প্রথম অধ্যায়ঃ ভাবনায় মহাবিশ্ব
এক অদ্ভুত ও বিষ্ময়কর মহাবিশ্বে আমাদের বাস। এর বয়স, আকার, উন্মত্ততা এবং সৌন্দর্যের গভীরে পৌঁছতে হলে প্রয়োজন অসম্ভব রকম কল্পনা শক্তি। এই বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের মতো মানুষের অবস্থান নগণ্য মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এ জন্যেই আমরা এর সবকিছু জানতে চাই, দেখতে চাই এতে আমাদের অবস্থান কোথায়। কয়েক দশক আগে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী (কারো কারো মতে তিনি ছিলেন বারট্রান্ড রাসেল) জ্যোতির্বিদ্যার ওপরে একটি লেকচার দেন। তিনি এতে বলেন, পৃথিবী কীভাবে সূর্যের চারদিকে ঘুরেছে, সূর্য নিজেই কীভাবে আবার অনেক নক্ষত্রের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে ঘিরে পাক খাচ্ছে ইত্যাদি।
বক্তব্য শেষ হবার পর হলের পেছন থেকে এক বৃদ্ধা মহিলা দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি আমাদের যা বললেন, তার সব বানানো কথা। আসলে পৃথিবী হল থালার মতো চ্যাপ্টা, আর এটি বসে আছে একটি দৈত্যাকার কাছিমের পিঠে।’
বিজ্ঞানীর জ্ঞানগর্ভ ও হাসিমাখা প্রশ্ন, ‘কাছিমটি তাহলে কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে?’
মহিলা জবাব দিলেন, ‘ইয়াং ম্যান, আপনি খুবই চালাক, তবু নিচে কিন্তু আসলে একেরপর এক কাছিমই আছে!’
কাছিমের উপর স্থাপিত মহাবিশ্বের চিত্রটি এখন অনেকের কাছেই হাস্যকর মনে হবে। কিন্তু আমরা খুব ভালো জানি- এমনটা মনে করা ঠিক হবে কি? বিশ্ব সম্পর্কে আপনি যা জানেন – অথবা জানেন বলে মনে করেন তা একটিবারের জন্যে একটু ভুলে যান। এবার তাকিয়ে দেখুন রাতের আকাশের দিকে। ঐসব আলোক বিন্দুকে আপনার কী মনে হচ্ছে? এরা কি ছোট ছোট আগুনের স্ফুলিঙ্গ? এদের সম্পর্কে সত্যিকারের ধারণা করা কঠিন, কেননা এদের প্রকৃত পরিচয়ের সাথে আমাদের দৈনন্দিন কাজ- কর্মের কোনোই মিল নেই। নিয়মিত রাতের আকাশের খোঁজখবর রেখে থাকলে আপনি গোধূলির সময় একটি ক্ষণস্থায়ী আলোকে দিগন্তের উপর ভেসে থাকতে দেখে থাকবেন। এটা আসলে বুধ গ্রহ। কিন্তু এর সাথে আমাদের গ্রহের (পৃথিবী) কোনোই মিল নেই। বুধ গ্রহের এক দিন তার এক বছরের তিন ভাগের দুই ভাগের সমান। দিনের বেলায় সূর্যের উপস্থিতিতে এর তাপমাত্রা ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে, যা রাতের বেলায় নেমে আসে হিমাংকের ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে। তবে বুধ গ্রহ আমাদের গ্রহের চেয়ে আলাদা- এটা বুঝুতে পারার চেয়ে নক্ষত্র যে আলাদা সেটা বোঝা তুলনামূলক সহজ। এক একটি নক্ষত্র এক একটি বিশাল চুল্লি, যা প্রতি সেকেন্ডে বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড পদার্থ পুড়িয়ে এর কেন্দ্রের তাপমাত্রা কোটি ডিগ্রি পর্যন্ত উন্নীত করে।
গ্রহ এবং নক্ষত্রদের প্রকৃত দূরত্ব কল্পনা করাও বেশ কঠিন কাজ। প্রাচীনকালে চীন দেশের মানুষ ভালো করে তারা দেখার জন্য পাথর দিয়ে টাওয়ার বানাত। গ্রহ এবং নক্ষত্রদেরকে এদের প্রকৃত দূরত্বের চেয়ে কাছে মনে করা খুব স্বাভাবিক। অন্তত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা মহাকাশের বিশাল বড়ো দূরত্বের সাথে পরিচিত নই। এই দূরত্বগুলো এত বেশি বড়ো যে এদেরকে আমাদের বহুল পরিচিত ফুট বা মাইল দিয়ে হিসাব করা অর্থহীন। এর পরিবর্তে আমারা ব্যবহার করি আলোকবর্ষ নামক একটি একক, যা আলোর এক বছরে অতিক্রান্ত দূরত্বের সমান। এক সেকেন্ডে একটি আলোকরশ্মি ১, ৮৬, ০০০ মাইল যেতে পারে। অতএব, আলোকবর্ষ এককটি অনেক বড়ো একটি দূরত্ব। সূর্যের পরে আমাদের নিকটতম নক্ষত্র হল প্রক্সিমা সেন্টোরি (অপর নাম আলফা সেন্টোরি সি)। এটি প্রায় ৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই দূরত্বটি এত বড়ো যে বর্তমান সময়ে আমাদের কল্পনাযোগ্য সবেচেয়ে দ্রুতগামী মহাকাশযানে চেপে ওখানে যেতে প্রায় ১০ হাজার বছর সময় লাগবে।
