Tuesday, August 29, 2017

হিস্টিরিয়া : নারীমনের রোগ

সোমবার, ১৮ জুলাই ২০১৬

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ৮ ছাত্রী গত ৭ মে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এতে অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অসুস্থ শিক্ষার্থীদের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, সকাল ৮টায় অ্যাসেম্বলি শেষে ছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষে চলে যায়। কয়েকটি ক্লাস হওয়ার পর একে একে এসব শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে ওরা সুস্থ হয়ে ওঠে।

ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার নিজপানুয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার ১০ জন ছাত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। অজ্ঞান অবস্থায় ছাত্রীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে শিক্ষার্থীরা গণহারে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ায় ফরিদপুর সদর উপজেলার ৫৭টি স্কুল দু’দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। জেলা সদরের মাচ্চর ইউনিয়নের শিবরামপুর আরডি একাডেমি ও খলিলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শতাধিক ছাত্রী স্কুল চলাকালে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হলে তাদের ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। বিষয়টি জানার পর রোগের কারণ অনুসন্ধানে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। কমিটির সদস্যরা আক্রান্ত কয়েকজন শিক্ষার্থীর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং ওই দুটি স্কুল পরিদর্শন করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোগের কারণ নির্ণয় করতে পারেনি জেলা প্রশাসন। পরিস্থিতি আরো পর্যবেক্ষণ ও সতর্কতার জন্য স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেন তারা। ওই সময় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক গণপতি বিশ্বাস শুভ গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন, এটা গণমনস্তাত্তি¡ক রোগ (ম্যাস সাইকোলজিক্যাল ডিজিজ)। সাধারণত ছাত্রীরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে একজন থেকে আরেক জনে এ রোগ ছড়ায়। তবে হাসপাতালে আসার পর স্যালাইন ও অক্সিজেন দিলে তারা সুস্থ হয়ে ওঠে। এ রোগে মৃত্যুর কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নয়, শিল্প প্রতিষ্ঠানেও নারী শ্রমিকদের হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা যায়। গত ১৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি পোশাক কারখানায় গণহিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২০ নারী শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানায় মেয়েদের হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার খবর মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। প্রাথমিকভাবে এটাকে ‘অজ্ঞাত’ রোগ বলা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটি ‘হিস্টিরিয়া (ঐুংঃবৎরধ)’ রোগ। এটাকে সাধারণভাবে নারীমনের রোগ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। দেহের অসুখ হলে নানা উপসর্গ দেখা দেয় এবং দেহ কষ্ট পায়। মনের অসুখ হলেও শরীরের ওপর প্রভাব পড়ে। হিস্টিরিয়া তেমনি একটি মানসিক রোগ। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। বয়ঃসন্ধিকালে সমস্যা বেশি হয়। হিস্টিরিয়ার সঙ্গে বিষণœতা, উৎকণ্ঠা, ব্যক্তিত্বের বিকার প্রভৃতি মানসিক রোগ থাকতে পারে।

হিস্টিরিয়া বলতে সাধারণ অর্থে বোঝায় নিয়ন্ত্রণহীন আবেগের আধিক্য। অবচেতন মনের অবদমিত মানসিক দ্ব›দ্ব থেকে হিস্টিরিয়ার সৃষ্টি। একে বলা হয় ‘কনভারসন ডিজঅর্ডার’ বা ‘কনভারসন ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার’। হিস্টিরিয়ার সঙ্গে কোনো না কোনো ধরনের চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার সম্পর্কিত। এই চাওয়া-পাওয়াগুলোর সঙ্গে যে বাস্তবের সম্পর্ক থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই, কাল্পনিকও হতে পারে। এই চাওয়া-পাওয়াগুলো বাস্তবিক বা কাল্পনিক যাই হোক না কেন ভুক্তভোগী কিন্তু সত্যিকার অর্থে নিজেই বুঝতে পারে না তার সমস্যাটি কী। এই হিস্টিরিয়ায় ভুক্তভোগীদের সম্বন্ধে এখনো আমাদের সমাজে কিছু প্রচলিত ধারণা বিদ্যমান। যেমন অনেকেই বলেন, অভিনয় করছে, জিন-ভূতে ধরেছে অথবা বাতাস লেগেছে। হিস্টিরিয়া হওয়ার কারণ সম্পর্কে জর্জ টেলর নামের একজন চিকিৎসক ১৮৫৯ সালে দাবি করেন, প্রতি চারজনে একজন নারী হিস্টিরিয়ার রোগী। সাধারণত ভয়, দুশ্চিন্তা, হতাশা, মানসিক চাপ, মানসিক আঘাত, দীর্ঘদিন যাবৎ অসুখে ভোগা, মৃত্যুশোক বা প্রেমে প্রত্যাখ্যান থেকে এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

জন বেয়ার্ড নামের আরেকজন চিকিৎসক হিস্টিরিয়ার লক্ষণ হিসেবে ৭৫টি সম্ভাব্য লক্ষণের তালিকা করেন এবং শেষে লেখেন যে তার তালিকা এখনো অসম্পূর্ণ। তারপরও প্রচলিত যেসব লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় তা হলো- ঘুম ঘুম ভাব, হতাশা, বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট (যদিও কিছুক্ষণ পর তা ভালো হয়ে যায়), মাথাব্যথা, হাত-পা ব্যথা, দাঁত খিচ দিয়ে রাখা, গলায় কিছু আটকে গেছে এমন বলা, কোনো কারণ ছাড়াই অট্টহাসি দেয়া বা কান্না করা। সর্বোপরি হিস্টিরিয়ার ভুক্তভোগীরা আদর ভালোবাসার কাঙ্গাল হয়ে যায় এবং অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।

