Tuesday, August 29, 2017

হ্যালুসিনেশন বা গায়েবী আওয়াজ – মানসিক রোগ ।


‘হ্যালুসিনেশন’ নানা মানসিক রোগের একটা উপসর্গ। মানসিক রোগীরা তাদের কানে নানান ধরনের গায়েবি কথাবার্তা শোনার কথা বলে থাকেন। এটি আসলে হ্যালুসিনেশন। আমরা অনেক সময় ঘুম থেকে জাগার সময় আশপাশের কেউ যেন নাম ধরে ডাকছে এমন মনে করে থাকি। এটিও হ্যালুসিনেশন। এটি হতে অন্তত একটা ব্যাপার সুসপষ্ট- হ্যালুসিনেশন সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থাতেও ঘটতে পারে।  

আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের একটা সাধারণ ধর্ম হলো, এরাএক এক ইন্দ্রিয় এক এক অনুভূতি জাগায়। শ্রবণেন্দ্রিয় শব্দের অনুভূতি জাগায়, ত্বক সপর্শানুভূতি জাগায়, জিহ্বা স্বাদের অনুভূতি জাগায়, নাক
গন্ধের অনুভূতি জাগায়, চোখ দর্শনের অনুভূতি জাগায়। আমাদের সামনে যখন কোনো একটা দড়ি ঝুলতে থাকে তখন একে স্বাভাবিক অবস্থাতে দড়ি মনে হবে। যখন কেউ দড়িকে সাপ দেখেন তখন ইলিউশন বা দৃষ্টিভ্রম হয়। দড়ি এখানে একটা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে থাকে। ইলিউশনে উদ্দীপকের দরকার হয়। কিন্তু হ্যালুসিনেশন একদম ভিন্ন প্রক্রিয়া। সামনে কোনো কিছুই নেই অথচ ব্যক্তি কিছু দেখতে পায়। রোগীরা অনেক ক্ষেত্রে বলে থাকে তার সামনে একটা কুকুর হাঁটছে। আশপাশের কেউ তো দেখছে না। রুম তো একদম আলোকিত। তাহলে রোগী কি মিথ্যা বানানো গল্প বলে যাচ্ছে? আসলে রোগীর চোখে হ্যালুসিনেশন ঘটছে।
কিছু ঘটনা হ্যালুসিনেশন নানাভাবে ঘটতে পারে। যাদের পরিবারের কোনো সদস্য সিজোফ্রেনিয়ার মতো কোনো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত তাদের কতক আচরণ হতে এটি বুঝে নেয়া যায়- (১) রহিমা। বয়স ৩০ বছর। প্রচণ্ড কান্নাকাটি করছে। তার সাথে জিন-পরীরা কথা বলে যাচ্ছে। সে সবাইকে দেখতে পাচ্ছে। রোগী আসলে হিস্টিরিয়াতে আক্রান্ত। তার চোখের হ্যালুসিনেশন ঘটেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন। (২) করিম। ডাক্তাররা তার রোগ নির্ণয় করেছেন ‘সিজোফ্রেনিয়া’। সে সব সময় একা একা কথা বলতে থাকে। আসলে তার একা একা কথা বলাটা হ্যালুসিনেশনের একটা পরোক্ষ প্রকাশ। তার কানে প্রতিনিয়ত নানা গায়েবি আওয়াজ আসে। সে এসব বক্তাবিহীন সংলাপের উত্তর প্রতিনিয়ত দিয়েই চলেছে। তাই তো তার একা একা কথা বলা। (৩) অনেক মানসিক রোগী কানে তুলা দিয়ে থাকেন। কারণ তিনি কোনো এক অজানা জায়গা হতে ভেসে আসা কথাগুলো শুনতে চান না। তাই তো তার এ সতর্কতা অবলম্বন। কিন্তু তাতে কি শেষরক্ষা হবে? এমনও অনেক ঘটনার নজির দেখা গেছে যেখানে রোগী ধারাল কোনো যন্ত্র দিয়ে কানের পর্দা পর্যন্ত ছিঁড়ে দিয়েছে। এতে ফলাফল যা তা হলো রোগী তার কোলাহল বিশ্ব হতে মুক্তি পেয়ে গেলেও এমন এক জগতে তার প্রবেশ ঘটেছে যেখানে বাইরের কোনো শব্দ নেই, কেবল সে সব কথা। তাহলে হ্যালুসিনেশন! 
হ্যালুসিনেশন হলো এমনি একটি দশা-কোনো প্রকার উদ্দীপনা ব্যতিরেকে ব্যক্তি কোনো বিশেষ ইন্দ্রিয়ানুভূতি লাভ করে। এ অনুভূতির সঞ্চার স্বাভাবিক অনুভূতির মতোই ঘটে থাকে। যেমন ধরুন এক ব্যক্তি গায়েবি কথা শুনে থাকে মানে শ্রবণেন্দ্রিয়ের হ্যালুসিনেশন ঘটে থাকে। এ গায়েবি কথা খুব হাল্কাভাবে ঘটে থাকে এমন নয় কিন্তু। আশপাশের লোকজনের কথা সে যেমনভাবে শুনতে পায়, কানের গায়েবি কথাও ঠিক তেমনভাবে ঘটে থাকে। হ্যালুসিনেশন দেহের প্রতিটি ইন্দ্রিয়তে ঘটতে পারে।
শোনার হ্যালুসিনেশন কানে গায়েবি আওয়াজ আসাকে বলা হয় শোনার হ্যালুসিনেশন। বেশির ভাগ মানসিক রোগের এটি ঘটে থাকে। রোগী কানে কথা শুনতে পায়। রোগ নির্ণয়ে কেবল এতটুকু তথ্য জানলেই যথেষ্ট নয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ এ ক্ষেত্রে কানের গায়েবি আওয়াজের খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসা করে থাকেন। কারণ কেবল হ্যালুসিনেশন হতে রোগ নিরূপণ করা যায় না। উল্লেখ্য, হ্যালুসিনেশন ছাড়াও রোগীর আরো নানা উপসর্গ থাকে।