প্রাচীন কালেও মানুষ মহাবিশ্বকে বুঝতে অক্লান্ত চেষ্টা করেছে। কিন্তু তখনো এ সময়ের মতো গণিত ও বিজ্ঞানের এমন অগ্রগতি হয়নি। বর্তমানে আমাদের কাছে আছে উন্নত যন্ত্র- যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে গণিত ও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির জগতে রয়েছে কম্পিউটার ও টেলিস্কোপের মতো যন্ত্র। যন্ত্রগুলোর সাহায্যে বিজ্ঞানীরা মহাকাশের অনেকগুলো তথ্যকে জোড়া দিতে পেরেছেন। কিন্তু মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা ঠিক কী জানি এবং তা কীভাবে জানি? মহাবিশ্বের উৎপত্তি কীভাবে হল? ভবিষ্যতে এর কী হতে যাচ্ছে? মহাবিশ্বের কি কোন শুরু ছিল? যদি থেকেই থাকে তবে তার আগে কী ছিল? সময় আসলে ঠিক কী? এর কি কোন শেষ আছে? আমরা কি অতীতের দিকে যেতে পারি? পদার্থবিদ্যার সাম্প্রতিক অগ্রগতির মাধ্যমে দীর্ঘ দিন জমে থাকা এসব প্রশ্নের মধ্যে অনেকগুলোর জবাব হাতে এসেছে। এক সময় হয়ত এই প্রশ্নগুলোর জবাব পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে ঘোরার মতোই পরিষ্কার হয়ে যাবে- অথবা হয়ত কচ্ছপের টাওয়ারের মত হাস্যকর মনে হবে। এর উত্তর কেবল সময়ই বলতে পারে, তা সময়ের পরিচয় যাই হোক।
কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-২
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণার ক্রমবিকাশ
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সময়েও পৃথিবীকে সমতল ভাবা মানুষ খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যেত। এমনকি আজকের দিনেও এমন কিছু লোক খুঁজে পাওয়া যাবে। তবু আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার শুরু কিন্তু সেই গ্রিকদের আমলেই। খৃস্টের জন্মের প্রায় ৩৪০ বছর আগে এরিস্টটল On the Heavens (মহাকাশ প্রসঙ্গ) নামে একটি বই লিখেন। বইটিতে তিনি থালার মত চ্যাপ্টা পৃথিবীর বদলে গোলক আকৃতির পৃথিবির সপক্ষে কিছু ভালো যুক্তি তুলে ধরেন।
একটি যুক্তি ছিল চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে। এরিস্টটল বুঝতে পেরেছিলেন, পৃথিবী সূর্য ও চাঁদের মাঝে এসে পড়লে চন্দ্রগ্রহণ হয়। এ অবস্থায় চাঁদে পৃথিবীর ছায়া পড়ার কারণে গ্রহণটি ঘটে। এরিস্টটল দেখলেন, পৃথিবীর ছায়া সব সময় গোল হয়ে পড়ে। পৃথিবী যদি চ্যাপ্টা চাকতি না হয়ে গোলকের মতো হয় তবেই কেবল এমনটা সম্ভব। পৃথিবী যদি চাকতির মত সমতল হত, তবে গোল ছায়া শুধু তখনই পড়ত যখন সূর্য চাকতির ঠিক কেন্দ্র বরাবর থাকত। অন্য সময় ছায়া লম্বা হয়ে উপবৃত্তের মত হয়ে যেত। উল্লেখ্য, একটি বৃত্তকে একদিকে টেনে লম্বা করে দিলে যে আকৃতি পাওয়া যায় সেটিই হল উপবৃত্ত।
পৃথিবীর আকৃতি গোলকীয় হবার পক্ষে গ্রিকদের আরেকটি যুক্তি ছিল। পৃথিবী যদি সমতল হত, তবে দূর থেকে আসা কোন জাহাজকে দিগন্তের কাছে একটি ছোট্ট ও সাধারণ বিন্দু হিসেবে দেখা যেত। এরপর ক্রমেই কাছে আসতে থাকলে এর আরো খুঁটিনাটি যেমন পাল, কাঠামো ইত্যাদি দেখা যেত। কিন্তু বাস্তবে এমন হয় না। জাহাজ আসার সময় দিগন্তের দিকে তাকালে আমরা সবার আগে দেখি জাহাজের পাল। এর আরো অনেকক্ষণ পরে চোখে পড়ে এর মূল কাঠামো। জাহাজের লম্বা মাস্তুল এর মূল কাঠামো থেকে অনেক উঁচুতে থাকায় সবার আগে একে দিগন্তে উঁকি দিতে দেখা যায়- এ থেকে প্রমাণ হয়, পৃথিবীর আকৃতি গোলকের মতো (সমতল নয়)।

দিগন্ত থেকে আসা জাহাজের ছবি: পৃথিবীর আকৃতি গোলকীয় হবার কারণে দিগন্ত থেকে আসা জাহাজের পাল ও মাস্তুল এর মূল কাঠামোর আগে চোখে পড়ে।
