি হয়ে থাকে দুই ধরণের।  এই নয়েজ আসতে পারে কোন বহির্জাগতিক উৎস থেকে, কিংবা হতে পারে কোন যন্ত্রের নিজস্ব ত্রুটির কারণে।  প্রথমে বহির্জাগতিক কোন উৎস ঝামেলা পাকাচ্ছে কিনা সেটা সন্ধান করলেন এই দুই বিজ্ঞানী। হর্ন এন্টেনার  কাছাকাছি অবস্থিত কোন বৃহৎ তড়িৎ-আবিষ্ট ল্যান্ডমার্ক কিংবা কোন  বৈদ্যুতিক যন্ত্রের কারণে  এই বৈদ্যুতিক সঙ্কেত তাদের এই হর্ন এন্টেনায় ধরা পড়ছে কিনা তার খোঁজ করলেন। ফলাফল সেই শূন্য। এমনকি একসময় আকাশ পর্যবেক্ষণ বাদ দিয়ে নিউইয়র্কের দিকেও তাদের টেলিস্কোপ তাক করলেন। সঙ্কেতের কোন তারতম্য হল না।  যেদিকেই যন্ত্র তাক করেন সেদিকেই তারা শুনতে পান সেই একই মৃদু  ‘হিস্‌ হিস্‌’ শব্দ।

ঝামেলাটা যন্ত্রের নিজস্ব ত্রুটির কারণে হচ্ছে কিনা সেটাও অনুসন্ধান করলেন তারা। তারা যন্ত্রের এমপ্লিফায়ার, স্পিকারগুলো খুঁটিয়ে দেখলেন, আর সবচেয়ে বেশি দেখলেন বৈদ্যুতিক বর্তনী এবং বর্তনীর সংযোগস্থানগুলো। কোন শিথিল বা নড়বড়ে বৈদ্যুতিক সংযোগ  সমস্যা সৃষ্টি করছে নাকি, সেটাও আগাপাশতলা পরীক্ষা করলেন বহুবার। এমনকি যে সংযোগগুলো প্রথম দৃষ্টিতে ভালই মনে হচ্ছিল, সেগুলোকেও তারা অ্যালুমিনিয়ামের টেপ দিয়ে মুড়লেন পুনর্বার।  সাবধানের তো মার নেই।

কিন্তু কোন কিছু করেই এই ‘গায়েবী আওয়াজ’ সরানো যাচ্ছিল না।  এমন সময় তাদের নজরে পড়ল তাদের সাধের এন্টেনায় কোত্থেকে একজোড়া কবুতর এসে বাসা বেঁধেছে। কে জানে অনেকদিন ধরেই হয়তো তারা সেখানে ঘাপটি মেরে ছিল।   পেনজিয়াস আর উইলসন ভাবলেন, যাক এইবার হতচ্ছাড়া সংকেতের  উৎস খুঁজে পাওয়া গেছে।  ২০ ফুট এন্টেনা বেয়ে উপরে উঠে গিয়ে কবুতরের বর্জ্য পরিষ্কার করলেন, কারণ তারা ভেবেছিলেন এন্টেনায় জমা হওয়া এই ‘White dielectric material’ গুলোই যত নষ্টের গোঁড়া। কিন্তু সেগুলো সাফসুতরো করেও লাভ হল না, এমনকি দুই দফা কবুতর তাড়িয়েও না।

প্রায় হাল ছেড়ে দেয়া অবস্থা যখন, তখনই পেনজিয়াস এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্নার্ড ব্রুকের কাছ থেকে একটা টেলিফোন কল পান।  ব্রুক তাকে বলেন যে তিনি প্রিন্সটনের দুই গবেষক – ডিকি আর পিবলসের একটা গবেষণাপত্রের ড্রাফট কপি পেয়েছেন, যেখানে তারা বিগ ব্যাং এর মডেলের ক্ষেত্রে বিস্ফোরণ পরবর্তী অণুতরঙ্গ দৈর্ঘ্যের একটা মাপজোক করেছেন। ব্রুকের কেন যেন মনে হচ্ছে ডিকি-পিবলসের গবেষণার  সাথে  পেনজিয়াস -উইলসনের এন্টেনায় ধরা পড়া আওয়াজের কোথাও একটা সম্পর্ক আছে। ব্রুক বললেন, ‘ইউ শুড প্রোবাবলি কল ডিকি অ্যাট প্রিন্সটন’

[13]

এর পরদিনই প্রিন্সটনে ফোন করলেন পেনজিয়াস, আর ফোন ধরলেন ডিকি। ডিকির সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই প্রথম বারের মত পেনজিয়াস বুঝতে পারলেন কী গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে ফেলেছেন তারা নিজেদের অজান্তেই। এন্টেনায় ধরা আওয়াজের সাথে নিউইয়র্কের দিকে এন্টেনা তাক করা, বর্তনীর শিথিল সংযোগ কিংবা কবুতরের বিষ্ঠা – কোন কিছুরই কোন সম্পর্ক নেই। তারা আসলে খুঁজে পেয়েছেন মহাবিস্ফোরণের প্রাচীনতম ফসিল। মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন যাকে বলে।  পশ্চাৎপট বিকিরণের তীব্রতা মেপে ডিকি-পিবলসদের গণনার কাছাকাছি ফলাফল পেয়েছেন তারা। পরম শূন্যের উপর ৩ ডিগ্রি। আর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পাচ্ছেন দুই মিলিমিটারের সামান্য কম।  পেনজিয়াসের এই সব কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন ডিকি । ফোন রেখে তার ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বৎসরা, পাঙ্গামারা সারা’  (‘বয়েস, উই হ্যাভ বিন স্কুপড’)।

চিত্র: পেনজিয়াস এবং উইলসন বেল ল্যাবের বিখ্যাত সেই হর্ন এন্টেনার সামনে

এর পরদিনই ডিকি তার সাথে আরো দু’জন পদার্থবিদকে নিয়ে প্রিন্সটন থেকে ৩০ মাইল গাড়ি চালিয়ে নিউজার্সির হোলম্যান টাউনশিপে পৌঁছালেন। সেখানেই বেল ল্যাবের রিসার্চ সেন্টার। সেখানে  পেনজিয়াস আর উইলসনের পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফলগুলো হাতে কলমে দেখে নিশ্চিত হলেন, হ্যাঁ যে সিগনাল তারা অ্যান্টেনায় পাচ্ছেন, সেটা  মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণই বটে।  তখনই দুই দল মিলে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতে মনস্থ করলেন  অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নালে। তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পর পেনজিয়াস আর উইলসনের এই আবিষ্কারটিকে বিজ্ঞানের জগতে অন্যতম সেরা আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃত হয় প্রায় সর্বত্রই। নাসার নভোচারী রবার্ট জ্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘পেনজিয়াস আর উইলসন আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিগত পাঁচশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা আবিষ্কারটি করছেন’। হার্ভার্ডের পদার্থবিদ এডওয়ার্ড পার্সেল ছিলেন আরো এককাঠি বাড়া। তিনি বলেছিলেন, ‘যে কোন কারো দেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এটি’।

এই মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বা সিএমবি আবিষ্কারের জন্য পেনজিয়াস ও উইলসন নোবেল পুরস্কার পান ১৯৭৮ সালে- গ্যামোর মৃত্যুর দশ বছর পরে। লেমিত্রিও মারা গিয়েছেন ততদিনে। মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার প্রদানের কোন রীতি নেই, থাকলে গ্যামোকে চোখ বন্ধ করে বোধ হয় তখন নির্বাচিত করা হত, যিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় বিগ-ব্যাং’র ধারণাকে বিজ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বোধ হয় কিছু বৈজ্ঞানিক অবদান সব সময় থেকে যাবে যা নোবেল প্রাইজের চেয়েও বেশি দামী আর গুরুত্বপূর্ণ।

বিগ ব্যাং এর ফসিল আনলো কোবে
পেনজিয়াস আর উইলসন  মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের হদিস দিলেও সেটা খুব নিখুঁত ছিল না। কারণ বিজ্ঞানীরা জানতেন, মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ বড় স্কেলে সুষম মনে হলেও ছোট স্কেলে কিছুটা হলেও ‘ফ্লাকচুয়েশন’ বা অস্থিতি বজায় থাকতে হবে। এই অস্থিতিটুকুই কাজ করবে ভবিষ্যৎ-গ্যালাক্সি তৈরির বীজ হিসেবে।
কিন্তু এই অস্থিতি ধরে ফেলা কোন সহজ ব্যাপার নয়। অনেক সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির দরকার। সত্তুরের দশকে যে সমস্ত যন্ত্রপাতি ছিল তা দিয়ে একশ ভাগের এক ভাগ মাত্রায় ফ্লাকচুয়েশন পরিমাপ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এতে কোন অস্থিতি ধরা পড়েনি। আবহমণ্ডলের মধ্যকার রশ্মিগুলো ঝামেলা করছে ভেবে  বেলুন ফেলুন উপরে পাঠিয়ে নানা পরীক্ষা করা হল, তাতেও কোন ভাল ফলাফল এলো না।

সাফল্য এলো অবশেষে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। বহু খরচাপাতি করে নাসা একটা  কৃত্রিম উপগ্রহ বানিয়েছিল কোবে (COBE) নামে ১৯৮৯ সালে। এই মহাজাগতিক বিকিরণ কব্জা করার লক্ষ্যেই বানানো হয়েছিল সেটা।  সেই কোবে আদিম সদ্যজাত মহাবিশ্বের এক দুর্লভ ছবি আমাদের কাছে এনে দিল – যার মধ্যে পাওয়া গেল অস্থিতির সুস্পষ্ট চিহ্ন। ব্যাপারটা চিন্তা করা যাক। আমাদের আজকের এই মহাবিশ্বের বয়স ১৪ শ কোটি বছরের বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আর এই কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা সিএমবির যে ছবিটা আমরা দেখি সেটা মহাবিশ্ব জন্মানোর মাত্র চার লক্ষ বছরের।  মানবিক স্কেলে চিন্তা করলে অনেকটা এরকমের শোনাবে – আমাদের মহাবিশ্বকে  যদি সত্তর বছরের বৃদ্ধ হিসেবে আমরা কল্পনা করি, তবে কোবের সংগৃহীত এই মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ বা সিএমবির ছবিটা মাত্র কয়েক ঘণ্টার সদ্যজাত শিশুর। আর সেই শিশুবেলাকার ছবির মধ্যেই রয়েছে নক্ষত্র তৈরি হবার সম্ভাবনাময় বীজ।

১৯৯২ সালে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সেমিনারে যখন এই ফলাফল প্রকাশ করা হল, আর সে সভায়  উপস্থিত ১৫০০ জন বিজ্ঞানীর সবাই যখন  হতবাক হয়ে দেখলেন কোবের মাইক্রো তরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের উপাত্ত ২ দশমিক ৭৩ ডিগ্রি কেলভিনের কৃষ্ণকায়া বিকিরণের তত্ত্বীয় রেখার সাথে প্রায় পুরোপুরি মিলে গেল, তখন মুহুর্মুহু করতালিতে ফেটে পড়ল পুরো সভাঘর।

চিত্র: কোবের পাঠানো মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত ২ দশমিক ৭৩ ডিগ্রি কেলভিনের কৃষ্ণকায়া বিকিরণের তত্ত্বীয় রেখার সাথে প্রায় পুরোপুরি মিলে গিয়েছিল (ছবির উৎস : স্টিফেন হকিং, ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল)।

প্রিন্সটনের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী অস্ট্রিকার মন্তব্য করলেন,
‘যখন পাথরের খাঁজে ফসিল পাওয়া যায় তখন আমাদের চোখে প্রজাতির উদ্ভবের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। কোবে আমাদের জন্য মহাবিশ্বের ফসিল নিয়ে এসেছে’।

কথাটা মিথ্যে নয়। এই সিএমবি সদ্যজাত মহাবিশ্বের ফসিলই তো। কিন্তু তারপরেও একটা ব্যাপার হল, কোবের পাঠানো ছবি খানিকটা হলেও ঝাপসা ছিল। আর কোবের সংবেদনশীলতা ছিল কেবল ৭ ডিগ্রি কোনের চেয়ে বড় ফ্লাকচুয়েশনগুলো কব্জা করার মতো পর্যায়ের। কিন্তু এর চেয়েও  সূক্ষ্ম ফ্লাকচুয়েশন ধরার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০০৩ সালে ডব্লিউ-ম্যাপ (WMAP) উপগ্রহের পাঠানো উপাত্তের জন্য।


চিত্র: পেনজিয়াস –উইলসন, কোবে এবং ডব্লিউ ম্যাপ থেকে পাওয়া মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ।

কোবে এবং ডব্লিউ ম্যাপের পাঠানো মহাজাগতিক বিকিরণের ফসিলই বিগ ব্যাং বনাম স্থিতি তত্ত্বের দ্বন্দ্বের যবনিকা ফেলে দেয়। মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে তত্ত্বের দ্বন্দ্বে বিগ ব্যাং বেরিয়ে আসে একমাত্র ‘সুপার পাওয়ার’ হিসেবে।

অতঃপর…
‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের গৌরবময় সাফল্য বিজ্ঞানীদের একেবারে সম্মোহিত করে রেখেছিলো বেশ অনেক দিন।  সবকিছুই সেই উত্তপ্ত মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে একসাথে সৃষ্টি হয়েছে, আর তার আগে কিছুই ছিলো না, এমন ভাবনা যেন বিজ্ঞানীরা অনেকটা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন কয়েক দশক ধরে।  মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে অনেকে আবার বিগ-ব্যাং তথা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের মধ্যে একেবারে ‘ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি’ পর্যন্ত দেখতে পেয়েছিলেন। এমনকি নিউজ উইকের মত ম্যাগাজিন ১৯৯৮ সালের ২০ এ নভেম্বর সম্পাদকীয় ছেপেছিলো এই বলে বিজ্ঞান নাকি ঈশ্বরকে পেয়ে গেছে!

চিত্র: (ক) স্ট্যান্ডার্ড বিগ-ব্যাং মডেল :  যেটি মনে করে অতি ঘন, উত্তপ্ত এক অদ্বৈতবিন্দুর মধ্যে দিয়ে আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে। (খ) ‘বিজ্ঞান ঈশ্বরকে পেয়ে গেছে’- দাবী করে নিউজ-উইকের একটি কুখ্যাত প্রচারণা।

তারপর যতদিন গেছে উত্তেজনা আর ‘সম্মোহনের ভাব’ ধীরে ধীরে থিতিয়ে এসেছে। একটা সময় পরে বিজ্ঞানীরা নিজেরাই দেখেছেন বিগ ব্যাং -এর প্রমিত মডেল আসলে সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে না।  এরও অনেক সমস্যা আছে। বিজ্ঞান লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী প্রায়ই তার লেখায় বলেন, ‘স্বর্গোদ্যানে ঘাসের নীচে সাপের অবস্থান যেমন রসভঙ্গ করে, মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং তত্ত্বও একইভাবে সর্বৈব সুন্দর নয়। এরও সমস্যা আছে।

[14]’   যেমন, বিজ্ঞানীরা আজকের মহাবিশ্বের প্রকৃতি অনুসন্ধান করে দেখেছেন প্রায় ১৪শ কোটি বছর আগে ঘটা মহা বিস্ফোরণ অনেক বড় স্কেলেও প্রচণ্ড সমসত্ত্ব ছিল। কিন্তু কেন যে ছিল এর কোন ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনি।  বলতে পারেনি এত বিশালকায় এই মহাবিশ্বের দুইপ্রান্তের  দুই অঞ্চলের তাপমাত্রা কিভাবে সমান হয়? এ সমস্যাটি দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীদের মাঝে পরিচিত ছিল ‘দিগন্ত সমস্যা’ হিসেবে।  দিগন্ত সমস্যার পাশাপাশি  ছিল মহাবিশ্বের ‘সামতলিক সমস্যা’।  ‘প্রমিত বিগ ব্যাং এর মডেল কখনোই বলতে পারেনি কেন আমাদের মহাবিশ্ব অতিমাত্রায় ফ্ল্যাট বা সমতল (১০২৮ সেন্টিমিটার স্কেলে)। এরকম সমতল মহাবিশ্ব তৈরি করতে গেলে মহাবিশ্বের মোট ঘনত্ব আর সন্ধি ঘনত্বের অনুপাত হতে হবে টায়ে টায়ে ১। মহাবিশ্বের উষালগ্নে কীভাবে এই ‘সূক্ষ্ম সমন্বয়ের’ মত ব্যাপার ঘটেছিল? জবাব পাওয়া যায়নি। এর উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ‘ম্যাগনেটিক মনো-পোল’ সমস্যা।  মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের প্রমিত মডেল বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় আধানযুক্ত অতি ভারী একক মেরুবিশিষ্ট কিছু কণিকার প্রাচুর্য থাকবার ভবিষ্যৎবাণী করেছিলো, যা আমরা কখনোই দেখতে পাই না।  এমনকি আমাদের মহাবিশ্ব বাড়তে বাড়তে কেন এতো বড় হল – এ সমস্যারও কোন সমাধান হাজির করতে পারেনি এ তত্ত্ব। স্ট্যান্ডার্ড বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী অতি ঘন, উত্তপ্ত এক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যদি আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম হয়ে থাকে, তবে গণনা করে দেখা গেছে  এটি খুব বেশী হলে মাত্র দশটি প্রাথমিক কণিকা তৈরি করার মত ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। আর তা দিয়ে একজন মুক্তমনা পাঠকেরও মাথা গুঁজবার ঠাঁই হবে না, তাদের একেক জনের দেহেই যে রয়েছে প্রায় ১০২৯ টি অমনতর প্রাথমিক কণিকা!তার চেয়েও বড় কথা হল, বিগব্যাংকে মহাবিশ্বের উৎপত্তির ‘আলাদীনের চেরাগ’ হিসেবে অনেকে দেখাতে চাইলে কি হবে  এটিকে আসলে উৎপত্তির সর্বশেষ তত্ত্ব বলা যায় না।  আদপে এটা বিস্ফোরণ বিষয়ক তত্ত্বই নয়।  এর মাধ্যমে একটি বিস্ফোরণের বেশ কিছু ফলাফল ব্যাখ্যা করা যায় বটে কিন্তু বিস্ফোরণের মূল প্রকৃতি সম্বন্ধে সে কিছুই বলতে পারে না। কি এই বিস্ফোরণ, এই বিস্ফোরণের আগে কি ছিল, কিংবা কেনই বা এই মহাবিস্ফোরণ ঘটেছিল, এ বিষয়ে এই মডেল একেবারেই নীরব।