চোখের হ্যালুসিনেশন ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন। রোগী চোখের সামনে কোনো বস্তু দেখতে পায়। এতেও আবার আকারের পরিবর্তন ঘটতে পারে। কোনো বস্তুকে তার স্বাভাবিক আকারের চেয়েও ছোট অবয়বে দেখতে পারে। আবার অনেক বেশি বিবর্তিত হতে পারে। রোগী এ ক্ষেত্রে তার সামনে দৈত্যের কথা বলতে পারে।
ত্বকের হ্যালুসিনেশন রোগী বলতে পারে তার ত্বকের ওপর দিয়ে বা নিচ দিয়ে শুয়ো পোকা চলাচল করছে। অপর একদল বলে থাকে কেউ যেন প্রতিদিন তার সঙ্গে সঙ্গম করে যাচ্ছে। তার শরীরের মাঝে কেউ যেন ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে। এগুলো ত্বকের হ্যালুসিনেশন।
জিহ্বা আর নাসিকার হ্যালুসিনেশন মনোরোগ গবেষকরা এ দুটোকে এক সাথে উল্লেখ করে থাকেন। কারণ এ দুটো নাকি এক সাথে ঘটে থাকে। জিহ্বার হ্যালুসিনেশনে রোগী কোনো এক অজানা জায়গা হতে খাবারের স্বাদ পেয়ে থাকে। নাসিকার হ্যালুসিনেশনে আশপাশের কেউ কোনো গন্ধ শুঁকছে না অথচ রোগী প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে তার নাকে যেন কোথা হতে এক উৎকট গন্ধ আসছে।
ইলিউশন হ্যালুসিনেশন বিস্তৃত আঙ্গিকে বোঝার জন্য ইলিউশন সম্পর্কে একদম স্বচ্ছ ধারণা থাকা চাই। হ্যালুসিনেশন আর ইলিউশন দুটোই বোধনে বিভ্রান্তি। তবে ইলিউশনে কোনো উদ্দীপক থাকবে, হ্যালুসিনেশনে এমন কোনো উদ্দীপক থাকবে না। সামনের ঝুলে থাকা দড়ি যদি কারো কাছে সাপ মনে হয় তাহলে এটি ইলিউশন। যদি কোনো দড়ির অস্তিত্ব ছাড়াই সাপ দেখতে পায় তাহলে তা হ্যালুসিনেশন।
কখন ইলিউশন ঘটে? হ্যালুসিনেশনের মতো ইলিউশনও স্বাভাবিক অবস্থাতে ঘটতে পারে। নানা অবস্থাতে ইলিউশন ঘটে থাকে। এ ধরনের কয়েকটা অবস্থা-
(ক) যখন উদ্দীপন তীব্রতা কমে আসে তখন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষও ইলিউশনের শিকার হতে পারেন। যখন সন্ধ্যায় আলো কমে আসে তখন সামনের ঝোপকে মনে হয় কেউ যেন বসে আছে।
(খ) ব্যক্তির সজ্ঞানতাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যখন কোনো রোগের কারণে আমাদের হুঁশ অবস্থা কমে যায় তখনো এমন বিভ্রান্তি ঘটতে পারে। এ কারণে স্ট্রোক, কিডনি রোগীরা এমনকি জ্বরের রোগী পর্যন্ত এমন বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন।
(গ) ইলিউশন ঘটার ক্ষেত্রে রোগীর মনের অবস্থাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খুব উদ্বিগ্ন অবস্থাতে দূরের ঝোপকে শত্রু মনে হতে পারে।
নানা ধরন আমরা এবার হ্যালুসিনেশন বর্ণনাতে আরো গভীরে প্রবেশ করব। রোগীর কানে গায়েবি কথা আসছে। মানে রোগীর হ্যালুসিনেশন ঘটছে। শোনার এ হ্যালুসিনেশনে নানা রকমারিতা দেখা যায়।
(ক) কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীকে সরাসরি তুমি সম্বোধন করে হ্যালুসিনেশন ঘটে থাকে। যেমন তুই শব্দ, তুই এটা কর, তোর সব শেষ…। এ শোনার হ্যালুসিনেশনের নাম সেকেন্ড পারসন হ্যালুসিনেশন।
(খ) কতক ক্ষেত্রে কানে দুই বা ততধিক লোক রোগীকে নিয়ে আলাপ-আলোচনায় মেতে ওঠে। রোগীর অবস্থান অনেকটা থার্ড পারসনের মতো। যেমন করিম ভালো ছেলে, করিমকে দিয়ে কিছু হবে না ইত্যাদি। এর নাম থার্ড পারসন হ্যালুসিনেশন।