এরিস্টটল মনে করতেন, পৃথিবী স্থির এবং সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ এবং নক্ষত্ররা পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার পথে ঘুরছে। তাঁর এই বিশ্বাসের কারণ ছিল একটি অতিদ্রীয় যুক্তি যে পৃথিবীর অবস্থান মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এবং বৃত্তাকার গতিই হচ্ছে সবচেয়ে নিখুঁত। ২য় শতাব্দীতে আরেক গ্রিক পণ্ডিত টলেমি এই ধারণাকে একটি পরিপূর্ণ মডেলে রূপ দান করেন। তাঁর গবেষণা সম্পর্কে তিনি আবেগসিক্ত ভাষায় বলেন, ‘বৃত্তাকার পথে চলনশীল নক্ষত্রদের গতির কথা ভাবতে থাকলে আমার মনেই হয় না আমি এই পৃথিবীতে আছি’।
টলেমির মডেলে আটটি ঘূর্ণায়মান গোলক পৃথিবীকে বেষ্টন করেছিল। এর প্রতিটি আগেরটি চেয়ে ক্রমান্বয়ে বড় ছিল, অনেকটা রুশদের নেস্টিং ডলের২ মতো। এই গোলকদের কেন্দ্রে ছিল পৃথিবীর অবস্থান। সবচেয়ে বাইরের গোলকের পরে কী আছে তা কখনোই স্পষ্ট করে বলা হয়নি, তবে একে মানুষের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের মধ্যেও গণ্য করা হয়নি। ফলে, বাইরের গোলকটিই ছিল মহাবিশ্বের সীমানা বা ধারক। এই গোলকের মধ্যে নক্ষত্ররা স্থিরভাবে বসেছিল, ফলে গোলকটি আবর্তন করলেও নক্ষত্রদের পারস্পরিক অবস্থান একই থাকত এবং এরা দলবেঁধে একই সাথে পুরো আকাশজুড়ে আবর্তন করত।
গ্রহদের গোলক ছিল ভেতরের দিকে। এরা এদের নিজস্ব গোলকের মধ্যে নক্ষত্রদের মত স্থির ছিল না, বরং গোলকের মধ্যেই এরা আবার ছোট ছোট বৃত্তাকার পথে চলত। এই বৃত্তাকার পথকে বলা হত মন্দবৃত্ত (Epicycle)। গ্রহরা গোলকের সাথে ঘূর্ণনের পাশাপাশি নিজেরাও গোলকের মধ্যে চলাচল করছে বলে পৃথিবী থেকে দেখতে এদের চলাচলের পথকে জটিল দেখাচ্ছে। এভাবে টলেমি আকাশে গ্রহদের দৃশ্যমান কক্ষপথকে প্যাঁচানো দেখা যাচ্ছে কেন তার একটি ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হলেন।
টলেমির মডেলের সাহায্যে আকাশের বস্তুদের অবস্থানের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল। কিন্তু এই অবস্থানগুলোর সঠিক পূর্বাভাস দিতে গিয়ে মেনে নিতে হচ্ছিল যে চাঁদের কক্ষপথ একে কোনো কোনো সময় অন্য সময়ের চেয়ে পৃথিবীর দ্বিগুণ কাছে নিয়ে আসে। এটা সঠিক হলে কোনো কোনো সময় চাঁদকে অন্য সময়ের দ্বিগুণ বড় দেখানোর কথা ছিল। টলেমি তাঁর মডেলের এই খুঁত সম্পর্কে জানতেন। তবুও তাঁর মডেলটি সাধারণভাবে স্বীকৃত ছিল, যদিও সবাই তা মেনে নেয়নি। ধর্মগ্রন্তের সাথে মিলে যাওয়ায় খ্রিষ্টানদের গির্জায়ও এই মডেলটি অভ্যর্থনা পায়। গির্জার জন্যে এই মডেলের সুবিধাটি ছিল যে এতে স্থির গোলকদের বাইরে স্বর্গ ও নরকের জন্যে যথেষ্ট জায়গা উপস্থিত ছিল।

টলেমির মডেলে পৃথিবীর অবস্থান ছিল মহাবিশ্বের কেন্দ্রে, যার বাইরের আটটি গোলক মহাকাশের সবগুলো বস্তুকে ধারণ করে রেখেছিল।
১৬০৯ সালে গ্যালিলিও কিছু দিন আগে আবিষ্কৃত টেলিস্কোপের সাহায্যে রাতের আকাশ দেখা শুরু করেন। তিনি বৃহস্পতির (Jupiter) দিকে তাকিয়ে দেখেন, এর চারপাশে কিছু ছোট ছোট উপগ্রহ একে প্রদক্ষিণ করছে। এর অর্থ হচ্ছে এরিস্টটল ও টলেমিদের চিন্তা সঠিক নয়- সবাইকে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে এমন কোনো কথা নেই। একই সময়ে কেপলার কোপার্নিকাসের তত্ত্বটি উন্নত করেন। নতুন তত্ত্বের বক্তব্য ছিল, গ্রহরা বৃত্তাকার পথে নয়, চলছে উপবৃত্তাকার পথে। এই পরিবর্তনের ফলে তত্ত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ মিলে গেল। এ ছিল টলেমির মডেলের কফিনে শেষ পেরেক।
