Wednesday, August 30, 2017

ভূত দেখে অনেকের একসাথে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।

মাঝে মাঝেই সংবাদপত্রে এমন খবর দেখা যায় যে-অমুক স্কুলে ভূত দেখে ১০০/২০০ স্টুডেন্ট অজ্ঞান হয়ে পড়েছে কিংবা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে । গুগলে সার্চ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময়ে মোট ১৮ টা এই ধরনের ঘটনার সন্ধান পেয়েছি । সেগুলো এখানে বলার চেষ্টা করছি । ১৮টা ঘটনার বর্ননা শেষে এই ঘটনার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন করার চেষ্টা করব ।
ঘটনা ১ 
১৮ই এপ্রিল ২০১৭ ।  খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা উপজেলার তৈ মথাং গ্রামে অদ্ভূত কিছু ঘটনা ঘটে । অনেক মানুষ সেখানে পাগলের মত অস্বাভাবিক আচরন শুরু  করে এবং অজ্ঞান হয়ে যায় । ১০০ জনের বেশি মানুষের এই সমস্যা দেখা দেয় । হাসপাতালে প্রায় ৩০জনকে ভর্তি করা হয় ।
বিডিনিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , ঘটনার তিন দিন আগে এক পাহাড়ি বৈদ্য গ্রামবাসীর কাছে জনপ্রতি ১০০ করে টাকা চায়। দুইজন বাদে সবাই টাকা দেয়। কিন্তু ওই বৈদ্য অভিশাপ দিয়ে বলে, সবাই টাকা না দেওয়ায় গ্রামের সবাই পাগলের মতো আচরণ করবে। এরপর থেকে হঠাত কিছু মানুষ পাগলের মত আচরন করা শুরু করেছে । যাদের সমস্যা দেখা যাচ্ছে, তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছেন। মানুষ দেখলে পালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। এক পর্যায়ে অনেকে সংজ্ঞাও হারাচ্ছেন।

পার্বত্য নিউজ ডট কমের আরেক খবরে বলা হয়েছে, প্রথমে রোগী অস্বাভাবিক আচারণ করে অনেকটা হিংস্র আচারণ করে ধারালো অস্ত্র নিয়ে একে অপরকে ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, খাগড়াছড়ির গুইমারায় ২০১১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি একইভাবে অনেক মানুষ একসাথে অসূস্থ হয়েছিল । তখন এলাকাবাসী এ ঘটনার জন্য কর্ণজয় ত্রিপুরা (৫৮) ও কীর্তি কুমার নামে দু’জনকে আটক করছিল (৬০)। গ্রামবাসীর ধারণা ছিল , অসুস্থরা সবাই যাদুটোনার শিকার এবং এর জন্য কর্ণজয় এবং কীর্তিই দায়ি। কীর্তি কুমারের প্ররোচনায় ওঝা কর্ণজয় ত্রিপুরা অপবিদ্যার প্রয়োগে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলও বলে তারা দাবি করেছিল সাংবাদিকদের কাছে ।
রেফারেন্স ,,
ঘটনা  ২
২০১৭ সালের ৪ঠা মার্চ। স্থানঃ যশোরের চাচড়া এলাকায় অবস্থিত আদ-দ্বীন সখিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্সিং ইনস্টিটিউশন।
বলে রাখা ভাল, এটি একটি আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মোট ১৯০ জন ছাত্রী এখানে নার্সিং শেখেন। এদের মধ্যে অনেকেই নার্সিং ইন্সটিটিউশনের হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেন।
শনিবার, ৪ঠা মার্চ রাত ৯টার দিকে দুইতলায় অবস্থিত একটি রুমের দুইজন ছাত্রী হঠাৎ ‘জিন জিন’ বলে চিৎকার করে ওঠে। এর ফলে ওই রুমে থাকা বাকি সবাই আতংকিত হয়ে ওঠে এবং অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। রুমটা ছিল গণরুম, একরুমে গাদাগাদি করে ২৯ জন থাকতো। ২৯ জনের সবাই অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করে। একে অপরের গলাও চেপে ধরে তারা। অনেকের মুখ থেকে ফেনা বের হওয়া শুরু হয়। পাশের রুমের মেয়েরা বিষয়টা জানতে পারলে তাদের ভিতরেও অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে শুরু করে। সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। হুড়াহুড়িতে পায়ের নিচে চাপা পড়ে অনেকে আহত হয়। ৩০ জন ছাত্রীকে যশোর শহরের রেল রোডে অবস্থিত আদ-দ্বীন এর নিজস্ব হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই ৩০ জনের মধ্যে ৫ জন অন্যের পায়ের তলায় চাপা পড়ে আহত হয়েছে। বাকি ২৫ জন ‘জিনের ভয়ে অসুস্থ’ হয়েছে বলে তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো।
কয়েকজন শিক্ষার্থী দৈনিক যুগান্তরের সাংবাদিককে জানান, ইন্সটিটিউটের দোতলার যে রুমে শিক্ষার্থীরা থাকেন, সেগুলোর একটিরও দরজা নেই। আর নিচতলায় তাদের শেখানোর জন্যে একটি লাশকাটা ঘর রয়েছে; ওই কক্ষেরও দরজা নেই। এই কক্ষে তাদের শেখানোর জন্যে মৃতদেহ কাটাছেঁড়া করা হয়। এ কারণে দুইতলার রুমে থাকা শিক্ষার্থীরা প্রায় রাতেই ভয় পান। দুই সপ্তাহ আগে এক ছাত্রী প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন। পরদিন সকালে বিষয়টি তাদের হাউজ কিপারকে জানালে তিনি দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দেন। বিষয়টি বাইরে প্রকাশ করতে নিষেধ করেন তিনি।”
এমন ভুতুড়ে পরিস্থিতিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ ৫ মার্চে ১ সপ্তাহের জন্য নার্সিং ইন্সটিটিউট বন্ধ ঘোষণা করেন। ছাত্রীদের হোস্টেল খালি করে নিজ নিজ বাসায় চলে যেতে বলা হয়। কলেজের অধ্যক্ষ এবং ডাক্তাররা এই বিষয়টিকে ছাত্রীদের ‘মানসিক অসুস্থতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন ।
রেফারেন্স –   ৩ 
নিচের ছবিটা ৫ তারিখ দৈনিক যুগান্তরে ছাপা হয়েছিলো। এখানে দেখা যাচ্ছে আদ-দ্বীন নার্সিং ইন্সটিটিউট থেকে ছাত্রীরা মালপত্র নিয়ে বাসায় চলে যাচ্ছে।
ঘটনা ৩