আগে হিস্টিরিয়ার সঙ্গে খিঁচুনি রোগকে গুলিয়ে ফেলত মানুষ। বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে এ দু’টির মাঝে পার্থক্য করা সম্ভব। খিঁচুনির রোগীরা সত্যিকারে অজ্ঞান হলেও এরা হয় না। এরা দাঁত দিয়ে জিহ্বা কাটে না, ব্যথা দিলে তা অনুভব করে, শ্বাসকষ্ট নিজে থেকে ভালো হয়ে যায়। এর কোনোটিই খিঁচুনি রোগের ক্ষেত্রে ঘটে না। হিস্টিরিয়া আক্রান্তের আরো কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন- কখনো শরীরের কোনো অংশ বা পুরো শরীরই অবশ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। কথা বলতে না পারা, ঢোক গিলতে না পারা বা প্রস্রাব আটকে যাওয়ার মতো মনে হওয়া। কখনো চোখে না দেখা বা কানে শুনতে না পারার লক্ষণ থাকে। হাত-পায়ের অস্বাভাবিক নড়াচড়া, বারবার চোখের পলক পড়া, জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখা, ঘাড় বাঁকা করে থাকা এবং বমি করা বা বারবার বমির চেষ্টা করা এসব লক্ষণ থাকতে পারে। অনেক সময় রোগী হাত নাড়াতে নাড়াতে দেহকে ঝাঁকুনি দিয়ে হাঁটে। এর প্রতিকারে বড় বিষয় হলো গভীর পর্যবেক্ষণ।

রোগের লক্ষণকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিলেও অহেতুক বাড়াবাড়ি করা যাবে না। তার চারপাশে ভিড় করা, হাত-পায়ে তেল মালিশ করা, মাথায় বালতি বালতি পানি ঢালা চলবে না। রোগের লক্ষণগুলো কোনো প্রকৃত শারীরিক কারণে হচ্ছে কিনা, জানার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পরীক্ষা করাতে হবে। রোগীর অবচেতন মনের দ্ব›দ্ব দূর করতে কাউন্সেলিং, পারিবারিক সাইকোথেরাপি ও গ্রুপ সাইকোথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হয়। হিস্টিরিয়ার সঙ্গে উৎকণ্ঠা বা বিষণœতা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ দেয়া যেতে পারে। ফকির, কবিরাজ, ওঝা দিয়ে অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছে হাজার হাজার নারী। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘গণহিস্টিরিয়া’ বা ‘ম্যাস সাইকোলজিক্যাল হিস্টিরিয়া’ একটি মামুলি সমস্যা। যেকোনো ধরনের টেনশন, ভয় ইত্যাদির মতো মানসিক সমস্যা থেকে এটা শারীরিক সমস্যায় পরিণত হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে, এ ধরনের সমস্যায় আতঙ্ক যেন ছড়িয়ে না পড়ে। কোনো ধরনের ওষুধে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন কাউন্সিলিং।

:: সাদেকুর রহমান (পিআইডি ফিচার)