উপবৃত্তাকার কক্ষপথের মাধ্যমে কোপার্নিকাসের মডেল উন্নত হলেও কেপলার নিজে একে চূড়ান্ত মনে করতেন না। এর কারণ ছিল প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর মনে আসন গেঁড়ে থাকা এমন কিছু ধারণা, যেগুলো তাঁর কাছে পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানের চেয়ে প্রভাবশালী ছিল। এরিস্টটলের মতো তিনিও মনে করতেন উপবৃত্তের চেয়ে বৃত্তরা কম সুন্দর। তাঁর মতে এমন ত্রুটিপূর্ণ পথে গ্রহরা চলবে- এমন বিশ্রী কথা চূড়ান্ত সত্য হতে পারে না। আরেকটি কারণেও তিনি এই ধারণাটি ঠিক মনে করতেন না। তাঁর মতে গ্রহরা সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সূর্যের চৌম্বক বলের কারণে, যার ফলাফল উপবৃত্তকার পথের সাথে মেলে না। যদিও তিনি ভুল করে গ্রহদের কক্ষপথের জন্যে চৌম্বক বলকে দায়ী করেছেন, তবুও আমরা তাঁকে এর পেছনে কোন বলের উপস্থিতি থাকার বিষয়টি বুঝতে পারর জন্যে কৃতিত্ব দিতে পারি। এর আরো অনেক পরে, ১৬৮৭ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন সূর্যের চারদিকে গ্রহদের কক্ষপথের সঠিক ব্যখ্যা দেন। এটি প্রকাশিত হয় ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা (Philosophiae Naturalis Principia Mathematica) প্রবন্ধে। সম্ভবত এটি পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে গ্রুত্বপূর্ণ একক অবদান।
প্রিন্সিপিয়াতে নিউটনের একটি সূত্রের বক্তব্য ছিল, কোনো বল কাজ করার আগ পর্যন্ত সকল স্থির বস্তু স্থিরই থাকবে। এতে তিনি আরো দেখালেন যে বলের প্রভাবে কীভাবে একটি বস্তু চলতে শুরু করে বা গতির পরিবর্তন করে। তাহলে গ্রহরা সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার পথে চলে কেন? নিউটনের মতে এর পেছনে দায়ী হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বল। তাঁর মতে, এই একই বলের কারণে উপরে নিক্ষিপ্ত বস্তু ভূমিতে ফিরে আসে। তিনি এই বলের নাম দিলেন মহাকর্ষ বা গ্র্যাভিটি (Grvaity)। নিউটনের আগে gravity শব্দটি মেজাজের রুক্ষতা বা ওজোনের বৈশিষ্ট্য হিসবেই শুধু ব্যবহৃত হত।
এছাড়াও মহাকর্ষ বা অন্য কোনো বলের প্রভাবে বস্তুর কী প্রতিক্রিয়া হয় তাও তিনি গাণিতিকভাবে বের করে ফেললেন। সমাধান করলেন উদ্ভূত সমীকরণগুলো। এভাবে তিনি দেখাতে সক্ষম হলেন যে সূর্যের মহাকর্ষের ফলেই পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহরা উপবৃত্তাকার পথে চলে। এটি মিলে গেল কেপলারের বক্তব্যের সাথে। নিউটনের মতে এই সূত্র মহাবিশ্বের সব কিছুর জন্যেই প্রযোজ্য, তা চাই পড়ন্ত আপেল হোক অথবা গ্রহ বা নক্ষত্রই হোক। ইতিহাসে এই প্রথম কেউ গ্রহদের গতির এমন ব্যাখ্যা দিলেন যা পৃথিবীর গতিও নিয়ন্ত্রণ করে। আধুনিক পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার এখানেই পথ চলা শুরু।
টলেমির গোলকীয় ধারণা বাদ দিলে মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক কোন সীমানা (সর্ববহিঃস্থ গোলক) আছে বলে মনে করার আর কোনো কারণ বাকি ছিল না। অন্য দিকে যেহেতু দেখা যাচ্ছে যে রাতের আকাশের নক্ষত্ররা শুধু পৃথিবীর আবর্তনের৩ কারণেই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই বোঝা গেল, এরাও সূর্যের মতোই বস্তু কিন্তু অনেক দূরে অবস্থিত। আমরা শুধু পৃথিবীকেই মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরাইনি, বরং সূর্য এমনকি সৌরজগতও যে মহাবিশ্বের বিশেষ কোনো অংশ হতে পারে- এমন ধারণাও বাদ দিয়েছি। মতের এই পরিবর্তনের সাথে চিন্তার জগতেও বড় একটি পরিবর্তন সাধিত হয়। মহাবিশ্ব সম্পর্কে আধুনিক জ্ঞানেরও সূচনা এখানেই।
নোটঃ
১। পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তনের কারণে রাতের আকাশের তারাদেরকে প্রতি রাতেই পূর্ব থেকে পশ্চিমে যেতে দেখা যায়। আবার সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণের কারণে প্রতি রাতেই কোন তারাকে আগের রাতের চেয়ে একটু পশ্চিমে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে কোনো তারাকে আগের দিনের চেয়ে প্রায় চার মিনিট আগে একই জায়গায় দেখা যায়। এভাবে চলতে চলতে এক বছর পর একটি তারাকে আবার একই সময়ে আগের জায়গায় দেখা যায়। কিন্তু গ্রহরা এরকম নির্দিষ্ট কোন চক্র মেনে চলে না। এক একটি রাত আসতে আসতে এদেরকে কখনো পশিমে আবার কখনো পূবে সরতে দেখা যায়। – অনুবাদক
২। অনেক গুলো ছোট- বড়ো পুতুলকে সাইজ অনুসারে একটিকে ক্রমান্বয়ে আরেকটির ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা হলে একে নেস্টিং ডল বলে। – অনুবাদক।
৩। পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করায় রাতের আকাশের তারাদেরকে পশ্চিমে যাচ্ছে বলে মনে হয়। নক্ষত্রদের আরো নানান রকম গতি থাকলেও এরা বহু দূরে থাকায় সেসব গতির ফলাফল আমাদের চোখে কয়েকশো বছরেও ধরা পড়ে না। – অনুবাদক
কালের সংক্ষিপ্ততর ইতিহাস (A Briefer History of Time): পর্ব-৩
তৃতীয় অধ্যায়ঃ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য
মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট্য এবং এর কোনো শুরু আছে কি নেই- এসব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আগে জানা দরকার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কাকে বলে। সোজা কথায় বললে, থিওরি বা তত্ত্ব হচ্ছে মহাবিশ্বের একটি মডেল বা নমুনা, অথবা সেই নমুনার কোন সীমিত অংশবিশেষ এবং এমন এক গুচ্ছ নিয়ম বা সূত্র, যে সূত্রগুলো পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত তথ্যকে মডেলের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে পারবে। এই তত্ত্ব থাকে আমাদের মস্তিষ্কে এবং এর অন্য রকম কোনো বাস্তবতা নেই (বাস্তবতার সংজ্ঞা যা হয় হোক)।একটি তত্ত্ব কে ভালো বলা হয় যদি এর মধ্যে দুটো গুণ পাওয়া যায়। এক, অনেকগুলো পর্যবেক্ষণকে এটি অল্প কথায় সঠিকভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারবে। পাশাপাশি, একে ভবিষ্যত পর্যবেক্ষণের ফলাফল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস [১] দিতে হবে। এরিস্টটল এমপেডোক্লেসের এই তত্ত্ব মেনে নিয়েছিলেন যে জগতের সবকিছু মাটি,বায়ু,আগুন ও পানি- এই চারটি উপাদান দিয়ে তৈরি। তত্ত্বটি যথেষ্ট সরল ছিল, কিন্তু এটি কোনো সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দিতে পারেনি। অন্য দিকে, নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বটি উপস্থাপন করা হয় আরো সরল ভাবে। এই তত্ত্বে বস্তুরা একে অপরকে তাদের ভরের সমানুপাতিক ও তাদের মধ্যবর্তী দূররত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক বলে আকর্ষণ করে। তত্ত্বটি দেখতে সরল হলেও এটি অনেক নিখুঁতভাবে সূর্য,চন্দ্র এবং গ্রহদের গতির পূর্বাভাস দিতে পারে।
যে কোনো ভৌত তত্ত্বই (physical theory)এই অর্থে অস্থায়ী যে এটি শুধুই একটি অনুমান।একে কখোনই পুরোপুরি প্রমাণ করা যাবে না। পরীক্ষার ফলাফলের সাথে হাজারবার মিলে গেলেও আপনি কখোনই নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না এটি পরের বার বিপরীত ফলাফল দেবে না। উল্টো দিকে একটি তত্ত্বকে ভুল বলার জন্যে এর বিপক্ষে একটি মাত্র পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট। বিজ্ঞানের দার্শনিক কার্ল পপার যেমন জোর দিয়ে বলেছেন,একটি ভালো তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,এতে এমন অনেকগুলো পূর্বাভাস থাকবে যাদেরকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ভুল বা মিথ্যা প্রমাণ করার সুযোগ থাকবে। যখনি নতুন কোন পরীক্ষার সাথে এর পূর্বাভাস মিলে যাবে, তত্ত্বটি বেঁচে যাবে। কিন্তু কখনো নতুন কোনো পর্যবেক্ষণ এর সাথে না মিললে আমাদেরকে তত্ত্বটিকে পরিত্যাগ বা সংস্কার করতে হবে।