২০১৬ সালের ২৭শে আগস্ট। স্থানঃ আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকায় ডেকো ডিজাইন নামক একটি গার্মেন্টস কারখানা।
দুপুরের খাবারের বিরতির সময় বেশ কয়েকজন নারী শ্রমিক কারখানার টয়লেট থেকে ফিরে এসে দাবি করেন, টয়লেটে তারা ভূত দেখেছেন। শুনে কৌতূহলী হয়ে আরো কয়েকজন মহিলা টয়লেটে ভূত দেখতে যান। কিছুক্ষণ পর তারা চিৎকার করতে করতে বাইরে বের হয়েই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এসময় আশেপাশে থাকা অন্যরাও ভূতের কথা জানতে পারে এবং আতংকিত হয়ে পড়ে। ৬ তলা গার্মেন্টস বিল্ডিংয়ের সবাই ভূতের কথা জানতে পেরে আতংকিত হয়ে পড়ে। অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে অজ্ঞান হয়ে যায়। অনেকে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত হয়। ৫০ জন শ্রমিককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

কারখানা কর্তৃপক্ষ পরদিন কারখানায় ছুটি দিয়ে দেন।
রেফারেন্স – ২ 
 বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাংবাদিক নাজমুল হুদা ৩০শে আগস্ট ওই কারখানা দেখতে যান । তিনি দেখতে পান, ‘ভূত তাড়ানোর জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কবিরাজ ও ফকির নিয়ে আসা হয়েছে। ওই কারখানার প্রাচীরের চারপাশে সরিষা ও সোনা-রুপার পানি ছিটানো হয়েছে। পরে দুপুরের দিকে ‘ভূত তাড়িয়ে’ কারখানার মূল ফটকসহ প্রতিটি গেটের সামনে ঝুলানো হয় প্রায় ২০টি তাবিজ। এরপর কারখানার ভেতরে আয়োজন করা হয় দোয়া মাহফিলের। এতে ওই এলাকার বিভিন্ন মসজিদের প্রায় ২৭ জন ইমাম অংশগ্রহণ করেন। স্থানীয় মসজিদের হাফেজ নুরুল আমিন বলেন, জিন, ভূত, পেত্নীর কারণে এ কারখানার শ্রমিকরা গত তিন দিন যাবৎ কাজে যোগ দিতে পারছে না। আর এ কারণেই আজকে ভূত তাড়ানোর কাজ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। মিরপুর থেকে আসা নুরুল আহসান ভুঁইয়া নামের এক ফকির বলেন, কারখানায় একাধিক জীন ও ভূত রয়েছে। আর এজন্য কারখানার ভূত তাড়াতে সরিষা, সোনা-রুপার পানি ছিটানো হয়। এছাড়াও ওই কারখানার বিভিন্ন গেটের সামনে তাবিজ ঝুলানো হয়েছে, যাতে করে ভূত দ্রুত পালিয়ে যায়।’
ঘটনা ৪

২০১৬ সালের ২২শে মার্চ। স্থানঃ টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কালিদাস কলিম উদ্দিন হাই স্কুল।
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে অন্যান্য দিনের মতই স্কুলে ক্লাস শুরু হলো। কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার একটু পর সপ্তম শ্রেণির জাহিদ হাসান হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তাকে বিদ্যালয়ের বারান্দায় নিয়ে মাথায় পানি ঢালা শুরু হলো। দেখাদেখি অন্য ক্লাসের ১৪ জন শিক্ষার্থীও একে একে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে শিক্ষকরা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা যোগে তাদেরকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সখীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। অসুস্থ ছাত্রছাত্রীরা হচ্ছে – নবম শ্রেণির শিলা, স্বপ্না রানি, অন্তরা, সপ্তম শ্রেণির মুক্তি, আলিফ, সুলতানা, সীমা, জাহিদ হাসান, আশিস সরকার ষষ্ঠ শ্রেণির আরজিনা, তাসলিমা, দোলন আক্তার ও রিশিতা আক্তার (অসুস্থ ১৪ জনের মধ্যে ১২ জনই মেয়ে)।
রেফারেন্স – ২ 
ঘটনা ৫

২০১৬ সালের ৫ই মার্চ। স্থানঃ মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার জোড়পুকুরিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।
সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মিম, মিমারা, প্রমা ও ঋতু জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরে জ্ঞান ফিরলে তারা জানায় হাত, পা ও মাথাবিহীন রক্তমাখা ভূত এসে তাদের গলা টিপে ধরেছে। এর বাইরে আর কিছু বলতে পারেনি তারা। এ খবর পেয়ে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যান। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানিয়ে বাধ্য হয়ে স্কুল ছুটি ঘোষণা করা হয়।
 ঘটনা ৬

২০১৬ সালের ১৯ শে জানুয়ারি। ফরিদপুরের শিবরাম রোড একাডেমী স্কুলের ছাত্রী রিতু সাহা শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার সময় হঠাৎ অস্বাভাবিক বোধ করে। তার সমস্যার কথা জানাজানি হলে প্রাথমিক চিকিৎসাও দেয়া হয়। কিন্তু একই সময় তার ৩৭ জন সহপাঠীও একই ধরণের উপসর্গের কথা বলে। শিক্ষক সুশান্ত কুমার বলেন, ‘সে সময় আমরা সকল শিক্ষার্থীকে ক্লাসরুম থেকে সরিয়ে মাঠে অবস্থান নিতে বলি। কিন্তু একটু পরেই দেখা গেল তাদের মধ্যে ৩০ জন (শুধু বালিকা) শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’ স্কুল পরিদর্শক গণপতি বিশ্বাস বলেন, ‘ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় শ’ খানেক ছাত্রী আক্রান্ত হয়।’ প্রথমে একজন শিক্ষার্থী শ্বাস গ্রহণ করার সময় আক্রান্ত হয়। পরে বাকীরাও একইভাবে অসুস্থ বোধ করতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সবার মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে।’
প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত শিক্ষার্থীদেরকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিহ্নিত উপসর্গের প্রেক্ষিতে ডাক্তারেরা রোগ নির্ণয় করতে পারেননি। এমনকি উপসর্গের সাথে অসুস্থতার কোন কারণও খুঁজে পাননি। ডাক্তারেরা সম্ভাব্য যত কারণ ধারণা করেছিলেন, আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের রোগের সঙ্গে তার কোনো সঙ্গতি ছিল না। কোনো কোনো কারণের সঙ্গতি থাকলেও তা ছিলো ন্যূনতম।
ঘটনাটি জানাজানি হলে পরের দিন পাশের স্কুলের (খলিলপুর উচ্চ বিদ্যালয়) অনেক শিক্ষার্থীও ক্লাস চলাকালীন সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে উপজেলার অন্যান্য স্কুলেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় আতঙ্ক কাটাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৩ ও ২৪শে জানুয়ারি সদর উপজেলার ৫৭টি স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
রেফারেন্স –  ২ 
ঘটনা ৭