(ঘ) কোনো কোনো ক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশনের ধরন আরো মজার। রোগী মনে মনে যা চিন্তা করে সেটিই সে শুনতে পায়। কেউ যেন তার মনের মাঝের চিন্তাগুলোকে শুনিয়ে যাচ্ছে। চিন্তাগুলো কথার মাধ্যমে শোনার মাঝেও নানা রকমফের বিদ্যমান। কেউ কেউ মনে চিন্তা আসার আগেই কানে শুনতে পায়, সেটিই পরক্ষণে চিন্তনে রূপ নেয়। অপর দল চিন্তা সমসাময়িকে শব্দ বাক্যে শুনতে পায়। তৃতীয়পক্ষের বেলাতে প্রথমে চিন্তা মনে আসে। অতঃপর মনের সে সব চিন্তা কেউ যেন সশব্দে উচ্চারণ করে শুনিয়ে দেয়। যেন চিন্তাগুলো মনের মাঝে প্রতিধ্বনিত হতে পারে। (ঙ) এক ধরনের শ্রবণ হ্যালুসিনেশন গায়েবি আওয়াজের অবস্থান সার্বক্ষণিক। ক্রিকেটের ধারাবিবরণী প্রকাশের মতো করে ব্যক্তি যেন রোগীর কার্যকলাপ বলেই যেতে থাকে। যেমন করিম ভাত খাচ্ছে, ভাতের সাথে সামান্য তরকারি নিল, তার তরকারি ভালো লাগছে না…। এ ধরনের হ্যালুসিনেশনের নাম রানিং কমেন্টারি।
ঠিক এমনটি ঘটতে পারে শ্রবণ ক্ষমতার বেলাতেও। আমাদের শোনার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। বাংলাদেশে বসে আমেরিকায় কোনো আত্মীয় কথা বলছে তা শোনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মানসিক রোগে এ অসম্ভব সম্ভব হয়ে যায় মনের মাঝের কোনো এক অজানা প্রক্রিয়ায়। রোগী তার কাছ হতে হাজার মাইল দূরে থাকা কারো কথা শুনতে পায়। এর নাম এক্সট্রা ক্যাম্পেইন অডিটরি হ্যালুসিনেশন। 
ফাংশনাল হ্যালুসিনেশন এটি আরেক ধরনের মজার শ্রবণেন্দ্রিয় হ্যালুসিনেশন। কেউ হয়তোবা বাথরুমে গিয়ে পানির ট্যাপ ছাড়ল আর সাথে সাথে কানে গায়েবি আওয়াজ আসতে শুরু করে দিল। মজার ব্যাপার হলো যখনই পানির ট্যাপ বন্ধ করে দেয়া হয় তখন সাথে সাথেই কানের শ্রবণেন্দ্রিয় হ্যালুসিনেশন বন্ধ হয়ে যায়।
রিফ্লেক্স হ্যালুসিনেশন ফাংশনাল হ্যালুসিনেশন অপেক্ষা এটি আরো চমৎকার। এরা গান শুধু কানেই শোনে না, তা চোখেও দেখতে পায়। মানে কানের শ্রবণ উদ্দীপনাতে ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন শুরু হয়ে যায়। গাঁজা বা এলএসডি আসক্তিতে এটি দেখা যায়।
অটোসকোপিক হ্যালুসিনেশন এতে ব্যক্তি নিজেকে তার সামনে দেখতে পায় যেন ব্যক্তির সামনে একটা আয়না বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি এক ধরনের বিশেষ হ্যালুসিনেশন। এটি পুরোপুরিভাবে চোখের হ্যালুসিনেশন নয়।
বিষণ্নতা রোগে হ্যালুসিনেশন আমাদের সবার ধারণা, হ্যালুসিনেশন কেবল সিজোফ্রেনিয়ার মতো মারাত্মক সাইকোসিসে ঘটে থাকে। অন্যান্য অনেক রোগেও তা ঘটতে পারে। যেমন মৃগীরোগ, বিষণ্নতা, হিস্টিরিয়া এমনকি ব্রেন টিউমারের বেলাতেও।
বিষণ্নতা রোগে মূলত দু’ধরনের হ্যালুসিনেশন ঘটে থাকে। একটা শোনার হ্যালুসিনেশন আর অপরটা দেখার হ্যালুসিনেশন। কানের হ্যালুসিনেশন প্রায়ই ক্ষেত্রে সেকেন্ড পারসন হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে। কানে কানে কেউ বলে যায় ‘তুই শেষ’, ‘সামনে তোর মরণ’।
সিজোফ্রেনিয়া রোগেও অনেক ক্ষেত্রে এমনটি ঘটতে পারে। এ সাধারণ চিত্রে বিষণ্নতার সাথে মূল পার্থক্য হলো বিষণ্ন রোগী কানে ভেসে আসা কথাগুলোকে একদম যৌক্তিক ধারণা করে মাথা পেতে নেয়। সিজোফ্রেনিয়ার রোগী এগুলো শুনে বিরক্ত হয়। এ তো গেল শ্রবণের হ্যালুসিনেশন। আর দেখার হ্যালুসিনেশন ব্যক্তি সামনে দেখতে পায় তাকে সমাধিস্থ করা হচ্ছে।
হ্যালুসিনেশন ও ব্যক্তি যখন কানে গায়েবি আওয়াজ আসতে থাকে তখন ব্যক্তি তাতে কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে থাকে? প্রথমদিকে ব্যক্তি বেশ আতঙ্কিত হয়। সে মনের এসব অনুভূতি বুঝে উঠতে পারে না। এ কারণে অনেকটা বিহ্বল হয়ে চারপাশে তাকাতে থাকে। অনেকে সারাক্ষণ বক বক করে। তারা আসলে কানের আওয়াজগুলোকে প্রশ্ন করে। অনেকে সামনের লোককে আঘাত পর্যন্ত করতে পারে। কারণ হ্যালুসিনেশনে কানে কোনো আদেশ আসতে থাকে। এর নাম কমান্ড হ্যালুসিনেশন।
অধ্যাপক ডা. এ কে এম নাজিদুদ্দৌলা চৌধুরী
এমবিবিএস ডিপিএম এফসিপিএস এমআরসিপি এফআরসিসাইক 