এটাই হচ্ছে সাধারণ নীতি। কিন্তু যিনি পরীক্ষা চালিয়েছেন তার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্নতো তোলা যেতেই পারে।
বাস্তবে দেখা যায় নতুন তত্ত্ব আসলে আগের তত্ত্বেরই পরিবর্ধন মাত্র। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বুধ গ্রহের গতির কথা। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের পূর্বাভাসের সাথে এর গতির সামান্য ভিন্নতা দেখা দেয়। আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব নিউটনের তত্ত্বের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন অনুমান প্রদান করে,যা পর্যবেক্ষণের সাথে ঠিক ঠিক মিলে যায়। নিউটনের তত্ত্বের জায়গায় নতুন এই তত্ত্বের জায়গা করে নিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবুও এখনও আমরা বাস্তবে নিউটনের তত্ত্বই বেশি ব্যবহার করি, কারণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দুটো থিওরির পার্থক্য সামান্য। নিউটনের থিওরির আরেকটি সুবিধা হল এটি আইনস্টাইনের সূত্রের চেয়ে অনেক সরল।
বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি তত্ত্ব প্রদান করা, যা সমগ্র মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে পারবে। অবশ্য অধিকাংশ বিজ্ঞানীই বাস্তবে সমস্যাটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে কাজ করেন। প্রথমত,কিছু সূত্র আমাদেরকে বলছে যে সময়ের সাথে সাথে মহাবিশ্বের কীরূপ পরিবর্তন ঘটছে। (আমরা যদি কোনো একটি সময়ে মহাবিশ্বের অবস্থা জানি, এই ভৌত সূত্রগুলো আমাদের বলবে পরবর্তী কোনো সময়ে মহাবিশ্ব কী অবস্থায় থাকবে।) দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল মহাবিশ্বের আদি অবস্থা নিয়ে। কেউ কেউ মনে করেন, বিজ্ঞানের উচিত শুধু প্রথম অংশটি নিয়ে কাজ করা। তাদের মতে,মহাবিশ্বের আদি অবস্থার বিষয়টি অধিবিদ্যা [২] বা ধর্মের আলোচ্য বিষয়। তাদের মতে,সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মহাবিশ্বের সূচনা নিজের যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই করেছেন [৩]। তা হলেও হতেও পারে,কিন্তু সেক্ষেত্রে ঈশ্বর মহাবিশ্বকে কোনো অনির্দিষ্ট প্রক্রিয়াতেই বিবর্তিত হতে দিতেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তিনি একে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন করেছেন,যা কিছু সূত্র মেনে চলছে। কাজেই মহাবিশ্বের আদি অবস্থাও কিছু নিয়ম মেনে চলছিল মনে করাটাই যুক্তির দাবি।
মহাবিশ্বের সবকিছুকে একই তত্ত্বে গেঁথে ফেলা কঠিক একটি কাজ। ফলে আমরা একে ভেঙে অনেকগুলো আংশিক তত্ত্ব তৈরি করি। এই আংশিক তত্ত্বদের প্রতিটি কিছু নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা ও পূর্বাভাস দিতে পারে। এর আওতার বাইরের বিষয়গুলো সম্পর্কে এটি নিরব থাকে অথবা তাদেরকে কিছু সংখ্যা দ্বারা প্রকাশ করে। খুব সম্ভব, এটি একটি ভুল পদ্ধতি। যদি মৌলিক জায়গাটিতে মহাবিশ্বের সবকিছু অন্য সব কিছুর উপর নির্ভরশীল হয়,তাহলে এদেরকে আংশিকভাবে মূল্যায়ন করে পূর্ণাংগ সমাধানে পৌঁছা সম্ভব নাও হতে পারে। তবুও, আমরা অতীতে কিন্তু এটাই করে এসেছি। উদাহরণ হিসেবে আবারও বলব নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের কথা। এটি বলছে, দুটো বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বল বস্তুদ্বয়ের একটিমাত্র নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের উপর (ভর)নির্ভরশীল [৪]।বস্তু কী দিয়ে তৈরি তার উপর এই বল নির্ভর করে না।কাজেই গ্রহদের কক্ষপথের হিসাব বের করার জন্য এদের এবং সূর্যের গঠন ও উপাদানের জন্যে আমাদের আলাদা কোন তত্ত্বের প্রয়োজন নেই।