আসলে এই নিঃসীম নীরবতা ভেঙ্গে উত্তর হাজির হওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল আশির দশকে অ্যালেন গুথ নামে এক বিজ্ঞানীর আগমনের জন্য; ‘স্ফীতিতত্ত্বের জনক’ হিসেবে পরিচিত এই প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর কাজের মাধ্যমেই এইসব কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর ক্রমশ আমরা জানতে পেরেছি।

তথ্যসূত্র –
[2] Lawrence M. Krauss, A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing, Free Press, 2012, p 17.
[3] George Gamow, My World Line : An Informal Autobiography, Viking Adult; 1970
[4] অভিজিৎ রায়, মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?,  মুক্তমনা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০০৮ দ্রঃ।  মুক্তমনা এবং সচলায়তন ব্লগে সে সময় (২০০৮) প্রকাশিত এ লেখায় স্ট্যালিনীয় জামানায় সাহিত্যিক এবং বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের উপর লাগাতার অত্যাচারের নমুনা পেশ করে বাম ঘরণার দেশীয় সৈনিকদের ভয়ঙ্কর তোপের মুখে পড়েছিলাম। যথারীতি ‘পুঁজিবাদের দালাল’ , ‘শোধনবাদী’ থেকে শুরু করে ‘ছাগল’ ‘পাগল’ সহ নানা উপাধি হজম করতে হয়েছিল।আমি দিন কয়েক পরে একটি প্রত্যুত্তর দিয়েছিলাম ‘মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?’ প্রবন্ধের সমালোচনার উত্তরে’ শিরোনামে।  অবশ্য তাতে খুব একটা লাভ হয়েছিল বলা যাবে না। এ লেখাটি এখনো অনেকের কাছে বাংলা ব্লগে মার্কসবাদ নিয়ে তর্ক বিতর্কের আদি অকৃত্রিম উৎস।
[5] অভিজিৎ রায়, লাইসেঙ্কোইজম, মুক্তমনা, নভেম্বর ০১, ২০০৮।
[6] স্টালিনীয় আমলে বিজ্ঞানীদের উপর লাগাতার অত্যাচার এবং বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞান প্রচারের সাথে পাঠকেরা আরো বিস্তৃতভাবে পরিচিত হতে চাইলে অনন্ত বিজয় দাশের লেখা ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব : লিসেঙ্কো অধ্যায়’ (শুদ্ধস্বর)বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
[7] জেনেটিক্সকে যেমন ‘পুঁজিবাদী বিজ্ঞান’ হিসেবে অভিহিত করে হটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, ঠিক তেমনি আবার একটা সময় বিগ ব্যাং এরও বিরুদ্ধাচরণ করা হয়েছিল কমিউনিস্ট রাশিয়ায়। বলা হয়েছিল বিগ ব্যাং এর ধারণা মার্ক্সিস্ট ভাবধারার সাথে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, ওটা ‘বুর্জোয়া বিজ্ঞান’। যে সমস্ত বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাং তত্ত্বের পক্ষে কথা বলতেন তাদের উপর নেমে এসেছিল রাস্ট্রীয় নির্যাতন। যেমন, ১৯৩৭ সালে নিকোলাই কোজারভ নামের এক বিজ্ঞানী ছাত্রদের মাঝে বিগ ব্যাং মডেল নিয়ে আলোচনা করায় তাকে ধরে শ্রমশিবিরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। অত্যাচার করা হয়েছিল ভসেভলদ ফ্রেডরিকস এবং মাতভেই ব্রনস্টেইন নের মত বিজ্ঞানীদের উপরেও, করণ তারা বিগ ব্যাং তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন।  গ্যামো রাশিয়া ছেড়ে পালানোর পর তাকে বিশ্বাসঘাতক ‘আমেরিকান মুরতাদ’ (Americanized apostate)  হিসেবে চিহ্নিত করে বিচারের প্রহসনও করা হয়েছিল।
[8] Alex Vilenkin, Many Worlds in One: The Search for Other Universes, Hill and Wang, 2007
[9] Lemaître later summarized his theory as thus:  “The primeval atom hypothesis is a cosmogenic hypothesis which pictures the present universe as the result of the radioactive disintegration of an atom”.
[10] ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান অনুসন্ধানের অপচেষ্টা নিয়ে আমি বহু আগে একটা লেখা লিখেছিলাম ‘বিজ্ঞানময় কিতাব’ নামে।  লেখাটি আরেকটু বিবর্ধিত আকারে অন্তর্ভুক্ত হয় রায়হান আবীরের সাথে যুগপৎভাবে লিখিত ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (শুদ্ধস্বর, ফেব্রুয়ারি, ২০১১) বইয়ে। সহব্লগার নাস্তিকের ধর্মকথাও এই বিষয় নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন ব্লগে। ধর্মে বিজ্ঞান খোঁজার প্রয়াসকে  তিনি অভিহিত করেছেন ‘আম গাছে নিমের সন্ধান’ হিসেবে। লেখাটি মুক্তমনার সংকলনগ্রন্থ ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ (চারদিক, ২০১২) এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
[11] এখানে উল্লেখ্য, মুসলিম বিশ্বের একমাত্র নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালামও লেমিত্রির মতোই বিগ ব্যাং তত্ত্বকে কোরআনের আয়াতের সাথে মিশাতে  বারণ করতেন।  তিনি বলতেন,
‘বিগব্যাং তত্ত্বের সাম্প্রতিক ভাষ্যটি বর্তমানে মহাবিশ্বের উৎপত্তির সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করছে। কিন্তু আগামীকাল যদি এর চাইতেও কোন ভাল ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তাহলে কি হবে?  তাহলে কি নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ধর্মগ্রন্থের আয়াত বদলে ফেলা হবে?’
[12] Simon Singh, Big Bang: The Origin of the Universe, HarperCollins; 2005
[13] Richard Panek, The 4 Percent Universe: Dark Matter, Dark Energy, and the Race to Discover the Rest of Reality, Houghton Mifflin Harcourt; 1ST edition , January 10, 2011
[14] এ এম হারুন-অর-রশীদ এবং ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, অপূর্ব এই মহাবিশ্ব, প্রথমা, ২০১১। অথবা, সৈয়দা লাম্‌মীম আহাদ এবং ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, সবার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা, তাম্রলিপি, ২০১২ দ্রষ্টব্য।


বিগ ব্যাং এর আগে কি ছিল? (শেষ পর্ব)

 

স্ফীতি তত্ত্বের আবির্ভাব
এই যে আমাদের চিরচেনা মহাবিশ্ব, এই যে আমাদের চারিদিকের প্রকৃতি – চাঁদ, তারা সূর্য, পৃথিবী, গাছপালা, পশুপাখি, মানুষজন – এই সব কিছু এলো কোথা থেকে? এই প্রশ্ন কেউ করলে কিছুদিন আগেও আমরা চোখ বুজে বলে দিতাম –  কোত্থেকে আবার, ‘বিগ ব্যাং’ থেকে – বাংলায় আমরা যাকে ‘মহাবিস্ফোরণ’ নামে ডাকি!  কিন্তু আশির দশকে ‘ইনফ্লেশন’ বা স্ফীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজের কথা জানার পর থেকে কিন্তু বিজ্ঞানীরা এরকম  উত্তর আর পছন্দ করছেন না। আসলে কোন কিছু ‘বিগ ব্যাং থেকে এসেছে’ বলা  মানে একটা শিশু হাসপাতালের ‘মাতৃসদন’ বা মেটারনিটিটি ওয়ার্ড থেকে এসেছে – বলার মতো শোনায় এখন

[1]। উত্তরটা হয়তো ভুল নয়, মাতৃসদন থেকেই শিশুদের কোলে করে বাসায় নিয়ে আসি আমরা, কিন্তু এই ধরণের উত্তর শিশুর জন্মের সত্যিকার প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি সম্বন্ধে কিন্তু কোন ধারণাই দিতে পারে না।
বিগ ব্যাং এর ব্যাপারটিও তেমনি। মহাবিশ্বের উদ্ভব বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ থেকে হয়েছে – এভাবে বললে হয়তো বলাই যায়, কিন্তু বিস্ফোরণের প্রকৃতি সম্বন্ধে আমরা  কোন ধারণাই পাই না এ থেকে। অ্যালেন গুথের ভাষায়, ‘কী এই বিস্ফোরণ, কীভাবে এই বিস্ফোরণ,  আর কেনই বা এই বিস্ফোরণ – এই প্রশ্নগুলোর কোন সন্তোষজনক উত্তর বিগ-ব্যাং তত্ত্ব দিতে পারে না’
[2]
আর বিগ ব্যাং-এর  এর আগে  কি ছিল – এই প্রশ্ন করলে তো কথাই নেই। এ ধরণের প্রশ্ন কিছুদিন আগেও বিজ্ঞানে দেখা হত ‘ব্লাসফেমি’ হিসেবে।  কেউ এ ধরণের প্রশ্ন করলেই বিজ্ঞানীরা বলতেন, আরে – এ ধরণের প্রশ্ন অনেকটা ‘উত্তর মেরুর উত্তরে কি আছে?’ বলার মত শোনায়।  এভাবে ভাবার কারণ যে নেই তা নয়। আমরা আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বে যে স্থান কালের ধারণার সাথে পরিচিত, সেই স্থান ও কালের ধারণাও আসলে এসেছে এই মহাবিস্ফোরণ ঘটবার পর-মুহূর্ত থেকেই। কাজেই মহাবিস্ফোরণ ঘটার মুহূর্তে কিংবা পূর্বে কি ছিল- এ প্রশ্ন বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একেবারেই অর্থহীন।
কিন্তু অর্থহীন বলে সবাই এড়িয়ে গেলেও  ‘ক্যারা মাথা’র কেউ কেউ থাকেন দুনিয়ায়, যারা ‘মান্য করে ধন্য’ হবার নন। তারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন না। নাফরমানি চিন্তা করতেই থাকেন অনবরত। এমনি একজন নাফরমান বিজ্ঞানী অ্যালেন গুথ।
চিত্র: অ্যালেন গুথ: স্ফীতি তত্ত্বের জনক
গুথের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালে।  না –  হয়েল,  গ্যামো, ওয়েইনবার্গ, হকিংদের মত প্রথম থেকেই একাডেমিয়ার সাথে যুক্ত কোন বিজ্ঞানী ছিলেন না গুথ। তার পরিচিতি  বলার মত কিছু ছিল না, অন্তত আশির দশকের আগ পর্যন্ত তো বটেই। ১৯৭৯ সালে ৩২ বছরের এই বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ কাজ করছিলেন স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার এক্সিলেটরে, একজন ছাপোষা বিজ্ঞানের কর্মী হিসেবেই। চাকরি থাকা আর না থাকার মাঝামাঝি জায়গাতেও চলে গিয়েছিলেন কিছুদিন।  হয়তো বা বিস্তৃতির আড়ালেই হারিয়ে যেতেন তিনি, কিন্তু সে অবস্থা থেকেই এমন এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করলেন, যে গোটা মহাবিশ্বের ছবিটাই গেল পালটে। মহাবিশ্বের পাশাপাশি অবশ্য তার জীবনও পাল্টালো বলাই বাহুল্য। অভূতপূর্ব এই আবিষ্কার মূলধারার বিজ্ঞানীদের মধ্যে এতোটাই সাড়া ফেলে দিল যে, এক মাসের মধ্যে তিনি আমেরিকার সাত সাতটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব পেলেন।  এর মধ্যে থেকে তিনি গ্রহণ করলেন তার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটির অফার, এবং এখনো সেখানেই অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।  তার সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটিকে এখন ইনফ্লেশন বা স্ফীতি-তত্ত্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়।  মহাবিশ্বের উদ্ভব বিষয়ক আধুনিক যে কোন বইয়ে  কিংবা  যে কোন পেপারে গুথের কাজের উল্লেখ না থাকলেই নয়।   প্রমিত মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বকে এর সাথে জুড়ে দিয়ে তত্ত্বটিকে  এখন ‘ইনফ্লেশনারি বিগ ব্যাং মডেল’ হিসেবেও ডাকা হয় ।

মহাকর্ষের বিকর্ষণ
গুথের আবিষ্কারের মূল বিষয়টি তাহলে ঠিক কী ছিল?  মুল ধারণাটা আসলে খুব একটা কঠিন কিছু নয়। মহাকর্ষ ব্যাপারটিকে যে আমরা এতদিন আকর্ষণমূলক বল বলে ভবে এসেছি, গুথ বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই মহাকর্ষ আসলে সুযোগ আর পরিস্থিতি বিচারে কখনো কখনো বিকর্ষণমূলক হয়ে উঠতে পারে। এবং সেটা হয়ও। আইনস্টাইনের ঝানু মাথাতেও একসময় এটা এসেছিল। তিনি তার আপেক্ষিকতা থেকে পাওয়া ক্ষেত্র-সমীকরণে একটা ‘মহাজাগতিক ধ্রুবক’ যোগ করেছিলেন, পরে আবার তা ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’ ভেবে বাদও দিয়েছিলেন। আইনস্টাইনের ভুলটাকেই  যেন সঠিক প্রমাণিত করে নতুনভাবে ফিরিয়ে আনলেন অ্যালেন গুথ, তবে একটু অন্যভাবে।
দেখা যাক কিভাবে।  আমরা বস্তু কণাদের মধ্যে আকর্ষণের কথা বলি  হরহামেশাই। ছোটবেলায় শেখা নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র থেকে আমরা জানি,  এই আকর্ষণ বল বস্তুকণাদের ভরের উপর এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব বাজারে আসার পর থেকে আমরা বুঝলাম, ব্যাপারটা আসলে পুরোপুরি ঠিক নয়। মাধ্যাকর্ষণ বল কেবল বস্তুর ভরের উপরেই নির্ভর করে না, নির্ভর করে বস্তু কণার মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তির উপরও। বস্তুর  মধ্যস্থিত অণু পরমাণুগুলো কি হারে ছুটোছুটি করছে সেটা আমাদের  কাছে শক্তির একটা পরিমাপ হাজির করে।  এই ছুটোছুটি  আবার নির্ভর করে বস্তুর তাপমাত্রার উপর।  তাপমাত্রা বাড়লে অণুদের ছুটোছুটি বাড়ে, সেই সাথে বাড়ে ওজন। তাই, টেবিলে পড়ে থাকা একদিনের বাসি ডালপুরি আর তাওয়ায় ভাজা গরম গরম ডালপুরির ওজন এক হবে না। গরম ডালপুরির ওজন কিছুটা হলেও বেশি পাওয়া যাবে, এবং পাওয়া যায়ও, কারণ, গরম ডালপুরিতে বাড়তি তাপমাত্রার কারণে এর ভিতরকার অণুগুলো বেশি হারে ছুটাছুটি করে, ঠাণ্ডা ডালপুরির তুলনায়। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বললে আমরা বলব, গরম ডালপুরিতে গতিশক্তি বেশী থাকে।  ব্যাপারটা আমি ডালপুরির জন্য বললেও যে কোন পদার্থের জন্যই সত্য। পদার্থের এই গতিশক্তি যে  বস্তুর ওজন বাড়াতে পারে, আর সর্বোপরি আকর্ষণ বলের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিউটনের সময় জানা ছিল না।  আরেকটি ব্যাপারও বোধ হয় নিউটন জানতেন না। বস্তুকণার মধ্যস্থিত চাপও বস্তুকণাদের শক্তি বাড়িয়ে দিতে পারে, আর সেটা ফেলতে পারে আকর্ষণ বলের উপর নানামুখী প্রভাব।  একটা স্প্রিং-ওয়ালা খেলনা এমনিতে পাল্লায় রেখে ওজন করলে, আর তারপর  স্প্রিং এর চাবি জোরসে পেঁচিয়ে ওজন করলে ওজনে সামান্য হের ফের পাওয়া যাবেই। এর কারণ হচ্ছে ‘খোলা স্প্রিং’ এর চেয়ে ‘প্যাঁচানো স্প্রিং’ এ শক্তি বেশি লুকিয়ে থাকে।  ব্যাপারটা স্প্রিং এর জন্য যেমন সত্য, তেমনি সত্য চিপসের ঠোঙা কিংবা কোকাকোলার বোতলের ক্ষেত্রেও।  কোকের বোতলে বাতাসকে উঁচু চাপে আটকে রাখা হয় । সেরকম একটা বন্ধ বোতল ওজন করলে আর বোতলের ছিপি খুলে ওজন করলে দেখা যাবে ওজন খানিকটা কম পাওয়া যাচ্ছে।
গুথ ধারনা করতে পেরেছিলেন যে, চাপ যেমন  ওজন বাড়িয়ে বস্তুকে টেনে ধরতে পারে, ঠিক তেমনি সেটা কখনো কখনো বস্তুকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলেও দিতে পারে দূরে। কখন? যখন চাপটা ধনাত্মক না হয়ে হয়ে উঠে ঋণাত্মক।  এই ঋণাত্মক চাপের ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ঋণাত্মক চাপের উদ্ভব ঠিক কিভাবে হয় এটা বোঝা জরুরী। তবে এই ব্যাপারটিকে পরিচিত জাগতিক উপমা দিয়ে বোঝানো একটু কষ্টকর। একটা দুর্বল চেষ্টা আমি করেছিলাম আমার ‘আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী’ বইটিতে গিটারের উপমা হাজির করে