মানসিক রোগ বনাম জ্বিন ভূতের আছর

রিতা একমাস ধরে কথা বলেনা। সারাদিন বোবার মত তাকিয়ে থাকে। একেবারেই চুপ, তাও না হয় সহ্য করা যেত কিন্তু গত পনের দিন সে হাত পা কুকড়ে ঝাকানি শুরু করেছে। একবার শুরু হলে ৫ থেকে ১০ মিনিট চলতে থাকে। শ্বশুরবাড়ীর লোকজন এই অদ্ভূত কান্ড দেখে ভীষন ভয় পেয়েছে। মৃগী রোগ কিনা বোঝার জন্য হাত পা ঝাকানোর সময় জুতা শুকিয়ে দেখা হয়েছে। খারাপ কোন কিছু আছর করেছে কিনা মসজিদের ইমামের পড়াপানি খাইয়ে দেখেছে। এরপরও কাজ না হওয়ায় বাবার বাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছে। রিতার বাবা মা থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েও সুরাহা পায়নি। মেয়েকে যে জ্বিনেই ধরেছে সে ধারনা পাকাপোক্ত হয়েছে। নিজ গ্রামের, ভিন গ্রামের পীর-ফকির, কবিরাজ সবার কাছেই ছুটোছুটি করেছেন মেয়েকে নিয়ে। রিতার বয়স আঠারো চলছে। দুই বছর ধরে বিয়ে হয়েছে, তার অমতে। স্বামী বিদেশ থাকত, মাসখানেক ধরে দেশে এসেছে। জ্বিনে ধরা বউ নিয়ে তো আর সংসার চলেনা তাই নতুন করে পাত্রী দেখা হচ্ছে।
রিতার সাথে আমার পরিচয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটে। অনেক পথ পাড়ী দিয়ে তার এই হাসপাতালে আসা। পানিপড়াসহ ওঝা ফকিরের লাঞ্জনাও সহ্য করতে হয়েছে। তখনও সে কথা বলেনা এবং হাত পাগুলোকে অদ্ভূতভাবে ঝাকায়। রিতা কনভারসন ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ছিলো যার প্রচলিত নাম হিস্টিরিয়া। এক ধরনের মানসিক রোগ। সাইকোথেরাপী যেখানে চমতকার কাজ করে। রিতা একসপ্তাহের মধ্যেই সাইকোলজিস্টের সাথে কথা বলে। সে ছোটবেলা থেকেই নানুর বাসায় মানুষ। বাবার আর্থিক অবস্থা অত খারাপ না, সুযোগ সুবিধা বেশী বলে নানুর বাসায়ই থাকা হত। ক্লাস টেনে ওঠার পর এই বিয়ের প্রস্তাবটি আসে। ছেলে বিদেশ থাকে, অনেক পয়সা কামাই করে, টাউনে নিজেদের বাড়ী আছে। পাত্রপক্ষের এত আগ্রহ দেখে রিতার মামারা রাজী হয়ে যায়। রিতার মতামত কেউ জানার প্রয়োজন মনে করেনা। বিয়ের পর রিতা বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলো যতটা আগ্রহ দেখিয়ে তাকে বিয়ে করিয়ে আনা হয়েছে বিয়ের পর তার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই। ছোটখাট বিষয়ে তাকে কথা শোনানো হয়। বিয়ের পরপরই স্বামী বিদেশ চলে যায়। রিতার শ্বাশুড়ী তার স্বামীর সৎ মা, নানান ছুতায় তাকে অপমান করেন। কাজকর্মে অদক্ষতার জন্য পদেপদে ভুল ধরা হয়। রিতা কোন কথা বললে তা আবার ব্যাঙ্গ করে তাকে শোনানো হয়। স্বামী ফোন করে শুধু তার পরিবারের লোকজনদের সাথেই কথা বলেন। রিতার অনুভূতির কোন মূল্য দেয়া হয়না। পড়াশুনা চালিয়ে না যাতে পারার দুঃখ আর এত আগ্রহের বিয়ের এই ফলাফল, বিভিন্ন সময়ে অপমানিত হবার অভিজ্ঞতা রিতার ভিতরে ভিতরে তীব্র দ্বন্দ্ব তৈরি করে। যার বহিঃপ্রকাশ শারীরিক এই লক্ষণের মাধ্যমে ঘটে, কথা বন্ধ হয়ে যায়। হিস্টিরিয়ার বা কনভার্সন ডিসঅর্ডারের মূল কারণটাই হলো মানসিক কোন দ্বন্দ্ব যা ব্যাক্তির মনে অসচেতনভাবে কাজ করে এবং বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সাইকোথেরাপী মূলতঃ এই মানসিক দ্বন্দ্বটাই আবিস্কার করে। মানসিক চাপ কমে গেলে শারীরিক লক্ষণগুলো কমে আসে। যেমন সাইকোথেরাপীর কয়েকটি সেশনের পর রিতার শারীরিক লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে কমে আসে। রিতার কোন শারীরিক সমস্যা ছিলোনা, সমস্যাটা পুরোপুরি মানসিক কিন্তু রিতার মতো অনেকেই এরকম জ্বিন ভূতের আছর সংক্রান্ত ভুল ধারণার শিকার হয়। জ্বিন ভূতের আছর তাড়ানোর নামে চলে অপচিকিতসা। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে মানসিক রোগগুলোর বিচিত্র লক্ষণসমূহ। শুধুমাত্র কনভারশন ডিসঅর্ডারেই এত ধরনের লক্ষণ দেখা যায় আর সেগুলো এতই অদ্ভূত যে তা মানসিক রোগ হিসাবে সাধারণের বোঝা সত্যি দুরূহ। তাছাড়া আমাদের সমাজে মানসিক রোগ সম্পর্কে রয়েছে নেতিবাচক ধারনা। মানসিক রোগ মানেই মনে করাই পাগল। মানসিক রোগ সম্পর্কে রয়েছে নানা রকম কুসংস্কার। এই কুসংস্কার দূর করার জন্য চাই যথাযথ পদক্ষেপ। মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপুর্ণ উপায় হতে পারে পাঠ্যবইতে কিছু প্রচলিত মানসিক রোগের ধারণার অন্তর্ভূক্তি। প্রাথমিক শিক্ষায় শারীরিক রোগগুলোর মতো মানসিক রোগগুলোকেও পরিচয় করিয়ে দিলে মানুষ অনেক ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্তি পাবে। 
Tahmina Pervin