বর্তমানে মহাবিশ্বের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানীরা দুটি মৌলিক আংশিক তত্ত্ব কাজে লাগাচ্ছেন। এরা হল জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এই দুটি তত্ত্ব বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বুদ্ধির জগতের এক বিরাট অর্জন। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব মহাকর্ষ বল ও মহাবিশ্বের বড় দৈর্ঘ্যের কাঠামোকে (Large scale structure)ব্যাখ্যা করে। মাত্র কয়েক মাইল থেকে শুরু করে অন্তত এক হাজার কোটি কোটি কোটি (১ এর পরে ২৪ টি শুন্য) মাইল তথা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের আকারের সমপরিমাণ অংশ এই তত্ত্বের আওতায় আছে। অন্য দিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স কাজ করে এক ইঞ্চির এক লক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগের মতো অত্যন্ত ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যের জগতে। কিন্তু এই দুটি তত্ত্ব একে অপরের বিরোধী- এদের দুটোই যে ঠিক হবে সেটি সম্ভব নয়। বর্তমানে পদার্থবিদ্যার একটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নতুন একটি তত্ত্ব প্রদান করা, যা এই দুটো তত্ত্বকে একীভূত করে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি নামে কমন একটি তত্ত্বের জন্ম দেবে।এই তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা এই বইয়েরও একটি অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আমরা এখনও এমন তত্ত্ব বের করতে পারিনি। হতে পারে, আমরা এখনও এর থেকে বহু দূরে আছি। কিন্তু এই তত্ত্বের কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত তার অনেকগুলোই আমরা ইতোমধ্যে জেনে গেছি। পরের অধ্যায়গুলোতে আমরা দেখবো কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি নামক তত্ত্বটিকে কী কী পূর্বাভাস দিতে পারতে হবে তা সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যেই অনেক কিছু জানি।

এখন আমরা যদি বিশ্বাস করি যে মহাবিশ্ব এলোমেলোভাবে নয় বরং কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলছে, তাহলে এই আংশিক সূত্রগুলোকে অবশ্যই একটি পূর্ণাংগ একীভূত তত্ত্বে রূপদান করতে হবে, যা ব্যাখ্যা দেবে মহাবিশ্বের সব কিছুর। কিন্তু এরকম একটি একীভূত তত্ত্বের সন্ধান করতে গেলে একটি সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়। উপরে উল্লিখিত বিজ্ঞানের এই চিন্তা- ভাবনাগুলোতে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে আমরা বুদ্ধিমান জীব, যারা স্বাধীনভাবে মহাবিশ্বকে দেখছি ও তা থেকে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।যদি এটা সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আমরা উন্নতি করতে করতে একদিন মহাবিশ্বের কার্যকরী নিয়মগুলোর কাছাকাছি পৌঁছতে পারব বলে মনে করা খুবই স্বাভাবিক। অন্য দিকে, এমন কোন পূর্ণাংগ একীভূত সূত্র যদি থাকেই তবে সেটি নির্ধারণ করবে আমাদের নিজেদের কাজকর্মও [৫]।তার মানে তত্ত্ব নিজেই এর অনুসন্ধানের ফলাফল নির্ধারণ করবে!তাহলে সেই তত্ত্ব কেন এটাই নির্ধারণ করবে যে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছবো? সেটাতো আমাদের জন্যে এটাও নির্ধারণ করে রাখতে পারে যে আমরা ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছব, তাই না? অথবা এমনও হতে পারে, এটি নির্ধারণ করে রাখবে যে আমরা কোন সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে পারবো না!