[3]। এখানেও সেটা দেয়া যাক।  যারা গিটার বাজান তারা জানেন, গিটার বাজানো শেষ হলে গিটারটা ঝুলিয়ে রাখার সময় তারগুলোকে খুলে ঢিলে করে দিতে হয়।  নয়তো তারগুলো সারা রাত ধরে টান টান হয়ে থেকে গিটারের বাহুকে ভেতরের দিকে বাঁকিয়ে দেবে। এখানে গিটারের সাপেক্ষে তারের চাপ ঋণাত্মক বলে চিন্তা করা যেতে পারে। ঠিক একভাবে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে চিন্তা করলে – ঋণাত্মক চাপযুক্ত কোন বস্তু বাইরের দিকে চাপ দেবে না, ভিতরের দিকে কুঁকড়ে যেতে চাইবে, অর্থাৎ এটি অনুভব করবে অন্তর্চাপ। আর এই চাপের ফলে বস্তুটির মহাকর্ষীয় শক্তি হবে ঋণাত্মক, অর্থাৎ বিকর্ষণধর্মী। বিজ্ঞানী ব্রায়ান গ্রিন তার ‘দ্য ফেব্রিক অব কসমস’ বইয়ের ‘Deconstructing the Bang’  অধ্যায়ে লিখেছেন

[4],
‘ধনাত্মক চাপ স্বাভাবিকভাবেই  মহাকর্ষের উপর ধনাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।  কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে চাপ হয়ে উঠতে পারে ঋণাত্মক, ফলে সেই অংশে বহির্চাপের বদলে অনুভূত হবে অন্তর্চাপ। যদিও ব্যাপারটা মোটেই অদ্ভুতুড়ে বলে মনে হচ্ছে না, কিন্তু আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সাপেক্ষে ব্যাপারটা হয়ে উঠে রীতিমত অসাধারণ। যেখানে ধনাত্মক চাপ বস্তুকণার উপর সাধারণ এবং পরিচিত আকর্ষণমূলক মহাকর্ষের সৃষ্টি করে, ঋণাত্মক চাপ সেখানে তৈরি করে বিকর্ষণমূলক মহাকর্ষের। ’
আর বলা বাহুল্য, এই বিকর্ষণধর্মী শক্তিটাই মহাবিশ্বকে এমন তীব্রভাবে প্রসারিত হবার পথ তৈরি করে দিয়েছিল।  কতটা তীব্র বোধ হয় কল্পনাতেও আসবে না। গুথ গণনা করে দেখলেন,  চোখের পলক ফেলতে  আমাদের যে সময় লাগে তার চেয়েও ঢের কম সময়ে – খুব সঠিকভাবে বললে মাত্র ১০-৩৫ সেকেন্ডের মধ্যে মহাবিশ্ব বেড়ে গিয়েছিল অন্তত  ১০২৬ গুণিতক হারে

[5]।  আর এই ব্যাপারটাই সমাধান করে দিয়েছিল যাবতীয় সমস্যার, যেগুলো সমাধান করতে বিগ ব্যাং তত্ত্বের অনুসারীরা রীতিমত হিমসিম খাচ্ছিলেন এতদিন ধরে।

কিন্তু কথা হচ্ছে  কোথায় আর কীভাবে তৈরি হয়  এই অদ্ভুতুড়ে বিকর্ষণমূলক মহাকর্ষের? মহাবিশ্বের শুরুতে তো আর গিটারের তার (উপরের উদাহরণ দ্রঃ) হাজির ছিল না মহাবিশ্বের বাহুকে বাঁকানোর জন্য। তাহলে? আসলে এর জন্য গুথকে চিন্তা করতে হয়েছিল এক ধরণের অস্থায়ী ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতার, যার নাম দিয়েছিলেন  তিনি ‘ফল্‌স্‌ ভ্যাকুয়াম’ ।

ফল্‌স্‌ ভ্যাকুয়াম
গুথের দেওয়া ফলস ভ্যাকুয়ামের ব্যাপারটা সাধারণ পাঠকদের কাছে একটু জটিল মনে হতে পারে। কিন্তু এখানে আমরা একটু সহজ উপমা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করব – সেটা আমাদের চেনা জানা নদীর গতিপথ থেকে।  নদীগুলো সাধারনতঃ পাহাড় পর্বত থেকে সৃষ্টি হয়ে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে সমুদ্রে  গিয়ে পড়ে – এ আমরা সবাই জানি। আমাদের পদ্মা নদীর কথাই ধরি। এই নদী হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রথমে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যায়। তার পরে দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় এর নাম হয় গঙ্গা। এই গঙ্গা নামে ভারতের উত্তরপ্রদেশ ও বিহার রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে টয়ে এক সময় বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারন করে,মুর্শিদাবাদ জেলায়। তারপর সেটা চাঁদপুরের কাছে এসে মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। দেশের অন্যান্য নদীগুলোও তাই। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র – এসেছে কৈলাস শৃঙ্গের মানস সরোবর থেকে, মেঘনা- এসেছে আসামের লুসাই পাহাড় থেকে তারপর নানা পথ পেরিয়ে কোন না কোন সাগরে গিয়ে পড়ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে কেন নদীরা শেষ পর্যন্ত সাগরের বুকে গিয়ে আশ্রয় খোঁজে? কারণ, বিজ্ঞানীরা বলেন – যে যাই করুক না কেন, দিন শেষে সবাই আসলে  ‘লোয়ার এনার্জি স্টেটে’ থাকতে চায়। এই যে আমরা সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটনি করে এসে রাতে বিছানায় গা এলিয়ে দেই – এই জন্যেই। কারণ শুয়ে থাকার মাধ্যমেই আমরা আমাদের দেহের সবচেয়ে নিচু শক্তিস্তরে আমাদের অবস্থান নিশ্চিত করি। নদীরাও তাই চায়। পাহাড় পর্বত বেয়ে সাড়া জীবন চলতে চাওয়ার চেয়ে সাগরের বুকে থাকাই তার কাছে পছন্দের, কেননা সেখানে সে সবচেয়ে কম শক্তিস্তরের জায়গাটা খুঁজে নিতে পারে। ধরা যাক, এই সাগরের এই সবচেয়ে কম শক্তিস্তরের জায়গাটাকে আমরা  নাম দিলাম প্রকৃত শূন্যতা বা  ‘ট্রু ভ্যাকুয়াম’। এখন কথা হচ্ছে, সবসময়ই যে নদীরা সাগরে তথা প্রকৃত ভ্যাকুয়ামের মধ্যে গিয়ে পড়তে পারে তা কিন্তু নয়। ধরা যাক, ফারাক্কা বাঁধের মত কোন বাঁধ কোন একটা নদীর বুকে আছে। ফলে নদীর পানি সাগর পর্যন্ত না পৌঁছে বাঁধেই আটকে থাকবে। বাঁধের উদাহরণের মতই আমাদের বিছানায় ঘুমানোর উদাহরণেও এ ধরণের অস্থায়ী অবস্থা তৈরি করতে পারি।  পুরোপুরি বিছানায় গা এলিয়ে দেবার বদলে চেয়ারে কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে নিতে পারি। আমাদের এই বিছানার বদলে চেয়ারে মানে খানিকটা উঁচু শক্তিস্তরে বসে ঝিমানো, কিংবা নদী একদম নীচে সাগরে না এসে একটু উঁচুতে বাঁধ পর্যন্ত গিয়ে আটকে থাকা – এই ধরণের অবস্থাকে বলা যেতে পারে ‘ফল্‌স ভ্যাকুয়াম’।
এই ফলস ভ্যাকুয়াম আসলে বস্তুর অস্থায়ী দশা। গুথ তার বইয়ে লিখেছেন

[6],
‘ফলস ভ্যাকুয়াম আসলে অস্থায়ী ভ্যাকুয়াম হিসেবে কাজ করে।  কাজেই ফলস মানে এখানে আসলে সাময়িক বা অস্থায়ী’।
নদীতে বাঁধ দিয়ে মানে সাময়িক সময়ের জন্য পানি আটকে দিয়ে আমরা তৈরি করতে পারি এক ধরণের ফলস ভ্যাকুয়ামের মত ক্ষেত্র। বাঁধ যত শক্ত পোক্তই হোক না কেন, একে কেউ সাগরের মত প্রকৃত ভ্যাকুয়াম ভেবে নেবেন না যেন! বাঁধের উপরে পড়ছে পানির অবিরত চাপ। বাঁধের মুখ খুলে দিলেই কিংবা বাঁধে সামান্য চিড় ধরলেই সেই বাঁধ ছত্রখান হয়ে ভেঙে চুরে পানিকে বয়ে নিয়ে যাবে সাগরের বুকে।
চিত্র: হিগস ক্ষেত্র এবং শক্তিঘনত্বের সম্পর্কসূচক  ত্রিমাত্রিক গ্রাফ।

নদীর উপমা দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো হলেও এখানে বলা দরকার যে, মহাবিশ্বের ফলস ভ্যাকুয়ামের কাজের সাথে উপরের নদীর উপমার পার্থক্য আছে।  ফলস ভ্যাকুয়ামের মধ্যে তৈরি হয় বিকর্ষণমূলক মহাকর্ষের, যা আক্ষরিক অর্থেই এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। গুথ তার বইয়ে এই মেকি ভ্যাকুয়ামকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন –
‘এই মেকি ভ্যাকুয়ামের রয়েছে এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য, যা অন্য সকল পদার্থ থেকে আলাদা। সাধারণ পদার্থের (সেটা কঠিন, তরল, বায়বীয় বা প্লাজমা – যাই হোক না কেন), শক্তি ঘনত্ব নিয়ন্ত্রিত হয় কণাদের ভর দিয়ে, যেটা আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুযায়ী আবার শক্তির সমানুপাতিক ( $latex E = mc^2 $ )। সাধারণ পদার্থের ক্ষেত্রে আয়তন বাড়লে পদার্থের ঘনত্ব কমে যায়, সেই সাথে কমে শক্তি ঘনত্ব। কিন্তু মেকি ঘনত্বের ক্ষেত্রে এটা কণার উপর প্রযুক্ত হয় না, হয় হিগস ক্ষেত্রের উপর। কাজেই মহাবিশ্ব প্রসারিত হলেও ফল্‌স ভ্যাকুয়ামের শক্তি ঘনত্ব অপরিবর্তিত থাকে, যদি না আমরা দীর্ঘ সময় ধরে মেকি ভ্যাকুয়ামের অবক্ষয়ের জন্য অপেক্ষা করি’।
এই মেকি ভ্যাকুয়ামের থাকে তীব্র বিকর্ষণমূলক শক্তি। গুথ গণনা করে দেখিয়েছেন, ভ্যাকুয়ামের ক্ষেত্রে বিকর্ষণ শক্তির মান আকর্ষণ শক্তির অন্তত তিনগুণ বেশি পাওয়া যায়

[7]।  ইনফ্লেশনের গণিতটা খুব সহজভাবে লিখলে দাঁড়াবে অনেকটা এরকমের

 [8]যেহেতু  $latex \rho $ এর মান  সবসময়ই ধনাত্মক, কাজেই  সমীকরণের শর্তকে সিদ্ধ করতে হলে  $latex P $ এর মান ঋণাত্মক হতে হবে, এবং এটা অবশ্যাম্ভাবী।
আসলে মহাবিশ্বের শুরুতে ‘ফলস ভ্যাকুয়াম’ বা মেকি শূন্যতা  নামের অদ্ভুতুড়ে জিনিসটা ছিল বলেই কিন্তু  ঋণাত্মক চাপ এসে মহাবিশ্বকে এত দ্রুত প্রসারিত করে দিতে পেরেছে।  কিন্তু কীভাবে তৈরি হয়েছিল এই  মেকি শূন্যতা? এটা বোঝার জন্য আমাদের হিগস ফিল্ডের মত স্কেলার ক্ষেত্রের দ্বারস্থ হতে হবে।

স্কেলার ক্ষেত্র  : হিগস ফিল্ড
কান টানলে যেমন মাথা আসে, ফলস ভ্যাকুয়ামের কথা বলতে গেলে স্কেলার ক্ষেত্রের কথা চলে আসবে আমাদের আলোচনায়। স্কেলার ক্ষেত্র বলতে আমরা বুঝি এমন সাংখ্যিক মান, যা সুষমভাবে আমাদের চারপাশের স্থানের প্রতিটি বিন্দুতে ছড়িয়ে রয়েছে। ক্ষেত্রটিকে ‘স্কেলার’ বলা হয় কারণ, এর সাংখ্যিক মান আছে, কিন্তু কোন দিক নেই। এই সাংখ্যিক মান এক বিন্দু থেকে অপর বিন্দুতে ভিন্ন হতে পারে, কিংবা হতে পারে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত । এ ধরণের  স্কেলার ক্ষেত্রের একটি খুব সাধারণ উদাহরণ হচ্ছে তাপমাত্রা। আমরা পৃথিবীর কিংবা মহাবিশ্বের যেখানেই যাওয়ার কথা কল্পনা করি না কেন, সেটা বান্দরবনের কোন গাছের মগডালেই হোক, বরফাচ্ছাদিত শ্বেতশুভ্র উত্তরে মেরুতেই হোক,  কিংবা হোক না সে সূর্যের কেন্দ্রে – তাপমাত্রার কোন না কোন মান আমরা পাব।
গুথ সে সময় এমনি একটি স্কেলার ফিল্ড নিয়ে কাজ করছিলেন, নাম হিগস ফিল্ড।  এই হিগস ক্ষেত্রটি আবার নিজেকে প্রকাশ করে থাকে এক রহস্যময় কণার মাধ্যমে। কণাটির নাম মিডিয়ার সাম্প্রতিক তোলপাড়ের কারণে সবার জানা হয়ে গেছে।  এই সেই হিগস বোসন –  মিডিয়াতে সমাদৃত হয়েছে ‘ঈশ্বর কণা’  নামে।  আশির দশকে গুথ যখন কাজ করছিলেন, তখন সেটা ‘হাইপোথিটিকাল’ বা উপপ্রমেয়মূলক একটি ধারণা হিসেবেই কেবল বজায় ছিল। কিন্তু গুথের দৃঢ় ধারণা ছিল যে, হিগস কণা পাওয়া যাবে।   ১৯৯৭ সালে লেখা ‘ইনফ্লেশনারি ইউনিভার্স’ বইয়ের ১৩৬ পৃষ্ঠায় গুথ বলেছিলেন  –
‘যদিও হিগস কণা এখনো পাওয়া যায়নি,  কিন্তু তত্ত্বের প্রতি বিজ্ঞানীদের আস্থা রয়েছে পুরোমাত্রায়। আমরা জানি   W এবং Z কণাগুলোকে ১৯৮৩ সালের আগ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, ‘তাড়িত দুর্বল’ বল তত্ত্ব দেয়ার পর ১৬ বছর লেগেছে এর পেছনের কণার বাস্তব অস্তিত্ব খুঁজে পেতে।  কণাগুলোর ভর এবং মিথস্ক্রিয়া আগেকার দেয়া তাত্ত্বিক ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে পুরোপুরি মিলে গেছে।  তাই আশা করা অমূলক নয় যে, যখন একবিংশ শতকে সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বানানো শেষ হবে,  প্রমিত মডেলের আরাধ্য  হিগস কণাও খুঁজে পাওয়া যাবে’।
আমরা আজ জানি, ১৯৯৭ সালে বলা গুথের প্রতিটি বাক্য সত্য প্রমাণিত হয়ে গেছে। ২০১২ সালের ৪ঠা জুলাই তারিখে সার্নের বিজ্ঞানীরা আমাদেরকে হিগস কণার অস্তিত্বের বাস্তব প্রমাণ দিতে সক্ষম হয়েছেন

[9]। বলা বাহুল্য, হিগস ক্ষেত্রের এহেন পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ গুথের স্ফীতি তত্ত্ব তথা প্রমিত বিগ ব্যাং মডেলেরও একটা  জোরালো স্বীকৃতি । এ নিয়ে আরেকটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করার ইচ্ছে আছে।  এখানে কেবল স্ফীতির সাথে হিগসের সম্পর্ক নিয়ে প্রাসঙ্গিক দু’চার কথা জানার চেষ্টা করব।