নারায়ণগঞ্জ, ২৪শে জানুয়ারি ২০১৬।
সকাল ১০টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত আদমজী ইপিজেডে ‘ডিএনবি ক্লথিং’ নামের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় শাহিদা বেগম নামের এক নারী শ্রমিক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে ২০ জন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে পুরো কারখানায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে তাদেরকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ঘটনা ৮

২০১৫ সালের ৩০শে আগস্ট। মেহেরপুরের শৈলমারি সেকেন্ডারি গার্লস স্কুল।
সকাল সাড়ে ৯টায় ক্লাস শুরু হলে ক্লাস সিক্সের ছাত্রী মুক্তা বেগম হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তার অজ্ঞান হওয়া দেখে আরো প্রায় ৪০/৪৫ জন ছাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সবাইকে মেহেরপুর জেনারেল হাওপাতালে ভর্তি করা হয়।  সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য স্কুল কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রেফারেন্স — ২ 
ঘটনা ৯

২০১৫ সালের ১১ই আগস্ট। বরগুনার হরিটানা মডেল হাই স্কুল।
ক্লাস চলাকালীন হঠাৎ ৫ জন স্টুডেন্টের শরীরে খিঁচুনি শুরু হয়। অনিয়ন্ত্রিতভাবে তাদের হাত পা কাঁপতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা অজ্ঞান হয়ে যায়। তাদেরকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। একইভাবে ১২ তারিখে আরো ৮ জন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। ১৩ তারিখে অসুস্থ হয় আরো ৩ জন। তবে ১৩ তারিখে পাশের স্কুল তাসলিমা মেমোরিয়াল একাডেমির ২ জন ছাত্রীও একইভাবে অসুস্থ হয় এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়। সব স্টুডেন্টের বয়স ১২-১৬ বছরের মধ্যে।

ঘটনা ১০

২০১৫ সালের ১৮ই জুন। স্থানঃ গাজীপুর সদর উপজেলার ইসলামপুরে অবস্থিত নর্ফ নিটিং গার্মেন্টস (Norf Knitting Garments)।
এক মহিলা টয়লেট থেকে বের হয়েই অসূস্থ বোধ করতে থাকেন। তিনি দাবি করেন, টয়লেটের ভিতরে কোনো খারাপ জিনিস বা ভূত তার উপরে ভর করেছে। ফলে তিনি অসুস্থ হয়েছেন। তার এই অসুস্থতার খবর ফ্যাক্টরির সবাই জেনে যায়। সবাই আতংকিত হয়ে পড়ে। ফ্যাক্টরীতে ভূত আছে, এখানে কাজ করা নিরাপদ নয় – এই দাবি তুলে অনেকে কাজ করতে অস্বীকার করেন। মালিকপক্ষ তাদেরকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। শ্রমিকরা কাজ করতে অস্বীকার করেন। তাদের দাবি – কারখানায় হুজুর ডেকে মিলাদ পড়ানো হোক, তাবিজ কবজ বেঁধে কারখানা থেকে ভূত তাড়ানো হোক, তারপর তারা কাজে যোগ দেবেন। এই দাবিতে প্রায় ৩৫০০ জন শ্রমিক কারখানার সামনে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা ভাংচুর করাও শুরু করেন। গাজীপুর জেলার শিল্প পুলিশ ডেকে এনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হয়। পুলিশের সংগে তখন শ্রমিকদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ২ জন পুলিশ সহ মোট ১৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
রেফারেন্স –  ২ 
ঘটনা ১১

২০১৫ সালের ১৩ মে। স্থানঃ পাবনার বোরাদনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়।
ক্লাস ফাইভের ছাত্রি রুমি খাতুন স্কুলের টয়লেট থেকে ফিরে আসার পরেই শ্বাসকষ্ট এবং প্রচণ্ড মাথা ব্যথা অনুভব করে। তাকে দ্রুত চাটমোহর উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরদিন ১৮ মে, রুমি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এরপরে ওই স্কুলের আরো ৮ জন ছাত্রী একে একে অসুস্থ হয়ে পড়ে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই ৮ জনের সবাই ওই নির্দিষ্ট টয়লেটে গিয়েছিলো। এই ঘটনার পরে ভয়ে সবাই স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। বাধ্য হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলটি বন্ধ করে দেয় কিছুদিনের জন্য।
এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, স্কুলের টয়লেটের পাশে অনেক বড় একটা তালগাছ ছিলো। ঐ গাছে একটা ভূত থাকতো। তালগাছ কেটে ফেলার পর ভূতটা টয়লেটের ভিতরে আশ্রয় নিয়েছে। মেয়েরা ওই টয়লেটে ঢুকলে ভূতটা মেয়েদের ঘাড়ে ভর করে, ফলে মেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ে।
রেফারেন্স  ২ 
ঘটনা ১২

২০১৫ সালের পহেলা মার্চ। স্থানঃ পাবনার কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ।
পহেলা মার্চ দুপুরে শিক্ষক আনিসুর রহমান অংক ক্লাস নিচ্ছিলেন। এ সময় নদী নামক একজন ছাত্রীর পানির বোতল থেকে অদ্ভুত শব্দ বের হতে থাকে। শিক্ষক নদীকে তার পানির বোতল বের করতে বলেন। নদী তার পানির বোতল বের করে টেবিলের উপরে রাখে। তখন বাতাসের বুদবুদের কারণে অথবা অন্য কোনো এক অজানা কারণে বোতলটি বেশ শব্দ করে ফেটে যায়। এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যায়। ক্লাসরুম থেকে তখন মোট ২৫ জনকে পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের প্রত্যেকেই ক্লাস নাইনের ছাত্রী, সবার বয়স ১৩ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার বিএম শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, বোতলে বোমা জাতীয় কোনো কিছু ছিলো না। মেয়েরা শুধুমাত্র ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
রেফারেন্স-   ২  

ঘটনা ১৩

২০১৩ এর জুন মাস। রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ার ফলে এক হাজারেরও বেশি পোশাক কর্মী নিহত হন। এ ঘটনার পর বেশ কিছু পোশাক কর্মী বিভিন্ন কারণে অসুস্থ হতে থাকেন। অধিকাংশ পোশাক কর্মীর দাবি ছিলো, ফ্যাক্টরির সাপ্লাই করা পানি নোংরা এবং দূষিত। এই পানি খেয়ে তাদের পেট খারাপ হয়েছে। ডায়রিয়া, বমি, শ্বাসকষ্ট কিংবা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মত কিছু রোগের উপসর্গও তাদের দেখা দিতো। এদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার এবং প্যাথলজিস্টরা সংশ্লিষ্ট গার্মেন্টসের পানি সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেন। তারা জানান, পানিতে কোনো রোগ জীবানু পাওয়া যায়নি। তাদের ধারনা, পোশাক কর্মীরা মানসিক কারণে অসূস্থ হয়েছেন, পানি খেয়ে তাদের অসুস্থ হওয়ার কথা নয়।