সিজোফ্রেনিয়া



“সিজোফ্রেনিয়া” শব্দটির সাথে আমরা মোটামুটিভাবে পরিচিত হলেও এটি সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণার অভাব রয়েছে। সিজোফ্রেনিয়া মূলত মস্তিষ্কের একটি মারাত্মক রোগ। Schizophrenia দুটি গ্রীক শব্দ “Skhizein” অর্থ "to split" বা বিভক্ত কর এবং Phrenos (phren) অর্থ “diaphragm, heart, mind” বা হৃদয় এবং মন। সিজোফ্রেনিয়া একটি মানসিক সমস্যা যা সাধারনত বয়ঃসন্ধির প্রথমেই অথবা একদম শৈশবে দেখা যেতে পারে, তবে জীবনের যে কোন সময় এটি হতে

পারে।


সববয়সই মানুষের মনেই এই ব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে। তবে ১৫-২৫ বয়সীরা তুলনামূলক সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত হয় বেশি। তবে বয়স ৪০-এর ওপরে গেলেও সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ সিজোফ্রেনিয়া বা স্মৃতিভ্রষ্ট রোগে আক্রান্ত হচ্ছে৷ এর বাইরে আরও কোটি কোটি মানুষ রয়েছেন, যাঁরা আংশিক সিজোফ্রেনিয়া কিংবা মানসিক রোগের শিকার৷ এর কারণ খুঁজে বের করার জন্য দিনের পর দিন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যাচ্ছেন। 
সিজোফ্রেনিয়া নামের তীব্র জটিল মানসিক রোগে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকলাপ বিঘ্নিত হয়। ফলে, রোগীর পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং দৈনন্দিন ব্যক্তিজীবন বিপর্যস্ত ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। এদের অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা, কাজকর্ম কোনকিছুই বাস্তবিকতার সাথে সামঞ্জস্য নয়। সিজোফ্রেনিয়া রোগীরা নিজস্ব একটি জগত তৈরি করে নেয় যার মাঝে বাস্তবতার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া থাকে না। বাস্তবতার সাথে তাদের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি আর বোধশক্তির এত বেশি ফারাকের জন্য অনেকেই এটিকে সাইকোসিস বলে থাকে। সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগীরা নিজেরাও বুঝতে পারে না যে সে একটি মানসিক রোগের স্বীকার। আতঙ্কজনক বিষয় হচ্ছে এই রোগটির বিকাশ এতই মন্থর গতিতে হয় যে রোগীর পরিবারের সদস্য বা কাছের মানুষরাও বেশির ভাগ সময় বুঝতে পারেন না যে, তার প্রিয়জন এক ভয়াবহ মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। এর উপর আছে কুসংস্কার আর অপচিকিৎসা। অন্যসব মানসিক ব্যাধির তুলনায় বেশি কুসংস্কার ও অপচিকিৎসার শিকার হয় সিজোফ্রেনিয়া রোগীরা। মনোবিজ্ঞানের নানা সমীক্ষা থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ০.২৪% লোক সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। 




সিজোফ্রেনিয়ার প্রকারভেদঃ

অনেক প্রকারভেদের মধ্যে কয়েক প্রকার সিজোফ্রেনিয়ার বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করা যায়। যেমনঃ

ইনসিডিয়াল সিজোফ্রেনিয়াঃ এধরণের সিজোফ্রেনিয়া ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং সে সহ আশপাশের কেউ বুঝতে পারে না যে সে এক ভয়াবহ মানসিক ব্যাধিতে জড়িয়ে যাচ্ছেন। 

একিউট বা ক্রাইসিস সিজোফ্রেনিয়াঃ হঠাৎ করে যদি সিজোফ্রেনিয়া হয়ে যায় এবং উপসর্গগুলো সপষ্ট থাকে তবে তাকে একিউট বা ক্রাইসিস সিজোফ্রেনিয়া বলে। এটি তীব্রমাত্রাসম্পন্ন হয়ে থাকে। এতে হ্যালুসিনেশন বা অলীক প্রত্যক্ষণ, ডিলিউশন বা ভ্রান্ত বিশ্বাস, চিন্তন পদ্ধতিতে গণ্ডগোল ও নিজের সম্পর্কে অস্তিত্ববোধ বা নিজস্ব অনুভূতিবোধ বিকৃত হয়ে যেতে পারে। 

ক্রনিক সিজোফ্রেনিয়া বা দীর্ঘমেয়াদি সিজোফ্রেনিয়াঃ এটি অনেক ক্ষেত্রে তীব্রমাত্রায় রোগীকে দীর্ঘদিনের অক্ষমতায় ভোগায়। এতে রোগী সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, এদের প্রেষণার মারাত্মক ঘাটতি থাকে, বিষণ্নতা বা দীর্ঘমেয়াদি অবসন্নতাবোধ থাকতে পারে এবং এদের আবেগ ভোঁতা থাকে বা কতক ক্ষেত্রে আবেগের স্থূলতা থাকে। সাথে ভ্রান্ত বিশ্বাস বা ডিলিউশন এবং চিন্তা করাতে বা চিন্তনপ্রক্রিয়ায় অসামঞ্জস্যতা থাকতে পারে।

সিজোফ্রেনিক রোগীদের লক্ষণ ও উপসর্গ কতক ক্ষেত্রে কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহের মাঝে সপষ্ট হয়ে উঠতে পারে। এ সময় এদের আচরণজনিত নাটকীয় পরিবর্তন সম্পন্ন হয়ে থাকে। অনেকের আবার জীবনব্যাপী এ ধরনের ছোটখাটো নাটকীয় আচরণ বা অস্বাভাবিক আচরণ কয়েকবার হয়ে থাকে। পরপর দুটি এপিসোড বা অ্যাটাক হওয়ার মাঝখানে তারা আবার মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন-যাপন করে থাকে। অনেকে আবার এ সময়ে সব বিষয়ে অনীহায় ভোগে, অবসন্ন বা বিষণ্ন থাকে, স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে না