হিগসের পেছনের ইতিহাসটা বেশ পুরনো। হিগস ক্ষেত্রের ধারণাটা  প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানীদের মাথায় এসেছিল  ষাটের দশকে কণা পদার্থবিজ্ঞানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে। প্রকৃতির মৌলিক বলগুলোর (দুর্বল নিউক্লিয়, সবল নিউক্লিয়, তাড়িত চৌম্বক এবং মহাকর্ষ) একত্রীকরণে হিগসের বড় সড় একটা ভূমিকা আছে। প্রকৃতির এই বলগুলোকে – বিশেষত মহাকর্ষ এবং তাড়িত চৌম্বক বল দুটোকে একীভূত করার লক্ষ্যে আইনস্টাইন তার জীবনের শেষ বছরগুলোতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ করতে গিয়ে সেসময় পদার্থবিজ্ঞানের মূল ধারার গবেষণা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্নই হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। খুবই উচ্চাভিলাষী ছিল তাঁর স্বপ্ন। বহুবার আইনস্টাইন ভেবেছিলেন তার স্বপ্নের যাদুর কাঠি বুঝি হাতে পেয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত তার স্বপ্ন সাধ অপূর্ণই থেকে যায়।  তবে,  আইনস্টাইনের মৃত্যুর (১৯৫৫) দুই দশকের মধ্যে পদার্থবিদেরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করলেন।
ষাটের দশকের শেষ দিকে তত্ত্বীয় পদার্থবিদেরা সফলভাবে ‘তাড়িতচৌম্বক’ বল এবং ‘দুর্বল নিউক্লিয়’ বলকে একই সুতায় গাঁথতে সমর্থ হলেন।  একে এখন অভিহিত করা হয় ‘তাড়িত দুর্বল’ বল নামে। সত্তরের দশকে এসে তাড়িত দুর্বল তত্ত্বের পরীক্ষালব্ধ সত্যতা নির্ণীত হয়। শুরুটা হয়েছিল শেল্ডন গ্ল্যাসোর হাতেই। ১৯৬৭ সালের দিকে গ্ল্যাসো ‘গেজ গুচ্ছ’ নামের একটি প্রক্রিয়া ব্যবহার করে দুর্বল ও তাড়িত চৌম্বক মিথস্ক্রিয়ার একত্রীকরণের একটা প্রয়াস নিয়েছিলেন। কিন্তু এ পদ্ধতিতে সমস্যা ছিল যে, গ্ল্যাসোর সমীকরণ থেকে পাওয়া ল্যাগ্রাঞ্জিয়ানে  ভর সূচক পদটি  প্রতিসাম্যতাকে সংরক্ষণ করত না।
এর সাত বছর পরে এই বোসনের ভর সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হাজির করলেন সালাম এবং ওয়েনবার্গ;  এবং যে প্রক্রিয়ায় তারা এর সমাধান বের করেছিলেন তাকে বলা হয় ‘হিগস প্রক্রিয়া’।  প্রক্রিয়ার নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তাদের সমাধানে  ‘হিগস অনুকল্পের’ একটা বড় ভূমিকা ছিল।  আসলে ঠিক কীভাবে W বোসন, Z বোসনের (এরা দুর্বল নিউক্লিয় বলের পরিবাহী কণা, ঠিক যেমন আমরা জানি যে ফোটন হচ্ছে আলোর পরিবাহী কণা)  মত গেজ বোসনগুলো ভর প্রাপ্ত হয়,  আর ফোটনের মত কণিকারা থেকে যায় ভরশূন্য  – এই সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে স্কটল্যান্ড নিবাসী বিজ্ঞানী পিটার হিগস ১৯৬৪ সালে এক নতুন ‘বল ক্ষেত্র’ (Force Field ) – এর কল্পনা করেছিলেন, যেটাকেই আমরা আজ ‘হিগস ক্ষেত্র’ বলে ডাকি। সালাম আর ওয়েনবার্গেরা দেখালেন, যখনই হিগস বলক্ষেত্র নিজেকে প্রকাশ করে, সেই মুহূর্তেই তাড়িত চৌম্বক আর দুর্বল নিউক্লিয় বল পরপষ্পর থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। এটাকে বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি ‘প্রতিসাম্যতার ভাঙ্গন’।  যখন থেকে  হিগস প্রক্রিয়া গ্ল্যাসো-সালাম-ওয়েনবার্গ মডেলের সমীকরণে অন্তর্ভুক্ত হল, তখন থেকেই তাড়িত দুর্বল তত্ত্ব চমৎকারভাবে কাজ করতে শুরু করল।  আর এ তত্ত্বটির পুনর্নমায়ন (renormalization) সংক্রান্ত প্রমাণ দিয়ে তত্ত্বটিকে আরো পাকাপোক্ত করে তুললেন  বিজ্ঞানী ‘টি হুফট ১৯৭১ সালে।  ‘টি হুফটের প্রমাণে উদ্বেলিত  হয়ে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিডনী কোলম্যান  মন্তব্য করেছিলেন, ‘টি হুফটের কাজ ওয়াইনবার্গ-সালামের রূপকথার ব্যাঙ-কে যেন জাদুমন্ত্রে সুদর্শন রাজকুমারে পরিণত করল’

[10]।  এ সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ আবদুস সালাম, স্টিফেন ওয়েইনবার্গ এবং শেলডন গ্ল্যাসো ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
হিগস সংক্রান্ত পেছনের এ ইতিহাসগুলো গুথের জানা ছিলই। তিনি আরো জানতেন যে, হিগস নামের এই স্কেলার ক্ষেত্রটা  W  এবং  Z কণার সাথে মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায়, আর তাদের গায়ে গতরে তাদের ভারী করে তুলে। কিন্তু ফোটন কণা এই স্কেলার ক্ষেত্রের সাথে কোন ধরণের মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায় না, তাই তারা চলতে পারে আলোর বেগে হু হু করে। এই  হিগস ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আরো কিছু নতুন ব্যাপার জানলেন গুথ। তিনি দেখলেন, এর বৈশিষ্ট্য অন্য সব চেনা জানা স্কেলার ক্ষেত্রের চেয়ে আলাদা।  অন্য সবার জন্য, বল ক্ষেত্রের মান শূন্য থাকলেই  শক্তি ঘনত্ব সবচেয়ে  কম পাওয়া যায়।  কিন্তু হিগসের ক্ষেত্রে শক্তি ঘনত্ব আমরা সবচেয়ে কম পাই –  যখন হিগসের একটি ‘নন জিরো ভ্যালু’ বা অশূন্য মান থাকে। এর মানে হচ্ছে  শূন্য স্থানে, যেটাকে আমরা প্রচলিত ভাবে ভ্যাকুয়াম বলে অভিহিত করি –  সেখানেও হিগসের একটা মান সবসময়ই পাওয়া যাবে। আমাদের মহাবিশ্বের মেকি শূন্যতার পথ পাড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে প্রকৃত শূন্যতায় এসে পৌঁছানোর ব্যাপারটা যদি সঠিক হয়, তবে সেই প্রকৃত শূন্যতার অবস্থানে হিগসের একটা নির্দিষ্ট মান থাকবে, যেখানে মহাবিশ্বের শক্তি ঘনত্ব হবে সর্বনিম্ন।   নীচের ছবিটার দিকে তাকানো যাক। এ ছবিটা উপরে ফলস এবং ট্রু ভ্যাকুয়াম সংক্রান্ত  ত্রিমাত্রিক ছবিটির দ্বিমাত্রিকরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে।
চিত্র: হিগস ক্ষেত্র এবং শক্তিঘনত্বের সম্পর্কসূচক  দ্বিমাত্রিক গ্রাফ। মহাবিশ্ব  ‘ফলস ভ্যাকুয়াম’ থেকে যাত্রা শুরু করে মালভূমির গা বেয়ে নেমে ‘ট্রু ভ্যাকুয়ামে’ এসে স্থিত হয়।
ছবি থেকে বোঝা যাচ্ছে,শক্তি ঘনত্ব $latex u $ এর মান ধীরে ধীরে কমতে কমতে একটা জায়গায় এসে শূন্য হলেও  সেখানে স্কেলার ক্ষেত্র  $latex \phi $ এর মান  শূন্য নয় বরং  $latex \phi = \phi_t $ । এটাই প্রকৃত ভ্যাকুয়াম।  আমাদের মহাবিশ্ব আজ এই জায়গাতেই আছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। কিন্তু অতীতে যখন স্কেলার ক্ষেত্রের মান শূন্য ছিল ( $latex \phi = 0 $ ) তখন তার  শক্তি ঘনত্বের মান ছিল  $latex u_f $ । এই সসীম ঘনত্বের দশাকেই বলা হয় মেকি ভ্যাকুয়াম। ছবি থেকে দেখা যাচ্ছে, হিগস ক্ষেত্রের মান যত বাড়তে থাকে শক্তি ঘনত্ব একটি মালভূমির ঢাল বেয়ে ততই নীচে নামতে থাকে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের সাথে সাথে স্কেলার ক্ষেত্র তার ঘনত্ব কমাতে চায়। কিন্তু মালভূমিটি যদি যথেষ্ট সমতল হয় তাহলে বোঝাই যাচ্ছে সেই ঘনত্ব কমাতে (অর্থাৎ, মালভূমির চূড়া থেকে পর্বতের ঢাল বেয়ে উপত্যকায় নেমে আসতে) যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। এই স্বল্প সময়ের জন্য মেকি ভ্যাকুয়াম এক ধরণের আপাতঃ শূন্যতা হিসেবে কাজ করে, অর্থাৎ তার ঘনত্ব কমানো সেভাবে যায় না। আর এই ব্যাপারটাই যেন হাজির হয়েছিল সব রহস্যের সমাধান হিসেবে।  গুথ  তার সেসময়কার সহকর্মী হেনরি তাই এর সাথে মিলে হিগস ফিল্ডের বৈশিষ্ট্য গুলো নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে গুথ ভাবলেন, হিগস ফিল্ডের মানের সাথে হয়ত মহাবিশ্বের প্রসারণের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। ব্যাপারটা একটু নেড়ে চেড়ে দেখতে হবে।
নেড়ে চেড়ে দেখতে গিয়ে যা পেলেন তা এককথায় অভিনব। হিগস ক্ষেত্র এক ধরণের অতিশীতীভূত (supercool)  অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়ে তার দশার পরিবর্তন ঘটায়,  ফলে সে সময়টায়  প্রতিসাম্যতার ভাঙ্গন সাময়িক সময়ের জন্য হলেও যেন চেপে চুপে রাখা যায়।  ‘অতিশীতীভূত  অবস্থা’,  ‘প্রতিসাম্যতার ভাঙ্গন’ এই কঠিন কঠিন শব্দ শুনে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। পুরো ব্যাপারটাকে সহজ উপমা দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। একে অনেকটা পানির দশা পরিবর্তনের সাথে তুলনা করা যায়। সাধারণ তাপমাত্রায় পানি তরল অবস্থায় থাকে। যে দিক থেকেই তাকাই না কেন, পানিকে একই রকম লাগে আমাদের। বিজ্ঞানের ভাষায় বললে বলা যায়, তরল অবস্থায় পানি সব দিক থেকেই থাকে প্রতিসম । পানিকে শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ঠাণ্ডা করলে তা বরফে পরিণত হয়, এ আমরা জানি, আর হরহামেশাই দেখি।  কিন্তু যেটা অনেকেই জানিনা তা হল – বরফে পরিণত হওয়া মানেই  কিন্তু  এর প্রতিসাম্যতা ভেঙ্গে পড়া।  যে কোন বরফের চাই নিয়ে পরীক্ষা করলেই দেখা যায়, এর বিভিন্ন অক্ষ বরাবর অণুর সাজসজ্জা ভিন্ন হয়। তাই বলা যায় – তরল অবস্থায় পানির যে প্রতিসমতা বজায় ছিল তা ভেঙ্গে পড়ে পানি বরফে পরিণত হয়ে গেলেই।  তবে, একটু সতর্ক হলে আমরা কিন্তু পানির এই সহজাতভাবে বরফে পরিণত হওয়া ঠেকাতে পারি। এ জন্য অবশ্য দরকার অতিমাত্রায় বিশুদ্ধ পানি যোগাড় করে একে অতিদ্রুত বরফ গলনের তাপমাত্রার নীচে  নিয়ে যাওয়া। এভাবে খুব তাড়াতাড়ি পানিকে ঠাণ্ডা করলে অনেকসময় দেখা যায়, পানি শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নীচেও বরফে পরিণত না হয়ে আগের মতই তরল অবস্থাতেই থেকে যাচ্ছে। তরলের এই দশাকে ‘অধিতরল’ অবস্থা  বলতে পারি আমরা। গুথ ভাবলেন, মহাবিশ্বও নিশ্চয় এভাবেই কাজ করেছিল শুরুতে। তাপমাত্রা ক্রান্তিমানের চেয়ে নীচে নেমে গেলেও প্রতিসাম্যতা বজায় ছিল, আর মহাবিশ্ব ছিল সাময়িক সময়ের জন্য অস্থায়ী দশায় মানে মেকি শূন্যতায় বন্দি হয়ে।  কিন্তু এ ব্যাপারটা ঘটার জন্য সুপ্ততাপের মাধ্যমে অতিরিক্ত শক্তির যে যোগানটা এসেছিল,  সেটাই দিয়েছিল বিকর্ষণমূলক ধাক্কা, অনেকটা আইনস্টাইনের সেই মহাজাগতিক ধ্রুবকের মতোই।  মহাজাগতিক ধ্রুবকের মত আচরণ বললেও, আসলে মাত্রাগত ভাবে এর সাথে আইনস্টাইনের ধ্রুবকের পার্থক্য অনেক। গুথ এবং হেনরির গণনা থেকে যেটা বেরুলো সেটার মান আইনস্টাইন যা অনুমান করেছিলেন তার চেয়ে ১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ গুন (অর্থাৎ ১০১০০ গুন) বেশি। এই তীব্র বিকর্ষণ শক্তি তৈরি হয়েছিল বলেই মহাবিশ্ব এইভাবে এতটা দ্রুত বিবর্ধিত হতে পেরেছিল। ‘এতটা দ্রুত’ বলছি বটে, কিন্তু ঠিক কতটা দ্রুত? বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই মহাবিশ্বের আকার বেড়ে গিয়েছিল মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন গুন (১ এর পরে ৩০টা শূন্য)। আর এই দানবীয় স্ফীতিটাই সমাধান করে দিয়েছিল নীচের সমস্যাগুলোর, যেগুলো স্ফীতিতত্ত্ব আসার আগে কোনভাবেই সমাধান করা যাচ্ছিল না।

মহাবিশ্বের আকার
প্রথম সমাধানটা মহাবিশ্বের আকার সংক্রান্ত। আমাদের মহাবিশ্ব যে বড় তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ঠিক কতটা বড়? আমাদের জানা শোনা বস্তুকণার মধ্যে আলোর বেগ  সবচেয়ে বেশি। সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল। কিন্তু মহাবিশ্বের পুরোটুকু দেখতে চাইলে এই দানবীয় গতিবেগও নেহাত তুচ্ছ মনে হবে।  আমাদের ছায়াপথ থেকে সবচেয়ে কাছের যে গ্যালাক্সি – অ্যান্ড্রোমিডা  – সে রয়েছে ২০ লাখ আলোকবর্ষ দূরে।  সবচেয়ে দূরবর্তী যে গ্যালাক্সিগুলো টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা যায় সেগুলোর আলো  ছড়িয়ে পড়েছিল ১৩ বিলিয়ন অর্থাৎ ১৩০০ কোটি বছর আগে।  স্ফীতি টিতি নিয়ে যদি আমরা মাথা না ঘামাতাম,  তবে ঐ ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষের দূরত্বকেই আমরা দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রান্তসীমা বলে ভাবতাম। আফটার অল বিগ ব্যাং তো হয়েছিল প্রায় ১৩০০ কোটি বছরের কাছাকাছি সময়েই। তাই ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষের চেয়ে বেশি দূরের জিনিস দেখা যাবেই বা কিভাবে?
কিন্তু মজাটা হল, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রান্তসীমা ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষ নয়, বরং অন্তত ৪৬০০ কোটি আলোকবর্ষ[11]। মানে, ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষের ঢের বেশি দূরের জিনিস বিজ্ঞানীরা ‘দেখতে’ পান। কিভাবে এটা হল?  এটা হল, কারণ স্ফীতি তত্ত্বের কল্যাণে বিজ্ঞানীরা জানেন ১৩০০ কোটি বছর আগে যে গ্যালাক্সিগুলো থেকে  আলো ছড়িয়ে পড়েছিল, সেগুলো আমাদের কাছ থেকে আলোর গতির দ্বিগুণ গতিতে দূরে চলে গেছে। ফলে মধ্যবর্তী স্থানের  বিস্তর প্রসারণ ঘটেছে।  আর দৃশ্যমান মহাবিশ্বের দেওয়ালটা সরে গিয়ে ৪৬০০ কোটি আলোকবর্ষের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ দুই পাশ হিসেব করলে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস হবে ৯২০০ কোটি আলোকবর্ষ।

চিত্র: আমাদের মহাবিশ্ব এতো বড় হল কীভাবে বিগ ব্যাং মডেলের জন্য সবসময়ই একটা সমস্যা। দৃশ্যমান মহাবিশ্ব প্রকৃত মহাবিশ্বের  তুলনায় অনেক ছোট, আর আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি তো  তার তুলনায় বিন্দুসম। কি ভাবে তাহলে তৈরি হল এত বিশাল আকারের মহাবিশ্ব?

এত গেল ‘দৃশ্যমান’ মহাবিশ্বের কথা। প্রকৃত মহাবিশ্ব যে কত বড় কেউ তা জানে না। আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের দেওয়ালও তার কাছে ক্ষুদ্র।  সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা বলছে মহাবিশ্বের ব্যাস অন্তত ১৫ হাজার কোটি আলোকবর্ষের কম হবে না।

এত কম সময়ের মধ্যে কীভাবে তৈরি হয়েছে এই বিপুলাকৃতি মহাবিশ্ব?  বিগ ব্যাং তত্ত্ব এর কোন সদুত্তর  দিতে পারেনি।  কিন্তু স্ফীতিতত্ত্বের জন্য এর উত্তর দেয়া কোন সমস্যা নয়। কারণ স্ফীতিতত্ত্ব অনুযায়ী শুরুতে মহাবিশ্বের প্রসারণ ঘটেছিল সূচকীয় হারে। কোন কিছু সূচকীয় হারে বাড়লে সেটা কি রকম ভয়ানক হয়ে দাঁড়ায় তার নমুনা পাওয়া যায় ভারতের প্রাচীন এক উপাখ্যানে। গল্পটা রসিকরাজ গ্যামো তার ‘ওয়ান, টু, থ্রি … ইনফিনিটি’ বইয়ে উল্লেখ করেছিলেন