অন্ধকার

-বাবা, ও বাবা, বাবা
-মশকরা করতাছস? এদিকে কি কেউ আছে যে বাবা ,বাবা কইরা চিতকুর পারস?
-আরে ফাতেমা ছেড়ি তো তর কেরামতি ধইরা লাইসে
-কোন কেরামতি?
-জীনে যে দুধ খায়, ছেড়ি তো এই কেরামতি মাইনসেরে দেহায়া কয় যে তুই একটা ঠগ
-ক্যামনে ধরল?
-আজিব তো, আমি ক্যামনে কমু?
-ঘুমা ,এহন ঘুমা, সকালে দেখমু
ফাল্গুনের ৩ তারিখ। বৃক্ষের মন্থরে নতুন পল্লব গজানো শুর করেছে। অল্প অল্প করে খাদ্য ভীরু লুকুচুরি খেলা বাচ্চাটার মত সূর্যের আলো পরছে। নৈসর্গিক প্রকৃতির মাঝে হটাত কোথাও কোকিলের গান শোনা যায়। চন্দ্রাবতী নদীর পাশের হিজল গাছটার দক্ষিণের বড় ডালের উপরে একটা কোকিল বসে আছে। খানিক আগে সেখান থেকে কোকিল পাখিটার গান শোনা যাচ্ছিল । পুরুষ কোকিল । তার ধারনা ছিল গাছের আড়ালে একটা মেয়ে কোকিল বসে আছে। কিন্তু তার ধারনাটা ভুল প্রমানিত হয়েছে। সেখানে আসলে একটা চড়ুই ছিল। যার কারনে পুরুষ কোকিলের কণ্ঠে এখন আর গান নেই । কি বিচিত্র জিবনের ধারা তাই না?
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পীর মুহাম্মদ কেরামত আলির ঘুম ভাঙ্গে । তার চেহারায় এখন বিরক্তি ও রাগের ছাপ।শান্তির ঘুমটা নষ্ট হয়ে গেল। কোন শালা পিচ্ছি যে টিনের চালে বল মারল? এই গ্রামের পিচ্ছি গুলো বিরাট বদমাইশ । ভক্তি শ্রদ্ধা কাকে বলে জানে না।
কেরামত আলি সাহেব তার চেলা মতিন কে ফাতেমার বাড়িতে পাঠিয়েছে । ফাতেমা আর ফাতেমার বাবাকে খানকা শরিফে নিয়ে আসার জন্য । মতিন এক সময় কেরামত আলির বন্ধু ছিল। সেই নয় বছর বয়সের থেকে। এখন কেরামত আলি হয়েছে পীর বাবা আর মতিন তার প্রধান শিশ্য । দুজনের ই বিয়ের সাধ আর সংসারের আকাঙ্খা মিশিয়ে গেছে। তবুও মনের ভেতরের গহিনের প্রেষণা কখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে । দুজনের কেউই সবসময় সংযমের প্রয়োজন বোধ করেন না। এত সংযম করেই বা কি হবে? মানুষ আর পশু তো একই। দুর্ভাগ্য বশত মানুষের বুদ্ধি বেশি। বেটারা দল বাধতে শিখেছে। জিবনের অন্যরকম একটা মানে খুজে পেয়েছে তারা। যেই সমস্ত মানবির সামনে বাবা আর বাবার শিষে এর সংযম ভেঙ্গে যায় শুধুমাত্র তারাই কেরামত আলির মত ভাবতে শেখে, মানুষ আর পশু জাতির মাঝে মেলবন্ধন খুঁজে পায়।
ফাতেমা মেয়েটা শাহ কেরামত আলিকে বিশ্বাস করেন না। ফাতেমার মনে হয় লোকটা একটা ঠগ । এরকমভাবে মানুষকে ঠকানো কি ঠিক?
শাহ কেরামত আলি অনেকক্ষন ধরে ফাতেমাকে বোঝালেন। ফাতেমা যা দেখিয়ে ছিল টা জাদু আর কেরামত আলির টা ছিল প্রকৃতির লীলা ।
-সব এক হয় না রে ,মা । তোর মাথাটা ঠিক কর। মাথায় গিঁটটু লাগছে। গিঁটটু টা ঠিক কর।নাইলে তো তুই পাগল হয়া যাবি রে মা। তর কথাবার্তায় তো দেহি আল্লাহ বিশ্বাস ই নাই।
পিরবাবার কথায় ফাতেমার বাবাও সায় দিলেন।মেয়েতার কি দরকার সব জিনিস নিয়ে উল্টাপাল্টা মাথা ঘামানোর । পিরবাবা ফাতেমাকে একটা কাগজ দিয়ে বললেন- উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথায় আসলে খালি ঘরে একা বইসা , এই কয়লার টুকরাখানা সুতায় পেঁচাইয়া কাগজে একটা যোগ চিহ্ন আঁকবি। এরপরে যোগ চিহ্নের কেন্দ্রের বরাবর উপরে কয়লা আঙ্গুলে ঝুলায়া একনজরে তাকায়া থাকবি আর দোয়ায় ইয়ুনুস পরবি।সব ঠিক হয়া যাইব, আল্লাহ মেহেরবান।
আজকে প্রবল বৃষ্টি পরছে। টিনের চালের উপরে বৃষ্টির আওয়াজ টা সত্যিই খুব সুন্দর। পিরবাবা শাহ কেরামত আলির কাছে আজকে তেমন কোন মুরিদান নাই। কেরামত আলি ভাবছেন ফাতেমা মেয়েটার বুদ্ধি একটু বেশিই। সে কি বুঝে না –এত বুদ্ধি ভাল না?
কেরামত আলির চেলা মতিন এসে জিজ্ঞাসা করল-
-কি ডোজ দিলি?
-কিছুই দেই নাই ,যোগ চিহ্নের উপর কয়লা ধইরা তাকায়া থাকতে কইছি
-এটাতে অর কিছুই হইব না ।
-অর হইব ,অর মত মানুষের মাথারে কয় ফ্লেমেতিক বা আত্মস্থ । বৈজ্ঞানিকগো মাথার গঠন এইরকম হয়। এটা দিয়াই কাজ হইব।
আজকে ফাতেমার মনটা ভাল নেই। মা বাবা তাকে অনেক বকেছে ।
-নিজেরে বেশি বুদ্ধিমান মনে করস? তর তেহে কেউ কম বুঝে না।আর কোনদিন যদি দেখছি উল্টাপাল্টা জিনিস নিয়া মাথা ঘামাইতে…………
ফাতেমার নিজের উপরই রাগ লাগে।সে কেন এত বেশি বুঝতে গেল? এত বেশি বুঝা কি তার জন্য ভাল? ওই শয়তান কেরামত আলির উপরেও জিদ লাগছে। লোকটা আসলে বিরাট বদ।
ফাতেমা মন ভাল করার মত কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। তার প্রচুর কান্না পাচ্ছে। কিন্তু এত বড় মেয়ে কাঁদলে মানুষ কি বলবে? সে আসলেই খুব বড়। ?
ফাতেমার হটাত মনে হল লোকটা কয়লা ধরে যেই কাজটা করতে বলেছে একবার করে দেখি তো।
ফাতেমা যোগ চিহ্নের উপরে কয়লা ধরে কয়লার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।হটাত ফাতেমার মনে হল কয়লাটা নড়ছে। কয়লাটা যোগ চিহ্নের এই পাশে ওই পাশে যাচ্ছে । সে তো হাত নাড়াচ্ছে না । তবে কয়লাটা কেন নড়বে? হ্যাঁ কয়লাটা সত্যিই ঝুলে রয়ে নড়ছে, এই পাশে ওই পাশে যাচ্ছে, কিন্তু কেন? কেন এরকম হচ্ছে? সে তো হাত নাড়াচ্ছে না । ফাতেমা ভয় এ হাত থেকে সুতাটা ফেলে দিল।
সারারাত ফাতেমার ঘুম হল না। সে কি সত্যিই কেরামত আলি কে ভুল বুঝেছে? কয়লাটা কেন নরবে?তাহলে সত্যিই কি ফাতেমাই ভুল ছিল আর কেয়ামত আলিই ঠিক?
পরদিন রাতে ফাতেমা নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে আবার কাজটা করতে শুরু করল। হ্যাঁ, আজকেও তো কয়লাটা নরছে।এদিক ওদিক যাচ্ছে। কে নাড়াচ্ছে এটাকে? কে?
আচমকাই ফাতেমার মনে একটা আধিভৌতিক অনুভূতি ঘিরে ধরল। তার শরীরটা কেমন জেন ঝিন ঝিন করছে। ফাতেমার মনে হচ্ছে তার আশেপাশেই কেউ একজন আছে। কে সে ? কে?