সিজোফ্রেনিয়ার কারনঃ

সিজোফ্রেনিয়াতে আসলে মানব মন মস্তিষক ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ‘দি ব্রোকেন ব্রেন’ বইটিতে ডা. ন্যান্সি অ্যানড্রেমন বলেন যে, সিজোফ্রেনিয়ার জন্য কোনো একক কারণ দায়ী নয় বরং এ অসুখটি বিকাশের জন্য অনেকগুলো ফ্যাক্টর বা কারণ দায়ী। এতে ব্রেনের বা মস্তিষক গঠনেও পরিবর্তন লক্ষণীয়। এটি বিকাশের পশ্চাতে বংশগত বা জেনেটিক কারণকে অস্বীকার করারও উপায় নেই। এমনকি ভাইরাসজনিত ইনফেকশন বা ভাইরাল সংক্রমণ অথবা মস্তিষেক আঘাতের কারণে যে সিজোফ্রেনিয়া হবে না এমনটিও নিশ্চিত করে বলা যায় না। একটি শারীরিক অসুখের জন্য মানসিক সমস্যা হওয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞান খুব সুন্দরভাবে বর্তমানে গ্রহণ করেছে। সবমিলিয়ে, এটি পারিবারিক এবং বংশগত হতে পারে। গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে অনেক সময় এ রোগের আবির্ভাব দেখা দেয়৷ পুষ্টিহীনতা এবং ভাইরাসের মতন রোগজীবাণু দ্বারা মস্তিস্কের সংক্রমণ ঘটলে হতে পারে। বিভিন্ন ঔষুধের সাইড ইফেক্ট মাথায় আঘাতজনিত কারণে হতে পারে।

লক্ষণঃ

মানব মস্তিষেক নিউরন বা স্নায়ুকোষের পরিমাণ অনির্দিষ্ট, এ সংখ্যাটি বিলিয়ন হতে পারে। প্রত্যেকটি স্নায়ু বা নিউরনের শাখা-প্রশাখা থাকে যার সাহায্যে সে অন্য স্নায়ু বা মাংসপেশি বা অন্য কোনো গ্রন্থি থেকে উদ্দীপনা গ্রহণ করতে পারে। নিউরন বা স্নায়ুকোষের শেষাংশে বা টার্মিনাল থেকে কিছু রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। এগুলোকে নিউরোট্রান্সমিটার বা রাসায়নিক দূত বলা হয়ে থাকে। এগুলোর সাহায্যে মূলত নানা ধরনের উদ্দীপনা স্নায়ুকোষ থেকে স্নায়ুকোষে পরিবাহিত হয়। সিজোফ্রেনিয়া রোগে এই যোগাযোগব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়।


আসুন, লক্ষণগুলো সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জানবার চেষ্টা করি।


অবাস্তব চিন্তা-ভাবনা
অস্বাভাবিক ও অবাস্তব চিন্তা-ভাবনা মনে বাসা বাঁধবার ফলে সে মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখে। ভ্রান্ত বিশ্বাসের ফলে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় সে মনে করে মানুষ তার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসছে এবং তাকে নিয়ে সমালোচনা করছে। অনেক 
ভ্রান্ত বিশ্বাসের প্রকাশভঙ্গি বিভিন্নরকম হয়। তবে সেটি রোগীর বয়স, ধর্মীয় চেতনাবোধ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। যেমন-কেউ তার ক্ষতি করছে, খাবারে ও পানিতে বিষ মিশিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করছে, তাকে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।

রোগী সবসময় মনে করে, তার মনের গোপন কথা সে কাউকে না বললেও আশপাশের লোকজন সেগুলো কি করে যেন জেনে যায়। তার কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা এগুলো তার নিজের না বরং বাইরে থেকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে। কোনো কোনো রোগী মনে করে, তার অতীন্দ্রিয় বা অলৌকিক ক্ষমতা আছে। সে স্বপ্নের মধ্য দিয়ে বিশেষ ক্ষমতা লাভ করছে। অনেক রোগীর মনে হয় তার সঙ্গে জ্বীন-পরীর যোগাযোগ আছে।




মারাত্মক প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ : 
সিজোফ্রেনিয়া রোগীর মধ্যে বিচিত্র সব অনুভূতি দেখা যায়। সে কখনো মনে করে, পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মানুষ সে নিজে। সেই কারণে কেউ কোনো পরামর্শ বা উপদেশ দিতে গেলে সে মারমুখি হয়ে উঠে। সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগীর মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা দেয়। অনেক সাধারণ বিষয় সে সহজভাবে নিতে পারে না। হঠাৎ হঠাৎ সে প্রবল উত্তেজিত হয়ে উঠে। অকারণে উত্তেজিত হয়ে সে কাছের মানুষকে মারতে উদ্যত হয়। বকাবকি ও গালিগালাজ হয়ে উঠে তার সারাক্ষণের সঙ্গী। কোনো রোগীকে দেখা যায়, এই হাসছে আবার কোন কারণ ছাড়াই কাঁদছে। সত্যিকার পরিস্থিতির সাথে এদের আবেগজনিত প্রকাশ অনেকাংশে খাপ খায় না। যেমন, প্রচন্ড হাসির কৌতুকেও এরা অনেক সময় কেঁদে ফেলে। সামান্য অনেক বিষয় তার মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ তৈরি করে। 