[12]।  গুথের ‘ইনফ্লেশনারি ইউনিভার্স’ বইয়েও এর উল্লেখ আছে।  ঘটনাটা এরকমের:
এক জ্ঞানী দরবেশ দাবা খেলা আবিষ্কার করলে, সে রাজ্যের সুলতান তার উপর খুব খুশি হন। কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সুলতান দরবেশকে পুরস্কার দিতে চাইলে, দরবেশ সুলতানকে এক অভিনব প্রস্তাব দিয়ে বসেন । বললেন,
-মহারাজ, আমি যৎ সামান্য ভিক্ষে চাই। প্রথম দিন দাবার প্রথম ছকে কেবল একটি গমের দানা।
-কী? মাত্র একটা গমের দানা? তুমি কি আমার জৌলুসের প্রতি অবজ্ঞা করছ?
দরবেশ উত্তরে বললেন,
– না হুজুর, ঠিক একটা গমের দানা নয়। প্রথম দিন একটা গমের দানা। এর পর দিন এর পরের ছকে থাকবে এর দ্বিগুণ দানা – অর্থাৎ দুটি। তৃতীয় দিন তৃতীয় ছকে থাকবে এর দ্বিগুণ – অর্থাৎ চারটি … এভাবে  আমাকে প্রতিদিন ভিক্ষে দিতে হবে যতদিন না দাবার ছক পূর্ণ হয়।
সুলতানের ঠোঁটে কুটিল হাসি ফুটে উঠল। বললেন,
– তোমাকে অনেক জ্ঞানী আর চালাক ভেবেছিলাম। কিন্তু তোমার প্রস্তাব দেখে বুঝলাম তুমি তা নও। দাবার ৬৪ টা ঘর পূর্ণ হতে মাত্র ৬৪ দিন লাগবে। একটা গমের দানা দিয়ে যাত্রা শুরু করে ৬৪ দিনে আর কয়টা গমের দানা তুমি কব্জা করবে? এখনো সময় আছে, অন্য কিছু যদি চাও তো চাইতে পার।
– না হুজুর, এই সামান্য ভিক্ষেই আমার সই।
‘তথাস্তু’ বলে  সুলতান দরবেশের প্রার্থনা মঞ্জুর করে দিলেন।
গমের দানা  সূচকীয় হারে বাড়লে কোথায় যাবে – সেই গণিতটা সুলতান আসলে বুঝতে পারেননি।  প্রথম কয়েকদিনে অবশ্য সুলতানের আসলেই কোন চিন্তা ছিল না। কারণ প্রথম দিন একটি দানা, ২য় দিন দুটি দানা,  তৃতীয় দিনে চারটি দানা করে দরবেশ এগুচ্ছিলেন। সুলতান দরবেশের বোকামির জন্য আড়ালে আবডালে তামাসাও করছিলেন সভাসদদের সাথে মিলে।
ষষ্ঠ দিনে দরবেশ ৩২ টি দানা পেলেন।  অষ্টম দিনে ১২৮ টি গমের দানা পেলেন। কিন্তু এর পর যত দিন যেতে লাগল সম্রাটের কপালে রীতিমত ভাঁজ পড়তে শুরু করল। ষোলতম দিনে ৩২,৭৬৮টি দানার হিসেবে দেখা গেল দরবেশ বাবাজি সবমিলিয়ে ৬৫ হাজারের বেশি দানা কবজা করে ফেলেছেন। ২০ দিনে তা বেড়ে দাঁড়ালো ১০ লক্ষ ৪৮ হাজার দানার উপরে।  সম্রাটের চোয়াল তখন রীতিমত ঝুলে পড়েছে।  তিনি খানিকটা হলেও বুঝতে শুরু করেছেন –   দরবেশের পাওনা মেটানো তার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ দাবার সর্বশেষ ছক মানে ৬৪ নম্বর ঘরে পৌঁছুতে পৌঁছুতে তাকে ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন গমের যোগান দিতে হবে, যেটা ভারত বর্ষ তো কোন ছার –  হাজার বছর ধরে সারা পৃথিবীর সকল গমের দানা যোগাড় করলেও পোষাবে না।   ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন গমের হিসেবটা যেন কেউ কোন আকাশ কুসুম কল্পনা ভেবে না বসেন, চৌষট্টি তম দিনে এসে সত্য সত্যই দরবেশের হস্তগত হবে ১৮,৪৪৬,৭৪৪,০৭৩,৭০৯, ৫৫১, ৬১৫ টা দানা (পুরো গণনা দেখতে চাইলে ক্লিক করুন এখানে), যা দিয়ে  আসলে সারা পৃথিবীকে কয়েক ইঞ্চি পুরু গমে ঢেকে ফেলা যাবে। এত গমের যোগান দেবার সাধ্য আর সুলতানের ছিল কোথায়?

চিত্র: আমাদের মহাবিশ্ব এতো বড় হল কীভাবে তা স্থিতিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে।
মহাবিশ্বের স্ফীতিও কাজ করেছিল অনেকটা দরবেশের দাবার ছকে দেয়া গমের মতোই। তবে পার্থক্য ছিল যে, স্ফীতির ঘরের সংখ্যা দাবার বোর্ডের ৬৪ টি ঘরে সীমাবদ্ধ না থেকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল একশ কিংবা তার চেয়েও বেশি সংখ্যক ঘরে। ফলে মাত্র  ১০-৩৫ সেকেন্ডের মধ্যেই মহাবিশ্বের আকার বেড়ে প্রাথমিক আকারের ১০৩০ গুন হয়ে গিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি  আজকের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের (অর্থাৎ, ১০২৮ সেন্টিমিটারের)  মত এত বড় একটা মহাবিশ্ব।

দিগন্ত সমস্যা
কোন এক রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকালে বোঝা যায় এদিকে ওদিকে ছোট খাট কিছু পার্থক্য থাকলেও মোটাদাগে আমাদের আকাশের দৃশ্যপটটা মোটামুটি সুষম। তেমনিভাবে কেবল আকাশ নয় আমাদের চারিদিকে তাকালেও দেখা যায়, চারপাশের প্রকৃতি বিন্যস্ত হয়েছে সুষমভাবে। সেটা ভাল করে বোঝা যায় খোলা মাঠে গিয়ে দাঁড়ালে কিংবা এমনকি সুন্দরবনের মত গহীন  বনে গিয়ে হাঁটলেও।  সুন্দরবনে জঙ্গলের একটু ভিতরে প্রবেশ করলেই আপনি দেখতে পাবেন, বনের গাছগুলো আপনাকে ঘিরে তৈরি করেছে এক সুষম জগত। আপনি আরেকটু এগিয়ে সামনে যান, কিংবা দুই কদম পিছিয়ে দাঁড়ান, একই ছবি পাবেন। আপনার অবস্থান পরিবর্তনের সাথে  ডান, বাম, সামনে কিংবা পিছনের গাছগুলো হয়তো বদলাবে, কিন্তু মোটাদাগে সুষম জঙ্গলের ছবিটা প্রায় একই রকমের।  অর্থাৎ গড় হিসেবে (স্থানিক বিচ্যুতি বাদ দিলে) পুরো জগৎটাই মোটের উপর সমসত্ত্ব আর দিক নিরপেক্ষ

[13]।   একই কথা বিজ্ঞানীরা বলেন মহাজাগতিক বিকিরণের তাপমাত্রা মেপেও।  বিকিরণের তাপমাত্রা  গড়পড়তা একইরকম পাওয়া যাবে। এবং সেটা যায়ও।
কিন্তু সমস্যাটা  অন্য জায়গায়।  আমরা জানি মহাবিশ্বে আলোর গতিই সর্বোচ্চ। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে আলোর গতিকে টেক্কা দিয়ে  যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। মহাবিশ্বের যা বয়স তাতে করে একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আলো, তাপমাত্রা কিংবা তথ্য এত সহজে পৌঁছে যেতে পারে না। বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মহাবিশ্বে তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব নয় কোনভাবেই।
পরিস্থিতিটা আরো জটিল হয়ে যায় যখন আমরা বিগ ব্যাং এর ৩৮০,০০০ বছর পরের আকাশের কোন ছবি দেখি। এই সময়ের ছবিটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এই সময় মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের মায়াবী প্রতিচ্ছবিটা প্রথমবারের মত এক ধরণের অবয়ব নিতে করেছিল।   খুব ক্ষুদ্র স্কেলে ফ্লাকচুয়েশন থাকলেও মোটাদাগে এই বিকিরণের প্রতিচ্ছবির প্রকৃতি সুষম বলেই বিজ্ঞানীরা জানেন। আমরা উপরে মহাবিশ্বের আকার নিয়ে যে অংশে কথা বলেছিলাম, সেখানে একটা হিসেব দিয়েছিলাম দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাসের, সে প্রায় ৯২০০ কোটি আলোকবর্ষ। এর মানে হচ্ছে,  এই মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণকে  অন্ততঃ ৯২০০ কোটি আলোকবর্ষ পাড়ি দিতে হবে আজকের দিনের এই সমসত্ত্ব অবস্থায় পৌঁছুতে।  কিন্তু এটা এক কথায় অসম্ভব ব্যাপার, এমনকি আলোর বেগে তথ্য গেলেও ৩৮০,০০০ বছরের মধ্যে দুইপাশের সবকিছু এভাবে সমান করে দেয়া সম্ভব নয়। এটা হল কি করে? আলোর বেগে তথ্য গেলেও যে দূরত্ব অতিক্রম করা যাচ্ছে না,  সেই দুর্লঙ্ঘ্য বাধা পেরিয়ে কীভাবে দুইপ্রান্তকে একই জায়গায় নিয়ে আসা গেল? এটা বহুদিন ধরেই বিগ ব্যাং মডেলের জন্য একটা সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত ছিল।  প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ রবার্ট ডিকি ( হ্যাঁ যার নাম আমরা আগের অধ্যায়ে জেনেছি, তার বিখ্যাত ‘বয়েস, উই হ্যাভ বিন স্কুপড’ উক্তির মাধ্যমে) এর নাম দিয়েছিলেন ‘দিগন্ত সমস্যা’ ।
সমস্যার কথা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু সমাধানটা কি করে পাওয়া গেল? কিভাবে  অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের এবড়ো থেবড়ো জমিকে এত তাড়াতাড়ি পিটিয়ে সমান করে দেয়া গেল?  কে চালালো অমানুষিক বেগে এই ‘থরের হাতুড়ি’?  হ্যাঁ উত্তর হচ্ছে আমাদের  ‘ইনফ্লেশন’।  গুথ চিন্তা করলেন, স্ফীতি যদি সত্য হয়ে থাকে তবে এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই স্থানের প্রসারণ হয়েছিল ১০৩০ গুন, ফলে নিমেষ মধ্যেই মহাবিশ্বের দুইপ্রান্ত তাপীয় সাম্যাবস্থায় পৌঁছিয়ে যেতে পেরেছিল, ঠিক যেমনি ভাবে চুলায় রান্না বান্না করার পর আমাদের রান্নাঘর আর বসারঘরের তাপমাত্রাকে সামান্য সময়ের মধ্যেই আমরা সমান হয়ে হয়ে যেতে দেখি। কিংবা কাপের গরম চা বাইরে রেখে দিলে সামান্য সময় পরেই দেখি ঘরের তাপমাত্রায় নেমে আসতে।

মনোপোল সমস্যা
বিগ ব্যাং তত্ত্বের একটা ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে,  আমাদের মহাবিশ্বে বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় আধানযুক্ত অতি ভারী একক মেরুবিশিষ্ট কিছু কণিকার প্রাচুর্য থাকবে

[14]।  এই একক  কণাগুলোকে বলা হয় মনোপোল।  সহজ কথায় মনোপোল হচ্ছে সেরকম চুম্বক, যার কেবল উত্তর মেরু আছে, কিন্তু দক্ষিণ মেরু নেই; কিংবা হয়ত দক্ষিণ মেরু আছে, উত্তর মেরু নেই। কিন্তু  দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ধরণের  কোন কণার অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাই না।
একটা চুম্বক হাতে নিয়ে একে মাঝামাঝি জায়গায় দ্বিখণ্ডিত করুন। যে ছোট টুকরো দুটো পাওয়া যাবে, তাতে উত্তর আর দক্ষিণ মেরু থাকবে।  সেগুলোকে দ্বিখণ্ডিত করলেও উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু বিশিষ্ট খণ্ড পাওয়া যাবে। যত ছোট টুকরাই আমরা করি না কেন, দেখব সব সময়ই উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুকে যুগল আকারেই পাওয়া যাচ্ছে। একক কোন উত্তর মেরু বা দক্ষিণ মেরু আমরা পাই না।
অথচ, গ্র্যাণ্ড ইউনিফাইড তত্ত্বের জোরালো পূর্বাভাস ছিল যে এধরণের কণা থাকতে হবে।  তাহলে কেন আমরা সেগুলো দেখতে পাইনা?  এই ব্যাপারটারও সমাধান হিসেবে হাজির হল স্ফীতিতত্ত্ব। গুথের গণনা থেকে জানা গেল,  মেকি ভ্যাকুয়ামের দশায় মহাবিশ্ব এত বিপুলভাবে প্রসারিত হয়েছে যে, মনোপোলগুলোর ঘনত্ব লঘু থেকে লঘুতর হয়ে গেছে, আর মহাবিশ্বের প্রসারণের সাথে সাথে তা চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে, কিংবা একেবারেই নগণ্য স্তরে।  বিজ্ঞানী শন ক্যারল তার ‘ফ্রম ইটারনিটি টু হেয়ার’ গ্রন্থে একে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে

[15]
‘মনোপোল সমস্যার কথাই ধরুন। আদি মহাবিশ্বে এই মনোপোল প্রচুর পরিমাণে তৈরি হয়েছিল। এখন চিন্তা করুন, মনোপোল তৈরির আগেই ইনফ্লেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।  এর ফলে ইনফ্লেশন যতক্ষণ টিকে থাকবে, আনুষঙ্গিক স্থান প্রসারিত হবে এত দ্রুতগতিতে যে মনোপোলগুলো লঘূকৃত হতে হতে শূন্যতায় মিলিয়ে যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ডার্ক সুপার এনার্জি (ইনফ্লেটন)  অবক্ষয়িত হয়ে পদার্থে পরিণত হবে,  এবং তেজস্ক্রিয়তা আর কোন মনোপোল তৈরি করবে না – আর তারপর –হিং টিং ছট  – মনোপোল সমস্যা উধাও হয়ে যাবে’।


সামতলিক সমস্যা
স্ফীতিতত্ত্ব সবচেয়ে আকর্ষণীয়ভাবে যে সমস্যাটির সমাধান করেছিল সেটা হল সামতলিক সমস্যা।  অন্যগুলো যদি বাদও দেই, এই একটি সমস্যা সার্থক ভাবে সমাধানের কারণেই স্ফীতি-তত্ত্বকে এত গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে শুরু করলেন মূল ধারার জ্যোতির্পদার্থবিদরা।
সামতলিক সমস্যা বলে যে কিছু একটা আসলে ছিল সেটা গুথ প্রথমে জানতেন না। তখন তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চ করছিলেন। সেটা সেই ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আইনস্টাইন দিবস’ উপলক্ষে একটা আলোচনা সভায় প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ রবার্ট ডিকির  বক্তৃতা  দেবার কথা ছিল। সে সময় গুথ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানকে দেখতেন  এক ধরণের অস্পষ্ট  ঘোলাটে বিষয় হিসেবে, যার কোন সঠিক গন্তব্য নেই, নেই কোন দিক নির্দেশনা। এর চেয়ে কণা-পদার্থবিজ্ঞানের সাজানো গোছানো কাঠামোটাই ছিল তার কাছে  ঢের উপাদেয়!  গুথ তার বইয়ে বলেছেন, “যদি সপ্তাহটাতে আরেকটু বেশি ঝামেলা থাকতো,  তাহলে হয়তো ডিকির লেকচার শুনতে যাওয়া হত না’।
কিন্তু সৌভাগ্যবশত সে সপ্তাহে ঝামেলা টামেলা তেমন কিছু ছিল না, আর  গুথও যথারীতি লেকচার শুনতে যেতে পারলেন।  সেখানে গিয়ে গুথ দেখলেন -ডিকির বক্তৃতার মূল বিষয় হচ্ছে ফ্ল্যাটনেস প্রবলেম বা  ‘সামতলিক সমস্যা’ ; এটি নাকি মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের জন্য সবচেয়ে বড় একটা ধাঁধা।  ডিকি তার বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করলেন, আমাদের মহাবিশ্বকে ‘দেখলে’ মনে হয় তা যেন অতিমাত্রায় ‘ফ্ল্যাট’। এর মানে, আমাদের মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে ‘বদ্ধ’ আর ‘উন্মুক্ত’ মহাবিশ্বের মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে খুব কায়দা করে গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে। সেটা কীভাবে বলার আগে বদ্ধ আর উন্মুক্ত মহাবিশ্ব নিয়ে দু চার কথা বলে নেয়া যাক। বদ্ধ মহাবিশ্ব হচ্ছে সেই মহাবিশ্ব যা প্রসারিত হতে হতে  একসময় মাধ্যাকর্ষণের টানে  আবার চুপসে যেতে শুরু করবে। অন্য দিকে উন্মুক্ত মহাবিশ্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে কেবল প্রসারিতই হতে থাকবে ক্রমাগত।  আর ডিকির আলোচিত ফ্ল্যাট বা সামতলিক মহাবিশ্ব থাকবে এই দুইয়ের মাঝামাঝি। এই সামতলিক মহাবিশ্ব প্রসারিত হবে বটে, তবে কোন রকমে পাশমার্ক পেয়ে পাশ করে যাওয়া ছাত্রের মত টায়ে টায়ে। ফেল করার হাত থেকে খুব কায়দা করে গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে। এখন মহাবিশ্ব উন্মুক্ত হবে না বদ্ধ হবে নাকি সামতলিক হবে, তা নির্ভর করে মহাবিশ্বের ভর তথা গড় ঘনত্বের উপর।  মহাবিশ্বের প্রকৃত ঘনত্ব আর সন্ধি ঘনত্ব (অর্থাৎ যে ঘনত্ব মহাবিশ্বকে চুপসে দেবার জন্য যথেষ্ট) –এর অনুপাতকে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেন গ্রীক অক্ষর ওমেগা (Ω)  দিয়ে।  মহাবিশ্বকে সামতলিক বা ফ্ল্যাট হতে হলে এর মান হতে হবে ১ এর কাছাকাছি।
ডিকির লেকচার শেষে নিজের বাসায় গিয়ে খাতাকলম নিয়ে বসলেন গুথ ।  দেখলেন প্রমিত বিগ ব্যাং মডেলে সামতলিক মহাবিশ্ব পেতে হলে  মহাবিশ্বের শুরুতে ওমেগার মান শুধু ১ এর কাছাকাছি নয়, এক্কেবারে সমান হতে হবে। একটু কম বেশি হলেই ভ্যারাচ্যারা লেগে যাবে। যেমন,  ১ এর চেয়ে একটু কম মান নিয়ে যাত্রা শুরু করলেই দেখা যাবে কিছুদিন পর তা কমতে কমতে ১ এর এত নীচে চলে যাবে যে সেই মহাবিশ্বে গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা  তৈরি হবার মত কোন পরিবেশই গঠিত হবে না।  আবার ১ এর চেয়ে সামান্য বেশি মান নিয়ে যাত্রা শুরু করলে হবে আরেক বিপদ। কিছুদিনের মধ্যেই এই মান বাড়তে বাড়তে এত বেশি  হয়ে যাবে যে,  এই মহাবিশ্ব আর প্রসারিত না হয়ে তাৎক্ষনিক ভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়বে নিজের ঘারেই।
কারণটা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। আজকের যে মহাবিশ্বের ছবি আমরা দেখি, সেটা  আদি মহাবিশ্বের  অন্তত এক লক্ষ কোটি গুন আকারে বেড়েছে। তাই, মহাবিশ্ব যদি শুরুতে  ক্রান্তি ঘনত্বের তার চেয়ে শতকরা দশভাগ কম বা বেশি মান নিয়ে যাত্রা শুরু করতো, তবে আজকে আমাদের মহাবিশ্বের ঘনত্বের মান  অন্তত এক লক্ষ কোটি গুন পার্থক্য পাওয়া যেত।
এই পুরো ব্যাপারটাকে নীচের সমীকরণের  সাহায্যে লেখা যায় এভাবে –

গুথ গণনা করে দেখলেন, মহাবিস্ফোরণের ১ সেকেন্ড পরে ভর ঘনত্বের মান ক্রান্তীয় ঘনত্বের ০.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯ গুণ থেকে ১.০০০০০০০০০০০০০০১ এর মধ্যে থাকতে হবে, নইলে আজকের এই সামতলিক মহাবিশ্ব পাওয়া যাবে না।
এবার স্ফীতিকে গোনায় ধরে আবারো ক্যালকুলেশন করলেন গুথ। এবারে যে সমীকরণ পেলেন তা উপরেরটা থেকে একেবারেই ভিন্ন। তার প্রকৃতি হল এরকমের –
যেখানে $latex H_{inf} $ হচ্ছে স্ফীতি চলাকালীন সময়ে হাবলের প্যারামিটার।  সমীকরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বাম পাশে যে মান নিয়েই ওমেগা যাত্রা শুরু করুক না কেন, $latex t $ এর মান যত বাড়বে, ডানপাশের চলকটি ( $latex e^{-2H_{inf}t} $ )  তত ০ এর কাছাকাছি চলে যাবে।  ডানপাশের চলক শূন্য হয়ে যাবার অর্থ হল, ওমেগা (Ω)-এর মান   ১ এর কাছাকাছি চলে যাওয়া।
গণিত থেকে পাওয়া এই ফলাফল সত্যই দুর্দান্ত।  প্রমিত বিগ ব্যাং থেকে পাওয়া  আগের উপসংহার  ছিল – ওমেগার মান ১ এর সমান হতে হবে খাপে খাপ (কিছু বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখেছিলেন সেটা হতে হবে ১০১৫ ভাগের ১ ভাগ সূক্ষ্মতায়

[16])। গুথ তার গণনায় দেখালেন –  না, ওমেগাকে যাত্রা শুরুর সময় এত সূক্ষ্মভাবে সমন্বিত (Fine tuned) হবার দরকার নেই। প্রমিত বিগ ব্যাং মডেলে যেখানে সামান্য হেরফের হলেই ওমেগার মান ১ এর  থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল, সেখানে স্ফীতিতত্ত্ব একেবারে বিপরীত উপসংহার নিয়ে আসল। দেখা গেল  ১, ১০০০, ১,০০০,০০০, .০০০১ অথবা .০০০০০১ কিংবা এ ধরণের যে কোন মান দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও স্ফীতির কারণে ওমেগার মান ১ থেকে দূরে সরে না গিয়ে বরং সবসময়ই ১ এর দিকে চলে আসে, আর মহাবিশ্বকে করে তোলে পুরোপুরি সামতলিক।

চিত্র: সামতলিক সমস্যার সমাধান  – যে কোন মান দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও স্ফীতির কারণে ওমেগার মান ১ থেকে দূরে সরে না গিয়ে বরং সবসময়ই ১ এর দিকে চলে আসে, আর মহাবিশ্বকে করে তোলে সামতলিক।

ঠিক তখনই গুথ বুঝতে পারলেন তিনি মহাবিশ্বের অন্তিম রহস্যটা এক ধাক্কায় সমাধান করে ফেলেছেন, তিনি তার ডায়রির পাতায়  শিরোনাম দিলেন ‘স্পেক্টেকুলার রিয়েলাইজেশন’  বা ‘অভাবনীয় অনুভব’ ; তারপর ওটার চারিদিকে  ডবল মার্জিন দেয়া বক্স করে লিখলেন –
অভাবনীয় অনুভব:
এ ধরণের অতিশীতীভূতকরণ ব্যাখ্যা করতে পারে কেন আমাদের মহাবিশ্ব আজকে এত প্রত্যয়াতীতভাবে  সমতল, এবং সেই সঙ্গে এটি রবার্ট ডিকি আইনস্টাইন দিবসের দিনের লেকচারে যে সূক্ষ্ম সমন্বয়ের ধাঁধা উপস্থাপন করেছিলেন, সেটারও সমাধান দিয়ে দেয়।

চিত্র: ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখে লেখা ‘অভাবনীয় অনুভব’  নোট সম্বলিত অ্যালেন গুথের ডায়রি।
গুথ তার গণনার ফলাফলগুলো ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস জার্নালে জার্নালে প্রকাশের জন্য পাঠালেন  সে বছরই ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে। সহকর্মী হেনরি তাই এর সাথে যৌথভাবে লেখা সেই গবেষণাপত্রটি জার্নালে আলোর মুখ দেখেছিল  ১৯৮০ সালে

[17]।  এর পরের বছর প্রকাশিত হয় গুথের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পেপার।  ১৯৮১ সালে ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত এ গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিল  ‘স্ফীতিময় মহাবিশ্ব: দিগন্ত এবং সামতলিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান’

[18]

সাফল্য এবং প্রতিক্রিয়া
গুথের গবেষণার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রকাশিত হলেও  প্রাথমিকভাবে  গুথ একটু ভীত ছিলেন এই ভেবে যে, হয়তো তার গণনায় কোথাও হয়ত ভুলত্রুটি আছে। বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা এর মধ্যেই তত্ত্বের ভুল বের করে ফেলবেন, এবং তিনি তার সহকর্মীদের মাঝে ঠাট্টা তামাসার পাত্র হয়ে উঠবেন।
তা অবশ্য হল না। আশির দশকে  গুথ যখন তার নতুন তত্ত্ব নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করেছিলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী মারে গেল-ম্যান উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘আপনি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটির সমাধান করে ফেলেছেন’।  এম আইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালেন পি লাইটম্যান তাঁর ধারণাটিকে অভিহিত করেছেন, ‘বিগ ব্যাং এর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাজাগতিক  ধারণার উন্নয়ন’ হিসেবে। আরেক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী শেল্ডন গ্ল্যাসো গুথের কাছে এসে বললেন, ‘গুথ,  স্টিভেন ওয়েইবার্গ কিন্তু ইনফ্লেশনের কথা শুনে খুব রেগে গেছেন’।
-‘তাই নাকি? স্টিভ কি কোন সমস্যা খুঁজে পেয়েছেন?’ – উদ্বিগ্ন গুথ প্রশ্ন করলেন গ্ল্যাসো কে। গ্ল্যাসোর সাথেই পদার্থবিজ্ঞানে ভাগাভাগি করে নোবেল  পেয়েছিলেন ওয়েনবার্গ। তাই স্টিভেন ওয়েনবার্গ কোন সমস্যা খুঁজে পেলে তা নির্ঘাত বিপদের কথা, জানতেন গুথ।
-‘ নাহ!’ আস্বস্ত করলেন গ্ল্যাসো – ‘এই স্ফীতির ব্যাপারটা তার নিজের মাথায় আসেনি কেন, এ নিয়ে ক্ষুব্ধ স্টিভ!’
নাহ, স্ফীতিতত্ত্ব  পদার্থবিজ্ঞানীদের  মধ্যে কোন সমস্যা তৈরি করল না, বরং বড় ধরনের আলোড়নই ফেলে দিল বিজ্ঞানীদের মাঝে। মূলধারার বিজ্ঞানীরা স্ফীতি তত্ত্বকে সাদরেই গ্রহণ করলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী কয়েক বছর ধরে স্ফীতি নিয়ে গবেষণাপত্রের লাগাতার প্রকাশে। একটা সময় গুথ হিসেব করতে বসেছিলেন কয়টা পেপারে স্ফীতিতত্ত্বের উল্লেখ আছে। প্রথম বছরই অন্তত ৪০ টি পেপারে গুথের কাজের উল্লেখ থাকলো। তারপর থেকে যেন এটা বাড়তে লাগল প্রায় গুণোত্তর হারেই। ১৯৯৭ সালে তার বিখ্যাত ‘দ্য ইনফ্লেশনারি ইউনিভার্স’ বইটি লেখার আগ পর্যন্ত হিসেব করে দেখেছিলেন অন্তত ৩০০০টা পেপারে ইনফ্লেশন নিয়ে গবেষণার হদিস আছে; তারপর গোনাগুনি ছেড়ে দিয়েছিলেন গুথ।  সে সব নিত্য নতুন গবেষণাপত্রে পুরাতন স্ফীতি, নতুন স্ফীতি, কেওটিক স্ফীতি,   হাইব্রিড স্ফীতি, হাইপারটেক্সট স্ফীতি থেকে শুরু করে ‘ওয়ার্ম’, ‘সফট’, ‘টেপিড’, ‘ন্যাচারাল’ সহ বিভিন্ন ধরণের স্ফীতির ভাষ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়
[19]।  তবে স্ফীতির যে নতুন ভাষ্যই তৈরি হোক না কেন, তাকে যাত্রা শুরু করতে হয় গুথ বর্ণিত উচ্চ শক্তি ঘনত্ব বিশিষ্ট সেই ‘ফলস ভ্যাকুয়াম’  ধরণের স্তর থেকে, আর করতে হয় কোন না কোনভাবে বিকর্ষণমূলক মহাকর্ষের প্রয়োগ

[20]।   শুধু পেপারেই নয়, সাফল্য এলো তার নিজের কর্মজীবনেও। এক অখ্যাত অচেনা পোস্ট ডক্টরেট ফেলো থেকে রাতারাতি পরিণত হলেন এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের  পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকে; পরিণত হলেন মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একজন শীর্ষস্থানীয় কাণ্ডারিতে।

এরপর যতদিন গেছে স্ফীতিতত্ত্ব কেবল জোরালো থেকে জোরালই হয়ে উঠেছে কেবল।  যত দিন যাচ্ছে স্ফীতিতত্ত্বে পক্ষে প্রমাণের পাহাড় কেবল  বাড়ছেই। স্ফীতিতত্ত্ব কেবল বিগ ব্যাং-এর মনোপোল, দিগন্ত বা সামতলিক সমস্যা জাতীয় সমস্যাগুলোই সমাধান করেনি, দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। একটি হল, মহাবিশ্বের জ্যামিতি হতে হবে সামতলিক, অর্থাৎ ওমেগা (Ω)-র মান হবে ১ এর একদম কাছাকাছি।  আর দ্বিতীয়টি হল, আদি মহাবিশ্বের সঠিক ছবি কেউ তুলতে পারলে সেখানে কিছু বিশেষ প্যাটার্নে  ঘনত্বের পার্থক্য বা ফ্লাকচুয়েশন পাওয়া যাবে।  দুটোই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।  ২০১৩ সালে ‘স্কাই এন্ড টেলিস্কোপ’ ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী এন্থনি এগুরি  বলেন

[21],
‘দুটো ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতাই নির্ণীত হয়েছে নাসার উইলকিনসন মাইক্রোওয়েভ অ্যানিসোট্রপি প্রোব স্যাটেলাই্টের  পাঠানো উপাত্তের মাধ্যমে।  স্ফীতিতত্ত্ব উত্তীর্ণ হয়েছে সময় সময় এ ধরনের বিভিন্ন পর্যবেক্ষিত পরীক্ষার মাধ্যমে  খুব দুরন্তভাবেই।  স্ফীতির যে প্রসারণের কথা আমরা বলি সেটা বোধহয় সত্যই ঘটেছিল ’।
তবে পরিস্থিতি প্রথম থেকেই এরকম কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।  ওমেগার সঠিক মান নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক ছিল অনেকদিন ধরেই। যদিও গুথের গণনা ইঙ্গিত করছিল স্ফীতিতত্ত্ব সঠিক হলে, ওমেগার মান ১ এর কাছাকাছি হতেই হবে, কিন্তু সত্যই সেটা ১ কিনা বহুদিন পর্যন্ত আমরা জনতে পারিনি।  শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল টার্নার অবশ্য লরেন্স ক্রাউসের সাথে মিলে মাঝখানে (১৯৮৫ সালে এবং ১৯৯৫ সালে) দুটো পেপার লিখেছিলেন।  সেখানে তারা দাবী করেছিলেন যে মহাবিশ্বের জ্যামিতি হতে হবে সামতলিক

[22], কিন্তু তারপরও সেটা ঠিক কিনা কেউ নিশ্চিত ছিলেন না। ওমেগার মান পর্যবেক্ষণ থেকে আসছিল সর্বসাকুল্যে মাত্র ০.২ এর মত। অর্থাৎ মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব পাওয়া যাচ্ছিল সন্ধি ঘনত্বের মাত্র শতকরা ২০ ভাগ

[23]। আর সেটা তৈরি করেছিল  স্ফীতিতত্ত্বের জন্যও অস্বস্তিকর একটা ক্ষেত্র ।  হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট ক্রিশনার বলেছিলেন, ‘দিস ইনফ্লেশন  আইডিয়া সাউন্ডস ক্রেজি’।  অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রজার পেনরোজ বলেছিলেন,  ‘হাই এনার্জি ফিজিস্টিস্ট দের জ্যোতির্বিজ্ঞানে এসে নাক গলানোটা মনে হচ্ছে এক ধরণের ফ্যাশন হয়ে গেছে। … এমনকি কুৎসিত আর্ডভার্করাও ভাবে তার সন্তান খুব সুন্দর’। এর মধ্যে ১৯৮২ সালে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং নাফিল্ড ওয়ার্কশপ নামে একটা ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছিলেন,  যার অফিশিয়াল শিরোনাম ছিল ‘দ্য ভেরি আর্লি ইউনিভার্স’

[24]।  মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণারত ৩০ জন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীকে আহবান জানানো হয়েছিল সেই ওয়ার্কশপে।  অ্যালেন গুথ, পল স্টেইনহার্ট, মাইকেল টার্নার সহ অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীই উপস্থিত ছিলেন সেই ওয়ার্কশপে।  সেই ওয়ার্কশপ শেষে সারসঙ্কলন করতে গিয়ে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী উইলজেক খুব স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, ‘ওমেগার মান ১ এর কাছাকাছি পাওয়া না গেলে স্ফীতিতত্ত্বের কোন ভাত নেই’

[25]
কিন্তু সবকিছুই বদলে গেল যখন গুপ্ত পদার্থ (Dark Matter)  গুপ্ত শক্তি (Dark Energy)র খোঁজ পেলেন বিজ্ঞানীরা। গুপ্ত পদার্থের খোঁজ অবশ্য বিজ্ঞানীরা বেশ আগেই পেয়েছিলেন – ফ্রিৎস জুইকি এবং পরে ভেরা রুবিনের পর্যবেক্ষণের কল্যাণে সেই সত্তরের দশকেই। কিন্তু তারপরেও ওমেগার মান ১ এর কাছাকাছি আসছিল না; মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব  পাওয়া যাচ্ছিল ক্রান্তি ঘনত্বের কেবল এক তৃতীয়াংশ।  সোজা কথায় – আমাদের চেনা জানা পদার্থ আর গুপ্ত পদার্থ মিলিয়ে শতকরা ৩০ ভাগ পদার্থের সন্ধান আমরা পাচ্ছিলাম তখন। কিন্তু মহাবিশ্বকে সমতল প্রমাণ করার জন্য দরকার ছিল আরো ৭০ ভাগ শক্তির যা মহাবিশ্বের সামগ্রিক কাঠামোর উপর কোন প্রভাব ফেলবে না, কিন্তু সন্ধি ঘনত্বে পৌঁছানোর জন্য বাদবাকি শক্তির যোগান দেবে।  গণিতের ভাষায় বললে, আমাদের হাতে তখন  মানের সমান উপকরণ ছিল। মহাবিশ্বকে সমতল করার জন্য আমাদের দরকার ছিল বাদবাকি  এর হিসেব।  সেটাই পাওয়া গেল ১৯৯৮ সালে।  টাইপ ১এ সুপারনোভা নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীদের দুই দল সময়ের সাথে সাথে মহাবিশ্বের প্রসারণের হার কতটুকু কমছে সেটা বের করতে গিয়ে দেখেন, মহাবিশ্বের প্রসারণের হার আসলে কমছে না বরং সমানে বেড়ে চলেছে।  আর এই বেড়ে চলার পেছনে আছে এক অজ্ঞাত শক্তি – শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল টার্নারের সুপারিশ ক্রমে এর  নামকরণ করা হয়েছে ‘গুপ্ত শক্তি’ বা ডার্ক এনার্জি হিসেবে।  গুপ্ত শক্তির হদিস পাওয়ার পর পরই গণিতের হিসেবটা মিলে গেল খাপে খাপ –



 চিত্র:মহাবিশ্বের পদার্থের মধ্যে  কেবল শতকরা ৪ ভাগ চেনা জানা ব্যারিয়নিক পদার্থ দিয়ে গঠিত, যে পদার্থ দিয়ে গ্রহ, নক্ষত্র, গাছপালা কিংবা মানুষজন তৈরি হয়েছে বলে আমরা জানি। বাদবাকি পদার্থের শতকরা ২৩ ভাগ হচ্ছে গুপ্ত পদার্থ, যাদের ল্যাবরেটরিতে সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে না করা গেলেও মাধ্যাকর্ষণের উপর এর প্রভাব সনাক্ত করা হয়েছে। বাকি শতকরা ৭৩ ভাগ তৈরি হয়েছে আরো রহস্যময়  গুপ্ত শক্তি দিয়ে যা মহাবিশ্বের প্রসারণকে ত্বরান্বিত করছে।

কেবল গুপ্ত শক্তির হিসেব থেকেই নয়, মহাবিশ্বের জ্যামিতি যে সামতলিক, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করেও। প্রথম প্রমাণ এসেছিল ১৯৯৭ সালের দিকে যখন একদল বিজ্ঞানী অ্যান্টার্কটিকায়  বড় সড় বেলুন উড়িয়ে  মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের প্রকৃতি ধরার চেষ্টা করলেন। তারা তাঁদের বেলুনে লাগিয়ে দিয়েছিলেন খুব সংবেদনশীল এক টেলিস্কোপ। সে বেলুন  মাটির ১২০,০০০ ফুট উপর থেকে সাড়ে দশ দিন ধরে ডেটা সংগ্রহ করে ফলাফল প্রকাশ করল। সে ফলাফল বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন যে মহাবিশ্বের প্রকৃতি সত্যই সমতল।

চিত্র: বুমেরাং প্রজেক্ট থেকে পাওয়া ডেটা আমাদের নিশ্চিত করেছে যে মহাবিশ্বের জ্যামিতি সামতলিক (মাঝের ছবি)। যদি মহাবিশ্বের প্রকৃতি সামতলিক না হয়ে বদ্ধ হত, তবে উত্তপ্ত অঞ্চলের (hot spot) চেহারা পাওয়া যেত বাম পাশের মত, আর এর প্রকৃতি যদি উন্মুক্ত হত, তবে আমরা পেতাম ডানপাশের মত।

আরো নিখুঁত ফলাফল পাওয়া গেল  কয়েক বছর পরে WMAP-এর উপাত্ত  বিশ্লেষণ করে। সেখানে ওমেগার মান পাওয়া গেছে   $latex \Omega = 1.02 \pm 0.02 $ , যা স্ফীতিতত্ত্বের অনুমানের সাথে প্রায় অবিকল মিলে যায়

[26]।  বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ২০১৩ সালে নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে বলেই ফেললেন, ‘ডব্লিউম্যাপ থেকে পাওয়া স্ফীতির সাক্ষ্যগুলো আমার পেশাগত জীবনে সবচেয়ে চমকপ্রদ সাফল্য’।
গুপ্ত শক্তি নামে হারানোর শক্তির আবিষ্কার এবং ডব্লিউম্যাপ ডেটা থেকে পাওয়া নিখুঁত পর্যবেক্ষণ  সমতল মহাবিশ্ব  নিয়ে সব বিতর্কের মোটামুটি যবনিকাপাত ফেলে দেয়;  এবং সেই সাথে স্ফীতি তত্ত্বের সফলতার মুকুটে  যোগ করে এক নতুন পালক।  ২০০১ সালে অ্যাস্ট্রোনমি ম্যাগাজিন শিরোনাম করল, ‘মহাবৈশ্বিক সুর গাইছে স্ফীতির গান’। এর দু মাস পরেই ফিজিক্স টুডেতে নিবন্ধিত হল আরেকটি প্রবন্ধ  ‘স্ফীতিতত্ত্বের আরেকটি বিজয়’

[27] শিরোনামে।  স্ফীতিতত্ত্ব পরিণত হল মহাজাগতিক গবেষণার অন্যতম সজীব একটি ক্ষেত্রে।
খুব সম্প্রতি স্ফীতি তত্ত্বের মুকুটে পড়েছে সাফল্যের আরেকটি বড় পালক। স্ফীতি তত্ত্বের একটি বড় অনুমান ছিল, প্রচণ্ড রকমের স্ফীতির মধ্য দিয়ে আমাদের মহাবিশ্ব উদ্ভূত হয়ে থাকে, তবে সেই ধাক্কার কিছুটা রেশ মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আকারে আমাদের খুঁজে পাওয়ার কথা।  এই মহাকর্ষ তরঙ্গ বয়ে নিয়ে যায় যে হাইপোথিটিকাল কণা, বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছিলেন গ্র্যাভিটন। ফোটন কণার কথা যে আমরা অহরহ শুনি সেটা আলোক কণিকা বা তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ বয়ে নিয়ে যায়।  তড়িচ্চুম্বক বলের ক্ষেত্রে বার্তাবহ কণিকা যেমন হচ্ছে  ‘ফোটন কণিকা’, তেমনি সবল নিউক্লিয় বলের ক্ষেত্রে আছে ‘গ্লুয়োন’ (Gluon) আর দুর্বল নিউক্লিয় বলের জন্য রয়েছে  W এবং Z কণা। মহাকর্ষের ক্ষেত্রেও তেমনি কল্পণা করা হয়েছে গ্র্যাভিটন কণার। সেই ১৯১৯ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের প্রমাণ পাওয়ার পর থেকেই বিজ্ঞানীরা জানতেন মহাবিস্ফোরণের প্রমিত মডেল সঠিক হলে এই মহাকর্ষ তরঙ্গ একদিন না একদিন খুঁজে পাবেন তারা।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মহাকর্ষীয় এ তরঙ্গ খুব দুর্বল তরঙ্গ। এটা এমনিতে খুঁজে পাওয়া মুশকিলই।  গ্র্যাভিটনের সাথে পরিচিত পদার্থের মিথষ্ক্রিয়া এতোই দুর্বল যে এটা মানবীয় পরিমাপণের সীমার বাইরে বলেই এতোদিন ধরে নেয়া হত। কিন্তু সেই অসাধ্যই সম্পন্ন করেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সম্প্রতি (মার্চ, ২০১৪) জন কোভাক সহ  ‘হার্ভাড স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’ এর সাথে নিযুক্ত পদার্থবিজ্ঞানীরা মহাকর্ষ তরঙ্গ সনাক্ত করতে পেরেছেন বলে দাবী করা হচ্ছে। অ্যান্টার্কটিকায় পরিচালিত  BICEP2 experiment নামক পরীক্ষার মাধ্যমে এই তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে বলে মিডিয়ায় এসেছে।
যেভাবে সনাক্ত করা হয়েছে, তার মূল ব্যাপারটি বর্ণনা করলে দাঁড়াবে এরকমের । বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সরাসরি দেখতে পান না বটে, কিন্তু আদি মহাবিশ্ব থেকে আসা তরঙ্গের প্রভাব আলোর উপরে কেমন সেটা তারা  সনাক্ত করতে পারেন। বিজ্ঞানীরা জানেন যে, তরঙ্গ আলোকে ‘পোলারাইজ’ করে দিতে পারে। আলো বিভিন্নভাবে পোলারাইজড হতে পারে, কিন্তু স্ফীতির উপজাত হিসেবে পাওয়া মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ  একটি বিশেষ উপায়েই আলোর এই পোলারাইজেশন ঘটাতে পারে। বিজ্ঞানীরা একে বলেন, ‘B mode polarization’।  এ পোলারাইজেশন  কিভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা বের করতে গিয়ে অবশ্য তাদের বিশ্লেষণ করতে হয়েছিল মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের ‘ক্লাম্পস’ এবং ‘জিগেলস’ এর কৌনিক গতিপ্রকৃতি সহ বহুকিছু। আর এগুলো বিশ্লেষণ করেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব সম্বন্ধে।
এই আবিষ্কারের ফলে মহাকর্ষ আসলেই যে একটি কোয়ান্টাম ঘটনা থেকে উদ্ভূত উদ্ভাস – বিজ্ঞানীদের অনেক দিনের ধারণার প্রমাণ পাওয়া গেল।  স্বয়ং জন কোভাক ‘নেচার’ জার্নালের সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন –
জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে জড়িত সবাই জানে, হয়তো স্পষ্ট করে বলে না যে, স্ফীতি থেকে পাওয়া ‘বি মোড’ এর ভবিষ্যদ্বাণী কেবল মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের ঘটনাই নয়, সেই সাথে মকাকর্ষ নিজেও যে কোয়ান্টাইজড – সেটার ইঙ্গিতবাহী। স্ফীতিতত্ত্বের অনুমান ছিল, সবকিছুই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন থেকে উদ্ভূত, এবং স্ফীতির মাধ্যমে বিবর্ধিত হয়েছে। কাজেই গভীর স্তরে গিয়ে চিন্তা করলে, এই আবিষ্কার কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং মহাকর্ষের সাথে সম্পর্কের স্থাপনার উপর দাঁড়িয়ে আছে।
সেইসাথে মহাবিশ্ব যে এক ধরণের কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনেরই ফসল এই ধারণা আরো পাকাপোক্ত হয়ে উঠল।

স্ফীতি তত্ত্বের বিবর্তন
১৯৮১ সালে দেওয়া অ্যালেন গুথের স্ফীতিতত্ত্ব  বিজ্ঞানীরা খুব সাদরে গ্রহণ করলেও  মূল ভাষ্যে একটা ছোট সমস্যা ছিল। গুথ স্ফীতির শুরুটা কীভাবে ঘটবে সেটা বুঝতে পারলেও এর সমাপ্তি কীভাবে ঘটবে সেটার সুরাহা তিনি করতে পারছিলেন না।  এ যেন অনেকটা মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অভিমন্যুর মত অবস্থা। অভিমন্যু চক্রব্যূহে প্রবেশের কৌশল জানতেন, কিন্তু নির্গমের কৗশল জানতেন না।
আসলে সমস্যাটা করেছিল প্রকৃত ভ্যাকুয়ামে উত্তরণের সময় মেকি ভ্যাকুয়ামের  অবক্ষয়। গুথ দেখছিলেন, এই মেকি ভ্যাকুয়ামের অবক্ষয়ের ফলে অসংখ্য বুদ্বুদ তৈরি হয়।  অনেকটা একটা পাত্রে পানি নিয়ে চুলায় ফুটাতে থাকলে আমরা যেমন দেখি, অনেকটা সেরকমের। কিন্তু গুথের মডেলে পাওয়া বুদ্বুদগুলো ছিল মহা বদ খদ। তারা একে অপরের সাথে সংঘর্ষ ঘটিয়ে  অতি দ্রুত এমন ‘ভ্যারাচ্যারা অবস্থা’ তৈরি করে যে  মহাবিশ্বের সমসত্ত্ব অবস্থার একেবারে বারোটা বেজে যায়। অর্থাৎ গুথের মূল মডেল সত্য হলে মহাবিশ্ব আজকের দিনের মত এত সুষম হবার কথা নয়। কাজেই কোথাও একটা ঝামেলা আছে। এই ঝামেলার ব্যাপারটা অবশ্য গুথের নিজেরই নজরে পড়েছিল

[28]।  সেই সাথে পড়েছিল আরেক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর অভিজ্ঞ চোখেও। হকিং একটু ভিন্ন দিক থেকে গণনা করে সিদ্ধান্তে এলেন,  বুদ্বুদগুলোর সংঘর্ষ কোন সমস্যা করবে না, কিন্তু বুদ্বুদগুলোর তুলনায় মহাবিশ্ব এত দ্রুত প্রসারিত হবে যে কোন ধরণের সংঘর্ষ ঘটারই সুযোগ পাবে না, আর সেটা মহাবিশ্বকে এক সময় পরিণত করবে এক ‘এম্পটি ইউনিভার্স’ এ; এর কোন কোন জায়গায় প্রতিসাম্যতার ভাঙ্গন ঘটবে, কোন কোন জায়গা থেকে যাবে অক্ষত।  এই মহাবিশ্ব মোটাদাগে পরিণত হবে সমরূপতা বিবর্জিত এক মহাবিশ্বে যা মোটেই আমাদের আজকের মহাবিশ্বের মতো নয়

[29]।  কাজেই গুথের ‘পুরাতন’ এ স্ফীতিতত্ত্ব অনুযায়ী হয় বুদবুদের স্থানান্তর ঘটবে এত দ্রুত যে যথেষ্ট স্ফীতি ঘটার সুযোগ থাকবে না, আর নয়তো এত ধীরে এগুবে যে,  মহাবিশ্ব স্ফীতি থেকে বেরুতেই পারবে না। এই সমস্যাটিকে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘মার্জিত নির্গমন সমস্যা’ (graceful exit problem)  হিসেবে।
এই সমস্যাটির সমাধান হাজির করলেন রুশ বিজ্ঞানী আঁদ্রে লিণ্ডে ১৯৮২ সালে

[30] (এর কিছুদিন পরেই  আরো দুই বিজ্ঞানী – পল স্টেইনহার্ট এবং আলব্রিচট স্বতন্ত্রভাবে গবেষণা করে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হন)।  লিণ্ডে দেখলেন বুদবুদের সংযোগের সমস্যাকে সহজেই সমাধান করা যায় যদি  মেকি ভ্যাকুয়ামের অবক্ষয়ের সময় উদ্ভূত বুদ্বুদগুলোকে শুরুতেই কোন না কোনভাবে একটি বড় সড় বুদবুদের ভিতরে সাঁটানো যায়।  এর ফলে মহাবিশ্বের সমসত্ত্ব অবস্থা যেমন রক্ষা করা যায়, ঠিক তেমনি পাওয়া যায় ‘মার্জিত নির্গমন সমস্যা’ থেকেও মুক্তি।  এটা অবশ্য এমনি এমনি ঘটেনি; এর জন্য অবশ্য স্কেলার ফিল্ডের চালচলনে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছিল লিণ্ডেকে। পুরনো স্ফীতিতত্ত্ব অনুযায়ী যেখানে হিগস ক্ষেত্রের মান একটি খাড়া মালভূমির ঢাল বেয়ে নীচে নামতে  হত, এবং তাকে নির্ভর করতে হত রহস্যময় ‘কোয়ান্টাম টানেলিং’ প্রক্রিয়ার উপর, সেখানে  লিণ্ডের নতুন মডেলে  কোন ধরণের টানেলিং এর দরকার পরে না, কারণ সেখানে মালভূমি থাকে অপেক্ষাকৃত নিচু আর সমতল। মেকি ভ্যাকুয়াম থেকে প্রকৃত ভ্যাকুয়ামে পৌঁছুতে হলে এই মালভূমির ঢাল বেয়ে শক্তি ঘনত্বের নীচে নেমে আসতে হবে অত্যন্ত ধীর লয়ে। প্রতিসাম্যতার ভাঙ্গন ঘটবে  অতি ধীর গতিতে।  তার এই নতুন ঢিলে ঢালা মডেলকে নামাঙ্কিত করা হয়েছে ‘নতুন স্ফীতিতত্ত্ব’ হিসেবে।
  চিত্র:  পুরাতন স্ফীতি বনাম নতুন স্ফীতি।  নতুন স্ফীতিতত্ত্ব শক্তি ঘনত্বের ঢাল থাকে অপেক্ষাকৃত নিচু আর সমতল। এই মডেল ‘মার্জিত নির্গমন সমস্যা’ থেকে আমাদের মুক্তি দেয়।

কিন্তু এই ‘নতুন স্ফীতিতত্ত্ব’ও একেবারে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর ছিল না।  তথাকথিত ‘মার্জিত নির্গমন সমস্যা’ থেকে এই মডেল আমাদের মুক্তি দিলেও এর প্রক্রিয়া ছিল অপেক্ষাকৃত জটিল এবং আদপে যে মোটেই বাস্তবসম্মতও নয় সেটা লিণ্ডেও স্বীকার করেছিলেন

[31]। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে লিণ্ডে সমস্ত জটিলতা থেকে মুক্ত এক ‘সুন্দর’ স্ফীতিতত্ত্বের ভাষ্য আমাদের উপহার দিলেন।  এই ভাষ্য আগের স্ফীতিতত্ত্বগুলোর চেয়ে অনেক  সরল – এতে কোয়ান্টাম  টানেলিং, কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি এফেক্ট, ফেইজ ট্রাঞ্জিশন কিংবা সুপার কুলিং – কোন  অনুকল্পকেই স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে নেওয়ার দরকার নেই।  এমন কি দরকার নেই বিগ ব্যাং এর সেই অতি উত্তপ্ত অসীম ঘনত্বের কোন পরিবেশ কল্পনারও।  কেবল স্কেলার ক্ষেত্রের বিভিন্ন মান পরিবর্তন করে আমরা বিভিন্ন ধরণের স্ফীতি পেয়ে যাই আমরা। এই স্ফীতির বিভিন্ন মান থেকে আবার তৈরি হয়  ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বের যে সব মহাবিশ্বের একেকটাতে একেক ধরণের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র কাজ করতে পারে।

চিত্র:  বিজ্ঞানী  আঁদ্রে লিণ্ডে তার ‘কেওটিক ইনফ্লেশন’ তত্ত্ব কম্পিউটারে সিমুলেশন করে দেখেছেন, স্ফীতিময় অঞ্চলগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র কাজ করে।   ছবির তীক্ষ্ণ চূড়াগুলো আসলে একেকটি নতুন ‘বিগ ব্যাং’ এবং চূড়ার উচ্চতাগুলো মহাবিশ্বের শক্তি ঘনত্ব নির্দেশ করে।  ছবিতে চূড়ার শীর্ষে রঙ খুব দ্রুত স্পন্দিত হতে দেখা যাচ্ছে, এর মানে হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র সেখানে এখনো পুরোপুরি সুস্থিত হয়নি। এরা সুস্থিত হয় কেবল উপত্যকার কাছে এসে, যেখানে আমাদের মহাবিশ্বের মত একটি মহাবিশ্ব অবস্থিত বলে মনে করা হয়।

লিণ্ডের এই কেওটিক স্ফীতির একটা বৈশিষ্ট্য হল – এটা ‘চিরন্তন’ এবং ‘অবিরাম’, কারণ একবার এটা শুরু হলে এ আর থামে না, দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে

[32]। তাই এই তত্ত্বকে  ‘Eternal Inflation  নামেই অভিহিত করা হয় এখন।  তবে এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যটা অন্য জায়গায়।   স্ফীতির বিভিন্ন মান ক্রমাগতভাবে এখানে সেখানে ঘটাতে থাকে বিগ ব্যাং এর যা  জন্ম দিতে থাকে ছোট বড় নানা ধরনের মহাবিশ্বের

[33]।  এর কোনটাতে হয়তো প্রাণের অভ্যুদয়ের মতো পরিবেশ তৈরি হয় কোন এক গ্রহে গিয়ে, কোনটা হয়তো থেকে যায় সাহারা মরুভূমির মতো উষর আর বন্ধ্যা – সেখানে গ্রহ নক্ষত্র নীহারিকা তৈরি হবার মতো পরিবেশই তৈরি হয় না।  এটাই সেই বিখ্যাত ‘মাল্টিভার্স’ বা অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা যা এখন বিজ্ঞানীদের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। লিণ্ডে দেখালেন, মাল্টিভার্স আসলে স্ফীতি তত্ত্বের একটি স্বাভাবিক পরিণতিই

[34]। পরে অবশ্য স্ট্রিং তত্ত্ব থেকেও মাল্টিভার্সের স্বপক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে  লিওনার্ড সাসকিণ্ড সহ অন্যান্য স্ট্রিং তাত্ত্বিকদের গবেষণায়


[36]।  এ নিয়ে আমি মুক্তমনায় একটা লেখা লিখেছিলাম বছর খানেক আগে ‘মাল্টিভার্স : অনন্ত মহাবিশ্বের খোঁজে’ শিরোনামে।   মাল্টিভার্স নিয়ে আলোচনা এই অধ্যায়ের পরিসরের বাইরে রাখছি, কারণ এই বইয়ের পরবর্তী একটি অধ্যায়ে  বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আনব বলে ঠিক করেছি।
মাল্টিভার্স আছে কি নেই এ নিয়ে জমজমাট বিতর্ক করা গেলেও যে জিনিসটি ক্রমশ বিতর্কের ঊর্ধ্বে চলে যাচ্ছে তা হল স্ফীতিতত্ত্বের সাফল্য আর গুরুত্ব। সেই আশির দশকের শুরুতে গুথ এবং লিণ্ডের গবেষণাপত্র প্রকাশের পর বহুদিন পর্যন্ত স্ফীতিতত্ত্বের আসলে কোন যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। সম্প্রতি বিজ্ঞানী পল স্টেইনহার্ট এবং নেইল টুরক ‘চক্রাকার’ বা ‘সাইক্লিক মডেল’ নামে একটা তত্ত্বকে স্ফীতি তত্ত্বের বিকল্প হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করছেন অবশ্য। তবে মূলধারার বিজ্ঞানীরা এখনো এটাকে সেরকম কোন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ বলে কিছু মনে করেন না

[37]।  বরং ২০১২ সালে প্রকাশিত  ‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’ বইয়ে  বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস স্পষ্ট করেই বলেন, ‘বর্তমানে স্ফীতিতত্ত্বই হচ্ছে একমাত্র তত্ত্ব যা মহাবিশ্বের সমসত্ত্ব  প্রকৃতি এবং সামতলিক বৈশিষ্ট্য সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। অধিকন্তু স্ফীতিতত্ত্ব মহাবিশ্ব নিয়ে বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যার সবগুলোই এখন পর্যন্ত সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে’।
আমাদের কাছে স্ফীতিতত্ত্বের আবেদন অবশ্য আরো বৃহৎ পরিসরে।  আলেকজাণ্ডার ভিলেঙ্কিন যে কথাগুলো তার ‘মেনি ওয়ার্লডস ইন ওয়ান’ বইয়ে বলেছেন, সেগুলোর সাথে আমি খুবই একমত

[38]
‘স্ফীতিতত্ত্বের আবেদন অনেকক্ষেত্রেই ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের সাথে তুলনীয়। দুটি ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমন সমস্ত রহস্যের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যেগুলোকে একটা সময় মনে করা হত মানুষের জ্ঞানের বাইরে  কিংবা ঐশ্বরিক কিছু।  বিজ্ঞান তার হাত প্রসারিত করে কুসংস্কারকে হটিয়ে অজানাকে জয় করেছে’।
ভিলেঙ্কিন ভুল কিছু বলেননি। স্ফীতিতত্ত্ব আসলে আমাদের সবচেয়ে অন্তিম প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, আমাদের অস্তিত্বের  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রহস্যটির সমাধানের দিকে ইঙ্গিত করে – ‘কেন কোন কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?’ ; এবং,  এটি তৈরি করে প্রাকৃতিক-ভাবেই শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের  নান্দনিক একটি ক্ষেত্র।

শূন্য থেকে মহাবিশ্ব? অবিশ্বাস্য মনে হবে শুনলে। কিন্তু স্ফীতিতত্ত্ব সত্যি হলে এটাই হয়তো ঘটেছে বাস্তবে, তা আপাত দৃষ্টিতে যত অসম্ভবই  মনে হোক না কেন।  স্ফীতি তত্ত্বের গণিত থেকেই বেরিয়ে এসেছে এটা। ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ উদ্ভবের ব্যাপারটা কোন সায়েনফিকশন নয়, কিংবা নয় জুয়েল আইচের জাদু, বরং শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের ধারণাটা স্ফীতিতত্ত্ব থেকে আসা জোরালো অনুসিদ্ধান্তই। ধারনাটিকে গবেষণারত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা খুব গুরুত্বের সাথেই নিচ্ছেন এখন। তারা জানেন স্ফীতিতত্ত্ব থেকে আসা  অন্যান্য উপসংহারগুলো যেহেতু পর্যবেক্ষণের সাথে মিলে গেছে, এটাকে পাগলামো বলে উড়িয়ে দিলে খুব ভুল হবে। আর শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের ধারণাটা অবাস্তব হলে পদার্থবিজ্ঞানের নামকরা জার্নালগুলোতে এর উল্লেখ পেতাম না

[39], কিংবা বড় বড় বিজ্ঞানীদের লেখা (যেমন, অ্যালেন গুথের ‘ইনফ্লেশনারি ইউনিভার্স’, আলেকজাণ্ডার ভিলেঙ্কিনের ‘মেনি ওয়ার্ল্ডস ইন ওয়ান’, মিচিও কাকুর ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস’,  ব্রায়ান গ্রিনের ‘হিডেন রিয়ালিটি’, স্টিফেন হকিং এর ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ কিংবা  ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’, এবং লরেন্স ক্রাউসের সাম্প্রতিক ‘দ্য ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’) জনপ্রিয় ধারার বইগুলো বাজারে দেখতে পেতাম না।  স্ফীতি তত্ত্বের জনক অ্যালেন গুথ মহাবিশ্বকে অভিহিত করেছেন, ‘দ্য আল্টিমেট ফ্রি লাঞ্চ’ হিসেবে; তিনি স্ফীতি তত্ত্বের গণিত সমাধান করে উদ্বেলিত হয়ে  বলেন  –
‘গ্রীক দার্শনিক লুক্রেটিয়াস খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে একটি বই লিখেছিলেন De Rerum Natura (On the Nature of Things) নামে। সে বইয়ে একটা লাইন ছিল –‘শূন্য থেকে কোন কিছুই সৃষ্টি হতে পারে না’। … তার সেই দাবীর ২০০০ বছর পর আজ মহাজাগতিক স্ফীতি তত্ত্ব দাবী করছে, তার দাবী সঠিক ছিল না।
প্রাকৃতিক ভাবে মহাবিশ্বের তথা পদার্থের উদ্ভবের ব্যাপারটি আজ আর বিজ্ঞানের বাইরে নয়। দুই হাজার বছরের বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতি ইঙ্গিত করছে লুক্রেটিয়াস নির্ঘাত ভুল ছিলেন। সঠিকভাবে বললে, আমাদের চারদিকের  আদি উপাদানগুলোর সবকিছুই শূন্য থেকে তৈরি হয়েছে। “সবকিছু” বলতে কেবল আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যকার জিনিসগুলো নয়, এর বাইরের অনেক কিছুও এসে পড়বে।  মহাজাগতিক স্ফীতিতত্ত্বের কাঠামোতে বিচার করলে মহাবিশ্ব হচ্ছে আল্টিমেট ফ্রি লাঞ্চ’।

কিন্তু কীভাবে এত বিপুল মহাবিশ্ব, আর তার ভিতরের গ্রহ নক্ষত্র, সৌরজগৎগুলো – স্রেফ শূন্য থেকে রাতারাতি উদ্ভূত হতে পারে?  প্রক্রিয়াটা ঠিক কিরকমের? এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে পরবর্তী অধ্যায়ে …

তথ্যসূত্র:
[1] Brad Lemley and  Larry Fink, Guth’s Grand Guess, Discover, April 01, 2002
[2]  Alan Guth, The Inflationary Universe, Basic Books; 1st  Paperback Edition, 1998
[3] অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৫ (পুনর্মূদ্রন ২০০৬)
[4] Brian Greene, The Fabric of the Cosmos: Space, Time, and the Texture of Reality [Paperback], Vintage, 2005.
[5] Ken Olum (Institute of Cosmology, Tufts University), What powered the Universe’s early growth spurt?, Astronomy’s 60 Greatest Mysteries, Sky and Telescope, 2013
[6] Alan Guth, The Inflationary Universe, Basic Books; 1st  Paperback Edition, 1998
[7] Alex Vilenkin, Many Worlds in One: The Search for Other Universes, Hill and Wang; 2006
[8] Andrew R. Liddle  and David H. Lyth, Cosmological Inflation and Large-Scale Structure, Cambridge University Press, 2000
[9] ২০১২ সালের জুলাই মাসের চার তারিখে যখন হিগস প্রাপ্তির ঘোষণা দেয়া হয়, তার ক’দিন পরই আমি মুক্তমনায় একটা লেখা লিখেছিলাম ‘সার্ন থেকে হিগ্‌স বোসন – প্রলয়-নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে!’ শিরোনামে। সেখানে হিগস কণার বৈশিষ্ট এবং এর আবিস্কারের প্রক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেই সাথে যোগ করেছিলাম আমার সার্ন ভ্রমণের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও।  লেখাটি সেসময় বাংলা ব্লগে বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল।
[10] Sidney Coleman, The 1979 Nobel Prize In Physics, Science, December 1979: 1290-1292.
[11] Chris Impey (University of Arizona, Tucson), How Big is the Universe, Astronomy’s 60 Greatest Mysteries, Sky and Telescope, 2013
[12] George Gamow, One Two Three . . . Infinity: Facts and Speculations of Science, Dover Publications, 1988
[13] এ এম হারুন-অর-রশীদ এবং ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, অপূর্ব এই মহাবিশ্ব, প্রথমা, ২০১১। অথবা, সৈয়দা লাম্‌মীম আহাদ এবং ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, সবার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা, তাম্রলিপি, ২০১২
[14] In one paper published in 1979,  J. P. Preskill calculated that magnetic monopoles would be produced so copiously that they would outweigh everything else in the universe by a factor of about 1012. (Ref. Preskill, J. P. 1979, Phys. Rev. Lett., 43, 1365)
[15] Sean Carroll, From Eternity to Here: The Quest for the Ultimate Theory of Time, Dutton Adult, 2010
[16] R. H  Dicke, & Peebles, P. J. E., in General Relativity: An Einstein Centenary Survey, ed. S. W. Hawking & W. Israel (Cambridge: Cambridge Univ. Press),  1979
[17]     A. H. Guth and S.-H. H. Tye, “Phase Transitions and Magnetic Monopole Production in the Very Early Universe,” Phys. Rev. Lett. 44, 631, 1980.
[18] Alan H. Guth, The Inflationary Universe: A Possible Solution to the Horizon and Flatness Problems., Physical Review D, Volume 23, Issue 2, 1981
[19] Brad Lemley and  Larry Fink, Guth’s Grand Guess, Discover, April 01, 2002.
[20] A. D. Linde, Particle Physics and Inflationary Cosmology (Contemporary Concepts in Physics), vol 5, CRC Press, 1990
[21] Anthony Aguirre (University of California, Santa Cruz), How did Our Universe Come to be?, Astronomy’s 60 Greatest Mysteries, Sky and Telescope, 2013
[22] Michael S. Turner, Gary Steigman and Lawrence M. Krauss, Flatness of the Universe: Reconciling Theoretical Prejudices with Observational Data, Phys. Rev. Lett. 52, 2090–2093 , 1984
Also see, Lawrence M. Krauss and Michael S. Turner, The Cosmological Constant Is Back.,  General Relativity and Gravitation, Vol. 27, No. 11, page 1135; 1995.
[23] Richard Panek, The 4 Percent Universe: Dark Matter, Dark Energy, and the Race to Discover the Rest of Reality, Houghton Mifflin Harcourt; 2011
[24] G. W. Gibbons (Editor), S. W. Hawking (Editor), S. T. C. Siklos, The Very Early Universe: Proceedings of the Nuffield Workshop, Cambridge 21 June to 9 July, 1982
[25] Richard Panek, The 4 Percent Universe: Dark Matter, Dark Energy, and the Race to Discover the Rest of Reality, Houghton Mifflin Harcourt; 2011
[26] Alan H. Guth, Inflation, Carnegie Observatories Astrophysics Series, Vol. 2, Measuring  and  Modeling The Universe, 2004
[27] A. Guth,: Inflation and the New Era of High-Precision Cosmology. MIT Physics Annual, pp. 28– 39 , 2002
[28] A.H. Guth, & Weinberg, E.J. ‘Could the universe have recovered from a slow first-order phase transition?’, Nucl. Phys. B212, 321, 1983
[29] S.W. Hawking.,  Moss. I.G. & Stewart. J. M., Bubble collisions in the very early universe. Phys. Rev. D26. 2681, 1983.
[30] A. D. Linde, “A new inflationary universe scenario: A possible solution of the horizon, flatness, homogeneity, isotropy and primordial monopole problems,” Phys. Lett. B 108, 389 , 1982
[31] Andrei Linde, The Self-Reproducing Inflationary Universe , Scientific American, Vol. 271, No. 5, pages 48-55, November 1994
[32] Andrei Linde, Eternally Existing Self-Reproducing Chaotic Inflationary Universe, Phys. Lett. B175, 395 , 1986
[33] লিণ্ডে সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখায় বলেছেন, ‘এই প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে, ইনফ্লেশন বা স্ফীতি  বিগ ব্যাং তত্ত্বের অংশ নয়, যেটা ১৫ বছর আগেও সত্য বলে মনে করা হত, বরং বিগ ব্যাংই এখন ইনফ্লেশনারি মডেলের অংশ হয়ে উঠেছে’ (Scientific American, Vol. 271, No. 5, 1994)।
[34] স্ফীতি থেকে যে অনন্ত মহাবিশ্বের অভ্যুদয় ঘটে অতি স্বাভাবিক নিয়মে তা কেবল লিন্ডে নয়, আরেক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আলেকজাণ্ডার ভিলেঙ্কিনের চোখেও পড়েছিল, এবং সেটা লিন্ডে তত্ত্ব দেওয়ার বহু আগেই। কিন্তু মূলধারার পদার্থবিজ্ঞানীরা এটা গ্রহণ করবেন না ভেবে তিনি এই ধারণা বাক্সবন্দি করে তার কাজের টেবিলের ড্রয়ারে ফেলে রেখেছিলেন বহুদিন।
[35] Leonard Susskind, The Cosmic Landscape: String Theory and the Illusion of Intelligent Design, Back Bay Books; 2006
[36] Stephen M. Feeney (UCL), Matthew C. Johnson (Perimeter Institute), Daniel J. Mortlock (Imperial College London), Hiranya V. Peiris (UCL), First Observational Tests of Eternal Inflation, Phys. Rev. Lett. 107, 071301, 2011
[37] পল স্টেইনহার্ট এবং নেইল টুরকের মডেলটি ‘চক্রাকার’ বা ‘সাইক্লিক’। এধরনের সাইক্লিক মডেলে সব সময়েই একটা সমস্যা থাকে, সেটা হল এন্ট্রপির সমস্যা। যে কোন সাইক্লিক মডেল এটা দীর্ঘ সময় পর ‘হিট ডেথ’ অবস্থা প্রাপ্ত হয়,  অর্থাৎ এন্ট্রপি স্থিতিশীল অবস্থায় চলে আসে, যেটা আমাদের মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণের ঠিক বিপরীত। যদিও স্টেইনহার্ট এবং টুরক দাবী করেছেন তারা পূর্ববর্তী সাইক্লিক মডেলের এই এন্ট্রপির এই সমস্যা তারা সমাধান করেছেন (তাদের ‘এন্ডলেস ইউনিভার্স’ বইয়ে আইজ্যাক আসিমভের বিখ্যাত The last question গল্পের শিরোনাম দিয়ে একটি চ্যাপ্টারও অন্তর্ভুক্ত করেছেন তারা), কিন্তু বহু বিজ্ঞানীই মনে করেন না যে, তারা এই সমস্যার কোন সমাধান দিতে পেরেছেন। বিজ্ঞানী শন ক্যারলের ‘From Eternity to Here’ বইয়ে এ নিয়ে ভাল আলোচনা আছে। অ্যালেন গুথ তার একটি পেপারে (Inflation, Carnegie Observatories Astrophysics Series, Vol. 2) বলেছেন, ‘স্ফীতির বিকল্প দাবী করা হলেও স্টেইনহার্ট এবং টুরক মূলতঃ স্ফীতির তত্ত্বের সাহায্যেই বরং প্রমাণ করেছেন যে মহাবিশ্বের আকার কেন এত বড় কিংবা মহাবিশ্বের প্রকৃতি কেন এত সমসত্ত্ব কিংবা সামতলিক’।  আঁদ্রে লিণ্ডে দাবী করেছেন, “স্ফীতি তত্ত্বের বিকল্প হয়ে উঠার বদলে চক্রাকার মডেলের রূপপ্রেখা বরং ‘উদ্ভট’ এবং ‘স্ফীতিতত্ত্বেরই একটি সমস্যাজনক ভাষ্য’ হয়ে উঠেছে’’। তার চেয়েও বড় কথা হল, মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়ার সাথে সাথে পল স্টেইনহার্টের ‘চক্রাকার’ বা ‘সাইক্লিক’ মডেলের সমাধি সূচিত হল। স্ফীতিতত্ত্বই বর্তমানে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ব্যাখ্যায় একমাত্র অপ্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব।
[38] Alex Vilenkin, Many Worlds in One: The Search for Other Universes, Hill and Wang; 2007
[39] উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, A. Vilenkin, “Creation of the Universe from Nothing,” Physical Letters 117B: 25–8.,1982; Victor Stenger, “The Universe: the Ultimate Free Lunch”, Eur J Phys 11, 236243, 1990; ইত্যাদি।