আরেকটি বিদেশী নিউজপেপার থেকে জানতে পেরেছি, জুন মাসের ১৯ তারিখে কোনো একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ভূত তাড়াতে স্পেশাল মিলাদের আয়োজন করা হয়েছিলো। ওই ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের দাবি ছিলো, ভূতের কারণেই তাদের কর্মীরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।

ঘটনা ১৪
২০১১ সালের ১৫ অক্টোবর। স্থানঃ সাভারের শিমুলতলা এলাকার ফ্যান ফ্যাশন গার্মেন্টস কারখানা।
টয়লেট থেকে বের হয়ে বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানান, তাদেরকে ভূতে ধরেছে। প্রথমে অল্প কয়েকজন এরকম কথা বলতে থাকে, কিন্তু বিষয়টা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ১৫ তারিখে এ রকম ১৫ জন ‘ভূতে ধরা’ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৬ তারিখে আরো ৭ জন শ্রমিককে ভূতে ধরে। শ্রমিকরা টয়লেট থেকে বের হয়েই বমি করা শুরু করে। কেউ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলে শ্রমিকরা চিৎকার করে বলে, ‘আমাকে বাঁচাতে এসেছিস? এখন তোকেও ভূতে ধরবে’। এ কারণে কেউ সাহস করে সাহায্য করতে যেতে চায়নি। সোমবারে কারখানাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ঘটনা ১৫
২০১১ সালের জুলাই মাসে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে বেশ কিছু অদ্ভুত খবর নজরে এলো। এ স্কুলে মাসের পর মাস ধরে ‘অজ্ঞান হয়ে যাওয়া’ রোগ চলতেই থাকে, ছাত্রীরা কোনোভাবেই সূস্থ হচ্ছিলো না। স্কুলের জিন/ভূত/খারাপ নজর তাড়াতে অনেক চেষ্টা তদবির করা হয়। আমি ওই সময়ে প্রকাশিত খবরের কাগজ থেকে এখানে কপি পেস্ট করছিঃ
_ _ _ _ _ _
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরমোহনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে এক ঘণ্টার মধ্যে অজ্ঞাতরোগে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ৪০ ছাত্রী।
 
শিক্ষক ও অভিভাবকদের ধারণা ছাত্রীদের ওপর ‘জ্বীন-পরী’ আছর করেছে।
 
কথিত ‘জ্বীন-পরী’ তাড়াতে বৃহস্পতিবার বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অভিভাবকদের সহযোগিতায় ‘শেফা’ খতমের আয়োজন করে বিদ্যায়লয় কর্তৃপক্ষ। এ সময় খতমে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তাবারক হিসেবে এক মণ মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
 
এদিকে, গত এক সপ্তাহ ধরে শিক্ষক ও অভিভাবকরা স্থানীয় ইমাম ও কবিরাজের পরামর্শে বিদ্যালয় মাঠে প্রতিদিন ১৫০টি করে তাবিজ আগুনে পোড়াচ্ছেন।
 
অন্যদিকে, অসুস্থ ১০ ছাত্রীকে সোমবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে হাজির করে শিক্ষকরা ‘কথিত জ্বীন’ তাড়াতে উপজেলা পরিষদ মসজিদের ইমামকে ডেকে আনেন। সেখানে তিনি ঝাড়ফুঁক দিয়ে ছাত্রীদের জ্বীন তাড়ানোর চেষ্টা করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী উপজেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান।
 
চরমোহনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ হারুনুর রশিদ জানান, জুনের মাঝামাঝি থেকে প্রতিদিন ক্লাস চলাকালে ১৫ থেকে ২০ জন ছাত্রী দৃশ্যমান কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে বেঞ্চ থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
 
জবা, জোনাকি, সূর্যমুখী, কৃষ্ণদাস, কৃতদাস, মানিক, লালপরী ও সাদাপরী নাম নিয়ে ছাত্রীরা নিজেদের জ্বীন-পরী পরিচয় দিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করে ও অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে। অসুস্থ ছাত্রী লিমা তার পিতাকে বলে, ‘তুই এখানে কী করছ’ ? অন্যরাও শিক্ষক ও তাদের অভিভাবকদের অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে।
 
৫ থেকে ৭ ঘণ্টার মধ্যে অধিকাংশ ছাত্রীই ফের সুস্থ হয়ে ওঠে বলে জানান প্রধান শিক্ষক।
 
তিনি জানান, কোনো কোনো ছাত্রী ১০-১২ বার এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তবে বাড়িতে থাকলে ছাত্রীরা স্বাভাবিক থাকে। এ কারণে শিক্ষক ও অভিভাবকদের ধারণা, শত বছরের পুরোনো বিদ্যালয় অঙ্গনে থাকা জ্বীন-পরীই ছাত্রীদের ওপর আছর করেছে। তাই তারা মসজিদের ইমাম ও কবিরাজের শরণাপন্ন হয়েছেন।
 
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুনুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘ক্লাশ চলাকালীন সময়ে ছাত্রীরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মাটিতে লুটে পড়ে। তারা উচ্চস্বরে অসংলগ্ন কথা-বার্তা ও অশোভনীয় অঙ্গভঙ্গি করে। অসুস্থরা ১ থেকে ৭ ঘণ্টা পর সুস্থ হতে শুরু করে। দুপুরে যোহরের নামাজের সময় ছাত্রীরা অসুস্থ হয়। সুস্থ হওয়ার পর তাদের কেউ কেউ জিন-পরী কর্তৃক তাদেরকে মারধর ও ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার কথা আমাদেরকে জানায়।’
 
রায়পুর উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদের খতিব ও ওই বিদ্যালয়ে জিন তাড়ানোর তদবিরকারী মাওলানা আবুল হোসাইন বলেন, ‘জিন-পরী তাড়াতে আমি বিদ্যালয়ে ৫-৬ বার গিয়েছি। সেখানে জিনের আস্তানা আছে। বর্তমানে দিন যত যাচ্ছে, জিন তত উগ্র হচ্ছে। আমার পরামর্শক্রমেই শিক্ষক ও এলাকাবাসী শেফা খতম, বিদ্যালয়ে মিলাদ ও তাবিজ পুঁড়িয়েছে।’
 
তিনি আরও বলেন, ‘নিরুপায় হয়ে শেষমেশ সূরা জিন পাঠ ও জিনের বাদশাকে সতর্ক করে চিঠি ও লাল পতাকা ঝুলিয়েছি। আমি আমার অবস্থানে থেকে জিন তাড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হচ্ছেনা। আসলে বিষয়টি রহস্যজনক। তবে জিন তাড়ানোর নামে কেউ আর্থিক চুক্তি করলে তা সম্পূর্ণ হারাম।’
 