তার মনে হচ্ছে , সেই কেউ একজন টা তার ভেতরে ঢুকে গিয়েছে । তার এমন লাগছে কেন? ফাতেমার মনে হল সে যেন গহিন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। অন্ধকার। শুধুই অন্ধকার।
ফাতেমার মা বাবা চিৎকার শুনে ফাতেমার ঘরে দৌড়ে গেল। তারা খানিকটা ভয় পাচ্ছে – মেয়েটা খাটের উপর এরকম খোলা চুলে ঝিম ধরে বসে আছে কেন?কি হয়েছে ওর?
পরদিন সকালে ফাতেমার বাবা লক মারফত কেরামত আলিকে খবর পাঠালেন যে, ফাতেমাকে জীনে ধরেছে।কেউ তাকে ধরে রাখতে পারছে না। তাকে এখন বেঁধে রাখা হয়েছে।
সন্ধ্যার সময় কেরামত আলি ফাতেমার বাড়িতে গেলেন। ফাতেমা কেরামত আলির কাছে আসতে চায় না। সাতজন মিলেও ফাতেমার সাথে কেউ পেরে উঠছে না। মেয়েটার গায়ে এত আশ্চর্য জোর কথা থেকে এল? তার গলাটাও পুরুষের মত শোনাচ্ছে ।
ফাতেমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হল । অনেক কষ্টে শেষ পর্যন্ত তাকে কেরামত আলির কাছে আনা হয়।
-তর নাম কি?
-কমুনা
-কালফার কচি দিয়া বাড়ি মারলেই কবি।
কেরামত আলি কালফার কচি দিয়ে ফাতেমার গায়ে অনেকগুলো বাড়ি মারলেন।
-আমার নাম কফিল।জিন কফিল
-ওরে ধরছস ক্যান?
-মন চাইসে
-মন চাইসে? না । দাড়া।
এরপর কেরামত আলি ফাতেমাকে কালফার কচি দিয়ে বেধরক পেটালেন।
-ওরে ছাইড়া দে
-না ছাড়মুনা
কেরামত আলি তখন ফাতেমার বাবাকে ডেকে বললেন – এই সমুসসা, কঠিন সমুসসা।এই জিন শয়তান জিন। একটা বাটিতে কইরা মরিচের গুঁড়া আনেন।
কিছুক্ষন পরে কেরামত আলি জিন কফিলের অর্থাৎ ফাতেমার চোখে মরিচের গুঁড়া মারতে লাগলেন।
-যাবি না , মারলে ঠিকই যাবি।দেহি কতক্ষন মাইর খায়া থাকতে পারস?
কেরামত আলি জিন কফিলের মুখে শরীরে জোরে জোরে লাথি মারতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত জিন কফিল ফাতেমাকে ছেড়ে যাবে বলে কথা দিয়েছে।তবে শর্ত হল তাকে একটা খাসি দিতে হবে।সবাই সেই শর্ত বাধ্য হয়েই মেনে নিল।কিছু টাকার খরচ করে খাসি গেলে তো সমস্যা নাই। মেয়েটা তো বাঁচবে।
কেরামত আলি জিন কফিলকে বললেন – ওরে যে ছাইররা যাবি সেইরকম একটা প্রমান রাইখা যা।এই পানি ভরতি কলসি দাঁতে নিয়ে পাঁচ কলম যাবি।
জিন কফিল রাজি হল
ফাতেমা কলসি দাঁতে নিয়ে পাঁচ কদম গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পরল।
পরদিন সকাল নয়টায় ফাতেমার জ্ঞান ফেরে।তার এখন কোন সমস্যা নাই।ফাতেমা এখন পুরোপুরি সুস্থ। তার মা বাবা ও খুব খুশি। কেরামত আলি বাবা সত্যিই মেহেরবান। তার ছোঁয়াতেই মেয়েটা এখন সুস্থ হয়ে গেল।ফাতেমার এখন কোন সমস্যা নাই
পাঁচ মাস পর
তখন শ্রাবন মাসের দিন। এক সন্ধাবেলায় আকাশে মেঘ করে এল। ফাতেমার বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ফাতেমা আর নেই। কিন্তু সেই কান্নার আওয়াজ বেশিদুর এগোল না। তার আগেই রাশ ভারি বৃষ্টি নামল । বৃষ্টির ঝম ঝম আওয়াজ প্রকৃতিতে এক অপূর্ব সিম্ফনি তৈরি করছে। প্রকৃতি, কি অপূর্ব সৌন্দর্য ! কি অপূর্ব এই মহাবিশ্ব ! কি অপূর্ব মেঘের অপারের ওই অনন্ত নক্ষত্রবীথি !
ব্যাখ্যাঃ অন্ধকার গল্পটি আমাদের সমাজের অন্ধ সংস্কার বা কুসংস্কারের প্রেক্ষাপটে তৈরি। যেই অন্ধ সংস্কারের ধারা চলে আসছে শতাব্দী ধরে। সমাজের কিছু অকর্মণ্য , অলস ও চতুর বাক্তিরা তাদের বুদ্ধির বদৌলতে সাধারণ মানুষকে নিজের কেনা গোলাম বানিয়ে রাখে। আর এই পথে তারা আশ্রয় নেয় মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের । আর এভাবে এক পর্যায়ে ধর্মের প্লাটফর্মও খারাপ করে থাকে মানুষের কাছে ভণ্ড পীরেরা।
আবার ওই সমাজের ই কিছু বুদ্ধিমান যুক্তিবাদী মানুষ যখন প্রকৃত সত্যকে সকলের সামনে তুলে ধরেন , তখন ওই সমস্ত ভণ্ড ও চতুর ধর্মগুরুরা নানান পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে যুক্তিবাদী মানুষকে দমিয়ে রাখে। সমাজের এই রুপচিত্র আমরা প্রাচীনকাল মধ্যযুগ ও বর্তমানে ও দেখে আসছি। গালিলিও, কোপারনিকাস, টাইকো ব্রাহের সত্য আবিষ্কারের পরও ধর্ম গুরুদের গোঁড়ামি আর শ্রেষ্ঠত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সাড়ে তিনশত বৎসর সূর্যকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে হয়েছে।
অন্ধকার গল্পটিতে পীর কেরামত আলির মত ভণ্ড লোক যখন গ্রামের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে প্রতারণা করে, বিজ্ঞানের জাদুকে অলৌকিকত্ব বলে প্রকাশ করে তখন ফাতেমা নামের অবিশ্বাসী ও যুক্তিবাদী মেয়ে তার প্রতারণামূলক উপার্জনের পথে আঘাত করে । তখন গ্রামের অশিক্ষিত কিন্তু বুদ্ধিমান বালিকা ফাতেমাকে মারার জটিল ফন্দি আঁটে । ফাতেমাকে কেরামত আলি যেই পদ্ধতিতে মনের বৈপরীত্য দূর করার কথা বলেন সেখানে যে কোন মানুষই একলা ঘরে deep concentration দিয়ে তাকিয়ে থাকলে , কয়লার নাড়াচাড়া দেখতা পাবেন । এর পেছনে কাজ করে মানুষের অচেতন মনের ক্রিয়াকলাপ। ফাতেমা অশিক্ষিত মেয়ে , এই কয়লার নাড়াচাড়া ও তার চারপাশের অবস্থা তার মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। যা থেকে সে হিস্টিরিয়া নামক মানুষিক রোগে আক্রান্ত হয়। যাকে আমরা না বুঝে জীনে ধরা বলে থাকি। কেরামত আলি জানতেন যে এই পদ্ধতিতে ফাতেমার হিস্টিরিয়া হতে পারে, কিন্তু গ্রামের মানুষ তাকে জীনে ধরা বলে ভাববে এবং তখন কেরামত আলিকেই যেতে হবে সেই জিন ছাড়াবার জন্য। কেরামত আলি ভেবেই রেখেছেন সে যখন জিন ছাড়াতে যাবে তখন ফাতেমাকে এমন প্রহার করবে যেন তার মানুষিক সমস্যা টুকু ভাল হলেও কিছুদিন পরে সে মারা যায়। আর তেমনটাই হয়েছে। কেরামত আলির শত্রু ফাতেমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার পথের কাঁটা সরে গিয়েছে। 