অবাস্তব-অদ্ভুত সব অনুভূতিঃ
একজন সিজোফ্রেনিক প্রচন্ড আবেগীয় পরিস্থিতিতে পর্যন্ত আবেগশূন্যতায় ভোগে। সিজোফ্রেনিয়া যত প্রবল হয়, আবেগহীনতা তত বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় এর বিপরীত বিষয় ঘটে। দেখা যায়, রোগীর মনে তীব্র আবেগের সঞ্চার হলেও বাইরে তা প্রকাশ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। অনেক সিজোফ্রেনিয়া রোগীই দাবী করে, সে গায়েবী আওয়াজ শুনতে পায়। একে হ্যালুসিনেশন বা অলীক শ্রবণ বলে। আশপাশে কোন লোকজন নেই, অথচ সে কারো কথা শুনতে পায়। কখনো ফিসফিস আওয়াজ বা পাখির ডাকের মতো শব্দও শুনতে পায়। অলীক বা গায়েবি আওয়াজকে বলা হয় "অডিটরি হ্যালুসিনেশন" এসব শোনা থেকে রক্ষা পেতে অনেকে কানে তুলো বা আঙ্গুল দিয়ে বসে থাকে। ধীরে ধীরে রোগীর স্মরণ শক্তি লোপ পায়। মূলত এদের অনুভূতি বা ইন্দ্রিয় স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি শাণিত ও তীক্ষ্ণরূপ ধারণ করে। যেসব তথ্য পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে মস্তিষ্কে পৌছায়, এক্ষেত্রে মস্তিষ্ক সেসব তথ্যকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা করতে পারে না। তাই এসব তথ্যের তাড়নায় ব্যক্তি যে সাড়া দেয় তা থাকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অসংলগ্ন। সিজোফ্রেনিকরা কানে যা শোনে তা বিশ্বাস করে ও সাথে সাথে মানে। অনেক সময় রোগীকে একা একাই কথা বলতে দেখা যায়। কেউ কেউ নাকে বিশেষ কিছুর গন্ধ পায়। ঘুমের মধ্যে অনেক রোগী হাঁটিহাটি একটু আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা সে মনে করতে পারে না। আকাশ-কুসুম কল্পনাকে অনেক রোগী বাস্তবের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। 



অসামাজিক এবং অসংলগ্ন জীবনযাপনঃ 
সিজোফ্রেনিকরা অনেক সময় সবকিছু থেকে নিজেকে আড়াল নেয়, মানুষের সঙ্গে মিশতে চায় না। ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ জীবনযাপন করতে পছন্দ করে। কেউ কেউ পরিবার-পরিজন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য দিনের পর দিন একা একা বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। কেউ ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। নিজের খাওয়া-দাওয়া, ঘুম আর শরীরের প্রতি খেয়াল থাকে না। জীবন সম্পর্কে কোনো উৎসাহবোধ তাদের থাকে না। জামা-কাপড় বা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে ওঠে। জিনিষপত্র ভাঙচুর করে, কাগজপত্র এবং কাপড়-চোপড় কেটে কুটি কুটি করে। হঠাৎ করে কাপড় বা অন্য কিছুতে আগুন ধরিয়ে দেয়। অবস্থা গুরতর হলে রোগীর লজ্জা লোপ পায়। কাপড় চোপড় সবার সামনে খুলে ফেলতেও সে দ্বিধা করে না। যেখানে সেখানে মল-মূত্র ত্যাগ করে এবং তা ঘাটাঘাটি করে। আত্মহত্যার কথা ভাবে এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করে। 

শেষ কথাঃ 

কিছু লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই সে সিজোফ্রেনিয়া রোগী এমনটা মনে করা ঠিক নয়। উপরের লক্ষণগুলোর বেশিরভাগই যদি কারো মধ্যে দেখা যায়, যার কারণে শিক্ষাজীবন, পারিবারিক জীবন, কর্মজীবন এবং সামাজিক জীবনের ব্যাঘাত ঘটে এবং লক্ষণগুলো ৬ মাসের অধিক সময় থাকে, তখনই তাকে সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগী হিসেবে ধরে নেওয়া যাবে। তবে, সিজোফ্রেনিয়া গুরুতর মনোব্যধি হলেও দূরারোগ্য নয়। সঠিক চিকিৎসা ও পরিবারের আন্তরিকতার মাধ্যমে সিজোফ্রেনিয়া রোগী ফিরে পেতে পারেন তার স্বাভাবিক জীবন ও মানসিক সুস্থতা।

১৬ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে ‘চিকিৎসা নিতে হবে’ এমন রোগী ১৬ লাখ। এই চিকিৎসায় খুব বেশি টাকা-পয়সাও খরচ হয় না। আর চিকিৎসা পদ্ধতিও মোটামুটি নির্ভরযোগ্য। আধুনিক বিজ্ঞানে এই রোগের চিকিৎসায় প্রচুর নতুন নতুন ওষুধ আবিষকার হয়েছে। আর এগুলো নির্দেশমতো খাওয়াও অত্যন্ত সহজ। ‘পুষে রাখা রোগী’ যে কোনো সময় সামাজিক, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। এদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। 


কৃতজ্ঞতাঃ "ভূতাত্মা" যিনি এই লেখাটি আমাকে ব্লগে ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছেন।
 
 
 

হ্যালুসিনেশন কেন হয় ?