এই সমস্যার জবাব দেওয়ার জন্যে আমাদের মাথায় ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের (Natural selection) নীতি ছাড়া আর কিছু আসছে না। এই নীতি অনুসারে,স্ব-প্রজননে সক্ষম প্রাণীদের নিজেদের মধ্যে জিনগত উপাদান ও বেড়ে ওঠার মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকবে। এই পার্থক্যের কারণে এদের কেউ কেউ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ও সেই অনুসারে কাজ করতে অন্যদের চেয়ে বেশি দক্ষ হয়ে ওঠবে।অন্যদের চেয়ে এদের টিকে থাকা ও সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা হবে বেশি। ফলে এদের আচরণ ও চিন্তাই হবে প্রভাবশালী। অতীতে এটাই সত্য হয়ে এসেছে এবং এই বুদ্ধিও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার টিকে থাকার ক্ষেত্রে একটি সুবিধা প্রদান করেছে। নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে এটাই এক্ষেত্রেও হচ্ছে। আমাদের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো আমাদের ধ্বংসের কারণও হয়ে যেতে পারে। আর যদি তা নাও হয়,একটি পূর্ণাংগ একীভূত তত্ত্ব হয়ত আমাদের টিকে থাকার সম্ভাবনায় খুব বেশি পরিবর্তন আনবে না। অবশ্য মহাবিশ্ব যদি একটি নিয়ম মেনে তৈরি হয়ে থাকে তাহলে আমরা আশা করতে পারি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাপ্ত আমাদের বুদ্ধি পূর্ণাংগ একীভূত তত্ত্ব অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও আমাদের সহায় হবে, যাতে আমরা ভুল সিদ্ধান্তের দিকে চলে না যাই।
অতিরিক্ত চরম কিছু অবস্থার কথা বাদ দিলে আমাদের বর্তমান আংশিক তত্ত্বগুলো সব ক্ষেত্রেই পূর্বাভাস দিতে সক্ষম।এ কারণে বাস্তব জগতের কথা ভাবলে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত তত্ত্বের সন্ধান করাকে অযৌক্তিক মনে হয়। (উল্লেখ্য যে, একই রকম যুক্তি আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিপক্ষেও তোলা যেত, কিন্তু এই তত্ত্বগুলো আমাদের জন্যে নিউক্লিয়ার শক্তি ও মাক্রোইলেকট্রনিক্স বিপ্লব সম্ভব করেছে)কাজেই, একীভূত তত্ত্ব মানব প্রজাতিকে টিকে থাকার ব্যাপারে সাহায্য করবে- এমনটি বলা যাচ্ছে না।এটি হয়ত আমাদের লাইফ স্টাইলে কোন প্রভাব ফেলবে না।কিন্তু সভ্যতার শুরু থেকেই দেখা গেছে,মানুষ বিভিন্ন ঘটনাকে সম্পর্কহীন ও ব্যাখ্যাতীত মনে করে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। আমরা জগতের অন্তর্নিহিত রহস্য জানার জন্যে অধীর থেকেছি। আজও আমরা জানতে উৎসুক, আমরা কেন এখানে আছি এবং কোথেকেইবা এসেছি। গভীর জ্ঞান পিপাসাই আমাদের অবিরত অনুসন্ধান চালিয়ে যাবার পেছনে একটি যৌক্তিক কারণ। আমরা যে মহাবিশ্বে বাস করি তার একটি সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়ার চেয়ে ছোট নয় আমাদের উদ্দেশ্য।
নোটঃ
(অনুবাদকের যোগ করা)
১। যেমন আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব। ১০০ বছর আগে এর মহাকর্ষ তরঙ্গের পূর্বাভাস ২০১৬ এসে প্রমাণিত হয়। ফলে এটি ভালো তত্ত্ব হিসেবে আরো জোরালো স্বীকৃতি লাভ করে।
২। অধিবিদ্যা (Metaphysics) হল দর্শনের একটি শাখা। অন্য অনেক কিছুর মতো এরও জনক এরিস্টটল। বিশ্বের অস্তিত্ব, আমাদের অস্তিত্ব, সত্যের ধারণা, বস্তুর গুণাবলী, সময়, স্থান, সম্ভাবনা ইত্যাদি এর আলোচ্য বিষয়।
৩। অর্থ্যাৎ,তাদের মতে নির্দিষ্ট কোন সূত্র প্রয়োগ করে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করা হয়নি, তাই সেই আদি অবস্থার ব্যাখ্যা দেবার মত কোনো নির্দিষ্ট সূত্রের ব্যাখ্যা খোঁজা অনর্থক।
৪। মহাকর্ষ বল বস্তুদের দূরত্বের উপরও নির্ভরশীল- এটা ঠিক, কিন্তু দূরত্বতো আর বস্তুর নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট্য নয়।
৫। কারণ আমরাওতো মহাবিশ্বেরই একটি অংশ।
অনুবাদকের পরিচিতি:

আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ। পাই জিরো টু ইনফিনিটির মাধ্যমে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখির শুরু। বর্তমানে লিখছেন ও কাজ করছেন প্রথম আলো পরিবারের মাসিক বিজ্ঞান ম্যাগাজিন বিজ্ঞান চিন্তায়।পাশাপাশি নিয়মিত লিখছেন জিরো টু ইনিফিনিটি , ব্যাপন ও অনলাইন বিজ্ঞান পোর্টাল বিজ্ঞান পত্রিকায়। বাংলায় জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জনপ্রিয়করণ ও সহজে উপস্থাপন করার জন্যে তৈরি করেছেন অনলাইন পোর্টাল বিশ্ব ডট কম (www.bishwo.com)।
প্রিয় শখঃ জ্ঞানার্জন (বিশেষ করে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান) ও রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ।
পড়াশোনাঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ।
ফেসবুকঃ Facebook.com/mahmud.sbi
পৈত্রিক নিবাসঃ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ঝাউডগী গ্রাম।
প্রিয় শখঃ জ্ঞানার্জন (বিশেষ করে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান) ও রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ।
পড়াশোনাঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ।
ফেসবুকঃ Facebook.com/mahmud.sbi
পৈত্রিক নিবাসঃ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ঝাউডগী গ্রাম।