আমরা কি নিজেদেরকে চিনতে পারি? নিজেকে কি চেনা সম্ভব? প্রাচীন গ্রীক চিন্তাবিদরা ভাবতেন হ্যাঁ, সম্ভব। কিন্তু যদি উনারা ভুল হয়ে থাকেন? যদি মনোজগতের কিছু নিষিদ্ধ এলাকা বদ্ধ রুমের মতো আটকানো থাকে যেখানে সরাসরি প্রবেশ করা যায় না? সিগমুন্ড ফ্রয়েড মনের এই অন্ধকার অঞ্চলকে বলতেন অচেতন, নির্জ্ঞান মন।
মানুষ সারা জীবন ধরে যত ধরনের কাজকর্ম করে বেড়ায়, তার পেছনে নানান কামনাবাসনাইচ্ছা কাজ করে। এসব কামনাবাসনা অনেক সময় আমাদের সচেতন মন থেকে লুকানো থাকে। আমাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করে এই গোপন বাসনাগুলো। সভ্যতার সবচেয়ে সেরা কিংবা নিকৃষ্টতম বিষয়ের উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে অচেতনে। ফ্রয়েড মনে করতেন নির্জ্ঞান মনের এই সুপ্ত বাসনারা দেখা দেয় স্বপ্নে, ছদ্মবেশে।

শিল্পী Alvaro Alvarez Huayllas

অচেতন মন
পেশাগত জীবনের শুরুতে ফ্রয়েড ছিলেন একজন স্নায়ুবিদ
(নিউরোলজিস্ট)। থাকতেন বর্তমান আস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে। বেশ কয়েকজন কমবয়স্ক রোগী নিয়ে কাজ করার সময় তিনি ধীরে ধীরে মনের গভীরের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে আগ্রহী হতে থাকলেন। তিনি অনুভব করতে লাগলেন যে রোগীদের মনোজগতের কোন গোপন অংশ তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ রোগীরা সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে একেবারে কিছুই জানেন না। ফ্রয়েড হিস্টিরিয়া এবং অন্যান্য বিকারগ্রস্থ রোগী নিয়ে কাজ করতেন। হিস্টিরিয়াগ্রস্থ বেশিরভাগ রোগীই ছিলো নারী, অনেকেই রাত্রে ঘুমের মধ্যে হাঁটতো, বিভিন্ন অলীক ঘটনা দেখতো (হ্যালুসিনেশন), এমনকি পক্ষাঘাতগ্রস্থও ছিলো। কিন্তু কেন এসব সমস্যা হচ্ছে জানা ছিলো না। চিকিৎসকরাও এসব উপসর্গের কোন শারীরিক কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ফ্রয়েড তার রোগীদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন, তাদের ব্যাক্তিগত ইতিহাস খুব সুক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করেন। রোগীদের পীড়াদায়ক কোন অতীত স্মৃতি বা অসুস্থ কামনা থেকে এই প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে তা বুঝতে পারলেন তিনি। এই রোগীদের চিকিৎসা করার জন্যে তিনি এক অভিনব উপায় খুঁজে বের করলেন। রোগীদের একটি শয্যায় শুইয়ে আরাম করতে দিতেন। তারপর তাদের মনে যা যা আসে, সেগুলো নিয়ে কথা বলতে দিতেন। অনেক সময় এই কথা বলার মাধ্যমে রোগীর মনের লুকানো চিন্তাভাবনা বের হয়ে যেতো। তখন রোগীরা আগের চাইতে ভালো বোধ করতেন। এই বিস্ময়কর ফলাফল দেখে মনে হয় যে অচেতনের বিভিন্ন চিন্তাভাবনা রোগীরা সরাসরি মুকাবেলা করতে চাচ্ছিলো না। সচেতনে জানতোই না যে নির্জ্ঞান মন এই সুপ্তবাসনা বা পুরনো কোন স্মৃতির আবেগ লালন করছে। ফ্রয়েডের সাথে কথা বলার কারণে এগুলো দিনের পরিস্কার অলোতে চলে আসে। ফলে একটা বদ্ধ মানসিক চাপ থেকে রোগীরা রেহাই পায়। এ থেকে শুরু হয় ফ্রয়েডের বিখ্যাত মনোবিশ্লেষণ চিকিৎসা।
অবদমিত কামনা
তবে কেবল স্নায়ুরোগী বা হিস্টিরিয়াগ্রস্থদের মনের অচেতনে বাসনা ও স্মৃতি লুকানো থাকে এমনটা নয়। ফ্রয়েড মনে করতেন আমাদের সবার নির্জ্ঞান মনে ধূসর স্মৃতি ও বাসনা অবদমিত আছে। এসব কামনা সবসময় প্রকাশের উপযোগী হয় না। অচেতনে অনেক কিছু লুকানো থাকে বলেই সমাজে জীবনযাপন সম্ভব হয়। আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে চলছে। সেগুলো দেখেশুনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নানান কথা ও ভাবনার আসে – নানান অনুভূতির উদয় হয়। এই ভাবনা ও বোধ আপনাআপনি আসে, এদেরকে সচেতন মন ঠেকাতে পারে না। আমরা নিজেদের কাছ থেকে এই ভাবনাঅনুভূতির স্রোত লুকিয়ে রাখতে চাই। এদেরকে ফ্রয়েড বলতেন অবদমিত কামনা। এসব অবদমিত অন্ধকার কামনার অনেকগুলি হিংসাবিদ্বেষপূর্ণ, অনেকগুলি যৌনভাবনা তাড়িত। এদের প্রকাশ করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাই সচেতনভাবে প্রকাশিত না করে আমাদের মন এদের অচেতনের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়। অবদমিত কামনার মধ্যে শক্তিশালীগুলো প্রয়শই তৈরি হয় শৈশবে। শৈশবের খুব শুরুর ঘটনা প্রাপ্তবয়স্কের জীবনে আবার ফেরত আসতে পারে। যেমন ধরা যাক ইডিপাস কমপ্লেক্স। প্রাচীন গ্রীক নাটকের একটি চরিত্র হলো ইডিপাস। ইডিপাস ঘটনাক্রমে নিজের পিতাকে হত্যা করে মাকে বিয়ে করে ফেলে। সবটুকুই হয় নিজের অজান্তেই, ইডিপাস নিজে কি করছে তা না বুঝেই। ফ্রয়েড মনে করতেন সব পুরুষের অচেতনে নিজের পিতাকে হত্যা করে মাতার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার বাসনা থাকে। শুরুর এই অবদমিত কামনা অন্তত কিছু লোকের পরবর্তী জীবনকে একটা ভিন্ন, বিকৃত রূপ দেয়।
সব অবদমিত কামনা যে যৌনবিষয়ক বা বিদ্বেষপূর্ণ হবে এমনটা না। কিছু হতে পারে মৌলিক দ্বন্দ্বের প্রকাশ। সচেতনভাবে আমরা কোন কিছু চাই, কিন্তু মনের গহীনে হযতো সেটা চাই না। হয়তো আপনি কোন পরীক্ষার প্রস্তুতী নিতে চাচ্ছেন। বুঝতে পারছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে হয়তো সেই পরীক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিগত বছরের প্রশ্ন যোগাড় করলেন, কোচিঙেও ভর্তি হলেন। হাতে বেশ কিছু সময় নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলেন। পরীক্ষার হলে দেখলেন আপনি প্রবেশপত্রই নিয়ে আসেন নি। কিংবা টেনশনের কারণে অনেক জানা জিনিস ভুল দাগিয়ে এলেন। ফ্রয়েড বলবেন সচেতনে পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বুঝতে পারলেও মনের গহীনে ব্যার্থতার আশংকা রয়ে গেছে আপনার। এই ব্যার্থতার ভয় হয়তো আপনি স্বীকার করতে চান না, কিন্তু অচেতন মন সেটা ভিন্নভাবে প্রকাশ করলো।

শিল্পী: Salvador Dalí

গভীর অচেতনের রাজপথ
গভীর মনের এইসব অন্ধকার ভাবনা বাস্তবে খুব কম ক্ষেত্রেই প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পায়। আমাদের মন এই অন্ধকার বাসনা চেপে রাখে, আসল রূপে প্রকাশ পেতে দেয় না। কিন্তু এই চেপে রাখা সবসময় সফল হয় না। অন্ধকার কামনাবাসনা নিজেদেরকে প্রকাশিত করে, কিন্তু সরূপে নয়, ছদ্মবেশে। যেমন ধরা যাক স্বপ্ন। স্বপ্নে অবদমিত কামনারা দেখা দিতে পারে।

ফ্রয়েড স্বপ্নকে বলতেন অচেতনকে বোঝার রাজপথ। স্বপ্ন দেখে আমাদের যা মনে হয় স্বপ্নের আসল অর্থ ঠিক তেমনটা না। স্বপ্নমঞ্চের সামনে কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে, যা আমরা স্বপনেদেখি। আর পর্দার অন্তরালে কিছু বিষয়বস্তু থাকে, যা কিনা স্বপ্নের আসল মানে। মনোবিশ্লেষকের কাজ হলো স্বপ্নের এই প্রকৃত অর্থ খুঁজে বের করা। স্বপ্নে আমাদের সামনে যা যা আসে তার সবকিছুই বিভিন্ন রূপক বা প্রতীক। এই রূপকেরা অচেতন মনের গোপন কামনার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। যেমন ধরা যাক, কোন স্বপ্নে সাপ কিংবা তলোয়ার অথবা বন্ধ ছাতা থাকলে তা আসলে যৌনবিষয়ক ছদ্মবেশী স্বপ্ন! সাপ, লাঠি বা ছাতা সবই ধ্রুপদী ফ্রয়েডীয় রূপক, এরা সবাই পুরুষ লিঙ্গের প্রতীক হিসেবে কাজ করে। পাঠকের কাছে এই ধারণা হাস্যকর, অর্থহীন কিংবা ফালতু মনে হতে পারে। সেক্ষেত্রে ফ্রয়েড হয়তো বলতেন পাঠকের সচেতন মন তার মাঝে এই ধরনের যৌনচিন্তার উপস্থিতি সনাক্ত হতে দিতে চাচ্ছে না, তাই তার এরকমটা মনে হচ্ছে!
ফ্রয়েড স্বপ্নের মানে
স্বপ্ন নিয়ে ফ্রয়েডের আগ্রহের শুরু তার মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করার সময় থেকে। তিনি দেখলেন রোগীদের স্বপ্নের বিষয়বস্তুর সাথে তাদের মানসিক সুস্থতার একটা সম্পর্ক আছে। শারীরিক উপসর্গ দেখে যেমন বিভিন্ন রোগ নিরূপন করা যায়, তেমনি তিনি ভাবলেন স্বপ্ন বিশ্লেষণ করে রোগীদের মানসিক অবস্থারও অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যাবে। ফ্রয়েডের স্বপ্ন বিষয়ের বই হলো The Interpretation of Dreams। এই বইটি লেখার আগে ফ্রয়েড মোটামুটি হাজারখানেকেরো বেশি স্বপ্নের চিকিৎসাগত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। স্বপ্ন বিষয়ে এই বইয়ে তার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত রয়েছে:

. গত কয়েকদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে যে ছাপ রেখে যায়, স্বপ্ন সেই স্মৃতিগুলো ব্যাবহারে তুলনামূলকভাবে বেশি অগ্রাধিকার থাকে। তবে স্বপ্নে শৈশবের স্মৃতিও নানা ভাবে ফিরে ফিরে আসে।
. স্বপ্ন ঠিক কোন ধরনের স্মৃতিকে নির্বাচন করবে তা জাগ্রত মনের কাছে গুরুত্ববহ নয়। অচেতন মন সাধারণত বড়সড় বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উপর মনোযোগ দেয় না, কিন্তু সামান্য বা খেয়াল করা হয় নি এমন ঘটনাগুলো মনে রাখে।
. সাধারণত স্বপ্নের দৃশ্যকল্পগুলো এলোমেলো, অর্থহীন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। আসলে স্বপ্ন পরস্পর সম্পর্কহীন ব্যাক্তি, ঘটনা ও আবেগের সমন্বয়সাধন করে। ফলে তৈরি হয় একটি গল্প
. স্বপ্নের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু সবসময়েই আমি
. স্বপ্নের একাধিক অর্থ থাকতে পারে। অনেকগুলো চিন্তা স্বপ্নে একটি দৃশ্র্যে ঘনীভূত হতে পারে। স্বপ্নের দৃশ্যগুলো নিজেদের রূপ বদলাতে পারে। যেমন চেনা কাউকে দেখে স্বপ্ন শুরু হলেও দেখা যাবে তিনি হঠাৎ অচেনা হয়ে গেছেন। “ছিলো রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল” ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।
. প্রায় সব স্বপ্নই হলো ইচ্ছে পূরণবিষয়ের। স্বপ্নে উদঘাটিত হতে পারে খুব গভীর প্রেরণা বা বাসনা যেগুলো হয়তো বাস্তবে পূর্ণ হতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই প্রেরণা বা বাসনার শিকড় থাকে শৈশবে।
ফ্রয়েডের সমসাময়িক অনেক লেখক মনে করতেন নিত্যদিনের ঘটনাগুলো মনের উপর যে ছাপ ফেলে তাই স্বপ্নের মূল কারণ। কিন্তু ফ্রয়েডের মতে নিত্যদিনের স্মৃতি এবং পরিবেশের সংবেদন স্বপ্নে কাঁচামালহিসেবে কাজ করে। তারা স্বপ্নের কারণ নয়, শুধু অন্য কোন অর্থ তৈরির জন্যে মন তাদের ব্যাবহার করছে।

ছদ্মবেশী
স্বপ্ন
স্বপ্নে অচেতন মন নিজেকে প্রকাশ করে। অচেতন মনের
ইচ্ছেপূরণে‘-র হাতিয়ার হলো স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নমঞ্চের পেছনে না বলা বাসনাটা এতো অস্পষ্ট কেন? কেন অদ্ভূত সব প্রতীক আর খাপছাড়া দৃশ্যকল্প দিয়ে স্বপ্ন জড়ানো থাকে? কেন গোপন বাসনার নগ্নতাকে এড়ানো হয় স্বপ্নে?
ফ্রয়েড এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। আমাদের অনেক কামনাবাসনা সচেতন মন কর্তৃক অবদমিত হয়। অবদমিত কামনাগুলো অচেতন মনের অতলে পড়ে থাকে। অচেতন থেকে সচেতন মনে প্রবেশ নিষেধ তাদের। আমাদের সচেতন মন কখনোই এইসব কামনাবাসনার অস্তিত্ব মেনে নিতে চাইবে না। অচেতন মন থেকে সচেতনে উঠে আসতে পারার সুযোগ তখনই সম্ভব যদি অবদমিত কামনাগুলো কোনরূপ ছদ্মবেশ ধারণ করে। স্বপ্নে অচেতন মন এই সুযোগ নেয়। অবদমিত কামনাগুলো এমন ভিন্নরূপ নেয় যে তাদের অর্থ উল্টে যায়। ফ্রয়েড এই অর্থবিকৃতির তুলনা দিয়েছেন রাজনৈতিক লেখকের সাথে। কোন রাজনৈতিক লেখক বর্তমান শাসকের কড়া সমালোচনা করে একটি লেখা লিখতে চান। কিন্তু সেই লেখা হয়তো তাকে বিপদের মুখে ফেলে দিতে পারে। শাসকের সেন্সরশীপ বা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারেন লেখক। তাই তিনি মধ্যপন্থা অনুসরণ করতে পারেন, ‘সহনীয়পর্যায়ের সমালোচনা লিখতে পারেন। মূল সমালোচনার ভাষা কিছুটা বিকৃত করে দিতে পারেন লেখক। স্বপ্নে আমাদের গহীন মন ঠিক এই কাজটাই করে। অবদমিত কামনার বার্তা সচেতন মনকে পৌছিয়ে দেয় বার্তাটাকে প্রীতিকর রূপে, কিংবা অন্যকিছুর ছদ্মবেশে সাজিয়ে। আমরা কেন স্বপ্ন খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাই? ফ্রয়েড মনে করতেন সচেতন মনচেষ্টা করে তার জাগ্রত এলাকায় অচেতন মনের প্রভাব হ্রাস করানোর জন্যে। একারণে ঘুম থেকে জাগার পর সচরাচর আমাদের স্বপ্নের কথা মনে থাকে না।
ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্বের আরেকটি বক্তব্য হলো স্বপ্ন সব সময়েই আত্মকেন্দ্রীক। স্বপ্নে অন্য কেউ দেখা দেয়ার মানে হতে পারে তারা আমাদেরই একটি ভিন্ন প্রতীক; অথবা ওই ব্যাক্তিকে আমরা কোন দৃষ্টিতে দেখি তার প্রকাশ। ফ্রয়েড মনে করতেন স্বপ্নমঞ্চে কোন অদ্ভুত লোক দেখা দেয়ার মানে তিনি ঐ ব্যাক্তির জীবনের এমন কোন দিকের প্রতীক হিসেবে কাজ করছেন যা কি না জাগ্রত অবস্থায় কখনোই প্রকাশ পেতো না। স্বপ্ন কোন ভাবনা খুব জোড় দিয়ে প্রকাশ করতে পারে যেটা কিনা সচেতনভাবে অবদমিত হয়। আর সেই বার্তা সবসময়ই নিজেকে নিয়ে, সমাজ, পরিবার বা পরিপার্শ্ব অন্য কিছু নিয়ে নয়।


সমালোচনা
মানুষের চিন্তার ইতিহাসে যেসব মনীষীরা খুব বড়সড়ো নাড়া দিয়ে গেছেন তাদের মাঝে অন্যতম ফ্রয়েড। তবে অনেক মনোবিদই ফ্রয়েডের মূলনীতিগুলো স্বীকার করেন না। এমন কি অনেকে তো ফ্রয়েডের তত্ত্বকে অবৈজ্ঞানিক বলে ভাবেন। যেমন দার্শনিক কার্ল পপার মনে করেন
, ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণের অনেক সিদ্ধান্ত সত্য না মিথ্যা তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। পপার দর্শনের অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক যে কোন গবেষণায় এমন পরীক্ষা করার সুযোগ থাকতে হবে যাতে বোঝা যায় ঐ তত্ত্বটি ভুল। পপারের মতে যদি সব ধরণের বাস্তব বা সাম্ভাব্য পর্যবেক্ষণ কোন বক্তব্যের পক্ষে যায় তাহলে তা বৈজ্ঞানিক নয়। কারণ তাহলে সেই বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণের কোন উপায় থাকে না। একটি বৈজ্ঞানিক বক্তব্যের জন্যে এমন কোন পর্যবেক্ষণের সম্ভাবনা থাকতেই হবে যার ফলে ওই বক্তব্য ভুল বলে প্রমাণিত হয়। পপার একটি আগ্রহোদ্দীপক উদাহরণ দিয়েছেন। এক লোক এক বাচ্চাকে নদীতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। অন্যদিকে আরেক লোক এসে সেই বাচ্চাকে উদ্ধার করলো। পপার বলেন ফ্রয়েডের তত্ত্ব দিয়ে এই দুই ঘটনাকেই সমানভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ফ্রয়েডের তত্ত্ব হয়তো বলবে প্রথম লোকটি তার ইডিপাস তাড়নাকে অবদমিত করার ফলে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়ার মতো ধ্বংসাত্মক আচরণ করছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় ব্যাক্তি তার অচেতন কামনাকে একটা মহিমান্বিত স্তরে নিয়ে গেছে যার কারণে অন্যের উপকারে আসে এমন সব কাজে নিজেকে নিয়োজিত করছে। যেহেতু ফ্রয়েডের তত্ত্ব দুইটি বিপরীত পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে একই ব্যাখ্যা হাজির করছে, পপারে মতে সেহেতু এই তত্ত্ব অবৈজ্ঞানিক।
ফ্রয়েড বেঁচে থাকলে এই কথার জবাবে হয়তো বলতেন পপারের মধ্যে নিশ্চয়ই কোন অবদমিত তাড়না আছে যার কারণে মনোবিশ্লেষনের প্রতি তিনি আক্রমণাত্মক সমালোচনা করছেন!
তথ্যসূত্র:
A Little History of Philosophy by Nigel Warburton
50 Psychology Classics by Tom Butler-Bowdon।