হায়দরগঞ্জ তাহেরিয়া এমআর ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুল আজিজ মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, ‘জিনের অস্তিত্ব আছে সত্য। জিন দুই-একজন ছাত্র-ছাত্রীর ওপর ভর করলে তারা অসুস্থ হতে পারে। কিন্তু পর্যায়ক্রমে বেশি সংখ্যক ছাত্রী অসুস্থ হওয়ার কথা নয়।’
 
এ সুযোগে কিছু লোক জিনের ধোঁয়া তুলে ব্যবসা করছে বলে তিনি দাবি করেন।
 
তদবিরকারী রায়পুর উপজেলা ইমাম ও মুয়াজ্জিন সমিতির সভাপতি সালেহ আহাম্মদ বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক আমাকে বিদ্যালয়ে নিয়ে গেছে। আমি অসুস্থদের সাথে কথা বললে তারা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে বিদ্যালয়ে জিন আছে, ভূত নেই। এর থেকে উত্তরণের জন্য আমি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লক্ষ্মীপুরের মান্দারীর জিন তাড়ানোর ওস্তাদ আবদুল সাত্তার খনকারের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছি। তিনি মারা গেছেন, তার ছেলে ফজল খনকার বর্তমানে এসবের ভালো তদবির দেন।’
 
শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসলে পর্যায়ক্রমে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। হঠাৎ করে তাদের প্রচন্ড মাথা ব্যাথা, জ্বর ও বমি হয়। আক্রান্তরা এরপর বেঞ্চ ও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি যায়। পরে জ্ঞান ফিরলে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে। অসুস্থদের কারো কারো মুখ দিয়ে লালা ঝরে।
 
জবা, জোনাকী, দিদি মনি, সূর্যমুখী, নূপুর, ঝুমুর, রাজরাণী, কালাপরী, হলুদপরী, রাধাকৃষ্ণ, কৃষ্ণদাস, কৃতদাস, মানিক, লালপরী ও সাদাপরী নাম নিয়ে ছাত্রীরা নিজেদেরকে ‘জিন-পরী’ পরিচয় দিয়ে এ ধরণের আচরন করে।
 
অসুস্থ ছাত্রী লিমা আক্তার তার পিতাকে বলে- ‘তুই এখানে কি করছ?’ অন্যন্যারাও শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতি অস্বাভাবিক আচরণ করে রুম থেকে তাদেরকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য বলে।
 
একবার সুস্থ হওয়ার পর বিদ্যালয়ে ফেরা শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ পরে আরও ১০-১২ বার এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বাড়িতে থাকাকালীন তারা স্বাভাবিক থাকে। তবে রাতে কয়েকজন ছাত্র -ছাত্রী ঘুমের ঘোরে চিৎকার ও চেঁচামেচি করে ওঠে বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন।
রেফারেন্স   ৩ 
ঘটনা ১৬
২০১০ সালের ২৭শে অক্টোবর। গাইবান্দার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার একটি স্কুল (স্কুলের নাম বের করতে পারিনি)। ওই সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে হাঁই এনার্জি বিস্কুট দেওয়া হতো। সকাল সাড়ে ১০টায় স্কুলে টিফিনের টাইম হয়। ক্লাস মনিটর সবাইকে বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে যায়। ক্লাস থ্রির একজন ছাত্রী তখন বলে, ‘আমার বিস্কুটের প্যাকেটের রঙ দেখে মনে হচ্ছে এটা ভাল না। আমাকে বদলে আরেকটা প্যাকেট দাও’। মনিটার তখন শিক্ষককে এই কথা বলে। শিক্ষক তখন ওই ছাত্রীকে বলেন, ‘প্যাকেট বদলে দেওয়া যাবে না, যেটা পেয়েছো সেটাই খাও’। মেয়েটা সেটাই খেতে লাগলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, চোখে ঝাপসা দেখা ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা অনুভব করতে লাগলো। তার কথা শুনে ক্লাসের ১৮জন স্টুডেন্টও একই সমস্যার কথা শিক্ষককে জানালো। শিক্ষক দ্রুত তাদেরকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। পরদিন সতর্কতা হিসেবে স্কুলে কোনো বিস্কুট দেওয়া হল না। কিন্তু তারপরেও ৩ জন স্টুডেন্ট অসুস্থ হয়ে গেলো। খবর ছড়িয়ে পড়লে পাশের শাহঘাটাতে আরো ২টি স্কুলে ৩০শে অক্টোবর বেশ কিছু স্টুডেন্ট অসুস্থ হয়ে পড়লো। ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ দল গিয়ে বিস্কুটের নমুনা পরীক্ষা করলেন। কিন্তু সেখানে ক্ষতিকর কিছু পাননি তারা। এই বিস্কুট খেয়ে কোনো মানুষের অসুস্থ হওয়ার কথা নয়–এমনটাই দাবি তাদের।
ঘটনা ১৭

২০১০ সালে চট্টগ্রামের একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো এ রকম ঘটনার কারণে। ৭০০ জন কর্মী অভিযোগ করেছিলো, জ্বিনের আছরের কারনে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
ঘটনা ১৮

২০০৭ সালের জুলাই মাস। কোনো কারণ ছাড়াই নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, শেরপুর এবং পাবনার কমপক্ষে ২০৭ জন ছাত্রছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লো। ক্লাস শুরু হলে দেখা যায়, ক্লাসের কোনো এক কোণায় একজন স্টুডেন্ট মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। তার অজ্ঞান হওয়া দেখে ক্লাসের আরো অনেকে তাৎক্ষনিকভাবে অজ্ঞান হয়ে যায়।
ঘটনা ১৯

ভূত দেখে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে প্রাচীন ঘটনা সম্ভবত ২০০৫ সালে। কিন্তু ওই সময়ের কোনো ঘটনার লিংক পাচ্ছি না। অন্যান্য নিউজের সাথে ফুটনোট হিসেবে ২০০৫ এর ঘটনা পেয়েছি। সেখান থেকে জানতে পেরেছি, ২০০৫ সালের আগস্টে কয়েক ডজন স্কুল বন্ধ করে দিতে হয়। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অজানা কোনো বিষয়ে ভয় পেয়ে ধারাবাহিকভাবে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলো, তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ এই পদক্ষেপ নেয়।
রেফারেন্স-   ২ 
ঘটনা ২০
২০১৭ সালের ৭ই এপ্রিল কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানোর পরে অনেক বাচ্চা অসূস্থ হয়ে পড়তে থাকে ।ট্যাবলেট খাওয়া অনেক শিক্ষার্থী মাথা ঘোরা, পেট ব্যাথা, বমিভাবসহ বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে শুরু করে। প্রথম তিন দিনে এরকম ৯০০ শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
(রেফারেন্স-  ৩ )

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘ঝিনাইদহে কৃমিনাশক ওষুধ খেয়ে একটি শিশু মারা গেছে’—এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল পহেলা এপ্রিল। এই গুজব শোনার পরে অভিভাবকেরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। বাচ্চারাও একজনের মৃত্যুর খবর শোনার পরে অসুস্থ অনুভব করতে থাকেন। অভিভাবকরা তখন তাদেরকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
এই ঘটনা নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের গুজব ছড়াচ্ছেন। কেউ বলছেন, ভেজাল ওষুধ খাওয়ানোর ফলে এই অবস্থা। যদিও ডাক্তাররা বলেছেন তাদের কারো কোন শারীরিক অসূস্থতা নেই, এদের রোগটা মানসিক। রোগের নাম গণমনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতা (Mass psychogenic illness অথবা mass hysteria)। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অতীতে অনেকবার এই রোগ দেখা গেছে। বাংলাদেশেও হয়েছে একাধিকবার। এই রোগ নিয়ে অযথা আতংকিত হওয়ার কিছু নেই ।
২০১৩ সালে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খেয়ে অনেক বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। ওই সময় বিভিন্ন মিডিয়ায় দাবি করা হয়েছিলো, ক্যাপসুল সরবরাহকারী দুইটা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শত্রুতা রয়েছে। এই বছর ক্যাপসুল কেনার কন্ট্রাক্টরি পেয়েছিল কোম্পানি এ (ধরি)। এতে ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে কোম্পানি বি ক্যাপসুলের কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং ওই ক্যাপসুল খেয়ে অনেকে অসূস্থ হচ্ছে এমন গুজব ছড়িয়ে দেয়। ওই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল দাবি করেছিলো, এই ক্যাপসুল ইন্ডিয়া থেকে আমদানি করা এবং এন্টি ইন্ডিয়ান সেন্টিমেন্ট থেকেই তারা শিশু অসুস্থের গুজব ছড়িয়েছিলো (খবর-  ২ )। যাই হোক, এ বিষয়ে তখন আর কোনো তদন্ত হয়নি, তাই আমরা জানি না ঘটনাটা কী ছিলো।
রহস্যের সমাধান : বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন
বাংলাদেশে IEDCR (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ, এবং গবেষণা ইন্সটিটিউট) নামে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। রহস্যময় কোনো অসুখ হলেই তাদেরকে খবর দেওয়া হয়। তারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানায়, রোগটি আসলে কী। এ পর্যন্ত তারা মোট ৭টি ঘটনাকে মাস হিস্টিরিয়া বা মাস সাইকোজেনিক ইলনেস বলে চিহ্নিত করেছে। ওয়েবসাইটে ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরন পেলাম না, কেবল স্থান এবং তারিখ পেলাম।
৮/২/২০১৫ সাভার
১৩/৯/২০১৪ গৌরনদী, বরিশাল
৪/৫/২০১৩ তেওতা, শিবালয়, মানিকগঞ্জ
৩০/৬/২০১৩ আশুলিয়া, দ্য রোজ ড্রেসেস
৯/৭/২০১০ ঈশ্বরগঞ্জ
১৪/১০/২০১৫ Qwait Amal Orphanage, Jhikorgacha, Jessore
জুলাই,২০০৭ নরসিংদি
বাংলাদেশের বাইরেও মাস হিস্টিরিয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে। এখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের উল্লেখযোগ্য মাস হিস্টিরিয়ার কিছু ঘটনা জানাচ্ছি। সব ঘটনাই উইকিপিডিয়া  থেকে কালেক্ট করা।
১ । ১৯৬২ সালের ৩০শে জানুয়ারি তাঞ্জানিয়ার কাশাশার একটি স্কুলে একজন টিচার একটা জোক বলেছিল। মজা পেয়ে স্টুডেন্টরা হেসে দিল। কিছুক্ষন পরে সবার হাসি থামলেও ৩ জন এর হাসি থামেনি। তারা হাসতেই লাগল। তাদের দেখে অন্যরাও আবার হাসা শুরু করল। কিছুতেই তারা হাসি থামাতে পারছিল না। ওই ক্লাসরুমের হাসি তখন অন্যান্য ক্লাসের স্টুডেন্টদের মাঝেও সংক্রামিত হল। একসময় পুরো স্কুলের সব স্টুডেন্ট একসাথে হাসতে লাগল।
অনেকে দ্রুত সুস্থ হয়েছিল, কিন্তু অনেকের হাসি থামতে অনেক সময় লেগেছিল। সর্বোচ্চ ১৬ দিন পর্যন্ত কেউ কেউ হেসেছিলেন।
২। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে শ্রীলংকার ১১০০ জন ছাত্রছাত্রী মাস হিস্টিরিয়ার লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ওদের স্কুলগুলো ৩ দিন বন্ধ রাখা হয়েছিল।
৩। ২০০৯ সালে আফগানিস্তানের কিছু স্কুলছাত্রী অভিযোগ করে, তাদের স্কুলের আশেপাশে বিষাক্ত গ্যাস রয়েছে, এর ফলে তারা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। ন্যাটো এবং অন্যান্য অনেক সংস্থা পরীক্ষা করে কোনো বিষাক্ত গ্যাসের সন্ধান পায়নি, তারা একে ম্যাস হিস্টিরিয়া বলে চিহ্নিত করেন।
৪। ১৯৯০ সালে কসোভোয় ৪০০০ জন বিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রী মাস হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এদের অধিকাংশ ছিল সংখ্যালঘু আলবেনিয়ান।
৫। ১৯৮৩ সালে ফিলিস্তিনের ৯৪৩ জন ছাত্রী এবং গেরিলা যোদ্ধা মাস হিস্টিরিয়ার লক্ষণ নিয়ে হাসপাতলে ভর্তি হয়। তাদের দাবি ছিল, ইজরাইল তাদের উপর রাসায়নিক বোমা ছুঁড়েছে, যদিও এমন বোমার কোনো লক্ষণ ডাক্তাররা খুঁজে পাননি।
৬। ১৫১৮ সালে ইউরোপে মাস হিস্টিরিয়াতে আক্রান্ত অনেক মানুষ রাস্তায় রাস্তায় নেচে বেড়াতো।
৭। ১৫০০ শতাব্দীর আশেপাশে, ফ্রান্সের একজন গীর্জার সেবিকা বিড়ালের মত মিউ মিউ করা শুরু করলেন। তার দেখাদেখি ওই গীর্জার সবাই মিউ মিউ করা শুরু করল। আশেপাশের গীর্জাতেও এই ‘বিড়াল হওয়া রোগ’ ছড়িয়ে পড়ে।
যখন অনেক মানুষের একসাথে হিস্টিরিয়া রোগ হয়, তখন তাকে বলে মাস হিস্টিরিয়া। আসুন এই রোগটি সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করি।

হিস্টিরিয়া

গ্রিক শব্দ ‘হিস্টেরা’ বা জরায়ু থেকে উৎপত্তি হয়েছে ‘হিস্টিরিয়া’ শব্দের। একসময় মনে করা হতো, নারীর জরায়ুর কোন অস্বাভাবিক অবস্থার কারনেই হিসটিরিয়ার সৃষ্টি। পরবর্তীতে একে মানব মনের এক ধরনের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অনেক সময় একে কনভার্সন ডিসঅর্ডার বা ‘কনভার্সন ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার’ বলা হয়। কনভারসন ডিসঅর্ডারে হাত-পা অবশ হওয়া, কথা বলতে না পারা—প্রভৃতি শারীরিক লক্ষণ দেখা যায় (যদিও প্রকৃতপক্ষে শারীরিক কোনো সমস্যা থাকে না)। আর ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডারে বিভিন্ন মানসিক লক্ষণ দেখা যায়। যেমন – নিজের পরিচয় মনে করতে না পারা, নিরুদ্দেশে চলে যাওয়া, পূর্বের স্মৃতি ভুলে যাওয়া প্রভৃতি।
আমাদের অবচেতন মনের কিছু অবদমিত সহজাত কামনার সঙ্গে আমাদের সামাজিক আচারের সংঘাত ঘটে। সৃষ্টি হয় সহ্যতীত উত্কণ্ঠা ও মানসিক চাপ। ফলে আমাদের অজ্ঞাতেই কিছু মানসিক ক্রিয়া সেই সহজাত কামনাগুলোকে দমন করে। যখন কোনো কারণে মানসিক ক্রিয়াশক্তি দুর্বল হয়ে যায়, তখন সেই অবাঞ্ছিত অবদমিত কামনাগুলো সজ্ঞান চেতনায় উঠে আসতে চায়। শুরু হয় দ্বন্দ্ব, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নানা শারীরিক লক্ষণে। কারও কারও মতে, সামাজিক বিধিনিষেধ যখন আমাদের কামনা-বাসনাগুলোকে অবদমিত করে রাখে, তখন সেই অবদমিত কামনা-বাসনাগুলো অন্যভাবে (শারীরিক লক্ষণ হিসেবে) প্রকাশ পায়; তখন হয় হিস্টিরিয়া।
মস্তিষ্কে বাঁ ও ডান – দুটি অংশ থাকে। যখন কোনো কারণে দুই অংশের কাজে সমন্বয়হীনতা ঘটে, তখন হিস্টিরিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন। মস্তিষ্কের ‘ব্যাসাল গ্যাংলিয়া’ ও ‘থ্যালামাস’—এ দুটি অংশকে হিস্টিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে ধারণা করা হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে যদি কাউকে নিপীড়ন করা হয়, কেউ যদি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, কাউকে যদি কোনো কারণে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং এসব ক্ষেত্রে তারা যদি বিষয়টি প্রকাশ করতে না পারে, উপযুক্ত প্রতিকার না পায়, তবে অবদমিত ক্ষোভ ও ধ্বংসাত্মক মনোবৃত্তি থেকে হিস্টিরিয়া দেখা যেতে পারে।
একটি কেস স্টাডি পর্যালোচনা করা যাক।
ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষার্থী মিতু হঠাৎ করেই বলতে লাগলো, তার খুব খারাপ লাগছে। বলতে বলতেই গড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে। সবাই ধরাধরি করে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। মিতুর দুই চোখ শক্ত করে বন্ধ, সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে খুব জোরে জোরে, যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। হাজারো ডাকাডাকি, চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেওয়া হলো, তবু সে চোখ খুলল না। শক্ত করে বন্ধ থাকা তার দুই চোখ পিটপিট করছে কেবল। বাবা-মা অস্থির হয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন কাছের একটি হাসপাতালে। পরীক্ষা করে চিকিত্সক তাঁদের জানালেন, মিতু সম্ভবত হিস্টিরিয়া রোগে ভুগছে।
মিতুর ঘটনার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন, সামনে তার এইচএসসি পরীক্ষা কিন্তু পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো নয়। তার এই খারাপ প্রস্তুতি সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তার মধ্যে তৈরি হয়েছে তীব্র মানসিক চাপ ও উত্কণ্ঠা। আর সেই মানসিক চাপের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার শারীরিক লক্ষণের মধ্য দিয়ে। আবার এমনটাও হতে পারে, সে তার এক সহপাঠীকে পছন্দ করে, কিন্তু তার বাবা-মা সেই সম্পর্ক মেনে নিতে পারছেন না। আবার মিতুও তার বাবা-মায়ের মতের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তাই তার মনের অন্তর্দ্বন্দ্বগুলো শারীরিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আবার এমনটাও হতে পারে, মিতু তার বাড়িতে বা কলেজে বা কোচিংয়ে কারও দ্বারা ক্রমাগত উত্ত্যক্ত হচ্ছে, কিন্তু লজ্জায় সে কাউকে তা বলতে পারছে না। তখন বলতে না পারা কথাগুলো তার মনে তৈরি করছে মানসিক চাপ ও দ্বন্দ্ব, যার প্রকাশ ঘটছে শারীরিকভাবে।
এরকম আরো অসংখ্য কারণে (মানসিক দ্বন্দ্ব) হিস্টিরিয়া হতে পারে। প্রথম পিরিয়ড হওয়ার সময় কাউকে লজ্জায় কিছু বলতে না পারা থেকে হিস্টিরিয়া হতে পারে। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সম্পর্কে মুখ বুজে থাকা, কারো সাথে শেয়ার করতে না পারার কারনে হিস্টিরিয়া হতে পারে। চিকিৎসক আনোয়ারা সৈয়দ হকের লেখা ‘মানসিক সমস্যার গল্প’ বইটাতে ৩০ বছর বয়স্ক এক হিস্টিরিয়া রোগীর কাহিনী বর্ননা করা হয়েছে। মহিলার স্বামীর সাথে তার বয়সের ব্যবধান অনেক বেশি। তার স্বামীর যৌবন তখন শেষ হয়ে গেছে। মহিলার সাথে তিনি আর শারীরিকভাবে মিলিত হতে পারেন না। কিন্তু মহিলার যৌবন তো আর শেষ হয়নি, তিনি তো আর অক্ষম নন। স্বামীর অক্ষমতার কারনে তিনি কেন সুখ থেকে বঞ্চিত হবেন? এটা এমন এক সমস্যা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ মেয়েই এই সমস্যার কথা কাউকে বলতে পারে না। গল্পের ভিক্টিম কাউকে কিছু বলতে না পেরে শেষ পর্যন্ত হিস্টিরিয়ার রোগীতে পরিণত হয়েছিলো এবং আনোয়ারা সৈয়দ হকের চেম্বারে এসেছিলো।
এদেশে নারীরা এমনিতেই সামাজিক ভাবে নানা সময় লাঞ্ছনা, অবহেলা বা শারীরিক অত্যাচারের স্বীকার হন, যার ফলে প্রধানত মহিলাদেরকেই হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে জিনের আছর ওয়ালা একটি মেয়ের ভিডিও পেয়েছি। সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটির হিস্টিরিয়া হয়েছে।
জহির রায়হানের লেখা ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি আমাদের সময়ে SSC-এর সহপাঠ হিসেবে ছিলো। এ উপন্যাসে মজু ব্যাপারীর মেয়েকে একদিন ভূতে ধরে। ভূত ছাড়ানোর জন্য তাকে গনু মোল্লার কাছে নিয়ে আসা হয়। তবে উপন্যাসের বর্ণনা পড়ে মনে হয়, মজু ব্যাপারীর মেয়ে আসলে হিস্টিরিয়াতে আক্রান্ত হয়েছিলো।

মাস হিস্টিরিয়া

যখন অনেক মানুষ একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকে, একে অপরের সাথে দিনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কাটায়, একই কাজ সবাই একসাথে মিলে করে কিংবা সবার জীবন যাপনের ধরন এক, তখন পরস্পরের প্রতি তাদের অন্ধ বিশ্বাস জন্মায়। একজন যা করে, অন্যরাও সেটা অনুকরণ করে। মনের অজান্তেই একজনের কাজের প্রতি অন্যজনের মস্তিষ্ক সায় দিয়ে দেয়। কেউ একজন যদি ভূত দেখার দাবি করে, তাহলে অন্যরাও সেটা বিশ্বাস করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যাচাই করতে যায় না। একজনের যদি হ্যালুসিনেশন হয়, তাহলে অন্যদেরও হয়। একজনের যদি হিস্টিরিয়া হয়, তাহলে অন্যদেরও হয়। এই ঘটনাকেই মাস হিস্টিরিয়া বলে।
মাস হিস্টিরিয়া হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত থাকতে হবেঃ
–আক্রান্ত ব্যক্তিদের বয়স কম হতে হবে। কারণ কম বয়সীদের মস্তিষ্ক বেশি চাপ নিতে পারে না। একজনকে অজ্ঞান হতে দেখলে অন্যরাও ভয় পায়। সে তখন চিন্তা করে আমার বন্ধু অজ্ঞান হয়ে গেল, আমার এখন কী হবে?
–আক্রান্তরা মানসিকভাবে কাছাকাছি হতে হবে (স্কুলের বাচ্চারা মানসিকভাবে অনেক ঘনিষ্ঠ থাকে। কলেজ/ভার্সিটির বন্ধুরা এত ঘনিষ্ঠ নয়। একইভাবে পোশাক-কর্মীরা সারাদিন একসাথে কাজ করেন বলে বেশি ঘনিষ্ঠ। অপরদিকে বহুজাতিক কোম্পানির কর্মীরা অফিসের ভিতরে এবং বাইরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে, বিভিন্ন মানুষের সাথে মিশে অনেক কাজ করেন বলে একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া এত বেশি নয়।
–যে স্থানে তারা থাকে, সেটা অস্বাস্থ্যকর হতে হবে (স্বাস্থ্যকর পরিবেশে মনও সুন্দর থাকে। স্কুল/গার্মেন্টসের টয়লেট যদি ঘিঞ্জি, নোংরা হয়, সেখানে ভূতের গুজব উঠতেই পারে। কিন্তু টয়লেট পরিষ্কার হলে কারো মনে সহজে সন্দেহ জাগবে না যে, সেখানে ভূত থাকতে পারে)
–ভিক্টিমকে মানসিকভাবে দুর্বল হতে হবে (সাধারণত মেয়েরা কিংবা আদিবাসীরা বাই ডিফল্ট মানসিকভাবে একটু দুর্বল থাকে। আবার শহরের তুলনায় গ্রামের বাচ্চারা মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকে। তাই তারা সহজে মাস হিস্টিরিয়ার শিকার হয়)।
–কর্মক্ষেত্রে, স্কুলে বিষণ্ণ বা অসুখী পরিবেশ থাকবে।

মাস হিস্টিরিয়া এড়ানোর জন্য কী কী করা যেতে পারে ?

— স্কুলে আনন্দমুখর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। টিচারের বেত খাওয়ার ভয় থাকলে বাচ্চাদের মানসিক অসুস্থতা দেখা দিবেই। ক্লাসের লেখাপড়ার বাইরে খেলাধূলা এবং অন্যান্য কো-কারিকুলার এক্টিভিটিজ বাড়াতে হবে। গণিত অলিম্পিয়াড কিংবা ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার মত ইন্টার স্কুল কম্পিটিশনে বেশি বেশি অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। অনেক মানুষের সাথে ছাত্রছাত্রীদের ভাব আদান প্রদান করা সম্ভব হবে।
— গার্মেন্টস কিংবা অন্যান্য ফ্যাক্টরির ক্ষেত্রে কাজের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। কর্মীদের নিরাপত্তা এবং সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিতে হবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ যদি ১০/১২ ঘণ্টা প্রতিদিন ডিউটি দেয়, সে মানসিকভাবে খুব একটা সুস্থ থাকবে না।
— শিশুশ্রম কিংবা অন্যান্য বেআইনী কার্যক্রম বন্ধ করাও একটা ভাল পদক্ষেপ হতে পারে। এর ফলে কর্মীদের ভিতরে কোনো অপরাধবোধ থাকবে না। শিশু/কিশোর শ্রমিক না থাকলে হিস্টিরিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও অনেক কম হবে, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিশোর কিশোরীরাই মাস হিস্টিরিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয়।
— স্কুল এবং ফ্যাক্টরিতে মাস হিস্টিরিয়া সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে।
আর কখনো যদি এই ধরনের মাস হিস্টিরিয়া হয়েই যায়, তখন কী করতে হবে ?
এই রোগে ওষুধের ভূমিকা খুব সামান্য। বিশ্রাম এবং কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করা হয়। তবে হাসপাতালে না পাঠানো হলে রোগী আতংকিত হয়ে পড়তে পারে এই ভেবে যে, তার সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে না। রোগীকে বুঝাতে হবে, “তোমার সকল প্রকার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, তুমি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে”। আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ মানুষের কাছ থেকে দ্রুত আলাদা করে ফেললে অন্যদের আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ কম থাকে।