‘হ্যালুসিনেশন’ শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত। অনেকেই মনে করি হ্যালুসিনেশন মজার একটি বিষয়। কিন্তু হ্যালুসিনেশন কখনোই মজার কোনো বিষয় না। এটি এমন এক মানসিক অবস্থা যখন কেউ ভ্রান্তির ভেতর বসবাস করে অজান্তে। আসলে মিথ্যার জগতে বসবাস করে কেউ ভাবে সে সত্যজগতে বসবাস করছে। এটি একটি অস্বাভাবিক অনুভূতি। এ অনুভূতি স্বাভাবিক অনুভূতির মতোই ঘটে থাকে।
যেমন ধরুন কেউ একজন হয়তো দাবি করে অদৃশ্য কেউ তার কানে কানে কথা বলে যায়-তার মানে ওই ব্যক্তির শ্রবণেন্দ্রিয়ের হ্যালুসিনেশন ঘটে থাকে। হ্যালুসিনেশন দেহের প্রতিটি ইন্দ্রিয়তে ঘটতে পারে। কেউ হয়তো দেখে তার আশপাশে একটা কুকুর সব সময় হাঁটাহাঁটি করছে; আদতে কোন কুকুর আসলে তার আশপাশে থাকে না। এটা ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন। এমনো হতে পারে আক্রান্ত মানুষটি এক বা একের অধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে। হতে
পারে সে এখানে বসে দূরের কারো সঙ্গে কথা বলছে। আসলে কেউ কেউ এটাকে অলৌকিক শক্তি ভাবলেও এটা একটা মানসিক রোগের উপসর্গ।
হ্যালুসিনেশন আসলে কোনো রোগ নয়, এটি অন্য রোগের উপসর্গ। এটি সাধারণত মানসিক রোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তবে কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকেও হ্যালুসিনেশন হতে পারে। তাই কেবল হ্যালুসিনেশন দিয়ে কোনো নির্দিষ্ট রোগ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। সাধরণত যেসব কারণে হ্যালুসিনেশন ঘটতে পারে।
* সিজোফ্রেনিয়া, সিভিয়ার মুড ডিসঅর্ডার, ডিল্যুশনাল ডিসঅর্ডারে রোগীর প্রায়ই হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
* মস্তিষ্কের সমস্যায় হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
* শরীরে লবণের তারতম্যের জন্যও স্বল্পমেয়াদের হ্যালুসিনেশন দেখা দিতে পারে।
* প্রচণ্ড জ্বর হলে, বিশেষ করে শিশুদের হ্যালুসিনেশন হয়।
* মৃগীরোগ, 
বিষণ্নতা, হিস্টিরিয়া এমনকি ব্রেন টিউমারের বেলাতেও হ্যালুসিনেশন ঘটতে পারে।
* স্নায়ুতেন্ত্রর রোগে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।
* ইন্দ্রিয়ের সমস্যায় হ্যালুসিনেশন ঘটতে পারে।
* লিভার বা কিডনির সমস্যা, ব্রেইন ক্যান্সার প্রভৃতি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হলে।
* মাত্রারিক্ত ড্রাগস বা অ্যালকোহল সেবনের কারণেও হ্যালুসিনেশন হতে পারে। যে কারণেই হ্যালুসিনেশন হোক না কেন, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বদ-অভ্যাসগুলো ত্যাগ করুন। সুস্থ থাকুন।
 
 
 

সংস্কারঃ কুসংস্কার

কবিরাজ।
উল্লেখ্যঃ ইনি সাত দিন পানির নিচে ছিলেন!
(কথিত আছে)
জেনে ধরা ভুতে ধরা রুগী তার একটু "ফু"তেই সুস্থ্য!!(কথিত আছে)
গ্রামের মহিলা মহলে তার মুখের কথা বেদবাক্যের ন্যায় মান্য করা হয়।
গ্রামঞ্চলে মানুষের ভুতে বিশ্বাস প্রবল।
আর তাইতো তাদের ব্যাখার অতীত সমস্ত ঘটনাই ভুত বলে পরিগনত হয়।
হয়তো কেউ রাতে বাচ্চার মত কান্না শুনেছে।
তাদের আসরে কথাটা উঠলো।
ব্যাখ্যা হবে ভুত,জেন, পরি।
বাচ্চার রুপ ধরে কাদছিল!
হয়তো কেউ পূর্ণচন্দ্র রাতে গাছের নিচে সাদা কাপর পড়া কিছু দেখলো তাদের ব্যাখ্যা হবে, ভুত, জেন, পড়ি।
বুড়ির রুপ ধরে তরে নিয়ে যাইতে চাইছিল।
সবচেয়ে যেটা মারাত্মক!!!
১২ কিম্বা ১৩ বছর বয়সি বিয়ে হওয়া কোন মেয়ে কোন (শারিরিক অথবা মানুষিক) কারণে শ্বামীর সাথে না থাকে তার ব্যাখ্যা দ্বার করানো হয় জেনে ধরা কিম্বা তাবিজ করা!
আর তার পর থেকে শুরু হয় তার উপর তেল পরা পানি পরার অত্যাচার।
কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তাদের কাছে গৃহিত না!
ব্যাখা একটাই.... জেন... ভুত.... প্রেত....পড়ি... দেও..... দেত্য... দানব....!
তার ব্যাখ্যার কিছু ভুল ধরলেই একটাই কথা,
" যেইদিন ফাঁদে পড়বি, সেই দিন বুজবি।"
মহিলারা সব সমস্বরে,"হু হু... সেই দিন বুঝবি"
সাইকোলজিক্যাল ডিজিজ সম্পর্কে তারা অজ্ঞ।
হেলুসিনেসন তাদের কাছে ভুত!
হিস্টিরিয়া তাদের কাছে জিন!
ডিপ্রেশন তাদের কাছে পড়ি !
আর মজার ব্যাপার হচ্ছে কিছু আই এ, বি এ পাশ ব্যাক্তি চরম ভাবে বিশ্বাস করে।
তাবিজ কবজের প্রতি তাদের অগাধ বিশ্বাস!
শত্যি ভয়ংকর।
কবিরাজ আজ অসুস্থ।।
বয়স হয়েছে ১০৫ বছর (প্রায়)
মারা যাবে!
ভাবছেন তার সাথে সাথে এ কুসংস্কার গুলো কবরে যাবে?
যাবে না!
তার হাতে তৈরি হয়েছে অনেক ওহি( তার নাম)!
উল্লেখ্য'
তার নিতনি ঘাড়ে আজমির শরিফের জেন আছে
সেই জেন কার কি অসুখ সব বলে দিতে পারে।!
বাংলার হাজার গ্রাম কি প্রাগৈতিহাসিকের পাচির মত পচাঁ ঘাঁ (কুসংস্কার) বয়ে বেরাবে যুগ যুগান্তরে!?
নাকি অবতার আসবে!
করবে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন!